১১. বায়তুল মোকাদ্দাস

১১. বায়তুল মোকাদ্দাস 

হিজাজের মক্কার নতুন নবী মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ ৬১০ সালে যখন তার প্রথম ওহি লাভ করেন, তখন বিশ্বাস করেননি যে তিনি একটি নতুন বিশ্ব ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন। ওই বছরই রাজা দ্বিতীয় খসরু বায়েজান্টাইন এলাকা আক্রমণ করেছিলেন। সততার জন্য বিখ্যাত মক্কার বণিক মুহাম্মদ (সা.) নগরীর আধ্যাত্মিক পঙ্কিলতা নিয়ে উদ্বেগে ছিলেন। মক্কা তখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বস্তুগত সমৃদ্ধি ভোগ করছিল। কিন্তু এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে পুরনো অনেক গোত্রীয় মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পুরনো আমলের রীতিনীতির আলোকে সমাজের দুর্বলতর সদস্যদের পরিচর্যা করার বদলে লোকজন তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধিতে মনোযোগী হয়ে পড়েছিল। অনেকে পুরনো পৌত্তলিকতার ব্যাপারে অস্পষ্টভাবে অসন্তুষ্ট ছিল। তখন তারা আধুনিক বিশ্বে প্রবেশ করতে থাকার প্রেক্ষাপটে ওই পৌত্তলিকতা তখন আর পর্যাপ্ত বিবেচিত হচ্ছিল না। ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হতো আরব দেবমণ্ডলের সর্বোচ্চ ঈশ্বর ছিলেন আল্লাহ, এই নামের অর্থ স্রেফ ‘ঈশ্বর’, বস্তুত ইহুদি ও খ্রিস্টানদের উপাস্য দেবতা। অবশ্য আরবরা যেসব ইহুদি ও খ্রিস্টানের সংস্পর্শে এসেছিল, তারা তাদেরকে প্রায়ই কটাক্ষ করত। কারণ ঈশ্বর তাদের কাছে তাদের নিজস্ব কোনো ওহি বা নবী পাঠাননি। 

এসব চিরকালের মতো বদলে গেল ৬১০ সালের রমজান মাসে। এক ঐশী উপস্থিতি ও তার ঠোঁট থেকে ঐশী উদ্দীপ্ত গ্রন্থের শব্দ বের হতে দেখে সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছিলেন মুহাম্মদ (সা.)। পরের ২২ বছর ধরে মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর কাছ থেকে অব্যাহতভাবে ওহি পেতে থাকলেন। পরে তার অনুসারীরা এসব ওহি কোরআন নামে পরিচিত আরবি পাণ্ডুলিপি হিসেবে সঙ্কলন করেন। অবশেষে ঈশ্বর আরবদের কাছে তাদের নিজস্ব ভাষাতে কথা বললেন, তাদেরকে সত্যিকারের বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সামিল করলেন। অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.) তার ওহিকে নতুন কিছু বিবেচনা করেননি। তার কাছে যে ওহি নাজিল হয়েছে তা আসলে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের উপাস্য এক ঈশ্বরের পুরনো ধর্ম। এটি মক্কার লোকজনকে ঈশ্বরের কাছে তাদের পুরনো জীবন নিঃশর্ত সমর্পণের (ইসলাম) আহ্বান জানায়। তারা আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবনযাপন করলে ন্যায়সঙ্গত ও পরিচ্ছন্ন সমাজ নির্মাণ করে তারা সমৃদ্ধ হবে, অস্তিত্বের জন্য মৌলিক বিবেচিত ঐশী বিধানের আলোকে সম্প্রীতিতে থাকবে। 

অর্থাৎ ইসলাম অচেনা কোনো কিছুর কাছে বশ্যতা স্বীকারের বিষয় ছিল না। কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, এটি ব্যাপকভাবে সহজাত কাজ। কিভাবে জীবনযাপন করা উচিত, তা জানানোর জন্য ঈশ্বর দুনিয়ার বুকে থাকা সব লোকের কাছে নবী ও রাসুল পাঠিয়েছেন। এই ঐশী নির্দেশনার কাছে আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমেই কেবল লোকজন তাদের মানব সম্ভাবনা পূরণ করতে পারে। ঈশ্বরের প্রতি বিদ্রোহ (কুফুর) করা হবে অস্বাভাবিক, অকৃতজ্ঞ ও ন্যায়ভ্রষ্টকাজ। কারণ এটি হবে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। এটি কেবল ব্যক্তি ও সমাজজীবনে বিশৃঙ্খলা ও বিঘ্নতা সৃষ্টি করতে পারে। অন্য দিকে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করা মুসলিম তার জীবনকে সম্প্রীতি, উদ্দেশ্যপূর্ণ ও নির্দেশনাপূর্ণ দেখতে পাবে। কারণ সবকিছু যেভাবে চলছে, সেও সে অনুযায়ী চলছে। অর্থাৎ সৃষ্টির শুরুতে আল্লাহ যখন নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করেছিলেন, সেই নিখুঁত অবস্থায় ফেরে মুসলিমরা। 

অর্থাৎ ইসলামের সামগ্রিকতাকে বিবেচনা করা যেতে পারে সম্পূর্ণতাকে অনুসন্ধান করার তথা মানুষের হারানো বেহেশতে ফিরে যাওয়া প্রয়াস হিসেবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে পবিত্র কোরআন বা এর নবী সম্পর্কে উদ্ভট বা পলায়নপর প্রবৃত্তিপূর্ণ কিছু নেই। মুহাম্মদ (সা.) কেবল আধ্যাত্মিক প্রতিভাধরই ছিলেন না, তার রাজনৈতিক মেধাও ছিল তীক্ষ্ণ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ খুবই স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। ব্যক্তিগত সম্পদ পঞ্জীভূত করা অন্যায়, সম্পদ সবার সাথে ভাগাভাগি করা ভালো কাজ। প্রথম ধর্মীয় কর্তব্য হলো এমন এক সমাজ সৃষ্টি করা যেখানে গরিব ও দুর্বলেরা সম্মানজনক আচরণ পাবে। হিব্রু নবীদের মতো মুহাম্মদ (সা.) বাস্তব সহানুভূতির প্রধান কর্তব্যের দিকে নজর দিয়েছেন : গরিব, এতিম, বিধবা, নির্যাতিতদের পরিচর্যা করা মুসলিমদের মুখ্য দায়িত্ব। পবিত্র কোরআন এক গুচ্ছ জটিল ধর্মীয় মতাবাদের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অনুগত হতে বলে না। বস্তুত, কেউ কোনোভাবেই প্রমাণ করতে পারবে না, এমন ধর্মতাত্ত্বিক কল্পনার দিকে পবিত্র কোরআন একেবারেই সময় ক্ষেপণ করেনি। অন্য দিকে ইহুদি ধর্মে প্রগাঢ় নিষ্ঠার চেয়ে নৈতিক নির্দেশনার মধ্যে ঈশ্বরের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। 

পবিত্র কোরআনের বার্তা ওই সময়েই (মনে করা হয়ে থাকে) মক্কার সাথে প্রাসঙ্গিক ছিল। পুঁজিবাদী বিপ্লবের অনিবার্য পরিণতিতে তখন মুহাম্মদের (সা.) কোরাইশ গোত্রের সদস্যরা সম্পদের জন্য অনেক বেশি নাজুক হয়ে পড়ে গিয়েছিল। পবিত্র কোরআনের প্রতি সাড়া দেওয়া প্রথম সময়ের অনেকে ছিলেন ক্রীতদাস, নারী ও অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেণির লোক, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত গরিব ও কম সফল গোত্রগুলোর সদস্য। মক্কার এস্টাবলিশমেন্টের অবশ্য বিদ্যমান অবস্থা পরিবর্তন করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। মুহাম্মদ (সা.) যখন ঐতিহ্যবাহী দেবতাদের পূজা করতে অস্বীকার করে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে নির্দেশ দিলেন, তখন ওই সমাজের সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তাদের কাছে এটিকে তাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও আরবের প্রাচীন পবিত্রতা থেকে বিচ্যুতি বিবেচিত হয়েছিল। মক্কার অভিজাতেরা ছোট মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন চালালে ৬২২ সালে তারা মুহাম্মদ (সা.) মক্কা ত্যাগ করে প্রায় ৭০টি পরিবার নিয়ে প্রায় ২৫০ মাইল উত্তরে ইয়াসরিবে চলে যেতে বাধ্য হন। এই হিজরত (অভিবাসন) মুসলিম সাল গণনার সূচনা করে। কারণ এই পর্যায়ে মুহাম্মদ (সা.) তার আদর্শ পুরোপুরি বাস্তবে প্রয়োগ করতে ও প্রথম উম্মাহ (সমাজ) গঠন করতে সক্ষম হন। এই সম্প্রদায়ের সমাজব্যস্থা ও আধ্যাত্মিকতা পবিত্র কোরআনের আলোকে গাঁথা ছিল। 

পরের ১০ বছর ছিল মুসলিমদের জন্য বিপজ্জনক ও ভীতিকর। ক্রমবর্ধমান উম্মাহ অব্যাহতভাবে বিলীন হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় ছিল। হিজরত ছিল একটি বড় ধরনের ধাক্কা, এমনকি ঈশ্বর অবমাননাকর কাজও। নিজেদের গোত্র পরিত্যাগ করে মুসলিমরা আরবের অন্যতম ঐশী মূল্যবোধ রক্তের বন্ধন লঙ্ঘন করেছিল। তারা বিশ্বে তাদের সত্যিকারের স্থানটি থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজেদেরকে এমন চরম বৈরী বিশ্বে দিকভ্রান্ত অবস্থায় নিক্ষেপ করেছিল, যেখানে গোত্রীয় গ্রুপের সমর্থন ছাড়া ব্যক্তি সাধারণভাবে বাঁচতে পারত না। উম্মাহ মক্কার শক্তিশালী নগরীটির সাথে টানা যুদ্ধের হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। উম্মাহকে ইয়াসরিবের কিছু ইহুদি ও পৌত্তলিকের তীব্র বিরোধিতাও মোকাবিলা করতে হয়েছিল। এসব ইহুদি ও পৌত্তলিক রক্তের বন্ধনের ভিত্তিতে নয়, বরং আদর্শভিত্তিক এই বিপ্লবী সমাজে যোগ দিতে চায়নি। কিছু ইহুদি ও পৌত্তলিক মুহাম্মদকে (সা.) হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। আবার অনেকে মক্কার সাথে যোগসাজশ করে উম্মাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছিল। তারা সফল হলে মুসলিমরা সবাই নিশ্চিতভাবেই মক্কার ভয়াবহ প্রতিহিংসায় নিহত হতো। মৃত্যু ও গণহত্যা ঘটত। মক্কার বিরুদ্ধে মরিয়া লড়াইয়ে মুসলিমরা তাদের জীবন হারাচ্ছিল। তারা তাদের টিকে থাকার সংগ্রামে ইয়াসরিবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোত্রগুলোর তিনটিকে বসতি থেকে বহিষ্কার করে কিংবা একেবারে শেষ করে দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত গোত্রীয় সহিংসতা ও প্রতিহিংসার অপ্রতিরোধ্য চক্রের অবসান ঘটিয়ে নবী আরবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। একটির পর একটি গোত্র মুহাম্মদের (সা.) উম্মাহয় যোগ দেয়, এবং শেষ পর্যন্ত ৬৩০ সালে এমনকি গর্বিত নগরী মক্কাও মুসলিম সেনাবাহিনীর জন্য তার দরজা খুলে দেয়। মুহাম্মদ (সা.) রক্তপাত ছাড়াই তার নিজ শহর দখল করে নেন। 

ইসলাম হলো শান্তি ও ঐক্যের ধর্ম। ইসরাইল-অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেইতায় মুসলিমরা একে অন্যের হাতে চুমু খাচ্ছে। নবী মুহাম্মদের (সা.) সময় থেকে এটি উম্মাহর শুভেচ্ছা জ্ঞাপন পদ্ধতি হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। 

ইসলামের জন্ম সহিংস হলেও পবিত্র কোরআনের আদর্শ সম্প্রীতি ও ঐক্যের। ইসলাম শব্দটির মূল হচ্ছে সালাম (শান্তি)। পবিত্র কোরআনের মহান আদর্শ হলো তৌহিদ বা (এক হওয়া)। ব্যক্তি মুসলিমরা তাদের জীবনকে এমনভাবে বিন্যস্ত করবে যেখানে আল্লাহই হবেন তাদের সর্বোচ্চ বিষয় : তারা এই ব্যক্তিগত একীকরণ অর্জন করতে পারলে আল্লাহর সাথে মিলনের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। পুরো মানব সমাজকে এই ঐক্য ও ভারসাম্য অর্জন করতে হবে, তার সব কার্যক্রম ঐশী সত্তার সুরক্ষায় থাকতে হবে। মুসলিমদেরকে তাই আল্লাহর দেখানো আদি পূর্ণাঙ্গতার দিকে মানুষ ও প্রাকৃতিক জগতের সবকিছুকে চালিত করার জন্য বিরামহীন জিহাদে (সংগ্রামে) নিয়োজিত থাকতে হবে। আর এর ধারাবাহিকতায় ধর্মের মধ্যে কোনো বিভক্তিকর সাম্প্রদায়িকতা থাকতে পারবে না। শুরুতে মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বাস করতেন যে ইহুদি ও খ্রিস্টানেরা একই বিশ্বাসের অধিকারী। তিনি দুঃখের সাথে আবিষ্কার করলেন যে কোনোভাবেই প্রমাণ করা যায় না, এমন মতবাদগত বিষয়াদি নিয়ে তারা বিবাদে নিয়োজিত। ইয়াসরিবের বেশির ভাগ ইহুদি তাকে সত্য নবী হিসেবে স্বীকার করে নিতে অস্বীকার করলে এবং মুসলিমদের সামনে তাদের দরজা বন্ধ করে দিলে, তা ছিল তার জন্য চরম বেদনাদায়ক বিষয়। এরপর পবিত্র কোরআন মুসলিমদেরকে মূলে তথা ইব্রাহিমের বিশুদ্ধ ধর্মে ফিরে যেতে নির্দেশ দিলো। কারণ ইব্রাহিম তাওরাত বা গসপেলের আগের আমলের লোক হওয়ায় তিনি ইহুদি বা খ্রিস্টান কোনোটিই ছিলেন না। তিনি স্রেফ ছিলেন মুসলিম। তিনি আল্লাহর কাছে তার জীবনকে সমর্পণ করেছিলেন। ইয়াসরিবের অধিকতর বন্ধুপ্রতীম ইহুদিদের কাছ থেকে মুহাম্মদ (সা.) শিখেছিলেন যে আরবরা মনে করে তারা ইব্রাহিমের ছেলে ইসমাইলের বংশধর : তারাও নিজেদের ইব্রাহিমের সন্তান ভাবতে পারে, যেমন মনে করে ইহুদি ও খ্রিস্টানেরা। 

তবে মুহাম্মদ (সা.) এও বিশ্বাস করেছিলেন যে সব ইহুদি বা খ্রিস্টান এই বর্জনশীল সাম্প্রদায়িকতায় আবদ্ধ নয়। তিনি নিজে ইহুদিদের বিরুদ্ধে মরিয়া সংগ্রামে নিয়োজিত হলেও জোর দিয়ে তার অনুসারীদের বলেছেন, তাদেরকে অবশ্যই আগেকার কিতাবের অনুসারী তথা আহলে কিতাবিদের সম্মান করতে হবে: 

তোমরা উত্তম পন্থা ছাড়া কিতাবিদের সাথে বিতর্ক করো না, তবে তাদের সাথে করতে পারো, যারা তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী। এবং বলো, ‘আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তাতে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো একই এবং আমরা তারই প্রতি আত্মসমর্পণকারী। 

পবিত্র কোরআনে বারবার জোর দিয়ে বলেছে যে মুহাম্মদের (সা.) ওহি আগের নবী তথা আদম, নূহ, ইব্রাহিম, ইসহাক, ইসমাইল, যব, মুসা, দাউদ, সোলায়মান ও ঈশার শিক্ষা বাতিল করেনি। পবিত্র কোরআন একটিমাত্র বার্তা বারবার বলেছে ও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে আল্লাহই সব জাতিকে পাঠিয়েছেন। মানবীয় সব ব্যবস্থাকে ছাপিয়ে যাওয়া আল্লাহর বদলে কোনো মতবাদ বা কোনো প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেওয়া পৌত্তলিকতা। ইব্রাহিমের মূল বিশ্বাসে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে মুসলিমেরা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয় বরং আল্লাহকেই তাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। 

মানুষের ধর্মীয় অনুসন্ধানের এই অনিবার্য ঐক্যের এই স্বপ্নাবিভাব জেরুসালেমে মুসলিম নীতিতে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। পূর্বসূরিদের চেয়ে মুসলিমদের অনেক ভিন্ন ঐশী ভূগোল ছিল। সবকিছুই আল্লাহর কাছ থেকে আসায় সবকিছুই ছিল ভালো। ফলে ইহুদি ধর্মের মতো পবিত্র’ ও ‘অপবিত্রের’ মধ্যে অনিবার্য কোনো দ্বি-বিভাজন ছিল না। উম্মাহর লক্ষ্য হলো ঐশী সত্তা ও মানুষ, ভেতর ও বাইরের দুনিয়ার মধ্যে এমন একীকরণ ও ভারসাম্যের ব্যবস্থা করা যা এ ধরনের বিভাজনকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে। ‘ভালোর’ বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা অন্তর্নিহিত ‘পাপী’ বলে কিছু নেই, ‘শয়তানি’ রাজ্য বলেও কিছু নেই। এমনকি শেষ দিনে শয়তানকেও ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সবকিছুই পবিত্র ও এর ঐশী সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করতে হবে। ফলে সব স্থানই ঐশী, কোনো স্থান অন্য স্থানের চেয়ে বেশি পবিত্র নয়। তারপরও ইসলাম বাস্তববাদী বিশ্বাস হওয়ায় মুহাম্মদের (সা.) জানা ছিল যে কোনো কিছুর দিকে নিবদ্ধ থাকতে হলে প্রতীকের প্রয়োজন। প্রাথমিক বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় মুসলিমেরা তিনটি স্থানকে বিশ্বের ঐশী কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করতে শিখেছিল। 

এসবের মধ্যে প্রথমটি হলো মক্কা। নগরীর কেন্দ্রস্থলে কিউব-আকৃতির গ্রানাইটের একটি উপাসনালয় ছিল। সুপ্রাচীন এই স্থাপনাটি কাবা নামে পরিচিত ছিল। এটিকে আরবের সবচেয়ে পবিত্র স্থান হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচনা করা হতো। প্রতি বছর সমগ্র উপদ্বীপ থেকে গোত্রগুলো কষ্টসাধ্য ও জটিল হজ অনুষ্ঠান পালন করতে সমবেত হতো। পৌত্তলিকদের পাশাপাশি খ্রিস্টান আরবেরাও হজে শরিক হতো। মুহাম্মদের (সা.) সময় নাগাদ কাবা উৎসর্গ করা ছিল নাবাতিয়ান দেবতা হুবলের নামে। এর চারপাশ পরিবেষ্টিত ছিল আরব দেবমণ্ডলের নানা মূর্তিতে। তবে শুরুতে এটি পরম স্রষ্টা আল্লাহর ইবাদতগাহ হিসেবে পরিচিত ছিল। বেশির ভাগ ঐশী স্থানের মতো কাবাকেও পৃথিবীর কেন্দ্রে দণ্ডায়মান বলে মনে করা হতো : বেহেশতের দরজা সরাসরি এর ঠিক ওপরে বলে বিবেচিত হতো। ফলে এটিই ছিল ওই স্থান যেখান থেকে ঐশী বিশ্ব নিজেও দুনিয়ায় প্রবেশ করতে পারত। কাবার প্রাচীরে গাঁথা ছিল একটি কালো পাথর। একসময় আকাশ থেকে পড়া এই ধূমকেতুর টুকরাটি বেহেশত ও দুনিয়ার মধ্যে সংযোগ সাধন করেছিল। জেরুসালেমের হেরডের টেম্পলের মতো মক্কার পবিত্রতা (হারাম) বাস্তবতার সামগ্রিতা প্রতিনিধিত্ব করত, এবং স্বকীয়তার প্রতিনিধিত্ব করত কাবা। বাক্স- আকৃতির উপাসনালয়টি পৃথিবীকেও প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তুলত, এর চার কোণ একটি কেন্দ্রীয় স্থান থেকে জ্যোতি বিচ্ছুরণ ঘটাত। উপাসনাকারীরা মাঝামাঝি গতিতে, পাস জিমনেটিকের মতোই, সূর্যের দিক অনুসরণ করে সাতবার কাবাঘর তওয়াফ করত। তারা এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের ছন্দ ও গতির সাথে প্রতীকীভাবে নিজেদের স্থাপন করত, সঠিক দিক ও সঠিক পথ গ্রহণ করত। প্রায় সব সংস্কৃতিতেই বৃত্ত হলো উৎকর্ষতা ও শ্বাশততার প্রতীক। এসব তওয়াফের মাধ্যমে আরবরা দুনিয়াবি বাস্তবতা থেকে ঐশী সামগ্রিতার অনুভূতিতে প্রবেশ করত। তাওয়াফ ছিল ধ্যানশীল অনুশীলন : গতিশীল মহাবিশ্বের স্থির, ছোট বিন্দুকে চক্কর দিয়ে তীর্থযাত্রীরা নিজেদের অবস্থান জানত, তাদের নিজদের কেন্দ্র ও অগ্রাধিকারগুলো খুঁজে নিত। বর্তমানে হাজিরা মনে করে যে অন্যান্য হাজির সাথে তওয়াফ করার মাধ্যমে জাতির একজনে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে তারা অহংকে মিশিয়ে অভিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কাবার পবিত্রতা ২০ মাইল ব্যাসার্ধ পর্যন্ত সুরক্ষিত ছিল। এই পবিত্র স্থানে সব ধরনের সহিংসতা নিষিদ্ধ। ফলে এটি ছিল বিরামহীন উপজাতীয় লড়াই থেকে আশ্রয়স্থান। মক্কার বাণিজ্যিক সফলতার কারণ ছিল এটি। আরবরা নিশ্চিন্তমনে সেখানে মিলিত হতে পারত, শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা ছাড়াই ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারত। 

কাবার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ততা অনুভব করতেন মুহাম্মদ (সা.)। তিনি হারামে ইবাদত করতে পছন্দ করতেন, সেখানে পবিত্র কোরআন তেলায়াত করতেন, তাওয়াফ করতেন। তিনি সম্ভবত প্রাক-ইসলামি আরবে প্রচলিত কিংবদন্তিটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে প্রথম মানুষ আদম এই ঐশী স্থানে আদি উপাসনালয় নির্মাণ করেছিলেন। অর্থাৎ এটি হলো সমগ্র বিশ্বে আল্লাহর সম্মানে নির্মিত প্রথম উপাসনালয়। মক্কার হারাম ইডেন উদ্যানের স্থান। এখানেই আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, পশু-পাখির নাম দিয়েছিলেন, ফেরেশতাদের সম্মান লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ হারানো বেহেশতের প্রতিনিধিত্ব করত মক্কা। এই পবিত্র স্থানে ঐতিহ্যবাহী ইবাদত করার মাধ্যমে ক্ষণিকের জন্য সেই বেহেশতে প্রবেশ করা যায়। ইবাদতগাহটি পরে আদমের ছেলে শিশ, মহাপ্লাবনের পর নূহ এবং ইব্রাহিম ও ইসমাইল পুনঃনির্মাণ করেছিলেন। সবশেষে এটি পুনঃনির্মাণ করেছিলেন মক্কার কোরাইশ গোত্রের পূর্বপুরুষ কুশে বিন কিলাব। বর্তমানের সাথে অতীতকে, মানুষের সাথে ঐশী সত্তাকে, বহির্বিশ্বের সাথে অন্তঃবিশ্বকে সংযুক্তকারী স্থাপনা হলো কাবা। 

কিন্তু তবুও মুহাম্মদ (সা.) তার প্রথম ধর্মান্তরিতদেরকে অন্তরের ইসলামের বাহ্যিক প্রকাশ হিসেবে আল্লাহর সামনে নামাজ পড়ার সময় কাবার বদলে জেরুসালেমের দিকে সিজদা করতে বলেছিলেন। কাবা এখন মূর্তির কারণে দূষিত হয়ে পড়েছে। ফলে মুসলিমদেরকে এখন এক আল্লাহর উপাসক ইহুদি ও খ্রিস্টানদের আধ্যাত্মিক কেন্দ্রের দিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। কিবলা (নামাজের দিক) তাদের গোত্রীয় চেতনা থেকে সামগ্রিক মানবতার আদি বিশ্বাসের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টিই তুলে ধরেছিল। এটি আহলে কিতাবিদের সাথে সংহতি ও ধারাবাহিকতার ব্যাপারে মুহাম্মদের (সা.) অনুভূতিও প্রকাশ করেছে। ৬২৪ সালের জানুয়ারিতে যখন পরিষ্কার হয়ে গেল যে ইয়াসরিবের বেশির ভাগ ইহুদি মুহাম্মদকে (সা.) কখনোই গ্রহণ করবে না, তখন উম্মাহ অপেক্ষাকৃত পুরনো বিশ্বাসগুলো থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র ঘোষণা করল। মুহাম্মদ (সা.) জামায়াতে নামাজ পড়ার সময় জেরুসালেম থেকে মুখ ফিরিয়ে মক্কায় দিকে নামাজ পড়লেন। এই কিবলা পরিবর্তনের ঘটনাকে মুহাম্মদের (সা.) অন্যতম সৃষ্টিশীল ইচ্ছাপ্রকাশ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিবাদমান নানা গ্রুপে বিভক্ত হওয়ার আগে ইব্রাহিমের যে আদি বিশ্বাস প্রচলিত ছিল তাতে মুসলিমদের প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিতময় ছিল এটি। এটি ছিল ঐক্য খুঁজে পাওয়ার একটি প্রয়াস, যা সত্যিকারের মুসলিম ইব্রাহিমের পুনঃনির্মিত আদি ইবাদতগাহের প্রতিনিধিত্ব করত। কাবার সাথে ইহুদি বা খ্রিস্টানদের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকায় মুসলিমরা কৌশলে ঘোষণা করল যে তারা খোদ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠিত ধর্মের কাছে নতি স্বীকার করবে না : 

যারা দ্বীন সম্পর্কে নানা মতের সৃষ্টি করে করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোনো দায়িত্ব তোমাদের নয়… 

বলো, ‘আমার প্রতিপালক আমাকে সৎপথে পরিচালিত করেছেন। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন… ইব্রাহিমের ধর্মাদর্শ, তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ও তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। 

বলো, ‘আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতগুলোর প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যেই। 

কিবলা পরিবর্তনের ঘটনাটি ইয়াসরিবে হিজরতকারী প্রবাসী মক্কার মুসলিমদের জন্য সান্ত্বনাদায়কও ছিল। এটি তাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার অনুভূতি উপশম ঘটায়, প্রতীকীভাবে বাড়ির ঐশী সম্পৃক্ততার প্রতি তাদেরকে প্রতীকীভাবে চালিত করে। 

মুহাম্মদ (সা.) ৬৩০ সালে যখন বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন তার প্রথম কাজ ছিল মূর্তিগুলো গুঁড়িয়ে ও হুবলের কুশপুত্তলিকা অপসারণ করে কাবাকে পরিশুদ্ধ করা। দুই বছর পর মৃত্যুর আগে তিনি পুরনো পৌত্তলিক হজ অনুষ্ঠান পালন করে সেটিকে নতুন, একেশ্বরবাদী ব্যাখ্যা দেন। এগুলো এখন আবারো জনমানবহীন প্রান্তরে ইব্রাহিমের পরিত্যাগ করা হাজেরা ও ইসমাইলের অভিজ্ঞতার প্রতীকে পরিণত হলো। মক্কা মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র স্থান হিসেবে বহাল থাকল, হারাম পরিণত হলো ইসলামি ধর্মীয় অভিজ্ঞতার প্রতীকী প্রকাশ। পবিত্র কোরআন সবসময় মুসলিমদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে ‘নিদর্শন’ ও ‘প্রতীকের’ (আয়াত) আলোকেই আমরা কেবল আল্লাহর কথা বলতে পারি। পবিত্র কোরআনের প্রতিটি পংক্তিকে বলা হয় আয়াত বা উপমা। আর বেহেশত, শেষ বিচার ইত্যাদিও নিদর্শন। কারণ আল্লাহ ও তার সৃষ্টি কেবল আলঙ্কারপূর্ণ অবয়বেই মানুষ প্রকাশ করতে পারে। ফলে মুসলিমরা প্রতীকীভাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, আদিম ঐশী স্থান মক্কার পবিত্রতাকে ইসলামি স্বপ্নবিভাবের সামগ্রিক গতিশীলতা প্রতিফলনকারী বলে বিবেচনা করতে পারত। এক আল্লাহ ও এক ধর্ম যেমন অনেক অবয়বে প্রকাশিত হতে পারে, ঠিক সেভাবেই একটি পবিত্র স্থান মক্কাও বহুত্বকে প্রকাশ করতে পারে। এর পরে আত্মপ্রকাশ করা ইসলামি বিশ্বের অন্য সব পবিত্র স্থান তাদের পবিত্রতা লাভ করেছিল মক্কা থেকে এবং সেগুলো এই কেন্দ্রীয় পবিত্রতার সম্প্রসারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে মহাবিশ্বও আল্লাহর একটি আয়াত এবং একইভাবে তার উপস্থিতি প্রকাশ করে। ইসলামি বিশ্বের অন্য সব ইবাদতখানাও এ কারণে পবিত্রতার সমরূপ প্রতীক মক্কার মডেলে হয় : এটি হবে তৌহিদের প্রকাশ, মহাবিশ্বের মিলনকেন্দ্র ও একীকরণের স্থান। 

অন্য যেসব সবচেয়ে পবিত্র স্থান রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো জেরুসালেম। মুসলিমরা কখনো ভোলেনি যে আহলে কিতাবের পবিত্র নগরী তাদের প্রথম কিবলা। এই নগরী এমন এক প্রতীক যা তাদেরকে স্বতন্ত্র ইসলামি পরিচিতি গঠন করতে, তাদেরকে তাদের পূর্বপুরুষদের পৌত্তলিক প্রথা থেকে সরিয়ে একটি নতুন ধর্মীয় পরিবারে পরিণত করতে সহায়তা করেছিল। জেরুসালেম এই বিচ্ছিন্নতার বেদনাদায়ক প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সবসময় মুসলিমদের আধ্যাত্মিক দৃশ্যপটে বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। এটি ইসলামি ধারাবাহিকতার অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানেরা স্বীকার করুক বা না করুক আহলে কিতাবের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। মুসলিমেরা এই নগরীকে বলবে মাদিনাত বায়তুল মোকাদ্দিস বা ‘সিটি অব দি টেম্পল’। এটি দীর্ঘ দিন ধরে ছিল তাদের একেশ্বরবাদী পূর্বসূরীদের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র। মহান নবী দাউদ ও সোলায়মান এখানে ইবাদত করেছেন, এই স্থান শাসন করেছেন : সোলায়মান একটি পবিত্র মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। নগরীটি ঈশাসহ (যিশু) আরো কয়েকজন পবিত্রতম নবীর সাথেও সম্পৃক্ত, মুসলিমেরা তাদের অত্যন্ত সম্মান করে। অবশ্য মুসলিমেরা বিশ্বাস করে না যে যিশু ছিলেন ঈশ্বর। 

পরবর্তীকালে মুসলিমেরা দাবি করেছিল যে নবী মুহাম্মদও (সা.) জেরুসালেম সফর করেছিলেন। আল্লাহ এক রাতে মক্কা থেকে অলৌকিকভাবে ওই যাত্রার বর্ণনা করেছেন : 

পবিত্র ও মহিমময় তিনি যিনি তার বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছিলেন উপাসনার অলঙ্ঘনীয় ঘর [মসজিদুল হারাম] থেকে দূরের মসজিদে মসজিদুল আকসা], যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। 

মসজিদুল হারাম নিশ্চিতভাবেই কাবা, কিন্তু জেরুসালেমের সাথে দূরের মসজিদের কোনো সংযোগের কথা পবিত্র কোরআনে নেই। তবে সম্ভবত মুহাম্মদের (সা.) কয়েক প্রজন্ম পরে মুসলিমেরা এটি শনাক্ত করেছিল। তারা বলে, হিজরতের আগে ৬২০ সালের দিকে এক রাতে মুহাম্মদ কাবায় ইবাদত করার সময় জিবরাইল ফেরেশতা তাকে জেরুসালেম নিয়ে যান। তারা বোরাক নামে পাখাযুক্ত ঘোড়ায় উড়ে ওই রাতে টেম্পল মাউন্টে অবতরণ করেন। সেখানে মুহাম্মদের (সা.) পূর্বসূরি বিপুলসংখ্যক নবী তাকে স্বাগত জানান। এরপর জিব্রাইল ও মুহাম্মদ (সা.) টেম্পল মাউন্ট থেকে খোদার সিংহাসন পর্যন্ত বিস্তৃত একটি মইয়ে (আল-মিরাজ) করে সাত আসমান পাড়ি দেন। প্রতিটি ঐশী মণ্ডলে একেক নবী- আদম, ঈশা, জন দি ব্যাপ্টিস্ট, ইউসুফ, ইউনুস, হারুন, মুসা ও সবশেষে ইব্রাহিম- স্বাগত জানান। সেখানে মুহাম্মদ (সা.) চূড়ান্ত ওহি লাভ করেন, এই ওহি মানবীয় উপলব্ধি সীমার বাইরে নিয়ে যায় তাকে। তার সর্বোচ্চ আসমানে আরোহণ ইসলামের চূড়ান্ত কাজ হিসেবে বিবেচিত। এটি ছিল সব সৃষ্টির উৎসের কাছে ফিরে যাওয়া। মুহাম্মদের (সা.) নৈশ সফর (আল-ইসরা) ও আরোহণ (আল-মিরাজ) সুস্পষ্টভাবেই ইহুদি মরমিসাধকদের ‘থ্রন ভিশনের’ স্মৃতিবাহী। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি অপেক্ষাকৃত পুরনো বিশ্বাসগুলোর সাথে ধারাবাহিকতা ও সংহতির মুসলিম বিশ্বাসের নিদর্শন। কাবা থেকে মুসলিমদের নবীর টেম্পল মাউন্টের যাওয়ার ঘটনাটি মক্কার পবিত্রতা জেরুসালেমে তথা আল মসজিদ আল-আকসায় ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ও প্রকাশ করে। দুই নগরীর মধ্যে ঐশীভাবে সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। 

তবে ইসলামি বিশ্বে জেরুসালেম হলো স্রেফ তৃতীয়-সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান। দ্বিতীয়টি ছিল প্রথম উম্মাহর বাসস্থান ইয়াসরিব। মুসলিমেরা এই নগরীকে বলে মদিনা তথা ‘নগরী’। মুহাম্মদ (সা.) তার ছোট্ট ধর্মান্তরিত গ্রুপটিকে মদিনায় নিয়ে যাওয়ার সময় আদি পবিত্র স্থান মক্কার ঐশ্বিতা এই নতুন নগরীতে আরোপ করেছিলেন। মৃত্যুর পর মুহাম্মদ (সা.) মুসলিমদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা লাভ করেন ‘পূর্ণাঙ্গ মানুষ’ হিসেবে : তিনি ঐশী সত্তা ছিলেন না। যিশুর প্রতি যেভাবে দেবত্ব আরোপ করেছিল সে ধরনের কিছু তার ওপর আরোপ করতে মুহাম্মদ (সা.) ক্লান্তিহীনভাবে বারণ করেছিলেন। তবে ঐশী সত্তা না হলেও তার বিশ্বাস, সদগুণ, আল্লাহর কাছে সমর্পণ এত সর্বাত্মকরণে ছিল যে তিনি তার নিজ ব্যক্তিত্বে বেহেশত ও দুনিয়ার মধ্যে জীবন্ত সংযোগ (কুতুব) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্থাৎ মুসলিমেরা পবিত্র স্থানের প্রাচীন নিদর্শনের সাথে পবিত্র মানুষের অধিকতর সাম্প্রতিক ধর্মমতের সমন্বয় সাধন করেছিল। মানুষ ও সেইসাথে স্থানও আসমান ও দুনিয়ার মধ্যে সংযোগ সাধন করতে পারে। তবে নবীর বাড়ি মদিনা, আরো বিশেষভাবে মুহাম্মদের (সা.) কবরটি (এখানেই তার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি কেন্দ্ৰীভূত ছিল) বেহেশতের পৃথিবীকে স্পর্শ করার স্থানে পরিণত হয়। মদিনাও পবিত্র স্থান। কারণ উম্মাহ অস্তিত্ব লাভ করেছিল এখানেই। তৌহিদের অভিন্ন মূলনীতিতে সব ভবিষ্যত ইসলামি নগরী ও রাষ্ট্র মদিনার আদি পবিত্রতায় সামিল হয়। মদিনা পরিণত হয় আল্লাহর শাসনে মানবজীবনের সামগ্রিকতাকে আনার প্রয়াসের নিদর্শন। 

একইভাবে ইসলামি বিশ্বে নির্মিত ভবিষ্যতের সব মসজিদও হয় মদিনায় মুহাম্মদের (সা.) নির্মিত প্রথম সাদামাটা মসজিদের মডেলে। অগোছাল এই ভবনটি প্রাথমিক ইসলামি আদর্শের কৃচ্ছ্র ও সরলতা প্রকাশ করেছিল। তিনটি গাছের কাণ্ড ছাদকে ঠেকিয়ে রেখেছিল, একটি পাথর নামাজের দিক কিবলার চিহ্ন নির্দেশক ছিল। খোতবা দেওয়ার জন্য মুহাম্মদ (সা.) একটি চৌকিতে দাঁড়াতেন। এসবই অর্থাৎ ছাদকে ঠেস দেওয়ার জন্য কয়েকটি স্তম্ভ, মিরহাব, মক্কার দিক নির্দেশক কুলুঙ্গি, খোতবার জন্য মিম্বার পরবর্তীকালের মসজিদের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হয়। মদিনার মসজিদটির মতো করে একটি আঙিনাও রাখার ব্যবস্থা করা হয় এসব মসজিদে। এই আঙিনা প্রথম উম্মাহর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মুহাম্মদ (সা.) ও তার স্ত্রীরা এই আঙিনার চার দিকে তৈরি ছোট ছোট অ্যাপার্টমেন্ট বা কুঁড়ে ঘরে বাস করতেন। নগরীর গরিব মানুষেরা সাহায্য, খাবার ও পরিচর্যার জন্য এখানে জমায়েত হতে পারত। আঙিনায় অনুষ্ঠিত জনসমাগমগুলোতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয়াদির সাথে ধর্মীয় বিষয় নিয়েও আলোচনা হতো। একইভাবে বর্তমান সময়েও মুসলিম সম্প্রদায়ের সব ধরনের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে মসজিদ ভূমিকা পালন করছে। এটি কেবল ধর্মীয় কার্যক্রমের জন্য ব্যবহৃত হয় না। 

আর পবিত্রতাকে অনিবার্যভাবেই ইহজগত থেকে আলাদা বিবেচনাকারী ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কাছে এটি প্রায়ই বিস্ময়কর, এমনকি দুঃখজনকও মনে হয়। তারা কল্পনা করে, মুসলিমেরা যেহেতু মসজিদে তাদের বন্ধুদের সাথে খোশগল্প করে কিংবা রাজনৈতিক সভাসমাবেশ করে পবিত্রতাকে ‘ব্যবহার’ করে, কাজেই তারা তাদের মসজিদ ও প্রার্থনার স্থানগুলোকে সত্যিকার অর্থে ঐশী বিবেচনা করে না। কিন্তু আসলে ঐশী সত্তা-সম্পর্কিত ইসলামি ধারণা নিয়ে ভ্রান্ত চিন্তার কারণেই এমনটা মনে হয় তাদের। ইসলামে ঐশী সত্তাকে আসলে বিচ্ছিন্ন কিছু (জেরুসালেমের কাদ্দশ) বিবেচনা করা হয় না, বরং এমন কিছু বোঝায় যা সমগ্র জীবনকে উদ্দীপ্ত করে। মুহাম্মদ (সা.) মসজিদের আঙিনায় তার স্ত্রীদের জন্য ঘর বানিয়ে দেখালেন যে যৌনজীবন, ঐশী সত্তা ও গৃহস্থালী জীবন- বাস্তবিকই ও অত্যাবশ্যকভাবে- পূর্ণাঙ্গতা এনে দিতে পারে। একইভাবে রাজনীতি, সমৃদ্ধি ও সমাজজীবনের সুবিন্যাস অবশ্যই পবিত্রতার আওতাধীন ও আল্লাহর শাসনের অধীনে আনতে হবে। ইসলামে পবিত্রতাকে তাই বর্জনকর না ভেবে বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক বিবেচনা করা হতো। মদিনার খ্রিস্টানদেরকে মসজিদে প্রার্থনা করতে দেওয়া হতো। এটি ছিল গসপেলের সাথে ইসলামি ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার প্রকাশ। মসজিদের বহুমুখী কার্যক্রম ছিল তাই তৌহিদের প্রকাশ, মানবজীবনের সামগ্রিক পরিসরকে ধর্মীয় পরিধির মধ্যে নিয়ে আসা। অধিকন্তু, সব স্থানই সহজাতভাবে পবিত্র হওয়ায় মসজিদকে এর আশপাশের এলাকা থেকে বেড়া দিয়ে আলাদা করার দরকার হতো না। বলা হয়ে থাকে নবী বলেছেন : ‘দুনিয়াকে গালাগাল করো না, কারণ দুনিয়া হলো আল্লাহ।’ আর পবিত্র কোরআন অব্যাহতভাবে আয়াতের মতো করেই দুনিয়ার সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলাকে বিবেচনা করতে বলেছে। এ কারণে গাছপালা, যা টেম্পল মাউন্টে নিষিদ্ধ ছিল, মুসলিম উপাসনালয়ে উৎসাহিত করা হয়। আঙিনায় থাকবে ঝরনা, আর মসজিদ হতে হবে পুরোপুরি আলোতে উদ্ভাসিত; পাখিরা জুমার নামাজের সময় সেখানে উড়তে পারবে। দুনিয়াকে বাইরে না রেখে মসজিদের ভেতরে আমন্ত্রণ জানানো হবে। মদিনার মূলনীতি ইসলামি বিশ্বের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান জেরুসালেমেও দৃশ্যমান হয়েছিল। 

মুহাম্মদ (সা.) ৬৩২ সালের ৬ জুন ইন্তিকাল করেন। তিনি প্রায় পুরো আরবকে তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তবে আরব উপদ্বীপে গোত্রীয় যুদ্ধ এত ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল যে তার মৃত্যুর পর উম্মাহ ভেঙে পড়ার প্রকৃত বিপদে পড়েছিল। মদিনার সাথে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ অনেক গোত্র তার ধর্মের সাথে না হয়ে নবীর সাথে অনেক বেশি সম্পৃক্ত ছিল। ফলে তার মৃত্যুর পর তারা 

তার উত্তরসূরি (খলিফা) আবু বকরের সাথে থাকার গরজ অনুভব করল না বা ইসলামি কোষাগারে ধর্মীয় কর (জাকাত) দিতে চাইল না। স্থানীয় ‘নবীরা’ মুহাম্মদের (সা.) প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চেয়ে উম্মাহ থেকে বের হয়ে গেলেন। আবু বকরকে বিদ্রোহী আসাদ, তামিম, গাতাফান ও হানিফা গোত্রের বিরুদ্ধে নির্মম অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছিল। বিদ্রোহ দমন করার পরপরই আবু বকর সম্ভবত উম্মাহর দুর্দমনীয় শক্তিগুলোকে বাইরের শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে উম্মাহর অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা দূর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ঘটনা যাই হোক না কেন, ৬৩৩ সাল নাগাদ মুসলিম সেনাবাহিনী পারস্য, সিরিয়া ও ইরাকে নতুন নতুন অভিযান শুরু করে। ৬৩৪ সালে আবু বকর ইন্তিকাল করার সময় একটি আরব সেনাবাহিনী বাহরাইন থেকে পারসিকদের বিতাড়িত করে, আরেকটি বাহিনী ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে গাজা জয় করে। 

প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এসব যুদ্ধ ধর্মীয় প্রণোদনাপূর্ণ ছিল না : পবিত্ৰ কোরআনে ইসলামের জন্য বিশ্ব জয় করতে হবে এমন কর্তব্যের কথা বিশ্বাস করতে মুসলিমদের উৎসাহিত করেনি। অবশ্য এমন ইঙ্গিত রয়েছে যে মুহাম্মদ (সা.) তার জীবনের শেষ দিকে আরো আরবকে উম্মাহয় সামিল করার পরিকল্পনা করেছিলেন। ৬৩০ সালে তিনি আরব উপদ্বীপে উত্তর অঞ্চলে সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অবশ্য এই পর্যায়ে খ্রিস্টান ধর্মের মতো মিশনারি ধর্ম ছিল না ইসলাম। বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ না করলে মুহাম্মদ (সা.) প্রত্যাশা করতেন না যে ইহুদি বা খ্রিস্টানেরা ইসলামে ধর্মান্তরিত হোক। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে তারা তাদের নিজস্ব বৈধ ওহি পেয়েছে। প্রাথমিক দিনগুলোতে মুসলিমেরা ইসলামকে বিবেচনা করত ইসমাইলের বংশধর আরবদের জন্য দেওয়া একটি ধৰ্ম, ঠিক যেমন ইয়াকুবের বংশধরদেরকে দেওয়া হয়েছিল ইহুদি ধর্ম। ইসলামে ধর্মান্তরিত বেদুইনেরা সাথে সাথে অস্ত্রের জোরে অনীহ বিশ্বে নতুন ধর্ম চাপিয়ে দিতে আরবের বাইরে ছুটে গিয়েছিল বলে পুরনো ধারণাটি আধুনিক ইতিহাসবিদেরা পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছেন। বেশির ভাগ মুসলিম জেনারেলের সম্ভবত অনেক বেশি দুনিয়াবি উদ্দেশ্য ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরব বিশুষ্ক তৃণপ্রধান বৃক্ষহীন প্রান্তরের যাযাবরেরা আরো উর্বরা ভূমি ও আরো ভালো পশু চারণভূমির সন্ধানে উপদ্বীপ থেকে ছুটে বের হতে চেয়েছে। তখন পর্যন্ত দুটি পরাশক্তি বায়েজান্টাইন ও পারস্যের সেনাবাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছিল। তবে ক্ষমতার শূন্যতার সুযোগে ৬৩৩ সালে মুসলিমেরা তাদের বৈদেশিক অভিযান শুরু করে। একে অপরের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে যুদ্ধ করে করে পারস্য ও বায়েজান্টাইন উভয়েই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। দুই সাম্রাজ্যের কিছু সৈন্য ছিল আরব। তারা আক্রমণকারীদের সাথে জাতিগত বন্ধন অনুভব করে মুসলিম সেনাবাহিনী যোগ দিয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আরব সীমান্তে থাকা ঘাসান গোত্রটি দীর্ঘ দিন ধরে ছিল কনস্টানটিনোপলের অনুগত। তাদের দায়িত্ব ছিল আরব যাযাবরদের কোণঠাসা করে রাখা। কিন্তু বায়েজন্টাইনরা সম্প্রতি ভর্তুকি প্রত্যাহার করায় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিল। তারা ধর্মীয় কারণে নয়, বরং আরব সংহতির অস্পষ্ট অনুভূতিতে পক্ষ ত্যাগ করে উম্মাহর সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। সিরিয়া ও ইরাকে থাকা আরামাইক ও সেমিটিক উপাদানগুলো হয় আরব অভিযানের ব্যাপারে উদাসীন ছিল কিংবা এতে উৎসাহিত ছিল। আমরা বায়েজান্টাইন সাম্রাজ্যে দেখেছি, খ্রিস্টান সম্রাটদের নির্যাতনমূলক নীতির ফলে মনোফাইসিত মুরতাদরা ও বিশাল ইহুদি জনসাধারণ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তারা বায়েজন্টাইনদের সমর্থন করতে ইচ্ছুক ছিল না। ফিলিস্তিনে ইহুদিরা বিশেষভাবে মুসলিমদের স্বাগত জানিয়েছিল। এসব জটিল কারণে মুসলিম সেনাবাহিনী তুলনামূলক সহজে পুরনো সাম্রাজ্য দুটির বেশ বড় পরিমাণ ভূখণ্ড জয় করতে পেরেছিল। 

আবু বকরের মৃত্যুর পর নবীর সবচেয়ে সংযমী ও আবেপ্রবণ সাহাবা খলিফা উমর পারস্য ও বায়েজান্টাইন উভয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখেন। মুসলিমেরা বেশ ধনী হতে শুরু করলেও উমর কিন্তু মুহাম্মদের (সা.) মতোই সাদামাটা জীবনযাপন অব্যাহত রাখেন। তিনি সবসময় একটি পুরনো তালি দেওয়া উলের জোব্বা পরতেন, অন্য সব সৈনিকের মতো নিজের বোঝা নিজে বইতেন এবং জোর দিয়ে বলতেন যে তার অফিসারদেরও একইভাবে চলতে হবে। অর্থাৎ ফিলিস্তিনে ইসলাম এসেছিল কর্মশক্তিসম্পন্ন বিশ্বাস হিসেবে, ধর্মটির প্রথম উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে। অন্য দিকে বায়েজান্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার অনেক প্রজাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বিষণ্ণতায় অসুস্থ, আধ্যাত্মিক সঙ্কটে জর্জরিত। তিনি আশঙ্কা করতেন, মুসলিম অভিযান হলো ঈশ্বরের অসন্তুষ্টির নিদর্শন। আরব সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনে তাদের অভিযান অব্যাহত রাখে। ৬৩৬ সালের ২০ আগস্ট ইয়ারমুকের যুদ্ধে বায়েজান্টাইন সৈন্যদের পরাজিত করে মুসলিমরা। যুদ্ধের মধ্যেই ঘাসানিরা বায়েজান্টাইন পক্ষ ত্যাগ করে তাদের আরব ভাইদের সাথে যোগ দেয়। ইহুদিদের সহায়তায় দেশের বাকি অংশ দখল করতে থাকে মুসলিমেরা। হেরাক্লিয়াস কেবল একটু দম নিয়ে জেরুসালেমে প্রবেশ করে ট্রু ক্রুশ’ নিয়ে চির দিনের জন্য সিরিয়া ত্যাগ করেন। ৬৩৭ সালের জুলাই নাগাদ মুসলিম সেনাবাহিনী জেরুসালেমের প্রাচীরগুলোর বাইরে তাঁবু স্থাপন করে। 

প্যাট্রিয়ার্ক সফ্রোনিয়াস বায়েজান্টাইন গ্যারিসনের সহায়তায় সাহসিকতার সাথে নগরীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থার আয়োজন করেন। কিন্তু ৬৩৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় খ্রিস্টানেরা। প্রচলিত রয়েছে যে প্যাটিয়ার্ক খলিফা উমর ছাড়া অন্য কারো হাতে পবিত্র নগরী হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। অন্যতম একটি প্রাচীন মুসলিম উৎস দাবি করেছে, উমর ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত ছিলেন না, তিনি পরে কোনো একসময় জেরুসালেম সফর করেন। তবে বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ এখনো বিশ্বাস করেন যে উমরই নগরীর আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ওই সময় সিরিয়ায় ছিলেন। প্রাথমিক ইসলামে জেরুসালেমের মর্যাদার কারণে তিনিই এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় সভাপতিত্ব করতে চাইবেন, এমনটাই স্বাভাবিক। প্রচলিত ভাষ্যে বলা হয়, সফ্রোনিয়াস ঘোড়ায় চড়ে নগরীর বাইরে গিয়েছিলেন উমরের সাথে সাক্ষাত করতে। তারপর তিনি উমরকে সসম্মানে দিয়ে জেরুসালেমে নিয়ে এসেছিলেন। উমর নিশ্চিতভাবেই জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরা বায়েজান্টাইনদের মধ্যে মানানসই ছিলেন না। কারণ তিনি তার স্বাভাবিক জীর্ণ পোশাক পরে সাদা উটে চড়ে নগরীতে প্রবেশ করেছিলেন। এমনকি তিনি এই অনুষ্ঠানের জন্যও পোশাক পরিবর্তন করতে রাজি হননি। কয়েকজন খ্রিস্টান পর্যবেক্ষকের মনে হয়েছিল যে খলিফা আসরে কপট লোক। তারা সম্ভবত অস্বস্তিকরভাবে অবগত ছিল যে মুসলিম খলিফা তাদের নিজস্ব কর্মকর্তারদের চেয়ে অনেক বেশি করে পবিত্র দারিদ্র্যতার খ্রিস্টান আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। 

উমর জেরুসালেমের আগের যেকোনো বিজয়ীর, সম্ভবত ব্যতিক্রম ছিলেন রাজা দাউদ, চেয়ে অনেক বেশি সহানুভূতিসূচক একেশ্ববাদী আদর্শ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি নগরীর দীর্ঘ ও অসংখ্য মর্মান্তিক ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও রক্তপাতহীন বিজয়ে সভাপতিত্ব করেন। খ্রিস্টানেরা আত্মসমর্পণ করার পর কোনো হত্যাকাণ্ড, সম্পত্তির ধ্বংস হয়নি, প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মীয় নিদর্শনে অগ্নিসংযোগ করা হয়নি, কোনো বহিষ্কার বা সম্পত্তির বাজেয়াপ্তকরণ হয়নি, অধিবাসীদের বলপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয়নি। নগরীর পূর্ববর্তী অধিবাসীদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন যদি একেশ্বরবাদী শক্তির পূর্ণাঙ্গ প্রকাশক হয়ে থাকে, তবে বলতে হবে জেরুসালেমে ইসলাম তার দীর্ঘ শাসনকাল ঠিক সেভাবেই শুরু করেছিল। 

উমর পবিত্র স্থানগুলো দেখতে চাইলে সফ্রোনিয়াস তাকে সোজা অ্যানাস্তাসিসে নিয়ে গেলেন। বস্তুত এই জটিল জাকালো ভবনগুলো ছিল যিশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের স্মারক। ফলে তা খলিফাকে খুশি করেনি। পবিত্র কোরআন ঈশাকে (যিশু) অন্যতম মহান নবী হিসেবে সম্মান করে। তবে বিশ্বাস করে না যে তিনি ক্রুশে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। যিশুর বিপরীতে মুহাম্মদ (সা.) তার জীবদ্দশায় চোখ ধাঁধানো সাফল্য পেয়েছিলেন। আর মুসলিমদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে আল্লাহ কোনো নবীকে এ ধরনের লজ্জাজনকভাবে মৃত্যু অনুমোদন করবেন। আরবরা দৃশ্যত নিকট প্রাচ্যের অনেক এলাকায় প্রচলিত ডসেটিস্ত ও ম্যানিচেন আদর্শ গ্রহণ করেছিল। এতে বলা হতো, যিশুকে দেখে মনে হয়েছিল তিনি মারা গেছেন। আর ক্রুশটি ছিল অপঃছায়া, কুহেলিকা সৃষ্টি করা হয়েছিল এর মাধ্যমে। বরং ইউনুস ও ইলিজার মতো ঈশাকেও তার জীবনের শেষ প্রান্তে বিজয়ীবেশে বেহেশতে চলে গিয়েছিলেন। পরে মুসলিমরা খ্রিস্টান বিশ্বাসকে নিন্দা করতে অ্যানাস্তাসিসকে আল-কিয়ামাহর (পুনরুত্থান) বদলে বলেছিল আল কুমামাহ (‘গোবরের স্তুপ’)। অবশ্য উমর এ ধরনের কোনো উগ্রতা প্রকাশ করেননি, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ একটি সামরিক জয়ের উত্তেজনা সত্ত্বেও। তার কবরের পাশে দাঁড়ানোর সময় নামাজের সময় হয়ে গেল। সফ্রোনিয়াস খলিফাকে সেখানেই নামাজ আদায় করতে বলেন। উমর তা সৌজন্যতার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি কনস্টানটাইনের ম্যাটিরিয়ামে নামাজ পড়লেন না। এর বদলে তিনি বাইরে গিয়ে কারডো ম্যাক্সিমাসের ব্যস্ত রাস্তার পাশে নামাজ আদায় করেন। তিনি প্যাট্রিয়ার্কের কাছে বলেন, তার খ্রিস্টান উপাসনালয়ের ভেতরে নামাজ না পড়ার কারণ হলো, বায়তুল মোকাদ্দিসে খলিফার নামাজ পড়ার স্মৃতিকে ধরে রাখতে ইসলামি ইবাদাতগাহে পরিণত করার জন্য মুসলিমরা এসব স্থান বাজেয়াপ্ত করে নিতে পারে। উমর সাথে সাথে একটি সনদ লিখে ম্যারটিরিয়ামের সিঁড়িতে নামাজ পড়া কিংবা সেখানে মসজিদ নির্মাণে মুসলিমদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পরে তিনি নেয়ায় নামাজ পড়েন। তিনি এখানেও স্থাপনাটি খ্রিস্টানদের হাতে বহাল থাকা নিশ্চিত করতে সতর্কতা অবলম্বন করেন। 

তবে খ্রিস্টানদের সম্পত্তি দখল না করেই একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য জায়গা প্রয়োজন ছিল মুসলিমদের। তারা সোলায়মানের টেম্পলটিও দেখার জন্য উতলা ছিল। ঐতিহ্যবাদী আল-ওয়ালিদ ইবনে মুসলিমের মতে সফ্রোনিয়াস চেয়েছিলেন ‘দাউদের মসজিদ’ হিসেবে ম্যারটিরিয়াম ও হলি সায়নের ব্যাসিলিকা দিয়ে দিতে। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি উমর ও তার সহযাত্রীদেরকে টেম্পল মাউন্টে নিয়ে যান। পারস্য দখলদারিত্বের সময় থেকেই, ওই সময় ইহুদিরা প্লাটফর্মে আবার উপাসনা শুরু করেছিল, খ্রিস্টানরা স্থানটিকে নগরীর আবর্জনা ফেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করছিল। মুসলিম ইতিহাসবিদ মুজির উদ্দিন জানান, টেম্পলের পুরনো বিধ্বস্ত ফটকগুলোতে পৌঁছানোর পর উমর আবর্জনা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন, ‘পবিত্র ইবাদতগাহের পুরোটাই [আবর্জনা] সয়লাব হয়ে গিয়েছিল, ফটকগুলোর সিঁড়িতে এত জমে গিয়েছিল যে ফটক খোলার জন্য পিছিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে হয়েছিল। সবমিলিয়ে এত আবর্জনা যে মনে হচ্ছিল, প্রবেশপথের ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল তা।’ প্লাটফর্ম পর্যন্ত যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল হাত আর হাঁটু ব্যবহার করে হামাগুড়ি দেওয়া। সফ্রোনিয়াস প্রথমে গেলেন, তারপর তার পেছন পেছন অনেক কষ্টে গেলেন মুসলিমেরা। শীর্ষে পৌঁছে মুসলিমেরা নিশ্চয় বিশাল ও পরিত্যক্ত সম্প্রসারিত হেরড প্লাটফর্মের দিকে কষ্টের সাথে তাকিয়েছিল। তখনো সেটি ইট-সুড়কি আর আবর্জনায় ভরা ছিল। সুদূর আরব পর্যন্ত যে পবিত্র স্থানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটির এমন দুরাবস্থা দেখার কষ্ট কখনো বিস্মৃতির আড়ালে যায়নি: মুসলিমেরা দাবি করে, টেম্পল মাউন্টের প্রতি খ্রিস্টানদের গর্হিত আচরণের কারণেই তারা বদলা দিনতে আনাস্তাসিস আল-কামামাহকে ‘গোবরের স্তুপ’ বলে ডাকে। 

উমর মনে হয় না পরবর্তীকালে ইসলামি ধর্মানুরাগে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এ স্থানটি যাচাই-বাছাই করার জন্য কোনো সময় ব্যয় করেছিলেন। পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেই তিনি আবর্জনা আর জঞ্জাল মুঠো মুঠো করে তার জোব্বায় তুলে নিয়ে নগর-প্রাচীরের বাইরে হিন্নম ভ্যালিতে নিক্ষেপ করেন। সাথে সাথে তার সহকর্মীরাও একই কাজে নিয়োজিত হন। ১২ বিশুদ্ধকরণের এই কাজ কনস্টানটাইনের অধীনে গলগোথা খননকাজের সাথে অমিল ছিল না। আবারো সদ্য দুর্দান্ত বিজয় লাভকারী একটি ধর্ম জেরুসালেমে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আগের দখলকারদের অধার্মিকতা খুঁড়ে বের করেছিল ধর্মটির ভিত্তির সাথে ভৌত সংযোগ স্থাপন করার জন্য। 

জেরুসালেমে মুসলিমদের আগমন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। হিজরতে প্রথম মুসলিম ধর্মান্তরিতরা বেদনার সাথে তাদের বাড়িঘর ও সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলো থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছিল। এখন আরব সেনাবাহিনী এমন এক বিশ্বে নিজেদের প্রবেশ করাতে শুরু করল যা ছিল আরবে পরিচিত তার রুচি ও সংস্কৃতিতে একেবারেই নতুন, তার সভ্যতার গণ্ডির সম্পূর্ণ বাইরে। তাদেরকে তাই তাদের নতুন বিশ্বাসকে প্রবলভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকা পুরাতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ঐহিত্যগুলোকে মোকাবিলা করতে হচ্ছিল। ইসলামি সেনাবাহিনী স্থায়ীভাবে এগিয়ে চলছিল তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। তবে এখন তারা বায়তুল মুকাদ্দিসের তথা মহান কয়েকজন নবীর আবাসভূমি ও তাদের প্রথম কিবলার মালিক। এটি ছিল এক ধরনের বাড়ি ফেরা, তাদের ধর্ম-পিতাদের নগরীতে দৈহিকভাবে ‘প্রত্যাবর্তন’। ইসলাম এখন এসব প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে এমনভাবে অবয়বগতভাবে নিজেকে স্থাপন করতে পারে যা পবিত্র কোরআনের স্বপ্নাবিভাবের ধারাবাহিকতা ও সামগ্রিকতা প্রতীকীভাবে ফুটে ওঠে। বিশ্বকে পবিত্র করার মিশনে মুসলিমদেরও কর্তব্য রয়েছে একটি স্থানকে আবার পবিত্র করার, যা ভয়াবহভাবে অপবিত্র হয়ে গেছে। 

প্লাটফর্মটি পরিষ্কার হওয়ামাত্র ইসলামে ধর্মান্তরিত ও ইসরাইলিয়াত (আমরা তাকে বলতে পারি ‘ইহুদি স্টাডিজে’ বিশেষজ্ঞ) ইহুদি কাব ইবনে আহবারকে তলব করেন। ইহুদিদের পূর্বপুরুষদের কাছে পবিত্র স্থানটি সম্পর্কে জানার জন্য মুসলিমদেরকে ইহুদিদের সাথে পরামর্শ করাই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। ইহুদি ও মুসলিম উভয় সূত্রই স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, মাউন্টটির পুনরুদ্ধারে ইহুদিরা অংশগ্রহণ করেছিল। বলা হয়ে থাকে, তাইবেরিয়াস থেকে আসা একদল রাব্বিকে নিয়ে উমর জেরুসালেম ঘুরেছিলেন। দশম শতকের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আবু জাফর আত- তাবারি বলেন, দাউদ, সোলায়মান ও টেম্পল-সম্পর্কিত কাহিনী থাকা পবিত্ৰ কোরআনের ১৭ ও ১৮ তম সুরা তিলায়াত করতে করতে কাবের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন উমর। তারপর মাউন্টের কোন স্থানটি নামাজের জন্য সর্বোত্তম তা বলতে বলেন কাবকে। কাব টিলা (পাথর) বা রকটির উত্তরের একটি স্থান দেখিয়ে দেন। ধারণা করা হয় (প্রায় নিশ্চিতভাবেই তা ছিল ভ্রান্ত) যে এটি ছিল দেভিরের স্থান। মুসলিমেরা যদি সেখানে নামাজ পড়ে তবে নিশ্চিতভাবেই তারা মক্কা ও ইহুদি হলি অব হলিস উভয়টির সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবে। ১৩ এটি নিশ্চিতভাবেই কিংবদন্তি। কারণ রকের (টিলা) প্রতি মুসলিমদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল মাত্র ৫০ বছর আগে। তবে কাহিনীটি প্রকাশ করছে, অপেক্ষাকৃত পুরনো বিশ্বাসগুলোর ইসলামি স্বাধীনতার নীতিমালা ধারণ করেছিল মুসলিমেরা। কাবের পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে উমর প্লাটফর্মের দক্ষিণ প্রান্তে তার মসজিদ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেটি ছিল হেরডের রয়্যাল পর্টিকো। এখানেই বর্তমান আল- আকসা দাঁড়িয়ে আছে। এখানে কেবল নামাজ পড়ার সময় মুসলিমেরা মক্কার দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। উমরের মসজিদটি ছিল প্রাথমিক যুগের সংযমী আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাদামাটা কাঠের ভবন। প্রথম যে ব্যক্তি এ মসজিদটি সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন তিনি হলেন খ্রিস্টান তীর্থযাত্রী আরকাফ। তিনি ৬৭০ সালে জেরুসালেম সফর করে জমকালো টেম্পলের সম্পূর্ণ বিপরীত স্থাপনা হিসেবে অভিহিত করেছেন : ‘স্যারাসেনরা এখন প্রায়ই চার দেয়ালের ইবাদতগৃহ নির্মাণ করে। তারা এগুলো তৈরি করে সাদাসিধাভাবে। এটি তৈরি করা হয়েছে ধ্বংস্তুপের অবশিষ্টাংশের ওপর বোর্ড ও বিমের ওপর। তবে এটি ছিল বিশাল। এখানে তিন হাজার লোক নামাজ আদায় করতে পারত। এই সময়ের মধ্যে এই অঞ্চলের আরব গোত্রগুলো ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে। তারা জুমার নামাজ আদায়ের জন্য উমরের মসজিদে সমবেত হতো। 

নগরীর খ্রিস্টানদের কাউকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়নি। বস্তুত অষ্টম শতকের আগে পর্যন্ত ধর্মান্তরিত উৎসাহিত করা হতো না। তাবারি উমর ও জেরুসালেমের খ্রিস্টানদের মধ্যে একটি সমঝোতার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এটি সত্য ছিল না, তবে এটি নির্ভুলভাবে বিজিত লোকজনের ব্যাপারে মুসলিমনীতি প্রকাশ করে। 

[উমর] তাদের প্রতিটি ব্যক্তির ও তাদের সম্পত্তির নিরাপত্তা মঞ্জুর করেন : তাদের চার্চগুলো, তাদের ক্রুশগুলোর, অসুস্থ ও স্বাস্থ্যবান লোকদের প্রতি, তাদে ধর্মের সব লোকের প্রতি। তাদের চার্চগুলোতে আমরা মুসলিম সৈন্যদের মোতায়েন করব না। আমরা তাদের চার্চগুলো ধ্বংস করব না, সেখানে থাকা তাদের মালামাল, সম্পত্তি, ক্রুশ বা অন্য কোনো কিছুরই ক্ষতি করব না। আমরা তাদের বিশ্বাস পরিত্যাগ করার জন্য জেরুসালেমের লোকজনকে বাধ্য করব না, তাদেরকে কোনো ধরনের ক্ষতি করব না।১৫ 

ইসলামি সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রজার মতো ফিলিস্তিনের ইহুদি ও খ্রিস্টানেরা জিম্মি (সুরক্ষিত সংখ্যালঘু) হয়। তাদেরকে আত্মরক্ষার সব উপায় ত্যাগ করতে হয়েছিল, অস্ত্রও ধারণ করতে পারত না। এর বদলে মুসলিমরা জিজিয়ার পরিশোধকারী জিম্মিদের সামরিক সুরক্ষা দিত। জেরুসালেমে সম্ভবত প্রতিটি পরিবারকে বছরে এক দিনার করে দিতে হতো। বাইরে থেকে ইসলামি সাম্রাজ্যে প্রবেশ করলে খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের এক দিনার করে দিতে হতো, যাতে তাদের অবস্থানকালে তারা জিম্মিতে পরিণত হতে পারে। ১৬ জিম্মিব্যবস্থা নিখুঁত ছিল না। পরে ইসলামি আইন কিছু পরিবর্তন করে আরো অপমানজনক বিধান করা হয় : জিম্মিরা অনুমতি ছাড়া নির্মাণ করতে পারবে না; তাদের উপাসনার স্থানগুলো কোনোভাবেই মসজিদের চেয়ে উঁচু হতে পারবে না; জিজিয়া প্রদানের সময় তাদেরকে অবনত হতে হবে; ঘোড়ার পিঠে চড়া নিষিদ্ধ থাকবে; আলাদা পরিচিতিসূচক পোশাক পরতে হবে। অবশ্য এসব বিধিনিষেধ কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করা হতো না। এই ব্যবস্থা জিম্মিদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিলেও সাম্য দেয়নি : তাদেরকে মুসলিমদের প্রজা হয়ে মুসলিমদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিতে হয়েছে। তবে এর ফলে বিভিন্ন বিশ্বাসের লোকজন তুলনামূলক সম্প্রীতির সাথে সহাবস্থান করতে পেরেছিল, সামগ্রিকভাবে প্রজা সাধারণের সাথে সৌজন্যতা আইনগতভাবে আচরণ করা হতো। এটি ছিল বায়েজান্টাইন আইনের বিপুল অগ্রগতি। বায়েজান্টাইন আইনে মনোফাইসিত, সামারিতান ও ইহুদিদের মতো সংখ্যালঘুদের ক্রমবর্ধমান হারে নির্যাতন করা হতো। 

ফলে স্বাভাবিকভাবেই নেস্টোরিয়ান ও মনোফাইসিত খ্রিস্টানদের মুসলিমদের স্বাগত জানিয়েছিল এবং বায়েজান্টাইনদের চেয়ে ইসলামকে বেশি পছন্দ করেছিল। দ্বাদশ শতকের ইতিহাসবিদ মাইকেল দি সিরিয়ান লিখিছেন, ‘তারা ধর্মের ব্যাপারে জানতে চায় না, মুরতাদ ও দুষ্ট জাতি গ্রিকদের মতো ধর্মের কারণে কাউকে নির্যাতন করে না।’ অর্থোডক্স খ্রিস্টানদেরকে সমন্বয় সাধন করার জন্য অনেক বেশি কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। উমরকে টেম্পল মাউন্টে দাঁড়াতে দেখে সফ্রোনিয়াস কেঁদেছিলেন। তার নবী দানিয়েলের ভবিষ্যদ্বাণী ‘জনমানবশূন্যতার ঘৃণার’ কথা স্মরণ হয়েছিল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভগ্ন হৃদয়ে তিনি মারা গিয়েছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে। অনেক খ্রিস্টান মহাপ্রলয়ী কল্পনাবিলাসে থাকত। তারা ভাবত, কোনো গ্রিক সম্রাট জেরুসালেম মুক্ত করে খ্রিস্টের দ্বিতীয় আবির্ভাবের পথ প্রস্তুত করে দেবেন। ১৮ জেরুসালেমের খ্রিস্টানেরা এখন নিজেদেরকে কনস্টানটিনোপল থেকে বিচ্ছিন্ন দেখতে পেল। কনস্টানটিনোপল তাদের ব্যাপারটি পুরোপুরি ভুলে গেল। ৬৯১ সালের আগে পর্যন্ত সফ্রোনিয়াসের স্থানে আর কোনো প্যাট্রিয়ার্ক নিয়োগ করা হয়নি। তাদেরকে টেম্পল মাউন্টের পরিবর্তন দেখতে হচ্ছিল। এটির অপবিত্রকরণ তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অনেকে সম্ভবত মনোস্তাত্ত্বিক অস্বীকারকরণ নীতির আশ্রয় নিতে চাইছিল : আরকাফের মতো খ্রিস্টান তীর্থযাত্রী তাদের পবিত্র নগরীতে মুসলিমদের উপস্থিতির কথা খুব কম উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত খ্রিস্টনেরা অবচেতনভাবে বিশ্বাস করত, তারা ‘স্যারাসেনদের’ অগ্রাহ্য করতে পারলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না।১৯ এটি করা তাদের জন্য কঠিন ছিল না। নগরীতে খ্রিস্টানেরা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রেখেছিল, এমনকি মুসলিমেরাও স্বীকার করত যে জেরুসালেম অনেকটাই জিম্মিদের নগরী। খ্রিস্টানদের পবিত্র স্থানগুলোর প্রায় সবই ওয়েস্টার্ন হিলকে কেন্দ্র করে ছিল। এটি পুরোপুরি খ্রিস্টান এলাকায় রয়ে যায়। মুসলিম বিজয়ীরা শহরের ওই অংশে বসতি স্থাপন করেনি, এমনকি যদিও তাদের হারামের পাদদেশে থাকা তাদের মহল্লাগুলোর চেয়ে খ্রিস্টানদের ওই এলাকা ছিল অনেক শীতল ও স্বাস্থ্যকর। মুসলিমদেরও ওইসব চার্চে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। চার্চগুলোর বেশির ভাগই ছিল মাউন্ট অলিভেস ও কিদরন ভ্যালিতে। বিশেষ করে অ্যাসেনশন চার্চ ও ভার্জিন টম্ব উভয়টিই ছিল স্মারক স্থান ও ঘটনা, মুসলিমেরা এসবকে শ্রদ্ধা করত। খ্রিস্টানদেরকে অবাধে তাদের চার্চ নির্মাণ ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া হতো। বস্তুত সপ্তম ও অষ্টম শতকে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে অনেক চার্চ নির্মিত হয়েছিল। খ্রিস্টানদেরকে তখনো তাদের শোভাযাত্রা ও উপাসনা করতে দেওয়া হতো। একমাত্র যে স্থানে মুসলিমরা বিপুল সংখ্যায় সমবেত হতো, তা হলো তাদের হারাম। আর এই পুরনো টেম্পল ও এ স্থানটি খ্রিস্টান উপাসনাব্যবস্থায় কোনোই ভূমিকা পালন করত না। 

বিজয়ের পরপরই সফ্রোনিয়াসের সাথে উমর একমত হন যে ইহুদিদেরকে জেরুসালেমে বসবাস করার অনুমতি দেওয়া হবে না। কোনো নতুন নগরী জয়ের পর উমর সাধারণত স্থিতিবস্থা বজায় রাখতেন। ইহুদিরাও জেরুসালেম ও এর আশপাশের এলাকায় দীর্ঘ দিন নিষিদ্ধ ছিল। অবশ্য পরে ইহুদিদের নিষিদ্ধ রাখার ব্যবস্থাটি বাতিল করা হয়। দাউদের নগরীতে ইহুদিদের বসবাস করার ইহুদিদের অধিকার অস্বীকার করার কোনো যুক্তিসম্মত কারণ পাওয়া যায়নি। জেরুসালেমে বসবাস করার জন্য উমর তাইবেরিয়াস থেকে ৭০টি ইহুদি পরিবারকে আমন্ত্রণ জানান। তাদেরকে হারামের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সিলয়াম পুলের পাশ্ববর্তী এলাকায় বাস করতে বলা হয়। ৬১৪ সালে পারস্য বিজয়ের সময় এ এলাকাটি বিধ্বস্ত হয়েছিল, তখনো জঞ্জাল আর আবর্জনায় ভরা ছিল। ইহুদিরা এলাকাটি পরিষ্কার করে নেয়, পুরনো পাথরগুলোতে নতুন বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করে। তাদেরকে একটি সিনাগগ নির্মাণ করারও অনুমতি দেওয়া হয়। ‘দি কেভ’ নামের এ সিনাগগটি ছিল হেরডের পশ্চিম দিকের সহায়ক প্রাচীরের কাছে, সম্ভবত প্লাটফর্মের খিলানের নিচে।২১ কোনো কোনো সূত্র জানায়, ইহুদিদেরকে খোদ প্লাটফর্মেই প্রার্থনা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, ঠিক যেভাবে মদিনার মসজিদে খ্রিস্টানদেরকে উপাসনা করতে দেওয়া হয়েছিল। কিছু জিম্মিকে (ইহুদি ও খ্রিস্টান) হারামের প্রহরী ও সেবক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। বিনিময়ে তাদেরকে জিজিয়া থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছিল।২২ ইহুদিরা সম্ভবত এই কাজে নিয়োজিত হতে ইচ্ছুক ছিল। কারণ মুসলিম বিজয় তাদেরকে নতুন আশা দিয়েছিল। বায়েজান্টাইন সম্রাটেরা ইহুদি ধর্ম নিষিদ্ধ করেছিলেন, হেরাক্লিয়াস একপর্যায়ে ইহুদিদেরকে ব্যাপ্তাইজ হতে বাধ্য করছিলেন। তারা পারস্যের আমলে যেভাবে সহায়তা করেছিল, মুসলিমদেরও সেভাবে সহায়তা করতে আগ্রহী ছিল, বিশেষ করে একেশ্বরবাদের এ নতুন সংস্করণটি খ্রিস্ট ধর্মের চেয়ে ইহুদি ধর্মের কাছাকাছি ছিল। সম্ভবত অনেকে বিশ্বাস করত যে ইসলাম হলো স্রেফ সত্য বিশ্বাসের ইসমাইলিয়াতে ধর্মান্তরিত হওয়ার একটি পর্যায় মাত্র। মুসলিমেরা কেবল বায়জান্টিয়াম নির্যাতন থেকেই তাদেরকে মুক্ত করেনি, সেইসাথে তাদের পবিত্র নগরীতে স্থায়ীভাবে বাস করার অনুমতিও দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এই বিপরীত অবস্থাটি কিছু মহাপ্রলয়বাদী স্বপ্নকে উদ্দীপ্ত করেছিল, বিশেষ করে মুসলিমেরা টেম্পল মাউন্ট পবিত্র করার চেষ্টা করায়। তারা কি মেসাইয়ার নতুন ও চূড়ান্ত টেম্পল নির্মাণের প্রস্তুতিপর্ব সারছে? সপ্তম শতকের শেষ দিকে একটি হিব্রু কবিতায় আরবদেরকে মেসাইয়ার অগ্রদূত হিসেবে প্রশংসা করা হয়েছে। এতে ইহুদি নির্বাসিতদের একত্রিত করা ও টেম্পল পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। ২৩ এমনকি মেসাইয়া যখন আবির্ভূত হতে ব্যর্থ হলেন, তখনো জেরুসালেমে ইসলামি শাসনের ব্যাপারে ইহুদিরা অব্যাহতভাবে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করত। একাদশ শতকে লিখিত একটি চিঠিতে জেরুসালেমের রাব্বিরা ‘ইসমাইলের রাজ্যকে’ ফিলিস্তিন জয়ের সুযোগ দিয়ে তাদের জনগণের প্রতি ঈশ্বরের ‘করুণা’ প্রদর্শনের কথা স্মরণ করেছেন। তারা স্মরণ করে খুশি হয় যে মুসলিমেরা যখন জেরুসালেমে আসে তখন ইসরাইলের সন্তানেরা তাদের সাথে ছিল; তারা টেম্পলের স্থানটি তাদেরকে দেখিয়ে দেয় এবং তারা এই দিনটি পর্যন্ত তাদের সাথে বাস করছে।’২৪ 

মুসলিমদের ফিলিস্তিন জয়ের অর্থ দেশটি রাতারাতি হিজাজের আরবদের হয়ে যায়নি। জাতিগতভাবে ফিলিস্তিনি জনগণ আগের মতো মিশ্রই ছিল। নতুন ভূখণ্ডে মুসলিম বিজয়ীদের বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তারা তখনো ক্ষুদ্র সামরিক জাতি হিসেবে রয়ে গিয়েছিল, তারা স্থানীয় জনগণের থেকে আলাদা হয়ে বিশেষ সামরিক কম্পাউন্ডে বাস করত। কিছু জেনারেলকে এস্টেট নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবে তা কেবল কারো নিয়ন্ত্রণে নয়, এমন এলাকায়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, জেরুসালেমে মুসলিমেরা শহরে অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যপ্রদ অংশে বসতি স্থাপনের কোনো চেষ্টা করেনি। তারা বরং ইহুদি মহল্লার পাশে তাদের হারাম এলাকায় বাস করছিল। জেরুসালেম একটি মুসলিম পবিত্র এলাকা-সংবলিত খ্রিস্টান-প্রধান নগরীই রয়ে গিয়েছিল। একবার মুহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন, যে আরবিতে কথা বলবে, সে আরব, যেভাবে গ্রিক ভাষাভাষীদের হেলেনি বলা হতো। সময়ের পরিক্রমায় অধিবাসীরা আরবিকেই তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। আর এর ফলেই আমরা তাদের বংশধরদের (মুসলিম ও খ্রিস্টান) বলি আরব। 

মুসলিমেরা ফিলিস্তিনে তাদের নিজস্ব প্রশাসন চালু করার সময় তারা পুরনো বায়েজান্টাইন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছিল। এতে দেশটিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা ছিল। এখন জেরুসালেম অন্তর্ভুক্ত হলো জান্দ ফিলাস্তিনের। এতে সামিল ছিল জুদা ও সামারিয়ার উপকূলীয় সমভূমি। জান্দ উরদুনে ছিল গ্যালিলি ও পেরাইয়ের পশ্চিম অংশ। আর জান্দ দিমাশক ছিল মোয়াব ও ইদম নিয়ে। আরবেরা জেরুসালেমকে বায়তুল মুকাদ্দিস বা ‘আলিয়া’ বলা অব্যাহত রাখে। নগরীর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা প্রকাশ পায় যেসব প্রতিভাধর লোককে তারা এই নগরী শাসনের জন্য নিযুক্ত করেছে তাদের দেখে। পরবর্তী সময়ের খলিফা মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান পুরো সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের (আরবরা একে বলত আস-শ্যাম) গভর্নর হন। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম অফিসার উওয়াইমির ইবনে সাদকে জান্দ ফিলাস্তিনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জিম্মিদের প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণের জন্য তার সুখ্যাতি ছিল। পবিত্র কোরআনের শীর্ষ পাঁচ বিশেষজ্ঞের অন্যতম উবায়দা ইবনে আস-সামিত হন জেরুসালেমের প্রথম কাজি (ইসলামি বিচারপতি)। ফাইরুজ আল-দাইলামি ও শাদ্দাদ ইবনে আউসের মতো মহানবীর প্রখ্যাত সাহাবাদের আকৃষ্ট করে নগরীর পবিত্ৰতা। 

শুভ সূচনার পর ৬৪৪ সালে এক পারসিক যুদ্ধবন্দির হাতে উমর নিহত হলে ইসলামি সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার বিপদে পড়েছিল। ধর্মের অন্যতম দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এটি প্রায়ই তার সবচেয়ে মূল্যবান আদর্শগুলোই পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। এ কারণেই ভালোবাসার ধর্ম খ্রিস্টান ধর্ম জেরুসালেমে প্রায়ই নিজেকে ঘৃণা আর বিদ্বেষে প্রকাশ করেছে। আর এখন ঐক্য ও একীভূত করার বিশ্বাস ইসলামও অনৈক্য ও বিভেদের শিকার হলো। উম্মাহর নেতৃত্ব নিয়ে মুহাম্মদের (সা.) মৃত্যুর পর থেকেই খলিফা ও নবীর পরিবারের মধ্যে উত্তেজনা ছিল। শেষ পর্যন্ত এই সঙ্ঘাত সুন্নি/শিয়া ভাঙনের সৃষ্টি করে। উমরের স্থলাভিষিক্ত হন উসমান ইবনে আফফান। তিনি ছিলেন নবীর সাহাবা ও অভিজাত উমাইয়া গোত্রের সদস্য। জেরুসালেমে তার প্রধান অবদান ছিল নগরীর গরিব মানুষের জন্য সিলোয়াম পুলে বিশাল একটি গণউদ্যান নির্মাণ করে দান করে দেওয়া। উসমান ধার্মিক হলেও অকার্যকর নেতা ছিলেন। ৬৫৬ সালে একদল লোকের হাতে তিনি নিহত হন। তারা নবীর ঘনিষ্ঠতম জীবিত পুরুষ স্বজন আলী ইবনে তালিবকে চতুর্থ খলিফা ঘোষণা করেন। সাথে সাথে আলী ও শ্যামের শাসক ও বর্তমানে উমাইয়া গোত্রের শাসক মুয়াবিয়ার মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মুয়াবিয়া জোর দিয়ে বললেন, উসমানের হত্যাকারীদের শাস্তির জন্য তার হাতে তুলে দিতেই হবে। ৬৬১ সালে নতুন একটি ধর্মান্ধ গ্রুপের জনৈক সদস্যের হাতে আলী নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত যুদ্ধ চলতেই থাকে। ছয় মাস পর জেরুসালেমে নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন মুয়াবিয়া। মুয়াবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের প্রথম খলিফা। এ রাজবংশটি প্রায় এক শ’ বছর ইসলামি সাম্রাজ্য শাসন করে। 

মুয়াবিয়া সাথে সথে সাম্রাজ্যের রাজধানী মদিনা থেকে দামেস্কে সরিয়ে নেন। এর মানে এই নয় যে তিনি পুরনো ধর্মীয় আদর্শ পরিত্যাগ করেছেন, অবশ্য এমনটাই অনেক সময় বলা হয়ে থাকে। মুসলিমেরা এখন পূর্বে খোরাসান থেকে বর্তমানে উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত একটি সাম্রাজ্য শাসন করছে। উমাইয়া আমলের শেষ দিকে ইসলামি সাম্রাজ্য জিব্রাল্টার থেকে হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, রাজধানী ছিল অনেক বেশি কেন্দ্রীয় ও মুসলিমেরা তাদের জয় করা ভূখণ্ডগুলোতে নিজেদের পুরোপুরি একীভূত করে নিয়েছিল। বিশ্বকে পবিত্র করার মুসলিম মিশনও ছিল এতে : মুসলিমদের অবশ্যই সামনে অগ্রসর হতে হবে, দেশের পবিত্র স্থানগুলোতে আঁকড়ে ধরে না থেকে সাম্রাজ্যের বাইরে আল্লাহর পবিত্রতা ছড়িয়ে দিতে হবে। রাজধানী দামাস্কাসে সরিয়ে নেওয়াটা জেরুসালেমের জন্য কল্যাণকর হয়েছিল। জেরুসালেম এখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর কাছাকাছি থেকে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছিল। মুয়াবিয়া প্রায় ২০ বছর আস-শ্যামের গভর্নর ছিলেন। তিনি জেরুসালেমকে ভালোবাসতে শিখেছিলেন। তিনি ফিলিস্তিনে গেলে নগরীতে যেতেনই। এমনকি একবার সেখানে তাকে হত্যা করার চেষ্টা সত্ত্বেও নগরীতে যাওয়া থেকে বিরত থাকেননি। মুসলিমেরা বায়তুল মুকাদ্দিস নিয়ে তার প্রশংসাবাক্য সংগ্রহ করে রেখেছে। এতে দেখা যায়, মুসলিমেরা জিম্মিদের কাছ থেকে জেরুসালেমের লোকঐতিহ্য আত্মস্ত করেছিল। নগরী ছিল এমন স্থান যেখানে কিয়ামতের দিনে লোকজন আবার জন্ম নিয়ে সমবেত হবে।’ এটি এমন এক স্থান, যেখানে বসবাস করলে লোকজন পবিত্র হয়ে যায়। আর সমগ্র আস-শ্যাম হলো ‘আল্লাহর পছন্দের ভূমি, যেখান থেকে আল্লাহ তার দাসদের পরিচালনা করবেন।’ একবার হারামে খুতবা দেওয়ার সময় খলিফা বলেন, ‘আল্লাহ বিশ্বের অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে এই মসজিদের দুই দেয়ালের মাঝখানের স্থানকে বেশি ভালোবাসেন।’২৫ সেখানে বসবাসরত মুসলিমেরা মক্কা থেকে অনেক দূরে বাস করলেও জেরুসালেম হারামের মধ্যে এর পবিত্রতা উপভোগ করতে পারত। 

মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যে আরো বিবাদের সৃষ্টি হয়। অনেক মুসলিমই তার ছেলে ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ৬৮০ সালে আলীর ছেলে ও নবীর নাতি আল- হোসাইন উমাইয়াদের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাকে তার অতি ক্ষুদ্র দলের সাথে ইরাকের কারবালায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে শিয়াদের কাছে কারবালা পবিত্র নগরীতে পরিণত হয়। শিয়ারা বিশ্বাস করত, উম্মাহ পরিচালিত হওয়া উচিত মুহাম্মদের (সা.) বংশধরদের দিয়ে। কারবালার পবিত্রতা সত্ত্বেও শিয়ারা এখনো মুহাম্মদ (সা.) ও আলীর বংশধর তাদের ইমামদের (নেতা) প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রতিটি ইমাম তার প্রজন্মের কাছে কুতুব বিবেচিত। পূর্ণাঙ্গ মানব মুহাম্মদের (সা.) পবিত্রতা লাভ করে তিনি মুসলিমদের সরাসরি বেহেশতে প্রবেশের সুযোগ দিতে পারেন। 

উমাইয়াদের বিরুদ্ধে ৬৮৩ সালে আরেকটি বিদ্রোহ ঘটে। এসময় খলিফা ইয়াজিদ মারাত্মক অসুস্থ ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আল-জুবায়ের নিজেকে খলিফা ঘোষণা করে পবিত্র নগরী মক্কা দখল করে নেন। তিনি ৬৯২ সাল পর্যন্ত সেখানে ক্ষমতায় থাকলেও সমগ্র উম্মাহর সমর্থন লাভ করতে পারেননি। ইয়াজিদের মৃত্যুর পর মারওয়ান (৬৮৪-৮৫) ও তার ছেলে আবদুল মালিক (৬৮৫-৭০৫) সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিসর এবং তারপর সাম্রাজ্যের বাকি অংশে উমাইয়া ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবদুল মালিক ছিলেন বিশেষভাবে সক্ষম শাসক। নতুন আরব প্রশাসনে পুরনো বায়েজান্টাইন ও পারস্য ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করেন তিনি। ধর্মতাত্ত্বিক আদর্শে একটি কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্র গঠন করেন তিনি।

খলিফা আবদুল মালিকের নির্মিত ডোম অব দি রক (কুব্বাতুস সাখরা) সম্পূর্ণ হয় ৬৯১ সালে। টেম্পল মাউন্ট পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সেখানে প্রথম প্রধান ইসলামি ভবন নির্মাণের মাধ্যমে মুসলিমরা তাদের প্রত্যয় ঘোষণা করল যে তাদের নতুন বিশ্বাস অপেক্ষাকৃত পুরনো ঐতিহ্যগুলোর পবিত্রতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। 

শান্তি ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরপরই খলিফা আবদুল মালিক জেরুসালেমের দিকে নজর দেন। অন্য সব উমাইয়ার মতো তিনিও ছিলেন জেরুসালেমের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। তিনি সাম্প্রতিক গোলযোগে ক্ষতিগ্রস্ত নগরীর প্রাচীর ও প্রবেশদ্বারগুলো মেরামত করেন। তিনি আলিয়ার গভর্নরের জন্য বাসভবন দার ইমামা নির্মাণ করেন। এটি ছিল হারামের কাছে। তবে নগরীর প্রতি আবদুল মালিকের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল সন্দেহাতীতভাবে ডোম অব দি রক বা কুব্বাতুস সাখরা। ৬৮৮ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। ইসলামের নিজস্ব একাধিক পবিত্র স্থান ছিল; এর অনন্য শক্তি ও সৌন্দর্যের একটি আরবি ধর্মগ্রন্থও রয়েছে। তবে ইসলামের মহান কোনো সৌধ ছিল না। আবার জেরুসালেম ছিল এমন এক নগরী যেখানে চমকপ্রদ অনেক চার্চে ভর্তি। মুসলিমেরা এতে অস্বস্তি অনুভব করত। তারা খ্রিস্টানদের কিছু দেখাতে চেয়েছিল। হারামে থাকা তাদের সাদামাটা কাঠের মসজিদটির প্রতি উন্নাসিকতা-সংবলিত আরকাফের প্রতিক্রিয়া যদি খ্রিস্টান সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে, তবে তাদেরও প্রকাশের প্রবল দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। দশম শতকে জেরুসালেমের ইতিহাসবিদ মোকাদাসি উল্লেখ করেছেন যে আস-শ্যামের সব চার্চ এত ‘সুন্দর’ এবং ‘ডোম অব কামামা’ এত মহান ও চমকপ্রদ যে আবদুল মালিক ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে ‘এটি মুসলিমদের মনকে ধাঁধিয়ে দেবে।’ তারা এমন একটি সৌধ বানাতে চাইল যা হবে ‘বিশ্বে অনন্য ও বিস্ময়কর।২৬ এ কারণে আবদুল মালিক ডিক্রি জারি করলেন যে ওয়েস্টার্ন হিলের ডোম অব আনাস্তাসিস ও মাউন্ট অলিভেসের অনন্যসাধারণ অ্যাসেনসন চার্চকে (এটি রাতে উদ্ভাসিত হতো, এত উজ্জ্বলভাবে দীপ্তমান হতো যে এটিই পরিণত হয়েছিল জেরুসালেমের অন্যতম দর্শনীয় বস্তু) চ্যালেঞ্জ করে নতুন ডোম নির্মাণ করা হবে। ২৭ নতুন মুসলিম স্থাপনাটি যাতে একই ধরনের দীপ্তমান হয় তা নিশ্চিত করার জন্য আবদুল মালিক বায়েজান্টাইন থেকে কারিগর ও স্থপতি নিয়োগ করেন। নির্মাণকাজের দায়িত্বে থাকা তিনজনের দুজন ছিলেন খ্রিস্টান। ২৮ জিম্মিদের থেকে এই সুবিধা গ্রহণ করা সত্ত্বেও প্রথম মহান মুসলিম উপাসনালয়টি সন্দেহাতীতভাবে ইসলামি বার্তা বহন করত। 

খলিফা তার ডোম নির্মাণের জন্য এমন একটি টিলা বেছে নিয়েছিলেন যা প্লাটফর্মের উত্তর প্রান্তের দিকে হেরডিয়ান ফুটপাথ থেকে ছাড়িয়ে গেছে। সম্মান জানাতে তিনি কেন বাইবেল বা পবিত্র কোরআনের কোথায় উল্লেখ না থাকা এ টিলাকে বেছে নিয়েছিলেন? পরে মুসলিমেরা বিশ্বাস করেছিল যে মিরাজের সময় মুহাম্মদ (সা.) এ টিলা থেকেই বেহেশতে গিয়েছিলেন এবং এর নিচে থাকা ছোট গুহায় তিনি নামাজ পড়েছিলেন। তবে ৬৮৮ সালে এ ঘটনাটি সুনির্দিষ্টভাবে জেরুসালেমের সাথে সম্পর্কিত ছিল না। আবদুল মালিক যদি নবীর মিরাজ যাত্রার সাথে এই সৌধের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেন, তবে তিনি নিশ্চিতভাবেই স্থাপনাটির কোথাও যথাযথ কোরআনিক আয়াত খোদাই করে রাখতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। টিলাটির প্রতি ভক্তির সূচনা কোথা থেকে তা তিনি জানতেন না। বদুর তীর্থযাত্রীটি ইহুদিদের টেম্পল মাউন্টের ‘প্রবিষ্ঠ পাথরকে’ তেলসিক্ত করতে দেখেছেন। তবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যে সেটি ছিল ওই টিলাটি। দ্বিতীয় শতকে মিসনাতে ‘ভিত্তি পাথরের (ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠান) কথা বলা হয়েছে। এটি দাউদ ও সোলায়মানের আমল থেকে আর্কের পাশে ছিল। কিন্তু রাব্বিরা আমাদের বলছেন না যে পাথরটি এখনো হেরডের টেম্পলের কোনো স্থানে আছে কিনা। এমনকি তারা বিধ্বস্ত টেম্পল মাউন্টের ওপর থাকা টিলা বা রকের সাথেও একে গুলিয়ে ফেলছেন না। খুব সম্ভবত, ইহুদি ও মুসলিম উভয়ই ধরে নিয়েছিল যে রকটি টেম্পলের হলি অব হলিসের স্থানটি চিহ্নিত করে। অবশ্য বর্তমান সময়ের গবেষকেরা একমত যে তথ্যটি সত্য নয়। ২৯ যদি সেটিই হতো, তারা স্বাভাবিকভাবেই রকটিকে ‘পৃথিবীর কেন্দ্র’ হিসেবে তথা বেহেশতে প্রবেশের পথ হিসেবেই দেখা হতো। ডোম অব দি রক নির্মাণের পর ইহুদি ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনই রক সম্পর্কে কিংবদন্তি সৃষ্টি করে। এর ফলে ইহুদি কল্পনা হয়তো মুসলিম ইবাদতগাহকে উদ্দীপ্ত করে থাকতে পারে। ইহুদি ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনই রককে পৃথিবীর কেন্দ্র, ইডেন উদ্যানের প্রবেশপথ ও উর্বরতার উৎস টেম্পলের ভিত্তি বিবেচনা করত। একেশ্বরবাদী পবিত্র স্থানের সাথে এগুলোর সবই ছিল কাল্পনিক সম্পৃক্ততা। একেবারে শুরুর সময় থেকেই মুসলিমেরা মনে করত, নতুন ইবাদতগাহে সফর করা হলে তারা বেহেশতে আদি সম্প্রীতিতে ফিরে যেতে পারবে। 

অনেক বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে আবদুল মালিক নিজে থেকে স্থানটি পছন্দ করেননি। তাদের তত্ত্ব হলো, পারস্য দখলদারিত্বের সময় ইহুদিরা মাউন্টের ওপর তাদের টেম্পল নির্মাণকাজ শুরু করেছিল। হেরাক্লিয়াসের নগরীটি ফের জয় করার পর তিনি পারস্য ও ইহুদি ধর্মের বিরুদ্ধে খ্রিস্ট ধর্মের বিপুল বিজয় উদযাপনের লক্ষ্যে একটি অষ্টাকোণি বিজয় চার্চ নির্মাণ করেছিলেন। এর ভিত্তি স্থাপিত হলেও আরবরা ফিলিস্তিন আক্রমণ করলে তাদের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত করতে হয়েছিল। ৬৮৮ সালে ডোম অব দি রকের কাজ শুরু হলে এসব বায়েজান্টাইন ভিত্তির ওপরই আবদুল মালিক নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইসলামি বিশ্বে অনন্য একটি ভবন নিয়ে এটিকে বিতর্কিত তত্ত্বই বলা যায়। ডোম অব দি রক কিন্তু মসজিদ নয়। এটি কিবলার দিক নির্দেশ করে কোনো চিহ্ন নেই, নামাজ পড়ার কোনো জায়গাও এখানে নেই। বরং রকটি কেন্দ্রীয় অবস্থান গ্রহণ করেছে, এর চারপাশে ৪০টি স্তম্ভ দিয়ে দুটি বৃত্তকার হাঁটার পথ করা হয়েছে। ডোম অব দি রক একটি উপাসনালয়, একটি স্মারকচিহ্ন। অবশ্য এটি জেরুসালেমের অস্বাভাবিক কোনো ভবন নয়। এর চারপাশে রয়েছে বিখ্যাত সব চার্চ। এগুলো সবাই উজ্জ্বল টিলা (রক) আর গুহা : অনাস্তাসিস রোতানদা গুহা-কবরের পাশে; ম্যারিটিরিয়ামে রয়েছে গলগোথা রক; ন্যাটিভিটি চার্চ হলো খ্রিস্টের জন্মস্থানের ওপর; অ্যাসেনসন চার্চটি যিশুর পায়ের ছাপবিশিষ্ট টিলাকে ঘিরে নির্মিত। এসব স্থানের সবগুলোই অবতারের স্মরণে তৈরি। এই প্রেক্ষাপটে আবদুল মালিকের চমকপ্রদ নতুন ভবনটি আগের ওইসব ক প্রত্যাখ্যান করে মাথা উঁচু করেছে। 

ডোমের ভেতরে আর্চগুলোর ওপর প্রধান খোদাইলিপিগুলোতে থাকা কোরআনের আয়াতগুলোতে অনন্যভাবে ঈশ্বরের সন্তান থাকার ধারণাটি অস্বীকার করা হয়েছে। এতে ‘গসপেলের অনুসারীদের’ উদ্দেশ করে তাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে ভ্রান্ত ও বিপজ্জনক বক্তব্যের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে : 

মরিয়ম-তনয় ঈসা মসিহ আল্লাহর রাসুল এবং তার বাণী যা তিনি মরিয়মের কাছে প্রেরণ করিয়েছিলেন ও তার আদেশ। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তার রাসুলে ঈমান আনো এবং বলো না তিন। নিবৃত্ত হও, এটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর হবে। আল্লাহ তো একমাত্র ইলাহ, তার সন্তান হবে- তিনি এর অনেক ঊর্ধ্বে। ৩১ 

জেরুসালেমে মুসলিমেরা ছিল সংখ্যালঘু। খ্রিস্টান সংখ্যাগুরুরা সম্ভবত তাদের বিজয়ীদের তাচ্ছিল্য করত, তাদেরকে মনে করত আদিম বর্বর। তবে ডোম অব রক জেরুসালেমের সবচেয়ে প্রাচীন পবিত্র স্থান থেকে রাজসিকভাবে মাথা উঁচু করে নাটকীয়ভাবে জোরালোভাবে ঘোষণা করছিল যে ইসলামের আগমন ঘটেছে, এখানে সে এসেছে থাকার জন্য। এটি খ্রিস্টানদেরকে তাদের বিশ্বাস সংশোধন করার জন্য ও ইব্রাহিমের বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদে ফেরার জন্য কর্তৃত্বব্যঞ্জকভাবে আহ্বান জানাচ্ছিল। ৩২ 

ইহুদিরা অবশ্যই এই খোদাইলিপি অনুমোদন করেছিল। তাদের সবাই তাদের টেম্পল মাউন্টের ওপর এই মুসলিম ভবনের কর্ম-পরিকল্পনায় হতবিহ্বলভাবে তাকিয়েছিল তা নয়। ৭৫০ সালের দিকে ‘দি মিস্টরিয়াস অব দি রাব্বি সিমেয়ন বেন ইয়োহাই’-এর ইহুদি লেখক ভবনটিকে মেসাইনিক যুগের সূচনাপর্ব হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি মুসলিম খলিফাকে ইসরাইলের প্রেমিক’ হিসেবে প্রশংসা করে বলেছিলেন, তিনি ‘বিধ্বস্ত জায়ন ও বিধ্বস্ত টেম্পল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন।’ তিনি মাউন্ট মরিয়াহ ছিদ্র করে একে সমান করে টেম্পল রকের [ইভেন শেতিয়াহ} ওপর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন।৩৩ তবে ডোম অব দি রক ইহুদিদের প্রতিও বার্তা ছিল। এটি তাদের টেম্পলের (যা নির্মিত হয়েছিল যেখানে ইব্রাহিম তার ছেলেকে কোরবানি দিয়েছিলেন) স্থানটি দখল করেছিল। এখন ইসমাইলের সন্তানেরা এই পবিত্র স্থানে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। ইহুদিরাই কেবল ইব্রাহিমের সন্তান নয়, তাদের মনে রাখা উচিত যে তিনি না ছিলেন ইহুদি বা না ছিলেন খ্রিস্টান, বরং তিনি ছিলেন মুসলিম। 

এই সম্ভাবনাও প্রবলভাবে রয়েছে যে ডোম ব দি রকের মুসলিম পরিচিতি ঘোষণা করার চেয়ে অন্য একটি উদ্দেশ্যও ছিল। তা হলো, মক্কা থেকে হজ সরিয়ে নেওয়া। উল্লেখ্য, তখনো মক্কা ছিল ইবনে আল-জুবায়ের হাতে। এই তত্ত্ব প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন নবম শতকের ইতিহাসবিদ ইয়াকুবি। তিনি আমাদের বলছেন যে বৃত্তাকার হাঁটার পথটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল তাওয়াফ করার জন্য : ‘কাবার চার দিকে তাওয়াফ করার মতো করে লোকজনও [রকের] চার পাশে ঘুরতে শুরু করেছিল।৩৪ এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। তাওয়াফের জটিল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্য যে পরিমাণ জায়গার দরকার হয়, ডোম অব দি রকে তা ছিল না। তাছাড়া মক্কার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে কিছু নির্মাণের লক্ষ্য যদি খলিফার থাকত তবে তিনি কাবার স্রেফ নকল করেই কাজ সারতে পারতেন, এমন জটিল ও বিশাল ডোমের নক্সা করার কাজ না করলেও চলত। অন্য কোনো সমসাময়িক ইতিহাসবিদ খলিফার এ ধরনের ঈশ্বর-অবমাননামূলক প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেননি। কারণ ওই ধরনের প্রকল্পে পুরো মুসলিমবিশ্ব কষ্ট পেত। অন্য দিকে আবদুল মালিক মক্কা ও কাবার প্রতি গভীরতম ধর্মানুরাগ প্রদর্শন করতেন। ইয়াকুবি প্রবলভাবে উমাইয়াদের বিরোধিতা করতেন। ফলে এই তত্ত্বকে নিছক প্রপাগান্ডা হিসেবে খারিজ করা যেতে পারে। 

ডোম অব দি রকের অভ্যন্তর ভাগ। রক ও বৃত্তাকার ডোম সামগ্রিকতা ও পরিপূর্ণতার আধ্যাত্মিক আবেশ প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। 

ডোম অব দি রককে যদি জিম্মিদের বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হতো, তবে এটি কখনো মুসলিম জনসাধারণের হৃদয় জয় করতে পারত না। বরং, এটি পরবর্তীকালে সব মুসলিম ইবাদতগাহের বিশেষ উদাহরণে পরিণত হয়। তীর্থযাত্রী ও ইবাদতকারীরা এই ভবনে প্রবেশ করে দেখতে পেত যে এটি নিখুঁতভাবে এমন পথকে প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তুলেছে যা আল্লাহকে পাওয়ার জন্য এই পথে প্রবেশ করতে হবে। ৩৫ এ কারণে নক্সাটি হয়তো ইসলামি মরমিবাদ তথা সুফিদের নতুন আধ্যাত্মিকতাকে উদ্দীপ্ত করেছিল। এই সুফিরা একেবারে সূচনা থেকে জেরুসালেমে বাস করতে শুরু করেছিল। আমরা ইসলামে প্রতীকীবাদের গুরুত্ব দেখি। আল্লাহ যেহেতু তুলনীয় নন, তাই মুসলিমরা তাদের উপাসনার স্থানে মূর্ত চিত্রকলা নিষিদ্ধ করে। তবে জ্যামিতির নক্সা ও আকার অনুমোদিত হয়। কারণ তা কল্পনায় আদর্শ দুনিয়াকে প্রতিফলিত করে। নক্সা আর আকারগুলো অস্তিত্বের এমন অন্তর্নিহিত কাঠামোর ইঙ্গিত করে যা আল্লাহর সাথে সামঞ্জস্যতা বিধান করার জন্য, শান্তি ও ঐক্য খোঁজার জন্য তাদেরকে সাধনা করতে হবে। মক্কার হারামে বর্গাকার কাবাঘর তাওয়াফ করার দিকে চালিত করার মাধ্যমে দুনিয়া থেকে শ্বাশতের সফরকে প্রতিফলিত করে। জেরুসালেমের ইবাদতগাহে একই ধরনের রীতি রয়েছে। রক ও এর গুহাটি দুনিয়া, উৎস ও অনুসন্ধানের সূচনা বিন্দুকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরে। মুসলিমদের মনে হয়েছে, অষ্টাকোণে পরিবেষ্টিত থাকাটা বর্গের অপরিবর্তনীয় ধারণা থেকে এক ধাপ পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ। ফলে এটি সামগ্রিকতা, পূর্ণাঙ্গতা ও শ্বাশতের দিকে যাত্রার সূচনা ইঙ্গিত করে, ডোমের পূর্ণাঙ্গ বৃত্তে এরই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। 

মুসলিম স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া ডোম নিজেই বেহেশতে ঊর্ধ্বারোহণে শক্তিশালী প্রতীকে পরিণত হয়েছে। তবে এটি তৌহিদের পূর্ণাঙ্গ ভারসাম্যও প্রতিফলিত করে : আকাশের অসীমতায় দিকে পৌঁছে যাওয়ার এর বহির্ভাগ এর অন্তর্ভাগ মাত্রার নিখুঁত প্রতিফলন। এটি একক সামগ্রিকের দুটি অর্ধ হিসেবে ঐশী সত্তা ও মানুষ, ভেতর ও বাইরের দুনিয়াকে একে অন্যের সাথে সামঞ্জস্য বিধান ও পরিপূরক হওয়াটা ফুটিয়ে তোলে। ইবাদতগাহটির প্রতিটি রঙও একটি বার্তা বহন করে। ইসলামি শিল্পকলায় নীল হলো আকাশের রঙ। এটি বোঝায় অসীমতা। আর স্বর্ণ হলো জ্ঞানের রঙ। পবিত্র কোরআন হলো এর অন্তর্নিহিত শক্তি। মুসলিমেরা এর মাধ্যমে আল্লাহকে বুঝতে পারে। 

মুসলিমদের প্রথম কিবলার স্থানেই ডোম অব দি রক নির্মিত হয়েছিল। স্থানটি আধ্যাত্মিক ‘কেন্দ্র’ হিসেবে পরিচিত ছিল। রকের নিচে থাকা গুহাটি সম্পর্কে মুসলিমেরা বলে যে এখানে ইব্রাহিম, দাউদ, সোলায়মান ও আলিজা নামাজ পড়েছিলেন। অনেকে রকে ইউনুসের পায়ের ছাপ দেখতে পায়। তারা বিশ্বাস করে যে এখান থেকেই তিনি বেহেশতে গিয়েছিলেন। যে কয়েকটি স্থানে বেহেশত ও দুনিয়া মিলিত হয়েছে, এটি তার অন্যতম। এই বিশ্বাসের ফলে মুসলিমেরা আল্লাহর পথে তাদের যাত্রা শুরু করতে সহায়তা লাভ করে। আর আবদুল মালিকের ইবাদতগাহর প্রতীকীবাদ চূড়ান্ত বাস্তবতার দিকে ফেরার প্রক্রিয়ার কথা বলে, এটি এমন আরোহণপথ যা একইসাথে, সুফিদের আবিষ্কার করা, অবতরণের স্থানও। আমরা দেখছি যে টেম্পলের স্থাপত্যটি টেম্পল ভবন ধ্বংসের অনেক পরে ইহুদি চেতনা প্রকাশ করে যাচ্ছে। এখন ইসলামি স্থাপত্যের প্রথম বড় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ডোম অব দি রকও মুসলিমদের আধ্যাত্মিক মানচিত্রে পরিণত হলো। 

এ মৌলিক নক্সাটি পরবর্তীকালে বেহেশত ও দুনিয়ার মধ্যে সংযোগসূত্র বিবেচিত কুতুব হিসেবে শ্রদ্ধাভাজন নারী বা পুরুষের সমাধিসৌধে প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। অন্য দিকে ডোম অব দি রকও মক্কার মৌলিক প্রতীকীবাদকে অনুকরণ করে। মক্কার পরিবর্তক হিসেবে ডোমের নক্সা করা হয়েছিল বলে ইয়াকুবির কাহিনীটি প্রায় নিশ্চিতভাবেই ভ্রান্ত। তবে এটি অন্তত এই দুটির মধ্যে সম্পর্ক থাকার মুসলিম অনুভূতি প্রকাশ করে। মুসলিম ইতিহাসের একেবারে সূচনায় প্রথম কিবলাটি কিছু সময়ের জন্য কাবার প্রতিস্থাপক ছিল। উভয় স্থানকে ইডেন উদ্যান, পৃথিবী কেন্দ্ৰ বিবেচিত হচ্ছিল। উভয়টিই আদম ও ইব্রাহিম ও তার ছেলের কোরবানির সাথে সম্পর্কিত ছিল। মিথ ও অন্যান্য উপাসনালয়ের স্থাপত্যে মক্কার মূল পবিত্রতার অনুকরণ কোনো হীনম্মন্যতামূলক ছিল না। এটি নিজেই ছিল ঐক্যের সাথে, সব কিছুকে উৎসের সাথে সম্পর্কিত করে মূল পূর্ণাঙ্গতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামের প্রতীক। 

জেরুসালেমের পবিত্রতা নিয়ে সপ্তম শতকের শেষ নাগাদ ইসলামি বিশ্বে প্রচারিত হতে শুরু করা নতুন নতুন প্রথায় এটি পরিষ্কার হয়ে যায়। এসব প্রথার অনেকগুলো নিশ্চিতভাবেই ছিল ইসরাইলিয়াতে প্রভাবিত। ইহুদিরা সবসময়ই টেম্পলকে বিশ্বের উর্বরতার উৎস হিসেবে কল্পনা করত। এখন মুসলিমেরা ঘোষণা করল যে ‘সব মিঠা পানির উৎস হয়েছে রকের নিচ থেকে।’ শেষ বিচার হবে জেরুসালেমে, আল্লাহ সেখানে গগ ও মাগগকে পরাজিত করবেন; হাশরের দিনে পবিত্র নগরীতে মৃতরা জীবিত হয়ে সমবেত হবে। জেরুসালেমে ইন্তেকাল করাটা ছিল বিশেষ রহমতের ব্যাপার : ‘যিনি জেরুসালেমকে ইন্তেকাল করার জন্য বাছাই করে নেবেন, তিনি বেহেশতে ইন্তেকাল করেছেন বলে বিবেচিত হবেন।’ সব নবী সেখানে সমাহিত হতে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। এমনকি ইন্তেকালের আগে ‘আদম নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যে তাকে জেরুসালেমে কবর দিতে হবে।’ বলা হয়ে থাকে যে মুহাম্মদের (সা.) বন্ধুরা চাইতেন তাদের লাশ যেন সমাহিত করতে সব নবীর বিশ্রাম স্থল ও পুনরুত্থানের স্থান জেরুসালেমে নিয়ে যাওয়া হয়। জেরুসালেম ছিল সব সাধু-দরবেশ ও পবিত্র বস্তুর স্বাভাবিক সমাপ্তি : শেষ দিনে খোদ কাবাকে জেরুসালেমে নিয়ে আসা হবে। পুনরাবৃত্তিমূলক এই মিথে মুসলিম কল্পনাশক্তিতে দুটির গভীরভাবে মিশে যাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করে। ৩৬ 

খলিফা প্রথম আল-ওয়ালিদ ৭০৫ সালে আবদুল মালিকের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি হারামের পবিত্রতা ও রাজকীয়তা জোরদার করা অব্যাহত রাখেন। ৭০৯ সালে তিনি উমরের সাদামাটা ভবনের স্থলে বর্তমান আল-আকসা নামের একটি নতুন মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেন। ডোম অব দি রকের বিপরীতে এ মসজিদটি বারবার বিধ্বস্ত হয়েছে, আবার নির্মাণ করা হয়েছে, বদলানো হয়েছে। আল- ওয়ালিদের মসজিদটি নির্মাণের পরপরই ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়ে যায়, খুব সামান্য টিকে ছিল। আমরা জানি যে এর মার্বেল হাঁটার পথ ছিল, স্তম্ভ ছিল। পরে এটি খুবই দীর্ঘ ও সংকীর্ণ বলে সমালোচিত হয়েছিল। হেরডের সহায়ক প্রাচীর সংস্কার করে ওপরের দিকে সম্প্রসারণ করেন খলিফা। অবশ্য তিনি হেরডের পাথরগুলোর বিশাল আকারের সাথে তাল মেলাতে পারেননি। প্লাটফর্মের প্রাচীরগুলোর চারপাশে খলিফা সমব্যবধানে সমশ্রেণী নির্মাণ করেন। এগুলো বর্তমানের মতো ছিল না। সবশেষে হারামের অতি কাছাকাছি থাকা পুরনো আবাসিক এলাকাগুলো কয়েকটি চমৎকার রাজকীয় ভবনের জায়গার জন্য পরিষ্কার করা হয়। প্লাটফর্মের দক্ষিণ প্রান্তের দরজাগুলো নতুন করে নির্মাণ করা হয়, সরকারি ভবনগুলো তোলা হয়। সবচেয়ে দর্শনীয়টি ছিল দোতলা সমান উঁচু বিশাল এক প্রাসাদ। এর কক্ষগুলো মধ্য আঙিনার পাশে কক্ষগুলো ছিল। উপরের ভবনটি সেতু দিয়ে হারামের সাথে সংযুক্ত ছিল। এটি দিয়ে নতুন মসজিদে যাওয়া যেত। আরো কিছু সমশ্রেণীর স্তম্ভ ছিল পশ্চিমের সহায়ক দেয়ালজুড়ে পশ্চিম ও উত্তর দিকে সম্প্রসারিত হয়। তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি হোস্টেল, হাম্মামখানা, একটি ব্যারাক ও অন্যান্য কাঠামো ছিল। সবশেষে রাস্তা থেকে হারামের পুরনো হেরডিয়ান সেতুটি আজ স্ট্রিট অব চেইন (তারিক আল-সিলসিলা) নামে পরিচিত। এটি পুনঃনির্মিত হয়। এটি উমাইয়াদের নির্মিত বৃহত্তম ভবন কমপ্লেক্স : আল-ওয়ালিদের ইচ্ছা কি ছিল ইসলামি সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে জেরুসালেমের রাজধানী গড়ার? ৩৭ 

নিশ্চিতভাবে আল-ওয়ালিদের ছেলে সোলায়মান (৭১৫-১৭) গভীরভাবে জেরুসালেমের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মুজির উদ্দিন বলেন, তিনি ‘জেরুসালেমে বাস করার পরিকল্পনা করেছিলেন, একে তার রাজধানী করেছিলেন, সেখানে বিপুল সম্পদ ও অনেক জনসংখ্যা জড়ো করেছিলেন। ৩৮ সোলায়মানকে রাজধানীতে খলিফা ঘোষণা করা হলেও আনুগত্যের বায়াত নিতে প্রতিনিধিদেরকে বায়তুল মোকাদ্দিসে আসতে হয়েছিল। নবী সোলায়মানের নামে নাম থাকা খলিফা সোলায়মান লোকজনকে ডোম অব দি রকের কাছে একটি গম্বুজবিশিষ্ট ভবনের নিচে বসে টেম্পল মাউন্টে লোকজনকে সাক্ষাত দিতে পছন্দ করতেন। স্থানটি একটি কার্পেট, কুশন ও ডিভানে সজ্জিত ছিল। অবশ্য জেরুসালেমকে রাজধানী করার তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। একটি বিশাল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র হওয়ার মতো স্থান ছিল না জেরুসালেম। বিষয়টি বুঝতে পেরে সোলায়মান লিড্ডার কাছে নতুন নগরী হিসেবে রামলেকে গড়ে তোলেন। এটি হয় জান্দ ফিলাস্তিনের প্রশাসনিক রাজধানী। এর ফলে জেরুসালেমের অনেক ক্ষমতা ও সমৃদ্ধি উপকূলে চলে যায়। ব্যাপকভাবে খ্রিস্টান প্রাধান্যপূর্ণ একটি নগরীকে রাজধানী নগরী করা উমাইয়াদের পক্ষে সম্ভবত অসম্ভব ছিল। তবে এর মানে এই নয় যে তারা জেরুসালেমকে মূল্যায়ন করত না, যদিও অনেকে এই দাবি করত। একেবারে শুরু থেকে মুসলিমেরা তাদের রাজধানীকে তাদের পবিত্রতম স্থানগুলো থেকে দূরে রাখার ঝোঁক প্রকাশ করত। মক্কা জয়ের পর মুহাম্মদ (সা.) তার রাজধানী মদিনা থেকে সেখানে সরিয়ে নেননি। অথচ তিনি তার অনুসারীদের মধ্যে কোনো ধরনের সংশয় রাখেননি যে মক্কাই অধিকতর পবিত্র স্থান। প্রথম খলিফারাও তাদের রাজধানী মদিনাতে রাখেন। জেরুসালেমের বদলে রামলেকে পছন্দ করার মধ্যে ও একই চিত্র দেখা যায়। এমনকি জেরুসালেমের পবিত্রতার ব্যাপারে সংশয়হীন ইহুদিরা পর্যন্ত রামলেতে বসবাস করাকে অগ্রাধিকার দেয় : নতুন নগরীতে ইহুদি সম্প্রদায় সবসময়ই জেরুসালেমের চেয়ে অনেক বড় ছিল। অষ্টম শতকের মাঝামাঝিতে সাম্রাজ্য ঝামেলায় পড়ে। ৭৪৪ সালে খলিফা দ্বিতীয় ওয়ালিদ নিহত হন। তার ছেলে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে জান্দ ফিলাস্তিন ও জান্দ উরদুন উভয় গোত্রই বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ দমন করার অনেক পরও জিম্মিদের প্রতি তার সহিষ্ণু নীতির বিরোধিতা করে যায় তারা। ইয়াজিদের উত্তরসূরী দ্বিতীয় মারওয়ানের বিরুদ্ধে আস-শ্যামে বিদ্রোহ অব্যাহত থাকে। এর ধারাবাহিকতায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে জেরুসালেম, হিমস, দামাস্কাস ও অন্যান্য নগরীর প্রাচীরগুলো ধ্বংস করা হয়। ৭৪৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর একটি ভূমিকম্প আঘাত হানলে নগরী এর চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডোম অব দি রকের পূর্ব ও পশ্চিম দিক ধসে পড়ে। এছাড়া আল-ওয়ালিদ মসজিদ, উমাইয়া প্রাসাদ ও জাস্টিনিয়ানের নেয়া চার্চেরও একই অবস্থা হয়। হারামের কাছাকাছি বসবাসকারী অনেক মুসলিম নিহত হয়। আফটারশকের ভয়ে অনেক অধিবাসী প্রায় ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত পাহাড়গুলোতে বাস করতে থাকে। ভূমিকম্পটি উমাইয়া রাজবংশের রাজনৈতিক পতনের সূচনা করে। মুহাম্মদের (সা.) চাচা আব্বাসের বংশধরেরা দীর্ঘ দিন ধরে ট্রান্সজর্দানের হুমায়মায় তাদের ঘাঁটিতে উমাইয়াদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছিল। ৭৪৯ সালে তাদের সাথে যোগ দেয় খোরাসানের আবু মুসলিম। তিনি খিলাফতের সব বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। জানুয়ারিতে খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান দজলা নদীর পূর্ব দিকে জাব নদীতে তার চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করেন। এরপরপরই ফিলিস্তিনের অ্যান্টিপাট্রিসে অবশিষ্ট উমাইয়াদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। আবু আল-আব্বাস হন প্রথম আব্বাসি খলিফা। তবে তারা তাদের রাজধানী নতুন নগরী বাগদাদে সরিয়ে নেন। এটি জেরুসালেমের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *