১৬. পুনঃজীবন
জেরুসালেমে ঊনিশ শতক শুরু হয়েছিল বাজেভাবে। নগরীতে ছিল দারিদ্র্যতা আর উত্তেজনা। উসমানিয়া ব্যবস্থা তখনো বিশৃঙ্খলায়, অপঃশাসনে লোকজন দুর্ভোগ পোহাচ্ছিল। সাধারণভাবে দামাস্কাস প্রদেশের অংশ নগরীটি নতুন শতকের শুরুতে প্রকৃতপক্ষে সিডনের ওয়ালির মাধ্যমে শাসিত হতো। আরব গভর্নরের সংখ্যা বাড়ছিল। তাদের একজন ছিলেন মুহাম্মদ আবু মুরাক। মুসলিম ও জিম্মি উভয়েই তার উৎপীড়নে জর্জরিত ছিল। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদ ছিল। ১৮০০ সালে জেরুসালেমে ছিল ৮,৭৫০ জন অধিবাসী। এদের মধ্যে ৪,০০ ছিলেন মুসলিম, ২,৭৫০ জন খ্রিস্টান ও ২,০০০ ছিলেন ইহুদি। তাদের সবার জন্য ছিল অভিন্ন বাজার (সুক), তাদের প্রধান উপাসনালয়গুলোর চারপাশে গুচ্ছাকারে বাস করত। কিছু আন্তঃসম্প্রদায়গত সম্পর্ক ছিল বন্ধুপ্রতীম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মাগরিবি মহল্লার মুসলিমদের সাথে ইহুদিদের সুসম্পর্ক ছিল। ওয়েস্টার্ন ওয়ালে যেতে ইহুদিরা তাদের মহল্লার ভেতর দিয়েই যেত। তবে হলি সেপালচারে প্রবেশ করা ইহুদিদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। খ্রিস্টানদের সাথে ইহুদিদের সম্পর্ক এতই খারাপ ছিল যে তারা তাদের আশপাশের এলাকা থেকেও দূরে থাকত। খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলো একসাথে বাস করলেও তাদের মধ্যে বৈরিতা এতই বিষাক্ত ছিল যে তা সামান্যতম উল্কানিতেই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারত। ইহুদি মহল্লায় সেফারদিম ও অ্যাশকেনাজিমের, তারা ১৮১০ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে জেরুসালেমে ফিরে এসেছিল, মধ্যে উত্তেজনা ছিল। নগরীর শান্তি হতাশা ও ক্ষোভে ফুটছিল, একীভূত হওয়ার পুরনো আদর্শ হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। এই ক্রোধ প্রায়ই দাঙ্গা আর গণ-আন্দোলনে ফুঁসে ওঠত।
হলি সেপালচারে ১৮০৮ সালে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আর্মেনিয়ান সন্ন্যাসীর অধীনে থাকা সেন্ট হেলেনার ক্রিপ্টে তা শুরু হয়। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পুরো চার্চ পুড়ে ছাই হয়ে যায়, ডোমের সহায়ক স্তম্ভগুলো ধসে পড়ে। বিপর্যয়ের জন্য সম্প্রদায়গুলো একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকায় অভিযোগের পর অভিযোগ উত্থাপিত হতে থাকে। চার্চের স্থিতিবস্থা পরিবর্তনের জন্য আর্মেনিয়ানরা পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠতে থাকে; অন্যরা বলতে থাকে যে গ্রিক অর্থোডক্স পাদ্রিরা মদ্যপ অবস্থায় কাঠে আগুন ধরাতে গিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলেছেন, পরে তা নেভাতে গিয়ে ব্র্যান্ডি ব্যবহার করায় সেটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায। পুনঃনির্মাণ যেহেতু বৈধ মালিকানার সাথে জড়িত ছিল, তাই পুনঃনির্মাণের দায়িত্ব পেতে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। প্রতিটি স্থানের অধিকারীই অন্যদের দাবি নাকচ করছিল, সমর্থনের জন্য বিদেশী ‘রক্ষকদের’ কাছে আবেদন জানাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত গ্রিকরাই এ সুবিধাটি পেয়ে যায়, মেরামতের কাজ শুরু হয় ১৮১৯ সালে। তবে নির্মাণকাজ কখনো জেরুসালেমের নিরপেক্ষ কার্যক্রম ছিল না। হলি সেপালচার চার্চ নিয়ে মুসলিমরা অনেক আগে থেকেই অস্বস্তিতে ছিল, বিশেষ করে অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সময়। মুসলিমরা এখন কাজ বন্ধ করার দাবিতে গভর্নরের বাসভবন ঘেরাও করল। তাদের সাথে যোগ দিলো স্থানীয় জাননেসারিরা। নগরদুর্গে অন্য সৈন্যদের রাখায় তারা ক্রুদ্ধ হয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই নগরীর সর্বত্র পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ শুরু হলো। বিদ্রোহীরা গ্রিক অর্থোডক্স প্যাট্রিয়ারচাট আক্রমণ করল, দুর্গ দখল করে নিলো। গভর্নরকে নগরী থেকে বহিষ্কার করা হলো। দামাস্কাসের ওয়ালি দুর্গ অবরোধ করার জন্য সৈন্য পাঠানোর আগে পর্যন্ত আন্দোলন থামেনি। ৪৬ জন নেতাকে শিরোশ্ছেদ করে তাদের মাথা দামাস্কাস পাঠানো হয়।
হলি সেপালচারের পুনঃনির্মাণ অব্যাহত থাকে। তবে পুনঃনির্মাণ নিজেই একটি যুদ্ধে পরিণত হয়। গ্রিকরা সুযোগটি লুফে নিয়ে ভবন থেকে ল্যাতিন দখলদারিত্বের সব চিহ্ন মুছে ফেলে। তারা অষ্টাদশ শতকে সমাধির ওপর ফ্রান্সিসক্যানদের নির্মিত ইডিকিউল (সৌধ) পুনঃস্থাপন করে, বোলনের গডফ্রে ও রাজা প্রথম ব্যান্ডউইনের কবর উপড়ে ফেলে। এরপর থেকে এক গ্রিক সন্ন্যাসী সেপালচারের ওপর স্থায়ী পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকে। তারা এখন কবর ও গলগোথা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকল; ফ্রান্সিক্যানেরা ভবনের উত্তর দিকে সীমিত হয়ে পড়ল, আর্মেনিয়ানরা সেন্ট হেলেনার ক্রিপ্টে, কপ্টরা কবরের পশ্চিমে ছোট চ্যাপেলে, সিরিয়ানরা রোতানদার ওপর থাকা চ্যাপেলে অবস্থান নেয়। ইথিওপিয়ানরা ছাদের ওপর তাদের মঠ ও চার্চ নির্মাণ করতে বাধ্য হয়। খ্রিস্টানরা তাদের পবিত্রতম উপাসনালয়ে সম্প্রীতিপূর্ণভাবে একসাথে বাস করতে অক্ষম হয় : একটি মুসলিম পরিবারকে চার্চের চাবির মালিকানা দেওয়া হয়। তারা বর্তমানে চার্চ খোলা ও বন্ধ করার কাজটি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় পরিচালনা করে। এই দুরহ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা ছিল। কারণ কোনো সম্প্রদায়ই অন্যদের ওপর দায়িত্বটি ন্যস্ত করতে চায় না। বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী সমাধির ধর্মীয় কার্যক্রম চালানোর জন্য পালাক্রমে চাবি গ্রহণ করে, তবে এতে প্রায়ই মারামারি লেগে যায়, অভব্যতা দেখা যায়। এক শোকাহত ব্রিটিশ পর্যটক এই দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছিলেন :
ধরুন কপ্টরা উপাসনালয়ের সামনে দাঁড়াল : তারা তাদের ৬০ মিনিটের উপাসনা শেষ করার অনেক আগেই আর্মেনিয়ানরা কয়ারের সামনে বিপুলসংখ্যায় সমবেত হতে থাকে। না, তাদের সাথে প্রার্থনায় যোগ দিতে বা হাঁটু গেড়ে ভক্তি জানানোর জন্য নয়, বরং কপ্টিক ধর্মগুরুদের বিদ্রুপ করতে, সকালের প্রার্থনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য।
প্রার্থনাকারীরা প্রায়ই হাতাহাতিতে মেতে ওঠে। তখন ‘মোমবাতি, কুঁজো হওয়া ও ক্রুশবিদ্ধকরণ নিয়ে চলা লড়াই থামানোর জন্য স্থায়ীভাবে চার্চের বাইরে মোতায়েন তুর্কি প্রহরীরা প্রচণ্ড শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসে। রক্তপাত না ঘটলে উপাসনা অব্যাহত থাকে। অবশ্য তখনো প্রহরীরা বন্দুক প্রস্তুত করে দাঁড়িয়ে থাকে। বিশ্বাসের প্রতীক যদি হয় বদান্যতা ও ভালোবাসা-দয়ার্ততা, তবে খ্রিস্টান ধর্ম জেরুসালেমে সুস্পষ্টভাবেই ব্যর্থ হয়েছে।
খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে আবারো মুসলিম শক্তি প্রদর্শন হয়েছিল ১৮২১ সালে। এবার পেলোপোনেসের গ্রিকরা উসমানিয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। আবারো গ্রিক অর্থোডক্স প্যাট্রিয়াচাট আক্রান্ত হন। অবশ্য ইস্তাম্বুলের কড়া নির্দেশে কাজি ও জেরুসালেমের অভিজাত পরিবারগুলো সহিংসতা থামাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল। ১৮২৪ সালে আবারো মারাত্মক গোলযোগের সৃষ্টি হয়। দামাস্কাসের নতুন ওয়ালি মোস্তফা পাশা আগের হারের চেয়ে কর ১০ গুণ বাড়িয়ে দেন। জেরুসালেমের আশপাশের গ্রামগুলোর কৃষকেরা সাথে সাথে বিদ্রোহ করে, পাশা পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহ শান্ত করার জন্য রওনা হন। এবার জেরুসালেমের অভিজাতেরা উসমানিয়া এস্টাবলিশমেন্টকে সমর্থন করেনি, তারা বরং একসাথে কৃষক ও নগরবাসীর সাথে জোট বাঁধেন। পাশা দামাস্কাস ফিরে যাওয়ার মাত্র, তিনি মনে করেছিলেন বিদ্রোহ শান্ত হয়ে গেছে, জেরুসালেমের লোকজন দুর্গ আক্রমণ করে উসমানিয়া সেনাবাহিনী বিতাড়িত করে অস্ত্র কেড়ে নেয়, নগরী থেকে সব অনারব নাগরিককে তাড়িয়ে দেয়। সম্ভবত এটি ছিল জেরুসালেমে আরব সংহতির প্রাথমিক প্রকাশ। এমনকি সিডনের গভর্নর আবদুল্লাহ পাশা দুই হাজার সৈন্য ও সাতটি কামান নিয়ে এলেও আরবরা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এক সপ্তাহ ধরে লড়াই চলে, মাউন্ট অলিভেস থেকে নগরীতে অব্যাহতভাবে গোলাবর্ষণ করা হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তুর্কিরা বিদ্রোহীদের দাবি মেনে নেয় : কর হ্রাস করা হয়, নগরীর দৈনন্দিন জীবনে সেনাবাহিনী আর কোনো হস্তক্ষেপ না করতে সম্মত হয়, জেরুসালেমের ভবিষ্যত সব কর্মকর্তা আরব হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
তবে ১৮৩১ সালে তুর্কি শাসনে জেরুসালেম আরো জোরদার হয়। আলবেনিয়ান তুর্কি ও উসমানিয়া কমান্ডার মুহাম্মদ আলী মিসরে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ফরাসিদের বিদায় নেওয়ার পর তিনি কার্যত ইস্তাম্বুল থেকে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হন। তার উচ্চাভিলাষ ছিল পাশ্চাত্যের আদলে মিসরকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করা, যেখানে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার থাকবে, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে থাকবে সমান। সেনাবাহিনী আধুনিকায়ন করা হয়, ১৮৩১ সাল নাগাদ ফিলিস্তিন ও সিরিয়া আক্রমণ করার মতো শক্তি অর্জন করেন। তিনি উসমানিয়াদের কাছ থেকে এসব প্রদেশ কেড়ে নেয়। জেরুসালেমের ইতিহাসে এটি ছিল টার্নিং পয়েন্ট। মুহাম্মদ আলী ১৮৪০ সাল পর্যন্ত সিরিয়া ও ফিলিস্তিন নিয়ন্ত্রণ করেন। ওই ৯ বছরে তিনি আধুনিকরণ ধারণাগুলো প্রয়োগ করে জেরুসালেমের জীবনযাত্রা স্থায়ীভাবে বদলে দেন। তার ছেলে ইব্রাহিম পাশা বেদুইনদের দমন করতে সক্ষম হন, তাদেরকে মিসরীয় সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার দেন। তিনি একটি সেক্যুলার বিচারিকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি কার্যকরভাবে শরিয়াহ আদালতের ক্ষমতা খর্ব করে। এর ফলে জিম্মিরা জীবন ও সম্পত্তির ওপর পূর্ণ সাম্য ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ভোগ করতে থাকে, ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরও জেরুসালেমের মজলিশে (নগরীর গভর্নরকে পরামর্শ দানের জন্য গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ) প্রতিনিধি করা হয়। জেরুসালেমে সেক্যুলারবাদের আগমন ঘটে, রাষ্ট্র ও বিচারিকব্যবস্থা ধর্ম-নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে থাকে।
স্বাভাবিকভাবেই এসব সংস্কারের বিরোধিতাও ছিল। জেরুসালেমের প্রধান পরিবারগুলো ও স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিরা অনেক বছর ধরে যে সুবিধা ও মর্যাদা ভোগ করে আসছিল, তা খোয়ানোর শঙ্কায় পড়ে। ১৮৩৪ সালে পুরো ফিলিস্তিন ও ট্রান্সজর্দানে বিদ্রোহ ঘটে। পাঁচ দিন ধরে বিদ্রোহীরা নগরীর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে, তারা রাস্তায় রাস্তায় ছুটে চলে, জিম্মিদের দোকানপাট লুট করে। এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইব্রাহিম পাশাকে তার পুরো সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে। অবশেষে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, মিসরীয় সরকার সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখে। নগরীতে আধুনিক শিল্পব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের জন্য ইব্রাহিম পাশা জেরুসালেমে প্রথম দুটি উইন্ডমিল নির্মাণ করেন। জিম্মিরা তাদের নতুন স্বাধীনতা উপভোগ করতে থাকে। তারা এখন ঘুষ আর অসাধু উপায় অবলম্বন ছাড়াই তাদের উপাসনালয়ের সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।
তারা সাথে সাথে এই সুবিধার সুযোগ গ্রহণ করে। ১৮৩৪ সালে ভূমিকম্পের কারণে অনেক খ্রিস্টান মঠ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সন্ন্যাসীরা এখন সাথে সাথে সেগুলো সংস্কার করতে সক্ষম হলো। ফ্রান্সিসক্যানেরাও সেন্ট স্যাভিয়ার্সের মেরামত কাজ সেরে নেয়। সাম্প্রতিক বিদ্রোহে সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় এটি বিশাল কমপ্লেক্সে পরিণত হয়েছিল। ফ্রান্সিসক্যানেরা এখন প্রতি সপ্তাহে আট শ’ খ্রিস্টান ও মুসলিমকে রুটি দিচ্ছিল, তারাই প্রথম আরব খ্রিস্টানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে। ক্যাথলিক দীক্ষা গ্রহণকারী পরিবারগুলোর ৫২টি ছেলেকে আরবি, ইতালিয়ান ও ল্যাতিন পড়তে ও লিখতে শেখানো হয়। অবশ্য গণিত বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান শেখানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আরব মেয়েদের জন্য একটি সেলাই শিক্ষার স্কুলও ছিল। ১৮৩৯ সালে ফ্রান্সিসক্যানেরা নগরীতে তাদের অবস্থান সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হয়। তখনো নগরীর বিশাল অংশ ছিল জনবসতিহীন ফ্যাগেলেশনে তাদের চার্চটি ছিল ভায়া ডোলোরোসার পাশে নির্মিত প্রথম খ্রিস্টান ভবন। উনিশ শতকে এটি ধীরে ধীরে নতুন খ্রিস্টান মহল্লায় পরিণত হয়।
ইহুদিরাও নির্মাণের সুযোগটি গ্রহণ করে। ১৮৩৪ সালে মুহাম্মদ আলী একটি ফরমান ইস্যু করে বিধ্বস্ত বেন জাক্কাই সিনাগগ নতুন করে নির্মাণের জন্য সেফারদিমদের অনুমতি দেন। পোল্যান্ড থেকে নতুন অভিবাসীর আগমন ঘটায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অ্যাশকেনাজিক সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। তাদেরও উপাসনার জন্য নতুন স্থান নির্মাণ করার প্রয়োজন পড়ে। ১৮৩৬ সালে অ্যাশকেনাজিম নতুন সিনাগগ ইয়েশিভা ও মিকভে নির্মাণ করার সুযোগ পায়। তারা ১৭২০ সালে স্থানটি খালি করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। পুরো সম্প্রদায় নতুন ভবন নির্মাণকাজে নেমে পড়ে। রাব্বি, ছাত্র, এমনকি বুড়ো লোকজন পর্যন্ত ভিত্তি খনন করে, আবর্জনা পরিষ্কার করে। নতুন হারভা সিনাগগের প্রথম অংশের উদ্বোধন হয় ১৮৩৭ সালে। তবে এই ভবন বিবাদের উৎসে পরিণত হয়। মিনস্কের রাব্বি বারদাকি নতুন সিনাগগের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, স্থানটি এর বদলে গৃহায়নের জন্য ব্যবহার করা উচিত। তখন প্ৰায় পাঁচ শ’ অভিবাসী বাস্তবিকই গৃহহীন ছিল। এর প্রতিবাদে তিনি ও তার অনুসারীরা সুকোথ শ্যালম সিনাগগ নির্মাণ করেন। এতে অ্যাশকেনাজিক সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থায়ীভাবে বিভক্তির সৃষ্টি হয়। এটি ছিল নানা বিরোধের প্রথমটি। ঊনিশ শতকে ইহুদি সম্প্রদায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল : অ্যাশকেনাজিমের বিরোধী ছিল সেফারদিম, হ্যাসিদিম লড়াই করত মিতনাগেদিমের বিরুদ্ধে, বড় বড় গ্রুপের মধ্যে উপদল গড়ে উঠছিল। ইহুদি মহল্লা নানা দলাদলিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। প্রতিটি গ্রুপই নিজ নিজ রাব্বিকে ঘিরে আলাদা হয়ে পড়েছিল, প্রায়ই তারা বিভিন্ন সিনাগগে উপাসনা করত।
জেরুসালেমের প্রায় প্রতিটি নতুন ঘটনা সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়িয়ে দিত, নগরীতে তা বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করত। মুহাম্মদ আলী পাশ্চাত্যের সমর্থন লাভ করতে উদগ্রিব ছিলেন। এ কারণে তিনি ইউরোপিয়ানদের নগরীতে বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করতেন। ফলে প্রথমবারের মতো পাশ্চাত্য শক্তি জেরুসালেমে কনস্যুলেট প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। স্থানীয় লোকজন এ নিয়ে দীর্ঘ দিন লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল। ১৮৩৯ সালে ইংরেজ কূটনীতিক উইলিয়াম টার্নার ইয়ং ব্রিটিশ ভাইস-কনস্যাল হিসেবে জেরুসালেমে আসেন। পরের ১৫ বছরে ফ্রান্স, প্রুসিয়া, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া পবিত্র নগরীতে তাদের কনস্যুলেট খোলে। কনসালরা জেরুসালেমে চরম গুরুত্বপূর্ণভাবে নিজেদের উপস্থাপন করে। তারা নগরীতে আধুনিক চিকিৎসা, শিক্ষা ও প্রযুক্তি নিয়ে আসে। তবে প্রত্যেকেরই নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল। আর তা প্রায়ই আগে থেকেই বিভক্ত নগরীতে নতুন সঙ্ঘাতের সৃষ্টি করত। স্থানীয় লোকজনকেও ইউরোপিয়ান শক্তিগুলোর বিবাদে জড়িয়ে ফেলা হতো। এমন প্রেক্ষাপটে ইউলিয়াম ইয়ং অ্যাশকেনাজিক ইহুদিদের প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠলেন। জেরুসালেমে একটি ‘প্রটেকটোরেট’ প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিল ব্রিটেন। ফ্রান্স ও রাশিয়া ইতোমধ্যেই তা করেছিল। তবে প্রোটেস্ট্যান্টদের জন্য কোনো কনসাল ছিল না। আবার ইউরোপিয়ান ইহুদিদের কোনো স্পন্সর ছিল না। ইয়ং নিজেকে তাদের অঘোষিত পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সামনে নিয়ে এলেন। তিনি প্রাচীন সহস্রাব্দ স্বপ্নে উদ্দীপ্ত ছিলেন। সেন্ট পল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে দ্বিতীয় আগমনের (সেকেন্ড কামিং) আগে সব ইহুদি গ্রহণ করবে খ্রিস্ট ধর্ম। আর ক্রমবর্ধমান সংখ্যক ব্রিটিশ খ্রিস্টান মনে করত যে তারা এই ভবিষ্যদ্বাণী পূরণ করা তাদের কর্তব্য। তারা স্পষ্টভাবে মনে করত, মহা পরিত্রাণের পথে হতে এটিই চূড়ান্ত বাধা। ১৮৩৯ সাল নাগাদ ইয়ংয়ের প্রভাবে ‘লন্ডন সোসাইটি ফর প্রমোটিং খ্রিস্টানিটি অ্যামং দি জিউশ’কে (‘লন্ডন জিউশ সোসাইটি’ নামেও পরিচিত) জেরুসালেমে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে পবিত্র নগরীতে প্রথম প্রটেস্ট্যান্ট মিশনারির আগমন ঘটে। তবে তারা পুরনো খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলো ও ইহুদি (খ্রিস্টান তৎপরতায় তারা ক্ষুব্ধ ছিল) উভয়ের বিরাগ ভাজন হয়েছিল।
এখন জেরুসালেমে আধুনিক ধ্যান-ধারণা প্রবেশ করতে শুরু করেছে। আর এর কোনো বিরতি ছিল না। ১৮৪০ সালে ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো যখন মিসরীয়দের ফিলিস্তিন ত্যাগ করতে বাধ্য করে এবং উসমানিয়ারা আবার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, তখন পুরনো ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তনের কোনো প্রশ্নই ছিল না। আধুনিকতার কাছে নতি স্বীকার করে ইস্তাম্বুল। সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ সংস্কার করা একটি সেনাবাহিনী নিয়ে আরো কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার তানজিমাত (‘নিয়ন্ত্রণ’) জিম্মিদের নতুন সুবিধা নিশ্চিত করে। তাদেরকে তখনো সামরিক সুরক্ষার জন্য জিজিয়া প্রদান করতে হলেও অধিকতর ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত, স্থানীয় মুসলিমদের কোনো বাধা ছাড়াই তারা তাদের উপাসনার স্থানগুলো নির্মাণ ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারত। উসমানিয়ারা এখন জেরুসালেমের প্রতি আরো আগ্রহ দেখাল। এর কিছু অংশ অবশ্য পবিত্র নগরীতে পাশ্চাত্য দখলে বদলে গিয়েছিল। মিসরীয় অভিযানের আগে একর বিবেচিত হতো ফিলিস্তিনের প্রধান নগরী। এখন জেরুসালেম এর স্থান দখল করল। এটি এখনো মুতাসারিফলিক অর্থাৎ প্রশাসনিক দিক থেকে প্রদেশ (ইয়ালেত) ও জেলার (সানজাক) মাঝামাঝি এর অবস্থান। তবে গাজা, জাফা ও (১৮৫৮ সাল পর্যন্ত) নাবলুস সানজাকগুলো জেরুসালেমের সাথে যুক্ত হয়। ১৮৭২ সালে স্বল্প সময়ের জন্য জেরুসালেম আলাদা হয়ে যায় : সিডন বা দামাস্কাসের ওয়ালির অধীনে না থেকে গভর্নর সরাসরি ইস্তাম্বুলের কাছে দায়বদ্ধ থাকতেন। জনসংখ্যাও বাড়ছিল। ১৮৪০ সালে নগরীতে জনসংখ্যা যেখানে ছিল ১০,৭৫০ জন। এদের মধ্যে ইহুদি ছিল ৩,০০০, খ্রিস্টান ৩,৩৫০ জন। জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে নাটকীয়ভাবে। ১৮৫০ সালে ইহুদিরা নগরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, ১০ বছরে তাদের বৃদ্ধি ঘটে প্রায় দ্বিগুণ। এই ধারা অব্যাহত থাকে। নিচের টেবিলটিতে বিষয়টি স্পষ্ট হবে :
বছর | মুসলিম | খ্রিস্টান | ইহুদি | মোট |
১৮৫০ | ৫,৩৫০ | ৩,৬৫০ | ৬,০০০ | ১৫,০০০ |
১৮৬০ | ৬,০০০ | ৪,০০০ | ৮,০০০ | ১৮,০০০ |
১৮৭০ | ৬,৫০০ | ৪,০০০ | ১১,০০০ | ২২,০০০ |
১৮৮০ | ৮,০০০ | ৬,০০০ | ১৭,০০০ | ৩১,০০০ |
১৮৯০ | ৯,০০০ | ৮,০০০ | ২০,০০০ | ৪২,০০০ |
১৯০০ | ১০,০০০ | ১০,০০০ | ৩৫,০০০ | ৫৫,০০০ |
১৯১০ | ১২,০০০ | ১৩,০০০ | ৪০,০০০ | ৭০,০০০ |
১৯২২ | ১৩,৫০০ | ১৪,৭০০ | ৩৪,৭০০ | ৬২,৬০০ |
একটি জনহীন, নিরাশায় ভরা নগরী জেরুসালেম একটি সমৃদ্ধশীল আধুনিক মেট্রোপলিশে পরিণত হয়। টেম্পল ধ্বংস হওয়ার পর প্রথমবারের মতো আবারো ইহুদিরা ওপরের দিকে উঠতে থাকে।
এদিকে পাশ্চাত্য শক্তিগুলো কনসাল ও চার্চগুলোর মাধ্যমে পবিত্র নগরীতে তাদের প্রভাব বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে থাকে। প্রুসিয়া ও ব্রিটেন যৌথভাবে জেরুসালেমে প্রথম প্রটেস্ট্যান্ট বিশপ নিয়োগ করে। তারপর ১৮৪২ সালের ২১ জানুয়ারি ইহুদি ধর্মান্তরিত বিশপ মাইকেল সলোমন জেরুসালেমে এসে ঘোষণা করেন যে তার প্রথম কর্তব্য হলো নগরীর ইহুদিদেরকে খ্রিস্টের কাছে নিয়ে আসা। স্বাভাবিকভাবেই এটি ইহুদিদের সতর্ক করে। নতুন প্রটেস্ট্যান্ট ক্যাথেড্রালকে বলা হতো হিব্রু ক্রাইস্ট চার্চ। এটি নির্মিত হয় জাফা গেটের কাছে, ব্রিটিশ কনস্যুলেটের ঠিক পাশেই। ১৮৪৩ সালের ২১ মে কনসাল ইয়ংয়ের উপস্থিতিতে তিন ইহুদি ক্যাথেড্রালে হিব্রু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ব্যাপ্তাইজ হয়। স্বাভাবিকভাবেই ইহুদিরা এসব প্রটেস্ট্যান্টের কল্যাণ ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গরিব ইহুদিদের চার্চে নিয়ে যেতে প্রলুব্ধ করার কাজে ক্ষুব্ধ হয়। ইহুদি সম্প্রদায়ে অদ্ভুত হয়ে যাওয়া এসব ধর্মান্তরিত ব্যক্তিকে স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাতারে সামিল হওয়া খ্রিস্টানরা সহায়তা করে। ১৮৪৪ সালে আরো ইহুদি ব্যাপ্তাইজ হয়। এতে ইহুদিরা উপলব্ধি করতে থাকে যে খ্রিস্টান আক্রমণ প্রতিহত করতে তাদেরও কিছু করতে হবে।
জেরুসালেমের পবিত্রতায় লোকহিতৈষী কার্যক্রম সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এখন এটিও আগ্রাসী ও বিভক্তসূচক হয়ে পড়ে। ১৮৪৩ সালে লন্ডন জিউশ সোসাইটি ইহুদি মহল্লার কাছাকাছি একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে বিনা মূল্যে ওষুধ প্রদানের সুযোগ দেয়। কনসাল পদে ইয়ংয়ের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যখন জেমস ফিন এলেন, তখন তিনি ধর্মান্তর কর্মসূচিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করে বৈরুতের কনস্যুলেটের পক্ষ থেকে রাশিয়া হতে আগত ইহুদি অভিবাসীদেরকে সুরক্ষা প্রদান করার প্রস্তাব দিলেন। উসমানিয়ারা ১৮৫০ সালে সাম্রাজ্যে জমি কেনার জন্য বিদেশীদের অনুমতি দিলে ফিন প্রাচীরের বাইরে মাউন্ট সায়নের এক মাইল পশ্চিমে একটি এস্টেট কিনে নেন। এটি তালবিয়া কলোনিতে পরিণত হয়। এখানে ইহুদিরা কৃষিকাজে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারত। ফিনের প্রধান দাতা ছিলেন চেলটেনহ্যামের মিস কুক। এই নারীর তহবিলে আরো দুটি খামার প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি বেথলেহেমের কাছে, অপরটি জাফা গেটের উত্তরে ইব্রামিমের আঙুর বাগানে। এখানে ছয় শত ইহুদির চাকরির ব্যবস্থা হয়। ফিন নিশ্চিত ছিলেন, ইহুদিরা যদি ইহুদি মহল্লার জঘন্য পরিবেশ ত্যাগ করে, নিজেদের জীবিকা উপার্জন করে তবে তাদের অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটবে। জেরুসালেমের ইহুদিদের বেশির ভাগ বেঁচে থাকত হালাকার ওপর, অর্থাৎ প্রবাসী ইহুদিদের দান-দাক্ষিণার ওপর। ইহুদিরা যাতে পবিত্র নগরীতে বাস করে তাওরাত ও তালমুদ অধ্যায়ন করতে পারে, সেজন্যই প্রবাসীরা এই সহায়তা করত। আলোকিত ইহুদি লোকহিতৈষীদের মতো ফিন বিশ্বাস করতেন, ইহুদিদের জন্য অস্বাস্থ্যকর নির্ভরতা থেকে সরে আসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর কোনো কারণে হালাকা যদি না আসে, তবে ইহুদিদের জীবন বিপন্ন হয়ে যাবে। শিক্ষাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নতুন প্রটেস্ট্যান্ট বিশপ গোবাট ইহুদি ধর্মান্তরিত ও আরব খ্রিস্টানদের জন্য দুটি স্কুল খোলেন। একটি ছেলেদের জন্য, অপরটি মেয়েদের জন্য। মাউন্ট সায়নের উত্তর ঢালুতে ছিল স্কুল দুটি। জার্মান চার্চের পক্ষ থেকে ক্রাইস্ট চার্চের কাছে ইহুদিদের জন্য একটি স্কুল খোলা হয়। লন্ডন জিউশ সোসাইটিও ক্রাইস্ট চার্চের কাছে একটি হাউস অব ইন্ডাস্ট্রি খোলে তরুণ ইহুদিদের ব্যবসা-বাণিজ্য শেখাতে। এসব প্রতিষ্ঠান দারিদ্র- পীড়িত ইহুদিদের অনিবার্যভাবে আকৃষ্ট করত। স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, এই হুমকি প্রতিরোধ করার সর্বোত্তম উপায় ছিল ইহুদি কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান খোলা। ১৮৪৩ সালে ব্রিটিশ ইহুদ জনদরদি স্যার মোসেস মন্টেফিওর নগরীতে একটি ইহুদি ক্লিনিক খোলেন। রথচাইল্ডস ১৮৫৪ সালে মাউন্ট সায়নের দক্ষিণ ঢালুতে মসিগ্যাভ লাদাচ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে স্কুল ও স্বল্প সুদে মূলধন প্রদানের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়।
এই প্রটেস্ট্যান্ট চ্যালেঞ্জের ফলে অপেক্ষাকৃত পুরনো খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলোও নতুন নতুন জনসেবায় উদ্দীপ্ত হয়। গ্রিক অর্থোডক্স সেন্ট স্যাভিয়র্সের চেয়ে অনেক বড় কারিকুলাম নিয়ে আরব ছেলেদের জন্য একটি স্কুল খোলে। ল্যাতিন প্যাট্রিয়াচেট আবার চালু করার লক্ষ্যে রোমান ক্যাথলিক চার্চ উদ্দীপ্ত হয় প্রটেস্ট্যান্ট বিশপের আগমনে। ক্রুসেডার রাজ্য বিলীন হওয়ার পর থেকেই তারা ম্লান হয়ে পড়েছিল। নতুন প্যাট্রিয়ার্ক জাফা গেটের কাছে নতুন ভবনে সরে যান। এটি পরিণত হয় জেরুসালেমের আধুনিক এলাকা। তার উপস্থিতি নগরীতে নতুন বিভেদের সৃষ্টি করে। তিনি গ্রিকদের সামনে অবধারিত চ্যালেঞ্জই দেননি, সেইসাথে এই নিয়োগে অপমানিত হওয়া সেন্ট স্যাভিয়ার্সের ফ্রান্সিসক্যানদেরও ক্ষিপ্ত করেন। নতুন প্যাট্রিয়াচেটের অর্থ হলো নগরীতে আরো বেশি ক্যাথলিক ব্যবস্থা চালু করা। অল্প সময়ের মধ্যেই সিস্টার্স অব জায়ন’ (লন্ডন জিউশ সোসাইটির রোমান ক্যাথলিক সংস্করণ) ভায়া ডোলোরোসার ইসে হোমো আর্চের কাছে একটি কনভেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তারা মেয়েদের জন্য একটি স্কুল খোলে।
আধুনিক দুনিয়ার কাছে জেরুসালেম নিজেকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছিল। ১৮৫২ সালের এপ্রিলে নগরীতে পা দিয়েই আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ববিদ অ্যাডওয়ার্ড রবিনসন পরিবর্তনটি লক্ষ্য করেন। তিনি এর আগে ১৮৩৮ সালে মিসরীয় দখলদারিত্বের আমলে জেরুসালেম সফর করেছিলেন। তবে এবার তিনি সাথে সাথে আধুনিক অ্যাঙ্গিক্যান চার্চ, কনস্যুলেট ও জাফা গেটের কফি হাউস দেখে মোহিত হন। ‘জেরুসালেমে অগ্রগতি চলছে, পুরনো ঘরবাড়ি ভেঙ্গে ফেলে নতুন নতুন তৈরি হচ্ছে। এটি আমাকে অনেকটা নিউ ইয়র্কের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। রাস্তা-ঘাটে অনেক বেশি তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। অনেক বেশি লোক উদ্যোমী, অনেক বেশি গতিশীল ব্যবসা দেখা যাচ্ছে। অবশ্য রবিনসনকে প্রাচীন জেরুসালেম নিয়ে খুবই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গবেষণা করতে আসতে হয়েছিল। তিনি বাইবেলের সত্যকে বৈজ্ঞানিক ও সাম্রাজ্যবাদী পদ্ধতিতে আক্ষরিকভাবে সত্য প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে ইব্রাহিম, মুসা ও যশুয়ার সফরের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া সম্ভব। ১৮৮৩ সালের সফরকালে তিনি হেজেকিয়ার নির্মিত পানিব্যবস্থা দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলেছিলেন। তার বাইবেলিক রিসার্চেস ইন প্যালেস্টাইন (১৮৪১) ফিলিস্তিনে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। দৃশ্যত এটি ছিল ধর্মের সত্যতা প্রদর্শন এবং বাইবেলের ঐতিহাসিক বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বিজ্ঞানী, ভূতত্ত্ববিদ ও শাস্ত্রবিদদের তীব্র সমালোচনার জবাব দেওয়ার প্রয়াস। এই নতুন ‘বাইবেলিক প্রত্নতত্ত্বের’ লক্ষ্য ছিল কল্পনাপ্রসূত পুরানতত্ত্বভিত্তিক হিসেবে নয়, বরং তথ্য ও তত্ত্বের ভিত্তিতে আধুনিক পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ধর্ম হিসেবে প্রকাশ করা। জেরুসালেম অবশ্য ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাস থেকে আলাদাভাবে কাজ করে এমন কিছুর প্রতি অনেক কম বুদ্ধিবৃত্তিক টান প্রদর্শন করত। নগরীতে রবিনসনের প্রথম সফরকালে তিনি নিজেকে পুরোপুরি আবেগে আচ্ছন্ন দেখতে পেয়েছিলেন। শৈশব থেকে স্থানটি কল্পনাপ্রসূতভাবে তার সামনে হাজির করা হয়েছিল। ফলে তিনি আগে কখনো নগরীটি সফর না করলেও তার মনে হয়েছিল এই সফর ছিল তার ‘প্রত্যাবর্তন’ এবং তিনি তরুণতর সত্তার মুখোমুখি হয়েছেন। স্থানগুলো ‘সবই ছিল আমার কাছে পরিচিত, মনে হচ্ছিল যে আগের স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল, আমি শৈশবের লালিত দৃশ্যগুলোতে পৌঁছে গেছি।’
রবিনসন ১৮৫২ সালে জেরুসালেমে ফিরে এসে দারুণ একটি আবিষ্কার করেন। আগের বছর আমেরিকান প্রকৌশলী জেমস বার্কলে মামলুক মাদরাসাগুলো সংরক্ষণ নিয়ে পরামর্শ দিতে উসমানিয়াদের অতিথি হিসেবে নগরী সফর করেছিলেন তিনি। ওয়েস্টার্ন ওয়ালে তিনি একটি বিশাল সরদল (লিন্টেল) লক্ষ্য করেন। এটি হেরড টেম্পলের একটি দরজার উপরে ছিল। এখন রবিনসনের নজরে পড়ে ওয়েস্টার্ন ওয়ালের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে ভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল বিশাল পাথর। তিনি সেগুলোর ওপর থেকে মাটি সরিয়ে ফেলে বুঝতে পারেন এটি অবশ্যই যোশেফাসের বর্ণিত টাইরোপোয়ন ভ্যালিতে বিস্তৃত কোনো সৌধের খিলান হবে। ‘বার্কলেস গেট’ ও ‘রবিনসনস আর্চ’ ছিল মূল্যবান আবিষ্কার। অবশ্য এসব পাথরের সত্যিকারের কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে। অবশ্য প্রত্নতত্ত্ব তার নিজস্ব পবিত্র যুদ্ধে ইন্ধন দিতে পারে। ক্যাথলিকেরা এসব ও অন্যান্য প্রটেস্ট্যান্ট আবিষ্কারকে চ্যালেঞ্জ করতে উদ্বুদ্ধু হলো। ১৮৫০ সালে ফেলিসিয়েন সি সলসি (এই সৈনিক লোকটির পুরাতত্ত্বের ওপর কোনো প্রশিক্ষণও ছিল না) দাবি করেন যে হারামের হেরডিয়ান প্রচীরগুলো সোলায়মান নির্মাণ করেছিলেন এবং আদিয়াবেনের রানির প্রথম শতকে নির্মিত ‘টম্ব অব দি কিংস’ ছিল দাউদ ও জুদার রাজাদের কবর। এসব দাবির সপক্ষে কোনো ধরনের প্রমাণ না দিয়ে ডি সলসি প্রটেস্ট্যান্ট উদ্যোগ (রবিনসন বিশ্বাস করতেন যে দাউদের কবর রয়েছে মাউন্ট সায়নে) বাতিল করার আশা করেন এবং সাধারণভাবে প্রটেস্ট্যান্ট বিশ্বাসের ওপর সন্দেহের রেখাপাত করেন।
এসব অধিকতর গবেষণামূলক বিতর্ক চলতে থাকার মধ্যেই জেরুসালেমের খ্রিস্টানদের তিক্ত বিবাদ পরাশক্তিগুলোর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়। ১৮৪৭ সালে ন্যাটিভিটি চার্চে গ্রিক ও ল্যাতিন পাদ্রিদের মধ্যে কলঙ্কজনক বিবাদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। খোয়া যাওয়া একটি রুপার তারা নিয়ে রক্ত ঝরে, তীব্র দোষারোপ দেখা যায়। এ নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের ‘রক্ষক’ ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে সঙ্ঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। আর ফ্রান্স এই সুযোগে পবিত্র স্থানগুলো নিয়ে তার দাবি আবার প্রকাশ করে। তবে রাশিয়া জবাব দেয়, স্থিতিবস্থা বজায় রাখতেই হবে, অন্যসব সম্প্রদায়ের চেয়ে গ্রিকদের অপেক্ষাকৃত উচ্চ মর্যাদায় রাখতে হবে। এই বিবাদ উসমানিয়া ভূখণ্ডে নতুন কোনো রুশ অগ্রগতি রুখে দিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার প্রয়োজনীয় অজুহাত পেয়ে যায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স। ১৮৫৪ সালে ক্রিমিয়া যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। নতুন সেক্যুলারবাদ সত্ত্বেও জেরুসালেম ইস্যুটি তখনো খ্রিস্টান শক্তিগুলোর মধ্যে বড় ধরনের সঙ্ঘাত ছড়িয়ে দিত।
রাশিয়ার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ১৮৫৫ সালে যুদ্ধ সমাপ্ত হলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইস্তাম্বুলের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে। কয়েক শত বছরের মধ্যে এই প্রথম খ্রিস্টানদের জন্য হারাম খুলে দেওয়া হয়। ব্রাবান্তের ডিউক ও ডুচেস ১৮৫৫ সালের মার্চে প্রথম পাশ্চাত্য পর্যটক হিসেবে পবিত্র ধর্মীয় স্থানটি পরিদর্শন করেন। এর কয়েক মাস পর যুদ্ধে ব্রিটেনের অংশগ্রহণের স্বীকৃতি হিসেবে স্যার মোসেস মন্টেফিওরি সাম ১২১ আবৃতি করতে করতে হারাম প্লাটফর্মে আরোহণ করেন। তবে তাকে সেডান চেয়ারে করে বহন করা হয়েছিল যাতে নিষিদ্ধ এলাকার কোথাও তার পা অসাবধনতা বশেও স্পর্শ না করে। অন্যদের আনুকূল্যও আসন্ন ছিল। ক্রুসেডার চার্চ সেন্ট আনা ফরাসি জনগণকে উপহার হিসেবে তৃতীয় নেপোলিয়নকে ফিরিয়ে দেন সুলতান। সুলতান সালাহউদ্দিন সেটিকে মাদরাসায় রূপান্তরিত করেছিলেন। আর ব্রিটিশরা জোর দিয়ে বলতে থাকে, হুরভা সিনাগগে ইহুদিদের যেন প্রবেশ করার সুযোগ দেওয়া হয়।
যুদ্ধের পর আধুনিকায়ন-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। খ্রিস্টান চার্চগুলো প্রিন্টিং প্রেস কিনে আনে। ১৮৬২ সাল নাগাদ দুটি ইহুদি প্রেস চালু হয়। এক বছরের মধ্যে সেখান থেকে দুটি হিব্রু পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ইহুদি ছেলেদের আধুনিক শিক্ষা প্রদান করার জন্য লাইমেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারা এখানে আরবি, গণিত ও সেইসাথে তাওরাতও শিখত। এটি ইহুদি মহল্লায় বৈরিতার সৃষ্টি করে। কারণ অধিকতর রক্ষণশীল ইহুদিরা, বিশেষ করে অ্যাশকেনাজিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা এই ইহুদি প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক রাখেনি। নগরীতে আধুনিক ভবনরাজি নির্মাণ শুরু হয়। অস্ট্রিয়া সরকার ১৮৬৩ সালে সুকের প্রধান রাস্তাগুলোর একটি মোড়ে ক্যাথলিক তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি পান্থনিবাস নির্মাণ করে। কাছাকাছি স্থানে দামাস্কাস গেটের কাছে বেজেথার সুন্দর একটি বাড়িতে অস্ট্রিয়ান কনস্যুলেট প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটিও আধুনিকতার কেন্দ্র সূচিত করে। ব্রিটিশ ও ফরাসি কনস্যুলেটগুলো এই এলাকায় সরিয়ে নেওয়া হয়। ফলে এটি শহরের অন্যতম আকর্ষণীয় এলাকায় পরিণত হয়।
অবশ্য প্রাচীর ঘেরা নগরী থেকে বের হওয়ার গতি ছিল অনেক বেশি। এটি শুরু হয় ১৮৫৭ সালে মন্টিফিওরি মাউন্ট সায়নের বিপরীতে এক টুকরা জমি কেনার অনুমতি লাভ করলে। এটি ছিল তালবিয়া এস্টেটের চেয়ে কয়েক শ’ গজ সামনে ছিল নগরীর। তিনি প্রথমে সেখানে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। পরে মন পরিবর্তন করে নিঃস্ব ইহুদি পরিবারগুলোর জন্য আশ্রয়শিবির নির্মাণ করেন। তিনিও অতিরিক্ত জনাকীর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর ইহুদি মহল্লা থেকে ইহুদিদের সরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কুঠিরগুলো থেকে দেখা যায়, এমন একটি পাহাড়ের ওপর জেরুসালেমের সবচেয়ে উন্নত উইন্ডমিল নির্মাণ করেন তিনি। ফিনের মতো মন্টিফিওরিও চেয়েছিলেন, ইহুদিরা যেন স্ব-নির্ভর হয়। অন্যান্য ইহুদি এই আইডিয়ায় আকৃষ্ট হয়। ১৮৬০ সালে রুশ ইহুদি ডেভিড ইয়েলিন নগরী থেকে পাঁচ মাইল পশ্চিমে ক্যালোনিয়া গ্রামের কাছে জমি কেনেন। ১৮৮০ সালে এসব নতুন ইহুদি শহরতলীর সংখ্যা ছিল ৯টি। এগুলোর একটি ছিল অ্যাশকেনাজি কলোনি। জাফা গেট থেকে অর্ধ মাইল দূরে মিয়া শেয়ারিম (শত তোরণ) নামে অভিহিত করা হতো। এটি তাওরাতের নিয়ম কঠোরভাবে অনুসরণ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। এতে ছিল নিজস্ব সিনাগগ, বাজার ও ইয়েশিভা (ইহুদি বিদ্যালয়)। তবে এসব বসতিতে সরে আসাটা ছিল বিপজ্জনক। মন্টিফিওরি কটেজের যাওয়া প্ৰথম পরিবারগুলো ডাকাতদের ভয়ে এত সন্ত্রস্ত্র থাকত যে তারা রাতের বেলায় চুপি চুপি তাদের পুরনো কুটিরে ফিরে যেত। অ্যাশকেনাজিমরা প্রায়ই মিয়া শেয়ারিমে যাওয়ার পথে হামলা চালাত। তা সত্ত্বেও বসতিগুলো সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ হতে থাকে। একবার তারা ইহুদি মহল্লা ত্যাগ করতে শুরু করার পর জেরুসালেমের ইহুদিদের স্বাস্থ্য নাটকীয়ভাবে ভালো হতে শুরু করে। ১৯ শতকে ইহুদি সম্প্রদায়ের দ্রুত বৃদ্ধির এটিও অন্যতম কারণ। আরেকটি কারণ হলো পরিচ্ছন্ন জীবিকা আয়ের নুতন সুযোগ সৃষ্টি। জেরুসালেমে ইহুদিদের জীবন সবসময়ই কঠিন ছিল। এ কারণে নবাগত অভিবাসীদের অনেকে স্যাফেদ বা তাইবেরিয়াসে বসতি স্থাপন করাকে অগ্রাধিকার দিত। এখন ওই বাধা দূর হয়েছে। ইহুদিরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের পবিত্র নগরীতে আসতে চাইত। স্যাফেদে যখনই কোনো ভূমিকম্প বা অন্য কোনো বিপর্যয় ঘটত, তারা সহজাতভাবেই জেরুসালেমে বসতি স্থাপন করত।
আরবরাও প্রাচীরের বাইরে বসতি স্থাপন শুরু করে। এর মাধ্যমে মুসলিম, খ্রিস্টান ও মিশ্র সমাজ সৃষ্টি হতে থাকে। ১৮৭৪ সালে নগরীর উত্তরে করিম আল- শেখ ও বাব আল-জাহরেবে, দামাস্কাস ফটক থেকে চার শ’ গজ উত্তর-পশ্চিমের মুরেসায়, জাফা তোরণ থেকে এক মাইল দূরে কাতামনে এবং হিন্মম ও কিদরন উপত্যকা থেকে দেখা যাওয়া আবু তুরে পাঁচটি আরব আবাসিক শহরতলী গড়ে ওঠে। খ্রিস্টান সমাজগুলোও প্রাচীরের বাইরে সরে যাওয়া শুরু করে। ১৮৬০ সালে সুইস জার্মান ব্রাদারহুড আরব শিশুদের জন্য জাফা ফটকের বাইরের খামারগুলোতে একটি এতিমখানা গড়ে তোলে। জার্মান নারী গির্জা-কর্মী জাফা রোডের দক্ষিণের খামারগুলোতে মেয়েদের জন্য তালিথা কুমি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭১ সালে ওরটেমবার্গের প্রটেস্ট্যান্টরা নগরীর দক্ষিণে জার্মান কলোনি নির্মাণ করে। তারা শুরু করে একটি চার্চ, একটি পান্থনিবাস, স্কুল ও হাসপাতাল দিয়ে। ১৮৮০ সালে আমেরিকান পরিবার স্প্যাফোর্ডস দামাস্কাস গেটের উত্তরে নতুন প্রটেস্ট্যান্ট মিশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে। এটি আমেরিকান কলোনিতে পরিণত হয়। খুব বেশি বিলম্ব হওয়ার আগেই রুশরা নগরীর পশ্চিমে একটি বিশাল পান্থনিবাস নির্মাণ করে। এতে এক হাজার তীর্থযাত্রীর স্থান সঙ্কুলান হয়। জাফা থেকে আগতদের প্রথমেই এর বিশেষ সবুজ গম্বুজগুলোই চোখে পড়ত। ক্যাথলিকেরাও ১৮৮০-এর দশকে প্রাচীরের বাইরে প্রতিষ্ঠান খোলা শুরু করে। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে দামাস্কাস গেটের বিপরীতে প্রাচীরের উত্তর-পশ্চিম কোণে স্কমিডট কলেজ, সেন্ট ভিনসেন্ট পল মনাস্টেরি, নটর ডেম ডি ফ্রান্স, সেন্ট লুই হাসপাতাল।
আধুনিক জেরুসালেমের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয় দামাস্কাস গেট। অবশ্য অনেক সময় পরিবহন মাধ্যম, পোশাকের স্টাইল আর স্থাপত্য নতুন ও পুরাতন পাশাপাশি অবস্থান করতে থাকে।
আরব জেরুসালেমও উন্নত হতে থাকে। ১৮৬৩ সালে নগরীতে প্রথম মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল (বালাদিয়া অল-কুদস) প্রতিষ্ঠিত হয়। ভায়া ডেলোরোসায় দুটি ছোট রুমে ছিল এর অফিস। ইস্তাম্বুলে এ ধরনের অফিস চালুর পর সম্ভবত জেরুসালেমেই ছিল এ ধরনের প্রতিষ্ঠান চালু হওয়া প্রথম উসমানিয়া শহর। ১০ সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিলে ছিলেন ছয়জন মুসলিম, দুজন খ্রিস্টান, একজন ইহুদি; ১৯০৮ সালে ইহুদি সংখ্যা বাড়িয়ে দুই করা হয়েছিল। নগরীতে উত্তেজনা সত্ত্বেও তিন ধর্মের লোকজন সৃষ্টিশীলভাবে একসাথে কাজ করতে সক্ষম হয়েছিল। পুরুষ উসমানিয়া নাগরিকদের ভোটে প্রতি চার বছরের জন্য কাউন্সিল নির্বাচিত হতো। ভোটার হওয়ার যোগ্যতা ছিল তাদের বয়স হতে হবে ২৫ বছরের বেশি এবং বছরে অন্তত ৫০ তুর্কি পাউন্ড কর দিতে হবে। নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে মেয়র নিয়োগ করতেন গভর্নর। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত বেশির ভাগ মেয়রই হতেন খালিদি, আলামি, হোসাইনি ও দাজানি পরিবারগুলো থেকে। নিয়োগের সময় বিখ্যাত খান্দানগুলো বিশেষ করে খালিদি ও হোসাইনি পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা হতো। জেরুসালেমের উন্নয়নে মিউনিসিপ্যালিটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করত। একেবারে শুরু থেকে সংস্থাটি জেরুসালেমের অবকাঠামো উন্নয়ন, ফুটপাত তৈরি ও রাস্তা পরিচ্ছন্ন রাখা, পয়ঃনিষ্কাষণ স্থাপন, নগরীকে আলোকিত ও পরিষ্কার রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো। ১৮৯০-এর দশকে কাউন্সিল নিয়মিতভাবে পানি ছিটানো, আবর্জনা সংগ্রহ, রাস্তায় রাস্তায় গাছ লাগনো, জাফা রোডে নগর পার্ক প্রতিষ্ঠা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পুলিশ বাহিনী প্রবর্তন করাও ছিল কাউন্সিলের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তারা বিনা পয়সায় চিকিৎসা সহায়তাও প্রদান করত। শতাব্দীর শেষ প্রান্তে জাদুঘর ও জাফা গেটের কাছে একটি থিয়েটার স্থাপন করা হয়। থিয়েটারে তুর্কি, আরবি ও ফরাসি ভাষায় অনুষ্ঠান হতো। উসমানিয়া সাম্রাজ্যে অল্প কিছু নগরীতেই কেবল এ ধরনের সক্রিয় ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মিউনিসিপ্যাল সংস্থা ছিল।
এসবের অন্যতম পথিকৃত ছিলেন ইউসুফ আল-খালিদি। তিনি ৯ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ফিলিস্তিনি নতুন নগরবাসীর প্রতিনিধিত্ব করতেন। তিনি জেরুসালেমের প্রথম আরব হিসেবে আধুনিক, পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য খালিদির কোনো জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা ছিল না। তিনি ছিলেন অনুগত উসমানিয়া নাগরিক। ১৮৭৭-৭৮ সময়কালে স্বল্প মেয়াদি উসমানিয়া পার্লামেন্টে জেরুসালেমের প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। এখানে তিনি নির্ভীকভাবে সুলতান আবদুল হামিদের প্রশাসন দখল ও অসাংবিধানিক আচরণের সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সংস্কার করা উসমানিয়া রাষ্ট্রের উচিত আধুনিক শিক্ষা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সাংবিধানিক অধিকার ও উন্নত অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা।১৮৭৯ সালে বরখাস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন জেরুসালেমের স্থানীয় নায়ক। স্থানীয় পরিবারগুলোর ক্ষমতা কেড়ে নিতে উদ্যোগী গভর্নর রউফ পাশা তাকে অপসারণ করেছিলেন। এটি জেরুসালেমে খালিদিদের রাজনৈতিক উত্থানের সমাপ্তি ঘটায়, আরো রক্ষণশীল ও অসহিষ্ণু হোসাইনিদের এগিয়ে যাওয়ার সূচনা ঘটায়। তবে জেরুসালেমে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় এ ধরনের ঘটনা সবসময় সহায়ক হয় না।
রউফ পাশা চেষ্টা করেছিলেন খালিদি ও অন্যান্য আরব অভিজাতের স্থানে তুর্কি কর্মকর্তাদের বসাতে। তবে এ নিয়ে জেরুসালেমে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এই ব্যবস্থাকে আরববিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছিল। এটি ছিল নতুন ঘটনা। এর পর থেকে জাতিগত পরিচিতির চেয়ে ধর্মীয় পরিচিতিই অনেক বেশি গুরুত্ব পেতে থাকবে। ১৮২৫ সালের আন্দোলনের সময় প্রথম আত্মপ্রকাশ করা নতুন আরব সচেতনতা ফিলিস্তিনের আরব জাতীয়তাবাদকে প্রথমবারের মতো নাড়া দিতে থাকে। কনস্যালরা লক্ষ্য করেন যে জেরুসালেমের আরবদের ক্ষোভে তুর্কিরা ক্রমবর্ধমান হারে বিরক্ত হচ্ছে। এসব আরব ভবিষ্যতের সংগ্রামে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। স্বতন্ত্র আরব পরিচিতি ঘোষণার আরেকটি নিদর্শন দেখা যায় ১৮৭২ সালে। এ সময় গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের আরব সদস্যরা তাদের চার্চে অধিকতর অংশগ্রহণের জন্য জোরালো আন্দোলন শুরু করে। তারা এলিট গ্রিক সংখ্যালঘুদের হাতে তাচ্ছিল্যের শিকার ও কোণঠাসা রয়েছে বলে মনে করতে থাকে। জেরুসালেমে বিবাদ শুরু হলেও তা ফিলিস্তিনের বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে উৎসাহ দিয়েছিলেন রুশ কনস্যাল। পবিত্র ভূমিতে অর্থোডক্সির গ্রিক প্রাধান্যে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে তার নিজস্ব অজুহাত ছিল। একপর্যায়ে আরব আচরণ এত সহিংস হয়ে পড়ে যে ব্রিটিশ কনস্যাল একে বিদ্রোহের প্রাথমিক অবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও আরব ক্ষোভ ভেতরে ভেতরে ধূমায়িত হতে থাকে। ১৮৮২ সালে আরব খ্রিস্টানেরা তাদের চার্চে বিদেশী নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অর্থোডক্স প্যালেস্টাইন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আরবরা তাদের দেশের জন্য নিজস্ব পরিকল্পনা প্রণয়নের চেষ্টা করে। তবে ইউরোপিয়ানরাও ফিলিস্তিনি অবস্থানের দিকে আগ্রহ নিয়ে চোখ রাখছিল। তারা জেরুসালেমের আধুনিকতাকে ‘শান্তিপূর্ণ ক্রুসেড’ হিসেবে দেখতে চাচ্ছিল। তারা চাচ্ছিল এর মাধ্যমে দখল ও আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে। ফরাসিরা একটি সফল ক্রুসেডের মাধ্যমে জেরুসালেম ও সমগ্র প্রাচ্যকে ক্রুশের অধীনে আনার কথা ভাবছিল। তাদের কাজ ছিল সুলতানের অধীন থেকে জেরুসালেম মুক্ত করা, তাদের প্রধান অস্ত্র হবে উপনিবেশবাদ। জার্মান কলোনি নির্মাণকারী প্রটেস্ট্যান্টরা নিজেদেরকে টেম্পলার্স বলত। তারা তাদের সরকারকে ক্রুসেডারদের কাজ সম্পন্ন করার তাগিদ দিত। ব্রিটিশদের ছিল ভিন্ন নীতি। তারা জাতিগত জায়নবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাদের বাইবেল পাঠ তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করেছিল যে ফিলিস্তিনির মালিক ইহুদিরা। ১৮৭০-এর দশকেই সংযত ব্রিটিশ পর্যবেক্ষকেরা গ্রেট ব্রিটেনের সুরক্ষায় ফিলিস্তিনে ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এটি প্রটেস্ট্যান্ট ইংল্যান্ডের অনেক লোকের কাছে অবধারিত ধারণায় পরিণত হয়। এখানে বাইবেল অনেকটা আক্ষরিক অর্থে পাঠ করা হতো। এতে বলা হতো, ইহুদিরা একদিন জায়নে ফিরে যাবে, আর আরবরা সাময়িক সময়ের আন্দোলনকারী।৮
ইউরোপিয়ানরা দেশটিকে দখল করার উপায় হিসেবে জেরুসালেমে আধুনিকতাকে ব্যবহার করছিল। ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ রয়্যাল ইঞ্জিনিয়ার্সের ক্যাপ্টেন চার্লস উইলসন জেরুসালেমের পানিবিজ্ঞান সমীক্ষার জন্য ফিলিস্তিনি আসেন। তিনি পবিত্র নগরীর প্রথম সরকারি মানচিত্র প্রস্তুত করেছিলেন। এতে পাশ্চাত্য মানসিকতায় পুরনো ঐশী ভূগোল ছাপিয়ে যাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। হারামের ভূগর্ভস্থ জলাধার অনুসন্ধানের সময় উইলসন ‘রবিনসন্স আর্চের সমান্তরালে একটি বিশাল স্মারক আর্চ লক্ষ্য করেন। প্রস্তাবিত নতুন পানিব্যবস্থার চেয়ে ‘রবিনসন্স আর্চ’ ব্রিটিশ জনমানষে অনেক বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। উইলসনের ডিসপ্যাচের ফলে পবিত্র ভূমির প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস গবেষণার জন্য ১৮৬৫ সালে প্যালেস্টাইন এক্সপ্লোরেশন ফান্ড (পিইএফ) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শান্তিপূর্ণ ক্রুসেডের’ সহজাত দাবির আলোকে নতুন সোসাইটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এর সভাপতি ইয়র্কের আর্চবিশপ বক্তব্য রাখেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘ফিলিস্তিন দেশটির মালিক আপনি ও আমি; এটি অনিবার্যভাবেই আমাদের। এই ভূমি থেকেই আমাদের মুক্তির বার্তা এসেছিল। এই ভূমিতেই আমাদের সব আশার ভিত্তি রয়েছে। এই ভূমিতে প্রতি আমরা এই পুরনো ইংল্যান্ডের মতোই দেশপ্রেমের দিকে তাকিয়ে থাকি।’ খ্রিস্টান কল্পনাশক্তিতে ফিলিস্তিন এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ হওয়াতে নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে নির্মোহ দৃষ্টিতে বিবেচনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এটি যেভাবেই হোক না কেন খ্রিস্টান অহং ও পরিচিতির অংশে পরিণত হয়। এতে করে সেখানে সত্যিই যারা বসবাস করছে ও যারা নিজেদের দেশ বানিয়েছে, তাদেরকে আমলে নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিতে বিবেচনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ফিলিস্তিনের জনগণ অল্প সময়ের মধ্যেই এই নতুন ক্রুসেডিং প্রত্নতত্ত্বের নেপথ্যে থাকা বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়ে পড়ে। ১৮৬৩ সালে জেরুসালেমে ডি সলসি ফিরে আসেন রাজাদের কবর খননকাজ অব্যাহত রাখতে। এবার তিনি ক্রুদ্ধ স্থানীয় অধিবাসীদের তোপের মুখে পড়েন। তারা তাদের ভূমি ও সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ দাবি করে। কিন্তু তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন। ইহুদিরাও অভিযোগ করে যে ডি সলসি তাদের পূর্বপূরুষদের কবর অপবিত্র করছে। ইউরোপিয়ানরা মনে করতে থাকে যে তারা যেখানে অনুসন্ধানকাজ চালাচ্ছে, সেখানে তা করার একচেটিয়া অধিকার তাদের আছে। রয়্যাল ইঞ্জিনিয়ার্সের চার্লস ওয়ারেন ১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেরুসালেমে পৌঁছে দেখতে পান যে কৰ্তৃপক্ষ বৈরী ও সন্দিহান। তাকে খোদ হারামে খননকাজ চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি : এসব নতুন ক্রুসেডারের ক্রুবার, জ্যাক আর ব্লাককে পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। সমস্যাটি সমাধান করার জন্য হারামের দক্ষিণ প্রান্তের দিকে একটি বেসরকারি প্লট ভাড়া নিয়ে গভীর গর্ত খনন করে ভূগর্ভের পথ দিয়ে প্রাচীরের ভিত্তি পর্যন্ত যান ওয়ারেন। তিনি আবিষ্কার করেন যে হেরডের টেম্পলটি বাইবেল আমলে সঞ্চিত নরম খোয়া জমে জমে ও টাইরোপোয়ন ভ্যালিতে জমা হওয়া স্তুপের ওপর নির্মিত হয়েছিল। ওফেল খননের সময় তিনি প্রাচীন জেবুসিত পানি প্রবাহ ব্যবস্থার দেখা পান। এটিই পরে ‘ওয়ারেন শ্যাফট’ নামে পরিচিত হয়।
ফিলিস্তিনে তথ্যানুসন্ধানী পাশ্চাত্য পর্যটকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছিল। পুরনো আমলের তীর্থযাত্রীদের মতো তারা আর বিশ্বাসের আলোকে ঐশী ভূগোল অনুসন্ধান করত না। তারা বরং এমন প্রমাণ সংগ্রহ করার চেষ্টায় থাকত যাতে প্রমাণিত হয় যে তাদের বিশ্বাস সত্য। পিইএফ জাফা গেটে একটি দোকান ও লেকচার রুম প্রতিষ্ঠা করে। গাইডদেরকে পিইএফের অনুসন্ধানকারীদের গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে জেরুসালেমের ইতিহাসবিষয়ক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতো। ‘বাইবেলের প্রত্নতত্ত্ব শুরু হয়েছিল বুদ্ধিবৃত্তিক নিশ্চয়তা অনুসন্ধান করতে। তবে এটি আরো জটিল বাস্তবতা উন্মোচন করতে থাকায় ওই ধরনের নিশ্চয়তাকে কঠিন করে তুলছিল। জেরুসালেমের অতীত সম্পর্কে সহজ বিবৃতি তৈরি করা সত্যিই সম্ভব ছিল না। আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ববিদ ফ্রেডেরিক জে ব্লিসের খননকাজের ফলে জেরুসালেম থেকে প্রায় ৩০ মাইল দক্ষিণে তেল আল-হেসিতে একটি প্রাচীন হস্তলিপি ট্যাবলেট আবিষ্কৃত হয়। এটি সম্প্রতি মিসরের লেত আল-আমারনায় পাওয়া ট্যাবলেটগুলোর মতো। স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে, ‘পবিত্র ভূমির ইতিহাস বাইবেল দিয়ে শুরু হয়নি। ব্লিস জেরুসালেমেও একই জটিলতার সন্ধান পান। তিনি প্রমাণ না করতে পারলেও বুঝতে পারেন যে দাউদের মূল নগরীটি কয়েক শ’ বছর ধরে লোকজন যেমনটি মনে করছে, সে অনুযায়ী মাউন্ট সায়নে ছিল না। বরং তা ছিল ওফেল পাহাড়ে। এটি কি তথাকথিত দাউদ সমাধির জন্য সংগ্রাম করা মূর্খতাপূর্ণ কাজ হিসেবে প্রমাণ করছে? ওফেলে খননকাজ শুরু হলে ব্লিস দেখতে পান যে ইর ডেভিড খনন করা ও এর রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব নয়। তিনি প্রাচীন যেসব কাঠামোর সাক্ষাত পান, সেগুলোর কয়েকটির তারিখ নির্ধারণ সহজ নয়। তবে তাতে স্পষ্ট হয় যে পাহাড়টিতে ব্রোঞ্জ যুগ থেকে বায়েজন্টাইন আমল পর্যন্ত অব্যাহতভাবে লোকজন বাস করে গেছে। বিভিন্ন স্তর সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর অবস্থায় একে অপরকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে জেরুসালেমের অতীত সম্পর্কে নির্ভুল ছবি তৈরি করতে প্রত্নতত্ত্ববিদদের অনেক বছর সময় লেগে যাবে। বাইবেল-পাঠের বিশ্বাসী মন যতটা ধারণা করে, তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল এ বিষয়টি।১০
ডোমিনিক্যান প্রত্নতত্ত্ববিদ হিউ ভিনসেন্ট ১৯১০ সালে ওফেলে রিসের খননকাজের বাকি অংশ সম্পন্ন করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে জেরুসালেমে প্রাথমিক নগরী আসলে মাউন্ট সায়নে নয়, এখানেই ছিল। তিনি ব্রোঞ্জ যুগের কবর, পানিব্যবস্থা, দুর্গ খুঁজে পান। এতে প্রমাণ হয় যে দাউদের আগেও সেখানে শহরের অস্তিত্ব ছিল।’ ফলে ইহুদিরাই ছিল এ নগরীতে প্রথম, কাজেই এটি তাদের- এমন দাবি করা সম্ভব নয়। বস্তুত বাইবেল পরোক্ষ ও অস্পষ্ট পন্থায় দেখিয়েছে যে ইসরাইলিরা আদিবাসী জনসাধারণের কাছ থেকে ফিলিস্তিন ও জেরুসালেম উভয়টি কেড়ে নিয়েছিল। অর্থাৎ আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদেরা বিশ্বাসের বেশ কিছু অবধারিত বিষয়ও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন।
জেরুসালেম মুসলিমদের কাছে প্রত্নতত্ত্ব তখনো এমন আশঙ্কাপূর্ণ ঈশ্বর- অবমাননাকর তৎপরতা যা রূঢ়, আগ্রাসী সব পন্থায় ঐশী সত্তার রহস্যে অনুপ্রবেশ করতে চায়। পিয়েরে ভিনসেন্টের খননকাজ হয়েছিল আর্ল অব মর্লের ছেলে মন্টেগু ব্রাউনলো পার্কারের লজ্জাজনক অভিযানের প্রেক্ষাপটে। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে হারামের ভূগর্ভস্থ ভল্টগুলোতে গুপ্তধন চাপা পড়ে আছে। পুরোপুরি অপ্রশিক্ষিত পার্কার যাতে মূল্যবান প্রমাণ ধ্বংস না করে ফেলেন, তা নিশ্চিত করতেই ভিনসেন্ট তাকে সহায়তা করতে রাজি হয়েছিলেন। ১৯১০ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে পার্কার ঘুষ দিয়ে হারামে প্রবেশ করে রকের নিচে গুহায় অনুসন্ধান শুরু করেন। হারামে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এক মুসলিম প্রহরী শব্দ শুনে ডোম অব রকে ছুটে গিয়ে পার্কারকে একটি হাতকুঠার দিয়ে ঐশী টিলাটি খুঁড়তে দেখেন। জেরুসালেমের মুসলিমেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, কয়েক দিন ধরে নগরীতে দাঙ্গা চলে। পার্কার ছিলেন পাশ্চাত্য সেক্যুলারবাদের সবচেয়ে খারাপ ঘটনার উদাহরণ। তিনি প্রাচীন পবিত্রতার বিধান লঙ্ঘন করেছিলেন এবং জ্ঞান আহরণের জন্য নয়, বরং আক্ষরিকভাবেই পুরোপুরি পুরোপুরি জাগতিক লাভের জাগতিক লাভের জন্য পবিত্রতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলেন।
আধুনিকতা ধীরে ধীরে ধর্মকে বদলে দিচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের লোকজন নিদর্শন ও ছবিতে থাকা চিন্তাভাবনার শিল্প হারিয়ে ফেলেছিল। এর বদলে তারা চিন্তাধারার আরো রৈখিক, অসংলগ্ন ধারা তৈরি করতে থাকে। সমাজবাদ ও জাতীয়তাবাদের মতো নতুন নতুন মতাদর্শ পুরনো ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকে। তারপরও ঐশী ভূগোলের পুরানতত্ত্ব গভীরে প্রবেশ করে। আমরা দেখিছি যে এ ধরনের ধর্ম মানানসই মনে করেনি বায়েজান্টাইন খ্রিস্টানেরা, পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় তাদের ধারণাগুলোও সংশোধন করে নিয়েছিল। খ্রিস্টের কবর আবিষ্কার হওয়ামাত্র তারা দ্রুত ঐশী স্থানের নিজস্ব পুরানতত্ত্ব বিবর্তিত করেছিল। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে অনেক ইহুদি জায়নের পুরনো মতাদর্শ নতুন পন্থায় বলতে থাকে। ইউরোপিয়ান ইহুদিরা একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। ফ্রান্স, জার্মানি ও ইংল্যান্ডে তারা মুক্তি পেয়ে আধুনিক সেক্যুলার সমাজে যোগ দিতে উৎসাহিত হয়। তবে ঘেটো থেকে মুক্তি পেয়ে অনেকে বিকশিত হলেও অন্যদের কৌতূহল হারিয়ে গেছে বলে মনে হতে থাকে। তারা তাদের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই নিজেদেরকে ভাসমান অবস্থায় দেখতে পেল। আধুনিক বিশ্বে ইহুদি হওয়ার মানে কী? জেরুসালেম কি ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয় ছিল? কিছুসংখ্যক ইহুদি পৌরাণিক কাহিনীমুক্ত বিশ্বাস তৈরি করে যা পরিকল্পিতভাবে মেসাইনিবাদ ও টেম্পল পুনঃনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা এড়িয়ে যায়। তারা আসলে রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করতে চেয়েছিল। তবে অন্যদের কাছে এই সমাধান সন্তোষজনক মনে হয়নি। অধিকন্তু, তারা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছিল যে ইউরোপের এই নতুন সহিষ্ণুতা কৃত্রিম। সেমিটিকবাদবিরোধিতা খ্রিস্টান প্রকৃতির অনেক গভীরে প্রোথিত, এটি সহজে দূর হওয়ার নয়। ইউরোপিয়ানরা কার্যত তাদের নতুন উদ্দীপনার আলোকে ইহুদিদের সম্পর্কে তাদের পুরনো কল্পকথা নতুন করে ব্যাখ্যা করেছিল। কিছু সংখ্যক ইহুদি ক্রমবর্ধমান হারে দূরে সরে যাচ্ছিল, সাহসী নতুন আধুনিক বিশ্বে তারা অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল। তাদের নিজেদের জন্য একটি সত্যিকারের স্থান না থাকায় তারা সহজাতভাবেই জায়নের দিকে মুখ ফেরায়।
দামাস্কাসে ফ্রান্সিসক্যানদের প্ররোচনায় ইসলামি বিশ্বের প্রথম সেমিটিকবিরোধী প্রগ্রমের পর ১৮৪০-এর শতকের শুরুর দিকে সারায়েভোর সেফারদিক রাব্বি ইহুদা হাই আলচেলাই নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার জন্য ইহুদিদের প্রতি আহ্বান জানান। তারা ইসলামি বিশ্বকে যতটুকু নিরাপদ মনে করেছিল, কার্যত তা ছিল না। মেসাইয়ার জন্য অসহায়ভাবে অলস বসে থাকা কোনো কাজের বিষয় ছিল না : পরিত্রাণ শুরু হবে ইহুদিদের নিজেদের প্রয়াসে, লিখেছেন মিনহাত ইয়েহুদা।১২ তাদেরকে অবশ্যই সংগঠিত হতে হবে, নেতা পছন্দ করতে হবে, ফিলিস্তিনে ভূমি কেনার জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে হবে। ১৮৬০ সালে অ্যাশকেনাজিক রাব্বি জভি হিরশচ ক্যালিশচার পোল্যান্ডে তার স্থানীয় প্রতিবেশীদের মধ্যে নতুন জাতীয়তাবাদ দেখে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। এটি নিজেদের কোনো ভূমি না থাকা ইহুদিদের কোথায় নিয়ে যাবে? তাদেরকে অবশ্যই তাদের নিজস্ব জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করতে হবে। ক্যালিশচার আরো ভাবলেন যে মেসাইয়ার জন্য নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে থাকাটা ভালো হবে না। ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনের জন্য মন্টিফিওরি ও রথচাইল্ডদের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ইহুদিরা নিজেদের বলে দাবি করতে পারে এমন একটি স্থানে তাদের গণ-অভিবাসনের ব্যবস্থা করা উচিত। বেশির ভাগ অর্থোডক্স রাব্বি, তারা আধুনিকতার ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দিতে নারাজ ছিলেন এবং কঠোরভাবে ঐতিহ্যবাহী ব্যবস্থা অনুসরণ করতেন, নতুন জায়নবাদে কোনো ভূমিকা পালন করতেন না। তারা একে তাড়াহুড়া করে পরিত্রাণকে সংগঠনের অধার্মিক প্রয়াস হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। তবে অ্যালচেলাই ও ক্যালিশচার প্রমাণ করেছিলেন, বৈরী বিশ্বে ইহুদিরা যখন নিজেদের নিঃসঙ্গ মনে করছেন, তখন তাদেরকে জায়নের দিকে তাকানোই সহজাত ব্যাপার। জায়নবাদ ছিল সেক্যুলার আন্দোলন। ধর্মের প্রতি আস্থা হারানো ইহুদির বেশির ভাগই এতে উদ্দীপ্ত হলেও এই দুই রাব্বি প্রমাণ করেন যে আন্দোলনটির ধর্মীয় সম্ভাবনাও রয়েছে।
অবশ্য যে লোকটিকে জায়নবাদের পিতা হিসেবে অভিহিত করা হয় তার নাম মোসেস হেস। মার্কস ও অ্যালেঞ্জসের শিষ্য হেস সমাজবাদ ও জাতীয়তাবাদের বৈপ্লবিক আদর্শের আলোকে পুরনো বাইবেলবিষয়ক পুরানতত্ত্ব নতুন করে ব্যাখ্যা করেন। ধর্মের বদলে বর্ণের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদী জার্মানিতে সেমিটিকবাদবিরোধী মনোভাব বাড়ার নতুন অবয়বটি দেখতে পেয়েছিল যেসব লোক, তিনি ছিলেন তার অন্যতম। জার্মানরা পিতৃভূমির প্রতি অনেক বেশি নিবেদিতপ্রাণ হওয়ায় ইহুদিদের ঘৃণা ও নির্যাতন করা হবে। কারণ ইহুদিরা আর্য জাতি নয়, তাদের নিজেদের কোনো ভূমি নেই। ওই সময় খুব কম লোকই হেসের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। কারণ তখন বেশির ভাগ লোকের মনে হচ্ছিল যে ইহুদিদের একীভূত করে নিতে চায় জার্মানি। তবে ওই সময় সমাজের অনেক গভীরে থাকা স্রোতটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন হেস। তিনি তার জায়নবাদী ক্লাসিক রোম অ্যান্ড জেরুসালেমে (১৮৬০) যুক্তি দিয়েছিলেন যে ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনে একটি সমাজবাদী সমাজ গড়তেই হবে। মাজিনি যেভাবে তাইবারে শ্বাশত নগরী মুক্ত করেছিলেন, ইহুদিদেরও মাউন্ট মরিয়ার শ্বাশত নগরী মুক্ত করতে হবে। সমাজবাদ ও ইহুদিবাদ পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। নবীরা ন্যায়বিচারের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন, গরিবদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইহুদিরা জেরুসালেমে সমাজবাদী কমনওয়েলথ প্রতিষ্ঠা করা মাত্র জায়ন থেকে আবার আলো বের হতে থাকবে। হেস যেটিকে ইতিহাসের সাবাথ’ বলেছিলেন, এটি তাই হবে। আর কার্ল মার্ক্সের ভব্যিদ্বাণী করা ইউটোপিায়কে মেস মেসাইনিক রাজ্যের সাথে তুলনা করেন।
ইউরোপে যেসব ইহুদি মনে করত যে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, তারা জার্মান ইতিহাসবিদ হেইনরিচ গ্রাটজের কথায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠল। তিনি তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যে ইহুদি ধর্ম তাদের আমলের অতি মাত্রায় রাজনীতিতে ভারাক্রান্ত বিশ্বেও প্রাসঙ্গিক। হিস্টরি অব দি জিওশ ফ্রম দি অ্যানসিয়েন্ট টাইমস টু দি প্রেজেন্ট (১৮৫৩-৭৬) নামের তার ইহুদি ইতিহাসবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে গ্রাটজ যুক্তি দেন যে সংস্কার মনস্ক ইহুদিদের সুপারিশ মতো রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করা কিংবা খ্রিস্ট ধর্মের অনুসরণ করার মধ্যে কোনো লাভ নেই। ইহুদি ধর্ম অনিবার্যভাবেই রাজনৈতিক বিশ্বাস। রাজা দাউদের সময় থেকে ইহুদিরা সৃষ্টিশীলভাবে ধর্মকে রাজনীতির সাথে সংযুক্ত করেছে। এমনটি টেম্পল হারানোর পরও ইহুদিরা পবিত্র ভূমির বিকল্প হিসেবে তালমুদ বিকশিত করেছিল। তাওরাত বিশ্বের যেকোনো স্থানের প্রতিটি ইহুদি বাসাকে নিখুঁতভাবে ফিলিস্তিনিতে পরিণত করতে পারত। ৩ অর্থাৎ তাদের রক্তে রয়েছে পবিত্র ভূমি। ‘ফলে যে কেউ বলতে পারত যে তাওরাত, জাতি ও পবিত্র ভূমির একটির সাথে অপরটির আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ছিল। তারা অদৃশ্য বন্ধনে অবিভাজ্যভাবে ঐক্যবদ্ধ।’ এগুলোর ছিল ঐশী মূল্য, ইহুদি পরিচিতির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তিনি হেসের গবেষণার প্রশংসা করলেও ইহুদিদের ফিলিস্তিনে অভিবাসনের পক্ষে কথা বলেননি। তিনি পবিত্র নগরী সফরের সময় জেরুসালেমের পশ্চাদমুখী ধারণায় বিশ্বাসী ইহুদি ও সেখানকার চরম নোংরা পরিবেশ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে ছিলেন। জায়নবাদী স্বার্থের প্রতি তার অবদান ছিল তার গ্রন্থ হিস্টরি। এই গ্রন্থ ইহুদিদের একটি পুরো প্রজন্মকে শিক্ষিত করে, তাদেরকে আধুনিক দর্শনের আলোকে তাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধু করে।
ফিলিস্তিন ও জেরুসালেমের ইতিহাসে ১৮৮১-৮২ সময়কালটি ছিল মাইলফলক। প্রথমত, ব্রিটিশরা মিসর জয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলে তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। আসন্ন সংগ্রামে তারা ভাগ্য নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। মিসরীয় অভিযানে অন্যতম নায়ক ছিলেন জেনারেল চার্লস ‘চাইনিজ’ গর্ডন। খার্তুম পতনের পর সুদানে তাকে হত্যা করা হয়। জেরুসালেমে তার প্রধান অবদান ছিল ‘গার্ডেন টম্ব’ আবিষ্কার। হলি সেপালচার চার্চের প্রতি বিরক্ত অনেক ইউরোপিয়ান এই সেকেলে ভবনটিকে ক্রুদ্ধ, অমার্জিত সন্ন্যাসীদের সাথে তাদের ধর্মের নির্মল মরমিবাদের সাথে মেলাতে পারেননি। জেরুসালেম নিয়ে উইলসনের অর্ডন্যান্স জরিপ পাঠ করে গর্ডন লক্ষ করেন যে নক্সা রেখাগুলোর একটি নারীদেহের মতো, যা ‘মাথাটি’ দামাস্কাস গেটের উত্তরের ছোট একটি পাহাড়। এটি অবশ্যই ‘খুলির স্থান’ (প্লেস অব দি স্কাল) হবে। তিনি তার তথাকথিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর আস্থা রেখে সেখানে দৃশ্যত প্রাচীন পাথর কবর দেখতে পান। তিনি সাথে সাথে পাহাড়টিকে গলগোথা এবং কবরটিকে খ্রিস্টের কবর হিসেবে চিহ্নিত করেন। তার মৃত্যুর পর গার্ডেন টম্ব পরিণত হয় প্রটেস্ট্যান্ট পবিত্র স্থান। এটি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্মৃতিসৌধ। এটি জেরুসালেমের ইতিহাস স্থায়ীভাবে বদলে দিয়েছিল।
রাশিয়ায় ১৮৮২ সালে ভয়াবহ ইহুদি নির্যাতন (প্রগ্রোম) ছড়িয়ে পড়ার পর ফিলিস্তিনে প্রথম দিককার জায়নবাদী কলোনিগুলো গড়ে ওঠে। তবে এগুলো জেরুসালেমে নয়, গ্রামীণ এলাকায় ছিল। এসব কলোনি সমাজবাদী আদর্শে পরিচালিত হতো। এগুলো সফল না হলেও ফিলিস্তিনকে বদলে দেওয়া ইহুদি উদ্দীপনা একটি স্থানীয় প্রকৃতি লাভ করে, মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। প্যাট্রিয়ার্কদের ভূমিতে জায়নবাদ বাস্তব অস্তিত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৮৯৯ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্রাসেলসে প্রথম সম্মেলনের মাধ্যমে জায়নবাদীরা তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম লাভ করে। প্রথম দিকের এসব জায়নবাদীর অনেকে সেক্যুলারপন্থী হলেও এবং তারা ঐতিহ্যবাদী ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাসে আর বিশ্বাসী না হলেও তারা তাদের আন্দোলনকে পবিত্র নগরীর অন্যতম প্রাচীনতম নামে অভিহিত করত, যা দীর্ঘ দিন মুক্তির ভাবমূর্তি ছিল। তারা প্রচলিত ইহুদি কল্পনাচিত্রে তাদের আদর্শগুলো প্রকাশ করত। এ কারণে জায়নবাদের মুখপাত্রে পরিণত হওয়া থিওডোর হারজলকে মঞ্চে উঠতে দেখে বেশ উদ্দীপ্ত হয়েছিল। তাকে ‘সকল কিংবন্তির গৌরব নিয়ে হঠাৎ করে কবর থেকে ওঠে আসা রাজা দাউদ পরিবারের কোনো এক সদস্যের’ মতো লাগছিল বলে স্মৃতিচারণ করেছিলেন ওযেসা থেকে যাওয়া প্রতিনিধি মরডেচাই বেনঅ্যামি। মনে হচ্ছিল দুই হাজার বছর ধরে আমাদের জনগণ যে স্বপ্নকে লালন করে আসছিল, সেটি অবশেষে সত্যে পরিণত হলো, দাউদের সন্তান মেসাইয়া আমাদের সামনে দাঁড়ালেন। ১৫
হারজল অবশ্য মৌলিক চিন্তাবিদ ছিলেন না। অবশ্য তার গ্রন্থ দি ইহুদি স্টেট (১৮৯৬) জায়নবাদী ক্লাসিকে পরিণত হয়েছিল। তিনি ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিও ছিলেন না। তিনি একীভূত হওয়ার আদের্শ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন, এমনকি খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনাও গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তবে তিনি ফ্রান্সের ড্রেফাস ঘটনায় মর্মাহত হয়েছিলেন। এতে ইহুদি লোকজনের রক্ষাকবচ না থাকার বিষয়টিই ফুটিয়ে তুলেছিল। আসন্ন সেমিটিকবিরোধী বিপর্যয় তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন (যথার্থভাবে)। তিনি ইহুদিদের জন্য একটি স্বর্গভূমি পাওয়ার চেষ্টায় কঠোর পরিশ্রম করে যান। গণসংযোগের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি সুলতান, পোপ, কায়সার, ব্রিটিশ উপনিবেশিক সচিবের সাথে ছুটে যান। এর মাধ্যমে তিনি জায়নবাদকে বিশ্বের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে পরিচিত করতে সক্ষম হন। নতুন ইহুদি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনেই হতে হবে, এমনটি তিনি বিশ্বাস করতেন না। তার মতে উগান্ডায় হতে পারে এমন একটি রাষ্ট্র। কিন্তু দ্বিতীয় জায়নবাদী সম্মেলনে তার প্রস্তাবটি প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়লে তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। নেতৃত্ব ধরে রাখার জন্য হারজলকে তার আইডিয়াটিকে পরিত্যাগ করতে হয়েছিল। তিনি প্রতিনিধিদের সামনে তার ডান হাত উঁচু করে সাম থেকে এ কথাগুলো উদ্ধৃত করেন : ‘আমি যদি ভুলে যাই, হে জেরুসালেম, আমার ডান হাত যেন শুকিয়ে যায়!’
অবশ্য ১৮৯৮ সালে হারজল যখন সত্যিই জেরুসালেম সফর করেছিলেন, তিনি তেমন অভিভূত হননি। বরং তিনি এর ‘দুর্গন্ধময় অলিগলিতে দুই হাজার বছরের অমানবিকতা, অসহিষ্ণুতা ও অন্যায়ের নোংরা স্তুপে আতঙ্কিত হয়েছিলেন।’ তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, জায়নবাদীরা যদি কখনো জেরুসালেমের নিয়ন্ত্রণ পায়, তবে তাদের প্রথম কাজ হবে এসব পরিষ্কার করা।
ঐশী নয়, এমন সবকিছু আমি পরিষ্কার করে ফেলব, শ্রমিকদের বাড়িঘর নগরীর বাইরে নিয়ে যাব, ফাঁকা ও নোংরা ইঁদুরের গর্তগুলো ভরাট করে দেব, ঐশী নয় এমন ধ্বংসাবশেষ জ্বালিয়ে দেব, সব স্থানে বাজার বসাব। তারপর পুরনো স্থাপত্য স্টাইলগুলো যতটা সম্ভব রেখে দেব এবং আলো-বাতাসে ভরপুর, স্বস্তিদায়ক, যথাযথ পয়োঃপ্রণালী বানাব, পবিত্র স্থানগুলোর চারপাশে ঝকঝকে নতুন নগরী নির্মাণ করব। ১৬
কয়েক দিন পর তিনি তার মন পরিবর্তন করেন : তিনি প্রাচীরগুলোর বাইরে একটি নতুন সেক্যুলার নগরী নির্মাণ করে পবিত্র ধর্মস্থানগুলোকে তাদের নিজেদের ছিটমহলে ছেড়ে দেবেন। নতুন সেক্যুলারবাদী আদর্শে এটি ছিল নিখুঁত ভাবমূর্তি : ধর্ম অবশ্যই আলাদা পরিমণ্ডলে থাকবে। প্রাথমিক জায়নবাদী আন্দোলনে জেরুসালেমের পবিত্রতা সামান্য ভূমিকা পালন করেছিল। আন্দোলনের বেশির ভাগ আদর্শবাদীই নগরী ত্যাগ করাকেই অগ্রাধিকার দিয়ে এর ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোকে তাদের নিজেদের মতো থাকতে দিতে চেয়েছিল। হারজল মনে করতেন, মুক্তি উপর থেকে আসবে না : এটি থাকবে নগরীর বাইরে নির্মাণ করতে ইচ্ছুক সাহসী নতুন নগরীতে। ‘চারপাশের পাহাড়ের ঢালগুলোতে প্রশস্ত, সবুজ বেষ্টনি’ হবে ‘নতুন জেরুসালেমের গৌরবময় স্থান। ইহুদি ধর্মের পুরনো ধর্মীয় ঐতিহ্য পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে। এর পরপরই ওয়েস্টার্ন ওয়াল পরিদর্শন করে ইহুদিদের জঘন্য বেদনাময় ও ভীরু দৃষ্টিভঙ্গিতে হারজল তার বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেন। তার দৃষ্টিতে এসব ইহুদি এমনসব প্রতীকী পাথর আঁকড়ে ধরে থাকে, যেগুলো থেকে জায়নবাকে অবশ্যই ঊর্ধ্বে ওঠতে হবে।
অবশ্য, ওই প্রতিক্রিয়া সব জায়নবাদীর ছিল না। ওয়েস্টার্ন ওয়াল প্রথমবারের মতো দেখে শিশুর মতো কেঁদেছিলেন মোরদেচাই বেন হিলেল। এটি ছিল ইহুদি জাতির মতো টিকে থাকা অবশিষ্ট স্মারক, এর শক্তি তথ্য বা যুক্তি থেকে আসেনি, এসেছে ‘কিংবদন্তি’ থেকে যা প্রবল মানসিক শক্তি বিচ্ছুরণ করে।১৮ লেখক এ এস হিসবার্গেরও একই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল ১৯০১ সালে জেরুসালেম সফর করার সময়। মাগরেবি কোয়ার্টার দিয়ে হাঁটার সময় তিনি অস্বস্তি পড়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলেন। তবে ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে সেফারদিক চৌকিদারের দেওয়া প্রার্থনা গ্রন্থ হাতে নেওয়া মাত্র তিনি অনিয়ন্ত্রিত কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি প্রবল ধাক্কার শিকার হয়েছিলেন। পরে তিনি তার অস্তিত্ব নিয়ে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন : ‘আমার সব ব্যক্তিগত ঝামেলা আমাদের জাতির দুভার্গের সাথে মিলে গিয়ে একটি প্রবল ধারার সৃষ্টি করে।’ প্রাচীরটি একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। শিকড়হীনতা আর নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত সেক্যুলার ইহুদিদের বেশির ভাগের জন্যই এটি ছিল আরোগ্যকারী ক্ষমতাসম্পন্ন। এর শক্তিতে তারা বিস্মিত হয়েছিল, তাদের হৃদয়-মন জয় করেছিল।
রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ থেকে জায়নবাদী নতুন বসতি স্থাপনকারীদের নতুন ঢেউ ১৯০২ সালে ইসরাইলে আসতে শুরু করে। তারা ছিল সেক্যুলার বিপ্লবী। তারা সমাজবাদী আদর্শে ছিল নিবেদিতপ্রাণ। তাদের একজন হলেন তরুণ ডেভিড বেন-গুরিয়ান। এই অভিবাসনকে ‘সেকেন্ড আলিয়া’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এটি এই আন্দোলনের ইতিহাসকে বদলে দিয়েছিল। বেন-গুরিয়ান ধার্মিক ছিলেন না। তার নতুন জেরুসালেম ছিল সমাজবাদী সংস্করণ। তার স্ত্রী পলার কাছে তিনি লিখেছিলেন : ‘কষ্ট ও চোখের পানিতে তুমি উঁচু পর্বতে উঠবে, তা থেকে নতুন দুনিয়ার দৃশ্যপট দেখবে, সর্বোচ্চ সুখ ও গৌরবময় অস্তিত্বের শ্বাশত নতুন আদর্শের শিখার উজ্জ্বলতা দেখতে পাবে। তাদের সেক্যুলার বিশ্বাস সাধারণভাবে ধর্মের সাথে থাকা পরমানন্দ নিয়ে এসব বসতি স্থাপনকারীদের পরিপূর্ণ করে রেখেছিল। তারা ফিলিস্তিনে তাদের অভিবাসনকে আলিয়া হিসেবে অভিহিত করার প্রধান কারণ ছিল এটি ছিল ইসরাইল ভূমিতে তাদের প্রত্যাবর্তনের ঐতিহ্যবাহী পরিভাষা। অবশ্য এটি উচ্চতর স্তরে আরোহণের প্রতীকও প্রকাশ করেছিল। অবশ্য তাদের মতে পবিত্রতা ভূমিতে বাস করে, স্বর্গে নয়। এসব জায়নবাদীর কেউ কেউ জেরুসালেমে বসতি স্থাপন করেছিল। অবশ্য অনেকেই হারজলের বিতৃষ্ণার সাথেও একমত ছিল। ১৯০৯ সালে আরব বন্দর জাফার পাশে তারা তেল আবিব নিৰ্মাণ শুরু করে। এই নগরী তাদের নতুন ইহুদি ধর্মের প্রদর্শন কেন্দ্রে পরিণত হয়।
বসতি স্থাপনকারীদের বেশির ভাগই ছিল শহরবাসী। অবশ্য জায়নবাদী উপাসনালয়ে তারা কখনো কিবুতজিমের বসতি স্থাপনকারীদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এসব সম্মিলিত খামারের প্রথমটি স্থাপিত হয়েছিল ১৯১১ সালে গ্যালিলির দাগ্যানিয়ায়। জায়নবাদী তাত্ত্বিক নাহুম সোলোলভ মন্তব্য করেছেন : ‘মধ্যাকর্ষণের মূল বিন্দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জেরুসালেম থেকে স্থানান্তরিত হয়ে খামার আর কৃষি স্কুল, মাঠ আর তৃণভূমিতে চলে গেছে।২১ প্রাচীন ইসরাইল যেভাবে জেরুসালেমের বাইরে থেকে এসেছিল, একইভাবে নতুন ইসরাইলও পবিত্র নগরীতে নয়, বরং গ্যালিলির কিবুবতজিমে গঠিত হয়েছিল।
অবশ্য জেরুসালেম তখনো ছিল একটি প্রতীক। এর ছিল এসব সেক্যুলার জায়নবাদীকে উদ্দীপ্ত করার শক্তি। এই শক্তিতেই তারা নতুন দুনিয়া সৃষ্টি করার সংগ্রাম করেছিল, যদিও তারা নশ্বর বাস্তবতা হিসেবে নগরীর জন্য তাদের সময় ছিল খুবই কম। আইজ্যাক বেন-জভি রাশিয়ায় একটি বিপ্লবী সমাবেশে বক্তৃতা করার সময় জায়নবাদ গ্রহণ করেন। পরে তিনি ইসরাইল রাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি হঠাৎ করেই তার আশপাশের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভুল স্থানে অবস্থান করার বিষয়টি অনুভব করেন। তিনি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমি এখানে কেন, সেখানে নয় কেন?’ তারপর তিনি একটি স্বপ্নাবিভাব লাভ করেন। ‘আমার মনের চোখ খুলে গেল, ধ্বংসস্তুপ, সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পবিত্র নগরী জেরুসালেমের জীবন্ত ছবি দেখলাম।’ ওই মুহূর্ত থেকে তিনি আর রাশিয়ায় বিপ্লবের কথা ভাবেননি, বরং ভেবেছেন কেবল ‘আমাদের জেরুসালেম’ নিয়ে। তিনি বলেন, ‘ঠিক ওই মুহূর্ত থেকে আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমাদের স্থান হচ্ছে ইসরাইল ভূখণ্ডে। আমাকে অবশ্যই সেখানে যেতে হবে, আমার জীবনকে নিবেদন করতে হবে এটি গড়ে তোলার জন্য এবং তা করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।’২২ তিনি তার সত্যিকারের পথ আবিষ্কার করেন, বিশ্বে তার নিজের স্থান খুঁজে পান।
আরব ও ইহুদিদের মধ্যকার আধুনিক সঙ্ঘাতের বীজ এর আগেই বিশ শতকের শুরুতে বপণ করা হয়ে গিয়েছিল।
সমস্যা হলো জেরুসালেম এর সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন’ ছিল না। তার সন্তানেরা আগে থেকেই ছিল। তারা কয়েক শ’ বছর ধরে বাস করছিল, নগরীর ব্যাপারে তাদেরও নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। আর বেন-জভি যেভাবে কল্পনা করেছেন, নগরটি তেমন বিধ্বস্তও ছিল না। ১৮৭০-এর দশক থেকে ১৪টি নতুন উপশহর গড়ে ওঠেছিল। জেরুসালেমে ছিল আধুনিক শপিং আর্কেড, জাফা গেটে ছিল হোটেল, ঝকমকে পার্কে বিকেলগুলোতে মিউনিসিপ্যালের ব্যান্ড সঙ্গীত পরিবেশন করত, জাদুঘর ছিল, থিয়েটার ছিল, ছিল আধুনিক ডাকঘর, টেলিগ্রাফব্যবস্থা। পবিত্র নগরী থেকে জাফাকে সংযুক্তকারী একটি নতুন ক্যারেজ রোড ছিল। একটি রেলওয়ে উপকূল থেকে সফরকারীদের বাকা ভ্যালিয়ে বয়ে আনত। জেরুসালেম গর্ব করার মতো নগরীতে পরিণত হয়েছিল। আরব অধিবাসীরা তুর্কি দখলদারিত্ব নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল। তারা জায়নবাদী বসতি স্থাপনকারীদের আগমনে শঙ্কিতও ছিল। ১৮৯১ সালে জেরুসালেমের অভিজাত সম্প্রদায় ইস্তাম্বুলে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে ইহুদি অভিবাসন বন্ধ ও জায়নবাদীদের কাছে জমি বিক্রি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে একটি আবেদন দাখিল করে। ইউসুফ আল-খালিদির শেষ পরিচিত রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল হারজলের বন্ধু রাব্বি জাদক কানের কাছে একটি পত্র লেখা। তাতে তিনি ফিলিস্তিনকে নিজের মতো করে থাকার সুযোগ প্রদান করার জন্য তার কাছে অনুনয় করেন। তিনি বলেন, জেরুসালেমে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমেরা একসাথে বাস করতে সক্ষম হয়েছে। এসব জায়নবাদী প্রকল্প এই সহাবস্থানকে নস্যাৎ করে দেবে। ১৯০৮ সালে ইয়ং তুর্কি বিদ্রোহের পর ফিলিস্তিনের আরব জাতীয়তাবাদীরা তাদের তুর্কি দখলমুক্ত নিজস্ব আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ১৯১৩ সালে প্রথম আরব কংগ্রেসের সময় নিকট প্রাচ্যের ৩৮৭ আরবের সই হওয়া একটি সমর্থক টেলিগ্রাম আসে। সইকারীদের মধ্যে ১৩০ জনই ছিলেন ফিলিস্তিনি। ১৯১৫ সালে বেন গুরিয়ান ফিলিস্তিন নিয়ে এসব আরব আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে সচেতন হন। তার দৃষ্টিতে তারা ছিলেন খুবই গোলযোগ সৃষ্টিকারী। তিনি পরে বলেছিলেন, ‘এটি বোমার মতো আমাকে আঘাত করেছিল। আমি চরম বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ২৩ অবশ্য ইসরাইলি লেখক অ্যামোস এলোন আমাদেরকে বলেন যে এই বোমার আঘাত সত্ত্বেও বেন-গুরিয়ান ফিলিস্তিনি আরবদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা অব্যাহত রাখেন। এর দুই বছর পর তিনি অবাক করা পরামর্শ দেন যে ‘ঐতিহাসিক ও নৈতিক দিক থেকে’ ফিলিস্তিন ছিল ‘অধিবাসীবিহীন’ একটি দেশ।২৪ ইহুদিরা একে নিজ দেশ মনে করায় ওই দেশের অন্য সব অধিবাসীকে স্রেফ বিভিন্ন বিজয়ীর জাতিগত বংশধর মনে করা হতো। বেন-গুরিয়ান আরব ও অন্য ব্যক্তিদের কল্যাণ কামনা করলেও মনে করতেন যে জাতি হিসেবে তাদের কোনোই অধিকার নেই। জেরুসালেমের মতো ইসরাইল ভূমিও ইহুদিদের মনে গেঁথে ছিল। এমনকি বেন- গুরিয়ানের মতো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নাস্তিকও তার চেহারার সামনে ভাসতে থাকা জনসংখ্যাগত ও ঐতিহাসিক তথ্যগুলোর চেয়ে এর পবিত্র অবস্থান তার আবেগগত মানচিত্রে অনেক বেশি স্থানজুড়ে ছিল। যদিও এই প্রবল অস্বীকার অল্প সময়ের মধ্যেই অবধারিতভাবেই কিছু কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়েছিল। এর আংশিক কারণ ছিল অস্বীকার। তা ইহুদি ও আরবদের মধ্যে মর্মান্তিক স্বার্থের সঙ্ঘাত সৃষ্টি হচ্ছিল।
বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে ১৯১৪ সালে। ফরাসি ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তুর্কিরা জার্মানদের পক্ষে অবস্থান নেয়। জেরুসালেম হয় তুর্কি অষ্টম কোরের সদরদফতর। ১৯১৫ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যা ভবিষ্যতের বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দেয়। এ ঘটনা জেরুসালেমের ইতিহাসে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সরকারি তুর্কি নীতিতে আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যার কথা বলা হয়। জেরুসালেমে আর্মেনিয়ানরা দীর্ঘ সময় নিম্ন মর্যাদার কাঘাকাতসিরা নির্যাতনের শিকার হয়নি। সরকারি পদমর্যাদায় থাকা লোকজন তাদের পদ থেকে বঞ্চিত হলেও আর্মানিয়ান মহল্লায় তাদের পারিবারিক জীবন স্বাভাবিকই ছিল। তবে ব্যতিক্রম ছিল এই যে কেবল তাদের তরুণ সদস্যদের তুর্কি সেনাবাহিনীতে ভর্তি করতে হতো। উসমানিয়া সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে আর্মেনিয়ানদের নির্দয়ভাবে ধ্বংস করা হয়। এই গণ-হত্যার কোড শব্দ ছিল ‘বহিষ্কার’। পরবর্তীকালে নাৎসি জার্মানিও এই কোড শব্দ ব্যবহার করেছিল। লোকজনকে দল বেঁধে নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে পানিতে ফেলে দেওয়া হতো। যারা সাঁতার কেটে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করত, তাদেরকে সৈন্যরা গুলি করত। খাদ্য ও পানি ছাড়াই মরুভূমিতে লাখ লাখ লোককে ফেলে দেওয়া হতো। এভাবে লাখ লাখ আর্মেনিয়ান মারা যায়। আরো লাখ লাখ লোক নির্বাসনে যায়। তাদের অনেকে জেরুসালেমে গিয়ে আর্মেনিয়ান মহল্লায় ঠাঁই নেয়। উদ্বাস্তুদের ভ্রাতৃত্ববন্ধনে সেন্ট জেমস কনভেন্টে বাস করার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে সেক্যুলারদের সাধারণত এই সুবিধা দেওয়া হতো না। বিশ শতকের প্রথম গণহত্যা অনেককে জেরুসালেমের প্রাচীন পবিত্রতায় আশ্রয় নিতে উদ্বুদ্ধু করেছিল। ব্রিটিশরা ১৯১৬ সালে সিদ্ধান্ত নেয় যে নিকট প্রাচ্যে একটি দর্শনীয় জয় ফ্রান্সের পরিখা যুদ্ধকৌশলের অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে পারে। ব্রিটিশ ইজিপ্টিয়ান এক্সপেডিশনারি ফোর্স সরে যায় সিনাই উপদ্বীপে। তবে তারা গাজায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তুর্কি প্রতিরোধের মুখে পড়ে। জেনারেল মারের স্থলাভিষিক্ত হওয়া জেনারেল অ্যাডওয়ার্ড অ্যালেনবাই প্রধানমন্ত্রী লয়েড ‘জর্জকে ব্রিটেনের জনগণের জন্য ক্রিসমাস উপহার হিসেবে জেরুসালেম জয় করতে বলেন। অ্যালেনবাই সতর্কতার সাথে পিইএফ প্রকাশনাগুলো অধ্যায়ন করেন : এক শ’ বছর আগে নেপোলিয়নের অভিযানের সময়ও সামরিক দখলদারিত্বের প্রস্তাবনা ছিল বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে অ্যালেনবাই গাজা দখল করে জেরুসালেমের দিকে অগ্রসর হন। গভর্নর জামাল পাশা তুর্কিদেরকে নগরী ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। ৯ ডিসেম্বর মেয়র হোসাইন সেলিম আল-হোসাইনি নগরী ত্যাগ করার একমাত্র কর্তৃপক্ষ ছিলেন। তিনি আর্মেনিয়ান মিশনারি থেকে একটি সাদা চাদর ধার করে ছোট ছেলেদের একটি শোভাযাত্রা নিয়ে জাফা গেট দিয়ে পুরনো নগরী ত্যাগ করেন। তিনি বিস্ময়াভূত দুই ব্রিটিশ স্কাউটের কাছে জেরুসালেম সমর্পণ করেন। ১১ ডিসেম্বর অ্যালেনবাই জাফা গেটে পৌঁছালে তাকে নগরীতে স্বাগত জানাতে নগরীর ঘণ্টাগুলো বেজে ওঠে। জেরুসালেমের পবিত্রতার প্রতি সম্মান দেখাতে অ্যালেনবাই ঘোড়া থেকে নেমে হেঁটে নগরীতে প্রবেশ করেন। তিনি দুর্গের সিঁড়িতে অবস্থান করেন। তিনি ‘আশীর্বাদপুষ্ট জেরুসালেমের অধিবাসীদের আশ্বাস দেন যে তিনি পবিত্র স্থানগুলো রক্ষা করবেন, মহামান্য সরকারের নামে ইব্রাহিমের তিন ধর্মের অনুসারী সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখবেন। তিনি ক্রুসেডাদের কাজ সম্পন্ন করেছিলেন।