১২. আল-কুদস

১২. আলকুদস 

মুসলিমেরা এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় যার ফলে প্রথমবারের মতো জেরুসালেমে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমেরা একসাথে বসবাস করতে পেরেছিল। ইহুদিরা বেবিলনের নির্বাসন থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর একেশ্বরবাদীরা নগরীর এমন স্বপ্নাবির্ভাব নির্মাণ করে যা এর ঐশী সত্তা বহিরাগতদের বর্জন করার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। অবশ্য, ঐশী সত্তার ব্যাপারে মুসলিমদের অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তমূলক ধারণা ছিল। তা হলো ইব্রাহিমের তিন ধর্মের সহাবস্থান, প্রতিটি ধর্মেরই নিজস্ব পরিধি বজায় রেখে তার নিজস্ব বিশেষ উপাসনালয়ে প্রার্থনা করতে পারা। এই ধারণায় এক আল্লাহর কাছ থেকে লাভ করা যথাযথভাবে নিৰ্দেশিত সব ধর্মের ধারাবাহিকতা ও সম্প্রীতির ব্যাপারে মুসলিমদের দর্শন প্রতিফলিত হয়। তিন ধর্মের সবার কাছে পবিত্র বিবেচিত নগরীতে একসাথে বসবাসের অভিজ্ঞতা একেশ্বরবাদীদেরকে একে অপরকে আরো ভালোভাবে বোঝার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি। পরিস্থিতির মধ্যে সহজাত টানাপোড়েন ছিল। ছয় শত বছরের বেশি সময় ধরে বিশেষ করে জেরুসালেমের মর্যাদা নিয়ে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে উত্তেজনা ছিল। প্রত্যেকেই বিশ্বাস করত যে অন্যরা ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত রয়েছে। ফলে পবিত্র নগরীতে পাশাপাশি বসবাস করেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। অনেক মুসলিমও পবিত্র কোরআনের সার্বজনীন দর্শন পরিত্যাগ করতে শুরু করে ইসলামকে একমাত্র সত্য বিশ্বাস হিসেবে ঘোষণা করে। সুফি ও দার্শনিকেরা সর্বাত্মকভাবে তাদের ভিন্ন পন্থায় পুরনো আদর্শ জোরালোভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মুসলিম ধরে নিতে চেষ্টা করছিল যে পুরনো বিশ্বাসগুলোকে অপসারণ করে তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিল ইসলাম। একেশ্বরবাদ একবার যদি এমন বর্জনশীল ঘোষণা দেয়, তবে সহাবস্থান খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিটি বিশ্বাস যদি ধরে নেয় যে সে এবং একমাত্র সেই ঠিক, তবে একই দাবি করা অন্যান্য ধর্মের নৈকট্য এমন অন্তর্নিহিত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে, যা সহ্য করা খুবই কঠিন। তিনটি ধর্মের প্রতিটিই স্বতন্ত্র্য পরিচিতি ও সহজাত শ্রেষ্ঠত্ব জোরালোভাবে ঘোষণা করার চেষ্টা করায় আব্বাসি শাসনকালে বায়তুল মুকাদ্দিসে উত্তেজনা বাড়ে। 

নগীর বর্ধিত উদ্বিগ্নতা সৃষ্টির আরেকটি কারণ ছিল খিলাফতের রাজধানী বাগদাদে সরিয়ে নেওয়া। বাগদাদ ৭৬২ সালে ইসলামি সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানীতে পরিণত হয়। আব্বাসি খলিফাদের জন্য জেরুসালেম তখনো প্রতীকী গুরুত্ব ছিল। তবে পূর্বসূরীদের মতো আস-শাম ও বায়তুল মুকাদ্দিসে ঢালাওভাবে ব্যয় করার ও এর প্রতি মনোযোগী হওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। উমাইয়া শাসনের সাথে জেরুসালেমের খুব বেশি সম্পৃক্ততা ছিল। উমাইয়া খলিফারা নিয়মিতভাবে পবিত্র নগরী সফর করতেন, নগরীর সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন তারা। কিন্তু আব্বাসীয়রা ছিলেন সুদূরের সেলিব্রেটি। তাদের কেউ যখন জেরুসালেম সফর করতেন, সেটা হতো বিরাট ঘটনা। তবে প্রথম খলিফারা তাদের বৈধতার প্রতীক হিসেবে জেরুসালেম সফর প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করতেন। আর ৭৫৭ সালে খলিফা আল-মনসুর অবশেষে যখন তার শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন, তখন তিনি হজ থেকে ফেরার পথে জেরুসালেম সফর করেন। নগরী ছিল দুর্দাশাগ্রস্ত। ৭৪৭ সালের ভূমিকম্পের পর হারাম ও উমাইয়া প্রাসাদ তখনো বিধ্বস্ত ছিল। মুসলিমেরা তাকে হারামের দক্ষিণ প্রান্তে থাকা আল-ওয়ালিদের মসজিদটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে বললে তিনি স্রেফ এ জবাবই দেন যে তার কাছে টাকা নেই। তবে তিনি ডোম অব দি রকে থাকা স্বর্ণ ও রৌপ্য গলিয়ে মেরামতের খরচ মেটানোর পরামর্শ দেন। আব্বাসিরা হারামকে অবহেলা না করলেও উমাইয়াদের মতো উদারভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখেনি। মসজিদটি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরপরই ৭৭১ সালে আরেকটি ভূমিকম্পে সেটি ভেঙ্গে পড়ে। খলিফা আল-মাহদি খলিফা (৭৭৫- ৮৫) হওয়ার পর মসজিদটি পুনঃনির্মাণ ও সম্প্রসারণ করার আদেশ দেন। এ সময় সব প্রাদেশিক গভর্নর ও স্থানীয় সেনা ছাউনিগুলোর কমান্ডারকে ব্যয় পরিশোধ করতে বলেন। পুরনো মসজিদের চেয়ে নতুনটি অনেক বেশি টেকসই ছিল। মোকাদ্দাসি ৭৮৫ সালে জেরুসালেমের বর্ণনা লিখেছিলেন, তখনো মসজিদটি টিকে ছিল। তখন এর একটি সুন্দর গম্বুজ ছিল, যা আগের চেয়ে অনেক প্রশস্ত : উমাইয়া ভবনের অবশিষ্ট অংশটি ‘নতুনটির মধ্যে সুন্দর বিন্দুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। 

মসজিদটিকে এখন বলা হয় আল-মসজিদ আল-আকসা, ‘প্রত্যন্ত মসজিদ’ : এটিকে পবিত্র কোরআনে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখিত মুহাম্মদের (সা.) মিরাজের ঘটনার সাথে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হতে থাকে। নবীর জেরুসালেমে স্বপ্নাবিভাবী অভিজ্ঞতার প্রথম পূর্ণ বিবরণ দেখা যায় মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের (মৃত্যু ৭৬৭) লেখা জীবনীতে। এতে বার্তাবাহক ফেরেশতা জিব্রাইলের মাধ্যমে মুহাম্মদের (সা.) মক্কা থেকে টেম্পল মাউন্টে যাওয়ার বিস্তারিত ভাষ্য রয়েছে। তিনি সেখান থেকে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে ঐশী আরশে পৌছান। অনেক মুসলিম আক্ষরিকভাবে কাহিনীটি ব্যাখ্যা করে বিশ্বাস করতে থাকে যে মুহাম্মদ (সা.) দৈহিকভাবে জেরুসালেম গিয়েছিলেন, সশরীরে বেহেশতে আরোহণ করেছিলেন। নবীর প্রিয় স্ত্রী আয়েশাসহ অন্যরা সবসময় জোর দিয়ে বলেছেন যে এটি ছিল পুরোপুরি আধ্যাত্মিক বিষয়। আল্লাহর কাছে যাওয়ার এই উদ্যোগের সাথে সালেমকে সম্পৃক্ত করা মুসলিমদের জন্য ছিল সহজাত ব্যাপার। ৬৯১ সালে ডোম অব দি রক নির্মাণ সম্পূর্ণ হওয়ার পর থেকে হারাম হয়ে পড়ে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আধ্যাত্মিক আরোহণের শক্তিশালী ছবি। সুফিরা অপ্রতিরোধ্যভাবে বায়তুল মুকাদ্দিসের প্রতি আকৃষ্ট হন। প্রায় এই সময়ই আকসা মসজিদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই পর্যায়ে প্রখ্যাত নারী মরমি সাধক রাবি আল-আদাবিয়া নগরীতে ইন্তিকাল করলে তাকে ডোম দেখা যায়, এমন স্থান মাউন্ট অলিভেসে করব দেওয়া হয়। সুফিবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আবু ইসহাক ইব্রাহিম ইবনে আদহামও বসবাস করার জন্য খোরাসান থেকে জেরুসালেমে চলে আসেন। সুফিরা ইসলামি আধ্যাত্মিকতার অন্তরাত্মার মাত্রা অনুসন্ধান করার জন্য মুসলিমদের শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তাদের মরমি সাধনার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল আদি ঐক্যে ফিরে যাওয়া এবং মুহাম্মদের (সা.) ইশরা ও মিরাজ তাদের নিজস্ব আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মডেলে পরিণত হয়। তারা দেখে ছিলেন, ঐশী আরশের সামনে মুহাম্মদ (সা.) ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তবে এই ফানা (আত্মবিলোপসাধন) ছিল সম্প্রসারিত ও পরিপূর্ণতাপ্রাপ্ত মানুষের সামগ্রিক স্থায়ী সত্তায় (বাকা) পৌছার স্রেফ সূচনা পর্ব। 

সুফিরা হারামের আশপাশে ভিড় জমাতে লাগলেন : অনেকে এমনকি প্লাটফর্মের কিনারায় ভাবেষ্টিত বারান্দাগুলোতে বাস করতে থাকলেন, যাতে তারা মুহাম্মদ (সা.) যেখান থেকে ঊর্ধ্বগমন করেছিলেন, সেই ডোম অব দি রকের প্রতীকতা নিয়ে ধ্যান করতে পারেন। তাদের উপস্থিতি জেরুসালেমে কল্যাণকর প্রভাব পড়েছিল। কারণ সুফিরা অন্যান্য ধর্মের মূল্য সম্পর্কে অনবদ্য প্ৰশংসা করতেন। ইসলামি আইন বিকাশকারী আলেম ও মুফতিরা ইসলামকে অন্যদের থেকে বর্জনশীল ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইলেও সুফিরা পবিত্র কোরআনের সার্বজনীনতার প্রতি সত্যনিষ্ঠ থাকতেন। সুফি মরমিবাদীদের জন্য বেশ স্বাভাবিক ব্যাপার যে তারা ইহুদি, খ্রিস্টান বা মুসলিম হিসেবে নয়, এবং মসজিদ, সিনাগগ, চার্চ বা মন্দিরে কিংবা বাড়িতে একই অবস্থায় ধ্যানে মগ্ন হতে পারে। কারণ ফানায় তারা অহং বিনাশ করে মনুষ্য-সৃষ্ট ভিন্নতার ঊর্ধ্বে ওঠতে পারেন। সব মুসলিম এই মরমি উচ্চতায় উঠতে না পারলেও তারা ছিলেন সুফি দর্শনে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। সাম্রাজ্যের অনেক অংশে সুফিবাদ প্রভাবশালী ইসলামি ধর্মানুরাগে পরিণত হয়। অবশ্য প্রাথমিক সময়ে এটি বেশ প্রান্তিক ও সন্দেহজক বিবেচিত হতো। 

এখন মুহাম্মদ যেহেতু জেরুসালেম সফর করেছেন বলে মনে করা হলো, তখন নগরীটি দ্বিগুণ পবিত্র হয়ে গেল। স্থানটি সবসময়ই পৃথিবীর আধ্যাত্মিক কেন্দ্ৰ হিসেবে টেম্পল নগরী হিসেবে শ্রদ্ধা করা হতো। কিন্তু এখন এর সাথে পূর্ণাঙ্গ মানব নবীর সাথেও সম্পৃক্ত হয়ে পড়ল। মক্কা থেকে জেরুসালেমে তার আধ্যাত্মিক সফর (আল-ইসরা) দুটি পবিত্র স্থানের মধ্যে সংযোগ জোরদার করল। মুহাম্মদ (সা.) তার নিজস্ব ব্যক্তিতে মক্কার আদি পবিত্রতা জেরুসালেমের সুদূরের মসজিদে পৌঁছে দিয়েছেন। মক্কা ও মদিনার মতো জেরুসালেমের পবিত্রতাও পরিপূর্ণ মানবের উপস্থিতিতে বেড়ে গেছে। মুহাম্মদ (সা.) বেহেশত ও দুনিয়ার মধ্যে নতুন সংযোগ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুহাম্মদের (সা.) মিরাজের কাহিনী বিষয়টি পুরোপুরি পরিষ্কার করে দিয়েছে। এই সময় নাগাদ মুসলিমেরা নবীর জীবনকে খোদার মানবীয় রূপে প্রকাশ হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। নিশ্চিতভাবেই তিনি ঐশী সত্তা ছিলেন না, তবে তার ক্যারিয়ার ছিল আয়াত তথা পৃথিবীতে আল্লাহর কার্যক্রম এবং আল্লাহর কাছে পূর্ণাঙ্গ মানুষের আত্মসমর্পণের নিদর্শন। অষ্টম ও নবম শতকে বিদ্বজনেরা মুহাম্মদের (সা.) হাদিস ও রীতিনীতি (সুন্নাহ) সংগ্রহ সঙ্কলনের কাজ শুরু করেছিলেন। এগুলো ইসলামি আইনের (শরিয়াহ) ও প্রতিটি মুসলিমের দৈনন্দিন জীবনের ভিত্তি গড়ে দেয়। সুন্নাহ মুহাম্মদের (সা.) কথা বলা, খাওয়া, গোসল করা, ভালোবাসা, ইবাদত করার বিষয়গুলোতে এত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে তাকে অনুকরণ করতে শেখায় যাতে তারা তার পরিপূর্ণ ইসলামে অংশ নিতে পারে। প্রতিরূপের প্রতীকী কাজটি মুসলিমদের সাথে শ্বাশত আদিরূপ মুহাম্মদের (সা.) সংযোগ সাধন করে। তিনি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, কারণ আল্লাহর ইচ্ছাই ছিল তা। 

একজন মুসলিম আল্লাহর কথা কোরআন অধ্যায়ন করছেন আল আকসা মসজিদে। এই অধ্যায়নের মাধ্যমে মুসলিমেরা ঐশী সত্তার সাথে সংযোগ সাধন করে, তাদের দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্রতম পর্যায়েও কিভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা যায়, তা শেখে। 

জেরুসালেমের হারাম থেকে সর্বোচ্চ আসমানে মিরাজ করার কাহিনীতে আল্লাহর কাছে মুহাম্মদের (সা.) পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের ঘটনাটি যে অলঙ্কারপূর্ণভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তেমন ভাষ্য আছে খুব কমই। মুসলিমদের কাছে এটি ছিল প্রত্যাবর্তনের সহজাত ছবি। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, সব মানুষকেই অস্তিত্বের উৎসে ফিরে যেতে হবে। ফলে জেরুসালেমে ইবাদত করতে আসা মুসলিমেরা নবীর আধ্যাত্মিক সফরে অংশগ্রহণ করার মতো করে ইসরা ও মিরাজের বাহ্যিক ঘটনাগুলো অনুকরণের প্রতীকীমূলকভাবে বিবর্ধিত করেছিল। 

তারা এর মাধ্যমে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করার তার আন্তর প্রবণতার কোনো না কোনো মাত্রার কাছাকাছি হওয়ার আশা করে। হারাম নিয়ে তাদের নতুন সুন্নাহ জেরুসালেমের আশপাশে যিশুর পদাঙ্ক অনুসরণকারী খ্রিস্টানদের ধর্মীয় শোভাযাত্রার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। অষ্টম ও নবম শতকে (আমরা নিশ্চিত নই, ঠিক কখন ঘটেছিল) হারামে ছোট ছোট কয়েকটি ইবাদতগাহ ও ক্ষুদ্র উপাসনালয় আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। (দেখুন মানচিত্র।) ডোম অব রকের ঠিক উত্তরে ছিল নবীর গম্বুজ (ডোম অব দি প্রফেট) ও জিব্রাইলের মঞ্জিল (স্টেশন অব জিবরিল)।৩ স্বর্ণ মই (আল-মিরাজ) দিয়ে উপরে যাওয়ার আগে মুহাম্মদ (সা.) ও জিবরাইল ফেরেশতা অন্য নবীদের সাথে কোথায় নামাজ পড়েছিলেন, এসব ছোট ইবাদতগাহ সেই স্থানগুলো চিহ্নিত করেছিল। কাছেই ছিল মিরাজ গম্বুজ (ডোম অব দি মিরাজ)। এখান থেকে নবী আসমানি সিংহাসনের দিকে উপরে উঠা শুরু করেছিলেন। মুসলিমেরা হারামের দক্ষিণ তোরণেও ইবাদত করতে পছন্দ করত। কারণ ওই স্থানটি নবীর তোরণ নামে পরিচিত ছিল। বলা হয়ে থাকে, এখান দিয়েই মুহাম্মদ (সা.) জিবরাইল ফেরেশতার আগে আগে হেঁটে নগরীতে প্রবেশ করেছিলেন। এ সময় সূর্যের মতো তীব্র আলো অন্ধকার সরিয়ে দিয়েছিল। তারপর তারা হারামের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটি স্থানে গিয়েছিলেন। মক্কা থেকে সফর করার পর এখানেই মুহাম্মদের (সা.) ঐশী ঘোড়া বোরাক বেঁধেছিলেন। 

হারামের বিভিন্ন ইবাদতগাহ অন্যান্য নবীর উপস্থিতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানেও আমরা সুফি প্রভাব দেখতে পাই। জেরুসালেমে মুসলিম জিয়ারতকারীদের তাদের আগে নগরীতে বসবাসকারী, ইবাদতকারী, দুর্ভোগ সহ্যকারী পবিত্র মানুষদের প্রতি সম্মান জানানো শেখানো হতো। বলা হয়ে থাকে, ডোম অব রকের পূর্ব দিকে থাকা ডোম অব দি চেইন এমন এক স্থান যেখানে রাজা দাউদ বিচার করতেন ইসরাইল সন্তানদের। তিনি গোপন মিথ্যা শনাক্ত করতে আলোর একটি বিশেষ শিকল তৈরি করেছিলেন। হারামের দক্ষিণ দিকে ছিল সোলায়মানের সিংহাসন। এখানে রাজা সোলায়মান টেম্পল নির্মাণ শেষ করে নামাজ পড়েছিলেন। হারামের কয়েকটি তোরণের সাথে ইহুদি ইতিহাসের সম্পৃক্ততা ছিল : ইসরাইলিরা আর্কটি নিয়ে এসেছিল বাব আল-আকিনা (ডিভাইন প্রেজেন্স বা ঐশী উপস্থিতি) দিয়ে, তারা যম কিপুরের ওপর বাব হিত্তায় (গেট অব রেপেনট্যান্স বা অনুতপ্ত তোরণ) ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল। অবশ্য জেরুসালেম ঈশার (যিশু) নগরীও ছিল। তার জন্ম ও শৈশব সম্পর্কে অনেক গল্প বলেছে পবিত্র কোরআন। এতে বলা হয়েছে, মরিয়ম (মেরি) যখন অন্তঃসত্তা ছিলেন তখন জন দি ব্যাপ্তিস্তের বাবা জাকারিয়া তার যত্ন নিতেন। আর তার খাবার আসত অলৌকিকভাবে। তিনি যখন শিশু ছিলেন, তখন ঈশা তার দোলনা থেকে আশ্চর্যভাবে কথা বলতেন। এটি নিঃসন্দেহে তার নবুয়তির প্রাথমিক আয়াত। এখন হারামে মুসলিম জিয়ারতকারীরা প্লাটফর্মের উত্তর-পূর্ব কোণে ওরাকল অব জাকারিয়া ও হাঁটার পথে দুটি খিলানে থাকা দুটি ইবাদতগাহে ইবাদত করতেন। এ দুটি স্থান ছিল মিরহাব মরিয়ম (ওরাটর অব ম্যারি) ও মিহদ ঈশা (ক্রেডল অব জেসাস)। সবশেষে মুসলিমরা কিনারা থেকে ওয়াদি জাহান্নাম (ভ্যালি অব হিন্মম) ও মাউন্ট অব অলিভেসের দিকে তাকাত। তাদের কাছে স্থান দুটি ছিল শেষ বিচার ও পুনরুত্থানের স্থান। তারা হারামের পূর্ব দিকের ‘গোল্ডেন গেট’কে বলত বাব আল-রাহমা (গেট অব মার্সি)। এটি পবিত্র কোরআনে রহমত ও গজবের মধ্যে বিভক্ত সৃষ্টি করত। বিচারের পর হারাম পরিণত হবে বেহেশতে আর ওয়াদি জাহান্নাম হবে দোজখে। তোরণের কক্ষগুলোতে সুফিরা একটি মসজিদসহ খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে তারা আসন্ন সমাপ্তির জন্য ধ্যান করতে পারতেন। 

খলিফা হারুন-অর-রশিদ (৭৮৬-৮০৯) ছিলেন জেরুসালেম সফরের জন্য তাগিদ অনুভব না করা প্রথম আব্বাসি খলিফা। এমনকি তিনি হজ থেকে ফেরার পথে অনেকবার সিরিয়া সফর করলেও কখনো সেখানে যাননি। ঘৃণিত উমাইয়াদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র নগরীটির থেকে আব্বাসিরা নিজেদের মুক্ত থাকতে শুরু করতে শুরু করেছিল। বাগদাদে হারুন-অর-রশিদের রাজদরবার ছিল কিংবদন্তিময় জাঁকজমকপূর্ণ। সেখানে বিপুল সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি ছিল। কিন্তু বাস্তবে খিলাফতের পতন শুরু হয়ে গিয়েছিল : হারুন-অর-রশিদ ইরাকের বাইরে তার শাসন কার্যকরভাবে আরোপ করতে সক্ষম ছিলেন না, স্থানীয় কমান্ডাররা সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তারা সাধারণভাবে খলিফার নামে শাসন করলেও কার্যত স্বাধীনতা উপভোগ করতেন। এই পর্যায়ে ফিলিস্তিন কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিকভাবে পতনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। উমাইয়াদের আমলে দেশটি সমৃদ্ধ হতে শুরু করেছিল। কিন্তু এখন আব্বাসিরা অঞ্চলটি শোষণ করতে শুরু করে সম্পদ ও সমৃদ্ধি কেড়ে নিতে থাকে। একটি প্লেগও বিপুলসংখ্যক লোককে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। বেদুইনরা গ্রাম এলাকায় হানা দিতে থাকে, শহর ও গ্রামগুলো লুণ্ঠন করতে থাকে, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে তাদের নিজস্ব গোত্রীয় যুদ্ধ চালাতে থাকে। উমাইয়াদের আমলে বেদুইনরা খিলাফতের জন্য লড়াই করত, এখন তারা দেশের জন্য অভিশাপে পরিণত হলো। এই অস্থিরতার ফলে জেরুসালেমে স্থানীয় মুসলিমেরা ও খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রকাশ্য উত্তেজনার প্রথম নিদর্শন দেখা যায়। বেদুইনরা জুদার মঠগুলোতে আক্রমণ করে, ওয়েস্টার্ন হিলের খ্রিস্টানেরা বুঝতে পারে যে অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত মুসলিমেরা তাদের প্রাচুর্যে অসন্তুষ্ট। তাদের চার্চগুলো বিপুল সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করত, কঠিন অবস্থায় মুসলিমরা খ্রিস্টান সম্পদের বিবরণ শুনে ক্ষুব্ধ হতো। 

জেরুসালেমের জনসাধারণের কাছে হারুন-অর-রশিদ ছিলেন সুদূরের ও অজনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। তবে পশ্চিম ইউরোপের খ্রিস্টানদের কাছে তিনি ছিলেন সহৃদয় সম্মানীয় ব্যক্তি। তাদের সম্রাটেরও তিনি অত্যন্ত কদর করে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ৮০০ সালের ক্রিসমাস দিবসে পোপ তৃতীয় লিও পাশ্চাত্যের হলি রোমান সম্রাট ফ্রাঙ্কদের রাজা চালর্সকে মুকুট পরান। অভিষেক অনুষ্ঠানে জেরুসালেমের সন্ন্যাসীরা উপস্থিত ছিলেন। বায়েজান্টাইনরা চালর্সের উচ্চ মর্যাদার স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। এক নিরক্ষর বর্বরকে রাজকীয় পোশাক পরার ধারণায় আতঙ্কিত হয়েছিলেন তারা। চার্লসকে তার মিত্র লাভের জন্য আরো অনেক দূর তাকাতে হয়েছিল। পাশ্চাত্যের লোকজন আবারো একজন সম্রাটকে পেয়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিল। মনে হচ্ছিল রোম পতনের পর ইউরোপের ওপর যে অস্পষ্টতা আর অন্ধকার নেমে এসেছিল, তা অবশেষে কাটতে শুরু করেছে। তারা চার্লসকে ‘শার্লেমেন’ ও ‘চার্লস দি গ্রেট’ নামে ডাকতে শুরু করল। তাদের কাছে তিনি নির্বাচিত জাতির রাজা বিবেচিত হলেন। আচেনে অবস্থিত তার রাজধানী হলো নিউ জেরুসালেম, সেখানে তার সিংহাসনটি ছিল রাজা সোলায়মানের সিংহাসনের আদলে। সহজাতভাবেই তারা নতুন পাশ্চাত্য পরিচিতি কামনা করেছিল। ইউরোপের লোকজন জেরুসালেমের পবিত্র নগরীর দিকে ছুটল। খ্রিস্টের কবর আবিষ্কারের পর এখন আবার দীর্ঘ ও কষ্টকর তীর্থযাত্রায় উদ্বুদ্ধু হলো তারা। খলিফা হারুন-অর-রশিদের সাথে ইতোমধ্যেই উপহার বিনিময় করেছিলেন শার্লেমেন। আর জেরুসালেমের প্যাট্রিয়ার্ক তাকে অ্যানাস্তাসিসের প্রত্নতাত্ত্বিক উপহার ও চাবি পাঠিয়েছিলেন। খলিফা সম্ভবত নতুন বিদেশী মিত্র পেয়ে খুশি হয়েছিলেন। তিনি চার্লসকে অ্যানাস্তাসিসের বিপরীতে জেরুসালেমে একটি সরাইখানা নির্মাণের অনুমতি দিলেন। এতে একটি চার্চ ও একটি জাঁকজমকপূর্ণ লাইব্রেরিও ছিল। চার্লস তীর্থযাত্রীদের জন্য কিদরন ভ্যালিতে ১২টি কক্ষ-সংবলিত একটি ভবন প্রতিষ্ঠা করেন। এতে খামার, আঙর বাগান ও একটি বাণিজ্যিক সবজি খামার ছিল। জেরুসালেমে নতুন সম্রাটের একটি ঘাঁটি হলো : তার নতুন সাম্রাজ্যের শিকড় দুনিয়ার কেন্দ্রে ছিল বলে বলা হয়ে থাকে। 

বাস্তবে মৃত্যুর পর চার্লসের সাম্রাজ্য টিকে না থাকলেও ইউরোপের লোকজন কখনো তার সংক্ষিপ্ত রেনেসাঁ কিংবা জেরুসালেমের সাথে তার সংযোগের কথা ভোলেনি। পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদ ও ইতিহাসলেখকেরা দাবি করেছেন, চার্লসের প্রতি খলিফা এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি তাকে পুরো পবিত্র ভূমি দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অন্যরা বলে, তিনি চার্লসকে জেরুসালেমের খ্রিস্টানদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পাশ্চাত্যের সজ্ঞানতায় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে হারুন-অর- রশিদ তাকে ফিলিস্তিন দিতে না পারলেও তাকে অ্যানাস্তাসিসের মালিকানা দিয়েছিলেন। ফলে এই পবিত্র স্থানটিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এটি ছিল এমন এক বিশ্বাস যা তিন শ’ বছর পর ক্রুসেডের আমলে ভয়াবহভাবে বিস্তৃত হয়েছিল। ওই সময় পাশ্চাত্য আরো স্থায়ীভাবে পুনর্জীবন অর্জন করেছিল। তবে এসব রাজকীয় স্বপ্নের কিছু কিছু জেরুসালেমে চার্লসের নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য আসা ইউরোপিয়ান সন্ন্যাসী, পুরোহিত ও নানেরা প্রকাশ করতেন। ৮০৭ সালে ন্যাটিভিটি চার্চে গ্রিক ও ল্যাতিনদের মধ্যে দাঙ্গা বেঁধে যায়। নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাখ্যা বিকাশকারী প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানেরা একে অপরের প্রতি মতবাদগত সহজাত বিরূপতা পোষণ করত। এতে করে খ্রিস্টান বিশ্বের পবিত্রতম একটি স্থানে সহিংসতার সৃষ্টি হয়। এটি ছিল জেরুসালেমের দীর্ঘ ও লজ্জাজনক বিরোধিতার সূচনা। 

মুসলিমদের কাছে ওয়েস্টার্ন হিলের ওপর নতুন ল্যাতিন ভবনগুলো জেরুসালেমের খ্রিস্টানদের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও সম্পদের ব্যাপকতাই প্রকাশ করেছিল। তাদের নিজদের খলিফা দৃশত্য পবিত্র নগরীকে অবহেলা করতে থাকলেও খ্রিস্টান রাজারা সেখানে তাদের অবস্থান মজবুত করার জন্য মুক্ত হাতে ব্যয় করা থেকে বিরত থাকছে না। সিরিয়ান মনোফাইসিত সম্প্রদায় জ্যাকোবাইতরাও হারামের ঠিক উত্তরে মেরি ম্যাগদালেনকে নিবেদন করে নতুন একটি মঠ নির্মাণ করল। তখন ছিল ফিলিস্তিনের ভয়াবহ সময়। ৮০৯ থেকে ৮১৩ পর্যন্ত সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ ছিল। হারুন-অর-রশিদের দুই ছেলে উত্তরাধিকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। খলিফা আল-মামুনের সিংহাসন আরোহণের মধ্য দিয়ে এর নিষ্পত্তি হওয়ার পর আবার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে ডোম অব অ্যানাস্তাসিস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর পঙ্গপালের আক্রমণ ঘটে। এত গ্রামীণ এলাকায় বিপর্যয় ঘটে, পরিণামে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। হারামের আশপাশের মুসলিম অধ্যুষিত মহল্লাগুলো ছিল শহরের অধিকতর অস্বাস্থ্যকর এলাকা। তারা কয়েক সপ্তাহের জন্য জেরুসালেম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তারা ফিরে এসে দেখল যে প্যাট্রিয়ার্ক টমাস সুযোগটি লুফে নিয়ে অ্যানাস্তাসিস ডোম মেরামত করে ফেলেছেন। এটি এখন ডোম অব রকের মতোই বড়। এতে তারা প্রচণ্ডভাবে ক্ষিপ্ত হয়। নগরীর মুসলিম অধিবাসীরা তিক্তভাবে রাজকীয় কমান্ডারের কাছে অভিযোগ করে যে খ্রিস্টানেরা ইসলামি আইন লঙ্ঘন করেছে। ওই আইনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, জিম্মিরা মসজিদ কিংবা উম্মাহর অন্যান্য ঐশী ভবনের চেয়ে বড় বা সমান কোনো উপাসনালয় স্থাপন করতে পারবে না। 

এটি ছিল উদ্বেগজনক নতুন ঘটনা। এই ধরনের সমস্যা জেরুসালেমে অব্যাহতভাবে ঘটতে থাকে। অনেক দিন ধরেই নগরীতে নির্মাণ ছিল আদর্শগত অস্ত্র। হ্যাড্রিয়ানের আমল থেকে নির্মাণের অর্থ ছিল আগের মালিকদের মালিকদের মুছে ফেলার প্রবণতা। এখন ভবনগুলো জেরুসালেমের সম্প্রদায়গুলোর কাছে অন্যদের প্রতি তাদের বৈরিতা প্রকাশের মাধ্যমে পরিণত হলো। মুসলিমরা সবসময়ই বায়তুল মোকাদ্দাসে খ্রিস্টানদের চমকপ্রদ চার্চগুলো নিয়ে নার্ভাস ছিল। তবে উমাইয়া আমলে খলিফারা ইসলামি জেরুসালেম ও সার্বিকভাবে দেশের জন্য অর্থ ঢালতে ইচ্ছুক থাকায় তাদের পক্ষে তা হজম করা অনেক সহজ ছিল। এখন তারা অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত থাকায়, খলিফার কাছ থেকে পরিত্যক্ত হওয়ায় মুসলিমদের কাছে অ্যানাস্তাসিস ডোম অসহ্যকর মনে হলো। ইসলাম আত্মবিশ্বাসী ধর্ম হিসেবে ফিলিস্তিনে হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করেছিল। ধর্মীয় ভবনগুলো আগে অলৌকিক সামগ্রী হলেও নতুন নিরাপত্তাহীনতার কারণে এখন সেগুলো মুসলিমদের নিজস্ব বিপন্ন পরিচিতির প্রতীকে পরিণত হলো। খ্রিস্টানেরাও প্রায় নিশ্চিত ছিল যে তাদের নিজস্ব ডোমের সম্প্রসারণ ছিল নগরীতে তাদের শক্তি ও অবস্থানের আগ্রাসী মনোভাবের প্রকাশ। ইসলাম হয়তো তাদেরকে জয় করেছে, কিন্তু তারা দীর্ঘ সময় নিকৃষ্টতর অধীনস্থ হয়ে থাকেনি। 

সবশেষে একটি সমঝোতা হলো। প্যাট্রিয়ার্ক প্রহার থেকে রক্ষা পেতে সক্ষম হয়েছিলেন অভিযোগকারীদের এ কথা বলে যে নতুন ডোমটি পুরনোটির চেয়ে যে বড় তা যেন তারা প্রমাণ করে। এক মুসলিমই তাকে এই চালাকি শিখিয়ে দিয়েছিল। এর বিনিময়ে ওই মুসলিম পরিবারটি পরের ৫০ বছর প্যাট্রিয়াক অফিস থেকে নিয়মিত ভাতা পেয়েছিল। খলিফা আল-মামুন মুসলিম অনুভূতিকে মূল্যায়ন করে হারামে নতুন নির্মাণের আদেশ জারি করেছিলেন। প্লাটফর্মের পূর্ব ও উত্তর তোরণগুলো নির্মাণ করা হয়, ডোম অব দি রক একেবারে ঢেলে সাজানো হয়। আল-মামুন প্রধান খোদাইলিপি থেকে উমাইয়া বংশের আবদুল মালিকের নাম মুছে ফেলার সুযোগটিও গ্রহণ করে সেখানে তার নিজের নাম স্থাপন করেন। অবশ্য তারিখ পরিবর্তন না করার বুদ্ধিটি তার ছিল। ৮৩২ সালে খলিফা ‘আল-কুদস’ (মহা পবিত্র, জেরুসালেমের নতুন মুসলিম নাম) শব্দ-সংবলিত নতুন মুদ্রা ইস্যু করেন। 

তবে মুসলিমদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাতে খ্রিস্টানেরা তাদের ধর্মীয় প্রতীকগুলো অব্যাহতভাবে ব্যবহার করতে থাকে। নবম শতকে আমরা প্রথমবারের মতো ইস্টার সানডের আগের সন্ধ্যায় অ্যানাস্তাসিসের হলি ফায়ার (পবিত্র আগুন) বার্ষিক অনুষ্ঠানের কথা শুনি। জনতা প্রত্যাশা নিয়ে রোতানদা ও ম্যারটিরিয়ামে সমবেত হতো। দুটিই থাকত পুরোপুরি অন্ধকার। কবরের পেছন থেকে স্বাভাবিক সন্ধ্যা প্রার্থনা আওড়াতেন প্যাট্রিয়ার্ক। তারপর হঠাৎ করে অনেকটা স্বর্গ থেকে নেমে আসার মতো করে একটি পরিষ্কার সাদা শিখা উপাসনালয়ে আত্মপ্রকাশ করত। উত্তেজিত, চাপা নীরবতায় অপেক্ষমান সমবেত জনতা উচ্চ শব্দে চরম উল্লাসে ফেটে পড়ত। তারা সর্বোচ্চ শক্তিতে পবিত্র গ্রন্থ থেকে পাঠ করত, বাতাসে তাদের ক্রুশ দোলাত, আনন্দে চিৎকার করত। প্যাট্রিয়ার্ক শিখাটি মুসলিম গভর্নরের কাছে হস্তান্তর করতেন। তিনি সবসময় ওই অনুষ্ঠানে হাজির থাকতেন। তারপর তা দেওয়া হতো জনতার কাছে। তারা সেখান থেকে নিজ নিজ মোমবাতি ধরাত। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত, পবিত্র আগুনটি তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় রাস্তায় চিৎকার করতে করতে বলত ‘ক্রুশের ধর্ম তাড়াতাড়ি চলো!’ অনুষ্ঠানটিতে মুসলিমেরা বিরক্ত হতো বলে মনে হচ্ছে। এই প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিমেরাই অনুষ্ঠান-সম্পর্কিত আমাদের তথ্যের প্রধান উৎস। প্রতি বছর খলিফার কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠাতেন গভর্নর। ৯৪৭ সালের এক ঘটনায় বাগদাদের কর্মকর্তারা সত্যিই এই অনুষ্ঠান বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। তারা প্যাট্রিয়ার্ককে ‘জাদুর তন্ত্রমন্ত্রের’ জন্য প্যাট্রিয়ার্ককে তিরষ্কার করেন। তারা দাবি করেন ‘আপনি পুরো সিরিয়া আপনার খ্রিস্টান ধর্ম দিয়ে ভরে দিয়েছেন, আপনি আমাদের প্রথা ধ্বংস করেছেন।’ মুসলিমেরা আপাত দৃষ্টিতে ‘অলৌকিক’ মনে হওয়া এ ঘটনাকে ঘৃণ্য কৌশল হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছিল। এটি কিভাবে হতো, তা নিয়ে প্রত্যেকেরই নিজস্ব তত্ত্ব ছিল। তবে এতে কিছুই নেই বলে তারা নিজেদের পুরোপরি আশ্বস্ত করতে পারছিল না। তারা জনতার বন্ধনহীন উল্লাসে আতঙ্কিত হয়েছিল। মুজির উদ্দিনের মতে, তাদের ‘বিভীষিকা আতঙ্কে গা কাঁপা শুরু হয়ে যায়।’ ইসলামের সৌম্য উপাসনাব্যবস্থায় এর সাথে তুলনীয় কিছুই ছিল না। এই কয়েক ঘণ্টার তুমুল কোলাহলপূর্ণ অনুষ্ঠান জেরুসালেমে মুসলিম উপস্থিতি ঢেকে ফেলছে বলে মনে হতো। আর এই কঠিন সময়ে মুসলিমরা তাতে উদ্বিগ্ন হতো। প্রতি বছর খ্রিস্টানেরা তাদের বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইত, মুসলিমেরা এই প্রদর্শনী পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করতে পারত না। 

আব্বাসি শক্তির পতনের অর্থ ছিল ফিলিস্তিনে শৃঙ্খলা বজায় রাখা রাজ- কর্তৃপক্ষের জন্য ক্রমবর্ধমান হারে কঠিন হয়ে দাঁড়ানো। ৮৪১ সালে জেরুসালেমের সব অধিবাসী (ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমেরা) কৃষক বিদ্রোহের সময় আতঙ্কে নগর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। এই বিদ্রোহের নেতা তামিম আবু হার্ব উমাইয়া শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি করেছিলেন। তিনি ও তার অনুসারীরা নগরী লুণ্ঠন করেছিল, মসজিদ ও চার্চগুলোতে হামলা করেছিল। প্যাট্রিয়ার্ক বিপুল পরিমাণ অর্থ ঘুষ দেওয়ায় পুরোপুরি ধ্বংস হওয়া থেকে আনাস্তাসিস রক্ষা পেয়েছিল। ৮৬৮ সালে স্বস্তির সৃষ্টি হলো স্থানীয় তুর্কি কমান্ডার আহমদ ইবনে তুলুনের মিসরের ক্ষমতা দখল করে সেখানে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। মিসর তখন সিরিয়া ও ফিলিস্তিনও নিয়ন্ত্রণ করত। তিনি আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, অর্থনীতির উন্নতি ঘটে, বাণিজ্য বিকশিত হয়। ইবনে তুলুন বিশেষ করে জিম্মিদের প্রতি উদার ছিলেন। তিনি জেরুসালেমে একজন খ্রিস্টান গভর্নর নিয়োগ করেন, ক্ষতিগ্রস্ত ও ভেঙ্গে পড়া চার্চগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জেরুসালেমে ইহুদিদের একটি নতুন উপদলকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ারও অনুমোদন দেন। 

দানিয়েল আল-কুমুসি ৮৮০ সালের দিকে ছোট একদল সহযোগী নিয়ে খোরাসান থেকে জেরুসালেমে অভিবাসন করেছিলেন। তারা ছিল কারাইতেসের গুপ্ত উপদলের সদস্য। এই ইহুদিরা তালমুদ প্রত্যাখ্যান করেছিল, পুরোপুরি বাইবেলের ওপর ভিত্তি করে তাদের জীবনযাপন করত। অবশ্য, জেরুসালেমে পৌছার পরপরই দানিয়েল একটি সম্পূর্ণ নতুন মেসাইনিক মাত্রা দেন কারাইবাদকে। ফিলিস্তিনে তিনি কামরান উপদলের হাতে থাকা নথিপত্রের সান্নিধ্যে লাভ করেন। এ উপদলটি সম্প্রতি বেদুইনদের একটি কুকুরের খুঁড়ে বের করা একটি পাণ্ডুলিপিটির মালিক ছিল। দানিয়েল নবম শতকের এসব ডেড সি স্কুল দেখে নিশ্চিত হন যে ইহুদিদের প্রবাস জীবন অল্প সময়ের মধ্যেই অবসান ঘটবে। ইহুদিরা যদি প্রবাসে তাদের স্বস্তির ঘরবাড়ি ত্যাগ করে পর্যাপ্ত সংখ্যায় জেরুসালেমে বসতি স্থাপন করে, তবে তারা মেসাইয়ার আগমন ত্বরান্বিত করতে পারে। সারা দুনিয়া থেকে খ্রিস্টান ও মুসলিমেরা জেরুসালেমে আসতে পারলে ইহুদিরা কেন পারবে না? প্রবাসে থাকা প্রতিটি ইহুদি সম্প্রদায় যেন অন্তত পাঁচজন করে বসতি স্থাপনাকারীকে পবিত্র নগরীতে পাঠায়। দানিয়েলের শিষ্য সাহল ইবনে মাসলিয়া জেরুসালেমের একটি মর্মভেদী ছবি আঁকেন, যাতে নগরীকে এর সত্যিকারের সন্তানদের জন্য আকুলতা প্রকাশ করতে দেখা যায়। নরগীটি অবহেলা করা খোদ ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করার প্রায় সমান : ‘পবিত্র নগরীতে সমবেত হন, তোমার ভাইদের সাথে একত্রিত হও, তোমার উপস্থিতি একটি জাতি গড়ে ওঠবে, যা স্বর্গের পিতার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে বহাল নেই। 

দানিয়েল ও সাহলের প্রপাগান্ডায় ফলে কারাইতরা জেরুসালেমে আসতে শুরু করে। ইবনে তুলুন তাদেরকে নগরীর বাইরে ওফেলের পূর্ব ঢালে আলাদা মহল্লা প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি দেন। কারাইতরা খাদ্য ও পবিত্রতার ব্যাপারে তালমুদের আইন পালন করত না। সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদিদের মতো তারা রাব্বিদের কর্তৃত্ব গ্রহণ করত না, ‘রাব্বানিয়াত’ অনুসরণ করত না। তারা কৃচ্ছ্রসাধন করত, যা ইহুদি ধর্মে ছিল অস্বাভাবিক। চামড়ার তৈরি পোশাক পরত তারা, গোশত খাওয়া থেকে বিরত থাকত। মাউন্ট অলিভেসে তারা নিজেদের জন্য একটি পনির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এভের নবম দিনে বিধ্বস্ত টেম্পলের ওপর কাঁদত, তবে কারাইতরা দুঃখকে জীবনযাত্রার অংশে পরিণত করেছিল। তারা নগর ফটকগুলোতে নিয়মিত প্রার্থনা অনুষ্ঠান আয়োজন করত। এসময় তারা হিব্রু, পারসি ও আরবিতে ‘নিঃসঙ্গতার’ জন্য উচ্চস্বরে বিলাপ করত। তারা বিশ্বাস করত যে জায়নের বিলাপকারীরা, তারা এমনটিই বলত, মেসাইয়াকে পাঠাতে ও পুরোপুরি ইহুদি নগরী হিসেবে জেরুসালেম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ঈশ্বরকে বাধ্য করবে। রাব্বানিয়াতরা এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিকে আড়চোখে তাকাতেন। তারা সব ধরনের মেসাইনবাদ নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। কারণ মেসাইনবাদ অনেকবার ইহুদি জীবনে মর্মান্তিক ও অগ্রহণযোগ্য ক্ষতি ডেকে এনেছিল। তারা বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বর তার নিজের সুসময়ে পরিত্রাণের ব্যবস্থা করবেন, সেটিকে ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করা ঈশ্বর অবমাননার সামিল। বস্তুত মেসাইয়াকে আনার আশায় জেরুসালেমে আলিয়া না করতে ইহুদিদের নিষেধ করেছিলেন অনেক রাব্বি। 

তুলুনীয় শাসন শেষ হয় ৯০৪ সালে। এ সময় আব্বাসিরা আবার ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। তবে তারা দীর্ঘ সময় তা ধরে রাখতে পারেনি। মধ্য এশিয়ার তুর্কি মুহাম্মদ ইবনে তুঘ ৯৩৫ সালে মিসর, সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাগদাদের খলিফাকে ন্যূনতম অধীনতা স্বীকার করে শাসনকাজ চালাতেন। তবে কার্যত তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতেন। তিনি ও তার উত্তরসূরিরা এশিয়ার রাজকীয় পদবি ইখশিদ পদবি গ্রহণ করেন। সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে আরো কিছু রাজবংশের উত্থান ঘটে। এর ফলে প্রায়ই ক্ষমতার দাবিদার প্রতিযোগী রাজবংশগুলোর বিরামহীন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় ফিলিস্তিন। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে বায়েজান্টাইমের গ্রিক সম্রাটেরা মুসলিম সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ১০ম শতকে বায়েজান্টাইনরা সিলিসিয়া, তারসাস ও সাইপ্রাস ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করে সত্য বিশ্বাসের জন্য জেরুসালেম পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। 

এসব গ্রিক বিজয় অনিবার্যভাবে জেরুসালেমে মুসলিম-খ্রিস্টান সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটায়। সাধারণভাবে মুসলিমেরা আল-কুদসে খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেনে নিতে পেরেছিল। হলি ফায়ারের মতো বিষয়াদিকে কেন্দ্র করে মাঝে মাঝেই ঝামেলা হতো, তা অস্বস্তিতে পরিণত হতো। তবে তারা নগরীতে খ্রিস্টানদের দাবি স্বীকার করত, ধরে নিত যে আল-কুদসে খ্রিস্টান উপস্থিতি সবসময়ই থাকবে। বায়েজান্টিয়ামের সাথে তার যুদ্ধের সর্বোচ্চ সময়ে ইখশিদ খ্রিস্টান সম্রাটকে স্মরণ করিয়ে দেন যে জেরুসালেম উভয় ধর্মের জন্যই পবিত্র। এটি 

ঐশী ভূমি। এখানে আছে আল-আকসা মসজিদ ও খ্রিস্টান প্যাট্রিয়ার্ক। ইহুদি ও খ্রিস্টানেরা সেখানে তীর্থ করে, এখানেই মেসাইয়া ও তার মা জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এই হলো সেই স্থান যেখানে দুটি সেপালচার পাওয়া গেছে। 

মুসলিমেরা সেক্যুলার পন্থায় খ্রিস্টান উৎসবগুলোতে অংশ নিত। এনকাইনিয়ায় তারা আঙুর উৎসবের সূচনা উদযাপন করত। সেন্ট জর্জের উৎসব ছিল নতুন বীজ বপণের দিন। সেন্ট বারবারার উৎসব বর্ষা মওসুমের সূচনা ঘটত। মুসলিমেরা মেনে নিয়েছিল যে খ্রিস্টানেরা সেখানে থাকবে। তবে গ্রিকরা যখন পবিত্র যুদ্ধ শুরু করে, জেরুসালেমকে মুক্ত করার যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে থাকে, তখন উত্তেজনা অসহ্যকর হয়ে পড়ে। ৯৩৮ সালে খ্রিস্টানদের পাম সানডে শোভাযাত্রার সময় তাদের ওপর আক্রমণ চালায়, মুসলিমেরা ম্যারটিরিয়ামের ফটকগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে। আনাস্তাসিস ও গলগোথা চ্যাপেল উভয়টিই ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৯৬৬ সালে আরেক দফা বায়েজান্টান বিজয়ের পর প্যাট্রিয়ার্ক চতুর্থ জন জেরুসালেম পুনঃজয়ের জন্য সাথে সাথে অগ্রসর হওয়ার জন্য সম্রাটের প্রতি আহ্বান জানান। মুসলিম ও ইহুদিরা তখনই অ্যানাস্তাসিসে হামলা চালায়, ম্যারটিরিয়ামের ছাদে আগুন ধরিয়ে দেয়, হলি সায়নের ব্যাসিলিকা লুট করে। দাঙ্গার সময় তেলের পিপায় লুকিয়ে ছিলেন প্যাট্রিয়ার্ক। তাকে সেখান থেকে টেনে বের করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। 

ইখশিদ এসব বৈরিতা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। সম্রাটের কাছে জন তার অবিজ্ঞচিত আবেদন জানানোর পরপরই প্যাট্রিয়ার্ককে রক্ষার জন্য কায়রোতে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন ইখশিদ। এরপর ইখশিদ চার্চের ক্ষতির জন্য সম্রাটের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তিনি তার নিজের তহবিল থেকে সেগুলো পুনঃনির্মাণের প্রস্তাব দেন। সম্রাট কাঠখোট্টাভাবে প্রত্যাখ্যান করেন : তিনি নিজেই পবিত্র নগরী পুনঃনির্মাণ করবেন এবং তা করবেন তরবারি দিয়ে। এটি ছিল বিষাক্ত চক্র : গ্রিক বিজয়গুলো খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে প্রত্যাখ্যাতের সৃষ্টি হয়, এই ‘নির্যাতন’ কেবল বায়েজান্টাইন পবিত্র যুদ্ধ প্রয়াসের ইন্ধন দেয়।১২ ফলে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমেরা আল-কুদসের ব্যাপারে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে চলে যায় : তারা কল্পনাও করতে পারেনি যে গ্রিক বিজয়ের ক্ষেত্রে খ্রিস্টানেরা উমর যেভাবে অধিবাসীদের সাথে সহৃদতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তাদের সাথে সে রকম করা হবে। প্রথমবারের মতো তারা হারামের বাইরে তাকাতে শুরু করে, আনাস্তাসিসের কাছে ওয়েস্টার্ন হিলের ওপর একটি নতুন মসজিদ নির্মাণ করে। এটি খলিফা উমরের প্রতি নিবেদন করা হয়। খ্রিস্টান জেরুসালেমে এটিই ছিল প্রথম মুসলিম ভবন। খ্রিস্টানদের পবিত্রতম স্থানের কাছে উল্কানিমূলকভাবে অবস্থিত এ মসজিদটি খ্রিস্টানদের স্মরণ করিয়ে দেয় কারা জেরুসালেমের প্রকৃত শাসক এবং, সম্ভবত, মুসলিমদেরও আনাস্তাসিসের প্রতি উমরের উদার আচরণ (যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা বিন্দুমাত্র দেখা যাচ্ছিল না) করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। 

ইখশিদদের ফিলিস্তিন থেকে বের করে দেয়, প্রথমে কারমাতি নামের শিয়া গ্রুপ, এবং তারপর তিউনিশিয়ার শিয়া ফাতেমিরা। তারা ৯৭০ সালের মে মাসে রামলে জয় করেছিল। পরের ১৩ বছর ফিলিস্তিনের গ্রামগুলো বিধ্বস্ত হয় ফাতেমি, কারমাতি, বেদুইন ও আরব সৈন্যরা অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযান চালাতে থাকলে। শেষ পর্যন্ত ফাতিমিরা ৯৮৩ সালে তাদের নিজস্ব প্রতিদ্বন্দ্বী শিয়া খিলাফতকে প্রতিষ্ঠা করে তাদের রাজধানী কাইরোয়ান থেকে কায়রোতে সরিয়ে আনে। দেশে অস্বস্তিকর শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। আরব গোত্রগুলো প্রায়ই বিদ্রোহ করত, তবে ইহুদিরা ফাতেমিদের আকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল। বায়েজান্টিয়ামের সাথে খলিফা সাময়িক যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই করেন, আনাস্তাসিস ও ম্যারটিরিয়াম পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেন। ম্যারটিরিয়াম ৯৬৬ সাল থেকে ছাদহীন ছিল। এই চুক্তি খ্রিস্টানদের আরো শক্তিশালী মর্যাদা এনে দেয়, নগরীর উত্তেজনা প্রশমিত হয়। 

অবশ্য তলে তলে অস্বস্তি থেকেই যায়। স্থানীয় ভূগোলবিদ মুকাদ্দাসি ৯৮৫ সালে জেরুসালেমের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জেরুসালেমকে জিম্মিদের নগরী হিসেবে অভিহিত করেন : সব জায়গায় ইহুদি আর খ্রিস্টানেরা রয়েছে উচ্চতর স্থানে।১৩ জেরুসালেমে খ্রিস্টানেরা ছিল সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী : তারা ইহুদিদের চেয়ে অনেক বেশি ধনী ছিল, মুসরিমদের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত ছিল। মুকাদ্দাসি তার নগরী নিয়ে গর্বিত ছিলেন। মুসলিম বিশ্বের কোথাও ডোম অব দি রকের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো ভবন ছিল না; জলবায়ু ছিল নিখুঁত, বাজারগুলো পরিচ্ছন্ন ও সুন্দরভাবে গোছানো, আঙুর প্রচুর, অধিবাসীরা গুণে অনন্য। জেরুসালেমে একটিও বেশ্যালয় পাওয়া যাবে না, কোনো অন্ধকারাচ্ছন্নতা নেই। তবে মুকাদ্দাসি পুরোপুরি উজ্জ্বল ছবি আঁকতে পারেননি। হাম্মামখানাগুলা ছিল নোংরা, খাদ্য ছিল ব্যয়বহুল, কর ছিল বেশি, খ্রিস্টানেরা ছিল রূঢ়। তিনি বিশেষভাবে জেরুসালেমের বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দীপনার পতনে উদ্বিগ্ন হয়েছেন। এই পর্যায় পর্যন্ত ইসলামি আইনশাস্ত্রের অন্যতম মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা আস-শাফির মতো মহান মুসলিম বিদ্বজ্জনেরা নগরীর পবিত্রতায় আকৃষ্ট হয়ে জেরুসালেম সফরে আসতেন। এখন শিয়া ফাতেমিরা ক্ষমতায় ছিল। ফলে সুন্নি বিশ্ব থেকে সফরকারীদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কারণ বোধগম্য। ফাতেমিরা শিয়া আদর্শ প্রচার করার জন্য একটি স্টাডি সেন্টার (দার আলিম) প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা পুরো ইসলামি বিশ্ব জয় করার স্বপ্ন দেখছিল, সম্ভবত সুন্নাহর গণশিক্ষা হ্রাস করতে চেয়েছিল। মুকাদ্দাসি ফাতিমি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন। প্রতিটি ফটকে পাহারা ছিল, বাণিজ্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। সর্বোপরি বিদ্বজ্জনিত বিতর্কের অভাব ছিল। নগরীতে খুব কম খ্যাতিমান আলেম ছিলেন : ‘ফকিহদের কাছে কেউ যায় না, পণ্ডিত ব্যক্তিরা আর খ্যাতিমান নন; ক্লাস হয় না বলে স্কুলগুলো ফাঁকা থাকে।’ কথা সত্য, তবে জ্ঞান চর্চা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি : কোরআন পাঠকদের নগরীতে পাঠচক্র ছিল, আল আকসা মসজিদে হানাফি মাজহাবের স্টাডি গ্রুপ ছিল, সুফিরা তাদের খানকাহগুলোতে মিলিত হতেন। তবে পবিত্র কোরআনকে সবচেয়ে আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করার রক্ষণশীল ও রক্ষণাত্মক এই প্রবণতা সম্ভবত ছিল মুকাদ্দাসি যেটিকে শিয়াদের বিশেষ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া।’ মুকাদ্দাসি অনেক সফর করেছেন, ইসলামি বিশ্বের অন্যান্য অংশে প্রচলিত থাকলে সহজে দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময়ে প্রথাটি তিনি তার নিজ শহরে দেখেননি। 

ফাতেমি খলিফা আল-আজিজ ৯৯৬ সালের অক্টোবরে কায়রোতে ইন্তিকাল করেন। তার উত্তরসূরী হন তার ছেলে আল-হাকিম। তিনি ছিলেন ধার্মিক, কঠোর নীতিপরায়ণ। তিনি সামাজিক ন্যায়বিচারের শিয়া আদর্শের প্রতি আবেগপূর্ণভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। অবশ্য তিনি ছিলেন বদরাগী। প্রচণ্ড ক্রোধে ও নির্দয়তায় ফেটে পড়তেন। তার মা ছিলেন খ্রিস্টান। সম্ভবত সাংঘর্ষিক পরিচিতি থেকে খলিফার অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথমে খ্রিস্টানদের প্রতি খলিফার স্পষ্ট সহানুভূতি জেরুসালেমের খ্রিস্টানদের জন্য শুভসঙ্কেত বিবেচিত হলো। আল- হাকিম তার মামা ওরেসটেসকে প্যাট্রিয়ার্ক নিয়োগ করেন। মনে হচ্ছিল, তিনি সেখানে ওই সম্প্রদায়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চান। ১০০১ সালে তিনি বায়েজান্টিয়ামের সম্রাট দ্বিতীয় বার্সিলের সাথে আরেকটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেন। এটি তার সমসাময়িকদের বেশ মুগ্ধ করেছিল। এতে মনে হচ্ছিল, ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্ম বন্ধুত্ব ও শান্তির নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। 

তারপর ১০০৩ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে ফুসতাতে অবস্থিত সেন্ট মার্কের চার্চটি ধ্বংস করার নির্দেশ দেন খলিফা। তার দাবি মতে, এটি অনুমোদনহীনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, এবং নিশ্চিতভাবেই ইসলামি বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ওই স্থানে আল- হাকিম আল-রাশিদা মসজিদ নির্মাণ করেন। আর নির্মাণের সময় তা এত সম্প্রসারণ করেন যে তা কাছাকাছি থাকা ইহুদি ও খ্রিস্টান কবরস্থানও ঢাকা পড়ে যায়। এর পর তিনি ফরমান জারি করে মিসরে খ্রিস্টানদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন, ক্রুশ জ্বালিয়ে দেন, চার্চগুলোর ছাদে ছোট ছোট মসজিদ নির্মাণ করেন। ফিলিস্তিনে গোলযোগের গুজবেও খলিফা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বলা হয়ে থাকে যে সেখানে সাম্প্রতিক বেদুইন হামলার পেছনে খ্রিস্টান ও বায়েজান্টাইনরা ছিল। এটি পূর্ণ মাত্রায় বিপ্লব সৃষ্টির হুমকি ত্বরান্বিত করেছিল। এক ইস্টারে সবকিছু চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাল। এ সময় খলিফা লক্ষ্য করলেন যে কপ্টিক খ্রিস্টানদের একটি বিরাট গ্রুপ ‘বিপুল ও আক্রমণাত্মক প্রদর্শনী’ সহযোগে জেরুসালেম রওনা হয়েছে। তাদেরকে মক্কাগামী হাজিদের মতো দেখাচ্ছে। কী ঘটছে এবং অ্যানাস্তাসিস চার্চের অপরিমেয় সম্পদ সম্পর্কে যা শুনেছেন সে সম্পর্কে তিনি শিয়া প্রপাগান্ডাবাদী কুতেকিন আল- আদুদির কাছে জানতে চান। ইস্টারে সর্বোচ্চ মর্যাদার খ্রিস্টানরা প্রার্থনা করার জন্য সেখানে যেতেন। এমনকি বায়েজান্টাইন সম্রাটেরাও ছদ্মবেশে জেরুসালেম সফর করেন বলে জনশ্রুতি ছিল। ‘তারা বিপুল পরিমাণে রৌপ্য, আনুষ্ঠানিক পরিচ্ছেদ, রঙিন কাপড় ও নক্সা করা পোশাক বহন করেন… এবং দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণে সামগ্রী জড়ো হয়েছে।১৬ খ্রিস্টানদের সম্পর্কে সব গোপন ঈর্ষা, বিদেশে তাদের শক্তিশালী যোগাযোগের শঙ্কা এবং মুসলিম বিশ্বাসের প্রতি খ্রিস্টান চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে উদ্বেগ এখন প্রকট আকার ধারণ করেছিল। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো, খলিফাকে আল-আদুদি বলেছিলেন যে হলি ফায়ার অনুষ্ঠানটি [মুসলিমদের] অভিভূত করার, তাদের হৃদয়-মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির’ একটি কৌশল।১৭ 

আল-হাকিমের বিভ্রান্ত হৃদয়ে এই ভাষ্য নিশ্চিতভাবেই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। ১০০৯ সালে খলিফা কনস্টানটাইনের অ্যানাস্তাসিস ও ম্যারটিরিয়াম উভয়টি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এমনকি চার্চ ও চ্যাপেলগুলোর ভিত্তি পর্যন্ত উপড়ে ফেলার হুকুম জারি করেন। রামলের ফাতেমি গভর্নর তীব্র বেগে এই কাজে নামেন। গলগোথার সব ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। রক্ষা পায় কেবল রোতানদার কিছু অংশ। এ ব্যাপারে খ্রিস্টান ইতিহাসবিদ ইয়াহিয়া ইবনে সাইদ বলেন, কারণ হলো ‘গুঁড়িয়ে দেওয়া খুবই কঠিন প্রমাণিত হয়েছিল। এসব ভগ্নাংশ টিকে ছিল এবং বর্তমান ভবনে তা একীভূত করা হয়েছিল। কবরটি, এর উপাসনালয়টি এবং গলগোথার পাথরটি হাতকুঠার ও হাতুরি দিয়ে টুকরা টুকরা করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য ইয়াহিয়া ইঙ্গিত দিয়েছেন, কবরের ছোট একটি টুকরা পেছনে রয়ে গিয়েছিল। পাথরটির বাকি সব অংশ নগরীর বাইরে ফেলা হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে অন্য কোনো মুসলিম শাসকই এ ধরনের কাজ কখনো করেননি। এমনকি খলিফার মুসলিম প্রজারা পর্যন্ত এতে অস্বস্তিতে ভুগেছে। পরবর্তী নতুন বিধানে জিম্মিদেরকে উম্মাহ থেকে আলাদা করার ব্যবস্থা প্রবর্তন ও তাদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা বাধ্যতামূলক করা হয়। খ্রিস্টানদেরকে তাদের গলায় ভারী ক্রুশ ও ইহুদিদেরকে কাঠের বড় ব্লক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। ১০১১ সালে একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের সময ইহুদিদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করা হয়। জেরুসালেমের সিনাগগটি অপবিত্র করা হয়, এর অলগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। অনেক জিম্মিকে ইসলাম গ্রহণ করতে সন্ত্রস্ত্র করা হয়, অন্যরা অটল থাকে। অবশ্য অনেক খ্রিস্টান বায়েজান্টিয়াম সীমান্তে পালিয়ে যাওয়ার বিকল্প গ্রহণ করেছিল। 

খলিফার মানসিক বৈকল্য থেকে এরপর যারা দুর্ভোগে পড়েছিল তারা হলো মুসলিমেরা। ১০১৬ সালে আল-হাকিম ঘোষণা করেন যে তিনি ঐশী সত্তার অবতার, মানব জাতির কাছে নতুন ওহি নাজিল করার জন্য প্রেরিত হয়েছেন। এটি ইসলামি বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। কায়রোতে দাঙ্গা দেখা দেয়। খ্রিস্টানদের চেয়ে মুসলিমেরা অনিবার্যভাবেই এই ঈশ্বর অবমাননায় অনেক বেশি ক্রুদ্ধ হয়েছিল। ফলে তাদের ওপর নেমে আসে আল-হাকিমের ক্রোধ। ১০১৭ সালে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে ফরমান বাতিল করা হয়, তাদের সম্পত্তি ফেরত দেওয়া হয়। অন্য দিকে রমজান মাসে রোজা রাখা কিংবা হজ করা মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এই নির্দেশ অমান্যকারীদেরকে ভয়ঙ্করভাবে নির্যাতন করা হয়। খলিফা সম্ভবত তার নিজের স্বপ্নে বিভোর হয়ে এসব সহিংসতা ঘটনার মধ্য দিয়ে এগুতে থাকেন : দাঙ্গার সময় বেখেয়ালে কায়রোর রাজপথ দিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকলে ক্রুদ্ধ দাঙ্গাবাজদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। ২০১২ সালে এক রাতে একাকী ঘোড়ায় চড়ে মরুভূমিতে চলে যান, আর কখনো তাকে দেখা যায়নি। 

উন্মাদ খলিফা খ্রিস্টান জেরুসালেমকে ধ্বংস করে গিয়েছিলেন : কবর ও গলগোথা টিলায় রয়ে যাওয়া অংশের ওপর কোনোভাবে একটি নতুন উপাসনালয় নির্মাণ করা হয়। ১০২৩ সালে আল-হাকিমের বোন সিত্ত আল-মুলক জেরুসালেমের অবস্থা অবহিত করার জন্য প্যাট্রিয়ার্ক নাইসফোরাসকে কনস্টানটিনোপলে পাঠান। কিন্তু পরের বছর বেদুইনদের জারাহ গোত্র আবারো ফাতেমিদের ওপর চড়াও হয়। তারা ফিলিস্তিনের রাস্তাগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, পরিকল্পিতভাবে গ্রাম এলাকা লুণ্ঠন করতে থাকে। জেরুসালেমের অবস্থা এত খারাপ ছিল যে নির্মাণের কোনো চিন্তাই করা যেত না। ইহুদিদের অবস্থা ছিল বিশেষভাবে গুরুতর। ১০ম শতক নাগাদ জেরুসালেমের ইহুদি সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা কিছুটা বাড়ে। এর কারণ ছিল ৯৪০-এর দশকে বাগদাদ ও উত্তর আফ্রিকায় সৃষ্ট গোলযোগ থেকে রক্ষা পেতে ইহুদি উদ্বাস্তুরা ফিলিস্তিনে আশ্রয় নিয়েছিল। অবশ্য বেশির ভাগ নতুন অভিবাসী রামলে বা তাইবেরিয়াসে বাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাদের একজন লিখেছিলেন যে জেরুসালেম শহর হলো ‘অভিশপ্ত… এখানে খাদ্যদ্রব্যের সংস্থান হয় অনেক দূর থেকে, জীবিকার উপায় সীমিত। এখানে অনেকে ধনী এসে দারিদ্র-পীড়িত ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ১৯ খ্রিস্টানেরা ছিল সবচেয়ে বিত্তবান ও মর্যাদাবান অবস্থানে : ইহুদিরা ব্যাংকার, রংরেজ ও চামড়া প্রক্রিয়ার কাজ করত, যদিও কাজ করার সুযোগ ছিল কম। এতসব সমস্যা সত্ত্বেও ১০ম শতকে তাইবেরিয়াস থেকে ইহুদিরা জেরুসালেমে একটি পরিচালনা সংস্থা চালাত। ফলে জেরুসালেম আবারো ফিলিস্তিনি ইহুদিদের প্রশাসনিক রাজধানীতে পরিণত হয়। আল-হাকিমের অধীনে তারা দুর্ভোগে থাকলেও ইহুদিরা ফাতেমি সরকারের প্রতি কঠোর সমর্থক রয়ে যায়। ১০২৪ সালে বেদুইন বিদ্রোহের সময় তাদের আনুগত্যের জন্য তাদের ওপর নির্দয় করারোপ করা হয়। ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় অনেক ইহুদিকে কারাবরণ করতে হয়। বুভুক্ষা ও চরম দারিদ্রতা ছিল। অনেক ইহুদি মারা যায়। বাকিরা ‘কপর্দহীন, নগ্ন, বিমর্ষ ও গরিব’ হয়ে পড়েছিল বলে লিখেছেন পরিচালনা পরিষদের প্রধান বা গোয়ান সলোমন হা-কন। তিনি লিখেছেন, ‘এক লোকের বাড়িতেই কিছু ছিল না, এমনকি তার নিজের পোশাক বা গৃহস্থালি সামগ্রীও নয়। ‘২১ দুর্ভোগ অব্যাহত থাকে। ফিলিস্তিনে আরেকটি বেদুইন হামলা হয় উত্তর দিক থেকে। ফাতেমি খলিফা আল-জাহির ১০২৯ সালের আগে দেশটির নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে পারেননি। নিজের অবস্থান জোরদার করার জন্য তিনি বায়জান্টিয়ামের সাথে নতুন চুক্তি করেন, অ্যানাস্তাসিস পুনঃনির্মাণ অনুমোদন করার প্রতিশ্রুতি দেন। প্রায় ১০০ বছরের মধ্যে ১০৩০ সালটি ছিল প্রথম শান্তিপূর্ণ বছর। তুর্কি গভর্নর আল-দিজবিরি সাথে সাথে বিধ্বস্ত দেশটিতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে দেন। 

মুসলিমেরাও জেরুসালেমে তাদের নিজস্ব পুনঃগঠনের কাজ করেছিল। ১০১৭ সালে ডোম অব দি রক ধসে পড়ে। সম্ভবত তহবিল সংগ্রহ অভিযানের অংশ হিসেবে খ্যাতিমান মুসলিম পণ্ডিত আল-ওয়াসিতি জেরুসালেমের প্রশংসাসূচক ঐতিহ্যবাহী রচনা সঙ্কলন ফাজায়েল আল-কুদস প্রথম প্রকাশ করেন। ফলে উমাইয়া আমল থেকে ইসলামি বিশ্বে প্রচারিত হতে থাকা জেরুসালেমের প্রশংসাসূচক নবী, খলিফা ও দরবেশ-আউলিয়াদের বাণী এক খণ্ডে পড়ার সুযোগ হলো। পবিত্র নগরীতে ব্যাপক উত্তেজনা ছিল, অতি সম্প্রতি আল-হাকিমের নির্যাতন বিপর্যয়ের ফলে তিনটি ধর্মের সবাইকে রক্ষণাত্মক করে ফেলেছিল। তবে আল-ওয়াসিতির সঙ্কলনটি ছিল একীভূত করার পুরনো মুসলিম আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত। ইসরাইলিয়াত ও অন্যান্য স্থান থেকে উদ্ধৃত করা অনেক বাণী জেরুসালেমে ঈশা নবীর উপস্থিতির কথা স্মরণ করা হয়। আল-কুদস তখনো ইব্রাহিমের সব সন্তানের জন্য পবিত্র বলে স্বীকৃত ছিল। কিভাবে মক্কা ও মদিনার সাথে সৃষ্টিশীলভাবে জেরুসালেম অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে গেছে, তাও এতে দেখা গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আল-ওয়াসিতি নবীর নিচের হাদিসটি উদ্ধৃত করেছেন: 

দুনিয়ায় কোনো কিছু সৃষ্টির এক হাজার বছর আগে আল্লাহ মক্কা নগরীকে মর্যাদাসম্পন্ন করেছিলেন, সৃষ্টি করেছিলেন ও ফেরেশতাদের দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন। তারপর তিনি একে মদিনার সাথে এবং মদিনাকে জেরুসালেমের সাথে সংযুক্ত করেছিলেন। এবং এরও এক হাজার বছর পর তিনি একটি একক প্রয়াসে [বাকি দুনিয়া] সৃষ্টি করেছিলেন।২২ 

শেষ দিনে বেহেশত নববধূর মতো জেরুসালেমে প্রতিষ্ঠিত হবে, কাবা ও কৃষ্ণ পাথর মক্কা থেকে আল-কুদসে আসবে, যা হবে সমগ্র মানবজাতির জন্য চূড়ান্ত গন্তব্য। ২৩ বস্তুত, স্থানীয় লোকগাঁথায় দুই নগরী মক্কা ও জেরুসালেম আগেই বাস্তবভাবে সংযুক্ত হয়ে গিয়েছিল। মক্কায় হজের মাসে হাজিরা যখন আরাফাতের ময়দানে দাঁড়াতেন, তখন বলা হয়ে থাকে যে কাবার কাছে অবস্থিত পবিত্র জমজম কূপের পানি আসত মাটির নিচ দিয়ে সিলোয়াম সরোবর থেকে থেকে। ওই রাতে জেরুসালেমের মুসলিমেরা সেখানে বিশেষ উৎসবের আয়োজন করত। জেরুসালেমের পবিত্রতা এসেছে মক্কার আদি পবিত্রতা থেকে- এই বিশ্বাস প্রচারের জন্য মনোমুগ্ধকর কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল। দুইয়ের মিলনের এ প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করবে কিয়ামতের দিনে। ওই সময় সব শ্বাশতার জন্য মক্কার পবিত্রতা হস্তান্তরিত হবে আল-কুদসে। চূড়ান্ত একীকরণ হওয়ার পর দুনিয়ায় হয়ে যাবে বেহেশত। 

স্থানীয় লোকজনের স্থির বিশ্বাস ছিল যে মক্কা ও জেরুসালেম একই পবিত্ৰতা ধারণ করে। সম্ভবত একাদশ শতকের প্রথম দিকে মক্কায় গিয়ে হজ করতে না-পারা মুসলিমেরা হজের দিনগুলোতে জেরুসালেমে সমবেত হতো। যে রাতে হাজিরা মক্কার ঠিক বাইরে আরাফাতের ময়দানে রাত্রি জাগরণ করত, তখন এলাকাবাসী ও জেরুসালেমবাসী লোকজন হারামের প্লাটফর্ম ও মক্কার দিকে মুখ করা আল-আকসা মসজিদে সমবেত হতো। তারা সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকত, আরাফাতের ময়দানের মতো করেই উচ্চ কণ্ঠে ইবাদত-বন্দেগি করত। হজের শেষ দিন ঈদ-উল-আজহার সময় তারা হারামে প্রথাগত কোরবানি করত, এই কাজও তারা করত মক্কায় উপস্থিত থাকার মতো করে। অনেক হাজি তাদের হজযাত্রায় জেরুসালেম জিয়ারতও রাখতেন। হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্য যে ধরনের পোশাক পরা হতো, জেরুসালেম জেয়ারতের সময়ও তা করত তারা। তবে অনেক মুসলিম একে বিদআত মনে করে আপত্তি করত। এমন হাদিসও প্রচলিত ছিল যেখানে নবী আসলে জেরুসালেম না যাওয়ার জন্য তার অনুসারীদের বলেছেন। তবে আল- কুদসের প্রতি উচ্ছ্বসিত ভক্তি প্রদর্শন নিয়ে কোনো কোনো মহল ভুরু কুঁচকালেও সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য বিশ্বাস ছিল যে এটি হলো ইসলামের তিন পবিত্র নগরীর একটি। মুহাম্মদ (সা.) এই বিখ্যাত হাদিসে বলেছেন : ‘তুমি কেবল তিনটি মসজিদে সফর করতে পারো। একটি হলো হারাম মসজিদ [মক্কায়], আমার মসজিদ [মদিনায়] ও আকসা মসজিদ।’ 

এখন প্রতি শুক্রবার বিকেলে হারামে বিপুলসংখ্যক মুসলিম সমবেত হয়। তবে কেবল হজের মাসে নয়, জামায়াতে নামাজের জন্য। 

খলিফা আল-জহিরের তাগাদায় গভর্নর আল-দিজবিরি দ্রুততার সাথে ডোম অব দি রক পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছিলেন। হারামের প্রতি খলিফার বিশেষ আগ্রহ ছিল। ওই সময় ডোমের ভার বহনের জন্য যে কাঠের বিমগুলো লাগানো হয়েছিল, তা বর্তমান সময়েও আছে। অবশ্য এর পর আবারো বিপর্যয় আঘাত হানে। ১০৩৩ সালের ৫ ডিসেম্বর আরেকটি ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে ফিলিস্তিনে। সৌভাগ্যবশত এটি হয় সূর্য ডোবার আগে। ফলে বেশি লোক তাদের ঘরের ভেতরে ছিল না। ওই দিনগুলোতে কোনো লোক ঘরের ভেতর যেতে সাহস পেত না, লোকজন নগরীর আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় তাঁবু খাঁটিয়ে রাত্রিযাপন করত। একটি সামগ্রিক নতুন ভবন পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল। হারামের সহায়ক প্রাচীরগুলো মেরামতের প্রয়োজন পড়ে, আল-জহির নতুন নগর-প্রাচীর নির্মাণ শুরু করার নির্দেশ দেন। এ প্রকল্পটি শেষ হতে এক প্রজন্মের বেশি সময় লাগে। এই ভূমিকম্পে আল আকসা মসজিদ ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গম্বুজের উত্তরে চলাচলের ১৫টি পথের সবই ধসে পড়েছিল। নির্মাণকাজ সাথে সাথে শুরু হয়, ১০৪৭ সালে পারসিক পর্যটক নাসির-ই-খসরু জেরুসালেম সফরের সময় নতুন মসজিদের কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। মসজিদটি এখন অনেক সংকীর্ণ হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পথগুলোর স্থানে সাতটি খিলান দিয়ে একটি চক্রকার অংশ নির্মাণ করা হয়। নাসির সুন্দর সুন্দর কার্পেট, মার্বেলের পতাকা, ২৮০টি মার্বেলের স্তম্ভ ও ডোমের ওপর বর্ণাঢ্য এনামেল কারুকাজের প্রশংসা করেছেন। 

একাদশ শতকের মধ্যভাগে জেরুসালেম দৃঢ় পুনরুদ্ধার করে ফেলেছিল বলে মনে হয়। নাসির বলেছেন, নগরীতে প্রায় ২০ হাজার পরিবার বাস করে। এতে ধারণা করা হয়, নগরীর জনসংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ। তিনি নগরীর চমৎকার বাজার ও উঁচু ভবনরাজিতে অভিভূত হয়েছেন। প্রতিটি শিল্পের নিজস্ব সুক (বাজার) ছিল, শহরে ছিল অনেক কুশলী কারিগর। দ্রব্যসামগ্রী ছিল প্রাচুর্যপূর্ণ ও সস্তা। নাসির একটি বিশাল হাসপাতাল, বিশাল মাদরাসার কথা বলেছেন। এখানে চিকিৎসাবিজ্ঞান শেখানো হতো। এছাড়া মসজিদের পাশে সুফিদের দুটি খানকাহ ছিল। এখানে তারা বাস করতেন ইবাদত করতেন। সুফিদের একটি জামাত হারামের উত্তর দেয়ালের পাশে ফাঁকা স্থানে উপাসনালয় বানিয়ে নিয়েছিল। নাসির হারাম প্লাটফর্মে থাকা উপাসনালয় ও ছোট উপাসনা-কুঠুরীগুলোতে ধ্যানমগ্নভাবে আসা-যাওয়া করতেন, এক ‘মঞ্জিল’ থেকে আরেকটিতে যেতেন, দোয়া-দরুদ পাঠ করতেন, নবীদের মহান সংগ্রামের কথা ভাবতেন। তিনি কল্পনার চোখে দেখেছেন, নবী মুহাম্মদ (সা.) তার মিরাজের আগে রকের পাশে প্রার্থনা করেছেন, এর ওপর হাত রেখেছেন যাতে রকটি জেগে ওঠে তার সাথে সাক্ষাত করতে পারে। এতে করেই নিচের গুহাটি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি অন্য নবীদের সাথে একত্রিত হয়েছেন, গেট অব রিপেনট্যান্সে বিশেষ করে রাজা দাউদের কথা ভেবেছেন, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। যিশুর দোলনায় (ক্রেডল অব জেসাস) তিনি সিজদায় অবনত হয়েছেন। খ্রিস্টান পবিত্র স্থানগুলোর মতো নবীরা প্রত্যক্ষ ছাপ রেখে গেছেন। নাসির নিবিষ্ট মনে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মার্বেল স্তম্ভগুলোর আঁকড়ে ধরার সময় (যেভাবেই হোক সতর্কভাবে) মরিয়মের রেখে যাওয়া চিহ্নের কথা ভেবেছেন। বলা হয়ে থাকে, ইব্রাহিম ও ইসহাকের পায়ের ছাপ রকে দেখা যেতে পারে। 

নাসির নতুন অ্যানাস্তাসিস চার্চও পরিদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সম্রাট ৯ম মনোমারচাসের তহবিলে ১০৪৮ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। নাসির এটিকে চরম সুন্দর হিসেবে দেখেছিলেন, যিশু, অন্যান্য নবী, হাশরের ময়দানকে নিবেদন করে এর পেইন্টিং ও মোজাইকে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কারণ উপাসনালয়ে চিত্রকলার সাথে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। নতুন চার্চটি ছিল কনস্টানিয়ানের ভবন থেকে খুবই ভিন্ন। ম্যারটিরিয়াম আবার বানানোর কোনো চেষ্টাই হয়নি। স্থানটি এখন পাথর, ভাঙ্গা স্তম্ভে বোঝাই, ব্যাসিলিকাটি যেখানে ছিল, তা এখন ইট-সুড়কিতে পূর্ণ। কবরটির পাশে নতুন চার্চটি নির্মিত হয়েছিল আল-হাকিমের ধ্বংসকারী দলের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া রোতানদার অবশিষ্ট অংশের ওপর। মোনোমারচাসের নতুন ভবনটি সাবেক রোমান স্মৃতিসৌধকে বদলে দিয়েছিল। নির্মাতারা একটি উপরের তলা ও একটি অর্ধবৃত্তকার গৃহকোণ নির্মাণ করে একটি বড় খিলানের সাথে যোগ করেন। (ডায়াগ্রাম দেখুন।) অ্যানাস্তাসিসের সামনে সবসময়ই একটি আঙিনা ছিল। এখন এটি সম্প্রসারিত করে উত্তর-পূর্ব কোণায় গলগোথার বাকি অংশকে এবং পেছনে আদমের চ্যাপেলকে অন্তর্ভুক্ত করে। নতুন চ্যাপেলগুলো সেন্ট জন, ট্রিনিটিকে নিবেদন করা হয় এবং সেন্ট জেমসকে ব্যাপ্তাইজকরণ অংশের সাথে যুক্ত করা হয়। আর আঙিনার গলগোথার অংশকে প্যাসেনের বিভিন্ন ঘটনার সাথে যুক্ত করা হয়। 

নতুন চার্চ সফরের সময় কোনো উত্তেজনা অনুভব করেননি নাসির। তিনি বাধাহীনভাবে হাঁটতে পেরেছিলেন এবং নিশ্চিতভাবেই ইব্রাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব ও ঈশার মতো পরিচিত নবীদের ছবি দেখে নিজস্ব পরিবেশে অবস্থান করছেন বলে অনুভব করেছেন। তবে গত শতকে খ্রিস্টানেরা যে যন্ত্রণা ও ধ্বংসের মুখে পড়েছিল, তা তারা ভুলতে পারেনি, তারা তখনো অরক্ষিত থাকার অনুভূতিতে ভুগছিল। ১০৫৫ সালে নগর প্রাচীর নির্মাণের সময় গভর্নর খ্রিস্টানদের বলেন যে নগরীতে তাদের নিজস্ব অংশের প্রাচীরের ব্যয়ভার তাদেরকেই বহন করতে হবে। তাদের কাছে আর কোনো উপায় না থাকায় তারা ৯ম কনস্টানটাইনের শরণাপন্ন হয়। তিনি পবিত্র নগরীর জীবনযাত্রায় হস্তক্ষেপ করার এ সুযোগটি আগ্রহ নিয়ে লুফে নেন। খলিফার সাথে আলোচনার পর সমঝোতা হলো যে কনস্টানটাইন নগরীর যে অংশের প্রাচীর নির্মাণ করার ব্যয়ভার বহন করবেন, সেখানে কেবল খ্রিস্টানেরা বাস করবে। ফলে ১০৬৩ সাল নাগাদ জেরুসালেমের খ্রিস্টানরা নিজস্ব বিশেষ মহল্লা পেল। এই প্রাচীর উত্তর দ্বার থেকে নগরীর পশ্চিম দ্বার পর্যন্ত নগরদুর্গ থেকে বাইরের দিকে ছিল। অভ্যন্তরীণভাবে সীমানা প্রাচীরটি নগরদুর্গের পেছনের মোড় পর্যন্ত পুরনো কার্ডো ম্যাক্সিমাসজুড়ে বিস্তৃত ছিল। ৯ম কনস্টানটাইনের কল্যাণে তাদের এখন ‘প্যাট্রিয়ার্ক ছাড়া অন্য কোনো প্রভূর বিচারের মুখে পড়তে হতো না।’২৪ বায়েজান্টাইনরা এক ধরনের সুরক্ষা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এ খ্রিস্টান ছিটমহলটি মুসলিম নগরী থেকে আলাদা হয়ে এক বিদেশী শক্তির সমর্থনপুষ্ট ছিল। বর্তমানে ‘প্যাট্রিয়ার্কস কোয়ার্টার’ নামে পরিচিত ভবনটি ছিল সেন্ট জন দি আলমনারের হসপিটাল। এটি ইতালির আমালফির লোকজনের মাধ্যমে শার্লেমেনের পুরনো সরাইখানাটি নির্মাণের সময় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের লোকজন ‘অন্ধকার যুগের’ বিশৃঙ্খলা থেকে উদ্ধার পাওয়ার আরেকটি চেষ্টা করেছিল। ইতালির নগরগুলোর বণিকেরা প্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য শুরু করেছিল। আর আমালফিতানরা ফাতেমিদের বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। ফলে তারা ইতালির বেনেডিকটিন সন্ন্যাসীদের জন্য একটি মঠ নির্মাণের জন্য সহজেই খলিফার কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে যায়। এখানে তাদের নগরী থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের বাস করার ব্যবস্থা করা হলো। 

জেরুসালেমের অন্য নবাগতরা ছিল আর্মেনিয়ানরা। ইউরোপিয়ানদের মতো তারাও চতুর্থ শতক থেকে পবিত্র নগরী সফর করতে আসছিল। তাদের অনেকে সন্ন্যাসী ও সাধু পুরুষ হিসেবে অবস্থান করছিল। এখন তারা মাউন্ট সায়নে নতুন চার্চ কিনে নিলো। এটি ১০৩০-এর দশকে জর্জিয়ান সন্ন্যাসী প্রোচোর নির্মাণ শুরু করেছিলেন। একইসময় নগর প্রাচীরের বাইরে ক্রুশ মনাস্টেরিও নির্মাণ করছিলেন তিনি। আর্মেনিয়ানরা প্রায় ৪০ বছর পর জর্জিয়ানদের কাছ থেকে সায়ন চার্চটি সংগ্রহ করেছিল। তারা এটিকে ক্যাথেড্রালে পরিণত করেছিল। এটি সেন্ট জেমসের (বা ‘সার্প হ্যাগপ’, তিনি আর্মেনিয়ান ভাষায় এই নামেই ডাকতেন) প্রতি নিবেদন করেছিলেন। এর প্রধান উপাসনালয়, কিলকাতির, ছিল হেড জেমস দি ‘পিলার’ তথা যিশুর শিষ্যের মাথা। ৪২ সালে জেরুসালেমে তার শিরোশ্ছেদ করা হয়েছিল। উঁচু বেদির নিচে ছিল জেমস দি জাদিকের কবর। তিনি ছিলেন জেরুসালেমের প্রথম ‘বিশপ’। মাউন্ট সায়নে অনেক দিন খ্রিস্টানেরা তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করত। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার পর আর্মেনিয়ানরা ধীরে ধীরে তাদের প্যাট্রিয়ার্কের জন্য একটি কনভেন্ট এবং পাদ্রি, বিশপ ও গির্জার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত সেন্ট জেমস ব্রাদারহুডের নির্মাণকাজ শুরু করেছিল। কয়েক শ’ বছরের মধ্যে আর্মেনিয়ান প্যাট্রিয়ার্করা ধৈর্য ধরে কনভেন্ট ভবনগুলোর আশপাশের জমি ও বাড়িঘর কিনে ফেলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রায় সব এলাকাই তাদের হয়ে যায়। আর্মেনিয়ান তীর্থযাত্রীরা জেরুসালেমে থাকার সিদ্ধান্ত নিলে তাদেরকে নির্মাণাধীন আর্মেনিয়ান মহল্লায় কোনো বাড়িতে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হতো। তারা ব্রাদারহুডের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থায়ী সেক্যুলার সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। তারা কাঘাকাতসি (জেরুসালেমের অধিবাসী) নামে পরিচিত হয়। তারা নিজেদের হিসেবে নগরীকে গ্রহণ করে। তাদের ধর্মপল্লীর চার্চের জন্য তারা তারা কনভেন্টের কেন্দ্রের কাছে হলি আর্চানজেলের চ্যাপেলকে বরাদ্দ করে। এটি আনাসের বাড়ির স্থান ছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এ লোকটি যিশুকে মৃত্যুদণ্ড দিতে সাইয়াফাসকে সহায়তা করেছিলেন। এর আঙিনায় একটি প্রাচীন জলপাই গাছ ছিল। এই গাছের সাথেই যিশুকে বাঁধা হয়েছিল বলে বলা হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে কাঘাকাতসি একটি বড় আকারের ও আলাদা সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। আর্মেনিয়ানরা মনোফাইসিত হলেও তারা গ্রিক অর্থোডক্স ও ল্যাতিন ক্যাথলিক ছিল না। তারা ধর্মান্তরিতদের গ্রহণ করত না। ফলে তারা জাতিগতভাবে স্বতন্ত্রই থেকে যায়। ঊনিশ শতকের শেষ দিকে কাঘাকাতসির সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। আর্মেনিয়ান মহল্লা ছিল জেরুসালেমের পুরো নগরীর এক দশমাংশের সমান। 

একাদশ শতক নাগাদ জেরুসালেমে দল বেঁধে বেশি বেশি তীর্থযাত্রী আসছিল। পশ্চিম ইউরোপ থেকে আগমনের বিষয়টি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে তীর্থযাত্রা উৎসাহিত করত বারগান্ডির অ্যাবে অব ক্লুনির সংস্কারশীল সন্ন্যাসীরা। সত্যিকারের খ্রিস্টান মূল্যবোধ সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে তারা এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। বারগুনডিয়ান ইতিহাসলেখক রাউল গ্লাবারের মতে, ১০০০ সহস্রাব্দে অভিজাত, ও সাধারণ মানুষের মধ্যে রাস্তায় নামার ‘অপরিমেয় মাত্রায়’ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল, তারা জেরুসালেমে যেতে ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ : তারা এসেছিল ইতালি, গাউল, হাঙ্গেরি ও জার্মানি থেকে। মহাপ্রলয়ের ধারণায় তারা ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত হয়েছিল। ২৫ লোকজন সেই রোমান আমলের শেষ দিকের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো স্মরণ করত। ওইসব ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা হতো, মহাপ্রলয়ের আগে পাশ্চাত্যের এক সম্রাট জেরুসালেমে মুকুট পরবেন, সেখানে খ্রিস্টবিরোধীর সাথে লড়াই করবেন। ‘দি বুক অব রেভেলেশন’-এ ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে শয়তানের বিরুদ্ধে খ্রিস্টের বিজয়ের ১০০০ বছর পর এই চূড়ান্ত যুদ্ধ হবে। ২৬ ফলে ১০০০ সালে সেকেন্ড কামিং প্রত্যক্ষ করার জন্য তীর্থযাত্রীরা জেরুসালেমে ভিড় করতে লাগল। কারাইতিসদের মতো তারাও সম্ভবত বিশ্বাস করত যে পবিত্র নগরীতে তাদের উপস্থিতি ঈশ্বরকে নিউ জেরুসালেমে নেমে এসে আরো ভালো বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করবে। তবে মহাপ্রলয় না হওয়ায় লোকজন মনে করতে শুরু করল যে সালটি হয়তো হবে আরো যৌক্তিক তারিখ ক্রুশবিদ্ধকরণের হাজারতম বার্ষিকীতে তথা ১০৩৩। ওই বছর ইউরোপে প্রবল দুর্ভিক্ষ হয়। গ্ল্যাবের আমাদের জানাচ্ছেন যে অনেক লোকের মনে ধারণার সৃষ্টি হলো যে এই বিপর্যয় শেষ দিবসের সূচনা। ওই সময়ে সমাজের প্রতিষ্ঠিত শ্রেণি কৃষকেরা প্রথমে এবং সবশেষে ধনী অভিজাতেরা ‘জেরুসালেমের স্যাভিয়র্স টম্বের দিকে ছুটতে শুরু করল।’ গ্ল্যাবের নিশ্চিত ছিলেন যে পবিত্র নগরী এর আগে কখনো জনসাধারণের এমন চাপ অনুভব করেনি এবং তীর্থযাত্রীরা নিশ্চিত ছিলেন যে এই ‘এই পূর্বাভাস হতভাগ্য খ্রিস্টবিরোধীর আগমন ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এই খ্রিস্টবিরোধী নিশ্চিতভাবেই দুনিয়ার সমাপ্তি আসন্ন হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।’২৭ মুক্তির প্রতীক জেরুসালেমের প্রতি বর্বরতা ও বিশৃঙ্খলার দীর্ঘ সময় থেকে বের হয়ে লোকজন সংগ্রাম করতে থাকায় পশ্চিম ইউরোপের খ্রিস্টানদের মধ্যে মরিয়া ভাব ছিল। 

একেবারেই আলাদা ছিল ১০৬৪ সালে মহান পাশ্চাত্য তীর্থযাত্রা। বামবার্গের বিশপ আর্নল্ডের নেতৃত্বে এসব তীর্থযাত্রী ‘পবিত্র দারিদ্র্যে’ সফর করছিলেন না। ইউরোপের জীবন উন্নত হয়েছিল। জার্মান সম্ভান্ত অমার্ত্যরা তাদের সম্পদ ও শ্রেষ্ঠত্ব গর্ব করে প্রদর্শন করছিল, তাতে হঠকারিতাও ছিল। বেদুইন গোত্রগুলো সবসময় তীর্থযাত্রীদের দলগুলোর অপেক্ষায় থাকত। তারা জানত যে একেবারে দীনহীন ব্যক্তিও তাদের জীর্ণ জোব্বার নিচে সোনার টুকরা সেলাই করে লুকিয়ে রাখতে পারে। আর জার্মান তীর্থযাত্রীদের জাঁকজমক ছিল উন্মুক্ত প্রলোভন : গোত্রগুলো তীর্থযাত্রীদের আক্রমণ করল। তারা পবিত্র নগরী প্রায় চোখে দেখা দূরত্বে বিপুল সংখ্যায় মারা গেল। প্রায় প্রতি ৩০ বছর পরপর ইউরোপ থেকে বিশাল তীর্থযাত্রী আসত। শতাব্দী কাছাকাছি চলে আসায় এ ধরনের পাশ্চাত্য অভিযানের আরেকটি সময় চলে আসে। তবে ১০৯৯ সালে পবিত্র নগরীতে আগত তীর্থযাত্রীরা সাথে করে একটি করে তরবারিও নিয়ে এসেছিল। তারা কেবল নিজেদের রক্ষা করতে নয়, লড়াই করতে ও হত্যা করতেও প্রস্তুত ছিল। 

ইহুদি তীর্থযাত্রী ও বসতি স্থাপনকারীরাও জেরুসালেমে আলিয়া করতে উদ্দীপ্ত ছিল। তারাও অনেক সময় খ্রিস্টানদের মতো দেশে দুর্যোগে তাড়িত থাকত। ১০৫০-এর দশকে যাযাবর বর্বরেরা কাইরুয়ানে হামলা করলে ইহুদি ও মুসলিম উভয়েই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে ফিলিস্তিনে অভিবাসন করে। স্পেনের দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পেতে আরেক ধরনের অভিবাসীর আগমন ঘটে। এসব ইহুদিকে পাশ্চাত্যের লোকজন ‘মাগরেবি’ বলে ডাকত। তারা পবিত্র নগরীতে বসতি স্থাপন করলেও সেখানকার কঠিন অবস্থা ইসলামি বিশ্বের অন্য প্রান্তে তাদের বাড়িঘরের প্রতি তাদের গৃহকাতরতা প্রকাশ পেত। যোসেফ হা-কোন বলেছেন, জেরুসালেমের ইহুদিরা হলো ‘খাদকদের খাদ্য… ঔদ্ধত্যের কাছে নিঃশেষিত… গরিব, দুস্থ, পিষ্ট ও বন্ধক হয়ে যাওয়া’। খ্রিস্টান ও মুসলিমদের উপস্থিত ছিল অসহ্যকর। জীবনটি যদি খুব খারাপ না হতো তবে তীর্থযাত্রার সময় ইহুদিদেরকে ‘ইদমের [খ্রিস্টান] জনতার গোলমাল’ এবং ‘পাঁচবার মিথ্যা কথা [মোয়াজ্জিনের] শুনতে হতো, যা কখনো বন্ধ হতো না।২৮ জেরুসালেম সম্প্রদায় পুরোপুরি ফুসতাত ও রামলে থেকে দানের ওপর নির্ভর করত। ফলে সেখানে কোনো প্লেগ বা খরা দেখা দিলে তাদেরকে ক্ষুধায় থাকতে হতো। 

এসব কাঠিন্য সত্ত্বেও ইহুদি তীর্থযাত্রীরা অব্যাহতভাবে জেরুসালেমে তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখছিল, বিশেষ করে তিশরি মাসে তারা সেখানে সুকোথ উদযাপন করতে চাইত। ওই সময়টাতে তারা খোরাসানের মতো অনেক দূর থেকেও আসত। এই মেসাইনিক উৎসবের জন্য তারা নিজস্ব শাস্ত্রাচার উদ্ভাবন করেছিল। প্রথমে তীর্থযাত্রী ও অধিবাসীরা নগর প্রাচীরগুলো চক্কর দিত, আগের মতোই হারামের ফটকগুলোতে প্রার্থনা করত, মাউন্ট অলিভেসে আরোহণ করার সময় সাম গাইত। গাওন (ইহুদি ধর্মীয় নেতা) সোলোমন বেন জুদা লিখেছেন, তারা ‘ছুটির দিনগুলোতে ঈশ্বরের টেম্পলের, ঐশী উপস্থিতির স্থান, তার শক্তি ও তার পা রাখার জায়গায়, দিকে মুখ করে দাঁড়াত। ২৯ টেম্পল মাউন্ট মুসলিম উপাসনালয়ে ঢাকা পড়ে যাওয়ায় বিষণ্নতা ভর করলেও মাউন্ট অব অলিভেসে বিপুল ইহুদি সমাবেশ হতো উৎসবমুখর ও আনন্দময়। ইহুদিরা একে অন্যকে উষ্ণভাবে শুভেচ্ছা জানাত, আবেগে জড়িয়ে ধরত। তারা পর্বতে একটি বিশাল পাথরের পাশে সমবেত হতে পছন্দ করত। তারা তাতে থাকা একটি চিহ্নকে মনে করত যে জেরুসালেম ত্যাগ করার সময় সেখানে শেখিনা বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এখানে জেরুসালেমের গাওন তার বার্ষিক বক্তব্য রাখতেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সমাবেশের বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের ওপর একটি সাম্প্রদায়িক বৈরিতার ছায়া ভর করে : গাওন একটি তাওরাতের স্ক্রল বের করে শান্তভাবে কারাইতেসদের ধর্মচ্যুত করতেন। কারাইতেসের ক্যাম্পটি হতো পর্বতের অন্য দিকে রাব্বানিয়াতদের শিবিরের বিপরীতে। এই ধর্মচ্যুতি প্রায় সবসময়ই মারাত্মক বিবাদের সৃষ্টি করত, এমনকি মারামারিও হতো। শান্তিপূর্ণ মানুষ গাওন সোলোমন চেয়েছিলেন এই প্রথা বাতিল করতে। মুসলিম কর্তৃপক্ষও ধর্মচ্যুতির ঘোষণা বাদ দিতে বলত। তারা জোর দিয়ে বলত, রাব্বানিয়াত ও কারাইতেস উভয়ের তাদের রুচি অনুযায়ী বিশ্বাস অনুসরণের অধিকার রয়েছে। 

জেরুসালেমের ফাতেমি দখলদারিত্ব নগরীর জন্য মিশ্র আশীর্বাদ বয়ে এনেছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই অধিবাসীরা উত্তর দিক থেকে নতুন শত্রুর মুখে পড়তে হলো। ১০৫৫ সালে সম্প্রতি সুন্নি ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী তুর্কি গোত্রগুলো আব্বাসি খলিফা ও সুন্নাহর নামে উত্তর সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করল। তারা ছিল প্রতিভাধর প্রশাসক ও চৌকষ সৈনিক। এসব অভিযানে সেলজুক বংশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এ কারণে এসব তুর্কোম্যানকে (‘অভিজাত তুর্কি’) অনেক সময়ই সেলজুক নামে অভিহিত করা হতো। অবশ্য তাদের সব নেতাই এই বংশের সদস্য ছিল না। ১০৭১ সালে তুর্কি নেতা আলপ এশিয়ান আর্মেনিয়ার মানজিকার্টে বায়েজান্টাইন প্রতিরক্ষা লাইন গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। তুর্কিরা অল্প সময়ের মধ্যেই এশিয়ার বেশির ভাগ স্থান দখল করে নেয়। এদিকে আতসিজ ইবনে ইবাক শিয়াদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তিনি ফিলিস্তিন আক্রমণ করেন, রামলে দখল করে জেরুসালেমে অবরোধ করেন। নগরী ১০৭৩ সালের জুনে আত্মসমর্পণ করে, অধিবাসীরা বিজয়ীদের সংযমে আশ্চর্য হয়ে যায়। আতসিজ জেরুসালেমের সব অধিবাসীর জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেন। তিনি তার লোকজনকে কাউকে স্পর্শ না করতে, নগরীর বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন না করার নির্দেশ দেন। তিনি এমনকি চার্চ ও মসজিদগুলো রক্ষায় প্রহরী পর্যন্ত নিয়োগ করেছিলেন। তুর্কি, সুদানি ও বার্বারদের নিয়ে গঠিত ফাতেমি সেনাবাহিনী নগরীতেই রয়ে যায়। তুর্কিরা যোগ দেয় সেলজুকদের সাথে, অন্যরা বেসরকারি নাগরিক হিসেবে অবস্থান করতে থাকে। 

তুর্কি দখলদারিত্ব মানে জেরুসালেম এখন সুন্নি পরিমণ্ডলে ফিরে গেল। আলেমেরা জেরুসালেমে ফিরতে শুরু করলেন। ফাতেমি শাসনে বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে মুক্তি পেয়ে নবজাগরণ সৃষ্টি হলো নগরীতে তুর্কোম্যান শাসন নগরীতে সমৃদ্ধি বয়ে আনল। ১০৮৯ সালে একটি নতুন মসজিদ নির্মিত হলো, চার মাজহাবের দুটি- শাফি ও হানাফি- নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হলো। তুর্কিরা বাথ-হেসদা পুলের পাশে অবস্থিত ভার্জিন মেরির জন্মস্থান স্মরণে নির্মিত চার্চটিকে পুনঃনির্মাণ করে একে শাফি মাদরাসায় রূপান্তরিত করে। শেখ নাসর আল-মাকদিসির নেতৃত্ব নগরীতে আবার হাদিস ও ফিকাহ চর্চায় সমৃদ্ধি আসে। মুজির উদ্দিন আল-কুদসে শিক্ষা প্রদানের জন্য আগমনকারী প্রখ্যাত আলেমদের তালিকা দিয়েছেন। এদের মধ্যে ছিলেন আন্দালুসিয়া থেকে আগত মহান ফকিহ আল-তারতুশি ও আবুল-ফাতহ নাসির। ১০৯৫ সালে প্রখ্যাত সুন্নি চিন্তাবিদ আবু হামিদ আল-গাজ্জালি জেরুসালেমে আসেন ইবাদত-বন্দেগি ও ধ্যান করতে। তিনি মার্সি গেটের ওপরে ছোট একটি খানকায় বাস করতেন। এখানে তিনি সুফি চর্চা করতেন। জেরুসালেমেই তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ দি রিভাইবাল অব দি রিলিজিয়াস সায়েন্সস (ইলাহিয়া উলুম আদ-দিন) লিখেছিলেন। আমরা চতুর্দশ অধ্যায়ে দেখতে পাব যে সংস্কার করা সুন্নাহর রূপরেখায় পরিণত হয়েছিল এই গ্রন্থ। প্রায় একই সময় স্প্যানিশ পর্যটক আবু বকর ইবনে আল-আরাবি জেরুসালেম সফর করেছিলেন। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভবে এখানে তিন বছর অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি দুটি ফিকাহ মক্তব দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে বিতর্ক ও আলোচনার পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো, যা আল-আন্দালুসে অপরিচিত ছিল। তিনি মুসলিম ও জিম্মি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যকার সংলাপে অভিভূত ছিলেন। এতে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমেরা একসাথে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। 

নগরীতে টানাপোড়েন ছিল। ১০৭৭ সালে আতসিজের মিসর অভিযানের সময় জেরুসালেমের ফাতেমিপন্থী গ্রুপগুলো বিদ্রোহ করে। কাজি সব তুর্কি নারী ও শিশুদের বন্দি করে নগরদুর্গে আটকে রাখেন। তিনি তুর্কি সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করেন। এবার যখন আতসিজ নগর-প্রাচীরের বাইরে এলেন, তখন কোনো দয়া দেখাননি। নগরী আত্মসমর্পণ করলে তার সৈন্যরা প্রায় তিন হাজার অধিবাসীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। কেবল হারামে আশ্রয় গ্রহণকারীরাই রক্ষা পেয়েছিল। অবশ্য প্যাট্রিয়ার্কের মহল্লায় থাকা খ্রিস্টানেরা নিরাপদ ছিল। ফাতেমিদের প্রতি সবসময় অনুগত থাকা ইহুদিদের জন্য পরিস্থিতি তেমন সুবিধাজনক হয়নি। তারা সম্ভবত তুলুনীয় আমলেও খ্রিস্টানদের মতো একই ধরনের পৃষ্ঠপোষকতাও পায়নি। তারা তুর্কোম্যান শাসনকে বিপর্যয়ের কাল হিসেবে অভিহিত করেছে, ব্যাপক ধ্বংস ও তাণ্ডবে কথা বলেছে, ফসল জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা লিখেছে, উপাসনালয় ধ্বংস, লুণ্ঠন ও সন্ত্রাসের কথা জানিয়েছে। ইহুদি ইয়েশিভা এই সময়েই জেরুসালেম থেকে টায়ারে চলে যায়। ফাতেমি শাসনকে সমর্থনকারী শীর্ষস্থানীয় মুসলিমদেরকেও দেশটি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। অবশ্য বেশির ভাগ লোকই সম্ভবত এই সহিংস গোলযোগ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ইবনে আল-আরাবি একটি ছোট বিদ্রোহের সময় লোকজন তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম যেভাবে পরিচালনা করে তা দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। একজন বিদ্রোহী নগরদুর্গে প্রবেশ করলে গভর্নরের তীরন্দাজরা তার প্রতি ঝাঁকে ঝাঁকে তীর নিক্ষেপ করতে থাকে, সৈনিকেরা দুই দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকে। এ ধরনের কোনো ঘটনা আল- আন্দালুসে ঘটলে পুরো নগরীতে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ত, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত, স্বাভাবিক জীবন পুরোপুরি বিঘ্ন ঘটত। অথচ ইবনে আল-আরাবি অবাক হয়ে দেখতে পেলেন, তুলনামূলক ছোট এই শহরে জীবনযাত্রা স্বাভাবিকভাবে চলছে : 

এসব গোলযোগের কারণে কোনো বাজার বন্ধ হয়নি, সহিংসতা সৃষ্টি করে কোনো সাধারণ মানুষ এতে অংশ নেয়নি, কোনো দরবেশ আকসা মসজিদ ত্যাগ করেননি, কোনো আলোচনা স্থগিত হয়নি। ৩০ 

.

জেরুসালেমের অধিবাসীরা আগের দুই শ’ বছরে এত বেশি সহিংস প্রতিহিংসামূলক ঘটনার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল যে তারা এ ধরনের তুলনামূলক ছোটখাট সঙ্ঘাতের প্রতি খুবই উদাসীন হয়ে পড়েছিল। মাঝে মধ্যে ঘটা এসব ঘটনা সত্ত্বেও তুর্কোম্যান শাসনকালে জেরুসালেম সমৃদ্ধ হয়েছিল, ফিলিস্তিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে পরিণত হয়েছিল। ১০৩৩ সালের ভূমিকম্পের পর আর কখনো আগের অবস্থায় ফেরেনি রামলে। তবে এখন জেরুসালেমের নতুন প্রাচীর হয়েছে, সংস্কার করা ভবনরাজিতে মুগ্ধতা অর্জন করেছে। এখানে এখন সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক জীবন রয়েছে, এটি আন্তর্জাতিক নগরীতে পরিণত হয়েছে। সারা দুনিয়া থেকে এখন বছরে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এখানে আসে। এমনকি আল-আরাবি যদিও এখানকার সম্প্রীতি উপভোগ করছিলেন। কিন্তু তবুও একটি বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছিল। আর জেরুসালেমও এ বিপদটিকে স্বাভাবিক উদাসিনতার সাথে এড়িয়ে যেতে পারছিল না। ফাতেমিরা ফিলিস্তিন ত্যাগ করেনি। ১০৯৮ সালের আগস্টে শিয়া খলিফা আল-আফজাল ছয় মাস অবরোধের পর নগরী দখল করে নেন। এটি ফাতেমি সমর্থকদের জন্য আনন্দ বয়ে আনে। কিন্তু এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১০৯৯ সালের জুনে ইউরোপ থেকে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা জেরুসালেমের পাহাড়গুলোর বাইরে এসে পৌঁছে যায়। তাদের চোখে যখন প্রথমবারের মতো পবিত্র নগরী ধরা দেয়, তখন পুরো সেনাবাহিনী ভয়ঙ্কর ভাবাবেশে প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছিল। সৈন্যরা কাঁদল, প্রচণ্ড শব্দে চিৎকার করল। পবিত্র নগরীতে সোনালি ডোম অব দি রককে তাদের পবিত্র নগরীতে রাজকীয় প্রাধান্য বিস্তার করে থাকতে দেখে তারা ক্রোধমিশ্রিত উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। তারপর ক্রুসেডার সেনাবাহিনী জেরুসালেম প্রাচীরের বাইরে অবস্থান নিলো। গেস্তা ফ্রাকোরামের এক অজ্ঞাতনামা লেখক বলেছেন, তারা উল্লাস করছিল, উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। তারা নগরী অবরোধ করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *