১৭. ইসরাইল

১৭. ইসরাইল 

জেরুসালেমের দীর্ঘ ও মর্মান্তিক ইতিহাসে নগরীকে অনেকবার ধ্বংস করা হয়েছে, পুনঃনির্মাণও করা হয়েছে। ব্রিটিশদের আগমনে নগরীটি আরেক দফা পরিবর্তনের বেদনাদায়ক পর্বের মুখে পড়ে। ক্রুসেডার দখলদারিত্বের সংক্ষিপ্ত সময় বাদ দিলে জেরুসালেম প্রায় ১৩ শত বছর ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি নগরী হিসেবে বহাল ছিল। এখন সেই উসমানিয়া সাম্রাজ্য বিজিত হয়েছে, এই অঞ্চলের আরবদেরকে তাদের স্বাধীনতা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। প্রথমে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা নিকট প্রাচ্যে ম্যান্ডেট ও প্রটেকটোরেট প্রতিষ্ঠা করলেও একে একে আরব রাষ্ট্র ও রাজতান্ত্রিক দেশ আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। এগুলো হচ্ছে জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, মিসর ও ইরাক। এ প্রেক্ষাপটে অন্য সব কিছু একই রকমের থাকলে ফিলিস্তিনও স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারত। আর গুরুত্বপূর্ণ নগরী হিসেবে জেরুসালেম হতে পারত এর রাজধানী। কিন্তু তা ঘটেনি। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সময় জায়নবাদীরা নিজেদেরকে দেশটিতে প্রতিষ্ঠা করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। জেরুসালেম ধর্মীয় ও কৌশলগত মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিরাজ করে। এর মালিকানা নিয়ে ইহুদি, আরব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিরোধে লিপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালে ইহুদি সামরিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগই সফল হয়, জেরুসালেম হয় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের রাজধানী। বর্তমান সময়ে জেরুসালেমের আরব বৈশিষ্ট্য হলো অ্যালেনবাই ও তার সৈন্যদের নগরীতে প্রবেশ করার সময়কার ছায়ামাত্র। 

জায়নবাদী বিজয় ছিল একটি নজিরবিহীন পশ্চাদগমন। ১৯১৭ সালে ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার ৯০ ভাগ ছিল আরব, জেরুসালেমের জনসংখ্যার ৫০ ভাগের সামান্য কম ছিল তারা। ইহুদি ও আরবরা অবাক দৃষ্টিতে পেছনের ঘটনার দিকে তাকায়। বিপুল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জায়নবাদীরা তাদের সাফল্যকে প্রায় আশ্চর্য ঘটনা মনে করে; আরবরা তাদের পরাজয়কে বলে আল-নাকবা। এই শব্দটি দিয়ে আসমানি গজবের কাছাকাছি পর্যায়ের কিছু প্রকাশ করতে চায় তারা। সংগ্রামের লিখিত ভাষ্যের ব্যাপারে উভয় পক্ষের অতি সরলিকরণ বিস্ময়কর কিছু নয়। তারা একে নায়ক আর খলনায়ক হিসেবে বর্ণনা করে, সম্পূর্ণ ভালো আর মন্দ হিসেবে বিবেচনা করে, আল্লাহ ইচ্ছা বা আসমানি গজব হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা ছিল অনেক বেশি জটিল। মূলত জায়নবাদী নেতাদের দক্ষতা ও সম্পদের মাধ্যমেই ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে। তারা প্রথমে ব্রিটিশ ও পরে আমেরিকান সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এসব নেতা কূটনৈতিক-প্রক্রিয়ার ধূর্ত-চালবাজি বুঝতে পেরেছিলেন। যখন কোনো পরাশক্তি তাদেরকে কিছু দিতে চাইত, প্রায় সবসময়ই তারা তা গ্রহণ করতেন, এমনকি তা যদি তাদের চাহিদা বা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কমও হতো। তবে শেষ পর্যন্ত তারা সবকিছুই পেত। জায়নবাদীরা তাদের নিজস্ব আন্দোলনের মধ্যে থাকা আদর্শগত বিভক্তিও উত্রাতে সক্ষম হয়। আরবরা ততটা সৌভাগ্যবান ছিল না। উসমানিয়া সাম্রাজ্যের হঠাৎ করে দুঃখজনক পতন ও ব্রিটিশদের আগমনে বিচলিত ফিলিস্তিনি আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বাস্তব রাজনৈতিক যৌক্তিকতা ও অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারেনি। অথচ একদিকে ইউরোপিয়ান ও অন্য দিকে জায়নবাদীদের মোকাবিলা করার জন্য এর দরকার ছিল খুবই বেশি। তারা প্রবল টেকসই প্রতিরোধ গড়তে পারেনি, আবার পাশ্চাত্য কূটনীতির পদ্ধতিগুলোতেও অভ্যস্ত ছিল না। তারা অব্যাহতভাবে তাদেরকে দেওয়া যেকোনো প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করত এই আশায় যে প্রত্যাখ্যানের দৃঢ় ও আপসহীন নীতি জনসংখ্যাগত ও ঐতিহাসিকভাবে তাদের অধিকার বলে মনে হওয়া এলাকায় স্বাধীন আরব রাষ্ট্রের নিশ্চিত অধিকার পেয়ে যাবে। শুরুতে তারা বোকার মতো মনে করেছিল যে তাদের প্রতি ব্রিটিশদের কল্যাণকর উদ্দেশ্য রয়েছে। তাদের বারবারের ভেটোর ফলে তারা শেষ পর্যন্ত কিছুই পায়নি এবং ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর গৃহহীন, সমূলে উচ্ছেদ ও অধিকারহারা ফিলিস্তিনিদের স্থলাভিষিক্ত হয় অধিকারহারা, সমূলে উচ্ছেদ ও ভাসমান ইহুদিরা। 

ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সময় জেরুসালেম মন্থর ও বেদনাদায়ক এমন এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় যা একে আরব নগরী থেকে ইহুদি প্রাধান্যপূর্ণ নগরীতে পরিণত করে। 

ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ও নীতিও ছিল বিভ্রান্তিকর ও সন্দেহজনক। উভয় পক্ষের কাছেই ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যে পূরণের সাথে কাজ করা কঠিন বলে মনে হয়। মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার আরব ও ইহুদি উভয়কেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ১৯১৫ সালে তুর্কিদের বিরুদ্ধে হিজজের আরবদের বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত করতে মিসরের হাইকমিশনার স্যার হেনরি ম্যাকমোহন মক্কার শরিফ হোসাইন ইবনে আলীকে প্রতিশ্রুতি দেন যে আরব দেশগুলোর ভবিষ্যত স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেবে ব্রিটেন। এর ফলে পবিত্র স্থানগুলো একটি ‘স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রের অধীনে থাকবে। ফিলিস্তিন বা ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান জেরুসালেমের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। ম্যাকমোহনের প্রতিশ্রুতি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুস্বাক্ষর করা চুক্তি ছিল না, বরং এতে চুক্তির তাৎপর্য ছিল। ১৯১৬ সালে হোসাইন যখন টি ই লরেন্সের সহায়তায় আরব বিদ্রোহের ঝান্ডা উড়ালেন, তখন তেমনই মনে হয়েছিল। ম্যাকমোহনের এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা করার সময়ই ব্রিটেন ও ফ্রান্স গোপন সাইকিস-পিকট চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা বলছিল, যাতে উপদ্বীপের উত্তরে পুরো আরব বিশ্বকে ব্রিটিশ ও ফরাসি জোনে ভাগ করার কথা ছিল। 

তারপর অ্যালেনবাইয়ের জেরুসালেম জয়ের ঠিক এক মাস পর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ তার পররাষ্ট্রসচিব আর্থার বেলফোরকে নির্দেশ দেন এই ঘোষণা-সংবলিত একটি চিঠি লিখতে লর্ড রথচাইল্ডকে : 

মহাহান্য সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য জাতীয় আবাসভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। আর এই লক্ষ্য হাসিলে সরকার সর্বাত্মক প্রয়াস চালাবে। তবে এটিও স্পষ্টভাবে মনে রাখতে হবে যে ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়গুলোর বেসামরিক ও ধর্মীয় অধিকারগুলো কিংবা অন্য কোনো দেশের ইহুদিদের ভোগ করা অধিকার ও রাজনৈতিক মর্যাদা সংস্কারে কিছু করা হবে না। 

.

ব্রিটেন দীর্ঘ দিন ফিলিস্তিনে ইহুদিদের ফেরানোর কল্পনা লালন করেছে। ১৯১৭ সালে বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে তাদের কৌশলগত বিবেচনাগুলোও হয়তো কাজ করেছে। কৃতজ্ঞ ইহুদিদের ব্রিটিশ প্রটেক্টরেট হয়তো ওই অঞ্চলে ফরাসি উচ্চাভিলাষকে প্রতিরোধ করবে বলে মনে করা হয়েছিল। তবে বেলফোর তার সরকারের দেওয়া অত্যন্ত সঙ্ঘাতপূর্ণ প্রতিশ্রুতিগুলোর ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। ১৯১৯ সালের আগস্টে এক স্মারকে তিনি উল্লেখ করেন যে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জনগণের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে নিকট প্রাচ্যে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে ফিলিস্তিনে ‘আমরা দেশটির বর্তমান অধিবাসীদের ইচ্ছার আলোকে কোনো কিছু করার প্রস্তাব করছি না।’ 

জায়নবাদের প্রতি চারটি পরাশক্তি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর প্রাচীন ওই ভূমিতে বর্তমানে বসবাসরত সাত লাখ আরবের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও পছন্দ-অপছন্দের চেয়ে ভুল হোক বা ঠিক হোক, ভালো হোক বা মন্দ হোক, জায়নবাদ দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য বর্তমানের জন্য প্রয়োজনীয় ও ভবিষ্যতের জন্য ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনায় শিকড় গেড়ে রয়েছে। 

অবাক করা উদাসিন্যে বেলফোর সমাপ্তি টানলেন যে ‘ফিলিস্তিন সম্পর্কে বলা যায়, শক্তিগুলো এমন কোনো বক্তব্য দেয়নি, যা স্পষ্টভাবেই ভুল। লঙ্ঘন করা হতে পারে- এমন কোনো উদ্দেশ্যে তারা কোনো ধরনের বক্তব্য দেয়নি। ২ প্রশাসনের করা পরিষ্কার, সুস্পষ্ট বক্তব্যে এটি অর্থহীন কথা ছিল না। 

ফিলিস্তিন ও জেরুসালেম ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২০ সালের জুলাই পর্যন্ত ছিল ব্রিটিশ সামরিক নিয়ন্ত্রণে (অধিকৃত শত্রু এলাকার প্রশাসন)। সামরিক গভর্নর ছিলেন লে. কর্নেল রোন্যাল্ড স্টরস। তিনি ১৯১৬ সালের আরব বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার প্রথম কর্তব্য ছিল নগরীতে যুদ্ধে বিধ্বস্ত এলাকা মেরামত করা। পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছিল, পরিষ্কার পানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না, রাস্তাগুলো আর চলাচল উপযোগী ছিল না। ব্রিটিশরা পবিত্র স্থানগুলোর পরিচালনার দায়দায়িত্ব নিয়ে অনেক বেশি আচ্ছন্ন ছিল। আর ভদ্র, মার্জিত ব্যক্তিত্ব স্টোর্স জেরুসালেমকে ভালোবাসতেন। তিনি ঐতিহাসিক স্থানগুলো সুরক্ষা করতে প্রো-জেরুসালেম সোসাইটি গঠন করেন তিন ধর্মের ধর্মীয় লোক ও স্থানীয় অভিজাত ব্যক্তিদের নিয়ে। এই সংস্থা সরকারি ভবন ও স্মৃতিসৌধগুলো মেরামত ও সংস্কারের কাজ সম্পাদন করত। বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে নগর পরিকল্পনা করা ও প্রাচীন স্থানগুলো সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদেরকে। এই সংস্থার গ্রহণ করা একটি অন্যতম কার্যকর সিদ্ধান্ত ছিল নগরীতে সব নতুন ভবনে অবশ্যই স্থানীয় হলুদাভ পাথর ব্যবহার করতে হবে। এই নির্দেশ এখনো অনুসরণ করা হয়। এটি জেরুসালেমের সৌন্দর্য সংরক্ষণে সহায়ক হয়। 

অবশ্য উত্তেজনাও ছিল। বেলফোর ঘোষণা সম্পর্কে আরবদের আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করা হয়নি। তবে খবরটি ফাঁস হয়ে যায়। খবরটি তাদের কাছে বিস্ময়কর না হলেও সন্দেহজনক ও আতঙ্কমূলক ছিল। তারা লক্ষ করেছে যে সরকারি নোটিশগুলোতে ইংরেজি ও আরবি ভাষার পাশাপাশি হিব্রু ভাষাও চালু করা হয়েছে। এছাড়া প্রশাসনে ইহুদি আমলা ও অনুবাদকও নিয়োগ করা হয়েছে। তবে তারা তখনো আশা করছিল, ব্রিটিশরা তাদের স্বার্থের প্রতি ন্যায়বিচার করবে। স্টোর্সের ১৯১৮ সালে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলে অন্তত তারা নিশ্চিত প্রাধান্য ধরে রেখেছিল। এতে ছয় সদস্যের মধ্যে প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দুজন করে ছিলেন। তবে মেয়র ছিলেন মুসলিম। স্টোর্স মেয়র পদে নিয়োগ দেন মুসা কাসিম আল-হোসাইনিকে। তার এখন দুজন সহকারী : একজন ইহুদি, অপরজন খ্রিস্টান। এই ব্যবস্থায় ইহুদিরা পুরোপুরি খুশি ছিল না। কারণ তারা এখন নগরীর জনসংখ্যার প্রায় ৫০ ভাগ। আরব মেয়ররা পদটিকে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে বেলফোর ঘোষণার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন বলে মনে হওয়াতেও তারা ক্ষুব্ধ হয়েছিল। 

বিদেশ থেকেও বৈরী বার্তা আসত। বর্তমানে ব্রিটিশদের জয় করা জেরুসালেম নিয়ে ভ্যাটিকান তার উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, এটি খ্রিস্টানদের হাতেই থাকা উচিত। খ্রিস্টান ধর্মের বেশির ভাগ পবিত্র উপাসনালয় যদি অ-খ্রিস্টানদের হাতে দেওয়া হয়, তবে তা হবে’ মর্মান্তিক ব্যাপার। নবগঠিত জাতিপুঞ্জের ১৯১৯ সালে কিং-ক্রেন প্রতিবেদনে উপসংহার টানে যে বেলফোর ঘোষণা বাস্তবায়ন করা উচিত নয়। এর বদলে ফিলিস্তিনের উচিত হবে সাময়িক কর্তৃত্ব লাভ করে সংযুক্ত আরব রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে সিরিয়ার সাথে যোগ দেওয়া। এই প্রতিবেদন কোনো কাজে আসেনি। এটি যখন বিবেচনার সময় এসেছিল, তখন প্রেসিডেন্ট উইলসনের মনোযোগ ছিল অন্যত্র, এটি শেলফে তুলে রাখা হয়েছিল। 

নগরীতে ১৯২০ সালের ৪ এপ্রিল নবী মুসা উৎসবের সময় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এই অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিল মামলুকেরা। ওই সময় জেরুসালেম পাশ্চাত্য ক্রুসেডারদের হুমকির মুখে ছিল। নতুন ক্রুসেডার অ্যালেনবাই নগরীতে আসার পর থেকে ফিলিস্তিনের আরবরা মনে করতে থাকল যে আল-কুদস আবার বিপদের মুখে। আরববিশ্বে ক্রুসেডারদের নিয়ে নতুন করে আগ্রহের সৃষ্টি হলো। কুর্দি সালাহউদ্দিন এখন আরব নায়ক বনে গেলেন। আর জায়নবাদীদের নতুন ক্রুসেডার কিংবা অন্তত ক্রুসেডে নিয়োজিত পাশ্চাত্যের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হতে লাগল। নবী মুসা শোভাযাত্রা সবসময়ই প্রতীকভাবে পবিত্র নগরীর নিয়ন্ত্রণ লাভ বলে গণ্য হতো। কিন্তু এবার মুসলিম জনতা প্রথা ভেঙে ইহুদি মহল্লার মধ্য দিয়ে ছুটে গেল। আরব পুলিশ বাহিনী দাঙ্গাকারীর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে, সহিংসতা শান্ত করতে ব্রিটিশ সৈন্যরা এলো না। ইহুদিরা তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করার কথা ভুলে গিয়েছিল। হতাহতদের বেশির ভাগই ছিল ইহুদি। ৯ জন নিহত ও ২৪৪ জন আহত হয়েছিল। জেরুসালেমে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও মাঝে মাঝে সহিংসতা ছিল। কিন্তু ১৯২০ সালের দাঙ্গা দেখাল যে পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে। এই ঘটনা ইহুদি ও ব্রিটিশদের মধ্যেও ফাটল সৃষ্টি করল। জায়নবাদীরা সাথে সাথে এই নির্যাতনের জন্য স্টোর্স ও প্রশাসনকে দায়ী করল। তাদের মতে, তারা আরবদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেছে। এর পর থেকে ইহুদি ও আরব উভয় পক্ষই ‘অন্য দলের পক্ষাবলম্বনের জন্য ব্রিটিশদের দায়ী করতে থাকে। 

বস্তুত, ব্রিটিশনীতির মধ্যেই সঙ্ঘাতের সহজাত উপাদান ছিল। ১৯২০ সালের এপ্রিলে নিয়োগ পাওয়া ফিলিস্তিনে ম্যান্ডেটরি শক্তিতে পরিণত হয় ব্রিটেন। জাতিপুঞ্জের ধারা ২২-এ জোর দিয়ে বলা হয়েছিল যে ব্রিটেন ‘সভ্যতার পবিত্র আমানতের আকারে [ফিলিস্তিনি জনগণের] কল্যাণ ও উন্নয়নের নীতিমালা’ প্রয়োগ করবে। তবে ব্রিটিশরা বেলফোর ঘোষণাও বাস্তবায়ন করছিল, ফিলিস্তিনে ইহুদি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার পথও তৈরি করছিল। এই কাজ করার জন্য ও সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়নে (ধারা ৪) সরকারি সংস্থা হিসেবে একটি জিউশ এজেন্সিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এজেন্সির আরেকটি দায়িত্ব ছিল ‘ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনি নাগরিকত্ব পাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করা (ধারা ৬) ও ‘যথাযথ শর্তে ইহুদি অভিবাসনের ব্যবস্থা করা (ধারা ৭)। এসব পদক্ষেপ কি ফিলিস্তিনে ‘অইহুদি সম্প্রদায়গুলোর অধিকারের ওপর কোনো আঘাত সৃষ্টির বিপদ ছিল না? 

ফিলিস্তিনে প্রথম বেসামরিক হাই কমিশনার হিসেবে ১৯২০ সালের জুলাই মাসে নিয়োগপ্রাপ্ত স্যার হারবার্ট স্যামুয়েল ছিলেন ইহুদি। এটি জায়নবাদীদের জন্য আশার নিদর্শন হলেও আরবদের কাছে ছিল অলুক্ষুণে বার্তা। স্যামুয়েল ছিলেন বেলফোর ঘোষণার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে তিনি দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছর কালে আরবদের জোরালোভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তাদেরকে বলেন, তাদের ভূমি কখনো তাদের কাছ থেকে নেওয়া হবে না এবং কোনো ইহুদি সরকার কখনো মুসলিম ও খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠদের শাসন করবে না। এমন কিছু করা ‘বেলফোর ঘোষণার অর্থ নয়।’ তবে এসব আশ্বাস আরবদের ভয় প্রশমিত করতে পারেনি, তারা ইহুদিবৈরী হয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশ সচিব উইস্টন চার্চিলের ১৯২২ সালের শ্বেতপত্রে একই যুক্তি অবতারণা করা হয় : আরব সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কোনোভাবেই দমন করা হবে না। বেলফোর ঘোষণার ধারণাটি ছিল স্রেফ (সার্বিকভাবে নয়) ফিলিস্তিনের ভেতরে একটি কেন্দ্র সৃষ্টি করা, যেখানে ইহুদিরা কোনো দুর্ভোগ পোহানো ছাড়াই বাঁচতে পারবে। আবারো বলা যায়, কোনো পক্ষই খুশি হয়নি। আরবরা শ্বেতপত্র প্রত্যাখ্যান করে, অবশ্য পরে বেশি কিছু পাওয়া যাবে, এই আশায় ইহুদিবাদিরা তা গ্রহণ করে। 

অবশ্য যেভাবেই হোক না কেন, ম্যান্ডেটের অধীনে জেরুসালেম সমৃদ্ধ হচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল। ক্রুসেডের পর প্রথমবারের মতো এটি ছিল ফিলিস্তিনের রাজধানী নগরী। ১৯২০-এর দশকে ইংল্যান্ডের মতো নতুন উদ্যান উপশহর গড়ে ওঠতে থাকে। এগুলো ছিল জেরুসালেমের আশপাশে মিউনিসিপ্যাল এলাকার বাইরে। তালপিয়ত, রেহাভিয়া, বায়িত বেগান, কিরয়াত মোশে ও বেইত হাকেরেম ছিল ইহুদি এলাকা। এসব এলাকায় পার্ক, খোলা জায়গা ও ব্যক্তিগত উদ্যান ছিল। এগুলো পুরনো নগরীর পশ্চিমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পুরনো নগরী প্রাচীরের পশ্চিমে একটি নতুন বাণিজ্যিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। গ্রিক অর্থোডক্স প্যাট্রিয়াচেটের কাছ থেকে এই জমি কেনা হয়েছিল : এর প্রধান রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছিল ইতিহাসবিদ ইলিজার বেন-ইয়েহুদার নামে। তিনি আধুনিক, কথ্য ভাষা হিসেবে হিব্রুর ব্যবহার পুনর্জীবন করেন। একটি দ্বিতীয় বাণিজ্যিক সেন্টারের কাজও শুরু হয় মাহানেহ ইয়েহুদা মার্কেটে। এছাড়া তালবিয়া, কাতামন ও বাকা ও সেইসাথে শেখ জারা ও ওয়াদি আল-যশে অভিজাত আরব এলাকা ছিল। আর ছিল আমেরিকান কলোনি। জেরুসালেমের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস ছিল মাউন্ট স্কপাসে হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন। বেলফোর এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন। এটি ছিল ফিলিস্তিনে তার প্রথম ও একমাত্র সফর। অনুষ্ঠানজুড়ে তার চিবুক বেয়ে প্রকাশ্যেই গড়িয়ে চোখের পানি ঝরছিল। তবে মনে হয় তিনি লক্ষ করেননি যে জেরুসালেমের রাস্তাগুলোতে আরবরা ধর্মঘট পালন করছে, নীরবে প্রতিবাদ করছে। তারা সুকে শোক প্রকাশের কালো পতাকাও উড়িয়েছিল। 

জেরুসালেমে নতুন নতুন নেতার উদয় হয়েছিল। স্যামুয়েলের প্রথম নিয়োগগুলোর একটি ছিল মুফতি হিসেবে হাজি আমিন-আল হোসাইনিকে নিয়োগ। এটি জায়নবাদীদের আতঙ্কিত করেছিল। কারণ হোসাইনি ছিলেন চরমপন্থী আরব জাতীয়তাবাদী। তিনি ১৯২০ সালের দাঙ্গায় নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন। স্যামুয়েল সম্ভবত আশা করেছিলেন, হাজি আমিনকে কো-অপ্ট করার মাধ্যমে তাকে প্রশমিত করতে পারবেন। অবশ্য বেশির ভাগ ব্রিটিশের মতো তিনিও এই তরুণে সত্যিকার অর্থেই অভিভূত হয়েছিলেন। বিনয়ী, স্বল্পবাক, মর্যাদাসম্পন্ন এই নতুন মুফতিকে ক্রোধ-সঞ্চারকারী বলে মনে হতো না। পরের বছর তিনি সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিলের সভাপতি নিযুক্ত হন। এই নতুন সংস্থাটিকে গঠন করা হয়েছিল ফিলিস্তিনে ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকি করার জন্য। তিনি এটিকেই ভিত্তি বানিয়ে বেলফোর ঘোষণার বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত হলেন। তিনি হারামে একটি নির্মাণ ও সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিলেন। এর মানে হলো, তাকে বিপুল মাত্রায় প্রপাগান্ডা কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে। জায়নবাদীরাও তাদের টেম্পল পুনঃনির্মাণের স্বপ্ন দেখছে বলে মুফতি দাবি করলেন। তিনি আরো জানালেন, এতে হারামের ওপর থাকা মুসলিম ইবাদতগাহগুলো অনিবার্যভাবেই বিপদে পড়বে। এসব অভিযোগ জায়নবাদী নেতাদের কাছে কল্পনাবিলাস বলে মনে হলো। তাদের বেশির ভাগই টেম্পলের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ ছিল না, তারা ওয়েস্টার্ন ওয়ালের দিকেও তেমন যেত না। তবে এখন আমরা যা দেখছি, তাতে করে বলা যায়, হোসাইনির ভয় একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না। 

হোসাইনির নিয়োগের ফলে জেরুসালেমের আরবেরা পরস্পর বিপরীত অবস্থান নিয়ে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পরে। চরমপন্থীরা মুফতির দিকে ঝোঁকে, উদারপন্থীরা নতুন মেয়ার রাগিব আল-নাশাশিবির সাথে যোগ দেয়। এই মেয়র জায়নবাদের বিরোধিতা করলেও যখনই সম্ভব কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতা করার নীতিতে বিশ্বাস করতেন। স্যামুয়েল দৃশ্যত স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত ছিলেন যে জেরুসালেম ব্যাপকভাবে ইসলামি নগরী। মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল সম্প্রসারিত করা হয়, এখন এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল চারজন মুসলিম, তিনজন খ্রিস্টান ও তিনজন ইহুদি সদস্য। মেয়র অব্যাহতভাবে মুসলিম রয়ে গেছেন। তবে ইহুদিরা যাতে বেশি করে ভোট দিতে পারে, সেজন্য ভোটাধিকার সম্প্রসারিত করেন স্যামুয়েল। উভয় পক্ষের কাছে নিরপেক্ষ থাকায় হাই কমিমনার কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারেননি। ফিলিস্তিন ও জেরুসালেম নিয়ে জায়নবাদী ও আরবদের পারস্পরিকভাবে বর্জনশীল পরিকল্পনা থাকায় সঙ্ঘাত হয়ে পড়ে অনিবার্য। 

জায়নবাদীদের স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিজস্ব নায়ক ও পথপ্রদর্শক ছিল। ফিলিস্তিনিদের তাদের সংগ্রামে ইন্ধন দিতে নতুন করে কোনো পুরানতত্ত্ব ও মতাদর্শ সৃষ্টির প্রয়োজন পড়েনি। ফিলিস্তিন ছিল তাদের বাড়ি, তারা আল-কুদসে শত শত বছর ধরে বাস করছিল, এর পবিত্রতা উদযাপন করছিল। তাদের ভূমি ও নগরী সম্পর্কে বইপত্র লেখার কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না তাদের : প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে কোনো লোকের কি আবেগময় কবিতা লেখার দরকার পড়ে? তবে ফিলিস্তিনকে নিজেদের সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য জায়নবাদীদেরকে বইপত্র লিখতে হয়েছিল। তারা অচেনা, বৈরী বিশ্বে তাদের নিজেদের একটি স্থান খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় দেশটিতে এসেছিল। আলিয়া অবশ্য প্রায়ই যন্ত্রণাদায়ক হতো, বেদনাপূর্ণ অভিজ্ঞতা দিত। নতুন পথিকৃতদের বেশির ভাগই ১৯২০-এর দশকে দেশটি ত্যাগ করে : জীবন ছিল কঠিন, দেশটি ছিল অদ্ভূত। এটি তাদের দেশের মতো লাগেনি। ভূমিটির সাথে আধ্যাত্মিকভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করার জন্য তাদের দরকার ছিল যুক্তিনির্ভর মতাদর্শেরও বেশি কিছুর। তারা তাদের মতাদর্শগুলোকে সহজাতভাবেই কাব্বালার পুরনো আধ্যাত্মিক ভূগোলের দিকে চালিত করে। সূচনায় সেক্যুলার থাকা একটি আন্দোলন আধ্যাত্মিক মাত্ৰা নেয়। 

এই জায়নবাদী কাব্বালাহর মুখ্য নায়কেরা জেরুসালেমে বাস করতেন না, পবিত্র নগরীকেন্দ্রিকও ছিলেন না তারা। রাশিয়ায় কাব্বালার সূচনাকারী এ ডি গর্ডন আলিয়া করেছিলেন তুলনামূলক তারুণ্যে, ৪৬ বছর বয়সে। ডেদানিয়ার তার কিবুজে তরুণ পথিকৃতদের সাথে মাঠে মাঠে কাজ করতেন তার সাদা দাড়ি দুলিয়ে। তার কাছে ফিলিস্তিনে অভিবান ছিল খুবই কঠিন : তিনি রাশিয়ার জন্য খুবই গৃহকাতরতা অনুভব করতেন। তার কাছে ফিলিস্তিনের নিকটপ্রাচ্যের ভূ- প্রকৃতি অচেনা মনে হয়েছিল। তিনি মাটিতে কাজ করার সময় যে অবস্থায় পড়তেন বলে বলতেন, আগেকার সময়ে সেটিকেই বলা হতো শেখিনার প্রকাশ। তার মনে হতো যে তিনি জেরুসালেমের ঈশ্বরের সংস্পর্শকে প্রায়শই ফুটিয়ে তোলা সেই আদি সামগ্রিকতায় ফিরে গেছেন। গ্যালিলিতে গর্ডন সেই সংস্পর্শ পেয়েছিলেন। প্রবাসে ইহুদিদেরকে যন্ত্রণাদায়ক ও অপ্রাকৃত জীবন কাটাতে হয়েছিল। গর্ডন তার কবিতা ও বক্তৃতায় তরুণ পথিকৃতদের শিক্ষা দিতেন। ভূমিহীন ও মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা ঘেটৌর নাগরিক জীবনে নিজেদেরকে অনিবার্যভাবে অপরিণত করে ফেলেছে। তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা নিজেদেরকে ঈশ্বর ও নিজেদের- উভয় থেকেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। জুদা হ্যালেভির মতো গর্ডনও বিশ্বাস করতেন যে ইসরাইল ভূমি (ইরেজট ইসরায়েল) ছিল অনন্যভাবে ইহুদি চেতনার সৃষ্টি। তাদের কাছে ঐশী স্বচ্ছতা, অসীমতা ও জ্যেতি প্রকাশ করে। এটিই তাদেরকে সত্যিকারের স্বকীয় করে তোলে। এই সত্তার উৎস থেকে আলাদা হওয়ার কারণেই তারা ক্ষতিগ্রস্ত ও টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। এখন ভূমির বিপুল পবিত্রতায় অবগাহন করে তাদের কর্তৃব্য হয়ে দাঁড়াল একেবারে নতুন হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলা। গর্ডন লিখেছেন, ‘আমাদের প্রত্যেকেরই প্রয়োজন হয়ে পড়ল নতুন করে সাজিয়ে নেওয়ার। ফলে অপ্রাকৃতিক, ত্রুটিপূর্ণ ও দলছুট ব্যক্তিকে নিজেকেই বদলে প্রাকৃতিক, সামগ্রিক মানবে পরিণত হওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ল, যে নিজের কাছে সত্যে পরিণত হবে।’ তবে গর্ডনের আধ্যাত্মিকতার মধ্যে আগ্রাসনের ইঙ্গিত ছিল : ইহুদিদেরকে অবশ্যই তার ভাষায় শ্রমের মাধ্যমে জয় করা ভূটিতে তাদের দাবি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শারীরিক কষ্টে নিজেদের নিয়োজিত করবে ইহুদিরা। ফিলিস্তিনের পবিত্রতায় সাড়া দিয়ে তারা এর সত্যিকারের মালিক হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। 

নেগেভের এসব জায়নবাদী বসতি স্থাপনকারীদের প্রথম কাজ ছিল ১৯৪৬ সালে তাদের প্রতিষ্ঠিত নতুন কিবুজের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া তোলা। ইহুদিদের জন্য ‘লেবার জায়নবাদ’ ইতিবাচক ছিল। এদের সমাজবাদী মূল্যবোধ সত্ত্বেও তারা ফিলিস্তিনের থেকে আবর জনসাধারণকে বাদ দিয়েছিল। এমনকি এ ডি গর্ডনও আরবদেরকে ‘চরম নোংরা’, ‘ফালতু’, ও ‘ঘৃণ্য’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। 

প্রাচীন কালে থেকে ইহুদিরা জেরুসালেমে তাদের টেম্পলের আদি সম্প্রীতিতে একইভাবে ফিরে যেতে চাইত। কিন্তু গর্ডন জায়নবাদীদের শিক্ষা দিলেন যে শেখিনাকে আর মাউন্ট জায়নে পাওয়া যাবে না, বরং তাকে পাওয়া যাবে গ্যালিলির মাঠে-ময়দানে আর পাহাড়-পর্বতে। প্রাচীনকালে অ্যাডোদার অর্থ ছিল টেম্পলের উপাসনা। কিন্তু গর্ডনের কাছে অ্যাভোদার অর্থ হলো কায়িক শ্রম। অবশ্য অল্পসংখ্যক জায়নবাদী টেম্পল মাউন্টে অবিলম্বে প্রত্যাবর্তন প্রত্যাশা করছিল। লেবার জায়নবাদের সেক্যুলার নেতাদের মাধ্যমে কোণঠাসা ও উপহাসাম্পদের শিকার হওয়া ধর্মীয় জায়নবাদীরা একটি গ্রুপ গঠন করেছিলেন। তারা একে বলতেন ‘মিজরাচি’। তারা অধিকতর সনাতন ধারণায় জেরুসালেমকে বিশ্বের কেন্দ্ৰ মনে করতেন। তাদের নেতা ছিলেন রাব্বি আব্রাহাম আইজ্যাক কুক। তিনি ১৯২১ সালে জেরুসালেমের অ্যাশকেনাজিমের প্রধান রাব্বি হন। বেশির ভাগ অর্থোডক্স ইহুদি পুরো জায়নবাদী উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করলেও কুক আন্দোলনকে সমর্থন করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে না-বুঝেই সেক্যুলার জায়নবাদীরা ঈশ্বরের রাজ্য গঠনে সহায়তা করছে। ভূমিতে ফেরা অনিবার্যভাবেই তাদেরকে তাওরাতে প্রত্যাবর্তনের দিকে চালিত করবে। কাব্বালিস্টবাদী কুক বিশ্বাস করতেন যে ইহুদিরা যখন ফিলিস্তিন থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, তখন সমগ্র বিশ্বের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ঐশী সত্তা অ-ইহুদি বিশ্বের পাপাচারে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রবাসের সিনাগগ ও ইয়েশিবাগুলোতে লুকিয়ে ছিল। এখন পুরো বিশ্বকে পরিত্রাণ করা হবে : বিশ্বের সব সভ্যতা আমাদের চেতনার রেনেসাঁসে নতুন করে জাগবে। সব বিবাদের অবসান ঘটবে, আমাদের পুনর্জাগরণের ফলে নতুন জন্মের আনন্দে সকল জীবন আলোকিত হবে।’ বস্তুত পরিত্রাণ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। কুক ইতোমধ্যেই তার মনের চোখে দেখতে পেয়েছিলেন যে পুনঃনির্মিত টেম্পল বিশ্বের কাছে ঐশী সত্তাকে প্রকাশ করছে : 

এখানে টেম্পল তার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সব মানুষ আর রাজ্যের সম্মান ও গৌরব নিয়ে। এবং এখানে আমরা আমাদের সামনে আনন্দ-ভূমির বয়ে আনা ফসল আনন্দচিত্তে গ্রহণ করি, এই আনন্দ-ভূমির শস্য ও মদে পরিপূর্ণ আমাদের মদ্য প্রস্তুত করার যন্ত্রের চমৎকারিত্বে আমাদের হৃদয় খুশি হয় এবং এখানে আমাদের আগে আবির্ভূত হয়েছিলেন টেম্পলের প্রভু, ইসরাইলের ঈশ্বরের পুরোহিত, পবিত্র-মানব ও দাসেরা। 

.

এটি সুদূরের কোনো স্বপ্ন ছিল না : ‘আমরা অদূর ভবিষ্যতেই প্রভুর পর্বতের ওপর তাদেরকে আবার দেখতে পাব, এবং প্রভুর এসব পুরোহিতকে এবং তাদের পবিত্র উপাসনা দেখে এবং তাদের চমৎকার সঙ্গীত শুনে আমাদের হৃদয় ফুলে ওঠবে। অবশ্য জেরুসালেমের ফিলিস্তিনি মুসলিমদের মধ্যে বিপুল আনন্দ বয়ে আনার কোনো স্বপ্নাবিভাব ছিল না। রাব্বি কুক তার জীবদ্দশায় পাগলাটে ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কেবল আমাদের সময়েই তার ধারণাগুলো কার্যকারিতাসহ পূর্ণ স্বীকৃতি পেয়েছে। 

হার্বার্ট স্যামুয়েলের উত্তরসূরি হিসেবে নিযুক্ত হন লর্ড প্লামার, ১৯২৫ সালে। তার আমলে ফিলিস্তিন ছিল আপত দৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ। ইহুদি সম্প্রদায় বা ইউশুব ম্যান্ডেটের অধীনে একটি সমান্তরাল রাষ্ট্র নির্মাণে ব্যস্ত ছিল। তার ছিল নিজস্ব সেনাবাহিনী (হাগানা), কিবুতজিম ও বাণিজ্যিক ইউনিয়নগুলোর (হিসতাদরুথ) সমন্বয়ে একটি পার্লামেন্টারি সংস্থাও ছিল। তাদের নিজস্ব করব্যবস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপারি অনেক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও দাতব্য সংস্থাও ছিল। জিওশ এজেন্সি (পশ্চিম জেরুসালেমের রেহাভিয়ায় ছিল এর সদরদফতর) ব্রিটিশ সরকারের কাছে ইউশুভের আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থায় পরিণত হয়েছিল। আরবরা ছিল অনেক কম সংগঠিত। জায়নবাদের বিরোধিতা প্রশ্নে হোসাইনি ও নাশাশিবি উপদলের উত্তেজনায় তারা বিভক্ত ছিল। অবশ্য জায়নবাদী-আরব সঙ্ঘাতের উভয় পক্ষেই চরমপন্থীরা ক্রমাগত গুরুত্ব পাচ্ছিল। তারা আর বর্তমান অবস্থাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না। চরমপন্থী জায়নবাদীরা ভ্লাদিমির জ্যাকোতিনস্কির আদর্শে আকৃষ্ট হয়েছিল। আর মুফতি তার অনুসারীদেরকে ব্রিটিশদের সাথে সহযোগিতা বন্ধ করতে আহ্বান জানাচ্ছিলেন। 

সঙ্ঘাতটি উভয় জনগোষ্ঠীর গভীরতম আকাঙ্ক্ষার প্রতীক বিবেচিত নগরী জেরুসালেমে নতুন ও মর্মান্তিক অধ্যায়ের সৃষ্টি করে। ব্রিটিশদের আগমনের পর থেকে আরবেরা ওয়েস্টার্ন ওয়ালের প্রতি ইহুদিদের ভক্তিতে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেছিল। ঊনিশ শতকে মন্টেফিওর ও রথচাইল্ড উভয়ে প্রার্থনার এলাকাটি কেনার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯১৮ সাল থেকে মুসলিমেরা লক্ষ্য করেছিল যে ইহুদিরা তাদের উপাসনাকালে চেয়ার, বেঞ্চ, পর্দা, টেবিল ও স্কুলসহ বেশি বেশি আসবাবপত্র নিয়ে আসছে। মনে হতে থাকে উসমানিয়া আমলের স্থিতিবস্থার যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেটি লঙ্ঘন করে তারা সেখানে একটি সিনাগগ নির্মাণ করতে যাচ্ছে। মুফতি তার অনুসারীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, জায়নবাদীরা হারামের নিয়ন্ত্রণ লাভ করার পরিকল্পনা করছে। তিনি প্রাচীরে ইহুদিদের এসব কার্যক্রমকে বড় ধরনের উদ্যোগের আগে ছোট পরিবর্তন হিসেবে অভিহিত করেন। গোলযোগ ঘটে ১৯২৮ সালের যম কিপুরের প্রাক্কালে। জেরুসালেমের জেলা কমিশনার অ্যাডওয়ার্ড কি রোচ পুলিশপ্রধান ডগলাস ডাফকে নিয়ে পুরনো নগরীতে হাঁটছিলেন। তানজিকিয়া মাদরাসায় মুসলিম শরিয়াহ কোর্টে তাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারা নিচে ইহুদি উপাসনা অনুষ্ঠানের দিকে তাকালে রোচ লক্ষ করেন যে প্রার্থনার সময় নারী ও পুরুষদের আলাদা করার জন্য একটি বেডরুমের পর্দা ব্যবহার করা হয়েছে। কক্ষে থাকা মুসলিম আলেমরা এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন, রোচ তাদের সাথে একমত হয়ে বলেন যে এটি স্থিতিবস্থার লঙ্ঘন। পর দিন ছিল যম কিপুর। পর্দা সরিয়ে ফেলার জন্য পুলিশ পাঠানো হয়। তারা উপস্থিত হয়েছিল উপাসনার সবচেয়ে ভাবগম্ভীর সময়ে। এ সময় নীরব উপাসনায় নিশ্চল অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল উপাসনাকারীরা। উপাসনা শেষ হয়ে হওয়ার সাথে সাথেই সংবেদনহীনভাবে পুলিশ পর্দা সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করে। স্পষ্টভাবে অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করায় ইহুদিরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ফিলিস্তিনজুড়ে ইউশুভ ক্রুদ্ধভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঈশ্বর অবমাননার অভিযোগ আনে। 

মুফতি এখন নতুন প্রচারণা শুরু করলেন। তিনি জোর দিয়ে বলতে থাকেন যে স্থিতিবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে হবে। প্রাচীরটি হারামের অংশ, এটি ইসলামি ওয়াকফের সম্পত্তি। এটি সেই স্থান যেখানে মুহাম্মদ (সা.) নৈশ সফরে বোরাককে বেঁধেছিলেন। ইহুদিদের উচিত হবে না আসবাবপত্র এনে কিংবা সোফার বাজিয়ে হারামে মুসলিমদের নামাজে বিঘ্ন ঘটিয়ে স্থানটিকে তাদের সম্পত্তি বিবেচনা করার মতো আচরণ করা। তারা ছিল যন্ত্রণাদগ্ধ। মুফতি ভক্তিকেন্দ্রিক আক্রমণও শুরু করেন। কাছেই ছিল একটি সুফি খানকাহ। হঠাৎ করেই জিকিরের শব্দ খুবই বেড়ে গেল, আর তা বিশৃঙ্খল বলে মনে হলো। প্রাচীরে ইহুদিরা যখন উপাসনা করত, ঠিক তখনই মোয়াজ্জিনেরা আজান দিতে লাগলেন। সবশেষে সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল উপাসনা স্থানটির উত্তর দিকের প্রাচীর খুলে দিলো যাতে ওই রাস্তাটির অস্তিত্ব আর না বোঝা যায়। এতে করে পুরোটিই হারামের প্রান্ত দেশের সাথে মাগরিবি এলাকাকে সংযুক্ত হয়ে যায়। আরবরা ইহুদিদের উপাসনার সময় সেখান দিয়ে পশু নিয়ে যেত, সাবাতের সময় দেখিয়ে দেখিয়ে সিগারেট ধরাত। স্বাভাবিকভাবেই ইউশুভের, সেক্যুলার ও ধর্মীয়- সব ইহুদিই, বিশেষ করে ব্রিটিশেরা এই নীতিগর্হিত কাজগুলোকে অনুমোদন করায় অব্যাহতভাবে ক্রুদ্ধ ও অসন্তুষ্ট হচ্ছিল। 

জুরিখে ১৯২৯ সালের গ্রীস্মে হয় ১৬তম জায়নবাদী সম্মেলন। প্রথম দিনে জ্যাবোটিনস্কি জ্বালাময়ী বক্তৃতায় জর্ডানের উভয় তীরে ইহুদি রাষ্ট্র (হোমল্যান্ড নয়) প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। সম্মেলনে উদারপন্থী জায়নবাদীদের মাধ্যমে তার প্রস্তাবটি বড় ব্যবধানে বাতিল হয়ে যায়। তবে আরবেরা এই ঘটনায় অত্যন্ত সতর্ক হয়ে যায়। তারপর এভের নবম দিনে (১৫ আগস্ট) জ্যাবোটিনস্কির তরুণ শিষ্যদের একটি গ্রুপ জেরুসালেমে ম্যান্ডেটরি অফিসের বাইরে বিক্ষোভ করে। তারপর তারা ওয়েস্টার্ন ওয়ালে গিয়ে ইহুদি জাতীয় পতাকা দোলায়, মৃত্যু পর্যন্ত তারা প্রাচীরটি রক্ষা করার সংকল্প ব্যক্ত করে। উভয় পক্ষে উত্তেজনা বাড়ে। পর দিন জুমার নামাজের সময় আরবরা হারামে সমবেত হতে শুরু করে। মুফতির কয়েকজন সমর্থক প্রাচীরে ইহুদি উপাসনালয়ের দিকে ছুটল। এবার পুলিশ দাঙ্গা দমন করে। তবে পরে একটি মর্মান্তিক ঘটনা বড় ধরনের সঙ্ঘাতের সূচনা করে। এক ইহুদি বালকের বল আরবদের একটি বাগানে পড়েছিল। এ নিয়ে দস্তাদস্তির একপর্যায়ে ছেলেটি মারা যায়। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় জায়নবাদীরা ক্রুদ্ধভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ২২ ও ২৩ আগস্ট ফিলিস্তিনি কৃষকেরা লাঠি ও ছুরি নিয়ে জেরুসালেমে আসে। কারো কারো কাছে আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত ছিল। ক্রোধ প্রশমিত করতে মুফতি কিছুই করলেন না। ওই শুক্রবারের জুমার খুতবায় আসলে উস্কানিমূলক কিছু বলেননি। কিন্তু তবুও নামাজের পর উত্তেজিত জনতা হারাম থেকে ছুটে গিয়ে সামনে যে ইহুদিই পড়েছে, তাকেই আক্রমণ করেছে। আবারো এ ধরনের ঘটনায় প্রতিশোধ নেওয়ার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। লর্ড প্লামার ব্রিটিশ পুলিশ সদস্য কমিয়ে দিয়েছিলেন। তারা এখন এই সঙ্কট যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে পারছিল না। পুরো ফিলিস্তিনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আগস্ট মাসের শেষ নাগাদ ১৩৩ জন ইহুদি নিহত ও ৩৩৯ জন আহত হয়। ব্রিটিশ পুলিশ ১১০ আরবকে হত্যা করে। তেল আবিবের কাছে ইহুদি পাল্টা হামলায় নিহত হয় আরো ছয় আরব। 

জেরুসালেমের গ্র্যান্ড মুফতি হাজি আমিন আল-হোসাইনকে (মাঝে), দেখা যাচ্ছে আরব লিগের সদস্যদের সাথে। জায়নবাদের বিরোধিতায় তিনি ছিলেন আপসহীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের সাথে দেখা করে তিনি শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলেন বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করে। 

ওয়েস্টার্ন ওয়ালের দাঙ্গা অনিবার্যভাবে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। আপতভাবে প্রাচীরের যুদ্ধে আরবেরা জয়ী হয়। ঘটনা তদন্তে গঠিত শ কমিশন উসমানিয়া আমলের স্থিতিবস্থা ব্যবস্থা বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে। ইহুদিরা উপাসনার সাথে সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম আনতে পারবে, তবে স্ক্রল, মেনেরারা ও আর্ক কোনোভাবেই সেখানে আনতে পারবে না। প্রাচীর এলাকায় সোফার বাজানো যাবে না, কোনো সঙ্গীত চলবে না। মুসলিমদেরও উচ্চস্বরে জিকির করতে মানা করা হয়, তাদের পশুগুলো ইহুদি উপাসনার সময় সেখান দিয়ে পারাপারের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবে এটি ছিল ফাঁকা বিজয়। হিটলার ক্ষমতায় এলে জায়নবাদ আরো চরম, মরিয়া সংগ্রামে পরিণত হয়। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হারে জার্মানি ও পোল্যান্ড থেকে উদ্বাস্তুরা আসতে থাকে। জায়নবাদীদের পুরনো ধীরে চলার নীতি এখন আর চলনসই রইল না। আর ইউশুভে না হলেও পরবাসী ইহুদিরা হঠাৎ করে আরো বেশি হারে জ্যাবোটিনস্কির রিভিশনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে থাকে। চরমপন্থী ইহুদি গ্রুপগুলো (তাদের অনেকে রাব্বি কুকের কাজে উদ্দীপ্ত হয়েছিল) আরো বেশি চরমপন্থী হয়ে ওঠে, জঙ্গি সংগঠন গড়ে তুলতে থাকে। তারা বেন গুরিয়ানের সমাজবাদী আদর্শের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায়নি। তাদের নায়ক ছিলেন যশুয়া ও রাজা দাউদ। কারণ এ দুজন বলপ্রয়োগে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসব ডানপন্থী গ্রুপের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইরগুন ভেই লিউমি। তখনো ফিলিস্তিনে ইউশুভদের মাত্র ১০ থেকে ১৫ ভাগ ইহুদি সত্যিকার অর্থে ডানপন্থীদের দিকে ঝুঁকেছিল। বেন গুরিয়ান অব্যাহতভাবে সংযত থাকার নীতি অবলম্বনের তাগিদ দিতে থাকেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, হিটলারের সেমিটিকবিরোধী উন্মাদগ্রস্ত নীতি জায়নবাদী স্বার্থের জন্য অনুকূলই হবে। 

ইহুদি অভিবাসন ১৯৩০-এর দশকে বাড়ায় আরবরা চরমভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা অভিযোগ করতে থাকে যে জায়নবাদীরা তাদের স্বার্থ পূরণ করার লক্ষ্যে জার্মান বিপদকে ব্যবহার করছে। তারা প্রশ্ন করতে থাকে, ইউরোপের সেমিটিকবিরোধী অপরাধের কারণে তাদের দেশ কেন দুর্ভোগ পোহাবে? এটি ছিল পুরোপুরি যৌক্তিক ও জবাব-অযোগ্য প্রশ্ন। আরবদের উদ্বেগ বোধগম্য ছিল। ১৯৩৩ সালে ইহুদিরা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৮.৯ ভাগ, ১৯৩৬ সালে তারা বেড়ে হয় ২৭.৭ ভাগ। আরবরা আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি মনে করতে থাকে। আরব শিবিরে এখন আরো চরমপন্থী দলের উদ্ভব ঘটতে থাকে। অবশ্য এই পর্যায় পর্যন্ত আরব শিবিরের নিয়ন্ত্রণ ছিল অভিজাতদের হাতে। এসব দলের মধ্যে ছিল ডিফেন্স পার্টি, রিফর্ম পার্টি, প্যান-আরব ইস্তিকবাল। ফিলিস্তিনিদের অনেকে ব্রিটিশ ও জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গেরিলা সংগঠনগুলোতে যোগ দিতে শুরু করে। ১৯৩৫ সালের নভেম্বরে শেখ আল- কাসামের গেরিলারা জেনিনের কাছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়। এ সময় শেখ নিহত হন। তিনি ফিলিস্তিনের অন্যতম প্রথম শহিদ হন। ১৯৩৬ সালে মুফতির সভাপতিত্বে জেরুসালেমে আরব হায়ার কমিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে নতুন দলগুলোর নেতারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। ফলে উভয় পক্ষই আরো চরমপন্থী পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছিল। জায়নবাদী ও আরবরা চূড়ান্ত সঙ্ঘাতের জন্য নিজেদের সশস্ত্র করছিল। 

নগরীতে উত্তেজনা বাড়ার মধ্যেই জেরুসালেমের সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন অব্যাহত থাকে। প্রাচীরের বাইরে কিং ডেভিড হোটেলের মতো বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক, বিশালাকার ওয়াইএমসিএ ভবন, ডাকঘর ও রকফেলার মিউজিয়ামের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। জেরুসালেম দ্রুততার সাথে মেট্রোপলিটান এলাকা ছাড়িয়ে বহু দূর পর্যন্ত দ্রুত বিস্তৃত হতে থাকে। ব্রিটিশরা তাই ব্যাপকভিত্তিক জেরুসালেম উপ- বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। এতে পুরনো নগরী ঘিরে নতুন নতুন ইহুদি ও আরব উপশহর গড়ে ওঠতে থাকে। ফিলিস্তিনে ইহুদিরা যেমন ঢলের মতো আসতে থাকে, একইভাবে জেরুসালেমে আরব জনসংখ্যাও বাড়তে থাকে। মিউনিসিপ্যাল এলাকার মধ্যে ইহুদিরা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্তমানে এক লাখ ইহুদির বিপরীতে মুসলিম ও খ্রিস্টানের সংখ্যা ৬০ হাজার। তবে উপ-জেলায় আরবরা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের কিছু বেশি ছিল, তারা ৮০ ভাগ সম্পত্তির মালিক। বিশেষ করে পশ্চিম জেরুসালেমে বড় আকারের মধ্যবিত্ত আরব উপশহর গড়ে ওঠতে থাকে। এছাড়া কাতামন, মুসরারাহ, তালবিয়া, আপার ও লোহার বাকা, গ্রিক ও জার্মান কলোনি, শেখ জারা, আবু তোর, মামিলা, নবি দাউদ ও শেখ বদর ছিল মূল্যবান আরব রিয়েল এস্টেট। (দেখুন মানচিত্র।) এসব আরব এলাকার কোনো কোনোটি ছিল পশ্চিম জেরুসালেমে। বর্তমানে এগুলো ইহুদি প্রাধান্যপূর্ণ এলাকা। 

এরপর ১৯৩৬ সালের সাধারণ ধর্মঘটের সময় স্পষ্ট আইন অমান্য আন্দোলনকালে আরব অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। তারপর ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঘটে আরব বিদ্রোহ। এতে জেরুসালেম ব্যাপকভাবে ঝামেলায় পড়ে। আরব বিক্ষোভকারীরা ক্রুদ্ধভাবে বিক্ষোভ করে। ইহুদিদের একটি ধর্মীয় স্কুলে একটি বোমা ফেলা হলে ৯ শিশু মারা যায়, আরো কিছু সন্ত্রাসী হামলায় ৪৬ জন ইহুদি মারা যায়। ১৯৩৮ সালের একপর্যায়ে ফিলিস্তিনি বিদ্রোহীরা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য নগরী দখল করে নিয়েছিল। এই সঙ্কটকালে জায়নবাদী নেতারা সংযত থাকার আহ্বান জানালেও ইরগুন বোমা নিক্ষেপ ও সন্ত্রাসী হামলা চালাতে থাকে। এতে ৪৮ জন আরব প্রাণ হারায়। বিদ্রোহের সময় জায়নবাদী প্রতিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে জেরুসালেম তার স্থান হারায়। মুফতি ও আরব হায়ার কমিটিকে ব্রিটিশরা নগরীছাড়া করে। মুফতি বাইরে গিয়ে হিটলারের সাথে মিত্রতা স্থাপন করলে ফিলিস্তিনি স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। ফিলিস্তিনে নেতৃত্ব চলে যায় গ্রামীণ শেখদের হাতে। তারা আরো নির্মম পদ্ধতি প্রয়োগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। 

Romema 

Givat Shad 

Hakerin 

সহিংসা বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশেরা ফিলিস্তিন প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করতে থাকে। ১৯৩৭ সালে পিল কমিটি দেশটিকে ভাগ করার করার সুপারিশ করে। গ্যালিলি ও উপকূলীয় সমতলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র হবে, আর নেগেভসহ বাকি ভূখণ্ড আরবদের হাতে থাকা উচিত বলে কমিটি অভিমত প্রকাশ করে। কমিশনারেরা আরো সিদ্ধান্ত নেন যে জেরুসালেম ও এর উপ-বিভাগগুলো ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের স্থায়ী নিয়ন্ত্রণে একটি করপাস সেপারেটাম (আন্তর্জাতিক তদারকির আওতায়) হিসেবে থাকবে। এর পর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ফিলিস্তিন বিভক্তির বেশির ভাগ পরিকল্পনায় জেরুসালেমকে সঙ্ঘাতের বাইরে রাখার চেষ্টা করে এমনটা নিশ্চিত করতে যে পবিত্র স্থানগুলোতে (এগুলো সভ্যতার ‘ঐশী আমানত’- পিল কমিশনাররা এভাবে অভিহিত করেছিলেন) সবার প্রবেশাধিকার থাকবে।১১ জায়নবাদীরা প্রচণ্ড বিতর্কের পর পিল পরিকল্পনা গ্রহণ করে, অবশ্য তারা তাদের বিভক্তির নিজস্ব পরিকল্পনাও পেশ করেছিল। এই জায়নবাদী পরিকল্পনায় জেরুসালেম বিভক্ত করার কথা ছিল : ইহুদিরা পাবে পশ্চিম জেরুসালেমের নতুন এলাকাগুলো, আর পুরনো নগরী ও পূর্ব জেরুসালেম থাকবে ম্যান্ডেটরি নিয়ন্ত্রণে। 

পিল পরিকল্পনার প্রতি আরবেরা সম্মতি দেয়নি। ১৯৩৯ সালে তাদের দৃঢ় অবস্থানের সুফল পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে থাকা ব্রিটিশ সরকারকে বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্র জায়নবাদের প্রতি তার সমর্থন হ্রাস করার অনুরোধ করে। নতুন একটি শ্বেতপত্রে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসন ব্যাপকভাবে সীমিত করা ও পিল বিভক্তি পরিকল্পনা বাতিল করার কথা বলা হয়। এর বদলে আরব ও ইহুদি উভয়ের যৌথভাবে শাসন করা হবে এমন একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সৃষ্টির রূপরেখা দেওয়া হয়। জায়নবাদীদের জন্য এটি ছিল মারাত্মক আঘাত। তারা আর কখনো ব্রিটেনকে বিশ্বাস করতে পারেনি, এমনকি যদিও যুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রিটেনকে সমর্থন করা ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। অবশ্য এটি রিভিশনিস্টদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা বাড়িয়ে দেয়। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত আব্রাহাম স্টার্নের লেহি গ্রুপ ব্রিটিশ ও নাৎসিদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেনি। পরবর্তীকালে শীর্ষস্থানীয় দুই ইহুদি সন্ত্রাসী ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিল। ১৯৪২ সালের এক অভিযানে স্টার্ন নিহত হলে আইজ্যাক শামির হন ‘স্টার্ন গ্যাঙের’ নেতা। জ্যাবোটিনস্কির উচ্ছ্বসিত প্রশংসাকারী মেনাচেম বেগিন ১৯৪২ সালে অবৈধভাবে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে ইরগুনের অন্যতম নেতা হন। এমনকি উদার বেন গুরিয়ান পর্যন্ত ১৯৪২ সালে আরো চরমপন্থী হয়ে যান। ইউশুভের পুরনো ধীরে চলা নীতি পরিত্যক্ত হলো। ‘আবাসভূমির’ আলোচনা আর ছিল না। জায়নবাদীরা মনে করেছিল যে একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ইহুদি রাষ্ট্রই ইহুদিদের জন্য নিরাপদ স্বর্গের ব্যবস্থা করতে পারে, এমনকি এর অর্থ যদি হয় আরবদেরকে দেশ থেকে উচ্ছেদ করাও। ১২ 

যুদ্ধপরবর্তী অধ্যায়ে উভয় পক্ষে সন্ত্রাস বাড়ে। নাৎসি ক্যাম্প থেকে বেঁচে যাওয়া এক লাখ উদ্বাস্তুকে ফিলিস্তিনে প্রবেশের সুযোগ দিতে জায়নবাদীদের অনুরোধ একগুঁয়েভাবে প্রত্যাখ্যান করে ব্রিটিশরা। এর বদলা নিতে কিং ডেভিড হোটেলের একটি অংশ উড়িয়ে দেয় ইরগুন। এর একটি ফ্লোর ব্যবহার করত ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। এতে ৯১ জন নিহত ও ৪৫ জন আহহ হয়। এই শেষ বছরগুলোতে ব্রিটিশরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে বলে মনে হতে থাকে। ম্যান্ডেট নিয়ে বিভ্রান্তি শুরু হয়। অসম্ভব একটি নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে গিয়ে ১৯৪৭ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা মনোবল ও ধৈর্য হারিয়ে ফেলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা দেশটির জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয়। তাদের চলে যাওয়ার সুযোগ খোঁজা উচিত বলে মনে হতে থাকে। ১৯৪৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রসচিব আরনেস্ট বেভিন ম্যান্ডেটটিকে সদ্য গঠিত জাতিসঙ্ঘে পাঠিয়ে দেন। জাতিসঙ্ঘ তখন নতুন বিভক্তি পরিকল্পনা প্রস্তুত করে। এতে দেশটিকে এমনভাবে ভাগ করা হয়, যাতে পিল পরিকল্পনার চেয়ে ইহুদিরা বেশি সুবিধা পেয়ে যায়। পূর্ব গ্যালিলি, আপার জর্ডান ভ্যালি, নেগেভ, উপকূলীয় সমভূমি নিয়ে একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও বাকি অংশ নিয়ে একটি আরব রাষ্ট্রের প্রস্তাব করা হয়। জেরুসালেম ও বেথলেমেহের করপাস সেপারেটাম থাকবে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদ এই পরিকল্পনা গ্রহণ করে জেরুসালেমের আন্তর্জাতিক জোনের মর্যাদা নির্ধারণের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। আরবেরা জাতিসঙ্ঘের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকার করে, জায়নবাদীরা তাদের স্বাভাবিক বাস্তবতাবোধের আলোকে তা গ্রহণ করে। তারা জেরুসালেমের আন্তর্জাতিকীকরণকেও গ্রহণ করে নেয়। ১৯৪৬ সালের আগস্টে জাতিসঙ্ঘে উত্থাপিত ওই প্রস্তাবটিতে জেরুসালেমকে আবারো করপাস সেপারেটামে রাখার কথা বলা হয়। এই পর্যায়ে পবিত্র নগরীর মালিকানা নতুন ইহুদি রাষ্ট্রের কাছে অপরিহার্য বিবেচিত হয়নি। 

জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাবটি পাস হওয়ার প্রায় সাথে সাথে ফিলিস্তিনে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ২ ডিসেম্বর উত্তেজিত আরব জনতা জাফা গেট দিয়ে ঢুকে বেন ইয়েহুদা স্ট্রিটের ইহুদি বাণিজ্যিক কেন্দ্র লুট করে। এর বদলা নিতে ইরগুন কাটামন ও শেখ জারার আরব উপশহরগুলোতে হামলা চালায়। ১৯৪৮ সালের মার্চের মধ্যে জেরুসালেমের আশপাশের লড়াইয়ে ৭০ জন ইহুদি ও ২৩০ জন আরব নিহত হয়। তখনো ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অবসান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটেনি। সিরিয়া ও ইরাকি সৈন্যরা দেশটিতে প্রবেশ করে জেরুসালেমগামী রাস্তাগুলো অবরোধ করে। হাগানা সামরিক ‘প্লান দালেট’ বাস্তবায়ন শুরু করে। এটি শেষ পর্যন্ত জেরুসালেম থেকে উপকূল পর্যন্ত একটি করিডর সৃষ্টি করতে সফল হয়। ব্রিটিশরা এতে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরবেরা পশ্চিম জেরুসালেমে ইহুদি উপশহরগুলো অবরোধ করেছিল। হাগানা ওই রাস্তাগুলো খুলে দেওয়ার আগে পর্যন্ত দেশের বাকি অংশ থেকে উপশহরগুলো বিচ্ছিন্ন থাকে। ১০ এপ্রিল যুদ্ধ নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে। এসময় ইরগুন জেরুসালেম থেকে তিন মাইল পশ্চিমে অবস্থিত দির ইয়াসিনে আরব গ্রামগুলোতে হামলা চালায়। এতে ২৫০ জন পুরুষ, নারী ও শিশু নিহত হয়। লাশগুলো বিকৃত করা হয়। ১৩ এপ্রিল ইরগুন সন্ত্রাসীদের বহন করা বহরে হামলা চালায় আরবেরা। এসব সন্ত্রাসী দির ইয়াসিনে আহত হয়েছিল। তাদেরকে মাউন্ট স্কপাস মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এই হামলায় ৪০ নির্দোষ ইহুদি মেডিক্যাল স্টাফ নিহত হয়। 

ব্রিটিশেরা ১৯৪৮ সালের ১৫ মে চলে যাওয়ার আগে ইরগুন জাফায় হামলা চালায়, আর দির ইয়াসিনের ভীতির কারণে ৭০ হাজার নগরী ৭০ হাজার আরব অধিবাসী পালিয়ে যায়। এটি ফিলিস্তিনিদের তাদের বাড়িঘর ত্যাগ করার এক্সডসের সূচনা করে। কোনো কোনো উদ্বাস্তু জেরুসালেমে একটি নিরাপদ স্থান কামনা করেছিল। ২৬ এপ্রিল হাগানা পশ্চিম জেরুসালেমের বিশাল মধ্যবিত্ত আরব শহরতলীগুলোতে হামলা চালায়। হানাদার দলগুলো টেলিফোন ও বিদ্যুৎ লাইন কেটে ফেলে। ভ্যানে রাখা লাউডস্পিকারে রাস্তায় রাস্তায় প্রচণ্ড শব্দে বলা হতে থাকে, ‘বাড়িঘর ত্যাগ না করলে তোমাদেরকেও দির ইয়াসিনের ভাগ্য বরণ করতে হবে!’ অধিবাসীরা শেষ পর্যন্ত মে মাসের শেষ নাগাদ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায়। তাদের অনেকে পুরনো নগরীতে আশ্রয় নেয়। মে মাসের প্রথম দিকে জাতিসঙ্ঘ প্রতিনিধিরা আন্তর্জাতিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জেরুসালেমে আসে। কিন্তু ব্রিটিশ ও সেইসাথে বিবদমান পক্ষগুলোও তাদের অগ্রাহ্য করে। ১৪ মে বেন- গুরিয়ান নতুন ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ঘোষণা করতে তেল আবিবে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পর দিন ব্রিটিশরা যখন শেষ পর্যন্ত নগরী ত্যাগ করে, ইহুদি বাহিনী পুরনো নগরীতে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তবে জর্দানি আরব বাহিনী শেষ মুহূর্তে এসে গেলে তারা ওই আক্রমণটি চালায়নি। এই বাহিনী প্রাচীরঘেরা নগরী ও পূর্ব জেরুসালেমে একটি সামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে। 

জাতিসঙ্ঘ ১৯৪৮ সালের জুলাই মসে একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি চুক্তির ব্যবস্থা করার সময় নগরীটি ইসরাইল ও জর্দানের মধ্যে ভাগ করা ছিল। পুরনো নগরীর পশ্চিম প্রাচীরজুড়ে নগরীটি দুই ভাগে বিভক্ত থাকে, বিধ্বস্ত-জনশূন্য এলাকাটি নো ম্যান্স ল্যান্ড হিসেবে থাকে। (মানচিত্র দেখুন।) জিউশ কোয়ার্টারের দুই হাজার বাসিন্দাকে পুরনো নগরী থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারা পশ্চিম জেরুসালেমের নতুন সীমান্তের ওপরে বর্তমানে ইসরাইল-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম জেরুসালেমের ৩০ হাজার আরব বাসিন্দা ইসরাইল রাষ্ট্রে তাদের বাড়িঘর হারায়। পুরনো নগরী এখন জাফা, হাইফা, শহরতলী ও জেরুসালেমের আশপাশের গ্রামগুলোর তখন উদ্বান্তে ঠাসা। ইসরাইল বা জর্দানের কেউই জেরুসালেম এলাকা ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী রেজুসালেমকে আন্তর্জাতিকভাবে করপাস সেপারেটামে পরিণত করার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে জেরুসালেম ও এর আশপাশের এলাকা থেকে সরে যাওয়া-সংক্রান্ত জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব ৩০৩-এর প্রতি কর্ণপাত করতে অস্বীকার করে তারা। ১৫ নভেম্বর জর্দানের রাজা আবদুল্লাহকে কপ্টিক বিশপ পুরনো নগরীতে জেরুসালেমের রাজা হিসেবে মুকুট পরিয়ে দেন। পূর্ব জেরুসালেম ও জর্দানের পশ্চিম তীর জর্দানের ভূখণ্ড ঘোষিত হলো। ১৩ ডিসেম্বর জর্দানের পার্লামেন্ট জর্দান ও ফিলিস্তিনের ইউনিয়নকে অনুমোদন করে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করার মতো কেউ ছিল না। 

এর বদলে রাজা পূর্ব জেরুসালেম ও পশ্চিম তীরের অধিবাসীদের জর্দানের নাগরিকত্ব দেন। এই জর্দানি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো জোরালো প্রতিবাদ জানালেও শেষ পর্যন্ত হয়েই যখন গেছে, তখন আর কিছু করার নেই বিবেচনায় তারা তা মেনে নেয়। ইসরাইলি পক্ষ থেকে বেন-গুরিয়ান ১৩ ডিসেম্বর ঘোষণা করেন যে প্রতিরক্ষা, পুলিশ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়া নেসেট ও সব সরকারি অফিস পশ্চিম জেরুসালেমে সরে যাবে। ১৯৪৯ সালের ১৬ মার্চ দুই দেশের মধ্যকার বৈধ সীমান্ত হিসেবে অস্ত্রবিরতি রেখাকে স্বীকার করে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে ইসরাইল ও জর্দান। জাতিসঙ্ঘ জেরুসালেমে ইসরাইলি/জর্দানি দখলদারিত্বকে অবৈধ বিবেচনা করা অব্যাহত রাখলেও ১৯৫০ সালের এপ্রিলের পর জেরুসালেম প্রশ্নে আর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। 

অভ্যন্তরীণভাবে অসংখ্যবার ভাগ হওয়া জেরুসালেম এখন দেড় মাইলের বেশি দুর্ভেদ্য সীমান্ত, কাঁটাতারের বেড়া ও বিশাল প্রতিরক্ষা প্রাচীর দিয়ে বিভক্ত। উভয় পক্ষের স্নাইপাররা নো ম্যান্স ল্যান্ডের অপর পাড়ের ভূখণ্ডে গুলি ছুড়ছিল। নো ম্যান্সল্যান্ডের মধ্যেও ছিল অনেক রাস্তা ও ১৫০টি পরিত্যক্ত ভবন। পুরনো নগরীর তিনটি গেট (নিউ গেট, জাফা গেট ও জায়ন গেট) বন্ধ করে দিয়ে কংক্রিটের প্রাচীর দিয়ে মজবুত করা হয়। নগরীটি এখন লম্বা প্রতিবন্ধকতায় বিভক্ত, উভয় পক্ষে লাখ লাখ মাইন পোঁতা হয়। একমাত্র ক্রসিং পয়েন্ট ছিল তথাকথিত ম্যান্ডেলবাম গেট। জনৈক ম্যান্ডেলবামের মালিকানাধীন একটি বাড়ির কাছে থাকা একটি খোলা রাস্তায় ছিল এই গেট। একটি প্রতিবন্ধকতা দিয়ে এটি অতিক্রম করতে হতো। কেবলমাত্র ধর্মীয় লোকজন, কূটনীতিক, জাতিসঙ্ঘ প্রতিনিধিদলের সদস্য, কয়েকজন বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত পর্যটককে এক দিক থেকে অপর দিকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো। ইসরাইল থেকে পূর্ব জেরুসালেমে প্রবেশ করার অনুমতি লাভের জন্য বেশির ভাগ পর্যটককে খ্রিস্টান ধর্মের প্রমাণপত্র দেখাতে হতো। তাদেরকে ইসরাইলে ফিরে যেতে দেওয়া হতো না। বরং জর্দান থেকে তাদেরকে তাদের নিজ দেশে ফিরতে হতো। পানি, টেলিফোন ও রাস্তা-ঘাট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। জর্দানি জেরুসালেমে মাউন্ট স্কপাস হয়ে পড়েছিল একটি ইহুদি ছিটমহল। সেখানকার হাদাসা হাসপাতাল ও হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেগুলো জাতিসঙ্ঘের তদারকিতে রাখা হয়েছিল। ছোট স্কপাস গ্যারিসনে সরবরাহ পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিভক্তি রেখা দিয়ে ইসরাইলি একটি বহরকে অনুমতি দেওয়া হতো। ১৯৪৮ সালের আগে শত্রুর মালিকানায় থাকা ভূখণ্ড ও ভবনগুলো উভয় পক্ষেই একজনের জিম্মায় দেওয়া হলো। বিভক্তির অমানবিকতা বিশেষভাবে মর্মভেদী হয়ে ওঠেছিল বায়েত সাফাফা গ্রামে। গ্রামটি দুই ভাগে ভাগ করা হয় : এক ভাগ ছিল ইসরাইলি ভূখণ্ডে, অপর ভাগ জর্দানে। পরিবার ও বন্ধুরা একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। অবশ্য বিয়ে অনুষ্ঠানগুলোতে মাঝে মাঝে লোকজনকে একত্রিত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো। কখনো কোনো উপলক্ষে সীমান্তের রেললাইনের ধারে সমবেত হওয়ার সুযোগও দেওয়া হতো। তারা তখন বিভক্তি রেখার ওপর দিয়ে খবর আর গুজব চিৎকার করে বলত। 

ইসরাইলি-জর্দানি অস্ত্রবিরতি চুক্তির ধারা ৮-এ ওয়েস্টার্ন ওয়ালে ইসরাইলি ইহুদিদের অবাধে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও পশ্চিম জেরুসালেমের আরব উপশহরগুলো ফিরিয়ে দিতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত এই চুক্তি মেনে চলতে অস্বীকার করে। কয়েক বছরের চাপের পর ইসরাইলের আরব খ্রিস্টানদেরকে ক্রিসমাস ও ইস্টারে হলি সেপালচার ও ন্যাটিভিটি চার্চে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে এই অনুমতি ছিল মাত্র ৪৮ ঘণ্টার জন্য। পবিত্র স্থানগুলোর পবিত্রতা লঙ্ঘনের জন্য দুই পক্ষই অপর পক্ষকে অভিযুক্ত করত : মাউন্ট অব অলিভেসে থাকা ইহুদি কবরস্থান ও পুরনো নগরীর জিউশ কোয়ার্টারের সিনাগগগুলো নষ্ট করার জন্য জর্দানকে দায়ী করে ইসরাইলিরা। এসব স্থান এখন ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। আরবেরা তিক্তভাবে অভিযোগ করছিল যে মামিলায় তাদের ঐতিহাসিক কবরস্থানটি ধ্বংস করেছে ইসরাইলিরা। এখানে অনেক বিখ্যাত আলেম, মরমি সাধক ও বীর যোদ্ধার কবর ছিল। 

জর্দানি জেরুসালেম অনেক সমস্যায় জর্জরিত ছিল। ১৩ ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনে ইসরাইলিদের একটি রাষ্ট্র হলো, এটি জাতিসঙ্ঘের রূপরেখায় থাকা এলাকার চেয়ে বড় ছিল। আশপাশের আরব দেশগুলোর মধ্যে কেবল জর্দানই ইসরাইলি বাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিরোধ করতে সক্ষম ছিল। বৈরিতার সময় ফিলিস্তিনের প্রায় সাড়ে সাত লাখ আরব দির ইয়াসিনের খবরে সন্ত্রস্ত্র হয়ে দেশটি ছেড়ে পালিয়েছিল। এসব উদ্বান্তের অনেকে আশপাশের আরব রাষ্ট্রগুলোতে শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের কাউকে তাদের গ্রাম ও শহরে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়নি। অনেক ফিলিস্তিনি তাদেরকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার জন্য জর্দানকে দায়ী করে। মিসরে প্রবাসী সরকার হিসেবে মুফতি ফিলিস্তিন জাতীয় পরিষদ গঠন করেন। বাদশাহ আবদুল্লাহ প্রভাবশালী আরব পরিবারগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করেন। তারা ঐতিহ্যগতভাবে মুফতির বিরোধী ছিল। তাদের অনেকে আম্মানে সরকারি পদ লাভ করে, অনেকে জর্দানি পার্লামেন্টে আসন পর্যন্ত পায়। এর ফলে জেরুসালেম থেকে আসা অনেক অভিজাত পরিবার আম্মানে বসতি স্থাপন করে। এটি নগরীর পরিবেশ বদলে দেয়। জেরুসালেমে রয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের বেশির ভাগই আম্মানের তীব্র বিরোধী ছিল। তারা ছিল তুলনামূলক বেশি শিক্ষিত এবং পূর্ব তীরের বেশির ভাগ আরবের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। তাদের কাছে জর্দানের অনুগত হওয়াটা অসহ্যকর মনে হয়েছে। জর্দান সরকার ঝামেলায় পড়লে প্রায়ই জেরুসালেমে দাঙ্গা হতো। এটি জর্দান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। আল-কুদসের আরবদের কাছে মনে হচ্ছিল যে পুরো বিশ্ব হলি সিটির মালিকানা থেকে তাদের বঞ্চিত করতে চায়। বাদশাহ আবদুল্লাহ এর অবসান চাইলেন। 

আরব জেরুসালেম ১৯৪৮ সালের পর মারাত্মকভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। সে তার আভিজাত্য হারিয়েছিল। বাদশাহ আবদুল্লাহ জেরুসালেমে তার শক্তির ঘাঁটি থাকাটা নিশ্চিত করার জন্য জর্দানের সমর্থক হেবরনের অধিবাসীদের আল-কুদসে বসতি স্থাপন করতে উৎসাহিত করলেন। নগরীতে বিপুল উদ্বাস্তু সমস্যা ছিল। যুদ্ধের সময় এটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জর্দানের সম্পদও সীমিত হয়ে আসছিল। জেরুসালেম এলাকায় বাধ্য হয়ে ভিড় করা বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা লাঘব করার মতো অবস্থা ছিল না জর্দানের। কয়েক মাসের যুদ্ধের ফলে পুরনো নগরীর অবস্থা ভয়াবহ খারাপ হয়ে পড়েছিল। অবশ্য ফিলিস্তিন জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত একটি নগরীতে বিনিয়োগ করার আগ্রহও ছিল না বাদশাহের। প্রায়ই আবদুল্লাহ জেরুসালেমের চেয়ে নাবলুস ও হেবরনকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। সরকারি অফিসগুলো জেরুসালেম থেকে আম্মানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে মুফতির এজেন্টদের হাতে আকসা মসজিদের প্রবেশপথে বাদশাহ নিহত হওয়ার সময় জর্দানি সরকারের সাথে নগরীর সম্পর্ক উন্নতি হয়নি। 

অবশ্য জর্দানি জেরুসালেম সেরে ওঠছিল। ১৯৫৩ সালে আকসা মসজিদ পুনর্গঠন করা হয়, মুসলিম চ্যারিটেবল সোসাইটি ফর দি রিকনস্ট্রাকশন অব জেরুসালেম প্রতিষ্ঠা করা হয় স্কুল, হাসপাতাল ও এতিমখানা স্থাপনের জন্য। ১৯৫০-এর দশকে ওফেল হিল ও ওয়াদি জজ, আবু তর, শেখ জারায় নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়। অবশ্য জর্দানিরা তখনো ম্যান্ডেটের আমলে করা জেরুসালেমের মাস্টার প্লানের প্রতি কঠোরভাবে অনুরক্ত ছিল। নগরীর সৌন্দর্য সংরক্ষণের জন্য তারা মাউন্ট স্কপাসের ঢালে বা কিদরন ভ্যালিতে কোনো নির্মাণকাজ করেনি। পুরনো নগরীর উত্তর ও পূর্ব দিকে একটি নতুন বাণিজ্যিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৫৮ সালে হারামের বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। ধীরে ধীরে অর্থনীতিও বিকশিত হতে থাকে। জেরুসালেম কখনো শিল্পকেন্দ্র ছিল না। সরকার এই এখান থেকে সরে এসে জেরুসালেমের শহরতলী থেকে আম্মান পর্যন্ত পর্যটন শিল্প ও কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তবে জর্দান জেরুসালেমে পর্যটন শিল্প গড়ে তুলেছিল। এটিই পশ্চিম তীরের ৮৫ ভাগ আয়ের ব্যবস্থা করেছিল। ১৯৪৮ সালে পূর্ব জেরুসালেমে মাত্র একটি আধুনিক হোটেল ছিল, ১৯৬৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০-এ। নগরীতে ধনী ও গরিবের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য ছিল। তবে ১৯৬০-এর দশকে আরব জেরুসালেম তার সহিংস বিভক্তি থেকে অনেকাংশে উদ্ধার পেয়ে বসবাসের জন্য মনোরম নগরীতে পরিণত হয়। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি সম্ভবত পশ্চিম জেরুসালেমে তাদের ইসরাইলি প্রতিপক্ষদের চেয়ে অনেক উন্নত জীবনমান উপভোগ করত। অবশ্য আধুনিকায়নের প্রক্রিয়াটি জেরুসালেমের ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী পরিবেশকে ধ্বংস করেনি। নগরীটি তার বিশেষ আরব বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে। 

নগরীর মর্যাদাও উন্নত হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরোধিতা প্রতিরোধ করে ইসরাইলিরা তাদের রাজধানী হিসেবে পশ্চিম জেরুসালেমকে গড়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সেখানেই নেসেট সরিয়ে নেয়। জর্দান মনে করে, তাদেরও জবাব দিতে হবে। ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে জর্দানি মন্ত্রিসভা প্রথমবারের মতো জেরুসালেমে বৈঠক করে। এরপরপরই সেখানে পার্লামেন্টের সভা আহ্বান করা হয়। ১৯৫৭ সালের শুরুতে রাউহি আল-খতিব আরব জেরুসালেমের মেয়র হলে স্থানীয় সরকার অনেকটাই স্থিতিশীলতা অর্জন করে। কঠোর সংযমী ও দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তিনি আম্মান ও ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনার কিছুটা প্রশমিত করতে সক্ষম হন। জর্দানের সাথে সম্পর্ক উন্নত হয়। ১৯৫৯ সালে জেরুসালেমের মর্যাদা বালাদিয়া (মিউনিসিপ্যালটি) থেকে বাড়িয়ে আমানায় (জিম্মাদারি) উন্নীত করা হয়। এর মাধ্যমে এর মর্যাদা আম্মানের সমপর্যায়ের হয়ে যায়। বাদশাহ হোসাইন ঘোষণা করেন যে জেরুসালেম হবে জর্দানের দ্বিতীয় রাজধানী। তিনি নগরীর উত্তরে একটি প্রাসাদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। 

সীমান্তের অপর পাড়ে পশ্চিম জেরুসালেমেও সম্ভবত একই সমস্যা ছিল। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে বেন গুরিয়ান ঘোষণা করেন যে জেরুসালেমে উপস্থিতি বজায় রাখা ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য : 

ইহুদি জেরুসালেম ইসরাইল রাষ্ট্রের মূল ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি ইসরাইলের ইতিহাস, ইসরাইলের বিশ্বাস ও আমাদের জনগণের প্রতিটি আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ। জেরুসালেম হলো ইসরাইল রাষ্ট্রের হৃদয়ের হৃদয়। ১৪ 

যুদ্ধের ভাগ্যে পশ্চিম জেরুসালেম ইসরাইলি হাতে চলে আসায় নগরীর প্রতি পুরনো জায়নবাদী উদাসিনতা উধাও হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫০-এর দশকে ইসরাইলিরা ইসরাইলের সক্রিয় রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নীতির দিকে অগ্রসর হয়, যদিও আন্তর্জাতিক আইনে এমনটি নিষিদ্ধ ছিল। জাতিসঙ্ঘ তখনো জেরুসালেমকে করপাস সেপারেটাম হিসেবে বহাল রাখতে চাইছিল আর ক্যাথলিক দেশগুলো বিশেষভাবে নগরীর বিভক্তির বিরোধিতা করছিল। ১৯৫২ সালে আইজ্যাক বেন-ভি ইসরাইলের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হন। তিনি তার অফিস তেল আবিব থেকে জেরুসালেমে সরিয়ে আনেন। ফলে বিদেশী রাষ্ট্রদূতেরা সমস্যায় পড়ে যান। তারা যদি পশ্চিম জেরুসালেমে প্রেসিডেন্টের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করেন, তবে তা প্রচ্ছন্নভাবে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে নগরীর স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে যায়। কোনো কোনো রাষ্ট্রদূত পশ্চিম জেরুসালেমে আসতে শুরু করে দেন। তারপর ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ ও আমেরিকান রাষ্ট্রদূত দুজন যখন জেরুসালেমে প্রেসিডেন্ট বেন-ভির কাছে তাদের পত্র উপস্থাপন করেন, তখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে ধীরে ধীরে বয়কটের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ে ঘোষণা করে যে তারা জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাবের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখবে। তবে আনুষ্ঠানিক অস্বীকৃতি সত্ত্বেও ইসরাইলিরা প্রথম রাউন্ডে জয়ী হয়। তারপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশে শারেত তার প্রধান অফিস পশ্চিম তীরে সরিয়ে নেন। আর বিদেশী দূতেরাও ধীরে ধীরে সেখানে তার সাথে সাক্ষাত করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ১৯৬৭ সাল নাগাদ প্রায় ৪০ ভাগ বিদেশী কূটনীতিক তেল আবিব থেকে পশ্চিম জেরুসালেমে সরে যায়। 

যদিও পশ্চিম জেরুসালেমকে রাজধানী করতে বিশ্ব বিরোধিতা করছিল, ইসরাইলি সরকার তা অগ্রাহ্য করে চলেছিল। নেসেটের বেশির ভাগ সদস্য ছিল কিতনিক। তারা নগরীগুলোর প্রতি খুব একটা আগ্রহী ছিল না, নগরনীতির ব্যাপারেও তাদের পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল না। রাজধানীর মর্যাদা পাওয়া পশ্চিম জেরুসালেমের যতটুকু উপকৃত হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। সামগ্রিকভাবে ইসরাইলের যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল, তা থেকে অনেক কম ছিল পশ্চিম জেরুসালেমের। প্রধান নিয়োগকারী সরকার ও হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এগুলো সম্পদ-উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ছিল না। আবার পশ্চিম জেরুসালেমে পর্যটনও বিকশিত হয়নি। বেশির ভাগ আকষর্ণীয় স্থান পড়েছিল নো ম্যান্স ল্যান্ডের অপর পাড়ে। এখানে ছোট হালকা শিল্প ছিল, দাম ছিল বেশি। ইহুদি জেরুসালেমের কিছু অংশ ছিল বস্তি। আরব দেশগুলো থেকে আসা ইহুদি উদ্বাস্তুরা এখানে ঠাঁই পেয়েছিল। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টি ও ফিলিস্তিনিদের বহিষ্কার করার পর তাদেরকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এসব প্রাচ্য, সেফারদি ইহুদিদের প্রথম দলটিকে অ্যাশকেনাজি জায়নবাদী এস্টাবলিশমেন্টের কাছে কখনো গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা নো ম্যান্স ল্যান্ডের কাছাকাছি অধিকতর বিপজ্জনক এলাকাগুলোতে বাস করত। তারা ছিল আরব অস্ত্রধারীদের নাগালের মধ্যে। ইহুদি নগরীতে বৈষম্য ও ক্ষোভ ছিল। 

বস্তুত, পশ্চিম জেরুসালেমে না ছিল দৃঢ়তা, না ছিল ঐক্য। এখানে ছিল অনেক উপনগরী, প্রতিটিতে আলাদা আলাদা জাতিগত বা ধর্মীয় গ্রুপ বাস করত। তারা তাদের মতো করে জীবনযাত্রা নির্বাহ করত। এটি নিজের বিরুদ্ধে বিভক্ত নগরীও ছিল : সেফারদিম বনাম অ্যাশকেনাজিম, ধর্মীয় বনাম সেক্যুলার ইহুদি। অর্থোডক্সরা তখনো আবেগপূর্ণভাবে ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরোধী ছিল। সাবাথের বিশ্রামদের নিয়ম লঙ্ঘনকারী ইসরাইলিদের গাড়ির দিকে লক্ষ করে পাথর ছোড়ার জন্য সাবাতের দিনে তারা রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত। পুরনো নগরী কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিম জেরুসালেম অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। এটি অবশিষ্ট ইসরাইল থেকে বিচ্ছিন্ন ও একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে তিন দিক থেকে আরব ভূখণ্ড দিয়ে পরিবেষ্টিত ছিল। উপকূল থেকে আসা রাস্তাগুলোর শেষ প্রান্ত থেকে সামান্য কিছু বেশি ছিল এই নগরী। পরবর্তীকালে মেয়র হওয়া টেডি কলেক বলেছিলেন, এটি ছিল ‘একটি সংকীর্ণ করিডোরের প্রান্তে, রাস্তাগুলোর কোনো গন্তব্য ছিল না। আধা ঘণ্টা ধরে গাড়ি চালাতে এক জায়গায় গিয়ে দেখা যাবে লেখা রয়েছে ‘থামো! বিপদ! সামনে সীমান্ত! ১৬ তিনি তার ক্লাসিক উপন্যাস মাই মাইকেল-এর উপজীব্য এই পর্যায়ের ঘটনাবলী। ইসরাইলি লেখক অ্যামোস ওজও নগরী হিসেবে পুরনো নগরীর একই অবস্থা তুলে ধরেছেন। নগরীটি তখন মৃত্যু-আঘাতে জর্জরিত। এর শহরতলীগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, দুর্গগুলো নির্জন। ভীতিকর স্থানগুলোতে শেয়াল চড়ে বেড়াচ্ছে। এটি ছিল প্রাচীর, ধ্বংস্তুপ আর পতিত জমির নগরী। এই নগরী এখনো ইহুদি অধিবাসীদের জন্য ছিল বন্ধ।’ ওজের নায়িকা হানা জানতে চান, ‘কেউ কি জেরুসালেমে বাড়ি থাকার কথা কখনো ভাবতে পারে, এমনকি সে যদি এখানে এক শ’ বছরও থাকে?’৮। মনে হয় এটি সাধারণ একটি নগরী। কিন্তু একটি কোণের দিকে তাকালে হঠাৎ করে শূন্যের বিপরীতে তাকানো হবে : 

মাথা যে দিকেই ঘোরাবে, দেখবে পাথুরে ভবনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছ। জলপাই গাছ, শুষ্ক প্রান্তর। সীমা ছাড়ানো ঘন উপত্যকা। অগণিত পায়ে মাড়ানো রাস্তার সংযোগস্থলগুলো জীর্ণ হয়ে পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর নব-নির্মিত ভবনটির আশপাশে গবাদি পশু চড়ছে। ১৯ 

প্রাচীন নগরীটি নির্মাণ করা হয়েছিল জীবনযাপনে অসম্ভব বিবেচিত মরুভূমির দানবীয় রাজ্যের বিরুদ্ধে নিরাপদ এলাকা হিসেবে। এখন পশ্চিম জেরুসালেমের নাগরিকেরা সার্বক্ষণিক জনহীন প্রান্তরের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, এই বিপজ্জনক এলাকায় মৃত্যু আর বিলুপ্তির শঙ্কায় থাকত। বস্তুত, খোদ জেরুসালেমই প্রাচীন দুঃস্বপ্ন জনহীন প্রান্তরের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। এটি কোনোমতে টিকে ছিল। হানা বলেছেন, ‘জেরুসালেম বলে কিছু নেই। ২০ 

ইসরাইল রাষ্ট্রটি ব্যর্থ হয়ে যাওয়া ঠেকাতে পারত না। ইহুদিদের বিরুদ্ধে হিটলারের নাৎসি ক্রুসেড যদি না ঘটত, তবে জায়নবাদী উদ্যোগটি সফল হতো না কখনোই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিবিরগুলোতে অপরাধ, দুর্বিসহ অবস্থা ও নিষ্ঠুরতার তথ্য প্রকাশের ফলে ইহুদি জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতির স্রোত বইয়ে দেয়। এটি নিশ্চিতভাবেই ইহুদি স্বার্থের সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু ৬০ লাখ লোকের মৃত্যুজনিত বিপর্যয়ের সাথে কিভাবে ইহুদি জনগোষ্ঠী ও ইসরাইল রাষ্ট্র মানিয়ে নিয়েছিল? পবিত্র নগরীগুলো শুরুতে স্বর্গ বিবেচিত হয়েছিল, যা ধ্বংস থেকে এর অধিবাসীদের সুরক্ষা দিত। এখন ইউরোপের (যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইহুদিদের ভীতিকর মানসে দুঃস্বপ্নে তাড়িত করত) পৈশাচিক কল্পনার মুখোমুখি হয়ে ইহুদিরা বিলুপ্তির শঙ্কায় পড়ে গেল। এক্সডাসের কল্পকথায় প্রাচীন ইসরাইলের লোকজন প্রতিশ্রুত ভূমির নিরাপত্তা লাভের জন্য প্রাচীন ইসরাইলের লোকজন মরুভূমির শূন্যতা দিয়ে তাদের সফরের কথা স্মরণ করেছিল। শিবিরগুলোতে ভয়ঙ্করভাবে নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকেই আধুনিক ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল। তবে পশ্চিম জেরুসালেমে নগরীর মধ্যেই মরুভূমির ভয়াবহ শূন্যতা দেখা যেত : হলুকাস্টের নিয়তি এড়ানোর কোনো উপায় ছিল না। জায়নবাদী নেতারা মোটামুটিভাবে পোল্যান্ড, রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ থেকে এসেছিলেন। তারা প্রায় মৃতে পরিণত হওয়া ইহুদিদের জন্য তাদের রাষ্ট্র নির্মাণ করেছিলেন। এই নতুন সেক্যুলার ইহুদি জেরুসালেমের অন্যতম উপাসনার স্থান ছিল ইয়াদ ভাশেমের হলুকাস্ট মেমেরিয়াল। এর ওহেল আইজকোরে (‘মেমোরিয়াল তাবেরনাকল’) ২১টি বৃহত্তম মৃত্যু শিবিরের নাম খোদাই করা ছিল। ইসরাইলিদের সৃষ্ট নতুন জেরুসালেমের যে কোনো অর্থই ছিল না, তাতে অবাক হওয়ার মতো কিছু আছে সামান্যই। শেষ পর্যন্ত আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে দেখতে পাব যে অনেক ইহুদি ঐশী স্থানের পুরনো কল্পকথা ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে শান্তি খুঁজে পেয়েছিল। 

অবশ্য ফিলিস্তিনিরাও দুর্ভোগে ছিল। তারা তাদের আবাসভূমি হারিয়েছে, মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। তারাও এক ধরনের নিশ্চিহ্ন হওয়ার মতো অবস্থায় পড়েছে। জেরুসালেম বিভক্তির এসব বছরে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় জেরুসালেমের অধিবাসীরা ছিল সবচেয়ে কষ্টে। ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের বিপর্যয়কে মেনে নিতে হয়েছিল আর ইসরাইলিরা এই অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার মুখে পড়েছিল যে ইউরোপের নির্মমতার শিকার হয়ে তারা টিকে থাকার মরিয়া চেষ্টায় অন্য জনগোষ্ঠীকে ভয়াবহভাবে আঘাত করেছিল। অন্যকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছিল উভয়েই। আরব পর্যটন মানচিত্রগুলোতে পশ্চিম জেরুসালেমকে ফাঁকা সাদা স্থান হিসেবে দেখানো হতো। ইসরাইলে প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মায়ার একটি কথা বিখ্যাত হয়ে আছে : ‘ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব নেই।’ নগরীর উভয় অংশের শিক্ষাব্যবস্থাতেই এই পারস্পরিক অস্বীকারকে উৎসাহিত করা হতো। ইসরাইলি বা আরব কোনো অংশের শিশুদেরকেই পর্যাপ্তভাবে ‘অন্য পক্ষের’ ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হতো না। ইসরাইলিরাও আরব জেরুসালেমের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল : আবারো তাদেরকে নগরীতে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। কয়েক শ’ বছর আগে হারানো টেম্পলের জন্য ইহুদিরা মাউন্ট অলিভেস থেকে কাঁদত। ইসরাইলিরা এখন তা করতে পারত না। কারণ পর্বতটি ছিল জর্দানিদের হাতে। উৎসবের দিনগুলোতে মাউন্ট সায়নের উঁচু ভবনগুলোর শীর্ষ থেকে (এখন থেকে ইহুদি মহল্লা দেখা যেত) তারা প্রার্থনা করত। 

কিন্তু বাস্তবে নগরীর দুই অংশ একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।২২ জর্দানি সরকারের মধ্যে উত্তেজনা সত্ত্বেও আরব জেরুসালেম ছিল স্বাভাবিকভাবেই প্রাচ্যপ্রবণ, আম্মানমুখী এবং পশ্চিম জেরুসালেমের অগ্রহণযোগ্য বাস্তবতা থেকে দূরে। ইহুদি জেরুসালেমেও ইসরাইলিরা অনিবার্যভাবে তেল আবিব ও উপকূলগামী নো ম্যান্স ল্যান্ডের বিপন্নতা থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছিল। সীমান্তের পাশে থাকা এলাকাগুলোতে ছিল অনেক বস্তি। সেখানে বসবাস করত সেফারদিম ইহুদিরা। স্নাইপারদের পাল্লার মধ্যে পড়ায় বেন ইয়েহুদি স্ট্রিটের বাণিজ্যিক কেন্দ্রটি অবহেলিত ছিল। পশ্চিমের পাহাড়গুলোর শীর্ষে নতুন নতুন এলাকা তৈরি করা হয়েছিল। পশ্চিম জেরুসালেমের ভৌগোলিক কেন্দ্ৰ এখন গিবাত রামে অবস্থিত হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ছিল ১৯৪৮-পূর্ব মিউনিসিপ্যালের অনেক পশ্চিমে। এই অবস্থা চলতে থাকলে জেরুসালেম সত্যিই দুটি আলাদা নগরীতে পরিণত হতো। দুই নগরীর মাঝখানে থাকত মনুষ্যহীন ও নো ম্যান্স ল্যান্ডের কাঁটাতারের বেড়া। 

বেন গুরিয়ানের নতুন রাতি লেবার পার্টির সদস্য টেডি কোলেক ১৯৬৫ সালে পশ্চিম জেরুসালেমের মেয়র হন। তিনি সীমান্তের অপর পাড়ের রাহি আল-খতিবের মতোই বিপুল প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন। মোটাসোটা, উজ্জ্বল বর্ণের প্রাণবন্ত এ লোকটি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ইসরাইলি মিউনিসিপ্যালটিকে বেশি স্থিতিশীলতা প্রদান করেন। তিনি পশ্চিম জেরুসালেমকে উপকূলমুখী করার চেষ্টা করেন। সীমান্তের ঠিক লাগোয়া মিউনিসিপ্যালটি ভবনটি নতুন জেরুসালেমের পশ্চিম অংশে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কোলেক যেখানে ছিলেন, সেখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ মেয়র ও তার কাউন্সিলকে তাদের সীমান্ত বস্তিগুলোতে থাকা প্রাচ্যের ইহুদিদের পরিত্যাগ করা উচিত হবে না। সর্বোপরি ‘সীমান্তে অবস্থান করার মাধ্যমে আমরা আমাদের বিশ্বাসকে চূড়ান্ত পর্যায়ে জেরুসালেমের একত্রীকরণের আশ্বাস দিচ্ছিলাম। ২৩ যুদ্ধপরবর্তী বিভক্তি ও অভাব- অনটনের মধ্যে ইসরাইলিরা সামগ্রিকতা ও একীকরণের স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। 

ইসরাইল ও আরব দেশগুলো ১৯৬৭ সালের মে মাসে আরেকটি যুদ্ধের ভয়ঙ্কর শঙ্কার মুখে পড়ে। ১৩ মে সিরিয়াকে সোভিয়েতরা অবগত করে যে ইসরাইল তাদের দেশে হামলা চালানোর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। তাদেরকে সম্ভবত ভুল তথ্য প্রদান করা হয়েছিল। কারণ এ ধরনের হামলার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তবে মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদাল নাসের তার আরব মিত্রের বিরুদ্ধে এই অনুমিত হুমকির প্রতিক্রিয়ায় সিনাই উপদ্বীপে এক লাখ সৈন্য মোতায়েন করেন, ইসরাইলি জাহাজ চলাচলের জন্য আকাবা উপসাগর বন্ধ করে দেন। সঙ্ঘাত থেকে দূর থাকার জন্য জর্দানের কাছে ইসরাইল অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও ৩০ মে জর্দানের বাদশাহ হোসেন মিসরের সাথে একটি সামরিক চুক্তিতে সই করেন। পরাশক্তিগুলো পক্ষ নেয়, ভয়ঙ্কর সঙ্ঘাত আসন্ন বলে মনে হয়। ইসরাইলিদেরকে নাসেরের আবেগপূর্ণ বাগাড়ম্বরতা, তাদের সবাইকে সাগরে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকির কথা শুনতে হয়। অনিবার্যভাবেই তাদেরকে সবচেয়ে খারাপ পরিণতি ও নতুন হলুকাস্টের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। 

অবশ্য যুদ্ধ শুরুর তিন সপ্তাহ আগে পশ্চিম জেরুসালেম অত্যন্ত খুশির দিন অতিবাহিত করে, তারা তাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি ছিল বিশেষ ঘটনা : বার্ষিকীটির হিসাব করা হয়েছিল হিব্রু পঞ্জিকা অনুসারে। ফলে ১৯৬৭ সালের মতো ১৪ মে বিশেষ দিবসের সামঞ্জস্য হওয়ার ঘটনাটি ঘটে বিরলভাবে। জেরুসালেমে কোনো অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জামের অনুমোদন জাতিসঙ্ঘ না দেওয়ায় সামরিক প্যারেড হয়নি। এর বদলে কোলেক পরামর্শ দেন সুপরিচিত গায়ক নোয়ামি শেমারের একটি গান মিউনিসিপ্যাল স্পন্সর করবে। ‘জেরুসালেম অব গড’ সাথে সাথে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এটি ছিল করুণ অবস্থায় থাকা নগরীর প্রতি ‘এর হৃদয়ে থাকা প্রাচীরের প্রতি ভালোবাসার সঙ্গীত। এতে ইসরাইলি জীবনের দুর্বোধ্যতাও প্রকাশ করে : 

কিভাবে জলাধারগুলো শুকিয়ে গেছে :
বাজার ফাঁকা
পুরনো নগরীর টেম্পল মাউন্ট কেউ সফর করে না। অবশ্য নগরী কোনোভাবেই জনশূন্য হয়নি। এর সুক ছিল জনাকীর্ণ। এখানে বিলাসী পণ্য বিক্রি হতো, যা পশ্চিম জেরুসালেমের ইসরাইলিদের কাছে সহজলভ্য ছিল না। হারাম ছিল ধার্মিক মুসাফির ও ইবাদতকারীদের দিয়ে পরিপূর্ণ। এই গানেও ধরে নেওয়া হয়েছিল যে আরব জেরুসালেমের কোনো অস্তিত্ব নেই। এদিকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট আমলের জেরুসালেমের প্রখ্যাত প্রধান রাব্বির ছেলে রাব্বি ভি ইয়েহুদা কুক পশ্চিম জেরুসালেমের অপর পারে মারকাজ হারাভ ইয়েশিভায় ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম উদযাপন উপলক্ষে বার্ষিক ধর্মীয় বক্তৃতা করছিলেন। হঠাৎ করে তার শান্ত কণ্ঠস্বর উচ্চকণ্ঠ হয়ে গেল, তার শ্রোতাদের কাছে মনে হলো তার ওপর নবুয়তি আত্মা ভর করেছে। একপর্যায়ে তিনি চিৎকার করে কাঁদলেন; ইরেতজ ইসরায়েলের জীবন্ত দেহ থেকে বের হওয়া টেম্পল মাউন্ট, হেবরন, শেচেম ও জেরিকোর মতো নগরী (ইহুদি জনগোষ্ঠীর কাছে পবিত্র বিবেচিত পশ্চিম তীরের জেরুসালেম) ও স্থানগুলো নিয়ে আকূলতা প্রকাশ করলেন। রাব্বি কেঁদে কেঁদে বললেন, গোয়িমদের হাতে এসব পবিত্র স্থান রাখা পাপ।২৪ তিন সপ্তাহ পর ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর ট্যাঙ্কগুলো যখন পশ্চিম তীরের এসব নগরীতে ঢুকে পড়ে, জেরুসালেমের পুরনো নগরীর সাথে ইহুদি জনসাধারণকে আবার একত্রিত করে তখন রাব্বিকে ইসরাইলের সত্যিকারের নবী হিসেবে অভিনন্দিত করা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *