সপ্তদশ অধ্যায়
১২৮৪ [1877-78] ১৭৯৯ শক ॥ রবীন্দ্রজীবনের সপ্তদশ বৎসর
এই বৎসরে রবীন্দ্রনাথের জীবনের সবচেয়ে বড়ো ঘটনা ভারতী পত্রিকার প্রকাশ। তত্ত্ববোধিনী যদিও এক অর্থে ঠাকুরবাড়িরই কাগজ ছিল এবং বালক রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি রচনা তত্ত্ববোধিনী-র পৃষ্ঠাতে প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু আদি ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র হিসেবে ধর্মীয় ও সামাজিক নানা দায়দায়িত্ব থাকায় পুরোপুরি সাহিত্য-পত্রিকা হয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাংলা ভাষায় সাহিত্য-বিষয়ক পত্রিকার সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিল বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন। তারই আদর্শে পরবর্তীকালে জ্ঞানাঙ্কুর, আৰ্য্যদর্শন, বান্ধব, প্রতিবিম্ব প্রভৃতি উৎকৃষ্ট মাসিক পত্রিকার আবির্ভাব ঘটে। এর অনেকগুলিতে রবীন্দ্রনাথের বাল্যরচনা প্রকাশিত হয়েছে, তা আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি। কিন্তু আমরা যে-সময়ের কথা আলোচনা করছি, বাংলা সাময়িক পত্রের জগতে সে-সময়টি খুব ভালো কাটছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র-সম্পাদিত বঙ্গদর্শন চার বৎসর পরে চৈত্র ১২৮২-তে বিদায়গ্রহণ করে, সঞ্জীবচন্দ্রের সম্পাদনায় বর্তমান বৎসর পুনঃপ্রকাশিত হলেও তখন তার পূর্বমহিমা অনেকটাই অস্তমিত। প্রতিবিম্ব প্রকাশের কয়েক মাস পরেই জ্ঞানাঙ্কুর-এর সঙ্গে সম্মিলিত হয়েও শেষ পর্যন্ত কেউই আত্মরক্ষা করতে পারেনি। ভ্রমর মাত্র এক বৎসর তিন মাসের পরমায়ু আষাঢ় ১২৮২-তেই শেষ করেছে [১২৮৫ বঙ্গাব্দে অবশ্য ভাদ্র ও আশ্বিন দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল]। বান্ধব অনিয়মিতভাবে তিন বৎসর প্রকাশিত হয়ে ১২৮৪-তে এক বছরের ছুটি ভোগ করে ১২৮৫-তে পুনঃপ্রকাশিত হয়। আৰ্য্যদর্শন-এর অনিয়মিত প্রকাশ সম্বন্ধে আমরা পূর্ব অধ্যায়েই আলোচনা করেছি।* এই অবস্থায় সুপরিচালিত একটি মাসিক পত্রিকার প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে কিশোর রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-প্রতিভা এই সময়ে যেভাবে বিভিন্ন দিকে বিপুলভাবে আত্মপ্রকাশের তাগিদ অনুভব করছিল, অনুরাগী আত্মীয়-বন্ধুরা তার একটি উপযুক্ত মাধ্যম তৈরি করে দিতে আগ্রহী হবেন এটা খুবই স্বাভাবিক। ভারতী-ই হল সেই মাধ্যম।
ভারতী-র চল্লিশ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে লিখিত ‘কবির নীড়’ নামক রচনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠিক এই কথাটাই লিখেছেন:
আমি তেতালায় যে-ঘরটিতে বসতুম, সেখানে একটা গোল টেবিল, তার চারিধারে খানকতক চৌকি। আর দেয়ালের গায়ে একটা পিয়ানো ছিল। রবি আমার নিত্য সঙ্গী (বালক-কবি তখন জগৎ-কবি হন নি), আর-এক কবি, আমার বাল্যবন্ধু অক্ষয় মধ্যে মধ্যে এসে জুট্তেন। আমরা তিন জনে যখন একত্র এই টেবিলের চারিধারে বসতুম, কত গাল-গল্প হত, কত কবিতা পাঠ হত, কত গান বাজনা হত, গান রচনা হত, তার ঠিকানা নেই। পাখীর গানে যেমন ছাদটা মুখরিত হত, এই দুই কবি-বিহঙ্গের গানে ও কবিতা-পাঠে বৈঠকখানাটাও তেমনি প্রতিধ্বনিত হত।
একদিন প্রাতে এই টেবিলে বসে আমরা সাহিত্যালোচনা করচি—কি-শুভক্ষণে আমার হঠাৎ মনে হল,—এই দুই কবি-বিহঙ্গ কেবল আকাশে-আকাশেই উড়ে বেড়াচ্চে, ওদের মধুর গান আকাশেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। লোকালয়ের কোন কুঞ্জ-কুটীরে ওরা যদি আশ্রয় পায় কিংবা একটা নীড় বাঁধতে পারে, তাহলে কতলোকে ওদের স্বর-সুধা পান করে কৃতার্থ হয়।১
রবীন্দ্রনাথ ও অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী, বিশেষত রবীন্দ্রনাথ, এই দুই কবির জন্য নীড় রচনার আকাঙক্ষাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনে একটি সাহিত্য-পত্রিকা প্রকাশের সংকল্প সৃষ্টি করেছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এর পর লিখেছেন : ‘এই কথা মনে হবা মাত্র, দোতালায় নেমে এলুম!/ দোতালার দক্ষিণ বারণ্ডায় আর-একটি প্রবীণ বিহঙ্গরাজের আসন ছিল।…আমার প্রস্তাব শোনবা মাত্রই তিনি রাজি হলেন, আর তখনি দেবী “ভারতী”কে আবাহন করে তাঁরই পুণ্যকুঞ্জে, নবীন কবি-বিহঙ্গদের জন্য একটি নীড় বেঁধে দিলেন।’১ অবশ্য ‘প্রবীণ বিহঙ্গরাজ’ দ্বিজেন্দ্রনাথ খুব সহজে রাজি হননি, তিনি এ-সম্পর্কে বলেছেন : “জ্যোতির ঝোঁক হইল, একখানা নূতন মাসিক-পত্র বাহির করিতে হইবে। আমার কিন্তু ততটা ইচ্ছা ছিল না। আমার ইচ্ছা ছিল, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’কে ভাল করিয়া জাঁকাইয়া তোলা যাক। কিন্তু জ্যোতির চেষ্টায় ‘ভারতী’ প্রকাশিত হইল। বঙ্কিমের ‘বঙ্গদর্শনের’ মত একখানা কাগজ করিতে হইবে, এই ছিল জ্যোতির ইচ্ছা। আমাকে সম্পাদক হইতে বলিল। আমি আপত্তি করিলাম না। আমি কিন্তু ঐ নামটুকু দিয়াই খালাস। কাগজের সমস্ত ভার জ্যোতির উপর পড়িল।’২
পত্রিকার নাম কী হবে এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলল।‘ দ্বিজেন্দ্রবাবু নাম করিলেন “সুপ্রভাত”—কিন্তু এ নামটি জ্যোতিবাবুদের মনোনীত হইল না, কারণ ইহাতে যেন একটু স্পর্দ্ধার ভাব আসে; অর্থাৎ এতদিনে ইহাদের দ্বারাই যেন বঙ্গসাহিত্যের সুপ্রভাত হইল। সুপ্রভাত নাম যখন গ্রাহ্য হইল না, তখন দ্বিজেন্দ্রবাবুই আবার তাহার নাম রাখিলেন “ভারতী”।‘৩ নামকরণের তাৎপর্য ও পত্রিকার উদ্দেশ্যটি সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রথম সংখ্যার ‘ভূমিকা’-তে ব্যাখ্যা করেছেন :
ভারতীর উদ্দেশ্য যে কি তাহা তাঁহার নামেই স্বপ্রকাশ। ভারতীর এক অর্থ বাণী, আরেক অর্থ বিদ্যা, আরেক অর্থ ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, বাণী স্থলে স্বদেশীয় ভাষার আলোচনাই আমাদের উদ্দেশ্য।…যে কারণে ব্রিটেনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা ব্রিটানিয়া নাম ধারণ করিয়াছেন এবং তাহার বহুপূৰ্ব্বে এথেন্সগরের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা মিনাভা—এথেনিয়া নাম ধারণ করিয়াছিলেন সেই কারণে ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা সরস্বতী—ভারতা নাম ধারণ করিতে পারেন।…ভারত ভূমি বিদ্যার জন্মভূমি, বিদ্যার অধিদেবকে তাই আমরা ভারতী নামে সম্বোধন করিতে পারি।…ভারত ভূমিতে যদি জাগ্রতা দেবতা অদ্যাপি কেহ বিরাজমান থাকেন, তবে তিনি ভারতী। ভারতের প্রতি ভারতীর এমনি কৃপাদৃষ্টি যে, তাহাকে লক্ষ্মী পরিত্যাগ করিলেও তিনি পরিত্যাগ করেন না।…আমরা ভাই বন্ধু একত্র হইয়া ভারতীর আবাহনপূর্ব্বক এই ত প্রতিষ্ঠা করিলাম, এক্ষণে ভারতীর বরপুত্রগণ অগ্রসর হইয়া তাঁহার যাঁহাতে রীতিমত সেবা চলে, তাহার ব্যবস্থা করুন। ভারতীর আশীৰ্বাদে তাঁহাদের মনস্কামনা পূর্ণ হইবে।৪
পত্রিকা-প্রকাশের পরিকল্পনা কবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মাথায় এসেছিল, ঠিক বলা যায় না। তবে জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম দিকেই এই পরিকল্পনাকে কার্যকরী রূপ দেওয়া শুরু হয়েছিল, তা বোধহয় জোর করেই বলা যায়। কারণ ভারতী-র গ্রাহকতালিকা-ভুক্ত হবার আহ্বান জানিয়ে ৫ আষাঢ় তারিখে হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এর আগেও কোনো বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল কিনা আমাদের জানা নেই। কিন্তু ৮ আষাঢ় তারিখেই জলেশ্বর থেকে মূল্যপ্রাপ্তির হিসাব দেখে মনে হয়, অন্য কোনো পত্রিকায় এর আগেও বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। যাই হোক, এই তথ্য থেকেই বোঝা যায় পত্রিকা প্রকাশের কার্যকরী ব্যবস্থা অনেকটা এগিয়ে না গেলে বিজ্ঞাপন দেওয়া সম্ভব হত না। অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর স্ত্রী শরৎকুমারী লিখেছেন,
আমি পঞ্জাব হইতে আসিয়া* শুনিলাম যে, একখানি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের কল্পনা জল্পনা চলিতেছে; প্রবন্ধাদি রচিত ও সংগৃহীত হইবার আয়োজন হইতেছে।…সে সময় প্রতি রবিবারে জ্যোতিবাবু ও রবীন্দ্রনাথ ভারতীর ভাণ্ডার লইয়া আমাদের বাড়ীতে আসিয়া ‘ভারতী’ সম্বন্ধে আলোচনা করিতেন ও পরে “তাঁহাকে” লইয়া বিহারীলাল চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের বাটীতে যাইতেন এবং সেখান হইতে জোড়াসাঁকো ফিরিয়া যাইতেন।
কোন কোন দিন বৈকালে আমরা জানকীবাবুর [জানকীনাথ ঘোষাল। রামবাগানস্থ বাড়ীতে যাইতাম—সেখানে ন-বৌঠাকুরাণী [প্রফুল্লময়ী দেবী], নতুন বৌ [কাদম্বরী দেবী, জ্যোতিবাবু, রবিবাবু প্রভৃতিও আসিতেন। …সকলে মিলিত হইলে ‘ভারতী’র জন্য রচিত নূতন প্রবন্ধাদি পাঠ, আলোচনা, রবীন্দ্রনাথের গান হইত, পরে আহারাদি সমাপনান্তে বাড়ী ফিরিতে রাত্রি ১০। ১১টা বাজিয়া যাইত।৫
এই বর্ণনা থেকে ভারতী-র উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যদের পরিচয় ও পরামর্শ-সভানুষ্ঠানের পদ্ধতি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা করা যায়। শরৎকুমারী আরও একটি সভাস্থলের কথা লিখেছেন—সেটি হল ভারতী-র প্রকৃত জন্মস্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বাইরের তেতলার ছাদে টবের গাছে সাজানো জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাগান, অক্ষয় চৌধুরী যার নাম দিয়েছিলেন ‘নন্দন-কানন’।
এইখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। শরৎকুমারী দেবীর উপরোক্ত বর্ণনা থেকে মনে হতে পারে, কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী ভারতী প্রকাশের সময় উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমাদের ধারণা, দীর্ঘকাল পরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি ঘটনার পারম্পর্য ঠিক রক্ষা করতে পারেননি। কারণ বিহারীলাল যদি প্রথমাবধিই ভারতী-গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হতেন, তাহলে তাঁর মতো বিখ্যাত কবির যে-কোনো কবিতার সাক্ষাৎ আমরা প্রথম সংখ্যাতেই পেতাম। কিন্তু বিহারীলালের কবিতা ভারতী-তে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় বর্ষে জ্যৈষ্ঠ ১২৮৫ সংখ্যায় [‘গীত/ললিত বিভাস–আড়াঠেকা/বিরাজ সারদে কেন’]। সুতরাং এ-ব্যাপারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উক্তিই গ্রহণযোগ্য : ‘ভারতী-প্রকাশ হইতেই আমাদের আর একজন বন্ধুলাভ হইল। ইনি কবিবর শ্রীযুক্ত বিহারীলাল চক্রবর্তী। আগে তিনি বড়দাদার কাছে কখনও কখনও আসিতেন, কিন্তু আমার সঙ্গে তেমন আলাপ ছিল না। এখন ‘ভারতী’র জন্য লেখা আদায় করিবার জন্য আমরা প্রায়ই তাঁহার বাড়ী যাইতাম এবং সেই সূত্রে তিনিও আমাদের বাড়ী আরও ঘন ঘন আসিতে লাগিলেন।…আমাদের বাড়ী যখনই আসিতেন, তখনই তিনি আমাকে বেহালা বাজাইতে বলিতেন। আমি বাজাইতাম, আর তিনি তন্ময় হইয়া শুনিতেন।’৬ লক্ষণীয়, রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে তাঁর মুখে শোনা যে দুটি গানের উল্লেখ করেছেন [‘বালা খেলা করে চাঁদের কিরণে’ ও ‘কে রে বালা কিরণময়ী ব্রহ্মরন্ধ্রে বিহরে’] সেগুলি অনেক পরবর্তীকালের রচনা। তাই মনে হয়, বিহারীলালের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা ১২৮৪ বঙ্গাব্দের একেবারে শেষে ঘটেছিল।
পত্রিকা-প্রকাশের সব বন্দোবস্ত হয়ে যাবার পর তার অঙ্গসজ্জা বা প্রচ্ছদ নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। দ্বিজেন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘মলাটের উপরে একটি ছবির design আমি দিয়াছিলাম; কিন্তু সে ছবি ওরা দিতে পারিল না।’৭ শরৎকুমারী দেবী লিখেছেন : ‘অনেক গবেষণার পর আর্ট ষ্টুডিয়োর দেবী সরস্বতীর ছবির অনুকরণে ভারতীর মলাটের ব্লক প্রস্তুত হয় এবং তখনকার পক্ষে ছবিখানি উৎকৃষ্ট হইয়াছে বলিয়াই সকলে মানিয়া লইয়াছিলেন।’৮ কোলে অনাহত নীরব বীণা নিয়ে নতমুখে চিন্তামগ্না দেবী ভারতীর বিষাদিনী মূর্তি ও দূরে পাহাড়ের আড়ালে নবোদিত সূর্যরশ্মির আভাসে সুপ্রভাতের সূচনা—প্রথম সংখ্যায় লিখিত দ্বিজেন্দ্রনাথের ভূমিকার সঙ্গে প্রচ্ছদ-চিত্রটি যথেষ্ট সংগতিপূর্ণ।
কাঠ খোদাই করে এই ব্লকটি তৈরি হয়েছিল এবং দীর্ঘকাল ভারতী-র প্রচ্ছদ-রূপে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এই কাঠ-খোদাই ব্লকটি প্রস্তুত করেছিলেন তখনকার দিনের বিখ্যাত এনগ্রেভার ও ব্রাহ্মসমাজের উৎসাহী সভ্য ত্রৈলোক্যনাথ দেব [1847-1928]।৯ ভারতী পত্রিকার আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার জন্য জোড়াসাঁকোর সেরেস্তায় একটি স্বতন্ত্র ক্যাশবহি রক্ষিত হত। এই ক্যাশবহি-র ৯ কার্তিক [বুধ 24 Oct] তারিখের হিসাবে দেখা যায় : ‘ব° ত্রৈলক্ষনাথ দে/দং ভারতির পুস্তকের উপরে/ছবি খোদাই করার বি° এক বিল সোদ/মা° সরকারি তহবিল ৪০৲’ টাকা অর্থাৎ ব্লক তৈরির জন্য খরচ পড়েছিল চল্লিশ টাকা [তখনকার পক্ষে খরচটি কম নয়] এবং সরকারী তহবিল থেকেই খরচটি মেটানো হয়েছিল [লক্ষণীয়, শিল্পীর নামটি ভুল লেখা হয়েছে, পরেও একই ভুল লক্ষিত হয়, কিন্তু যখন নামটি ইংরেজিতে লেখা হয়েছে তখন ‘T.N. Deb’-ই দেখা যায়]। ভারতী-কে যে ঠাকুরবাড়ির কাগজ বলা হত, তা যে যথার্থ এই হিসাবই তার প্রমাণ। পত্রিকাটি এই পর্বে কখনোই স্ব-নির্ভর হতে পারেনি, এমন-কি ১২৯১ বঙ্গাব্দে যখন স্বর্ণকুমারী দেবীর সম্পাদনায় কাশিয়াবাগান থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হত তখনও প্রতি মাসে ঠাকুরবাড়ির আর্থিক সাহায্য লাভ করেছে।
প্রকাশনার পরিকল্পনা সম্পূর্ণ হলে বিভিন্ন সাময়িকপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। বিজ্ঞাপনের একটি আদর্শ আমরা তুলে দিচ্ছি, এটি প্রকাশিত হয়েছিল The Hindoo Patriot-এর [Vol. XXIV, No. 25, p. 299] 18 Jun 1877 [সোর্ম ৫ আষাঢ় ১২৮৪] সংখ্যায় :
বিজ্ঞাপন।
আগামী শ্রাবণ মাস হইতে ভারতী নামে সাহিত্য-
বিজ্ঞান-দর্শন প্রভৃতি নানা-বিষয়িণী এক খানি মাসিক
সমালোচনী পত্রিকা প্রকাশিত হইবে। এখনকার
সুপ্রসিদ্ধ লেখকের মধ্যে অনেকে এই পত্রিকার
সাহায্য করিবেন। ইহার কলেবর রয়েল ৮ পেজি ৫
ফর্ম্মা। মূল্য বার্ষিক ৩ তিন টাকা। বিদেশে বার্ষিক
৷৵৹ ছয় আনা ডাকমাশুল লাগিবে। ইহা প্রতি মাসের
১৫ই প্রকাশ হইবে। যাঁহারা ইহার গ্রাহকশ্রেণী-
ভুক্ত হইতে চাহেন তাঁহারা যোড়াসাঁকো দ্বারকানাথ
ঠাকুরের লেন ৬নং বাটীতে শ্ৰীযুক্ত প্রসন্নকুমার
বিশ্বাসের নামে পত্র লিখিবেন।
শ্রীদ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সম্পাদক।
এই বিজ্ঞাপনটি উক্ত পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যা-তেও [No. 26, p. 311, 25 Jun সোম ১২ আষাঢ়] প্রকাশিত হয়। ২৭ শ্রাবণ [10 Aug] তারিখে এই দুটি বিজ্ঞাপন বাবদ সাত টাকা শোধ করা হয়েছে। কিন্তু শুধু হিন্দু পেট্রিয়ট-এ নয়, ক্যাশবহি থেকে জানা যায়, আৰ্য্যদর্শন [২ বার] এডুকেশন গেজেট [৪ বার] সোমপ্রকাশ [৮ বার] অমৃতবাজার পত্রিকা প্রভৃতিতেও বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এর কোনোটিই আমরা দেখিনি, কিন্তু অনুমান করা যায়, বিজ্ঞাপনের বয়ানটি সর্বত্রই একই রকম ছিল।
বিজ্ঞাপন দেওয়ার ফল প্রায় হাতেনাতেই পাওয়া গেছে। মাত্র তিনদিন পরেই একজন গ্রাহক হলেন। অর্ধশতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত পত্রিকার প্রথম গ্রাহক, তাঁর নামটি ইতিহাসে স্থান পাবার যোগ্য। ৮ আষাঢ় [বৃহ 21 Jun] ক্যাশবহি-তে লেখা হয়েছে [হিসাবটি অবশ্য পরে লেখা, কারণ ক্যাশবহিটি-ই কেনা হয়েছে ১৪ আষাঢ় তারিখে] : ‘সবস্কৃপনসন খাতে/ জমা ১৲/মা° বাবু শ্যামাচরণ গুপ্ত/জলেশ্বর/দ° লক্ষ্মীনাথ সাধারণ পুস্তকালয়/ভারতী পত্রিকা গ্রহণ জন্য অগ্রীম/মূল্য স্বরুপ ডাকে পাঠান/বিঃ উহার চিঠী ৬ হিঃ ডাক টীকীট’ অর্থাৎ মেদিনীপুর জেলার জলেশ্বর* থেকে লক্ষ্মীনাথ সাধারণ পুস্তকালয়ের ঠিকানায় শ্যামাচরণ গুপ্ত ভারতী-র প্রথম গ্রাহক; অবশ্য অর্থের দিক থেকে ভারতী-র ভাণ্ডার তখনও শূন্য, কারণ উক্ত গ্রাহক তাঁর চাঁদা পাঠিয়েছেন দু’পয়সা দামের বত্রিশটি ডাকটিকিট দিয়ে। ভাণ্ডারে প্রথম টাকা জমা পড়ে প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ-প্রদত্ত পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ১৪ আষাঢ় [বুধ 27 Jun] তারিখে; নগদ টাকা তিনি জমা দেন বেণীমাধব রায় মারফত (ইনি রবীন্দ্রনাথের ভাবী শ্বশুর, পূর্বে ১২৮৩ বঙ্গাব্দে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে মাত্র কুড়ি দিন সেরেস্তায় কাজ করেছিলেন, কিন্তু এখন থেকে ১২৯০ অগ্রহায়ণে রবীন্দ্রনাথের বিবাহের কয়েকমাস আগে পর্যন্ত তিনি নিয়মিত কর্মচারীরূপে নিযুক্ত ছিলেন। এই দিনই আবার খরচের খাতে ‘ভারতী পত্রিকার কেসবহী, চীঠীবহী, ও বৌচার বহী ও সবস্ক্রাইবার দিগের নাম রেজেষ্টরি ও টীনা বাক্স্ তিনটা’ কিনতে তিন টাকা এগারো আনা ব্যয় করা হয়। পরের দিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথও পঞ্চাশ টাকার একটি চেক দেন উক্ত বেণীমাধব রায় মারফত। এইভাবেই প্রধানত দুই ভাইয়ের টাকাতেই ভারতী-র অর্থভাণ্ডার গড়ে ওঠে। কিন্তু এই দিনই জনৈক তিনকড়িবাবুকে ‘অক্ষরাদী ক্রয়’ বাবদ ৪৫ টাকা ‘হাওলাত’ দেওয়া হয় এবং ২৮ আষাঢ় উক্ত তিনকড়িবাবুকে ‘পাঁচ শত কপী ভারতী ছাপার জন্য কাগজ ক্রয় ও অন্যান্য খুজঁরা ব্যায়’ বাবদ ২৭৸৴৫ ও আদি ব্রাহ্মসমাজ [প্রেস]-কে ভারতী পত্রিকার প্রথম ও দ্বিতীয় নম্বর/ছাপার ব্যায় পাঁচ ফরম ৬ হিঃ ৩০ ও কবরিং ৩ একুণে/৩৩৲ -প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যার ব্যায় ঐ ৩৩৲ হি৹…৬৬৲’ [বাদ হাওলাত ৪৫ টাকা] শোধ দেওয়া হয়। ১১ শ্রাবণ [15 Jul] ‘লেখক দিগের কপী রাখার জন্য/ছোটবাবুর নিকট রাখিবার নিমিত্ত/টীন বাক্স ক্রয়’ করা হয় ১।৴১৫ দিয়ে। এই বাক্সটি সম্পর্কে শরৎকুমারী লিখেছেন : ‘একটি হল্দে রঙের বাক্স হইল ‘ভারতী’র ভাণ্ডার; প্রথমে সেটি জ্যোতিবাবুর কাছেই থাকিত, পরে কোন এক সময়ে সেই ভাণ্ডারটি আমাদের মাণিকতলা স্ট্রীটের ক্ষুদ্র ঘরের তাকের উপর রাখা হয়। সেই বাক্স ও কয়েকটি পরিত্যক্ত প্রবন্ধ অনেকদিন পর্য্যন্ত আমার সাথের সাথী ছিল—অল্প কিছুদিন হইল বিসর্জ্জন দিয়াছি।’১০ সেই সময়ে রবীন্দ্রভবনের কথা ভাবাই হয়নি—নইলে এই বাক্সটি তার একটি অমূল্য দ্রষ্টব্য বস্তু হত, ‘পরিত্যক্ত প্রবন্ধ’-গুলিও ইতিহাসের কোন্ গুপ্ত রহস্য উদঘাটিত করত তা আজ আর জানবার উপায় নেই।
উপরের হিসাব থেকে একটি জিনিস স্পষ্ট বোঝা যায় যে, অন্তত প্রথম সংখ্যা ভারতী [শ্রাবণ ১২৮৪] ৫০০ কপি ছাপানো হয়েছিল। ড পশুপতি শাশমল জানিয়েছেন, প্রথম সংখ্যাটি দুবার ছাপা হয়১১ দ্বিতীয় মুদ্রণটি নিশ্চয়ই পরবর্তী কোন সময়ের, কারণ এটি পুনর্মুদ্রণ নয়, কিছু কিছু পাঠ-সংস্কারের নিদর্শনও তাতে পাওয়া যায়। প্রতিশ্রুতি-অনুযায়ী ঠিক ১৫ শ্রাবণ ১২৮৪ [রবি 29 Jul 1877] তারিখেই ভারতী-র প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়—বাঁধাই করেন নেহাজুদ্দীন দপ্তরী। এই দিনই ৮৪ খানা ভারতী মফঃস্বলে ডাক মারফত পাঠানো হয়। কলকাতা ও হাওড়া অঞ্চলে গ্রাহক ও অন্যান্যদের কাছে ভারতী পৌঁছে দিতেন দুজন ‘বিলি সরকার’—দিননাথ [দীননাথ] ঘোষ ও উদয়চাঁদ দাস। ১৭ শ্রাবণ আমেদাবাদে সত্যেন্দ্রনাথের ও স্কটল্যাণ্ডে ডাক্তারি-শিক্ষা-রত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের [বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী] কাছে দুখানা ভারতী পাঠানো হয়।
ভারতী, প্রথমবর্ষ প্রথম সংখ্যা-র সূচিটি ছিল নিম্নরূপ :
১-৩ | ‘ভূমিকা’ : [সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ-লিখিত] |
৩-৪ | ‘ভারতী’ [কবিতা] : [রবীন্দ্রনাথ] |
৪-৭ | ‘তত্ত্বজ্ঞান কতদূর প্রামাণিক’ [দ্বিজেন্দ্রনাথ] |
৭-১৭ | ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’। /(মাইকেল মধুসূদন প্রণীত। )’ : ‘ভঃ’ [রবীন্দ্রনাথ] দ্র র°র°১৫ [শতবার্ষিক সং]। ১১২-২১ |
১৭-২৪ | ‘জ্ঞান, নীতি ও ইংরাজি সভ্যতা/ (বকল্ সাহেব-কৃত ইংলণ্ডীয় সভ্যতার ইতিহাস। )’ : ‘সঃ’ [সত্যেন্দ্রনাথ] |
২৪-২৯ | ‘বঙ্গ সাহিত্য।/ (শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত সি এস প্রণীত বঙ্গ সাহিত্য। )’ : [অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ] |
২৯-৩৫ | ‘গঞ্জিকা/অথবা/তুরিতানন্দ বাবাজীর আক্ড়া।) : [দ্বিজেন্দ্রনাথ] |
৩৫-৪২ | ‘ভিখারিণী’ [১-৩ পরিচ্ছেদ] : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র গল্পগুচ্ছ ২৭। ১০৩-১০ |
৪২-৪৪ | ‘স্বাস্থ্য।/উপক্রমণিকা।’ : ‘যঃ—’ [ডাঃ যদুনাথ মুখোপাধ্যায়] |
৪৪-৪৮ | ‘সম্পাদকের বৈঠক।’/’আফ্রিকা দেশের শৃঙ্গী মনুষ্য’; ‘একটী চতুর বৃদ্ধ বানর’; ‘লূতাতন্তু’; ‘কুক্কুরগণ অনেক কাজে লাগে’; ‘চতুষ্পদ মৎস্য’; ‘চীনদেশীয় বহুরূপী বৃক্ষ’; ‘বৃহৎ পদ্ম-পর্ণ’; ‘সাবান তৃণ’; ‘কৃষ্ণ গোলাপ’; ‘রামকান্তের সন্তান লাভ’; ‘দেবতার মানত’। : [? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ] |
তখনকার দিনে কোনো পত্রিকাতেই বিশিষ্ট লেখক ছাড়া রচয়িতাদের নাম প্রকাশিত হত না। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে কেবল নামের আদ্যক্ষরটুকু রচনা-শেষে উল্লিখিত হত। ভারতী-ও এই রীতির ব্যতিক্রম করেনি। এই অদ্ভূত ও অপ্রয়োজনীয় রীতিটি এই যুগের সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় অনেক অসুবিধা ঘটিয়েছে। রবীন্দ্র-রচনার ইতিবৃত্ত সংকলনও একই কারণে অনেক সংশয় ও বিতর্কে কণ্টকিত। আমরা উপরে যে সূচিটি উদ্ধৃত করেছি, সেখানেও এই অসুবিধাটি বর্তমান। নানা ধরনের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রমাণের সাহায্যে কয়েকটি রচনার লেখককে নির্দিষ্ট করা সম্ভব, সেগুলি আমরা তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করেছি। কিন্তু সবগুলির ক্ষেত্রে এরূপ নির্দেশ করা সম্ভব হয়নি। শরৎকুমারী দেবী লিখেছেন : ‘প্রতি মাসেই সম্পাদক মহাশয়ের, জ্যোতিবাবু, রবিবাবু ও “তাঁহার” রচনা কিছু-না-কিছু প্রকাশিত হইতই।‘১২ জ্যোতিরিন্দ্রনাথও বলেছেন : ‘প্রথম বর্ষের “ভারতী”তে রবি ও অক্ষয়ের লেখাই বেশী প্রকাশিত হইয়াছিল। …অক্ষয় তখন বঙ্গসাহিত্যের সমালোচনা এবং হৃদয়-ভাবের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করিয়া এক একটি প্রবন্ধ লিখিতেন, যেমন “মান ও অভিমানে কি প্রভেদ?” ইত্যাদি। লোকের এ সব তখন খুবই ভাল লাগিত।’১৩ ভারতী-র পৃষ্ঠায় রবীন্দ্র-রচনার সন্ধানে অনেক গবেষণা ও বিতর্ক করা হয়েছে, তার প্রয়োজনও আছে, কিন্তু অন্যদের রচনা—বিশেষ করে অক্ষয় চৌধুরীর—নিয়ে অনুরূপ সন্ধান খুবই কম হয়েছে। অথচ রবীন্দ্রনাথের মানস-বিকাশের গতিপ্রকৃতি বোঝার পক্ষে এই অনুসন্ধানেরও প্রয়োজন আছে, কারণ তিনিও ‘ভারতীর সম্পাদকচক্রের বাহিরে’ ছিলেন না—প্রবন্ধ কবিতা ইত্যাদি বাছাইয়ে, সেগুলি নিয়ে আলোচনা-বিতর্কে তাঁরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল, যা তাঁর বিচার-বুদ্ধি ও রসবোধকে পরিণত করেছে, তাঁকে চিন্তাজগতের বিচিত্র অলিগলিতে ভ্রমণ করিয়েছে। বিশেষ করে অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর লেখাগুলি চিহ্নিত করা খুবই দরকার, কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করেছেন : ‘ইঁহার সদ্য রচনাগুলি সর্বদাই পড়িয়া শুনিয়া আলোচনা করিয়া আমার তখনকার রচনারীতি লক্ষ্যে অলক্ষ্যে ইঁহার লেখার অনুসরণ করিয়াছিল।’১৪ রচনাগুলি চিহ্নিত করার একটি সূত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উক্তির মধ্যেই পাওয়া যায়। সেই অনুযায়ী বর্তমান সংখ্যায় ‘বঙ্গ সাহিত্য’ নামে যে প্রবন্ধটি দেখা যায় [এটি ধারাবাহিকভাবে কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, চৈত্র ১২৮৪ এবং বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, কার্তিক ১২৮৫ ও বৈশাখ, আষাঢ়, শ্রাবণ ১২৮৬ সংখ্যাগুলিতেও প্রকাশিত হয়েছিল] সেটি অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর লেখা। কয়েকটি প্রবন্ধের শেষে ‘চ—’ অক্ষরটি দেখা যায়, যেটি ‘চৌধুরী’ শব্দটির আদ্যক্ষর—এই ‘চ’ অক্ষরটির সাহায্যেও কতকগুলি রচনা অক্ষয়চন্দ্রের লেখা বলে চিহ্নিত করা যায়। ‘গঞ্জিকা অথবা তুরিতানন্দ বাবাজীর আক্ড়া’ রচনাটি দ্বিজেন্দ্রনাথের, এটি সম্বন্ধে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘ভারতীর প্রথম বর্ষে ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ ‘গঞ্জিকা’ নামে একটা বিভাগ ছিল। তাহাতে কেবল ব্যঙ্গকৌতুকের কথাই থাকিত। এইভাগে বড়দাদাই প্রায় সব লিখিতেন। আমি “উনবিংশ শতাব্দীর রামায়ণ বা রামিয়াড়” নামে কেবল একটা নক্স [ভাদ্র ১২৮৪। ৬৯-৭৪] লিখিয়াছিলাম মাত্র। আমি তখন অনেক বিষয়েই লিখিতাম। ‘মনে হয়, বর্তমান সংখ্যার ‘সম্পাদকের বৈঠক’-এর সবগুলি যদি না হয়, অনেকগুলি-ই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা। ‘স্বাস্থ্য’ প্রবন্ধটির ক্রমানুসৃতি পরবর্তী অনেকগুলি সংখ্যাতেই দেখা যায়, পড়লে বোঝা যায় প্রবন্ধগুলি কোনো অভিজ্ঞ চিকিৎসকের লেখা; ১৯ আষাঢ় ১৮০২ শক [১২৮৭] রাজনারায়ণ বসু তাঁর ‘দেবগৃহে দৈনন্দিন লিপি’-তে লিখেছেন : ‘অদ্য যদুনাথ মুখোপাধ্যায়কৃত “শরীর পালন” পাঠ করিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম।’১৫
প্রথম সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথের তিনটি রচনা প্রকাশিত হয়—‘ভারতী’, ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ ও ‘ভিখারিণী’–এদের মধ্যে ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ প্রবন্ধটির শেষে ‘ভ’ লেখা আছে, বাকি দুটি স্বাক্ষরবিহীন। ‘ভারতী’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের কোনো কাব্য-সংগ্রহে আজ পর্যন্ত সংকলিত হয়নি, রবীন্দ্রনাথও কোথাও কবিতাটি সম্পর্কে কিছু লেখেননি, কিন্তু তাঁর জীবৎকালেই সজনীকান্ত দাস অগ্রহায়ণ ১৩৪৬-সংখ্যা শনিবারের চিঠি-তে ‘রবীন্দ্র-রচনাপঞ্জী’ প্রবন্ধে কবিতাটিকে রবীন্দ্র-রচনা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। বঙ্গসুন্দরী-র ছন্দে লেখা এই কবিতাটি পাঠ করলে এই অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা স্বীকার করতে হয়। ত্রৈলোক্যনাথ দেব ভারতী পত্রিকার জন্য যে প্রচ্ছদ-চিত্রটি অঙ্কন করেন, কবিতাটি যেন সেই চিত্রটিকে উদ্দেশ করেই লেখা:
শুধাই অয়ি গো ভারতী তোমায়
তোমার ও বীণা নীরব কেন?
কবির বিজন মরমে লুকায়ে
নীরবে কেন গো কাঁদিছ হেন?
অযতনে আহা সাধের বীণাটি
ঘুমায়ে রয়েছে কোলের কাছে,
অযতনে আহা এলোথেলো চুল
এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে আছে।
কেন গো আজিকে এ ভাব তোমার
কমলবাসিনী ভারতী রাণী
মলিন মলিন বসন ভূষণ।
মলিন বদনে নাহিক বাণী! [পৃ ৩]
—এই হিসেবে কবিতাটিকে আমরা আষাঢ় মাসের শেষ দিকে [Jul 1877] লেখা বলে মনে করতে পারি। এটিকে এক অর্থে ভারতী পত্রিকার ‘কাব্য-ভূমিকা’ নামে অভিহিত করা যায়; সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ‘ভূমিকা’য় গদ্যে যে কথা লিখেছেন : ‘তোমার প্রসাদাৎ আমরা দুর্ব্বল হইয়াও সবল, গতশ্রী হইয়াও নবশ্রী, নির্জ্জীব হইয়াও সজীব’–সম্পাদকচক্রের কনিষ্ঠতম সদস্য ও Poet Laureate সেই কথাটিই লিখলেন এই কাব্য-ভূমিকায় :
আজো তুমি মাতা বীণাটি লইয়া
মরমে বিঁধিয়া গাওগো গান
হীনবল সেও হইবে সবল,
মৃত দেহ সেও পাইবে প্রাণ॥ [পৃ ৪]।
‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ প্রবন্ধটি প্রথম বর্ষ ভারতী-র শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, পৌষ ও ফাল্গুন সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধটিও রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে কোনো রচনা-সংগ্রহে গ্রহণ করা হয়নি। বিভিন্ন গ্রন্থে অংশত উদ্ধৃত হলেও সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি গ্রন্থমধ্যে প্রথম সংকলিত হয় নীলরতন সেন-সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রবীক্ষা’ [? ১৩৬৮] গ্রন্থে [পৃ ৫-৫৪]; পরে এটি পশ্চিমবঙ্গ সরকার-প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলী-র ‘শতবার্ষিক সংস্করণ’-এর পঞ্চদশ খণ্ডে [১৩৭৩] ১১২-৪৮ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়। দুটি পুনর্মুদ্রণই অবশ্য ত্রুটিপূর্ণ। প্রথমটি এমনভাবে ছাপা হয়েছে যাতে মনে হয় সমস্ত প্রবন্ধটি একটি সম্পূর্ণ রচনা রূপে লিখিত, ভারতী-র বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশের ফলে রচনাভঙ্গিতেই যে বিশিষ্টতা সৃষ্টি হয়েছে সেটি স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না, প্রথম সংখ্যার শেষ অনুচ্ছেদ ও দ্বিতীয় সংখ্যার প্রথম অনুচ্ছেদ একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলায় আজকের পাঠকের পক্ষে বিভ্রান্তি ঘটা স্বাভাবিক। দ্বিতীয় পুনর্মুদ্রণে এই ত্রুটি না থাকলেও পাদটীকাগুলি সম্পূর্ণ বর্জন করে আরও বড়ো বিচ্যুতি ঘটানো হয়েছে। আরও একটি হাস্যকর ব্যাপার, সম্ভবত কোনো কীটদষ্ট খণ্ড থেকে রচনাটি কপি করা হয়েছিল—ফলে কীটের আক্রমণে লুপ্ত শব্দগুলির স্থানে ‘** ’ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন গ্রন্থাগারে প্রথম বর্ষের ভারতী-র খুব-একটা অভাব নেই!
এই প্রবন্ধটির স্বত্ব নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। রবীন্দ্রনাথের নামান্তর ‘ভানু’র আদ্যক্ষর ‘ভ’ রচনা-শেষে ব্যবহৃত হয়েছে এবং রচনাটির কথা তিনি জীবনস্মৃতি-তেও উল্লেখ করেছেন : ‘ইতিপূর্বেই আমি অল্পবয়সের স্পধার বেগে মেঘনাদবধের একটি তীব্র সমালোচনা লিখিয়াছিলাম। কাঁচা আমের রসটা অম্লরস—কাঁচা সমালোচনাও গালিগালাজ। অন্য ক্ষমতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার ক্ষমতাটা খুব তীক্ষ্ণ হইয়া উঠে। আমিও এই অমর কাব্যের উপর নখরাঘাত করিয়া নিজেকে অমর করিয়া তুলিবার সর্ব্বাপেক্ষা সুলভ উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম। এই দাম্ভিক সমালোচনাটা দিয়া আমি ভারতীতে প্রথম লেখা আরম্ভ করিলাম।’* তথ্যের দিক থেকে এখানে সবচেয়ে মূল্যবান কথাটি হল ‘ইতিপূর্বেই’, অর্থাৎ ভারতী প্রকাশের পরিকল্পনা হবার আগেই সম্ভবত তিনি এই সমালোচনাটি লিখেছিলেন। জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব-তে কাব্য-সমালোচনা প্রকাশের গৌরব হয়তো তাঁকে আরও খ্যাতিমান কবি ও কাব্যবিচারে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রবন্ধটি পত্রিকায় খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হবার সময়ে নিশ্চয়ই মূল রচনার প্রয়োজনীয় সংশোধন-পরিবর্ধন করা হয়েছিল—তার প্রমাণ প্রকাশিত পাঠেই রয়েছে—কিন্তু প্রাথমিক খসড়াটি খুব সম্ভব ১২৮৩ বঙ্গাব্দের শেষ ভাগেই সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য ফাল্গুন ১২৮৪ সংখ্যায় বাল্মীকির রামায়ণে ইন্দ্রজিতের সঙ্গে লক্ষ্মণের যুদ্ধবর্ণনার একটি দীর্ঘ অনুবাদ দিয়ে কোনোরকম মন্তব্য ছাড়াই যেভাবে প্রবন্ধটির ইতি ঘটেছে, তাতে সত্য সত্যই সেটি সমালোচকের ঈপ্সিত সমাপ্তি কিনা এ সংশয় প্রকাশ করার সংগত কারণ আছে।
রবীন্দ্ররচনার প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপি মালতীপুঁথি-র 41/২২ক পৃষ্ঠায় বাল্মীকি-রামায়ণের দুটি শ্লোকের এবং মধুসূদনের একটি ইংরেজি পত্রের অংশ ও এগুলির গদ্যানুবাদ দেখা যায়, যেগুলি এই ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রবন্ধের প্রথম কিস্তিতেই [শ্রাবণ ১২৮৪] ব্যবহৃত হয়েছে। পাণ্ডুলিপিতেই কিছু সংশোধনের চিহ্ন আছে, প্রবন্ধে গৃহীত হবার সময় আরও কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ-সম্পর্কে আলোচনায় অগ্রসর হবার আগে রচনাংশগুলি উদ্ধৃত করছি [তৃতীয় বন্ধনী-ধৃত অংশগুলি ভারতী-র পাঠ অবলম্বনে নির্মিত]†:
ক. ‘[স্ব]বল ক্ষয় এবং বিরূপাক্ষ বধ [শ্রবণে রাক্ষসেশ্বর] রাবণ দ্বি[গুণ ক্রোধে]/জ্বলিয়া উঠিলেন।’
খ. ‘অতঃপর হনু[মান] কর্তৃক কুমার অ[ক্ষ] নিহত হইলে/রাক্ষসাধিপতি মনঃসমাধান পূর্বক শোক সম্ব[রণ] করিয়া ইন্দ্রজিতকে রণে/যাত্রা করিতে আদেশ করিলেন।’
গ. ‘People here grumble and say that/the heart of the poet in “মেঘনাদ” is with the Rakshas!/And that is the real truth. I despise Ram and his ra[bble,]/but the idea of রাবণ elevates and kindles my imaginat[ion.]/He was a grand fellow.’
ঘ. ‘এখানকার লোকেরা অসন্তোষের সহিত বলিয়া থাকে যে,/ মেঘনাদবধ কাব্যে কবির মনের টান রাক্ষসদের প্রতি [!]/বাস্তবিক তাহাই বটে। আমি রাম এবং তাঁহার অনুচরদের ঘৃণা করি [,]/কিন্তু রাবণের চরিত্র চিন্তা করিলে আমার কল্পনা প্রজ্বলিত ও উন্নত/হইয়া উঠে। রাবণ লোকটা খুব জমকালো ছিল।’
প্রবোধচন্দ্র সেন উপরোদ্ধৃত অংশগুলি সম্পর্কে লিখেছেন : ‘এই অনুবাদটুকুর মধ্যে বালক রবীন্দ্রনাথের শুধু শিক্ষার ধারা নয়, তাঁর ভাষার অধিকার এবং প্রকাশভঙ্গির বৈশিষ্ট্যও পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। শুধু অনুবাদ নয়, এই অংশটুকুর ঠিক পূর্বেই মেঘনাদবধ কাব্যের একটু খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ আলোচনাও লক্ষিতব্য। সব মিলিয়ে এই অনুমান হয় যে, এই আলোচনা ও অনুবাদ ‘ঘরের পড়া’ যুগেরই (অর্থাৎ পূর্বোক্ত ১৮৭৩ সালের পরবর্তী কালেরই) কাজ।’১৬ শ্রী সেন মেঘনাদবধ কাব্যের আলোচনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেও আমাদের আলোচ্য প্রবন্ধটির সঙ্গে পাণ্ডুলিপির এই অংশটির সম্পর্ক তিনি সম্ভবত অনুধাবন করেননি। কিন্তু এই সম্পর্কটি এতই স্পষ্ট যে, এগুলিকে অনুবাদ-চর্চার নিদর্শন রূপে গ্রহণ করার কোনো কারণ থাকতে পারে না, উক্ত প্রবন্ধে ব্যবহার করার জন্যই এই অনুবাদগুলি করা হয়েছিল এরূপ সিদ্ধান্ত করাই যুক্তিযুক্ত, সুতরাং এই আলোচনা ও অনুবাদ অনির্দিষ্ট 1873-এর পরবর্তী ‘ঘরের পড়া’ যুগের কাজ নয়, নির্দিষ্টভাবেই 1877-এর প্রথম দিকে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সমালোচনা-প্রবন্ধ রচনার সমসাময়িক।
বাল্মীকি-রামায়ণের শ্লোকানুবাদ দুটির প্রসঙ্গ আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথ তুলনামূলক আলোচনার জন্য মূল রামায়ণ থেকে অংশবিশেষ বঙ্গানুবাদে উদ্ধার করেছেন, তার অনেকগুলিই ‘শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র ভট্টাচাৰ্য কর্তৃক অনুবাদিত রামায়ণ’ থেকে উদ্ধৃত। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য [বিদ্যারত্ন] আদি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন; আমাদের আলোচ্য পর্বে তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র সম্পাদক [এর আগেও তিনি ১২৭৪-৭৫ এই দু-বৎসরও সম্পাদক ছিলেন]। 1869 থেকে তিনি রামানুজের টীকাসহ সংস্কৃত মূল বাল্মীকি রামায়ণ ও বঙ্গানুবাদ ৬৪ পৃষ্ঠা পরিমিত খণ্ডে প্রকাশিত করতে থাকেন। এই গ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঋণ-স্বীকার করে আটটি ছোটো ও বড়ো উদ্ধৃতি তাঁর প্রবন্ধে ব্যবহার করেন। কিন্তু এগুলি ছাড়াও আরও কতকগুলি অনুবাদ প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে [যার মধ্যে উপরে উদ্ধৃত দুটি অনুবাদও আছে] যেগুলি রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত নিজেই অনুবাদ করেন, অবশ্য অন্যের বা স্বয়ং হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের সাহায্যও তিনি নিয়ে থাকতে পারেন এমন অনুমান করা অযৌক্তিক নয়। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রামায়ণ-অনুবাদের যে প্রকাশ-তালিকা দিয়েছেন,১৭ তাতে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের এই প্রবন্ধ রচনার পূর্বে বালকাণ্ড [1869-70], অযোধ্যাকাণ্ড [1870], আরণ্যকাণ্ড [1874] ও কিষ্কিন্ধাকাণ্ড [1875] প্রকাশিত হয়েছে—সুন্দরকাণ্ড [1878] ও যুদ্ধকাণ্ড [1878-80]-এর প্রকাশ-কাল এর পরবর্তী। এই তথ্য অনুসরণ করে দেখা যায়, ‘অযোধ্যাকাণ্ড’ থেকে যে-অংশ উদ্ধৃত হয়েছে সেগুলির পাদটীকায় হেমচন্দ্রের নাম উল্লিখিত এবং মূল রচনার সঙ্গে তাদের অবিকল সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু আরও যে-দুটি উদ্ধৃতির পাদটীকায় হেমচন্দ্রের নাম উল্লিখিত হয়েছে, তার একটি সুন্দর কাণ্ডের ৯ম সর্গ ও অপরটি যুদ্ধকাণ্ডের ৪র্থ সর্গের অন্তর্ভুক্ত। উপরের তালিকা অনুযায়ী এই খণ্ডদুটি তখনও প্রকাশিত হয়নি, অথচ বিশেষ করে যুদ্ধকাণ্ডের উদ্ধৃতিটির সঙ্গে মূল রচনার অবিকল সাদৃশ্য দেখা যায় ও উৎস-নির্দেশও যথাযথ। কিন্তু সুন্দরকাণ্ড থেকে উদ্ধৃতিটি যদিও হেমচন্দ্রের নাম-সংযুক্ত, কিন্তু রাবণের বাসগৃহের বর্ণনাটি সভাগৃহের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে এবং উদ্ধৃতিটিও অসম্পূর্ণ [সর্গ সংখ্যাও উল্লিখিত হয়নি]। অপরপক্ষে, সুন্দরকাণ্ড থেকে আর-একটি অংশ [মালতীপুঁথি-তে প্রাপ্ত ‘খ’ চিহ্নিত অনুবাদটি] ও যুদ্ধকাণ্ড থেকে ছোটো ও বড়ো অনেকগুলি অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের স্ব-কৃত, যেগুলির সঙ্গে হেমচন্দ্রের অনুবাদের পার্থক্য অনেকখানি। আরও লক্ষণীয় যে, এগুলির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ‘সর্গ’ শব্দটির জায়গায় ‘অধ্যায়’ শব্দটি পাদটীকায় ব্যবহার করেছেন এবং অধ্যায়ের যে-সংখ্যা নির্দেশ করেছেন তাতে মনে হয় তিনি অন্য কোনো সংস্কৃত-মূল অনুসরণেই অনুবাদগুলি করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধকাণ্ডের চতুর্থ সর্গ থেকে উদ্ধৃতিটি এবং তার যথাযথ মূল-নির্দেশ আমাদের সিদ্ধান্তটিকে দ্বিধান্বিত করে তোলে।
যাই হোক, এই আলোচনা থেকে একটি বিষয় আশা করি স্পষ্ট হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে বা অন্যত্র এই সমালোচনা-প্রবন্ধটিকে যতখানি তুচ্ছ করে দেখাবার প্রয়াস পেয়েছেন, রচনার পিছনের আয়োজনটি তত সামান্য ছিল না। মনে রাখতে হবে, মধুসূদনের অন্তরঙ্গ বন্ধুদের অন্যতম রাজনারায়ণ বসু, তত্ত্ববোধিনী-সম্পাদক হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, অক্ষয় চৌধুরী প্রমুখ বিদগ্ধ পণ্ডিতজনেরা রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। সুতরাং প্রবন্ধটি যদি শুধু বাল্যলীলার ‘উদ্ধত অবিনয়, অদ্ভূত আতিশয্য ও সাড়ম্বর কৃত্রিমতা’র নিদর্শনমাত্র হত, তাহলে তা নির্বিবাদে কয়েক মাস ধরে ভারতী-তে প্রকাশিত হতে পারত না [‘য়ুরোপ-যাত্রী কোন বঙ্গীয় যুবকের পত্র’-প্রসঙ্গে দ্বিজেন্দ্রনাথ-কৃত দীর্ঘ সম্পাদকীয় মন্তব্যগুলি এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয়]। আসলে সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের পল্লবগ্রাহী সমালোচনার যে রীতিতে প্রবন্ধটি লিখিত হয়েছিল, আমরা পরবর্তীকালে সেই রীতি থেকে অনেকখানি সরে এসেছি এবং তা প্রধানত রবীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত ভাবগ্রাহী সমালোচনার আদর্শেই। নতুবা মধুসূদনের কাব্য থেকেই রবীন্দ্রনাথ যে ‘অদ্ভুত আতিশয্য ও সাড়ম্বর কৃত্রিমতা’র দৃষ্টান্তগুলি তুলে ধরেছেন কিংবা নায়ক ও অন্যান্য চরিত্র-চিত্রণে যে অসংগতিগুলি দেখিয়েছেন—আজকের দিনেও সেগুলির যাথার্থ্য অস্বীকার করা যায় না। কয়েক বছর পরে ভাদ্র ১২৮৯ সংখ্যা ভারতী-তে [পৃ ২৩৪-৪০] ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নামক আর-একটি প্রবন্ধেও [সমালোচনা গ্রন্থে সংকলিত, দ্র রবীন্দ্র-রচনাবলী, অচলিত ২। ৭৫-৭৯] তিনি কাব্যটির প্রশংসা করেননি। পরের মাসে একই নামের একটি প্রবন্ধে [পৃ ২৬৫-৭২] জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে-মত প্রকাশ করেন তাকেও অনুকূল বলা চলে না। এমন-কি রাজনারায়ণ বসু তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা’ [১২৮৫, ৪ অগ্র ১২৮৩-তে পঠিত] গ্রন্থে মেঘনাদবধ-এর ‘বিকট বিকট প্রয়োগ’, রসভঙ্গ-দোষ, জাতীয় ভাব ও প্রাঞ্জলতার অভাব প্রভৃতি ত্রুটি নির্দেশ করে লেখেন : ‘মিল্টনে যেরূপ ভাবের গভীরতা, শব্দবিন্যাসে রাজ-গাম্ভীর্য্য ও রচনার জম্জমাট্ দৃষ্ট হয়, মাইকেলের কবিতাতে ততটা দৃষ্ট হয় না।‘ সুতরাং দেখা যাচ্ছে মধুসূদনের এই কাব্য সম্বন্ধে ভারতী-গোষ্ঠীর অনেকেরই মনোভাব প্রশংসামূলক ছিল না। তাই বাল্যকালে পাঠ্যপুস্তক-রূপে ‘মেঘনাদবধ’ পড়ার ফলেই রবীন্দ্রনাথের মনে এই কাব্য সম্বন্ধে বিরূপতা জন্মেছিল এবং সেই জন্যই তিনি এর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন—এ ব্যাখ্যা অনেকটা অতিসরলীকরণেরই প্রয়াসমাত্র। অবশ্য দীর্ঘকাল পরে ‘সাহিত্য-সৃষ্টি’ [সাহিত্য ৮। ৩৯৯-৪১৪; বঙ্গদর্শন, আষাঢ় ১৩১৪। ১১৩-২৬] প্রবন্ধে তিনি কাব্যটি সম্পর্কে সপ্রশংস মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু সেখানেও যেটি লক্ষ্য করবার বিষয় সেটি হল য়ুরোপ থেকে আগত নূতন ভাবের সংঘাতে রাম-কথার একটি বিশেষ বিবর্তন হিসেবেই রবীন্দ্রনাথ সেখানে মেঘনাদবধ কাব্য সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন, স্বতন্ত্রভাবে মধুসূদনের কবি-কৃতি তাঁর বিচার্য ছিল না।
ভারতী-র প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের অপর রচনাটি হল ‘ভিখারিণী’ নামক একটি গল্পের প্রথম তিনটি পরিচ্ছেদ। পরবর্তী সংখ্যায় আরও দুটি পরিচ্ছেদ প্রকাশিত হয়ে রচনাটি সমাপ্ত হয়। জীবনস্মৃতি-তে রবীন্দ্রনাথ গল্পটির প্রসঙ্গে কিছু লেখেননি, কিন্তু ছেলেবেলা-য় তিনি লিখেছেন : ‘আমার মতো ছেলে, যার না ছিল বিদ্যে, না ছিল সাধ্যি, সেও সেই বৈঠকে জায়গা জুড়ে বসল, অথচ সেটা কারও নজরে পড়ল না—এর থেকে জানা যায়, চার দিকে ছেলেমানুষি হাওয়ার যেন ঘুর লেগেছিল। দেশে একমাত্র পাকা হাতের কাগজ তখন দেখা দিয়েছিল বঙ্গদর্শন। আমাদের এ ছিল কাঁচাপাকা; বড়দাদা যা লিখছেন তা লেখাও যেমন শক্ত বোঝাও তেমনি, আর তারই মধ্যে আমি লিখে বসলুম এক গল্প—সেটা যে কী বকুনির বিনুনি নিজে তার যাচাই করবার বয়স ছিল না, বুঝে দেখবার চোখ যেন অন্যদেরও তেমন করে খোলে নি।’১৮ জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : ‘একটা যে ছোটো গল্প লিখিয়াছিলাম, তাহার কথা উল্লেখ করিতেও আমি কুণ্ঠিতবোধ করিতেছি।’ এই কুণ্ঠা-বশতই তিনি তাঁর কোনো গল্পসংগ্রহে এই গল্পটিকে স্থান দেননি। পরে ‘গল্পগুচ্ছ’ চতুর্থ খণ্ডে ও রবীন্দ্র-রচনাবলী ২৭শ খণ্ডে [পৃ ১০৩-১৬] গল্পটি গ্রন্থভুক্ত হয়েছে।
‘ভিখারিণী’র গল্পাংশ অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু পূর্ববর্তী কাহিনীমূলক রচনা বনফুল বা পরবর্তী কবি-কাহিনী-র সঙ্গে গভীর সাদৃশ্যযুক্ত। সবগুলিরই বিষয়বস্তু প্রেমের ব্যর্থ পরিণতি এবং প্রত্যেকটিরই ঘটনাস্থল হিমালয়ের পার্বত্য-অঞ্চল; এমন-কি বনফুল-এর মতো ‘ভিখারিণী’-তেও ‘শাখাদীপ’-প্রসঙ্গে পাদটীকায় লিখিত হয়েছে : ‘পার্বত্য লোক চীড়বৃক্ষের শাখা জ্বালাইয়া মশালের ন্যায় ব্যবহার করে’। পিতার সঙ্গে হিমালয়-ভ্রমণের বাস্তব অভিজ্ঞতা তিনটি কাহিনীরই পরিবেশ-রচনায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। গল্পটির ভাষাও লক্ষণীয়—ড সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন, ‘কাহিনী যতটা কাঁচা ভাষা ততটা নয়। (প্রথম হইতেই পদ্যের তুলনায় গদ্যে রবীন্দ্রনাথ বেশি দক্ষতা দেখাইয়াছিলেন।)’১৯
সমসাময়িক বহু পত্রিকায় ভারতী-র প্রথম সংখ্যাটির প্রাপ্তি স্বীকার করা হলেও সমালোচনা চোখে পড়ে সাধারণী-তে [৮। ১৮, ২৯ শ্রাবণ, পৃ ২১০] : ‘শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতী নামে মাসিক সমালোচনী পত্রিকা প্রকাশিত করিয়া আমাদিগকে আশ্বস্ত করিয়াছেন। খাস কলিকাতায় একখানি প্রথম শ্রেণীর সাময়িক পত্রের অভাব ইহাতে দূরীকৃত হইয়াছে। ভারতীর সম্যক সমালোচন এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে সম্ভবে না, তবে কেবল পরামর্শ স্বরূপ একটা কথা বলিতে প্রস্তুত আছি। ‘গঞ্জিকা’ প্রবন্ধে ভারতীর হাস্যরস প্রধান রচনার নমুনা আমরা পাইয়াছি। বলিতে কি, ইহা প্রথম শ্রেণীর পত্রের উপযুক্ত নহে; “সম্পাদকের বৈঠকও”—তথৈব চ।’
ভারতী-র দ্বিতীয় সংখ্যা [ভাদ্র ১২৮৪]-র সূচিপত্রটি নিম্নরূপ :
এই সংখ্যাতেও রবীন্দ্রনাথের তিনটি রচনা প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ও ‘ভিখারিণী’ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য পূর্বেই উপস্থাপিত হয়েছে। প্রসঙ্গত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘রামিয়াড্… রচনাটি সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলা দরকার। নামেই প্রকাশ যে এটি একটি ব্যঙ্গরচনা—রামায়ণ ও ইলিয়াড্ নাম দুটির মিশ্রণে ‘রামিয়াড্’ শব্দটি গঠিত হয়েছে—রামায়ণের কাহিনীর উনবিংশ শতাব্দীয় সংস্করণ কি রকম হতে পারে তারই একটি কৌতুকজনক রূপরেখা এই রচনাটিতে অঙ্কন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ধারণা, রচনাটি নিতান্তই কৌতুকের জন্য লেখা হয়নি, সম্ভবত কনিষ্ঠ ভ্রাতার মেঘনাদবধ কাব্য-সমালোচনার প্রতি একটি প্রচ্ছন্ন সমর্থন তাঁকে এটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমরা আগেও বলেছি, উক্ত সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ যে মতামত প্রকাশ করেছিলেন, তা একান্তই তাঁর নিজস্ব মত ছিল না, ভারতী-গোষ্ঠীর অনেকেই তার সমর্থক ছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘রামিয়াড্…’ রচনাটিকে দেখা উচিত।
‘হিমালয়’ কবিতাটি অ-স্বাক্ষরিত, এর কথা রবীন্দ্রনাথ কোথাও বলেননি, আজ পর্যন্ত তাঁর কোনো রচনা-সংগ্রহেই কবিতাটি স্থান পায়নি। সজনীকান্ত দাস অবশ্য শনিবারের চিঠি-তে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্র-রচনাপঞ্জী’তে কবিতাটিকে তালিকাভুক্ত করেছেন এবং লিখেছেন : ‘এই তালিকাধৃত রচনাগুলিকে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং একটি দলিলে স্বীকৃতি দিয়াছেন।‘ তবু এ-সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হবার জন্য যে প্রমাণের প্রয়োজন ছিল, সেটি মালতীপুঁথি থেকে চিত্তরঞ্জন দেব সংগ্রহ করে দিয়েছেন। ঐ পাণ্ডুলিপির 40/২১খ পৃষ্ঠায় ‘হিমালয়’ কবিতার ৩৭-৫২ সংখ্যক ছত্রগুলির প্রাথমিক রূপটির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিন্তু এর ফলে একটি সমস্যার সমাধান হলেও, আরও কয়েকটি জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। পাণ্ডুলিপির উক্ত পৃষ্ঠাটির অপর পিঠে অথাৎ 39/২১ পৃষ্ঠায় ‘নূতন উষা’ শিরোনাম-যুক্ত [শিরোনামটি তিনি পরে বর্জন করেছিলেন কিনা, পাণ্ডুলিপি থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায় না] একটি কবিতার—[সং]সারের পথে পথে, মরীচিকা অন্বেষিয়া/ভ্রমিয়া হয়েছি ক্লান্ত নিদারুণ কোলাহলে,’ ইত্যাদি—সন্ধান মেলে, যেটি ভাব-ভাষা ও ছন্দের দিক দিয়ে ‘হিমালয়’ কবিতার শেষ ষোলোটি ছত্রের সঙ্গে গভীর সাদৃশ্য-যুক্ত; এমন-কি ‘নূতন উষা’ নামাঙ্কিত পৃষ্ঠাটির ১৪শ ছত্রটি—’নূতন প্রেমের রাজ্যে পুন আঁখি মেলিব’–40/২১খ পৃষ্ঠার ২য় ছত্র ‘নূতন নূতন রাজ্যে মনোসুখে খেলিব’-র পরিবর্তে ‘হিমালয়’ কবিতায় গৃহীত হয়েছে ৩৮শ ছত্র হিসেবে। এর থেকে মনে হয়, উভয় পৃষ্ঠায় লিখিত অংশ দুটি একটি ভাবসূত্রে গ্রথিত সম্পূর্ণ কবিতা রূপেই লিখিত হয়েছিল। পরে নতুন ভাবনার স্রোতে আরও ছত্রিশটি ছত্র লিখিত হলে তার সঙ্গে এই ষোলটি ছত্র যুক্ত হয়ে ‘হিমালয়’ কবিতার রূপ পরিগ্রহ করেছে। কিন্তু 39/২১ পৃষ্ঠায় লিখিত অংশটি সম্পূর্ণ বর্জিত হয়নি—এর প্রথম আটটি ও ১১-১২শ ছত্র কিছু কিছু পরিবর্তন-সহ ‘ভগ্নহৃদয় কাব্যের ঊনত্রিংশ সর্গে ললিতা-র উক্তি রূপে ব্যবহৃত হয়েছে [দ্র অচলিত ১। ২৫৯]—সেখানে অবশ্য অতিরিক্ত আরও ষোলোটি ছত্র যোগ করা হয়েছে। মালতীপুঁথি-তে প্রাপ্ত কবিতাটি ঠিক কবে লিখিত হয়েছিল নিশ্চিত করে বলা না গেলেও ১২৮৪ বঙ্গাব্দের বৈশাখ-শ্রাবণ মাসের কোনো সময়ে লেখা বলে অনুমান করা যায়। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ যদিও লিখেছেন : ‘বিলাতে আর-একটি কাব্যের পত্তন হইয়াছিল। কতকটা ফিরিবার পথে কতকটা দেশে ফিরিয়া আসিয়া ইহা সমাধা করি। ভগ্নহৃদয় নামে ইহা ছাপানো হইয়াছিল’,২০ কিন্তু কাব্যটির গোড়াপত্তন যে তার অনেক আগে—১২৮৪ বঙ্গাব্দের শুরুতেই—ঘটেছিল এই অংশটিই তার প্রমাণ। প্রকৃতপক্ষে ভগ্নহৃদয় কাব্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কবি-মানসের যে রূপটি দেখা যায়, সেটি তাঁর বয়ঃসন্ধিকালের মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। যদিও কাব্যটি সম্পূর্ণ রূপ লাভ করেছে। অনেক পরে [কার্তিক ১২৮৭ : Nov 1880 সংখ্যা থেকে ভারতী-তে প্রকাশিত হতে শুরু করে, গ্রন্থাকারে প্রকাশ : May 1881], কিন্তু মালতীপুঁথি-র বিভিন্ন পৃষ্ঠায় এর অনেক অংশই স্বতন্ত্র কবিতা বা গানের আকারে দেখতে পাওয়া যায়, যে-গুলির রচনাকাল সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ-কথিত সময়ের অনেক পূর্ববর্তী। ভগ্নহৃদয়-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন, তা আমরা যথাস্থানে আলোচনা করব, কিন্তু ভারতী-র প্রথম পর্বের কবিতাগুলি—যার মধ্যে ‘হিমালয়’ ‘নূতন উষা’ এবং কিয়ৎপরিমাণে ভগ্নহৃদয়-ও পড়ে—রচনার সময়ে তাঁর মানসিক অবস্থাটি কেমন ছিল তা আমরা বুঝে নিতে পারি তাঁরই একটি উক্তি থেকে:
মোটের উপর এই সময়টা আমার পক্ষে একটা উম্মত্ততার সময় ছিল। কতদিন ইচ্ছা করিয়াই, না ঘুমাইয়া রাত কাটাইয়াছি। তাহার যে কোনো প্রয়োজন ছিল তাহা নহে কিন্তু বোধকরি রাত্রে ঘুমানোটাই সহজ ব্যাপার বলিয়াই, সেটা উলটাইয়া দিবার প্রবৃত্তি হইত।…কত গ্রীষ্মের গভীর রাত্রে, তেতালার ছাদে সারিসারি টবের বড়ো বড়ো গাছগুলির ছায়াপাতের দ্বারা বিচিত্র চাঁদের আলোতে, একলা প্রেতের মতো বিনা কারণে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছি।
কেহ যদি মনে করেন, এ-সমস্তই কেবল কবিয়ানা, তাহা হইলে ভুল করিবেন। পৃথিবীর একটা বয়স ছিল যখন তাহার ঘন ঘন ভূমিকম্প ও অগ্নি-উচ্ছাসের সময়। এখনকার প্রবীণ পৃথিবীতেও মাঝে মাঝে সেরূপ চাপল্যের লক্ষণ দেখা দেয়, তখন লোকে আশ্চর্য হইয়া যায়; কিন্তু প্রথম বয়সে যখন তাহার আবরণ এত কঠিন ছিল না এবং ভিতরকার বাষ্প ছিল অনেক বেশি, তখন সদাসর্বদাই অভাবনীয় উৎপাতের তাণ্ডব চলিত। তরুণবয়সের আরম্ভে এও সেইরকমের একটা কাণ্ড। যে-সব উপকরণে জীবন গড়া হয়, যতক্ষণ গড়াটা বেশ পাকা না হয়, ততক্ষণ সেই উপকরণগুলাই হাঙ্গামা করিতে থাকে।২১
প্রথম বর্ষের ভারতী-তে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি কবিতাতেই এই মানসিকতার ছায়াপাত ঘটেছে।
আমরা মালতীপুঁথি-তে লিখিত ‘নূতন উষা’ নামে যে কবিতাটির কথা উপরে উল্লেখ করেছি, পাণ্ডুলিপির সেই পৃষ্ঠাতেই মূল রচনার ডান পাশে কতকগুলি বিচ্ছিন্ন পদ্য-পঙ্ক্তি, কয়েকটি চিত্রকলার নিদর্শন, ইংরেজিতে নিজের নাম-স্বাক্ষর, কয়েকবার D.N. Tagore [ দেবেন্দ্রনাথ না দ্বিজেন্দ্রনাথ?] নামটি লেখা ছাড়া ‘Hecate Thacroon’ কথাটি অন্তত তিনবার লিখিত হয়েছে। আমরা জানি, অন্তরঙ্গ মহলে কাদম্বরী দেবী ‘হেকেটি নামে অভিহিত হতেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : “কাদম্বরী দেবীর নারীহৃদয় ত্রিবেণীসংগম ক্ষেত্র ছিল। কবি বিহারীলালকে শ্রদ্ধা, স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রকে প্রীতি ও দেবর রবীন্দ্রনাথকে স্নেহদ্বারা তিনি আপনার করিয়া রাখিয়াছিলেন। সেইজন্য অন্তরঙ্গ আত্মীয়রা বলিতেন ত্রিমুণ্ডী ‘হেকেটি’।”২২ কাদম্বরী দেবী বিহারীলালের কবিতার একজন ভক্ত-পাঠিকা ছিলেন এ-কথা রবীন্দ্রনাথই আমাদের জানিয়েছেন—কিন্তু পূর্বের আলোচনাতেই দেখেছি, বিহারীলালের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পরিচয় ১২৮৪ বঙ্গাব্দের শেষ দিকের ঘটনা ও ‘নূতন উষা’ কবিতার রচনাকাল শ্রাবণ ১২৮৪-র পরে নয়। সুতরাং কাদম্বরী দেবীর ‘হেকেটি’ নামকরণের সঙ্গে বিহারীলালকে যুক্ত করা সম্ভবত কষ্টকল্পনার পর্যায়ে পড়ে। তাই আমাদের পূর্ব-কথিত বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করে বলতে হয়, ত্রিমুণ্ডী দেবী হেকেটি থেকে নয়, ম্যাকবেথ নাটকের ডাইনী-প্রধানা হেকেটির সূত্রেই কাদম্বরী দেবীর উক্ত নামকরণ এবং সম্ভবত দেবর-বৌদির ঠাট্টার সম্পর্ক থেকেই তিনি উক্ত অভিধা লাভ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে এমন কথাও ভাবা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের ‘ভানু’ নাম হয়তো কাদম্বরী দেবীরই দেওয়া। তাঁর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ‘পুষ্পাঞ্জলি’ নামে যে রচনা লিখেছিলেন, তাতে আছে : ‘আমাকে যাহারা চেনে সকলেই তো আমার নাম ধরিয়া ডাকে, কিন্তু সকলেই কিছু একই ব্যক্তিকে ডাকে না, এবং সকলকেই কিছু একই ব্যক্তি সাড়া দেয় না। এক-একজনে আমার এক-একটা অংশকে ডাকে মাত্র, আমাকে তাহারা ততটুকু বলিয়াই জানে। এইজন্য আমরা যাহাকে ভালোবাসি তাহার একটা নূতন নামকরণ করিতে চাই; কারণ সকলের সে ও আমার-সে বিস্তর প্রভেদ।’২৩—সম্ভবত এই অংশের মধ্যে উক্ত নামকরণের ইতিহাসটি প্রচ্ছন্ন রয়েছে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী—পরমাত্মীয় এই দম্পতির সঙ্গে কিশোর রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত, আমরাও এই প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা আগেই করেছি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই হাওয়া বদল করতে যেতেন গঙ্গার ধারের বাগানে—শ্রীরামপুরের কাছে চাঁপদানিতে ঠাকুরপরিবারের একটি নিজস্ব বাগানই ছিল। বর্তমান বৎসরেও বায়ু-পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স-স্ত্রীক সম্ভবত গঙ্গার ধারে কোনো বাগানে কিছুদিন অবস্থান করেন—রবীন্দ্রনাথও তাঁদের সঙ্গী হন।
১২৮৪ বঙ্গাব্দের ক্যাশবহি-টি যদি কালের গর্ভে লুপ্ত না হত, তাহলে আমরা এই গঙ্গাতীর-বাস সম্পর্কে সম্ভবত কিছু বিস্তৃত খবর দিতে পারতাম। তার অভাবে অনেকটাই অনুমানের আশ্রয় নিতে হবে। এ-সম্বন্ধে একটি অপেক্ষাকৃত নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় মালতীপুঁথি-তে; এর 54/২৮খ পৃষ্ঠায় ‘শৈশব সঙ্গীত’ শীর্ষনাম-যুক্ত একটি কবিতার উপরে লেখা আছে : ‘বোটে লিখিয়াছি—মঙ্গলবার/২৪ আশ্বিন/ ১৮৭৭’—খ্রিস্টীয় পঞ্জিকা-অনুযায়ী তারিখটি হল 9 Oct [এইটিই রবীন্দ্রনাথের স্থান ও সন-তারিখ-যুক্ত প্রথম কবিতা; লক্ষণীয়, বাংলা তারিখের সঙ্গে ইংরেজি সাল ব্যবহৃত হয়েছে—এই অভ্যাসটি তিনি পরবর্তীকালেও রক্ষা করেছেন]। সম্ভবত, গঙ্গাতীরবর্তী উক্ত বাগান থেকে বোটে কলকাতায় ফেরার সময়ে কবিতাটি লেখা। পরবর্তী ১ কার্তিক [মঙ্গল 16 Oct]-এর মধ্যে তিনি জোড়াসাঁকোয় ফিরে এসেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় মালতীপুঁথি-তেই 57/৩০ক পৃষ্ঠায়—এই তারিখ দিয়ে তিনি ঐ দিন ‘বাড়িতে’ ‘কবি-কাহিনী’ রচনা শুরু করেছিলেন। ‘বাড়িতে’ শব্দটি লেখার বিশেষ দরকার হয়ে পড়েছিল তার আগে বাড়ির বাইরে ছিলেন বলেই।
‘শৈশব সঙ্গীত’ ও মালতীপুঁথি-র আরও কয়েকটি কবিতা নিয়ে আলোচনা করার আগে আশ্বিন সংখ্যা [১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা] ভারতী-র সূচিপত্রটি একবার দেখে নেওয়া যাক:
৯৭-১০৩ | ‘তত্ত্বজ্ঞান কতদূর প্রামাণিক’: [দ্বিজেন্দ্রনাথ] |
১০৩-১১ | ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ : ‘তঃ—’ [‘ভঃ—’; রবীন্দ্রনাথ] দ্র র°র°১৫ [শতবার্ষিক সং]। ১২৫-৩৩ |
১১১-১৩ | ‘আগমনী’ [কবিতা] : [? রবীন্দ্রনাথ] |
১১৩-২০ | ‘কুমারপাল’ : রামদাস সেন |
১২০-৩৫ | ‘জ্ঞান, নীতি ও ইংরাজি সভ্যতা’ : ‘সূঃ’ [সঃ; সত্যেন্দ্রনাথ] |
১৩৫ | ‘ভানুসিংহের কবিতা’ : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ২। ১৮-১৯ [১৩ নং] |
১৩৬-৩৭ | ‘উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে’ : ‘বঃ—’ [রাজনারায়ণ বসু] |
১৩৮-৪৪ | ‘করুণা।/ভূমিকা [১৩৮-৪০] ও প্রথম পরিচ্ছেদ [১৪০-৪৪] : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র করুণা ২৭। ১১৭-২৪ |
১৪৪ | ‘উৎসর্গ-গীতি’ [‘তোমারি তরে মা সঁপিনু দেহ’] : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র গীতবিতান ৩। ৮১৯ |
এই তালিকার মধ্যে ‘মেঘনাদ-বধ কাব্য’ ও ‘উৎসর্গ-গীতি’ সম্বন্ধে আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। ‘আগমনী’ [‘সুধীরে নিশার আঁধার ভেদিয়া/ফুটিল প্রভাত তারা’] কবিতাটি সজনীকান্ত দাসের তালিকায় থাকলেও রবীন্দ্রনাথ এটি সম্পর্কে কোথাও উল্লেখ করেননি কিংবা আজ পর্যন্ত তাঁর কোনো কাব্য-সংগ্রহে গৃহীত হয়নি। ড সুকুমার সেন লিখেছেন : ‘কবিতাটির সম্বন্ধে কোন সংশয়ই নাই। ইহার আরম্ভ, “সুধীরে নিশায় [নিশার] আঁধার ভেদিয়া।” রবীন্দ্রনাথের মধ্য-কৈশোরক কালের রচনায় “সুধীরে” শব্দের প্রয়োগ একটি বিশিষ্ট লক্ষণ।’২৪ ড সেন-কথিত এই লক্ষণটি ও বঙ্গসুন্দরী-র ছন্দের অনুবর্তন ছাড়া কবিতাটির মধ্যে আর এমন কোনো বৈশিষ্ট্যের সন্ধান মেলে না, যাতে এটিকে নিশ্চিতভাবে রবীন্দ্রনাথের বলে চিহ্নিত করা যায়। রামপ্রসাদ-কমলাকান্ত ও কবিওয়ালাদের রচিত আগমনী গানের স্পষ্ট প্রভাব কবিতাটিতে লক্ষিত হয়। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে ব্যাপক পরিচয় ও অক্ষয় চৌধুরীর এই ধরনের রচনায় আসক্তির ফলে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই উমা-মেনকা কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, সুতরাং দুর্গাপূজার মাসে প্রকাশিত পত্রিকার জন্য এইরকম একটি ফরমায়েশি কবিতা লেখা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু এ-ব্যাপারে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত করাও কঠিন।
‘ভানুসিংহের কবিতা’ প্রকাশের সূচনা এই মাসেই, এরপর কেবল কার্তিক সংখ্যা ছাড়া বৈশাখ ১২৮৫ পর্যন্ত ভারতী-র পরবর্তী প্রত্যেকটি সংখ্যায় এবং পরেও মাঝে মাঝে এই শিরোনামে কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান কবিতাটি প্রথম প্রকাশের সময়ই শিরোনামের নীচে সুর-নির্দেশ করা হয়েছে ‘মল্লার’ বলে এবং পাদটীকায় লিখিত হয় : ‘এই ব্রজ-গাথাগুলি হিন্দুস্থানী উচ্চারণে ও দীর্ঘ হ্রস্ব রক্ষা করিয়া সংস্কৃত ছন্দের নিয়মানুসারে না পড়িলে শ্রুতি-মধুর হয় না—প্রত্যুত হাস্য-জনক হইয়া পড়ে।‘ এ-ছাড়া কয়েকটি অপ্রচলিত শব্দের অর্থও পাদটীকায় প্রদত্ত হয়েছিল। বর্তমানে রবীন্দ্র-রচনাবলীতে [২। ১৮-১৯] ও গীতবিতানে [২। ৪৪০] পদটিকে যে-আকারে ও রূপে পাওয়া যায়—‘শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা’—ভারতী-তে তার আকার [৪টি ছত্র অতিরিক্ত] ও রূপ [প্রথম পঙক্তিটি ‘সজনী গো—/অঁধার রজনী ঘোর ঘনঘটা’] দুই-ই স্বতন্ত্র। ভারতী-তে প্রকাশিত হবার পর বিভিন্ন সংস্করণে কত বিচিত্র পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পদটি বর্তমান আকার ধারণ করেছে, আগ্রহী পাঠক ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী-র ‘পাঠান্তর-সংবলিত সংস্করণ’-এ [আশ্বিন ১৩৭৬] তার পরিচয় লাভ করতে পারবেন।
পদটি ১২৮৩ বঙ্গাব্দের কোনো সময়ে লেখা—আমরা আগেই সঞ্জীবনী সভা-প্রসঙ্গে জানিয়েছি গঙ্গার ধারে রাজনারায়ণ বসু-সহ সভার সদস্যেরা “‘আজি উন্মাদ পবনে’ বলিয়া রবীন্দ্রনাথের নবরচিত গান” গেয়েছিলেন, সেটি ১২৮৩ সালেরই ঘটনা। সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত কাব্য গ্রন্থাবলী-র [১৩০৩] ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘ভানুসিংহের অনেকগুলি কবিতা লেখকের ১৫। ১৬ বৎসর বয়সের লেখা—আবার তাহার মধ্যে গুটিকতক পরবর্তীকালের লেখাও আছে’—এটি তারই প্রথম পর্যায়ভুক্ত।
ভারতী-র প্রথম দুটি সংখ্যায় ‘ভিখারিণী গল্প দিয়ে রবীন্দ্রনাথ গদ্য-কাহিনী রচনার সূত্রপাত করেছিলেন। বর্তমান সংখ্যা থেকে দীর্ঘতর কাহিনী রচনার সূচনা হল ‘করুণা’ দিয়ে। শরৎকুমারী চৌধুরানী লিখেছেন : ‘ছোট গল্প প্রথমে যেটি প্রকাশিত হয়, তাহা রবিবাবুর, পরে তাঁহার একটি গল্প ধারাবাহিকরূপে বাহির হইতে থাকে।’২৫ এই গল্পটি ‘করুণা’। জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে অন্য এক প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ রচনাটির কথা উল্লেখ করেছেন : “এই সকল বই [জামাই-বারিক ইত্যাদি] পড়িয়া জ্ঞানের দিক হইতে আমার যে অকাল পরিণতি হইয়াছিল, বাংলা গ্রাম্য ভাষায় তাহাকে বলে জ্যাঠামি;—প্রথম বৎসরের ভারতীতে প্রকাশিত আমার বাল্যরচনা “করুণা” নামক গল্প তাহার নমুনা।’২৬ মাঘ ১২৮৪ ও আষাঢ় ১২৮৫ সংখ্যা ছাড়া ভাদ্র ১২৮৫ সংখ্যা পর্যন্ত ভারতী-তে কাহিনীটির ২৭টি পরিচ্ছেদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। রচনাটি সম্পর্কে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন : ‘আশ্বিন [১২৮৫] মাসে বিলাত যাত্রা করায় বইটি সম্পূর্ণ হয় নাই বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। উপন্যাস-রচনা বিষয়ে কবির পরবর্তী জীবনের অভ্যাস দেখিয়া মনে হয় তিনি ‘করুণা’ মাসে মাসে লিখিয়া পত্রিকায় দিতেছিলেন। সমগ্র বইখানি একসঙ্গে লেখেন নাই।’২৭ পরে অবশ্য তিনি এই মত পরিবর্তন করেছেন : “করুণা’ উপন্যাস সম্পূর্ণ হয় নাই—এ কথা ঠিক নয়। কাহিনীটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। ক্ষুদ্র উপন্যাসটি কিস্তিতে কিস্তিতে লেখা কি না বলা যায় না।”২৮ সজনীকান্ত দাস, ড সুকুমার সেন ও আরো অনেকে কাহিনীটি অসমাপ্ত বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ড জ্যোতির্ময় ঘোষ তাঁর ‘রবীন্দ্র উপন্যাসের প্রথম পর্যায়’ [1969] নামক গবেষণা-গ্রন্থে ‘করুণা’ যে সম্পূর্ণ হয়েছিল তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন। এ-বিষয়ে আমাদেরও দ্বিমত নেই।
অল্পবয়সের অনেক রচনার মতো ‘করুণা’-ও রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে গ্রন্থভুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেনি। দীর্ঘকাল পরে গল্পগুচ্ছ চতুর্থ খণ্ড [১৩৭০] ও রবীন্দ্র-রচনাবলীর সপ্তবিংশ খণ্ডে [পৃ ১১৭-৮৪] উপন্যাসটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অন্তত একবার রচনাটি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন, তার প্রমাণ আছে। ১৭ আশ্বিন ১২৯১ [2 Oct 1884] তারিখে রবীন্দ্রনাথকে লিখিত একটি দীর্ঘ পত্রে২৯ চন্দ্রনাথ বসু ‘করুণা’ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেন। পত্রটি থেকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ চন্দ্রনাথ বসুর কাছে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ভারতী-র দুটি খণ্ড পাঠিয়ে দিয়ে কাহিনীটি সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চান, হয়তো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা বিষয়েও তাঁর অভিমত প্রার্থনা করেছিলেন। চন্দ্রনাথ কাহিনীটির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে দোষ ও গুণ দুই-ই দেখিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘গল্পটি পুস্তকাকারে ছাপান আবশ্যক’। তা-সত্ত্বেও এটি কেন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি তা বলা শক্ত।
সাহিত্য-আলোচনা আমাদের লক্ষ্যের বহির্ভূত বলে কাহিনীটির সাহিত্যিক গুণাগুণ নিয়ে আমরা আলোচনা করব না। কিন্তু তথ্যের দিক থেকে যেটি লক্ষণীয় সেটি হল যে, রবীন্দ্রনাথ কবিতায় যে-সময়ে ‘নিজের অপরিস্ফুটতার ছায়ামূর্তিকেই খুব বড়ো’ করে দেখে প্রেম ও নৈরাশ্যের এক ভাবালু স্বপ্নময় জগতে পরিভ্রমণরত, গদ্যে সেই সময়ে তিনি বাস্তবের অনেক কাছাকাছি এসে জীবন ও মনের রহস্যকে ধরবার চেষ্টা করেছেন। এর কারণও আছে। কাব্যে মধুসূদনের আদর্শকে তিনি গ্রহণযোগ্য মনে করেননি, হেমচন্দ্রের বৃত্রসংহার তাঁর ভালো লাগলেও সেই পথ তাঁর কবিস্বভাবের পক্ষে অনুকরণীয় ছিল না; বিহারীলালের রচনাদর্শ তাঁকে প্রভাবিত করেছিল বটে, কিন্তু তাঁর আত্মবিকাশের পক্ষে তা যথেষ্ট ছিল না। সুতরাং কবিতার বিষয়ে ও প্রকাশভঙ্গিতে বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিজের পথ তাঁকে নিজেই খুঁজে নিতে হয়েছে। কিন্তু গদ্যে—বিশেষ করে কাহিনী চিত্রণে—বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র, তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতির উপন্যাস ও দীনবন্ধুর নাটকসমূহের দ্বারা বাস্তব জীবনকে সাহিত্যে রূপ দেবার আদর্শ মোটামুটি রবীন্দ্রনাথের পূর্বেই বাংলা সাহিত্যে গড়ে উঠেছে, বাংলা গদ্যের প্রকাশক্ষমতাও তখন যথেষ্ট। সুতরাং গদ্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এই অল্পবয়সে যে-ধরনের পরিণতি অর্জন করেছেন, কবিতার ক্ষেত্রে সেই সিদ্ধি এত তাড়াতাড়ি তাঁর আয়ত্তে আসেনি। রবীন্দ্রসাহিত্যে করুণা-র গুরুত্ব প্রধানত এই দিক থেকেই। আরও লক্ষণীয়, সংলাপ রচনায় রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন রীতি অনুযায়ী প্রধানত সাধুভাষা ব্যবহার করলেও কোথাও কোথাও তাঁর অজ্ঞাতসারেই চলিত ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে।
‘করুণা’ রচনার সূত্রপাত সম্ভবত ভাদ্র মাসে ‘ভিখারিণী’ গল্পটি সম্পূর্ণ প্রকাশিত হওয়ার পরেই। আমাদের ধারণা, রবীন্দ্রনাথ কাহিনীটি একসঙ্গে লিখে শেষ করেননি, পরবর্তী কালের অভ্যাস-মতোই প্রতিটি সংখ্যার জন্য কয়েকটি করে পরিচ্ছেদ রচনা করেছিলেন। এটি আন্দাজ করা যায় একটি হিসাব থেকে—প্রথম পাঁচটি সংখ্যায় যেখানে ভূমিকা-সহ মাত্র ১১টি পরিচ্ছেদ ছাপা হয়েছে, [রবীন্দ্র-রচনাবলীতে মোটামুটি ৩০ পৃষ্ঠা], চৈত্র থেকে ভাদ্র মাসের মধ্যে পাঁচটি সংখ্যায় সেখানে প্রকাশিত পরিচ্ছেদ-সংখ্যা ১৭টি [৩৮ পৃষ্ঠা]—শুধু ভাদ্র সংখ্যাতেই ৫টি পরিচ্ছেদ মুদ্রিত হয়েছিল। এ-প্রসঙ্গে কয়েকটি তথ্য মনে রাখা দরকার যে, ফাঙ্গুন মাসের শেষেই রবীন্দ্রনাথের বিলাত-যাত্রার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গিয়েছিল এবং ৫ আশ্বিন ১২৮৫ তিনি ইংলণ্ডের উদ্দেশে বোম্বাই থেকে জাহাজে চড়েছিলেন। যাত্রার আগেই যাতে রচনাটি সমাপ্ত হয়ে যেতে পারে, সেই কারণেই শেষের দিকে তিনি অপেক্ষাকৃত দ্রুতবেগে লেখনী চালনা করেছিলেন, এমন মনে করা ভুল হবে না।
এইবার ফিরে যাওয়া যাক মালতীপুঁথি-র ‘শৈশব সঙ্গীত’ কবিতার প্রসঙ্গে। আগেই বলা হয়েছে পাণ্ডুলিপির 54/২৮খ চিহ্নিত পৃষ্ঠায় কবিতাটি লেখা শুরু হয়—শীর্ষনামের পাশেই লেখা : ‘বোটে লিখিয়াছি—মঙ্গলবার/২৩ আশ্বিন ১৮৭৭’, আমরা বলেছি সম্ভবত গঙ্গাতীরের বাগান [? চন্দননগর] থেকে বোটে কলকাতা ফেরার পথেই তিনি এটি রচনা করেন। এই পৃষ্ঠাটির অপর পিঠ অথাৎ 54/২৮ক পৃষ্ঠায় একটি প্ল্যানচেট আসরের বিবরণ আছে, সেটি নিশ্চয়ই অনেক পরে লেখা; কারণ এর শেষ লাইনটি ‘গুণদাদাকে এনেই তুমি যাবে কি?’—অবশ্যই গুণেন্দ্রনাথের মৃত্যুর [২২ জ্যৈষ্ঠ ১২৮৮ শুক্র 3 Jun 1881] পরবর্তী কোনো সময়কেই নির্দেশ করে। সুতরাং আমাদের আলোচ্য সময়ে পৃষ্ঠাটি সাদাই থেকে গিয়েছিল। ‘শৈশব সঙ্গীত’ কবিতাটির উপরের অংশে কিছু কিছু লেখা দেখা যায়—তার মধ্যে ‘R N Tagore’ স্বাক্ষর কয়েকটি, ‘D N Tagore’ লেখা একবার, কবিতাটির-ই কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ছত্র বা তার অংশ ছাড়াও ‘Grand fellow Raban’ ও ‘Rabana was a Grand fellow’ কথাগুলি লিখিত হয়েছে। ‘মেঘনাদ-বধ কাব্য’ প্রবন্ধটিও হয়তো কিস্তিতে কিস্তিতে লিখে ভারতী-তে প্রেরিত হচ্ছিল, এটি তার একটি প্রমাণ-স্বরূপ গণ্য হতে পারে; প্রবন্ধটির তিনটি কিস্তি প্রকাশিত হয়ে যাবার পরেও বিষয়টি তখনও তাঁর মন অধিকার করে রেখেছিল, অসতর্কভাবে লেখা এই দুটি বাক্য বা বাক্যাংশ তার চিহ্ন বহন করছে।
[মালতীপুঁথি-র উল্লিখিত পৃষ্ঠার উপরাংশে এই হিজিবিজি লেখা আমাদের কাছে কিছু সমস্যাও সৃষ্টি করেছে। কালিতে লেখা নানা বাক্য ও বাক্যাংশের অন্তরালে পেনসিলে অপেক্ষাকৃত পরিণত হস্তাক্ষরে লেখা চারটি ছত্রের আভাস পাওয়া যায়। এর বেশির ভাগই পড়া যায় না, শুধু প্রথম ছত্রে ‘শোন গো’, তৃতীয় ছত্রে ‘শ্যামল সলিল আরসী মাঝারে’ এবং শেষ ছত্রে ‘নলিনী’ শব্দটি পড়া যায়। সন্দেহ হয়, ছত্রগুলি ‘শুন নলিনী মেল গো আঁখি’ গানটির খসড়ার অংশ—হস্তাক্ষর অনেকটা 14/৭খ ও 27/১৫ক পৃষ্ঠায় লেখা ‘বল বল দেখি লো,/নিরদয় লাজ তোর টুটিবে কি লো?’ গানটির মতো। এই গানটি সম্ভবত আমেদাবাদ বা বোম্বাই অবস্থানকালে রচিত—‘শুন নলিনী’ গানটিও তাই। কিন্তু গানের ছত্র চারটি এই পৃষ্ঠাতেই লেখা হল কেন বোঝা মুশকিল। চেষ্টা করলে লেখাটির উপর ‘Turkhud’ শব্দটিও পড়া যায়।]
‘শৈশব সঙ্গীত’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের সমকালীন মানসিকতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ-প্রকৃতির পরিবেশে কল্পনাকে সাথী করে যে সুখের জীবন কবি কাটিয়েছেন, বর্তমানের দুঃখজ্বালা সেই অতীত সুখকে এক দারুণ দুরাশাময় ভবিষ্যতের গর্ভে নিক্ষেপ করছে, এইটিই কবিতার মর্মকথা। অনেক দিন আগে লেখা মালতীপুঁথির-ই ‘প্রথম সর্গ’ শীর্ষক কবিতাটির সঙ্গে ‘শৈশব সঙ্গীত’-এর কয়েকটি বিস্ময়কর সাদৃশ্য দেখা যায়—সেখানকার কয়েকটি পঙ্ক্তি এখানে যেন নূতন রূপ পরিগ্রহ করেছে। ‘প্রথম সর্গ’তে আছে :
দরিদ্র গ্রামের সেই ভাঙ্গাচোরা পথ,
গৃহস্থের ছোটখাট নিভৃত কুটীর
যেখানে কোথা বা আছে, তৃণ রাশি রাশি
কোথা বা গাছের তলে বাঁধা আছে গাভী
অযত্নে চিবায় কভু গাছের পল্লব
—‘শৈশব সঙ্গীত’-এ চিত্রটি এইভাবে অঙ্কিত হয়েছে :
ভাঙ্গা চোরা বেড়াগুলি, উঠেছে লতিকা তায়
ফুল ফুটি করিয়াছে আলা!
ওদিকে পড়িয়া মাঠ, দূরে দুচারিটি গরু
চিবায় নবীন তৃণদল।
কেহ বা গাছের ছায়ে, কেহ বা খালের ধারে
পান করে সুশীতল জল।
‘প্রথম সর্গ’ শীর্ষক কবিতাটি অসম্পূর্ণ, ‘শৈশব সঙ্গীত’-ও সম্ভবত তাই—কারণ পাণ্ডুলিপিতে কবিতাটির শীর্ষে ‘ভূমিকা’ কথাটি লেখা হয়েছে, আর সেই কারণেই হয়তো এটি ভারতী-তে প্রকাশিত হয়নি, ইচ্ছা ছিল এটিকে সম্পূর্ণ রূপ দেবার–যা কোনো কারণে সম্ভব হয়নি। ফলে দীর্ঘকাল পরে ১২৯১ বঙ্গাব্দে ‘শৈশব সঙ্গীত’ কাব্যগ্রন্থে বর্তমান আকারেই এটি সংকলিত হয়, কিন্তু সেখানে কবিতাটির নূতন নামকরণ করা হয়—“অতীত ও ভবিষ্যৎ।
‘শৈশব সঙ্গীত’ কবিতাটি 54/২৮খ পৃষ্ঠাতেই শেষ হয়নি, এর শেষ দশটি ছত্র আছে 57/৩০ক পৃষ্ঠায়, বোঝা যায় পাণ্ডুলিপির বিচ্ছিন্ন পাতাগুলি সাজানোর সময়ে ‘55/২৯ক’ ও ‘56/২৯খ’ চিহ্নিত পাতাটি ভুলক্রমে স্থান পরিবর্তন করেছে। যাই হোক, ঐ 54/২৮খ পৃষ্ঠায় ‘শৈশব সঙ্গীত’ কবিতাটি যেখানে শেষ হয়েছে এবং ১ কার্তিক ‘কবিকাহিনী’ রচনার যেখানে শুরু—এর মধ্যবর্তী অংশে দুটি কবিতা দেখা যায়, যা ইতিপূর্বে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। কবিতা-দুটি অবশ্যই ২৪ আশ্বিন [9 Oct] ও ১ কার্তিক [16 Oct] —মধ্যবর্তী এই সাতদিনের কোনো সময়ে লিখিত হয়েছিল।
‘শৈশব সঙ্গীত’-এর পরবর্তী কবিতা ‘আমার এ মননজ্বালা কে বুঝিবে সরলে’ পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাতেই আবদ্ধ ছিল—ভারতী বা অন্য কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি—এমনকি প্রায় সাত বছর পরে রবীন্দ্রনাথ যখন ‘তেরো হইতে আঠারো বৎসর বয়সের কবিতাগুলি’ ‘শৈশব সঙ্গীত’ গ্রন্থে প্রকাশ করেন, তখনও এটিকে তার অন্তর্ভুক্ত করেননি। অবশ্য ‘ভূমিকা’য় কৈফিয়ৎ-স্বরূপ তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমি যাহার বিশেষ কিছু-না-কিছু গুণ দেখিতে পাইয়াছি তাহা ছাপাই নাই’—সেই হিসেবে বলা যেতে পারে এই কবিতাটির মধ্যে তিনি কোনো গুণ দেখতে পাননি। কিন্তু আমাদের ধারণা অন্যরূপ। লক্ষ্য করবার বিষয়, এই সময়ে লিখিত যে কবিতাগুলির মধ্যে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত সুরটি ধ্বনিত হয়েছে, সেগুলি তিনি হয় প্রকাশ করেননি, নাহয় কোনো কাহিনীমূলক কাব্যের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। আমরা আগেই দেখেছি, ‘নূতন উষা’ কবিতাটির একাংশ ললিতার উক্তি-রূপে ‘ভগ্নহৃদয়’-এ স্থান পেয়েছে এবং অপর অংশটি ‘হিমালয়’-এর প্রাকৃতিক দৃশ্য-বর্ণনার অঙ্গীভূত হয়ে নৈর্ব্যক্তিকতা অর্জনের চেষ্টা করেছে। ‘শৈশব সঙ্গীত’-এর ‘অতীত ও ভবিষ্যৎ’ নামকরণ হয়তো এই কারণে। এই আত্মগোপন-প্রয়াসের মূল সম্ভবত পারিবারিক প্রতিবেশের মধ্যে নিহিত ছিল। সেই কারণেই এই যুগটি রবীন্দ্রকাব্যের ইতিহাসে গাথা বা কাহিনী-কাব্যের যুগ। গাথা বা কাহিনীগুলির মধ্যে কবিস্বভাব পুরুষ বা নারীর সাক্ষাৎ প্রায়ই পাওয়া যায় এবং তাদের পরিণতি প্রায়শই বিয়োগান্ত। এইভাবে কাহিনীর কোনো চরিত্রের অন্তরালে আত্মগোপন করে নিজের মনের প্রেম ও নৈরাশ্যের রূপটি চিত্রিত করা তাঁর পক্ষে অনেক নিরাপদ বলে মনে হয়ে থাকতে পারে। চেষ্টাটি হয়তো সবসময়ে তাঁর সচেতন মন থেকে উৎসারিত হয়নি, কিন্তু সতর্কতার চিহ্নও খুব দুর্লক্ষ্য নয়। সেই কারণেই এই পর্বে প্রকাশিত কবিতাগুলির মধ্যে বিশুদ্ধ গীতিকবিতার সাক্ষাৎ পাওয়া শক্ত [অবশ্য কয়েকটি গান-জাতীয় রচনা এর ব্যতিক্রম—যেমন অগ্র ১২৮৪ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘ছিন্ন লতিকা’; গীতবিতানে এটিকে ‘জয়জয়ন্তী—ঝাঁপতাল’ এই সুর-তাল-নির্দেশ-সহ পাওয়া যায়]। রবীন্দ্রনাথের এই কৌতূহলোদ্দীপক মানসিকতার পরিচয় মেলে এমন-কি ‘করুণা’ উপন্যাসেও। সেখানে তিনি ‘ভূমিকা’য় করুণার পরিচয়টি দিয়েছেন এইভাবে : ‘সঙ্গিনী-অভাবে করুণার কিছুমাত্র কষ্ট হইত না। সে এমন কাল্পনিক ছিল, কল্পনার স্বপ্নে সে সমস্ত দিন-রাত্রি এমন সুখে কাটাইয়া দিত যে, মুহূর্তমাত্রও তাহাকে কষ্ট অনুভব করিতে হয় নাই।…এইরূপে করুণা তাহার জীবনের প্রত্যুষকাল অতিশয় সুখে আরম্ভ করিয়াছিল। তাহার পিতা ও প্রতিবাসীরা মনে করিতেন যে, চিরকালই বুঝি ইহার এইরূপে কাটিয়া যাইবে।’৩০ কিন্তু এই কাল্পনিকতা কঠোর বাস্তবের সঙ্গে যদি সামঞ্জস্য স্থাপন করতে না পারে, ‘এই প্রফুল্ল হৃদয় একবার যদি বিষাদের আঘাতে ভাঙিয়া যায়, এই হাস্যময় অজ্ঞান শিশুর মতো চিন্তাশূন্য সরল মুখশ্রী একবার যদি দুঃখের অন্ধকারে মলিন হইয়া যায়, তবে বোধ হয় বালিকা আহত লতাটির ন্যায় জন্মের মতো স্রিয়মাণ ও অবসন্ন হইয়া পড়ে, বর্ষার সলিলসেকে—বসন্তের বায়ুবীজনে আর বোধ হয় সে মাথা তুলিতে পারে না।‘৩১ রবীন্দ্রনাথের এই সময়ে লিখিত অনেকগুলি কবিতায় এই ভাবেরই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। অথচ এই মনোভাবকে ঠাট্টা করতেও কিশোর-কবির বাধেনি। নামহীন ঐ গীতিকবিতাটির কয়েকটি পঙ্ক্তি হল:
[ম্রিয়]মাণ মুখে, এই শুন্যপ্রায় নেত্রে
[ক]লঙ্ক সঁপিগো আমি তোমাদের হরষে;
পূর্ণিমা যামিনী যথা মলিন হইয়া যায়
ক্ষুদ্র এক অন্ধকার জলদের পরশে
এই কথাগুলিই রবীন্দ্রনাথ বসিয়েছেন ‘কবিতাকুসুমমঞ্জরী-প্রণেতা কবিবর স্বরূপচন্দ্রবাবু’র মুখে : ‘শরৎকালের জ্যোৎস্নারাত্রে কখনো ছাতে শুয়েছ? চাঁদ যখন ঢলঢল হাসি ঢালতে ঢালতে আকাশে ভেসে যায় তখন তাকে দেখেছ? আবার সেই হাস্যময় চাঁদকে যখন ঘোর অন্ধকারে মেঘে আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন মনের মধ্যে কেমন একটা কষ্ট উপস্থিত হয়, তা কি কখনো সহ্য করেছ।’৩২ যদিও গদ্যাংশটি উপরোক্ত কবিতার পূর্বে লেখা, তবু বোঝা যায় এই ধরনের ‘কবিয়ানা’র—এমন-কি নিজেরও হাস্যকরত্ব সম্পর্কে তিনি সচেতন থাকলেও এর কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাঁর গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু এগুলিকে লোসমক্ষে প্রকাশ করার ব্যাপারে সংকোচবশতই পত্রিকা বা গ্রন্থে এদের স্থান দেননি।
নামহীন এই গীতিকবিতাটির পরে একই পৃষ্ঠায় ‘উপহার গীতি’ নামে আর একটি কবিতা লিখিত হয়েছে। এরই নীচে ‘১লা কার্ত্তিক’ তারিখ দিয়ে ‘কবিকাহিনী’ কাব্যের সূচনা, সুতরাং ‘উপহার গীতি’র রচনাকাল আশ্বিন মাসের শেষ সপ্তাহে। কবিতাটির শেষে লেখা আছে ‘Les Poetes হইতে/অনুবাদিত—এবং শিরোনামের পাশে অস্পষ্টভাবে দেখা যায় ‘ভগ্ন…উপরে’, প্রবোধচন্দ্র সেন সাক্ষ্য দিয়েছেন৩৩ পাণ্ডুলিপি-প্রাপ্তির সময়ে তিনি নিজে লেখাটির পূর্ণরূপ দেখেছেন—‘ভগ্নহৃদয়ের উপরে’। এর থেকে মনে হতে পারে কবিতাটি মৌলিক রচনা নয় কিন্তু তা নাও হতে পারে।* যাই হোক, রচনার সময়েই কিংবা পরে রবীন্দ্রনাথ এটিকে ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যের উপহার-গীতি হিসেবে ব্যবহার করার কথা চিন্তা করেছিলেন এবং সেইজন্যই ‘ভগ্নহৃদয়ের উপরে’ এই নির্দেশটুকু লিখে রেখেছিলেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কবিতাটি ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যের উপহার কবিতা রূপে ব্যবহৃত হয়নি, এমন-কি কোথাও প্রকাশিত হয়নি। তার পরিবর্তে ভারতী-তে প্রকাশের সময় ‘উপহার’-রূপে ব্যবহৃত হয় ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ গানটি ও গ্রন্থাকারে প্রকাশ-কালে অন্য একটি দীর্ঘ কবিতা এই উদ্দেশ্যে মুদ্রিত হয়—আমরা যথাসময়ে সে-প্রসঙ্গ আলোচনা করব।
আলোচ্য ‘উপহার গীতি’ কবিতাটির সঙ্গে এর আগের নামহীন কবিতাটির ভাবের দিক থেকে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য দেখা যায়। অতীতের অনুরাগ বর্তমানে বিরক্তিতে পর্যবসিত হয়েছে, তবুও সেই নিদয়ার কাছেই ভগ্নহৃদয়ের ‘সর্ব্বস্বধন কবিতার মালাগুলি’ সমর্পণ করতে হবে—এই বিষাদ দুটি কবিতাতেই অন্তর্লীন হয়ে আছে। নামহীন কবিতাতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
জানিতাম ওগো সখি, কাঁদিলে মমতা পাব,
কাঁদিলে বিরক্ত হবে এ কি নিদারুণ?
চরণে ধরিগো সখি, একটু করিও দয়া।
নহিলে নিভিবে কিসে বুকের আগুন!
—‘উপহার গীতি’তে লিখলেন :
একদিন মনে পড়ে, যাহা তাহা গাইতাম
সকলি তোমার সখি লাগিত গো ভাল
নীরবে শুনিতে তুমি, সমুখে বহিত নদী
মাথায় ঢালিত চাঁদ পূর্ণিমার আলো।
সুখের স্বপনসম, সেদিন গেলগো চলি
অভাগা অদৃষ্টে হায় এ জন্মের তরে
আমার মনের গান মৰ্ম্মের রোদনধ্বনি
স্পর্শও করেনা আজ তোমার অন্তরে।
তবুও—তবুও সখি তোমারেই শুনাইব
তোমারেই দিব সখি যা আছে আমার।
দিনু যা’ মনের সাথে, তুলিয়া লও তা হাতে
ভগ্ন হৃদয়ের এই প্রীতি উপহার।
এই কবিতা-দুটি লেখার কিছুদিন পরেই ভারতী-র কার্তিক সংখ্যায় ‘শারদ জ্যোৎস্নায়/ভগ্ন হৃদয়ের গীতোচ্ছ্বাস’ [পৃ ১৫৪-৫৬] নামে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। সজনীকান্ত দাস কবিতাটিকে রবীন্দ্রনাথের লেখা অনুমান করে মন্তব্য করেছেন, ‘এই কবিতাটিকে অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর বলিয়া কেহ কেহ মনে করেন কিন্তু শেষ চার পংক্তিতে “ভানু” দেখিয়া রবীন্দ্রনাথকেই ইহার রচয়িতা বলিয়া মনে হয়। পংক্তিচারিটি এই :
“নিশি তুমি! আজ হয়ো না প্রভাত,
ভানুর মাথায় পড়ুক বাজ,
কাঁদায়ে চকোরে, ফেলিয়ে আমারে,
মধুর যামিনী, যেয়োনা আজ।”৩৪
—সজনীকান্তের যুক্তি মানা সম্ভব নয়, আমাদেরও ধারণা কবিতাটি অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর লিখিত। উদ্ধৃতির ‘ভানু’ শব্দটি রবীন্দ্রনাথের নামান্তর নয়, এর দ্বারা সূর্যকেই বোঝানো হয়েছে। ভাষা ও ছন্দও অক্ষয়চন্দ্রের রচনারীতির অনেক কাছাকাছি। জীবনস্মৃতি-তে রবীন্দ্রনাথ ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্য-প্রসঙ্গে লিখেছেন : ‘তখনকার কবির একটি শ্লোক মনে পড়ে—
আমার হৃদয় আমারি হৃদয় [,]
বেচিনি [বেচিনে] তো তাহা কাহারো কাছে,
ভাঙাচোরা হোক, যা হোক তা হোক,
আমার হৃদয় আমারি আছে।
সত্যের দিক দিয়া হৃদয়ের কোনো বালাই নাই, তাহার পক্ষে ভাঙিয়া যাওয়া বা অন্য কোনোপ্রকার দুর্ঘটনা নিতান্তই বাহুল্য, কিন্তু যেন তাহা ভাঙিয়াছে এমন একটা ভাবাবেশ মনের নেশার পক্ষে নিতান্তই আবশ্যক—দুঃখবৈরাগ্যের সত্যটা স্পৃহনীয় নয়, কিন্তু শুদ্ধমাত্র তাহার ঝাঁঝটুকু উপভোগের সামগ্রী, এইজন্য কাব্যে সেই জিনিসটার কারবার জমিয়া উঠিয়াছিল’।৩৫ এখানেও খানিকটা আত্মগোপনের প্রয়াস আছে, তৎকালীন হৃদয়ভাবকে একটু লঘু করে দেখানোর চেষ্টাও দুর্লক্ষ্য নয়—কিন্তু ‘শারদ জ্যোৎস্নায়…’ কবিতা থেকে ১৬শ স্তবকটি যেভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে, নিজের লিখিত কবিতা হলে সেভাবে করা সম্ভব হত না।* এটি যে রবীন্দ্রনাথের লেখা নয়, তার একটি প্রমাণ, ভারতী-র ফাল্গুন সংখ্যায় ‘বিজন চিন্তা।/কল্পনা’ শীর্ষক প্রবন্ধে এর প্রথম দুটি ছত্র উদ্ধৃত করে প্রতিবাদ করা হয়েছে, আমাদের ধারণা ‘বিধবা’ নামে লিখিত উক্ত প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথেরই লেখা [পরে আমরা এটি সম্পর্কে আলোচনা করব]। আসলে Les Poetes থেকে কবিতাটি অনুবাদ করতে রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও অক্ষয় চৌধুরীর সাহায্য গ্রহণ করতে হয়েছে। সুতরাং মালতীপুঁথি-র এই কবিতাটি তাঁদের অজ্ঞাত ছিল না, আর অক্ষয় চৌধুরী এর বিষয়বস্তু লঘু করার জন্যই হালকা চালে ‘শারদ জ্যোৎস্নায়…’ কবিতাটি লিখে বলতে চেয়েছিলেন:
বিষাদের ঘোর কেন রবে তবে,
ভাবনায় কেন দলিত হ’ব,
চাহে না পৃথিবী, চাহিনা পৃথিবী,
আপনার ভাবে আপনি র’ব!
—বয়সের ও শিক্ষাদীক্ষার বিপুল ব্যবধান সত্ত্বেও অক্ষয়চন্দ্র সত্যই রবীন্দ্রনাথের বন্ধুস্থানীয় হয়ে উঠেছিলেন। তাই প্রবন্ধের মাধ্যমে উত্তর-প্রত্যুত্তর, এমন-কি রবীন্দ্রনাথের কবিতারও ভাবগ্রাহী প্রতি-কবিতা রচনা করতে [যেমন, ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ অবলম্বনে লিখিত ‘অভিমানিনী নির্ঝরিণী’] তিনি উদ্বুদ্ধ হতেন। আলোচ্য কবিতাটি তারই একটি নিদর্শন।
মালতীপুঁথি-তে ‘উপহার গীতি’ কবিতাটি যেখানে শেষ হয়েছে তারই নীচে ‘কবি-কাহিনী’ কাব্যের সূত্রপাত। অবশ্য পাণ্ডুলিপিতে কোনো শিরোনাম নেই, কেবল স্থান-কাল নির্দেশিত হয়েছে : ‘বাড়িতে ১লা কার্ত্তিক মঙ্গলবার’ [16 Oct 1877]। এর পর পাণ্ডুলিপির 58/৩০খ, 37/২০ক, 38/২০খ, 35/১৯ক, 36/১৯খ, 59/৩১ক ও 60/৩১খ পৃষ্ঠায় কবিকাহিনীর প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ সর্গের খসড়া রূপটি পাওয়া যায়, ভারতী-তে প্রকাশের সময় যার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দ্বিতীয় সর্গের সম্পূর্ণটি ও অন্য তিনটি সর্গের অনেক অংশ পাণ্ডুলিপিতে নেই, এমন হতে পারে পাণ্ডুলিপির কয়েকটি পৃষ্ঠা হারিয়ে গেছে কিংবা পত্রিকার জন্য প্রেস-কপি তৈরি করার সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক অংশ নতুন করে লিখে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। যাই হোক, চতুর্থ সর্গের শেষে [পাণ্ডুলিপিতে কোনো সর্গ বিভাগ নেই] একটি কাল-নির্দেশ পাওয়া যায় : ‘১২ই কার্তিক/শনিবার [27 Oct]/৪ দিন লিখি নাই।’ অর্থাৎ ১লা থেকে ১২ই কার্তিকের মধ্যে চার দিন বাদ দিয়ে মাত্র আট দিনে কাব্যটি রচিত হয়েছিল। মালতীপুঁথি-র নির্দেশ-অনুযায়ী কাব্যটি আট দিনে লিখিত হলেও এটি প্রকাশযোগ্য রূপ পেতে আরও অনেকদিন লেগেছে এবং এর জন্য আরও একটি পাণ্ডুলিপি বা প্রেস-কপি তৈরি হয়েছিল, যার কোনো সন্ধান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। পৌষ থেকে চৈত্র ১২৮৪—এই চার মাসে ভারতী-তে কাব্যটির চারটি সর্গ প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা ১ম খণ্ড [১৩৭২] ও ২য় খণ্ডে [১৩৭৫] ‘কবি-কাহিনী’-র পাণ্ডুলিপি ও চিত্তরঞ্জন দেব-কৃত সুবিস্তৃত ‘তথ্য-সংকলন’ মুদ্রিত হয়েছে। তথ্যানুরাগী পাঠকের পক্ষে এগুলির পর্যালোচনা আবশ্যিক কর্তব্য।
রবীন্দ্রনাথ কাব্যটি প্রসঙ্গে লিখেছেন :
এই প্রথম বৎসরের ভারতীতেই ‘কবিকাহিনী’ নামক একটি কাব্য বাহির করিয়াছিলাম। যে-বয়সে লেখক জগতের আর-সমস্তকে তেমন করিয়া দেখে নাই, কেবল নিজের অপরিস্ফুটতার ছায়ামূর্তিটাকেই খুব বড়ো করিয়া দেখিতেছে, ইহা সেই বয়সের লেখা। সেইজন্য ইহার নায়ক কবি। সে কবি যে লেখকের সত্তা তাহা নহে,—লেখক আপনাকে যাহা বলিয়া মনে করিতে ও ঘোষণা করিতে ইচ্ছা করে, ইহা তাহাই। ঠিক ইচ্ছা করে বলিলে যাহা বুঝায় তাহাও নহে—যাহা ইচ্ছা করা উচিত অথাৎ যেরূপটি হইলে অন্য দশজনে মাথা নাড়িয়া বলিবে, হাঁ কবি বটে, ইহা সেই জিনিসটি। ইহার মধ্যে বিশ্বপ্রেমের ঘটা খুব আছে—তরুণ কবির পক্ষে এইটি বড়ো উপাদেয়, কারণ ইহা শুনিতে খুব বড়ো এবং বলিতে খুব সহজ। নিজের মনের মধ্যে সত্য যখন জাগ্রত হয় নাই, পরের মুখের কথাই যখন প্রধান সম্বল, তখন রচনার মধ্যে সরলতা ও সংযম রক্ষা করা সম্ভব নহে। তখন, যাহা স্বতই বৃহৎ তাহাকে বাহিরের দিক হইতে বৃহৎ করিয়া তুলিবার দুশ্চেষ্টায়, তাহাকে বিকৃত ও হাস্যকর করিয়া তোলা অনিবার্য।৩৬
এর মূল কথাটা আমাদের গ্রাহ্য হলেও, নিজের অল্প বয়সের রচনা-সম্পর্কে পরিণত বয়সের রবীন্দ্রনাথের কথা সর্বাংশে মান্য করবার কোনো কারণ নেই। নিজের অল্প বয়সের লেখা সম্পর্কে কারো কারো অতিরিক্ত মমতা দেখা গেলেও বেশি ভাগ নামী লেখকেরই একধরনের কৃপামিশ্রিত ঔদাসীন্য দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথও তার ব্যতিক্রম নন। পরবর্তীকালে শিল্পসাধনায় যে সিদ্ধি তিনি অর্জন করেছিলেন, তার তুলনায় আলোচ্য যুগের রচনার দুর্বলতা তাঁর কাছে পীড়াদায়ক লাগতেই পারে, এবং সেটা আরো বেশি করে লাগে সেগুলির সঙ্গে তাঁর নিজের নাম যুক্ত আছে বলেই। সেই কারণে তাঁকে রচনার মান সম্পর্কে সতর্ক হতে হয়েছে, বাল্যরচনা যার মধ্যে দুর্বলতার লক্ষণ সুস্পষ্ট তাকে নিঃশেষে বর্জন করার দিকে তাঁর এত আগ্রহ! কিন্তু ঐতিহাসিকের মনোভাব অন্যপ্রকার। তাঁর আকর্ষণের কারণ দ্বিবিধ। প্রথমত সমসাময়িক সাহিত্যের পটভূমিকায় আলোচ্য গ্রন্থের মূল্য ও বৈশিষ্ট্য নিরূপণ, দ্বিতীয়ত পরিণত রবীন্দ্র-মানসের প্রাথমিক সূত্র সন্ধান। এই দিক দিয়ে কবি-কাহিনী-র গুরুত্ব অসাধারণ, কিন্তু সে আলোচনা আমাদের নির্ধারিত লক্ষ্যের বহির্ভূত।৩৭
‘বনফুল’ সমগ্র কাব্য হিসেবে সাময়িক-পত্রে আগে প্রকাশিত হলেও, ‘কবি-কাহিনী’-ই পুস্তকাকারে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের সর্বপ্রথম রচনা। ক্যালকাটা গেজেটে প্রকাশিত বেঙ্গল লাইব্রেরির পুস্তক-তালিকায় গ্রন্থটির প্রকাশের তারিখ 5 Nov 1878 [২০ কার্তিক ১২৮৫]। যথাস্থানে আমরা বিষয়টি পুনরুত্থাপন করব।
এইবার কার্তিক সংখ্যা [১। ৪] ভারতী-র সূচিপত্রটি দেখা যাক। [উল্লেখযোগ্য, শ্রাবণ ও ভাদ্র সংখ্যা মুদ্রিত হয়েছিল ৫০০ কপি করে, কিন্তু আশ্বিন সংখ্যা থেকেই ১০০০ কপি করে ছাপা আরম্ভ হয়। ক্যাশবহি-তে ২৩ কার্তিকের হিসাবে দেখা যায়, ‘বঃ নেহাজাদ্দিন দপ্তরি/দঃ আশ্বিন ও কার্ত্তিক মাহার ভারতী ১০০০ কপী করিয়া ২০০০ কপী ভারতী বান্দাইবার মূল্য শোদ’ ৯ ৵৹। ভারতী-তে ‘মূল্যপ্রাপ্তি’ তালিকায় দেখা যায় ১১ আশ্বিন থেকে ১০ অগ্রহায়ণ এই দু-মাসে নতুন গ্রাহকের সংখ্যা ১২৯ জন।]
এই সূচির অন্তর্গত রবীন্দ্রনাথের রচনা ও ‘শারদ জ্যোৎস্নায়…’ কবিতাটি সম্পর্কে আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। অন্যান্য রচনাগুলি নিয়ে আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। সুতরাং আমরা অগ্রহায়ণ সংখ্যার সূচিটি উদ্ধার করছি :
১৯৩-২০০ | ‘প্রকৃত শিক্ষা-প্রণালী’ : ‘ত—’ |
২০০-০৬ | ‘ঝান্সীর রাণী: : ‘ভ—’ [রবীন্দ্রনাথ] দ্র ইতিহাস [১৩৬২]। ১০৩-১৩ |
২০৬-০৭ | ‘ভানুসিংহের কবিতা’ [‘গহন কুসুম-কুঞ্জ মাঝে’] : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ২।১২-১৩ [৮ সংখ্যক] |
২০৭-০৯ | ‘প্রাচীন ভারতের শিল্প’ : [কালীবর বেদান্তবাগীশ] |
২০৯-১৬ | ‘তত্ত্বজ্ঞান কতদূর প্রামাণিক’ : [দ্বিজেন্দ্রনাথ] |
২১৭-২৩ | ‘ভারতবর্ষীয় ইংরাজ’ : ‘শ্রীস—’ [সত্যেন্দ্রনাথ] |
২২৩-২৯ | ‘বঙ্গসাহিত্য’ : ‘চ—’ [অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী] |
২২৯-৩৪ | ‘করুণা’/পঞ্চম পরিচ্ছেদ : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র করুণা ২৭। ১৩৪-৩৯ |
২৩৪-৪০ | ‘প্রাপ্ত-গ্রন্থ’ [সংক্ষিপ্ত সমালোচনা] |
২৪৮ | ‘ছিন্ন লতিকা [‘সাধের কাননে মোর’] : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র শৈশবসঙ্গীত অ-১। ৪৬৪-৬৫ |
এই সূচির অন্তর্গত ‘ঝান্সীর রাণী’ রচনাটি ‘ভ’ স্বাক্ষরযুক্ত, যেটি রবীন্দ্রনাথের পরিচয়বাহী। তাছাড়া মালতীপুঁথি-র 32/১৭খ পৃষ্ঠায় ‘ঝান্সী রাণী’ শিরোনামে একটি গদ্যরচনা পাওয়া যায়, যার সঙ্গে ভারতী-তে প্রকাশিত প্রবন্ধটির মধ্যবর্তী অনেক অংশের বিষয় ও ভাষার সাদৃশ্য আছে। মালতীপুঁথি-তে প্রবন্ধটির সম্পূর্ণ খসড়া সম্ভবত করা হয়নি। কারণ পূর্ববর্তী 31/১৭ক পৃষ্ঠায় একটি দীর্ঘ কবিতা [‘এস আজি সখা বিজন পুলিনে’] দেখা যায়, যা কোথাও প্রকাশিত হয়নি। আর ‘ঝান্সী রাণী’ এই শিরোনাম দিয়ে খসড়াটির শুরু হয়েছে, সুতরাং সহজেই অনুমান করা যায় ভারতী-তে এর পূর্বে যে অংশটি দেখা যায় তা পরে যুক্ত। কিন্তু রচনাটির শেষাংশ মালতীপুঁথি-র কোনো বিলুপ্ত পৃষ্ঠায় লিখিত হয়েছিল কিনা বলা যায় না। খসড়াটি পড়লেই বোঝা যায়, এটি কোনো ইংরেজি রচনার অনুবাদ; ভারতী-র প্রবন্ধের শেষেও লিখিত হয়েছে, “ইংরাজী ইতিহাস হইতে আমরা রাজ্ঞীর এইটুকু জীবনী সংগ্রহ করিয়াছি’। অবশ্য প্রবোধচন্দ্র সেন যেমন অনুমান করেছেন যে এটি ‘ঘরের পড়া’ যুগে ভারতীয় ইতিহাস পাঠের অঙ্গ হিসেবে রচিত হয়েছিল, সেটি যথার্থ না হতেও পারে। ‘মেঘনাদ-বধ কাব্য’ প্রবন্ধ রচনার আগে রবীন্দ্রনাথ যেমন কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক ও একটি ইংরেজি পত্রাংশ উক্ত প্রবন্ধে ব্যবহার করার জন্যই অনুবাদ করেছিলেন, এটিও তেমনি ‘ঝান্সীর রাণী’ প্রবন্ধ-রচনার উদ্দেশ্যে তথ্য-সংকলনের নিদর্শনও হতে পারে—1859, 1858 প্রভৃতি কয়েকটি খ্রিস্টাব্দের উল্লেখ খসড়াটিতে যেভাবে করা হয়েছে তাতে এমন অনুমান করা খুব একটা অযৌক্তিক নয়। ইংরেজদের লিখিত ইতিহাস অবলম্বনে লক্ষ্মীবাঈ-এর জীবনী রচনা করে প্রবন্ধের শেষে উল্লিখিত হয়েছে : ‘আমরা নিজে তাঁহার যেরূপ ইতিহাস সংগ্রহ করিয়াছি তাহা ভবিষ্যতে প্রকাশ করিবার বাসনা রহিল।’ এই প্রতিশ্রুতি রবীন্দ্রনাথ কখনোই রক্ষা করেননি, কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বহুদিন পরে ১৩১০ বঙ্গাব্দে ‘মরাঠী হইতে’ লক্ষ্মীবাঈ-এর জীবনকাহিনী রচনা করে প্রকাশ করেন ‘ঝাঁশির রাণী’ [30 Sep 1903] নামে।
প্রবন্ধটি ঠিক কোন্ সময়ে রচিত হয়েছিল নিশ্চিত করে বলা না গেলেও, সঞ্জীবনী সভার প্রেরণা এটির পিছনে কাজ করেছিল বলে মনে হয়। উল্লেখযোগ্য যে, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক রজনীকান্ত গুপ্ত Jan 1877 থেকে খণ্ডাকারে তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’ প্রকাশ করতে শুরু করেন। আমরা সঞ্জীবনী সভার আয়ুষ্কাল সম্বন্ধে যা অনুমান করেছি, এই গ্রন্থ প্রকাশের কাল তারই অন্তর্বর্তী। রবীন্দ্রনাথ যেখান থেকেই প্রেরণা সংগ্রহ করে থাকুন-না কেন, জ্বলন্ত স্বদেশানুরাগ ও অকুতোভয়তা প্রবন্ধটির ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত। তিনি এর শুরুতেই লিখেছেন : ‘আমরা একদিন মনে করিয়াছিলাম যে, সহস্রবর্ষব্যাপী দাসত্বের নিপীড়নে রাজপুতদিগের বীর্যবহ্নি নিভিয়া গিয়াছে ও মহারাষ্ট্ৰীয়েরা তাহাদের দেশানুরাগ ও রণকৌশল ভুলিয়া গিয়াছে, কিন্তু সেদিন বিদ্রোহের ঝটিকার মধ্যে দেখিয়াছি কত বীরপুরুষ উৎসাহে প্রজ্বলিত হইয়া স্বকার্য-সাধনের জন্য সেই গোলমালের মধ্যে ভারতবর্ষের প্রদেশে প্রদেশে যুঝাযুঝি করিয়া বেড়াইতেছেন।’৩৮ তখনকার দিনের অধিকাংশ ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালির মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন ‘সিপাহি যুদ্ধের সময় অনেক রাজপুত ও মহারাষ্ট্রীয় বীর তাঁহাদের বীর্য অযথা পথে নিয়োজিত করিয়াছিলেন’,৩৮ কিন্তু এঁরা যে যথার্থ বীরের মর্যাদা পাবার যোগ্য এ-সম্বন্ধে তাঁর মনে কোনো সংশয় ছিল না, আর সেই কারণেই ‘সর্বাপেক্ষা বীরাঙ্গনা ঝান্সীর রানী লক্ষ্মীবাঈকে ভক্তিপূর্বক নমস্কার’ করে তাঁর জীবনী রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। এর মধ্যে আমাদের যেটি বিস্মিত করে সেটি হল, রাজরোষের ভয়ে যেখানে ‘দিল্লী দরবার’ কবিতাটি কোথাও প্রকাশিত না হয়ে পরে ছদ্মবেশ ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিল সেখানে বর্তমান প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁতিয়া টোপীর প্রাণদণ্ড-প্রসঙ্গে নির্দ্বিধায় লিখতে পেরেছিলেন :
ইংরাজেরা যদি স্বার্থপর বণিক জাতি না হইতেন, যদি বীরত্বের প্রতি তাঁহাদের অকপট ভক্তি থাকিত, তবে হতভাগ্য বীরের এরূপ বন্দীভাবে অপরাধীর ন্যায় অপমানিত হইয়া মরিতে হইত না, তাহা হইলে তাঁহার প্রস্তরমূর্তি এতদিনে ইংলণ্ডের চিত্রশালায় শ্রদ্ধার সহিত রক্ষিত হইত। যে ঔদার্যের সহিত আলেকজাণ্ডার পুরুরাজের ক্ষত্রিয়োচিত স্পর্ধা মার্জনা করিয়াছিলেন সেই ঔদার্যের সহিত তাঁতিয়াটোপীকে ক্ষমা করিলে কি সভ্যতাভিমানী ইংরাজ জাতির পক্ষে আরো গৌরবের বিষয় হইত না? যাহা হউক, ইংরাজেরা এই অসামান্য ভারতবর্ষীয় বীরের শোণিতে প্রতিহিংসারূপ পশুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করিলেন।’৩৯
প্রবন্ধের অন্যত্রও ‘বিদেশীয়দের পক্ষপাতী ইতিহাস’ ‘অসভ্য ইংরাজ সৈনিক’ প্রভৃতি মন্তব্য লেখকের মনোভাবটি সুস্পষ্টভাবেই প্রকাশ করেছে।
‘ভানুসিংহের কবিতা’ ‘গহন কুসুম-কুঞ্জ মাঝে’ রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি অনুযায়ী এই শ্রেণীর কবিতাগুচ্ছের মধ্যে প্রথম লিখিত হয়েছিল, আমরা এ-সম্পর্কে পূর্বেই আলোচনা করেছি। ভারতী-তে প্রকাশিত হবার সময়েই ‘বিহাগড়া রাগিণীর উল্লেখ দেখে মনে হয় কবিতাটিতে ইতিমধ্যেই সুর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রথম সংস্করণ ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ [১২৯১]-তে গানটির সুর ‘ঝিঁঝিট’। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-রচিত ‘অশ্রুমতী’ [শ্রাবণ ১২৮৬] নাটকের তৃতীয় অঙ্ক তৃতীয় গর্ভাঙ্কে মলিনার গান-রূপে এটি ব্যবহৃত হয়; এখানে গানটির শীর্ষে ‘রাগিণী ঝিঁঝিট’ লেখা দেখে মনে হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘আমোদর গান’ হিসেবে এটিতে নতুন করে সুর-যোজনা করেন, রবীন্দ্রনাথ তখন বিলেতে [প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকেই উৎসর্গীকৃত]। ভানুসিংহের কবিতা এই প্রথম গ্রন্থভুক্ত হয়। গানটির প্রথম স্বরলিপিও করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘স্বরলিপি-গীতিমালা’ [১৩০৪]-তে। ১৩০৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘কাব্য গ্রন্থাবলী’তে এর নামকরণ করা হয় ‘অভিসার’। আশ্বিন সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সজনি গো/অঁধার রজনী [শাঙন গগনে] ঘোর ঘনঘটা’ গানটিরও ‘অভিসার’ নাম দেওয়া হয়।
‘ছিন্ন লতিকা’ ভারতী-তে ও শৈশবসঙ্গীত-এ গীতিকবিতা রূপেই মুদ্রিত হয়। কিন্তু ‘রবিচ্ছায়া’ [বৈশাখ ১২৯২] গ্রন্থে সুর-তালের উল্লেখ পাওয়া যায় : ‘জয়জয়ন্তী-ঝাঁপতাল’। সুরটি সম্ভবত হারিয়ে গেছে, ফলে এর কোনো স্বরলিপি পাওয়া যায় না।
মালতীপুঁথি-তে 60/৩খ পৃষ্ঠায় ‘কবি-কাহিনী’ যেখানে শেষ হয়েছে, তার নীচে ১৫ ছত্রের একটি ছোটো মিত্রাক্ষর ত্রিপদীতে লিখিত কবিতা আছে, তার প্রথম পঙ্ক্তিটি হল : ‘পাষাণ হৃদয়ে কেন সঁপিনু হৃদয়?’ প্রবোধচন্দ্র সেন কবিতাটির বহিরঙ্গের ও অন্যান্য পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে :
এটি প্রথমে লিখিত হয়েছিল পেন্সিলে, পরে অনেক অংশের উপরেই যদৃচ্ছাক্রমে কালি বুলানো আছে। এই কবিতাটির উপরে লেখা আছে, ‘শনিবার—অগ্রহায়ণ ১৮৭৭’। এই তারিখটাও পেন্সিলে লেখা, তার উপরে কালি বুলানো হয় নি। কবিতাটির প্রথম লাইনের উপরেও কালি বুলানো হয় নি। তাতে মনে হয় উক্ত তারিখটা এই কবিতাটিরই রচনার তারিখ। কিন্তু তারিখটা অসম্পূর্ণ। অগ্রহায়ণ মাসের কোন্ দিন তা লেখা নেই। তার জায়গায় আছে একটি লম্বা রেখা (ড্যাশ)। মনে হয় বাংলা তারিখটা মনে ছিল না বলে ওই জায়গাটা ফাঁক রাখা হয়েছিল। ১৮৭৭ অথাৎ বাংলা ১২৮৪ সালের অগ্রহায়ণ মাসে শনিবার ছিল চারটি—৩, ১০, ১৭ ও ২৪ তারিখে। ইংরেজি তারিখ যথাক্রমে নভেম্বর ১৭, ২৪ এবং ডিসেম্বর ১ ও ৮। কবিতাটি এই চার দিনের কোনো এক দিনে রচিত হয়ে থাকবে।৪০
পাণ্ডুলিপির ঐ একই পৃষ্ঠায় ‘ওকি সখি কেন করিতেছ…’ [পাণ্ডুলিপির জীর্ণতার জন্য কবিতাটির প্রায় প্রতিটি চরণেরই শেষের একটি-দুটি শব্দ লুপ্ত], ‘ভেবেছি কাহারো সাথে মিশিবনা আর’ এবং ‘হারে বিধি কি দারুণ অদৃষ্ট আমার’—এই তিনটি ছোটো কবিতা পাওয়া যায়, যার কোনোটিই কোথাও প্রকাশিত হয়নি। সব-ক’টি কবিতারই বিষয় ভগ্নহৃদয়ের গভীর বিষাদ যা তাঁর এই সময়ের কবিতার—এমন-কি প্রবন্ধেরও—অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কবিতাগুলি একই সময়ে লিখিত বলে অনুমান করা যায়।
পৌষ সংখ্যা [১। ৬] ভারতী-র সূচিপত্রটি এইরূপ :
২৪১-৪৭ | ‘তত্ত্বজ্ঞান কতদূর প্রামাণিক’ : [দ্বিজেন্দ্রনাথ] |
২৪৮-৬৪ | ‘ভারতবর্ষীয় ইংরাজ’ : ‘সঃ—’ [সত্যেন্দ্রনাথ] |
২৬৪-৬৮ | ‘কবি-কাহিনী’/প্রথম সর্গ : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র কবি-কাহিনী অ-১। ৫-১৩ |
২৬৮-৭৪ | ‘মেঘনাদ-বধ কাব্য’ : ‘ভঃ—’ দ্র র°র°১৫ [শতবার্ষিক সং]। ১৩৮-৪৫ |
২৭৪-৭৮ | ‘প্রাচীন-সিংহলের বাণিজ্য’ : ‘প্রঃ—’ [?] |
২৭৮-৮৪ | ‘বঙ্গ-সাহিত্য’ : [অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী] |
২৮৪-৮৮ | ‘করুণা’/ষষ্ঠ-সপ্তম পরিচ্ছেদ : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র করুণা ২৭। ১৩৯-৪৩ |
২৮৮ | ‘ভানুসিংহের কবিতা’ : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ২।১৪-১৫ [১০ সংখ্যক] |
এই সংখ্যায় ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রবন্ধের প্রকাশিত অংশটির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এতে হোমারের ‘ইলিয়াড’ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ থেকে একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি এবং হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনূদিত বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ড থেকে অনেকগুলি উদ্ধৃতি যেমন ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনি যুদ্ধকাণ্ড থেকে দুটি বড় অংশ সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ নিজেই অনুবাদ করেছেন। নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই কিশোর সমালোচকের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমটি এখানে লক্ষণীয়।
‘ভানুসিংহের কবিতা’ [‘বাজাও রে মোহন বাঁশী’]-টি বর্তমানে যে-আকারে দেখা যায়, ভারতী-র [প্রথম সংস্করণেরও] পাঠ সে-তুলনায় দীর্ঘতর। ভারতী-তে অপ্রচলিত শব্দের অর্থও পাদটীকায় প্রদত্ত হয়েছে। কিন্তু সেখানে কোনো-রকম সুর-নির্দেশ লক্ষিত হয় না, কিন্তু প্রথম সংস্করণে রাগ হিসেবে ‘মূলতান’ নির্দেশ দেখা যায়, সম্ভবত সুরটি পরবর্তীকালে দেওয়া। কাব্য গ্রন্থাবলী-তে কবিতাটির শিরোনাম দেওয়া হয় ‘ব্যাকুলতা’।
ভারতীর ক্যাশবহি-তে ২২ পৌষ [শনি 5 Jan 1878] তারিখে একটি হিসাব দেখা যায় : ‘বাহিরের এবং নিজ বাটীর/বাবুদিগের আহারের ব্যায়/গুঃ ছোটবাবু মহাশয় ১৮ ॥৵৯’। হিসাবটি অতর্কিতে পত্রিকার অন্তরালের একটি চিত্র দেখে নিতে আমাদের সাহায্য করে। ব্যয়টি করা হয়েছে ভারতী-র তহবিল থেকে, সুতরাং ‘ছোটবাবু’ অর্থাৎ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্যোগে বাইরের কিছু অতিথি ও বাড়ির কয়েকজনকে নিয়ে যে আহারাদির আয়োজন হয়েছিল বোঝা যায় তা ভারতী-কে কেন্দ্র করেই, হয়তো পত্রিকার লেখকগোষ্ঠী ও কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী একত্রিত হয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। অবশ্য আমরা শুধু অনুমানই করতে পারি, আরও স্পষ্ট করে অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে কিছু বলার মতো তথ্য আমাদের হাতে নেই। কবে এই অনুষ্ঠান হয়েছিল তাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না, কারণ হিসাবটি নিশ্চয়ই ব্যয় হয়ে যাবার পরে লেখা।
ভারতী-র মাঘ সংখ্যার [১।৭] সূচিপত্রটি দীর্ঘতর এবং অর্ধেকের বেশি রবীন্দ্র-রচনায় পূর্ণ :
২৮৯-৯৬ | ‘ভারতবর্ষীয় ইংরাজ’ : ‘শ্রীস—’ [সত্যেন্দ্রনাথ] |
২৯৬-৩০০ | ‘বঙ্গে সমাজ-বিপ্লব’ : [?] দ্র দেশ, রবীন্দ্ৰশতবর্ষপূর্তি সংখ্যা ১৩৬৯। ৫৩-৫৪ |
৩০০-০৪ | ‘তত্ত্বজ্ঞান কতদূর প্রামাণিক’ : [দ্বিজেন্দ্রনাথ] |
৩০৪-১০ | ‘বাঙ্গালীর আশা ও নৈরাশ্য’ : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র দেশ, রবীন্দ্ৰশতবর্ষপূর্তি সংখ্যা ১৩৬৯। ৫৫-৫৭ |
৩১১-১৩ | ‘স্বাস্থ্য’ : ‘যঃ—’ [ডাঃ যদুনাথ মুখোপাধ্যায়] |
৩১৩-১৮ | ‘ভারতী-বন্দনা’ : [বিভিন্ন জনের লেখা] দ্র শৈশবসঙ্গীত অ-১। ৪৬৫-৬৭ [প্রথম কবির রচিত অংশটুকু] |
৩১৮-২৫ | ‘কবি-কাহিনী’/দ্বিতীয় সর্গ : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র কবি-কাহিনী অ-১। ১৩-২৮ |
৩২৫-৩১ | ‘সম্পাদকের বৈঠক।/অনুবাদ।’ |
৩২৫ | ‘বিচ্ছেদ’/‘শরীর সে ধীরে ধীরে যাইতেছে আগে’/শকুন্তলা : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র রূপান্তর। ৭৩ |
৩২৬ | ‘বিচ্ছেদ’/’প্রতিকূল বায়ুভরে, ঊৰ্ম্মিময় সিন্ধু ’পরে’/Moore’s Irish Melodies: [রবীন্দ্রনাথ] |
৩২৬ | ‘বিদায় চুম্বন’/‘একটি চুম্বন দাও প্রমোদা আমার’/Burns: [রবীন্দ্রনাথ] |
৩২৬-২৭ | ‘কষ্টের জীবন’/‘মানুষ কাঁদিয়া হাসে’/Byron: [রবীন্দ্রনাথ] |
৩২৭ | ‘জীবন উৎসর্গ’/‘এস এস এই বুকে নিবসে তোমার’/Moore’s Irish Melodies: [রবীন্দ্রনাথ] |
৩২৭-২৮ | ‘ললিত নলিনী/(কৃষকের প্রেমালাপ)’/Burns |
৩২৮ | ‘বিদায়’/‘যাও তবে প্রিয়তম সুদূর প্রবাসে’/Mrs. Opie* |
৩২৯-৩১ | ‘মদন ভষ্ম’[স্ম]/‘সময় লঙঘন করি নায়ক তপন’/কুমারসম্ভব : [দ্বিজেন্দ্রনাথ] |
৩৩১ | ‘সঙ্গীত’/‘কেমন সুন্দর আহা ঘুমায়ে রয়েছে’/সেক্স্পিয়র |
৩৩২-৩৪ | ‘ছিটওয়ালা সিবিলিয়ান সাহেব’: ‘বঃ—’ [রাজনারায়ণ বসু] |
৩৩৪-৩৫ | ‘প্রাপ্ত গ্রন্থ।’ [সংক্ষিপ্ত সমালোচনা] |
৩৩৬ | ‘ভানুসিংহের কবিতা’ : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী [১৩৭৬] ৮৩-৮৪ [‘হম সখী দারিদ নারী’] |
এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত ‘বঙ্গে সমাজ-বিপ্লব’ ও ‘বাঙ্গালীর আশা ও নৈরাশ্য’ প্রবন্ধ দুটি সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠি, অগ্র ১৩৪৬ সংখ্যায় ‘রবীন্দ্র-রচনাপঞ্জী’তে অন্তর্ভুক্ত করেও মন্তব্য করেছেন,‘রচনা: দুইটি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের সংশয় আছে’ [পৃ ৩১৩]; কিন্তু তাঁর রবীন্দ্রনাথ : জীবন ও সাহিত্য [১৩৬৭] গ্রন্থে এই বাক্যটি বাদ দিয়েছেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রচনা দুটির কোনো উল্লেখই করেননি। ড সংঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় এ-দুটিকে রবীন্দ্রনাথের রচনা ধরে নিয়ে এদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন [দ্র রবীন্দ্রসাহিত্যের আদিপর্ব। ৩৫৩, ৩৬৪-৬৫]। পুলিনবিহারী সেনও ‘রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত সাময়িক পত্র’ প্রবন্ধের পরিশিষ্টে প্রদত্ত ‘ভারতী প্রথম বর্ষে প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনার সূচী’তে উক্ত রচনায়দ্বয় অন্তর্ভুক্ত করে প্রবন্ধ দুটি পুনর্মুদ্রিত করেছেন। প্রবন্ধ দুটি পাঠ ও পর্যালোচনা করে আমাদের কিন্তু মনে হয়েছে দ্বিতীয় প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের লেখা হলেও, প্রথমটি তাঁর রচনা নয়। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ Golden Book of Tagore [1931]-এ দ্বিতীয় প্রবন্ধটিকেই তাঁর রচনা বলে চিহ্নিত করেছেন।†
আমাদের বিশ্বাস, ‘বঙ্গে সমাজ-বিপ্লব’ প্রবন্ধটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রচনা। প্রবন্ধটির শেষাংশে আছে
এখন সমাজে তিন দল উখিত হইয়াছেন। যাঁহারা আমূল-সংস্কার-প্রিয় তাঁহারা সকলি ভাঙ্গিতে চান। যাঁহারা আমূল-রক্ষণ-প্রিয় তাঁহারা সকলি রাখিতে চান। যাঁহারা রক্ষণ-সংস্কার-প্রিয় তাঁহারা যাহা ভাল তাহাই রাখিতে চান, যাহা মন্দ তাহাই ভাঙ্গিতে চান। এইরূপে উপরি-উক্ত দুইটি শক্তির ঘাত-প্রতিঘাতে এবং শেষোক্ত শক্তির উত্তেজনায় সমাজ ঠিক উন্নতির সরল-পথে চলিতেছে।
উন্নতির পথ মধ্যবর্ত্তী, উন্নতির পথ এক-ঝোঁকা নহে।…যাঁহারা আমূল-সংস্কার-প্রিয় তাঁহারাও উন্নতিশীল নহেন, যাঁহারা রক্ষণ-সংস্কার-প্রিয় তাঁহারাই প্রকৃত উন্নতি শীল।৪১
প্রকৃতপক্ষে এই বক্তব্য আদি ব্রাহ্মসমাজের এবং মনে রাখা দরকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই সময়ে উক্ত সমাজের সম্পাদক। কেশবচন্দ্র সেন-পরিচালিত ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের সভ্যেরা উন্নতিশীল বলে নিজেদের পরিচয় দিতেন এবং যাবতীয় সংস্কার-মূলক কাজে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণের চেষ্টা করতেন। আর তাঁদের এই অত্যুৎসাহী সংস্কার-কার্যের প্রতিক্রিয়ায় রক্ষণশীল হিন্দুদের গোঁড়ামিও ধীরে ধীরে দৃঢ়বদ্ধ হচ্ছিল, যা কিছুদিন পরেই শশধর তর্কচূড়ামণি, কৃষ্ণানন্দ স্বামী ও বঙ্গবাসী পত্রিকার প্রচারে এক বিচিত্র রূপ লাভ করেছিল। আদি ব্রাহ্মসমাজ বিশ্বাস করতেন তাঁরা এরই ভিতরে মধ্যপথ অবলম্বন করে যথার্থ উন্নতিশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন। ‘বঙ্গে সমাজ-বিপ্লব’ প্রবন্ধটি এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার্য। তাছাড়া এর ভাষা রবীন্দ্রনাথের ভাষার মতো নয়, বরং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গদ্যের সঙ্গে এর অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়।
’বাঙ্গালীর আশা ও নৈরাশ্য’ সেখানে রবীন্দ্র-গদ্যের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই বহন করছে :
ভারতবর্ষের ধ্বংসাবশিষ্ট সভ্যতার ভিত্তির উপর ইউরোপীয় সভ্যতার গৃহ নির্ম্মিত হইলে সে কি সর্ব্বাঙ্গসুন্দর দৃশ্য হইবে! ইউরোপের স্বাধীনতা-প্রধান ভাব ও ভারতবর্ষের মঙ্গল-প্রধান ভাব, পূর্ব্বদেশীয় গম্ভীর ভাব ও পশ্চিম দেশীয় তৎপর ভাব, ইউরোপের অর্জনশীলতা ও ভারতবর্ষের রক্ষণ-শীলতা, পূৰ্ব্বদেশের কল্পনা ও পশ্চিমের কাৰ্য্যকরী বুদ্ধি উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য হইয়া কি পূর্ণ চরিত্র গঠিত হইবে। ইউরোপীয় ভাষার তেজ ও আমাদের ভাষার কোমল, ইউরোপীয় ভাষার সংক্ষিপ্ততা ও আমাদের ভাষার গাম্ভীর্য্য, ইউরোপীয় ভাষার প্রাঞ্জলতা ও আমাদের ভাষার অলঙ্কার-প্ৰাচুৰ্য্য উভয়ে মিশ্রিত হইয়া আমাদের ভাষার কি উন্নতি হইবে! ইউরোপীয় ইতিহাস ও আমাদের কাব্য উভয়ে মিশিয়া আমাদের সাহিত্যের কি উন্নতি হইবে! ইউরোপের শিল্প বিজ্ঞান ও আমাদের দর্শন উভয়ে মিলিয়া আমাদের জ্ঞানের কি উন্নতি হইবে!৪২
ভাব ও ভাষার এই ক্রমোচ্চশীলতা রবীন্দ্র-গদ্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তাছাড়া প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনের কথা রবীন্দ্রনাথ প্রায় সারাজীবনই বলে গিয়েছেন। তাঁর আর-একটি প্রিয় তত্ত্বের সাক্ষাৎও আমরা এই রচনাতে পাই : ‘অভাবের উৎপীড়ন হইতে অবসর পাইলেই জ্ঞানের দিকে মনুষ্যের নেত্র পড়ে। এইরূপে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তির অনুসন্ধিৎসু নেত্রের সম্মুখে জ্ঞানের দ্বার ক্রমশঃ উন্মুক্ত হইতে থাকে।’—এই অবসরতত্ত্ব বা Philosophy of Leisure রবীন্দ্রনাথের জীবন-দর্শনের একটি অন্যতম ভিত্তি। প্রবন্ধটির নাম ‘বাঙ্গালীর আশা ও নৈরাশ্য’ হলেও আশার সুরটিই এখানে প্রধান, নৈরাশ্যের কারণ যেটুকু আছে কিশোর সমাজতত্ত্ববিদ্ তার প্রতিকারের অমোঘ উপায়ও নির্দেশ করেছেন—ব্যবসায় ও ব্যায়াম।
এখানে একটি তথ্যের উল্লেখ করা প্রয়োজন। হিন্দুমেলার দ্বাদশ বার্ষিক অধিবেশন এই বৎসর ২৬ মাঘ [বৃহ 7 Feb 1878] থেকে ৩০ মাঘ [সোম 11 Feb] পর্যন্ত মহারানী স্বর্ণময়ীর কাঁকুরগাছির বাগানে অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানের কোনো বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়নি, সুতরাং বলা সম্ভব নয় প্রবন্ধ দুটি হিন্দুমেলায় পঠিত হয়েছিল কিনা। কিন্তু এদের বিষয়বস্তু হিন্দুমেলার উপযোগী এ-কথা এ-প্রসঙ্গে মনে হতেই পারে, যদিও উক্ত অনুষ্ঠানের পূর্বেই এগুলি ভারতী-তে প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল।
‘ভারতী বন্দনা’ কবিতাটি পাঁচজন কবি কর্তৃক দেবী ভারতীর স্তুতি-রূপে পরিকল্পিত। ‘শৈশব-সঙ্গীত’ কাব্যগ্রন্থে প্রথম কবির উক্তি অংশটিই শুধু সংকলিত হয়েছে। এতে মনে হয় বাকি চারটি অংশ অন্য চারজন কবির দ্বারা রচিত। আভ্যন্তরীণ বিচারে আমাদের অনুমান দ্বিতীয় কবি অক্ষয় চৌধুরী, তৃতীয় কবি দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং পঞ্চম কবি সম্ভবত বিহারীলাল চক্রবর্তী। চতুর্থ কবি সম্পর্কে কিছু অনুমান করা কঠিন, কখনো-কখনো মনে হয় এটিও রবীন্দ্রনাথের লেখা, কিন্তু সেক্ষেত্রে শৈশবসঙ্গীত-এ অংশটি অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া শক্ত হয়ে পড়ে।
‘সম্পাদকের বৈঠক’-এর অন্তর্গত অনুবাদ-কবিতাগুলির মধ্যে কুমারসম্ভব-এর তৃতীয় সর্গের ‘মদন ভস্ম’ অংশের অনুবাদ দ্বিজেন্দ্রনাথ-কৃত, এ-সম্পর্কে পূর্বে আমরা বিস্তৃত আলোচনা করেছি।* অন্যান্য কবিতাগুলির মধ্যে কয়েকটির সন্ধান পাওয়া যায় মালতীপুঁথি-তে; যেমন ‘বিচ্ছেদ’-শীর্ষক কবিতা দুটি [‘শরীর সে ধীরে ধীরে যাইতেছে আগে’ শকুন্তলার ‘গচ্ছতি পুরঃ শরীরং’ শ্লোকের অনুবাদ এবং ‘প্রতিকূল বায়ুভরে, উর্ম্মিময় সিন্ধু পরে’ Thomas Moore-এর Irish Melodies গ্রন্থের ‘The Journey Onwards’—‘As slow our ship her foamy track’ কবিতার প্রথম স্তবকের অনুবাদ], ‘কষ্টের জীবন’ [Byron-এর Childe Harold’s Pilgrimage গ্রন্থের Canto the Third-এর ৩২, ৩৩ ও ৩৪ সংখ্যক স্তবকের অনুবাদ], এবং ‘জীবন-উৎসর্গ’ [Moore-এর ‘Come, rest in this bosom, my own stricken deer’ কবিতার অনুবাদ]। অন্যান্য অনুবাদগুলির অনুরূপ পাণ্ডুলিপি না পাওয়া গেলেও সেগুলিও রবীন্দ্রনাথ-কৃত অনুবাদ বলেই অনুমিত হয়।
‘ভানুসিংহের কবিতা’ [‘হম সখি দারিদ নারী’]-র সুরের উল্লেখ আছে ভৈরবী বলে, কিন্তু সুরটি সম্ভবত হারিয়ে গেছে। বস্তুত প্রথম সংস্করণের [১২৯১] পর কবিতাটিকেই নির্বাসিত করা হয়। বহুদিন পরে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী-র ‘পাঠান্তর-সংবলিত-সংস্করণ’ [আশ্বিন ১২৭৬]-এ পদটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
এবার ফাল্গুন সংখ্যা [১।৮] ভারতী-র সূচিটি দেখা যাক:
৩৩৭-৪৪ | ‘প্রকৃত শিক্ষাপ্রণালী।’ : ‘ত—’ |
৩৪৫-৫১ | ‘ভারতবর্ষীয় ইংরাজ।/(পরিশিষ্ট)’ : ‘শ্ৰীস—’ [সত্যেন্দ্রনাথ] |
৩৫১-৫৪ | ‘প্রাচীন ভারতের শিল্প’: [কালীবর বেদান্তবাগীশ] |
৩৫৪-৬০ | ‘তত্ত্বজ্ঞান কতদূর প্রামাণিক’ : [দ্বিজেন্দ্রনাথ] |
৩৬০-৬৩ | ‘কবি-কাহিনী’/তৃতীয় সর্গ : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র কবি-কাহিনী অ-১। ২৮-৩৩ |
৩৬৩-৬৬ | ‘বিজন চিন্তা।/কল্পনা’: ‘বিধবা’ [? রবীন্দ্রনাথ] |
৩৬৬-৬৭ | ‘মেঘনাদ-বধ কাব্য’ [শেষ কিস্তি] : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র র°র°১৫ [শতবার্ষিক সং]। ১৪৫-৪৮ |
৩৭০-৭২ | ‘অভিনয় সমালোচনা’ : [? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ] |
৩৭৩-৭৪ | ‘স্বাস্থ্য’ : ‘য—’ [ডাঃ যদুনাথ মুখোপাধ্যায়] |
৩৭৫-৭৮ | ‘করুণা’/অষ্টম-দশম পরিচ্ছেদ : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র করুণা ২৭। ১৪৩-৪৭ |
৩৭৮-৮০ | ‘প্রাপ্ত গ্রন্থ’ |
৩৮০-৮১ | ‘ভানুসিংহের কবিতা’ : [রবীন্দ্রনাথ] |
৩৮০-৮১ | [‘সখিরে পিরীত বুঝবে কে?’] দ্র ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী [১৩৭৬]। ৮১- |
৩৮১ | [‘সতিমির রজনী, সচকিত সজনী’] দ্র ঐ ২।১৩-১৪ [৯ সংখ্যক] |
৩৮১-৮৩ | ‘সম্পাদকের বৈঠক। /বায়রণের কথোপকথনকালীন উক্তি’ |
৩৮৩-৮৪ | ‘বাল্যসখী’ [কবিতা] : ‘স্ব—’ [স্বর্ণকুমারী দেবী] |
‘মেঘনাদ-বধ কাব্য’ সমালোচনা এই সংখ্যাতেই শেষ হয়; কিন্তু বাল্মীকি রামায়ণ থেকে দুটি দীর্ঘ অনুবাদ-উদ্ধৃতি দিয়ে [একটি ‘হেমচন্দ্র ভট্টাচাৰ্য কৃত রামায়ণ হইতে উদ্ধৃত’, অন্যটি স্ব-কৃত] যেভাবে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই প্রবন্ধটি শেষ হয়েছে, তাতে মনে হয় এটি রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত সমাপ্তি নয়। তাছাড়া প্রমীলার চিতারোহণ এবং সীতা ও সরমার চরিত্র আলোচনা ছাড়া মেঘনাদ-বধ কাব্যের সাহিত্য-বিচার কিছুতেই শেষ হতে পারে না। তাই সমালোচনা-প্রবন্ধটিকে অসমাপ্ত মনে করাই সংগত। [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৪]।
‘ভানুসিংহের কবিতা’ শিরোনামে এই সংখ্যায় দুটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এদের মধ্যে প্রথম কবিতাটি প্রথম সংস্করণে ১৫-সংখ্যক কবিতা-রূপে প্রকাশিত হবার পর পরবর্তী সব সংস্করণেই বর্জিত হয়েছে। পাঠান্তর-সংবলিত সংস্করণে এটি পুনর্মুদ্রিত হয়। অপর কবিতাটিকে অবশ্য এই দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হতে হয়নি। মিশ্র জয়জয়ন্তী রাগে ও ত্রিতালে নিবদ্ধ ইন্দিরা দেবী-কৃত স্বরলিপি-সহযোগে কবিতাটি গান রূপে আজও যথেষ্ট পরিচিত। কাব্য গ্রন্থাবলী-তে কবিতাটির শিরোনাম দেওয়া হয় ‘প্রতীক্ষা’। বর্তমানে পদটি যে-আকারে পাওয়া যায় ভারতী-তে তার অতিরিক্ত আরো ১২টি ছত্র ছিল।
উপরে উদ্ধৃত সূচিপত্রে যে-রচনাটি আমাদের সর্বাধিক কৌতূহলাক্রান্ত করেছে সেটি হল ‘বিধবা’ লিখিত ‘বিজন চিন্তা/কল্পনা’ শীর্ষক আত্মভাবনা-মূলক প্রবন্ধটি। রচনা-শেষে লিখিত ‘বিধবা’ শব্দটির জন্যই সম্ভবত প্রবন্ধটির প্রতি কাবোর মনোযোগ আকৃষ্ট হয়নি। আমাদের ধারণা, প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের রচনা। প্রবন্ধটি আরম্ভ হয়েছে এই ভাবে :
এই মহাকল্লোলময় মহানগরের এক প্রান্তে এক খানি পর্ণ-কুটীরে আমার বাস। আমি সংসারী নহি, কেন না আমার সংসার নাই—আমি বিধবা, আমার আদর করিবার স্বামী নাই, সান্ত্বনা করিবার বন্ধু নাই, স্নেহ কিনিবার বিভব নাই, যত্ন লাভের সামর্থ্য নাই। ছিন্ন তৃণবৎ আমি সংসার-সাগর-স্রোতে একলাই ভাসিতেছি, একলাই উঠিতেছি, একলাই পড়িতেছি।…আমি এখন খুব স্বাধীন, অথচ স্বাধীনতায় সুখ পাই না। মনের ভিতর যেন কেমন একটা হু হু করিতে থাকে।…মনে করিয়াছিলাম যে, যখন কাহারো সঙ্গে আর সম্পর্ক নাই তখন কিসের উদ্বেগ, যখন আমি আর মোহের অধীন নহি তখন আর কিসের যাতনা, যখন মায়ায় আবদ্ধ নহি তখন কিসের ভাবনা, কিন্তু অপরিমিত স্বাধীনতাতেই কি সুখ?
সমকালীন রবীন্দ্র-মানসিকতার সঙ্গে এই প্রবন্ধের ভাব-সাদৃশ্য সুপ্রচুর, তাঁর ভাষার বৈশিষ্ট্যও এর প্রতি ছত্রে দেখতে পাওয়া যায়। একটু পরেই তিনি লিখেছেন : ‘যে লোক বলিয়াছেন—
“আমার হৃদয় আমারি হৃদয়।
বেচিনিত তাহা কাহারো কাছে।”
তিনি মিথ্যা কথা কহিয়াছেন। এরূপ গৰ্ব্বিত আস্ফালন কোন হৃদয়-সম্পন্ন মানুষের কণ্ঠ হইতে নিঃসৃত হইতে পারে না। আমার হৃদয় আছে যখনি ভাবিতে পারিলাম তখন ইহাও নিশ্চয় যে সে হৃদয় পরাধীন—হয় কোন ব্যক্তি বিশেষের নয় কোন বস্তু বিশেষের। কিন্তু এই প্রকার পরাধীনতা কি বিষাদের?’ পূর্বোক্ত ‘শারদ জ্যোৎস্নায়…’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত দুটি ছত্র, আমরা আগেই বলেছি, সম্ভবত অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর রচনা। অক্ষয়চন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে গদ্যে ও পদ্যে উত্তর-প্রত্যুত্তরের নিদর্শন পরবর্তী কালে কয়েকটি দেখা গেছে [যেমন, আষাঢ় ও শ্রাবণ ১২৮৯ সংখ্যায় প্রকাশিত অক্ষয়চন্দ্রের ‘দেশজ প্রাচীন কবি ও আধুনিক কবি’ প্রবন্ধের রবীন্দ্রনাথ-কৃত ‘প্রত্যুত্তর’ ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং রবীন্দ্রনাথের ‘নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতা অবলম্বনে অক্ষয়চন্দ্র ‘অভিমানিনী নির্ঝরিণী’ রচনা করেছিলেন]। বর্তমান সময়ে এই ধরনের রচনার একটি পরিচয় আমরা ‘শারদ জ্যোৎস্নায়..’ কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে দিয়েছি, বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধটি সম্ভবত আর একটি নিদর্শন। অপর একটি নিদর্শন আছে চৈত্র সংখ্যার ‘সান্ত্বনা’ ও ‘অশ্রুজল’ প্রবন্ধ দুটির মধ্যে, এগুলি সম্পর্কে আমরা আর একটু পরেই আলোচনা করব।
‘অভিনয় সমালোচনা’ প্রবন্ধটি ন্যাশানাল থিয়েটারে গিরিশচন্দ্র ঘোষ-কর্তৃক নাট্য-রূপায়িত মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ’ অভিনয়-প্রসঙ্গে লিখিত। খুব সম্ভব এটি লিখেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। এই নাট্যরূপটি প্রথম অভিনয় হয় ৮ পৌষ [শনি 22 Dec 1877] তারিখে। রাম ও মেঘনাদ চরিত্রে গিরিশচন্দ্র স্বয়ং, রাবণ চরিত্রে অমৃতলাল মিত্র ও প্রমীলা-রূপে বিনোদিনী অপূর্ব অভিনয় করেন। সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনয় দেখতে যাওয়া বিষয়ে ঠাকুরবাড়ির কোনোরকম শুচিবায়ুতা ছিল না। এইরূপ অভিনয়-দর্শনের কয়েকটি আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। বর্তমান অভিনয়-অনুষ্ঠানে ‘মেঘনাদ-বধ কাব্য’-সমালোচক রবীন্দ্রনাথের উপস্থিত থাকা খুবই স্বাভাবিক।
‘বাল্যসখী’ ভারতী-তে প্রকাশিত স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রত্ম কবিতা।
চৈত্র ১২৮৪ সংখ্যা ভারতী-র প্রথম বর্ষের নবম সংখ্যা হলেও, এই সংখ্যাতেই বর্ষ সমাপ্ত করা হয়। এর সূচিপত্রটি এইরূপ :
৩৮৫-৮৯ | ‘বোম্বাই রায়ৎ’ : ‘শ্ৰীস—’ [সত্যেন্দ্রনাথ] |
৩৯২-৯৯ | ‘কবি-কাহিনী’/চতুর্থ সর্গ [সমাপ্ত] : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র কবি-কাহিনী অ-১। ৩৪-৪৬ |
৩৯৯-৪০১ | ‘সান্ত্বনা’ : ‘ভ—’ [রবীন্দ্রনাথ] |
৪০১-০৫ | ‘তত্ত্বজ্ঞান কতদূর প্রামাণিক’ : [দ্বিজেন্দ্রনাথ] |
৪০৬-০৮ | ‘অশ্রুজল’ : ‘চ—’ [অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী] |
৪০৮-১৩ | ‘করুণা’/একাদশ-চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র করুণা ২৭। ১৪৭-৫৩ |
৪১৪-১৮ | ‘উদ্ভিদ’ : ‘য—’ [ডাঃ যদুনাথ মুখোপাধ্যায়] |
৪১৯-২২ | ‘স্বাস্থ্য’ : ‘য—’ [ঐ] |
৪২২ | ‘ভানুসিংহের কবিতা’ [‘বাদর বরখন, নীরদ গরজন’] : [রবীন্দ্রনাথ] দ্র ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ২। ১৯ [১৪ নং] |
৪২৩-২৬ | ‘বঙ্গসাহিত্য’ : ‘চ’ [অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী] |
৪২৬-২৩ | ‘সম্পাদকের বৈঠক’ : ‘ছিটওয়ালা সিভিলিয়ান’ [রাজনারায়ণ বসু],… |
৪৩২ | ‘প্রাপ্তগ্রন্থ’ |
এই সংখ্যার ভানুসিংহের কবিতা’তে ‘রাগিণী মল্লার’ সুর নির্দেশ করা থাকলেও এটির স্বরলিপি পাওয়া যায় না। ‘কাব্য গ্রন্থাবলী’তে কবিতাটিকে ‘বর্ষা’ শিরোনাম দেওয়া হয়।
‘ভ—’ ও ‘চ—’ স্বাক্ষরে যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথের ‘সান্ত্বনা’ ও অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর ‘অশ্রুজল’ নামে দুটি প্রবন্ধ বর্তমান সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। আমাদের ধারণা, দুটি প্রবন্ধ পরস্পর সম্পর্কাম্বিত এবং এদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সমকালীন বিষাদময় কবিতা-সমূহ, ‘শারদ জ্যোৎস্নায়…’ এবং উপরোক্ত ‘বিজন চিন্তা/কল্পনা’ প্রবন্ধের যোগ আছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
আমার সময়ে সময়ে কেমন মন খারাপ হইয়া যায়, হয় হউক্গে তাহাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু অমনি লোকে সান্ত্বনা দিতে আইসে কেন?…সান্ত্বনা দিতে হইলে প্রায়ই লোকে কহিয়া থাকে, তোমার কিসের দুঃখ? আরোত কত লোক তোমার মত কষ্ট পাইতেছে। এমন কষ্টকর সান্ত্বনা আর নাই,…যে একথা বলিয়া সান্ত্বনা দিতে আইসে, স্পষ্টই বোধ হয় আমার দুঃখে তাহার কিছুমাত্র মমতা হয় নাই; কারণ সে আমার দুঃখকে এত তুচ্ছ বলিয়া জানে, যে, এত ক্ষুদ্র দুঃখে তাহার মমতাই জমিতে পারে না,…একজন যে গম্ভীর ভাবে বসিয়া বসিয়া আমার অশ্রুজলের সমালোচনা করিতেছে ইহা জানিতে পারা অতি কষ্টকর।..তুমি যদি আমার শোকের কারণ দেখিয়া কষ্ট পাইয়া থাক ত আইস, তোমাকে আমার মনের কথা বলি, তাহা হইলে আমার কষ্টের অনেকটা লাঘব হইবে, নহিলে তোমার যদি মনে হইয়া থাকে, দুর্ব্বল হৃদয়, অল্পেতেই কষ্ট পাইতেছে, উহাকে একটু থামাইয়া থুমাইয়া দিই, তবে তোমায় কাজ নাই, তোমার সান্ত্বনা দিতে হইবে না।*
সম্ভবত এরই উত্তরে অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ‘অশ্রুজল’ প্রবন্ধে লিখেছেন : ‘হায়, সংসারে এই অশুতে অশ্রুর প্রত্যুত্তর কি দুর্লভ! অশ্রুতে অশ্রু মিশান’ দূরে থাকুক অনেক সময়ে অনেক স্থলে অশ্রুর উত্তরে কেবল মাত্র তিরস্কার বা বিরক্তিই প্রতিদান পাওয়া যায়। …মর্ত্ত্যলোকের কোন কোন পিশাচ পিশাচীদের চক্ষুর্দ্বয় এমন বজ্ৰায়সে নির্ম্মিত, যে ভগ্ন-হৃদয়ের অনর্গল অশ্রুলহরীতে অশ্রু মিশান দূরে থাকুক, তাহাতেই তাহারা ঘৃণার হাস্য, উপেক্ষার কটাক্ষ বর্ষণ করিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হয় না।…কিন্তু ভগ্নহৃদয়ের অশ্রু থামিবার নহে, পাষাণ হৃদয়ের মমতাও পাইবার নহে’। রচনাটির মধ্যে গভীর হৃদয়ভাবের বর্ণনার ছলে হাস্য-পরিহাসের সুরটি অশ্রুত থাকবার কথা নয়। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পূর্বোল্লিখিত কবিতাটিও মনে পড়া স্বাভাবিক :
পাষাণ হৃদয়ে কেন সঁপিনু হৃদয়?…
হেরিলে গো অশ্রুরাশি, বরষে ঘৃণার হাসি,
বিরক্তির তিরষ্কা[স্কা]র তীব্র বিষময়।…
ভগ্নবুকে কেন আর, বজ্র হানে বার বার…
—সব-ক’টি রচনাতেই ‘ভগ্ন-হৃদয়’ কথাটির পৌনঃপুনিক ব্যবহারও লক্ষণীয়।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ‘বিদ্বজ্জন-সমাগম’ অনুষ্ঠানের দুটি বিবরণ আগেই আমরা উদ্ধার করেছি। এই বৎসর তৃতীয় অনুষ্ঠানটির সংবাদ পাওয়া যায়। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার 18 Feb 1878 [Vol. XXV, No. 7] সংখ্যায় নিম্নোদ্ধৃত সংবাদটি প্রকাশিত হয়: ‘Saturday, 16th February. …There were two interesting social gatherings this evening, …the other conversazione at Babu Debendranath Tagore’s to which his son Babu Dijendranath Tagore invited native authors and scholars. Both the reunions went off very well. At the last a little cherub in the person of a grand-daughter of Babu Debendranath Tagore, a sweet little girl of about ten or eleven years, discoursed angelic music. The amiable host was very attentive to his guests.’ এই ‘দেবদূতী’টি হেমেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্যা প্রতিভা দেবী ছাড়া আর কেউ নন। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ৫ ফাল্গুন ১২৮৪ তারিখে। পত্রিকার বিবরণটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, প্রতিভা দেবীর সংগীত-পরিবেশন ছাড়া অনুষ্ঠান-সূচিতে আর কিছু ছিল কি না, রবীন্দ্রনাথ কোনো অংশ গ্রহণ করেছিলেন কিনা, সংবাদটিতে তার কোনো উল্লেখ নেই। সমকালীন অন্যান্য সংবাদপত্র, যা আমাদের দেখার সুযোগ ঘটেছে, এ-বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব। যাই হোক, এটি যে ‘বিদ্বজ্জনসমাগম’ নামেই চিহ্নিত হয়েছিল* সংবাদে তার কোনো উল্লেখ না থাকলেও ভারতীর ক্যাশবহি থেকে তা জানা যায়। ২৮ মাঘ [শনি 9 Feb] তারিখের হিসাব দেখা যায় : ‘বিদ্বজ্জন সমাগম সভায়/সভ্যগণের নিকট পত্র লেখায়/মাশুল ৪৯ খানার কাত/৴৹ আনা হিঃ—৩/৴৹’; এইরূপে অন্তত ৬১ জনকে পত্রের দ্বারা আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, সেটি আমরা জানতে পারি ১২ ফাল্গুন তারিখের হিসাব থেকে : ‘দ° বিদ্বজ্জন সমাগম সভায়/নিমন্ত্রণ পত্র পাঠাইতে যেসমস্ত/টীকীট ভারতীর তহবিল হইতে দেওয়া হয় তাহা ফেরৎ পাওয়া যায়…৩৸৴৹’। দেখা যাচ্ছে, প্রথমে ভারতী-র পক্ষ থেকেই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হলেও পরে ঠাকুরবাড়ির সরকারী তহবিল থেকে সমস্ত ব্যয় নির্বাহ করা হয়েছে। বস্তুত পরবর্তীকালে অনুষ্ঠানটিকে ‘ভারতী-উৎসব’ নামেও অভিহিত করা হয়েছে, তা আমরা যথাস্থানে দেখতে পাব। যদিও হিসাবে ৬১ জনকে পত্র পাঠানোর কথা জানা যায়, তবু মনে হয় আগের দুটি সমাগম-এর মতো এটিতেও প্রায় একশো জন উপস্থিত ছিলেন, কারণ স্থানীয় অনেককেই নিশ্চয় মৌখিকভাবেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের কৈশোর-জীবনের বোধ হয় সব চেয়ে বড়ো ঘটনার সূত্রপাত ঘটল এই বৎসরেই। তাঁর স্কুলজীবন ও তার পরিণতির কথা আমরা আগেই জেনেছি। প্রায় দু-বছর তিনি বিদ্যালয়ের বন্ধন থেকে মুক্ত ছিলেন। সম্ভবত অভিভাবকেরাও এই সময়ে এ নিয়ে চিন্তা করাও ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের সবাপেক্ষা প্রতিভাবান ছেলেটি কেবল কবিতা লিখে দিন কাটিয়ে দিক এটাও তাঁদের পক্ষে সম্পূর্ণ মেনে নেওয়া শক্ত ছিল। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবার একটা সুযোগও এই সময়ে পাওয়া গেল। সত্যেন্দ্রনাথের সিভিল সার্ভিস চাকুরির নিয়মানুযায়ী তাঁর দু-বছরের ফার্লো ছুটি নেবার সময় হয়েছিল। এই ছুটি নেওয়ার ভূমিকা-স্বরূপ তিনি এই বৎসরের গোড়াতেই স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে ইংলণ্ডে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ছুটি নিয়ে সেখানে তাঁদের সঙ্গে মিলিত হবার পূর্বে তিনি দেবেন্দ্রনাথের কাছে প্রস্তাব করলেন যে রবীন্দ্রনাথকেও তাঁর সঙ্গী করে নেবেন। [বস্তুত, এ-ধরনের প্রস্তাব আগের বছরেই নেওয়া হয়েছিল, তখন সত্যপ্রসাদও তার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।] দেবেন্দ্রনাথও এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘ভারতী যখন দ্বিতীয় বৎসরে পড়িল [অর্থাৎ বৈশাখ ১২৮৫-তে] মেজদাদা প্রস্তাব করিলেন, আমাকে তিনি বিলাতে লইয়া যাইবেন। পিতৃদেব যখন সম্মতি দিলেন তখন আমার ভাগ্যবিধাতার এই আর-একটি অযাচিত বদান্যতায় আমি বিস্মিত হইয়া উঠিলাম।’৪৩ এ-সম্পর্কে তিনি আরও লিখেছেন : ‘কথা ছিল, পড়াশুনা করিব, ব্যারিস্টর হইয়া দেশে ফিরিব।’ কিন্তু সাম্প্রতিক একটি আবিষ্কার বিষয়টির একটি অন্যরূপ চিত্র তুলে ধরেছে। ১২ ফাঙ্গুন ১৩৮৫ [25 Feb 1979] তারিখের রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা-য় শোভন বসু ‘রবীন্দ্রনাথ আই সি এস হতে চেয়েছিলেন?’ প্রবন্ধে এবং ২৪ ফাল্গুন ১৩৮৫ [9 Mar 1979] তারিখের অমৃত [পৃ ১০-১১] সাপ্তাহিকে মৃদুলকান্তি বসু ‘রবীন্দ্রনাথ সিভিলিয়ান হতে চেয়েছিলেন’ প্রবন্ধে বিষয়টির উপর নতুন আলোকপাত করেছেন। আমরা এই দুটি প্রবন্ধ থেকে নিম্নে আলোচিত তথ্যগুলি আহরণ করেছি।
তথ্যগুলির উৎস হল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্টেট আর্কাইভস-এ রক্ষিত একটি ফাইল; ফাইলটির কভারে লিখিত আছে : File No. 4/1878/Government of Bengal/General Department/ Miscellaneous BRANCH/Proceedings for March 1878/Number of Proceedings/1-2/Subject/Application from Robindranath Tagore praying for a certificate of his age for the Indian Civil Service Examination/Date of Proceedings./13-3-78’ এই ফাইলে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্রে লেখা আছে:
To
The Secretary to the Government of Bengal.
Sir,
As I intend to proceed to England for the purpose of competing at the Indian Civil Service Examination I beg to request the favor of your granting me a certificate of my age as required by the Rules. I beg to submit my Horoscope in evidence of my age and to express my readiness to appear at the time & place which you may be pleased to appoint to prove the same.
I have the honor to be Sir, Your obedient servant, [Rabi]ndranath Tagore | |
Calcutta The [12]th March, 1878. |
এই পত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে একটি কোষ্ঠীও পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু সেটি ফাইলের মধ্যে পাওয়া যায়নি। [এই কোষ্ঠীটি সম্ভবত সরকারী দপ্তর থেকেই হারিয়ে যায়, কারণ ১২ অগ্র ১২৮৬ তারিখে ক্যাশবহি-র হিসাবে দেখা যায় : ‘ব° রামচন্দ্ৰ আচাৰ্য্য/দং শ্ৰীযুত বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুষ্ঠী/হারাইয়া যাইবায় নূতন কুষ্ঠী তৈয়ারির জন্য/উক্ত আচাৰ্য্যকে মূল্য দেওয়া যায়…১২৲’। এই কোষ্ঠীটিরও কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।]
উক্ত ফাইলে রবীন্দ্রনাথের আবেদনপত্রের সঙ্গে ছোটো দুটি চিঠিও আছে। তার একটি লিখেছেন জানকীনাথ ঘোষাল বেঙ্গল গভর্মেন্টের অ্যাসিস্টান্ট সেক্রেটারি রাজেন্দ্রনাথ মিত্রকে : ‘My dear Rajendra Baboo,/Herewith I send that application of Baboo Robindra N. Tagore, & his Horoscope [এইখানে ‘some.little books’ কথা কটি লিখে আবার কেটে দেওয়া হয়েছে, সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের জন্মকালীন কোষ্ঠী-ঠিকুজি সাধারণ রীতি অনুযায়ী লম্বা তুলোট কাগজে না লিখে ছোটো পুস্তকাকারের কাগজে লিখিত হয়েছিল] We shall feel greatly obliged to you by your forwarding them to the [? police) today with instructions to expedite the matter. Yours truly/ Janokeenath Ghosal/13th March, 1878.’ এর সঙ্গে আর-একটি হলুদ রঙের লম্বা ছোটো কাগজে নীল পেনসিলে জনৈক Stapleton-কে লেখা একটি চিঠি পাওয়া যায়; চিঠিটির সব কথা পড়া যায় না, শেষে লেখা আছে: ‘The young mañ [is] leaving Calcutta [? shortly] & he is willing to take his certificate with him. He goes with his brother Mr. S.N. Tagore, Judge of some place in Bombay.’
এই অনুরোধের ফলে কাজ হয়েছিল; ৬৯ নং ফাইলের March/78-এর 1/2B নং প্রোসিডিংসে 13-3-78 তারিখে নোট লেখা হয় : ‘This may be forwarded to the Commr. of Police Calcutta, with the request that he will be so good as to call on the Police Magistrate to enquire into and report on the application with the least practicable delay.’ এই তারিখেই ফাইলটি মূল আবেদনপত্র ও অন্যান্য কাগজ-সহ পুলিস কমিশনারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
20 Mar 1878 [বুধ ৮ চৈত্র] রবীন্দ্রনাথের বয়সের প্রমাণপত্র স্বাক্ষরিত হয়; সেটি এইরূপ :৪৪
Certificate of the date of the birth/of Baboo Robindra Nath Tagore proceeding to England.
I HEREBY certify that Babu Robindra Nath Tagore a candiddate/for admission to compete for the Indian Civil Service, has submitted the proofs of his birth to the Magistrate of the Calcutta district, and/has satisfied that officer that he was born about the date stated by him, viz./6th May 1861 (One thousand Eight hundred and Sixty one).
FORT WILLIAM.
The 20th March, 1878.
Sd/- Illegible
Secretary to the Government of Bengal in the General Department.
—অর্থাৎ 20 Mar [বুধ ৮ চৈত্র] তারিখে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য তাঁর বয়সের প্রমাণপত্র অনুমোদিত হয়েছিল। কিন্তু এই প্রমাণপত্র জোড়াসাঁকো থেকে আমেদাবাদে তাঁর কাছে প্রেরণ করা হয় ২৯ আষাঢ় ১২৮৫ [শুক্র 12 Jul 1878] তারিখে। এই বিলম্বের কারণ অজ্ঞাত।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “নাট্যমঞ্চে সাধারণের সমক্ষে প্রকাশ হইবার পূর্বে জ্যোতিদাদার ‘এমন কর্ম আর করব না’ প্রহসনে আমি অলীকবাবু সাজিয়াছিলাম। সেই আমার প্রথম অভিনয়।”৪৫ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চতুর্থ নাট্য-রচনা ও দ্বিতীয় প্রহসন ‘এমন, কৰ্ম্ম আর ক’রব না’ [Apr 1900-এ প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে ‘অলীকবাবু’ নামকরণ করা হয়] বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকা অনুযায়ী 7 Jul 1877 [শনি ২৪ আষাঢ়] প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রথম অভিনয়ের এতাবৎ উল্লিখিত তারিখ—1877—যদি ঠিক হয়, তাহলে সম্ভবত এই গ্রন্থ প্রকাশের পরবর্তীকালেই তা সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু এই সময়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি ভারতী প্রকাশের আয়োজন নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলেন যে তাঁদের পক্ষে নাট্যাভিনয়ের বন্দোবস্ত করা একটু শক্ত বলেই মনে হয়। ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাট্যসংগ্রহ’ [১৩৭৬] গ্রন্থের ‘প্রসঙ্গ-কথা’-য় [পৃ ৬৫৭] লিখিত হয়েছে, “এমন কর্ম আর করব না’ ‘বিদ্বজ্জন সমাগমে’র ১৮৭৭ সালের অধিবেশনে প্রথম অভিনীত হয়।“ এই তথ্য সম্পাদক কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন তা উল্লেখ করেননি, কিন্তু আমরা 1877-এ ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’-এর কোনো বিস্তৃত বিবরণ সংগ্রহ করতে পারিনি। ৫ ফাল্গন [16 Feb 1878]-এ যে অধিবেশনের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, তাতে নাট্যাভিনয় সম্পর্কে কোনো কথা নেই। সজনীকান্ত দাস লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথের প্রথম অভিনয় লইয়া মতভেদ আছে। তিনি ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখিয়াছেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘এমন কর্ম্ম আর করব না’ প্রহসনে (১৮৭৭) তিনি অলীকবাবু ভূমিকা অভিনয় করেন। কিন্তু গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় বলিতেন, রবীন্দ্রনাথ সর্ব্বপ্রথম ‘মানময়ী’ নামক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-সঙ্কলিত এক গীতি-নাটিকায় অভিনয় করিয়াছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি পুস্তকে এই নাটিকাটিই ভ্রমক্রমে ‘মানভঙ্গ’ নামে অভিহিত হইয়াছে।”৪৬ খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ও প্রায় একই কথা লিখেছেন, ‘বহু পূর্ব্বে (১৮৭৬?) তিনি আত্মীয়দের সম্মুখে বাটিতে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের “মানময়ীতে” ‘মদনের’ ভূমিকা এবং ‘বিবাহ উৎসব’ গীতিনাট্যে একটি স্ত্রী-ভূমিকা (১৮৭৭?) ও “এমন কৰ্ম্ম আর করব না” প্রহসনে ‘অলীক বাবুর ভূমিকা অভিনয় করেন (১৮৭৭)।…এই প্রহসনে জোড়াসাঁকো বাড়ীর অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথের একজন সহযোগী অভিনেতা ছিলেন তাঁহার বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ, ‘সত্যসিন্ধু’র ভূমিকায়।’৪৭ কিন্তু এই তথ্য সম্পূর্ণ নির্ভুল কি না সে-সম্বন্ধে সন্দেহ আছে। ‘মানময়ী’ প্রকাশিত হয় ১৮০২ শকে [১২৮৭ : 1880], রচনাকালও একই সমসাময়িক বলে মনে হয়—সুতরাং 1876-এ ‘মানময়ী’-তে রবীন্দ্রনাথের অভিনয়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অপরদিকে স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা ‘বিবাহ-উৎসব’-এর রচনা ও অভিনয় অনেক পরের কথা—হিরন্ময়ী দেবীর বিবাহ উপলক্ষে সম্ভবত 1884-এর গোড়ার দিকে এটি অভিনীত হয়েছিল—আর ‘বিবাহ উৎসব’ বলতে খগেন্দ্রনাথ যদি ‘বসন্ত উৎসব’ গীতিনাট্যের কথা বুঝিয়ে থাকেন তাহলে সেটির রচনা ও অভিনয় হয় 1879-এ, রবীন্দ্রনাথ যখন ইংলণ্ডে। সুতরাং এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাট্যাভিনয় বিষয়ে একটু সংশয় থেকে যাবেই। তবে রবীন্দ্রনাথের নিজের উক্তিকে প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করলে সিদ্ধান্ত করতে হয় 1877-এর দ্বিতীয়ার্ধের কোনো এক সময়ে তিনি ‘এমন কৰ্ম্ম আর ক’রব না’ প্রহসনে ‘অলীকবাবু’র ভূমিকায় প্রথম অভিনয় করেন, দর্শক ছিলেন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়বন্ধুরা। ঠাকুরপরিবারের মহিলারাই নারীচরিত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন—সজনীকান্ত দাস অন্য এক প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে কাদম্বরী দেবী ‘হেমাঙ্গিনী’র ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন৪৮—এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই অভিনয়ের সঠিক তারিখ ও বিবরণ কেউ রক্ষা করেননি। পরবর্তীকালে প্রহসনটি বহুবার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই অভিনীত হয়েছে, তার অনেকগুলির বিবরণ অবশ্য বিভিন্ন জনের রচনায় রক্ষিত হয়েছে—প্রসঙ্গত তার কিছু কিছু বর্ণনা পরে যথাস্থানে আমরা উদ্ধৃত করব।*
প্রাসঙ্গিক তথ্য : ১
এখানে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্কিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরণ সংকলিত হল।
বৈশাখ মাসের শেষ সপ্তাহে [May 1877] জ্ঞানদানন্দিনী দেবী দুই শিশুপুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও কবীন্দ্রনাথ এবং শিশুকন্যা ইন্দিরাকে নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ইংলণ্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। খবরটি সমাচার চন্দ্রিকা-র ২ জ্যৈষ্ঠ সোম 14 May [৬৬। ২৮] সংখ্যায় প্রকাশিত হয় : ‘বিগত সপ্তাহে সিভিলিয়ান বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী ইংলণ্ড গিয়াছেন। সত্যেন্দ্র বাবুও শীঘ্র ছুটি লইয়া ইংলণ্ড যাইবেন।—এদেশীয়দিগের ইংলণ্ড গমন করা একটি রোগ হইয়া পড়িয়াছে।‘ সংবাদটি পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনার সুরটিও লক্ষণীয়। এই পত্রিকাটিই ৭ শ্রাবণ শনি 21 Jul [৬৬। ৮৬] সংখ্যায় লেখে : ‘আমাদেবাদের [আমেদাবাদের] সিবিল এবং সেসন জজ বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী নিজ পুত্র কন্যাদিগের সহিত লিবারপুলে পৌঁছিয়াছেন। সন্তানদিগকে বিলাতে রাখিয়া শিক্ষা দেওয়াই গমনের উদ্দেশ্য। —কালে কালে কত কি হবে?’ ইংলণ্ড যাত্রা ও প্রবাস-সম্পর্কে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ‘স্মৃতিকথা’য় বলেছেন : ‘তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দ আন্দাজ বিলেত যাই, যতদূর মনে আছে। সেই সময় এক ইংরেজ দম্পতী বিলেত যাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে উনি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন বোধ হয় ওদের ভাষা কায়দাকানুন শেখবার জন্য। কারণ আমার স্বামী ইংরেজ সভ্যতার খুব ভক্ত ছিলেন। কিন্তু জাহাজে সমুদ্রপীড়ার জন্য আমার বড় কষ্ট হয়েছিল, প্রায়ই শুয়ে থাকতুম। তখন রামা বলে আমাদের এক সুরতী চাকর ছিল, তাছাড়া এক মুসলমান চাকর বিলেত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই দেশে ফিরে গেল। সে জাহাজে আমাদের খুব যত্ন করেছিল।‘ [পুরাতনী। ৩৮] ‘বিলেতে আমার যে ছেলেটি অসময়ে হয়, তার মাথাটা ভাল করে হয়নি, শীঘ্রই মারা গেল।…তার উপরের চোবি বলে’ ছোট ছেলেটিও বিলেতে মারা যায়।‘ [ঐ। ৪০] দর্পনারায়ণ ঠাকুর-বংশীয় প্রসন্নকুমার ঠাকুরের একমাত্র পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে সপরিবারে লণ্ডনে বাস করতেন। তিনিই জ্ঞানদানন্দিনী ও তাঁর পুত্রকন্যাদের অভিভাবক-স্থানীয় ছিলেন। পরে সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ যখন ইংলণ্ডে যান, তখনও চিঠিপত্র ও টাকা-পয়সা ইংলণ্ডে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের ঠিকানাতেই প্রেরিত হয়েছে।
সমাচার চন্দ্রিকা ৬ অগ্র মঙ্গল 20 Nov [৬৬।১৭২] সংখ্যায় একটি সংবাদ পরিবেশন করে : ‘গত ২৬শে কার্ত্তিক সোমবার কলিকাতা আদি ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার জ্যেষ্ঠ জামাতাকে সমভিব্যাহারে করিয়া চীন দেশে যাত্রা করিয়াছেন।’ এ-বিষয়ে সাধারণী-র [৯। ৪, ৪ অগ্র] সংবাদটি হল : ‘গত শনিবার ভক্তিভাজন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার জ্যেষ্ঠ জামাতা শ্রীযুক্ত শারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়কে সঙ্গে করিয়া চীনযাত্রা করিয়াছেন।’—এই দুটি সংবাদকে মিলিয়ে মনে হয় ২৬ কার্তিক শনিবার 10 Nov তারিখে দেবেন্দ্রনাথ সারদাপ্রসাদকে নিয়ে চীনদেশের উদ্দেশে যাত্রা করেন। উক্ত সংবাদটি দিয়ে সমাচার চন্দ্রিকা লেখে : ‘দেবেন্দ্রবাবু বৎসরের মধ্যে অধিক কালই দেশ ভ্রমণে অতিবাহিত করেন। কখন জল পথে কখন স্থল পথে কখন বা হিমালয় শিখরে ভ্রমণ করিয়া বিষয় ও ঈশ্বর চিন্তা করিয়া বেড়ান। সংসারে থাকিয়া ধৰ্ম্ম চিন্তা হয় না, একথা যাঁহারা বলেন, তাঁহারা যেন দেবেন্দ্র বাবুর কার্য্যের প্রতি লক্ষ্য করেন। কখন দুই প্রভুর উপাসনা করা যায় না, অতএব সংসার ও ঈশ্বর এই উভয় প্রভুর উপাসনা কিরূপে সম্পন্ন হইতে পারে? একথা যাঁহারা বলেন, তাঁহারা বুঝিবেন, ঈশ্বরকেই একমাত্র প্রভু জ্ঞান করিয়া সংসারকে নির্লিপ্ত ভাবে সেবা করাই ঈশ্বরের অভিপ্রেত। যোগীশ্বর যাজ্ঞবল্ক্য কহিয়া গিয়াছেন, সংসারী হইয়া যিনি সংসারী নহেন, তিনিই যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী।’ এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের কাছে দেবেন্দ্রনাথের ধর্মসাধনা কোন্ রূপে প্রতিভাত হত।
চীনে দেবেন্দ্রনাথ খুব অল্পদিনের জন্যই গিয়েছিলেন কারণ ধর্ম্মতত্ত্ব পত্রিকার ১ মাঘ [১২। ১] সংখ্যায় লেখা হয় : ‘বিগত বুধবার (২৬ পৌষ 9 Jan 1878] ভক্তিভাজন শ্ৰীযুক্তবাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় আমাদিগের আচার্য্য মহাশয়ের নূতন ভবনে আসিয়া সকলের সহিত সদালাপ করিয়া আমাদিগকে সুখী করিয়া গিয়াছেন। নূতন মুদ্রিত উৎকৃষ্ট রূপে বাঁধান দশ বার খণ্ড “ব্রহ্মধর্ম” পুস্তক উপহার দিয়াছেন।…পুনরায় তিনি জলীয় বায়ু সেবনের জন্য পদ্মানদীর উপরে বিচরণ করিতেছেন।’
২৪ ফাল্গুন [বৃহ 7 Mar 1878] দ্বিজেন্দ্রনাথের দুই পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ও অরুণেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্মের পদ্ধতি অনুসারে উপনয়ন হয়। ঠাকুরবাড়িতে এই পদ্ধতি অনুসারে এইটিই দ্বিতীয় উপনয়ন-অনুষ্ঠান, প্রথমটি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথদের বেলায়। ২৭ ফাল্গুন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দেবেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী দুজনকে উপদেশ প্রদান করেন [দ্র তত্ত্ববোধিনী, বৈশাখ ১৮০০ শক। ১৪-১৫]।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা ‘সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ নাটক’ পুনরভিনীত হয় গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ২৪ ও ৩১ বৈশাখ [শনি 5, 12 May 1877]। সমাচার চন্দ্রিকা দুটি অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে : ‘গত শনিবার সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ নাটকের অভিনয় হইয়া গিয়াছে। অভিনেতৃগণের মধ্যে লক্ষ্মণ সিংহ, বিজয়, সরোজিনী, রোষেণারা এবং রাণীর অভিনয় সুন্দর হইয়াছিল। শূন্যে কালীর আবির্ভাব বড় আশ্চর্য্য হইয়াছিল। সরোজিনীর অভিনয়ে দর্শকবৃন্দ ব্যথিত হন। চতুর্ভুজা দেবীর মন্দির প্রাঙ্গণে সরোজিনীর খেদোক্তি, রোষেণারার বলিদান এবং রাজপুত মহিলাগণের চিতায় প্রাণত্যাগ অতীব মনোহারী হইয়াছিল’ [২৭ বৈশাখ] এবং ‘গত কল্য শনিবার…গ্রেট ন্যাশনালে সরোজিনীর অভিনয় অতীব মনোহারি হইয়ছিল, এমন কি অভিনয় দর্শনে দর্শকগণ ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়াছিল। ফলকথা বলিতে কি এরূপ অভিনয় বোধ হয় ইতিপূর্ব্বে আর কখন হয় নাই’ [২ জ্যৈষ্ঠ]। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, সরোজিনীর ভূমিকায় প্রখ্যাত নটী বিনোদিনী অভিনয় করতেন।
প্রাসঙ্গিক তথ্য : ২
১১ মাঘ [বুধ 23 Jan 1878] আদি ব্রাহ্মসমাজের অষ্টচত্বারিংশ সাংবৎসরিক অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বদিন ১০ মাঘ দেবেন্দ্রনাথের ভবনে রাত্রি সাতটায় ‘ব্রহ্মোপাসনা ও ব্রাহ্মধৰ্ম্মের গ্রন্থ পাঠ’ দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। ১১ মাঘ সকালে দ্বিজেন্দ্রনাথ বক্তৃতা দেন ও শম্ভুনাথ গড়গড়ি প্রার্থনা করেন। ব্রহ্মসংগীত যেটি গীত হয়, সেটি দ্বিজেন্দ্রনাথের রচনা :
ভৈরোঁ—ঝাঁপতাল। অনুপম-মহিম পূর্ণব্রহ্ম কর ধ্যান।
দেবেন্দ্র-ভবনে সায়ংকালীন অনুষ্ঠানে বেচারাম চট্টোপাধ্যায় বক্তৃতা করেন ও নিম্নোক্ত ব্রহ্মসংগীতগুলি গীত হয় :
নট্ বেহাগ—ঝাঁপতাল। জয় পরম শুভ-সদন, ব্রহ্ম-সনাতন | [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ] |
কেদারা—সুরফাঁকতাল। দরশন দাও হে হৃদয়-সখা | [দ্বিজেন্দ্রনাথ] |
বসন্ত—সুরফাঁকতাল। আনন্দে আকুল সবে দেখি তোমারে | [ঐ] |
খাম্বাজ—ধামাল। ব্যাকুল হয়ে তব আশে প্রভু এসেছি তব দ্বারে | [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ] |
সিন্ধু—চৌতাল। কঠিন দুখ পাই হে মোহান্ধকারে | [ঐ] |
খাম্বাজ—একতালা। পরম দেব ব্রহ্ম জগজন-পিতামাতা | [ঐ] |
বাহার—কাওয়ালি। হৃদয়ের মম যতনের ধন তুমি হে | [ঐ] |
দেখা যাচ্ছে, দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দুজনে মিলে এবারের মাঘোৎসবে গানের ডালি সাজিয়েছিলেন। তত্ববোধিনী বা অন্যত্র প্রকাশিত বিবরণে রবীন্দ্রনাথের অংশ গ্রহণের কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু আমরা অনুমান করে নিতে পারি, সম্পাদক জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সর্বকর্মের সাথী এই সুকণ্ঠ কিশোর অবশ্যই সংগীতের দলে তাঁর যথাযযাগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।
এই বৎসরটি ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে কেশবচন্দ্রের একাধিপত্য, খ্রিস্টধর্মানুরক্তি, ভক্তিবাদের আতিশয্য, আদেশবাদ, স্ত্রী-স্বাধীনতার প্রশ্ন প্রভৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই যুব-সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছিল। কখনও কখনও তা প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে পরিণত হয়েছিল, এই সব প্রসঙ্গ আমরা পূর্বে কিছু কিছু আলোচনা করেছি। বর্তমানে কুচবিহারের নাবালক হিন্দু রাজা যোলো বছরের কম বয়স্ক নৃপেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের নাবালিকা কিঞ্চিদধিক তেরো বছর বয়স্কা জ্যেষ্ঠা কন্যা সুনীতি দেবীয় বিবাহকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ভাঙনে পর্যবসিত হল। প্রধানত কেশবচন্দ্রের উদ্যোগে বিধিবদ্ধ 1872-র ৩ আইন বা সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টে অভিভাবকদের সম্মতি সাপেক্ষে পাত্রের বয়স আঠারো ও পাত্রীর বয়স চৌদ্দ নির্ধারিত হয়েছিল। তাছাড়া ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ব্রাহ্মধর্মের আদর্শ অনুসারে শালগ্রাম শিলা আনয়ন, অগ্নিসাক্ষী বা হোম এবং অন্যান্য হিন্দু আচার পালনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। বয়স ও আচার পালনকে উপলক্ষ করে আদি ব্রাহ্মসমাজকে বহুবার উন্নতিশীল ব্রাহ্মদের নিন্দাভাজন হতে হয়েছে। এখন সেই দুটি অভিযোগ তাঁর স্ব-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা কেশবচন্দ্রেরই বিরুদ্ধে উত্থাপিত হল। [আশ্চর্যের বিষয়, আদি ব্রাহ্মসমাজ-ভুক্ত নবগোপাল মিত্রের উদ্যোগে ১৩ ফাল্গুন রবি 24 Feb 1878 বিকেল সাড়ে চারটায় অ্যালবার্ট হলে কেশবচন্দ্র সেনের কন্যার ‘বিবাহ সম্বন্ধে সহানুভূতি প্রকাশের জন্য’ একটি সভা হয়, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-ও এ-বিষয়ে যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দেয়।] কিন্তু কেশবচন্দ্র বলেন, ‘আমি ব্রাহ্মধর্ম্ম পরিত্যাগ করা যেরূপ পাপ মনে করি, এই বিবাহদানে বিরত হওয়া আমার পক্ষে সেইরূপ পাপ, এ প্রকার বিশ্বাস করিয়া থাকি। আমি যেমন ঈশ্বরাদেশে ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছি, সেই প্রকার আদেশেই এই বিবাহদানে প্রবৃত্ত হইয়াছি।‘৪৯ বিবাহ হয় ২৩ ফাল্গুন বুধ 6 Mar 1878 তারিখে; কেশবচন্দ্র জাতিচ্যুত—পাত্রপক্ষ এইরূপ অভিযোগ করায় তিনি যথারীতি কন্যাসম্প্রদান করতে পারেননি, তাঁর হয়ে এই কাজ করেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা কৃষ্ণবিহারী সেন। কেশবচন্দ্র তাঁর কন্যার বিবাহে বাল্যবিবাহদান ও পৌত্তলিকতাদোষে দূষিত হয়েছেন, এই অভিযোগ করে প্রতিবাদীদল তাঁকে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের আচার্য ও সম্পাদক পদ থেকে অপসারিত করার জন্য প্রবল আন্দোলন সৃষ্টি করেন। প্রতিবাদীদলের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস, দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী, শিবচন্দ্র দেব প্রভৃতি। এই উপলক্ষে তাঁরা 17 Feb থেকে সমালোচক ও 21 Mar থেকে Brahmo Public Opinion নামে বাংলা ও ইংরেজি দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকেন। নানাপ্রকার গোলযোগের পর পরবর্তী বৎসরে ২ জ্যৈষ্ঠ ১২৮৫ [বুধ 15 May 1878] তারিখে টাউন হলে প্রতিবাদী-দলের দ্বারা অনুষ্ঠিত এক সভায় একটি স্বতন্ত্র ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। নূতন ব্রাহ্মসমাজের নাম হয় ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মধর্ম ও নানা সমাজসংস্কার-মূলক কাজকর্মে এই সমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু একটি ব্রাহ্মসমাজ ভেঙে তিনটি ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হওয়ায় ও তাদের মধ্যে বাদ-প্রতিবাদ ইত্যাদির ফলে ব্রাহ্মধর্মান্দোলন যে যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর সেই সুযোগে এক প্রতিক্রিয়াশীল নব্য হিন্দুধর্ম কিভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, তার পরিচয় আমরা যথাস্থানে লাভ করব। আলোচ্য পর্বের ঘটনাবলির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অবশ্যই কোনো যোগ ছিল না, কিন্তু পরবর্তী কালে নানাভাবে তিনি এই দ্বন্দ্ব-বিরোধের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলেন, রবীন্দ্রজীবনে সেইজন্যেই এই ঘটনাগুলির প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।
প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৩
ভারতী পত্রিকার ইতিহাসে এর প্রচ্ছদটির গুরুত্ব আছে। কারণ, ‘অনেক গবেষণার পর’ এই প্রচ্ছদটির পরিকল্পনা গৃহীত হয় এবং এটিকে অবলম্বন করে প্রথম বর্ষের ভারতী-তে অন্তত দুটি কবিতা ও সম্পাদকের ভূমিকার মূল বক্তব্যটি রচিত হয়েছিল, তা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। পরবর্তীকালেও ঠাকুরবাড়ির বালক-বালিকাদের একটি অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথের বন্ধু হ. চ. হ. বা হরিশ্চন্দ্র হালদার যে স্টেজ তৈরি করে দেন, তাতেও ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছিল তার পরিচয় আছে হিরন্ময়ী দেবীর লেখায় : “ভারতী”র মলাটে তখন বীণাপাণির যে ছবি থাকিত, আমাদের ষ্টেজের শিরোভাগে অঙ্কিত হইয়াছিল সেই ছবি।‘৫০ সুতরাং ভারতী-র প্রচ্ছদ ও তার শিল্পী টি. এন. দেব বা ত্রৈলোক্যনাথ দেব সম্পর্কে আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা আছে। কমল সরকার দেশ পত্রিকায় [6 Oct 1979] “‘ভারতী’র প্রচ্ছদ” প্রবন্ধে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। আমরা প্রধানত এই প্রবন্ধে প্রদত্ত তথ্যগুলির উপরেই নির্ভর করেছি।
শরৎকুমারী দেবী লিখেছেন : ‘আর্ট ষ্টুডিয়োর দেবী সরস্বতীর ছবির অনুকরণে ভারতীর মলাটের ব্লক প্রস্তুত হয়’—এই আর্ট স্টুডিও হল বউবাজার স্ট্রীটে অবস্থিত ‘ক্যালকাটা আর্ট স্টুডিও’। এর উদ্দেশ্য ছিল ‘to paint portraits, land-scapes and scenes from mythology, history, novels, drama, in an improved and scientific style hitherto unknown to the native Arts in Bengal’ [The Bengalee, Vol. XX, No. 43, 8 Nov 1879]। প্রখ্যাত শিল্পী অন্নদাপ্রসাদ বাগচীর নেতৃত্বে নবকুমার বিশ্বাস, ফণীভূষণ সেন, যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণচন্দ্র পাল প্রমুখ গবর্মেন্ট আর্ট স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রেরা এই স্টুডিওটি প্রতিষ্ঠা করেন। এঁদের লিথোগ্রাফিক প্রথায় মুদ্রিত বিভিন্ন চিত্র তৎকালে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল, ‘সরস্বতী’ ছবি তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু 1879-এ যে স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত হয়, Jun-Jul 1877-এ সেই স্টুডিও থেকে প্রকাশিত ছবির অনুকরণে ভারতী-র প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও অঙ্কন কী করে সম্ভব হল, এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শক্ত। অনুমান করতে হয় যে, সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্যালকাটা আর্ট স্টুডিও Nov 1879-এ প্রতিষ্ঠিত হলেও, ছোটো আকারে তার কাজকর্ম—হয়তো অন্নদাপ্রসাদ বাগচীর একক প্রচেষ্টায়—আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল।
আর্ট স্টুডিও-র ছবিটি লিথোগ্রাফিক পদ্ধতিতে মুদ্রিত হলেও, ভারতী-র প্রচ্ছদটি কাঠ খোদাই করে তৈরি করা হয়। প্রচ্ছদ-শিল্পী ত্রৈলোক্যনাথ দেবের জন্ম 1847-এ চব্বিশ পরগনা জেলার বারুইপুরে। বিশিষ্ট ব্রাহ্মনেতা ও শিক্ষাব্রতী উমেশচন্দ্র দত্তের তত্ত্বাবধানে হরিনাভি স্কুলে তাঁর শিক্ষালাভ ঘটে। পরে তাঁরই প্রভাবে ত্রৈলোক্যনাথ কেশবচন্দ্রের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে সারাজীবন ব্রাহ্মসমাজের সেবা করে যান। বামাবোধিনী ও ভারত সংস্কারক পত্রিকার কার্যাধ্যক্ষও ছিলেন তিনি। গবর্মেন্ট আর্ট স্কুলে চিত্রবিদ্যা শিক্ষা করে উডএনগ্রেভার হিসেবে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় ও গ্রন্থে অজস্র কাঠখোদাই চিত্র তাঁরই রচনা। ভারতী-র সঙ্গেও তিনি দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১২৮৭ বঙ্গাব্দের ভারতীর ক্যাশবহি-তে দেখা যায় ১৫ আষাঢ় [28 Jun 1880] তারিখে উডকাটের জন্য তাঁকে উনিশ টাকা বারো আনা দেওয়া হয়েছে। Sep 1928-এ প্রায় একাশি বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৪
আমরা জানি, ভারতী-র প্রথম সংখ্যা থেকেই কিশোর-সমালোচক রবীন্দ্রনাথ মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য-এর দীর্ঘ বিরূপ সমালোচনা করেছিলেন। এই সমালোচনা অবশ্যই তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু সমসাময়িক কোনো পত্রিকায় এ-বিষয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য আমাদের চোখে পড়েনি। কিন্তু খুচরো কিছু মন্তব্যের বদলে যা পাওয়া গেছে, তা অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের গ্রন্থাগারে আখ্যাপত্রহীন ‘মেঘনাদবধ প্রবন্ধ’ [গ্রন্থ নং ২৬৮০; ২৫৩৩ নং আরও একটি কপির উল্লেখ তালিকায় আছে, কিন্তু সেটির সন্ধান পাওয়া যায়নি; গ্রন্থতালিকায় বইটির প্রকাশকাল ১২৮৭ বঙ্গাব্দ] নামে ৮৯ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ আছে, যার শেষে লেখা : ‘কাশ্যধীতি শ্ৰীযোগীন্দ্রনাথ তর্কচূড়ামণি* কৃত। “মেঘনাদবধ প্রবন্ধ” সমাপ্ত।’ বইটির ৩৩ পৃষ্ঠা থেকে ৬৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত নেই, ৮০-৮৯ পৃষ্ঠার প্রবন্ধের শিরোনাম ‘মাইকেল-চরিত।/(জীবন-চরিত গ্রন্থে দর্শন কর।)’—বোঝা যায় বইটিতে মোট তিনটি প্রবন্ধ ছিল, প্রথমটি ১-৩২ পৃষ্ঠায় ‘ভারতীতে সমালোচনার সমালোচনা’, ৩৩-৭৯ পৃষ্ঠায় অজ্ঞাতনামা একটি প্রবন্ধ এবং শেষেরটি উক্ত ‘মাইকেল-চরিত’। এর মধ্যে আমাদের কাছে আকর্ষণীয় হল প্রথম রচনাটি।
সাধু-চলিত ও ইংরেজি-বাংলা মেশানো অপাঠ্য গদ্যে বইটি লেখা; লেখক এই রীতি সমর্থনও করেছেন : ‘ভাষা চলিতে চলিতে ইংরাজী কথা ব্যবহার হয়েছে, অনুবাদ করা হয় নাই বাঙ্গালা অক্ষরেও দেওয়া হয় নাই তার বিবেচনা এই ইংরেজী বাঙ্গালা সংস্কৃতাদি জানে এমন ব্যক্তি যেমন এই মহাকাব্য পড়িবার অধিকারী, তেমনি ঐরূপ ব্যক্তিই এ criticism পড়িবার অধিকারী।…এরূপ স্থলে অনুবাদাদি চেয়ে মিশ্র ভাষাই শোভা পায়।‘ এই যুক্তিতে লেখক তাঁর রচনায় অনুবাদ না করেই দেবনাগরী অক্ষরে বাল্মীকির রামায়ণ থেকে ও গ্রীক অক্ষরে হোমারের ইলিয়াড থেকে দীর্ঘ দীর্ঘ অংশ উদ্ধৃত করেছেন।
তর্কচূড়ামণি তাঁর আলোচনা শুরু করেছেন এইভাবে : ‘ভারতীতে যে Spiritএ সমালোচনা করা হইয়াছে তাতে স্পষ্টই বোধ হয় যে অতি রাগ ও রুক্ষ্ম Spiritএ। ভাল অগ্রে দেখা যাউক এঁদের আপত্তি কটী।’ এই বলে তিনি একাদিক্রমে ১০ পর্যন্ত এবং তারও মধ্যে a b c d প্রভৃতি উপবিভাগ করে ভারতী-র সমালোচনার মূল অভিযোগগুলি সংকলন করেছেন এবং একে একে সেগুলি খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তা তিনি করুন, আজ তাঁর যুক্তি-প্রমাণাদিতে আমাদের আগ্রহ বোধ না করাই স্বাভাবিক; কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগে এই তথ্যটি যে তাঁর এত আয়োজন একটি ষোড়শবর্ষীয় বালকের রচনার প্রতিবাদের কারণে। যোগীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না, তিনি বি. এ. পাস করেছিলেন কি না তাও আমাদের জানা নেই, কিন্তু ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা…’ ইত্যাদির সমালোচনা করার পর একজন বি. এ. পাস তার জবাব লিখছেন শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর যে উদ্বেগের বর্ণনা জীবনস্মৃতি-তে করেছেন এই প্রসঙ্গে সেকথা আমাদের মনে পড়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে রচয়িতার নামের বদলে কেবল ‘ভ’ অক্ষরটি থাকায় নিতান্ত অন্তরঙ্গ জন ছাড়া অন্য কারোর পক্ষে লেখকের আসল পরিচয় জানা সম্ভব ছিল না, ফলে ভুল বোঝার আশঙ্কা ছিল। এক্ষেত্রে ঘটেছেও তাই। রচয়িতার নাম জানা না থাকায় ‘জ্বল্ জ্বল্ চিতা…’ গানটির জন্য সমস্ত প্রশংসা যেমন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লাভ করেছিলেন, এখানে তেমনি সমস্ত নিন্দা বর্ষিত হয়েছে দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রতি। প্রবন্ধের শেষে লেখক সেই কাজই করেছেন :
Unhappy Bharati! Will she now retract this review? (নিষ্কর্ম্মার editorই ও head masterই) দেখ্লেই বোধ হয় যে, a public চটান লেখা, এ দুষ্ট ভারতী!!… মেঘনাদবধ নামক মহাকাব্যের Depthএ কখনই প্রবেশ করা হয় নাই, আর সে প্রবেশের ক্ষমতা ও তাঁর পুণ্যও নাই তিনি দার্শনিক চক্ষে কাব্য বিচার করিয়াছেন তা সে দর্শন ঠিক হইলেও একাৰ্য্য ঠিক হইত। Philosophy এবং কাব্য ভিন্ন, ঘরে বসে চাকরের কাছে পড়লে কি বিদ্যা হয়, comparative ভালরূপ professor কাছে, ভাল টোলে বা কালেজে পড়লে বুদ্ধি মার্জ্জিত হইতে পারিত অথবা বাল্মীকি অংশ হেম ভট্টাচার্যের চরণ বন্দনা করিলে বুদ্ধি সুপথগামিনী হইত।…বোধ করি মাইকেল বিচারালয় সংক্রান্ত মহাপুরুষ (council) ছিলেন, তিনি কলিকাতা বিখ্যাত বিষয় মহাধুৰ্ত্ত দ্বারকানাথ ঠাকুর ও ইহাদের প্রতি কুলে কোন কাৰ্য্য করিয়াছিলেন বা মতে মত দেন নাই, তাতেই তদ্বংশীয়েরা (তাঁরে আর কি করবেন তাহার সাধারণ-সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন।)…সাহিত্যদর্পণকার বলেন—রসবুঝিতে পুণ্য চাই—সে পুণ্য অত বড় মহাবংশে Peerali সব গোল করে গিয়াছেন!!!*
বহুদিন পরে নব্যভারত পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় ১২৯৯ সংখ্যায় যোগীন্দ্রনাথ বসু-লিখিত ‘মেঘনাদবধচিত্র নামে একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের এই রচনাটি সমালোচিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এ-সম্পর্কে লেখেন : ‘বহুকাল হইল প্রথম বর্ষের ভারতীতে মেঘনাদবধ কাব্যের এক দীর্ঘ সমালোচনা বাহির হইয়াছিল, লেখক মহাশয় এই প্রবন্ধে তাহার প্রতিবাদ প্রকাশ করিতেছেন। তিনি যদি জানিতেন ভারতীর সমালোচক তৎকালে একটি পঞ্চদশবর্ষীয় বালক ছিল তবে নিশ্চয়ই উক্ত লোকবিস্মৃত সমালোচনার বিস্তারিত প্রতিবাদ বাহুল্য বোধ করিতেন।’৫১
রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধটি বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হলেও সমকালীন একটি পত্রিকায় যে উচ্চ-প্রশংসিত হয়েছিল, তার দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করেছেন সুনীল দাস E. Lekhbridge-সম্পাদিত The Calcutta Review [Vol. IXV (1877) pp. xv-xvi] পত্রিকায় প্রকাশিত ভারতী-র প্রথম দুটি সংখ্যার সমালোচনা থেকে :
The articles on the late Michael M.S. Dutta’s epic of Meghanadabadha have given rise to considerable discussion in the vernacular press. We think that the view taken by the writer of these articles is correct. Mr. Dutta’s Ravana is a failure. And what else could it be? Mr. Dutta himself wrote to one of his friends—‘I despise Ram and his rabble but the idea of Ravana elevates and kindles my imagination. He was a grand fellow.’ This means that the poet was a lover of physical power—not of moral beauty. He could perceive grandeur in the forcible abduction of a chaste and virtuous princess in plunder, rapine, and vaulting ambition, but not in that filial love and obedience which could exchange an empire for a wilderness. Milton’s ‘Satan’ is a success, not because Milton loved Satan but because he loved to hate him. The poet of Paradise Lost did not consider Satan ‘a grand fellow’. Mr. Dutta’s Satan is a failure, because Mr. Dutta loved not to hate him. He has invested ‘Ravana’ with feminine frailty, with the view of exciting in the readers’ mind commiseration for a doomed scourge and oppressor of the human race. To excite sympathy with wickedness and vice is not the function of true poetry; nor is that man a true poet who finds grandeur in vice and wickedness. Wickedness is an ‘odurate’ and a ‘steadfast’ thing. To make it weep like a woman is to confess ignorance of its very nature.৫২
উল্লেখপঞ্জি
১ ভারতী, বৈশাখ ১৩২৩।৭
২ পুরাতন প্রসঙ্গ। ২৯৭
৩ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি। ১৫১
৪ ভারতী, শ্রাবণ। ১-৩
৫ ‘ভারতীর ভিটা’। ৩৭৩
৬ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি। ১৫২
৭ পুরাতন প্রসঙ্গ। ২৯৭
৮ ‘ভারতীর ভিটা’। ৩৭৪
৯ দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৩
১০ ‘ভারতীর ভিটা’। ৩৭৩
১১ ‘মালতী পুথির একচল্লিশ পৃষ্ঠা’ : অমৃত, ২৬ মাঘ ১৩৮৫। ৩৯
১২ ‘ভারতীর ভিটা’। ৩৭৪
১৩ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি। ১৫২
১৪ জীবনস্মৃতি [১৩৬৮]। ২৪৬, তথ্যপঞ্জী ৭০ ॥৩
১৫ তত্ত্ব, মাঘ ১৮০৬ শক [১২৯১]। ২০৫
১৬ রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা ১।১৪০
১৭ দ্ৰ সা-সা-চ ৯। ৯৫। ৫৭
১৮ ছেলেবেলা ২৬। ৬২৫
১৯ বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস ৩। ৩২৫
২০ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৭২
২১ ঐ ১৭।৩৫৩-৫৪
২২ রবীন্দ্রজীবনী ১। ১১৫
২৩ জীবনস্মৃতি-গ্রন্থপরিচয় ১৭। ৪৮৯
২৪ বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস ৩। ৪৪, পাদটীকা ১
২৫ ‘ভারতীর ভিটা’। ৩৭৪
২৬ জীবনস্মৃতি-গ্রন্থপরিচয় ১৭। ৪৬৮; রবীন্দ্রবীক্ষা ১৩ এ [১৩৯২]। ৩৬
২৭ রবীন্দ্রজীবনী ১।৮২-৮৩
২৮ ঐ ১।৫২৯, ‘সংযোজন’
২৯ দ্র বি.ভা.প., বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৯১। ৪২০-২৩
৩০ করুণা ২৭।১১৭
৩১ ঐ ২৭। ১২১
৩২ ঐ ২৭। ১২৩
৩৩ দ্র রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা ১।১৫২, পাদটীকা ২
৩৪ রবীন্দ্রনাথ : জীবন ও সাহিত্য। ২২৩; পাঠের ভুল সংশোধিত।
৩৫ জীবনস্মৃতি [১৩৬৮]।১০৩-০৪; রচনাবলী-সংস্করণে ১৭। ৩৭৭-৭৮ পৃষ্ঠার মুদ্রণে ছাড় আছে।
৩৬ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৫৪-৫৫
৩৭ দ্ৰ শঙ্খ ঘোষ : ‘কবিকাহিনী’, ছন্দোময় জীবন [১৪০০]। ১৩-২৭
৩৮ ইতিহাস [১৩৬২]। ১০৩
৩৯ ঐ। ১০৪
৪০ রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা ১।১৪৮
৪১ ভারতী, মাঘ। ২৯৮-৯৯
৪২ ঐ। ৩০৪
৪৩ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৫৬
৪৪ দ্ৰ সনৎকুমার বাগচী : রবীন্দ্রনাথ ও বিবিধ প্রসঙ্গ [১৪০০]। ১৭৯ [লিপিচিত্র]
৪৫ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৮৪
৪৬ শনিবারের চিঠি, পৌষ ১৩৪৬। ৪৪৫-৪৬
৪৭ রবীন্দ্র-কথা। ১৯২-৯৩
৪৮ রবীন্দ্রনাথ : জীবন ও সাহিত্য। ২৩৩
৪৯ আচার্য্য কেশবচন্দ্র ২। ১১৮৬-৮৭
৫০ ‘কৈফিয়ৎ’: ভারতী, বৈশাখ ১৩২৩। ১৬
৫১ সাধনা, ভাদ্র-আশ্বিন ১২৯৯। ৪৪২
৫২ সুনীল দাস : ভারতী : ইতিহাস ও রচনাপঞ্জী [১৩৯১]। ১২-১৩
* পরিস্থিতিটি সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন শরৎকুমারী চৌধুরানী; ‘তখন “জ্ঞানাঙ্কুরের” চিহ্ন মাত্র ছিল না, “বঙ্গদর্শন” মধ্যাহ্ন-আকাশ হইতে ঢলিয়া পড়িয়াছে, আর “আৰ্য্যদর্শন” ধূমকেতুর মত বোধ হয় ছয় মাস বা নয় মাস অন্তর কদাচিৎ দেখা দিত।’—‘ভারতীর ভিটা’, বি. ভা. প., কার্তিক-পৌষ ১৩৫১।১১৩; শরৎকুমারী চৌধুরানীর রচনাবলী [সাহিত্য পরিষদ সং, ১৩৫৭]। ৩৭৫ [এই প্রবন্ধ থেকে পরবর্তী উদ্ধৃতিগুলির ক্ষেত্রে বর্তমান সংস্করণটির পৃষ্ঠা-সংখ্যা ব্যবহৃত হয়েছে।]
* ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন : ‘বিবাহের পর অক্ষয়চন্দ্রের পত্নী শরৎকুমারী পিতার সহিত আবার লাহোরে চলিয়া গিয়াছিলেন। বছর পাঁচেক পরে তিনি কলিকাতায় স্বামীর কাছে আসেন; অক্ষয়চন্দ্র তখন সিমলা অঞ্চলে [মানিকতলা স্ট্রীট] একটি বাটিতে অবস্থান করেন। এই সময়ে ‘ভারতী’ প্রকাশের জল্পনা-কল্পনা চলিতেছে।’ [সা-সা-চ ৭৬।৮-৯]–এই বর্ণনায় সামান্য ত্রুটি আছে। অক্ষয়চন্দ্রের বিবাহ হয় ২৯ ফাল্গুন ১২৭৭ [12 Mar 1871]—সুতরাং বিবাহের ছ’বছরের বেশি সময় পরে শরকুমারী স্বামীগৃহে প্রত্যাগমন করেন।
* পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায় স্থানটির নাম ‘জনেশ্বর’ পড়েছেন, কিন্তু তখনকার দিনে ‘ন’-এর নীচে বিন্দু দিয়ে [বা কখনাে না দিয়ে] ‘ল লেখা হত। দু “ভারতী’র ক্যাশবই ও গ্রাহক তালিকা” : দেশ, ও Aug 1977। ৫৭
* জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৫৪; এই প্রসঙ্গে ‘প্রথম পাণ্ডুলিপি’র পাঠটিও উদ্ধার-যোগ্য : ‘ইতিপূর্ব্বেই আমি বালক-স্বভাবসুলভ স্পর্দ্ধার সহিত মেঘনাদবধকাব্যের একটি সমালোচনা লিখিয়াছিলাম। পাঠকসাধারণের শ্রদ্ধাভাজন এই অমর কাব্যকে লাঞ্ছিত করিয়া আমি মনে মনে ভারি একটা বাহাদুরি লইতেছিলাম। সেই দাম্ভিক লেখাটা দিয়া ভারতীতে আমি প্রথম লেখা আরম্ভ করিলাম।‘
† বিষয়টির গুরুত্ব প্রথম আবিষ্কার করেন ড পশুপতি শাশমল এবং তাঁর ‘মালতী পুঁথির একচল্লিশ পৃষ্ঠা’ প্রবন্ধে [ অমৃত, ১৮। ৩৭, ২৬ মাঘ ১৩৮৫, পৃ ৩৮-৪৪] এ-নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। বহু তথ্য ও বিশ্লেষণে পূর্ণ এই মূল্যবান প্রবন্ধটি উৎসাহী পাঠককে পড়তে অনুরোধ করি।
* পাণ্ডুলিপিতে শব্দগুলি এমনভাবে লিখিত, যার থেকে নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত করা কঠিন। অনাথনাথ দাস ব্যক্তিগত পত্রে অনুমান করেছেন, ভিক্টর য়্যুগোর Les Contemplations কাব্যের Les Poetes কবিতাটির অনুবাদ এখানে করবেন বলে রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, যা কোনো কারণে সম্ভব হয়নি। কবিতাটি মূল কবিতার পাশেই সাদা পাতায় অনূদিত হয় : ‘ওই যেতেছেন কবি কাননের পথ দিয়া’। একটি সম্ভাবনা হিসেবে বিষয়টি আমরা উল্লেখ করলাম, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত করা দুরূহ।
* [Oct] 1887-এ দার্জিলিং থেকে ইন্দিরা দেবীকে লেখা একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ স্তবকটির একটি প্যারডিও রচনা করেন : ‘আমার কোমর আমারই কোমর,/বেচি নি তো তাহা কাহারও কাছে!।/ভাঙাচোরা হোক, যা হোক তা হোক,/আমার কোমর আমারই আছে!’ দ্র ছিন্নপত্রাবলী। ৪, পত্র ২
* আমরা পূর্ববর্তী সংস্করণে লিখেছিলাম, এই কবিতাটিই সামান্য পরিবর্তিত আকারে [‘যাও তবে প্রিয়তম সুদূর সেথায়’] ভারতী-র আষাঢ় ১২৮৫-সংখ্যায় মুদ্রিত হয় [পৃ ১৪১], কিন্তু সেখানে কবির নাম ‘মূর’। কিন্তু মঞ্জুলা ভট্টাচার্য 22 Jun 1986 তারিখের রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা-য় ‘রবীন্দ্রনাথ, মূর ও এমিলিয়া ওপি’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, দুটি অনুবাদের প্রথম ছত্রদুটি সদৃশ হলেও প্রকৃতপক্ষে সে-দুটি স্বতন্ত্র কবিতা। Mrs. Emelia Opie-রচিত কবিতাটির প্রথম ছত্র : ‘Go youth beloved, in distant glades’। শ্রীমতী ভট্টাচার্য তাঁর প্রবন্ধে মূল কবিতাটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করেছেন। এর জন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
† ‘At the age of sixteen he discussed the promotion of material prosperity in Bengal, and the possibilities of building up a new civilization through the meeting of East and West in an essay entitled Hope and Despair of Bengalis published in the Bhatati.’—‘RABINDRANATH TAGORE THE HUMANIST’. pp. 298-99
* পৌষ ১২৮৪ সংখ্যায় ‘বঙ্গসাহিত্য’ প্রবন্ধে অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী এই সর্গেরই অন্তর্গত ৬৭, ৬৯ ও ৭৪ [এই শ্লোকটি রবীন্দ্রনাথ বা দ্বিজেন্দ্রনাথ কেউ-ই অনুবাদ করেননি] সংখ্যক শ্লোকের সমিল পয়ার বা ত্রিপদীতে অনুবাদ করেছেন। আমরা তাঁর-কৃত অনুবাদের প্রথম দুটি অংশ ও মালতীপুঁথি-তে প্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ পাশাপাশি উদ্ধৃত করছি, তাতে প্রমাণিত হবে শুধু দ্বিজেন্দ্রনাথ-ই নন, অক্ষয়চন্দ্রও রবীন্দ্রকৃত অনুবাদের সংস্কার-সাধনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন :
ঈষৎ চঞ্চল হল তাপসের মন
সবেমাত্র চন্দ্রোদয়ে সাগর যেমন
বিম্বাধর উমামুখে তখন মহেশ
একেবারে ত্রিনয়ন করিলা নিবেশ।
٭ ٭ ٭
মুহূর্ত্তে ইন্দ্রিয়-ক্ষোভ করি নিবারণ,
দিগন্তের চারিধার, ফিরায়ে নয়ন তাঁর
দেখিতে লাগিলা কোথা বিকৃতি-কারণ।
—ভারতী, পৌষ ১২৮৪। ২৮১
অমনি হইলা হর ঈষৎ অধীর
সবেমাত্র চন্দ্রোদয়ে অম্বুরাশি সম
উমার মুখের পরে মহেশ তখন
একেবারে ত্রিনয়ন করিলা নিবেশ।…
মুহূর্ত্তে ইন্দ্রিয়ক্ষোভ করিয়া দমন
বিকৃতির হেতু কোথা দেখিবার তরে
দিগন্তে করিল দেব ত্রিনয়ন-পাত।
—রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা ১। ১০-১১
* তু° ‘আমার এ মনোজ্বালা কে বুঝিবে সরলে |
কেন যে এমন করে, ম্রিয়মান [7] হোয়ে থাকি।
কেন যে নীরবে হেন বসে থাকি বিরলে।…
হে সখী হে সখাগণ, আমার মৰ্ম্মের জ্বালা।
কেহই তোমরা যদি না পার গো বুঝিতে,
কি আগুন জ্বলে তার নিভৃত গভীর তলে।
কি ঘোর ঝটিকাসনে হয় তারে যুঝিতে।
তবে গো তোমরা মোরে শুধায়োনা শুধায়োনা
কেন যে এমন করে রহিয়াছি বসিয়া
বিরলে আমারে হেথা, একলা থাকিতে দাও,..’
—মালতীপুঁথি, পৃ 57/৩০, রবীন্দ্ৰজিজ্ঞাসা ১। ৮৫
* সাধারণী [৯।১৮, ১৩ ফাল্গুন, পৃ ২১২] অনুষ্ঠানটিকে ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’ নামেই অভিহিত করে লেখে : ‘স্বপ্নপ্রয়াণে যাহা দেখিয়াছিলাম, এবারকার বিদ্বজ্জন সমাগমে তা প্রত্যক্ষ করিয়া আমরা চরিতার্থ হইয়াছি;
ভাতে যথা সত্য-হেম মাতে যথা বীর। …। সেই দেব নিকেতন আলো করে কবি ॥২৫ ॥
বাস্তবিক দেব-নিকেতনেই বটে, আর দ্বিজ কবি যথার্থ স্বীয় ঔদার্য্যগুণে আলো করিয়া বিচরণ করিতে ছিলেন। কিসে সকলকেই পরিতুষ্ট এবং আপ্যায়িত করিব এই চেষ্টাতেই দ্বিজেন্দ্রনাথ অনবরত ব্যাপৃত ছিলেন। বৎসরান্তে এইরূপ যেন চিরদিনই হয়।’
* প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ পূর্বোক্ত নোটের খাতায় লিখেছেন :
কবির অভিনয়ে যোগ দেওয়া।
১) “অলীকবাবু” in ‘এমন কর্ম্ম আর করবো না’ (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, পরে বইয়ের নাম হয় অলীকবাবু) 1877, আষাঢ় [মন্মথনাথ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ৬৯-৭০] Also কথাবাত্তা 4 Jan 1932.
২) As মদন in “মানময়ী” (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ)— খগেনবাবুর কাছে [19/1/32] শুনেছি, তিনি দীনুবাবুর কাছে শুনেছেন; কিন্তু কবি বলেন যে তিনি মানময়ীতে কোনো part নেন্ নি [কবি-কথা 29/1/32]।
* ড সুকুমার সেন এই লেখকের লেখা ‘কাননকথা’ [1879] নামে একটি নাটকের কথা উল্লেখ করেছেন, দ্র বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস ২।১২০
* ‘মেঘনাদবধ প্রবন্ধ’। 31-32; উল্লেখযোগ্য যে, বানান বা ভাষায় আমরা কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করিনি।