অষ্টম অধ্যায়
১২৭৫ [1868-69] ১৭৯০ শক ॥ রবীন্দ্রজীবনের অষ্টম বৎসর
এই বৎসরে রবীন্দ্রনাথের জীবনে সবচেয়ে বড়ো ঘটনা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বধূ-রূপে কাদম্বরী দেবীর আবির্ভাব। এই ঘটনাকে জীবনের প্রায় শেষ পর্যন্ত গদ্যে-পদ্যে নানাভাবে তিনি স্মরণ করেছেন। সেই কারণে প্রসঙ্গটি কিছু বিস্তৃতভাবে আলোচিত হচ্ছে।
বিবাহানুষ্ঠানটি হয় ২৩ আষাঢ় [রবি 5 Jul 1868] তারিখে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-য় সংবাদটি পরিবেশিত হয় এইভাবে :
ব্রাহ্ম বিবাহ।/গত ২৩ আষাঢ় ব্রাহ্মসমাজের প্রধান আচার্য্য শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের পঞ্চম পুত্র শ্রীমান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহিত কলিকাতা নিবাসী শ্ৰীযুক্ত বাবু শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যার যথাবিধি ব্রাহ্মধর্ম্মের পদ্ধতি অনুসারে শুভ বিবাহ সমারোহ পূর্ব্বক সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। বিবাহ সভায় বহুসংখ্য ব্রাহ্ম এবং এতদ্দেশীয় প্রধান প্রধান অধ্যাপক ব্রাহ্মণ সকল উপস্থিত ছিলেন। দরিদ্রদিগকে প্রচুর ভক্ষ্য ভোজ্যে পরিতৃপ্ত করিয়া বিস্তর অর্থ প্রদান করাও হইয়াছিল।১
উদ্ধৃতিটিতে একটি ভুল আছে; জ্যোতিরিন্দ্র-বধূ তাঁর পিতার ‘দ্বিতীয়া কন্যা’ নন, তৃতীয়া কন্যা। এই পরিবারটি বহুদিন থেকেই জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে আত্মীয়তাসূত্রে ঘনিষ্ঠ ছিল। নীলমণি ঠাকুরের ভ্রাতা গোবিন্দরামের স্ত্রী রামপ্রিয়া দেবী নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র জগন্মোহন গাঙ্গুলিকে কলকাতা হাড়কাটা গলিতে বাড়ি করে দেন। তাঁরই চেষ্টায় কেনারাম রায়চৌধুরীর কন্যা দ্বারকানাথের মামাতো বোন শিরোমণি দেবীর সঙ্গে জগন্মোহনের বিবাহ হয়। জগন্মোহন সংগীতশিল্পে পারদর্শী ও গুণগ্রাহী ছিলেন। তাঁর শারীরিক শক্তিও ছিল অসামান্য। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর ‘আমার বাল্যকথা ও আমার বোম্বাই প্রবাস’ গ্রন্থে এঁর সম্পর্কে অনেক কথা লিখেছেন [দ্র পৃ ২]। এঁরই চতুর্থ পুত্র শ্যামলালের কন্যা কাদম্বরী দেবী।
সত্যেন্দ্রনাথ এই বিবাহের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। প্রথমত তিনি চেয়েছিলেন এই বয়সে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিবাহ না দিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁকে ইংলন্ডে পাঠাতে। 8 Jun [সোম ২৭ জ্যৈষ্ঠ] আহমদনগর থেকে স্ত্রীকে লেখা এক পত্রে তিনি লিখেছেন : ‘শ্যাম গাঙ্গুলীর ৮ বৎসরের মেয়ে—আমি যদি নতুন হইতাম, তবে কখনই এ বিবাহ সম্মত হইত [হইতাম না। কোন্ হিসাবে যে এ কন্যা নতুনের উপযুক্ত হইয়াছে জানি না।’২ বিবাহের পরেও 12 Jul [শুক্র ২৯ আষাঢ়]-এর পত্রে লেখেন : ‘শ্যামবাবুর মেয়ে মনে করিয়া আমার কখনই মনে হয় না যে ভাল মেয়ে হইবে—কোন অংশেই জ্যোতির উপযুক্ত তাহাকে মনে হয় না।’৩ তাঁর এই মনোভাবের কথা তিনি পিতাকে জানালে প্রত্যুত্তরে তিনি লেখেন : ‘জ্যোতির বিবাহের জন্য একটি কন্যা পাওয়া গিয়াছে এইই ভাগ্য। একেত পিরালী বলিয়া ভিন্ন শ্রেণীর লোকেরা আমাদের সঙ্গে বিবাহেতে যোগ দিতে চাহে না, তাহাতে আবার ব্রাহ্মধর্ম্মের অনুষ্ঠান জন্য পিরালীরা আমারদিগকে ভয় করে। ভবিষ্যৎ তোমাদের হস্তে—তোমাদের সময় এ সঙ্কীর্ণতা থাকিবে না।’৪ জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর—হয়তো-বা সত্যেন্দ্রনাথেরও—ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। তিনি বলেছেন : ‘যে সূর্যকুমার চক্রবর্তীকে দ্বারকানাথ ঠাকুর ডাক্তারী শেখাতে বিলেত নিয়ে গিয়েছিলেন, তার বড় মেয়ে Miss Carpenter-এর সঙ্গে বিলেত থেকে এসেছিল।…সে আমার বড় ছিল। শ্যামলা রঙের উপর তার মুখশ্রী ভাল ছিল। তাকে আমার দেবর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে বিয়ে দিতে আমার ইচ্ছে হয়েছিল; কলকাতায় এসে তাঁকে দেখিয়েওছিলুম।’৫
সে যাই হোক, কাদম্বরী দেবী বধূবেশে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ করলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
এমন সময় একদিন বাজল সানাই বারোয়াঁ সুরে। বাড়িতে এল নতুন বৌ, কচি শামলা হাতে সরু সোনার চুড়ি। পলক ফেলতেই ফাঁক হয়ে গেল বেড়া, দেখা দিল চেনাশোনার বাহির সীমানা থেকে মায়াবী দেশের নতুন মানুষ। দূরে দূরে ঘুরে বেড়াই, সাহস হয় না কাছে আসতে। ও এসে বসেছে আদরের আসনে, আমি যে হেলাফেলার ছেলেমানুষ।’৬
জীবনস্মৃতি-তেও অনুরূপ বর্ণনা আছে। তাছাড়াও পরবর্তীকালের বহু রচনায় কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো-বা আভাসে ইঙ্গিতে এই স্মৃতি প্রকাশ পেয়েছে—তাতেই বোঝা যায় বালকমনে এই আবির্ভাব কত গভীরভাবে দাগ কেটেছিল।
বিবাহের সময় কাদম্বরী দেবীর বয়স ছিল ঠিক নয় বৎসর [জন্ম—২২ আষাঢ় ১২৬৬ মঙ্গল 5 Jul 1859];৭ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বয়স উনিশ বছর দু’মাস। আর এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের বয়স সাত বছর দু’মাস। দেবেন্দ্রনাথ এই বিবাহে উপস্থিত ছিলেন না; গত মাঘোৎসবের আগেই দেশভ্রমণে বহির্গত হয়ে এ-সময়ে তিনি মূরী হিল্সে অবস্থান করছিলেন। অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন গণেন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথের ৬ শ্রাবণ [সোম 20 Jul]-এর পত্র* থেকে বিষয়টি জানা যায়। পারিবারিক হিসাব খাতা থেকে দেখা যায় ঘটক বিদায়, কুলীন বিদায়, অধ্যাপক বিদায়, পাকস্পর্শ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুপ্রথা এই বিবাহে পালিত হয়েছে। আর সমারোহ-পূর্ণ এই অনুষ্ঠানে বালক-বালিকারাও বঞ্চিত হয়নি : ‘বিবাহ উপলক্ষে বাটীর সমুদায় বালক বালিকাগণের পোসাক তৈয়ারির ব্যয়’ বাবদ দু’শো বারো টাকা সাড়ে পনেরো আনা খরচের সঙ্গে সঙ্গে অরুণেন্দ্র, সোমেন্দ্র, রবীন্দ্র ও সত্যপ্রসাদ বাবুর জন্য ‘ইংরাজের দোকান হইতে’ জুতো কিনে আনা হয়েছে।
সম্ভবত নিরক্ষরা-রূপে কিংবা সামান্য অক্ষর-জ্ঞান সম্বল করেই কাদম্বরী দেবী শ্বশুরগৃহে প্রবেশ করেছিলেন, কারণ এই বছরের হিসাবে দেখা যায় ৮ আশ্বিন [বুধ 23 Sep] তারিখে ‘ছোট বধূ ঠাকুরাণী ধারাপাত পুস্তক’ এবং ২৪ চৈত্র [সোম 5 Apr 1869] তারিখে ‘শ্রীমতী ছোট বধূ ঠাকুরাণীর জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ দুই খানা পুস্তক ক্রয়’ করা হয়েছে। প্রসঙ্গটি এখানে উত্থাপনের তাৎপর্য এই যে, এই আপাত-অশিক্ষিতা বালিকাটি কোন্ অবস্থা থেকে আপন অন্তর্নিহিত শক্তি ও পরিবেশের প্রভাবে কয়েক বৎসরের মধ্যেই একটি সাহিত্যগোষ্ঠীর মক্ষীরানীতে পরিণত হয়েছিলেন—সেই দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
এই বৎসর রবীন্দ্রনাথ নর্মাল স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছেন। নীলকমল ঘোষাল ১২৭৩ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাস থেকে তাঁদের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন, এখনও তাঁর কাছেই সকাল বেলা বাড়িতে পড়া তৈরি করতে হয়। নর্মাল স্কুলে বাংলা ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষার উপযোগী করে ছাত্রদের পড়ানো হত—সুতরাং ইংরেজি ভাষা-শিক্ষার ব্যাপারটি সেখানকার পাঠ্যসূচিতে তেমন গুরুত্ব লাভ করেনি, সেকথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু তৎকালীন পরিবেশ অনুযায়ী ইংরেজি শিক্ষার দিকটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনবহিত থাকা অভিভাবকদের পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। সুতরাং বাড়িতেই ইংরেজি পড়ানোর আয়োজন করা হল। ২২ আশ্বিন [বুধ 7 Oct] তারিখের হিসাবে দেখা যায় : ‘বঃ রাখালদাস দত্ত/ বালকদিগের ঘরে ইংরাজি পড়াইবার মাষ্টার/ দ° উহার শ্রাবণ ভাদ্র দুই মাহার/ বেতন শোধ ৬৲ হিঃ—/বিঃ এক বিল গুঃ খোদ/ রোক ১২৲’ অথাৎ শ্রাবণ ১২৭৫ [Jul 1868] থেকে রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিক ভাবে ইংরেজি শেখা শুরু করেন। জীবনস্মৃতি বা অন্য কোথাও রবীন্দ্রনাথ এই শিক্ষকটির কথা উল্লেখ করেননি। অবশ্য এঁর কার্যকাল খুব দীর্ঘ নয়—এই বৎসরের ২রা ফাল্গুন [শুক্র 12 Feb 1869] পর্যন্ত বেতন মিটিয়ে তাঁকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ না করলেও রবীন্দ্রজীবনীতে রাখালদাস দত্ত একটি উল্লেখযোগ্য স্থান পাবার অধিকারী। এঁর কাছেই—সম্ভবত প্যারীচরণ সরকারের First Book of Reading [1853] অবলম্বনে—রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি বর্ণমালা থেকে আরম্ভ করে কয়েকটি পাঠ আয়ত্ত করেছিলেন, তথ্যটি অবহেলা করার মতো নয়। অবশ্য অনুমানটি নিশ্ছিদ্র নয়। ছেলেবেলা-য় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘যখন আমাদের বয়সী ইস্কুলের সব পোড়োরা গড়গড় করে আউড়ে চলেছে I am up আমি হই উপরে, He is down তিনি হন নীচে, তখনও বি-এ-ডি ব্যাড এম-এ-ডি ম্যাড পর্যন্ত আমার বিদ্যে পৌঁছয়নি।’৮—এখানে তিনি যে বইয়ের কথা বলেছেন, তা প্যারীচরণ সরকারের First Book of Reading না হওয়াই সম্ভব। সেখানে Lesson 12-এ ‘I am up’ শেখবার পর [‘He is down’ বাক্যটি নেই] Lesson 13-এ ‘dad’ ‘pad’ জাতীয় বৰ্ণযোজনা শেখানো হয়েছে। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ-পঠিত প্রথম ইংরেজি বইটি অন্য কোনো বই হওয়াও সম্ভব। রাখালদাসের বিদায়-গ্রহণের কয়েকদিন পরে ২৩ ফাল্গুন [শুক্র 5 Mar 1869] থেকে এই পদে নিযুক্ত হন রবীন্দ্রনাথ-কথিত ‘অঘোর বাবু’—যাঁর পুরো নাম ছিল অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ এ-সম্পর্কে লিখেছেন : ‘বাংলাশিক্ষা যখন বহুদূর অগ্রসর হইয়াছে তখন আমরা ইংরেজি শিখিতে আরম্ভ করিয়াছি। আমাদের মাস্টার অঘোরবাবু মেডিকেল কলেজে পড়িতেন। সন্ধ্যার সময় তিনি আমাদিগকে পড়াইতে আসিতেন।’৯ অন্যত্র একই প্রসঙ্গ তাঁর উক্তি : ‘মাস্টারমশায় মিটমিটে আলোয় পড়াতেন প্যারী সরকারের ফার্স্ট্ বুক। প্রথমে উঠত হাই, তার পর আসত ঘুম, তার পর চলত চোখ-রগড়ানি।’১০ মাস্টারমশায়ের অন্য ছাত্রেরা সোনার টুকরো ছেলে, ঘুম পেলে তারা চোখে নস্যি ঘষে—এইসব কথা শোনা কিংবা সব ছেলের মধ্যে একলা মুখ্যু হয়ে থাকার বিশ্রী ভাবনাও তাঁকে জাগিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। রাত্রি ন’টা বাজলে ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে ছুটি মিলত। এইভাবেই ইংরেজি ভাষার জগতে রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রবেশ। অঘোরনাথ ফাল্গুনের শেষে এই ভার গ্রহণ করেছিলেন, সুতরাং বর্তমান বৎসরে তাঁর সম্পর্কে বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই। এই জন্য প্রসঙ্গটি আমরা পরে আবার উত্থাপন করব।
এইসময়ে বাড়ির অন্যদের শিক্ষার রূপটিও একটু পর্যালোচনা করা যেতে পারে। কাদম্বরী দেবীর প্রাথমিক শিক্ষার কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। ছোড়দিদি বর্ণকুমারী দেবীর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘ছোড়দিদি আমাদের সঙ্গে সেই একই নীলকমল পণ্ডিতমহাশয়ের কাছে পড়িতেন কিন্তু পড়া করিলেও তাঁহার সম্বন্ধে যেমন বিধান, না করিলেও সেইরূপ। দশটার সময় আমরা তাড়াতাড়ি খাইয়া ইস্কুল যাইবার জন্য ভালোমানুষের মতো প্রস্তুত হইতাম—তিনি বেণী দোলাইয়া দিব্য নিশ্চিন্তমনে বাড়ির ভিতরদিকে চলিয়া যাইতেন; দেখিয়া মনটা বিকল হইত।’১১ আশ্চর্যের বিষয়, বাড়িতে মেয়েদের শিক্ষার কিছু ব্যবস্থা থাকলেও, সৌদামিনী দেবীর পর দেবেন্দ্রনাথ তাঁর আর কোনো কন্যাকে স্কুলে প্রেরণ করেননি। বর্ণকুমারী দেবীও স্কুলে যাননি; তবে ‘শ্রীমতী বর্ণকুমারির সিলেট একখানা…ও বর্ণকুমারির রাইটীং রাঁধিবার কাগজ ইত্যাদি ক্রয়’-এর হিসাব দেখা যায়। এর পাশাপাশি ‘শ্ৰীমতী স্বর্ণকুমারীর পড়িবার জন্য কপি বহি ও ফোর্থ বুক অফ রিডিং ক্রয়’ করা হয়। মনে রাখা দরকার, এই হিসাব যখনকার [২৭ ভাদ্র] তখন তিনি সন্তান-সম্ভবা, এই সময়ে পড়াশুনোর চেষ্টা তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও স্বামীর উৎসাহের প্রমাণ। বছরের শেষভাগে ফাল্গুন [Mar 1869] মাসে দ্বিজেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র অরুণেন্দ্রনাথও নর্মাল স্কুলে ভর্তি হন, দ্বিপেন্দ্রনাথ তখন পড়ছেন বর্ণপরিচয় তৃতীয় ভাগ।
কালিদাস ও নদেরচাঁদের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে গত বৎসর পৌষ মাসে সোমেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ দ্বারি দাস নামক ভৃত্যের অধীনে আসেন। সত্যপ্রসাদের জন্য অবশ্য আলাদা ভৃত্য ছিল—তার নাম মাধব দাস। ফাল্গুন মাসে উভয় পক্ষেই ভৃত্যের বদল হল। সোমেন্দ্র ও রবীন্দ্রের ভৃত্য হল গোবিন্দ দাস, এর কথা রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন—‘বেঁটে কালো গোবিন্দ কাঁধে হলদে রঙের ময়লা গামছা ঝুলিয়ে আমাকে নিয়ে যায় স্নান করাতে।’১২ খুব বেশি দিন কাজ করা অবশ্য তার ভাগ্যে সম্ভব হয়নি, চৈত্র মাসের ২৫ তারিখে তার জবাব হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লেখনীর স্পর্শ তাকে অমরত্ব দান করেছে, অপেক্ষাকৃত দীর্ঘকাল কাজ করেও যে সৌভাগ্য অনেকেই লাভ করতে পারেনি। ১৪ ফাল্গুন [বুধ 24 Feb] তারিখ থেকে সত্যপ্রসাদের ভৃত্য হিসেবে বহাল হল ঈশ্বর দাস, ১২৭৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস থেকেই হিসাব-খাতায় তার নতুন পরিচয় লেখা হয়েছে ‘সোমেন্দ্র ও রবীন্দ্রবাবুদিগের চাকর’-রূপে—যার বেতন দীর্ঘকাল ছিল মাসিক সাড়ে তিন টাকা। এর কথা রবীন্দ্রনাথ বিস্তারিতভাবে লিখে গেছেন, যথাস্থানে আমরা সে-প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করব।
এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের ‘কবিতা-রচনারম্ভ’। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : ‘আমার বয়স তখন সাত-আট বছরের বেশি হইবে না। আমার এক ভাগিনেয় শ্রীযুক্ত জ্যোতিঃপ্রকাশ* আমার চেয়ে বয়সে বেশ একটু বড়ো। …আমার মতো শিশুকে কবিতা লেখাইবার জন্য তাঁহার হঠাৎ কেন যে উৎসাহ হইল তাহা আমি বলিতে পারি না। একদিন দুপুরবেলা তাঁহার ঘরে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, “তোমাকে পদ্য লিখিতে হইবে।” বলিয়া, পয়ারছন্দে চৌদ্দ অক্ষর যোগাযোগের রীতিপদ্ধতি আমাকে বুঝাইয়া দিলেন।’১৩ জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপির বর্ণনা আরও একটু বিস্তৃত এবং অতিরিক্ত তথ্যবহুল : ‘একদিন দুপুর বেলায় তাঁহার ঘরে ডাকিয়া লইয়া কেমন করিয়া চোদ্দ অক্ষর মিলাইয়া কবিতা লিখিতে হয় আমাকে বিশেষ করিয়া বুঝাইলেন এবং আমার হাতে একটা স্লেট দিয়া বলিলেন পদ্মের উপরে একটা কবিতা রচনা কর। তাহার পূর্ব্বে বারম্বার রামায়ণ মহাভারত পড়িয়া ও শুনিয়া পদ্যচ্ছন্দ আমার কানে অভ্যস্ত হইয়া আসিয়াছিল। গোটাকতক লাইন লিখিয়া ফেলিলাম। জ্যোতি খুব উৎসাহ দিলেন।’ ছেলেবেলা-য় প্রসঙ্গটির বর্ণনা এইরূপ : ‘আমার চেয়ে বড়ো বয়সের এক ভাগনে একদিন বাৎলিয়ে দিলেন চোদ্দ অক্ষরের ছাঁচে কথা ঢাললে সেটা জমে ওঠে পদ্যে। স্বয়ং দেখলুম এই জাদুবিদ্যের ব্যাপার। আর হাতে হাতে সেই চোদ্দ অক্ষরের ছাঁদে পদ্মও ফুটল; এমন-কি, তার উপরে ভ্রমরও বসবার জায়গা পেল।’১৪ এই উদ্ধৃতিগুলি থেকে আমরা কয়েকটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি। জ্যোতিঃপ্রকাশই কাব্যরচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের প্রথম গুরু, আর রবীন্দ্র-রচিত প্রথম কবিতাটিই যে ফরমায়েশি কবিতা—একথা আমরা জানতে পারছি উদ্ধৃতিগুলি থেকে। আরও জানা যাচ্ছে কবিতাটি লেখা হয়েছিল শ্লেটে ও চৌদ্দমাত্রিক তানপ্রধান [পয়ার] ছন্দে—কবিতাটির বিষয়বস্তু প্রকৃতি এবং প্রথম সমালোচনা কবির পক্ষে অনুকূলই ছিল, জ্যোতিঃপ্রকাশের উৎসাহদানে তারই প্রমাণ।
এতগুলি কার্যকারণ-পরম্পরার অবশ্যম্ভাবী ফল ফলতে দেরি হল না। এতদিন ছাপার বইতে দেখা পদ্য যে সম্ভ্রম লাভ করে এসেছিল, কয়েকটি শব্দ জোড়াতাড়া দিতে তাই যখন পয়ার হয়ে উঠল, তখন পদ্যের সেই মহিমা আর বজায় রইল না। জমিদারি-সেরেস্তার কোনো একটি কর্মচারীর কৃপায় একখানি নীল কাগজের ফুল্স্ক্যাপ খাতা* জোগাড় করে ‘স্বহস্তে পেনসিল দিয়া কতকগুলা অসমান লাইন কাটিয়া বড়ো বড়ো কাঁচা অক্ষরে পদ্য লিখিতে শুরু করিয়া দিলাম।’১৫ দাদা সোমেন্দ্রনাথ ভাইয়ের এই কবিপ্রতিভায় বিমুগ্ধ হয়ে প্রচারকের ভূমিকা গ্রহণ করলেন। একদিন একতলায় কাছারির আমলাদের কাছে কবিত্ব ঘোষণা করে দুই ভাই বেরিয়ে আসছেন, এমন সময় ন্যাশানাল পেপার-এর এডিটর নবগোপাল মিত্রকে দেখে সোমেন্দ্রনাথ তাঁকে কবিতা শোনানোর জন্যে ধরলেন : ‘শুনাইতে বিলম্ব হইল না। কাব্যগ্রন্থাবলীর বোঝা তখন ভারি হয় নাই। কবিকীর্তি কবির জামার পকেটে-পকেটেই তখন অনায়াসে ফেরে।…পদ্মের উপরে একটা কবিতা লিখিয়াছিলাম, সেটা দেউড়ির সামনে দাঁড়াইয়াই উৎসাহিত উচ্চকণ্ঠে নবগোপালবাবুকে শুনাইয়া দিলাম।’১৬ কবিতাটিতে একটি শব্দ ছিল ‘দ্বিরেফ’, শব্দটির উপর বালককবির আশা-ভরসা সবচেয়ে বেশি ছিল—কিন্তু নবগোপালবাবুর উপর প্রতিক্রিয়া হল অন্যরকম, এমন-কি তিনি হেসে উঠলেন। এই হাসিই রবীন্দ্রকাব্যের প্রথম বিরূপ সমালোচনা। তার আঘাতে রবীন্দ্রনাথের মনে হল নবগোপালবাবু সমজদার লোক নন, যদিও শব্দটি পরিবর্তন করতেও তিনি রাজি ছিলেন না—‘শব্দটা মধুপানমত্ত ভ্রমরেরই মতো স্বস্থানে অবিচলিত রহিয়া গেল।’১৬
প্রসঙ্গান্তরে যাবার আগে আর-একটি তথ্যের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। জ্যোতিঃপ্রকাশের ফরমায়েশে লেখা কবিতাটি পদ্মের বিষয়ে লেখা, আর নবগোপাল বাবুকে যে কবিতাটি শোনানো হয়, সেটিরও বিষয়বস্তু পদ্ম। দুটি কি একই কবিতা? প্রথম কবিতাটি লেখা হয়েছিল শ্লেটে, দ্বিতীয়টি শোনানো হয়েছিল নীল খাতা থেকে। শ্লেটের কবিতাটিই যদি খাতায় তোলা হয়ে থাকে, তাহলে একই কবিতা বারবার লেখার যে অভ্যাস আমরা পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দেখতে পাই এখানে তারই সূচনা। ছেলেবেলা-য় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘মনে পড়ে পয়ারে ত্রিপদীতে মিলিয়ে একবার একটা কবিতা বানিয়েছিলুম, তাতে এই দুঃখ জানিয়েছিলুম যে, সাঁতার দিয়ে পদ্ম তুলতে গিয়ে নিজের হাতের ঢেউয়ে পদ্মটা সরে সরে যায়, তাকে ধরা যায় না।’১৭ সব ক’টি কবিতাতেই ঘুরে ফিরে পদ্মের কথা এসেছে, এটা কি কোনো তাৎপর্য বহন করে?
উপরোক্ত কবিতাগুলি, অন্তত প্রথম দুটি কবিতা [না কি একটি?], রবীন্দ্রকাব্যের ইতিহাসে আদিতম কবিতা রূপে গণ্য হতে পারে। অবশ্য প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়ের আরও একটি কবিতার উল্লেখ তিনি করেছেন :
পূজায় বলিদানের গল্প শুনে ঠিক করেছিলুম সিঙ্গিকে বলি দিলে খুব একটা কাণ্ড হবে। তার পিঠে কাঠি দিয়ে অনেক কোপ দিয়েছি। মন্তর বানাতে হয়েছিল, নইলে পূজো হয় না।—
সিঙ্গিমামা কাটুম
আন্দিবোসের বাটুম
উলুকুট ঢুলুকুট ঢ্যামকুড়কুড়
আখরোট বাখরোট খট খট খটাস
পট পট পটাস।
এর মধ্যে প্রায় সব কথাই ধার-করা, কেবল আখরোট কথাটা আমার নিজের। আখরোট খেতে ভালোবাসতুম। খটাস শব্দ থেকে বোঝা যাবে আমার খাঁড়াটা ছিল কাঠের। আর পটাস শব্দে জানিয়ে দিচ্ছে সে খাঁড়া মজবুত ছিল না।*
কবিদের সব কথাই তো ধার-করা, তা থেকে যদি বিশেষ কিছু ‘বোঝা’ যায়, তা যদি কিছু ‘জানিয়ে’ দেয়, তাহলে তো সবটাই কবির নিজস্ব হয়ে দাঁড়ায়—‘আখরোট’ কথাটা ব্যবহার না করলেও। রবীন্দ্রনাথ মন্ত্রটির উল্লেখ করেছেন তাঁর রেলিং-ছাত্রদের প্রসঙ্গে, যেটি তাঁর প্রথম স্কুল জীবনের ঘটনা। তাই যদি হয়, তাহলে রবীন্দ্রনাথের কাব্যরচনার ইতিহাসকে আরও পিছনে টেনে নিয়ে যেতে হয়, তাঁর চার বৎসর বয়সে। মন্ত্রটি লৌকিক ছড়ার ছন্দে রচিত—সাধু পয়ারে নয়—এটিও এ-প্রসঙ্গে স্মর্তব্য।১৮
নীল খাতায় কবিতা লেখা শুরু করার পর তাঁর ভাগ্যে আরও একটি প্রচ্ছন্ন সমাদর জুটেছিল। জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘সেজদাদাকে বড় ভয় করিতাম। সত্য একদিন আমার খাতা লইয়া তাঁহার হাতে দিল। পদ্যলেখায় সময়যাপনকে পাছে তিনি অপরাধ বলিয়া গণ্য করেন এই ভয়ে আমি লুকাইয়া বেড়াইতেছি এমন সময়ে আমার খাতা ফিরিয়া আসিল এবং যাহা রিপোর্ট পাওয়া গেল তাহাতে নিরাশ্বাস হইবার কোনো কারণ দেখিলাম না।’
এই বছর থেকেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর-পরিবারে যথেষ্ট প্রাধান্য লাভ করতে শুরু করেন। সংগীতচর্চা তিনি অনেকদিন ধরেই করছিলেন, ‘নব-নাটক’-এর অর্কেস্ট্রা-রচনা তারই পরিচয়। সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে বোম্বাই গিয়ে তিনি সেতারও শেখেন। সেই সাংগীতিক উৎসাহ এই বৎসর ঊনচত্বারিংশ সাংবৎসরিক ব্রাহ্মসমাজ অনুষ্ঠান উপলক্ষে উৎসারিত হয়ে ওঠে [১১ মাঘ শনি 23 Jan 1869]। হিমালয়-প্রত্যাগত দেবেন্দ্রনাথের উপস্থিতিও এই সমারোহের কারণ। কেশবচন্দ্রের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর এই প্রথমবার বহু সংগীতের মালায় [সর্বমোট ১৫টি গান] উৎসবটি সজ্জিত হয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একটি বক্তৃতাও করেন। বালক রবীন্দ্রনাথের উপরেও এই অনুষ্ঠানের প্রভাব পড়েছিল তা জানা যায় জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপি থেকে : ‘আমাদের পরিবারে গানচর্চার মধ্যে শিশুকাল হইতে আমরা বাড়িয়া উঠিয়াছি। কবে যে গান গাহিতে পারিতাম না তাহা মনে পড়ে না। মনে আছে, বাল্যকালে গাঁদাফুল দিয়া ঘর সাজাইয়া মাঘোৎসবের অনুকরণে আমরা খেলা করিতাম। সে খেলায় অনুকরণের আর-আর সমস্ত অঙ্গ একেবারেই অর্থহীন ছিল কিন্তু গানটা ফাঁকি ছিল না। এই খেলায় ফুল দিয়া সাজানো একটা টেবিলের উপরে বসিয়া আমি উচ্চকণ্ঠে ‘দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম-আননে’ গান গাহিতেছি, বেশ মনে পড়ে।’১৯ লক্ষণীয়, গণেন্দ্রনাথ-রচিত উক্ত ব্রহ্মসংগীতটি এই বৎসরে মাঘোৎসবের সায়ংকালীন অধিবেশনে গীত হয়েছিল।
প্রসঙ্গত এইখানে রবীন্দ্রনাথের সংগীত-শিক্ষা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করে নেওয়া যেতে পারে। তাঁর শৈশবে বিশিষ্ট পরিবারে সংগীতবিদ্যার অধিকার ছিল বৈদগ্ধ্যের অন্যতম প্রমাণ। এই ঐতিহ্যানুসারে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সংগীতের স্রোত প্রবাহিত হত। দেবেন্দ্রনাথ নিজে ছোটোবেলায় সাহেব শিক্ষকের কাছে পিয়ানো শিখেছেন, পরে ওস্তাদের কাছে গানবাজনার চর্চাও করেছেন। রামমোহনের সময় থেকে হিন্দি গানের সুরে বাংলা কথা বসিয়ে ব্রহ্মসংগীত রচনার যে প্রথার সূত্রপাত, দেবেন্দ্রনাথের সময়ও তা অব্যাহত ছিল। তাঁর পুত্রেরা—দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ—সকলেই নিষ্ঠার সঙ্গে সংগীতচর্চা করেছেন। জামাতা সারদাপ্রসাদ বিখ্যাত সেতারী জুয়ালাপ্রসাদের কাছে সেতার শিখতেন, তাঁর বৈঠকখানায় অনেক নামী সংগীতশিল্পীর সমাগম হত। তাছাড়া ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের বেতনভোগী গায়ক বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তী। ইনি এবং এঁর দাদা কৃষ্ণ রামমোহনের সময় থেকেই ব্রাহ্মসমাজে গান গাইতেন। কৃষ্ণের মৃত্যুর পরেও তিনি এই কাজে বহাল থাকেন ও অতি বৃদ্ধ বয়সে ১২৮৯ বঙ্গাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর পুত্রদের রচিত অনেক গানে তিনিই সুর দেন, কিংবা তাঁর প্রদত্ত অনেক হিন্দি গানের সুরে কথা বসিয়ে তাঁরা ব্রহ্মসংগীত রচনা করেন। ইনি ঠাকুর-পরিবারের সংগীতশিক্ষকও ছিলেন। স্বভাবতই শৈশব থেকে এঁর কাছে রবীন্দ্রনাথকেও সংগীতের পাঠ গ্রহণ করতে হয়েছে—রবিবার সকাল ছিল এই সংগীতশিক্ষার সময়। এই শিক্ষা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন: ‘বিষ্ণু যে গানে হাতেখড়ি দিলেন এখনকার কালের কোনো নামী বা বেনামী ওস্তাদ তাকে ছুঁতে ঘৃণা করবেন। সেগুলো পাড়াগেঁয়ে ছড়ার অত্যন্ত নীচের তলায়।’২০ কয়েকটি নমুনাও তিনি স্মৃতি থেকে উদ্ধার করেছেন; যেমন—
‘চন্দ্র সূর্য হার মেনেছে, জোনাক জ্বালে বাতি
মোগল পাঠান হদ্দ হল,
ফার্সি পড়ে তাঁতি।’২১
কিংবা, ‘গণেশের মা, কলাবউকে জ্বালা দিয়ো না,
তার একটি মোচা ফললে পরে
কত হবে ছানাপোনা।’ ইত্যাদি।
বিষ্ণুর সংগীতশিক্ষাদানের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
এখনকার নিয়ম হচ্ছে প্রথমে হারমোনিয়মে সুর লাগিয়ে সা রে গা মা সাধানো, তার পরে হালকা গোছের হিন্দি গান ধরিয়ে দেওয়া। তখন আমাদের পড়াশুনোর যিনি তদারক করতেন [সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ] তিনি বুঝেছিলেন, ছেলেমানুষি ছেলেদের মনের আপন জিনিস, আর ঐ হালকা বাংলা ভাষা হিন্দি বুলির চেয়ে মনের মধ্যে সহজে জায়গা করে নেয়। তা ছাড়া, এ ছন্দের দিশি তাল বাঁয়া-তবলার বোলের তোয়াক্কা রাখে না। আপনা-আপনি নাড়িতে নাচতে থাকে।…তখন হারমোনিয়ম আসে নি এ দেশের গানের জাত মারতে। কাঁধের উপর তম্বুরা তুলে গান অভ্যাস করেছি। কল-টেপা সুরের গোলামি করি নি।’২২
আর একটি প্রসঙ্গ আমরা এইখানেই আলোচনা করে নিতে চাই। জীবনস্মৃতি, ছেলেবেলা প্রভৃতি স্মৃতিকথামূলক রচনায় পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির ব্যাপারে তাঁদের দৈন্যদশার কথা রবীন্দ্রনাথ বহুবার বহুভাবে লিখেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত পারিবারিক হিসাবসম্বলিত ক্যাশবহি-গুলির সাক্ষ্য ভিন্ন ধরনের। আগেই বলা হয়েছে, ১২৭১ বঙ্গাব্দের পূর্বের এইধরনের কোনো খাতা আমাদের হাতে আসেনি। ২৪ পৌষ ১২৭১ [শুক্র 6 Jan 1865] ‘রবিবিন্দ্রবাবুর ইজের ১২টা’ বারো আনাতে যেমন কেনা হয়েছে, তেমনি ১৪ অগ্র [সোম 28 Nov 1864] ‘রবিন্দ্রনাথ বাবুর ১২টা ইজের তৈয়ারি’ করতে তিন টাকা পনেরো আনাও খরচ করা হয়েছে। আবার ৮ বৈশাখ ১২৭২ [বুধ 19 Apr 1865] ‘রবীন্দ্রবাবুর পিরান ১২টা’-খাতে দু’টাকা দশ আনা ব্যয় হলেও ১৮ চৈত্র ১২৭১ [বৃহ 30 Mar 1865] ‘রবিইন্দ্রনাথবাবুর ১২টা পীরান’-খাতে খরচের পরিমাণ পাঁচ টাকা সাড়ে পাঁচ আনা। জামা এবং প্যান্টের কাপড়ের গুণগত মান সম্পর্কে আমাদের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব না হলেও, একই সংখ্যক ইজের ও পিরানের দামের পার্থক্যটুকু বুঝিয়ে দেয় আটপৌরে ও পোশাকী দু’রকমের জামাকাপড়ের আয়োজন তাঁর জন্যে ছিল এবং যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল। সূক্ষ্মদর্শী পাঠককে তারিখগুলিও লক্ষ্য করতে বলি; এত কম সময়ের ব্যবধানে এত বেশি সংখ্যক জামা-প্যান্টের আয়োজন কি ‘এতই যৎসামান্য ছিল যে এখনকার ছেলের চক্ষে তাহার তালিকা ধরিলে সম্মানহানির আশঙ্কা আছে’২৩? এরও উপরে ২১ চৈত্র ১২৭২ [সোম 2 Apr 1866] ১৪টা করে কামিজ ও ইজের তৈরি করার জন্যে ‘নয়ানষুক’ কাপড়ও কেনা হয়েছে! ১২৭২ বঙ্গাব্দে এরই মধ্যবর্তী কালে ৬ আশ্বিন [বৃহ 21 Sep 1865] ৬টি করে পিরান ও ইজের কেনা হয়েছে এবং ২৯ অগ্র [বুধ 13 Dec] ‘রবিন্দ্রনাথবাবু ও সত্যপ্রসাদবাবুর ছিটের পীরান তৈয়ারি খরচ ৩ ॥৩/আস্তরের জন্য কেলিকো/১৸৵০’—এই হিসাব দেখা যায়। শেষোক্ত পোশাকটি সম্ভবত শীতবস্ত্র, তারিখটিও সেই ইঙ্গিতই করে। ১২৭২-এর হিসাবেও দেখা যায়, সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়কে ২৮ পৌষ [মঙ্গল 10 Jan 1865] ১১০ টাকার ‘বনাত [‘পশমী বস্ত্রবিশেষ’—হরিচরণ বন্দ্যো°; ‘পশুলোমজাত শীতবস্ত্রবিঃ’—জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস] খরিদ বাবত’ দেওয়া হয়েছে—বাড়ির সকলের শীতের পোশাক তৈরির কাজেই এই বনাত ব্যবহৃত হয়েছিল মনে করা যেতে পারে। ৭ মাঘ ১২৭৪ [20 Jan 1868]-এর হিসাবে দেখি—‘বালকদিগের বনাতের চাপকান/মেয়েদিগের ফেলানেলের পিরান/সোমবাবু ও রবিবাবুর লেপের বড় ওয়ার/স্বর্ণকুমারির চায়না কোট’ তৈরির খরচ দেওয়া হয়েছে। আবার ১৩ আষাঢ় ১২৭৫ [শুক্র 26 Jun 1868] তারিখের হিসাবে লেখা হয়েছে ‘দ° সোমেন্দ্র রবীন্দ্র সত্যেপ্রসাদ বাবুদিগের বনাতের চাপকান তৈয়ার হয় তাহার দরজির মজুরি ও বোতাম শোধ ৪৲’ এই মজুরি নিঃসন্দেহে উপরে উক্ত চাপকানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অথচ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘শীতের দিনে একটা সাদা জামার উপরে আর একটা সাদা জামাই যথেষ্ট ছিল’২৩!
হিসাবগুলি রবীন্দ্রনাথের নিতান্ত শৈশবের, চার-পাঁচ বছরের হলেও, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই যে, পরবর্তীকালে অবস্থার কিছু অবনতি হয়েছে। একই ধরনের হিসাব আমরা পরের বছরগুলিতেও দেখতে পাই। আর শুধু জামা-প্যান্ট নয়, মশারি, গামছা, লেপ-তোশক, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর যোগান অব্যাহত থেকেছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘আমাদের চটিজুতা একজোড়া থাকিত, কিন্তু পা দুটা যেখানে থাকিত সেখানে নহে। প্রতি পদক্ষেপে তাহাদিগকে আগে আগে নিক্ষেপ করিয়া চলিতাম—তাহাতে যাতায়াতের সময় পদচালনা অপেক্ষা জুতাচালনা এত বাহুল্য পরিমাণে হইত যে পাদুকাসৃষ্টির উদ্দেশ্য পদে পদে ব্যর্থ হইয়া যাইত।’২৩ কিন্তু এক জোড়া মাত্র ‘চটিজুতা’ নয়, ‘হাপচটী’, ‘চটীবিনামা’ ও ‘বিনামা’ [‘জুতা; চৰ্ম্ম-পাদুকা’—জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস] প্রভৃতি আখ্যায় যে-পরিমাণ জুতো রবীন্দ্রনাথের জন্যে কেনা হয়েছে, তার হিসেব নিলে প্রশ্ন জাগতে পারে, যাঁদের বাইরের জগতে যাতায়াত অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল তাঁরা এত জুতো নিয়ে কী করতেন—যার মধ্যে ‘ইংরাজের দোকান হইতে’ কেনা জুতোও ছিল! ‘বিনামা খরিদ’-এর সর্বপ্রথম হিসাব আমরা পাই ১৪ অগ্র ১২৭১ [সোম 28 Nov 1864] তারিখে, যেদিন বারো আনা দিয়ে রবীন্দ্রনাথের জন্য এক জোড়া জুতো কেনা হয়েছে। এরপর ১৬ বৈশাখ ১২৭৩ [শনি 28 Apr 1866] দশ আনায় এক জোড়া এবং ৪ ফাল্গুন ১২৭৪ [শনি 15 Feb 1868] এক টাকায় এক জোড়া জুতো কেনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান খুব বেশি মনে হতে পারে; কিন্তু তার পরেই [শুধু তারিখ উল্লেখ করে যাচ্ছি] ২৮ চৈত্র ১২৭৪ [বৃহ 9 Apr 1868], ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৭৫ [শুক্র 29 May 1868], এবং একই বছরে ২০ আষাঢ় [‘ইংরাজের দোকান হইতে ক্রয় হয়’], ৪ শ্রাবণ [‘১৫ আষাঢ় আনা হয়’], ৯ শ্রাবণ [‘বিনামা ক্রয় মায় বগলস’], ৬ আশ্বিন, ৩ পৌষ [‘বিনামা মায় বগলস’] অন্যান্য বালকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জন্যেও জুতো কেনা হয়েছে!
জীবনস্মৃতি-র আর একটি মন্তব্যেরও—‘বয়স দশের কোঠা পার হইবার পূর্বে কোনোদিন কোনো কারণেই মোজা পরি নাই’২৩ [‘অনেক সময় লেগেছিল পায়ে মোজা উঠতে’—ছেলেবেলা ২৬। ৫৯৫]—বিরোধিতা করে ক্যাশবহিগুলি। ২৪ পৌষ ১২৭১ [শুক্র 6 Jan 1865] তারিখের হিসাবে স্পষ্ট লেখা আছে—‘মোজা খরিদ দঃ ২০ কাৰ্ত্তীক/রবিন্দ্রনাথ বাবুর/১ ডজন’, দাম লেগেছে সাড়ে তিন টাকা। সেই যুগের মূল্যমানের কথা স্মরণে রাখলে অনুমান করা যায় সেগুলির গুণগত মানও খুব খারাপ ছিল না, যে-যুগে বড়োবাবু দ্বিজেন্দ্রনাথের জন্যও দু’জোড়া ধুতি কেনা হয় মাত্র ন’টাকায়। রবীন্দ্রনাথের বয়স এই সময়ে তিন বৎসর সাত মাস। এই খাতে পরবর্তী বৎসরগুলিতেও খরচ দেখতে পাওয়া যায়। [প্রসঙ্গটির পরিসমাপ্তির জন্য আমরা পরবর্তী কয়েক বৎসরের হিসাবও একই সঙ্গে সংকলন করে দিচ্ছি।] ৬ আশ্বিন ১২৭৪ তারিখে ‘স্বর্ণকুমারীর বস্ত্র ক্রয় ও সোমন্দ্র রবীন্দ্রবাবুদিগের মোজা ক্রয়’ উনিশ টাকা দু’আনা, ২৪ পৌষ ১২৭৫ তারিখে ‘সোমেন্দ্র রবীন্দ্র বাবু দিগের মোজা ২ ডজন’ সাড়ে এগারো টাকা, ১১ ভাদ্র ১২৭৬ তারিখে ‘সোমেন্দ্র ও রবীন্দ্রবাবুদিগের মোজা ২ ডজন’ তেরো টাকা ও একই বৎসরে ১৫ ফাল্গুনে ‘রবী ও সোম বাবু দিগের মোজা ক্ৰয় এক ডজন’ সাড়ে পাঁচ টাকা, ২০ পৌষ ১২৭৭ তারিখে ‘সোম রবী বাবু দিগের মোজা ২ ডজন’ দশ টাকা ছ’আনা—এই হিসাবগুলি দেখতে পাওয়া যায় এবং সবগুলির তারিখই রবীন্দ্রনাথ দশের কোঠা পার হবার পূর্ববর্তী!
উপরোক্ত বিবরণের সম্মুখীন হয়ে যে প্রশ্ন মনে জাগতে বাধ্য, সেটি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ এইসব আয়োজন সত্ত্বেও কেন অন্যরূপ লিখেছেন। এমন নয় যে পোশাক-পরিচ্ছদের, বিশেষ করে মোজার, যথাযথ যোগান তাঁর শৈশবের ব্যাপার, পরবর্তীকালে যা তাঁর স্মৃতিতে ছিল না। মোটামুটি একই ধরনের আয়োজন তাঁর সমগ্র বাল্যজীবনেই অনুসৃত হয়েছে। আমাদের অনুমান, অন্তঃপুরের স্নেহপ্রীতির জগৎ থেকে নির্বাসিত তীব্র অনুভূতিশীল বালকের আন্তরিক ক্ষোভ তাঁর মনে এক সর্বব্যাপী বঞ্চনার ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছিল। সেই ধারণার কাছে বাস্তব প্রাপ্তিগুলিও তুচ্ছ বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। এরূপ মনে হওয়ার আরও কিছু কারণ থাকতে পারে। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রথম পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে মাত্র একবছর দু’মাসের ছোটো ছিলেন। সত্যপ্রসাদ-সোমন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ এই ত্রয়ীর পাশাপাশি দ্বিপেন্দ্রনাথের জন্যও পোশাক-পরিচ্ছদ ও জুতোমোজা কেনা হয়েছে। কিন্তু তাদের পরিমাণ ও গুণমানে পার্থক্য যথেষ্ট। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ৪ শ্রাবণ ১২৭৫ [18 Jul 1868] তারিখের হিসাবে দেখি—‘সোমেন্দ্র ও রবিন্দ্র বাবু দিগের বিনামা ২ জোড়া দ° ১৫ আষাঢ় আনা হয়’ দু’টাকা এগারো আনা তিন পয়সা দিয়ে, কয়েকদিন বাদে ৭ শ্রাবণ [21 Jul] তারিখের হিসাবে দেখা যায়—‘দ্বিপেন্দ্রবাবুর বিনামা ক্রয় (সাহেবের দোকান হইতে)’ দাম সাত টাকা চার আনা। পার্থক্যটি খুবই দৃষ্টিকটু, এবং সেটির সমর্থন পাওয়া যায় দ্বিতীয় হিসাবটির পাশে পেনসিলে লেখা একটি মন্তব্য থেকে—‘এত মূল্য দেওয়া কর্ত্তামহাশয়ের অভিপ্রেত কিনা জানি না।’ বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত বড়োদের সাজপোশাক, আমোদপ্রমোদ এবং পার্শ্ববর্তী ৫ নং বৈঠকখানা বাড়ির জীবনযাত্রায় যে শৌখিনতার পরিচয় ছিল, পরিবারের বালকদের জন্য সর্বপ্রকার আয়োজন সত্ত্বেও তাদের মধ্যে পার্থক্য ছিল সুদুস্তর। এই-সব কারণেই বালক রবীন্দ্রনাথের নিজেকে অবহেলিত ও বঞ্চিত মনে করা কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। আর এই ক্ষোভ তাঁর মনে বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া সম্ভব, যার ফলে যতটুকু পেয়েছেন তাকেও তুচ্ছ মনে হয়েছে।
গোপালচন্দ্র রায় বহু যুক্তিজাল বিস্তার করে উপরের বক্তব্যকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন [দ্র ‘রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত তাঁর বাল্যকালের বেশভূষার কথা কি সত্য নয়?’: রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন। ৫৯-৬৭]। তাঁর প্রধান যুক্তি, বেশভূষার অভাবের কথা যেহেতু রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন সেহেতু তা সত্য হতে বাধ্য; আর ক্যাশবহির হিসাবগুলি হয় আমলাদের কারচুপি, নয় ভৃত্যদের তস্করতার জন্যই কেনা পোশাকগুলি রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করার সুযোগ পাননি—যেখানে ভৃত্য ঈশ্বর দাস যে জলখাবারের পয়সা এবং লুচি ও দুধ চুরি করত একথা তো রবীন্দ্রনাথই জানিয়েছেন। কিন্তু পয়সা-লুচি-দুধ চুরির সঙ্গে বোধ হয় জুতো-মোজা-শীতবস্ত্র চুরি বা তা নিয়ে হিসাবের কারচুপির কিছু পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রনাথের দেখাশোনার দায়িত্ব প্রধানত ভৃত্যদের উপরেই অর্পিত ছিল, সুতরাং অভিযোগ না করলে ঈশ্বর দাসের দুধ-লুচি চুরির খবর অভিভাবকদের জানার কথা নয়, যে অভিযোগ রবীন্দ্রনাথ পঞ্চাশ বছর বয়সে করেছেন, সাত-আট বছর বয়সে সেই অভিযোগ করলে তার প্রতিকার অবশ্যই হত—হঠাৎ-হঠাৎ চাকর-বদল কিংবা কারোর ‘জবাব’ হয়ে যাওয়ার সংবাদ তো আমরা ক্যাশবহি থেকেই দিয়েছি। তাছাড়া সেরেস্তার হিসাবপত্র পরীক্ষা কেবল বিকৃত-মস্তিষ্ক মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায় বা দাদা বীরেন্দ্রনাথই করতেন, তা তো নয়—সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথও করতেন, বালকদের শিক্ষাদীক্ষার আয়োজনের প্রতি যাঁর ছিল অতন্দ্র দৃষ্টি। সুতরাং জুতো-মোজা-শীতবস্ত্রাদি, বালকদের জন্য কেনা হচ্ছে অথচ পরানো হচ্ছে না এ ব্যাপার তাঁর চোখে পড়বে না এটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। খাওয়া-দাওয়ায় আপত্তি, পোশাক-পরিচ্ছদে অনাগ্রহ অনেক বালকের মধ্যেই দেখা যায়—কিন্তু এগুলি সবসময়ে অভাবের প্রমাণ নয়। দেবেন্দ্রনাথ অনেক সময়েই বাড়িতে থাকতেন না, কিন্তু যখন আসতেন তখন সকলকেই যথোপযুক্ত পোশাক পরে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হত, মাঘোৎসবাদি উৎসবেও নিশ্চয়ই বালক-বালিকাদের পোশাকে বৈলক্ষণ্য ঘটার সুযোগ ছিল না। কিন্তু এভাবে প্রমাণ জড়ো করার চেষ্টাই অর্থহীন, নিতান্ত দরিদ্রের ঘরে ছাড়া ‘শীতের দিনে একটা সাদা জামার উপরে আর-একটা সাদা জামাই যথেষ্ট’ বলে উল্লেখ করা নিঃসন্দেহে সত্যের অপলাপ। উল্লেখ্য, জীবনস্মৃতি-র প্রথম খসড়ায় এইসব দারিদ্র-কীর্তনের চিহ্নমাত্র নেই। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালেও যথাসম্ভব অনাড়ম্বর জীবনযাপনে আগ্রহী ছিলেন, তার কারণ অর্থাভাব নয়। জীবনস্মৃতি-কে প্রকাশযোগ্য রূপ দেওয়ার সময়ে ধনীর পুত্র বা জমিদার প্রভৃতি অভিধাগুলির বিপরীত ধারণা তৈরি করতে তিনি সচেতনভাবেই ক্রিয়াশীল ছিলেন।
প্রাসঙ্গিক তথ্য: ১
বর্তমান বৎসরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ও তথ্য এখানে উপস্থিত করা হচ্ছে।
? ২৮ বৈশাখ শনিবার 9 May 1868 শরৎকুমারী দেবী ও যদুনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রথমা কন্যা সুশীলা দেবীর জন্ম হয়।*
আশ্বিন মাসের শেষে [Oct 1868] সত্যেন্দ্রনাথের একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে ও অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই মারা যায়।*১ এর কয়েক মাস পরে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ৩০ পৌষ [মঙ্গল 12 Jan 1869] তারিখে স্টীমারে বোম্বাই যাত্রা করেন। সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় ও জানকীনাথ ঘোষাল তাঁর সহযাত্রী ছিলেন।
? ২১ অগ্র [শনি 5 Dec] স্বর্ণকুমারী দেবী ও জানকীনাথ ঘোষালের প্রথমা কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর জন্ম হয়। *২ আমরা আগেই বলেছি, জানকীনাথের বিবাহে তাঁর পিতা জয়চন্দ্র ঘোষালের সম্মতি ছিল না, সেইজন্য বিবাহে তিনি উপস্থিত হননি। কিন্তু পুত্রবধূর সন্তানসম্ভাবনার সংবাদে তাঁর বিরূপতা অন্তর্হিত হয়। ২ কার্তিকের একটি হিসাবে দেখা যায়: ‘দ° জানকীবাবুর পীতা শ্রীমতী স্বর্ণকুমারিকে দেখিতে আসেন উক্ত শ্রীমতী তাঁহাকে প্রণামী দেন’ অর্থাৎ এই সময় থেকে পিতা-পুত্রের মিলন্ ঘটে।
অন্যান্য আনন্দানুষ্ঠানের মধ্যে July 1868 [আষাঢ়-শ্রাবণ] মাসে দ্বিজেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র নীতীন্দ্রনাথ ও হেমেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র হিতেন্দ্রনাথের এবং ফাল্গুন [Feb 1869] মাসে শরৎকুমারী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা সুশীলা দেবীর অন্নপ্রাশন হয়।
ঠাকুর পরিবারে এই বৎসরের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথের বায়ু-পীড়ার সূত্রপাত। আহমদনগর থেকে 19 July [রবি ৫ শ্রাবণ] তারিখে লিখিত একটি পত্রে সত্যেন্দ্রনাথ স্ত্রীকে লেখেন: ‘বীরেন্দ্রের বিষয় আমাদের যাহা ভয় ছিল, তাহাই কি ঘটিল—বড় আক্ষেপের বিষয়। তাহাকে কোথাও বেড়াইতে লইয়া গেলে হয়ত ভাল হয়।’২৪ এই চিঠি থেকে বোঝা যায় এই পীড়ার লক্ষণ অনেক আগে থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল। বস্তুত তাঁর স্ত্রী প্রফুল্লময়ী দেবীর একটি উক্তি থেকে এই অনুমান করা যায় যে, বিবাহের পূর্বেই হয়তো কতকগুলি চিহ্ন তাঁর আচরণে ফুটে উঠেছিল: ‘দিদির বিবাহের পর আমি প্রায়ই মায়ের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর বাড়ি আসা যাওয়া করিতাম, সেই সময় আমাকে দেখিয়া আমার ননদ স্বর্ণকুমারী ও শরৎকুমারীর পছন্দ হওয়াতে আমার স্বামীকে বিবাহ করিবার জন্য বারবার অনুরোধ করিতে থাকেন। আমার স্বামী সেই কথায় তাঁহাদিগকে বলিয়াছিলেন যে, তিনি কলাবৌকে বিবাহ করিবেন। এই কথা শুনিয়া তাঁহাদের মধ্যে খুব একটা হাসাহাসির রোল পড়িয়া যায়।’২৫ বর্তমান প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন: ‘চার বৎসর বেশ সুখেই কাটিয়াছিল। বিবাহের চার বৎসর পরে আমার স্বামী মস্তিষ্ক রোগে আক্রান্ত হইয়া সাড়ে তিন বৎসর ওই ভাবে কষ্টে কাটান। আমার বিবাহের পরই তিনি এন্ট্রেন্স পরীক্ষা দিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন।*৩ এই রোগের পূর্বে তাঁহার যথেষ্ট মেধাশক্তি ছিল বলিয়া আমার শ্বশুর সমস্ত সংসারের তহবিলের আয় ব্যয় দেখিবার ভার তাঁহার উপর দিয়াছিলেন।*৪ ইহার পূর্বে আমার মামাশ্বশুর [ব্রজেন্দ্রনাথ রায়] হিসাবপত্র দেখিতেন, কিন্তু তাঁরও মাথার দোষ থাকায় শ্বশুর তাঁহাকে ছাড়াইয়া দিতে বাধ্য হন। তাঁহার যখন এইরূপ অবস্থা হইল এবং দিন দিনই রোগের বৃদ্ধি হইতে লাগিল…আমার স্বামী স্নান আহার পর্যন্ত সব ছাড়িয়া দিলেন, ও সকলের উপর একটা তাঁর সন্দেহের ভাব বাড়িতে লাগিল। এই সন্দেহ বাতিকের জন্য প্রায়ই আমাকে নানারকম ভুগিতে হইত।…আমার স্বামী খাওয়াদাওয়া একরকম ছাড়িয়াই দিলেন। তার উপর তাঁর কাসি ও হাঁপানী অল্প অল্প দেখা দিল, এই সব কারণে তাঁকে লইয়া আমি আমার বড় জা, নতুন বৌ, আমার দিদি সকলে মিলিয়া বোলপুরে যাই। সেখানে গিয়াও খাওয়ার কোন পরিবর্তন হইল না। চায়ের চামচের এক চামচ ভাত বা কোনও দিন একটি পটল পোড়া খাইয়া থাকিতেন। এমনি-ভাবে সেখানে তিনদিন কাটিল, খাওয়ার বা শরীরের কোনই বদল না হওয়াতে, তিনদিন পর আবার আমরা কলিকাতায় ফিরিয়া আসি।’২৬ ডাঃ পেন সাহেব বীরেন্দ্রনাথকে পরীক্ষা করেন। সম্ভবত তাঁরই নির্দেশে বীরেন্দ্রনাথের জন্য ড্রয়িং শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়, এমন-কি ভবানীচরণ সেন নামক একজন ড্রয়িং শিক্ষককেও নিয়োগ করা হয়। বর্তমান বৎসরে অবশ্য তাঁর অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যায়নি।
এছাড়া জ্ঞানদানন্দিনী দেবী সম্বন্ধে দেবেন্দ্রনাথের মনে কোনো কারণে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল যার জন্যে তিনি বাড়িতে ফিরতে অনিচ্ছুক ছিলেন, ফলে জ্ঞানদানন্দিনীর অন্য কোনো বাড়িতে থাকার কথাও চিন্তা করা হচ্ছিল ইত্যাদি এক অনির্দেশ্য পারিবারিক অশান্তির ইঙ্গিত সত্যেন্দ্রনাথের পত্রের মধ্যে পাওয়া যায়।২৭ দেবেন্দ্রনাথ অবশ্য জ্ঞানদানন্দিনীর বোম্বাই যাত্রার পূর্বেই বাড়িতে ফিরে আসেন।
রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে ‘বাহিরে যাত্রা’ অধ্যায়ে যে পেনেটির বাগানের কথা উল্লেখ করেছেন, বর্তমান বৎসরেই সেই বাগানটির সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যোগাযোগের সূচনা হয়। পৌষ মাসে হেমেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সারদাপ্রসাদ, যদুনাথ প্রভৃতি পানিহাটির ওই বাগানে বাস করেন। সত্যেন্দ্রনাথের পত্র থেকে জানা যায়, বোম্বাই-যাত্রার পূর্বে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীও কিছুদিন ওই বাগানে গিয়ে থাকেন। মাঘ মাসে সৌদামিনী দেবী ও স্বর্ণকুমারী দেবীও সেখানে ছিলেন, ক্যাশবহি থেকে এইসব খবর পাওয়া যায়। প্রসঙ্গটি আমরা পরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
১৫ ভাদ্র রবিবার 30 Aug ৬৭ বৎসর বয়সে দীর্ঘ রোগভোগের পর দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পৌত্র প্রসন্নকুমার ঠাকুরের মৃত্যু হয় [জন্ম 21 Dec 1801]। দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর দারুণ আর্থিক বিপর্যয়ের সময় ইনি দেবেন্দ্রনাথকে অনেক সুপরামর্শ দিয়েছিলেন।
প্রাসঙ্গিক তথ্য: ২
১১ মাঘ [শনি 23 Jan 1869] আদি ব্রাহ্মসমাজের ঊনচত্বারিংশ সাংবৎসরিক মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়। এই বৎসরের উৎসবের বিবরণ দেখলে মনে হয় ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে কিছুটা প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়েই এবারের অনুষ্ঠানসূচি রচিত হয়েছিল, কারণ এতটা সমারোহ আগের কোনো অনুষ্ঠানেই লক্ষিত হয়নি। এবারের উৎসবের সূচনা হয় ১ মাঘ থেকে, বুধবারের সাপ্তাহিক উপাসনার দিন ছাড়া ১ থেকে ১০ মাঘ পর্যন্ত প্রত্যহ সন্ধ্যায় ব্রাহ্মসমাজ গৃহে ব্রাহ্মধর্ম গ্রন্থের পাঠ ও ব্যাখ্যার আয়োজন করা হয়। ১১ মাঘ প্রাতে ব্রাহ্মসমাজগৃহে দেবেন্দ্রনাথ উদ্বোধন করেন এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও অযোধ্যানাথ পাকড়াশী ভাষণ দেন। এই অধিবেশনে সাতটি ব্রহ্মসংগীত গীত হয়:
শঙ্করা—আড়াঠেকা। আজি আমারদের মহোৎসব (সত্যেন্দ্রনাথ]
ভৈরব—চৌতাল। সবে মিলে গাও তাঁহার মহিমা [”]
দেবগিরি—একতালা। নয়ন খুলিয়ে দেখ নয়নাভিরাম
আসা—ঠুংরি। বলিহারি তোমারি চরিত মনোহর [সত্যেন্দ্রনাথ]
টোড়ী—চৌতাল। তুমি তো জীবনের আধার
টোড়ী—চৌতাল। দীননাথ! প্রেম-সুধা দেও [গণেন্দ্রনাথ]
গৌড়শারঙ্গ—আড়াঠেকা। আঁখি-অঞ্জন! ডাকি হে তোমারে [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ]
মধ্যাহ্নে দেবেন্দ্রভবনে আহারাদির পর ব্রহ্মসংগীত হয়: লুম ঝিজিট—যৎ। উথলিল প্রেম-সুধা, আজ, অহো সাধু!
দেবেন্দ্রভবনে সায়ংকালীন উপাসনায় গণেন্দ্রনাথ, বেচারাম চট্টোপাধ্যায় ও অযোধ্যানাথ পাকড়াশী বক্তৃতা করেন। প্রাতঃকালীন অনুষ্ঠানে গীত সত্যেন্দ্রনাথের ‘আজি আমাদের মহোৎসব’ গানটি ছাড়াও আরও সাতটি ব্রহ্মসংগীত এখানে পরিবেশিত হয়:
ইমনকল্যাণ—চৌতাল। তুমি জ্ঞান, প্রাণ; তুমিই সত্য, তুমি সুন্দর [সত্যেন্দ্রনাথ]
জয়জয়ন্তী—চৌতাল। প্রথম নাম ওঁকার, ভুবন-রাজ দেব-দেব [গণেন্দ্রনাথ]
বাহার—একতালা। দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম আননে [”]
কেদারা—চৌতাল। বহিছে কৃপা-পবন তোমার [দ্বিজেন্দ্রনাথ]
শাহানা—আড়াঠেকা। কেমনে কহিব, কি সুধাময় শোভা হেরিনু [”]
খাম্বাজ—ধামার। সেই প্রেম-ছবি সুধার ধার
ঝিঁজিট—ঠুংরি। গাওরে জগপতি জগবন্দন [সত্যেন্দ্রনাথ]
[দ্র তত্ত্ববোধিনী, ফাল্গুন ১৭৯০ শক]
উপরের বিবরণ থেকে বোঝা যায় তখন আদি ব্রাহ্মসমাজের সভাকবি হচ্ছেন প্রধানত সত্যেন্দ্রনাথ এবং কিছুটা দ্বিজেন্দ্রনাথ ও গণেন্দ্রনাথ। সুদূর আহমদনগরের কর্মস্থল থেকেও সত্যেন্দ্রনাথ ব্রহ্মসংগীত রচনা করে পাঠিয়েছেন, সে খবরও পাওয়া যায় গণেন্দ্রনাথ ও দেবেন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর চিঠি থেকে। 24 Jan 1869 [রবি ১২ মাঘ] গণেন্দ্রনাথকে তিনি একটি পত্রে ‘ইচ্ছা হয় সৰ্ব্ব ভুলে’, ‘মঙ্গলনিদান, বিঘ্নের কৃপাণ, মুক্তির সোপান’, ‘হে করুণাকর, দীনসখা তুমি’, ‘দীন-দয়াময় ভুলো না অনাথে’ ‘কৃপাসাগর হে অখিল জগৎপাতা’ এই পাঁচটি গান পাঠিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তীকে দিয়ে সেগুলিতে উপযুক্ত সুর বসাবার জন্য। পরের দিন পিতার কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি পূর্বোক্ত ‘দীন-দয়াময় ভুলো না অনাথে’ গানটি ছাড়াও তাঁর বিখ্যাত ব্রহ্মসংগীত ‘তুমি বিনা কে প্রভু শঙ্কট নিবারে’ গানটি প্রেরণ করেন। বলা বাহুল্য, গানগুলি বর্তমান বৎসরের মাঘোৎসবে গীত হওয়া সম্ভব ছিল না, কিন্তু পরবর্তীকালে নানা উপলক্ষেই এগুলি গাওয়া হয়েছে। বাংলায় স্বরলিপি-রচনার পরীক্ষায় এর মধ্যে কয়েকটি গানকে দ্বিজেন্দ্রনাথ বেছে নিয়েছিলেন, সেদিক থেকে এদের ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট।
ইতিমধ্যে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের কার্যকলাপে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া উপস্থিত হয়েছিল। গত বৎসর মাঘোৎসবের পর কেশবচন্দ্র সদলে বাংলায় শান্তিপুর ও ভারতের অন্যান্য স্থানে পরিভ্রমণ ও প্রচার আরম্ভ করেন। ভাগলপুর, মুঙ্গের, পাটনা, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, বম্বে প্রভৃতি স্থানে বক্তৃতা দিয়ে কেশবচন্দ্র পুনরায় Apr 1868-এর শুরুতে মুঙ্গেরে আসেন। 19 Apr [রবি ৮ বৈশাখ] সেখানে সারাদিনব্যাপী ব্রহ্মোৎসবের আয়োজন হয়। এর ফলে সেখানে যে ভক্তির আতিশয্য উপস্থিত হয়, তা শেষ পর্যন্ত কেশবচন্দ্র ও তাঁর সমাজের পক্ষে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেশবচন্দ্রের জীবনীকার গৌরগোবিন্দ রায় লিখেছেন:
একজন বন্ধু কেশবচন্দ্রকে এই সময়ে বলেন, মুঙ্গেরে বর্ত্তমানে যে প্রকার ভাব সমুপস্থিত, ইহাতে কুসংস্কারের আগমনের সম্ভাবনা। ইহাতে তিনি উত্তর দেন, “হইতে দাও।” এ কথার ভাব এই যে, শুষ্ক নীরস কঠোরভাব হইতে কুসংস্কারও ভাল।…সুতরাং কোন বাধা না পাইয়া ক্রমেই ভক্তির আতিশয্য দেখা ছিল, পরস্পরের চরণে অবলুণ্ঠন করিয়া তৃপ্তির পরিসমাপ্তি হইল না, পরিশেষে চরণ ধৌত করিয়া দিয়া পত্নীর সুদীর্ঘ কেশগুচ্ছ দ্বারা আর্দ্রপদ শুষ্ক করিয়া দেওয়া পর্যন্ত চলিল।…ভক্তগণের চরণধারণ, ভক্তগণের ভোজনাবশিষ্ট গলবস্ত্র হইয়া যাজ্ঞাপূর্বক গ্রহণ, এ সকল প্রায় নিত্যকৃত্য হইয়া উঠিল। এত দূর পর্যন্ত হইয়াই নিবৃত্ত রহিল না, বিবেকের প্রতিরোধশ্রবণস্থলে স্পষ্ট কেশবচন্দ্র সম্মুখে দাঁড়াইয়া প্রতিষেধ করিতেছেন, ব্যক্তিবিশেষ এরূপও প্রত্যক্ষ করিতে লাগিলেন।২৮
উক্ত জীবনীকার এর পর দুটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, যার থেকে বোঝ যায় কেশবচন্দ্র এই মনোভাবকে প্রশ্রয় দিতেন।
কেশবচন্দ্র কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করে 5 Jul 1868 [রবি ২৩ আষাঢ়], তারিখে ব্রাহ্মবিবাহ বিধিবদ্ধ করবার জন্য গবর্মেণ্টের কাছে আবেদন করা বিধেয় কিনা তদ্বিষয়ে বিবেচনা করার জন্য যে সভা হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন। এই সভায় গবর্মেন্টের কাছে এ বিষয়ে আবেদন করার প্রস্তাবই গৃহীত হয়। এই আবেদন উপলেক্ষ করে 10 Sep [২৬ ভাদ্র] মিঃ মেইন [Mr. Henry Summer Maine] ব্যবস্থাপক সভায় ‘দেশীয়গণের বিবাহবিধি’ [A Bill to legalize marriages between persons not professing the Christian Religion and objecting to marry according to the orthodox rites of any of the existing religions of India’] নামে আইনের খসড়া বিবেচনার জন্য উপস্থিত করেন। আদি ব্রাহ্মসমাজ এই বিলের প্রতিবাদ করে একটি স্মারকপত্র প্রেরণ করে।
প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি নোটবুকে পরিবারের সকলের জন্মতারিখ ও রাশিচক্র সংকলন করবার প্রয়াসী হয়েছিলেন। যে-কোনো কারণেই হোক তাঁর চেষ্টা সম্পূর্ণ হয়নি। নোটবইটি এখন শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে, পাণ্ডুলিপির অভিজ্ঞান-সংখ্যা ৩৬৪। এটি থেকে কাদম্বরী দেবীর জন্ম-তারিখ ও রাশিচক্রটি কৌতূহলী পাঠকদের জন্য উদ্ধৃত করে দিচ্ছি:
জন্ম—১৭৮১। ২। ২১। ১৬। ৫০ শক [২২ আষাঢ় ১২৬৬ মঙ্গল 5 Jul 1859]
রবীন্দ্রভবনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ফাইলে রক্ষিত একটি ঠিকুজি-কোষ্ঠী থেকে জানা যায়, কাদম্বরী দেবীর রাশিনাম ছিল মাতঙ্গিনী দেবী—পূর্বফল্গুনী নক্ষত্র, নরগণ ও ক্ষত্রিয় বর্ণ।
প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৪
‘সিঙ্গিমামা কাটুম’ ছড়াটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এর মধ্যে প্রায় সব কথাই ধার-করা’। প্রবোধচন্দ্র সেন ‘রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ’ [দেশ, ২১ বৈশাখ ১৩৫৮] প্রবন্ধের ১১ পৃষ্ঠায় এই ঋণের উৎস সন্ধান করেছেন:
কথাগুলো কোথা থেকে ধার করলেন, স্বভাবতই জানতে ইচ্ছে হয়। ১৩০১-০২ সালে রবীন্দ্রনাথ যে ছেলে-ভুলানো ছড়া সঙ্কলন করেছিলেন তার থেকে কয়েকটি অংশ তুলছি। একটি হচ্ছে—
তালগাছ কাটম বোসের বাটম গৌরী এল ঝি।
তোর কপালে বুড়ো বর আমি করব কী।
আরেকটি এই—
উলুকুট ধুলুকুট নলের বাঁশি।
নল ভেঙেছে একাদশী।
আরেকটা ছড়ার শেষাংশ এরকম—
নকা বেটা বর।
ঢ্যাম কুড়কুড় বাদ্যি বাজে চড়কডাঙার ঘর॥
বোঝা যাচ্ছে কোন চিরন্তন শিশুশাস্ত্র থেকে এই শিশু-পুরোহিত তার পুজোর মন্তর উদ্ধার করেছিলেন।
প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৫
দেশ, রবীন্দ্ৰশতবার্ষিকী সংখ্যা ১৩৬৮-তে দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্রনাথের প্রথম সঙ্গীতগুরু’ প্রবন্ধের পাদটীকায় (পৃ ১০৬-০৭] ছড়াটি সম্পর্কে লিখেছেন:
এই ছড়াটির প্রথম দু’লাইনের আর একটি পাঠ পাওয়া যায়। সম্প্রতি স্বৰ্গতা শ্রীযুক্তা ইন্দিরা দেবী ছড়াটির সেই পাঠ লেখককে জানিয়েছিলেন। মৃত্যুর চারদিন আগে এ বিষয়ে তিনি লেখককে প্রশ্নের উত্তরস্বরূপ যে চিঠি লিখেছিলেন, তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হ’ল:—
ওঁ
শান্তিনিকেতন, ৮-৮-৬০
কল্যাণবরেষু,
আমার বৃদ্ধ বয়স ও দুর্বল শরীর সত্ত্বেও যিনি যা প্রশ্ন করেন তার সাধ্যমত উত্তর দেবার চেষ্টা করি, যদি জানা থাকে।…
আমি শুধু এইটুকু জানি, অর্থাৎ শুনেছি যে, ছেলেবেলায় তিনি (বিষ্ণুচন্দ্র) কবিগুরুকে গান শোনাতেন, এবং ছোট ছেলের উপযোগী গান—যথাঃ—
বাঘ পালালো বেড়াল এল
শিকার করতে হাতী,
মোগল পাঠান হদ্দ হ’ল
ফার্সী পড়ে তাঁতি।”—
শুনে তাঁর উপর একটু ভক্তি হয়েছিল।……শ্রীইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী
উক্ত প্রবন্ধে শ্রীমুখোপাধ্যায় বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তীর জীবনকথা-প্রসঙ্গে লিখেছেন, 1819-এ রানাঘাট অঞ্চলে ‘আন্দুলে কায়েতপাড়া’ গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। পিতা কালীপ্রসাদ চক্রবর্তী শাস্ত্ৰচর্চায় জীবিকানির্বাহ করতেন ও নদীয়ার রাজসভায় তাঁর যাতায়াত ছিল। তাঁর পাঁচ পুত্রের মধ্যে কৃষ্ণপ্রসাদ, দয়ানাথ ও বিষ্ণুচন্দ্র রাজা শ্রীশচন্দ্রের সভাগায়ক হস্নু খাঁ, তাঁর ভাই দেল্ওয়ার খাঁ ও বিখ্যাত কাওয়াল মিয়া মীরণ প্রভৃতির কাছে ধ্রুপদ ও খেয়াল শিখেছিলেন। দয়ানাথের অকালমৃত্যুর পর কৃষ্ণ ও বিষ্ণু 1830-তে ব্রাহ্মসমাজের গায়ক নিযুক্ত হন, তখন বিষ্ণুর বয়স এগারো বছর।
প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৬
৩০ চৈত্র [রবি 11 Apr 1869] চৈত্র মেলা বা জাতীয় মেলার তৃতীয় অধিবেশন আগের বছরের মতো আশুতোষ দেবের বেলগাছিয়া উদ্যানে [‘ডনক্যাস্টরের বাগান’] অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল। মোট ১১টি জাতীয় সংগীত গীত হয়—তার মধ্যে পূর্ব অধিবেশনে গীত ‘মিলে সবে ভারত সন্তান’, ‘লজ্জায় ভারত যশ গাইব কি করে’ ইত্যাদি পাঁচটি গান ছাড়াও নূতন ছ’টি গান রয়েছে। বোঝ যায়, এই মেলাকে উপলক্ষ করে জাতীয় সংগীতের একটি নূতন স্রোত ধীরে ধীরে পুষ্টিলাভ করছিল। সংস্কৃত কলেজের ছাত্র রজনীকান্ত গুপ্তের পুরস্কারপ্রাপ্ত গদ্যরচনা ‘রামায়ণের মর্ম ও তদন্তৰ্গত নীতি’, জানকীনাথ দত্তের ‘মহাভারতের মর্ম ও তদন্তৰ্গত নীতি’ ইত্যাদি অনেকগুলি প্রবন্ধ সভায় পঠিত হয়। মনোমোহন বসু ‘হিন্দুমেলার উদ্দেশ্য বিষয়ক বক্তৃতা’য় মেলার ক্রমোন্নতি সম্পর্কে বলেন, ‘জন্মদিনে কেবল কতিপয় বান্ধব ও প্রতিবেশীমাত্র উৎসাহী ছিলেন, অর্থাৎ নিজবাটীর লোক ও নিজ কুটুম্ব বই নয়, কিন্তু দ্বিতীয় উৎসবে গ্রামস্থ এবং অদ্য এই তৃতীয় বার্ষিক উৎসবে চাকলাস্থ লোক আকর্ষিত হইয়াছেন’। আয়ের পরিমাণেও উন্নতির চিত্রটি প্রতিফলিত হয়েছে—দ্বিতীয় অধিবেশনের মোট আয় যেখানে ১৪৩৩ টাকা, তৃতীয় অধিবেশনের আয় সেখানে ২২৬০ টাকা ৫ পয়সা। ঠাকুরপরিবারের অন্যান্য ব্যক্তিরা ছাড়াও দেবেন্দ্রনাথ ও গণেন্দ্রনাথ প্রত্যেকে ১০০ টাকা করে দান করেন। প্রদর্শনীটি এ বৎসর আরও সুন্দর করার চেষ্টা হয়। ‘স্ত্রী-শিল্পজাত” সর্বোৎকৃষ্ট দ্রব্যের জন্য যে-কজন মহিলাকে এ-বৎসর হিন্দুমেলার নামাঙ্কিত রৌপ্যপদক প্রদান করা হয়, তাঁদের মধ্যে ‘শ্রীযুক্ত সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিবার’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়—ইনি সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের বড়দিদি সৌদামিনী দেবী। শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায় সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা-র ৬৭ বর্ষ ৩য়-৪র্থ সংখ্যায় [পৃ ২০৪-৯২] এই অধিবেশনের কার্যবিবরণটি সম্পূর্ণ সংকলন করেছেন।
এই বৎসর পৌষ মাস থেকে কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী অবোধ-বন্ধু পত্রিকাটির স্বত্বাধিকারী হন এবং এই সংখ্যা থেকেই কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য-অনূদিত ‘পৌল ভৰ্জ্জীনী’ প্রকাশিত হতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে পত্রিকাটির ও বিশেষ করে উক্ত অনুবাদ-রচনাটির বিশেষ গুরুত্ব আছে, যথা সময়ে আমরা সে-সম্পর্কে আলোচনা করব।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে গণেন্দ্রনাথ-অনূদিত ‘বিক্রমোৰ্ব্বশী’ [1 Jan 1869] ও দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘তত্ত্ববিদ্যা (৪র্থ)—সাধন প্রকরণ’ [10 Apr 1869] প্রকাশিত হয়।
উল্লেখপঞ্জি
১ তত্ত্ব, শ্রাবণ। ৭৮-৭৯
২ পুরাতনী। ৭৪, পত্র ২০
৩ ঐ। ১০৬, পত্র ৪৭
৪ ঐ। ১২৬, পত্র ৬৪ [16 Aug 1868 রবি ১ ভাদ্র ১২৭৫]
৫ ঐ। ৩৪-৩৫
৬ ছেলেবেলা ২৬ | ৬১৪
৭ দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩
৮ ছেলেবেলা ২৬। ৫৯৪
৯ জীবনস্মৃতি ১৭। ২৮৬
১০ ছেলেবেলা ২৬। ৫৯০
১১ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩২৪-২৫
১২ ছেলেবেলা ২৬।৬০৮
১৩ জীবনস্মৃতি ১৭।২৮৩
১৪ ছেলেবেলা ২৬।৬১৯
১৫ জীবনস্মৃতি ১৭।২৮৩
১৬ ঐ ১৭।২৮৪
১৭ ছেলেবেলা ২৬।৬১৯-২০
১৮ দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৪
১৯ জীবনস্মৃতি [১৩৬৮]।১৭৯
২০ ছেলেবেলা ২৬।৬০৩
২১ দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৫
২২ ছেলেবেলা ২৬।৬০৪
২৩ জীবনস্মৃতি ১৭।২৬৮
২৪ পুরাতনী। ১১০, পত্র ৫০
২৫ ‘আমাদের কথা’: বলেন্দ্রনাথ শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ। ১৭-১৮
২৬ ঐ। ২০-২১
২৭ দ্র পুরাতনী। ৯০, পত্র ৩১
২৮ আচার্য্য কেশবচন্দ্র ১। ৪৫০-৫১
* ‘প্রাণাধিক গণেন্দ্রনাথ/ জ্যোতির বিবাহে যাহা কিছু আমার হৃদ্য ও কল্যাণকর কাৰ্য্য হইয়াছে, তাহা তোমার প্রযত্নেই হইয়াছে। ইহা হইতে প্রচুর মঙ্গল উৎপন্ন হইয়া তোমার হৃদয়কে আনন্দে সিক্ত রাখুক এই আমার আশীর্বাদ।’ দ্র বি. ভা, প., বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৭৫। ২৫৫, পত্র ১৯
* জ্যোতিঃপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায় [1855-1919], গণেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা ভগিনী কাদম্বিনী দেবী ও যজ্ঞেশপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র।
* ১২৭৫ বঙ্গাব্দের যে-কটি হিসাবের খাতা শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত আছে [‘এস্টেটের কেসবহি’ ও ‘নিজ হিসাবের কেস বই’], সেগুলির কাগজ ও আকার রবীন্দ্রনাথ-বর্ণিত খাতারই অনুরূপ। এইরকম কাগজের খাতা ইতিপূর্বে ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তায় দেখা যায় না, ১২৮৩ বঙ্গাব্দের খাতা ছাড়া পরেও নেই। কাগজের জলছাপ দেখে মনে হয় তা বিদেশে প্রস্তুত। এই বছরেই কোনো এক সময়ে রবীন্দ্রনাথের প্রথম পাণ্ডুলিপিতে ‘কবিতা-রচনারম্ভ’ হয়, এটিকে তার পরোক্ষ প্রমাণ রূপে গণ্য করা যেতে পারে।
* ছেলেবেলা ২৬। ৫৯৪ : ছেলেবেলা-র অনেকগুলি পাণ্ডুলিপি রবীন্দ্রভবনে আছে, তার মধ্যে একটিতে ছড়াটির দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে ‘আদি’ শব্দটি এবং শেষ পঙ্ক্তিটি নেই।
* সূত্র: ক্যাশবহি-তে ৩১ বৈশাখের হিসাবে আছে: ‘(২৮ বৈশাখের খরচ) শ্রীমতী স্বরৎকুমারী দেবির কন্যা হওয়ায় নাড়িকাটা দাইএর বিদায় ৮৲’
*১ সূত্র: “১১ অক্টোবরে জানকীর পত্রে দেখিলাম তোমার একটি পুত্রসন্তান জন্মিয়াছে—আজ তোমার তেরই-এর পত্রে তাহার মৃত্যুসংবাদ পাইলাম।’ পুরাতনী। ১৫৫, পত্র ৯৫ [20 Oct 1868]
*২ সূত্র: ক্যাশবহি-তে এই দিনের হিসাবে আছে: ‘ব° Miss Murphy দ° শ্রীমতী স্বর্ণকুমারী প্রসব করাইবার ঐ বিবির ফি…৫৷০’
*৩ ‘বীরেন্দ্রনাথ ১৮৬৬ সনে বেঙ্গল একাডেমি হইতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।’ সা-সা-চ ৫। ৬০। ৭ |
*৪ এই বৎসরের জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত সংসারের মাসকাবারি খরচের টাকা বীরেন্দ্রনাথের হাতে দেওয়া হয়েছে ক্যাশবহি-তে এই তথ্যের সাক্ষাৎ মেলে।