চতুর্থ অধ্যায়
১২৭১ [1864-65] ১৭৮৬ শক ॥ রবীন্দ্রজীবনের চতুর্থ বৎসর
এই বৎসর থেকে আমরা রবীন্দ্রজীবনের অজস্র তথ্য সরবরাহ করবার সুযোগ লাভ করি। এতদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের লেখা জীবনস্মৃতি ও ছেলেবেলা এবং কিছু কিছু চিঠি, কোনো প্রবন্ধের অংশবিশেষ, আর ঠাকুরপরিবারেরই কারোর কারোর লেখা স্মৃতিকথা—রবীন্দ্রনাথের বাল্যজীবনী রচনার ক্ষেত্রে প্রধান উপকরণ রূপে গণ্য হত। এখন সে ক্ষেত্রে আমাদের হাতে এসেছে দেবেন্দ্রনাথের পারিবারিক হিসাবের খাতাগুলি—‘নিজ হিসাবের কেস বহি’ ‘বা ‘ক্যাশবহি’—যেগুলি সাংসারিক খরচের বিভিন্ন খুঁটিনাটি তথ্যে পরিপূর্ণ, যা এই পরিবারের অনেকেরই—রবীন্দ্রনাথের তো বটেই—জীবনের বাইরের কাঠামোটি যথাযথভাবে গড়ে তোলায় প্রভূত সাহায্য করতে পারে। জোড়াসাঁকোয় আদি ভদ্রাসন-বাড়ির বাইরের একতলায় জমিদারি কাছারি ছিল—এই খাতাগুলি সেখানকার কর্মচারীদের দ্বারাই লিখিত। প্রতি বাংলা নববর্ষে শুধু পারিবারিক হিসাব রাখার জন্যই একাধিক খাতার সূচনা করা হত এবং প্রায় প্রতিদিন বাংলা তারিখ, বার ও ইংরেজি তারিখ দিয়ে বিভিন্ন খাতে খরচের হিসাব যথাসম্ভব বর্ণনা দিয়ে লেখা হত। অবশ্য সব সময়ে যে প্রাত্যহিক খরচ সেইদিনেই লেখা হয়েছে, তা নয়; ভাউচার [খাজাঞ্চিদের পরিভাষায় ‘বৌচর’] ও কোনো কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তি বা দায়িত্বশীল কর্মচারীর প্রদত্ত ফর্দ দেখে পরবর্তী কোনো দিনেও লেখা হতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ভাউচারের নম্বর ও তারিখটিও উল্লিখিত হয়েছে—ফলে সেই বিশেষ খরচটি কোন তারিখে করা হয়েছিল তা নির্ণয় করা শক্ত হয় না। দেবেন্দ্রনাথের পুত্রদের মধ্যেই কেউ হিসাবগুলি পরীক্ষা করে ক্যাশবহির প্রতি পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর করতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, মাঝে মাঝেই দু-এক বৎসরের খাতা পাওয়া যায়নি—কিন্তু যা পাওয়া গেছে তাও কম নয়। শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে ছোটো-বড়ো মিলিয়ে এইরূপ খাতা বা ফাইল আছে প্রায় সাড়ে তিনশো—যার শুরু ১২৬৭-৬৯ বঙ্গাব্দের ‘এষ্টেটের হিসাববহি’ দিয়ে, শেষ হয়েছে ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ‘কালিম্পঙের ক্যাশবহি’তে। আমরা এই বৎসর থেকে অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে সঙ্গে এই খাতাগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্যও বহুলপরিমাণে ব্যবহার করব। হিসাবের কচ্কচিতে পাঠকেরা বিরক্ত হতে পারেন, কিন্তু এগুলির তাৎপর্য এমনই অসামান্য যে এদের এড়িয়ে চলা যায় না। এর থেকে আমরা রবীন্দ্রজীবনীতে বহু নূতন তথ্য যোগ করতে পারি, বহু তথ্য সংশোধন করতে পারি ও বহু তথ্যের যথাযথ স্থান-কাল নির্দেশ করতে পারি।
১২৭১ বঙ্গাব্দের ‘নিজ হিসাবের কেস বহি’তে রবীন্দ্রনাথের প্রথম উল্লেখ আমরা এইভাবে পাই ২২ জ্যৈষ্ঠ [শুক্র 3 Jun] তারিখে : ‘সোমেন্দ্রনাথ/রবীন্দ্রনাথ বাবুর/চাকর/কালিদাস/৩ ॥০ হিঃ—৭৲’। জীবনস্মৃতি ও ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বর [ছেলেবেলা-য় তার নাম ‘ব্রজেশ্বর’], শ্যাম এবং ‘বেঁটে গোবিন্দ’ চাকরেরই শুধু উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সমগ্র বাল্য ও কৈশোর জীবনে এরা তিনজন ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আরও বহু চাকরের সেবা লাভ করেছেন, যাদের নাম তিনি করেননি। এখানে তেমনিই একজনের নাম পাওয়া যাচ্ছে—যখন তাঁর বয়স সবে তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। এই তারিখেরই হিসাবে আমরা জীবনস্মৃতি বা অন্যান্য স্মৃতিকথার মাধ্যমে পরিচিত আরও কয়েকজন কর্মচারীর সাক্ষাৎ লাভ করি—কৈলাসচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কিশোরীনাথ চট্টোপাধ্যায়, স্বরূপ সর্দার ও পিয়ারী বা প্যারী দাসীকে। ‘তোষাখানার চাকর ঈশ্বর দাষ’-কেও আমরা এই দিনে বেতন পেতে দেখি—কিন্তু সে রবীন্দ্রনাথ-কথিত গ্রাম্য পাঠশালার প্রাক্তন গুরুমহাশয় ঈশ্বর চাকর কিনা বলা শক্ত, কারণ জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে তিনি লিখেছিলেন : ‘এই সময়ে ঈশ্বর নামে একটি নূতন চাকর আমাদের কাছে নিযুক্ত হইল, সে ব্যক্তি গ্রামে গুরুমহাশয়গিরি করিত।’—সে আরও পরের কথা। অবশ্য চাকরদের ক্ষেত্রে বদলিরও দৃষ্টান্ত দেখা যায়। তারা গোয়ালিনির সাক্ষাৎও হিসাব-খাতায় পাওয়া যায়—তাকে দুধের দাম হিসেবে ফাল্গুন ১২৭০ থেকে জ্যৈষ্ঠ ১২৭১ চার মাসের জন্য ২৪২ টাকা এগারো আনা এক পয়সা দেওয়া হয়েছে, ‘মাহ আসাড়’ ও ‘মাহ শ্রাবণ’-এর বিলও মাসিক ৬৪ টাকা করে। যত বড়ো পরিবারই হোক, তখনকার দিনে দুধের দামের কথা বিবেচনা করলে মনে হয় দুগ্ধের স্রোতে বাড়ি ভেসে যেত!
রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাশিক্ষার সূত্রপাত এই বৎসরেই। খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন : ‘পাঁচ বৎসরের পূর্ব্বেই তাঁহার বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ হয়; কিন্তু ঠাকুরবাড়ীর প্রথা ও বঙ্গদেশের প্রচলিত নীতি অনুসারে শুভদিন দেখিয়ে বাগদেবীর অর্চ্চনাপূৰ্ব্বক বালককে হাতে খড়ি ধরান হয় নাই। অন্য কোনও প্রকার অপৌত্তলিক অনুষ্ঠানও এই উপলক্ষকে জয়যুক্ত করে নাই।’১ তিনি বলেছেন, এই শিক্ষা আরম্ভ হয় গৃহস্থিত গুরুমশায়ের কাছে, তাঁর নাম ছিল মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বাড়ি বর্ধমান জেলায়।২ জোড়াসাঁকো বাড়ির ঠাকুরদালানে বসত এই পাঠশালা, তাতে শুধু বাড়ির শিশুরা নয়, পাড়াপ্রতিবেশীর ছেলেরাও পড়ত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথও একজন গুরুমশায়ের বর্ণনা করেছেন এইভাবে : ‘একেবারে সেকেলে পণ্ডিতের জ্বলন্ত আদর্শ। রং কালো, গোঁপ-জোড়া কাঁচাপাকায় মিশ্রিত মুড়া-খ্যাংরার ন্যায়।…মুখে কখনও এতটুকু হাসি দেখা যাইত না। …তাঁহার একগাছি ছোট বেত ছিল, নিজের দেহের সঙ্গে সেটিকেও তিনি সযত্নে তেল মাখাইতেন। …অপরাধে, বিনা-অপরাধে, যখন-তখন, এই বেতগাছটি ছাত্রদিগের পৃষ্ঠসংস্পর্শে আসিত…আর সেইসঙ্গে কতকগুলা অকথ্য গালিবর্ষণও যে না হইত, তাহাও নয়।’৩ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-কথিত এই গুরুমশায়ই মাধবচন্দ্র কিনা। যদি না হন, তা হলেও স্বভাব-প্রকৃতিতে সেকালের গুরুমশায়েরা প্রায় একই রকম ছিলেন, তথাকথিত মাধবচন্দ্র নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। ‘তথাকথিত’ বলছি এইজন্য যে, এই নামের বা এইরূপ কাজের জন্য কোনো বেতনভোগী কর্মচারীর অস্তিত্ব আমরা ক্যাশবহি-তে পাই না; যদিও ১৮ শ্রাবণ ১২৭৩ [বৃহ 2 Aug 1866] ‘ছেলেবাবুদিগের পণ্ডিতকে খয়রাত’ খাতে চার টাকা খরচ করতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথও শিশু কাব্যের অন্তর্গত ‘পুরনো বট’৪ কবিতায় জনৈক মাধব গোঁসাই-এর উল্লেখ করেছেন : ‘ওখানেতে পাঠশালা নেই,/পণ্ডিতমশাই—/বেত হাতে নাইকো বসে/মাধব গোঁসাই।’৪
রবীন্দ্রনাথের দাদা সোমেন্দ্রনাথ ও ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ উভয়েই তাঁর চেয়ে বয়সে দু-বছরের বড়ো হলেও তাঁরা প্রতিপালিত হতেন তিনজনে একসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তাঁহারা যখন গুরুমহাশয়ের কাছে পড়া আরম্ভ করিলেন আমারও শিক্ষা সেই সময়ে শুরু হইল, কিন্তু সে-কথা আমার মনেও নাই।’৫ অন্যত্র তিনি একটু বিস্তারিতভাবেই বিষয়টি বর্ণনা করেছেন : ‘ঐখানে [বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে অর্থাৎ পুজোর দালানে] গুরুমশায়ের পাঠশালা বসত। কেবল বাড়ির নয়, পাড়াপ্রতিবেশীর ছেলেদেরও ঐখানেই বিদ্যের প্রথম আঁচড় পড়ত তালপাতায়। আমিও নিশ্চয় ঐখানেই স্বরে-অ স্বরে-আ’র উপর দাগা বুলোতে আরম্ভ করেছিলুম, কিন্তু সৌরলোকের সবচেয়ে দূরের গ্রহের মতো সেই শিশুকে মনে-আনাওয়ালা কোনো দূরবীন দিয়েও তাকে দেখবার জো নেই।’৬
বইয়ের ব্যবস্থাও ছিল! ক্যাশবহি-তে ২২ ভাদ্র-এর [মঙ্গল 6 Sep] হিসাবে দেখা যায়—‘পুস্তক খরিদ—/…/ছেলেবাবুদীগের কারণ/প্রথমভাগ ২খান’ বাবদ দু-আনা খরচ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন তিন বছর চার মাস, সোমেন্দ্রনাথের পূর্ণ পাঁচ বছর ও সত্যপ্রসাদের পাঁচ বছর পূর্ণ হতে এক মাস বাকি। সুতরাং অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না যে, বইদুটি সোমন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদের জন্যই কেনা হয়েছিল অর্থাৎ তাঁরা দুজন এই সময় থেকে পাঠশালায় শিক্ষারম্ভ করেছিলেন। সর্বক্ষণের সঙ্গী শিশু রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অনুবর্তী হতে পারেন, কিন্তু সঠিক অর্থে শিক্ষার আয়োজন তাঁর জন্য অন্তত এই সময়ে করা হয়নি। এই আয়োজন দেখা গেল চার মাস পরে ২৪ পৌষ [শুক্র 6 Jan 1865] তারিখে—ওই দিন আবার ‘ছেলেবাবুদীগের বহিখরিদ’ করা হয়েছে দু-আনা দিয়ে দুখানা ‘বর্ণপরিচয়’ ও তিন আনা দিয়ে ‘শিশুশীক্ষা’ [ক’খানা উল্লেখ করা হয়নি, অনুমান করতে পারি এই বইটি তিনখানা কেনা হয়েছিল—1855-এ প্রকাশিত Rev. J. Long-এর A Descriptive Catalogue of Bengali Works -এ বইটির দাম এক আনা উল্লেখ করা হয়েছে।*]—শিশুশিক্ষা-র তৃতীয় কপিটি রবীন্দ্রনাথের জন্যই কেনা হয়েছিল, এ কথা স্বচ্ছন্দে বলা চলে, তাঁর বয়স তখন তিন বছর আট মাস মাত্র। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের দ্বারা পঠিত প্রথম পুস্তকের গৌরব মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রণীত শিশুশিক্ষা—প্রথম-ভাগ-এর প্রাপ্য। এই গ্রন্থের মাধ্যমে অক্ষর পরিচয় ঘটায় এর একটি বিশেষত্ব রবীন্দ্রনাথের মনে দুর্মর সংস্কারে পরিণত হয়েছিল। বিদ্যাসাগর তাঁর বিখ্যাত বর্ণপরিচয়—প্রথম ভাগ-এ৭ বাংলা ভাষায় প্রয়োগ নেই বলে দীর্ঘ-ঋ ও দীর্ঘ ৯-কে স্বরবর্ণ থেকে এবং যুক্তাক্ষর বলে ‘ক্ষ’-কে অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে বাদ দিয়েছিলেন—কিন্তু বর্ণগুলি শিশুশিক্ষা-য় পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু শেষোক্ত বই থেকেই অক্ষর পরিচয় ঘটেছিল বলে পরিণত বয়সেও রবীন্দ্রনাথ এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি, তার প্রমাণ মেলে ‘পকেট-বুক’ নামে বিখ্যাত তাঁর খসড়া রচনা-খাতায় :
দুই বুড়ো ঋ ৠ
চলে ধীরি ধীরি।
দুই বোন ৯ ৡ
হাসে খিলি খীলি।
হ হাঁচে হ ক্ষ
ক্ষ কাশে খ ক্ষ।
—এমন-কি ‘সহজ পাঠ—প্রথম ভাগ’ [বৈশাখ ১৩৩৭]-এ ‘ৠ’ ‘ৡ’ বর্জিত হলেও ‘ক্ষ’ অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে নিজের স্থান অক্ষুণ্ণ রেখেছে।
যদিও রবীন্দ্রনাথের জন্য বিশেষ করে বর্ণপরিচয়-প্রথম ভাগ কেনার উল্লেখ পাওয়া যায় না, তবু এই বইটিও তাঁর প্রথমশিক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিল বলেই মনে হয়। তিনি লিখেছেন : “তখন ‘কর খল’ প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’। আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা।“৮ এই বর্ণনা বর্ণপরিচয়-প্রথম ভাগ-কেই মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য সে ক্ষেত্রেও আমাদের দ্বিধা সম্পূর্ণ কাটে না। কারণ উক্ত গ্রন্থের তৃতীয় পাঠে ‘জল পড়ে’ বাক্যটি থাকলেও ‘পাতা নড়ে’ বাক্যটি নেই এবং অষ্টম পাঠে বাক্যদুটিকে পাওয়া যায় একেবারে গদ্যাত্মক চেহারায়—‘জল পড়িতেছে। পাতা নড়িতেছে।’—যাকে আদিকবির প্রথম কবিতা বলা শক্ত।
পাঠশালার কথার পর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘তার পরে বই পড়ার কথা প্রথম যা মনে পড়ে সে ষন্ডামার্ক মুনির পাঠশালার বিষম ব্যাপার নিয়ে, আর হিরণ্যকশিপুর পেট চিরছে নৃসিংহ অবতার—বোধ করি সীসের ফলকে খোদাই করা তার একখানা ছবিও দেখেছি সেই বইয়ে। আর মনে পড়ছে কিছু কিছু চাণক্যের শ্লোক।’৯
অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন সিদ্ধান্ত করেছেন, এই বই শিশুবোধক* ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি লিখেছেন, “গুরু মশায়ের ওই পাঠশালাতে অ আ ক খ শেখার অল্প পরেই রবীন্দ্রনাথ এই সচিত্র শিশুবোধক পড়েছিলেন। কেননা, এই বইএরই ‘প্রহ্লাদচরিত্র’-নামক শেষ কবিতায় আছে ষণ্ডামার্ক মুনির পাঠশালায় পাঠগ্রহণ-কালে শিশু প্রহ্লাদের উপর পিতা হিরণ্যকশিপুর অমানুষিক অত্যাচারের এবং পরিণামে নৃসিংহের হাতে হিরণ্যকশিপুবধের ভয়াবহ বিবরণ। এই বইএ হিরণ্যকশিপুবধের যে ছবিটি আছে তাও রবীন্দ্রনাথের বর্ণনার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে। তা ছাড়া, এই বইতেই প্রহ্লাদচরিত্রের পরে আছে ১০৫টি চাণক্যশ্লোক ও তার বাংলা পদ্যানুবাদ। সুতরাং স্বীকার করতে হবে যে, এই সচিত্র শিশুবোধক রবীন্দ্রনাথের প্রথম পড়া বই বলে অসামান্য গৌরবলাভের এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হবার অধিকারী।’১০
কিন্তু উপরে ক্যাশবহি থেকে যে হিসাব উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে রবীন্দ্রনাথ পাঠশালায় পড়েছিলেন এ কথা মেনে নিলেও পাঠ্যপুস্তকরূপে শিশুবোধক-এর জন্য স্থান করে দেওয়া অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে। কারণ এই পর্বে দু-দফায় যে বই কেনা হয়েছে, তাতে আমরা ‘প্রথম ভাগ’ [দাম দেখে বর্ণপরিচয়—প্রথম ভাগ হওয়াই সম্ভব বলে মনে হয়], বর্ণপরিচয় ও শিশুশিক্ষা-র কথাই জানতে পেরেছি, শিশুবোধক কেনা হয়েছে এমন কোনো ইঙ্গিত মেলেনি। আসলে, শিশুবোধক তিনি পড়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রথম-পড়া বই হিসেবে নয়, এটি তাঁর পঠিত তৃতীয় বই—এবং সেটি পড়েছিলেন, বাড়িতে পাঠশালা-পর্বে নয়, স্কুল-পাঠ্য বই হিসেবে বিদ্যালয়-পর্বে। ২৫ চৈত্র [বৃহ 6 Apr 1865] তারিখের হিসাবে দেখা যায় : ‘ছেলেবাবুদীগের ৩ জনের জন্য ইস্কুলের কেতাপ খরিদ ৩ খানা’, ব্যয়ের পরিমাণ ছ-আনা। আমাদের ধারণা, এই ‘ইস্কুলের কেতাপ’খানিই শিশুবোধক—লঙ্ সাহেবের ক্যাটালগে প্রদত্ত বইটির নাম আমাদের ধারণাকেই সমর্থন করে।
‘শিশুবোধক রবীন্দ্রনাথের প্রথম-পড়া বই’ এই মন্তব্য ছাড়া অধ্যাপক সেনের পরবর্তী সিদ্ধান্ত আমাদের বক্তব্যের অনুকূল : ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষারম্ভ হয়েছিল শিশুশিক্ষা দিয়ে এবং তার পরে সম্ভবতঃ বর্ণপরিচয়ের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ঘটেছিল। তারও পরে পড়েছিলেন শিশুবোধক, আর এই শিশুবোধকেই পেয়েছিলেন মূলপাঠসহ চাণক্যশ্লোকের বাংলা পদ্যানুবাদ।’১১ আর এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পুরো ইতিহাসটিকে গুছিয়ে আনতে পারি এইভাবে : বর্ণপরিচয়-প্রথমভাগ দিয়ে সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ যখন ভাদ্র [Sep 1864] থেকে শিক্ষারম্ভ করেন, রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁদের সঙ্গী ছিলেন না; তিনি পাঠশালায় যেতে শুরু করলেন পৌষ মাস [Jan 1865] থেকে, শিশুশিক্ষা অবলম্বনেই তাঁর অক্ষর পরিচয় হয়, কিন্তু ‘বর্ণযোজনা’ শেখেন বর্ণপরিচয় থেকে—‘কর খল’ এবং ‘জল পড়িতেছে। পাতা নড়িতেছে’ পাঠই তিনি গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ভাবী মহাকবির ‘সমস্ত চৈতন্য’ গদ্যের সেই সাদাসিধে রূপের অন্তরে নিহিত ছন্দটুকু আবিষ্কার করে গদ্যের ঘটমান বর্তমানকে কবিতার নিত্য বর্তমানে পরিণত করেছে। * এর পরে এসেছে শিশুবোধক, সেখানে পুনরায় শিশুশিক্ষার ‘ৠ ৡ ক্ষ’ বর্ণ তিনটিকে পেয়ে এমন এক সংস্কারে পরিণত হয়েছে যার প্রভাব পরিণত বয়সেও তিনি সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
এর পর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
তাহার পরে যে-কথাটা মনে পড়িতেছে তাহা ইস্কুলে যাওয়ার সূচনা। একদিন দেখিলাম, দাদা এবং আমার বয়োজ্যেষ্ঠ ভাগিনেয় সত্য ইস্কুলে গেলেন, কিন্তু আমি ইস্কুলে যাইবার যোগ্য বলিয়া গণ্য হইলাম না। উচ্চৈঃস্বরে কান্না ছাড়া যোগ্যতা প্রচার করার আর-কোনো উপায় আমার হাতে ছিল না। ইহার পূর্বে কোনদিন গাড়িও চড়ি নাই বাড়ির বাহিরও হই নাই, তাই সত্য যন ইস্কুল-পথের ভ্রমণবৃত্তান্তটিকে অতিশয়োক্তি-অলংকারে প্রত্যহই অত্যুজ্জ্বল করিয়া তুলিতে লাগিল তখন ঘরে আর মন কিছুতেই টিকিতে চাহিল না। যিনি আমাদের শিক্ষক ছিলেন তিনি আমার মোহ বিনাশ করিবার জন্য প্রবল চপেটাঘাতসহ এই সারগর্ভ কথাটি বলিয়াছিলেন, “এখন ইস্কুলে যাবার জন্য যেমন কাঁদিতেছ, না যাবার জন্য ইহার চেয়ে অনেক বেশি কাঁদিতে হইবে।”…কান্নার জোরে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে অকালে ভরতি হইলাম।১২
ক্যাশবহির সাক্ষ্য কিন্তু অন্য কথা বলে। এমন হতে পারে , সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদকে স্কুলে ভর্তি ও গাড়ি চড়ে বাইরে যেতে দেখে রবীন্দ্রনাথের মনে ঈর্ষা-জনিত ক্রন্দনের বেগ উপস্থিত করেছিল ও সেই ‘কান্নার জোরে’ কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে হয়েছিল—কিন্তু তাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন একই মাসে, তাঁদের ভর্তির হিসাব ক্যাশবহিতে একসঙ্গেই লিখিত হয়েছে। আর স্কুলটির নামও ওরিয়েন্টাল সেমিনারি নয়—‘কলিকাতা ট্রেনিং একাডেমি’।১৩ ক্যাশবহি-তে ২৬ চৈত্র ১২৭১ [শুক্র 7 Apr 1865] লেখা হয়েছে :
পড়িবার খরচ খাতে/খরচ—৬৲
বঃ কলিকাতা ট্রেনি° একাডিমী
দঃ রবিন্দ্রনাথঠাকুরের/মার্চ্চ মহার/১ বিল°—১৲ /ডিপাজিট—১৲
সোমেরিন্দ্রনাথঠক/মার্চ্চমহার/১ বিল—১৲/ডিপাজিট—১৲
বাবুঃ সত্যপ্রসাদ গঙ্গপাধ্যায়/মার্চ্চ মাহার/১বিল°—১৲/ডিপাজিট—১৲
তিনজনের ক্ষেত্রেই ডিপজিটের উল্লেখ প্রমাণ করে যে তিনজনে একই মাসে স্কুলে ভর্তি হন। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন তিন বছর দশ মাস মাত্র।
উপরে প্রদত্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের প্রথম শিক্ষাক্ষেত্র হিসেবে ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’ এত দিন পর্যন্ত যে গৌরব লাভ করে এসেছে, এখন থেকে সে গৌরবের অধিকারী হবে ‘কলিকাতা [ক্যালকাটা] ট্রেনিং একাডেমি’, যার তৎকালীন ঠিকানা ছিল ১৩ নং কর্নওয়ালিস স্ট্রীট এবং বর্তমানে স্কুলটি ১৩ নং ডাঃ নারায়ণ রায় সরণি [সিমলা স্ত্রীট] ঠিকানায় শ্রীমানী বাজারের ঠিক পিছনে অবস্থিত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে স্কুলটি কেন ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’-রূপে চিহ্নিত হয়ে ছিল—এ প্রশ্নের কোনো সমাধান আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। এ কথা ঠিক যে, এই বয়সের স্মৃতি রবীন্দ্রনাথের মনে স্পষ্ট থাকার কথা নয় সুতরাং কারো মুখে শুনেই এই ধারণা তাঁর মনে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এই ভুল সংবাদ তাঁকে কে কেন দিয়েছিলেন তা বোঝা যায় না; তাঁর জ্যেষ্ঠদের মধ্যেও কেউ এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন না। শুধু একটি সম্ভাবনার কথা মনে হয়। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র নন্দী সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গৃহশিক্ষক ছিলেন, এ কথা আমরা তাঁদের স্মৃতিকথা থেকে জানতে পারি। আমাদের আলোচ্য সময়েও তিনি মাসিক কুড়ি টাকা বেতন পেতেন, ক্যাশবহিতে তার উল্লেখ দেখা যায়। এমন হতে পারে, এই ঈশ্বরচন্দ্র নন্দীর অনুষঙ্গই রবীন্দ্রনাথের মনে উক্ত ধারণা সৃষ্টি কারণ।
বিশিষ্ট গবেষক গোপালচন্দ্র রায় রবীন্দ্রনাথের কথাকে অকাট্য ধরে নিয়ে লিখেছেন :
রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে তাঁর ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি হওয়ার প্রসঙ্গ এবং ঐ স্কুলে ছাত্র শাসন পদ্ধতির যে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন, সে কথা স্বীকার করে নিয়েও তো বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর দুই সঙ্গী ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার আগে অল্প কয়েক দিনের জন্য ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়েছিলেন। অল্প কয়েকদিনের জন্য বললাম এই জন্য যে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত ছাত্র শাসনের কথা সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথের অভিভাবকরা জানতে পেরে, ঐ স্কুল থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতিকে তখনই সরিয়ে এনেছিলেন।১৪
বিখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ [1893-1972] একসময়ে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও রচনা সম্পর্কে তথ্যসন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকেও প্রশ্ন করে তার উত্তর একটি খাতায় লিখে রাখেন, বর্তমানে খাতাটি রবীন্দ্রভবনের সংগ্রহে এসেছে। বর্তমান প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন :
কবির প্রথম স্কুলে যাওয়া [বরানগর, ৩০ জানুয়ারি ১৯৩২, কথাবার্ত্তা] পঞ্চম বৎসরে প্রথম স্কুলে যাই। জীবন-স্মৃতিতে একটু ভুল লিখেছি। Oriental Seminary আর আড্ডির স্কুল। কিন্তু পরে দাদাদের কাছে শুনেছিলাম যে ওর একটা স্কুল তার আগেকার আমলের।
এই বিবৃতিতেও ভুল আছে, পঞ্চম বৎসরের আগেই তিনি স্কুলে গিয়েছিলেন—কিন্তু আশা করি, ওরিয়েন্টাল সেমিনারি-সংক্রান্ত বিতর্ক সম্ভবত এই স্বীকারোক্তির সাক্ষ্যে পরিত্যক্ত হবে। তাছাড়া রবীন্দ্রভবন গ্রন্থাগারে রবীন্দ্রনাথ-ব্যবহৃত ও সংশোধিত প্রথম সংস্করণ জীবনস্মৃতি-তে দেখা গেল, তিনি ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’ শব্দগুলি ৫, ২১ ও ২২ পৃষ্ঠায় প্রথমবন্ধনী-ভুক্ত করে মার্জিনে জিজ্ঞাসা-চিহ্ন বসিয়েছিলেন। এটিও একটি অতিরিক্ত যুক্তি হিসেবে গণ্য হতে পারে।
প্রসঙ্গত, কলিকাতা ট্রেনিং একাডেমির ইতিহাস একটু অনুসন্ধান করা যেতে পারে। 2 Jun 1859 তারিখে ঠাকুরদাস চক্রবর্তী, মাধবচন্দ্র ধর, পতিতপাবন সেন, গঙ্গাচরণ সেন, যাদবচন্দ্র পালিত এবং বৈষ্ণবচরণ [বৈষ্ণবদাস?] আঢ্য প্রসিদ্ধ ধনী শ্যামাচরণ মল্লিকের সহায়তায় ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজের দক্ষিণে তখন বিখ্যাত ধনী শংকর ঘোষের একটি বৃহৎ জরাজীর্ণ বাড়ি ছিল। বাড়িটির তৎকালীন মালিক খেলাতচন্দ্র ঘোষের কাছ থেকে মাসিক ৫০ টাকা ভাড়ায় বাড়িটি নিয়ে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নাম প্রথমে ছিল ‘মেট্রোপলিটান ট্রেনিং স্কুল’, পরে নাম পরিবর্তিত করে ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল’ রাখা হয়। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্কুলটির প্রথম প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। Jan 1860 থেকে স্কুলটিতে শিশু বিভাগ খোলা হয়, বেতন ধার্য হয় মাসিক এক টাকা। এই বছরের ডিসেম্বর মাসে বিদ্যাসাগরকে সভাপতি, ঠাকুরদাস চক্রবর্তীকে সম্পাদক, মাধবচন্দ্র ধরকে কোষাধ্যক্ষ এবং পূর্বতন সভ্যদের সঙ্গে রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষ্ণদাস পাল প্রভৃতি কয়েকজন নূতন সভ্য নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। কিছুদিন পরে একটি অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে কমিটির সদস্যদের মধ্যে মনোমালিন্য উপস্থিত হলে ঠাকুরদাস চক্রবর্তী পদত্যাগ করে সম্ভবত Apr 1861 থেকে ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি’ নামে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। অল্পদিন পরে মাধবচন্দ্র ধরও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। ট্রেনিং স্কুল নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে 1864 থেকে ‘মেট্রোপলিটান স্কুল’ নাম গ্রহণ করে।*
২৫ চৈত্র [বৃহ 6 Apr] রবীন্দ্রনাথের তিনজনের জন্য তিনটি ‘ইস্কুলের কেতাপ’ ছ’আনা দিয়ে কেনার হিসাব পাওয়া যায়, এ কথা আমরা পূর্বেই বলেছি। এখন প্রশ্ন, এই বই তিনটি কী বই? আমাদের ধারণা, এই বই হচ্ছে ‘শিশুবোধক’। রেভারেণ্ড লঙ্-প্রণীত দেশীয় পুস্তকের তালিকায় ২৩৫ সংখ্যক পুস্তকের বিবরণে লেখা আছে ‘Shisubodhok, CHILD’S INSTRUCTOR, 1854, pp. 81, 2 as.’ তখনকার দিনে পুস্তকের মূল্যের খুব একটা হেরফের হত না, আর যেখানে শিশুশিক্ষা ও বর্ণপরিচয়-এর মতো উৎকৃষ্ট গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, তখন প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য 1854-এ প্রকাশিত দু–আনা দামের শিশুবোধক 1865-এও একই দামে বিক্রীত হত, এমন অনুমান করা অযৌক্তিক নয় এবং এই দাম আমাদের প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে যথেষ্ট সংগতিপূর্ণ। আর বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তীব্র মনোমালিন্যের ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-রূপে গড়ে ওঠা ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি’তে বিদ্যাসাগর-রচিত বর্ণপরিচয় কিংবা তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি’ থেকে প্রকাশিত শিশুশিক্ষা পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নির্বাচিত হবে না এটাই স্বাভাবিক। এর বাইরে শিশুবোধক ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য শিশুপাঠ্য গ্রন্থ তখন বাংলায় প্রকাশিত হয়নি। সুতরাং ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি’র শিশুশ্রেণীর ছাত্ররূপে রবীন্দ্রনাথ ‘শিশুবোধক’ থেকে পাঠ গ্রহণ করেছিলেন, এমন ধারণা অমূলক নয়।
এইবার বৎসরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। গত বৎসর সত্যেন্দ্রনাথ আই. সি. এস. পরীক্ষার যোগ্যতা নির্ধারক পরীক্ষায় ৪৩তম স্থান অধিকার করেছিলেন, এই বৎসর June মাসে অপেক্ষাকৃত সহজ শেষ পরীক্ষায় ৫২ জনের মধ্যে ষষ্ঠ হয়ে উত্তীর্ণ হন এবং কার্তিকের গোড়ায় [Oct 1864] কলকাতায় ফিরে আসেন। তাঁর বন্ধু ও সহ-পরীক্ষার্থী মনোমোহন ঘোষ এই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য ইংলণ্ডেই থেকে যান, তাঁর ইংলণ্ডে বসবাসের ও লেখাপড়ার সমস্ত খরচ দেবেন্দ্রনাথই বহন করতে থাকেন। সত্যেন্দ্রনাথ দেশে ফিরে আসবার পর ২৮ কার্তিক শনি 12 Nov সন্ধ্যায় বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ প্রভৃতি তিন শতাধিক শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এই প্রথম ভারতীয় আই. সি. এস.-কে সংবর্ধিত করেন।১৫ অনতিকাল পরেই অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে [Nov 1864] সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর চতুর্দশী পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজে তাঁর কর্মস্থল বোম্বাই প্রদেশে যাত্রা করেন। স্বভাবতই ঘটনাটি ঠাকুরপরিবারে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সত্যেন্দ্রনাথ ছাত্রজীবন থেকেই স্ত্রী-শিক্ষা ও স্ত্রী-স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিলেন। লণ্ডন-প্রবাসে থাকার সময়ে স্ত্রীকে লিখিত পত্র থেকে জানা যায় তিনি কিশোরী স্ত্রীকে ইংলণ্ডে নিয়ে যাবার জন্য ব্যগ্র ছিলেন এবং এ-বিষয়ে তিনি পিতাকে অনুরোধ করে পত্রও দেন। কিন্তু রক্ষণশীল পিতা যে তাতে সম্মত হননি, তা জানা যায় সত্যেন্দ্রনাথের 2 Jul 1864 [শনি ১৫ আষাঢ়] এ লেখা পত্র থেকে ‘বাবামশায় চান আমি যেন অন্তঃপুরের মানমর্য্যাদার উপর হস্তক্ষেপ না করি।’১৬ সুতরাং তিনি যখন পত্নীকে কর্মস্থলে নিয়ে যেতে চাইলেন, তখন দেবেন্দ্রনাথ সে-প্রস্তাবে যে সহজে সম্মত হননি, তা অনুমান করা শক্ত নয়। স্বর্ণকুমারী দেবী এই যাত্রার একটি বিবরণ দিয়েছেন :
তখন অন্তঃপুরে অবরোধপ্রথা পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান। তখনো মেয়েদের একই প্রাঙ্গণের এ বাড়ী হইতে ও বাড়ী যাইতে হইলে ঘেটাটোপ মোড়া পাল্কীর সঙ্গে প্রহরী ছোটে, তখনো নিতান্ত অনুনয় বিনয়ে মা গঙ্গাস্নানে যাইবার অনুমতি পাইলে বেহারারা পাল্কী শুদ্ধ তাঁহাকে জলে চুবাইয়া আনে। স্ত্রীকে মেজ দাদা লইয়া যাইতেছেন বোম্বাই সমুদ্রপার, কিন্তু তখনো অন্তঃপুর হইতে তাঁহাকে বহিব্বাটীর প্রাঙ্গণ পৰ্য্যন্ত হাঁটাইয়া গাড়ী চড়াইতে পারিলেন না। কুলবধূর পক্ষে ইহা এতই নূতন এতই লজ্জাজনক যে বাড়ী শুদ্ধ সকলেই ইহাতে বিশেষ আপত্তি প্রকাশ করিলেন। অগত্যা পাল্কী করিয়া তাঁহাকে জাহাজে উঠিতে হইল। একজন ফ্রেঞ্চ মহিলা তাঁহার বহির্গমনের উপযোগী নূতন বেশ প্রস্তুত করিয়া দিয়াছিলেন।১৭
জাহাজ নানা জায়গায় থেমে বোম্বাই পৌঁছতে প্রায় এক মাস সময় লাগে। সেখানে জাহাজ-ঘাটায় বিপুল সংবর্ধনা লাভের পর মানকজী করসদজী নামক এক পারসি ভদ্রলোকের গৃহে প্রায় তিন মাস অতিথি হয়ে থাকেন। এখানে প্রথম যে-সমস্যা দেখা দিয়েছিল তা হল জ্ঞানদানন্দিনী হিন্দি বা ইংরেজি বলতে অভ্যস্ত নন, সুতরাং কথাবার্তা বলা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয় সমস্যা স্ত্রীলোকের শোভন পরিচ্ছদের। নানারকম পরীক্ষার পর পারসি শাড়ি ও জামার নমুনায় এবং গুজরাটী মেয়েরা যেভাবে শাড়ি পরে তার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে জ্ঞানদানন্দিনীর পরিচ্ছদ-সমস্যার সমাধান করা হল, যা কালক্রমে বাঙালি মেয়েদের সার্বজনীন পোশাক হয়ে দাঁড়ায়।
অন্তঃপুরের এইসব পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কেও দেবেন্দ্রনাথ এক পরিবর্তনের সম্মুখীন হলেন। তিনি হিন্দু ধর্ম ও সমাজের সংস্কারের পক্ষপাতী হলেও এ ব্যাপারে তাড়াহুড়োর বিরোধী ছিলেন। হিন্দুরা সম্পূর্ণরূপে ব্রাহ্মদের প্রতিকূল হয়ে উঠুক এমন পদক্ষেপ গ্রহণে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর এই মনোভাব যে সুফলপ্রসূ হয়েছিল, তা বোঝা যাবে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের উক্তিতে : ‘যদিও সাকার ও নিরাকার উপাসনা লইয়া এই সাধক-সম্প্রদায়ের [ব্রাহ্মদের] সহিত হিন্দু-সমাজের বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল—তথাপি চিন্তাশীল হিন্দুমাত্রেরই সহিত এই সাধক-সম্প্রদায় ক্রমশ ঘনীভূত হইতেছিলেন। …হিন্দুগণ ক্রমশ বুঝিতেছিলেন যে, ব্রাহ্মধর্ম কোন নবধর্ম্ম নহে—বেদ ও উপনিষদাদি-মথিত ব্ৰহ্মজ্ঞানমূলক হিন্দুধর্ম্ম মাত্র।’১৮ কিন্তু কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর অনুগামীরা দেবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারাকে রক্ষণশীল বলে মনে করতেন। ফলে ভিতরে ভিতরে একটা অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠছিল। এই পরিস্থিতিতে প্রধানত কেশবচন্দ্রের চেষ্টায় ১৯ শ্রাবণ [মঙ্গল 2 Aug] প্রথম অসবর্ণ বিবাহ সংঘটিত হল। মাত্র কয়েক দিন পরে ৬ ভাদ্র [রবি 21 Aug] তাঁরই আগ্রহে সমাজে দু’জন উপবীত-ত্যাগী উপাচার্য নিযুক্ত হন—বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও অন্নদাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। ঘটনা-দুটির গুরুত্ব অসামান্য। যোগেন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘এতদিন ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়া কেহ জাতিচ্যুত হন নাই, কারণ, আদি ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুধর্মের ভিত্তিভূমি বর্ণাশ্রমের বিরোধী ছিলেন না। কিন্তু এখন ব্রাহ্মসমাজ বর্ণাশ্রমের বিরোধী হইয়া হিন্দুসমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িলেন।’১৯ এরপর ১৫ কার্তিক [রবি 30 Oct] কেশবচন্দ্র ‘বিবিধ উপায়ে ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রচার ও ভারতবর্ষস্থ সমুদায় ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে ঐক্য সংস্থাপন উদ্দেশ্যে’ ‘প্রতিনিধি সভা’ স্থাপন করেন এবং এই কার্তিক মাস থেকেই উন্নতিশীল ব্রাহ্মদের মুখপত্র হিসেবে ‘ধর্ম্মতত্ত্ব’ পত্রিকা মাসিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে : ‘ধৰ্ম্মনীতি; ধর্ম্মতত্ত্ব; সামাজিক উন্নতি; ব্রাহ্মধৰ্ম্মের উন্নতি; নীতিগর্ভ আখ্যায়িকা; সাধুদিগের জীবন; বেদ পুরাণ বাইবেল কোরাণ প্রভৃতি ধৰ্ম্মপুস্তক হইতে সত্য ধর্ম প্রতিপাদক ভাব; এই সমুদায় ঐ পত্রিকার লেখা বিষয়।’ ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র হিসেবে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা থাকা সত্ত্বেও ধর্মতত্ত্ব পত্রিকার প্রকাশ ও অন্যান্য আচরণের মধ্য দিয়ে নব্যদল কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের উপর তাঁদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন, এমন সন্দেহ স্বতই প্রাচীন দলের মনে উদিত হয়। দেবেন্দ্রনাথ নিজেও কেশবচন্দ্রের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ সত্ত্বেও এতখানি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। দীর্ঘকাল ধরে সামাজিক ও পারিবারিক নানা নির্যাতন সহ্য করে যাঁরা ব্রাহ্মধর্মের বিস্তারে দেবেন্দ্রনাথের আনুকূল্য করে এসেছেন, তাঁদের পরিত্যাগ করা তিনি যুক্তিযুক্ত মনে করলেন না। এর ফলে অগ্রহায়ণ মাসে ব্রাহ্মসমাজের ট্রাস্টী-রূপে দেবেন্দ্রনাথ কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের কার্যভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন এবং ট্রাস্টডীড অনুযায়ী উপাসনা-কার্য সম্পাদনের জন্য দ্বিজেন্দ্রনাথকে সম্পাদক নিযুক্ত করে তাঁর হাতে সমস্ত ট্রাস্ট-সম্পত্তি অর্পণ করেন ও তাঁকে সাহায্য করার জন্য অযোধ্যানাথ পাকড়াশীকে সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত করেন।২০ কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা সমস্ত দায়িত্বভার ত্যাগ করলেন। যদিও এর পর ১১ মাঘ [সোম 23 Jan 1865] পঞ্চত্রিংশ সাংবৎসরিক ব্রাহ্মসমাজে কেশবচন্দ্র যোগ দেন ও বক্তৃতা করেন, তবুও ব্রাহ্মসমাজের এই ভেদরেখা বিলুপ্ত হয়নি, যার পরিণতি ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ নামে স্বতন্ত্র সমাজ প্রতিষ্ঠায়।
এই সব ঘটনা সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য-মণ্ডিত। কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা ব্রাহ্মসমাজে যে প্রচারের উদ্দীপনা এনেছিলেন, বাংলা ও ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করে যে ব্যাপক ধর্মান্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন, তাঁদের হারিয়ে কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ—যা পরবর্তীকালে আদি ব্রাহ্মসমাজ নামে আখ্যাত হয়েছে—একটি সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও ক্ষিতীন্দ্রনাথ নানা সময়ে তার মধ্যে প্রাণসঞ্চারের চেষ্টা করেছেন—কিন্তু নিয়মিত উপাসনা, মাঘোৎসব ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশ ছাড়া কোনো উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর এই সমাজ আর রাখতে পারেনি। অপরপক্ষে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ও পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ তাঁদের সমাজসংস্কারমূলক অত্যুৎসাহী কার্যকলাপের ফলে ধীরে ধীরে বৃহত্তর হিন্দুসমাজের মধ্যে প্রথমে প্রবল বিরোধিতা ও পরে এক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উদ্ভব ঘটিয়েছে, যার ফলে অন্তর ধর্মের দিক থেকে রামমোহন-দেবেন্দ্রনাথের জীবনব্যাপী সাধনা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গ আমরা পরেও মাঝে মাঝেই উত্থাপন করব।
এই বৎসর ২০ আশ্বিন [বুধ 5 Oct] সকাল দশটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত প্রবল ঝড় হয়, যার ফলে কলকাতা ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বহু ঘরবাড়ি ভয়ংকারভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই কারণে পরবর্তীকালে এই বৎসরকে অনেকেই ‘আশ্বিনের ঝড়ের বছর’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই ঝড়ে চিৎপুর রোডে অবস্থিত ব্রাহ্মসমাজের ত্রিতল বাড়িটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় কার্তিক মাস থেকে বুধবারের সাপ্তাহিক সায়ংকালীন উপাসনা সাময়িকভাবে দেবেন্দ্রনাথের গৃহে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এই ঘটনাটিও উপরোক্ত মনোমালিন্যে বেশ-কিছু পরিমাণ ইন্ধন যোগায়।
১০ আষাঢ় [সোম 27 Jun] দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘ব্রহ্মদীক্ষা’ বা ‘ধর্মদীক্ষা’ দেন। এই অনুষ্ঠানটি তাঁর ক্ষেত্রেই প্রথম প্রবর্তিত হল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘আমার উপনয়ন প্রচলিত প্রথা-অনুসারেই হইয়াছিল। আমার দীক্ষা ব্রাহ্মধর্ম্মের অনুষ্ঠান-পদ্ধতি অনুসারে সম্পন্ন হয়। আমার বোধ হয়, অনুষ্ঠান-পদ্ধতি অনুসারে ইহাই প্রথম অনুষ্ঠান।’২১ ব্রাহ্মসমাজে শ্রেণী-বর্ণ-নির্বিশেষ দেবেন্দ্রনাথ এই প্রথা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এইরূপ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানকে প্রণালী-বদ্ধ করবার চেষ্টা বহুদিন ধরেই করা হচ্ছিল। এইবার সেইগুলিকে একত্রিত করে ‘অনুষ্ঠান পদ্ধতিঃ’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।*
দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয়া কন্যা সুকুমারী দেবীর একমাত্র সন্তান অশোকনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয় জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময়ে [May 1864]। সম্ভবত প্রসব-জনিত পীড়ায় দু-এক দিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়।† তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও পুত্রের জাতকর্ম অনুষ্ঠান-পদ্ধতি অনুসারে নিষ্পন্ন হয়।
বোলপুর-শান্তিনিকেতনে গৃহ-নির্মাণের কিছু কিছু সংবাদ এই বৎসরের ক্যাশবহি-তে পাওয়া যায়। ৯ বৈশাখ [বুধ 21 Apr] বোলপুরের হিসাবে ‘চুন ও বরগা ও রং খরিদ’ বাবদ ১৩৮ টাকা ৮ আনা ৩ পাই এবং ১ অগ্র [মঙ্গল 15 Nov] ‘শান্তিনিকেতন খাতে’ জনৈক রফিমদ্দী মিস্ত্রীকে ‘শান্তিনিকেতনের গাথনির হিসাব সোদ’ করা হয় ১৬ টাকা ৫ আনায়। অনুমান করা যায়, এই সব খরচ বর্তমান শান্তিনিকেতন-গৃহকে কেন্দ্র করেই। হেমেন্দ্রনাথ কয়েকবার বোলপুর যাতায়াত করছেন এমন হিসাবও আমরা ক্যাশবহি-তে দেখতে পাই।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই বৎসর কেশবচন্দ্র-প্রতিষ্ঠিত ‘কলিকাতা কলেজ’ [পরবর্তী নাম ‘অ্যালবার্ট কলেজ’] থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে এফ. এ. পড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। লক্ষণীয়, তাঁর চেয়ে চার বছরের বড়ো দাদা বীরেন্দ্রনাথ তখনও স্কুলের ছাত্র, তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন 1866-এ। হেমেন্দ্রনাথকে এই সময়ে জনৈক এল. এ. ডিকোরোজা [ডিক্রুজ?] সাহেবের কাছে ফরাসি ভাষা শিক্ষা করতে দেখা যায়। এই শিক্ষা আরও কয়েক বৎসর চলেছিল।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ এই বৎসর [Mar 1865] প্রকাশিত হয়।
কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্মতারিখ : আশুতোষ মুখোপাধ্যায়—১২ আষাঢ় [বুধ 29 Jun], রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী—৫ ভাদ্র -[শনি 20 Aug]; কামিনী রায় [সেন]—২৭ আশ্বিন [বুধ 12 Oct]।
উল্লেখপঞ্জি
১ রবীন্দ্র-কথা। ১৬৩
২ দ্র ঐ। ১৬৪
৩ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি। ২৫-২৬
৪ বালক, ভাদ্র ১২৯২। ২২৬-৩০; শিশু ৯। ৯০-৯৪
৫ জীবনস্মৃতি ১৭। ২৬৫
৬ ছেলেবেলা ২৬। ৬১১
৭ প্রথম প্রকাশ : Apr 1955 [বৈশাখ ১২৬২]
৮ জীবনস্মৃতি ১৭। ২৬৫
৯ ছেলেবেলা ২৬। ৬১১
১০ ‘শিশুবোধক, শিশুশিক্ষা ও বর্ণপরিচয়’ : বিদ্যাসাগর স্মারক-গ্রন্থ [১৩৮১]। ১৩
১১ ঐ। ৩৮
১২ জীবনস্মৃতি ১৭। ২৬৬
১৩ দ্র জীবনস্মৃতি [১৩৭৫]। ২৮৫, ‘গ্রন্থপরিচয়’
১৪ গোপালচন্দ্র রায় : রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন [১৩৯৩]। ৩৪
১৫ দ্র The Hindoo Patriot, Vol. XI, No. 46, p. 362
১৫ পুরাতনী। ৫৮
১৭ প্রদীপ, ভাদ্র ১৩০৬। ৩১৮
১৮ ‘বীরপূজা’ : যোগেন্দ্র গ্রন্থাবলী ২ [২য় সং, বসুমতী]। ২২৪
১৯ ঐ। ২২৫
২০ দ্র ‘বিজ্ঞাপন’ : তত্ত্ব, পৌষ। ১৪৮
২১ ‘পিতৃদেব সম্বন্ধে আমার জীবনস্মৃতি’ : প্রবাসী, মাঘ ১৩১৮। ৩৮৯
* ‘212 Sishu Sikha, pt. 1 by Madan Mahan [Tarkalankar], 1st ed. 1849. pp. 28, 10 ed. 1855, S. P. [Sanskrit Press], pp. 27, 1 an. A good elementary work, containing spelling to 3 syllables, simple reading lessons—the author was a Professor in the Sanskrit College.’
* ‘Shisubodhok, CHILD’S INSTRUCTOR, 1854, pp. 81, 2as. 18 mo.’ —Long’s ‘A Descriptive Catalogue…’ ‘Catalogue of Bengali Books for Schools. Vernacular Medical Classes, Normal Schools, &c.’ [1875] গ্রন্থে শিশুবোধক-এর প্রণেতা হিসেবে ‘The late Subhankar Das Pandit’-এর নাম করা হয়েছে। ১৩০৫ সালের একটি সংস্করণের আখ্যাপত্রটি এইরূপ : ‘শিশুবোধক,/অর্থাৎ/বালক শিক্ষার্থ।/বর্ণমালা, বানান, ফলা, পত্র, আর্য্যা, নামতা,/ অঙ্ক, অঙ্করীতি, গঙ্গার বন্দনা,/ গুরুদক্ষিণা, দাতাকর্ণ, কলঙ্কভঞ্জন, চাণক্য-/ শ্লোক এবং প্রহ্লাদচরিত্র প্রভৃতি। প্রতিমূৰ্ত্তি সহিত।’ ৯৬ পৃষ্ঠার এই বইটির চিত্রগুলি কাঠ-খোদাই—‘শ্রীহীরালালকর্মকারের কৃত/সাং বটতলা’ [অন্যান্য সংস্করণেও এই চিত্রগুলিই ব্যবহৃত হয়েছে]।
* বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয়’-এর বিভিন্ন সংস্করণে প্রচুর পাঠ-পরিবর্তন করতেন, এই যুক্তিতে গোপালচন্দ্র রায় আমাদের অনুমানের বিরোধিতা করে লিখেছেন : ‘রবীন্দ্রনাথ যে বার বার বলেছেন—তিনি বর্ণপরিচয় ১ম ভাগে জল পড়ে, পাতা নড়ে, পড়েছিলেন, সে সম্বন্ধে ১৮৬৪। ৬৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত বর্ণপরিচয় ১ম ভাগে এর বিপরীত কিছু না দেখা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের কথাকে কোন মতেই অস্বীকার করা যায় না।’ [রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন। ২০]। আমরা দায়িত্বটি গোপালবাবুকেই সমর্পণ করছি। এরূপ কোনো পাঠ তিনি দেখাতে পারলে আমরা ভুল স্বীকার করে নেব।
* তথ্যগুলি বিদ্যাসাগর কলেজ শতবর্ষ স্মরণিকা গ্রন্থ [1975]-এর অন্তর্ভুক্ত সুরেশপ্রসাদ নিয়োগী লিখিত ‘মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউসনের ইতিহাস : আদিপর্ব’ প্রবন্ধ থেকে সংগৃহীত।
* ‘অনুষ্ঠান পদ্ধতিঃ /জাতকৰ্ম্মনামকরণোপনয়নদীক্ষা-/বিবাহান্ত্যেষ্টিশ্রাদ্ধেতি-/ সপ্তবিধসংস্কারাত্মিকা/ এই পুস্তক প্রস্তুত হইয়াছে, মূল্য ॥০ আট আনা’—‘বিজ্ঞাপন’, তত্ত্ব, ফাল্গুন ১৭৮৬ শক। ১৮৪
† ক্যাশবহি-তে ১৫ জ্যৈষ্ঠ [শুক্র 27 May] তারিখের হিসাবে দেখা যায়—‘শ্রীমতী : শুকুমারি শুন্দরির/নবকুমার হওয়ার সংবাদ/ দেওয়া লোকের বকশীষ/১০৲’ এবং ‘শ্রীমতী শুকুমারি শুন্দরির পিড়া হয়ায় ডা° বেলি…ফিচ ১৬’। লক্ষণীয়, সুকুমারী দেবীর স্বামী দেবেন্দ্রনাথের অন্যান্য জামাতাদের মতো ঘরজামাই ছিলেন না, এবং তাঁর সন্তানও জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ভূমিষ্ঠ হয়নি।