১২. রবীন্দ্রজীবনের দ্বাদশ বৎসর

দ্বাদশ অধ্যায়
১২৭৯ [1872-73] ১৭৯৪ শক ॥ রবীন্দ্রজীবনের দ্বাদশ বৎসর

১২৭৯ বঙ্গাব্দ তথা 1872 খ্রিস্টাব্দ বাংলাদেশের পক্ষে এক উল্লেখযোগ্য বৎসর। বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন মাসিক পত্রিকার প্রকাশ এবং জাতীয় নাট্যশালা বা ন্যাশানাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা বাঙালি জাতি ও বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক নূতন উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল, যা পরবর্তীকালে নানাভাবে ফলপ্রসূ হয়েছে। রবীন্দ্রজীবনের ক্ষেত্রেও বৎসরটি নানা কারণে উল্লেখযোগ্য।

আমরা পূর্ব বৎসরের বিবরণেই দেখেছি কিভাবে রবীন্দ্রনাথের নর্মাল স্কুলে ‘বাংলা শিক্ষার অবসান’ হয়ে বেঙ্গল অ্যাকাডেমি-পর্বের সূচনা হল। Mar 1872-তে তিনি, সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ এই স্কুলে ভর্তি হন। ডিক্‌রূজ [DeCruz] সাহেব ছিলেন স্কুলের অধ্যক্ষ। মাসে মাসে বেতন মিটিয়ে দেবার সদ্‌গুণ থাকায় তিনি এই ছাত্রদের পাঠচর্চার গুরুতর ত্রুটিকেও ক্ষমার্হ মনে করতেন। নর্মাল স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে এখানকার স্কুলের সহপাঠীদের পার্থক্য রবীন্দ্রনাথ সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিয়েছেন: ‘এখানকার ছেলেরা ছিল দুর্বৃত্ত কিন্তু ঘৃণ্য ছিল না, সেইটে অনুভব করিয়া খুব আরাম পাইয়াছিলাম।’ এরাও নানারকম উৎপীড়ন করত, কিন্তু ‘এ-সকল উৎপীড়ন গায়েই লাগে, মনে ছাপ দেয় না—এ সমস্তই উৎপাতমাত্র, অপমান নহে। তাই আমার মনে হইল, এ যেন পাঁকের থেকে উঠিয়া পাথরে পা দিলাম—তাহাতে পা কাটিয়া যায় সেও ভালো, কিন্তু মলিনতা হইতে রক্ষা পাওয়া গেল।’

ফিরিঙ্গি স্কুলে ভর্তি হওয়ার দরুন পোশাক-পরিচ্ছদ বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল, সেকথা আমরা আগেই বলেছি। এই সব কারণে তাঁর মনে হয়েছে, তাঁরা যেন অনেকখানি বড় হয়েছেন, অন্তত স্বাধীনতার প্রথম তলাটাতে উঠেছেন। কিন্তু এই স্কুলে যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে, সে ঐ স্বাধীনতালাভের দিকেই। ‘সেখানে কী-যে পড়িতেছি তাহা কিছুই বুঝিতাম না, পড়াশুনা করিবার কোনো চেষ্টাই করিতাম না,—না করিলেও বিশেষ কেহ লক্ষ্য করিত না।’ ‘ল্যাটিন শেখার ক্লাসে আমি ছিলুম বোবা আর কালা, সকলরকম এক্‌সেসাইজের খাতাই ছিল বিধবার থান কাপড়ের মতো আগাগোড়াই সাদা।’ ফলে এই স্কুলে পড়ার সময়টা একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে।

অবশ্য বেঙ্গল অ্যাকাডেমিতে অবস্থানের কালটা নানাভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। কলকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপে প্রথমবার পড়াশুনোয় ছেদ পড়ে, দ্বিতীয়বার উপনয়নের পর হিমালয় যাত্রার ফলে।

ডেঙ্গুজ্বর এই বৎসর কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বিভীষিকার মতো দেখা দিয়েছিল। ন্যাশানাল পেপার এ-সম্পর্কে লিখেছে: ‘The Dengu is now in violent rage in Calcutta, sparing neither age, sex, nor rank. The fever is rife in European quarter too. In the Native quarter there is not one single householder we believe within whose threshold the Dengu has not made its appearance and made one or more of the inmates thereof victims of the disease. The disease is terrible indeed.’ [Vol. VIII, No. 19, May 8, 1872] প্রচণ্ড জ্বর, গায়ে ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ-যুক্ত এই ব্যাধি মাত্র তিন-চার দিনে রোগীকে এমন দুর্বল করে দেয় যে তার পরেও বেশ কিছুদিন তাকে প্রায় পঙ্গুজীবন যাপন করতে হয়, সমসাময়িক পত্রিকার বিবরণে রোগটিকে এইভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। সোমপ্রকাশ পত্রিকার কর্মচারীরা ডেঙ্গুজ্বরে পীড়িত হওয়ায় কয়েকটি সংখ্যা হ্রস্ব-আকারে প্রকাশিত হয়। ন্যাশানাল পেপার লেখে, এই ব্যাধির প্রকোপে বহু স্কুল-কলেজে ছাত্র ও শিক্ষকের উপস্থিতি এত কমে যায় যে প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছুটি ঘোষণা করে দিতে হয়।

1872-73-র Bengal Administration Report-এ লেখা হয়েছে: ‘The very peculiar fever or disease known as dengu commenced to attract notice in Calcutta towards the end of 1871 and was rife in 1872. It prevailed during the cold weather and increased rapidly as the hot weather advanced. It continued to rage epidemically during the hot weather and rains, and few escaped its attack. …The epidemic subsided towards the close of the rains.’ (pp. 405-06] বস্তুত ন্যাশানাল পেপার-এ এই সম্পর্কে প্রথম সংবাদ দেখা যায় পূর্ববর্তী বৎসরের 19 Jul সংখ্যায়, যেখানে বলা হয়েছে প্রায় ৫০০ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে, অর্থাৎ ১২৭৮ বঙ্গাব্দের আষাঢ়-শ্রাবণ মাস থেকেই এই ব্যাধির প্রকোপ দেখা গিয়েছে।

১২৭৯-র গ্রীষ্মে যখন এই রোগের সংক্রমণ সর্বব্যাপী হতে শুরু করেছে, তখন কলকাতার সম্পন্ন পরিবারগুলির অনেকেই কিছু দূরে গঙ্গাতীরবর্তী বাগানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘একবার কলিকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের তাড়ায় আমাদের বৃহৎ পরিবারের কিয়দংশ পেনেটিতে ছাতুবাবুদের বাগানে আশ্রয় লইল। আমার তাহার মধ্যে ছিলাম।’ এইটিই রবীন্দ্রনাথের প্রথম ‘বাহিরে যাত্রা’—বাংলাদেশের পল্লীপ্রকৃতির সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়। রবীন্দ্রনাথের মানস-বিবর্তনে বহিঃপ্রকৃতি নানাভাবে ক্রিয়া করেছে। কিন্তু জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির গণ্ডিবদ্ধ জীবনযাত্রায় প্রকৃতির দাক্ষিণ্য নানাভাবেই সংকুচিত ছিল, তা আমরা আগেই দেখেছি। ডেঙ্গুজ্বরের কল্যাণে সেই প্রকৃতি তার অবারিত সৌন্দর্য নিয়ে রবীন্দ্রজীবনে প্রথম আবির্ভূত হল, পেনেটি বা পানিহাটিতে অবস্থানের মূল্য এইজন্য সর্বাধিক।

গোড়াতেই কয়েকটি সমস্যার সমাধান করে নেওয়া দরকার। জীবনস্মৃতি-তে রবীন্দ্রনাথ যে বাগানকে ‘ছাতুবাবুর [আশুতোষ দেব] বাগান’ বলে উল্লেখ করেছেন, পরবর্তীকালে এক প্রবন্ধে তাকেই অভিহিত করেছেন ‘লালাবাবুদের বাগান’ বলে। সরলা দেবী চৌধুরানী লিখেছেন, ‘গঙ্গাধারের সে বাগানবাড়ি তখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই সম্পত্তি।’

দ্বিতীয় সমস্যা, ঠাকুর পরিবার কতদিন পেনেটির বাগানবাড়িতে বসবাস করেছিলেন। সরলা দেবী লিখেছেন: ‘ছমাস বয়সে খুব ঘটা করে আমার অন্নপ্রাশন হল পেনেটির (পানিহাটির) বাগান বাড়িতে’, তাঁর বর্ণনা থেকে মনে হয়, সেই সময় রবীন্দ্রনাথ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সরলা দেবীর জন্ম হয় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ২৫ ভাদ্র [সোম 9 Sep 1872] তারিখে। সুতরাং তাঁর হিসাব অনুযায়ী [ভারতীয় হিসাব-পদ্ধতিতে জন্মমাসকেও এক মাস ধরা হয়] অন্নপ্রাশন হয় মাঘ মাসে। এই মাসেই রবীন্দ্রনাথদের উপনয়ন হয়। তার আয়োজন অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। তাছাড়া আগের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বর্ষার শেষাশেষি কলকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ অনেক কমে আসে। সুতরাং মাঘ মাস পর্যন্ত ঠাকুরপরিবার পেনেটিতে বসবাস করেছিলেন, এ সিদ্ধান্ত খুব যুক্তিসংগত নয়। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ-প্রমুখ ছাত্রদের স্কুলে যাওয়ার প্রশ্নটিও আছে।

এই সমস্যাগুলির সমাধান করা যায় ক্যাশবহি-র হিসাবের পরিপ্রেক্ষিতে। ২১ আষাঢ় [বৃহ 4 Jul]-এর হিসাবে দেখা যায়—‘বঃ শ্রীমতী উপেন্দ্র মোহিনী দাসী/দ° পাণিহাটী বাগানের গত জ্যৈষ্ঠ মাহার ভাড়া শোধ/বিঃ এক বিল গুঃ প্রাণকৃষ্ণ মল্লিক/৬০০ ন° বাঙ্গাল বেঙ্কের এক চেক—১২৫৲’; আবার ২৬ আষাঢ় [মঙ্গল 9 Jul] উক্ত উপেন্দ্রমোহিনী দাসীকে ‘পাণিহাটীর বাগানের/আষাঢ় মাহার ১৮ রোজের ভাড়া শোধ’ করা হয়েছে ৭৫ টাকায়। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরু থেকে ১৮ আষাঢ় [সোম 1 Jul] পর্যন্ত পানিহাটির বাগানটি মাসিক ১২৫ টাকায় ‘ভাড়া’ নেওয়া হয়েছিল, সেটি ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পত্তি’ ছিল না। কিন্তু বাগানটির মালিক তো দেখা যাচ্ছে জনৈকা উপেন্দ্রমোহিনী দাসী, তাকে ‘ছাতুবাবুর বাগান’ বা ‘লালাবাবুর বাগান’ বলে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন কেন? এমন হতে পারে বাগানটি আগে আশুতোষ দেবেরই [ছাতুবাবু] সম্পত্তি ছিল [বস্তুত পানিহাটিতে আশুতোষ দেবের একটি বাগান ছিল, সেখানেই মাঘ ১২৬২-তে তাঁর মৃত্যু হয়], পরে তা হস্তান্তরিত হয়ে যায়। কিন্তু এই সম্ভাবনার তুলনায় ‘লালাবাবুর বাগান’ উল্লেখটির পিছনে আরও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আমরা সরবরাহ করতে পারি। ঠাকুরপরিবারের সঙ্গে পানিহাটির এই বাগানের যোগ যে কেবল এখনই ঘটেছে তা নয়। ১২৭৫ বঙ্গাব্দের ৭ মাঘ [মঙ্গল 19 Jan 1869]-এর হিসাবেই দেখা যায়—‘ব° উপেন্দ্রমোহিনী দাসী/দ° সেজবাবু মহাশয় দিগরের/পাণিহাটী বাগানে বেড়াইতে/যাওয়ায় উক্ত বাগানের পৌষ মাহার ভাড়া শোধ/বিঃ এক বিল/গুঃ লালচাঁদ মল্লিক…১২৫৲’ —পৌষ মাসেই হেমেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সারদাপ্রসাদ, যদুনাথ, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী প্রভৃতি এই বাগানে গিয়ে থাকেন, এমন-কি ঐ মাসে হিমালয় থেকে ফিরে দেবেন্দ্রনাথও বোটে করে গিয়ে সেখানে কয়েকদিন কাটিয়ে আসেন। মাঘ মাসে সৌদামিনী দেবী ও স্বর্ণকুমারী দেবীও এখানে বেশ কিছুদিন কাটান। এই সময়ে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত বাগানটি ভাড়া নেওয়া হয়। ক্যাশবহি-তে দেখা যায়, তিন মাসের ভাড়াই উক্ত ‘লালচাঁদ মল্লিক’ মারফৎ শোধ করা হয়েছে। আবার ২৯ চৈত্র ১২৭৮ [বুধ 10 Apr 1872] ‘লালাবাবুর বাটী হইতে কর্ণ বেধ উপলক্ষে/সওগাদ’ এলে এক টাকা বকশিশ দেওয়া হয়। এই লালচাঁদ মল্লিক-ই সম্ভবত ‘লালাবাবু’ বলে এখানে ও রবীন্দ্রনাথের উক্তিতে উল্লিখিত হয়েছেন। ইতিহাস-প্রসিদ্ধ ‘লালাবাবু’ বা পাইকপাড়া রাজবংশের কৃষ্ণচন্দ্র সিংহের সঙ্গে বর্তমান লালাবাবুর কোনো যোগ নেই বলেই মনে হয়।

যাই হোক, উপরোক্ত হিসাব থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই বছরের জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে ১৮ আষাঢ় পর্যন্ত পানিহাটির বাগানবাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল। ১ জ্যৈষ্ঠ [সোম 13 May] ‘বাটীর মধ্যে ডেঙ্গু জ্বর হওয়ায় নগদ বরফ খরিদ’ ও ‘ঠাকুরী বেহারা/ বাবু মহাশয়রা পাণিহাটী বাগানে থাকা উপলক্ষে/ঠিকা বেহারা বাটীতে কাজ করে উহার বেতন ই° ২ জ্যৈষ্ঠ না° ২০ আষাঢ় শোধ’ এবং ‘১৭ রোজ/বাবুমশায়রা ও ঠাকুরাণীরা/পাণিহাটী বাগান হইতে আসিবার জন্য/গাড়ি পাঠান যায়’—এই সব হিসাব বিশ্লেষণ করলে সিদ্ধান্ত করা যায়, রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ির ‘বৃহৎ পরিবারের কিয়দংশ’ ডেঙ্গু জ্বর থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য ২ জ্যৈষ্ঠ [মঙ্গল 14 May] থেকে ১৭ আষাঢ় [রবি 30 Jun] পর্যন্ত পানিহাটি বা পেনেটির বাগানবাড়িতে কাটান। হিসাবের খাতা থেকে আমরা জানতে পারি হেমেন্দ্রনাথ, শরৎকুমারী দেবী প্রভৃতিরা এই সময়টা রিষড়ার একটি বাগানে ছিলেন; সুতরাং দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অভিভাবকত্বেই পরিবারের অপর অংশটি পানিহাটিতে অবস্থান করেন, স্বচ্ছন্দে এমন সিদ্ধান্ত করা চলে। অবশ্য কোনো কোনো ভগ্নীপতিও সপরিবারে সেখানে ছিলেন এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘এই প্রথম বাহিরে গেলাম। গঙ্গার তীরভূমি যেন কোন্‌ পূর্বজন্মের পরিচয়ে আমাকে কোলে করিয়া লইল।’ নদীর প্রতি যে আকর্ষণ রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবন ব্যাপ্ত করে আছে, এখানেই তার সূত্রপাত। চাকরদের ঘরের সামনে গুটিকতক পেয়ারাগাছ, তারই ছায়ায় ঘেরা বারান্দায় বসে গঙ্গার ধারার দিকে চেয়ে তাঁর সমস্ত দিন কাটত। ‘প্রত্যহ প্রভাতে ঘুম হইতে উঠিবামাত্র আমার কেমন মনে হইত, যেন দিনটাকে একখানি সোনালিপাড়-দেওয়া নূতন চিঠির মতো পাইলাম। লেফাফা খুলিয়া ফেলিলে যেন কী অপূর্ব খবর পাওয়া যাইবে।’ পাছে সেই দৃষ্টিভোগের উৎসবে একটি পদ বাদ পড়ে যায় সেই আশঙ্কায় মুখ ধুয়েই বাইরে এসে চৌকি নিয়ে বসতেন। সেখান থেকে অতৃপ্ত নয়নে দেখতেন গঙ্গার জোয়ারভাঁটা, নানারকম নৌকার আসাযাওয়া, অপরপারে কোন্নগরে ‘শ্রেণীবদ্ধ বনান্ধকারের উপর বিদীর্ণবক্ষ সূর্যাস্তকালের অজস্র স্বর্ণশোণিতপ্লাবন’। কোনো-কোনো দিন সকাল থেকে মেঘ করে আসে, সশব্দ বৃষ্টির ধারায় দিগন্ত ঝাপসা হয়ে যায়, বালকের মনের আনন্দ ভিজে হাওয়ারই মতো প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে যা-খুশি তাই করে বেড়ায়। তিনি লিখেছেন: ‘কড়ি-বরগা-দেয়ালের জঠরের মধ্য হইতে বাহিরের জগতে যেন নূতন জন্মলাভ করিলাম। সকল জিনিসকেই আর-একবার নূতন করিয়া জানিতে গিয়া, পৃথিবীর উপর হইতে অভ্যাসের তুচ্ছতার আবরণ একেবারে ঘুচিয়া গেল।’

বাড়ির এক অংশে বড়ো বড়ো ফলগাছের ছায়ায় ঘেরা ঘাটবাঁধানো একটি খিড়কির পুকুরও তাঁর মনকে মুগ্ধ করত। সামনের গঙ্গার উদার প্রবাহের তুলনায় তাকে ঘরের বধূর মতো লজ্জাশীলা অন্তরালপ্রিয় মনে হত। তবু অনেক মধ্যাহ্নে পুকুরের ঘাটে জামরুলতলায় একলা বসে জলের গভীরে যক্ষপুরীর ভয়ের রাজ্য কল্পনা করে শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত।

জন্মাবধি কলকাতার ইঁট-কাঠের বন্ধনে বাস করে এবং কিছুটা হয়তো গল্পে-উপন্যাসে গ্রামজীবনের সহজ-সরল জীবনযাত্রার কথা পড়ে বাংলাদেশের পাড়াগাঁটাকে ভালো করে দেখবার জন্যে তাঁর মনে ঔৎসুক্য জমা হয়েছিল। বাগানের পিছনেই সেই পাড়াগাঁ—কিন্তু সেখানে যাওয়া নিষেধ। একদিন কৌতূহলের তাড়নায় দুই অভিভাবকের পিছু পিছু তাঁদের অগোচরে কিছুদূর গিয়েছিলেন। ‘গ্রামের গলিতে ঘনবনের ছায়ায় শেওড়ার-বেড়া-দেওয়া পানাপুকুরের ধার দিয়া চলিতে চলিতে বড় আনন্দে এই ছবি মনের মধ্যে আঁকিয়া আঁকিয়া লইতেছিলাম।’ কিন্তু অভিভাবকেরা তাঁর এই আগমন টের পেতেই অগ্রগমন স্তব্ধ হয়ে গেল। ভদ্ৰ-আচ্ছাদনের অভাব তাঁদের চক্ষে পীড়াদায়ক ঠেকেছিল: ‘পায়ে আমার মোজা নাই, গায়ে একখানি জামার উপর অন্য-কোনো ভদ্র আচ্ছাদন নাই—ইহাকে তাঁহারা আমার অপরাধ বলিয়া গণ্য করিলেন। কিন্তু মোজা এবং পোশাকপরিচ্ছদের কোনো উপসর্গ আমার ছিলই না, সুতরাং কেবল সেইদিনই যে হতাশ হইয়া আমাকে ফিরিতে হইল তাহা নহে, ত্রুটি সংশোধন করিয়া ভবিষ্যতে আর-একদিন বাহির হইবার উপায়ও রহিল না।’ রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলি অবশ্য আমাদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, কারণ তাঁদের জন্য মোজা ও অন্যান্য পোশাক-পরিচ্ছদের কী ধরনের আয়োজন ছিল তা আমরা পূর্বেই দেখেছি। সুতরাং মনে হয় ব্যাপারটি ছিল অন্যরকম। সম্ভবত অভিভাবকদের পল্লীর দিকে বেড়াতে যেতে দেখেই অতি আগ্রহ-বশত ঘরে-পরার সাধারণ যে পোশাক তাঁর গায়ে ছিল তাই পরেই বালক রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অনুসরণ করেছিলেন। অভিভাবকদের আভিজাত্যবোধ সেইজন্যই পীড়িত হয়েছিল এবং এই ত্রুটির ফলে আর-কোনোদিন বাইরে যাওয়ার সাহসই রবীন্দ্রনাথের হয়নি। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক সম্পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ কলকাতার বাইরে গিয়েও তিনি লাভ করেননি, তাই লিখেছেন: ‘কলকাতায় ছিলেম ঢাকা খাঁচার পাখি, কেবল চলার স্বাধীনতা নয় চোখের স্বাধীনতাও ছিল সংকীর্ণ; এখানে রইলুম দাঁড়ের পাখি, আকাশ খোলা চারি দিকে কিন্তু পায়ে শিকল।’১০ কিন্তু এই খোলা আকাশের স্বাধীনতা তিনি মনপ্রাণ দিয়ে উপভোগ করে নিয়েছেন। পিছনে বাধা ছিল বটে, কিন্তু সম্মুখের গঙ্গা সমস্ত বন্ধন হরণ করে নিয়েছিল। পালতোলা নৌকোয় তাঁর মন বিনা ভাড়ায় সওয়ারি হয়ে এমন সব দেশে যাত্রা করত, ভূগোলে যার পরিচয় পাওয়া যায় না।

ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ কমলে তাঁরা আবার জোড়াসাঁকোয় ফিরে আসেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘আমার দিনগুলি নর্মাল স্কুলের হাঁ-করা মুখবিবরের মধ্যে তাহার প্রাত্যহিক বরাদ্দ গ্রাসপিণ্ডের মতো প্রবেশ করিতে লাগিল।’১১ কিন্তু আমরা জানি, হাঁ-করা মুখবিবরটি বেঙ্গল অ্যাকাডেমির, নর্মাল স্কুল-পর্ব এর অনেক আগেই তিনি সমাপ্ত করে এসেছেন।

পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ আর-একবার পেনেটির বাগানে এসেছিলেন, তার কৌতূহলোদ্দীপক বর্ণনা পাওয়া যায় রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের অপ্রকাশিত একটি রচনায়। জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসেছিলেন 22 May 1919 [৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬] তারিখে, ভ্রমণটি হয় তারই কয়েকদিন পরে। প্রশান্তচন্দ্র লিখেছেন:

…একটা বড়ো চেয়ারে হেলান দিয়ে মাঝে মাঝে ছেলেবেলার কথা বলেন। পেনেটির বাগানের গল্প। গঙ্গার ধারে সেই বাড়ি। পুকুর ঘাট। বল্‌লেন আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারো? সেখানে গিয়ে কিছুদিন থাকি। আমি খোঁজ করে জানলুম, যে, সে বাগান-বাড়ি বনোয়ারি [লাল চৌধুরী] বাবুর এক সরিকদের হাতে। বনোয়ারিবাবু উৎসাহ করে ব্যবস্থা করিয়ে দিলেন। বাড়ির মালিকরা বলে পাঠালেন, কবির যতোদিন ইচ্ছা ওখানে গিয়ে যেন থাকেন। একদিন গিয়ে দেখে আসবেন। যদি ভালো লাগে বেশিদিন থাকবার মতো ব্যবস্থা করা হবে।

…দু একদিনের মধ্যে বিকালে কবিকে পেনেটির বাগানে নিয়ে গেলুম। কবির সঙ্গে শুধু আমি একা। বাড়ির মালিকদের বলে দেওয়া হয়েছিল, যে, কবি একা যেতে চান। মালিদের খবর দেওয়া হয়েছিল। তারা দরজা খুলে দিলে। দোতলা বাড়ি। এখন বাগান বেশি কিছু নেই। কতকগুলি পুরানো গাছ। কবি একবার চারদিক দেখলেন। গঙ্গার ধারে গিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়ালেন। সেখান থেকে পুকুরের দিকটা গেলেন—এখনো একটা পুরানো গাছ দাঁড়িয়ে আছে। তারপরে দোতলায়। এঘর ওঘর একটু দেখলেন। …নীচে নেমে এসে আরেকবার পুকুরের দিকটা দেখলেন। তার পরে আমাকে বললেন এবার চলো। কিছু নেই। সেই পেনেটির বাগানে আর ফেরা যায় না। যোড়াসাঁকোয় ফিরে এলুম।

পানিহাটির বাগানে যাওয়ার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের ‘বাহিরে যাত্রা’ বিশেষ কারণে শুরু হলেও, সেখানেই শেষ হয়নি। আমরা আগেই বলেছি, ঠাকুর পরিবারের আর-একটি অংশ ডেঙ্গুজ্বরের আশঙ্কায় রিষড়ার বাগানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ না করলেও, ক্যাশবহি আমাদের জানিয়ে দেয় এই বাগানের সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগও তিনি লাভ করেছিলেন। ৪ ভাদ্র [19 Aug]-এর হিসাবে জমা খাতে দেখা যায়: ‘ছেলেবাবুদিগের রিসড়া গমন জন্য/দশ টাকা ছোট বাবু [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ] লইয়া যান/তাহা ফেরত’; আর ঐদিনের খরচ খাতে ‘সোমেন্দ্রবাবু ও রবীন্দ্রবাবুদিগরের/রিসড়ার বাগানে জাতাতের ব্যয়’ আট টাকা দশ আনা লেখা হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় শ্রাবণের শেষে কিংবা ভাদ্রের প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সোমেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথকে রিষড়ার বাগান দেখাতে নিয়ে যান। এখানে তাঁদের অবস্থান-কাল দীর্ঘ ছিল না, সেই কারণে স্মৃতিকথায় এই ভ্রমণের কথা স্থান পায়নি।

বেঙ্গল অ্যাকাডেমি-তে ভর্তি হওয়া প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছেন, ‘ইহাতে আমাদের গৌরব কিছু বাড়িল। মনে হইল, আমরা অনেকখানি বড়ো হইয়াছি,’ তা যে-কারণেই তিনি লিখুন-না কেন, বাস্তব অর্থে তা অত্যন্ত সত্য। তিনি গত বৎসর বেহালা ব্রাহ্মসমাজের অষ্টাদশ সাংবৎসরিকে যোগদান করেছিলেন, এ বৎসরও ৩০ কার্তিক [বৃহ 14 Nov] উক্ত সমাজের ঊনবিংশ সাংবৎসরিক অনুষ্ঠানে অন্যান্য বালকদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। এই মাসে স্বর্ণকুমারী দেবীর পুত্র জ্যোৎস্নানাথ, বর্ণকুমারী দেবীর পূত্র সরোজনাথ ও হেমেন্দ্রনাথের কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরীর অন্নপ্রাশন হয়। এই উপলক্ষে ১৮ কার্তিক [শনি 2 Nov] ‘সোম রবী সত্যপ্রসাদবাবু দিগের/ধুতি তিনখানা ও উড়ানী তিনখানা/(দালানে অন্নপ্রাসন সময় পরিয়া যান) ৬ খানার মূল্য শোধ’ করা হয় অর্থাৎ এই তিন জনের মুখে প্রথম অন্ন তুলে দেওয়ার দায়িত্ব তাঁরাই পালন করেন। ৮ পৌষ [শনি 21 Dec] ‘সোম রবী সত্যপ্রসাদ বাবু দিগের/বড় দিনে খাবার জন্য উইলসন হোটেলের [বর্তমান গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল] মিঠাই’ ক্রয় করা হয়। এই রীতিটি এ বৎসরই প্রবর্তিত হয়, পরবর্তী বৎসরগুলিতেও তা অব্যাহত থাকে। ২১ পৌষ [শুক্র 3 Jan 1873] ‘ফেনসি ফেয়ার’ দেখতে যান; এই সময়ে তাঁরা থিয়েটার দেখতেও যান—২৬ পৌষ [বুধ ৪ Jan] ‘ছেলেবাবুরা থিএটর দেখিতে জান…/উহার দিগের টিকিটের মূল্য/ছোটবাবু মহাশয়ের আদেশমতে নবিনবাবুকে [নবীনচন্দ্র চক্রবর্তী—সেরেস্তার একজন কর্মচারী] দেওয়া যায়’। পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আর কোনো অভিযোগ করার সুযোগই রাখা হয়নি—আষাঢ় মাসের ‘১৪ রোজের [বৃহ 27 Jun] খরচ/দ° সোমেন্দ্র রবীন্দ্র ও সত্যপ্রসাদবাবু দিগের/চাপকান তৈয়ারি ১৪টা হিঃ ৪২টা তৈয়ারির ব্যয়…৫৩৸°’, ২৮ অগ্র [বৃহ 12 Dec] ‘রবীন্দ্রবাবুর তুলো ভরা বনাতের চাপকান একটী/তৈয়ারির ব্যয়…১৩।৵৬’; ৩ পৌষ ‘সোম রবী বাবু দিগের চাপকান পেনটুলেন/চোগা তৈয়ারীর জন্য বনাত ক্রয়’ ও এই কারণেই ‘চামরূ দরজি’কে ৬ পৌষ ও ২ মাঘ ‘কার কেলিকো ঘুণ্টি প্রভৃতি সরঞ্জম ক্রয়’ ও মজুরি হিসেবে ব্যয় শোধ করা হয়; বিনামা বা জুতো কেনার কথা তোলাই বাহুল্য, এত জুতো যে কোন্ কাজে লাগত তা ভেবেই পাওয়া যায় না।

পানিহাটির ‘বাহিরে যাত্রা’ পর্ব শেষ করে এলে বেঙ্গল অ্যাকাডেমির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আসল পরিচয়। তার আগে মার্চ থেকে মে এই তিন মাস মাত্র তিনি সেখানে গিয়েছিলেন, আবার জুলাই মাস থেকে বিদ্যালয় পর্ব শুরু হয় [আশ্চর্য লাগে, ফিরে আসবার পর ‘এপ্রিল মে দুই মাসের ফি শোধ’ করা হয়েছে, কিন্তু জুন মাসের বেতন—পরে হিমালয়-প্রবাসের তিন মাসের বেতনও—দেওয়া হয়নি। স্কুলেও কি তখন ঠিকা প্রথা চালু ছিল, ছাত্রেরা স্কুলে গেলে বেতন দেওয়া হবে—নতুবা নয়?]। স্কুলে তাঁকে ল্যাটিন পড়তে হত, একথা আমরা তাঁর লেখা থেকেই জেনেছি; কিন্তু আর কী ছিল পাঠ্যতালিকায় সে-কথা রবীন্দ্রনাথও বলেননি, আমরাও জানতে পারিনি। অবশ্য যা-ই পড়ানো হোক-না কেন, বালকেরা যে তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না, সেকথা রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করেই বলেছেন। নীলকমল ঘোষালের কাছে বাংলা শিক্ষার অবসান হওয়ার পর অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়-ই তখন তাঁদের একমাত্র গৃহশিক্ষক—সুতরাং না-পড়ার স্বাধীনতা যে অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শিক্ষার আয়োজন অবশ্য পুরো মাত্রাতেই ছিল—‘সোম ও রবীবাবুদিগের ইস্কুলে পুস্তক লইয়া যাইবার জন্য টীনের বাক্স’ ক্রয় করা হয়েছে, ‘সোম রবী সত্যপ্রসাদ বাবুদিগর ইস্কুলে একটি গরিবকে’ তিন টাকা দান করেন, এমন-কি বিদ্যালয়ের নভেম্বর মাসের বেতনের সঙ্গে ‘গান শিখিবার দরূণ বেশী ১৲ হিঃ ৩৲’ টাকাও খরচ করা হয়—কিন্তু আসল কাজ খুব একটা এগোয়নি। কারণ, যদিও এই স্কুলে উৎপাত কিছুই ছিল না, তবু ‘ইহার ঘরগুলা নির্মম, ইহার দেয়ালগুলা পাহারওয়ালার মতো—ইহার মধ্যে বাড়ির ভাব কিছুই নাই, ইহা খোপওয়ালা একটা বড় বাক্স। কোথাও কোনো সজ্জা নাই, ছবি নাই, রঙ নাই, ছেলেদের হৃদয়কে আকর্ষণ করিবার লেশমাত্র চেষ্টা নাই। …সেইজন্য বিদ্যালয়ের দেউড়ি পার হইয়া তাহার সংকীর্ণ আঙিনার মধ্যে পা দিবামাত্র তৎক্ষণাৎ সমস্ত মন বিমর্ষ হইয়া যাইত’১২। তাই নর্মাল স্কুলের তুলনায় এখানে স্বাধীনতার মাত্রা অনেক বেশি হলেও স্কুল-পালানোর অদম্য আকাঙক্ষা তাঁকে প্রায়ই চঞ্চল করে তুলত। এ-ব্যাপারে সাহায্য করার লোকের অভাবও ছিল না। তাঁর দাদারা একজনের কাছে ফারসি শিখতেন—সবাই তাঁকে মুনশি বলে ডাকত।* অস্থিচর্মসার এই মানুষটির ধারণা ছিল লাঠিখেলায় ও সংগীতবিদ্যায় তাঁর অসামান্য পারদর্শিতা। উঠানে রৌদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি অদ্ভুত ভঙ্গিতে লাঠি খেলতেন—নিজের ছায়াই ছিল তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী। আর তাঁর ‘নাকী বেসুরের গান প্রেতলোকের রাগিণীর মতো’ শোনাত, যা শুনে গায়ক বিষ্ণু তাঁর রুজি বন্ধ হবার আশঙ্কা প্রকাশ করতেন। এই মুনশিই ছুটির প্রয়োজন জানিয়ে স্কুলের অধ্যক্ষের কাছে ইংরেজিতে চিঠি লিখে দিতেন, অধ্যক্ষও তার সত্যতা নিয়ে কোনো বিচারবিতর্ক করতেন না।

এই স্কুলের দুটি সহপাঠীর কথা রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে লিখে গেছেন। জাত বাঁচাবার জন্য বাঙালি ছাত্রদের জন্য যে স্বতন্ত্র জলখাবারের ঘর ছিল, সেখানে তাঁদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো দুই-একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ‘তাহাদের মধ্যে একজন কাফি রাগিণীটা খুব ভালোবাসিত এবং তাহার চেয়ে ভালোবাসিত শ্বশুরবাড়ির কোনো একটি বিশেষ ব্যক্তিকে—সেই জন্য সে ওই রাগিণীটা প্রায়ই আলাপ করিত এবং তাহার অন্য আলাপটারও বিরাম ছিল না।’১৩

অপর ছাত্রটির সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তাঁর নাম হরিশ্চন্দ্র হালদার (হ. চ. হ,)—এঁর সঙ্গে যোগাযোগ স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছিল ও বহুদিন অক্ষুণ্ণ ছিল। ছাত্রটি ম্যাজিক সম্বন্ধে একটি ক্ষুদ্র পুস্তক মুদ্রিত করে নিজেকে প্রোফেসর উপাধি দিয়ে প্রচার করেছিলেন। এই কারণেই বালক রবীন্দ্রনাথের তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জন্মেছিল। এই বন্ধুটিকে তাঁরা রোজই গাড়িতে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন ও সেই উপলক্ষে সর্বদাই ঠাকুরবাড়িতে তাঁর যাওয়া-আসা শুরু হয়েছিল। নাটক-অভিনয়েও তিনি যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। তাঁর সাহায্যে কুস্তির আখড়ায় বাখারি পুঁতে তাতে কাগজ মেরে নানা রঙের ছবি এঁকে স্টেজ বানিয়ে অভিনয়ের আয়োজনও হয়েছিল। অবশ্য গুরুজনদের হস্তক্ষেপে সে অভিনয় হতে পারেনি।*

এই সময়ে বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে রবীন্দ্রনাথের সংগীত-শিক্ষাও অব্যাহত আছে। বাঁধা-ধরা শিক্ষার ব্যাপারে অসহিষ্ণু হলেও সুকণ্ঠের অধিকারী এই বালক তাঁর সংগীতে এমনকি পিতা দেবেন্দ্রনাথকেও মুগ্ধ করেছিলেন এবং সেজন্য তিনি সংগীতগুরু বিষ্ণুকে পুরস্কৃতও করেন। এই তথ্যটি আমরা পাই ক্যাশবহি-র ১৮ আশ্বিন [বৃহ 3 Oct] তারিখের একটি হিসাব থেকে—‘ব° বিষ্ণুচরণ [চন্দ্র] চক্রবর্তী/দ° কর্ত্তামহাশয় রবীবাবুর গান শ্রবণে/উক্ত গাহককে পারিতোষিক দেন বিঃ ১ বৌ°/গুঃ—৫৲’।

এই বৎসরের আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা রবীন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদের উপনয়ন। আমরা আগেই দেখেছি, দেবেন্দ্রনাথ হিন্দুধর্মের পৌত্তলিক অংশের তীব্র বিরোধী হলেও তার মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তনে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যের প্রতীক পৈতা ও উপনয়ন-সংস্কার নিয়ে তাঁর মন বরাবরই দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। ৮ মাঘ ১৭৭৫ শক [১২৬০: Jan 1854] রাজনারায়ণ বসুকে এক পত্রে তিনি লেখেন, ‘আমার মতে ব্রাহ্মদিগের উপনয়ন স্বধৰ্ম্মসম্মত নহে। অতএব অবশ্য তাহা পরিত্যাগ করিতে হইবে।’১৪ 1861-এ কেশবচন্দ্র-প্রণীত ‘ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান’ গ্রন্থ পাঠ করে তিনি উপবীত পরিত্যাগ করেন। তিনি ব্রাহ্মদের জন্য যে ‘অনুষ্ঠান-পদ্ধতি’ প্রণয়ন করেন [১৭৮৬ শক: 1865], তাতে ‘উপনয়ন’ বলে একটি ক্রিয়া থাকলেও, ‘তাহা কেবল কোনো উপদেষ্টার কাছে কোনো বালককে আনিয়া তাঁহার উপর তাহার ধর্মশিক্ষার ভার দেওয়া’।১৫ কিন্তু বর্তমানে তিনি বৈদিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্রাহ্মণসন্তানের উপযোগী অপৌত্তলিক উপনয়ন-পদ্ধতি রচনায় উদ্যোগী হলেন। অজিতকুমার চক্রবর্তী এর পিছনে রাজনারায়ণ বসু-প্রদত্ত বক্তৃতা ‘হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা’-র [৩১ ভাদ্র রবি 15 Sep 1872 তারিখে জাতীয় সভায় দেওয়া এই ভাষণে দেবেন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেছিলেন] কিছু প্রভাব থাকতে পারে এমন ইঙ্গিত করেছেন।১৫ আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশের সহায়তায় বৈদিক মন্ত্র নির্বাচন করে উপনয়ন-পদ্ধতি দেবেন্দ্রনাথ স্বয়ং রচনা করলেন। বেচারাম চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যহ বালকেরা উপনিষদের মন্ত্রগুলি বিশুদ্ধ রীতিতে বারবার আবৃত্তি করে আয়ত্ত করতে লাগলেন। এইভাবেই উপনয়নের আয়োজন চলতে লাগল।

এরই মধ্যে ১১ মাঘ [বৃহ 23 Jan 1873] আদি ব্রাহ্মসমাজের ত্রিচত্বারিংশ সাংবৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এবার প্রাতঃকালীন ও সায়ংকালীন উভয় অনুষ্ঠানেই রবীন্দ্রনাথ সংগীত-কার্যে যোগ দিয়েছিলেন বলে মনে হয়। প্রাতঃকালীন অনুষ্ঠানের বিবরণে দেখি:

অর্চ্চনান্তে আচার্য্য মহাশয়েরা বেদীতে উপবেশন করিলে পর বালক বালিকারা সঙ্গীত মঞ্চে উপবেশন করিয়া মনোহর তানলয় সমন্বিত সুমধুর স্বরে এই নূতন ব্রহ্মসঙ্গীতটি গান করিলেন।

রাগিণী আসা—তাল ঠুংরি। /জগৎ পিতা তুমি বিশ্ববিধাতা। [বিষ্ণুরাম চট্টোপাধ্যায়-রচিত]১৬

এই অনুষ্ঠানে শম্ভুনাথ গড়গড়ি ও বেচারাম চট্টোপাধ্যায় বক্তৃতা করেন।

সায়ংকালীন অধিবেশনের বিবরণে দেখা যায়:

সায়ংকাল উপস্থিত হইলে নারিকেল ও দেবদারু পত্রে ও কদলী বৃক্ষে সুসজ্জিত, স্তম্ভাদি দ্বারা অলঙ্কৃত ভবনময় দীপালোকে আলোকিত হইল এবং পূষ্পমালায় সুসজ্জিত উপাসনার স্থল সাধকগণের মন হরণ করিতে লাগিল। এত লোকের সমাগম হইল যে উর্দ্ধাধঃ কোন স্থানে আর প্রবেশ করিবার পথ থাকিল না। রাত্রি সাত ঘটিকার সময় প্রথমত ঘণ্টা পরে শংখ বাদ্য হইল। তৎপরে সঙ্গীত মঞ্চ হইতে হৃদয় প্রফুল্লকর সমবেত বাদ্য বাজিবা মাত্র জনতা পূর্ণ প্রাঙ্গণ নিস্তব্ধ হইল এবং সুধাবর্ষী বালক বালিকারা মধুর স্বরে যে দুইটী সঙ্গীত গান করিলেন,—

রাগিণী খাম্বাজ—তাল কাওয়ালি। শঙ্কর শিব সঙ্কট হারি। [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ]

রাগিণী বেহাগ—তাল ঝাঁপতাল। জয় জগজীবন জগত পাতা হে। [বিষ্ণুরাম চট্টোপাধ্যায়]১৭

এই অনুষ্ঠানে রাজনারায়ণ বসু বক্তৃতা করেন।

মাঘোৎসবের পক্ষকাল পরে ২৫ মাঘ বৃহস্পতিবার 6 Feb 1873 তারিখে সোমেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদের উপনয়ন-সংস্কার হয়।*আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ আচার্যের কার্য করেন। যঞ্জোপবীত ধারণ ও গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বিল্বদণ্ড ধারণ করে যথাক্রমে মাতা, মাতৃবন্ধু স্ত্রীগণ, পিতা ও অন্যদের নিকট ভিক্ষা করে ভিক্ষালব্ধ দ্রব্য আচার্যকে দান করেন। ‘পরে ব্রহ্মচারী সন্ধ্যা পর্যন্ত বাগ্‌যত হইয়া অবস্থান করিলেন এবং সন্ধ্যাকালে গায়ত্রী জপ করিয়া পরে হবিষ্যান্ন ভোজন করিলেন।’

এর পরে নির্জনবাসের তিন দিন অবশ্য গুরুগৃহে উপনীত ঋষিবালকদের মতো কঠোর সংযমে কাটেনি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:

‘মাথা মুড়াইয়া, বীরবৌলি *পরিয়া, আমরা তিন বটু তেতালার ঘরে তিন দিনের জন্য আবদ্ধ হইলাম। সে আমাদের ভারী মজা লাগিল। পরস্পরের কানের কুণ্ডল ধরিয়া আমরা টানাটানি বাধাইয়া দিলাম। একটা বাঁয়া ঘরের কোণে পড়িয়াছিল—বারান্দায় দাঁড়াইয়া যখন দেখিতাম নিচের তলা দিয়া কোনো চাকর চলিয়া যাইতেছে ধপাধপ্‌ শব্দে আওয়াজ করিতে থাকিতাম—তাহারা উপরে মুখ তুলিয়াই আমাদিগকে দেখিতে পাইয়া, তৎক্ষণাৎ মাথা নিচু করিয়া অপরাধ-আশঙ্কায় ছুটিয়া পলাইয়া যাইত।’১৮

ছেলেবেলা-য় এই কদিনের সম্পর্কে আর একটু খবর পাওয়া যায়: ‘মনে পড়ে পইতের সময় বৌঠাকরুণ [কাদম্বরী দেবী] আমাদের দুই ভাইয়ের হবিষ্যান্ন রেঁধে দিতেন, তাতে পড়ত গাওয়া ঘি। ঐ তিনদিন তার স্বাদে, তার গন্ধে, মুগ্ধ করে রেখেছিল লোভীদের।’*

২৮ মাঘ রবি 9 Feb 1873*সমাবর্তন অনুষ্ঠান হল। ‘উপনয়নের পর বেদাধ্যয়ন করিয়া তৃতীয় দিবসে…আচার্য শ্রীযুক্ত আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ সমাবর্তিত করিলেন।’ পরে বেদী থেকে প্রধান আচার্য দেবেন্দ্রনাথ উপদেশ প্রদান করেন। এই উপদেশে তিনি গায়ত্রীমন্ত্রের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন ও বলেন, ‘গায়ত্রী দ্বারা চিরজীবন প্রাতঃকালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মুখ প্রক্ষালন করিয়া শুচি হইয়া ঈশ্বরকে মনন করিবে, তাঁহার জ্ঞান শক্তি ধ্যান করিবে—তবে কালে তোমারদের আত্মা প্রস্ফুটিত হইয়া তাহা হইতে যে সুগন্ধ প্রবাহিত হইবে, তাহা দেবতাদিগেরও স্পৃহনীয় হইবে।’১৯ রবীন্দ্রনাথের জীবনব্যাপী সাধনায় গায়ত্রীর এই ব্যাখ্যা ও পিতার উপদেশ ধ্রুবতারা-স্বরূপ ছিল।

উপদেশের পর ব্রহ্মচারীগণ আচার্যকে অভিবাদন করেন। এই অভিবাদনের মধ্যে এমন কতকগুলি মন্ত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যেগুলি রবীন্দ্রনাথের পরবর্তীজীবনের ধর্মোপদেশসমূহে ও নানা রচনায় বহুল ব্যবহৃত হয়েছে;

(১) ওঁ পিতা নোহসি। পিতা নো বোধি। নমস্তেহস্তু। মা মা হিংসীঃ। [শুক্ল যজুর্বেদ]

(২) ওঁ বিশ্বানি দেব সবিতুর্দুরিতানি পরাসুব। যদ্ভদ্রং তন্ন আসুব। [ঋগ্‌বেদ]

(৩) ওঁ নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায় চ নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ। [শুক্ল যজুর্বেদ]

(৪) ওঁ য একোহবর্ণো বহুধা শক্তিমোদাদ্‌বর্ণানেকান্‌ নিহিতার্থ দধাতি। বিচৈতি চান্তে বিশ্বমাদো সদেবঃ সনোবুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনক্তু।* [শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্)

উপনয়ন-পর্ব শেষ হলে ‘নূতন ব্রাহ্মণ হওয়ার পরে গায়ত্ৰীমন্ত্রটা জপ করার দিকে খুব-একটা ঝোঁক পড়িল। আমি বিশেষ যত্নে একমনে ওই মন্ত্র জপ করিবার চেষ্টা করিতাম। মন্ত্রটা এমন নহে যে সে-বয়সে উহার তাৎপর্য আমি ঠিকভাবে গ্রহণ করিতে পারি। আমার বেশ মনে আছে, আমি ‘ভূর্ভুবঃ স্বঃ’ এই অংশকে অবলম্বন করিয়া মনটাকে খুব করিয়া প্রসারিত করিতে চেষ্টা করিতাম।’২০ এই সম্পর্কে তিনি আরও লিখেছেন: ‘আমার একদিনের কথা মনে পড়ে—আমাদের পড়িবার ঘরে শানবাঁধানো মেঝের এক কোণে বসিয়া গায়ত্রী জপ করিতে করিতে সহসা আমার দুই চোখ ভরিয়া কেবলই জল পড়িতে লাগিল। জল কেন পড়িতেছে তাহা আমি নিজে কিছুমাত্র বুঝিতে পারিলাম না। …আসল কথা, অন্তরের অন্তঃপুরে যে-কাজ চলিতেছে বুদ্ধির ক্ষেত্রে সকল সময়ে তাহার খবর আসিয়া পৌঁছায় না।’২১

কিন্তু আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে যাই ঘটুক-না কেন, বাস্তব ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিল পৈতে উপলক্ষে মুড়োনো ন্যাড়া মাথা নিয়ে বেঙ্গল অ্যাকাডেমির ফিরিঙ্গি ছাত্রদের সম্মুখীন হওয়া যাবে কি করে। এমন সময়ে তেতলায় পিতার ঘরে ডাক পড়ল। তিনি জানতে চাইলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে হিমালয় যেতে চান কিনা। বালকের মনের ভাব সহজেই অনুমেয়—‘“চাই” এই কথাটা যদি চীৎকার করিয়া আকাশ ফাটাইয়া বলিতে পারিতাম, তবে মনের ভাবের উপযুক্ত উত্তর হইত।’২২

কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, দেবেন্দ্রনাথ-ই বা কেন এই বালককে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন। গঙ্গাবক্ষে নৌকা-ভ্রমণের সময় তিনি কখনো কখনো পুত্রদের বা বন্ধুস্থানীয়দের তাঁর সহচর করে নিয়েছেন, কিন্তু হিমালয়-ভ্রমণে তাঁর নির্জন বাসের সময় অনুচর কিশোরী চাটুজ্জে ও গুটিকয়েক ভৃত্য ছাড়া আর কাউকেই ইতিপূর্বে তিনি সঙ্গী করেননি। ন্যাড়া মাথায় বিদ্যালয়ে যাওয়ার সমস্যা বালক রবীন্দ্রনাথের কাছে যতই গুরুতর হোক-না কেন, প্রবীণ দেবেন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই এই পথে সেই সমস্যা সমাধান করতে চাননি, যখন অনুরূপ সমস্যা সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদের ক্ষেত্রেও দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই ছিল। আসলে তিনি তাঁর এই বিদ্যালয়-বিমুখ আত্মমগ্ন ভাবুক কনিষ্ঠ পুত্রটির মধ্যে এমন কোনো বিশিষ্ট লক্ষণ দেখেছিলেন, যা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল—সাংগীতিক প্রতিভার সমাদর কিভাবে করেছিলেন সেকথা তো আগেই উল্লিখিত হয়েছে। সংসারের বাইরে-বাইরে কাটালেও পারিবারিক খুঁটিনাটি ব্যাপার তাঁর দৃষ্টি এড়াতে পারত না। হয়তো বালকের গায়ত্রী-জপের আগ্রহও তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। সেইজন্যই নিজের ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে রেখে পুত্রের ব্যক্তিত্বের যথাযথ উন্মেষ ঘটানোর আকাঙক্ষাই তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণ হতে পারে। লক্ষণীয়, তিনি পুত্রের কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে তিনি তাঁর সঙ্গে হিমালয়ে যেতে চান কিনা, কেবল যাওয়ার নির্দেশ ঘোষণা করেননি।

যাই হোক, এই ঘটনাটি ঘটেছিল ২৯ মাঘ [সোম 10 Feb] থেকে ২ ফাল্গুন [বুধ 12 Feb]—এই তিন দিনের মধ্যে। কারণ ২৮ মাঘ সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয় ও ৩ ফাল্গুনেই রবীন্দ্রনাথের জন্য যাত্রার আয়োজন শুরু হয়ে যায়। ঐ-দিনের হিসাবে কয়েকবারই রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ দেখা যায়: ‘রবীন্দ্রবাবুর জন্য পুস্তক ক্রয়/গুঃ বাবু সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়/২৫৸৴৬, গুঃ যদুনাথ চট্টোপাধ্যায়/পিটর পার্লি পুস্তক ২ খানা ক্রয়/৩ ॥০’ এবং ‘রবীন্দ্রবাবুর জন্য/পোর্ট মেন্ট একটা ক্রয়…১৪৲’; আবার ৪ ফাল্গুনের হিসাবে দেখা যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘রবীবাবুর জন্য পুস্তক ক্রয় নিমিত্তে’ ৪০ টাকা নিয়ে গিয়ে ১৯ ॥০ খরচ করে বাকি টাকা ফেরত দিয়েছেন। এই দিন তাঁর জন্য সাড়ে আট টাকা দিয়ে এক ডজন গরম মোজাও কেনা হয়েছে। বই তাঁর জন্য আরও কেনা হয়েছে: ৯ ফাল্গুন ‘রবীবাবুর পুস্তক ইত্যাদি ক্রয় ২৫৲’, ১০ ফাল্গুন ‘রবিন্দ্রবাবুর জন্য ছোট বাবু মহাশয় যে সমস্ত পুস্তক ক্রয় করিয়া আনা [আনেন তাহার] মূল্য সোধ…৩৬ ॥০’ [হিসাবগুলি পরে লিখিত হলেও সম্ভবত বোলপুর-যাত্রার পূর্বেই ব্যয়িত হয়েছে]। পরেও হয়তো তাঁরই জন্য Johnson’s Pocket Dictionary [১৫ চৈত্র], ‘ভারতবর্ষের পুরাবৃত্ত’ ও Lethbridge-এর লেখা History of India [২১ বৈশাখ ১২৮০] কিনে যথাক্রমে অমৃতসর ও বক্রোটায় প্রেরিত হয়েছে। এই সব হিসাব থেকে মনে হয় বিদ্যালয়বিমুখ পুত্রকে নিজস্ব পদ্ধতিতে পড়িয়ে পাঠানুরাগী করে তোলার সংকল্প দেবেন্দ্রনাথের মনে ছিল।

৪ ফাল্গুন [শুক্র 14 Feb] দুপুরের দিকে* তাঁরা কলকাতা ত্যাগ করেন। যাত্রার পূর্বে দেবেন্দ্রনাথ যথারীতি বাড়ির সকলকে নিয়ে দালানে উপাসনা করেন। উপাসনার পর রবীন্দ্রনাথ গুরুজনদের প্রণাম করে পিতার সঙ্গে গাড়িতে উঠলেন। [রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার বয়সে এই প্রথম আমার জন্য পোশাক তৈরি হইয়াছে। কী রঙের কিরূপ কাপড় হইবে তাহা পিতা স্বয়ং আদেশ করিয়া দিয়াছিলেন।’২৩ এই কথা যথার্থ ধরে নিলে একটি গুরুতর সমস্যা উপস্থিত হয়। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের জন্য কোনো ‘পোশাক’ তৈরির হিসাব দেখা যায় না—‘এক ডজন গরম মোজা’ ও ‘সালের গলাবন্দ একটা’ কেনা ছাড়া। ‘বনাতের মোগলাই চাপকান পেনটুলেন ও জোব্বা’ তৈরির জন্য ৫৯ টাকা সওয়া দু’আনা সত্যই খরচ করা হয়েছে, কিন্তু ৩ পৌষ এই ব্যয়ের শুরু ও ২ মাঘ তার সমাপ্তি, অর্থাৎ হিমালয়-যাত্রার প্রায় দু’মাস আগে এই ‘পোশাক’ তৈরি করা আরম্ভ হয়েছে এবং তা করা হয়েছে সোমেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ দু’জনের জন্য। এরই কাপড় ও রঙ যদি দেবেন্দ্রনাথ পছন্দ করে থাকেন, তাহলে বলতে হয় পুত্র-সহ হিমালয়-যাত্রার পরিকল্পনা তিনি বহু পূর্বেই গ্রহণ করেছিলেন এবং দুটি পুত্রকেই তিনি সঙ্গী করতে চেয়েছিলেন।] মাথায় পরার জন্য একটি ‘জরির-কাজ-করা গোল মখমলের টুপি’ কেনা হয়েছিল। ন্যাড়া মাথায় টুপি পরা নিয়ে বালকের মনে মনে আপত্তি ছিল। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের কাছে পরিচ্ছন্নতা ও ভব্যতার ব্যত্যয় হবার উপায় ছিল না, তাঁর নির্দেশে মাথায় টুপি পরতেই হল। মাঝে মাঝে সুযোগ বুঝে টুপি খুললেই পিতার সতর্ক দৃষ্টির শাসনে সেটিকে আবার যথাস্থানে তুলতে হত। ‘তরুশ্রেণীর সবুজ নীল পাড়-দেওয়া বিস্তীর্ণ মাঠ এবং ছায়াচ্ছন্ন গ্রামগুলি’কে ঝরনার বেগে ছুটিয়ে সন্ধ্যার সময় গাড়ি বোলপুর পৌঁছল। পালকিতে চড়ে বালক চোখ বন্ধ করে রইলেন। তাঁর ইচ্ছা সকালবেলায় বোলপুরের সমস্ত বিস্ময় একসঙ্গে তাঁর জাগ্রত দৃষ্টির সম্মুখে খুলে যাক—সন্ধ্যার অস্পষ্টতার মধ্যে যদি তার কিছু কিছু আভাস পাওয়া যায়, তবে পরদিনের অখণ্ড আনন্দের রসভঙ্গ হবে। ৪ ফাল্গন ১২৭৯ তারিখটি স্মরণযোগ্য—রবীন্দ্রজীবনের শেষ চল্লিশ বছর যে বোলপুর-শান্তিনিকেতনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, সেখানে এইদিনে তাঁর প্রথম পদার্পণ।

মাঠে ধান কি রকম দেখতে হয়, শহরের ছেলে রবীন্দ্রনাথের সে-সম্পর্কে কোনোরকম অভিজ্ঞতা ছিল না। সেইজন্য তা দেখার জন্য তাঁর কৌতূহল ছিল। ভোরে উঠে বাইরে এসে দেখলেন চারদিকেই মাঠ, কোথাও ধানের চিহ্ন নেই। কিন্তু ‘যাহা দেখিলাম না তাহার খেদ মিটিতে বিলম্ব হইল না—যাহা দেখিলাম তাহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট হইল। …প্রান্তরলক্ষ্মী দিক্‌চক্রবালে একটিমাত্র নীল রেখার গণ্ডি আঁকিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাতে আমার অবাধসঞ্চরণের কোনো ব্যাঘাত করিত না।’২৪ সেকালের বোলপুর-শান্তিনিকেতনকে তিনি কোন্ রূপে দেখেছিলেন তার চিত্র এঁকেছেন অনেক পরে লেখা একটি প্রবন্ধে: ‘বোলপুর শহর তখন স্ফীত হয়ে ওঠেনি। চালের কলের ধোঁয়া আকাশকে কলুষিত আর তার দুর্গন্ধ সমল করে নি মলয় বাতাসকে। মাঠের মাঝখান দিয়ে যে লাল মাটির পথ চলে গেছে তাতে লোকচলাচল ছিল অল্পই। বাঁধের জল ছিল পরিপূর্ণ প্রসারিত, চার দিক থেকে পলি-পড়া চাষের জমি তাকে কোণ-ঠেসা করে আনে নি। তার পশ্চিমের উঁচু পাড়ির উপর অক্ষুণ্ণ ছিল ঘন তালগাছের শ্রেণী। যাকে আমরা খোয়াই বলি, অর্থাৎ কাঁকুরে জমির মধ্যে দিয়ে বর্ষার জলধারায় আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু খোদাই পথ, সে ছিল নানা জাতের নানা আকৃতির পাথরে পরিকীর্ণ’।২৫ রবীন্দ্রনাথ সমস্ত দুপুরবেলা এই খোয়াইয়ে প্রবেশ করে নানারকম পাথর সংগ্রহ করে এনে পিতাকে দেখাতেন। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে নিরুৎসাহিত না করে একটি পুকুর খোঁড়বার ব্যর্থ চেষ্টার২৬ ফলে যে মাটির ঢিবি তৈরি হয়েছিল, এই পাথর দিয়ে সেটিকে সাজিয়ে দিতে বলেন। তিনি রোজ প্রভাতে পূর্বাস্য হয়ে এখানেই চৌকি নিয়ে উপাসনায় বসতেন।

খোয়াইয়ের এক জায়গায় মাটি চুঁইয়ে একটি গভীর গর্তের মধ্যে জল জমা হত। তার মধ্যে খুব ছোটো ছোটো মাছ ঘুরে বেড়াত। জামাকাপড় খুলে তার মধ্যে ডুব দিয়ে স্নান করা বালকের পক্ষে খুব আনন্দদায়ক ছিল। তিনি পিতাকে গিয়ে বললেন, এইখান থেকে স্নান ও পানের জল আনলে ভালো হয়। ক্ষুদ্র আবিষ্কর্তাকে পুরস্কৃত করার জন্য দেবেন্দ্রনাথ সেখান থেকেই জল আনার বন্দোবস্ত করলেন।

দায়িত্বজ্ঞান-সৃষ্টির জন্য পুত্রকে তিনি তাঁর দামি সোনার ঘড়িটিতে দম দেবার ভার দিয়েছিলেন এবং দু-চার আনা পয়সা দিয়ে হিসাব মেলানোর শর্তে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ভিক্ষুক দেখলে তাকে পয়সা দিতে বলতেন। দায়িত্বজ্ঞানের বাহুল্য-হেতু ঘড়িটি শীঘ্রই সারাবার জন্য কলকাতায় পাঠাতে হল এবং পয়সার জমাখরচ কিছুতেই মিলত না!

অবশ্য অন্য গুরুতর দায়িত্বও তিনি পুত্রকে দিয়েছিলেন। একখানি ভগবদ্‌গীতায় তাঁর পছন্দসই কতকগুলি শ্লোক চিহ্নিত করা ছিল। সেইগুলি বাংলা অনুবাদ-সমেত কপি করার ভার ছিল রবীন্দ্রনাথের উপর। এইভাবেই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অবহেলিত যে বালকটি একধরনের হীনমন্যতায় ভুগতেন, দেবেন্দ্রনাথ এইসব দায়িত্ব দিয়ে সেই ভাব কাটিয়ে উঠতে পুত্রকে অনেকখানি সাহায্য করেছিলেন।

সকালবেলা কিছুক্ষণ পিতার কাছে ইংরেজি ও সংস্কৃত পড়ার পর সারাদিন অবাধ ছুটি। এখানেও জোড়াসাঁকো বাড়ির সঙ্গে অনেক পার্থক্য। সেখানে সকাল হতে রাত্রি পর্যন্ত পড়াশুনোর জাঁতাকল থেকে নিস্তার পাবার কোনো উপায় ছিল না, ফলে নিষ্পেষিত বালকের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠত। এই বৎসরের শুরুতেই পেনেটির বাগানে তিনি এক ধরনের মুক্তি পেয়েছিলেন, কিন্তু পায়ের শিকল কাটেনি। বোলপুরে এসে সেই মুক্তি সম্পূর্ণ হল। তিনি লিখেছেন:

‘শান্তিনিকেতনে এসেই আমার জীবনে প্রথম সম্পূর্ণ ছাড়া পেয়েছি বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে। উপনয়নের পরেই আমি এখানে এসেছি। উপনয়ন-অনুষ্ঠানে ভূর্ভুবঃস্বর্লোকের মধ্যে চেতনাকে পরিব্যাপ্ত করবার যে দীক্ষা পেয়েছিলাম পিতৃদেবের কাছ থেকে, এখানে বিশ্বদেবতার কাছ থেকে পেয়েছিলাম সেই দীক্ষাই। আমার জীবন নিতান্তই অসম্পূর্ণ থাকত প্রথম বয়সে এই সুযোগ যদি আমার না ঘটত।.’২৭

এই পরিবেশে তাঁর কবিত্বশক্তির বিকাশ ঘটল। “ইতিমধ্যে সেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন নীল খাতাটি বিদায় করিয়া একখানা বাঁধানো লেট্‌স্ ডায়ারি* সংগ্রহ করিয়াছিলাম। এখন খাতাপত্র এবং বাহ্য উপকরণের দ্বারা কবিত্বের ইজ্জত রাখিবার দিকে দৃষ্টি পড়িয়াছে। শুধু কবিতা লেখা নহে, নিজের কল্পনার সম্মুখে নিজেকে কবি বলিয়া খাড়া করিবার জন্য একটা চেষ্টা জন্মিয়াছে। এইজন্য বোলপুরে যখন কবিতা লিখিতাম তখন বাগানের প্রান্তে একটি শিশু নারিকেলগাছের তলায় মাটিতে পা ছড়াইয়া বসিয়া খাতা ভরাইতে ভালোবাসিতাম। এটাকে বেশ কবিজনোচিত বলিয়া বোধ হইত। তৃণহীন কঙ্করশয্যায় বসিয়া ‘পৃথ্বিরাজের পরাজয়’ বলিয়া একটা বীররসাত্মক কাব্য লিখিয়াছিলাম।”২৮ ইন্দিরা দেবীকে লিখিত একটি পত্রে তিনি এ-সম্বন্ধে লিখেছেন: ‘সেটা লিখতে দিন সাতেক লেগেছিল।…তার একটা লাই্‌নও মনে নেই। কেবল মনে আছে বড়দাদা সেই কবিতাটা পছন্দ করেছিলেন।’২৯ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অনুমান করেছেন, ‘এই কাহিনীর ক্ষীণ প্রতিধ্বনি বোধ হয় রুদ্রচণ্ড নামক নাটকের মধ্যে শোনা যায়’।৩০

আমরা প্রসঙ্গটিকে একটু বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করতে চাই। এই বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ পেলেন কোথা থেকে? কিছুদিন আগে James Todd-এর Annals and Antiquities of Rajasthan [1829-32] গ্রন্থটির নূতন সংস্করণ ফর্মায় ফর্মায় প্রকাশিত হতে শুরু করে ও কবি সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার ‘রাজস্থানের ইতিবৃত্ত। মিবার’ নামে গ্রন্থটি বিভিন্ন খণ্ডে অনুবাদ করতে থাকেন। আলোচ্য সময়ের আগেই গ্রন্থটির ১ম খণ্ড [26 Aug 1872], ২য় খণ্ড [30 Sep 1872] ও তৃতীয় খণ্ড [5 Feb 1873] প্রকাশিত হয়। মনে করা যেতে পারে, অন্তত প্রথম খণ্ডটি ইতিমধ্যেই রবীন্দ্রনাথের পড়া হয়ে গিয়েছিল। এই গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায় [পৃ ৫৬-৭৮] থেকে তিনি এই কাব্যের কাহিনী সংগ্রহ করে থাকবেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির স্বাদেশিকতার আবহাওয়ায় এবং হিন্দু মেলার হিন্দু জাতীয়তাবোধের আদর্শে পরিবর্ধিত রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে হিন্দু রাজা পৃথ্বীরাজের বীরত্ব উজ্জ্বলভাবে দেখা দেবে এবং তাঁর পরাজয়ে বেদনা অনুভব করবেন এটাই স্বাভাবিক। এ-প্রসঙ্গে আরো স্মরণীয়, তাঁর দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’-এর [15 Dec 1876: ১ পৌষ ১২৮৩] কেন্দ্রীয় ঘটনাও মহম্মদ ঘোরীর হাতে পৃথ্বীরাজের পরাভব কাহিনী। ‘বঙ্গভাষার লেখক’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে, ‘১৮ বৎসর বয়সে ইঁহার প্রথম উপন্যাস দীপনিৰ্ব্বাণ রচিত হইয়া দুই বৎসর পরে সাধারণ্যে প্রকাশিত হয়’৩১ অর্থাৎ 1874-এর মধ্যে রচনাকার্য সমাপ্ত হয়েছিল বলে মনে করা যেতে পারে। সুতরাং Mar 1873-এ লিখিত বালক রবীন্দ্রনাথের বীররসাত্মক কাব্য ‘পৃথ্বিরাজের পরাজয়’ অগ্রজার উপন্যাস-রচনার অনুপ্রেরণা-রূপেও অন্তত কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল, এমন অনুমান করা অযৌক্তিক নয়। আর রুদ্রচণ্ড যদি ‘পৃথ্বিরাজের পরাজয়’ কাব্যের নাট্যরূপান্তর হয়, তাহলে সাদৃশ্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কারণ রুদ্রচণ্ড-এর চাঁদকবি দীপনির্বাণ-এর কবিচন্দ্র-রূপে উপন্যাসে গুরুতর ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। কাব্যটির মূল্য পরিণত-বয়স্ক রবীন্দ্রনাথের কাছেও কিছু কম ছিল না, তার পরিচয় পাওয়া যায় ইন্দিরা দেবীকে লিখিত পূর্বোক্ত পত্রে: ‘সেই Letts’ Diaryটা যদি খুঁজে পাই তা হলে আবার একবার ভোরের বেলায় সেই নারকেল-তলায় বসে সেই ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’টা পড়ে দেখতে ইচ্ছে করে।‘৩২ এই লেট্‌স ডায়ারি রবীন্দ্ররচনার দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি। হিমালয়-ভ্রমণকালে এবং তার পরেও কিছুদিন এইটিই তাঁর কাব্যরচনার বাহন ছিল। আমাদের ধারণা, ‘মালতীপুঁথি’ নামে বিখ্যাত পাণ্ডুলিপিটিতে রচনা আরম্ভের পূর্ব পর্যন্ত [হয়তো বা পরেও] এই বাঁধানো লেট্‌স্‌ ডায়ারি-তে তাঁর রচনা-কার্য সম্পন্ন হয়েছে—হয়তো ‘অভিলাষ’, ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ প্রভৃতি কবিতার প্রাথমিক রূপটি এই পাণ্ডুলিপিতেই লিখিত হয়েছিল।

শান্তিনিকেতনের একজন অধিবাসী বালক রবীন্দ্রনাথের ভীতিমিশ্রিত কৌতূহলের বিষয় ছিল, সে হল বৃদ্ধ দ্বারী সর্দার। এককালে বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মধ্যে দুটি ছাতিমগাছ ছাড়া এখানে আর কোনো গাছ ছিল না। আর ওই গাছতলা ছিল ডাকাতের আড্ডা। অনেক ক্লান্ত পথিক এখানে বিশ্রাম নিতে এসে হয় ধন, নয় প্রাণ, নয় দুই-ই হারিয়েছে। ‘এই সর্দার সেই ডাকাতি-কাহিনীর শেষ পরিচ্ছেদের শেষ পরিশিষ্ট বলেই খ্যাত।’৩৩ অবশ্য রবীন্দ্রনাথ যখন তাকে দেখেছেন, ‘তখন সে বৃদ্ধ, দীর্ঘ তার দেহ, মাংসের বাহুল্য মাত্র নেই, শ্যামবর্ণ, তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি, লম্বা বাঁশের লাঠি হাতে, কণ্ঠস্বরটা ভাঙা ভাঙা গোছের।’৩৩ এই বৃদ্ধ দ্বারী সর্দারের ছেলে হরিশ তখন বাগানের মালি। এরই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একদিন চীপ সাহেবের কুঠি দেখতে যান। সেখানে হরিশের শিকার করা খরগোসের রক্তাক্ত নির্জীব দেহ বালকের মনকে গভীরভাবে পীড়িত করেছিল।

বোলপুরে কিছুদিন থাকার পর সেখান থেকে সাহেবগঞ্জ, দানাপুর, এলাহাবাদ, কানপুর, আলিগড় [এই নামটি মুদ্রিত গ্রন্থে নেই, কিন্তু জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে আছে] প্রভৃতি জায়গায় মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়ে তাঁরা পৌঁছলেন অমৃতসরে। পথের একটি ঘটনা তাঁর কাছে স্মরণীয় হয়ে থেকেছে। একটি বড়ো স্টেশনে গাড়ি থামতে একজন টিকিট পরীক্ষক এসে টিকিট পরীক্ষা করে বালককে ভালো করে দেখে একটু পরে আর একজনকে ডেকে নিয়ে এল। তারা দরজার কাছে কিছুক্ষণ উসখুস করে এবার ডেকে নিয়ে এল বোধহয় স্বয়ং স্টেশন মাস্টারকে। তিনি বালকের হাফ টিকিট পরীক্ষা করে দেবেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করলেন বালকটির বয়স কি বারো বছরের বেশি নয়। দেবেন্দ্রনাথ নেতিবাচক উত্তর করলেন। বস্তুত তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স বারো পূর্ণ হতে অন্তত দু’মাস বাকি ছিল। কিন্তু স্টেশনমাস্টার তাঁর জন্যে পুরো ভাড়া দাবি করলেন। ‘আমার পিতার দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। তিনি বাক্স হইতে তখনই নোট বাহির করিয়া দিলেন। ভাড়ার টাকা বাদ দিয়া অবশিষ্ট টাকা যখন তাহারা ফিরাইয়া দিতে আসিল তিনি সে-টাকা লইয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন, তাহা প্ল্যাটফর্মের পাথরের মেজের উপর ছড়াইয়া পড়িয়া ঝন্‌ঝন্‌ করিয়া বাজিয়া উঠিল।’৩৪ টাকা বাঁচাবার জন্য তিনি মিথ্যা কথা বলছেন এমন সন্দেহের ক্ষুদ্রতা বুঝতে পেরে স্টেশনমাস্টার অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে চলে গেলেন। পিতার সত্যপ্রিয়তা ও অন্তরের তেজ পুত্রকে মুগ্ধ করেছিল বলেই ঘটনাটি তাঁর স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে ছিল।

সম্ভবত ফাল্গুনের শেষে কিংবা চৈত্রের শুরুতে [Mar 1873] তাঁরা অমৃতসরে পৌঁছন। জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘সেখানে সহরের বাহিরে একটা বড় বাগানের মধ্যে আমাদের থাকিবার বাংলা স্থির হইয়াছিল। …পড়ার অবকাশ পাইবামাত্র আমি প্রকাণ্ড সেই বাগানে ঘুরিয়া বেড়াইতাম। ইঁদারার ধারে একটি তুঁত গাছ ছিল তাহা হইতে তুঁতফল পাড়িয়া খাইতাম। আমাদের বাগানের গায়েই প্রতিবেশীর একটি গোলাপ ক্ষেত ছিল। সমস্ত দিন ইঁদারা হইতে চৰ্ম্মপাত্রে বলদের দ্বারা জল তোলাইয়া এই ক্ষেতের নালায় নালায় প্রবাহিত করা হইত। বাগানময় কলশব্দে সেই জলধারার সঞ্চার দেখা আমার একটি প্রধান আমোদ ছিল। দীর্ঘ মধ্যাহ্নে জল তুলিবার সেই আর্ত্তশব্দ ও জল-তোলা লোকটির মাঝে মাঝে সমুচ্চ করুণ সুরে গান এখনো স্বপ্নস্মৃতির মত আমার কানে লাগিয়া আছে।’

আমরা আগেই দেখেছি, বোলপুর যাত্রার পূর্বেই রবীন্দ্রনাথের জন্য অনেক বই কেনা হয়েছিল। বোলপুরে থাকার সময়ে দেবেন্দ্রনাথ সকালে পুত্রকে ইংরেজি ও সংস্কৃত পড়াতেন। সেই শিক্ষাপর্ব অমৃতসরেও অব্যাহত থেকেছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘পিতা আমাকে ইংরেজি পড়াইবেন বলিয়া Peter Parley’s Tales পর্যায়ের অনেকগুলি বই লইয়া গিয়াছিলেন।* তাহার মধ্য হইতে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের জীবনবৃত্তান্ত তিনি আমার পাঠ্যরূপে বাছিয়া লইলেন।’৩৫ লক্ষণীয়, পাদটীকায় যে-বইগুলির নাম দেওয়া হয়েছে, তার কোনোটিতেই ফ্র্যাঙ্কলিনের জীবনী নেই। কিন্তু গ্রন্থগুলির পিছনে এই পর্যায়ের পুস্তকের যে তালিকা দেওয়া আছে তাতে Peter Parley’s Tales about Lives of Washington and Franklin নামে একটি বই আছে। আমাদের ধারণা, এই বইটিই দেবেন্দ্রনাথ পুত্রকে পড়িয়েছিলেন। আমরা পূর্বেই জানিয়েছি, ৩ ফাল্গুন [13 Feb] সাড়ে তিন টাকা দিয়ে ‘পিটর পার্লি পুস্তক ২ খানা ক্রয়’ করা হয়েছিল। একখানি বইয়ের নাম আমরা এখানে জানতে পারলাম, কিন্তু অপর বইটির সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল মেটানোর মতো কোনো ইঙ্গিত রবীন্দ্রনাথ দেননি। উপরে যে পুস্তক-তালিকার কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে Peter Parley’sTales about the Sun, Moon, Stars, and Comets নামের একটি বই আছে। গ্রহতারকা বিষয়ে শিক্ষা দেবার সময় [বিষয়টি নিয়ে আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করব] দেবেন্দ্রনাথ এই বইটি ব্যবহার করেননি তো? যাই হোক, ফ্র্যাঙ্কলিনের জীবনবৃত্তান্ত পাঠ্যরূপে নিবাচিত করার কারণ হয়তো এই ছিল যে, দেবেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন জীবনী অনেকটা গল্পের মতো আকর্ষণীয় লাগবে এবং তাতে পুত্রের উপকারও হবে। কিন্তু পড়াতে গিয়ে তাঁর ভুল ভাঙল। ফ্র্যাঙ্কলিনের ‘হিসাব-করা কেজো ধর্মনীতির সংকীর্ণতা’ তাঁর চিত্তকে পীড়িত করত এবং পড়াতে পড়াতে কোনো কোনো জায়গায় প্রতিবাদ না করে থাকতে পারতেন না।

‘নানা বিদ্যার আয়োজন’ পর্বে রবীন্দ্রনাথকে হেরম্ব তত্ত্বরত্নের অধীনে মুগ্ধবোধের সূত্র আয়ত্ত করানোর চেষ্টা হয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ পূত্রকে বিদ্যাসাগর-প্রণীত ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ [Nov 1851] থেকে শব্দরূপ মুখস্থ করতে দিলেন ও একেবারেই ‘ঋজুপাঠ দ্বিতীয়ভাগ’ [Mar 1852] পড়াতে আরম্ভ করলেন। রবীন্দ্রনাথকে বাংলা এমন করে পড়তে হয়েছিল যে তাতেই সংস্কৃত শিক্ষার কাজ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ শুরু থেকেই পুত্রকে যথাসাধ্য সংস্কৃত রচনা-কার্যে উৎসাহিত করতেন। ‘আমি যাহা পড়িতাম তাহারই শব্দগুলা উলটপালট করিয়া লম্বা লম্বা সমাস গাঁথিয়া যেখানে-সেখানে যথেচ্ছ অনুস্বার যোগ করিয়া দেবভাষাকে অপদেবের যোগ্য করিয়া তুলিতাম। কিন্তু পিতা আমার এই অদ্ভুত দুঃসাহসকে একদিনও উপহাস করেন নাই।’৩৬

দেবেন্দ্রনাথ নিজের পড়ার জন্যে যে বইগুলি সঙ্গে নিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল দশ-বারো খণ্ডে বাঁধানো Edward Gibbon-এর. [1737-94] History of the Decline and Fall of the Roman Empire [1776-88]। এছাড়াও ১৫ চৈত্র [বৃহ 27 Mar] তারিখের হিসাবে দেখি—‘কর্ত্তামহাশয়ের নিকট অমৃতসরে নিম্নলিখিত পুস্তক…পাঠাইবার ব্যয়—হোয়ে হোয়েনস [?], ফিলজাফি ও হিস্টীরি ৫ ও জনসন্স পকেট ডিক্সনারী’। উপায়বিহীন বালক রবীন্দ্রনাথকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও অনেক কিছু পড়তে হত, কিন্তু পিতা স্বেচ্ছায় কেন এই নীরস গ্রন্থপাঠের দুঃখ বরণ করে নিতেন সেটা তাঁর বোধগম্য হত না।

অনেকদিন সকালবেলা রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে পদব্রজে সরোবরের মাঝখানে অবস্থিত অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে যেতেন। সেখানে সর্বদাই ধর্ম-সংগীত গাওয়া ও গ্রন্থসাহেব পাঠ ইত্যাদি চলে। দেবেন্দ্রনাথ সেই শিখ-উপাসকদের মাঝখানে বসে হঠাৎ একসময় সুর করে তাঁদের ভজনায় যোগ দিতেন—বিদেশীর মুখে তাঁদের এই বন্দনাগান শুনে তাঁরা অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে তাঁকে সমাদর জানাতেন।

একবার তিনি গুরুদরবারের একজন গায়ককে বাড়িতে এনে তার মুখে ভজনাগান শুনে তার পক্ষে আশাতিরিক্ত পুরস্কার দান করেছিলেন। ফলে বাড়িতে গায়কদের পথরোধের জন্য বিশেষ বন্দোবস্তের দরকার হল। সকালবেলা দেবেন্দ্রনাথ পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বেরোতেন। গায়কের দল পথেই আক্রমণ শুরু করল। কিন্তু ‘যে-পাখির কাছে শিকারি অপরিচিত নহে সে যেমন কাহারও ঘাড়ের উপর বন্দুকের চোঙ দেখিলেই চমকিয়া উঠে, রাস্তার সুদূর কোনো-একটা কোণে তানপুরা-যন্ত্রের ডগাটা দেখিলেই আমাদের সেই দশা হইত।’৩৭

সন্ধ্যায় দেবেন্দ্রনাথ বাগানের সম্মুখে বারান্দায় এসে বসতেন, তখন তাঁকে ব্রহ্মসংগীত শোনাবার জন্য রবীন্দ্রনাথের ডাক পড়ত। ‘চাঁদ উঠিয়াছে, গাছের ছায়ার ভিতর দিয়া জ্যোৎস্নার আলো বারান্দার উপর আসিয়া পড়িয়াছে—আমি বেহাগে গান গাহিতেছি—

তুমি বিনা কে প্রভু সংকট নিবারে

কে সহায় ভব-অন্ধকারে—

তিনি নিস্তব্ধ হইয়া নতশিরে কোলের উপর দুই হাত জোড় করিয়া শুনিতেছেন,—সেই সন্ধ্যাবেলাটির ছবি আজও মনে পড়িতেছে।’৩৮

অমৃতসরে মাসখানেক থেকে চৈত্রমাসের শেষে [Apr 1873] ড্যালহৌসি পাহাড়ের উদ্দেশ্যে তাঁরা যাত্রা করলেন। অমৃতসরে মাস আর যেন কাটছিল না। হিমালয়ের আহ্বান বালককে একেবারে অস্থির করে তুলেছিল। অমৃতসর থেকে ডাকগাড়ি চেপে প্রথমে পাঠানকোটে যাওয়া হয়।* সেখান থেকে ঝাঁপানে করে পাহাড়ে ওঠার শুরু। রবীন্দ্রনাথ এই যাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে: ‘আমরা প্রাতঃকালেই দুধরুটি খাইয়া বাহির হইতাম এবং অপরাহ্নে ডাকবাংলায় আশ্রয় লইতাম। সমস্তদিন আমার দুই চোখের বিরাম ছিল না—পাছে কিছু-একটা এড়াইয়া যায়, এই আমার ভয়। যেখানে পাহাড়ের কোনো কোণে পথের কোনো বাঁকে পল্লবভারাচ্ছন্ন বনস্পতির দল নিবিড় ছায়া রচনা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে এবং ধ্যানরত বৃদ্ধ তপস্বীদের কোলের কাছে লীলাময়ী মুনিকন্যাদের মতো দুই-একটি ঝরনার ধারা সেই ছায়াতল দিয়া, শৈবালাচ্ছন্ন কালো পাথরগুলার গা বাহিয়া, ঘনশীতল অন্ধকারের নিভৃত নেপথ্য হইতে কুল্‌কুল্ করিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে, সেখানে ঝাঁপানিরা ঝাঁপান নামাইয়া বিশ্রাম করিত। আমি লুব্ধভাবে মনে করিতাম, এ-সমস্ত জায়গা আমাদিগকে ছাড়িয়া যাইতে হইতেছে কেন। এইখানেই থাকিলেই তো হয়।’৩৯

দেবেন্দ্রনাথ পথখরচের টাকা-ভর্তি ক্যাশবাক্সটি রাখবার ভার পুত্রের উপর দিয়েছিলেন তাঁর কর্তব্যবুদ্ধি জাগ্রত করার জন্য। সেইজন্য একদিন ডাকবাংলায় পৌঁছে বাক্সটি পিতার হাতে না দিয়ে টেবিলের উপর, রেখেছিলেন বলে র্ভৎ সিত হয়েছিলেন।

এইভাবে চলতে চলতে তাঁরা বৈশাখের প্রথম দিকে বক্রোটা শিখরে গিয়ে পৌঁছন। সে-প্রসঙ্গ আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে বর্ণনা করব।

এখানে সমকালীন সংবাদপত্র থেকে দুটি সংবাদ উদ্ধৃত করছি। সোমপ্রকাশ-এর ২৬ চৈত্র [7 Apr] সংখ্যায় ‘মূলতানস্থ সংবাদদাতা’র প্রেরিত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়: ‘উন্নত হিন্দুচুড়ামণি বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় তাঁহার নবোপনীত পুত্র সমভিব্যাহারে অমৃতসর আসিবেন। গ্রীষ্মকাল তিনি ধৰ্ম্মশালার [পর্বতশিখরে অব-]স্থিতি করিবেন [১৫।২১, পৃ ৩৩৪]।’ উক্ত সংবাদদাতারই প্রেরিত দ্বিতীয় সংবাদটি ১০ বৈশাখ ১২৮০ [21 Apr] সংখ্যায় মুদ্রিত হয়: ‘কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের অধ্যক্ষ বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নবোপবীতধারী পুত্রের সহিত অমৃতসরে অবস্থিতি করিতেছেন। তাঁহার ইচ্ছা পূর্ব্বতন ঋষিদিগের আচার ব্যবহার রীতি নীতি ধৰ্ম্মালোচনা যতদূর পারেন উদ্দীপন করিবেন, কিন্তু ইংলণ্ডীয় সভ্যতা সম্পন্ন দেশীয় লোকদিগের নিকট এরূপ চেষ্টা কতদূর ফলবতী হইবে, তাহা তাঁহার পুত্রের উপনয়ন উপলক্ষে প্রকাশ পাইতেছে। “পুরাতন মদ্য কি নূতন বোতলে শোভা পায়।” [১৫।২৩, পৃ ৩৬৫]।’ তারিখগুলির দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে, সংবাদগুলি যথেষ্ট বাসি অবস্থায় পরিবেশিত হয়েছে এবং সংবাদদাতা যে আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রতি অনুকূল ছিলেন না তাঁর তির্যক বাগ্‌ভঙ্গিতেই তা প্রতীয়মান, কিন্তু এখানে যে তথ্যটি উল্লেখযোগ্য সেটি হল রবীন্দ্রনাথের নাম ব্যবহৃত না হলেও তাঁর গতিবিধি এই প্রথম সংবাদপত্রে উল্লিখিত হয়েছে—সেই দিক দিয়ে সংবাদ-দুটির ঐতিহাসিক মূল্য আছে বলে মনে করি।

প্রসঙ্গত এখানে একটি আনুমানিক সিদ্ধান্ত পাঠকদের বিচারের জন্য উপস্থিত করছি। গুরু নানকের রচিত ‘গগন মে থাল রবি চন্দ্র দীপক বনে’ ভজনটির [গানটির কতকগুলি পাঠান্তর আছে] প্রথমাংশের প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’ গানটির রচয়িতা কে এ-নিয়ে নানা সংশয় আছে। আদি ব্রাহ্মসমাজ-প্রকাশিত ‘ব্রহ্মসঙ্গীত স্বরলিপি’ দ্বিতীয় ভাগে গানটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রচনা বলে উল্লিখিত হয়েছে। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ-প্রকাশিত ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ গ্রন্থের সূচিপত্রেও গানটির রচয়িতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ [অবশ্য এই গ্রন্থের সম্পাদক ‘ব্রহ্মসঙ্গীত স্বরলিপি’ গ্রন্থে প্রদত্ত তথ্যের উপরই নির্ভর করেছেন]। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই ‘রবীন্দ্র-রচনাপঞ্জী’তে [শনিবারের চিঠি, মাঘ ১৩৪৬।৫৯০] লিখিত হয়েছে: ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ হইতে প্রকাশিত ‘ব্রহ্মসঙ্গীত-স্বরলিপি’ (দ্বিতীয় ভাগ) পুস্তকে ইহা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নামে বাহির হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন এটি তাঁহার রচনা।’ আবার ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী ‘রবীন্দ্রসংগীতের ত্রিবেণীসংগম’ প্রবন্ধে [বিশ্বভারতী পত্রিকা, ৮ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা, মাঘ-চৈত্র ১৩৫৬।২০৪-০৫] এই গানটি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এই শিখ-ভজনেরই আর-একটি বহুকাল আগে আমাদের কাছে এসেছিল, কী সূত্রে তা জানি নে; এবং আশ্চর্যের বিষয়, সেটিও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একেবারে প্রায় অক্ষরে-অক্ষরে অনুবাদ করেছেন। …কেউ কেউ ভুল করে ভাবেন এটি রবীন্দ্রনাথের।’* সূত্রটি সম্পর্কে আমাদের যতটুকু জানা আছে তা হচ্ছে, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের বাংলা পাক্ষিক মুখপত্র ধৰ্ম্মতত্ত্ব পত্রিকার ১ ভাদ্র ১৭৯৪ শক [১২৭৯; 1872] সংখ্যার [৫।১৪] ৭৩৮ পৃষ্ঠায় নানকের ভজনটি সম্ভবত প্রথম বঙ্গাক্ষরে প্রকাশিত হয়। এর পরই তত্ত্ববোধিনী-র ফাল্গুন সংখ্যার ১৯১-৯২ পৃষ্ঠায় ‘সংবাদ’ শিরোনামায় ২৪ ভাদ্র লাহোর সৎসভার দ্বিতীয় সাংবৎসরিক প্রসঙ্গে গদ্যানুবাদ-সহ গানটি মুদ্রিত হয়। পদ্যানুবাদটি সুর-সংযোজিত [‘রাগিণী জয় জয়ন্তী—তাল ঝাঁপতাল’] হয়ে ১১ মাঘ ১২৮১ [শনি 23 Jan 1875] তারিখে আদি ব্রাহ্মসমাজের পঞ্চচত্বারিংশ সাংবৎসরিকে সায়ংকালীন উপাসনায় গীত হয় ও পরবর্তী ফাল্গুন সংখ্যার তত্ত্ববোধিনী-র ২০৯ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়। ইন্দিরা দেবীর উপরোক্ত মন্তব্য সত্ত্বেও গীতবিতান তৃতীয় খণ্ড-তে [আশ্বিন ১৩৫৭] গানটি রবীন্দ্র-রচনা হিসেবেই গৃহীত হয় [মনে রাখা দরকার, এই গ্রন্থ-সংকলনে ইন্দিরা দেবী অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন]। আমাদের অনুমান, পদ্যানুবাঁদটি রবীন্দ্রনাথেরই কৃত। ফাল্গুন সংখ্যায় অনুবাদ-সহ মূল রচনাটি প্রকাশিত হবার কয়েকদিন পরেই রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে বোলপুর হয়ে অমৃতসরে আসেন। খুবই সম্ভব যে, তিনি তত্ত্ববোধিনী মারফত রচনাটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। অমৃতসরে পিতার সঙ্গে যখন গুরু-দরবারে উপস্থিত থাকতেন তখন অন্যান্য শিখ-ভজনের সঙ্গে এই গানটিও তিনি শুনেছিলেন, এমন সম্ভাবনার কথা সহজেই ভাবা যেতে পারে। আর এই যোগাযোগের অভিঘাতে রবীন্দ্রনাথ ভজনটির বঙ্গানুবাদ করেন। তত্ত্ববোধিনী-তে প্রকাশিত পাঠের সঙ্গে গদ্যানুবাদ দেওয়া ছিল এবং দেবেন্দ্রনাথও গানটি জানতেন, সুতরাং গুরুমুখী ভাষার অর্থ-নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। আমাদের এই আনুমানিক সিদ্ধান্ত যদি বিদগ্ধজনের সমর্থনযোগ্য হয়, তবে এটি-ই রবীন্দ্রনাথ-রচিত প্রথম ব্রহ্মসংগীত বলে গণ্য হবে। অবশ্য প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত ‘গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচী’ প্রথম খণ্ডে [1973] গানটিকে সূচির প্রথমেই স্থাপন করা হয়েছে। তবে আমাদের মত গ্রাহ্য হলে সেখানে বয়স ও সালটি সংশোধনের প্রয়োজন হবে, লিখতে হবে—‘বয়স ১১।১২৭৯।১৮৭৩’।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ১

বর্তমান বৎসরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পারিবারিক ঘটনা ও তথ্য এখানে সংকলিত হল।

১২ শ্রাবণ শুক্রবার [26 Jul 1872] তারিখে সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনীর পুত্র সুরেন্দ্রনাথ পুনায় জন্মগ্রহণ করেন। বলেন্দ্রনাথের সংকলিত রাশিচক্রের খাতায় জন্মতারিখ ও সময়টি এইভাবে দেওয়া আছে—‘১৭৯৪।৩।১১।৫।২৭।১১’ অথাৎ সকালের দিকে তাঁর জন্ম হয়। লক্ষণীয়, মাতা জ্ঞানদানন্দিনীর জন্মতারিখও ১২ শ্রাবণ [১২৫৭]। সুরেন্দ্রনাথ অবশ্য তাঁদের প্রথম সন্তান নন; আমরা জানি আশ্বিন ১২৭৫ [Oct 1868]-এ তাঁদের একটি পুত্রসন্তান জন্মের দু-একদিনের মধ্যেই মারা যায়। জ্ঞানদানন্দিনীও লিখেছেন: ‘প্রথম যখন আমি অন্তঃসত্ত্বা হলুম, তখন আমি কিছু বুঝতুম না বলে দৌড়াদৌড়ি করতুম, তাই দু-একবার সন্তান নষ্ট হয়।’৪০ সুদূর পুনাতে সুরেন্দ্রনাথের জন্ম হলেও জোড়াসাঁকোর বাড়িতেও আনন্দানুষ্ঠানের অভাব হয়নি, এ কথা জানা যায় ৯ ভাদ্র [শনি 24 Aug] তারিখের একটি হিসাব থেকে—‘মেজবাবু মহাশয়ের পুত্র হওয়ায় বিতরণ জন্য বাটী তৈল ও মিঠাই ক্রয়…৬২৸°’। এইটাই বোধহয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির রীতি ছিল, পুত্রসন্তানের জন্ম হলে দাসী ও ভৃত্যদের মধ্যে তেল-ভরা বাটি ও মিষ্টান্ন বিতরণ করা হত।

২৫ ভাদ্র সোমবার [9 Sep 1872] তারিখে স্বর্ণকুমারী দেবী ও জানকীনাথ ঘোষালের তৃতীয় সন্তান ও দ্বিতীয় কন্যা সরলার জন্ম হয়। সরলা দেবী নিজেই এই জন্মকথার বিবরণ দিয়েছেন এই ভাবে: ‘একদিন ভাদ্রমাসে—ললিতা সপ্তমী তিথিতে মহর্ষির আর একটি দৌহিত্রীর আবির্ভাব হল বাড়ির সূতিকাগৃহে, বাড়ির ভিতরের তেতালার একটি রোদফাটা কাঠের ঘরে।’৪১ এই ঘরটি অবশ্য ‘বাড়ির সূতিকাগৃহ’ ছিল না।

শ্রাবণ মাসে দ্বিজেন্দ্রনাথের দ্বিতীয়া কন্যা ঊষাবতীর অন্নপ্রাশন হয়। কার্তিক মাসে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম পুত্র জ্যোৎস্নানাথ, বর্ণকুমারী দেবীর জ্যেষ্ঠপুত্র সরোজনাথ ও হেমেন্দ্রনাথের দ্বিতীয়া কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরীর অন্নপ্রাশন একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। আগেই উল্লিখিত হয়েছে, সোমেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ এই অনুষ্ঠানে শিশুদের মুখে প্রথম অন্ন তুলে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। সরলা দেবীর বিবরণ অনুযায়ী, এই বৎসরের পৌষ-মাঘ মাসের কোনো দিনে পানিহাটিতে তাঁর অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এ-সম্পর্কে আমাদের হাতে কোনো তথ্য নেই, তা আগেই বলা হয়েছে। বিবরণটি যথার্থ না হওয়াই সম্ভব।

২০ আশ্বিন [শনি 5 Oct] তারিখের একটি হিসাবে দেখা যায়, ‘শ্রীমতী ইরাবতী দেবীর দ্বিতীয় বিবাহের ব্যয়’ বাবদ ৯৮৸৩ খরচ করা হয়েছে। সংবাদটি কিছুটা কৌতূহলজনক। ঋতুমতী হওয়ার পর কন্যাকে স্বামী-সকাশে প্রেরণের প্রথা হিন্দুসমাজে, বিশেষ করে যেখানে বাল্যবিবাহ প্রচলিত আছে, কিছু নতুন নয়; কিন্তু ঠাকুর পরিবারে ঘটনাটি একটু বৈচিত্র্যের স্বাদ আনে। ইরাবতীর বিবাহ ব্যাপারটিও রহস্যাবৃত। তাঁর বিবাহ হয়েছিল পাথুরিয়াঘাটার সূর্যকুমার ঠাকুরের দৌহিত্র নিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের পুত্র নিত্যরঞ্জনের সঙ্গে। নিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল কাশীতে। এই বিবাহ-সংক্রান্ত প্রথম হিসাবটি ক্যাশবহি-তে পাওয়া যায় ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১২৭৮ [বুধ 31 May 1871] তারিখে: ‘সারদাবাবুর কন্যা ইরাবতীর বিবাহের নিরঞ্জনবাবুর বাটী হইতে সওগাদ আনে লোকেরদিগের খাওয়াইবার ও বিদায় ব্যয়…১১৮৸৵/৯’—ইরাবতীর বয়স তখন দশ বৎসর পূর্ণ হয়নি। এর পরেই ১৪ মাঘ [শুক্র 26 Jan 1872] তারিখের হিসাবে দেখা যায়: ‘[অযোধ্যানাথ] পাকড়াশী মহাশয়কে ঢাকায় ইরাবতীর বিবাহ স্থগিদ সম্বাদ টেলিগ্রাফ করার ব্যয়…১৲’ অর্থাৎ মাঘ মাসেই [১২৭৮] বিবাহের আয়োজন হয়েছিল, কিন্তু কোনো অনিবার্য কারণে তা স্থগিত রাখতে হয়। এরপর বর্তমান বৎসরে ৬ বৈশাখ (বুধ 17 Apr 1872] তারিখে ‘ইরাবতী দেবীর বিবাহের মোট খরচ’-এর হিসাব পাওয়া যায় ৬০৪৫ ৷৷৴৯ পাই, তার থেকে মনে হয় বৈশাখ ১২৭৯ [Apr 1872]-র প্রথম সপ্তাহেই ইরাবতীর বিবাহ হয়েছিল দশ বৎসর বয়সে। আষাঢ় মাসের তত্ত্ববোধিনী-তে আদি ব্রাহ্মসমাজের চৈত্র ও বৈশাখ মাসের আয়ব্যয়ের বিবরণেও দেখা যায় ‘শুভকর্ম্মের দান। শ্রীযুক্ত সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় ২০৲,’ যা আমাদের ধারণা সমর্থন করে। এই বিবাহের ছ’মাসের মধ্যেই আশ্বিনে ‘ইরাবতী দেবীর দ্বিতীয় বিবাহ’ হয় অর্থাৎ তিনি স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরগৃহে যাত্রা করেন। একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মপরিবার থেকে ইরাবতী এক সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে উপস্থিত হন। সরলা দেবী লিখেছেন: ‘বড় মাসিমার জ্যেষ্ঠা কন্যা ইরুদিদিও কাশীতে শ্বশুরগৃহে নিত্য শিবদুর্গার সেবাপরায়ণা ছিলেন; কারণ, তাঁর বিবাহ হয়েছিল সেই রকম ঘরে—…যাঁদের নিজ বাড়িতেই শিবমন্দির ছিল। ইরুদিদিকে তাঁরা যোল-সতের বৎসর আর মায়ের কাছে মাতুলালয়ে পাঠাননি।’৪২

এই বৎসর জোড়াসাঁকো বাড়িতে একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটে, তিনি হলেন রায়পুরের শ্রীকণ্ঠ সিংহ—লর্ড ‘সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ মহাশয়ের জ্যেষ্ঠতাত’। রায়পুরের এই সিংহ পরিবারের কাছ থেকেই দেবেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের কুড়ি বিঘা জমি লাভ করেছিলেন। শ্রীকণ্ঠ সিংহ দেবেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত হন এবং সম্ভবত মাঘ মাসে জোড়াসাঁকোয় আগমন করেন। ২৬ মাঘ [শুক্র 7 Jan 1873] তারিখের হিসাবে দেখছি: ‘শ্রীকণ্ঠ বাবুর দাঁত বাঁধাইবার জন্য ব্যয়’ ১৭৫ টাকা সরকারী তহবিল থেকেই দেওয়া হয়েছে। আবার ৯ ফাল্গুন [বুধ 19 Feb] ‘শ্ৰীকণ্ঠবাবুর জন্য মশারি একটা ও বিছানার চাদর একখানা তৈয়ারি’ করানো হয়েছে অর্থাৎ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তিনি প্রায় স্থায়ী অতিথিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে বোলপুর ও হিমালয় ভ্রমণে রত, সেখান থেকে ফিরে আসার পরই তাঁর সঙ্গে শ্রীকণ্ঠ সিংহের অসমবয়সী বন্ধুত্বের সূচনা। সুতরাং সে-প্রসঙ্গ পরের অধ্যায়ে আলোচনার জন্য রেখে দেওয়া হল।

রবীন্দ্রনাথের গৃহশিক্ষক নীলকমল ঘোষালের সঙ্গে আমরা যথেষ্ট পরিচিত। তিনি কার্তিক ১২৭৩ [Oct 1866]-এ এই কাজে নিযুক্ত হন। ফাল্গুন ১২৭৮ [Feb 1872]-এ রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলা শিক্ষার অবসান’ ঘটলেও দ্বিপেন্দ্রনাথ প্রভৃতির গৃহশিক্ষক হিসেবে তিনি বহাল ছিলেন। কিন্তু বর্তমান বৎসরে ৪ ফাল্গুন [শুক্র 14 Feb] তাঁর কর্মাবসান ঘটে, এ তথ্য আমরা জানতে পারি ৭ ফাল্গুন [সোম 17 Feb]-এর হিসাব থেকে: ‘ব° নিলকমল ঘোসাল/দ° উহার বেতন মাঘ না° ৪ ফাল্গুণ…১৩৷৷৴৬’। আবার এই ফাল্গুন মাস থেকেই মাসিক ১৫ টাকা বেতনে আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশের পুত্র জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য ‘ছেলেবাবুদিগের ইংরাজি পড়াইবার শিক্ষক’ হিসেবে নিযুক্ত হন। এঁর সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ হিমালয় থেকে প্রত্যাগমনের পর, অতএব পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচ্য। কিন্তু এই নিয়োগের ফলে অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বেতন কমে মাসিক দশ টাকায় দাঁড়ায় এবং তিনি প্রতিভা প্রভৃতি বালিকাদের শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ২

বেঙ্গল অ্যাকাডেমির সহপাঠী হরিশ্চন্দ্র হালদারের সম্বন্ধে অনেক কৌতুকপ্রদ বিবরণ রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে দিয়েছেন, অবশ্য সেখানে তিনি এঁর নাম উল্লেখ না করে ‘গ্রন্থকার বন্ধু’ ‘প্রোফেসর’ ‘জাদুকর’ প্রভৃতি. আখ্যায় তাঁকে ভূষিত করেছেন। শেষ বয়সে রচিত গল্পসল্প গ্রন্থের ‘ম্যাজিশিয়ান’ ও ‘মুক্তকুন্তলা’ গল্পেও তিনি এঁর প্রসঙ্গ এনেছেন, সেখানে তিনি স্বনামে প্রতিষ্ঠিত হলেও তাঁর ব্যক্তিপরিচয়টি যথেষ্ট স্পষ্ট হয়নি। জীবনস্মৃতি-র বর্ণনা থেকে মনে হয়, বেঙ্গল অ্যাকাডেমিতে পড়ার সময়ই তাঁদের চেয়ে ‘বয়সে অনেক বড়’ এই সহপাঠীর সঙ্গে তাঁদের আলাপ হয়, গল্পসল্প-তেও ইঙ্গিত আছে ইরাবতীর শ্বশুরবাড়ি যাত্রার পরে তাঁর আবিভাব। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-অঙ্কিত প্রতিকৃতির তালিকায় ‘শিল্পী হরিশচন্দ্র হালদার’ চিত্রটিতে তারিখ দেওয়া আছে 1870৪৩, লক্ষণীয় ‘শিল্পী’ আখ্যাটি এই সময়েই তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। 1870-তে রবীন্দ্রনাথ নর্মাল স্কুলের ছাত্র, কিন্তু তখন থেকেই অন্তত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে হরিশ্চন্দ্রের পরিচয়ের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিমা দেবী লিখেছেন: ‘শোনা যায় যখন কবি [রবীন্দ্রনাথ] এবং সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে পড়তেন সেই সময় হ. চ. হ. ছিলেন তাঁদের সহপাঠী। সোদ্দাই এই বহুগুণযুক্ত মানুষটিকে সংগ্রহ করে পরিবারের তরুণ মহলে পরিচিত করিয়ে দেন। …তাঁর হ. চ. হ. নামকরণ সোদ্দাই করেছিলেন।’৪৪ ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে রবীন্দ্রনাথরা পড়েননি, সুতরাং সে-প্রসঙ্গ বাহুল্য; কিন্তু যে-তথ্যটি এখানে উল্লেখযোগ্য সেটি হল বেঙ্গল অ্যাকাডেমি পর্বের আগেই হ. চ. হ. জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। আর একটি মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করেছেন কমল সরকার তাঁর ‘রবীন্দ্র-রচনার প্রথম চিত্রকর’ প্রবন্ধে [দ্র দেশ, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৩৭৯।৪৬৫-৭১]। রবীন্দ্রনাথ হ. চ. হ. লিখিত এবং মুদ্রিত ম্যাজিক সম্বন্ধে চটি বই ও ‘ঝুলঝুলে খাতায় লেখা’ ‘মুক্তকুন্তলা’ নাটকের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি-যে অন্তত দুখানি মুদ্রিত নাট্যগ্রন্থের লেখকও ছিলেন সেই সংবাদ দিয়েছেন কমলবাবু। তাঁর নাটক দুটির নাম—‘কালাপাহাড় বা ধৰ্ম্মদ্রোহী নাটক’ [১৮০৩ শক: ১২৮৮] এবং ‘বেদবতী বা পতি-প্রাণা নাটিকা’ [১৮০৪ শক: ১২৮৯]। প্রথম গ্রন্থটির আখ্যাপত্রটি উদ্ধৃত করছি: ‘কালাপাহাড়।/বা ধৰ্ম্মদ্রোহী নাটক।/শ্রীহরিশ্চন্দ্র হালদার প্রণীত।/ KALA PAHARA/BY/HARISH CHANDRA HALDARA/LATE STUDENT OF THE/CALCUTTA GOVERNMENT SCHOOL OF ART/কলিকাতা/বাল্মীকি যন্ত্রে/শ্রীকালীকিঙ্কর চক্রবর্ত্তী দ্বারা মুদ্রিত।/শকাব্দা ১৮০৩।’ নাটকের শেষ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, দৃশ্যকাব্যটি অন্যান্য পুস্তকালয়ের সঙ্গে ‘জোড়াসাঁকো ঠাকুর ভবনে…এবং পাথুরিয়াঘাটা প্রসন্নকুমার ঠাকুরের স্ট্রীট ৩৩ নং ভবনে গ্রস্থকারের নিকট প্রাপ্তব্য।’ অপর গ্রন্থখানিও আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্রে মুদ্রিত। এই বিবরণে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে হরিশ্চন্দ্রের যোগাযোগের সাক্ষ্য ছাড়াও তিনি যে কলকাতা গবর্মেন্ট স্কুল অব আর্টের ছাত্রও ছিলেন সে-খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমরা জানি Jan 1867-এ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও তাঁর ভগ্নীপতি যদুনাথ মুখোপাধ্যায় ইণ্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট স্কুলে [1864 থেকে Government School of Art নামেই পরিচিত ছিল] ভর্তি হয়েছিলেন। এই সূত্রেই কি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল? তাহলে রবীন্দ্রনাথদের চেয়ে তিনি কত বড়ো ছিলেন?

যাই হোক, এই ব্যক্তিটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতার বর্ণনা জীবনস্মৃতি ও গল্পসল্প গ্রন্থে যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও পরবর্তীকালে আর কোনো যোগাযোগের কথা তিনি কোথাও উল্লেখ করেননি। কিন্তু এই পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক যে বহু দিন অক্ষুণ্ণ ছিল, তার প্রমাণ 24 Apr 1903 [শুক্র ১১ বৈশাখ ১৩১০] তারিখে বালিগঞ্জে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-অঙ্কিত তাঁর প্রতিকৃতি। এর মধ্যেও ১২৯২ বঙ্গাব্দে বালক পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যদের রচনা তিনি চিত্রিত ও লিথোগ্রাফ করে দিয়েছেন, গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে পীরপাহাড়ে বেড়াতে গেছেন [দ্র স্মৃতিচিত্র।৬৩] ও ছোটোদের অভিনয়ে মঞ্চসজ্জা করে দিয়েছেন। শেষোক্ত সংবাদটি আমরা পাই হিরন্ময়ী দেবীর রচনা থেকে: ‘বাড়ীতে তখন হরিশবাবু নামে একটি পোষা চিত্রকর থাকিতেন। …আমরা হরিশবাবুকে ধরিলাম যে আমাদের একটি ষ্টেজ আঁকিয়া দিতে হইবে। আমাদের হাত হইতে উদ্ধার পাইবার চেষ্টা বৃথা! রফা হইল যে ৫০৲ টাকায় তিনি সে কাজটা করিয়া দিবেন। …আমার মামা মহাশয় স্বর্গীয় গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ষ্টেজের ইতিহাস শুনিয়া হরিশবাবুর দেনা পরিশোধের ভার লইলেন। …“ভারতী”র মলাটে তখন বীণাপাণির যে ছবি থাকিত, আমাদের ষ্টেজের শিরোভাগে অঙ্কিত হইয়াছিল সেই ছবি। ড্রপসিনে—মধ্যে অঙ্কিত রবিমামার মুখ—আর তার চারদিকে একটি ফুলের মালা—কিন্তু সে ফুল, বাগানের ফুল নয়–নাট্যাভিনেতা ছেলে-মেয়েদের মুখগুলি।’৪৫ এইভাবেই এই মানুষটি প্রায় ত্রিশ বছরের উপর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুটি শাখার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও পরবর্তীকালে তাঁর যথেষ্ট যোগাযোগ থাকার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩

পূর্বেই বলা হয়েছে, কনিষ্ঠ পুত্রদ্বয় ও জ্যেষ্ঠ দৌহিত্রের উপনয়ন দেবার জন্য দেবেন্দ্রনাথ আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশের সাহায্যে বৈদিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্রাহ্মণসন্তানের উপযোগী অপৌত্তলিক উপনয়ন-পদ্ধতি রচনা করেন। কিন্তু এই ঘটনাটি ঘরে বাইরে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। রাজনারায়ণ বসুও প্রথমে এই প্রথার বিরোধিতা করলেও পরে এই যুক্তিতে সমর্থন করেন: ‘যদি অন্য দেশের অভিজাত ব্যক্তিরা সম্মুখের পা তোলা সিংহের প্রতিকৃতি ব্যবহার আভিজাত্যের চিহ্ন স্বরূপ জ্ঞান করেন, তবে আমাদের দেশের ব্রাহ্মণবংশোদ্ভব ব্রাহ্মেরা প্রাচীন ঋষিদিগের সন্তান বলিয়া পৌত্তলিকতার সহিত সংশ্রব না রাখিয়া উপবীত আধ্যাত্মিক আভিজাত্যের চিহ্নস্বরূপ যদি ব্যবহার করেন, তাহা হইলে তাহাতে আমি কোন হানি দেখি না। …প্রথমে আমি নৃতন উপনয়ন প্রথার বিপক্ষ ছিলাম, কিন্তু এরূপ উপনয়ন ব্যতীত আদি ব্রাহ্মসমাজের হিন্দু অনুষ্ঠান পদ্ধতি সর্বাবয়ব সম্পন্ন হয় না, ইহা বিবেচনা করিয়া তাহাতে যোগ দিয়াছিলাম।’৪৬

কিন্তু অনেকেই তা মেনে নিতে পারেননি। ধর্মতত্ত্ব পত্রিকার বক্তব্য যদি যথার্থ হয়, তাহলে বলতে হবে আদি ব্রাহ্মসমাজের এতদিনের একনিষ্ঠ সেবক অযোধ্যানাথ পাকড়াশীও এই প্রথা সমর্থন করতে পারেননি এবং এই মতানৈক্যের ফলেই তিনি উপাচার্য ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র সম্পাদক পদ থেকে অপসৃত হন। উক্ত পত্রিকা ১ চৈত্র [৬।৫] সংখ্যায় ‘সম্বাদ’ দেয়, ‘অযোধ্যানাথ পাকড়াসী কলিকাতা সমাজ হইতে অবসর লইয়াছেন।’ আবার ১৬ বৈশাখ ১২৮০ [৬।৮] সংখ্যায় লেখা হয়, ‘কলিকাতা…সমাজের প্রচারক বাবু ঈশানচন্দ্র বসুও নিষ্কাশিত হইয়াছেন। শ্রুত হওয়া গেল ইনি ও পাকড়াশী মহাশয় দেবেন্দ্র বাবুর সন্তানের উপবীত অনুষ্ঠানে অসম্মত হওয়ায় দেবেন্দ্রবাবু তাহাদের প্রতি বিরক্ত হন।’ এছাড়াও এই পত্রিকায় ১৬ মাঘ ও ১ ফাল্গুনের যুগ্মসংখ্যায় [৬|২-৩|৮৮১-৮৩] ‘কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের ভয়ানক দুর্ঘটনা’, ১৬ চৈত্র সংখ্যায় [৬।৬।৯১৮-২০] তত্ত্ববোধিনী-তে প্রকাশিত উপনয়নের অনুষ্ঠান-প্রণালীর সমালোচনা করে ‘শোচনীয় পতন’ এবং ১ জ্যৈষ্ঠ ১২৮০ সংখ্যায় [৬।৯।৯৫৪-৫৫] ‘যঞ্জোপবীত পৌত্তলিক চিহ্ন এবং পৌত্তলিকতা কিনা?’ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়; অনেকগুলি পত্রও মুদ্রিত হয়। সোমপ্রকাশ পত্রিকায় ‘মূলতানস্থ সংবাদদাতা’র প্রতিবেদনের যে অংশগুলি আমরা পূর্বে উদ্ধৃত করেছি, তার মধ্যেও সমালোচনাত্মক মনোভাব ছিল। কিন্তু ঐ পত্রিকার সম্পাদকীয় মত এই প্রথার অনুকূল ছিল বলেই মনে হয়: ‘বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্প্রতি তাঁহার দুই পুত্রের যঞ্জোপবীত দেওয়াতে সাপ্তাহিক সংবাদ বিদ্রুপ করিয়া লিখিয়াছেন আদি ব্রাহ্মসমাজের ব্রাহ্মেরা আবার হিন্দু হইতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা ত হিন্দুই আছেন, নূতন হইলেন না। এক ঈশ্বরের উপাসনা হিন্দুধৰ্ম্মের সারভূত, সমুদায় সংস্কৃত গ্রন্থকর্ত্তাই একথা কহিয়াছেন। কৈশব সম্প্রদায় ব্রাহ্ম বলিয়া পরিচয় দেন, কিন্তু তাঁহারা বাস্তবিক ব্রাহ্ম নহেন, তাঁহারা না হিন্দু না মুসলমান না খৃষ্টান।’ [সোমপ্রকাশ, ১৪ ফাল্গুন, ১৫।১৫।২৩৩]।

ক্যাশবহি থেকে জানা যায়, উপনয়ন খাতে মোট খরচ হয়েছিল ১৪৬৯৸৬, যার মধ্যে একটি কৌতূহলোদ্দীপক ব্যয়ের উল্লেখ আছে: ‘রবীবাবুর দাইকে বিদায় কাপড়ের মূল্য ৪৲’—জন্মের পর এই দাইয়ের স্তন্যেই রবীন্দ্রনাথ পালিত হয়েছিলেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৪

এই প্রসঙ্গে আমরা বোলপুর-শান্তিনিকেতনের সম্বন্ধে আলোচনা করব।

আমরা জানি, ১৮ ফাল্গুন ১২৬৯ [রবি 1 Mar 1863] তারিখে লিখিত একটি মৌরসী পাট্টার দ্বারা রায়পুরের জমিদার প্রতাপনারায়ণ সিংহ প্রভৃতির কাছ থেকে বার্ষিক পাঁচ টাকা খাজনায় দেবেন্দ্রনাথ ভুবনডাঙা বাঁধের উত্তরাংশে ‘সান্তীনিকেতন নামা গৃহের চতুপার্শ্বের মধ্যে’ ২০ বিঘা জমির স্বত্ব লাভ করেন। শান্তিনিকেতন নামা উক্ত গৃহের উল্লেখ আমাদের মনে সংশয় সৃষ্টি করে যে, দলিল সম্পাদনের পূর্বেই সেখানে কোনো গৃহের অস্তিত্ব ছিল কিনা। অজিত চক্রবর্তী লিখেছেন: ‘এই ছাতিমের ছায়াটিকে তাঁহার নির্জন সাধনার উপযুক্ত বলিয়া তাঁহার মনে হইল। তার পর হইতে ঐ ছাতিম গাছের তলায় মাঝে মাঝে তাঁহার তাঁবু পড়িতে লাগিল।’৪৭ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘কালে দেবেন্দ্রনাথ তথায় একখানি ক্ষুদ্র একতল অট্টালিকা নির্মাণ করেন, উত্তরকালে উহা দ্বিতল ও শান্তিনিকেতন অতিথিশালায় পরিণত হয়। সময় সময় মহর্ষির পুত্রদের বা কন্যাজামাতাদের কেহ কেহ গিয়া কয়েকদিন করিয়া বাস করিয়া আসিতেন, শান্তিনিকেতন নাম তখনো হয় নাই।’৪৮ উদ্ধৃতি দুটি থেকে মনে হয়, দেবেন্দ্রনাথ প্রথমে সেখানে তাঁবু স্থাপন করে বাস করতেন, পরে যখন সেখানে গৃহ নির্মিত হয় তখনো তার ‘শান্তিনিকেতন’ নামকরণ হয়নি। অজিত চক্রবর্তী হয়তো অনেক পূর্বের ঘটনা লিখেছেন, কিন্তু আমাদের ধারণা দলিল-সম্পাদনের পূর্বেই সিংহ-পরিবারের অনুমতিক্রমে দেবেন্দ্রনাথ সেখানে ‘শান্তিনিকেতন’ নাম দিয়ে একটি গৃহের পত্তন করেন। অন্তত ১২৭১ বঙ্গাব্দে ১ অগ্রহায়ণ [মঙ্গল 15 Nov 1864] তারিখে ‘শান্তিনিকেতন খাতে খরচ’ হিসাবে রফিমদ্দী মিস্ত্রীকে ‘শান্তিনিকাতনের গাথনির হিসাব সোদ’ বাবদ ১৬ টাকা ৫ আনা দেওয়া হয়েছে, এ-প্রসঙ্গ আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। সুতরাং দেবেন্দ্রনাথ পূর্বাবধিই এই গৃহকে ‘শান্তিনিকেতন’ নামে অভিহিত করতেন, এমন সিদ্ধান্ত করাই যুক্তিযুক্ত। ভাদ্র ১২৭২ [Sep 1865]-এর হিসাবে দেখা যায় শান্তিনিকেতনের জন্য ফুলের চারা কিনে পাঠানো হচ্ছে। অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘এই অনুর্ব্বর প্রান্তরে উদ্যান প্রস্তুত করা বহু আয়াস ও অর্থ-সাধ্য ব্যাপার। ডাঙ্গার কঙ্করমিশ্রিত মাটী তুলিয়া ফেলিয়া অন্যত্র হইতে উৎকৃষ্ট মাটী আনিয়া ঐ সকল স্থান পূর্ণ করিতে হইয়াছিল।’৪৮ক রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনে যান, তখন এখানকার গৃহ যথেষ্ট বাসযোগ্য হয়ে উঠলেও, নির্মাণ কার্য চলতেই থাকে। তিনি শান্তিনিকেতনের সাধারণ রূপটি তখন যা দেখেছিলেন তার বর্ণনা করে পরে লিখেছেন: ‘সে জায়গার সঙ্গে এখানকার এ জায়গার অনেক তফাত—ধূধূ করছে প্রান্তর, শ্যামল বৃক্ষচ্ছায়ার অবকাশ নেই প্রায় কোথায়ও। সেই ঊষর রুক্ষ প্রান্তরের মধ্যে, আজকাল যেটা অতিথিশালা তারই একটা ছোটো ঘরে, আমি থাকতুম, অন্যটাতে তিনি [দেবেন্দ্রনাথ] থাকতেন। তাঁরই রোপণ-করা শালবীথিকা তখন বড়ো হতে আরম্ভ করেছে।… নাট্যঘরের পাশে একটা নারিকেলগাছ ছিল, তারই তলায় বসে ‘পৃথ্বীরাজবিজয়’ নামে একটি কবিতা রচনা করে গর্ব অনুভব করেছিলুম।’৪৯

রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম শান্তিনিকেতন-বাসের অভিজ্ঞতায় যে অসমাপ্ত পুষ্করিণীর কথা লিখেছেন, এই চেষ্টায় ১২৭৪ বঙ্গাব্দে যথেষ্ট অর্থ ব্যয়িত হয়। ঐ বৎসরের ক্যাশবহি-তে এবিষয়ে প্রথম ব্যয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ২৩ ভাদ্র [শনি 7 Sep 1867] তারিখে—‘ব° দিননাথ বন্দ্যোপাধ্যায়/দ° শান্তিনিকেতনের পুষ্করিণীর-পাড়ের মাটী উঠাইবার খরচ…১০০৲’; ৮ আশ্বিন [23 Sep] তাঁকে এই কাজের জন্য আবার ১০০ টাকা দেওয়া হয়। ১০ কার্তিক [26 Oct] ও ৪ অগ্ৰ [19 Dec] তারিখে সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়কে ‘পুষ্করিণী খনন হিসাবে’ ২০০ টাকা করে দেওয়ার পর সম্ভবত প্রচেষ্টাটি পরিত্যক্ত হয়, কারণ এর পরে এই বাবদে আর কোনো খরচ দেখা যায় না। বর্তমানে আনন্দ পাঠশালার পাশে যে উঁচু মাটির ঢিবি দেখা যায়, সেটি এই পুকুর থেকে তোলা মাটি দিয়েই তৈরি—যার উপরে বসে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর প্রাতঃকালীন উপাসনা সম্পন্ন করতেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৫

বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন মাসিক পত্রিকা প্রকাশ এই বৎসরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই কথা বলে আমরা এই অধ্যায়ের সূচনা করেছিলাম। এইখানে প্রসঙ্গটির একটু বিস্তৃত আলোচনা করা হচ্ছে।

বঙ্গদর্শন প্রকাশের পূর্বেই বঙ্কিমচন্দ্র তিনটি বাংলা উপন্যাস—দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা ও মৃণালিনী—রচনা করে সাহিত্য-জগতে যথেষ্ট মর্যাদার আসন লাভ করেছিলেন। এই অবস্থায় তিনি Dec 1869-এ বহরমপুরে বদলি হন। ‘বহরমপুরে তখন রীতিমত সাহিত্যের আসর—সাহিত্য-চর্চ্চার যেন বান ডাকিয়াছিল। ভূদেব [মুখোপাধ্যায়], রামদাস সেন, লালবিহারী দে, রামগতি ন্যায়রত্ন, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, লোহারাম শিরোরত্ন, গঙ্গাচরণ সরকার, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, বৈকুণ্ঠনাথ সেন, তারাপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, দীননাথ গঙ্গোপাধ্যায়, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (তখন উকীল),—এই সুধী এবং সাহিত্য-সমাজে বঙ্কিমচন্দ্র যোগদান করিলেন।’৫০ এই সাহিত্যিক পরিবেশই হয়তো বঙ্কিমচন্দ্রের মনে একটি পত্রিকা প্রকাশের আকাঙক্ষার জন্ম দিয়েছিল। তারই ফলে বৈশাখ ১২৭৯ [Apr 1872] থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন।/মাসিক পত্র ও সমালোচন’ নামে ‘ভবানীপুরের ১নং পিপুলপটী লেনে সাপ্তাহিক সংবাদ যন্ত্রে ব্রজমাধব বসু কর্ত্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত’ হতে শুরু করে। ‘পত্র সূচনা’য় বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন:

সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা রচনায় বিমুখ বলিয়া সুশিক্ষিত বাঙ্গালী বাঙ্গালা রচনা পাঠে বিমুখ। সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা পাঠে বিমুখ বলিয়া, সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা রচনায় বিমুখ।/আমরা এই পত্রকে সুশিক্ষিত বাঙ্গালীর পাঠোপযোগী করিতে যত্ন করিব। …এই আমাদিগের প্রথম উদ্দেশ্য।

দ্বিতীয়, এই পত্র আমরা কৃতবিদ্য সম্প্রদায়ের হস্তে, আরও এই কামনায় সমর্পণ করিলাম যে, তাঁহারা ইহাকে আপনাদিগের বার্ত্তাবহস্বরূপ ব্যবহার করুন। বাঙ্গালী সমাজে ইহা তাঁহাদিগের বিদ্যা, কল্পনা, লিপিকৌশল, এবং চিত্তোৎকর্ষের পরিচয় দিক। তাঁহাদিগের উক্তি বহন করিয়া, ইহা বঙ্গ-মধ্যে জ্ঞানের প্রচার করুক।’৫১

শুধু কৃতবিদ্য সম্প্রদায়কে আহ্বান করা নয়, প্রথম সংখ্যা থেকেই উপন্যাস তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস, ব্যঙ্গকৌতুক, বিজ্ঞান-প্রসঙ্গ, গ্রন্থ-সমালোচনা প্রভৃতি বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই লেখনী ধারণ করে নবযুগের সাহিত্যের আদর্শ সকলের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস করেছেন। বঙ্গদর্শন-এর মাধ্যমেই ‘বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যে প্রভাতের সূর্যোদয় বিকাশ করিলেন, আমাদের হৃৎপদ্ম সেই প্রথম উদ্‌ঘাটিত হইল। …বঙ্গদর্শন যেন তখন আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার মতো “সমাগতো রাজবদুন্নতধ্বনির্‌।” এবং মুষলধারে ভাববর্ষণে বঙ্গসাহিত্যের পূর্ববাহিনী পশ্চিমবাহিনী সমস্ত নদী-নির্ঝরিণী অকস্মাৎ পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়া যৌবনের আনন্দবেগে ধাবিত হইতে লাগিল। …বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল।’৫২

বঙ্গদর্শন প্রথম পাঠের স্মৃতি রবীন্দ্রনাথ এইভাবে রোমন্থন করেছেন: ‘অবশেষে বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন আসিয়া বাঙালির হৃদয় একেবারে লুঠ করিয়া লইল। একে তো তাহার জন্য মাসান্তের প্রতীক্ষা করিয়া থাকিতাম, তাহার পরে বড়োদলের পড়ার শেষের জন্য অপেক্ষা করা আরও বেশি দুঃসহ হইত। বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর,* এখন যে-খুশি সেই অনায়াসে একেবারে একগ্রাসে পড়িয়া ফেলিতে পারে কিন্তু আমরা যেমন করিয়া মাসের পর মাস, কামনা করিয়া, অপেক্ষা করিয়া, অল্পকালের পড়াকে সুদীর্ঘকালের অবকাশের দ্বারা মনের মধ্যে অনুরণিত করিয়া, তৃপ্তির সঙ্গে অতৃপ্তি, ভোগের সঙ্গে কৌতূহলকে অনেকদিন ধরিয়া গাঁথিয় গাঁথিয়া পড়িতে পাইয়াছি, তেমন করিয়া পড়িবার সুযোগ আর-কেহ পাইবে না।’৫৩

বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় বঙ্গদর্শন মাত্র চার বৎসর প্রকাশিত হয়ে চৈত্র ১২৮২-র পর বন্ধ হয়ে যায়। পরে তাঁর মধ্যমাগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ১২৮৪ থেকে ১২৮৯ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়ে [৫ম খণ্ড—১২৮৪, ৬ষ্ঠ—১২৮৫, ৭ম—১২৮৭, ৮ম—বৈশাখ-আশ্বিন ১২৮৮ ও ৯ম—১২৮৯], শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদকত্বে কার্তিক-মাঘ ১২৯০ চারটি সংখ্যা বেরোবার পর বঙ্গদর্শন-এর বর্তমান পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। ১৩০৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘বঙ্গদর্শন-নব পর্যায়’ সম্পাদনা শুরু করেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৬

বঙ্গদর্শন প্রকাশের মতো ‘ন্যাশানাল থিয়েটার’ বা ‘জাতীয় নাট্যশালা’ স্থাপন এই বৎসরের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর পূর্বে নাটক অভিনয় হত ধনী ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠিত নিজস্ব নাট্যশালায়—কালীপ্রসন্ন সিংহের বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ, প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের বেলগাছিয়া নাট্যশালা, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়, ঠাকুরবাড়ির জোড়াসাঁকো থিয়েটার প্রভৃতি সবই এই ধরনের রঙ্গমঞ্চ। এখানে যে-সব অভিনয় হত আমন্ত্রিত অতিথিরা ছাড়া সাধারণের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। অথচ পাশাপাশি ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত নাট্যশালায় টিকিট কেটে নাট্যরস-সম্ভোগে কোনো বাধাই ছিল না। উত্তর কলকাতার বাগবাজারে নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রাধামাধব কর, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফী প্রভৃতি কয়েকজন শৌখিন অভিনেতা ‘বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার’ [পরবর্তীকালে ‘শ্যামবাজার নাট্যসমাজ’ নাম দেওয়া হয়] নামে একটি নাটকের দল প্রতিষ্ঠিত করে 1868-এ দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ ও পরে 11 May 1872 [শনি ৩০ বৈশাখ ১২৭৯] তাঁরই লেখা ‘লীলাবতী’ অভিনয় করে যথেষ্ট প্রশংসা লাভ করেন। তাতে উৎসাহিত হয়ে তাঁরা টিকিট বিক্রি করে সর্বসাধারণের জন্য একটি রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবতে শুরু করেন। অর্থ উপার্জন করা এঁদের লক্ষ্য ছিল না, নূতন নূতন নাটক অভিনয় করা এবং স্টেজ, দৃশ্যপট, সাজপোশাক, রূপসজ্জা ইত্যাদির পৌনঃপুনিক ব্যয় মেটানোর জন্যই টিকিট বিক্রির প্রস্তাব করা হয়েছিল। অমৃতবাজার পত্রিকা-র সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষ, মধ্যস্থ-সম্পাদক মনোমোহন বসু, ন্যাশানাল পেপার-সম্পাদক নবগোপাল মিত্র প্রভৃতি এই প্রস্তাব উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন করেন। এই রঙ্গমঞ্চের নাম ‘ন্যাশানাল থিয়েটার’ রাখার পিছনে নবগোপাল মিত্রের প্রেরণাও কার্যকরী ছিল বলে মনে হয়। ‘ন্যাশানাল পেপার’, ‘ন্যাশানাল গ্যাদারিং’ [জাতীয় মেলা], ‘ন্যাশানাল সোসাইটি’, ‘ন্যাশানাল স্কুল’ প্রভৃতির প্রতিষ্ঠাতা নবগোপাল সাধারণ রঙ্গমঞ্চের নামও ‘ন্যাশানাল থিয়েটার’ রাখতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। ন্যাশানাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা যায় ১৬ পৌষ [রবি 29 Dec 1872] ঐ থিয়েটার গৃহে জাতীয় সভার অধিবেশনে নীলকমল মুখোপাধ্যায় ‘জমিদার ও রায়ত’ বিষয়ে বক্তৃতা করেন এবং এই বৎসরে জাতীয় মেলার সপ্তম অধিবেশনে ৬ ফাল্গুন [রবি 16 Feb 1873] ন্যাশানাল থিয়েটার ‘ভারতমাতার বিলাপ’ বা ‘ভারতরাজলক্ষ্মী’ নাটিকা ও ‘নীলদর্পণ’ প্রভৃতি অন্যান্য নাটকের অংশবিশেষ অভিনয় করেন।৫৪ এরই মধ্যে আর্থিক ব্যাপার নিয়ে অধ্যক্ষদের মধ্যে বিবাদ দেখা দিলে 19 Jan 1873 যে সালিশী কমিটি নিযুক্ত হয় নবগোপাল মিত্র তার অন্যতম সদস্য ছিলেন।৫৫ এইগুলি ন্যাশানাল থিয়েটারের সঙ্গে নবগোপাল মিত্রের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রমাণ। যাই হোক, জোড়াসাঁকোয় মধুসূদন সান্যালের ‘ঘড়িওয়ালা বাড়ি’র বহির্বাটীর উঠানটি মাসিক ৪০৲ টাকায় ভাড়া নিয়ে ২৩ অগ্রহায়ণ ১২৭৯ [শনি 7 Dec 1872] দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি অভিনয়ের মাধ্যমে ন্যাশানাল থিয়েটারের শুভ সূচনা হল। টিকিটের মূল্য ছিল প্রথম শ্রেণী এক টাকা ও দ্বিতীয় শ্রেণী আট আনা। আমাদের ধারণা, রবীন্দ্রনাথও এই পর্বে ন্যাশানাল থিয়েটারের অভিনয় দেখতে যান। ক্যাশবহি-তে ২৬ পৌষ [বুধ ৪ Jan 1873] তারিখের হিসাবে দেখা যায় [এটি আমরা পূর্বেও উদ্ধৃত করেছি]: ‘ছেলেবাবুরা থিএটর দেখিতে জান…। উহার দিগের টিকিটের মূল্য/ছোটবাবু মহাশয়ের আদেশমতে নবিনবাবুকে দেওয়া যায়—/১ দফা ৮৲/১ দফা ৮৲’ [দ্বিপেন্দ্রনাথ প্রথমে দর্শনার্থীদের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় পিতামহী সারদা দেবী তাঁর টিকিটের দাম দিয়ে দেন]। এই হিসাব থেকে মনে হয়, এক দিন নয়, দু’দিন ছেলেবাবুরা থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন, কোন্ কোন্ নাটকের অভিনয় তাঁরা দেখেছিলেন? এই সময় পর্যন্ত কেবলমাত্র শনিবারে অভিনয় হত—বুধবারে অভিনয় প্রবর্তিত হয় 15 Jan [৩ মাঘ] থেকে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-প্রদত্ত বিবরণ অনুযায়ী ন্যাশানাল থিয়েটারে 28 Dec 1872 [১৫ পৌষ] ‘সধবার একাদশী’ এবং 4 Jan 1873 [২২ পৌষ] ‘নবীন তপস্বিনী’ অভিনীত হয়!৫৬ আমাদের ধারণা, অন্যান্য বালকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এই দুটি নাটকের অভিনয় দেখেছিলেন। ‘সধবার একাদশী’ অবশ্য ঠিক বালকদের দেখার উপযুক্ত নাটক নয়, কিন্তু ‘ছোটবাবু’ অথাৎ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মধ্যে অভিভাবক-সুলভ মনোভাবের অস্তিত্ব ছিল না বলেই বালকদের পক্ষে এই নাটকের অভিনয় দেখার সুযোগ ঘটেছিল।

এই প্রসঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-রচিত প্রথম নাট্যরচনা ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’-এর কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। বেঙ্গল লাইব্রেরির ক্যাটালগ অনুযায়ী গ্রন্থটির প্রকাশের তারিখ 20 Sep 1872 [শুক্র ৫ আশ্বিন]। এই সময়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক এবং তাঁর নিজের স্বীকৃতি অনুযায়ী কিছু পরিমাণে পুরাতনপন্থী ও স্ত্রী-স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন। আমরা জানি, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে ২৩ মাঘ ১২৭৮ [সোম 5 Feb 1872] কেশবচন্দ্র জয়গোপাল সেনের বেলঘরিয়াস্থিত বাগানে ‘ভারত আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং উক্ত সমাজের উপাসনামন্দিরে খ্রিস্টীয় রীতিতে স্ত্রী-পুরুষের মিলিত উপাসনা প্রবর্তিত করেন। এইগুলিকে ব্যঙ্গ করাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের এই প্রহসনের লক্ষ্য ছিল। গ্রন্থে তাঁর নাম মুদ্রিত না হলেও তিনিই যে এর রচয়িতা এ তথ্য গোপন থাকেনি। তার ফলে ধর্মতত্ত্ব পত্রিকা [১৬ আশ্বিন, ৫।১৭।৭৭৩] এই গ্রন্থ ও তার রচয়িতার বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদগার করে: ‘আমরা শুনিয়া যারপর নাই দুঃখিত হইলাম যে “কিঞ্চিৎ জলযোগ” নামক একখানি নাটক সম্প্রতি প্রকাশিত হইয়াছে। এই পুস্তকে ভারতাশ্রম, ব্রহ্মমন্দির, প্রচারকগণকে বিলক্ষণ গালি দেওয়া হইয়াছে, ব্রাহ্মিকাদিগকেও ইহার মধ্যে আনিয়া গ্রন্থকর্ত্তা যথোচিত আপনার নীচতা ও বিকৃত স্বভাবের পরিচয় দিয়াছেন। আমরা এ কথা শুনিয়া অবাক হইলাম যে উক্ত গ্রন্থকৰ্ত্তা কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের ভক্তিভাজন প্রধান আচার্য্যের পুত্র।…’ কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শন-এ [চৈত্র ১২৭৯।৫৭১-৭৬] গ্রন্থটির যথেষ্ট প্রশংসা করেন। ন্যাশানাল থিয়েটার সান্যাল-বাড়ির প্রাঙ্গণে 8 Mar 1873 [২৫ ফাল্গুন] এই পর্বের শেষ অভিনয় করলেও ১৫ বৈশাখ ১২৮০ শনি 26 Apr শোভাবাজারে রাজা রাধাকান্ত দেবের নাটমন্দিরে মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’র সঙ্গে ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’ও অভিনয় করে।৫৭ এই নাটকের এইটিই প্রথম অভিনয়।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৭

এই বৎসর হিন্দু মেলার সপ্তম অধিবেশন হয় নৈনানে অবস্থিত হীরালাল শীলের বাগানে ৫ ফাল্গুন [শনি 15 Feb 1872] থেকে ৭ ফাল্গুন [সোম 17 Feb] পর্যন্ত। প্রথম দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুরের সভাপতিত্বে সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় মেলা এবং জাতীয় সভার উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতার উল্লেখ করেন এবং হিন্দুজাতির পূর্বগৌরব ও বর্তমান হীন অবস্থার তুলনামূলক আলোচনা করে সকলকে জাতীয় উন্নতিবিধান সম্বন্ধে অবহিত হতে অনুরোধ করেন। রবিবার মেলার প্রধান দিবসে বেলা এগারোটায় রাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুরের সভাপতিত্বে মনোমোহন বসু ‘হিন্দু আচার ব্যবহার—সামাজিক’* নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। দেশজ শিল্প ও কৃষিজাত দ্রব্যের প্রদর্শনী সকলের কাছে আকর্ষণীয় হয়েছিল। ফুল, ফল ও শাকসব্‌জির প্রদর্শনীতে গুণেন্দ্রনাথ ও নীলকমল মুখোপাধ্যায় বিচারক ছিলেন। রমানাথ ঠাকুর শ্রেষ্ঠ মালীদের পুরস্কার প্রদান করেন। এবারে একটি পুস্তক-প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়েছিল। আগেই বলা হয়েছে, এদিন ন্যাশানাল থিয়েটার কর্তৃক ‘ভারত-মাতার বিলাপ’ বা ‘ভারতরাজলক্ষ্মী’ নাটিকা ও ‘নীলদর্পণ’ প্রভৃতি অন্যান্য নাটকের অংশবিশেষ অভিনীত হয়। তৃতীয় দিনে রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে সীতানাথ ঘোষ ‘বঙ্গের সংক্রামক জ্বরের কারণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এই বিষয়টি অবলম্বনে ২৮ জ্যৈষ্ঠ [9 Jun 1872] ভুবনমোহন সরকার জাতীয় সভায় একটি বক্তৃতা দেন। প্রদর্শনীতেও ‘ডেঙ্গু জ্বরাক্রান্ত রোগী’র মৃৎমূর্তি রাখা হয়েছিল। ন্যাশানাল পেপার-এও এ বিষয়ে অনেক সংবাদ ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বোঝা যায় জনসাধারণের শক্তিক্ষয়কারী এই ব্যাধিটির সামাজিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতা কর্তৃপক্ষের মধ্যে দেখা দিয়েছিল। ব্যায়াম-কসরতাদির পর জাতীয় সংগীত গীত হয়ে অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে।

বর্তমান বৎসরের মেলার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো যোগ ছিল না, কারণ মেলা আরম্ভের আগের দিন তিনি পিতার সঙ্গে বোলপুর যাত্রা করেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৮

এইখানে আমরা আর একটি প্রসঙ্গ আলোচনা করে নিতে চাই, যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক ছিল না বলেই মনে হবে, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের উন্নতি সম্পর্কে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা—যা পরবর্তীকালে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ গঠনে পরিণতি লাভ করেছে—সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা শুরু করার পিছনে প্রসঙ্গটির যথেষ্ট মূল্য আছে। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের কর্মচারী জন বীম্‌স [1837-1902] বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে কাজ করার সময়ে ভারতীয় ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গভীর অনুশীলন করেন এবং Outlines of Indian Philology (1867), A Comparative Grammar of the Modern Aryan Languages of India, 3 Vols. [1872-79] ও A Grammar of the Bengali Language, Literary and Colloquial [1894] প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। বর্তমান বৎসরে উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলার কালেক্টর থাকার সময়ে তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা করার জন্য একটি পরিষদ গঠনের প্রস্তাব-সংবলিত একখানি পুস্তিকা রচনা করেন [Suggestions for the formation of an Academy of Literature in Bengali by John Beams, B.C.S. Calcutta Wyman and Co., 1872]। পুস্তিকাটি প্রকাশের পূর্বেই বীম্‌স্‌ বাংলাভাষায় তাঁর বক্তব্য লিখে বঙ্গদর্শন-এ প্রেরণ করেন এবং সেটি বঙ্কিমচন্দ্রের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য-সহ উক্ত পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১২৭৯ [পৃ ১২২-৩০] সংখ্যায় ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সমাজ।/অনুষ্ঠান পত্র।’ নামে মুদ্রিত হয়। সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার দ্বারা ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান ও স্প্যানিশ ভাষা-সমূহের কিরূপ উন্নতি হয়েছে তার বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে বীম্‌স্‌ ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ভাষায় স্থিরতা বিধান জন্য’ একটি সাহিত্য-সমাজ স্থাপনের প্রস্তাব করেন। ভাষাকে প্রণালীবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে অত্যধিক সংস্কৃতানুসারী ও ‘রূঢ়, স্থানীয়, কর্কশ এবং অশ্লীল’ শব্দ-বর্জিত একটি অভিধান সংকলন ও লেখকদের সেই অভিধান অনুসরণ করে চলার জন্য তিনি পরামর্শ দেন। সভার কার্যপদ্ধতি সম্বন্ধে তিনি লেখেন: ‘অভিধান প্রস্তুত করাই সভার মূল কৰ্ম্ম। অথচ ঐ সম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠাদি এবং তর্কবিতর্ক হইবার বাধা নাই। গ্রন্থকারেরা নিজ গ্রন্থ প্রকাশের পূৰ্ব্বে সভাতে পাঠ করিবেন এবং পণ্ডিত সমূহের পরামর্শে তাহার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করিবেন।…সঙ্গীত আলোচনার দ্বারা সভার মনোরঞ্জনও হইতে পারে।’ বীম্‌স্‌ শত-খানেক বাঙালি সভ্যের সঙ্গে হিতৈষী ও বিজ্ঞ কয়েকজন ইংরেজ সভ্য গ্রহণ করার জন্যও সুপারিশ করেন। তাঁর এই প্রস্তাব সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছিল। ন্যাশানাল পেপার [Vol. VII, No 31, Jul 31] ইংরেজি পুস্তিকাটির উপর একটি দীর্ঘ আলোচনা করে জানায়, 11 Aug 1872 [রবি ২৮ শ্রাবণ] তারিখে জাতীয় সভার মাসিক অধিবেশনে রাজনারায়ণ বসু এই বিষয়ে বক্তৃতা করবেন। ঘোষিত সভাপতি রাজেন্দ্রলাল মিত্রের অনুপস্থিতিতে মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি গৃহে অনুষ্ঠিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। মধ্যস্থ [২ ভাদ্র] পত্রিকা লেখে: ‘বঙ্গভাষার বিখ্যাত লেখক রাজনারায়ণ বসু বীম্‌স্‌ সাহেবের প্রস্তাবিত “বাঙ্গলা সাহিত্যের ভাষা ও রীতি সংস্থাপনী সভা” এই প্রসঙ্গোপরি প্রায় তিন ঘণ্টাকাল এক সুদীর্ঘ মৌলিক বক্তৃতা করিয়াছিলেন। তিনি বঙ্গভাষার উৎপত্তি, ইতিহাস, উন্নতি প্রভৃতি সুদীর্ঘরূপে বিবৃত করিয়া পরিশেষে প্রকৃত প্রস্তাব আরব্ধ করেন। …পরে কিয়ৎক্ষণ তর্কবিতর্কের পর সভাপতি মহাশয় এই প্রস্তাব করেন যে সভা কর্তৃক বীম্‌স্ সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়া এই মর্ম্মে এক পত্র লেখা হয় যে তাঁহার মতে সাহিত্য-রীতি সংস্থাপনী সভা না হইয়া একটি সমালোচনা সভা হইলে ভাল হয়। এই প্রস্তাব সভ্যগণ কর্তৃক অনুমোদিত হইলে রাত্রি ৮॥ঘটিকার সময় সভা ভঙ্গ হয়।’৫৮ এই বক্তৃতার প্রতিবেদন বিভিন্ন মন্তব্য-সহ ন্যাশানাল পেপার [No 33, 14 Aug, pp. 391-92]-এ ও রহস্যসন্দর্ভ [৭ পর্ব্ব ৭১ খণ্ড।৭৬-৮০] পত্রিকাতেও৫৯ প্রকাশিত হয়। রামগতি ন্যায়রত্ন তাঁর ‘বাঙ্গালাভাষা ও বাঙ্গালাসাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাব’ [১২৮০] গ্রন্থে৫৯ বীম্‌সের প্রস্তাবের প্রতিকূল সমালোচনা করেন।

বাংলার বিদ্বন্মণ্ডলী বীম্‌সের প্রস্তাব গ্রহণ না করলেও তাঁর আকাঙ্ক্ষা যে সর্বাংশে ব্যর্থ হয়েছিল, সে-কথা বলা যায় না। বীম্‌সের প্রস্তাবিত অভিধান প্রণয়নে ব্রতী না হলেও, সাহিত্যিক ও সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তিদের একত্রিত করে আলোচনা, মতবিনিময়, সাহিত্যপাঠ, বক্তৃতা, সংগীত-পরিবেশন, অভিনয় ইত্যাদি আয়োজন করার কয়েকটি প্রয়াস লক্ষ করা যায়। ৬ বৈশাখ ১২৮১ [18 Apr 1874] জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ‘ন্যূনাধিক ১০০ ব্যক্তি’র উপস্থিতিতে যে ‘বিদ্বজ্জন-সমাগম’ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়, তাকে আমরা উক্ত লক্ষ্যের অভিমুখী মনে করতে পারি। এই বৎসর ১৮ পৌষ [1 Jan 1875] যে ‘কলেজ রি-ইউনিয়ন’ উৎসবের প্রবর্তন ঘটে, অন্য উদ্দেশ্য সত্ত্বেও তা আলোচ্য প্রয়োজনকে অনেকটা সিদ্ধ করেছিল। এরপর ১২৮২ বঙ্গাব্দে* যে ‘বঙ্গ-ভাষা সমালোচনী-সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয় [কয়েকটি অধিবেশনের বিবরণ ছাড়া সভাটির সংগঠন সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছু জানতে পারিনি], তার নামেই প্রমাণ যে বীম্‌সের প্রস্তাব সংগঠকদের অন্যতম প্রেরণা জুগিয়েছিল। ১২৮৯ বঙ্গাব্দে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ যে ‘সারস্বত সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাকেও আমরা এইসব প্রচেষ্টার উত্তরসূরি বলতে পারি। শেষপর্যন্ত ৮ শ্রাবণ ১৩০০ [23 Jul 1893] তারিখে The Bengal Academy of Literature বা বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ প্রতিষ্ঠার ফলে বীম্‌সের মনোবাসনা চরিতার্থ হয়, যার সঙ্গে সূচনার অব্যবহিত পরবর্তী কাল থেকে রবীন্দ্রনাথ আজীবন নানা সূত্রে আবদ্ধ ছিলেন।

উল্লেখপঞ্জি

জীবনস্মৃতি ১৭।২৯৯

ছেলেবেলা ২৬|৬৩০

জীবনস্মৃতি ১৭।২৮৯

‘আশ্রম বিদ্যালয়ের সূচনা’: আশ্রমের রূপ ও বিকাশ ২৭।৩৩২

জীবনের ঝরাপাতা। ৩

জীবনস্মৃতি ১৭।২৮৯

ঐ ১৭।২৮৯-৯০

ঐ ১৭।২৯০

ঐ ১৭।২৯০-৯১

১০ আশ্রমের রূপ ও বিকাশ ২৭।৩৩৩

১১ জীবনস্মৃতি ১৭।২৯১

১২ ঐ ১৭।২৯৯-৩০০

১৩ ঐ ১৭।৩০১

১৪ পত্রাবলী। ৪৯, পত্র ৩৮

১৫ দ্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।৪৩১

১৬ তত্ত্ব, ফাল্গুন।১৭৭

১৭ ঐ।১৮১

১৮ জীবনস্মৃতি ১৭।৩০৬

১৯ ঐ [১৩৬৮]।১৬৭

২০ ঐ ১৭।৩০৭

২১ ঐ ১৭।৩০৯

২২ ঐ ১৭।৩১০

২৩ ঐ ১৭।৩১০

২৪ ঐ ১৭।৩১২

২৫ আশ্রমের রূপ ও বিকাশ ২৭।৩৩৩

২৬ দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৪

২৭ আশ্রমের রূপ ও বিকাশ ২৭।৩৩৩

২৮ জীবনস্মৃতি ১৭।৩১৫

২৯ ছিন্নপত্রাবলী [১৩৬৭]।৩৬৩-৬৪, পত্র ১৬৬

৩০ রবীন্দ্রজীবনী ১[১৩৯২।৪০

৩১ হরিমোহন মুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত ‘বঙ্গভাষার লেখক’ [১৩১১]।৭৯৮

৩২ ছিন্নপত্রাবলী।৩৬৪, পত্র ১৬৬

৩৩ আশ্রমের রূপ ও বিকাশ ২৭।৩৩৪

৩৪ জীবনস্মৃতি ১৭।৩১৬

৩৫ ঐ ১৭।৩১৭

৩৬ ঐ ১৭|৩১৮

৩৭ ঐ ১৭|৩১৬

৩৮ ঐ ১৭।৩১৬-১৭

৩৯ ঐ ১৭|৩১৯

৪০ পূরাতনী।৩৩

৪১ জীবনের ঝরাপাতা।১

৪২ ঐ।১৮

৪৩ দ্র সুশীল রায়: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ [১৩৭০]।২৩৮

৪৪ প্রতিমা দেবী: স্মৃতিচিত্র [১৩৫৯]।৬২

৪৫ ‘কৈফিয়ৎ’: ভারতী, বৈশাখ ১৩২৩।১৬

৪৬ আত্মচরিত [১৩৬৮]।১৫০

৪৭ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।৪৪২

৪৮ রবীন্দ্রজীবনী ১[১৩৯২]।৩৯-৪০

৪৮ক শান্তিনিকেতন আশ্রম।১৩-১৪

৪৯ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ।৫৯-৬০

৫০ সা-সা-চ ২।২২।৪৯-৫০

৫১ বঙ্কিম রচনাবলী ২ [সাহিত্য সংসদ: ১৩৬১]।২৮৩

৫২ ‘বঙ্কিমচন্দ্র’: আধুনিক সাহিত্য ৯।৩৯৯-৪০০

৫৩ জীবনস্মৃতি ১৭।৩৩৩

৫৪ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়: বঙ্গীয় নাট্যশালা|[১৩৫১]।৬৬

৫৫ ঐ।৬৩-৬৪

৫৬ ঐ।৫৭

৫৭ দ্র The Bengalee, 26 Apr 1873

৫৮ সুনীল দাস-সম্পাদিত মনোমোহন বসুর অপ্রকাশিত ডায়েরি [১৩৮৭]।১৮৭

৫৯ দ্র মদনমোহন কুমার: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ইতিহাস [১৩৮১]।১৮১-৮৯

* ক্যাশবহি-তে এই ব্যক্তির কোনো সন্ধান আমরা পাইনি। জীবনস্মৃতি-র প্রথম ও দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিতে এর প্রসঙ্গ নেই, তৃতীয় পাণ্ডুলিপি বা প্রবাসী-র প্রেসকপিতে মার্জিনে সংযোজন হিসেবে এই অংশটি দেখা যায়। শেষ বয়সে রচিত ‘গল্পসল্প’ গ্রন্থে ‘মুনশি’ গল্পে চরিত্রটি আবার আবির্ভূত হয়েছে [দ্র গল্পসল্প ২৬|৩২৫-২৮]। অবনীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর ধারে [১৩৭৮ সং, পৃ ১৮] গ্রন্থে এক ‘ফার্সি পড়াবার মুনশী’র কথা বলেছেন, মনে হয় এঁরা একই লোক।

* অবশ্য ‘গল্পসল্প’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘মুক্তকুন্তলা’ [২৬।৩৫৯-৬১] গল্পে রবীন্দ্রনাথ যে বিবরণ দিয়েছেন, তাতে মনে হয় অভিনয় হয়েছিল। হরিশ্চন্দ্র হালদার সম্পর্কে আরও সংবাদের জন্য দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ২।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘১২৭৯ সালে শীতকালের প্রারম্ভে (১৮৭২ শেষভাগে) দেবেন্দ্রনাথ হিমালয়-ভ্ৰমণাস্তে কলিকাতায় ফিরিয়াছেন—কনিষ্ঠ পুত্রদ্বয় ও জ্যেষ্ঠ দৌহিত্রের উপনয়ন-সংস্কারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।’—রবীন্দ্রজীবনী ১ [১৩৯২]।৩৭। বস্তুত মাঘ ১২৭৮-এ হিমালয় থেকে ফিরে আসার পর তিনি উত্তরবঙ্গের জমিদারি, কার্তিক মাসে বোলপুরে ও অগ্রহায়ণ মাসে ঢাকায় যাওয়া ছাড়া কোনো দূরদেশ-ভ্রমণে যাননি। ৩১ ভাদ্র জাতীয় সভার অধিবেশনে সভাপতিত্ব, ১৩ কার্তিক [সোম 28 Oct] অন্নদাচরণ কাস্তগিরির কন্যার সঙ্গে সিভিলিয়ান বিহারীলাল গুপ্তের বিবাহসভায় উপস্থিতি ও পৌষ মাসে কালনা ব্রাহ্মসমাজের পঞ্চম সাংবৎসরিকে তাঁর যোগদান এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে।

* এই অনুষ্ঠানের বিশদ বিবরণ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র [৮ম কল্প ২য় ভাগ, ৩৫৫ সংখ্যা] চৈত্র ১৭৯৪ শক ২০৩-০৬ পৃষ্ঠায় ‘ব্রাহ্মধর্ম্মের অনুষ্ঠান।/ উপনয়ন।/ সমাবর্ত্তন।’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। জীবনস্মৃতি-র বিস্তৃত গ্রন্থ-পরিচয়-সমণ্বিত স্বতন্ত্র সংস্করণে এটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। দ্র জীবনস্মৃতি [১৩৬৮]। ১৬৫-৬৯

* ‘রবী সোম সত্যপ্রসাদ বাবু দিগের/ কর্ণ বেধ জন্য তিন জোড়া স্বর্ণ বীরবৌলি তৈয়ারির/ স্বর্ণ ক্রয় গিণী এক থান ক্রয়/ ১০৶°’ —ক্যাশবহি, ২৩ মাঘ [মঙ্গল 4 Feb]

* ছেলেবেলা ২৬।৬২৪; অতিরিক্ত তথ্য: ‘দ° ২৬ রোজের ব্রহ্মচারীদিগের খাবার তৈয়ারির জন্য/ বাটীর মধ্যে ছানা ক্রয় করিয়া দেওয়া যায় গুঃ কিনি দাসী।৵°’ —ক্যাশবহি, ২৯ মাঘ [সোম 10 Feb]।

* এই তারিখটি আমাদের অনুমিত। অনুমানের ভিত্তি ২৯ মাঘ-এর একটি হিসাব—‘গত রোজের সমাবর্ত্তনে বেদীতে দেওয়া যায়/৩০৲’

* এই মন্ত্রগুলি রবীন্দ্র-রচনায় সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কোথায় কতবার ব্যবহৃত হয়েছে তার জন্য দ্র ড পম্পা মজুমদার, রবীন্দ্রসংস্কৃতির ভারতীয় রূপ ও উৎস [১৩৭৯]। উপনয়ন-সংক্রান্ত আরও সংবাদের জন্য দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩।

* রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সন্ধ্যার সময় বোলপুরে পৌঁছিলাম’, দুপুরের দিকে যাত্রা শুরু করলে তবেই সন্ধ্যার সময় বোলপুরে পৌঁছনো সম্ভব। তারিখটি নির্ধারিত হয়েছে ক্যাশবহি-র ঐ-তারিখের একটি হিসাব থেকে—‘কর্ত্তাবাবু মহাশয়ের বোলপুর গমন জন্য ব্যয়/উক্ত মহাশয়ের ও রবীবাবুর ফাষ্ট ক্লাস টিকিট/ ১৫’। এইটিই রবীন্দ্রনাথের প্রথম ট্রেন-ভ্রমণ।

* Lett’s Diary: তখনকার দিনের বহুল-প্রচারিত ডায়ারি; বিভিন্ন আকারে ও প্রকারে পাওয়া যেত। The Friend of India পত্রিকায় Thacker Spink & Co.; G.C. Hay & Co. R.C. Lepage & Co. প্রভৃতি বিখ্যাত পুস্তক-বিক্রেতাদের প্রদত্ত বিজ্ঞাপনে এর উল্লেখ দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের বিবরণ অনুসারে মনে হয়, তাঁর ব্যবহৃত ডায়ারিটি ‘Desk Edition’ জাতীয়।

* বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ‘শান্তিনিকেতন/ আশ্রম/ বোলপুর’ লিখিত রাবার স্ট্যাম্প দেওয়া Peer Parley’s Tales পর্যায়ের সাতটি বই আছে(১) Tales About England, Scotland, Ireland and Wales (2) Tales About Plants [1839] (৩) Tales about the United States of America (1865) (8) Universal History on the basis of Geography (৫) Tales about the Sea (1863] (৬) A Grammar of Modern Geography (1855) (৭) Tales about Christmas. এর মধ্যে কোনো কোনো বইয়ের পাতা পর্যন্ত কাটা হয়নি।

* “অমৃতসর হয়ে ডাকের গাড়ি চড়ে প্রথমে পাঠানকোটে গিয়ে পড়লুম। …সেখানকার ছোটো ছোটো পাহাড়গুলো, ‘কর, খল’ ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’—এর বেশি আর নয়। তার পরে ক্রমে ক্রমে যখন উপরে উঠতে লাগলুম, তখন কেবল এই কথাই মনে হতে লাগল, হিমালয় যত বড়োই হোক-না, আমার কল্পনা তার চেয়ে তাকে অনেক দূর ছাড়িয়ে গিয়েছে।”—ভানুসিংহের পত্রাবলী [১৩৬৯]। ২৯-৩০, পত্র ১২

* প্রবন্ধটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময়ে [১৩৬১] উদ্ধৃতিটির শেষাংশ বাদ দিয়ে পাদটীকায় ‘কে রচয়িতা, এ বিষয়ে বিতর্ক আছে’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, দেবেন্দ্রনাথ Feb 1857-এ যখন প্রথম অমৃতসরে গিয়েছিলেন, তখনই স্বর্ণমন্দিরে গুরু নানকের এই ভজনটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, দ্র আত্মজীবনী। ১৮৪-৮৫

* ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসটি অবশ্য আমাদের আলোচ্য পর্বে প্রকাশিত হয়নি; এটি শ্রাবণ ১২৮০ থেকে ভাদ্র ১২৮১ সংখ্যা বঙ্গদর্শন-এ ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত হয়। ‘বিষবৃক্ষ’ সমাপ্ত হবার পর চৈত্র ১২৭৯ সংখ্যায় ‘ইন্দিরা’ সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়। ‘বিষবৃক্ষ’-এর শেষ চারটি অধ্যায় রবীন্দ্রনাথ হয়তো হিমালয়-যাত্রার আগে পড়ার সুযোগ পাননি, দীর্ঘ তিন মাসের প্রতীক্ষার পর প্রবাস থেকে প্রত্যাবর্তন করে তবেই আকাঙক্ষার তৃপ্তি ঘটে।

* এই বিষয়ে প্রথম বক্তৃতা তিনি ১৭ আশ্বিন [বুধ 2 Oct 1872] তারিখে জাতীয় সভার অধিবেশনে প্রদান করেন।

* সময়টি অনুমিত; ২২ মাঘ ১২৮৩ [3 Feb 1877] তারিখে এই সভার ২য় বৎসরের ৩০শ অধিবেশনে সত্যেন্দ্রনাথ ‘বঙ্গদেশ ও বোম্বাই’ সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *