পঞ্চদশ অধ্যায়
১২৮২ [1875-76] ১৭৯৭ শক ॥ রবীন্দ্রজীবনের পঞ্চদশ বৎসর
রবীন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ মাঘ ১২৮১ [Feb 1875]-তে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের স্কুল বিভাগের এন্ট্রান্স ক্লাসের এক ক্লাস নীচে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি, গবর্মেন্ট পাঠশালা বা বেঙ্গল অ্যাকাডেমির সঙ্গে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের বহু দিক থেকেই পার্থক্য ছিল। বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণের মধ্যে গাছপালা ঘেরা স্কুল বাড়িটি ঠিক খাঁচা ছিল না, এখানকার শিক্ষকেরাও অন্য স্কুলের শিক্ষকদের মতো ছিলেন না—তবু রবীন্দ্রনাথ এই পরিবেশের সঙ্গেও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলেন না। তিনি লিখেছেন : ‘যে-বিদ্যালয় চারিদিকের জীবন ও সৌন্দর্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন জেলখানা ও হাঁসপাতাল-জাতীয় একটা নির্মম বিভীষিকা, তাহার নিত্য-আবর্তিত ঘানির সঙ্গে কোনোমতেই আপনাকে জুড়িতে পারিলাম না।’১
এরই মধ্যে সেন্ট জেভিয়ার্সের যে পবিত্রস্মৃতি তাঁর মনে দীর্ঘকাল অম্লান থেকেছে, তা সেখানকার একজন অধ্যাপকের স্মৃতি। তাঁর পুরো নাম রেভারেণ্ড আলফোনসাস ডি পেনারাণ্ডা [1834-96]। এঁর সম্পর্কে জনৈক H.W.B. Moreno 9 Mar 1931 রবীন্দ্রনাথকে লেখেন: ‘I was about those days—perhaps a little later,-in S. Xaviers’…He was a Spanish Count and gave up all when he entered the Order. He was a real ascetic. He was a brilliant musician; and played excellently on the piano; but he gave up all for Jesus as he frequently say. …He was a wonderful mathematician and astronomer.’২ রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র এঁর সম্বন্ধে বলেছেন: ‘শুনেছিলুম তিনি স্পেনদেশের একটি সম্ভ্রান্ত ধনীবংশীয় লোক, ভোগৈশ্বর্য সমস্ত পরিত্যাগ করে ধর্মসাধনায় জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর পাণ্ডিত্যও অসাধারণ কিন্তু তিনি তাঁর মণ্ডলীর আদেশক্রমে এই দূর প্রবাসে এক বিদ্যালয়ে নিতান্ত নিম্নশ্রেণীতে অধ্যাপনার কাজ করছেন।’৩ স্পেনীয় বলে তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ কিছু পরিমাণে বিকৃত ছিল, ফলে ছাত্রেরা তাঁর ক্লাসের শিক্ষায় যথেষ্ট মনোযোগ দিত না। তাঁর মুখশ্রীও সুন্দর ছিল না, কিন্তু তাঁকে দেখলে রবীন্দ্রনাথের মনে হত, ‘তিনি সর্বদাই আপনার মধ্যে যেন একটি দেবোপাসনা বহন করিতেছেন—অন্তরের বৃহৎ এবং নিবিড় স্তব্ধতায় তাঁহাকে যেন আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।’* কপি করার জন্য রুটিনে আধঘণ্টা নির্দিষ্ট ছিল, এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ কলম হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক থাকতেন। একদিন ফাদার ডি পেনেরাণ্ডা সেই ক্লাস দেখাশুনো করার সময় প্রত্যেক বেঞ্চির পিছনে পদচারণা করে যাচ্ছিলেন। হয়তো কয়েকবার তিনি লক্ষ্য করে থাকবেন যে রবীন্দ্রনাথ কিছুই লিখছেন না। একবার তিনি তাঁর পিছনে থেমে নত হয়ে তাঁর পিঠে হাত রেখে সস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘টাগোর, তোমার কি শরীর ভালো নাই?’ এই স্মৃতি রবীন্দ্রনাথ কখনো ভোলেননি। তাই তিনি লিখেছেন: ‘অন্য ছাত্রদের কথা বলিতে পারি না কিন্তু আমি তাঁহার ভিতরকার একটি বৃহৎ মনকে দেখিতে পাইতাম—আজও তাহা স্মরণ করিলে আমি যেন নিভৃত নিস্তব্ধ দেবমন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিবার অধিকার পাই।’৪
কিন্তু স্কুলের সকল শিক্ষক সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ খুব সপ্রশংস মনোভাবের পরিচয় দিতে পারেননি। সাধারণ শিক্ষকেরা যেমন শিক্ষাদানের কল হয়ে উঠে বালকদের হৃদয়ের দিকে পীড়িত করে থাকেন এঁরা তার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি, উপরন্তু ধর্মানুষ্ঠানের বাহ্য আয়োজনের জাঁতায় পিষ্ট হয়ে তাঁদের হৃদয়প্রকৃতি আরও শুষ্ক হয়ে উঠেছিল, সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ এঁদের মধ্যে ‘ভগবদ্ভক্তির গম্ভীর নম্রতা’ লক্ষ্য করেননি। তিনি লিখেছেন: ‘যাহারা ধর্মসাধনার সেই বাহিরের দিকেই আটকা পড়িয়াছে তাহারা যদি আবার শিক্ষকতার কলের চাকায় প্রত্যহ পাক খাইতে থাকে, তবে উপাদেয় জিনিস তৈরি হয় না—আমার শিক্ষকদের মধ্যে সেইপ্রকার দুইকলে ছাঁটা নমুনা বোধকরি ছিল।’৫ এই ধরনের বিশ্লেষণ নিশ্চয়ই পরিণত চিন্তার ফসল, কিন্তু সূক্ষ্ম অনুভূতিশীল রবীন্দ্রনাথের কবিমন বিদ্যালয়ের বাঁধাধরা পাঠ্যসূচি ও শিক্ষকদের নিরানন্দ হৃদয়স্পর্শশূন্য শিক্ষাপদ্ধতির চাপে ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহ করেছে। ফলে অভিভাবকদের এই নূতন পরীক্ষাও তাঁর ক্ষেত্রে সার্থক হয়নি।
বেঙ্গল অ্যাকাডেমি থেকে পালানোর ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ মুন্শির সহায়তা পেয়েছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পালানোর উপায় তাঁকে নিজেকেই করে নিতে হয়েছে অসুস্থতার ছুতো করে। অথচ রবীন্দ্রনাথ নিজেও বারবার বলেছেন এবং ক্যাশবহি-র হিসাব থেকেও আমরা জানতে পারি যে, শিশু বয়স থেকেই তাঁর স্বাস্থ্য ছিল অত্যন্ত ভালো। এই হিসাব থেকে মাত্র তিনটি ক্ষেত্রে তাঁর অসুস্থতার খবর পাওয়া যায়: ১১ আশ্বিন ১২৭৭ [সোম 26 Sep 1870] ‘সোম রবী সত্যপ্রসাদ বাবু ও শ্ৰীমতী বৰ্ণর পীড়া হওয়ায় পামরূটী’; ১৬ আষাঢ় ১২৭৮ [বৃহ 29 Jun 1871] ‘রবীন্দ্রবাবুর কাণে ঘা হওয়ায় পিসকারি খরিদ’ এবং ঐ বৎসরেরই ১৩ আশ্বিন [বৃহ 28 Sep] ‘ব° বাবু মহেন্দ্রলাল সরকার ডাক্তার/দ° রবীন্দ্রবাবুর কাশী হওয়ায় উক্ত ডাক্তারের ফি শোধ বিঃ এক বৌচর ১০৲’—মনে হয় এদের মধ্যে শেষের অসুখটিই একমাত্র গুরুতর রূপ ধারণ করেছিল, নইলে তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি চিকিৎসক ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। এম. ডি.-কে ডাকা হত না বাড়িতে দুজন পারিবারিক চিকিৎসক থাকা সত্ত্বেও। চোদ্দ বছরে মাত্র তিনবার অসুস্থতা! এর পাশাপাশি শুধু বর্তমান ১২৮২ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের জন্য কতবার চিকিৎসককে আহ্বান করতে হয়েছে এবং ঔষধাদির প্রয়োজন হয়েছে আমরা শুধু তারিখ-সহ তার তালিকা করে দিচ্ছি, আশা করি কোনো বিশ্লেষণ ছাড়াই পাঠক এর থেকে যা বোঝবার ঠিকই বুঝে নিতে পারবেন। তালিকার শুরু ১৯ শ্রাবণ [মঙ্গল 3 Aug] ‘রবিবাবুর চিকিৎসার জন্য ব্রজেন্দ্র কবিরাজের বিজিট… ৬৲’ [তাঁর ভিজিট ছিল ২৲, সুতরাং তিনবার তিনি রোগীকে দেখেছেন], এরপর ১৫ ভাদ্র [সোম 30 Aug] ‘রবীবাবুর অসুখ হওয়ায় ব্রজেন্দ্রনাথ কবিরাজের ফি শোধ/বিঃ দুই বৌচর ৪৲’ ও ‘ব° ঐ/দ° রবীবাবুর অসুখ হওয়ায়/ঔষধের অনুপাণ জন্য মুগের ডাউল ক্রয়’; ৮ আশ্বিন [বৃহ 23 Sep] ‘ব° ব্রজেন্দ্রনাথ কবিরাজ/রবীবাবুর পিড়া হওয়ার ঔষধ ক্রয় এক বিল—১৯, ৯ আশ্বিন ‘রবীন্দ্রনাথবাবুর পিড়ার জন্য/ব্রজেন্দ্রনাথ কবিরাজের বিজিট/৫। ৬ আশ্বিনের দুই বৌচর —৪৲, ও ১২ আশ্বিন ‘রবীবাবুর অসুখ হওয়ায়/ব্রজেন্দ্র কবিরাজের বিজিট… ২৲’; ১৮ অগ্রহায়ণ [শুক্র 3 Dec] ‘রবীবাবু ও সতীশবাবুর পুত্রের পীড়া হওয়ায় নিলমাধব ডাক্তার ও ব্রজেন্দ্র কবিরাজের জাতের গাড়ি ভাড়া। মনে রাখতে হবে আশ্বিন ও কার্তিক মাসের অনেকটাই কেটেছে পুজোর ছুটিতে, হয়তো সেই কারণেই চিকিৎসকের আনাগোনায় দীর্ঘকালের ছেদ দেখা যায়! সজনীকান্ত দাস মন্তব্য করেছেন, রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত “ইর্রেগুলার” ছিলেন; প্রায়শই কামাই করিতেন’৬—উপরোক্ত তথ্য থেকে তার পটভূমিকাটি আমাদের কাছে যথেষ্ট স্পষ্ট হয়েই দেখা দেয়।
এই বৎসরেও যথারীতি জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য ও রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য [বিদ্যাভূষণ] তাঁদের গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। স্কুলের সংস্কৃত পাঠ্য না থাকলেও গৃহে সংস্কৃতচর্চা যে অব্যাহত ছিল রামসর্বম্বের উপস্থিতিই তা বুঝিয়ে দেয়। এমন যুক্তি অবশ্য দেখানো সম্ভব যে, রামসর্বস্ব দ্বিপেন্দ্র প্রভৃতি অন্যান্য বালকদের শিক্ষার জন্যই নিযুক্ত ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর শিক্ষকতার কোনো যোগ ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও রামসর্বস্বের যোগাযোগের এত প্রমাণ রয়েছে [আমরা এই অধ্যায়েই তা দেখতে পাব] যে। এমন যুক্তি মেনে নেওয়া শক্ত। বরং আমাদের ধারণা, রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছেন ‘অনিচ্ছুক ছাত্রকে ব্যাকরণ শিখাইবার দুঃসাধ্য চেষ্টায় ভঙ্গ দিয়া তিনি আমাকে অর্থ করিয়া করিয়া শকুন্তলা পড়াইতেন’৭—সেটি এই সময়েরই ঘটনা। জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের মতো তিনি ছাত্রকে দিয়ে নাটকটির কোনো অনুবাদ করিয়েছিলেন কিনা জানা যায় না—খুব সম্ভব করাননি—কিন্তু এই পাঠের পরোক্ষ প্রভাব ছড়িয়ে আছে কিছু পরে লেখা ‘বনফুল’ কাব্যে এবং প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায় পূর্বের অধ্যায়ে উল্লিখিত উক্ত নাটকের প্রথম অঙ্কের শেষ শ্লোকটির দুটি অনুবাদে। বোঝা যায়, কালিদাসের এই শ্রেষ্ঠ নাটকটি তাঁর বালকমনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল যা তাঁর পরিণত মনের গঠনে অনেক বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করেছে। অনুবাদ দুটি সম্ভবত আরও কিছু পরবর্তীকালের, তাই সেগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করবার আগে আর একটি প্রসঙ্গ সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া দরকার।
এই বয়সেই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কবিপ্রতিভার যে লক্ষণগুলি প্রকাশ পেয়েছিল, তার প্রতি নিস্পৃহ থাকা পরিচিত কারোর পক্ষেই সম্ভব ছিল না। ফলে বিদ্যালয়গত শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অবহেলা সকলের পক্ষেই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাজনারায়ণ বসু শিক্ষকতা কার্য ত্যাগ করে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করার পর জোড়াসাঁকো বাড়ির সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। সুতরাং এই সুকণ্ঠ বালকের কবিপ্রতিভা তাঁর অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। হয়তো রবীন্দ্রনাথের বহু বাল্যরচনা তাঁর সহৃদয় সমাদর লাভে উৎসাহদায়ী হয়ে উঠেছিল। সে-সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কিছু না লিখলেও তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটি উজ্জ্বলভাবে চিত্রিত করেছেন: ‘ছেলেবেলায় রাজনারায়ণবাবুর সঙ্গে যখন আমাদের পরিচয় ছিল তখন সকল দিক হইতে তাঁহাকে বুঝিবার শক্তি আমাদের ছিল না। তাঁহার মধ্যে নানা বৈপরীত্যের সমাবেশ ঘটিয়াছিল। তখনই তাঁহার চুলদাড়ি প্রায় সম্পূর্ণ পাকিয়াছে কিন্তু আমাদের দলের মধ্যে বয়সে সকলের চেয়ে যে-ব্যক্তি ছোটো তার সঙ্গেও তাঁহার বয়সের কোনো অনৈক্য ছিল না। তাঁহার বাহিরের প্রবীণতা শুভ্র মোড়কটির মতো হইয়া তাঁহার অন্তরের নবীনতাকে চিরদিন তাজা করিয়া রাখিয়া দিয়াছিল। এমন-কি, প্রচুর পাণ্ডিত্যেও তাঁহার কোনো ক্ষতি করিতে পারে নাই, তিনি একেবারেই সহজ মানুষটির মতোই ছিলেন।’৮ সুতরাং রাজনারায়ণ বসু স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এই কবি-বালকটির যথাযথ শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হবেন এটাই স্বাভাবিক। ‘ঘরের পড়া’ যুগেই তাঁর এই মনোযোগ পড়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘বক্রোটা শেখর’ থেকে তাঁকে লেখা দেবেন্দ্রনাথের ১২ আশ্বিন ১৭৯৬ শক [১২৮১ : রবি 27 Sep 1874] তারিখের পত্রে: ‘… রবীন্দ্রের তত্ত্বাবধারণ মধ্যে মধ্যে করিয়া থাক, ইহাতে আমি অতীব সন্তোষ লাভ করিয়াছি।’৯ বর্তমান বৎসরেও ‘বক্রোটা শেখর’ থেকে ১১ শ্রাবণ [সোম 26 Jul] তারিখের পত্রে তিনি লিখেছেন : ‘…রবীন্দ্রর ইংরাজী পড়া যে ভাল হইতেছে আমার এমন বোধ হয় না, তুমি তাহাকে শ্রেষ্ঠ ইংরাজী কবিদিগের এক ফর্দ করিয়া দিয়াছ। তাহা কি রবীন্দ্র আপনা আপনি পড়িয়া বুঝিতে পারিবে।’১০ আমাদের কাছে পত্রগুলির ধারা একমুখী, কারণ রাজনারায়ণের লিখিত পত্রগুলি রক্ষিত হয়নি; যদি সেগুলি পাওয়া যেত, সমস্ত বিষয়টি উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু এর থেকেই আমরা অনুমান করতে পারি, জন্ম-শিক্ষক রাজনারায়ণ রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি-শিক্ষা ও কবিত্বশক্তির বিকাশের উপযোগী করে সযত্নে তাঁর পাঠ্যতালিকা রচনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই চেষ্টা যথেষ্ট সুফল প্রসব করতে পারেনি। সজনীকান্ত দাস এ-সম্পর্কে লিখেছেন : দেবেন্দ্রনাথ ঠিকই সন্দেহ করিয়াছিলেন। রাজনারায়ণের নিৰ্বাচিত “শ্রেষ্ঠ” ইংরেজী কবিরা রবীন্দ্রনাথকে মোটেই আকর্ষণ করিতে পারেন নাই। রবীন্দ্রনাথকে এই তালিকার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। রবীন্দ্রনাথের মনে আছে, এই কবিকুলের শিরোভাগে ছিলেন—Mark Akenside; তাঁহার The Pleasures of Imagination এবং Dodsley-র কবিতা সংগ্রহে (Collection of Poems) “Human to the Naiads” রবীন্দ্রনাথের imagination কে মোটেই অধিকার করিতে পারে নাই। রাজনারায়ণবাবু পরাস্ত হইয়াছিলেন।’১১
আমাদের ধারণা, রাজনারায়ণবাবুর এই কবিতার তালিকার সূত্রেই অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত হয়। Akenside-এর কবিতার পাণ্ডিত্য রবীন্দ্রনাথের কাব্যানুভূতিকে উদ্দীপ্ত করতে সমর্থ ছিল না, এবং ঠিক সেইখানেই অক্ষয়চন্দ্রের উপযোগিতা ছিল অসাধারণ। ‘সাহিত্যভোগের অকৃত্রিম উৎসাহ সাহিত্যে পাণ্ডিত্যের চেয়ে অনেক বেশি দুর্লভ। অক্ষয়বাবুর সেই অপর্যাপ্ত উৎসাহ আমাদের সাহিত্যবোধশক্তিকে সচেতন করিয়া তুলিত।’১২ রবীন্দ্রনাথের মানসগঠনের পক্ষে এইটির প্রয়োজনই বেশি ছিল। তাই অক্ষয়চন্দ্র যখন অনেক রাতে দাদাদের সভা থেকে বিদায় নিতেন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে টেনে আনতেন নিজেদের ইস্কুল-ঘরে। সেখানে রেড়ির তেলের মিটমিটে আলোতে পড়বার টেবিলের উপর বসে সভা জমিয়ে তুলতে তাঁর কোনো কুণ্ঠা ছিল না। ‘এমনি করিয়া তাঁহার কাছে কত ইংরেজি কাব্যের উচ্ছ্বসিত ব্যাখ্যা শুনিয়াছি, তাঁহাকে লইয়া কত তর্কবিতর্ক আলোচনা-সমালোচনা করিয়াছি। নিজের লেখা তাঁহাকে কত শুনাইয়াছি এবং সে-লেখার মধ্যে যদি সামান্য কিছু গুণপনা থাকিত তবে তাহা লইয়া তাঁহার কাছে কত অপর্যাপ্ত প্রশংসালাভ করিয়াছি।’১২ মনে হয় এই ইংরেজি সাহিত্য-চৰ্চা সূত্রেই মালতীপুঁথি-তে পূর্বোল্লিখিত টমাস মূরের ‘আইরিশ মেলডিস্’ ও বায়রনের ‘চাইল্ড হ্যারল্ড’স্ পিলগ্রিমেজ’ থেকে অনুবাদগুলি করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : আমাদের বাড়িতে পাতায় পাতায় চিত্রবিচিত্র-করা কবি অ্যারের রচিত একখানি আইরিশ মেলডীজ ছিল। অক্ষয়বাবুর কাছে সেই কবিতাগুলির মুগ্ধ আবৃত্তি অনেকবার শুনিয়াছি। ছবির সঙ্গে বিজড়িত সেই কবিতাগুলি আমার মনে আয়র্লণ্ডের একটি পুরাতন মায়ালোক সৃজন করিয়াছিল।’১৩ উদ্ধৃতিটিতে অক্ষয়চন্দ্রের উল্লেখ অনুবাদগুলির সঙ্গে তাঁর যোগটিকে স্পষ্টতর করে। রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত এই বইটি বর্তমানে শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সুরক্ষিত রয়েছে। এর আখ্যাপত্রটি এইরূপ : MOORE’S IRISH MELODIES/ILLUSTRATED BY/D. MACLISE, R. A./LONDON:/PRINTED FOR/LONGMAN, BROWN, GREEN, AND LONGMANS,PATERNOSTER ROW./1846.* বইটিতে সর্বমোট ৩৪টি কবিতা টি (tick)-চিহ্ন দেওয়া—যার অনেকগুলিই রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে অনুবাদ করেছিলেন। এর ১৩৭-৩৮ পৃষ্ঠার “The Journey Onwards’ কবিতাটির ১ম, ৩য় ও ৪র্থ স্তবকগুলির অনুবাদ মালতীপুঁথি-র 4/২খ পৃষ্ঠায় প্রথমেই দেখা যায়। আমাদের অনুমান, এ-যাবৎ রবীন্দ্রনাথের যে অনুবাদ কবিতাগুলি পাওয়া গেছে, এইটিই তাদের মধ্যে প্রাচীনতম। সেই দিক থেকে কবিতাটির একটি ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এর মধ্যে প্রথম স্তবকটি প্রথম বর্ষ ভারতী-র সপ্তম সংখ্যা [মাঘ ১২৮৪]-তে ৩২৬ পৃষ্ঠায় ‘সম্পাদকের বৈঠক/অনুবাদ’ বিভাগে ‘বিচ্ছেদ’ শিরোনামে মুদ্রিত হয়, নীচে ‘Moore’s Irish Melodies’ লেখা ছিল [রচনাটি সম্পর্কে একটু পরে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব]। অনুবাদ কবিতাটির অপর দুটি স্তবক কোথাও মুদ্রিত হয়েছিল বলে জানা যায় না [বর্তমানে অবশ্য রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা প্রথম খণ্ডে পুরো মালতীপুঁথি-টিই মুদ্রিত হয়েছে। এই পৃষ্ঠায় অনূদিত দ্বিতীয় কবিতাটিও উক্ত গ্রন্থের ১৩৩-৩৪ পৃষ্ঠার ‘Come, rest in this. bosom,my own stricken deer’ কবিতাটির অনুবাদ, ভারতী-র উপরোক্ত সংখ্যায় ‘জীবন উৎসর্গ’ নামে প্রকাশিত হয়, যার প্রথম পঙ্ক্তিটি হল—এস এস এই বুকে, নিবাসে তোমার’ [দ্র রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা ১। ৫]। ভারতী ও রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা-র [২-৬ পঙক্তি খণ্ডিত) পাঠ চতুর্দশ মাত্রার পয়ারে গঠিত, কিন্তু মালতীপুঁথি-তে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ প্রথম কবিতাটি ৮+৮+১০ মাত্রার ত্রিপদীতে অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু ন’টি ছত্র লেখার পর পুরোটা কেটে দিয়ে অন্য রীতিতে লেখেন—এই ধরনের পরিবর্তন পরেও রবীন্দ্রনাথ বহুবার করেছেন, বর্তমান দৃষ্টান্তটি তার প্রথমতম প্রাপ্ত নিদর্শন।
এই পৃষ্ঠায় লিখিত অপর দুটি অনুবাদই বায়রনের ‘চাইল্ড হ্যারল্ড’স্ পিলগ্রিমেজ’ গ্রন্থ থেকে করা। প্রথমটি ‘কষ্টের জীবন’ [শিরোনামটি পুঁথিতেই আছে; প্রথম পঙ্ক্তি—‘মানুষ কাঁদিয়া হাসে, পুনরায় কাঁদে গো হাসিয়া’] উক্ত কাব্যের তৃতীয় সর্গ [Canto the Third]-এর ৩২, ৩৩ ও ৩৪ সংখ্যক স্তবকের অনুবাদ, শেষ স্তবকটির শেষ আড়াইটি ছত্র অনুবাদ করা হয়নি। [অনুবাদটি শুরু হয়েছিল ‘গভীর হৃদয় তলে আছে যত প্রাণের কথন’ পঙ্ক্তিটি লিখে, সম্ভবত ৩০ সংখ্যক স্তবকটি থেকে অনুবাদ করার ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু সেটি কেটে দিয়ে ৩২ সংখ্যক স্তবক থেকে আরম্ভ করেন।] এইটি ভারতীর উক্ত সংখ্যায় [পৃ ৩২৬-২৭] প্রকাশিত হয়েছিল। পরের অনুবাদটি বায়রনের উক্ত কাব্যের দ্বিতীয় সর্গের ১৫ সংখ্যক স্তবকটি থেকে করা, অনুবাদের শেষের চার পক্তি পরবর্তী 5/৩ক পৃষ্ঠায় বিস্তৃত হয়েছে; যার পর থেকে পূর্বোক্ত কুমারসম্ভব-এর অনুবাদটির সূচনা। বায়রন থেকে করা এই অনুবাদটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি।
আলোচ্য অনুবাদটির প্রথম চার পঙ্ক্তি হচ্ছে:
‘ভালবাসে যারে তার চিতাভষ্ম[স্ম]পানে
প্রেমিক যেমন চায় কাতর নয়ানে
তেমনি যেন তোমাপানে নাহি চায় গ্রীস্
তাহার হৃদয়মন পাষাণ কুলিশ।’
এরই ডান পাশে কাত করে লেখা চারটি পঙ্ক্তি দেখা যায়, যার কিয়দংশ অবলুপ্ত হয়ে গেছে:
‘[শরীর] সে ধীরে ২ যাইতেছে আগে
[অধীর] হৃদয় কিন্তু চায় পিছু বাগে
… … … যায় যবে তরী।
… … আগে ধায় ফিরি ২।’
—এ-সম্পর্কে প্রবোধচন্দ্র সেন লিখেছেন : ‘বলা বাহুল্য, ‘ভালবাসে যারে তার’ ইত্যাদি রচনার পাশেই এই চার পংক্তি লেখার কারণ হচ্ছে দুটি রচনার ভাবগত (আংশিক) সাদৃশ্য। শেষোক্ত চার পংক্তি রবীন্দ্রনাথের নিজের রচিত। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ পংক্তি-দুটি তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাই তাঁকে ওই দুটি পংক্তি নূতন করে লিখতে হয়েছিল নিম্নলিখিত রূপে—
“ধ্বজা লয়ে গেলে যথা প্রতিকূল বাতে
অংশুক তাহার মুখ ফিরায় পশ্চাতে।”
—মালতীপুঁথি, পৃ ৬ দ্বিতীয় স্তম্ভ
এই পংক্তি-দুটি স্থান পেয়েছে কুমারসম্ভব তৃতীয় সর্গের পদ্যানুবাদের (পৃ ৫-৬) ঠিক পরেই। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, আলোচ্যমান চারটি পংক্তি কালিদাসের একটি শ্লোকের অনুবাদ।’১৪ এর পর তিনি অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটকের প্রথম অঙ্কের শেষ শ্লোক ‘গচ্ছতি পুরঃ শরীরং’ ইত্যাদি উদ্ধৃত করেছেন।
অধ্যাপক সেন এবার উক্ত চারটি পঙ্ক্তিকে ‘রবীন্দ্রনাথের নিজের রচিত’ বলেছেন, আবার পরে তাকেই ‘কালিদাসের একটি শ্লোকের অনুবাদ’ বলে উল্লেখ করেছেন! কিন্তু এই অসংগতিটুকু ছেড়ে দিয়েও, তাঁর মূল প্রতিপাদ্য অথাৎ ‘ভালবাসে যারে তার’ ইত্যদির সঙ্গে এই চারটি পঙক্তির ভাবগত (আংশিক) সাদৃশ্য আমরা মেনে নিতে পারছি না। একথা ঠিকই যে পঙ্ক্তি চারটি বায়রনের উক্ত কবিতার অনুবাদের পাশেই লিখিত হয়েছে, কিন্তু তা সাদৃশ্যের কারণে নয়—অন্যত্র লেখার উপযুক্ত স্থানের অভাবে। প্রকৃতপক্ষে এই চারটি পঙ্ক্তির ‘সম্পূর্ণ’ ভাবগত সাদৃশ্য রয়েছে একই পৃষ্ঠায় লেখা প্রথম পদ্যানুবাদটির সঙ্গে; মূর ও বায়রনের কবিতাগুলি অনুবাদ করার পর রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণের কাছে শকুন্তলার প্রথম অঙ্কটি পড়বার সময়েই তার শেষ শ্লোকটি সঙ্গে মূরের কবিতাটির প্রথমাংশের আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ ঐ শ্লোকটির অনুবাদ করেন ও পৃষ্ঠার উপরে যথেষ্ট জায়গা না থাকায় নীচে একপাশে সেটি লিপিবদ্ধ করেন। আমরা মূল ইংরেজি কবিতা ও তার বঙ্গানুবাদের প্রাসঙ্গিক অংশটুকু পাশাপাশি উদ্ধৃত করছি, তাতে একই সঙ্গে আমাদের সিদ্ধান্ত ও রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের উৎকর্ষ প্রতিপন্ন হবে :
‘As slow our ship her foamy track
Against the wind was cleaving,
Her trembling pennant still look’d back
To that dear isle ‘twas leaving’.
‘প্রতিকূল বায়ুভরে ঊর্ম্মিময় সিন্ধুপরে
তরীখানি যেতেছিল ধীরি,
কম্পমান কেতু তার, চেয়েছিল কতবার্র
সে দ্বীপের পানে ফিরি ফিরি।’
—আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, এই স্তবকটি ‘বিচ্ছেদ’ শিরোনামে ভারতী-তে প্রকাশিত হয়েছিল; আর শকুন্তলা’র উক্ত অনুবাদটিও ভারতী-র একই সংখ্যায় একই বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে [পৃ ৩২৫], সেটিরও শিরোনাম ছিল ‘বিচ্ছেদ’। রামসর্বশ্বের কাছে শকুন্তলা পড়ার সুফলের সমকালীন নিদর্শন এটি।
আমাদের ধারণা, মালতীপুঁথি-তে কুমারসম্ভবের তৃতীয় সর্গ থেকে অকাল বসন্ত ও মদনভস্মের যে অনুবাদ পাওয়া যায় সেটি উপরোক্ত ইংরেজি অনুবাদগুলির পরে করা হয়েছে; শকুন্তলা পাঠ ও অনুবাদ তারও পরবর্তীকালের।
কিন্তু জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য ও রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভা বিকাশে যথেষ্ট সহায়তা করলেও স্কুলের পাঠ্যবিষয়ের প্রতি মনোযোগী করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। তাঁরা অবশ্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। মালতীপুঁথি-র কয়েকটি পৃষ্ঠায় সংস্কৃত ও ইংরেজি অনুবাদ-চর্চার কয়েকটি নিদর্শন পাওয়া যায় [দ্র পৃ1/১ক, 40/২১খ, এবং সম্ভবত 32/১৭খ পৃষ্ঠায় ‘ঝান্সী রাণী’ রচনাটি], সেগুলি পাঠাভ্যাসের জন্যই করা হয়েছিল।
যাই হোক, সবরকম সদিচ্ছা ও আয়োজন থাকা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তা সার্থক হতে পারেনি। অসুস্থতা ইত্যাদি অজুহাতে তিনি প্রায়ই স্কুল কামাই করেছেন, আর গৃহশিক্ষকেরা তাঁকে বাঁধা পথের শিক্ষায় চালিত করতে না পেরে ম্যাকবেথ, কুমারসম্ভব, শকুন্তলা ইত্যাদি পড়িয়ে অন্য পথে হলেও কিছুটা শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং তা রবীন্দ্রনাথের জীবনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা আমরা উপরোক্ত আলোচনায় দেখতে পেয়েছি। কিন্তু স্কুলে পড়লে স্কুলের নিয়ম কিছু মানতে হয়, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে গেলে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকও পড়তে হয়। তার কিছুই না করার জন্য সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের 1876-এর রেকর্ডে দেখা যায়, সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ এন্ট্রান্স ক্লাসে পৌঁছে গেলেও রবীন্দ্রনাথ ফিফ্থ্ ইয়ার’স্ ক্লাসেই রয়ে গেছেন। এখানেও তাঁর নাম Tagore, Nubindronath রূপেই মুদ্রিত হয়েছে, স্কুলের খাতায় নিজের নাম বিশুদ্ধ ও উজ্জ্বল করে রাখবার দিকে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না, এটা তারই প্রমাণ! রবীন্দ্রনাথ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি কিংবা পরীক্ষা দিতেই যাননি—এ-সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়; তবে শেষোক্ত সম্ভাবনাটিই প্রবল। এর পরে অবশ্য বেশিদিন স্কুলের খাতায় নাম টিকিয়ে রাখার কষ্টও রবীন্দ্রনাথকে ভোগ করতে হয়নি। ২৬ মাঘ [মঙ্গল ৪ Feb 1876]-এর হিসাবে দেখা যায় : ব° সেন্ট জেবিয়ার্স কলেজ/ দং সোম রবী সত্ত্বপ্রসাদ বাবু দিগের/১৮৭৫ সালের নবেম্বর হইতে ১৮৭৬ সালের মার্চ পয্যন্ত পাঁচ মাসের ফি শোধ/৮ হিঃ মাসিক ২৪, হিসাব/গুঃ সত্ত্যপ্রসাদবাবু/নোট—১২০৲’। এর পর যখন ২০ চৈত্র [শনি1 Apr] তারিখে বেতন দেওয়া হয়েছে, তখন তাতে রবীন্দ্রনাথের নাম অনুপস্থিত: ‘ব° সেন্ট জাবিয়াৰ্শ কলেজ/দং সোমবাবু ও সত্ত্যবাবুর এপ্ৰেল মাহার/ ফি শোধ/ গুঃ সত্যপ্রসাদবাবু—১৬৲। স্পষ্টই বোঝা যায় অভিভাবকেরা আর অনর্থক খরচের বোঝা বহন করে যাওয়া যুক্তিযুক্ত মনে করেননি।
1876-এ রবীন্দ্রনাথের ক্লাসে বাঙালি সহপাঠী ছিলেন কৃষ্ণকিশোর বসু, নবকিশোর বসু, শ্রীশচন্দ্র বসু, গোকুলচন্দ্র দে, আশুতোষ ধর ও কালীরঞ্জন ঘোষ। তবে এঁরা সম্ভবত স্কুলের খাতাতেই তাঁর সহপাঠী ছিলেন, 1876-এ রবীন্দ্রনাথ একদিনের জন্যও স্কুলে গিয়েছিলেন বলে মনে হয় না, কারণ এর মধ্যে অনেকটা সময় রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহতেই কাটিয়েছিলেন, সে-প্রসঙ্গ আমরা পরে আলোচনা করব। বরং এই সময়ে এন্ট্রান্স ক্লাসে সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদের বাঙালি সহপাঠীদের তালিকাটি অনেক মূল্যবান, কারণ তাঁদের কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন এবং সে-ঘনিষ্ঠতা অনেকদিন স্থায়ী হয়েছিল। 1876-এ এন্ট্রান্স ক্লাসের অন্যান্য বাঙালি ছাত্রেরা হচ্ছেন : দেবেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, মনোরঞ্জন দাস, প্রবোধচন্দ্র ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ মিত্র, বদনচন্দ্র চন্দ্রনাথ জ্ঞানচন্দ্র ও নীরদনাথ মুখার্জি, দেবেন্দ্রনাথ রায়, আনন্দলাল সান্যাল ও নবকৃষ্ণ সাহা। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে যে ফাদার হেনরি [Rev. J. Henry]-র কথা লিখেছেন, তিনি এই বৎসর পাঠ-পরিচালক (Prefect of Studies-এর দায়িত্ব ফাদার ডি পেনেরাণ্ডার হাতে ছেড়ে দিয়ে এন্ট্রান্স ক্লাসের শিক্ষকতা গ্রহণ করেন১৫। এই প্রাচীন অধ্যাপককে ছাত্রেরা খুব ভালোবাসত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে পড়েননি বলে তাঁকে ভালো করে জানতেন না। এঁর সম্পর্কে একটি মজার গল্প রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে বর্ণনা করেছেন—ঘটনাটি নিশ্চয়ই তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, সোমেন্দ্রনাথ বা সত্যপ্রসাদের কাছে শোনা, কারণ ব্যাপারটি 1876-এ এন্ট্রান্স ক্লাসেই ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘তিনি [ফাদার হেনরি] বাংলা জানিতেন। তিনি নীরদ নামক তাঁহার ক্লাসের একটি ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “তোমার নামের ব্যুৎপত্তি কী।” নিজের সম্বন্ধে নীরদ চিরকাল সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিল—কোনোদিন নামের ব্যুৎপত্তি লইয়া সে কিছুমাত্র উদ্বেগ অনুভব করে নাই—সুতরাং এরূপ প্রশ্নের উত্তর দিবার জন্য সে কিছুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু অভিধানে এত বড়ো বড়ো অপরিচিত কথা থাকিতে নিজের নামটা সম্বন্ধে ঠকিয়া যাওয়া যেন নিজের গাড়ির তলে চাপা পড়ার মতো দুর্ঘটনা—নীরু তাই অম্লানবদনে তৎক্ষণাৎ উত্তর করিল, “নীরু ছিল রোদ, নীরদ—অর্থাৎ, যাহা উঠিলে রৌদ্র থাকে না তাহাই নীরদ”।’১৬ এই নীরদ হচ্ছেন উপরের তালিকায় উল্লিখিত নীরদনাথ মুখার্জি, ইনি সম্ভবত 1876-এই সেন্ট জেভিয়ার্সে এন্ট্রান্স ক্লাসে ভর্তি হন, কারণ আগের বছরের এন্ট্রান্স বা ফিফ্থ ইয়ার’স্ ক্লাসের তালিকায় এঁর নাম পাওয়া যায় না। নীরদনাথ হচ্ছেন গুণেন্দ্রনাথের দিদি কুমুদিনী ও নীলকমল মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্র—সেই আত্মীয়-সূত্রেই ডাক নাম ‘নীরু’র প্রয়োগ।
অপর সহপাঠীদের মধ্যে প্রবোধচন্দ্র ঘোষের নাম অনেক পরিচিত। ইনিই রবীন্দ্রনাথের প্রথম গ্রন্থাকারে মুদ্রিত কাব্যগ্রন্থ ‘কবি-কাহিনী’র [5 Nov 1878 : ১২৮৫] প্রকাশক।
উল্লেখযোগ্য, Dec 1875-এ অনুষ্ঠিত এন্ট্রান্স পরীক্ষায় জগদীশচন্দ্র বসু সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীকালে তিনি রবীন্দ্রনাথের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন। এই সময়ে অবশ্য তাঁদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল বলে মনে হয় না।
দেবেন্দ্রনাথ ২১ অগ্রহায়ণ [সোম 6 Dec 1875] তারিখে বোটে করে শিলাইদহ যাত্রা করেন। এ-যাত্রায় তিনি রবীন্দ্রনাথকেও তাঁর সঙ্গী করেন। রবীন্দ্রনাথ অন্য প্রসঙ্গে এই ভ্রমণের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন:
‘একবার বাল্যকালে পিতার সঙ্গে গঙ্গায় বোটে বেড়াইবার সময় তাঁহার বইগুলির মধ্যে একখানি অতি পুরাতন ফোর্ট উইলিয়মের প্রকাশিত গীতগোবিন্দ পাইয়াছিলাম। বাংলা অক্ষরে ছাপা; ছন্দ অনুসারে তাহার পদের ভাগ ছিল না; গদ্যের মতো এক লাইনের সঙ্গে আর-এক লাইন অবিচ্ছেদে জড়িত। আমি তখন সংস্কৃত কিছুই জানিতাম না।* বাংলা ভালো জানিতাম বলিয়া অনেকগুলি শব্দের অর্থ বুঝিতে পারিতাম। সেই গীতগোবিন্দখানা যে কতবার পড়িয়াছি তাহা বলিতে পারি না। জয়দেব যাহা বলিতে চাহিয়াছেন তাহা কিছুই বুঝি নাই, কিন্তু ছন্দে ও কথায় মিলিয়া আমার মনের মধ্যে যে-জিনিসটা গাঁথা হইতেছিল তাহা আমার পক্ষে সামান্য নহে। আমার মনে আছে, ‘নিভৃতনিকুঞ্জগৃহং’ গতয়া নিশি রহসি নিলীয় বসন্তং’ [২। ১১]—এই লাইনটি আমার মনে ভারি একটি সৌন্দর্যের উদ্রেক করিত—ছন্দের ঝংকারের মুখে নিভৃতনিকুঞ্জগৃহং এই একটিমাত্র কথাই আমার পক্ষে প্রচুর ছিল। গদ্যরীতিতে সেই বইখানি ছাপানো ছিল বলিয়া জয়দেবের বিচিত্র ছন্দকে নিজের চেষ্টায় আবিষ্কার করিয়া লইতে হইত—সেইটেই আমার বড়ো আনন্দের কাজ ছিল। যেদিন আমি ‘অহহ কলয়ামি বলয়াদিমণিভূষণং হরিবিরদহনবহনেন বহুদূষণং’*—এই পদটি ঠিকমত যতি রাখিয়া পড়িতে পারিলাম, সেদিন কতই খুশি হইয়াছিলাম। জয়দেব সম্পূর্ণ তো বুঝিই নাই, অসম্পূর্ণ বোঝা বলিলে যাহা বোঝায় তাহাও নহে, তবু সৌন্দর্যে আমার মন এমন ভরিয়া উঠিয়াছিল যে, আগাগোড়া সমস্ত গীতগোবিন্দ একখানি খাতায় নকল করিয়া লইয়াছিলাম।’১৭
উদ্ধৃতিটি খুবই দীর্ঘ হয়ে গেল, কিন্তু এর থেকে আমরা কয়েকটি সিদ্ধান্ত বার করে নিতে চাই বলেই এই অংশটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করেছি। আমরা জানি, সংস্কৃতে লেখা হলেও জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্’ থেকেই বাংলার প্রেমগীতিসাহিত্য, বিশেষ করে বৈষ্ণব সাহিত্য, তার প্রাণরস আহরণ করেছে। রবীন্দ্রনাথ পূর্বেই বৈষ্ণব কবিতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, গীতগোবিন্দ সম্পূর্ণ না বুঝলেও অলক্ষিতে বৈষ্ণব-গীতিকবিতার প্রেমরহস্য নিশ্চয়ই তাঁর মনের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। মনে রাখা দরকার, ব্রাহ্মধর্মের আবহাওয়ায় বড়ো হওয়ার জন্য রাধা-কৃষ্ণ সম্পর্কে কোনো ধর্মীয় সংস্কার অন্তত এই সময়ে তাঁর মনে গড়ে ওঠার কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে আগে পড়া বিদ্যাপতির পদাবলি ও বোটভ্রমণের সময়ে পঠিত গীতগোবিন্দ বিশুদ্ধ প্রেমকবিতা হিসেবেই তিনি উপভোগ করেছেন। আদিরসাত্মক বর্ণনাগুলি বয়ঃসন্ধিকালে অবস্থিত রবীন্দ্রনাথের চিত্তকে কিছু পরিমাণে অবশ্যই আবিল করেছে—এ-প্রসঙ্গে তাঁর উক্তি আমরা আগেই উদ্ধৃত করেছি কিন্তু বাংলার মূল কাব্যধারার সঙ্গে এর দ্বারা যে পরিচয় সাধিত হয়েছে, তার মূল্য অনেক বেশি, তাঁর চিত্তবিকাশের পক্ষে তা অনেকখানি লাভজনক হয়েছে। দ্বিতীয়ত, গদ্য রীতিতে ছাগানো বই থেকে জয়দেবের বিচিত্র ছন্দকে নিজের চেষ্টায় আবিষ্কার করার আনন্দ ও শিক্ষা তাঁর ক্ষেত্রে অনর্থক হয়নি, পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধরনের ছন্দোরচনা, বিশেষ করে বাংলা ছন্দে ধ্বনিমাত্রিকতার প্রয়োগের পিছনে গীতগোবিন্দের প্রভাব অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। তৃতীয়ত, ‘রবীন্দ্রকাব্য-ভাষায় বারবার ব্যবহৃত বিশিষ্ট শব্দাবলীর মধ্যে জয়দেবের পদাবলী থেকে নেওয়া এই কয়েকটি শব্দ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য : তিমির, নিভৃত, নিলয়, নিলীন, বিপুল, মেদুর, রভস, বিপিন, বিতান, তল, নিবিড়, গহন, মধুযামিনী ইত্যাদি।’১৮ চতুর্থত, শিক্ষক ও অভিভাবকদের বহু চেষ্টা ও ভদ্রসমাজের বাজারে দর কমে যাওয়ার আশঙ্কাও যে-রবীন্দ্রনাথকে বিদ্যালয়-পাঠ্য পুস্তকের প্রতি মনোযোগী করতে সমর্থ হয়নি, তিনিই অকারণ আনন্দের দুরূহ গীতগোবিন্দ বারবার পাঠ করেছেন এমন-কি পুরো বইটি নকল করে নেওয়ার কঠোর পরিশ্রমকেও স্বীকার করে নিয়েছেন—এর মধ্যে রবীন্দ্র-চরিত্রের একটি গুঢ় বৈশিষ্ট্য নিহিত হয়ে রয়েছে। বাইরে থেকে চাপিয়ে না দিয়ে অন্তর থেকে বিকশিত করে তুলতে পারলেই শিক্ষা ব্যাপারটি উপাদেয় হয়ে ওঠে—কোনো যুক্তি-তর্ক দিয়ে নয়, নিজের বিভিন্ন আচরণের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন যা তাঁর পরবর্তীকালের শিক্ষাদর্শের ভিত্তিস্বরূপ বলে গণ্য হতে পারে।
পিতার সঙ্গে বোটে যাত্রা কবে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কবে শিলাইদহে পৌঁছন নিশ্চিত করে বলা যায় না, তবে ২৩ অগ্রহায়ণ [বুধ ৪ Dec] তারিখে ‘কর্ত্তামহাশয়ের নিকট ছোটবাবুর সরোজিনী পুস্তক…ও রবীবাবুর নামের ডাকের পত্র পাঠাইবার টিকেট ব্যয়’-এর হিসাব পাওয়া যায়। এ-যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ খুব বেশি দিন শিলাইদহে ছিলেন না, কিন্তু ‘ছোট বাবু মহাশয়ের’ নামে ‘রবীবাবুর নিকট এক পত্র পাঠান টিকিট ব্যয়’-এর হিসাব অন্তত আরও তিনবার দেখা যায় ২৯ অগ্রহায়ণ এবং ২ ও ৬ পৌষ তারিখে। অনুমান করা যায়, এই চারটি চিঠির সবগুলি না হোক বেশির ভাগই নতুন বধূঠাকুরানী কাদম্বরী দেবীর লেখা এবং রবীন্দ্রনাথও মফঃস্বল থেকে অন্তত সমসংখ্যক পত্র লিখেছেন। এইসব চিঠির কোনোটিই রক্ষিত হয়নি [বস্তৃত কাদম্বরী দেবী-সংক্রান্ত কোনো চিঠিপত্রই পাওয়া যায় না], রবীন্দ্রজীবনী-রচনা ও উভয়ের পরস্পরিক সম্পর্কটি যথাযথ চিত্রিত করার পক্ষে যা খুবই ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হতে পারে।
শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের এইটিই প্রথম আগমন। এই অঞ্চলে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন, ‘কস্যচিৎ দর্শকস্য’-প্রদত্ত তার একটি বিবরণ প্রকাশিত হয় তত্ত্ববোধিনী মাঘ-সংখ্যার ১৮৫ পৃষ্ঠায়:
‘গত ৪ঠা পৌষ শনিবার পূজ্যপাদ প্রধান আচার্য্য মহাশয় জলপথে ভ্রমণ করিতে করিতে রামপুর বোয়ালিয়ায় উপস্থিত হয়েন। তাঁহার আগমনে এখানকার ব্রাহ্মমণ্ডলী মহা উৎসাহিত হইয়া, গত ৫ই পৌষ রবিবার [19 Dec 1875] প্রাতঃকালে অত্ৰত্য ব্রাহ্মসমাজে উপাসনা কাৰ্য্য সম্পাদন করেন। উপাসনাসমাজে প্রায় তিন শতেরও অধিক ভদ্রলোকের সমাগম হয়। …শ্রীযুক্ত প্রধান আচার্য্য মহাশয় বেদী গ্রহণ করেন।… স্বাধ্যায়ের পর প্রধান আচার্য্য মহাশয়ের কনিষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুমধুর স্বরে একটী মনোহর ব্রহ্মসঙ্গীত করেন।
এর কিছু পরেই রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় ফিরে আসেন। তাঁর প্রত্যাবর্তনের তারিখটি সম্ভবত ৮ পৌষ [বুধ 22 Dec], কারণ ২২ পৌষের হিসাবে লেখা হয়েছে : ‘দ° গত ৯ পৌষের জমা/মা° রামসর্বস্ব ভট্টাচাৰ্য/দঃ গতরাত্রে সিলাইদহায় শ্রীযুক্ত কর্ত্তা/মহাশয়ের নিকট হইতে রবীবাবু/ও উক্ত ভট্টাচার্য্য আইসেন উহাদের/আসিবার খরচ শ্রীযুক্ত কর্ত্তামহাশয়/২০ টাকা দেন খরচ বাদে বাকী ফেরত পাওয়া গেল গুঃ খোদ—/৬ ৸৴°’। রামসর্ব্বস্ব বোটেও তাঁদের সঙ্গী ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহ থেকে জোড়াসাঁকোয় ফিরে এলেন, তখন সমস্ত কলকাতা ভারতসম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতা আগমন* উপলক্ষে আনন্দে মুখর হয়ে উঠেছে। তিনি সেরাপিস (Serapis) নামক রাজকীয় জাহাজে ৯ পৌষ [বৃহ 23 Dec] বিকেলে ভারত-সাম্রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় এসে পৌঁছন। তাঁকে অভ্যর্থনার জন্য নগরীর সৌধগুলি ও রাজপথসমূহ আলোকমালায় সজ্জিত করা হয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িও অনুরূপ সজ্জিত হয়েছিল কিনা জানি না, অন্তত হিসাব-খাতায় সে বাবদে কোনো ব্যয় দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই আনন্দোৎসবে দর্শক হিসেবে তাঁরা যোগ দিয়েছিলেন, তার প্রমাণ ক্যাশবহি-তে আছে; ২১ পৌষ [মঙ্গল 4 Jan 1876] তারিখের হিসাব থেকে জানা যায় ‘মহারাণীর জ্যেষ্ঠপুত্র আশায় বাবুমহাশয়রা তাঁহাকে দেখিবার জন্য পটলডাঙ্গায় [‘বহুবাজার’] বাটী ভাড়া করেন’ এবং মহারাণীর বড়পূত্র আশায় তাহা দেখিতে বাবুমহাশয়রা জান তাহার গাড়ি ভাড়া বাবদ দুটি গাড়ির ভাড়া বাইশ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। শুধু বাবুমহাশয়রা নন, ছোটোরাও যে তাঁদের সঙ্গী ছিলেন তার হিসাব পাওয়া যায় ২২ পৌষ তারিখে : ‘প্রিন্স ওয়েলের আগমন দেখিতে ছেলেবাবুরা জাইবার সময় উইলসেনের হটেলে মেঠাই ক্রয়’ করা হয় পাঁচ টাকার। ২০ পৌষ [সোম 3 Jan 1876] রাত্রি দশটার সময় যুবরাজ ট্রেনে কলকাতা ত্যাগ করেন, সুতরাং এই সব খরচ আগেই করা হয়েছে—ক্যাশবহি-তে হিসাব লেখা হয়েছে হুজুগ মিটে যাবার পর, তা বলাই বাহুল্য।
এই বৎসরই রবীন্দ্রনাথ আরও একবার শিলাইদহে যান ফাল্গুন মাসে। ৫ ফাল্গুন [বুধ 16 Feb] তারিখের হিসাবে দেখা যায় : ‘বেড়াইবার খাতে/ব° অভয়চরণ ঘোষ/দ° রবীবাবুর সিলাইদহায় বেড়াইতে/জাওয়ায় ট্রেণভাড়া একবৌচর/গুঃ প্রাণনাথ বসু—৭। ৴°’ অর্থাৎ ফাল্গুন মাসের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে যান। ইতিমধ্যে দেবেন্দ্রনাথ সেখান থেকে ফিরে ২২ মাঘ [শুক্র 4 Feb] দৌহিত্রী ইন্দুমতীর বিবাহ-কার্য সমাধা করে শান্তিনিকেতন হয়ে হিমালয় যাত্রা করেছেন ও মফঃস্বলে জমিদারি দেখাশোনা ও ব্যবসা করার জন্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেখানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। [উল্লেখযোগ্য, ৪ ফাল্গুন তারিখে দেবেন্দ্রনাথ বার্ষিক ছ’টাকা সুদে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে ৫০০০ টাকা ঋণ দেন।† সুদের উল্লেখ দেখে পাঠকের ভ্রূকুঞ্চিত করার কোনো প্রয়োজন নেই, মনে রাখা দরকার সেই বৃহৎ যৌথ পরিবারের সমস্ত সম্পত্তিই তখন এজমালি অবস্থায় ছিল।] রবীন্দ্রনাথ এইবারের শিলাইদহ ভ্রমণের কথা লিখেছেন ছেলেবেলা-য়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ নাটক’ প্রকাশের [30 Nov 1875] পর থেকেই তিনি কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে প্রমোশন দিয়ে সমশ্রেণীতে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। সুতরাং শিলাইদহে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথকে সেখানে আহ্বান করা অস্বাভাবিক ছিল না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘তিনি নিশ্চয় ভেবেছিলেন, ঘর থেকে এই বাইরে চলাচল এ একটা চলতি ক্লাসের মতো। তিনি বুঝে নিয়েছিলেন, আমার ছিল আকাশে বাতাসে চরে বেড়ানো মন—সেখান থেকে আমি খোরাক পাই আপনা হতেই।১৯ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিছু ভুল বোঝেননি, একটু আগে ‘গীতগোবিন্দ’-প্রসঙ্গে আমরা ঠিক এই কথাই বলতে চেয়েছি।
এইবার রবীন্দ্রনাথের চোখে সেই সময়কার শিলাইদহের রূপটি একবার দেখে নেওয়া যাক্ :
পুরোনো নীলকুঠি তখনো খাড়া ছিল। পদ্মা ছিল দূরে। নীচের তলায় কাছারি, উপরের তলায় আমাদের থাকবার জায়গা। সামনে খুব মস্ত একটা ছাদ। ছাদের বাইরে বড়ো বড়ো ঝাউগাছ, এরা একদিন নীলকর সাহেবের ব্যবসার সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল।… সেদিনকার আর যা-কিছু সব মিথ্যে হয়ে গেছে, কেবল সত্য হয়ে আছে দুই সাহেবের দুটি গোর।২০
রবীন্দ্রনাথ যদিও শিলাইদহে প্রথম এসেছিলেন পিতার সঙ্গে, কিন্তু সেবার এখানে অবস্থানকাল দীর্ঘ ছিল না, ফলে স্থানটির সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে তোলার সুযোগ ঘটেনি। সেই সুযোগ ঘটল এইবারের ভ্রমণে। তিনি লিখেছেন:
একলা থাকার মন নিয়ে আছি। ছোটো একটি কোণের ঘর, যত বড়ো ঢালা ছাদ তত বড়ো ফলাও আমার ছুটি। অজানা ভিন দেশের ছুটি, পুরোনো দিঘির কালো জলের মতো তার থই পাওয়া যায় না। বউ-কথা-কও ডাকছে তো ডাকছেই, উড়ো ভাবনা ভাবছি তো ভাবছিই। এইসঙ্গে সঙ্গে আমার খাতা ভরে উঠতে আরম্ভ করেছে পদ্যে। সেগুলো যেন ঝরে পড়বার মুখে মাঘের প্রথম ফসলের আমের বোল—ঝরেও গেছে।২১
এই খাতা মালতীপুঁথি কিনা, তা বলা সম্ভব নয়। অবশ্য এই সময়ে লিখিত সব কবিতাই যে উক্ত পুঁথিতে লেখা হয়েছে, তা নয়। মনে রাখা দরকার, সমসাময়িক কালে সাময়িকপত্রে প্রকাশিত প্রলাপ প্রভৃতি কবিতা এতে পাওয়া যায় না। সুতরাং স্বীকার করে নিতে হয় মালতীপুঁথি নামে পরিচিত খাতাই তাঁর কবিতারচনার একমাত্র বাহন ছিল না, পাশাপাশি আরও খাতা ছিল যাতে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখেছেন। লেট্স ডায়ারির সব পাতা কবে ভরে গিয়েছিল তা-ও আমরা জানি না। হতে পারে মালতীপুঁথি-তে যখন থেকে কবিতা রচনা শুরু হয়েছে, তখনও লেট্স ডায়ারিতে কবিতা লেখা চলেছে। ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ ছাড়াও ‘বনফুল’ ‘অভিলাষ’ ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ ‘প্রকৃতির খেদ’ প্রভৃতি বিখ্যাত কবিতা হয়তো লেট্স ডায়ারিতেই প্রথম লেখা হয়েছিল। অন্য খাতা থাকার সম্ভাবনাও অবশ্য উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
শিলাইদহে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ যে কেবল কবিতা লিখে খাতা ভরিয়েছেন, তা নয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসতেন। ভাইকেও তিনি শুধু ঘরের কোণে বসিয়ে রাখেননি, তাঁকে সাহসী করে তোলার জন্যে একটা টাট্টু ঘোড়ায় চড়িয়ে পাঠিয়ে দিলেন রথতলার মাঠে ঘোড়া দৌড় করিয়ে আনতে। সেই এবড়ো-খেবড়ো মাঠে পড়ি-পড়ি করতে করতে ঘোড়া ছুটিয়ে আনতুম। আমি পড়ব না, তাঁর মনে এই জোর ছিল বলেই আমি পড়ি নি।’২২ এর পরে কলকাতাতেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁকে বড়ো ঘোড়ায় চড়িয়েছিলেন। কিন্তু সে অভিজ্ঞতা তাঁর পক্ষে সুখের হয়নি।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বন্দুক ছুঁড়ে শিকার করতে ভালোবাসতেন। শিলাইদহে এ ব্যাপারে তাঁর সহকারী ছিল বিশ্বনাথ নামে এক অসম-সাহসী শিকারী, যার কাছে রবীন্দ্রনাথ শিকারের গল্প শুনতেন আগ্রহের সঙ্গে। শিলাইদহের জঙ্গলে বাঘ এসেছে শুনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শিকার করতে যেতেন, রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলায় সেই বাঘশিকারের দুটি বর্ণনা দিয়েছেন। এই বর্ণনার মধ্যে যেটি লক্ষণীয় সেটি হল, নিঃসংকোচে তিনি কনিষ্ঠ ভ্রাতাকেও সঙ্গী করে নিয়েছিলেন। এতে যে কোনো বিপদ ঘটতে পারে এমন চিন্তা তাঁর মনকে এতটুকু পীড়িত করেনি।
শিলাইদহে মালী এসে ফুল দিয়ে ফুলদানি সাজিয়ে দিত। রবীন্দ্রনাথের শখ হল ফুলের রঙিন রস দিয়ে কবিতা লিখতে। ফুল টিপে টিপে যেটুকু রস পাওয়া যায় তা কলমের নিবে উঠতে চায় না। তাই তিনি পরিকল্পনা করলেন ছিদ্রযুক্ত কাঠের বাটির উপর হামানদিস্তের নোড়া দড়িতে-বাঁধা চাকার সাহায্যে ঘুরিয়ে বৃহদাকারে ফুলের রস উৎপাদনকারী একটি যন্ত্র তৈরি করতে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে দরবার জানাতে তিনি একটুও না হেসে ছুতোরকে হুকুম করলেন। যন্ত্র তৈরি হল, কিন্তু ফুলে-ভরা কাঠের বাটিতে দড়িতে-বাঁধা নোড়া যতই ঘুরতে থাকে ফুল পিষে কাদা হয়ে যায়, রস বেরয় না। ‘জ্যোতিদাদা দেখলেন, ফুলের রস আর কলের চাপে ছন্দ মিলল না। তবু আমার মুখের উপর হেসে উঠলেন না।’২৩
উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলির মধ্যে অনেকটা হঠকারিতা ও কিছুটা হাস্যকরতা আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবনে এগুলির প্রয়োজন ছিল। স্কুলের ছাত্র হিসেবে তাঁর ব্যর্থতা কেবল অভিভাবকদেরই হতাশ করেনি, নিজের সম্পর্কে বড়ো কিছু আশা করা তাঁর পক্ষেও সম্ভব ছিল না। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁকে যে-সব কাজে প্রবৃত্ত করেছেন, তা তাঁর হারানো আত্মবিশ্বাসকে পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করেছে। এই কথাই রবীন্দ্রনাথ সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন জীবনস্মৃতি-তে :
তিনি আমাকে খুব একটা বড়রকমের স্বাধীনতা দিয়াছিলেন; তাঁহার সংস্রবে আমার ভিতরকার সংকোচ ঘুচিয়া গিয়াছিল। এইরূপ স্বাধীনতা আমাকে আর-কেহ দিতে সাহস করিতে পারিত না—সেজন্য হয়তো কেহ কেহ তাঁহাকে নিন্দাও করিয়াছে। কিন্তু প্রখর গ্রীষ্মের পরে বর্ষার যেমন প্রয়োজন, আমার পক্ষে আশৈশব বাধানিষেধের পরে এই স্বাধীনতা তেমনি অত্যাবশ্যক ছিল। সে-সময়ে এই বন্ধনমুক্তি না ঘটিলে চিরজীবন একটা পঙ্গুতা থাকিয়া যাইত।…শাসনের দ্বারা, পীড়নের দ্বারা, কানমলা এবং কানে মন্ত্ৰদেওয়ার দ্বারা, আমাকে যাহাকিছু দেওয়া হইয়াছে। তাহা আমি কিছুই গ্রহণ করি নাই। যতক্ষণ আমি আপনার মধ্যে আপনি ছাড়া না পাইয়াছি ততক্ষণ নিস্ফল বেদনা ছাড়া আর-কিছুই আমি লাভ করিতে পারি নাই। জ্যোতিদাদাই সম্পূর্ণ নিঃসংকোচে সমস্ত ভালোমন্দের মধ্য দিয়া আমাকে আমার আত্মাপলব্ধির ক্ষেত্রে ছাড়িয়া দিয়াছেন, এবং তখন হইতে আমার আপন শক্তি নিজের কাঁটা ও নিজের ফুল বিকাশ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে পারিয়াছে।২৪
এইবার রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে বোধহয় এক মাসেরও বেশি সময় অবস্থান করেছিলেন। তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন সম্ভবত ৮ চৈত্র [সোম 20 Mar] তারিখে। ক্যাশবহি-র ২২ জ্যৈষ্ঠ ১২৮৩ [শনি 3 Jun 1876] তারিখের হিসাবে দেখা যায় : ‘রবীবাবু সেলাইদহা হইতে আসায় ইষ্টীসেনে পোটমোন্ট থাকায় গুদাম ভাড়া। ৷৵৹ …বিঃ ৮ চৈত্রের এক বৌচর’। ফিরে আসার পরের দিনই তিনি একটি আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান করেন, তা জানা যায় ঐ মাসেরই ১৯ তারিখের হিসাবে: ‘সোম রবীবাবুর ৯ চৈত্র গড়ের মাটে নাছ দেখিতে জাতের গাড়ি ভাড়া…২৲’। এতে আমাদের পূর্বসিদ্ধান্তই সমর্থিত হয় যে, যদিও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের 1876-এর ক্যালেণ্ডারে রবীন্দ্রনাথের নাম দেখা যায় ও Mar 1876 পর্যন্ত তাঁর বেতনও মিটিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি এই বৎসরের শুরু থেকেই স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেন। তাঁর নিজের মতো করে পড়াশুনো অবশ্য অব্যাহত ছিল। ৪ জ্যৈষ্ঠ ১২৮৩ [মঙ্গল 15 May 1876] তারিখের হিসাবে দেখা যায়: ‘রবীৰাবুর কএকখান পূস্তক গত ১৯ ফাল্গুন বুক পোষ্টে সেলাইদহায় পাঠান মাশুল’ খাতে এক টাকা বারো আনা ব্যয় করা হয়েছে। মাশুলের পরিমাণ থেকেই অনুমান করা চলে, অনেকগুলি পুস্তকই তাঁর কাছে প্রেরিত হয়েছিল। বোঝা যায়, নিজের শক্তিতে নিজের ফুল বিকশিত করবার সাধনায় রবীন্দ্রনাথ কখনোই ক্ষান্ত হননি। ফিরে আসার পরও ২৪ চৈত্রের হিসাবে দেখি.’রবীবাবুর দুইখান পুস্তক ক্রয়/বিং এক বৌচর/গুঃ খোদ—৮ ৸৹’। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, বইগুলির নাম এখানে উল্লিখিত হয়নি, ফলে আমরা জানতে পারি না রবীন্দ্রনাথের পাঠরুচি কোন্ পথে অগ্রসর হয়ে তাঁকে স্বশিক্ষিত করে তুলছিল।
শিলাইদহ থেকে ফিরে এসে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে রবীন্দ্রনাথ কয়েকখানি পত্র লেখেন, তার মাশুল ব্যয়ের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে ১৫, ১৭, ২৩ ও ২৪ চৈত্র তারিখে। ১৮ ও ২২ চৈত্র নূতনবধূঠাকুরানী কাদম্বরী দেবীও স্বামীকে দুটি পত্র প্রেরণ করেন। দুঃখের সঙ্গে আবার উল্লেখ করতে হয়, রবীন্দ্রজীবনী-রচনার অমূল্য উপাদান এই পত্রগুলির একটিও সংরক্ষিত হয়নি।
আদি ব্রাহ্মসমাজের বেতনভোগী গায়ক বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে রবীন্দ্রনাথের সংগীতশিক্ষার পাঠগ্রহণের কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। এই বৎসর তিনি আরও একজন বিখ্যাত সংগীতশিল্পীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেলেন—তিনি হলেন যদুভট্ট [যদুনাথ ভট্টাচার্য, 1840-83]। [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৩] ইনি ঠিক কবে ঠাকুরবাড়ির সংস্পর্শে আসেন বলা যায় না, তবে হিসাবখাতায় এঁর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৮২ [বুধ 9 Jun 1875] তারিখে : ‘যদুনাথ ভট্টোর জন্য চা ক্রয় ও চায়ের দুগ্ধ ও মিছরি’। আবার ৯ শ্রাবণ [শনি 24 Jul] তারিখের হিসাবে দেখা যায় : ‘যদুনাথ ভট্টো গায়ক/দ° উহার বেতন গত আষাঢ় মাসের/এক বৌচর ৫০৲, মধ্যে/নিজবাটীর অংশে/শোধ ২৫৲’। এর থেকে বোঝা যায়, যদুভট্ট দেবেন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথের পরিবারে মাসিক বেতনের বিনিময়ে সংগীত-শিক্ষা দিতেন। খাওয়া-দাওয়াও করতেন, তার হিসাবও পাওয়া যায়। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসের হিসাবেও তাঁর নাম পাওয়া যায়, কিন্তু এর পরে তাঁর কোনো উল্লেখ নেই। তাই মনে হয় যদু ভট্ট খুব দীর্ঘদিন ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘তার পরে যখন আমার কিছু বয়েস হয়েছে তখন বাড়িতে খুব বড় ওস্তাদ এসে বসলেন যদু ভট্ট। একটা মস্ত ভুল করলেন, জেদ ধরলেন আমাকে গান শেখাবেনই; সেইজন্যে গান শেখাই হল না। কিছু কিছু সংগ্রহ করেছিলুম লুকিয়ে-চুরিয়ে—ভালো লাগল কাফি সুরে ‘রুম ঝুম বরখে আজু বাদরওয়া’, রয়ে গেল আজ পর্যন্ত আমার বর্ষার গানের সঙ্গে দল বেঁধে।’* প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য কাফি ঠাটে সুরফাঁকতালে রচিত ‘শূন্য হাতে ফিরি হে’ ব্রহ্মসংগীতটি [তত্ত্ববোধিনী, ফাল্গুন ১৮২৪ শক] এই গানটির সুরে কথা বসিয়ে তৈরি। কিন্তু এ-বিষয়ে একটি কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য হল, এই গানটি ভেঙেই দ্বিজেন্দ্রনাথ ‘দীন হীন ভকতে, নাথ, কর দয়া’ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তালের সামান্য পরিবর্তন করে ঝাঁপতালে ‘তুমি হে ভরসা মম, অকূল পাথারে’ ব্রহ্মসংগীত দুটি রচনা করেন এবং দুটিই প্রকাশিত হয় তত্ত্ববোধিনী, আশ্বিন ১৭৯৪ শক [১২৭৯ : Sep 1872] সংখ্যায় ৯৩ পৃষ্ঠাতে অর্থাৎ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে যদু ভট্ট আসবার অনেক আগেই। গানটি যদি যদু ভট্টের কাছ থেকেই সংগৃহীত হয়ে থাকে, তবে তাঁর সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির সম্পর্ক আরো আগেই গড়ে উঠেছিল বলে ধারণা করতে হয়।
শ্রীকণ্ঠ সিংহ-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যদু ভট্টের নাম না করে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন জীবনস্মৃতি-তে :
আমাদের বাড়িতে একসময়ে একজন বিখ্যাত গায়ক কিছুদিন ছিলেন। তিনি মত্ত অবস্থায় শ্রীকণ্ঠবাবুকে যাহা মুখে আসিত তাহাই বলিতেন। শ্ৰীকণ্ঠবাবু প্রসন্নমুখে সমস্তই মানিয়া লইতেন, লেশমাত্র প্রতিবাদ করিতেন না। অবশেষে তাঁহার প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য সেই গায়কটিকে আমাদের বাড়ি হইতে বিদায় করাই স্থির হইল। ইহাতে শ্ৰীকণ্ঠবাবু ব্যাকুল হইয়া তাঁহাকে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিলেন। বারবার করিয়া বলিলেন, “ও তো কিছুই করে নাই, মদে করিয়াছে।”২৫
‘তথ্যপঞ্জী’ [১৩৬৮ সং]-তে ‘বিখ্যাত গায়ক’-প্রসঙ্গে সংশয়-চিহ্ন যোগে যদু ভট্টের নাম করা হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট তথ্য সরবরাহ করতে পারি, ক্যাশবহি-তে ভাদ্র মাসের হিসাবে শ্ৰীকণ্ঠ সিংহ ও যদু ভট্ট দুজনেই জোড়াসাঁকোয় অবস্থান করতেন তার উল্লেখ পাওয়া যায়। লক্ষণীয় যে, ভাদ্র মাসের পরে যদু ভট্ট সম্পর্কে কোনো উল্লেখ ক্যাশবহি-তে দেখা যায় না। এর থেকে সিদ্ধান্ত করা যায়, উক্ত ‘বিখ্যাত গায়ক’ নিঃসংশয়িতভাবেই যদু ভট্ট, অন্য কেউ নন।
বর্তমান বৎসর রবীন্দ্রনাথের কাব্যরচনা ও কাব্যপ্রকাশের দিক থেকে নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। ১২৮১ থেকেই রবীন্দ্রনাথের রচনা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল, বর্তমান বৎসরে তা যথেষ্ট ব্যাপকতা অর্জন করেছে। এর প্রথমটি প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত শিক্ষক রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণ-সম্পাদিত প্রতিবিম্ব পত্রিকার ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায় [বৈশাখ ১২৮২, পৃ ১৩-১৭] ‘প্রকৃতির খেদ’ নামে। যথারীতি কবিতাটি অ-স্বাক্ষরিত, এবং কবিতাটির শেষে ‘ক্রমশঃ’ কথাটি লেখা আছে, কিন্তু পরবর্তী অংশটি কখনো প্রকাশিত হয়েছিল কিনা জানা যায় না। এই কবিতাটি অন্য রূপে ও সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বালকের রচিত’ আখ্যায় ভূষিত হয়ে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার আষাঢ় ১৭৯৭ শক [১২৮২ : Jun 1875] সংখ্যায় ৫২-৫৪ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। তত্ত্ববোধিনী-তে প্রকাশিত রচনাটি সম্পর্কে সজনীকান্ত দাস লিখেছেন : রবীন্দ্র-কাব্যের সহিত যাঁহাদের পরিচয় আছে, তাঁহারা কবিতাটি পড়িলেই বুঝিতে পারিবেন, ইহা রবীন্দ্রনাথের রচনা। আশ্চর্যের বিষয়, রবীন্দ্রনাথকে দেখাইতেই তিনি ইহার কয়েক পংক্তি মুখস্থ বলিতে পারিলেন, যদিও দীর্ঘ চৌষট্টি বৎসরের পূর্ব্বেকার কথা।‘২৬ প্রবোধচন্দ্র সেন অক্ষয়চন্দ্র সরকার-সম্পাদিত সাধারণী পত্রিকার ৩ জ্যৈষ্ঠ ১২৮২ [রবি 16 May 1875, ৪ ভাগ, ৫ সংখ্যা, পৃ ৫৬] সংখ্যায় উদ্ধৃত নিম্নলিখিত সংবাদটি তুলে দিয়ে কবিতাটি যে রবীন্দ্রনাথের লেখা তার নিঃসংশয়িত প্রমাণ উপস্থিত করেন২৭:
বিদ্বজ্জন সমাগম। সাপ্তাহিক হইতে।
গত রবিবার রাত্রিতে শ্রীযুক্ত বাবু গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাটিতে “বিদ্বজ্জন সমাগম” সভা হইয়াছিল। প্রায় একশত গ্রন্থকার ও বিদ্বান ব্যক্তি তথায় উপস্থিত হইয়াছিলেন।
সাহিত্য ও সঙ্গীতের আমোদ এই সভার প্রধান উদ্দেশ্য। সভাগৃহ কৃত্রিম তরুরাজি, পুষ্পমালা, আলোকাবলি ও সুন্দর আসনে সুশোভিত হইয়াছিল।
প্রথমে বাবু রাজনারায়ণ বসু বাঙলা ভাষার উৎপত্তি এবং বঙ্গকবি ও গ্রন্থকারদিগের সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা করেন, পরে প্রাচীন কবি বিদ্যাপতির গ্রন্থ হইতে কিয়দংশ পঠিত হয়। তাহার পর রাজনারায়ণবাবু কবিকঙ্কণের চণ্ডী হইতে একটুকু পাঠ করেন। অনন্তর হুতোম প্যাঁচা ও নবীন তপস্বিনী হইতেও কিছু কিছু পাঠ করা হয়। তদনন্তর বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “প্রকৃতির খেদ” নামে স্বরচিত একটি পদ্যপ্রবন্ধ পাঠ করেন। ঐ পদ্য অতি মনোহর। পাঠকালে সকলের মনে ভারতভূমির বর্তমান হীনাবস্থা স্মরণ হওয়াতে নেত্র হইতে অশ্রুপাত হইয়াছিল। রবীন্দ্রবাবুর বয়স ১২।১৩ বৎসর [? ১৪ বৎসর]।
পরে বাবু হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভা নামে অষ্টমবর্ষীয়া কন্যা [? নবমবর্ষীয়া] ও তদপেক্ষা+অল্পবয়স্ক আর একটি বালক [হিতেন্দ্রনাথ?] উভয়ে মিলিয়া সেতার বাজাইলেন। তাহার পর প্রতিভা পিয়ানোতে দুইটি গত বাজাইলেন, পরে ঐ দুটি শিশু ৩। ৪টি হিন্দী গান গাইলেন। সে গান হামোনিয়ম, বেহালা ও তবলার সঙ্গে সঙ্গত হইয়াছিল। তাহার পর প্রসিদ্ধ গায়ক বিষ্ণুবাবুর একটি গানে ঐ বালকটি তবলা সঙ্গত করিল। পরে আর ৪/৫টি গানের সঙ্গে প্রতিভা তবলা সঙ্গত করিলেন।
২ জ্যৈষ্ঠ [শনি 15 May] শিলাইদহ থেকে গুণেন্দ্রনাথকে লিখিত একটি পত্রে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লেখেন : ‘গুণু দাদা/বিদ্বজ্জনের card ও রবির কবিতা পাইয়াছি কর্ত্তামহাশয় কবিতাটী পাঠ করিয়া ভাল বলিলেন।…/সাপ্তাহিক সমাচারে “বিদ্বজ্জনসমাগমের” একটা graphic description দিয়াছে। তাহা কি দেখ নাই?’
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এখানে ‘রবির কবিতা’ বলতে ‘প্রকৃতির খেদ’কেই বুঝিয়েছেন, যেটি ‘বিদ্বজ্জন-সমাগম’-এর দ্বিতীয় অধিবেশনে পঠিত হয়েছিল। চিঠিটি সজনীকান্ত দাস ‘রবীন্দ্রনাথ : জীবন ও সাহিত্য’ [পৃ ১৯৬-৯৭] গ্রন্থে উদ্ধৃত করতে গিয়ে ‘পাইয়াছি’ শব্দের স্থানে ‘পাঠাচ্ছি’ লিখে একটি সংশয় সৃষ্টি করেছিলেন গুণেন্দ্রনাথের বাড়িতে অনুষ্ঠিত সভায় তিনিই অনুপস্থিত থাকার মতো অসৌজন্য তাঁর কাছে আশা করা যায় না বলে। কিন্তু মূল চিঠিটি আমরা দেখেছি, সেখানে এরূপ সংশয়ের সুযোগ নেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও দেবেন্দ্রনাথ উভয়েই এই সময়ে শিলাইদহে ছিলেন বলে ‘card ও রবির কবিতা গুণেন্দ্রনাথ তাঁদের কাছে পাঠিয়ে দেন; তারই প্রাপ্তিস্বীকার ও মন্তব্য পত্রটিতে রয়েছে।
প্রবোধচন্দ্র সেন বিভিন্ন যুক্তি তর্ক উত্থাপন করে সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’-এর আলোচ্য অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০ বৈশাখ ১২৮২ রবি 2 May 1875 তারিখে।২৮ সনৎকুমার গুপ্ত ১ জ্যৈষ্ঠ-সংখ্যা এডুকেশন গেজেট থেকে সঠিক তারিখটি উদ্ধার করেছেন:
গত ২৭শে বৈশাখ ১২৮২ রবিবার [9 May] সন্ধ্যার পর শ্রীযুক্ত বাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়দিগের ভবনে বিদ্বজ্জন সমাগম হইয়া গিয়াছে। সমাগমে কাৰ্য্য সাড়ে সাত ঘটিকার সময় আরম্ভ হয়। প্রায় দুই ঘণ্টাকাল ঐ কার্য্যে অতিবাহিত হয়। প্রথমে শ্রীযুক্ত রাজনারায়ণ বসুজ মহাশয় বঙ্গভাষায় পুরাবৃত্ত ও মৃত বাঙ্গালা গ্রন্থকর্ত্তাদিগের গ্রন্থের দোষগুণ এবং বাঙ্গালা ভাষার বর্তমান অভাব মোচন সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা করেন। তৎপরে মেদিনীপুর হাইস্কুলের হেড পণ্ডিত ভোলানাথ চক্রবর্তী মহাশয় বিদ্যাপতি প্রভৃতি কতকগুলি কবি ও গদ্য গ্রন্থকারের গ্রন্থের কোন কোন অংশ পাঠ করেন। তৎপরে ঠাকুরবংশীয় একটি চতুর্দশ বর্ষীয় বালক ‘প্রকৃতির খেদ এই শীর্ষকযুক্ত একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। এই কবিতাটি সমাগত সভ্যবৃন্দের অতীব হৃদয়গ্রাহী হইয়াছিল। তৎপরে ঐ বংশীয় অষ্টম বর্ষীয়া বালিকা ও একটি ষষ্ঠ বর্ষীয় বালক বিশিষ্ট নিপুণতার সহিত সেতার পিয়ানো প্রভৃতি যন্ত্রবাদন ও তবলার বিশুদ্ধ শ্রুতি-মনোহর সঙ্গীত করিয়াছিলেন। তাঁহাদের নৈপুণ্যে সমাগত ব্যক্তিগণ মোহিত হইয়াছিলেন। একজন শ্রোতা বলিয়াছিলেন, ইহা ইন্দ্রজালের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে। তদনন্তর রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর একটি মনোজ্ঞ অথচ সংক্ষেপ বক্তৃতা করিয়া সমাগমের কাৰ্য্যের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ ও তাহার অধ্যক্ষদিগকে প্রশংসা করিলেন। পরিশেষে সকলকে নানাবিধ ফলমূল ও মিষ্টান্ন ভোজন করাইয়া বিদায় দেওয়া হইল। একটি হিন্দু মহিলা কর্ত্তৃক চিত্রিত দুইখানি চিত্রপট প্রদর্শিত হইয়াছিল। চিত্ৰকারিণীর চিত্র-নৈপুণ্য দেখিয়া সকলে আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিলেন। নানাবিধ চিত্রের পুস্তক সমাগত ব্যক্তিদিগের দর্শন জন্য টেবিলের উপর স্থাপিত হইয়াছিল। গত বৎসরের সমাগম অপেক্ষা এ বৎসরের সমাগমের কাৰ্য্য অধিকতর পরিপাট্যরূপে সম্পাদিত হইয়াছে। ঠাকুরবাবুদিগের সৌজন্যে সকলেই যে আপ্যায়িত হইয়াছিলেন তাহা বলা বাহুল্য।২৯
বিদ্বজ্জন সমাগম-এ রবীন্দ্রনাথ ‘প্রকৃতির খেদ’ কবিতাটি যে আকারে পাঠ করেছিলেন, প্রতিবিম্ব-তে প্রকাশিত পাঠ তা থেকে ভিন্নতর। এ-বিষয়ে উক্ত পত্রিকার ১৩ পৃষ্ঠায় একটি সম্পাদকীয় টীকা মুদ্রিত হয়,: ‘আমাদিগের সম্ভান্ত [সম্ভ্রান্ত] লেখক প্রথমে এই পদ্যটির কাপি যেরূপ প্রেরণ করেন, প্রুফ সংশোধনের সময় তাহার অনেক পরিবর্ত্ত করিয়া দেন। গত রবিবার “বিদ্বজ্জন-সমাগম” সভায় কতিপয় মান্য বন্ধুর অনুরোধে রচয়িতাকে সাধারণের সম্মুখে এই কবিতাটি পাঠ করিতে হয়। লেখকের সংশোধিত পদ্যটি তৎকালে আমাদের নিকট থাকায় অসংশোধিত কাপিখানি দেখিয়া অর্দ্ধাংশ মাত্র মুদ্রিত করিয়া “বিদ্বজ্জনসমাগম” সভায় প্রদান করা হয়। এজন্য রচয়িতার এই সংশোধিত রচনার সহিত সভার মুদ্রিত রচনার স্থানে স্থানে অনেক প্রভেদ লক্ষিত হইবে [।]’৩০
এই পাদটীকাটি অত্যন্ত মূল্যবান। এটি না থাকলে কবিতাটি সম্পর্কে অনেক তথ্যই আমাদের অজানা থেকে যেত। প্রথমত, এই পাদটীকাটি থেকেই আমরা জানতে পারি যে, রবীন্দ্রনাথ ‘প্রকৃতির খেদ’ কবিতাটি প্রথমে যেভাবে লিখেছিলেন, প্রতিবিম্ব পত্রিকায় প্রকাশিত হবার আগে প্রফ-সংশোধনের সময় তার অনেক পরিবর্তন করেন। ‘স্থানে স্থানে অনেক প্রভেদ’ থাকার জন্য বোঝা যায় পরিবর্তন বেশ ব্যাপকভাবেই করা হয়েছিল। পত্রিকাটির ‘সূচনা’ থেকে জানা যায়, প্রতিবিম্ব ১ম খণ্ড ১ম সংখ্যা বৈশাখ ১২৮২-র শেষ সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছিল। তার পূর্বে ২৭ বৈশাখ তারিখে বিদ্বজ্জন সমাগম-এ পঠিত হবার আগেই কবিতাটির ফর্মা সাজানো, প্রুফ তৈরি, রবীন্দ্রনাথ-কর্তৃক প্রুফে ব্যাপক সংশোধন ইত্যাদি হবার পর সংশোধিত কপিটি পুনরায় প্রেসে চলে গিয়েছিল। এর থেকে অনুমান করা চলে, কবিতাটির রচনাকাল সম্ভবত ১২৮১ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের শেষ ভাগ। মনে রাখা দরকার, ২৭ ফাল্গুন তারিখে মাতা সারদা দেবীর মৃত্যু ও ৭ চৈত্র তাঁর আদ্যশ্রাদ্ধ হয়। এই সময়টি কবিতা রচনার পক্ষে অনুকূল না হওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং বাড়িতে শোকের পরিবেশটি একটু লঘু হয়ে যাবার পর কবিতাটি লিখিত হয়েছিল, এমন সিদ্ধান্ত করাই যুক্তিসংগত।
দ্বিতীয়ত, উক্ত পাদটীকা থেকে অনুমান করা চলে, কবিতাটি রচনার পিছনে নিজস্ব প্রেরণা কিংবা প্রতিবিম্ব পত্রিকার প্রথম প্রকাশ উপলক্ষে সম্পাদক [গৃহশিক্ষকও বটে] রামসর্বম্বের তাগিদই কার্যকরী ছিল। ‘হোক ভারতের জয়’ বা ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ যেমন বিশেষভাবে হিন্দুমেলার জন্যই রচিত হয়েছিল, এই কবিতাটি সেরূপ অন্তত ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’-এ পাঠ করার উদ্দেশ্যে যে রচিত হয়নি, উদ্ধৃতিটি থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। কতিপয় মান্য বন্ধুর অনুরোধে’ই কবিতাটি উক্ত সভায় পঠিত হয় এবং পরিকল্পনাটি প্রায় শেষ মুহূর্তে গৃহীত হওয়ায় তাড়াহুড়ো করে অসংশোধিত কপিটি থেকেই মাত্র অর্ধাংশ মুদ্রিত করে সভায় বিতরণ করা হয়েছিল, সম্পূর্ণটি ছাপানোর হয়তো সময়ই ছিল না। নইলে গৃহশিক্ষক রামসর্বস্ব জোড়াসাঁকো বাড়িতে এমন কিছু দুর্লভ মানুষ ছিলেন না, সময়াভাব যদি বাধা হয়ে না দাঁড়াত তাহলে তাঁর কাছ থেকে সংশোধিত কপিটি এনে পুরোটাই মুদ্রিত করা যেত। সুতরাং প্রবোধচন্দ্র সেন যে লিখেছেন: ‘একদিকে বিদ্বজ্জনসমাগমের আসন্ন অধিবেশন আর অন্য দিকে প্রতিবিম্বের আসন্ন প্রকাশ, এই উভয় তাগিদেই ‘প্রকৃতির খেদ’ কবিতাটি রচিত হয়’,৩১ এর প্রথম অংশটি আমরা সচ্ছন্দে বাদ দিতে পারি।
তৃতীয়ত, ‘হোক্ ভারতের জয়’ যেমন হিন্দুমেলায় স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করা হয়েছিল [‘delivered from memory’], এটি সেরূপ আবৃত্তি করা হয়নি, মুদ্রিত রচনা দেখে পাঠ করা হয়েছিল। গুণেন্দ্রনাথ এই মুদ্রিত রচনার কপি বিদ্বজ্জনসমাগমের কার্ডের সঙ্গে শিলাইদহে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে প্রেরণ করেছিলেন।
চতুর্থত, পাদটীকায় উল্লিখিত হয়েছে, মূল রচনাটির অর্ধাংশ মাত্র মুদ্রিত করে বিদ্বজ্জনসমাগম সভায় প্রদান করা হয়। প্রবোধচন্দ্র সেন প্রতিবিম্ব-তে প্রকাশিত পাঠ অবলম্বনে এই অর্ধাংশ নির্ণয় করবার চেষ্টা করেছেন। উক্ত পাঠে কবিতাটি মোট সাতাশটি অসমান স্তবকে বিভক্ত, শেষ দিকের স্তবকগুলি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ। প্রথম যোলোটি স্তবকে পঙ্ক্তিসংখ্যা ১০০, শেষ নয়টি স্তবকেও [১৯-২৭] তাই এবং মধ্যবর্তী ধুয়া-স্থানীয় সপ্তদশ ও অষ্টাদশ স্তবক দুটিতে [যেটি সপ্তবিংশ স্তবকের শেষাংশে প্রায় সম্পূর্ণরূপে পুনরুক্ত হয়েছে। শ্রীযুক্ত সেন অবশ্য শুধু সপ্তদশ স্তবকটির কথাই লিখেছেন; স্পষ্টতই সেটি ভুল।] আছে ১১টি পঙ্ক্তি। দুটি ভাবপর্যায়ে বিভক্ত এই কবিতাটিতে প্রথম পর্যায়টি শেষ হয়েছে যোড়শ স্তবকের শেষে। শ্রীযুক্ত সেনের অনুমান, ধুয়া-স্থানীয় সপ্তদশ ও অষ্টাদশ স্তবক দুটি এই যোলোটি স্তবকের সঙ্গে যুক্ত করে প্রায় অর্ধাংশ’ এই অংশটিই মুদ্রিত হয়ে ‘বিদ্বজ্জনসমাগম’এ বিতরিত হয়েছিল।৩২ আদিত্য ওহদেদার একটি প্রবন্ধে৩৩ তত্ত্ববোধিনী-তে মুদ্রিত পাঠ অবলম্বনে এই অর্ধাংশ নির্ণয়ের প্রয়াস পেয়েছেন, কিন্তু তাতে শ্রীযুক্ত সেনের মূল প্রতিপাদ্যটি মোটামুটি অক্ষুণ্ণ আছে।
কিন্তু এর পরেই শ্রীযুক্ত সেন লিখেছেন : এমনও হতে পারে যে, একশো বিদ্বজ্জনের সভায় একশো লাইনের কবিতা পড়াই বালক কবির অভিপ্রায় এবং সে অভিপ্রায়ে ওই অংশটুকুই বিদ্বজ্জনসভার জন্য রচিত হয়েছিল এবং ভাবের সম্পূর্ণতার খাতিরে এগারো লাইনের ধুয়াটিও যুক্ত হয়। কিন্তু কল্পনার বেগ কবিকে আরও রচনায় প্রবৃত্ত করে এবং কবির মনে তার পরেও কবিতাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার সংকল্প জাগায়। তারই ফলে প্রতিবিম্বে প্রকাশিত দুই পর্যায়ের পরেও ‘ক্রমশঃ কথাটি লিখিত হয়’৩৪—আমরা এই অনুমান সমর্থন করি না। আমরা আগেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত প্রেরণায় কিংবা প্রতিবিম্ব-এর জন্যই কবিতাটি রচনা করেন এবং কতিপয় মান্য বন্ধুর অনুরোধেই এটি সভাস্থলে পাঠ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সুতরাং ‘কল্পনার বেগ কবিকে আরও রচনায় প্রবৃত্ত করে’ ইত্যাদি অনুমান এ-প্রসঙ্গে অবান্তর।
প্রতিবিম্ব-তে প্রকাশিত কবিতাটির শেষে ‘ক্রমশঃ’ লিখিত থাকায় এবং উক্ত পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যার [জ্যৈষ্ঠ ১২৮২] পিছনের মলাটে ‘গ্রাহকগণের প্রতি নিবেদন :—আমাদের প্রতিবিম্বের কলেবর অতিশয় ক্ষুদ্র বলিয়া এবারে “প্রকৃতির খেদ”…পূর্বখণ্ড-প্রকাশিত এই কয়টী বিষয়ের পরিশিষ্টভাগ প্রকাশ করিয়া পাঠকবর্গের ক্ষোভ নিবৃত্তি করিতে পারিলাম না।…’—সম্পাদকের এই বিবৃতি আমাদের একটি প্রশ্নের সম্মুখীন করে যে, রবীন্দ্রনাথ কবিতাটির পরবর্তী অংশ রচনা করেছিলেন কিনা এবং সেটি উক্ত পত্রিকার পরবর্তী কোনো সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল কিনা। প্রতিবিম্ব পত্রিকার আর কোনো সংখ্যা না পাওয়ায় এ-প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে উক্ত ‘নিবেদন’-এ সম্পাদক স্থানাভাবকেই কবিতাটির পরবর্তী অংশ প্রকাশিত না হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সেটি লিখিত না-হওয়া বা কপি না-পাওয়াকে দায়ী করেননি। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ কবিতাটির ক্রমানুসরণ করেছিলেন, এ-সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু কোনো প্রমাণ না থাকায় এ-সম্পর্কে জোর করে কিছু বলা সম্ভব নয়।
বর্তমান প্রসঙ্গের শেষে প্রবোধচন্দ্র সেন লিখেছেন : ‘অতঃপর কবিতাটি[র] পূর্বসংকল্পিত শেষাংশ রচনার অভিপ্রায় কবি ত্যাগ করেন এবং প্রতিবিম্বে প্রকাশিত পর্যায় দুটিকে আরও পরিমার্জিত করার প্রয়োজন বোধ করেন। এই পরিমার্জিত রূপটি পরে প্রকাশিত হয় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়’।৩৪ আদিত্য ওহদেদার তাঁর প্রবন্ধে শ্রীযুক্ত সেনের এই মতটি বিশেষভাবে পুনর্বিচার করেছেন। তাঁর মতে : ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত পাঠই হল প্রকৃতির খেদ কবিতাটির প্রথম পাঠ, এবং এই পাঠেরই অর্ধাংশ বিদ্বজ্জন-সমাগম সভার জন্য মুদ্রিত ও তথায় পঠিত হয়। প্রতিবিম্বে যে পাঠ মুদ্রিত হয়েছে, তা হল তত্ত্ববোধিনীর পাঠের সংশোধিত ও পরিমার্জিত রূপ। সুতরাং প্রতিবিম্বে যে পাঠ পাই তা হল প্রকৃতির খেদ কবিতার দ্বিতীয় পাঠ।৩৫
শ্রীওহদেদারের বক্তব্যে যুক্তি আছে। রবীন্দ্রনাথের এই সময়কার স্বদেশমূলক কবিতা প্রধানত হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতার ভাব-ভাষা-ছন্দকে অনুসরণ করেছে। শ্রীযুক্ত সেনও স্বীকার করেছেন : “হিন্দুমেলার[য়] উপহার’ কবিতায় (১৮৭৫ ফেব্রুআরি) যেমন হেমচন্দ্রের ‘ভারতসংগীত’ কবিতার প্রভাব সুস্পষ্ট, প্রকৃতির খেদ’ কবিতাতেও তেমম হেমচন্দ্রের ‘ভারতবিলাপ’ কবিতার ছায়া দেখা যায়।”৩৬ অনুরূপভাবে ছন্দেও হেমচন্দ্রের অনুসরণ দেখা যায় তত্ত্ববোধিনীর পাঠে—‘অমল সলিলা গঙ্গা অই বহি যায়রে’ হেমচন্দ্রের হতাশের আক্ষেপ কবিতার আবার গগনে কেন সুধাংশু উদয় রে’ চরণটির অনুরূপ। কিন্তু ৮+৭ মাত্রার এই চরণ বন্ধ অল্প পরেই পরিত্যক্ত হয়ে ৮+৬ মাত্রায় পরিণত হয়েছে—যেটিকে একটি ছন্দোদোষ হিসেবে গণ্য করা যায়। প্রতিবিম্ব-র পাঠে এ-ধরনের ত্রুটি নেই। তাছাড়া তত্ত্ববোধিনী-পাঠের ‘দুলায়্যে’ ‘চড়ায়্যে’ ইত্যাদি বানানের সম্পূর্ণ না হলেও বেশির ভাগ পরিবর্তিত হয়েছে প্রতিবিম্ব-পাঠে, ‘অই’ পরিবর্তিত হয়েছে ‘ওই’-তে। অনেকগুলি শব্দ বা বাক্যবন্ধ পরিবর্তনেও প্রতিবিম্ব-পাঠে উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়। প্রতিবিম্ব-পাঠের কয়েকটি চরণ তত্ত্ববোধিনী-পাঠে অনুপস্থিত, কিন্তু একে বর্জন না বলে প্রতিবিম্ব-পাঠে সংযোজন বলেও বর্ণনা করা যায়। এছাড়া প্রতিবিম্ব-পাঠের যেটি সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য সেটি হচ্ছে এতে বিহারীলালের সারদামঙ্গল কাব্যের পঙক্তিবিন্যাস, ছন্দোবন্ধ এবং ভাষার অনুসরণের প্রয়াস খুবই স্পষ্ট। কিছুদিন আগে আৰ্য্যদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত [ভাদ্র-পৌষ ১২৮১] এই কাব্য তার ‘ভাষায় ভাবে এবং সংগীতে’ রবীন্দ্রনাথকে নিরতিশয় মুগ্ধ করেছিল। এই মুগ্ধতার প্রকাশ আছে প্রতিবিম্ব-পাঠে। সুতরাং আদিত্য ওহদেদার যে তত্ত্ববোধিনী-পাঠকে প্রথম পাঠ এবং প্রতিবিম্বপাঠকে দ্বিতীয়-পাঠ বলে অভিহিত করেছেন, তার যৌক্তিকতা অনস্বীকার্য। তিনি আরও বলেন, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত পাঠের অর্ধাংশই মুদ্রিত হয়ে ‘বিদ্বজ্জনসমাগমে’ বিতরিত হয়েছিল, তৃতীয় কোনো পাঠের অস্তিত্ব ছিল না।
কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রবোধচন্দ্র সেন ও আদিত্য ওহদেদার উভয়েরই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। শ্ৰীযুক্ত সেন ‘ভোরের পাখি’ প্রবন্ধের শেষাংশে পাঠান্তর-সহ প্রতিবি-পাঠটি অবিকল উদ্ধৃত করেছেন। এতে দেখা যায় ১-১৮ স্তবকের মধ্যে ‘দুলায়্যে’ ‘চড়ায়্যে’ ইত্যাদি বানানগুলি ‘দুলায়ে’ ‘চড়ায়ে’ রূপে পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু ১৯-২৭ স্তবকে একটি ছাড়া এই রূপগুলি অপরিবর্তিতই থেকে গেছে—এমনকি ১৭-১৮ স্তবকের ধুয়াটি ২৭ স্তবকের শেষে যখন পুনরাবৃত্ত হয়েছে তখন প্রথমটিকে সংশোধিত ও দ্বিতীয়টিকে অপরিবর্তিত রূপে পাওয়া যায়, ১৮ স্তবকের ‘খুলে দাও’ শব্দ দুটি ২৭ স্তবকে খুল্যে দেও’ বানানে মুদ্রিত। ১৭ স্তবকের ‘স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতল হোক্ একাকার’ চরণটি তত্ত্ববোধিনী-পাঠের অতিরিক্ত, কিন্তু ২৭ স্তবকে এই চরণটিকে দেখা যায় না। তাছাড়া প্রথম ১৮টি স্তবকে [১১১ চরণ] পরিবর্তনের সংখ্যা যেখানে ৩৮টি, শেষ ৯টি স্তবকে [১০০ চরণ] এই সংখ্যা সেখানে ১০টি মাত্র, বলা যেতে পারে চরণ বিন্যাসের পার্থক্য ছাড়া কবিতাটির শেষাংশের পাঠ মোটামুটি এক। এর থেকে বোঝা যায়, কবিতাটির যে অংশ মুদ্রিত হয়ে বিদ্বজ্জনসমাগম’-এ প্রদত্ত হয়েছিল বলে অনুমিত হয়েছে, প্রধানত সেই অংশটুকুতেই ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়। একই কবিতার দু’অংশে দু’রকম বানানরীতি ব্যবহারের এই অসংগতি সম্পাদক রামসর্বস্ব ও লেখক রবীন্দ্রনাথকে পীড়িত করেনি, এটি খুব আশ্চর্যজনক। শেষ অংশটিতে সংশোধনের কোনো চিহ্ন না থাকলে মনে করা যেত রবীন্দ্রনাথ এই অংশের পুফ দেখেননি, কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি এখানেও ১০টি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই রহস্য সমাধানের জন্য পণ্ডিত-মণ্ডলীকে আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রতিবিম্ব পত্রিকার সংখ্যাগুলি আমরা দেখিনি। কিন্তু ভাদ্র-সংখ্যা তত্ত্ববোধিনী-র ‘নূতন পুস্তক সমালোচনা’-য় [পৃ ৯৬] এর প্রথম সংখ্যাটির যে সমালোচনা প্রকাশিত হয়, তা থেকে পত্রিকাটির আখ্যাপত্র ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে কিছু সংবাদ জানা যায় : ‘প্রতিবিম্ব। সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, শিল্প, পুরাবৃত্ত, বার্তা শাস্ত্র, জীবনবৃত্ত, শব্দ শাস্ত্র ও সঙ্গীতাদি বিষয়ক মাসিক পত্র ও সমালোচন। শ্রীরামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণ কর্তৃক সম্পাদিত। কলিকাতা, ভিক্টোরিয়া যন্ত্রে মুদ্রিত, ১২৮২। এই সংখ্যায় নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি প্রকাশিত হইয়াছে। ১ম সূচনা, ২য় মনু ও তাঁহার রাজনীতি, ৩য় উদাসীন যোগী বেশে সাজারে আমায়, ৪র্থ বিজ্ঞান, ৫ম আলঙ্কারিক শিল্প, ৬ষ্ঠ প্রকৃতির খেদ, ৭ম পৌরাণিক ভূবৃত্তান্ত, ৮ম আয়ুর্ব্বেদ। স্বীয় লেখকগণের নাম ঘোষণা বিষয়ে প্রতিবিম্বের কোন আড়ম্বর নাই কিন্তু আমরা শুনিতে পাই এই মাসিক পত্র প্রণয়ন কার্য্যে উত্তম উত্তম লেখক ব্রতী আছেন। “আলঙ্কারিক শিল্পের” ন্যায় গদ্য প্রস্তাব ও “প্রকৃতির খেদের” ন্যায় কবিতা যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তাহা সাধারণের সমাদর ভাজন না হইয়া কখনই থাকিতে পারে না।…আমরা শুনিলাম পরলোকগত শ্যামাচরণ শ্রীমণি মহাশয় আলঙ্কারিক শিল্প ও পৌরাণিক ভূবৃত্তান্ত এই প্রস্তাবদ্বয় লিখিয়াছেন।…’
এর পরে রবীন্দ্রনাথের যে-রচনাটির সন্ধান আমরা পাই, তার কথা রবীন্দ্রনাথ কোথাও উল্লেখ করেননি এবং আমাদের অজ্ঞাতই থেকে যেত যদি বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি-রোমন্থন না করতেন। তিনি বলেছেন :
রবীন্দ্রনাথ তখন বাড়ীতে রামসর্বস্ব পণ্ডিতের নিকট সংস্কৃত পড়িতেন। আমি ও রামসর্ব্বস্ব দুইজনে রবির পড়ার ঘরে বসিয়াই, “সরোজিনী”র প্র সংশোধন করিতাম। রামসর্বস্ব খুব জোরে জোরে পড়িতেন। পাশের ঘর হইতে রবি শুনিতেন, ও মাঝে মাঝে পণ্ডিত মহাশয়কে উদ্দেশ্য করিয়া, কোন্ স্থানে কি করিলে ভাল হয়, সেই মতামত প্রকাশ করিতেন। রাজপুত মহিলাদের চিতাপ্রবেশের যে একটা দৃশ্য আছে, তাহাতে পূৰ্বে আমি গদ্যে একটা বক্তৃতা রচনা করিয়া দিয়াছিলাম। যখন এই স্থানটা পড়িয়া প্রফু দেখা হইতেছিল, তখন রবীন্দ্রনাথ পাশের ঘরে পড়াশুনা বন্ধ করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া বসিয়া শুনিতেছিলেন। গদ্যরচনাটি এখানে একেবারেই খাপ খায় নাই বুঝিয়া, কিশোর রবি একেবারে আমাদের ঘরে আসিয়া হাজির। তিনি বলিলেন—এখানে পদ্যরচনা ছাড়া কিছুতেই জোর বাঁধিতে পারে না। প্রস্তাবটা আমি উপেক্ষা করিতে পারিলাম না—কারণ, প্রথম হইতেই আমারও মনটা কেমন খুঁৎখুঁৎ করিতেছিল। কিন্তু এখন আর সময় কৈ? আমি সময়াভাবের আপত্তি উত্থাপন করিলে, রবীন্দ্রনাথ সেই বক্তৃতাটির পরিবর্ত্তে একটা গান রচনা করিয়া দিবার ভার লইলেন, এবং তখনই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই “জ্বল্ জ্বল্ চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ” এই গানটি রচনা করিয়া আনিয়া, আমাদিগকে চমৎকৃত করিয়া দিলেন। ৩৭
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিখ্যাত নাটক ‘সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ নাটক’ প্রকাশিত হয় [বেঙ্গল লাইব্রেরির ক্যাটালগ অনুযায়ী] 30 Nov 1875 [মঙ্গল ১৫ অগ্রহায়ণ ১২৮২]। গানটি আছে নাটকের ষষ্ঠ অঙ্কের একেবারে শেষ অংশে[১ম সং, পৃ ২৩৩-৩৮]। সুতরাং শেষ ফর্মার প্রুফ দেখার সময়েই ঘটনাটি ঘটেছিল। কাজেই নাটকের প্রকাশের তারিখটি যদি ঠিক হয় [ঠিক বলেই মনে হয়; রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ যখন বোটে করে শিলাইদহে যান, তখন ২৩ অগ্র ‘কর্ত্তামহাশয়ের নিকট ছোটবাবুর সরাজিনী পুস্তক’ পাঠাবার হিসাব পাওয়া যায়], তাহলে আমরা গানটির রচনাকাল কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহ বা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ [Nov 1875-এর মাঝামাঝি] বলে নির্ধারণ করতে পারি। কিশোর রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা যে যথার্থ ছিল, তার সমর্থন পাওয়া যায় সাধারণী-র ‘নাটক সমালোচন’-এ : ..আমাদের বিবেচনায় নাটকে স্থল বিশেষে ছন্দোময়ী রচনাভাবে রসহানি ঘটিয়াছে।’ [৯ ফাল্গুন। ১৯৬]
২ মাঘ [শনি 15 Jan 1876] গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারে ‘সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ নাটক’-এর প্রথম অভিনয় হয়। সরোজিনীর ভূমিকায় বিখ্যাত অভিনেত্রী বিনোদিনী ও বিজয়সিংহের ভূমিকায় অমৃতলাল বসু অভিনয় করেন। তখনকার দিনে নাটকটি সাহিত্য ও অভিনয়-ক্ষেত্রে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আমাদের ধারণা, এই সমাদরের পিছনে রবীন্দ্রনাথ-রচিত এই গানটির অবদান কম নয়। কিন্তু বহুকাল প্রকৃত রচয়িতার পরিচয়টি না জানা থাকায় সমস্ত প্রশংসা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের খাতেই জমা হয়েছে [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য : ২]।
রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণ-সম্পাদিত প্রতিবিম্ব পত্রিকাটি দীর্ঘজীবী হয়নি। মাত্র সাত মাস পরে অগ্রহায়ণ ১২৮২ থেকে এটি শ্রীকৃষ্ণ দাস-সম্পাদিত জ্ঞানাঙ্কুর পত্রিকার সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব নামে প্রকাশিত হতে থাকে। আশ্বিন ১২৭৯-তে জ্ঞানাঙ্কুর প্রথম রাজশাহী বোয়ালিয়া থেকে প্রকাশিত হয়। প্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘স্বর্ণলতা’ ধারাবাহিকভাবে এই পত্রিকারই প্রথম বর্ষে অংশত আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিবিম্বএর সঙ্গে সম্মিলিত হবার পর পত্রিকাটির চতুর্থ বর্ষে [অগ্রহায়ণ ১২৮২-কার্তিক ১২৮৩] রবীন্দ্রনাথের ‘প্রলাপ’ নামক কবিতা-গুচ্ছ, ‘বনফুল’ কাব্যোপন্যাস ও প্রথম কাব্যসমালোচনামূলক গদ্যরচনা ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা, অবসরসরোজিনী ও দুঃখ সঙ্গিনী’ প্রকাশিত হয়। এই সময়ে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গেও পত্রিকাটির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘পাতঞ্জলের যোগশাস্ত্র’-শীর্ষক দার্শনিক প্রবন্ধটি ধারাবাহিকভাবে পত্রিকাটিতে মুদ্রিত হয়। অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর [‘(উদাসিনী গীতিকাব্য লেখক প্রণীত)’] ‘মাধবমালতী’ গাথাকাব্যটির কিয়দংশ প্রকাশিত হয়। পৌষ ১২৮২ সংখ্যায় [পৃ ৭৯-৮১]।
এই ‘রচনা-প্রকাশ’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
এ-পর্যন্ত যাহাকিছু লিখিতেছিলাম তাহার প্রচার আপনা-আপনির মধ্যেই বদ্ধ ছিল। এমনসময় জ্ঞানাঙ্কুর নামে এক কাগজ বাহির হইল। কাগজের নামের উপযুক্ত একটি অঙ্কুরোদগত কবিও কাগজের কর্তৃপক্ষের সংগ্রহ করিলেন। আমার সমস্ত পদ্যপ্রলাপ নির্বিচারে তাঁহারা বাহির করিতে শুরু করিয়াছিলেন। *
রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির মধ্যে অবশ্য একটু ত্রুটি আছে। তত্ত্ববোধিনী ও প্রতিবিম্ব-তে প্রকাশিত রচনাগুলিকে আপনা-আপনির মধ্যে বদ্ধ বলা গেলেও অমৃতবাজার পত্রিকা-য় ‘হিন্দুমেলার উপহার’ বা বান্ধব-এ ‘হোক্ ভারতের জয়’ কবিতার প্রকাশ সম্পর্কে তেমন বলা যায় না। আর বলাই বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ-কথিত পত্রিকাটির নাম ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ নয়, জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব-জ্ঞানাঙ্কুর-এর প্রথম তিনটি বর্ষে তাঁর কোনো রচনা প্রকাশিত হয়নি।
জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্বতে বর্তমান বৎসরের কাল-সীমায় প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনার তালিকাটি এইরূপ:
৪।১, | অগ্রহায়ণ | পৃ ১৫-১৭ ‘প্রলাপ’ | দ্র র°র° ৩ [প. ব., ১৩৯০]।১১০১-০৬ |
ঐ ঐ | পৃ ৩৫-৩৮ | ‘বনফুল। /কাব্য/প্রথম সর্গ’ | দ্র বনফুল। অ-১। ৫১-৫৭ |
৪। ৩, মাঘ, | পৃ ১৩৫-৩৮ | ‘বনফুল/২য় সর্গ’ | দ্ৰ ঐ। অ-১। ৫৭-৬৫ |
৪। ৪, ফাল্গুন, | পৃ ১৯২ | ‘প্রলাপ’ | দ্র র°র° ৩ [প. ব.]। ১১০৬-০৮ |
৪।৫, চৈত্র, | পৃ ২২৮-৩৪ | ‘বনফুল/৩য় স্বর্গ’ [য] | দ্র বনফুল। অ-১। ৬৫-৭৯ |
‘প্রলাপ’ কবিতাগুচ্ছের আর একটি প্রকাশিত হয় বৈশাখ ১২৮৩ সংখ্যায়, ‘বনফুল’ আটটি সর্গে সমাপ্ত হয় আশ্বিন-কার্তিক ১২৮৩ যুগ্ম-সংখ্যায়।
‘প্রলাপ’ কবিতাগুলি কোন্ সময়ে রচিত হয়েছিল, আমাদের জানা নেই। কিন্তু রচনাকাল ও প্রকাশ-কালের মধ্যে খুব বেশি ব্যবধান নেই বলেই আমাদের ধারণা এবং ভাব ও ভাষা লক্ষ্য করলে মনে হয় তিনটি কবিতা বিভিন্ন সময়ে রচিত। এই কবিতাগুলি রচনার সময় তাঁর মানসিক পরিপ্রেক্ষিতটি রবীন্দ্রনাথ এইভাবে চিত্রিত করেছেন:
বাড়ির লোকেরা আমার হাল ছাড়িয়া দিলেন। কোনোদিন আমার কিছু হইবে এমন আশা, না আমার না আর কাহারও মনে রহিল। কাজেই কোনোকিছুর ভরসা না রাখিয়া আপন-মনে কেবল কবিতার খাতা ভরাইতে লাগিলাম। সে-লেখাও তেমনি। মনের মধ্যে আর-কিছুই নাই, কেবল তপ্ত বাষ্প আছে—সেই বাষ্পভরা বুদ্বুদ্রাশি, সেই আবেগের ফেনিলতা, অলস কল্পনার আবর্তের টানে পাক খাইয়া নিরর্থক ভাবে ঘুরিতে লাগিল। তাহার মধ্যে কোনো রূপের সৃষ্টি নাই, কেবল গতির চাঞ্চল্য আছে। কেবল টগ্বগ্ করিয়া ফুটিয়া ওঠা, ফাটিয়া ফাটিয়া পড়া। তাহার মধ্যে বস্তু যাকিছু ছিল তাহা আমার নহে, সে অন্য কবিদের অনুকরণ; উহার মধ্যে আমার যেটুকু সে কেবল একটা অশান্তি, ভিতরকার একটা দুরন্ত আক্ষেপ। যখন শক্তির পরিণতি হয় নাই অথচ বেগ জন্মিয়াছে তখন সে একটা ভারি অন্ধ আন্দোলনের অবস্থা।৩৮
‘প্রলাপ’ কবিতাগুচ্ছের মধ্যে এই মানসিকতার ছায়াপাত লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য শুধু প্রলাপ নয়, এই সময়ে লিখিত অধিকাংশ কবিতারই এটি সাধারণ লক্ষণ। ‘কল্পনা’-কে সঙ্গিনী করে নির্জন প্রকৃতির মধ্যে বসে হৃদয়ের কথা-বিনিময়, নিষ্ঠুর পৃথিবীর রূঢ় ব্যবহার, হৃদয়-শোণিত-ক্ষয়কারী তীব্র বিষমাখা মানুষের হাসি ও ঘৃণা উপহাস, হৃদয় দান করে হৃদয় পাবার আকাঙ্ক্ষার ব্যর্থতা ইত্যাদি প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের কৈশোরক কবিতায় প্রায়ই দেখা যায়। পূর্ব-আলোচিত ‘অভিলাষ’ এবং মালতীপুঁথি-র অন্তর্গত ‘প্রথম সর্গ-শীর্ষক কবিতায় এই লক্ষণগুলির পূর্বাভাস আমরা লক্ষ্য করেছি। বর্তমান কবিতাগুচ্ছে লক্ষণগুলি আরো স্পষ্ট রূপ লাভ করেছে।
এই কবিতাগুলির আর-একটি বিশিষ্ট লক্ষণ, এতে বিহারীলালের ‘বঙ্গসুন্দরী’ [১২৭৬] কাব্যের ‘নারী বন্দনা’ ‘চির পরাধিনী’ প্রভৃতি কবিতার ছন্দ অনুসৃত হয়েছে। অরোধ-বন্ধু পত্রিকার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ পূর্বেই এই কবিতাগুলি ও তার ছন্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন: ‘বিহারী চক্রবর্তী মহাশয় তাঁহার বঙ্গসুন্দরী কাব্যে যে-ছন্দের প্রবর্তন করিয়াছিলেন তাহা তিনমাত্ৰামূলক, যেমন—
একদিন দেব তরুণ তপন
হেরিলেন সুরনদীর জলে
অপরূপ এক কুমারীরতন
খেলা করে নীল নলিনীদলে।
…একদা এই ছন্দটাই আমি বেশি করিয়া ব্যবহার করিতাম।…এইটেই আমার অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল।’৩৯ সারদামঙ্গল-এর সঙ্গে তুলনা করে তিনি লিখেছেন: ‘বঙ্গসুন্দরীর ছন্দোলালিত্য অনুকরণ করা সহজ, সেই মিষ্টতা একবার অভ্যস্ত হইয়া গেলে তাহার বন্ধন ছেদন করা কঠিন, কিন্তু সারদামঙ্গলের গীতসৌন্দর্য অনুকরণ-সাধ্য নহে।’৪০ এই যে প্রভেদের কথা তিনি বলেছেন, তা প্রধানত যুক্তাক্ষরের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে। বঙ্গসুন্দরী-র ছন্দ যুক্তাক্ষরের ভার সহ্য করতে পারে না। সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথও ‘প্রলাপ কবিতাগুচ্ছে ও অন্যত্র যুক্তাক্ষর যথাসম্ভব বর্জন করে চলেছেন ও ‘কলপনা’ ‘স্বরগীয়’ ‘সউরভ’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করেছেন। অবশ্য তিনি প্রথম ও তৃতীয় পঙ্ক্তির মধ্যে মিলটি অনেকটা সচেতনভাবেই এড়িয়ে গিয়েছেন, সম্ভবত ছন্দের অতিলালিত্য কমানোর জন্যই।
বনফুল কাব্য-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতির পাণ্ডুলিপিতে লিখেছেন: “পাহাড় হইতে ফিরিয়া আসিয়া ‘বনফুল’ নামে যে একটি কবিতা লিখিয়াছিলাম সেটি বোধ করি জ্ঞানাঙ্কুরেই বাহির হইয়াছিল।” এই উক্তিকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করলে বলতে হয়, জ্যৈষ্ঠ ১২৮০ [May 1873]-তে হিমালয় থেকে ফিরে রবীন্দ্রনাথ এই কাব্য রচনা করেছিলেন। হিমালয়-ভ্রমণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এই কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে, বিশেষ করে প্রথম সর্গটি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এতে কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্ নাটকের যে গভীর ও ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, তাতে আমাদের অন্য ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথাই ভাবতে হয়। রবীন্দ্রনাথের উক্তি থেকেই আমরা জানি যে, তিনি শকুন্তলা পড়েছিলেন গৃহশিক্ষক রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণের কাছে এবং পূর্বেই আমরা এই পড়ার সময় ১২৮২ বঙ্গাব্দের প্রথম দিক বলে নির্ধারণ করেছি। সুতরাং বনফুল কাব্য প্রকাশের মতো এই কাব্য রচনাও বর্তমান বৎসরের কালসীমায় ঘটেছে বলে মনে হয়। লক্ষণীয়, বনফুল কাব্যের সূচনাতেই অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্ নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের দশম শ্লোকে দুষ্যতের উক্তির একাংশ ‘অনাঘ্রাতং পুষ্পং কিসলয়মলূনং কররুহৈঃ’ উদ্ধৃত হয়েছে। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার সময় [১২৮৬] শ্লোকটি আখ্যাপত্রে স্থানলাভ করেছে, কিন্তু পত্রিকায় এটিকে শীর্ষনামের নিচেই দেখা যায়। এই শ্লোকটি ব্যবহার শকুন্তলা নাটকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ পরিচয়কেই সপ্রমাণ করে। তাছাড়া এই কাব্যের নায়িকা কমলার চরিত্রগঠনে শেক্সপীয়রের টেম্পেস্ট নাটকের মিরাণ্ডা ও বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা ছাড়াও শকুন্তলা চরিত্রের প্রভাব অনুভব করা যায়। পার্বত্য-কুটীর ত্যাগ করে যাবার সময় কমলার উক্তি—
হরিণ! সকালে উঠি কাছেতে আসিত ছুটি
দাঁড়াইয়া ধীরে ধীরে আঁচল চিবায়—
ছিড়ি ছিড়ি পাতাগুলি মুখেতে দিতাম তুলি
তাকায়ে রহিত মোর মুখপানে হায়!
—শকুন্তলা নাটকের চতুর্থ অঙ্কে শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার একটি বর্ণনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই প্রভাব থাকা কিছুতেই সম্ভব ছিল না যদি কাব্যটি হিমালয় থেকে প্রত্যাবর্তনের অল্প পরেই রচিত হত।
বনফুল কাব্য যে ১২৮২ বঙ্গাব্দেই লেখা তার আরও কয়েকটি প্রমাণ দেওয়া যায়, প্রধানত ভাষা ও ছন্দের দিক থেকে। এর তৃতীয় সর্গটি মোটামুটি ‘প্রলাপ’-এর ছন্দে লেখা; ভাষার সাদৃশ্যও চোখে পড়ে—
বহিছে মলয় ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে,
নুয়ে নুয়ে পড়ে কুসুমরাশি!
ধীরি ধীরি ধীরি ফুলে ফুলে ফিরি
মধুকরী প্রেম আলাপে আসি!
—ইত্যাদি অংশে। এই সর্গে নীরদের গানটির মধ্যে আমরা প্রলাপ-এর সঙ্গে ভাব-সাদৃশ্যটিও স্পষ্ট চিনে নিতে পারি।
সারদামঙ্গল-এর ‘গীতসৌন্দর্য অনুকরণসাধ্য নয়’ মনে করেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় ছন্দ ও ভাষার দিক দিয়ে এই সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছিলেন তার একটি নিদর্শন তুলে দেওয়া যায় কাব্যটির অষ্টম সর্গ থেকে:
যেন কোন্ সুরবালা
দেখিতে মর্ত্যের লীলা
স্বর্গ হোতে নামি আসি হিমাদ্রিশিখরে
চড়িয়া নীরদ-রথে—
সমুচ্চ শিখর হোতে
দেখিলেন পৃথ্বীতল বিস্মিত অন্তরে।
যুক্তাক্ষরের সুনিপুণ ব্যবহারে ছন্দের ঝংকার ও ধ্বনিবৈচিত্র্য এবং সুষ্ঠু অন্ত্যমিল—যেগুলিকে রবীন্দ্রনাথ সারদামঙ্গল-এর ছন্দের বৈশিষ্ট্য বলে অভিহিত করেছেন,৪১ তার সব-ক’টিই উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে পাওয়া যাবে। এটিও বনফুল যে বর্তমান বৎসরের রচনা তার একটি প্রমাণ—কারণ আমরা জানি, বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গল-সংগীত’ আৰ্য্যদর্শন পত্রিকায় ভাদ্র-পৌষ ১২৮১ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
এই বৎসর রবীন্দ্রনাথের জীবনে আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা সংঘটিত হয়। বিভিন্ন সরকারী কলেজের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের একটি বার্ষিক সম্মিলনে মিলিত করবার প্রচেষ্টা হিসেবে কলেজ রি-ইউনিয়ন’ গত বৎসর থেকেই শুরু হয়েছিল। প্রথম বার্ষিক কলেজ রি-ইউনিয়ন’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল 1 Jan 1875 [শুক্র ১৮ পৌষ ১২৮১] রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের কলকাতার উপকণ্ঠে সিঁথিতে অবস্থিত মরকত-কুঞ্জ [Emerald Bower] নামক উদ্যানে। বর্তমান বসর একই স্থানে দ্বিতীয় বার্ষিক কলেজ রি-ইউনিয়ন অনুষ্ঠিত হয় সরস্বতী পুজোর দিনে ১৮ মাঘ [সোম 31 Jan 1876] তারিখে। [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৫] এই বৎসর যোগদানের সুযোগ উন্মুক্ত হয়েছিল সমস্ত কলেজের ও অন্যান্য প্রধান প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্রদের নিকট। যতীন্দ্রমোহনের ভ্রাতা রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর এই অনুষ্ঠানের সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং চন্দ্রনাথ বসু ছিলেন যুগ্ম-সম্পাদক। রবীন্দ্রনাথ এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে রবীন্দ্রনাথের বেতন যদিও Mar 1876 পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ক্লাসে অনুপস্থিতির কল্যাণে তিনি ইতিমধ্যেই উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্রের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন; সুতরাং এই অনুষ্ঠানে তাঁর যোগদানে কোনো নীতিগত বাধা ছিল না!
রবীন্দ্রনাথ এই অনুষ্ঠানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘সরোজিনী’ নাটক থেকে কয়েকটি তেজোদ্দীপ্ত কবিতা পাঠ করেছিলেন।* আমাদের নিশ্চিত ধারণা, তার একটি হল তাঁরই স্বরচিত ‘জ্বল্ জ্বল্, চিতা! দ্বিগুণ, দ্বিগুণ কবিতাটি। কারণ রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি ও সবশেষে রামদাসের মুখে একটি কবিতা ছাড়া [দৈববাণী ও ভৈরবাচার্যের দেবীবন্দনা বাদ দিয়ে] তেজোদ্দীপ্ত আর কোনো কবিতা এই গদ্যনাটকে দেখা যায় না।
এখানেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম বঙ্কিমচন্দ্রকে দেখেন, এই স্মৃতি তাঁর মনে দৃঢ়মূল হয়ে গিয়েছিল। জীবনস্মৃতিতে তিনি এই অনুষ্ঠান ও বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের একটি দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন:
তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন ছাত্রেরা মিলিয়া একটি বার্ষিক সম্মিলনী স্থাপন করিয়াছিলেন। চন্দ্রনাথ বসু মহাশয় তাহার প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। বোধকরি তিনি আশা করিয়াছিলেন, কোনো-এক দূর ভবিষ্যতে আমিও তাঁহাদের এই সম্মিলনীতে অধিকার লাভ করিতে পারিব—সেই ভরসায় আমাকেও মিলমস্থানে কী একটা কবিতা পড়িবার ভার দিয়াছিলেন। তখন তাঁহার যুবাবয়স ছিল। মনে আছে, কোনো জর্মান যোদ্ধৃকবির যুদ্ধকবিতার ইংরেজি তর্জমা*১ তিনি সেখানে স্বয়ং পড়িবেন, এইরূপ সংকল্প করিয়া খুব উৎসাহের সহিত আমাদের বাড়িতে সেগুলি আবৃত্তি করিয়াছিলেন।৪২
পরবর্তী অংশটি আমরা অন্যত্র থেকে উদ্ধৃত করছি:
সেদিন সেখানে আমার অপরিচিত বহুতর যশস্বী লোকের সমাগম হইয়াছিল। সেই বুধমণ্ডলীর [মধ্যে একটি ঋজু দীর্ঘকায় উজ্জ্বলকৌতুকপ্রফুল্লমুখ গুম্ফধারী প্রৌঢ় পুরুষ চাপকানপরিহিত বক্ষের উপর দুই হস্ত আবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। দেখিবামাত্রই যেন তাঁহাকে সকলের হইতে স্বতন্ত্র এবং … আত্মসমাহিত বলিয়া বোধ হইল। আর সকলে জনতার অংশ, কেবল তিনি যেন একাকী একজন। সেদিন আর কাহারও পরিচয় জানিবার জন্য আমার কোনোরূপ প্রয়াস জন্মে নাই, কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ আমি এবং আমার একটি আত্মীয় সঙ্গী একসঙ্গেই কৌতূহলী হইয়া উঠিলাম। সন্ধান লইয়া জানিলাম তিনিই আমাদের বহুদিনের অভিলষিতদর্শন লোকবিত বঙ্কিমবাবু। মনে আছে, প্রথম-দর্শনেই তাঁহার মুখশ্রীতে প্রতিভার প্রখরতা এবং বলিষ্ঠতা এবং সর্বলোক হইতে তাঁহার একটি সুদূর স্বাতন্ত্রভাব আমার মনে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল।
সেই উৎসব উপলক্ষে একটি ঘরে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দেশানুরাগমূলক স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোক পাঠ এবং তাহার ব্যাখ্যা করিতেছিলেন।*২ বঙ্কিম এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিলেন। পণ্ডিতমহাশয় সহসা একটি শ্লোকে পতিত ভারতসন্তানকে লক্ষ্য করিয়া একটা অত্যন্ত সেকেলে পণ্ডিতী রসিকতা প্রয়োগ করিলেন, সে-রস কিঞ্চিৎ বীভৎস হইয়া উঠিল। বঙ্কিম তৎক্ষণাৎ একান্ত সংকুচিত হইয়া দক্ষিণ-করতলে মুখের নিম্নার্ধ ঢাকিয়া পার্শ্ববর্তী দ্বার দিয়া দ্রুতবেগে অন্য ঘরে পলায়ন করিলেন।
বঙ্কিমের সেই সসংকোচে পলায়নদৃশ্যটি অদ্যাবধি আমার মনে মুদ্রাঙ্কিত হইয়া আছে।৪৩
জীবনস্মৃতি-তেও রবীন্দ্রনাথ ঘটনাটির বিস্তৃত বর্ণনা করেছেন [দ্র ১৭। ৪১৬]।
প্রাসঙ্গিক তথ্য :১
১২৮২ বঙ্গাব্দে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের সম্বন্ধে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ এখানে সংকলিত হল :
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি [Aug 1875] হেমেন্দ্রনাথের সপ্তম সন্তান ও চতুর্থ কন্যা মনীষা দেবীর জন্ম হয়।
অগ্রহায়ণ মাসে স্বর্ণকুমারী দেবীর তৃতীয়া কন্যা উর্মিলা দেবীর অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠিত হয়।
২২ মাঘ [শুক্র 4 Feb 1876] সৌদামিনী দেবীর কনিষ্ঠা কন্যা ইন্দুমতীর [শিশুবয়সে এঁর নাম রাখা হয়েছিল ইন্দ্রাবতী] বিবাহ হয় নিত্যানন্দ*৩ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এঁর সম্পর্কে ইন্দিরা দেবী লিখেছেন : ‘নিত্যবাবুর বেশ লম্বা চওড়া গড়ন, বড় ২ উজ্জ্বল কালো চোখ ও টি কলো নাক ছিল।’৪৪
১২ ফাল্গুন [বুধ 23 Feb 1876] গুণেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র গগনেন্দ্রনাথ এবং তাঁর জ্যেষ্ঠা ভগিনী কাদম্বিনী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র ইন্দুপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপনয়ন হয়।
?৯ চৈত্র [মঙ্গল 21 Mar] সারদাদেবীর ‘একদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ’ অনুষ্ঠিত হয়।
এই বৎসরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায় ক্যাশবহি-র ২২ জ্যৈষ্ঠ [শুক্র 4 Jun] তারিখের হিসাবে : ‘ব° ট্রটমেন এণ্ড ওয়াটকিনস্/শ্রীমতী শরৎকুমারী দেবীর জন্য/বেনেপুকুরের বাটী ক্রয় করা যায়/মূল্য ১০০০০৲ /এস্টাম্প মূল্য—১০০৲/১০১০০৲’। এই বাড়ি কেনার পরেই শরৎকুমারী দেবী অবশ্য সেখানে বসবাস করার জন্য উঠে যাননি। বরং দেখা যায় বাড়িটি মেরামত করে ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ট্যাক্স ইত্যাদি সরকারী তহবিল থেকেই দেওয়া হত। সুতরাং বাড়িটি ক্রয় করার তাৎক্ষণিক কোনো বিশেষ তাৎপর্য দেখা যায় না। কিন্তু এটি দেবেন্দ্রনাথের দূরদৃষ্টির ও সে-অনুযায়ী ব্যবস্থাগ্রহণের মতো বাস্তববুদ্ধির পরিচায়ক। তাঁর পুত্র ও কন্যাদের পরিবার যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তাতে দেবেন্দ্রনাথ স্পষ্টই বুঝতে পারছিলেন যে, জোড়াসাঁকো বাড়ির যথেষ্ট পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেও একদিন এই বাড়িতে সকলের জন্য স্থান সংকুলান করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া কন্যা-জামাতাদের ভরণপোষণের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব ছিল গৃহকর্ত্রী সারদা দেবীর উপর। তিনিই ছিলেন এই বৃহৎ পরিবারের গ্রন্থন-সূত্র। তাই তাঁর মৃত্যুর পর স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায়, দেবেন্দ্রনাথ সৌদামিনী দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী ও বীরেন্দ্রনাথের জন্যও অনুরূপ ব্যবস্থা করেছেন। আগেই উল্লিখিত হয়েছে তিনি ২০ জ্যৈষ্ঠ [বুধ 2 Jun] ও ৪ ফাল্গুন [মঙ্গল 15 Feb 1876] জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে স্বাধীন ব্যবসা ইত্যাদির জন্য বার্ষিক ৬ টাকা সুদে দু’দফায় দশ হাজার টাকা ঋণ দেন। এর পিছনেও তাঁর একই উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে হয়।
প্রাসঙ্গিক তথ্য : ২
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ নাটক’ প্রথম প্রকাশিত হয় বেঙ্গল লাইব্রেরির ক্যাটালগ অনুযায়ী 30 Nov 1875 [১৫ অগ্র] তারিখে এবং এই নাটকে রবীন্দ্রনাথ-রচিত ‘জ্বল্, জ্বল্, চিতা! দ্বিগুণ, দ্বিগুণ’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। নাটকটি সাহিত্য হিসেবে ও অভিনয়ের দিক দিয়ে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এই জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ছিল রবীন্দ্রনাথের লেখা এই কবিতাটি। সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রিকায় নাটকটির যে-সমালোচনাগুলি প্রকাশিত হয়, তার অধিকাংশেই কবিতাটির অনেকখানি করে উদ্ধৃত হয়েছে। সাধারণী-র ৯ ফাল্গুন সংখ্যায় ‘নাটক সমালোচন’-এ ‘ওই যে সবাই পশিল চিতায়…তবু না হইব তোদের দাসী’—এই দীর্ঘ অংশটি উদ্ধৃত হয়। বান্ধব ৩য় বর্ষ ১-২ যুগ্ম-সংখ্যায় [বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১২৮৩] ‘সংক্ষিপ্ত সমালোচন’-এ লেখা হয় : ‘আমরা এই নাটক-খানি সমালোচনা প্রসঙ্গে আর কিছু না বলিয়া ইহার দুইটি কবিতা পাঠকবর্গকে উপহার দিব। আমাদিগের নিশ্চিত ভরসা আছে যে, যিনি তাহা পাঠ করিবেন, তিনিই গ্রন্থকারকে সুকবি বলিয়া প্রশংসা করিবেন, সহৃদয় বলিয়া ভাল বাসিবেন, এবং স্বদেশবৎসল বলিয়া তাঁহার নিকট শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার পাশে বদ্ধ হইবেন [পৃ ৬৪]।’ এর পর সমালোচক দুটি কবিতা নয়, উপরোক্ত একটি কবিতারই দুটি অংশ—‘পরাণে আহুতি দিয়া সমর-অনলে…এর প্রতিফল ভুগিতে হবে ॥’ এবং ‘দেখ্ রে জগৎ, মেলিয়ে নয়ন,…সঁপিছে পরাণ অনল-শিখে ॥’—উদ্ধৃত করেন। আমরা আগেই দেখেছি, রবীন্দ্রনাথের হিন্দুমেলায় পঠিত একটি কবিতা ও ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’-এ পঠিত ‘প্রকৃতির খেদ’ সংবাদপত্রের সপ্রশংস মন্তব্য লাভ করেছিল। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে যে-ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে তার প্রকৃতিই আলাদা। অবশ্য সমালোচক জানতেন না আলোচ্য কবিতাটির প্রকৃত রচয়িতা কে, সুতরাং তাঁর সমস্ত প্রশংসা নাট্যকারের উদ্দেশেই নিবেদিত হয়েছে; কিন্তু আমরা যেহেতু প্রকৃত তথ্য জানি, সেহেতু রবীন্দ্র-কাব্যসমালোচনার ইতিহাসে উক্ত মন্তব্যকে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দিতে পারি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ‘জি পি রায় কোম্পানির যন্ত্রে মুদ্রিত’ ‘জাতীয় সঙ্গীত-প্রথম ভাগ’* গ্রন্থে সংকলকের ‘বিজ্ঞাপন’-এর তারিখ ৬ ফাল্গন ১২৮২] ‘স্বদেশানুরাগোদ্দীপক সঙ্গীতমালা’তে ঊনত্রিশটি সংগীতের মধ্যে, ‘সরোজিনী নাটক’ থেকে এই কবিতাটির ‘দ্যাখ্রে জগৎ মেলিয়ে নয়ন… এর প্রতিফল ভুগিতে হবে।’ [পৃ ৩৭-৩৮] অংশটিও গ্রথিত হয়েছিল।† গানটির সুর-তাল সম্পর্কে নির্দেশ আছে : ‘রাগিনী অহং—তাল একতালা।’ পাদটীকায় লিখিত হয়েছে : ‘ইংরাজি সুরে গান করিতে হয়।’
অভিনয়ের দিক দিয়েও নাটকটি যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছিল এবং সেই সাফল্যের অনেকটাই আলোচ্য গানটির কারণে। সরোজিনীর ভূমিকাভিনেত্রী বিনোদিনী লিখেছেন :
“সরোজিনী” নাটকের একটি দৃশ্যে রাজপুত ললনারা গাইতে গাইতে চিতারোহণ করছেন। সে দৃশ্যটি যেন মানুষকে উন্মাদ করে দিত। তিন চার জায়গায় ধূ ধূ করে চিতা জ্বলছে, সে আগুনের শিখা দু’তিন হাত উঁচুতে উঠে লক্লক্ করছে। তখন ত বিদ্যুতের আলো ছিল না, ষ্টেজের ওপর ৪।৫ ফুট লম্বা সরু সরু কাট জ্বেলে দেওয়া হ’ত। লাল রঙের শাড়ী পরে কেউ বা ফুলের গয়নায় সেজে, কেউ বা ফুলের মালা হাতে নিয়ে এক এক দল রাজপুত রমণী, সেই
“জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ
পরাণ সঁপিবে বিধবা বালা।
জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন
জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা॥
দেখ্ রে যবন দেখ্ রে তোরা
যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে।
সাক্ষী রহিলেন দেবতা তার
এর প্রতিফল ভুগিতে হবে॥” [পাঠে কিছু ভুল আছে]
গাইতে গাইতে চিতা প্রদক্ষিণ করছে, আর ঝুপ করে আগুনের মধ্যে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে পিচকারী করে সেই আগুনের মধ্যে কেরোসিন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে, তাতে কারু বা চুল পুড়ে যাচ্ছে, কারু বা কাপড় ধরে উঠছে—তবুও কারু ভ্রূক্ষেপ নেই—তারা আবার ঘুরে আসছে, আবার সেই আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তখন যে কি রকমের একটা উত্তেজনা হ’ত তা লিখে ঠিক বোঝাতে পারছি না।৪৫
দৃশ্যটি কী ধরনের উন্মাদনা সৃষ্টি করত, উদ্ধৃতিটি থেকে তা স্পষ্টই বোঝা যায়। বলতে দ্বিধা নেই, এই ব্যাপারে সমস্ত কৃতিত্বই রবীন্দ্রনাথ-কৃত এই কবিতা বা গানটির প্রাপ্য।
প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৩
রবীন্দ্রনাথের সংগীত-শিক্ষক যদুভট্ট সম্পর্কে আমরা যে বিবরণ দিয়েছি, তার অতিরিক্ত যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তার পরিমাণ খুবই সামান্য। মোগল সাম্রাজ্যের পতনোন্মুখ অবস্থার জন্য অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে দরবারের সংগীতগুণীরা ভারতের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। তানসেন-বংশীয় এক ধ্রুপদীয়া বাহাদুর খাঁ এই সময়ে বিষ্ণুপুর রাজসভায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে গদাধর চক্রবর্তী ও রামশঙ্কর ভট্টাচার্য খুবই বিখ্যাত। যদুভট্ট এই রামশঙ্করেরই শিষ্য। তিনি ধ্রুপদ, বিশেষত খাণ্ডারবাণী ধ্রুপদে বিশেষ দক্ষ ছিলেন। তানসেনবংশীয় বীনকার কাশেম আলি খাঁর কাছে তিনি সেতার শিক্ষা করেন। সুরবাহার ও পাখোয়াজেও তাঁর দক্ষতা ছিল।৪৬
যদুভট্টের জন্ম বিষ্ণুপুরেই। পিতা সেতারবাদক মধুসূদন ভট্টাচার্য। রামশঙ্করের কাছে প্রাথমিক সংগীতশিক্ষার পর ১৫ বৎসর বয়সে কলকাতায় এসে ধ্রুপদাচার্য গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে প্রায় ১০ বৎসর ধ্রুপদ শিক্ষা করেন। পঞ্চকোটে ও ত্রিপুরার রাজদরবারে মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের সভাগায়ক হিসেবে অনেকদিন নিযুক্ত ছিলেন।৪৭ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র ‘কয়েক বৎসর ধরিয়া যদু ভট্টের নিকট গান শিখিতেন। একটি হারমোনিয়মও কিনিয়াছিলেন।’ গোপালচন্দ্র রায় জানিয়েছেন, যদু ভট্টের বাড়ি বিষ্ণুপুরে হলেও তিনি ঐসময় কিছুদিন কাঁটালপাড়ায় তাঁর ভগিনীর বাড়িতে ছিলেন। এই যদু ভট্টই প্রথম বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম্ সংগীতে সুর দিয়ে গেয়ে তাঁকে শুনিয়েছিলেন।৪৮ সাধারণী পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় চুঁচুড়ায় একটি সংগীত-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে ১২৮৪ বঙ্গাব্দের মাঝামাঝি যদুভট্ট সেখানে শিক্ষকতা করেন।
‘আদি ব্রাহ্মসমাজ সঙ্গীত বিদ্যালয়’-এও যদুভট্ট কিছুদিন সংগীত-শিক্ষা দেন। আষাঢ় ১২৮২-সংখ্যা তত্ত্ববোধিনী-তে ২২ জ্যৈষ্ঠ তারিখ দিয়ে একটি ‘বিজ্ঞাপন’-এ দেখা যায়: ‘আদি ব্রাহ্মসমাজের ব্রহ্মসঙ্গীতের স্থায়িত্ব ও উন্নতি সাধনের জন্য উক্ত সমাজ-মন্দিরের দ্বিতীয়তল গৃহে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় সংস্থাপিত হইয়াছে। অদ্য হইতে তাহার কাৰ্য্য আরম্ভ হইবে। রবিবার ও বুধবার ব্যতীত প্রত্যহ সায়াহ্ন ৭ ॥ ঘণ্টা হইতে ১০ ঘণ্টা পর্য্যন্ত ছাত্রদিগকে বিনা বেতনে উচ্চ অঙ্গের কণ্ঠ ও যন্ত্র সঙ্গীতের শিক্ষা দেওয়া হইবে। প্রসিদ্ধ গায়ক ও সঙ্গীত-শাস্ত্রবেত্তা শ্রীযুক্ত বাবু যদুনাথ ভট্ট অধ্যাপনা কার্য্যের ভার গ্রহণ করিয়াছেন।…’ [পৃ ৫৬]
সোমপ্রকাশ পত্রিকায় ২৫ বৈশাখ ১২৯০ [২৭। ২৫] তারিখের সংবাদ থেকে জানা যায়, ২২ চৈত্র ১২৮৯ (বুধ 4 Apr 1883] মাত্র ৪২ বৎসর বয়সে বিশিষ্ট গায়ক যদুনাথ ভট্টাচার্যের মৃত্যু হয়।
স্বল্পকালীন পরিচয়েও রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভার প্রতি সশ্রদ্ধ মনোভাব পোষণ করেছেন আ-জীবন। তিনি বলেছেন: ‘ছেলেবেলায় আমি একজন বাঙালি গুণীকে দেখেছিলাম, গান যাঁর অন্তরের সিংহাসনে রাজমর্যাদায় ছিল—কাষ্ঠের দেউড়িতে ভোজপুরী দরোয়ানের মতো তাল-ঠোকাঠুকি করত না।…তিনি বিখ্যাত যদুভট্ট’।৪৯ অন্যত্র তাঁর উক্তি : ‘তিনি ওস্তাদজাতের চেয়ে ছিলেন অনেক বড়ো। তাঁকে গাইয়ে বলে বর্ণনা করলে খাটো করা হয়। তাঁর ছিল প্রতিভা, অর্থাৎ সংগীত তাঁর চিত্তের মধ্যে রূপ ধারণ করত। তাঁর রচিত গানের মধ্যে যে বিশিষ্টতা ছিল তা অন্য কোনো হিন্দুস্থানী গানে পাওয়া যায় না।…যদুভট্টর মতো সংগীতভাবুক আধুনিক ভারতে আর কেউ জন্মেছে কিনা সন্দেহ।’৫০
শান্তিদেব ঘোষ জানিয়েছেন, বাহার রাগিণী ও তেওড়া তালে রচিত যদুভট্টের একটি গান ‘আজু বহত সুগন্ধ পবন সুমন্দ’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আজি বহিছে বসন্তপবন সুমন্দ তোমারি সুগন্ধ হে’ গানটি রচনা করেন [১২৯২ বঙ্গাব্দের মাঘোৎসবে গীত]।৫১
প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৪
শিলাইদহ অর্থাৎ পরগনা বিরাহিমপুর [নদীয়া কালেকটরেটের ৩৪৩০ নং তৌজি] ঠাকুর পরিবারের অন্যতম প্রাচীন জমিদারি। দ্বারকানাথের পালক-পিতা রামলোচনের উইলে [২২ অগ্রহায়ণ ১২১৪; Dec 1807] স্বোপার্জিত সম্পত্তির তালিকায় এই জমিদারির উল্লেখ পাওয়া যায়। দ্বারকানাথ 20 Aug 1840 [ভাদ্র ১২৪৭] তারিখে যে ট্রাস্টডীড প্রস্তুত করেন, তাতে অন্য তিনটি জমিদারির সঙ্গে এই পৈতৃক জমিদারিটিও ট্রাস্ট সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
শিলাইদহ গ্রামটি ছিল পূর্বতন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার অন্তর্গত কুমারখালি থানার অধীনে। এই গ্রামের উত্তরে পদ্মা এবং পশ্চিম দিক দিয়ে গোরাই নদী প্রবাহিত; দুটি নদী যেন গ্রামটিকে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে রয়েছে। গ্রামটির নাম পূর্বে শিলাইদহ ছিল না, সরকারী সেট্লমেন্ট দলিলপত্রে খোরসেদপুর, কশবা ও হমিরহাট মৌজা নামেই অঞ্চলটি অভিহিত হয়েছে। কথিত আছে, নীলকর সাহেবেরা যখন এখানে কুঠি স্থাপন করে, তখন শেলী নামে একজন সাহেব এখানে বাস করতেন; পদ্মা ও গোরাই নদীর সংগমস্থলে যে একটি দহের সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে এই শেলী সাহেবের নাম যুক্ত হয়ে স্থানটির নাম হয় শিলাইদহ। রবীন্দ্রনাথ পুরোনো নীলকুঠির প্রাঙ্গণে যে দুটি কবরের কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলি নাকি এই শেলী সাহেব ও তাঁর স্ত্রীর। খোরসেদপুর নামেরও একটি ইতিহাস আছে, জনৈক খোরসেদ ফকিরের নাম তার সঙ্গে যুক্ত— ‘খোরসেদ দরগা’ তাঁরই স্মৃতি বহন করছে।* গ্রামটির নাম মুসলমানী হলেও অধিবাসীদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা ছিল যথেষ্ট, তাঁদের অনেকেই ছিলেন উচ্চবর্ণের। গ্রামের মাঝখানে অবস্থিত গোপীনাথদেবের মন্দির। কথিত আছে, রাজা সীতারাম গোপীনাথজীকে প্রতিষ্ঠিত করেন, পরে গ্রামটি রানী ভবানীর অধিকারে এলে তিনি দেবসেবার জন্য ব্রহ্মত্র জমি দান করেছিলেন। গোপীনাথদেবের কারুকার্যখচিত কাঠের রথ ছিল প্রকাণ্ড, ছেলেবেলা-য় রবীন্দ্রনাথ রথতলার মাঠের উল্লেখ করেছেন।
কুঠিবাড়িটি অবস্থিত ছিল পদ্মা ও গোরাই [মধুমতী] নদীর সংগমস্থলে বুনাপাড়ায়—এখানেই কুঠিরহাট ও শিলাইদহ খেয়াঘাট।† বিস্তৃত বাগানের মধ্যে অবস্থিত তেতালা কুঠিবাড়ির নীচের তলায় জমিদারি-কাছারি ছিল, উপরতলা ব্যবহৃত হত জমিদারবাবুদের বাসস্থান হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসে এই কুঠিবাড়িটিতেই উঠেছিলেন। কয়েক বৎসর পরে [শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর অনুমান ১২৯০ সালে] পদ্মা এইদিকের পাড় ভাঙতে আরম্ভ করলে বাড়িটি নদীগর্ভে যাবে এই আশঙ্কায় সেটিকে ভেঙে তার মালমশলা দিয়ে নদী থেকে কিছু দূরে নতুন কুঠিবাড়ি তৈরি হয়। কিন্তু পদ্ম পুরোনো কুঠিটিকে গ্রাস করল না, বাগানের গেট পর্যন্ত এসে আবার ফিরে গেল। নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ বহুদিন অটুট ছিল। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ১৩০৫ বঙ্গাব্দে [1898] রবীন্দ্রনাথ যখন সপরিবারে শিলাইদহে বাস করতে আসেন, তখনও নদীর ধারে বেড়াতে গিয়ে তাঁরা সেই ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন।৩
প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৫
‘কলেজ রি-ইউনিয়ন’ নামক অনুষ্ঠানটি রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির দ্বারাই ইতিহাসে স্থান লাভ করেছে। এটির সূত্রপাত হয় 1875-এ। রাজনারায়ণ বসু এ-বিষয়ে লিখেছেন : ‘ইংরাজী ১৮৭৫ সালে প্রথম কলেজ-সম্মিলন (College Reunion) হয়। আমি উহা প্রথম বিখ্যাত জগদীশনাথ রায়ের নিকট প্রস্তাব করি। জগদীশনাথ রায়ের সঙ্গে হিন্দু কলেজে পড়িয়াছিলাম। ইনি বাঙ্গালীর মধ্যে সর্বপ্রথম জেলা পুলিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট হন। যখন আমি তাঁহার নিকট ঐ প্রস্তাব করি, তখন তিনি বালেশ্বরের জেলা পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন। আমি প্রথম এই প্রস্তাব করি কেবলমাত্র পুরাতন হিন্দু কলেজের ছাত্রেরা কোন উদ্যানে সম্মিলিত হইয়া আমোদ আহ্লাদ করেন। জগদীশনাথ রায় আমার প্রস্তাবকে প্রসারিত করিয়া সকল কলেজের ছাত্রদিগকে তাহার অন্তর্ভূত করেন। প্রথম কলেজ সম্মিলন রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের “মরকত নিকুঞ্জ” নামক বিখ্যাত উদ্যানে হয়। আমি সেই সম্মিলনে হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্সী কলেজের ইতিবৃত্ত পাঠ করি।…আমার কলেজের সমাধ্যায়ী ও মহাত্মা রামগোপাল ঘোষের ভাগিনেয় নবীনচন্দ্র পালিতের প্রতি বাঙ্গলা পুস্তক হইতে বাছ বাছা স্থান পড়িবার ভার ছিল। তিনি একটি অশ্লীল স্থান খানিক পড়িয়াছেন এমন সময় জগদীশনাথ রায় তাঁহাকে একটি ধমক ও তৎপরে একটি উপহাস দ্বারা তাহা হইতে বিরত করিলেন। রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এক অতি সামান্য বেশ ধারণ করিয়া সকলের অভ্যর্থনা ও পরিচর্যা করিয়াছিলেন। এই সামান্য বেশ ধারণ জন্য বাঙ্গলা সংবাদপত্র সকল তাঁহাকে প্রশংসা করিয়াছিল।’৫৩ সম্মিলনটি হয় 1 Jan 1875] [শুক্র ১৮ পৌষ ১২৮১] তারিখে। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার ২২ খণ্ড ১ম সংখ্যাতে [4 Jan 1875] অনুষ্ঠানটির একটি বিবরণ প্রকাশিত হয়। এই বিবরণ থেকে জানা যায় সরকারী কলেজগুলির তিন শতাধিক প্রাক্তন ছাত্র অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এঁদের মধ্যে প্রাচীনতম ছাত্র প্যারীচাঁদ মিত্র এই সম্মিলনে সভাপতিত্ব করেন। রাজনারায়ণ বসুর উক্ত বক্তৃতা ছাড়াও হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজকৃষ্ণ মুখখাপাধ্যায় প্রভৃতি কয়েকজন এই উপলক্ষে রচিত কয়েকটি কবিতা পাঠ করেন। উদ্যানটি আলোকমালায় সজ্জিত হয়েছিল এবং সংগীত, খেলাধুলা ও যাদুবিদ্যা-প্রদর্শন অনুষ্ঠানের প্রধান অঙ্গ ছিল। সম্মিলনের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে পত্রিকাটি এটিকে স্থায়ী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার জন্য নানারকম প্রস্তাব করে।
দ্বিতীয় বার্ষিক কলেজ রি-ইউনিয়ন একই স্থানে অনুষ্ঠিত হয় সরস্বতী পুজোর দিন 31 Jan 1876 [সোম ১৮ মাঘ ১৮৮২] তারিখে। এই বত্সরের অনুষ্ঠান সম্পর্কে রাজনারায়ণ বসু লেখেন : ‘দ্বিতীয় বৎসরে কলেজ-সম্মিলনে জগদীশনাথ রায় উপস্থিত ছিলেন না। সকল বিষয়ে অধ্যক্ষতা আমাকে করিতে হইয়াছিল।…বিখ্যাত “শকুন্তলাতত্ত্ব” প্রণেতা বাবু চন্দ্রনাথ বসু এম. এ. এইবার সম্মিলনের সম্পাদক নিযুক্ত হইয়াছিলেন। এবার বক্তৃতা ও গানের শেষে কতকগুলি নাটকের বাছা বাছা স্থান অভিনীত হইয়াছিল ও কতকগুলি মূক অভিনয় প্রদর্শিত হইয়াছিল।’৫৩
বেঙ্গলী পত্রিকার বিজ্ঞাপনে যে অনুষ্ঠান-সূচি ঘোষিত হয় সেটি এইরূপ : ‘The business of the Reunion will commence at noon and last till 8 P.M. and consist of the delivery of lectures, recital of poems, readings from authors, musical performances, exhibition of tableaux vivants of Ragas and Raginis and pictures on water, tableaux of Scenes from Meghanada.’ এই বিজ্ঞাপনেই কলেজ রি-ইউনিয়ন কমিটির সদস্যদের নাম প্রকাশিত হয় : জগদীশনাথ রায়, প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, বিচারপতি রমেশচন্দ্র মিত্র, অধ্যাপক এইচ. ব্লখমান, ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, মৌলভী আবদুল লতীফ খান বাহাদুর, পণ্ডিত মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, রেভারেণ্ড লালবিহারী দে, ব্রহ্মমোহন মল্লিক, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, শ্রীনাথ ঘোষ, উমেশচন্দ্র দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, রামশঙ্কর সেন, ভূদেব মুখোপাধ্যায় এবং জি. সি. দত্ত। রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ, চন্দ্রনাথ বসু যুগ্ম-সম্পাদক এবং খগেন্দ্রনাথ রায় সহ-সম্পাদক নিযুক্ত হন।
বেঙ্গলী পত্রিকার প্রতিবেদন [Vol. XVII, No. 6, Feb 6] থেকে জানা যায়, বেলা দেড়টা নাগাদ ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে চন্দ্রনাথ বসু সম্মিলনের উদ্বোধন করে বলেন, ইংরেজি শিক্ষিত একটি গোষ্ঠী যাঁরা হিন্দু সমাজে বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছেন তাঁদের একস্থানে সমবেত করে এবং সৌহার্দ্যের পরিবেশে তাঁদের মধ্যে চিন্তা অনুভূতি ও আবেগ বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি করে এই সম্মিলন একটি প্রয়োজনীয় কাজ করেছে। সমাজের বর্তমান অবস্থায় যখন ঐক্যসাধনের নীতিগুলি সম্পূর্ণ অস্বীকৃত বা শক্তিশালী নয় তখন এইরূপ পুনর্মিলনের বিশেষ প্রয়োজন এবং এই কারণেই হিন্দু কলেজের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র গত বৎসর এই সম্মিলনের সূচনা করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বৃহৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই কলেজ সম্মিলন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে এবং এর সংগঠক ও সমর্থকরা যা পরিকল্পনাও করতে পারেননি সেই রকম সংগঠিত ও বিস্তৃত আকারে প্রতিষ্ঠানটি ইতিহাসে স্থান লাভ করবে। সমস্ত শিক্ষিত দেশবাসীর মধ্যে এই সম্মিলনের প্রস্তাব যেরূপ সহানুভূতি লাভ করেছে, তাঁর কাছে তা খুব উৎসাহব্যঞ্জক লক্ষণ বলে মনে হয়েছে এবং রি-ইউনিয়ন কমিটির সঙ্গে তাঁদের আন্তরিক সহযোগিতার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ ‘সরোজিনী’ নাটক থেকে কয়েকটি তেজোদ্দীপ্ত কবিতা পাঠ করেন ও চন্দ্রনাথ বসু বিখ্যাত জার্মান কবি ও বীর চার্লস থিওডোর কর্নারের ‘Lyre and Sword’ কাব্য থেকে দুটি সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করে শোনান।
এরপর শ্রীনাথ দত্ত কৃষি-বিষয়ে একটি সারগর্ভ বক্তৃতা দেন।
রাজনারায়ণ বসু হিন্দু কলেজের অন্যতম বিশিষ্ট ছাত্র পরলোকগত প্যারীচরণ সরকারের স্মৃতির প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা জানিয়ে মদ্যপান বিষয়ে তাঁর তীব্র বিরোধিতার কথা উল্লেখ করেন।
তারপর দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অনুপম কাব্য ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ থেকে কয়েকটি আকর্ষণীয় অংশ পাঠ করে শোনান। এরপর যখন সুকবি হেমচন্দ্রের গীতিমূর্চ্ছনাময় একটি কবিতা* মুদ্রিতাকারে সমবেত বিদগ্ধমণ্ডলীর হাতে বিতরণ করা হল এবং উপযুক্ত গাম্ভীর্যসহকারে পঠিত হল তখন তাঁরা পবিত্র ও বিষাদময় শান্তরসের আস্বাদন লাভ করে প্রীতি, বেদনা ও আশার একটি অজানা অথচ প্রচণ্ড আবেগপূর্ণ উপলব্ধির জগতে উত্তীর্ণ হলেন।
অনুষ্ঠানের পরবর্তী অংশের বিবরণ আমরা সাধারণী [৫। ১৫, ২৪ মাঘ, পৃ ১৭৩] থেকে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি : ‘…এই বিদ্বজ্জন সভায় কয়েকটী নির্ব্বাক জীবন্ত প্রতিমা প্রদর্শিত হইয়াছিল।…সস্ত্রীক শ্রীরাগ, পুষ্পলাঙ্কৃত বসন্তরাগ, ইন্দ্রজিতের রণযাত্রা নিবারণ-কারিণী প্রমীলা, মহাযোগীর যোগভঙ্গকারী—সশস্ত্র ফুলবাণ, সরমা অঙ্ক দেশে মূর্চ্ছিতা সীতা, নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ভূপাতিত মেঘনাদ, সঙ্গীতাধিষ্ঠাত্রী সরস্বতী এবং কাব্যাধিষ্ঠাত্রী বাগেদবী—সকলই সুন্দর, পৌরাণিক, মনোরম এবং উজ্জ্বল।
‘বাঙ্গালার রঙ্গভূমিতে যাহা কখন প্রদর্শিত হয় নাই, এরূপ একটী অভিনব অভিনয় প্রকরণ শৌরীন্দ্র বিদ্বজ্জন সমক্ষে উপস্থিত করিয়াছিলেন। “প্রহেলিকা অভিনয়” বলিয়া ইহার নামকরণ হইয়াছে এবং ‘অভিনয় দর্শনে কোন যৌগিক শব্দ নিরূপণ’ বলিয়া তাহার ব্যাখ্যা হইয়াছে।…’
‘নাস-তরঙ্গ’, সানাই ইত্যাদি বাদ্য পরিবেশনের পর রাত্রি প্রায় ন-টায় অনুষ্ঠানটির সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
এই বিবরণের মধ্যে ‘প্রহেলিকা অভিনয়’টি আমাদের খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ একসময়ে অনেকগুলি ‘হেঁয়ালি নাট্য’ বা Charade রচনা করেছিলেন এবং সেগুলি বালক এবং ভারতী ও বালক পত্রিকায় ১২৯২-৯৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাভাষায় এই ধরনের নাট্যরচনার সূত্রপাত এই প্রহেলিকার মাধ্যমেই হয়েছে বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, এ-প্রসঙ্গে আমরা এ তথ্যটিও স্মরণ করতে পারি।
প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৬
এ বৎসরে হিন্দুমেলার দশম বার্ষিক অধিবেশন হয় ৮ ও ৯ ফাল্গুন শনি ও রবিবার [19-20 Feb 1876] রাজা বদনচাঁদের টালার বাগানে। প্রথম দিন স্ত্রীলোকদের তৈরি কার্পেটের জুতো, টুপি, আসন, ছবি প্রভৃতি প্রদর্শিত হয়। দুটি বালিকা বিদ্যালয় থেকে দুজন করে চারজন বালিকা সভায় স্বরচিত প্রবন্ধ পাঠ করে [যোগেশচন্দ্র বাগল লিখেছেন, এই বালিকাচতুষ্টয়ের মধ্যে একজন হয়তো লেডি অবলা বসু (দাস), দ্র হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত। ৪৪]। সভাপতি দ্বিজেন্দ্রনাথ উক্ত বালিকাদের ও বালিকা বিদ্যালয়গুলির শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের উদ্দেশ্যে বলেন বালিকারা যেন বিদ্যাশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় ভাব রক্ষা করতেও শেখে।
রবিবার মেলার প্রধান দিবসে সকালে বাচখেলা ও কৃষি-প্রদর্শনী হয়। বার্ষিক অধিবেশনে দ্বিজেন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেন। প্রথমে কয়েকটি কবিতা পঠিত হয়। ‘একটি অল্প বয়স্ক বালক যেরূপ দুঃখ ও অভিমান ভরে একটি পদ্যের আবৃত্তি করেন, তাহাতে সকলেই স্তব্ধ ও সাশ্রুনয়ন হইয়াছিল। সকলেরই শিরার উপর শোণিতের সঞ্চরণ অনুভূত হইয়াছিল। এ সকল পদ্য শুনিয়া ভারতমাতার পূর্ব্ব সৌভাগ্য ও ইদানীন্তন হতশ্রী—উজ্জ্বলভাবে সকলের মনে চিত্রিত হইয়াছিল। সকলেই বুঝিয়াছিলেন যে, তাঁহারা মহদ্বংশজাত, তাঁহাদের পূর্ব্বপুরুষগণ মহাপুরুষ ছিলেন এবং এক্ষণে তাঁহারা বীৰ্য্যশূন্য হইয়াছেন। সকলেরই কর্তব্যজ্ঞান, স্বভাবতঃ সেই সময় জাগরূক হইয়াছিল [সাধারণী, ৫। ১৮, ১৬ ফাল্গুন]।’ এর পর মনোমোহন বসু একটি সুদীর্ঘ বক্তৃতা করেন। তাঁর বক্তৃতার পর নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘জাতীয় চরিত্র’ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন [দ্ৰ আৰ্য্যদর্শন, বৈশাখ ১২৮৩।১৪-২৫]। সভাপতির বক্তৃতার পর সভা ভঙ্গ হয়।
রবীন্দ্রনাথ হিন্দুমেলার এই অধিবেশনে যোগদান করেননি, এর কয়েকদিন পূর্বে ৫ ফাল্গুন তিনি শিলাইদহ যাত্রা করেন। তবে সোমেন্দ্রনাথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৭
এই বৎসরটি বাংলা তথা ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে কয়েকটি কারণে স্মরণীয়। ইতিপূর্বে Mar 1838-এ স্থাপিত ‘ভূম্যধিকারী সভা’ [Zamindary Association বা Landholder’s Society], 20 Apr 1843-তে স্থাপিত Bengal British India Society বা 20 Oct 1851-এ প্রতিষ্ঠিত British Indian Association ভারতবর্ষীয়দের রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করত এবং প্রয়োজনমতো স্বদেশে গভর্নর জেনারেলের কাছে কিংবা ইংলণ্ডে পার্লামেন্টের কাছে আবেদন-নিবেদন জানাত। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন তার জন্মের কিছুদিন পরেই 1852-তে ভারতের বিভিন্ন শাসনসংস্কারের প্রস্তাব জানিয়ে পার্লামেন্টের কাছে আবেদনপত্র পাঠায়। ড রমেশচন্দ্র মজুমদার এটিকে ‘ভারতের রাজনীতিক আন্দোলনের ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে একখানি অমূল্য দলিল’ বলে অভিহিত করেছেন।৫৪ পরেও বিভিন্ন বিষয়ে ভারতীয়দের অধিকার দাবি করে ও সুবিচার প্রার্থনা করে নানারকম আন্দোলনে অ্যাসোসিয়েশন অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এটি ছিল প্রধানত শিক্ষিত অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায়ের মিলনকেন্দ্র। জমিদার শ্রেণীর প্রভাবও এখানে যথেষ্ট পরিমাণে অনুভূত হত। ফলে এই অ্যাসোসিয়েশন সর্বশ্রেণীর মানুষের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার মুখপাত্র বলে পরিগণিত হতে পারেনি। মুসলমান সম্প্রদায় একে তাদের যথার্থ প্রতিনিধি বলে স্বীকার না করে 1865-এ Muhammadan Association of Calcutta নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। তাছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে সরকারী ও বেসরকারী নানা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকুরিজীবী যে একটি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল, তাঁরা প্রথমদিকে ধর্ম ও সমাজসংস্কারমূলক বিভিন্ন আন্দোলন নিয়ে মেতে থাকলেও, ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক সচেতনতা দেখা দেয়। এঁদের কাছেও ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন সম্পূর্ণরূপে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এক সময়ে হিন্দুমেলা এঁদের মনোভাবকে ভাষা ও কার্যকরী রূপ দেবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হিন্দুমেলা জাতীয় ভাব-চর্চা ও আত্মনির্ভরতার সাধনার উপর যতখানি গুরুত্ব আরোপ করেছে, রাজনীতিচর্চার দিকে ততটা সচেতন প্রয়াস করেনি। এইসব কারণেই প্রধানত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছিল। সেই সময়ে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সিভিল সার্ভিস থেকে পদচ্যুত হয়ে পুনর্নিয়োজিত হবার জন্যে নানা ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর Jul 1875এ৫৫ ইংলণ্ড থেকে ভারতে ফিরে এসে শিক্ষকতা-কার্যে ব্রতী হয়েছেন। ইতিমধ্যে কেমব্রিজের প্রথম ভারতীয় র্যাংলার ও প্রসিদ্ধ ব্যারিস্টার আনন্দমোহন বসু 2 Nov 1874 [১৭ কার্তিক ১২৮১] তারিখে কলকাতায় ফিরে আসেন। এঁরা দুজন ও শিবনাথ শাস্ত্রী এই ধরনের একটি সভা স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন। পরে অমৃতবাজার পত্রিকা-র সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষ, ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষ প্রভৃতি এই পরামর্শের অন্তর্ভুক্ত হন। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক এঁদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। ফলে শিশিরকুমার, মতিলাল ঘোষ, Rais and Rayyet পত্রিকার সম্পাদক শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রভৃতির উদ্যোগে ইণ্ডিয়ান লীগ [Indian League] নামে একটি সভা স্থাপিত হয় 25 Sep 1875 [১০ আশ্বিন ১২৮২] তারিখে। এর কয়েকমাস পরে 26 Jul 1876 [১২ শ্রাবণ ১২৮৩] আনন্দমোহন, সুরেন্দ্রনাথ প্রভৃতি ‘ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ স্থাপন করেন। ইণ্ডিয়ান লীগ দীর্ঘজীবী হয়নি, কিন্তু ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা ভারত-সভা 1885-এ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ভারতের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
এর আগে আরও একটি ঘটনা বাংলাদেশের ছাত্র ও যুবসমাজের প্রবল আবেগ ও উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। আনন্দমোহন বিলেত থেকে ফেরবার সময় কিছুদিন বোম্বাইয়ে অবস্থান করে সেখানকার শিক্ষা ও সমাজসংস্কারমূলক প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যকলাপ ও স্ত্রীশিক্ষা-বিস্তারের জন্য একটি যুব-ছাত্র প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করেন। কলকাতায় ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সভাপতিত্বে 23 Apr 1875 Students’ Association প্রতিষ্ঠা হয়।৫৬ সুরেন্দ্রনাথও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। স্টুডেন্টস্’ অ্যাসোসিয়েশনে তাঁর প্রথম বক্তৃতা হয় হিন্দু স্কুল থিয়েটারে ‘শিখ জাতির অভ্যুদয়’ বিষয়ে; দ্বিতীয় বক্তৃতা ভবানীপুরে লণ্ডন মিশনারি সোসাইটি’স্ ইনস্টিটিউশন হলে—বিষয় ‘চৈতন্য’। এছাড়াও খিদিরপুর, উত্তরপাড়া প্রভৃতি জায়গায় তিনি ভারতীয় ঐক্য, ইতিহাস-পাঠ, মাৎসিনির জীবন প্রভৃতি বিষয়ে ইংরেজি ভাষায় অজস্র জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করেন। ইতালীয় বিপ্লবী মাৎসিনি তাঁর রাজনৈতিক গুরু-স্থানীয় ছিলেন। মাৎসিনির বিশুদ্ধ স্বদেশপ্রেম, উচ্চ আদর্শ, মানবতার প্রতি সুগভীর ভালোবাসা সুরেন্দ্রনাথের মনকে অধিকার করেছিল। সুরেন্দ্রনাথ লিখেছেন, তিনি আর্য্যাদর্শন-এর সম্পাদক যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ ও সাহিত্যিক রজনীকান্ত গুপ্তকে মাৎসিনির জীবনী রচনার জন্য অনুরোধ করেন। যোগেন্দ্রনাথ ইতিপূর্বেই আর্য্যাদর্শন-এ ‘সুপ্রসিদ্ধ প্রথম ফরাসি বিদ্রোহ’ মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে [জ্যৈষ্ঠ-ভাদ্র ১২৮১] প্রকাশ করে এই কাজের সূত্রপাত করেছিলেন, এখন সুরেন্দ্রনাথের অনুরোধে ভাদ্র ১২৮২ থেকে ‘জোসেফ ম্যাট্সিনি ও নব্য ইতালী’ [‘Joseph Mazzini and La Giovina Italia or Young Italy’] নামে মাৎসিনির জীবনকথা ও আদর্শ সম্বন্ধে লিখতে শুরু করেন। সুরেন্দ্রনাথের উদ্দীপনাময় বক্তৃতা ও যোগেন্দ্রনাথের লেখা তরুণসমাজের মনে যেন আগুন জ্বেলে দিল। সুরেন্দ্রনাথ যদিও মাৎসিনির বিপ্লববাদী গোপন কার্যকলাপ ভারতবর্ষের বাস্তব অবস্থার পটভূমিকায় অনুসরণের পক্ষপাতী ছিলেন না, কিন্তু উদ্বেলিত তরুণসম্প্রদায় ইতালির কার্বোনারি [Carbonari] সম্প্রদায়ের অনুকরণে গুপ্তসমিতি স্থাপন করতে শুরু করল। এইগুলি রবীন্দ্রনাথ-কথিত ‘সঞ্জীবনী-সভা’র পূর্বপুরুষ।
উপরে উল্লিখিত স্টুডেন্টস’ অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির তরুণদের, বিশেষ করে সোমেন্দ্রনাথের, ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ৪ শ্রাবণ ১২৮৩ [18 Jul 1876] তারিখের একটি হিসাবে দেখি : ‘সোমবাবুমহাশয় দিগের /ভবানীপূর লেকচার শুনীতে/ জাতাতের গাড়ি ভাড়া…২’—সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভবানীপুরে চৈতন্যদেব বিষয়ে যে বক্তৃতা দেন, সম্ভবত সেটি শোনার জন্যই সোমেন্দ্রনাথ প্রভৃতি তরুণেরা সেখানে গিয়েছিলেন [রবীন্দ্রনাথও এই দলে থাকতে পারেন। বর্তমান বৎসরেও ‘সোমবাবু ও রবিবাবু তালতলায় জাতাতের গাড়ি ভাড়া (জিতেন্দ্রবাবুর নিকট)’ মেটানোর হিসাব পাওয়া যায় ৭ ভাদ্র [রবি 22 Aug 1875] তারিখে—এই ‘জিতেন্দ্রবাবু’ সম্ভবত সুরেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিখ্যাত ব্যায়ামবীর [ক্যাপ্টেন] জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় [1860-1935]। সোমেন্দ্রনাথের সঙ্গে স্টুডেন্টস’ অ্যাসোসিয়েশনের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ পরবর্তী কালেও ছিল—২৮ ভাদ্র ১২৮৫ [12 Sep 1878] তারিখে ক্যাশবহি-তে ‘সোমবাবু মহাশয়ের…Student association জাতাতের গাড়ি ভাড়া’র হিসাব পাওয়া যায়। এই প্রতিষ্ঠানের আদর্শ তিনি কার্যকরী করতেও আগ্রহী ছিলেন, তার উল্লেখ দেখি সুধীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণে : ‘সোমকাকা তাঁহার জীবনের প্রথম অবস্থায় আমাদের দেশের বালক-যুবকদিগের শারীরিক ও মানসিক বলসাধন এবং নৈতিক উন্নতিসাধনের জন্য নানাবিধ ব্যায়াম-ক্রীড়া ও শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়া নারিকেলডাঙ্গায় এক শিক্ষালয় স্থাপন করেন। আমরাও বালক-কালে এই শিক্ষালয়ে ভর্ত্তি হইয়াছিলাম। প্রতি সপ্তাহে সোমকাকা আমাদের শিক্ষা ও আমোদের জন্য আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া যাদুঘর, আলিপুর চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রভৃতি নানাস্থানে ঘুরাইয়া আনিতেন [এইরূপ ভ্রমণের কিছু হিসাব ক্যাশবহি-তে পাওয়া যায়]। সোমকাকা রোগাক্রান্ত হওয়ায় এই শিক্ষালয়টি উঠিয়া যায়।’ [তত্ত্ববোধিনী, ফাল্গুন ১৮৪৩ শক [১৩২৮]। ২৯০]
ড প্রতাপ মুখোপাধ্যায় ‘কলকাতার গুপ্তসমিতি: উনিশ শতক’ [১৩৯২] গ্রন্থে ছাত্র-আন্দোলনের প্রাথমিক ইতিহাস নিয়ে বহু আলোচনা করেছেন। আগ্রহী পাঠক বর্তমান প্রসঙ্গে সেই গ্রন্থটি দেখে নিতে পারেন।
উল্লেখপঞ্জি
১ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩২৮
২ রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত মূল পত্র
৩ ‘শুচি’ : শান্তিনিকেতন ১৬। ৪১৪
৪ জীবনস্মৃতি ১৭।৩২৯
৫ ঐ ১৭। ৩২৮
৬ শনিবারের চিঠি, আশ্বিন ১৩৪৮। ৯০৩; রবীন্দ্রনাথ : জীবন ও সাহিত্য। ৭৩
৭ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৩০
৮ ঐ ১৭। ৩৫২-৫৩
৯ পত্রাবলী। ১১৪, পত্র ৮৩
১০ ঐ।১১৩, পত্র ৮২
১১ শনিবারের চিঠি, পৌষ ১৩৪৬। ৪৪২-৪৩
১২ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৪০
১৩ ঐ ১৭। ৩৮০
১৪ রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা ১।১৪১-৪২
১৫ সুবল বন্দ্যোপাধ্যায় : ‘সেন্ট জেভিয়ার্সে’
১৬ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩২৯
১৭ ঐ ১৭। ৩০৮
১৮ ড সুকুমার সেন : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ৩ [১৩৭৬]। ৬-৭
১৯ ছেলেবেলা ২৬।৬১৮
২০ ঐ ২৬। ৬১৮; দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৪
২১ ঐ ২৬। ৬১৯
২২ ঐ ২৬। ৬২০
২৩ ঐ ২৬। ৬২২
২৪ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৪০-৪১
২৫ ঐ ১৭। ২৯৫
২৬‘রবীন্দ্ররচুনাপঞ্জী’, শনিবারের চিঠি, অগ্র ১৩৪৬। ৩০৭-০৮; রবীন্দ্রনাথ : জীবন ও সাহিত্য। ১৯১
২৭‘রবীন্দ্রনাথের বাল্যরচনা’ : দেশ, ১৬ চৈত্র ১৩৫২। ৩৭৫-৭৬; জীবনস্মৃতি [১৩৬৮]।১৮৬তে উদ্ধৃত
২৮ দ্র ‘ভোরের পাখি’ : বি. ভা. প., কার্তিক-পৌষ ১৩৬৮।১২৪-২৫
২৯ দ্র ‘ভূমিকা’ : জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি [প্রজ্ঞাভারতী, ১৩৮৯]। চ-ছ
৩০ ‘ভোরের পাখি’। ১২৩
৩১ ঐ। ১২৭
৩২ ঐ। ১২৬-২৭
৩৩ দ্র “রবীন্দ্রনাথের ‘প্রকৃতির খেদ’ পাঠভেদের পুনর্বিচার” : অমৃত, ২২ বৈশাখ ১৩৭৯। ২০-২২
৩৪ ‘ভোরের পাখি’। ১১৭
৩৫ অমৃত। ২০
৩৬ ‘ভোরের পাখি’। ১২৭
৩৭ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি।১৪৭
৩৮ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৪২
৩৯ ঐ ১৭। ৩৮৬-৮৭
৪০ ‘বিহারীলাল’: আধুনিক সাহিত্য ৯। ৪২০
৪১ ঐ ৯।৪১৮, ৪২০
৪২ জীনস্মৃতি ১৭। ৪১৫
৪৩ ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ :আধুনিক সাহিত্য ৯। ৪০৭-০৮
৪৪ ‘জীবনকথা’ : এক্ষণ, শারদীয় ১৩৯৯।১৯
৪৫ বিনোদিনী দাসী : ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’, আমার কথা ও অন্যান্য রচনা [১৩৭৬]। ১০৬-০৭
৪৬ শান্তিদেব ঘোষ : রবীন্দ্রসংগীত। ৪৯-৫০ থেকে তথ্যগুলি গৃহীত।
৪৭ দ্র ভারতকোষ ৫ [১৩৮০]।৩৮৮, দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়-রচিত বিবরণ
৪৮ গোপালচন্দ্র রায় : বঙ্কিমচন্দ্র [১৩৮৮]।১৪২
৪৯ সংগীতচিন্তা [১৩৯২] ৮৭
৫০ ঐ।২২৯
৫১ রবীন্দ্রসংগীত। ৩৫
৫২ দ্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর : পিতৃস্মৃতি [১৩৭৮]। ২৭
৫৩ রাজনারায়ণ বসু : আত্মচরিত [১৩৬৮]।১৫৭
৫৪ দ্র ড রমেশচন্দ্র মজুমদার : বাংলাদেশের ইতিহাস ৩ [১৩৮১]। ৫২০-২৩
৫৫ দ্র প্রতাপ মুখোপাধ্যায় : বিষয় কলকাতা [1990]। ৫
৫৬ দ্ৰ ঐ। ২০
* জীবনস্মৃতি ১৭। ৩২৯; এঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি বর্ণনায় কিছু ত্রুটি আছে। তিনি লিখেছেন, ফাদার ডি পেনেরাণ্ডা কিছুদিন নিয়মিত শিক্ষকের বদলি রূপে তাঁদের ক্লাসে পড়িয়েছিলেন; কিন্তু স্কুলের কাগজপত্র থেকে জানা যায় 1875-এ তিনি ফিফ্থ্ ইয়ার ক্লাসের অন্যতম শিক্ষক ছিলেন।
* গ্রন্থটিতে পেনসিলে ‘James winse’ নামে জনৈক ইংরেজের নাম লেখা আছে।
* উক্তিটি ভ্রমাত্মক; সংস্কৃতের উপর সম্পূর্ণ দখল না জন্মালেও ঋজুপাঠ, কুমারসম্ভব ও শকুন্তলা পড়ার ফলে তিনি এই ভাষার সঙ্গে কিছুটা পরিচয় অন্তত স্থাপন করতে পেরেছিলেন।
* শ্রীগীতগোবিন্দম, ৭ম সর্গ, ৭ম শ্লোক। ড সুকুমার সেন লিখেছেন: ‘যিনি কখনো পদটিকে ছন্দোবিভাগ করিয়া পড়িতে চেষ্টা করিয়াছেন তিনিই বুঝিবেন এ কাজ শিক্ষিত প্রবীণের পক্ষেও বড় সহজ নয়।’—বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ৩ [১৩৭৬]।
* প্রিন্স অব ওয়েলসের এই কলকাতা-আগমন উপলক্ষে উদ্ভূত কয়েকটি ঘটনা 1876-এর ‘Dramatic Perfomances Act বিধিবদ্ধ হবার জন্য দায়ী, যা পরবর্তীকালের নানাভাবে বাংলা নাট্যসাহিত্য ও অভিনয়ের উপর সরকারী হস্তক্ষেপের দ্বারা সুদুরপ্রসারী রাজনৈতিক তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়েছে। দ্র শিশির বসু, একশ বছরের বাংলা থিয়েটার [১৩৮০]। ১৬৬-৮১
† এর আগেও ২০ জ্যৈষ্ঠ ১২৮২ (বুধ 2 Jun 1875) তারিখে দেবেন্দ্রনাথ জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে একই হারে ৫০০০ টাকা ঋণ দেন।
* ছেলেবেলা ২৬। ৬০৬; শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন: ‘কিন্তু এ গানটি তিনি বর্ষাসংগীতে পরিণত করেন নি বলেই আমার বিশ্বাস, করেছে একটি উপাসনার গীতে। …এই সুরে তাঁর কোনো বর্ষার গান না পেয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, হয়তো ভুল করেছেন, তাঁর সঠিক স্মাণ ছিল না যখন এ কথা লেখেন, পরে সংশোধন করে দেবেন এই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।’—রবীন্দ্রসংগীত [১৩৭৬]।১২৩। উক্তিটি অবশ্য সংশোধিত হয়নি।
* জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৩৪; এই-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র বলেছেন : ‘জ্ঞানাঙ্কুরে আমার পাঠানো এই ভাবের [বিহারীলালের ত্রি-মাত্রিক ছন্দের অনুকরণে] লেখা সেখানেই পড়িয়াছিল। ছাপা হয় নাই। পরে বয়োজ্যেষ্ঠদের অনুরোধে এই মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। আমার বয়স তখন তেরো-চোদ্দ। খুবই উৎসাহ হইল।’—‘জীবনস্মৃতির জন্মকথা’ : ক্ষিতিমোহন সেনের অনুলেখন, শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা ১৩৮৩। ১১
* রবীন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গে বার বার বঙ্গসুন্দরী কাব্যের ‘সুরবালা’ নামক তৃতীয় সর্গের প্রথম শ্লোকটি উদ্ধৃত করেছেন। এই কবিতাটি অবোধ-বন্ধু পত্রিকায় ১২৭৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখ-আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সুতরাং পত্রিকাটির মাধ্যমেই তিনি এই কবিতাটি ও তার ছন্দের সঙ্গে প্রথম পরিচিত এবং তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু কবিতাটি বঙ্গসুন্দরী কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণে গৃহীত হয়নি, 1880-তে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত হয়।
* ‘Baboo Rabindro Nath Tagore read some very spirited verses from the Sarajini Natuck. —The Bengalee, 5 Feb 1876/44.
*১ ‘He [Rabindranath] was followed by Baboo Chunder Nath Bose M.A., who recited two exquisite picces of poetry from the “Lyre and Sword” of Charles Theodore Kor ner, the celebrated German poet and soldier.’—Ibid.
*২ ‘সংস্কৃত কলেজের ভূতপূর্ব্ব ছাত্র হরিশ্চন্দ্ৰ শৰ্ম্মা বাগাড়ম্বরে বক্তৃতা করিতে থাকেন, তাহাতে অনেকে আমোদিত হইয়াছিলেন।’—সাধারণী, ২৪ মাঘ। ১৭১
*৩ ড চিত্রা দেব এঁর নাম ‘নিত্যরঞ্জন’ বলে উল্লেখ করেছেন। দেবেন্দ্রনাথের আত্মজীবনী-তে প্রদত্ত বংশলতিকায় নামটি ‘নিত্যানন্দ’ রূপে দেখা যায়। ইরাবতী দেবীর স্বামীর নাম নিত্যরঞ্জন হওয়ায় সৌদামিনী দেবীর দুই জামাতা ‘বড়ো নিত্য’ ও ‘ছোটো নিত্য’ বলে পরিচিত ছিলেন, ড দেব এই সংবাদটি দিয়েছেন। দ্র ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল [১৩৮৭]। ৮৭
* পুস্তকটির মলাটে এইরূপ লেখা আছে; ‘NATIONAL SONG BOOK/PART I, (PATRIOTIC SONGS.)/ জাতীয় সঙ্গীত।/প্রথম ভাগ।/(স্বদেশানুরাগোদ্দীপক সঙ্গীতমালা।)/Calcutta:/PRINTED BY G.P. ROY & CO., 21 BOw BAZAR STREET/1876/ মূল্য আনা মাত্র। পৃষ্ঠাসংখ্যা—৬+৪২। ‘সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’য় ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘অবলাবান্ধব’ দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে এই গ্রন্থের সংকলক বলে নির্দেশ করেছেন। দ্ৰ সা-সা-চ ৭। ৮০। ২৯-৩০
† আর্য্যাদর্শন ৩য় বর্ষ ১ম সংখ্যায় [বৈশাখ ১২৮৩] পুস্তকটির সমালোচনা করতে গিয়ে সমালোচক সত্যেন্দ্রনাথের ‘মিলে সবে ভারত সন্তান’, দ্বিজেন্দ্রনাথের মলিন মুখ-চন্দ্রমা ভারত তোমারি প্রভৃতি চারটি গান উদ্ধৃত করে যেক’টি উদ্ধৃত করতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তার মধ্যে এই গানটিও আছে।
* খোরসেদ ফকির সম্বন্ধে একটি কিংবদন্তী আছে, দ্ৰ শচীন্দ্রনাথ অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহ [১৩৮০]। ৩৭৯-৮৩
† প্রমথনাথ বিশী-রচিত ‘শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ’ [১৩৭৯] গ্রন্থে প্রদত্ত একটি হতনক্সায় কুঠিবাড়িটির অবস্থান অন্যত্র—ডাকঘর ও হানিফের ঘাটের পূর্বদিকে পদ্মার তীরে। এটি ভুল।
* হেমচন্দ্রের এই কবিতাটি ‘সুহৃৎ-সঙ্গম’ নামে বঙ্গদর্শন-এর অগ্রহায়ণ ১২৮২ [পৃ ৩৭৯-৮১] সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছিল [বঙ্গদর্শন-এর প্রকাশ তখন অত্যন্ত অনিয়মিত]। দ্র কবিতাবলী [সাহিত্য পরিষদ সং, ১৩৭১]। ১০২-০৬