১১. রামায়ণের পার্শ্বচরিত্র : ইন্দ্রজিৎ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ, মন্দোদরী, শত্রুঘ্ন, শান্তা, মন্থরা, লবকুশ, মারীচ, শূর্পণখা, অহল্যা, মহিরাবণ

রামায়ণের পার্শ্বচরিত্র : ইন্দ্রজিৎ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ, মন্দোদরী, শত্রুঘ্ন, শান্তা, মন্থরা, লবকুশ, মারীচ, শূর্পণখা, অহল্যা, মহিরাবণ

রামায়ণে রাম-লক্ষ্মণ-সীতা-রাবণ ছাড়াও অসংখ্য ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি আছে, জনমানসে তাঁরা প্রায় অনুচ্চারিতই থেকে গেছেন। কিন্তু তাঁদেরকে বাদ দিলে, তাঁদেরকে স্মরণ না-করলে রামায়ণ অসমাপ্ত থেকে যাবে। বাল্মীকি রাময়ণে যেমন ইন্দ্রজিৎ, মন্দোদরী, শত্রুঘ্ন, শান্তা, মন্থরা, লবকুশ, মারীচ, শূর্পণখাদের পাই, তেমনই অন্য রামায়ণে অহল্যা, মহিরাবণের মতো ব্যক্তিদেরও পাই। আসুন পাঠকবন্ধু, রামায়ণে বিস্মৃতপ্রায় হয়ে আছেন, এমন কয়েকজন প্রায় অপ্রধান অথচ শক্তিশালী কিছু চরিত্রের উপস্থিতি বুঝে নিই। কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ,

ইন্দ্রজিৎ : গোটা রামায়ণে ‘প্রকৃত বীর’ বলে যদি কেউ থেকে থাকেন, তিনি ইন্দ্রজিত। ইন্দ্রজিৎ, ওরফে মেঘনাথ। যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁকে বীর শিরোপা দিতে কার্পণ্য করা উচিত হয় না। ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদ বা মেঘনাথ রামায়ণে বর্ণিত এক যোদ্ধা। তিনি সমগ্র মানব, দানব, অন্যান্য সৃষ্টি ও দেবদেবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বীরযোদ্ধা ও একমাত্র অতি মহারথী দানবদের গুরু শুক্রের শিষ্য ত্রিমূর্তিধারী ইন্দ্রজিৎ রাবণের পুত্র। মেঘনাদ রাম ও রাবণের মধ্যে সংঘটিত লঙ্কার যুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দুইবার রাম ও লক্ষ্মণকে পরাভূত করেন। কিন্তু তৃতীয় বারে বিভীষণের সহায়তায় লক্ষ্মণ নিকুম্ভিলায় উপস্থিত হয়ে মেঘনাদকে অসহায় ও নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করেন।

মেঘনাদের জননী ছিলেন মায়াসুরের কন্যা তথা রাবণের রাজমহিষী মন্দোদরী। জন্মের সময় মেঘনাদ বজ্ৰনাদের ন্যায় চিৎকার করেছিলেন। সেই কারণে তাঁর নাম মেঘনাদ। অন্যমতে, মেঘের আড়াল থেকে ঘোর যুদ্ধ করতেন বলে তাঁর নাম হয় মেঘনাদ। আবার দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাভূত করেছিলেন বলে তিনি ইন্দ্রজিৎ নামেও অভিহিত হন।

মেঘনাদের জন্মসংক্রান্ত আর-একটি কাহিনি প্রচলিত আছে : সমুদ্রমন্থনকালে সুলক্ষণা নামে এক সুন্দরী নারী উঠেছিলেন। তিনি পার্বতীর সখি হন। একদিন স্নানান্তে পার্বতী সুলক্ষণাকে তাঁর পরিধেয় বস্ত্র আনতে বলেন। বস্ত্র আনতে গেলে শিব সুলক্ষণাকে একা পেয়ে সম্ভোগ করেন। সুলক্ষণা বিব্রত হয়ে পড়লে শিব বর দেন যে তাঁর বিবাহের পরই পুত্রের জন্ম হবে। এদিকে পার্বতীর কাছে পরে বস্ত্র নিয়ে গেলে তিনি সব বুঝতে পারেন। তিনি সুলক্ষণাকে অভিশাপ দেন। সুলক্ষণা মন্দোদরীতে পরিণত হন। এই কারণে মেঘনাদের অপর নাম হয় কানীন।

মেঘনাদের দুই সহোদরের নাম অতিকায় ও অক্ষয়কুমার। বাল্যকালেই মেঘনাদ ব্ৰহ্মাস্ত্র, পাশুপতাস্ত্র, বৈষ্ণবাস্ত্র প্রভৃতি দৈব অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর গুরু ছিলেন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য। মেঘনাদ নাগরাজ শেষনাগের কন্যা সুলোচনাকে বিবাহ করেছিলেন। যুদ্ধে মেঘনাদের মৃত্যুর পর সুলোচনার কী হল জানা যয় না।

যেসব অস্ত্রশস্ত্র ইন্দ্রজিতের কাছে ছিল তার একটু পরিচয় নেওয়া যাক–কালচক্র (সময়ের চক্র, শত্রুর শোচনীয় অবস্থা করে, ভয়ংকর ক্ষমতাসম্পন্ন, আগুনের গোলা উৎপন্ন করে), বিষ্ণুচক্র ( অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত করে, অত্যুজ্জ্বল দীপ্তিসমৃদ্ধ, প্রতি পদক্ষেপে এক লক্ষ শত্রু সংহার করার ক্ষমতা রাখে, এর প্রয়োগ অতি ভয়ানক), ইন্দ্রচক্র (দেবরাজের চক্র), দণ্ডচক্র (দণ্ডদাতার চক্র), ধর্মচক্র (গুণচক্র), মোদক দণ্ড (অত্যাচারের অস্ত্র), শিখরী দণ্ড (দণ্ডের উচ্চ শিখর), ধর্মপাশ (ধর্মরাজের রজ্জ/বন্ধন), কালপাশ (সময়ের পাশ), নাগপাশ (সর্পের রঞ্জু, এর ফলে শত্ৰু বিষধর সর্পের কুণ্ডলিতে আবদ্ধ হয়), বরুণপাশ (আর্যদেবতা বরুণের পাশ, দেব-অসুর-মানুষ সকলকে বন্ধনে সক্ষম, এর বন্ধন হতে মুক্তিলাভ অসম্ভব), যমপাশ (যমের পাশ, ত্রিমূর্তি ব্যতীত সকলেই এর দ্বারা আবদ্ধ হতে পারে, যার বন্ধন হতে মুক্ত হওয়া অসম্ভব), সংবর্ত (যমের দেওয়া অস্ত্র, রাজা ভরত এটি ব্যবহার করে এক মুহূর্তে তিন লক্ষ গন্ধর্ব হত্যায় প্রয়োগ করেন), বজ্র (দেবরাজ ইন্দ্রের দেওয়া অস্ত্র, যা অব্যর্থ ও অজেয়), বাসবী শক্তি (ইন্দ্রের দেওয়া অব্যর্থ বাণ), কঙ্কালম (দৈত্যদের ভয়ংকর শস্ত্র), কপালম (দৈত্যদের ভয়ংকর শস্ত্র), কঙ্কণম (দৈত্যদের ভয়ংকর শস্ত্র), চন্দ্রহাস ( শিবের দেওয়া অসি, শিব এই অস্ত্রটি রাবণকে দিয়েছিলেন এবং রাবণ মেঘনাদকে দেন), ত্রিশূল (শিবের দেওয়া শূল, বলা হয় এর তুল্য কোনো শস্ত্র আর নেই), পিনাক (শিবের দেওয়া বাণ)।

প্রথম দিনের যুদ্ধ : নিজের ভ্রাতৃগণের মৃত্যুর পর ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। রাম ও লক্ষ্মণের সঙ্গে তাঁর তিন দিন যুদ্ধ হয়েছিল। প্রথম দিন রামের বাহিনীর সঙ্গে ইন্দ্রজিতের যুদ্ধ হয়। দক্ষ রণকৌশলে তিনি সুগ্রীবের বাহিনীকে হটিয়ে দেন। রাম ও লক্ষ্মণের সঙ্গে মেঘনাদের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে অঙ্গদ জয়লাভ করলেও ইন্দ্রজিতের মারণাস্ত্র আঘাত করলে রাম ও লক্ষ্মণ দুজনেই মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। এই মৃতপ্রায় রাম-লক্ষণকে নিয়ে রামশিবিরের সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। সংগতকারণেই সবচেয়ে বেশি চিন্তায় পড়ে গেলেন বিভীষণ। রাম-লক্ষ্মণ যদি মরেই যায় তাহলে তাঁর রাজ্যলাভের কী হবে? লঙ্কার সিংহাসনলাভ কী অধরাই থেকে যাবে। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বিলাপ করলেন–“হায়, আমি যাঁহাদের বাহুবলে রাজ্যপদ কামনা করিয়াছিলাম, এক্ষণে তাঁহারাই মৃত্যুর জন্য শয়ান।” ইন্দ্রজিৎ যত বড়ো বীরই হন, বিচারবুদ্ধিতে নালায়েক। তাই পরাস্ত মৃতপ্রায় শত্রুকে চিরতরে বিনাশ না-করে যুদ্ধক্ষেত্রেই শত্রুদের রেখে তিনি ফিরে আসেন। সেই ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে তাঁকে। অহংকার আর আস্ফালনই তাঁদের রাজনৈতিকবুদ্ধি বিনাশ করেছে। নয়তো এ যাত্রাতেই যুদ্ধের যবনিকা পতন হয়ে যেত। এই বিধ্বস্ত মুহূর্তটিকে কাজে লাগিয়ে রামের সেনাসমষ্টিকে তছনছ করে দিতে পারতেন।

দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধ : গরুড়ের চিকিৎসায় রাম-লক্ষ্মণ উভয়ই সুস্থ হয়ে উঠলেন। অতএব পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি। সামরিক মূঢ়তা, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও অনুমাননির্ভর রাজনীতির জন্য আবার যুদ্ধ। বীর অতিকায়ের মৃত্যুর পর ইন্দ্রজিৎকে দ্বিতীয়বার যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হল। এবার আরও ভয়ানক যুদ্ধ। রাম-লক্ষ্মণ তো বটেই–সেইসঙ্গে ইন্দ্রজিতের কালাস্ত্রে ভয়ানকভাবে ক্ষতবিক্ষত হলেন হনুমান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, জাম্ববান, সুষেণ, গবাক্ষ, নীল, মৈন্দ, দ্বিবিদ, গবয়, কেসরী, সূর্যানন, দধিমুখ, নল, পাবকক্ষ, জ্যোতিমুখ, কুমুদ, বিদ্যুদ্দ প্রমুখ। রামশিবিরে মৃত্যুর মিছিল। অসংখ্য বানরসেনার লাশ পড়ে আছে যুদ্ধক্ষেত্রে। শুধু বানরসেনাই নয়, অসংখ্য অপ্রধান আর্যদেবতাদের মুড়িমুড়কির মতো গ্রাসে গ্রাসে নিঃশেষ করেছেন। কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্য ও ভ্রাতৃবধু তারা লাভের আশায় সুগ্রীব মাশুল গুনছেন। অনর্থক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তিনি তাঁর বানরসেনাদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিলেন। এবার আর গরুড় এলেন না রাম-লক্ষ্মণদের বাঁচাতে। অসুস্থ জাম্ববানের পরামর্শে বিষক্রিয়ায় দুর্বল হনুমান গন্ধমাদন পর্বত থেকে বিশল্যকরণী ইত্যাদি ওষধি আনার পর, সেই ওষুধের যথাযথ প্রয়োগে সবাই সুস্থ হয়ে ওঠেন।

তৃতীয় দিনের যুদ্ধ : এবার ইন্দ্রজিৎ আবার মহা ভুল করে বসলেন। তিনি আবারও ভুলে গেলেন, শত্রুর শেষ রাখতে নেই। যেমন ঋণ, অগ্নি এবং ব্যাধির শেষ রাখতে নেই, তেমনি শত্রুর মৃত্যুকে নিশ্চিত না-করে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করা ইন্দ্রজিতের বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। একটুর জন্য ইন্দ্রজিৎ শেষরক্ষা করতে পারলেন না। তাই শমন তাঁর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য রণক্ষেত্রে নয়, নিকুম্ভিলায়। সুস্থ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে লক্ষ্মণ চললেন নিকুম্ভিলায়, ইন্দ্রজিৎকে হত্যা করতে। একা নন–সঙ্গে গেলেন ইন্দ্রজিতের খুল্লতাত বিভীষণ, চারজন বীর অমাত্য, সুগ্রীবের মহামন্ত্রী এবং হাজার হাজার বানরসেনা। নিকুম্ভিলা অবরুদ্ধ। নিকুম্ভিলা যুদ্ধে বিভীষণই হর্তাকর্তাবিধাতা। বিভীষণ লক্ষণকে বললেন–“তুমি সেনাদের ছিন্নভিন্ন করিতে যত্নবান হও। উহারা ছিন্নভিন্ন হইলে ইন্দ্রজিৎ নিশ্চয়ই দৃষ্ট হইবে।” হল। বিভীষণের পরামর্শে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল ইন্দ্রজিতের সেনাদের সঙ্গে। অবশেষে ইন্দ্রজিৎ রথে চড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এলেন। দেখতে পেলেন খুল্লতাত বিভীষণকে। চরম তিরস্কার করলেন খুল্লতাতকে। ইন্দ্রজিৎ রাবণের মতোই ক্ষমাশীল, তাই জ্ঞাতিদ্রোহী খুল্লতাত বিভীষণকে হত্যা করতে পারলেন না। এটাও ছিল ইন্দ্রজিতের ভয়ানক ভুল। অথচ উলটোদিকে নিজের সশস্ত্র দলবল নিয়ে নিজের ভাইপোকে হত্যা করতে এসেছেন আপন কাকা বিভীষণ।

লক্ষমণ এবং ইন্দ্রজিৎ উভয়ই আকাশপথেই যুদ্ধ করতে লাগলেন–এমন তথ্যই দিয়েছেন স্বয়ং বাল্মীকি। তবে লক্ষ্মণ একা নন–এই যুদ্ধে সঙ্গ দিচ্ছেন ঋষিগণ, পিতৃগণ, ইন্দ্রাদি দেবগণ, গন্ধর্ব প্রমুখ। লক্ষ্মণকে ঘিরে রক্ষা করছেন দেবসেনাগণ। ইন্দ্রজিৎ শত্ৰুবেষ্টিত হয়ে অসহায়ের মতো যুদ্ধ করছেন। অবশেষে ইন্দ্রজিতের মস্তক দেহচ্যুত হল লক্ষ্মণের ঐন্দ্রবাণে।

“ভাই লক্ষ্মণ! আজ বড়ো পরিতুষ্ট হইলাম। … যখন ইন্দ্রজিৎ বিনষ্ট হইল, তখন জানিও আমরাই জয়ী হইলাম। … আজ আমি বিজয়ী … লক্ষ্মণ তুমি আমার প্রভু, তোমার সাহায্যে অতঃপর সীতা ও পৃথিবী আমার অসুলভ থাকিবে না।”–ইন্দ্রজিতের মৃত্যুর পর রাম এই প্রথম লক্ষ্মণকে ‘প্রভু’ বলে সম্বোধন করলেন। এ থেকে বোঝা যায় ইন্দ্রজিৎ কতটা প্রতিরোধ্য ছিলেন। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় ইন্দ্রজিতের কাছে রামচন্দ্র কত অসহায় ছিলেন, চাপে ছিলেন। রাবণ নয়, ইন্দ্রজিৎই ছিলেন দাক্ষিণাত্যে আর্য-উপনিবেশের প্রধান ও প্রথম অন্তরায়। তাই ইন্দ্রজিতের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ভেরী বাজতে থাকল।

অন্য রামায়ণে এরকমভাবে ঘটনাকে বিকৃত করা হয়েছে–লক্ষ্মণ পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন জানতে পেরে মেঘনাদ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে যজ্ঞ সম্পাদনা করতে যান। বিভীষণ তাঁর গুপ্তচর মারফত সেই সংবাদ পেয়ে রামকে সতর্ক করেন। কারণ এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ হলে মেঘনাদ অজেয় হয়ে যাবেন। বিভীষণ লক্ষ্মণকে যজ্ঞাগারে নিয়ে যান। যজ্ঞাগারে মেঘনাদ অস্ত্র স্পর্শ করতেন না। তিনি প্রথমে যজ্ঞের বাসন ছুঁড়ে লক্ষ্মণকে অচেতন করে দেন। কিন্তু অস্ত্রাগারে যাওয়ার সময় পান না। তার পূর্বেই লক্ষ্মণের জ্ঞান ফেরে এবং তিনি নিরস্ত্র মেঘনাদকে হত্যা করেন। এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। যজ্ঞাগারে নিরস্ত্র অবস্থায় ইন্দ্রজিতের মৃত্যু হয়নি। এ গল্প মাইকেল মধুসূদনের মস্তিষ্কপ্রসূত।

১৮৬১ সালে রামায়ণের কাহিনি নিয়ে একই ছন্দে তিনি রচনা করেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘মেঘনাদবধকাব্য’। এটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক মহাকাব্য। আর কোনো রচনা না-থাকলেও মধুসূদন এই একটি কাব্য লিখে অমর হয়ে থাকতে পারতেন। এই কাব্যের মাধ্যমে তিনি মহাকবির মর্যাদা লাভ করেন এবং তাঁর নব আবিষ্কৃত অমিত্রাক্ষর ছন্দেও বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এই কাব্য ভাব ও ভাবনায় আধুনিকতায় প্রকাশভঙ্গির অভিনবত্বে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উপকরণের সংমিশ্রণে মধুসূদন বাংলা কাহিনি কাব্যের গতানুগতিক ধারায় এক আমূল পরিবর্তন আনেন। তিনি সংস্কৃতি থেকে আখ্যানভাগ গ্রহণ করলেও সংস্কৃতি ও অলংকারশাস্ত্রের বিধান পালন করেননি, বরং ভাবগাম্ভীর্য, ভাষা ও ছন্দের ওজস্বিতা এবং জীবন-ভাবনার ব্যাপকতা ও প্রগাঢ়তায় ‘মেঘনাদবধকাব্য’ গ্রিক মহাকাব্যের মহিমা লাভ করেছে। বস্তুত এটি গ্রিক আদর্শে রচিত প্রথম সার্থক বাংলা মহাকাব্য।

রামায়ণের নায়ক ‘দেবতা’ রামচন্দ্র। এখানে পররাজ্য আক্রমণকারী এবং দৈববলে বলিয়ান লক্ষণ। অন্যায় যুদ্ধে হন্তারকরূপে চিহ্নিত। রামায়ণের পরস্ত্রী অপহরণকারী রাক্ষস রাবণকে এখানে পাওয়া যায় মহাবীর ও প্রজাপালক রাজা, স্নেহময় পিতা ও ভ্রাতা হিসাবে। ভগ্নির অপমানে প্রতিশোধ নিতে তিনি সীতাকে অপহরণ করেন। কিন্তু কোনো অবমাননা করেননি৷ রাবণ পুত্র মেঘনাদ অসীম সাহসীরূপে বীরযোদ্ধা ও সত্যাশ্রয়ী নিরস্ত্র ও যজ্ঞরত অবস্থায় তাকে তার পিতৃব্য বিভীষণের সহায়তায় লক্ষ্মণ হত্যা করেন। মেঘনাদের স্ত্রী প্রমিলা নারীর ব্যক্তিত্ব, স্বতন্ত্র ও বীরের উজ্জ্বল। বিতাড়িত রাবণের অসহায় পরাভবের কাহিনি মূলত ঔপনিবেশ শক্তির পদানত পরাধীন ভারতবাসীর বেদনায় শিল্পরূপ। গ্রিক ও শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডি শিল্পাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মধুসূদন সর্বমোট নয়টি স্বর্গ, মর্ত, পাতালরূপী কাহিনি পরিকল্পনা, ঘটনা সংস্থাপন, উপমা বিশ্লেষণের অভিনবত্ব, অমিত্রাক্ষর ছন্দের কুশলী প্রয়োগ এবং বর্ণনায় দ্রুতময়তায় এই মহাকাব্য রচনা করেন। রামায়ণে বর্ণিত অধর্মাচারী, অত্যাচারী ও পাপী রাবণকে একজন দেশপ্রেমিক বীরযোদ্ধা ও বিশাল শক্তির আধাররূপে চিহ্নিহ্নত করে মধুসূদন দত্ত ঊনবিংশ শতকের বাঙালি নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ভারতবাসীর চিরাচরিত বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে প্রকৃত সত্য সন্ধান ও দেশপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন বাংলা সাহিত্যে তা তুলনাহীন।

কুম্ভকর্ণ : বাল্মীকির উত্তরকাণ্ড থেকে জানতে পারি কেকসীর যখন প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হল তখন আকাশে নাকি বিনা মেঘে বজ্রপাত, রক্তবৃষ্টি, চিল-শকুনের রব, শেয়াল, গাধার কান্না, নানা রকম অশুভ চিহ্ন ইত্যাদি হয়েছিল। জন্মেই সেই শিশু এমন চিৎকার বা রব করতে থাকল যে চতুর্দিক কম্পিত হতে লাগল। তুমূল রব করার জন্য তার নাম হল রাবণ। এরপর কেকসি আর-একটি শক্তিশালী পুত্রের জন্ম দেন, তাঁর নাম কুম্ভকর্ণ। কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম! কুম্ভকর্ণ আর গভীর ঘুম যেন সমার্থক। যেন শুধু ঘুমের কারণেই কুম্ভকর্ণের প্রসিদ্ধি। তারপরে শুভ লগ্নে যখন নানা শুভ চিহ্ন দেখা গেল তখন কেকসির গর্ভ থেকে একটি শিশু প্রসব হল, তাঁর নাম বিভীষণ। এরপর পুনঃ অশুভ লগ্নে কেকসি একটি কন্যার জন্ম দেন, তাঁর নাম শূর্পণখা। জন্মগ্রহণের অব্যবহিত পরেই সে ক্ষুধার্ত হয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য সহস্র প্রজা খেয়ে ফেলেছেন বলে খ্যাতি আছে। এই জাতিকে সকলের কাছে ঘৃণ্য করে তুলতেই জন্মের এহেন কুৎসিত বর্ণনা। যাই হোক, কুম্ভকর্ণ দৈত্যরাজ বলির দৌহিত্রী বজ্রমালাকে বিয়ে করেন। বজ্রমালার গর্ভে কুম্ভ ও নিকুম্ভ নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়।

গোকর্ণ আশ্রমে উগ্র তপস্যার পর ব্রহ্মার বর চাইতে গেলে কুম্ভকর্ণ প্রত্যাখ্যাত হন। কারণ দেবতারা ব্রহ্মার কান ভাঙিয়ে বলে দিয়েছেন–কুম্ভকর্ণ সাতটি অপ্সরা, ইন্দ্রের দশটি অনুচর এবং বহু ঋষি ও মনুষ্য খেয়ে ফেলেছেন। বরপ্রাপ্তির ফলে সে ত্রিভুবন খেয়ে ফেলবে! এদিকে কুম্ভকর্ণের কঠোর তপস্যায় পৃথিবী এমন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, মনে হয় সমস্ত যেন অগ্নিদগ্ধ হয়ে ছাইয়ে পরিণত হবে। দেবতারা দেবী সরস্বতীর শরণাপন্ন হলেন। দেবী সরস্বতী অভয় দিয়ে কুম্ভকর্ণের জিহ্বায় অধিষ্ঠান করলেন। এই সুযোগে ইন্দ্র তাঁর গায়ের ঝাল মেটাতে সরস্বতীর সঙ্গে জোট বাঁধলেন। বললেন, কুম্ভকর্ণের জিভ বেঁধে রাখতে। সরস্বতীও সেই মতো কাজ করলেন। বর চাইতে পারলেন না কুম্ভকর্ণ, ব্রহ্মার কাছে বর চাইতে গিয়ে জড়িয়ে গেল কুম্ভকর্ণের জিভ। তিনি চেয়েছিলেন ইন্দ্রাসন’ কামনা করবেন। জিভের আড়ষ্টতার কারণে অশুদ্ধ উচ্চারণ করে ফেললেন। ইন্দ্রাসন জিহ্বার আড়ষ্টতার হয়ে গেল ‘নিদ্রাসন’। ছয় মাস ঘুমোবেন, আর ছয় মাস জেগে থাকবেন। জাগার সময়ে কুম্ভকর্ণকে কেউ হত্যা করতে পারবেন না। কিন্তু নিদ্রার সময়কালে কেউ যদি অকালনিদ্রা ভঙ্গ করেন, তবে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। সরস্বতী প্রভাবে কুম্ভকর্ণ বর চাইলেন–“হে প্রজাপতি। তপস্যা করে আমি ক্লান্ত। আমাকে বর দিন যেন আমি ছয় মাস ঘুমাই আর একদিন মাত্র জাগি।” ব্রহ্মা বললেন- “তথাস্তু। কিন্তু অকালে তোমার নিদ্রাভঙ্গ করলে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত।”

যাই হোক, যখন ঘুম ভাঙত, পাগলের মতো খিদে পেত তাঁর। হাতের কাছে যা পেতেন ধরে কপাকপ মুখে পরে দিতেন। দীর্ঘ ছয় মাসের খিদে বলে কথা! জানা যায়, মানুষও সেই খাদ্যতালিকায় এসে পড়ত। রাবণ কুম্ভকর্ণের নিদ্রার জন্য দুই যোজন দীর্ঘ ও এক যোজন বিস্তৃত এক বিচিত্র ভবন নির্মাণ করে দেন। সেখানে ছয় মাসান্তে নিদ্রাভঙ্গের পর কুম্ভকর্ণ প্রচুর পান ও ভোজন করতেন। যে সময়টায় রাম-রাবণের যুদ্ধের সময়, তখন। কুম্ভকর্ণ তো নিদ্রার কাল। হাজার চেষ্টাতেও সেই ঘুম ভাঙানো সম্ভব হচ্ছে না। উপায়ান্তর না-পেয়ে অবশেষে ১০০০ হাতি তাঁর শরীরের উপর দিয়ে হাঁটিয়ে দেওয়া হল, ঘুম ভাঙল রাবণের এই ভাইয়ের। ছয় মাস ঘুমিয়ে থাকা আর ছয় মাস জেগে থাকা এবং ভোজনের বর্ণনা–এসব রূপকথার গপ্পো। বাড়াবাড়ি রকমের বানোয়াট।

রামশিবিরের যোদ্ধারা যখন সমুদ্রসৈকতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন কুম্ভকর্ণ রীতিমতো জেগে ছিলেন। কেউ তাঁর অসময়ের কাঁচা ভাঙিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে আনেননি। যুদ্ধের নিমিত্ত রামশিবির যেসময় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন রাবণ যুদ্ধকালীন কুম্ভকর্ণ, ইন্দ্রজিৎ, বিভীষণ, মহাপার্শ্ব সহ সকলকে নিয়ে সভা করছিলেন। রাবণের সভায় কুম্ভকর্ণই ছিলেন অন্যতম বক্তা। শত্রুর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করবেন বলে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন। তর্কের খাতিরে যদি রূপকথাটি মান্য করি, অকালে ঘুম ভাঙিয়ে কুম্ভকর্ণকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময়টায় জাগিয়ে কুম্ভকর্ণের স্বাভাবিক মৃত্যুর সময়। এ সময়ে কুম্ভকর্ণকে হত্যার মধ্যে কোনো বীরত্ব আছে বলে হয় না। বীরত্ব তখনই প্রকাশ পেত যদি কুম্ভকর্ণকে জাগার ছয় মাসের যে-কোনো সময়ে হত্যা করতেন।

অতিশয় ধার্মিক, বুদ্ধিমান এবং সাহসী ছিলেন। এতটাই যে তাঁকে স্বয়ং ইন্দ্র পর্যন্ত ঈর্ষা করতেন। রাম ও রাবণের যুদ্ধে লঙ্কা বীরশূন্য হয়ে পড়লে রাবণ বহু অনুচর পাঠিয়ে কুম্ভকর্ণকে ডেকে পাঠান। সীতা অপহরণ এবং রামেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য রাবণকে তিরস্কার করেন। রাবণের কামুকতা আর অহংবোধকে মহামতি কুম্ভকর্ণ অনুমোদন করতে পারেননি। বলেছেন–“দিষ্ট্যা ত্বাং নাবী রামো বিষমিশ্রমিবামিষ”।

দাদার প্রতি কর্তব্য পালনে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যান। বহু বানরকে হত্যা করেন, গিরিশৃঙ্গের আঘাতে সুগ্রীবকে সংজ্ঞাহীন করে দেন এবং লঙ্কায় ধরে নিয়ে যান। কুম্ভকর্ণের আক্রমণে ছত্রখান হয়ে যায় রামচন্দ্রের সেনা। আহত হন হনুমান। অজ্ঞান হয়ে যান সুগ্রীব। কুম্ভকর্ণের দুই পুত্র কুম্ভ এবং নিকুম্ভকেও এ যুদ্ধে প্রাণ হারাতে হয়। শিবপুরাণ অবশ্য বলছে, কুম্ভকর্ণের ভীম নামে তৃতীয় পুত্রও ছিলেন।

বিভীষণ : যিনি না-থাকলে রামের পক্ষে কিছুতেই রাবণ ও রাবণের সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করা সম্ভব হত না, তিনি ‘একমেব অদ্বিতীয়ম’ বিভীষণ। ঘরশত্রু বিভীষণ’, ‘বেইমান বিভীষণ’, ‘ঘর জ্বালানি পর ভুলানি বিভীষণ, ‘বিশ্বাসঘাতক’ বিভীষণ। বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরকে আমরা প্রাণ খুলে গাল পাড়ি, আবার বিশ্বাসঘাতকের ইতিহাসকে (যদি ইতিহাস বলেন) কুর্নিশও করি। চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই পরাজয়, বীরত্বে নয়। রামায়ণে বিভীষণের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় যেমন লঙ্কা ধ্বংস হয়েছে, তেমনই মহাভারতেও নিজেদেরই সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতায় কৌরব বংশ ধ্বংস হয়েছে। আঠেরো দিনের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষে সেনাপতির দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ, শল্য প্রমুখ অপ্রতিরোধ্য বীরপুরুষরা শত্রুপক্ষের শিবিরের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসলেন। প্রতিরোধ তো দূরের কথা, যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র ত্যাগ করে কৌরবদের ধ্বংসের পথ নিশ্চিত করেছিলেন। সেনাপতি হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এই ধরনের নিষ্ক্রিয় অবস্থানে পাণ্ডবদের প্রায় আয়েশেই যুদ্ধজয় হাতে তুলে নিয়েছেন। বিশ্বাসঘাতকতা না-করলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হত অবশ্যই। বেইমান, বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিদের চিনতে না-পারার মাশুল যেমন কৌরবদের। গুণতে হয়েছে, তেমনই বিভীষণকে কারাবন্দি বা মৃত্যুদণ্ড না-দিয়ে রাবণকেও একই মাশুল গুণতে হয়েছে।

‘রামায়ণ’ গ্রন্থখানির প্রধান খলনায়ক (?) চরিত্র রাবণের ‘অপদার্থ’ ভাই বিভীষণ। পৌরাণিক কাহিনি মতে বিশ্রবার ঔরসে নিকষা বা কৈকসী গর্ভে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। বিভীষণের অপর দুই ভাইয়ের নাম রাবণ ও কুম্ভকর্ণ, স্ত্রীর নাম সরমা। দুটি সন্তান–পুত্র তরণীসেন ও কন্যা কলা। সুমালী কুবেরের মতো দৌহিত্র লাভের আশায় তাঁর কন্যা কৈকসীকে বিশ্রবা মুনির কাছে পাঠান। ধ্যানস্থ অবস্থায় বিশ্রবা, তাঁর কাছে কৈকসীর আসার কারণ অবগত হয়ে কৈকসীর সঙ্গে যৌনমিলন করেন। তবে ইনি ভবিষ্যৎ বাণী করেন যে, অসময়ে যৌনসম্ভোগ করার কারণে কৈকসী রাক্ষসের জন্ম দেবেন। এরপর কৈকসী উত্তম পুত্র প্রদানের জন্য বিশ্রবাকে অনুরোধ করলে, বিশ্রবা সন্তুষ্ট হয়ে বলেন যে, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ধর্মানুরাগী হবে। সেই বাণী মতে কৈকসীর প্রথম দুই পুত্র রাবণ ও কুম্ভকর্ণ রাক্ষস হয়ে জন্মান। শেষ পুত্র বিভীষণ রাক্ষস হলেও ধর্মানুরাগী হন। এই হল। এঁদের জন্মবৃত্তান্ত।

বস্তুত পৌরাণিক কাহিনি শুধুমাত্র বিভীষণকে ‘ধর্মানুরাগী’ বলে চিহ্নিত করলেও রাবণ ও কুম্ভকর্ণও কিছু কম ধর্মানুরাগী ছিলেন না। আসলে পক্ষপাতিত্বেই বিভীষণকে কবি এগিয়ে রেখেছেন। বস্তুত রাবণের পরিবর্তে বিভীষণ যদি লঙ্কার রাজা হতেন তাহলে রাবণ যা করেছেন বিভীষণও তাই-ই করতেন। বিরোধী হিসাবে মহান’ থাকতে পারলেও শাসক হিসাবে থাকতে পারতেন না। সরকার বা শাসনে থাকার সঙ্গে বিরোধীদের ব্যবধান অনেক যোজন দূর। বিরোধী টেবিলে বসে কাঠি দেওয়া অনেক সহজ। বিভীষণও ব্যতিক্রম নন। কারণ তিনি ছিলেন রাজার বিরোধী, দেশদ্রোহী তো বটেই। বিভীষণের ষড়যন্ত্র ব্যতীত লঙ্কা কিছুতেই ছারখার হত না।

রামায়ণ মহাকাব্যে তাঁর ভূমিকা কী, কতটুকু? খর, দূষণ, শূর্পণখা ও রাক্ষসদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে রাবণ সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে আসেন। বছর দুয়েক হল রাবণ সীতাকে তুলে এনেছেন। প্রতিবাদ তো দূরের কথা, আপত্তিটুকু পর্যন্ত কোনোদিন করেননি বিভীষণ। যখন জানতে পারলেন রাম অপরাজেয় বানরবাহিনী নিয়ে লঙ্কার কাছাকাছি এসে উপস্থিত হয়েছেন লঙ্কেশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য, তখন কেমন যেন বিভীষণ বিদ্রোহ করতে শুরু করে দিলেন লঙ্কালাভের সুপ্ত বাসনায়। রাবণকে সীতাকে ফিরিয়ে দেওয়ার উপদেশ দেন। রামের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে রাবণ ও রাক্ষসবংশের সমূহ ক্ষতি হবে–এমন বক্তব্যও রাখলেন। এমন কোনো কথা তিনি আগে কখনো বলেননি, রাম-লক্ষ্মণরা যে তাড়কা-শূর্পণখা সহ হাজার হাজার রাক্ষসদের বিনা প্ররোচনায় মেরে ফেলছে তার কী হবে বিহিত! নিজের দেশের কথা না-বলে বিদেশি রামের পক্ষে সওয়াল করায় রাবণ বিভীষণকে অপমান এবং পদাঘাত করেন। “ন তু মিত্রপ্রবাদেন সংবসেৎ শত্রুসেবিনা”–রাবণ বললেন। এই অপমানের বদলা নিতে বিভীষণ তাঁর চারজন অনুগতকে রাক্ষস নিয়ে স্বদেশ ত্যাগ করেন এবং শত্রুপক্ষ রামের দলে সরাসরি যুক্ত হয়ে যান। কিন্তু বিভীষণ তো শত্রুপক্ষের, সুগ্রীব আর সুগ্রীবের সেনারা তাঁকে বিশ্বাস করবেন কেন? সুগ্রীব, জাম্ববান প্রমুখেরা যথারীতি সন্দেহ প্রকাশ করলেন। এমতাবস্থায় হনুমান এগিয়ে এলেন। হনুমান সুগ্রীবের মহামন্ত্রী, তাই বিভীষণের মতলব পড়ে নিতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি। হনুমান বললেন–“বালিনং তু হতং ত্বা সুগ্রীবঞ্চাভিষেতি। রাজ্যং প্রার্থয়মানস্তু বুদ্ধিপূর্বমিহাগতঃ”। অর্থাৎ “বালিকে হত্যা করে রাম যে সুগ্রীবকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা করেছেন, সে খবর বিভীষণ রেখেছেন। তাই বিভীষণ ভেবেছেন এ যুদ্ধে রাবণে মৃত্যু হলে তিনিই লঙ্কার রাজা হবেন। এটাই তাঁর আশা।” একথা অবগত হলেন রাম। বুঝলেন বিভীষণের সাধই রামশিবিরের সাধ্য পূরণ করতে পারে। রাম বিভীষণকে দলে নিলেন। গৃহভেদী’ বিভীষণ রাবণের শত্রুপক্ষে নাম লিখিয়েই জানিয়ে দিলেন–“ভবদগতং হি মে রাজ্যং জীবিতঞ্চ সুখানি চ।” অর্থাৎ “এখন আমার রাজ্যলাভ, জীবন ও সুখ সবই আপনার উপর।” বিনিময়ে বিভীষণ প্রতিশ্রুতি দিলেন–“রাক্ষসানাং বধে সাহং লঙ্কায়াশ্চ প্ৰধর্ষণে।” অর্থাৎ “রাক্ষস হত্যায় সাহায্য করব, লঙ্কার অধিকারে সাহায্য করব”।

রাম আর দেরি করলেন না। শুভস্য শীঘ্রম্। প্রতিশ্রুতি বিভীষণের মুখ থেকে বেরলো কি বেরলো না, তৎক্ষণাৎ বিভীষণের রাজ্যাভিষেকের আয়োজন করলেন। লঙ্কার নকল রাজা হলেন বিভীষণ। রাবণের সিংহাসন পেতে বিভীষণের এখন সময়ের অপেক্ষা। অনায়াসে রাবণ বধের সমস্ত অন্ধিসন্ধি রামকে জানিয়ে দিলেন বিভীষণ। রাবণ ও রাক্ষসবংশকে ধ্বংস করতে বিভীষণ নির্লজ্জের মতো রামকে সাহায্য করেছিলেন। রাজ্য ও সিংহাসনের লোভ বিভীষণের এতটাই যে, মেঘনাদের আঘাতে রাম-লক্ষ্মণ যখন মৃতপ্রায় হন, তখন বিভীষণ হাউহাউ করে কেঁদেছিলেন। কেঁদেছিলেন কারণ, রাম-লক্ষ্মণ মরেই যায়, তাহলে তিনি লঙ্কেশ্বর হবেন কী করে–“যয়োর্বীর্যমুপাশ্ৰিত্য প্রতিষ্ঠা কাঙ্ক্ষিতা ময়া”। বিভীষণ বলছেন–“হায়, আমি যাঁহাদের বাহুবলে রাজ্যপদ কামনা করিয়াছিলাম, এক্ষণে তাঁহারাই মৃত্যুর জন্য শয়ান।” কিষ্কিন্ধ্যারাজ সুগ্রীব বোঝালেন বিভীষণকে–“রাজ্যং প্রান্সসি ধর্মজ্ঞ লঙ্কায়াং নেহ সংশয়”।

বিভীষণ অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি, ক্ষুরধার তাঁর বুদ্ধি। তিনি বুঝে নিয়েছেন রাম যে সৈন্যবাহিনী নিয়ে লঙ্কার কাছাকাছি এসে উপস্থিত হয়েছেন, যুদ্ধ হলে লঙ্কার কেউ বেঁচে থাকবেন না। নিজের ‘জান’ বাঁচাতে হলে শত্রুশিবিরে যোগ দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। বহুদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিলেন বিভীষণ, রাবণকে সরিয়ে লঙ্কার সিংহাসন তিনি অলংকৃত করবেন। রাবণও কুবেরকে হটিয়ে লঙ্কার দখল নিয়েছিলেন। তবে সীতাকে ইস্যু করে এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেই সুযোগের পিছনে বিভীষণকে দৌড়োত হয়নি, সুযোগ বিভীষণের কাছে এসে ধরা দিল। না-হলে দু-বছর যাবৎ সীতা লঙ্কায় আটক ছিলেন রাবণ, কোনোদিন বিদ্রোহ তো দূরের কথা ন্যূনতম অভিযোগ পর্যন্ত করেননি। যেই-না শুনেছেন রাম তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে লঙ্কায় হাজির, অমনি তিনি নীতিবাগীশ হয়ে উঠলেন। সীতার জন্য কাতর তিনি।

এসবই বিভীষণের পূর্বপরিকল্পিত। তাই ক্রমে ক্রমে রাবণে উত্যক্ত করেছেন বিভীষণ। নানা অকথা কুকথা বলেছেন। বলেছেন–“তুমি গিয়া রামকে ধনরত্ন ও বসনভূষণের সহিত সীতা সমর্পণ করো, তাহা হইলেই আমরা এই লঙ্কাপুরীতে নির্ভয়ে বাস করিতে পারিব।” অন্যথায় রামের হাতেই তাঁর পরাজয় এবং মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে। এমনকি শত্রুপক্ষের যোদ্ধা রামের জয়গানে মুখর হয়ে উঠলেন বিভীষণ। রাবণ এবার সত্যিই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো কঠিন-কঠোর বাক্যবাণ–“বরং শত্রু ও রুষ্ট সর্পের সহিত বাস করিব, কিন্তু মিত্ররূপী শত্রুর সহিত সহবাস কদাচ উচিত নয়। .. রে কুলকলঙ্ক! যদি আমাকে অন্য কেহ এইরূপ কহিত, তবে দেখিতিস তদ্দণ্ডেই তাহার মস্তক দ্বিখণ্ড করিতাম।” বিভীষণ সফল। রাবণের মুখ থেকে চরম প্রতিক্রিয়াটি বের করতে পেরেছেন। বিভীষণ চেয়েছিলেন লঙ্কেশ্বর এরকম কিছুই বলুক। নাহলে বিভীষণের স্বপ্নপূরণ হবে না। রাজ্যলাভ হবে না। আর রাজ্যলাভ করতে হলে অবশ্যই শত্রুপক্ষে যোগ দেওয়া প্রয়োজন। ছুঁতো না-পেলে শত্রুপক্ষে যোগ দেওয়াটা বড়োই নগ্ন হয় পড়বে! শত্রুপক্ষে যোগ দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে এক মুহূর্তের জন্যেও বিভীষণ দেরি করেননি। যেখানে রাম-লক্ষ্মণ ও বানরসেনারা অপেক্ষা করে আছেন, সেখানে উপস্থিত হয়ে গেলেন। রামের ভক্ত হিসাবে নয়, লঙ্কায় ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য নয়–বিভীষণ রামের কাছে এসেছেন রাবণকে হত্যা করে লঙ্কার পরবর্তী রাজার হওয়ার বাসনায়। রামও স্পষ্টত বলেছেন–“তিনি স্বয়ং রাজ্যলাভার্থী, স্বার্থরক্ষার জন্য আমাদের সহিত সদ্ভাব স্থাপনই তাঁহার উদ্দেশ্য। সুতরাং বিভীষণকে সংগ্রহ করা কর্তব্য।”

ভাবুন, শত্রুপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রথম আলাপেই বিভীষণ সরাসরি তাঁর সুপ্ত ইচ্ছার কথা বলতে লজ্জাবোধ করেনি। লজ্জাবোধ থাকার কথাও নয়। কারণ নীতিগতভাবে তিনি তার বিনিময়ে রাবণের ধ্বংস সুনিশ্চিত করবেন। রামের জয় এনে দেবেন। গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি। “বিষ্ণুর অবতার” রামকে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন অপারেশনে সাহায্য করার জন্য বিভীষণ শত্রুপক্ষে যোগ দেননি। সুগ্রীব যদি কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্য ও বালীর স্ত্রীকে পেতে পারে, তবে তিনি কেন লঙ্কারাজ্য ও মন্দোদরীকে পাবেন না! অতএব হাত মেলাও বন্ধু হও।

মাইকেল মধুসূদনের মহাকাব্যে বিভীষণ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারের গোপন অবস্থানে লক্ষণকে নিয়ে গিয়ে ভাইপো মেঘনাদের হত্যায় সহায়তা করেন। ইনিই লঙ্কার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রাবণের শক্তি ইত্যাদি সমস্ত তথ্য রামের কাছে পাচার করেন। যুদ্ধে রাবণ সবংশে নিহত হলে রাম বিভীষণকে প্রতিদান ফিরিয়ে দিতে ভোলেননি। রাম লঙ্কার শাসনভার বিভীষণের হাতে শাসনভার তুলে দেন। ধর্মানুরাগী বিভীষণ নিজের সদ্য বিধবা বউদি মন্দোদরীকে (রাবণের স্ত্রী) বিবাহ করতে দেরি করেননি। না, কবি অবশ্য একথা কোথাও বলেননি যে, বিভীষণ বউদিকে নিজের করে ভোগ করার জন্য নিজের দাদা রাবণের মৃত্যুকে তরান্বিত করতে রামের পক্ষ নিয়ে কাজ হাসিল করেছিলেন। সুগ্রীবও একই পথে নিজের বউদিকে ভোগ করতে নিজের ভাইকে হত্যা করিয়েছিলেন রামকে দিয়ে। বউদিরা কি এতই সুস্বাদু!

সুবিপুল বানরসেনা, রাম-লক্ষ্মণের অস্ত্র-নিপুণতা আর বিভীষণের জ্ঞাতিবিরোধিতায় রাবণ পরাজিত হলেন। গুপ্তপথ, গুপ্তচর, গুপ্তঅস্ত্র–সবই রামকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন বিভীষণ। বিভীষণ না-থাকলে রামের পক্ষে রাবণ নিকেশ অত সহজে সম্ভব হত না। বিভীষণ থাকলে একটা মামুলি বানরও রাবণ হত্যায় সক্ষম হতেন। রামের প্রয়োজন হত না। রাবণ রামের অপেক্ষা কয়েকশো গুণ শক্তিশালী ও বীর ছিলেন। একথা রামই স্বীকার করেছেন–“মহাত্মা বলসম্পন্নো রাবণো লোকরাবণঃ”। সেইজন্যই বোধহয় কবি রাবণের দশ মাথা কুড়ি হাত কল্পনা করেছেন। উত্তরকাণ্ডে রামের আত্মহননের সময় বিভীষণও সঙ্গী হয়েছিলেন।

এই বিভীষণকেই আমরা মহাভারতেও দেখা পাই। সেটা আবার কীভাবে সম্ভব হল!! মহাভারত বলছে–পাণ্ডবরা যখন রাজাসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন, তখন বিভীষণ তাঁদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এবং তাঁদের বহুমূল্য সমস্ত সামগ্রী ও উপহার প্রদান করেন।

মন্দোদরী : মন্দোদরী প্রথমে রাবণের স্ত্রী এবং পরে বিভীষণের স্ত্রী। মন্দোদরী ছিলেন অ-সুররাজ ময়দানবের ও স্বর্গবশ্যা হেমার কন্যা। ময়দানব অ-সুর জাতির প্রখ্যাত স্থপতি। রামায়ণের কোনো কোনো সংস্করণ অনুযায়ী বলা হয়েছে–মন্দোদরী রামের স্ত্রী সীতারও গর্ভধারিণী মা। উল্লেখ্য, এই সীতাকেই তাঁর স্বামী রাবণ অপহরণ করে লঙ্কায় এনেছিলেন। সীতা, না বেদবতী? মন্দোদরী বারবার সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রাবণকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই কারণেই। কিন্তু রাবণ তাঁর কথায় কর্ণপাত করেননি। তবে রামায়ণগুলিতে রাবণের প্রতি মন্দোদরীর ভালোবাসা ও আনুগত্যেরই প্রশংসা করা হয়েছে। রামায়ণের একাধিক সংস্করণে রামের বানরসেনার হাতে মন্দোদরীর হেনস্থার উল্লেখ পাওয়া যায়। হেনস্থার ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু ভাবার অবকাশ নেই, এমন তো আজও হয়! কৃত্তিবাসের রামায়ণেও তো বলা হয়েছে,–বানরেরা মন্দোদরীকে টেনে এনে তাঁর পোশক পর্যন্ত ছিঁড়ে দিয়েছিলেন। বিচিত্র রামায়ণ’-এর বর্ণনা অনুযায়ীও হনুমান মন্দোদরীকে হেনস্থা করেছিলেন। থাই রামায়ণ ‘রামাকিয়েন’-এ মন্দোদরীর প্রতীকী ধর্ষণের উল্লেখ আছে। রামাকিয়েনে বলা হয়েছে–হনুমান রাবণের রূপ ধরে এসে মন্দোদরীর সঙ্গে যৌনসম্ভোগ করেন। এর ফলে মন্দোদরীর সতীত্ব নষ্ট হয় এবং যেহেতু মন্দোদরীর সতীত্বই রাবণের জীবন রক্ষা করছিল, সেহেতু এই ঘটনা রাবণের মৃত্যুর কারণ হয়।

আবার রামায়ণের কোনো কোনো সংস্করণে বলা হয়েছে, তাঁকে ব্যবহার করে বানরেরা রাবণের যজ্ঞ ভণ্ডুল করেছিল। হনুমান কৌশলে তাঁর কাছ থেকে রাবণের মৃত্যুবাণের অবস্থান জেনে নিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর জন্য হনুমানকে পথ দেখিয়েছিলেন মন্দোদরীই। জানিয়েছিলেন স্বামীর মৃত্যুবাণ কোন্ স্তম্ভে (Pillar) সুরক্ষিত আছে। রাবণের মৃত্যুর পরে বিভীষণ বিধবা মন্দোদরীকে বিবাহ করেন। যদিও বিভীষণের নিজেরও এক স্ত্রী ছিল, তাঁর নাম সরমা। একটি তত্ত্ব অনুযায়ী, রাবণ মাতৃতান্ত্রিক জাতির প্রতিনিধি ছিলেন। তাই তাঁর মৃত্যুর পর শাসনক্ষমতা পেতে বিভীষণ রাজমহিষীকে বিবাহ করেন। অপর একটি মতে, রাজমহিষীকে বিবাহ করা সম্ভবত অনার্য সভ্যতার লক্ষণ। মন্দোদরী ও বিভীষণের বিবাহ ছিল ‘রাজনৈতিক কূটবুদ্ধিপ্রসূত বলা হয়, এই বিবাহ কোনোভাবেই ‘পারস্পরিক দৈহিক আকর্ষণের ভিত্তিতে হয়নি। সম্ভবত রাজ্যের উন্নতি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে এবং রাজকীয় ক্ষমতা ভোগ করতে মন্দোদরী বিভীষণকে বিবাহ করতে রাজিও হয়েছিলেন। বিবাহের অপর একটি কারণ ছিল রাম মন্দোদরীকে ‘সতী’ হতে বারণ করেছিলেন।

বাল্মীকি রামায়ণে মন্দোদরীকে সুন্দরী নারীর রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। রামের বানর বার্তাবাহক হনুমান সীতার সন্ধানে লঙ্কায় এলে, তিনি মন্দোদরীর সৌন্দর্যে বিস্মিত হয়ে প্রথমে তাঁকেই সীতা বলে ভুল করেন। ভুল কেন করবেন সেটা বোধগম্য নয়, হনুমান যে স্বয়ং দেবতা’! রাবণ সীতার মুণ্ডচ্ছেদ করতে উদ্যত হলে মন্দোদরী সেই সময় রাবণকে বাধা দিয়ে সীতার প্রাণরক্ষা করেন। মন্দোদরী উপদেশ দেন, রাবণ সীতাকে বিবাহের ইচ্ছা ত্যাগ করে তাঁর অন্যান্য মহিষীদের সম্ভোগ করতে পারেন। মন্দোদরী সীতাকে তাঁর অপেক্ষা কম সুন্দরী ও নিচকুলজাত মনে করলেও, রামের প্রতি সীতার ভক্তি সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন এবং সীতাকে দেবী শচী ও রোহিণীর সঙ্গে তুলনা করেন। যুদ্ধের আগে মন্দোদরী শেষবারের মতো রাবণকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। শেষপর্যন্ত মন্দোদরী বাধ্য ও বিশ্বস্ত স্ত্রীর মতো রাবণের পাশে এসে দাঁড়ান স্বামীকে রক্ষাকরতে। যদিও তিনি তাঁর পুত্র মেঘনাদকেও রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার উপদেশ দিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর মন্দোদরী করছেন–“নাথ! সীতা অপেক্ষাও তো তোমার বহুসংখ্যক রূপবতী রমণী আছে। … সীতা ও রূপগুণে কিছুতেই আমার অনুরূপ বা অধিক নয়।”

রামায়ণে মন্দোদরীর ভূমিকা সংক্ষিপ্ত। তাঁকে এক ধর্মপ্রাণা ও নীতিপরায়ণা রাজমহিষীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের মতে, পঞ্চকন্যার অন্যান্যদের তুলনায় মন্দোদরীর জীবন ‘কম বর্ণময় ও কম ঘটনাবহুল। তিনি আরও বলেছেন, “মন্দোদরী বিশেষ গুরুত্ব পাননি। তাঁর ছবিটিতে বস্তুগত অভাব বোধ হয় এবং তা শীঘ্রই ক্ষীণ হয়ে আসে। যদিও স্বামীর প্রতি তাঁর ভালবাসা ও আনুগত্য বিশেষ গুরুত্বের দাবি রেখেছে।” ‘পঞ্চকন্যা উইমেন অফ সাবস্ট্যান্স গ্রন্থের রচয়িতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, “বাল্মীকি তাঁর (মন্দোদরী) সম্পর্কে বিশেষ কিছু লেখেননি। শুধু এটুকুই উল্লেখ করার মতো যে তিনি সীতাকে ফিরিয়ে দিতে বলেছিলেন এবং সীতাকে ধর্ষণ করার থেকে রাবণকে নিরস্ত করেছিলেন।” মন্দোদরী যতটুকু সীতাকে রক্ষার জন্য ডুকরে উঠেছিলেন, তার একবিন্দুও তেমন করে ডুকরে উঠেননি রাম-লক্ষ্মণ কর্তৃক বিরাধ-তাড়কা-শূর্পণখামারীচ সহ ১৪ হাজার স্বজাতির মৃত্যুতে। তখন কোথায় ছিল তাঁর মানবিক মুখ, সে বিষয়ে উল্লেখ নেই রামায়ণে। তবে মন্দোদরী বিশ্বাস করেন না যে রামই তাঁর স্বামীকে হত্যা করতে পারেন। তাঁর দৃঢ় ঘোষণা, ইন্দ্রই রাবণকে হত্যা করেছেন।

শত্রুঘ্ন : রাজা দশরথের স্ত্রী সুমিত্রার গর্ভজাত যমজ পুত্রের মধ্যে লক্ষ্মণ জ্যেষ্ঠ ও শত্রুঘ্ন কনিষ্ঠ। ইনি লক্ষ্মণ ও রামের অনুগত ও সহায় ছিলেন। রামের বনগমনে পুত্রশোকে দশরথ দেহত্যাগ করেন। তখন শত্রুঘ্ন ভরতের সঙ্গে ভরতের মাতুলালয়ে ছিলেন। শত্রুঘ্নের সঙ্গে জনকরাজার কনিষ্ঠ ভ্রাতার অন্যতমা কন্যা শ্রুতকীর্তির বিবাহ হয়। রামের নির্বাসনে ইনি এতদূর বিরক্ত ও মর্মাহত হয়েছিলেন যে সকল অনর্থের মূল কৈকেয়ীর দাসী মন্থরাকে নিগৃহীত করেন এবং কৈকেয়ীকে কঠোর ভর্ৎসনা করেন। কবিবর বাল্মীকি শত্রুঘ্নর জন্য এটুকু কাজই। বরাদ্দ করেছিলেন। এর বেশি নয়। প্রায় ঠুটো জগন্নাথ!!

পরবর্তী প্রক্ষিপ্ত-সংসোজক রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে শত্রুঘ্নর কিছু কাজ সংযোজন করে দিলেন। তা না-হলে যে শত্রুঘ্নর নামের প্রতি সুবিচার হয় না! বন-ফেরত রামের রাজত্বকালের প্রথম বছরেই শত্রুঘ্নকে পাঠিয়ে দিলেন মথুরায় লবণাসুরকে হত্যা করতে। অযোধ্যা শত্রম্নমুক্ত হল। ভরতের কাছ থেকে শত্রুঘ্নকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া গেল। ভরত গন্ধবদেশ জয় করে ওখানেই থেকে গেলেন এবং শত্রুঘ্নকে মথুরার রাজপদে রাম অভিষিক্ত করে দিলেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। সঙ্গে লবণবধের জন্য চার হাজার ঘোড়া, দুই হাজার রথ আর একশো হাতি পাঠিয়ে দিলেন। সেনাদের একমাস আগে পাঠিয়ে দিয়ে শত্রুঘ্নকে একা শরাসন হাতে দিয়ে পাঠালেন। অযোধ্যায় ফিরে আসার কোনো অনুমতি ছিল না শত্রুঘ্নর। পাছে অযোধ্যা আক্রমণ করে বসে সেই সতর্কতায় কি সৈন্যবাহিনীসহ শত্রুঘ্নকে অযোধ্যায় অবস্থান করতে দেননি? শত্রুঘ্ন মধুদৈত্যের পুত্র লবণাসুরের মুখোমুখি হলেন। এসময় যমুনাতীরবাসী মহর্ষিরা অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে উঠছিল। শত্রুঘ্ন রামের আদেশে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান করেন। লবণাসুর শত্রুঘ্নকে হুংকার দিলেন, বললেন–“পূর্বে অনেক বীরকে তৃণের মতো তুচ্ছ করে যমালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।” জবাবে শত্রুঘ্নও বললেন–“শত্রুঘ্ন ন তদা জাতো যদান্যে নির্জিতস্তয়া।/তদদ্য বাণাভিহত ব্ৰজ ত্বং যমসদন।” অর্থাৎ, “তুমি যখন বীরদের যমালয়ে পাঠিয়েছিলে তখন শত্রুঘ্নর জন্ম হয়নি। এখন তুমি আমার বাণে যমালয়ে যাও।” এরপর তাঁকে শূলহীন অবস্থার সুযোগ নিয়ে আক্রমণ করেন এবং বিনষ্ট করেন। দেবতা প্রদত্ত শূলের জন্যই মধুদৈত্যের মতো তাঁর পুত্র লবণও অজেয় ছিল। লবণবধের পর শত্রুয় লবণের মথুরারাজ্য নিজের পুত্র সুবাহু ও শত্রুঘাতাঁকে অর্পণ করেন। সুবাহু পরবর্তীকালে মথুরার রাজা হিসাবে অভিষিক্ত হন। শত্রুঘাতী ছিলেন বিদিশার রাজা। এরপর শত্রুঘ্ন রামের সঙ্গে সরযু নদীতে প্রবেশ করে দেহত্যাগ করেন। মোদ্দা কথা, একটিমাত্র শত্রু হত্যা করে তিনি শত্রু।

শান্তা : রামায়ণে শান্তা নামে একটি চরিত্র পাওয়া যায়। রাজা দশরথের ও দশরথের পরম বন্ধু অঙ্গাধিপতি রাজা রোমপাদের পালিতা কন্যা। রাজা লোমপাদ যজ্ঞ করার জন্যে বিভাণ্ডক মুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে নিজের রাজধানীতে নিয়ে আসেন। যজ্ঞশেষে তিনি নিজের পালিতা কন্যা শান্তাকে ঋষ্যশৃঙ্গের হাতে তুলে দেন। শান্তার সঙ্গে ঋষ্যশৃঙ্গের বিবাহ হয়।

কিন্তু কবিরা তাঁর প্রতি বিন্দুমাত্র সুবিচার করেননি। অযোধ্যাপতি দশরথ ও তার প্রধানমহিষী কৌশল্যার প্রথম সন্তান হলেন শান্তা। সম্ভবত শান্তাই হলেন রামায়ণের সবথেকে স্বল্পত চরিত্র। শান্তা রামচন্দ্রের অগ্রজা, বড়ো দিদি। যথাক্রমে শান্তা, রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন–এই হল চার ভাই, এক বোন। শান্তা রামচন্দ্রের দিদি নিশ্চয়ই, কিন্তু দশরথের ঔরসজাত সন্তান নয় বলেই অনেকে মনে করেন। রাজা দশরথের সন্তানদানে অক্ষমতা ও দুর্বলতাকে নানা গল্পে জড়ানো হয়েছে। শান্তা কৌশল্যার ক্ষেত্রজ সন্তান–যা রাম-লক্ষ্মণদের মতো নিয়োগ প্রথার ফসল। অনেক পণ্ডিত মনে করেন, ঋষ্যশৃঙ্গের নিয়োগে বা কৃপায় (কৃপা = করে যা পাওয়া) রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্ৰুগ্নদের জন্ম হয়েছে। শান্তার জন্মবৃত্তান্ত নিয়েও বহু গল্প আছে। কোনও কোনও রামায়ণ বলে, রাবণ যখন জানলেন, দশরথের পুত্রের হাতে তাঁর বিনাশ, তিনি নতুন উপায় বের করলেন। শিবের কাছে বর প্রার্থনা করলেন, দশরথের যেন কোনও পুত্র না জন্মায়। তাঁর বর মঞ্জুর হল।

শান্তার জন্ম হয়েছে রোমপাদের নিয়োগে। রোমপাদ পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে না-পারার ব্যর্থতায় সম্ভবত পরবর্তীতে ঋষ্যশৃঙ্গের ডাক পড়ে। ঋষ্যশৃঙ্গ হতাশ করেননি। ঋষ্যশৃঙ্গ রোমপাদের পুত্রসন্তান। একটি নয়, দুটি নয়–চারটি পুত্রসন্তান উপহার দিলেন। দশরথ ও কৌশল্যার মেয়ে হয়ে জন্মালেও অঙ্গরাজ রোমপাদ ও তাঁর মহিষী ভার্ষিণী (যে সম্পর্কে কৌশল্যার বোন) তাকে দত্তক নেয়। ঋষি বিভাণ্ড ও স্বৰ্গবেশ্যা উর্বশীর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে বিবাহ করে উনি উনার পিতার রাজ্যকে খরামুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীকালে উনার ও রাজা দশরথের অনুরোধে ঋষ্যশৃঙ্গ পুত্রকামাষ্টি যজ্ঞ করেন। যার ফলে কৌশল্যা ও দশরথের অন্য দুই স্ত্রী কৈকেয়ী ও সুমিত্রাও গর্ভধারণ করেন। ঋষ্যশৃঙ্গকে বাল্মীকির রামায়ণে আমদানি করিয়ে প্রক্ষিপ্ত-কবিরা বড়োই দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছেন। জটিলতা বাড়িয়েছেন। তবে গোটা রামায়ণে আর কোথাও শান্তাকে পাওয়া যায়নি।

কথিত আছে বিভাণ্ডক মুনির তপস্যা ভঙ্গ করতে দেবরাজ ইন্দ্র স্বৰ্গবেশ্যা উর্বশীকে পাঠালে উর্বশী মুনিকে প্রেমজালে আবদ্ধ করেন ও মুনির ঔরসে উর্বশীর গর্ভে ঋষ্যশৃঙ্গ জন্মায়। পুত্রের জন্মের পর স্বর্গের বেশ্যা (অপ্সরা) স্বর্গে ফিরে গেলে বিভাণ্ডকের খুব ক্ৰোধ জন্মায়। তাই সে নিজের পুত্রকে নারীদের সংস্রব থেকে দূরে রাখার জন্য এক নির্জন ও গভীর অরণ্যে প্রবেশ করেন। সেই থেকে ঋষ্যশৃঙ্গ একা বেড়ে ওঠে প্রকৃতির কোলে। রোমপাদ একবার এক ব্রাহ্মণকে অপমান করায় সে তাকে অভিশাপ দেয় যে রাজ্যে খরা নেমে আসুক। তখন শান্তা অনেক অনুনয় করলে ব্রাহ্মণ বলেন যে জন্মের পরমূহুর্ত থেকে যে পুরুষ কোনো নারীকে দর্শন করেনি সে যদি অঙ্গরাজ্যে এসে শান্তাকে বিবাহ করে তবেই বৃষ্টি নামবে। ফলে অনেক তপস্যা ও কষ্ট স্বীকার করে শান্তা ঋষ্যশৃঙ্গকে পরিণয় করে ও অবশেষে ব্রাক্ষ্মণের অভিশাপ থেকে রাজ্যকে রক্ষা করেন। শুধু রামায়ণে নয়, মহাভারত-পুরাণগুলিতে অবশ্য এরকম অজাচার সম্পর্কের কাহিনি পাওয়া যায়। বৌদ্ধ দশরথজাতকে তো রাম সীতা একে অপরের ভাই-বোন। এই রামায়ণে দশরথ অযোধ্যা নয়, বারানসীর রাজা। রাম পণ্ডিত, লক্ষ্মণ পণ্ডিত এবং সীতা দশরথের বড়ো রানির গর্ভে জন্ম নেন। বড়ো রানির মৃত্যু হলে দশরথ পুনরায় বিয়ে করেন এবং সেই নতুন রানির আবদারে ভাই-বোনদের হিমালয়ে নির্বাসনে পাঠাতে বাধ্য হন। অবশ্য বৌদ্ধদের রামায়ণে বানর নেই, মুনিঋষি নেই, রাবণ নেই, সীতার অপহরণও নেই। এ রামায়ণে হিমালয়ের নির্বাসন জীবন কাটিয়ে বারানসী ফিরে রাম রাজা হন, সীতা রানি হন। জাতক অনুসারে সীতা একদিকে রামের সহদোরা, অপরদিকে ভার্যাও। আবার অন্য এক রামকাহিনিতে পাওয়া যায় সীতা মন্দোদরীর কন্যা, মন্দোদরীর কন্যা হলে তো রাবণেরও কন্যা। যদি তাই-ই হয় তবে কি রাবণ সীতাকে ধর্ষণ করেছেন এ সন্দেহ ন্যায্যত হয়? সেযুগে হয়তো হত, না-হলে রাম সন্দেহ করবেন কেন! তবে অবশ্য রামায়ণে ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষির ভূমিকা আর বিশেষ কিছু নয়। রামজন্মের পর কোনো ঘটনাতেই এই ঋষির উল্লেখ করা হয়নি। সেটার একটা কারণে হতে পারে–চিত্রনাট্যের ডিমান্ডে শান্তাকে বিয়ে এবং রামের জন্ম যে উপায়ে হয়েছে, সেটা কবি চাননি মানুষ মনে রাখুক। তাই হয়তো ঋষ্যশৃঙ্গকে আর ফিরিয়ে আনা হয়নি। শান্তাকেও বিশেষ কেউ মনে রাখেনি।

মন্থরা : দশরথ যে অত্যন্ত গোপনে রামের রাজ্যাভিষেকের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সে কথা যেভাবেই হোক মন্থরার মাধ্যমে অন্দরমহলের কৈকিয়ের কাছে পৌঁছে যায়। দশরথের পরিকল্পনাকে কেঁচিয়ে দিতে দশরথের কাছ থেকে বর চাওয়ার ব্যাপারটা কৈকেয়ীকে মনে করিয়ে দেন মন্থরাই। রাজপ্রাসাদের ভিতরে রাম ও ভরতের বিভাজন–রাজনীতিটা মন্থরাও জানতেন, সেইজন্যই কৈকেয়ীর কানে মন্ত্র দেওয়ার সাহসটা তিনি পেয়েছেন।

মন্থরা হলেন রাজা দশরথের স্ত্রী রানি কৈকেয়ীর বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা কুজা দাসী। তিনি বিকৃতাকার, বক্ৰদেহা, ঈর্ষাপরায়ণা এবং কূটবুদ্ধিসম্পন্না ছিলেন। কুমন্ত্রণা দানে নিপুণ হলেও তিনি কৈকেয়ীর প্রকৃত হিতৈষী ছিল। স্বৰ্গবেশ্যাদের নৃত্যের সঙ্গে এঁরা বাদ্যযন্ত্রাদি বাজাতেন ও গাইতেন। হাহা, হুহু, চিত্ররথ (অঙ্গারপর্ণ), হংস, বিশ্বাবসু, গোমায়ু, নন্দি, তুম্বুরু ও মাদ্য–গন্ধর্ব হিসেবে প্রসিদ্ধ। গন্ধর্বীদের মধ্যে কুম্ভীনসী (অঙ্গারপর্ণের পত্নী), দুন্দভী (ইনিই মন্থরা’ নাম নিয়ে পিঠে কুঁজ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন দশরথপত্নী কৈকেয়ীকে কুমন্ত্রণা দিয়েছিলেন)। কুজা মন্থরা কৈকেয়ীর মাতৃসমা, আবার ভরতের ধাত্রীমাতাও। কেকয়রাজ অশ্বপতির স্নেহভাজন গুপ্তচরী। মন্থরা প্রিয়ভাষিণী কৌতুকপ্রিয়া, এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। রঙ্গকৌতুকে রাজপ্রাসাদের প্রতিটি মানুষকেই সহজেই আপন করে নিয়েছিলেন। গোপন সংবাদ সংগ্রহের জন্যে যে সকলেরই প্রয়োজন! মন্থরা অতি সুচতুর রাজনীতিক, ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী ধৈর্যশীলা এবং চারুদর্শিনী। দশরথ জ্যেষ্ঠপুত্র রামকে রাজ্যাভিষিক্ত করতে চাইলে কৈকেয়ীকে মন্থরা নানাভাবে উত্তেজিত করতে থাকে। প্রথমদিকে কৈকেয়ী এসবে কান না দিলেও অবশেষে মন্থরার যুক্তিতে তাঁর বুদ্ধি নাশ হয়। তিনি কৈকেয়ীকে মনে করিয়ে দেন দশরথ শম্বুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে আহত হলে কৈকেয়ী তাঁকে রণভূমি থেকে সরিয়ে এনেছিলেন এবং সেবা দিয়ে সুস্থ করেছিলেন। তখন দশরথ তাঁকে একই সঙ্গে দুটি বর দিতে রাজি হয়েছিলেন। এখন সেইসময় উপস্থিত হয়েছে, তাঁর উচিত প্রথম বরে ভরতকে রাজ্যে অভিষিক্ত করা এবং দ্বিতীয় বরে রামকে চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে পাঠানো। রাম বনের পথে লক্ষ্মণ ও সস্ত্রীক যাত্রা করলে ভরতের উপস্থিতিতে শত্রুঘ্নর হাতে লাঞ্ছনার পর মন্থরার আর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। অথচ মন্থরাই রামকথার অন্যতম নিয়ন্ত্রকই ছিলেন। কৈকেয়ী তো বরের কথা ভুলেই গিয়েছিল। মন্থরাই মনে করিয়ে দিয়েছে উপর্যুপরি কান ভাঙানিতে। মন্থরা যে মন্ত্র কৈকেয়ীর কানে দিয়েছিলেন, তা দশরথ নিজের মুখে রামকে বলতে পারেননি। কৈকেয়ীর মুখ থেকে সব শুনে রাম বনবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শুধু পিতৃসত্য পালনই নয়, বিমাতার মনোবাঞ্ছাও পূরণ করেছেন রামচন্দ্র।

লবকুশ : বাল্মীকি যে উত্তরকাণ্ড রচনা করেননি, সে ইঙ্গিত মেলে রামায়ণের চতুর্থ সর্গের সপ্তম শ্লোকে। বাল্মীকি নারদের নির্দেশে যে রামকথা লিখেছিলেন, তার নাম ছিল ‘পৌলস্ত্যবধ কাব্য’–“কাব্যং রামায়ণং কৃৎস্নং সীতায়াশ্চরিতং মহৎ।/পৌলস্ত্যবধ ইত্যেবং চকার চরিতঃ৷” লবকুশকে আমরা উত্তরকাণ্ডেই পাই। উত্তরকাণ্ডের কবিই এই চরিত্র দুটি সৃষ্টি করেছেন। বাল্মীকি লবকুশ সৃষ্টি করেননি বলেই অনেক পণ্ডিতগণ মনে করেন। এখন প্রশ্ন লবকুশ যদি রাম-সীতার সন্তান হন, তবে কীভাবে বাল্মীকির চোখ এড়িয়ে গেল? বাল্মীকির কিছুই চোখ এড়ায় না, এক্ষেত্রেও এড়ায়নি। চোখ এড়িয়েছে উত্তরকাণ্ডের কবির। আগেপিছে কিছু না-দেখে একটা আষাঢ়ে গপ্পো ফেঁদে বসলেন। সীতার যখন গর্ভসঞ্চার হয় তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮ + ১২ + ১৪ + ২৭ (১৮ বছর বয়সে বিয়ে + ১২ বছর স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে অযোধ্যার রাজগৃহে বাস + ১৪ বছর বনবাস + ২৭ বছর। বনবাসোত্তর স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বসবাস) = ৭১ বছর, মতান্তরে ৬ + ১২ + ১৪ + ২৭ = ৫৯ বছর। সীতাকে পরিত্যাগ করার পর বাল্মীকির আশ্রমে ১০ বছর যাপন। অশ্বমেধ যজ্ঞের সময়কালে রাম যখন দেখেন তখন লব ও কুশের বয়স ১০ বছর। এই ১০ বছর পিতার স্নেহ তো দূরের কথা, পিতার মুখ পর্যন্ত দেখার সুযোগ হয়নি দুর্ভাগা পুত্রদ্বয়ের।

বিজ্ঞান বলছে, বাস্তবিক কোনো নারী এই বয়সে গর্ভধারণ করতে পারেন না। নারীর গর্ভধারণের সময় কিছু কমবেশি ১২ বছর থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। মেনোপোজ বা পিরিয়ড বন্ধ হয়ে গেলে কোনো নারীর পক্ষেই সন্তানধারণ করা সম্ভব নয়। চরকসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ের চিকিৎসাস্থানে বলা হয়েছে–“দ্বাদশাদ্বৎসরাদূর্ধমা পঞ্চাশৎসমাঃ স্ত্রিয়ঃ।/মাসি মাসি ভগদ্বারা প্রকৃত্যৈবার্তবংস্রেবেৎ।” অর্থাৎ, স্ত্রীলোকের বারো বছর বয়সের পর থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত স্বভাবতই প্রতিমাসে তিনদিন করে রজঃ যোনিমুখ দিয়ে প্রস্রত হয়। চরক মুনি আরও বলেছেন–“দিনে ব্যতীতে নিয়তং সঙ্কুচিত্যম্বুজং যথা/ঋতৌ ব্যতীতে নাৰ্য্যাস্তু যোনিঃ সংব্রিয়তে তথা।” অর্থাৎ, দিনের শেষে যেমন পদ্ম সংকুচিত হয়, তেমনই ঋতুকাল অতিক্রান্ত হলে নারীদের যোনিও (জরায়ুপথ) সংকুচিত হয়ে যায়। অতএব এমন ভুল মহাকবি বাল্মীকি করতে পারেন না।

 “রামঃ সীতানুপ্রাপ্য রাজ্যং পুনরবাপ্তবান্।/পিলয়ামাস চৈবেমাঃ পিতৃবনূদিতাঃ প্রজাঃ/অযোধ্যাপতিঃ শ্রীমান্ রামো দশরথাত্মজঃ।” মহাকবি তাঁর রামচরিত এভাবেই শেষ করেছেন। পরে আর কিছু ছিল না বলাই যায়। তবে পণ্ডিতগণ বলেন, মহাকাব্য এভাবে শেষ হয় না। অতএব উত্তরকাণ্ড বাল্মীকি লিখতেই পারেন। যেভাবে হোমারকে ইলিয়াডের পরেও ওডিসি গ্রন্থটি লিখতে হয়েছিল।

কিন্তু বাল্মীকি যে স্বয়ং বলেছেন–“প্রাপ্তরাজ্যস্য রামস্য বাল্মীকিৰ্ভগবানৃষিঃ।/চকার চরিতং কৃৎস্নং বিচিত্রপদমর্থবৎ।/চতুর্বিংশ সহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবানৃষিঃ।/তথা সৰ্গ শতা পঞ্চ ষট্‌ কাণ্ডানি তথোত্তরম্।/কৃত্বাঃ তু তন্মহাপ্রাজ্ঞঃ সভবিষ্যং সহোত্তরম্।/চিন্তয়মানস্য মহর্ষের্ভাবিতাত্মনঃ।/অগৃহীতাং ততঃ পাদৌ মুনিবেশৌ কুশীলবৌ।/কুশীলবৌ তু ধৰ্ম্মজ্ঞে রাজপুত্রৌ যশস্বিনৌভ্রাতরৌ স্বরসম্পন্নৌ দদশাশ্রমবাসিনৌ।” কেদারনাথ মজুমদারের “রামায়ণের সমাজ” গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে পারি–“কুশীলবকে যে সীতার পুত্রদ্বয় বলিয়া পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা হইয়াছে, এবং নবম ছত্রে ঐ কুশীলবকে ‘রাজপুত্রৌ ও দশম ছত্রে ‘ভ্রাতরৌ’ বলিয়া যে নির্দেশ করা হইয়াছে, তাহা নারদ কথিত রামচরিত উপাখ্যানের বহির্ভূত। মুনিবেশৌ কুশীলবৌ’ প্রয়োগে আমাদের মোটেই কোনো আপত্তির কারণ নেই। ইহার অর্থ মুনিবেশধারী গায়কদ্বয়। বাল্মীকি রামচরিত গীতের জন্য রচনা করিয়াছিলেন এবং তাহা কুশীলব (গায়ক) দ্বারাই গান করাইয়া প্রচার করিয়াছিলেন। আমরা ‘কুশীলবৌ’ প্রয়োগটিকে সংগ্রাহকের প্রয়োগ বলিয়াই মনে করি; ইহার অর্থ ‘গায়কদ্বয়।এইএএএএ এই ‘কুশীলবৌ’ শব্দটিকে সীতার ‘রাজপুত্রৌ ও সেই প্রয়াস প্রসূত নবম ও দশম পংক্তির ‘পুত্রদ্বয়’ করিবার যে প্রয়াস ‘ভ্রাতরৌ’ ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগকে উত্তরকাণ্ড রচয়িতার প্রয়াস বলিয়া নির্দেশ করিতেছি। উত্তরকাণ্ড রচয়িতা উক্ত কাণ্ডটিকে মূল রামায়ণের অঙ্গরূপে গণ্য করাইবার জন্য, এই সকল শব্দ প্রয়োগ করিয়াছিলেন এবং কোন কোন পংক্তি ও সর্গ নূতন করিয়া লিখিয়া দিয়াছিলেন।”

রাম-সীতার বিবাহের পর দীর্ঘ সাতাশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর মাঝে অবশ্য বছর দুয়েক রামকে ছাড়াই সীতার একাকী জীবন লঙ্কায়। বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রী যেমন একত্রে একশয্যায় বসবাস করেন, রাম-সীতাও সেইভাবেই বসবাস করেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা নিঃসন্তান। অন্যদিকে ভরত, লক্ষ্মণ, শত্রুয় সকলেই দুটি করে পুত্রসন্তানের পিতা হয়ে গেছেন। এঁরা কীভাবে জোড়া জোড়া পুত্রের পিতা হয়েছিলেন, সে ব্যপারে রচয়িতা অবশ্য নীরব। রামভক্তরা হয়তো বলতে পারেন শ্রীরামচন্দ্র আর পাঁচটি পাতি মানুষের মতো নয়, রামচন্দ্র স্বয়ং বিষ্ণু। তিনি ব্রহ্মচর্য পালন করতেন। তাই তিনি নিঃসন্তান। এখন প্রশ্ন, রাম কেন ব্রহ্মচর্য পালন করতে যাবেন? রামকে তো কেউ ব্রহ্মচর্য পালন করতে শর্ত দেননি। বাল্মীকি তো তেমন কিছু বলেননি। রাম তো ভীষ্ম নয়। রাম তো সেই বিরল পুরুষ চরিত্র ভীষ্ম নয়, যিনি শত প্রলোভনেও ত্যাগ করতে পারেন নারীসঙ্গ, কামতেজ। রামভক্তদের বলি, লবকুশের বিষয়ে আপনারা যদি রামকে বাঁচাতে যান, তাহলে সীতা মারা যাবেন। সীতা কলঙ্কিত হবেন। সীতার সন্তানদের পিতাকে নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠে আসবে। রাবণ সন্দেহজনক হবে। আর যদি রামের বিপক্ষে থাকেন তাহলে বিবাহ-পরবর্তী সাতাশ বছরের হিসাবটাও মিলিয়ে দিতে হবে, তাই না? কারণ যাঁদের দীর্ঘ সাতাশ বছরে কিছু হল না, সেখানে সীতা লঙ্কা-ফেরত হয়েই গর্ভবতী! যদি এটা সংগত না-হয়, গোটা উত্তরকাণ্ডও সংগত হতে পারে না।

বাল্মীকির বিরচিত রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত কোথাও সীতার নির্বাসন, লক্ষ্মণ-বর্জন, লবকুশের কোনো উল্লেখ নেই। মহাভারতের বনপর্বে যে রামোপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে, সেখানেও সীতার বনবাস তৎসহ লবকুশের কোনো প্রসঙ্গই উল্লেখ হয়নি। উল্লেখ হয়নি, কারণ মহাকবি বাল্মীকি তাঁর গীতিকবিতায় যেটুকু বর্ণনা করেছেন, ঠিক ততটুকুই মহাভারতের কবি চয়ন করেছেন। অতএব লবকুশ বানোয়াট, অলীক মস্তিষ্কপ্রসূত, অর্থহীন, অপ্রাসঙ্গিক, বাতুলতা। উত্তরকাণ্ডে এসেও দেখতে পাচ্ছি রামচন্দ্র পুত্রদের অযোধ্যার সিংহাসনে বসিয়ে যাননি, অযোধ্যার পরিবর্তে অন্য পৃথকরাজ্যে দুই পুত্রকে দুটি রাজ্যে অনাড়ম্বর অভিষিক্ত করে যান।

উত্তরকাণ্ড অনুসারে রাম মারা যাওয়ার আগে কোশল সাম্রাজ্যটি দুটি ভাগে আলাদা হয়ে যায়। একটি শ্রাবস্তী নামে আত্মপ্রকাশ করে, এই রাজ্যটি লবের জন্য নির্দিষ্ট হল। অপর রাজ্যটি কুশাবতী নামে পরিচিত হয়, এই রাজ্যটি কুশের জন্য বরাদ্দ হয়। লব কিন্তু শ্রাবস্তী পেয়েই থেমে থাকেননি, তিনি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে তাঁর রাজ্য বিস্তার করে নেন এবং লাভাপুরী নামে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। এই লাভাপুরীই এখনকার লাহোর (বর্তমানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত)। লবের আর-এক নাম লোহ লোহ থেকেই লাহোর নামকরণ। লাহোর ফোর্টের ভিতরে তাঁর নামে একটি মন্দিরও আছে। প্রসঙ্গত জানাই–কাশী ও মৌর্য রাজবংশ নাকি কুশেরই বংশধর। অপরদিকে রাজস্থানের মেবার রাজবংশ নাকি লবের বংশধর। এরকমই দাবি। সত্যাসত্য যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই।

মারীচ : মারীচ, যিনি রামায়ণের স্বর্ণমৃগ। সোনার হরিণ, যাঁর ছলনায় রাবণ কর্তৃক সীতা অপহৃত হয়েছিলেন। লক্ষ্মণ বাণ ছুঁড়ে তাঁর নাক-কান কেটে দিলে শূর্পনখা ছুটে পালায়। এরপর বহু রাক্ষসরা দল বেঁধে যুদ্ধ করতে আসে। রাক্ষস দূষণ ও খরকে রামপক্ষ হত্যা করেন। শুধু তাই নয়, দণ্ডক বনে যত রাক্ষস জাতি ছিল প্রায় সবই মারা গেল। বেঁচে রইল অকম্পন ও শূর্পণখা। গতিক মন্দ দেখে তাঁরা লঙ্কায় গিয়ে রাজা রাবণকে খবর দেন। তখনি বোনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে সীতাহরণের পরিকল্পনা করেন রাবণ এবং মারীচের শরণাপন্ন হন। রাক্ষসবংশের হয়েও যে মুনিদের মতোই তপস্যা করছে–সে হল মারীচ। রাবণ পুষ্পক রথে চেপে রওনা হল মারীচের সঙ্গে দেখা করার জন্য। মারীচের কাছে এসে রাবণ সমস্ত জানায় তাঁকে। মারীচ বহুদিন তপস্যার পরে মুনিসুলভ ধীর। সে রাবণকে বলে, যা হয়েছে তা দুঃখজনক, কিন্তু এই মানুষ জাতিদের অনেক খবর আমরা এখনও জানি না। রামের কাছে যে কী ধরনের অস্ত্র আছে সেটাও আমাদের জানা নেই। মারীচ নারাজ হলে রাবণ তাঁকে হত্যার ভয় দেখান।

মারীচ প্রথমে একটি স্বর্ণমৃগের রূপ ধরে সীতার সামনে ভ্রমণ করতে থাকলে, সীতা উক্ত স্বর্ণমৃগকে ধরে দেওয়ার জন্য রামের কাছে আবদার করলে, রাম স্বর্ণমৃগের অনুসরণ করে শরাঘাত করেন। এরপর বনের মধ্য থেকে হরবোলা মারীচ রামের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে, “হা লক্ষ্মণ, হা সীতা” বলে বিলাপ করতে লাগলে, সীতা লক্ষ্মণকে রামের সাহায্যের জন্য পাঠালেন। এই অবসরে রাবণ ভিখারির বেশে সীতার সামনে উপস্থিত হয়ে প্রথমে সীতাকে বিভিন্নভাবে ঘরের বাইরে আনার চেষ্টা করলেন। শেষপর্যন্ত কার্যসিদ্ধ না-হওয়ায়, রাবণ জোর করে সীতাকে রথে উঠিয়ে লঙ্কার পথে রওনা হলেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে মারীচ কি সত্যিই ২৪ ক্যারেট সোনার নিরেট হরিণ হয়েছিলেন? সোনা তো ধাতু, ধাতুতে প্রাণসঞ্চার হল কীভাবে? সেটা কি সম্ভব? নাকি চিরাচরিত সোনা-লোভী নারীকেই এ ঘটনার মাধ্যমে প্রতীতী উপস্থাপন করা হয়েছে? মারীচ কেমন মৃগরূপ ধারণ করেছিল সেটা একবার দেখে নিতে পারি। সেইসঙ্গে দেখে নেব স্বর্ণমৃগের বাস্তবতা কতটা। মহাকবি বাল্মীকি ‘স্বর্ণমৃগ’ মারীচ সম্পর্কে কী বলেছেন পণ্ডিত শ্ৰীমনোনীত সেনের ভাষায় দেখব–“তাঁহার শৃঙ্গ উৎকৃষ্ট মণিসদৃশ, মুখ রক্তপদ্ম ও নীলোৎপল-সবর্ণ, বদনমণ্ডল শুক্ল ও কৃষ্ণপ্রভাময়, কর্ণ ইন্দ্রনীল মণিতুল্য ও গ্রীবা কিঞ্চিৎ উন্নত, উদর-বর্ণ ইন্দ্রনীলমণিতুল্য, গাত্রের বর্ণ পদ্মকেশর সদৃশ ও মনোহর চিক্কণ, উভয় পার্শ্বের বর্ণ মধুক পুষ্পসদৃশ, খুর বৈদূর্যমণিতুল্য, জঙ্ঘা ক্ষীণ, সন্ধিস্থল নিমগ্ন এবং পুচ্ছ ইন্দ্রধনুর ন্যায় বিচিত্র বর্ণ ও ঊর্ধ্বে উত্থিত; সেই রাক্ষস ক্ষণকাল-মধ্যে তাদৃশ বিবিধ রত্ন-পরিবৃত অতীব শোভান্বিত এক মৃগ হইল এবং বিবিধ ধাতুসমূহে চিত্রিত সুদৃশ্য সেই মনোহর মৃগরূপ ধারণপূর্বক সেই রম্য বন ও রামের আশ্রম উজ্জ্বল করিয়া বিদেহরাজ-দুহিতা সীতাকে প্রলোভিত করিবার নিমিত্ত আশ্রমের চতুর্দিকে ভ্রমণ করিতে লাগিল।” অতএব কল্পিত হরিণটি স্বর্ণনির্মিত ছিল না, বরং প্রচুর মণিমুক্তখচিত হয়ে নারী-সুলভ সাজুগুজু করেছিলেন মারীচ। এহেন জাগতিক (অলৌকিক নয়) সাজুগুজু করা হরিণীকে দেখে কীভাবে প্রলোভিত হওয়া যায়! কিন্তু সীতাদেবী প্রলোভিত হয়েছেন। এত মণিরত্ন সীতাদেবী জীবনে কখনো চোখে দেখেননি, তা তো নয়। সীতা রাজদুহিতা, তদুপরি রাজবধূ–ভিখিরি তো নয়! বনবাসকালেও তিনি অলংকারসজ্জিতাই ছিলেন। তা ছাড়া বনবাসে আসার সময় আগে উনি হরিণী দেখেননি, এই প্রথমবার দেখলেন–তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। বনবাসে আসার সময় তাঁর অঙ্গেও মহামূল্যবান রত্নখচিত অসংখ্য অলংকার ছিল, অন্তত মারীচকে দর্শন এবং রাবণের অপহরণ পর্যন্ত ছিল। অনার্য মারীচের হরিণে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়াটা অবশ্যই কল্পনাপ্রসূত, অবাস্তব। শব্দকল্পদ্রুমে মৃগ’ প্রসঙ্গে যা লেখা আছে একটু দেখি–মৃগঃ (মৃগয়তে অন্বেষয়তি তৃণাদিকং মৃগ্যতে বা ইতি। মৃগ + ইগুপধত্বাৎ কৰ্ত্তরি চকঃ) পশুমাত্র। (যথা, মনুঃ। ৫৯) অন্বেষণম্। (যথা, সাহিত্যদর্পণে) যাচঞা–ইতি মেদিনী। রামচন্দ্রও লোভী হয়ে পড়লেন এহেন মহামূল্যবান রত্নখচিত হরিণীকে দেখে। আশ্চর্য, স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার হয়ে এই জাগতিক লোভ সংবরণ করতে পারলেন না! এমনকি লক্ষ্মণের সতর্কবার্তাও কানে নিলেন না! যা রাম অনুধাবন করতে পারেননি, তা লক্ষ্মণ পেরেছেন। লক্ষ্মণ শ্রীরামকে বলেছিলেন–হে রঘুনন্দন মহীপতে! ভূতলে ঈদৃশ রত্নচিত্রিত মৃগ নেই। ইহা নিশ্চয়ই মায়ার কার্য, ইহাতে অনুমাত্রও সংশয় নেই–“মৃগো হেবংবিধো রত্ন-বিচিত্রা নাস্তি রাঘব।/জগত্যাং জগতীনাথ মায়ৈষা হি ন সংশয়ঃ।” মহামূল্যবান রত্ন দর্শনে রামও বিহ্বল হয়ে যান! এটা মনুষ্য বৈশিষ্ট্য বটে। তাই বিপদের আভাস পেয়েও রাম হরিণের পিছু নেয়। “অসম্ভবো হি হেমমৃগস্য জন্ম তথাপি রামো লোভে মৃগায় প্রায়ঃসমাপন্নে বিপত্তিকালে ধিয়ো অপি পুংসা মলিনা ভবন্তি।” প্রাবন্ধিক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর ভাষ্য অনুযায়ী–“রাবণের বেশ তপস্বীর মতো, অথচ তিনি সামনা-সামনি সীতার স্তন-জঘনের প্রশংসা করতে থাকলেন–তবু সীতার কোনো সন্দেহ হল না। মারীচের ডাক শুনে যাওয়ার আগে লক্ষ্মণের সঙ্গে সীতার একচোট বচসাও হয়। রাম মায়ামৃগের সন্ধানে যাওয়ার পূর্ববর্তীকালে লক্ষ্মণ মৃগের ছলনা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এবং মারীচের ডাক শুনে সীতাকেও তিনি বুঝিয়েছিলেন যে, বনের মধ্যে রাক্ষসেরা এরকমধারা শব্দ করেই থাকে–রাক্ষসা বাচো ব্যাহরন্তি মহাবনে। লক্ষ্মণের এত সন্দেহ, এত বচসা সত্ত্বেও, তপস্বীর মুখে কুলবতীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বর্ণনা শুনেও সীতার কোনো সন্দেহ হল না কেন? তাতেই বুঝি এই স্বর্ণমৃগের অংশ মূল রামায়ণে ছিল না। যা ছিল, তা সরলা কুলবতীর আত্মকথা–সীতা নিশ্চিন্ত মনে রাবণকে দশরথের কথা, তাঁর কৈকেয়ী-কামিতার কথা সবিস্তারে শুনিয়েছেন। রামের বনবাস, পিতৃসত্য রক্ষার দৃঢ়-প্রতিজ্ঞতা সবই তাঁকে বলেছেন। সবার শেষে রাবণকে যে কথাটা বলে তিনি একটু সবুর করতে বললেন সেই কথাটাই আমাদের সবচেয়ে বিস্মৃত করে। যেখানে এত বলশালী রাম মহাবিপদে পড়েছেন বলে দেওরের সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া করে তাঁকে সাহায্যের জন্য পাঠানো হল, সেখানে কোনো দুশ্চিন্তার ছায়ামাত্র সীতার ভাষায় ফুটে উঠল না। বরঞ্চ তিনি বললেন–এই আর একটুখানি বসুন–সমাশ্বস মুহূর্তং তু”, এই আমার স্বামী এলেন বলে। আমার স্বামী এখনওই অনেক বনজাত খাদ্যদ্রব্য, অনেক রুরু-মৃগ, গোসাপ, শুয়োর–সব মেরে প্রচুর মাংস নিয়ে আসবেন, আপনি এই একটুখানি বসুন–আগমিষ্যতি মে ভর্তা বন্যমাদায় পুষ্কল। রুরূ গোধা বরাহাংশু হত্বদায়ামিষং বহু।… নিহত্য পৃষতঞ্চান্যং মাংসমাদায় রাঘবঃ। ত্বরমানো জনস্থানং সসারাভিমুখং তদা।” এই ঘটনা থেকেও মনে হয় শিকারে বেরিয়ে একটা হরিণ মেরে এবং তারপরে আরও একটা হরিণ মেরে ছুটলেন ঘরের পানে, কারণ সীতা একা আছেন। এইরকম একটা অসংরক্ষিত অবস্থায় সীতাহরণ সম্পন্ন হয়েছে–এর মধ্যে মায়ামৃগ-কল্পনার অবকাশ নেই।”

শূর্পণখা : ভাগবতে এক কুজাকে পাওয়া যায়। এ কুজা অবশ্য কৈকেয়ীর দাসী ‘কুজা মন্থরা নন, ইনি রামায়ণে রাবণের বোন। বস্তুত কুজা ছিলেন দ্বাপর যুগের নারী। কাহিনি বলছে–কৃষ্ণ যখন জগৎ উদ্ধারের জন্য জন্মগ্রহণ করেন, তখন কুজাও মথুরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বয়সকালে কুজা ছিলেন সৈরিষ্ক্রী বা দাসী। ইনি রাজা কংসের সারা শরীরে গন্ধদ্রব্য মাখিয়ে দেওয়ার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কুজা ছিলেন খুবই কুরূপা এক নারী। কৃষ্ণ যখন মথুরায় কংস বধের জন্য আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে কুজার দেখা হয়। একদিন এক শুভক্ষণে হাজার হাজার নারীদের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলেন কুৎসিত কুজা। কৃষ্ণের দৃষ্টি গেল তাঁর দিকে। অমনি ঘটে গেল অলৌকিক ও অদ্ভুত কাণ্ড! কৃষ্ণের দৃষ্টিপাতে কুৎসিত কুজার স্বাভাবিক শরীরসম্পন্না ও পরমাসুন্দরী হয়ে গেলেন। এ ঘটনায় কৃষ্ণের বান্ধব উদ্ধব বিস্ময় প্রকাশ করলেন, জানতে চাইলেন এর রহস্য কী! তখন কৃষ্ণ বলেন–“শোনো উদ্ধব, আমি শুধু শুধু এই নারীর প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিনি। এই নারীর পিছনে একটা বিরাট ইতিহাস আছে৷ ইনি কুজা ত্রেতা যুগে আমি রাম অবতার হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নিই। এ সময় রাবণও জন্ম নেয়। রাবণ নিধনের নিমিত্তেই আমার এই জন্ম। আর কুজা হলেন রাবণের বোন৷ এই কুজার নাম হয় শূর্পণখা। যিনি পঞ্চবটি বনে সীতা ও আমাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। রামকে কামনা করে বসলেন। আমি বিবাহিত বারবার বলা সত্ত্বেও সে নারী কোনোরূপ কর্ণপাত করলেন না। ঈর্ষাকাতর হয়ে সীতার উপর আক্রমণ করতে গেলে লক্ষ্মণ তাঁর নাক-কান দুটোই কেটে দিয়েছিল। শূর্পণখা এমতাবস্থায় স্থান ত্যাগ করে পলায়ণ করলেন এবং দাদা রাবণকে সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। রাবণ ক্রুব্ধ হলেন এবং সীতাকে অপহরণ করেন। এই নারীর কারণেই রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল। রাম-রাবণের যুদ্ধ হলেও আমাকে না-পাওয়ার খেদ শূর্পণখার যায়নি। সে রাম হিসাবে আমাকে না-পাওয়ায় যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়েন এবং পরজন্মেও যাতে রামকে তিনি পান সে কারণে তিনি তপস্যায় গেলেন। অবশেষে তাঁর তপস্যাকে সম্মান। দিতে আমি কুজার গৃহে গেলাম।” শূর্পণখার সঙ্গে এক যুবকের ভালোবাসা হয়েছিল, তাঁরা পালিয়ে বিবাহ করেছিল। কারণ সেই রাক্ষস রাবণের সমকক্ষ ছিলেন না, ফলে উভয়ের প্রকাশ্যে বিবাহ হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এরপর রাবণ তাঁদের খুঁজে বোনের স্বামীকে হত্যা করে। শূর্পণখা প্রতিশোধের বীজ বুকে নিয়ে বিধবা হয়ে লঙ্কায় থাকতে লাগলেন।

ভাগবতে কুব্জা চরিত্রের বর্ণনা হয়েছে এভাবে–কুব্জা ছিলেন ‘কৃষ্ণ কামতপ্তা’। তিনি কৃষ্ণের কাছ থেকে কেবল কামই চেয়েছিলেন। কৃষ্ণ যখন কুব্জার গৃহে গিয়েছিলেন, সেই সময় কুব্জার গৃহ ছিল অশ্লীল ছবিতে পরিপূর্ণ এবং বিভিন্ন কামোদ্দীপক দ্রব্যে ভরপুর ছিল। ত্রেতাযুগের সময়কাল ছিল ১২,৯৬,০০০ এবং দ্বাপরযুগের সময়কাল ৮,৬৪,০০০–মাঝে ৪,৩২,০০ বছরের ব্যবধান। যদিও কৃষ্ণেরও মৃত্যু (দ্রষ্টব্য মহাভারত) হয়েছে, সুতরাং কৃষ্ণের আয়ুও নির্দিষ্ট৷ তবে ত্রেতাযুগের কুব্জা দ্বাপরে পাওয়া যায় কীভাবে? তবে কি জন্মান্তরবাদ তত্ত্বে পুনর্জন্মের প্রতিষ্ঠা! মনুসংহিতায় বলা হয়েছে সত্যযুগে মানুষের আয়ু ছিল ৪০০ বছর। পরবর্তী তিনযুগে ১০০ বছর করে পরমায়ু কমে যায়। সেই হিসাবে ত্রেতাযুগে ৩০০, দ্বাপরযুগে ২০০ এবং কলিযুগে ১০০ বছর মানুষের পরমায়ু হয়।

বিভিন্ন রামায়ণে শূর্পণখার নানারকম মুখরোচক বর্ণিত হয়েছে। আসল ঘটনা কী, সেটা কী কতটা গোপন রাখা হয়েছে? প্রকৃত ঘটনা হল–শূর্পণখা আসলে আর্যদেবতাদের টোপ। এ টোপ কোথায় ফেলা হয়েছিল? রাবণকে সিংহাসন থেকে অপসারণ করার জন্য শূর্পণখাকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রের পুরোধায় ছিলেন দেবমন্ত্রী ব্ৰহ্মা। বহুদিন ধরে লঙ্কায় রাবণের রাজসভার অন্দরমহলে বিদ্রোহ দানা বাঁধছিল। একটা গোষ্ঠী চাইছিল লঙ্কার সিংহাসন থেকে রাবণকে হঠিয়ে বিভীষণকে রাজা করতে। সুযোগ খুঁজছিলেন রাবণ-বিরোধীরা। শূর্পণখাও দাদার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসায় ফুসছিলেন, মনের মধ্যে আগুন জ্বলছিল দাউদাউ করে। ফুসছিলেন, কারণ রাবণ তাঁর দিগ্বিজয় পর্বে শূর্পণখার শ্বশুরবাড়ি কালকেয় রাক্ষসজাতির দেশ অতর্কিতে আক্রমণ করলে শূর্পণখার স্বামীর ভাইয়ের মৃত্যু হয়। সেই মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে শূর্পণখার স্বামী বিদ্যুৎজিহ্ব রাবণের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলে রাবণের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়। পতিব্রতা শূর্পণখা স্বামীর এই মৃত্যুর জন্য দাদা রাবণকেই দায়ী করেন। অতএব রাবণ-বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলালেন শূর্পণখা। রামের ছায়াসঙ্গী আর্যদেবতারাও কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে শূর্পণখার শরণাপন্ন হলেন এবং সফলও হলেন। সুপরিকল্পিতভাবে শূর্পণখাকে শিখিয়ে পড়িয়ে যেমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল শূর্পণখা তেমন-তেমনভাবেই কাজগুলো করেছিলেন। শুধু শূর্পণখাই নয়, আর্যদেবতাদের দ্বারা এক পদস্থ সেনাপ্রধান অকম্পনকেও কবজা করা সম্ভব হয়েছিল।

শূর্পণখা প্রথমেই নিজেকে নিজেই বিধ্বস্ত করে খর রাক্ষসের কাছে রামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, রাম তাঁকে ব্যাপক অপমান করেছেন এবং খরকে উপর্যুপরি উত্তেজিত করে পঞ্চবটিতে পাঠিয়ে দেন। শূর্পণখা স্বয়ং খরকে পথ দেখিয়ে পঞ্চবটিতে নিয়ে যান এবং আর্যদেবতাদের সঙ্গে সংঘর্ষে খরের মৃত্যু হয়। খর রাক্ষসের দুর্ভেদ্য দুর্গ শূর্পণখার কৃতিত্বে আর্যদেবতাদের হস্তগত হয়ে গেল। শূর্পণখার কোনো ক্ষতি হল না। কারণ শূর্পণখার এখনও আসল কাজই হয়নি।

এরপর যাতে সীতাকে অপহরণ করা হয়, সে ব্যাপারে রাবণকে প্ররোচনা দিতে থাকেন শূর্পণখা ও অকম্পন। শূর্পণখা যথাসম্ভব নিকৃষ্টভাবে রাবণকে প্ররোচনা দিতে থাকলেন, শত্রুর প্রশংসা করতে থাকলেন–“শোনা গেছে সীতার সৌন্দর্যবর্ণনা, যেমন সীতার নেত্র আকর্ণ আয়ত। মুখ পূর্ণচন্দ্র সদৃশ এবং বর্ণ তপ্ত কাঞ্চনের ন্যায়। সে সুনাসা এবং সুরূপা। উহার কটিদেশ ক্ষীণ, নিতম্ব নিবিড় এবং স্তনদ্বয় স্কুল ও উচ্চ… এইরূপ নারী আমি পৃথিবীতে আর কখনো দেখি নাই।… রাবণ! সেই সুশীলা তোমারই যোগ্য … আমি তোমারই জন্য উহাকে আনিবার উদযোগে ছিলাম।“ আর এই মহান কাজটি করতে গিয়েই রাম তাঁকে প্রচণ্ড অপমান করেছেন। অতএব কেল্লা ফতে!

শূর্পণখা আর অকম্পনের প্ররোচনার ফাঁদে পা দিলেন রাবণ এবং প্রচণ্ড ক্ষুবধ হলেন। রাবণ অকম্পনের কাছে জানতে চাইলেন–“অকম্পন! রাম কি ইন্দ্রাদি দেবগণের সঙ্গে জনস্থানে আসিয়াছে?” অকম্পন স্বীকার করলেন না যে, রাম নয়, পঞ্চবটিতে আর্যদেবতারাই শেষ কথা–রাম উপলক্ষ্যমাত্র। বললেন–“উহার (রামের) সহিত যে সুরগণ (দেবতারা) আইসে নাই ইহা নিশ্চয় জানিবেন।”

অনেক কবি শূর্পণখাকে কুৎসিত কিম্ভুতকিমাকার করে চিত্রায়িত করেছেন। বাল্মীকির রামায়ণে শূর্পণখা বিকৃতদর্শনা নন, তিনি প্রকৃতই অপরূপ সুন্দরী। রক্তোৎপলবর্ণ কখনোই কুরূপা বোঝায় না। যদি কুরূপাই হতেন, তাহলে তাঁকে বিরূপা করার আদেশ দিতেন না লক্ষ্মণকে। বিরূপা হলে কীভাবে আবার বিরূপা করা সম্ভব! বাল্মীকি ছাড়া অন্যান্য কবিয়া রাক্ষস মানেই বোঝাতে চেয়েছেন বিশালাকৃতির শরীর, কুলোর মতো কান, মূলোর মতো দাঁত, আলকাতরা-কালো গায়ের রং, মানুষখেকো ইত্যাদি। রাক্ষস মানে অদ্ভুত কিছু নয়–দৈত্য, নাগ, বানর, ভল্লুক, কুকুর জাতীয় ভিন্ন ভিন্ন মানবগোষ্ঠীমাত্র। মনুষ্যেতর অপর কোনো জীব তারা ছিলেন না। শ্রীকৃষ্ণের জ্ঞাতিগোষ্ঠী যদুবংশের এক শাখা কুকুর জাতি ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ বিয়েই করেছিলেন ভল্লুক জাতির মেয়ে জাম্ববতাঁকে। শাম্ব কৃষ্ণ-জাম্ববতীরই সন্তান।

কুন্তী, তুলসী, অহল্যাদের মতো শূর্পনখা পরপুরুষে আসক্ত ও দ্বিচারিণী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ প্রেমিকা। তিনি রামকে বলছেন ‘আমাকে ভোগ করো, একথা অতি কষ্টকল্পনা, অসভ্য কবিরাই এমন বর্ণনা লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হবেন। স্বামী বিদ্যুৎজিহ্বার মৃত্যুর পর রাবণ বহু চেষ্টা করেও বোন শূর্পণখার বিয়ে দিতে পারেননি। খর আর দূষণ তাঁকে নিয়ে দেশে দেশে ঘুরেছেন, কিন্তু কোনো পুরুষকেই তিনি পছন্দ করে উঠতে পারেননি। কারণ তাঁর স্মৃতি আর প্রেমে স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের জায়গা নেই যে! এমন এক পতিব্রতার চরিত্রহনন করে একমাত্র বিভিন্ন নোংরা যৌন আবেদনপূর্ণ রচনার কথকতাতেই শূর্পণখা চরিত্রটি কুশ্রী কামুকি চরিত্রে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আসলে এক শ্রেণির অর্বাচীন কবি বাল্মীকির রামায়ণকে বিকৃতি করে রামচন্দ্রকে ‘দেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা এবং শূর্পণখার সঙ্গে দেবতাদের ষড়যন্ত্রের ইতিহাসটি চাপা দেওয়ার সার্থক চেষ্টা। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘দ্বীপময় ভারত’ গ্রন্থে লিখেছেন–প্ৰাম্বানানের মন্দিরের রামকথা দেখা যায় .. শূর্পণখার একসঙ্গে আট আটটি রাক্ষস স্বামীর কল্পনা (প্রত্যেকেরই মুখ মোষ এবং শুয়োরের ভাব মিলিয়ে তৈরি করা মুখোশে ঢাকা–এই মহিষশৃঙ্গ শুয়োরের আটটি রাক্ষস যেন বর্বরতা ও মূর্খতার প্রতীক)–শূর্পণখার বিরহে আটজন স্বামীর নাচগানেরমাধ্যমে চিত্তের অধৈর্য প্রকাশ এবং দণ্ডকারণ্য থেকে শূর্পণখার ফিরে আসার যুগপৎ আট স্বামীর সোল্লাস নৃত্য–অদ্ভুত ও বীভৎস মিশ্র হাস্যরসের এক অনপ্রেক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টির দ্বারা এইভাবে পল্লবিত রামকথা যবদ্বীপে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

অহল্যা : রামায়ণে অন্তর্ভুক্ত অহল্যার কাহিনিটি বেশ জনপ্রিয়। ‘ভগবান’ রামের পাদস্পর্শে ‘অভিশপ্ত’ অহল্যার পাষাণমুক্তির জন্যই হয়তো। ভক্তিরসে পরিপূর্ণ।

বাল্মীকির রামায়ণে মহর্ষি গৌতম স্নানে গেছেন। কিন্তু কে জানে কী হয়েছিল অহল্যার, তিনি শৃঙ্গারোচিত প্রসাধনে চঞ্চলা হৃদয়ে বসেছিলেন–“সঙ্গমোচিতরূপ-প্রসাধনবতি”। পর্ণশালায় স্বামী গৌতম নেই, কামজর্জরিতা অহল্যা একা। এই অবসরে ইন্দ্রও চলে এসেছেন তাঁর ঘরে, কামনিবৃত্তিতাৰ্থে। কামমোচনের কোনো সময় হয় না। মানুষের কামমোচনের সময় সব ঋতুতে সবসময়–“সঙ্গমং তু অহমিচ্ছামি ত্বয়া সহ সুমধ্যমে”। অহল্যা পূর্বেই ইন্দ্রকে চিনতেন, ইন্দ্রও অহল্যাকে চিনতেন। বাল্মীকি এ সত্য লুকাননি। অহল্যাও জানতেন ইন্দ্র তাঁকে বহুকাল ধরে তাঁর শরীরী সঙ্গ চান–“বহুকালম্ অভিলাষশ্রবণাৎ”। ইন্দ্রের দর্শনমাত্রই অহল্যার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, মিলিত হলেন ইন্দ্রের শরীরে–“মতিং চকার দুর্মেধা দেবরাজকুতূহলাৎ”। ইন্দ্রের সঙ্গে যৌনমিলনে তীব্র কামেচ্ছা পূর্ণ হওয়ার পর তৃপ্ত অহল্যা বললেন–“আমি আজ কৃতার্থ হয়েছি, সুরশ্রেষ্ঠ। এখন আমি এবং আপনি এই নিন্দাপঙ্ক থেকে উদ্ধার পাই, সেইজন্য এই মুহূর্তে আপনি পলায়ন করুন–“কৃতার্থাস্মি সুরশ্রেষ্ঠ গচ্ছ শীঘ্রমিতঃ প্রভো”। না, কামরসিক ইন্দ্র পালাতে পারেননি। গৌতমের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন। কপালে ছিল হেনস্থা হওয়ার! ইন্দ্র খুব করে হেনস্থা হলেন গৌতমের কাছে। শুধু হেনস্থাই নয়, গৌতমের অভিশাপও খেলেন–“বিফলঃ ত্বং ভবিষ্যসি”। ইন্দ্রের অণ্ডকোষ খসে পড়ল মাটিতে। খসে পড়ল, নাকি শাস্তিস্বরূপ কেটে নেওয়া হল ইন্দ্রের অণ্ডকোষ! কিন্তু এই ধরনের শাস্তি? অণ্ডকোষ কেটে নিলে সে ব্যক্তি নিশ্চয় সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা হারাবে, কিন্তু কারোর যৌনক্ষমতা হারাবে না। সে যাই হোক, প্রাদেশিক কবিরা ইন্দ্রের শরীর থেকে যোনিচিহ্ন মুছে দিয়ে ‘সহস্রলোচন’ করে দিলেও, বাল্মীকি ইন্দ্রের অণ্ডশূন্য স্থানে মেষের অণ্ডকোষ শল্য করে দিলেন, ইন্দ্রের নতুন নাম হল ‘মেষবৃষণ’।

অহল্যাকেও তিনি অভিশাপ দেন, তাঁকে বহু সহস্র বছর বায়ুভক্ষা, নিরাহারা, ভস্মশায়িনী, তপন্তী ও অদৃশ্যা হয়ে থাকতে হবে। রাম তাঁকে আতিথ্য দিলে তবেই তিনি পবিত্র হবেন ও কামরহিত হয়ে স্বামীর সঙ্গে পুনরায় মিলিত হবেন। এরপর গৌতম পর্বতের চূড়ায় গিয়ে তপস্যায় নিমগ্ন হন। মিথিলার পথে এই উপাখ্যান শুনতে শুনতে রাম ও লক্ষ্মণ গৌতম মুনির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন, যেখানে অহল্যা পাষাণ হয়ে অবস্থান করছেন। রামের স্পর্শে অহল্যার শাপমুক্তি ঘটে। তিনি ভস্মশয্যা থেকে উঠে এসে অতিথি সৎকার করে। রাম ও লক্ষ্মণও তাঁর পদধূলি নেন। দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি ঘটান ও অহল্যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। গৌতম ঋষি ফিরে আসেন এবং রামকে পুজো করে স্ত্রীকে নিয়ে তপস্যা করতে চলে যান।

শাস্ত্র ঘেঁটে অহল্যার নানাবিধ কাহিনি পাই। অহল্যা ব্রহ্মার মানস কন্যা ও গৌতম ঋষির স্ত্রী ও শতানন্দের মা। প্রজা সৃষ্টির পর সেই প্রজাদের বিশিষ্ট প্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্রহ্মা এক কন্যা সৃষ্টি করেন। অদ্বিতীয়া সুন্দরী ও সত্যপরায়ণা বলে ব্রহ্মা তাঁর নাম রাখেন অহল্যা। ব্রহ্মা তাঁকে গৌতম ঋষির কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন। ইন্দ্র অহল্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ের কথা ভাবেন। কয়েক বছর বাদে গৌতম অহল্যাকে ব্রহ্মার কাছে ফিরিয়ে দেন। এর ফলে ব্রহ্মা খুশি হয়ে অহল্যার সঙ্গে গৌতমের বিয়ে দেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্র অহল্যাকে ধর্ষণ করেছিলেন। এই ধর্ষণের অপরাধে গৌতম ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন। বলেন যে, যুদ্ধে তাঁকেও ধর্ষিত হতে হবে এবং যে ধর্ষণ প্রথার সূচনা জগতে ইন্দ্র করলেন তাঁর অর্ধেক পাপ তাঁকেই বহন করতে হবে। শুধু তাই-ই নয়, জগতে দেবরাজের স্থানও স্থাবর হবে না। এক্কেরে হাতে হাতে ফল, ইন্দ্রজিৎ ইন্দ্রকে যুদ্ধে পরাস্ত করে লঙ্কায় বন্দি করে আনেন, সেইসঙ্গে নির্যাতনও করেন। গৌতম অহল্যাকেও ছাড়েননি। তাঁকেও অভিশাপ দেন–“মমাশ্রমা সমীপতঃ যিনিধ্বংস” এবং অহল্যা অপেক্ষাও অধিক সুন্দরী পৃথিবীতে তাঁর রূপের গৌরব খর্ব করতে জন্মগ্রহণ করবেন। অহল্যা স্বামীকে বোঝান যে তিনি নির্দোষ, ইন্দ্ৰ গৌতমের রূপ ধারণ করে তাঁকে ধর্ষণ করেছেন। গৌতম তখন শান্ত হন। অভিশাপ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না, মুক্তির পথ বাতলে দেওয়া যায়। তিনি অহল্যাকে বলেন, রামের দর্শনে তিনি পবিত্র হবেন।

‘কথাসরিৎসাগর’-এ অহল্যার সঙ্গে ছুপেছুপে যৌনমিলন করে নিলেও ইন্দ্র ধরা পড়েননি। তিনি মার্জার বা বিড়ালের রূপ ধারণ করে স্থান ত্যাগ করেন। গৌতম স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন–“মার্জার চলে গেছে”। মার্জার’ কথাটি দ্ব্যর্থক–এক অর্থে ‘মৎ-জার’ অর্থাৎ আমার নিষিদ্ধ প্রেমিক, অন্য অর্থে বিড়াল। অন্য একটি মতে, গৌতমের অভিশাপে অহল্যা পাথর হয়ে যান। রামচন্দ্রের পাদস্পর্শে তাঁর মুক্তি ঘটে। আর-এক কাহিনিতে গৌতমের শাপে ইন্দ্রে সারা দেহ যোনিচিহ্নে ভরে যায়। অপর একটি মতে, অহল্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্র মোরগের বেশে মধ্যরাতে আশ্রমে উপস্থিত হন ও ডেকে ওঠেন। ভোর হয়েছে মনে করে ঋষি স্নানে চলে যান। ইন্দ্র গৌতমের ছদ্মবেশে ফিরে এসে অহল্যাকে সম্ভোগ করেন। আবার অন্য একটি মতে জানা যায়, শাপমোচনের পর গৌতম পুত্র শতানন্দকে নিয়ে আশ্রমে ফিরে এসেছিলেন এবং একসঙ্গে বসবাসও শুরু করেন। পদ্মপুরাণেও রামের পাদস্পর্শে অহল্যার মুক্তির কথা আছে।

বালী ও সুগ্রীবের উপাখ্যানে জানা যায়–গরুড়ের দাদা অরুণের দুই পুত্র অহল্যার কাছে পালিত হতে থাকে। গৌতম এঁদের সহ্য করতে না-পেরে শাপ দিয়ে বানরে পরিণত করেন। এরপর ইন্দ্র এঁদের সন্ধানে এলে অহল্যা তাঁকে গৌতমের শাপের কথা জানান। দেবরাজ ছেলেদুটিকে খুঁজে আনেন। বড়োটির লেজ বড়ো বলে নাম হয় বালী ও ছোটোটির গ্রীবা সুন্দর বলে নাম হয় সুগ্রীব। অহল্যা যখন অপ্সরা, তখন আবার গল্পও বদলে যায়–রাজা ইন্দ্রদ্যমের স্ত্রী হলেন অহল্যা। তিনি ছিলেন অপ্সরা, অপ্সরারা হলেন স্বর্গের বেশ্যা। অহল্যার উপাখ্যান শুনে অপ্সরা অহল্যা ইন্দ্র নামে এক অসুরের প্রতি আকৃষ্ট হলে রাজা তাঁকে বিতাড়িত করেন। মহাকবি কালিদাস লিখেছেন–কিছুক্ষণের জন্য অহল্যা যেন ইন্দ্রের পত্নীপদ লাভ করেছিলেন–“বাসবক্ষণকলত্রতাং যযৌ”। অতএব যা হয়েছে তার কোনোকিছুই অহল্যার অমতে হয়নি। তাই প্রণয়ীকে এবং প্রণয়ীর মানসম্ভ্রম বাঁচাতে অহল্যা ইন্দ্রকে পালাতে বললেন–“কৃতার্থাস্মি সুরশ্রেষ্ঠ গচ্ছ শীঘ্রমিতঃ প্রভৈ”।

মীমাংসা দার্শনিক কুমারিলভট্টের মতে, অহল্যার উপাখ্যানটি হল একটি রূপক। ইন্দ্র সূর্য ও অহল্যা রাত্রি বা অন্ধকারের প্রতীক। অহল্যার ধর্ষণ অন্ধকার জয়ের প্রতীক। অন্য মতে, অহল্যা উষার প্রতীক। দিনে ইন্দ্ররূপী সূর্যের উদয় হলে অহল্যারূপী উষা অসূর্যম্পশ্যা হয়। আবার একটি মতে, অহল্যা অনুর্বর জমির প্রতীক।

পণ্ডিত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী অহল্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন–“মূল রামায়ণে অহল্যা গৌতমের শাপে পাষাণী হননি, মুনির কোপাগ্নিতে এবং অনুতাপে তিনি হয়েছিলেন ভস্মশায়িনী, সকলের অদৃশ্যা–বাতভক্ষ্যা নিরাহারা তপন্তী ভস্মশায়িনী। অদৃশ্যা সর্বভূতানাং আশ্রমে অস্মিন বসিষ্যসি। রাম আশ্রমে আসামাত্রই অদৃশ্যা অহল্যা তপঃপ্রভায় উদ্ভাসিতা হয়ে উঠলেন, অথচ প্রাদেশিক রামায়ণগুলির সর্বত্রই অহল্যা হয়ে গেছেন পাষাণী, এবং এর উৎস বোধহয় মহাকবি কালিদাস, যিনি প্রথম বলেছিলেন, “গৌতমবধূঃ শিলাময়ী”। অহল্যার কাহিনি নিয়ে মূল। রামায়ণের সঙ্গে দেশজ রামায়ণগুলির পার্থক্য বিস্তর।”

বস্তুত অহল্যার কোনো পাষাণমূর্তি রামচন্দ্র দেখেননি। অহল্যার পাষাণীরূপের কথা গল্পমাত্র। সম্ভবত রামের ভাবমূর্তি ঐশ্বরিক করতেই এ ধরনের গল্পের অবতারণ করা। বাল্মীকির রামায়ণে অহল্যার পাষাণী মূর্তিতে পরিণতি লাভ ও রামচন্দ্রের পাদস্পর্শে পুনর্জীবন অর্জনের কোনো গল্পই নেই।

মহিরাবণ : মহিরাবণ, রামায়ণে মহিরাবণ নামে একটি চরিত্রের সন্ধান পাই। তবে মহিরাবণ চরিত্রটি বাল্মীকি সৃষ্টি করেননি। তাঁকে পাওয়া যায় কৃত্তিবাসের রামায়ণে। কৃত্তিবাস বলেছেন–মহিরাবণ রাবণের পুত্র ছিলেন। তাঁর নয়টি মাথা ছিল। তিনি শক্ৰধনু নামের এক গন্ধর্ব দেবসভায় নৃত্য করার সময় এক অপ্সরাকে দর্শন করে মুগ্ধ হয় ও তালভঙ্গ করে। ফলে ব্রহ্মা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে রাক্ষস রূপে পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার অভিশাপ দেন। রাবণ বলির কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফেরার সময় পথের মাঝে গৌতমের স্ত্রী অহল্যাকে দেখে এমনই কামমোহিত হন যে, সেখানেই তাঁর বীর্যপাত (এটা লক্ষণীয়, সেযুগের দেবতা-মুনি-ঋষিদের যখন-তখন গলগল করে সমুদ্র-প্রমাণ বীর্যপাত হয়ে যেত। সেই বীর্য ধারণ করার স্থান খুঁজতেই সংকট উপস্থিত হত। জন্ম নিত জারজ সন্তান। উল্টোদিকে রাজা বা ক্ষত্রিয়দের অবস্থা খুবই করুণ। তাঁদের বীর্যের খবর পাওয়া যায় না। সন্তানের পিতা হতেও অপারগ।) হয়ে যায়। সেই বীর্যে অভিশপ্ত গন্ধর্ব শক্রধনু জন্ম নেন। পৃথিবী থেকে জন্ম নেওয়ায় নাম হয় মহিরাবণ। রাবণ মহিরাবণকে লঙ্কায় এনে তাঁকে মন্দোদরীকে প্রতিপালন করতে দেন। পরে রাবণ ইন্দ্রজিতের সহায়তায় বলিকে পরাজিত করে পাতালের অন্তর্গত কাঞ্চনা নগরী অধিকার করে মহিরাবণকে তাঁর রাজা করেন। মহিরাবণ পিতা রাবণের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন তাঁকে যে-কোনো বিপদে স্মরণ করলেই উপস্থিত হবেন। মহিরাবণ নিজের রাজধানীতে উগ্রতারার পুজো করতেন। তাঁরই বরে মহিরাবণ মায়াবিদ্যায় অর্জন করেন। মানুষ ও বানর ব্যতীত কারও হাতে তাঁর মৃত্যু হবে না–এমনই বর পান। মহিরাবণ।

গন্ধমাদন পর্বত থেকে প্রাপ্ত ঔষধি গুণে সবাই পুনর্জীবিত হলে রাবণ তাঁর পুত্র মহিরাবণকে ডাকেন। মহিরাবণকে সব ঘটনা বিস্তারিত বললে মহিরাবণ রাম ও লক্ষ্মণকে পাতালে নিয়ে গিয়ে হত্যা করবে বলে কথা দিলেন। এসময় বিভীষণ পাখির রূপ ধরে সব কথা শুনে রামকে তা জানিয়ে দেন। বিভীষণের পরামর্শে একটি গড় নির্মিত হয়। তার মাঝে রাম ও লক্ষ্মণকে রেখে চারিদিকে পাহারার ব্যবস্থা করলেন। মহিরাবণ বিভীষণের রূপ ধরে সবাইকে মায়াগ্রস্ত করে গড়ে প্রবেশ করেন এবং সুড়ঙ্গ পথে তাঁদের পাতালে নিয়ে যান। বিভীষণ এই সময় সেই স্থানে ছিলেন না। তিনি ফিরে এলে সবাই খুব অবাক হয়ে যায়। কারণ সবাই তাঁকে এইমাত্র গড়ে প্রবেশ করতে দেখেছেন। তাঁরা সবাই গড়ে গিয়ে দেখেন রাম ও লক্ষ্মণ সেখানে নেই। জাম্ববান এক সুড়ঙ্গ লক্ষ করেন। হনুমান সেই সুড়ঙ্গপথে গিয়ে এক বৃদ্ধার কাছে জানতে পারেন দুই সুদর্শন যুবককে পাতালে আনা হয়েছে, যাঁদের দেবী মহামায়ার কাছে বলি দেওয়া হবে। হনুমান মাছির রূপ ধরে কারাবন্দি রাম ও লক্ষ্মণের কাছে গেলেন। অতঃপর নিজের আসল রূপে তাঁদের অভয় দিলেন। পুনর্বার হনুমান মাছির রূপ। ধরে প্রাসাদে স্থাপিত দেবীর কানের কাছে বসে তাঁর অভিমত জানলেন। দেবীও মহিরাবণের বিনাশ চান। হনুমান ফিরে এসে রাম ও লক্ষ্মণকে বললেন মহিরাবণ যখন তাঁদের দেবীকে প্রণাম করতে বলবে তাঁরা যেন বলেন আমরা প্রণাম জানি না। এরপর মহিরাবণ দুই ভাইকে বলি দেওয়ার জন্য মন্দিরে নিয়ে চললেন। তিনি তাঁদের দেবীকে প্রণাম করতে বললেন, কিন্তু তাঁরা হনুমানের নির্দেশমতো কথা বললেন। মহিরাবণ তখন ভূমিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম কীভাবে করে তা দেখাতে লাগলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে হনুমান নিজের রূপ ধরে দেবীর খড়া দিয়ে তাঁর মস্তক দ্বিখণ্ডিত করলেন। অত্যন্ত অন্যায়ভাবে হত্যা করা হল মহিরাবণকে। এমন হত্যা কোনো মাহাত্ম থাকে না হনুমানের, রাম-লক্ষ্মণেরও। রাম-লক্ষ্মণ যুদ্ধের মাধ্যমে মহিরাবণকে হত্যা না-করে কেন চালাকির আশ্রয় নিলেন? কেন নিজেরা হত্যাটা না-করে হনুমানকে দিয়ে করালেন? হনুমানের পিছন দিক থেকে মহিরাবণকে হত্যাই রামদের বাঁচানো গেল, বিনা যুদ্ধেই। আবারও নৈতিকভাবে পরাজিত রাম, বীরধর্মচ্যুত। না-হলে সবই ঠিকঠাক ছিল, সেদিনই রাম-লক্ষ্মণ নিকেশ হয়ে যেত নিশ্চিত।

উপেক্ষিত হয়েছেন লক্ষ্মণের স্ত্রী ঊর্মিলা, ভরতের স্ত্রী মাণ্ডবী এবং শত্রুঘ্নর স্ত্রী শ্রুতকীর্তিও। ঊর্মিলা ছিলেন সীতার বোন, জনকরাজার কন্যা। কুশধ্বজের দুই কন্যা মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তির সঙ্গে যথাক্রমে ভরত ও শত্রুঘ্নের বিবাহ হয়। স্বয়ং লক্ষ্মণ রামের সঙ্গে ১৪ বছর বনবাসকালে একবারের জন্যেও স্মরণ করেননি। মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তিকে তো বিবাহ অনুষ্ঠানে ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায়নি৷ চরিত্র সৃষ্টি করেও পরিণতি প্রাপ্ত হল না কেন? সেই উত্তর কবি কোথাও দেননি। আসলে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি হয়তো। রামকে নিয়েই কবির সমগ্র চিন্তা এবং ব্যস্ততা। তাই রামের মাথার উপরই সার্চ লাইট, তাই সর্বত্র সমানভাবে আলোকপাত করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলা যায়। অন্য কবিরাও বাল্মীকির পথেই নিরাপদে হেঁটেছেন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ রচনায় লিখেছেন–“কবিগুরু ইহার প্রতি অনেক অবিচার করিয়াছেন, কিন্তু দৈবক্রমে ইহার নাম যে মাণ্ডবী অথবা শ্রুতকীর্তি রাখেন নাই সে একটা বিশেষ সৌভাগ্য। মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তি সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না, জানিবার কৌতূহলও রাখি না। ঊর্মিলাকে কেবল আমরা দেখিলাম বধূবেশে, বিদেহনগরীর বিবাহসভায়। তার পরে যখন হইতে সে রঘুরাজকুলের সুবিপুল অন্তঃপুরের মধ্যে প্রবেশ করিল তখন হইতে আর তাহাকে একদিনও দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। সেই তাহার বিবাহসভার বধূবেশের ছবিটিই মনে রহিয়া গেল। ঊর্মিলা চিরবধূ-নির্বাকুণ্ঠিতা নিঃশব্দচারিণী। ভবভূতির কাব্যেও তাহার সেই ছবিটুকুই মুহূর্তের জন্য প্রকাশিত হইয়াছিল-সীতা কেবল সস্নেহকৌতুকে একটিবার মাত্র তাহার উপরে তর্জনী রাখিয়া দেবরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বৎস, ইনি কে?’ লক্ষ্মণ লজ্জিতহাস্যে মনে মনে কহিলেন, “ওহহ, ঊর্মিলার কথা আর‍্যা জিজ্ঞাসা করিতেছেন।’ এই বলিয়া তৎক্ষণাৎ লজ্জায় সে ছবি ঢাকিয়া ফেলিলেন; তাহার পর রামচরিত্রের এত বিচিত্র সুখ-দুঃখ-চিত্ৰশ্রেণীর মধ্যে আর একটিবারও কাহারো কৌতূহল-অঙ্গুলি এই ছবিটির উপরে পড়িল না। সে তো কেবল বধূ ঊর্মিলা-মাত্র।”

রামায়ণে রামের মতো যেমন স্বামী আছেন, তেমনই লক্ষ্মণের মতো স্বামীও আছেন। সীতার মতো যেমন স্ত্রী আছেন, তেমনই ঊর্মিলা-মাণ্ডবী-শ্রুতকীর্তিদের মতো স্ত্রীও আছেন। কৌশল্যা-কৈকেয়ী-মন্দোদরী-সরমার মতো স্ত্রী বা মায়েরাও আছেন। বিভীষণের মতো ভাই যেমন আছেন, তেমনই লক্ষ্মণের মতো ভাইও আছেন। দশরথের মতো পিতা আছেন, রামের মতোও পিতা আছেন। কোনটা ধর্ম? কোনটা অধর্ম? কার ধর্ম অনুসরণযোগ্য?

মহাভারতে বহু জায়গায় রামায়ণের চরিত্র, রামায়ণের পুনরুল্লেখ হয়েছে। রামায়ণের কাছে মহাভারত ঋণী হয়ে আছে। কেবল উপাখ্যান, চরিত্র, ধর্মনীতিই নয়–মহাভারতের শ্লোকের সঙ্গে রামায়ণের বহু শ্লোক হুবহু মিলে যায়। বহু জায়গায় মহাভারতের বহু চরিত্র রামায়ণকে রামায়ণে আদর্শ চরিত্রগুলিকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। মহাভারতের বন পর্ব, দ্রোণ পর্ব, শান্তি পর্বে রামোপাখ্যানের উল্লেখ আছে। রামায়ণ গ্রন্থটি সামনে রেখে মহাভারত পাঠ করলে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝা যায় কেবল গল্পগুলিই নেওয়া হয়নি–রামায়ণে শ্লোক, শ্লোকাংশ, শ্লোকার্ধ সবই নেওয়া হয়েছে। এমনকি বেশকিছু চরিত্রও যেমন রামায়ণে আছে, মহাভারতেও পেয়েছি। মহাভারতের বনপর্বে রামের উপাখ্যানের বক্তা মহর্ষি মার্কণ্ডেয়৷ এই বনপর্বে মোট আঠারোটি অধ্যায়ে রাম বিষয়ক উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। রাবণ প্রমুখ রাক্ষস জাতির জন্ম ও তপস্যার কাহিনি রামায়ণে উত্তরকাণ্ডেই বর্ণিত হয়েছে, যা প্রক্ষিপ্ত হিসাবে আলোচিত। কিন্তু মহর্ষি মার্কণ্ডেয় সেই কাহিনি মহাভারতের বর্ণনা করেছেন। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে উল্লিখিত রাক্ষস প্রমুখদের বিষয়ে আলোচিত হলেও, আদিকাণ্ডের অশ্বমেধ যজ্ঞ, দশরথের পুত্রলাভ, পুত্রেষ্টি যাগযজ্ঞ, তাড়কা হত্যা, রামের হরধনু ভঙ্গ, সীতার সঙ্গে বিবাহ, অহল্যার পাষাণমুক্তির উপাখ্যানের মতো জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি মহাভারতে বর্ণিত হয়নি। এই উপাখ্যানে যেমন অনেক গৌণ বিষয় বাদ পড়েছে, তেমনই উভয়ের ঘটনামূলক অনৈক্যও লক্ষ করা যায়। সেই রামোপাখ্যানে নতুন নতুন চরিত্রও সংযোজিত দেখা যায়। রামায়ণের আদিকাণ্ড কি তবে মহাভারত রচনার পর সংযোজিত হয়েছে!! তাই-বা বলি কী করে! দণ্ডকারণ্যে বিরাধ হত্যা দিয়ে রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডের শুরু হয়েছে, সেই কাহিনিও মহাভারতে আসেনি–অথচ এ কাহিনিতেই সীতা প্রথম পরপুরুষ দ্বারা নিগৃহীতা হন, লাঞ্ছিত হন। শরভঙ্গ মুনির আগুনে প্রবেশ এবং কুমারে পরিণত হয়ে ব্রহ্মলোকে যাওয়ার রোমাঞ্চকর কাহিনিও মহাভারতে নেই, যা রামায়ণে উজ্জ্বলভাবে আছে।

মহাভারতে দশরথের কথা স্মরণ করেছেন, তেমনি রামের কথাও উচ্চারণ করেছেন সঞ্জয়–

“মরুং মনুমিক্ষবাকুং গয়ং ভরতেমব চ।

রামং দাশরথিঞ্চৈব শশবিন্দু ভগীরথ৷৷”(মহাভারত ১/১/২২৭)

কিংবা রাবণকেও দেখা যাচ্ছে “রামায়ণমুপাখ্যানমত্রৈব বহুবিস্তরম।/যত্র রামেণ বিক্রম্য নিহতো রাবণো যুধি।”(১/২/২০০) রামায়ণের দশরথ ও রামচন্দ্রের অনুষ্ঠিত ‘অশ্বমেধ যজ্ঞ’-এর ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। মহাভারতের ৩১ অধ্যায়ে ঘটোৎকচ অস্ত্রপ্রয়োগে অর্জুকে জামদগ্যের সমান এবং যুদ্ধে রামের সমকক্ষ বলা হয়েছে–

“কার্তবীর্যসমো বীর্যে সাগরপ্রতিমো বলে।

জামদগ্ন্যসমো হ্যন্ত্রে সংখ্যে রামসমোঅর্জুনঃ।”

লোমশমুনি যুধিষ্ঠিরের কাছে রাম কর্তৃক পরশুরামের তেজ কীভাবে নষ্ট করেছিলেন, সেই বর্ণনা করেছেন। যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন–

“শৃণু রামস্য রাজেন্দ্র ভার্গবস্য চ ধীমতঃ।

জাতত দশরথস্যাসীৎ পুত্রো রামো মহাত্মনঃ।”

গন্ধমাদন পর্বতে ভীমের সঙ্গে হনুমানের দেখা হলে হনুমান ভীমের পরিচয় জানতে চান।ভীম সীতার জন্য সমুদ্রলঙ্ঘনকারী হনুমানের ভাই বলে পরিচয় দেন–“রামপত্নীকৃতে যেন শতযোজনবিস্তৃতঃ।/সাগরঃ প্লবগেণে ক্রমেণৈকেন লঙ্ঘিতঃ।” মহাভারতের কাছে রামায়ণ যেন একমাত্র দৃষ্টান্ত। রামায়ণের কাছ শিক্ষা নিয়েছে মহাভারত, বারবার–বাঁকে বাঁকে। দ্রৌপদী যখন কীচকের দ্বারা অপমানিতা হন, তখন ভীম সীতার কথা বলেন, বলেন–“রক্ষসা নিগ্রহং প্রাপ্য রামস্য মহিষী প্রিয়া। ক্লিশ্যমানাপি সুশ্রোণ রামমেবান্ধপদ্যত।” এমনকি ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের কাছে অশ্বত্থামার গুণাবলির বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন–অশ্বত্থামা বেদবিদ, ব্রতপরায়ণ, ধনুর্বেদ বিশারদ এবং দাশরথি রামের মতো সমুদ্র-গম্ভীর প্রকৃতির।

Leave a Reply to akash roy Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *