॥ ১১ ॥
পরদিন একই সময়ে, একই জায়গায় মুখোমুখি দাঁড়ালেন দু’ পক্ষ। এই সব যুদ্ধে কোন দল শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে, যুদ্ধ কতদিন চলবে, এই চিন্তা, এই দুশ্চিন্তা সব সময় যোদ্ধাদের মন জুড়ে থাকে। দু’ পক্ষেই বড়-বড় বীর আছেন, তাই শেষ পর্যন্ত কোন দল যে জিতে যাবে, তা এখন বলা খুবই শক্ত।
পাণ্ডবপক্ষে রাজা যুধিষ্ঠির সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করেন কর্ণকে নিয়ে। এখনও যুধিষ্ঠির কর্ণের সঙ্গে তাঁদের কী সম্পর্ক, তা জানেন না। তিনি মনে করেন, অর্জুনের চেয়ে কর্ণই যুদ্ধবিদ্যায় বেশি দক্ষ। সে যদি হঠাৎ অর্জুনকে হারিয়ে দেয়, তা হলে তো পাণ্ডবদের জয়ী হওয়ার কোনও সম্ভাবনাও থাকবে না। কর্ণ এখনও যুদ্ধে যোগ দেননি বটে, কিন্তু যে-কোনও সময় কর্ণ তো এই যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পড়তেও পারেন। তখন কী হবে?
কৌরবপক্ষেও প্রধান দুশ্চিন্তা অর্জুনকে নিয়ে। অর্জুন যে কত বড় যোদ্ধা, তা দুর্যোধনও জানেন। কিন্তু তাঁর দলেও ভীষ্ম, দ্রোণের মতন যোদ্ধা আছেন, যাঁদের হারাবার সাধ্য এ পৃথিবীতে কারও নেই। এঁরা যদি মিলিত ভাবে অর্জুনকে আক্রমণ করেন, তা হলে অর্জুন কী করে বুঝবেন? তাঁকে পিছু হঠতে হবে।
তাই বুক ভরতি অভিমান নিয়ে দুর্যোধন কিছু আগে ভীষ্মের কাছে গিয়ে বলেছেন, “পিতামহ, আপনি কর্ণকে অপমান করলেন বলে, সে আর যুদ্ধ করতেও এল না। এতে আমাদের দলের কত ক্ষতি হয়ে গেল! আমি আশা করেছিলাম, আপনি একাই ওদের শেষ করে দিতে পারবেন। কিন্তু আমরা দেখছি, পাণ্ডবভাইদের মধ্যে কেউ যদি আপনার সামনে চলে আসে, তখন আপনি কেমন যেন নরম হয়ে যান। ওদের সঙ্গে মন দিয়ে যুদ্ধ করতে চান না। অন্যদিকে সরে যান! তা হলে কি এটাই বুঝব যে, আপনি আমাদের পক্ষে লড়াই করলেও, আপনি ওদেরই জিতিয়ে দিতে চান?”
ভীষ্ম বললেন, “তুমি যা অভিযোগ জানালে তার কিছুটা সত্যি তো বটেই। পাণ্ডবভাইদের কাছাকাছি দেখলেও তাদের হত্যা করার জন্য আমার হাত ওঠে না। আমার কাছে তোমরা যেমন, পাণ্ডবরাও তো সেই রকমই স্নেহের। ওদের আমি মারি কী করে? তবে, তোমাদের কাছে আমি যে শপথ করেছিলাম, আজ থেকে তা নির্ঘাত পালন করব। প্রত্যেক দিন আমি ওদের পক্ষের অন্তত দশ হাজার সৈন্যকে শেষ করে দেব। না, আমি তোমাদের পক্ষের পরাজয় চাই না মোটেই। আমি তো বলেছিই, যে-দলে কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীমের মতন বীররা রয়েছে, তাদের পরাজিত করা প্রায় অসম্ভব। তোমরা যদি এখনই যুদ্ধ থামিয়ে দিতে চাও, পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করো, তা হলেই এই বংশ টিকে থাকবে।”
দুর্যোধন বললেন, “যুদ্ধ থামাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। সন্ধি করতে আমি মোটেই চাই না। আমি আশা করেছিলাম, আপনার দাপটে পাণ্ডবপক্ষ পিছু হঠতে শুরু করবে।”
ভীষ্ম বললেন, “আমি যদি রোজ দশ হাজার সৈন্যকে শেষ করে দিতে পারি, তা হলে কয়েক দিনের মধ্যে ওদের পক্ষের সৈন্য আর থাকবে না। দেখো, এই পদাতিক সৈন্যরাই যুদ্ধের গতি-টতি পালটে দিতে পারে। চলো, দেখা যাক এর পরে কী হয়।”
ভীষ্ম আবার বললেন, “শোনো, এই কথাটা মনে রেখো, শিখণ্ডী নামে ওই দিকের দলের একজন যোদ্ধা আছে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারব না। সে আমার দিকে অস্ত্র ছুড়লেও আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকব। তখন তোমরা যদি পারো, আমাকে ঘিরে রেখো।”
পাণ্ডবপক্ষে এত বড়-বড় সব বীর আছেন, তাদের সবার বিরুদ্ধেই ভীষ্ম লড়ে যেতে পারেন, শুধু শিখণ্ডী নামের একজন মাঝারি ধরনের যোদ্ধার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবেন না কেন?
কে এই শিখণ্ডী?
আমরা জানি যে, আগেকার রাজা বিচিত্রবীর্যের বিয়ের সময় বেশ গোলমাল হয়েছিল। ভীষ্ম তো আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে, তিনি কখনও সিংহাসনে বসবেন না। বিয়েও করবেন না। এই বংশেরই একজনকে সিংহাসনে বসিয়ে ভীষ্মই দেশটাকে চালান।
বিচিত্রবীর্য ছিলেন দুর্বল ধরনের মানুষ। নিজে-নিজে যে বিয়ে করবেন, সে সাহসও তাঁর নেই। ভীষ্ম তখন বুঝলেন, তাঁকেই একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। এর মধ্যে তিনি খবর পেলেন যে, কাশীর রাজা তাঁর তিন মেয়ের জন্য স্বয়ংবর সভার ব্যবস্থা করছেন। সেখানে বিচিত্রবীর্যকে পাঠানো যেতে পারে। কিন্তু বিচিত্রবীর্যের দুর্বল চেহারা দেখে যদি কোনও মেয়েই তাঁর গলায় মালা না দেয়? তাতে তো এই বংশের উপরেই কলঙ্কের দাগ পড়বে। তখনই ভীষ্ম এমন একটা কাণ্ড করলেন, যার ফলাফল অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়ে গেল।
ভীষ্ম নিজেই গেলেন সেই স্বয়ংবর সভায়, বিচিত্রবীর্যকেও সঙ্গে নিলেন না। প্রথমে ভীষ্মকে দেখে সকলেই বেশ অবাক। ভীষ্ম যে বিয়ে করবেন না, তা তো সারা দেশের মানুষই জানে, ভীষ্ম সেই তিনটি মেয়েকেই তুলে নিলেন তাঁর নিজের রথে।
ভণ্ডুল হয়ে গেল স্বয়ংবর সভা।
অন্য রাজারা এতে অপমান বোধ করলেন। কয়েকজন রে রে করে তেড়ে গেলেন ভীষ্মের রথের দিকে। ভীষ্ম যে কত বড় যোদ্ধা, তা ওই আক্রমণকারীরা অনেকেই জানেন। তবু ভীষ্মের সঙ্গে লড়াই করতেই হয়, নইলে মান থাকে না।
এক-এক করে রাজারা সরে যেতে লাগলেন। ভীষ্ম ওই তিন রাজকন্যাকে নিয়ে এলেন হস্তিনাপুরে। তখনকার দিনে রাজারা, এমনকী অনেক সাধারণ মানুষও যত ইচ্ছে তত মেয়েকেই বিয়ে করতে পারত। ভীষ্ম ঠিক করলেন, এই তিনটি মেয়েকেই একসঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেবেন বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে। বিবাহ-বাসর সাজানো হচ্ছে দারুণ ভাবে। এরই মধ্যে অম্বা নামের বড় মেয়েটি ভীষ্মের কাছে এসে লাজুক ভাবে বলল, সে রাজা শাল্বকে মনে-মনে নিজের স্বামী বলে ঠিক করে রেখেছে। শাল্বও তা জানেন। এখন কি অন্য কাউকে বিয়ে করা ঠিক হবে?
এ-কথা শুনে ভীষ্ম অবাক তো হলেনই, খুব বিরক্ত বোধ করলেন। তিনি অম্বাকে বললেন, “এ-কথা তুমি আগে আমাকে বললে না কেন? তা হলে আগেই তোমাকে পাঠিয়ে দিতাম শাল্বর কাছে। এখন তুমি সেখানেই যাও।” কয়েকজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ আর একজন ধাত্রীকে সঙ্গে দিয়ে অম্বাকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন রাজা শাল্বর কাছে।
অম্বাকে দেখে শাল্ব বললেন, “হ্যাঁ, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চয়েছিলাম, তা ঠিকই। কিন্তু এর মধ্যে ভীষ্ম তোমাকে হরণ করে নিয়ে গেলেন। তুমি ওঁদের কাছে ছিলে কয়েকটা দিন। এই অবস্থায় আমি যদি তোমাকে বিয়ে করি, সবাই আমাকে ছি ছি করবে। তুমি ভীষ্মের কাছে ফিরে যাও।”
সেখানে অম্বার কোনও স্থান নেই। সে পাণ্ডবদের কাছে ফিরে যেতে বাধ্য হল।
সব কথা শুনে ভীষ্ম বললেন, “এখন তো আর আমি বিচিত্রবীর্যর সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে পারি না। রাজবাড়িতে তোমাকে আশ্রয় দেওয়াও ঠিক হবে না।”
একটা অসহায় মেয়েকে এদিক ওদিকে ঠেলে দিয়ে যে কত অপমান করা হচ্ছে, তা কেউ বুঝল না। কয়েকজন ঋষি অম্বাকে বললেন, “তুমি বরং তোমার বাপের বাড়ি ফিরে যাও।”
এবার রাগে ফুঁসে উঠে অম্বা বলল, “না, আমি বাপের বাড়িতে যাব না। আমার বাবাই তো আমাকে ভীষ্মের হাতে তুলে দিয়েছেন তারপর রাজা শাল্ব, এমনকী ভগবানও আমার উপর সুবিচার করেননি। তবে ভীষ্মের দোষই সবচেয়ে বেশি। আমি ভীষ্মের শাস্তি চাই।”
সেখানে কিছু মুনি-ঋষিও বুঝলেন যে, ভীষ্মের এই হঠকারিতাই অম্বার এই অবস্থার জন্য দায়ী!
কিন্তু ভীষ্মকে কে শাস্তি দেবে? সারা দেশে ভীষ্মের সমকক্ষ আর তো কোনও যোদ্ধা নেই। একমাত্র আছেন ঋষি পরশুরাম। একসময় তিনি রাগের বশে দেশ থেকে সমস্ত ক্ষত্রিয়দের শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। এখন অবশ্য তিনি আর যুদ্ধ-টুদ্ধ করতে চান না। বাছাই করা কিছু-কিছু শিষ্যকে যুদ্ধবিদ্যা শেখান।
খবর পাঠানো হল পরশুরামের কাছে। তিনি তাড়াতাড়িই এসে গেলেন কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে। তখনও কয়েকজন শিষ্য অম্বাকে বললেন, “বৎস, তুমি ঠিক করে বলো, তুমি কি শুধু ভীষ্মকেই মেরে ফেলতে চাও? কিংবা গুরু পরশুরাম শাল্বকে ডেকে পাঠিয়ে আদেশ করলেই তিনি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হবেন।”
অম্বা বলল, “এখন আমি আর শাল্বকে বিয়ে করতে চাই না। আমি ভীষ্মেরই শাস্তি চাই।”
তখন শুরু হল ভীষ্ম আর পরশুরামের যুদ্ধ। ভীষ্মও একসময় পরশুরামের শিষ্য ছিলেন। তাই ভীষ্ম যুদ্ধ করতে-করতে পরশুরামকে জিজ্ঞেস করলেন, “গুরুদেব, আপনি কী কারণে আমাকে যুদ্ধক্ষেত্রে ডেকে আনলেন, সেটাই তো এখনও বুঝিনি। আমি কী দোষ করেছি?”
পরশুরাম বললেন, “তুমিই তো এই মেয়েটির দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী। এখন একটাই মাত্র উপায় আছে, তুমি নিজে একে বিয়ে করো।”
ভীষ্ম বললেন, “তা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।”
চলতে লাগল যুদ্ধ।
এ এমন এক সমানে-সমানে যুদ্ধ, যা দেখতে এলেন বহু মানুষ, রাজা এবং দেবতারা। ভীষ্মের মা গঙ্গাদেবীকেও দেখা গেল পাতলা মেঘের আড়ালে।
এঁদের দু’জনের কাছে এমন কয়েকটা অস্ত্র আছে, যা প্রয়োগ করলে যার সঙ্গে যুদ্ধ হচ্ছে, সে তো মরবেই, আরও বহু মানুষেরও চরম ক্ষতি হবে।
দেবতারা বারবার ভীষ্ম আর পরশুরামকে সেই অস্ত্র প্রয়োগ না করতে অনুরোধ জানাতে লাগলেন। একসময় বোঝা গেল যে দু’জনের কেউই জিতবেন না, হারবেনও না। তখন অনেক মুনি-ঋষি, দেবতা আর গঙ্গাদেবী ভীষ্মকে এই যুদ্ধ থামিয়ে দিতে অনুরোধ করলেন।
পরশুরামও বুঝলেন ব্যাপারটা। ভীষ্ম তাঁর শিষ্য ছিলেন। তাঁর এমন বীরত্ব দেখে তিনি মুগ্ধ। তিনি ভীষ্মকে বললেন, “এ দেশে তোমার তুল্য আর কেউ নেই। আমাদের এই মিছিমিছি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কোনও মানে আছে? বরং চলো, এবার আমরা বাড়ি যাই।”
তিনি অম্বাকেও ডেকে বললেন, “তুমি দেখলে তো ভীষ্মকে শাস্তি দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তুমি বরং ভীষ্মের কাছেই চলে যাও। তাঁর শরণ নাও। এ ছাড়া আমি তো আর কোনও উপায় দেখছি না।”
অম্বা বলল, “আমি কিছুতেই ভীষ্মের কাছে আশ্রয় নিতে যাব না। আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন, তা তো দেখলাম। এবার আমিই যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্মকে হত্যা করব।”
কিন্তু অম্বা আর কতটুকু যুদ্ধবিদ্যা শিখেছে? সে ভীষ্মের মুখোমুখি হবে কী করে? তখন সে শুরু করল কঠোর তপস্যা। কোনও নারীকে এত কঠোর তপস্যা করতে আগে কেউ দেখেনি এখানে।
অবশেষে একদিন স্বয়ং মহাদেব এসে উপস্থিত হলেন। এবং সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আমার কাছে কী বর চাও?”
অম্বা উত্তর দিল, “আমাকে বর দিন, যাতে আমি ভীষ্মকে হত্যা করতে পারি।”
মহাদেব বললেন, “তুমি এ জন্মে পারবে না। পরের জন্মে…”
এখানে মহাদেব এমন একটা কথা বললেন, যেটার মানে ঠিকঠাক বোঝা যায় না।
তিনি বললেন, “এ জন্মে তো পারবে না। পরের জন্মে তুমি দ্রুপদ রাজার মেয়ে হয়ে জন্মাবে, তারপর তুমি একসময় পুরুষ হয়ে যাবে। তখন তুমি পারবে ভীষ্মের মুখোমুখি হতে।”
এ আবার কী ধরনের বর? একজন মেয়ে হয়ে জন্মাবে, আবার সে কিছু দিন পরে পুরুষ হয়ে যাবে, এ রকম কখনও হয় নাকি?
কিন্তু মহাদেব আর কিছুই বলতে চাইলেন না।
তিনি ফিরে যাওয়ার পর অম্বা ভাবল, যদি এ জন্মে আর কিছু করার না থাকে, তা হলে শুধু-শুধু বেঁচে থেকে সময় নষ্ট করার কোনও মানেই হয় না। তখন সে বনের মধ্যে এক জায়গায় আগুন জ্বেলে স্বেচ্ছায় তার মধ্যে ঢুকে গিয়ে মৃত্যু বরণ করল।
যথা সময়ে সে দ্রুপদ রাজার রানির গর্ভে জন্মাল একটি মেয়ে হয়ে। রানি খুব আশা করেছিলেন যে তাঁর এই সন্তানটি ছেলেই হবে। কিন্তু তা তো হল না। তাই তিনি প্রথম থেকেই ওই মেয়েটিকে পুরুষের মতন সাজিয়ে রাখেন, আর চতুর্দিকে রটে গেল যে রানির একটা ছেলেই হয়েছে।
এ সব অনেক দিন আগেকার কথা। অম্বার কথা কেউ তখন জানেই না। এই জন্মেই তার নাম রাখা হল শিখণ্ডী। রাজপুত্র হিসেবে তাকে একসময় না একসময় তো বিয়ে করতেই হবে। তখনও রানি শিখণ্ডীর আসল পরিচয় জানালেন না। এক রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল শিখণ্ডীর।
কয়েক মাসের মধ্যেই সেই রাজকন্যা তার বাবাকে জানাল, “বাবা, তুমি এ কার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছ? এ তো আমারই মতন একজন মেয়ে। মেয়েতে-মেয়েতে বিয়ে হয় নাকি?”
শিখণ্ডীর আসল পরিচয় জানাজানি হতেই চতুর্দিকে হুলস্থুল পড়ে গেল। ক্ষত্রিয়দের মধ্যে কেউ কখনও এ রকম মিথ্যে বলে না। বহু লোক ছি ছি করতে লাগল দ্রুপদের নামে। কয়েকজন রাজা দ্রুপদকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য যুদ্ধের আয়োজন শুরু করে দিল।
এরই মধ্যে শিখণ্ডী বেঁচে গেল এক অলৌকিক উপায়ে। মনের দুঃখে শিখণ্ডী একা-একা ঘুরে বেড়াত। একদিন সে বনের মধ্যে একটা সুন্দর বাড়ি দেখতে পেল। সেখানে আপাতত কেউ নেই। এক যক্ষ সেই বাড়ির মালিক। যক্ষরা ঠিক দেবতা নয়, আবার সাধারণ মানুষও নয়, মাঝামাঝি।
আড়াল থেকে সেই যক্ষ জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে? এখানে কী চাও?
শিখণ্ডী জানে যে, এই যক্ষরা অনেক সময় মানুষদের খুব সাহায্যও করে। তাই শিখণ্ডী নিজের পরিচয় জানিয়ে কাতর গলায় বলল, “আমি খুব বিপদে পড়েছি। তাই আপনার কাছে একটা প্রার্থনা জানাতে চাই। আপনি আমাকে আপনার পুরুষ পরিচয়টাই কিছুদিনের জন্য ধার দেবেন? তা হলেই আমি বাঁচতে পারি।”
যক্ষরা ইচ্ছে করলে অনেক কথাই জানতে পারে। এই যক্ষও নিশ্চয়ই শুনেছিল যে, শিখণ্ডী মেয়ে না পুরুষ এই নিয়ে দারুণ একটা শোরগোল হচ্ছে।
যক্ষ বলল, “ঠিক আছে। আমি তোমাকে আমার পুরুষ পরিচয়টা ধার দিতে পারি। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে যে, তোমার উদ্দেশ্য সফল হলে আমার কাছে এসে সেই পুরুষ পরিচয়টা ফেরত দেবে। তুমি যতদিন পুরুষ থাকবে, ততদিন আমাকেও তো নারী হিসেবে থাকতে হবে।”
শিখণ্ডী বলল, “আমি শপথ করছি, আপনাকে এই পরিচয় অবশ্যই ফিরিয়ে দিয়ে যাব।”
তার একটু পরেই শিখণ্ডী পুরোপুরি পুরুষ হয়ে গেল। তার শরীরে নারীত্বের কোনও চিহ্নই রইল না।
ফিরে এসে শিখণ্ডী সব কথা জানাল বাবা-মাকে। তাঁদের আর আনন্দের সীমা রইল না। এর মধ্যেই রাজা দ্রুপদকে কত রকম অপমান যে সহ্য করতে হয়েছে মিথ্যে কথা বলার জন্য। এবার তিনি সগর্বে বলে দিলেন, “মোটেই আমি মিথ্যে কথা বলিনি। শিখণ্ডী আমার ছেলে, মেয়ে তো নয়। যার ইচ্ছে, দেখে যেতে পারে।”
এখন শিখণ্ডী সত্যিই একজন পুরুষ। এবং সে অস্ত্রবিদ্যাও শিখতে লাগল। এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়ে লড়তে লাগল প্রাণপণে।
কিন্তু যখনই সে ভীষ্মর কাছাকাছি আসে, তখনই তিনি অস্ত্রত্যাগ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। কেন ভীষ্ম এই রকম আচরণ করছেন, তা বুঝতে পারল না কেউ।
এই সময়ই বোঝা গেল, মহাদেব অম্বাকে যে অদ্ভুত ধরনের বর দিয়েছিলেন, তার সঠিক মর্ম পরিষ্কার হয়ে গেল। শিখণ্ডী যদি প্রথম থেকেই নারী হত, তা হলে সে যুদ্ধক্ষেত্রে আসতেই পারত না। ভীষ্মর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগই পেত না। আর সে যদি প্রথম থেকেই পুরুষ হত, তা হলে ভীষ্ম একটুক্ষণের মধ্যে তাকে মেরে ফেলতে পারতেন।
ভীষ্মর মতন বীরপুরুষরা কখনও কোনও মহিলার সঙ্গে যুদ্ধ করেন না। কিন্তু শিখণ্ডী তো এখন একজন মাঝারি ধরনের যোদ্ধা। তার সঙ্গে কেন লড়বেন না ভীষ্ম? তিনি এই শিখণ্ডীর আগের জন্মের সব কথা জানেন। এই শিখণ্ডীই তো সেই অম্বা, তাই ওকে দেখলেই ভীষ্মের মনে অম্বার মুখটাই ভেসে ওঠে। এর সঙ্গে তিনি লড়বেন কী করে?
সেই জন্য একটু সুযোগ পেলেই শিখন্ডী ভীষ্মর কাছাকাছি এসে নানারকম অস্ত্র ছুড়তে থাকে। ভীষ্ম তা আটকানোরও চেষ্টা করেন না। তখন কৌরবপক্ষের বড়-বড় বীররা শিখণ্ডীর কাছে এসে ভীষ্মকে আড়াল করে যুদ্ধ করতে থাকে। একসময় শিখণ্ডী পিছু হঠতে বাধ্য হয়।
এবার আমরা ফিরে আসি আজকের যুদ্ধের কথায়। ভীষ্ম মন দিয়ে যুদ্ধ করছেন না বলে দুর্যোধন তাঁকে অনুযোগ করেছিলেন। তাই ভীষ্ম যেন আজ খেপে উঠলেন। ভুলে গেলেন তাঁর বয়সের কথা। তিনি কথা দিয়েছেন যে, প্রতিদিন তিনি অন্তত দশ হাজার সৈন্য বিনাশ করবেন। কিন্তু শুধু তির-ধনুক দিয়ে দশ হাজার মানুষের প্রাণ হরণ করা কি সোজা কথা? সেই জন্যই ভীষ্ম এত দ্রুত তির চালাতে লাগলেন, যাতে পাণ্ডবপক্ষের সৈন্যরা টপাটপ মরে যেতে লাগল। অনেকে ভয়ে পালাল, অন্ধকার হয়ে এল আকাশ।
পাণ্ডবপক্ষের বীররা সেই দৃশ্য দেখে হতবাক। তাঁদের প্রত্যেকেরই মনে হল, এই বৃদ্ধকে সরিয়ে দিতে না পারলে এই যুদ্ধ জয়ের কোনও আশা নেই। কিন্তু ওঁকে সরাবার সাধ্য আছে কার? একমাত্র অর্জুনই ভীষ্মের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু তিনি তাঁর পিতামহের শরীরে আঘাত করতে চান না। দূরে চলে যান। পাণ্ডবপক্ষের বীর যোদ্ধারা দূরে দাঁড়িয়ে ভীষ্মর এই পরাক্রমের দৃশ্য দ্যাখেন আর অসহায় ভাবে নিজেদের দিকে চেয়ে থাকেন।
এরই মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের হঠাৎ মাথা গরম হয়ে গেল। তিনি ভীষ্মর এই প্রতাপ সহ্য করতে পারছিলেন না। পাণ্ডব বীররা কেউই ভীষ্মকে থামাবার চেষ্টা করছেন না। কৃষ্ণ তো অর্জুনকে বলেই দিয়েছেন, যুদ্ধ হচ্ছে যুদ্ধ। এতে ভাই, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন এই সব পরিচয়ের আর কোনও মূল্য থাকে না। তবু অর্জুন দ্বিধা করছেন।
কৃষ্ণ ঠিক করলেন, তিনিই ভীষ্মকে বিনাশ করবেন। রথ থেকে লাফিয়ে নেমে এলেন কৃষ্ণ। ছুটলেন ভীষ্মর রথের দিকে।
কৃষ্ণের একটা সাংঘাতিক অস্ত্র আছে, তার নাম সুদর্শন চক্র। সেটা কাছে রাখতে হয় না। মনে-মনে তাকে ডাকলেই সে চলে আসে।
কৃষ্ণকে ওই ভাবে ছুটতে দেখে পাণ্ডবরা হকচকিয়ে গেলেন। তারপর অর্জুনও ছুটতে লাগলেন কৃষ্ণকে ধরার জন্য।
কাছে এসে তিনি কৃষ্ণের হাত চেপে ধরে বললেন, “এ কী করছ তুমি? কোথায় যাচ্ছ?”
কৃষ্ণ বললেন, “তোমরা তো কেউ তোমাদের পিতামহকে মারবে না। তাই আমিই সে কাজটা সেরে দিচ্ছি। আজ আর ভীষ্মর নিস্তার নেই।”
অর্জুন বললেন, “না, না, এ কাজ তুমি করতেই পারো না।”
কৃষ্ণ বললেন, “কেন পারব না? উনি তো আমার পিতামহ নন। ওঁর সম্পর্কে আমার কোনও দুর্বলতাও নেই। তুমি কী ভাবছ? আমি ভীষ্মর সমকক্ষ নই?
অর্জুন বললেন, “না কৃষ্ণ, আমি জানি যে, তুমি ইচ্ছে করলে সব কিছু ধ্বংস করে দিতে পারো। কিন্তু দুর্যোধনের কাছে কথা দিয়েছিলে যে, এই যুদ্ধে তুমি আমাদের দিকে থেকে শুধু পরামর্শ দিতে পারো। বড়জোর রথের সারথিও হতে পারে। কিন্তু কোনও অস্ত্র ধারণ করতে পারবে না। এখন যদি তুমি নিজেই নিজের কথা না রাখো, তা হলে লোকে তোমায় খুবই অপবাদ দেবে, আমাদেরও ছাড়বে না। না কৃষ্ণ, এ কাজ তোমাকে মানায় না। আমরা যদি এই যুদ্ধে জয়ী হতে নাও পারি, তবু আমরা কোনও অধর্ম করব না।”
আরও একটুক্ষণ এই সব নিয়ে কথাবার্তার পর কৃষ্ণের মেজাজ শান্ত হল। তিনি বুঝলেন যে, এই কাজটা করা তাঁর পক্ষে ঠিক হচ্ছিল না।
এর পর একদিন অন্য রকম যুদ্ধ হল। এর আগে শিখণ্ডীকে ভীষ্মের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করা হত। আজ শিখণ্ডীকেই ডেকে আনা হল সামনে। তার আড়ালে কয়েকজন বীর। এখন সকলে জেনে গিয়েছে যে, শিখণ্ডীকে দেখলেই ভীষ্ম অস্ত্রত্যাগ করেন। তাই শিখণ্ডী একেবারে সামনে গিয়ে ভীষ্মর উপর যা ইচ্ছে বাণ মারতে লাগল। তার আড়াল থেকে অন্য বীররাও তির বর্ষণ করতে লাগল অজস্র। ক্রমে এমন অবস্থা হল, শজারুর যেমন সারা শরীরেই বড়-বড় কাঁটা থাকে, ভীষ্মর শরীরেও সেই রকম এত বেশি বাণ বিদ্ধ হয়ে রইল যে, আর একটুও জায়গা খালি রইল না।
এই অবস্থায় ভীষ্ম গড়িয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। না, ঠিক মাটিতেও, না, সারা শরীরের এত তির তাঁকে শুইয়ে রাখল কিছুটা উঁচুতে। একেই বলে ভীষ্মের শরশয্যা। এ রকম অবস্থায় আর কাউকেই কখনও দেখা যায়নি।
ভীষ্মের এই পতনের কথা শুনে বহু মানুষ হাহাকার করে উঠল। যুদ্ধ থামিয়ে সকলেই ছুটে এল ভীষ্মের কাছে। ভীষ্ম বললেন, “সকলকেই একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হয়, আমিও যাচ্ছি। তবে আমার ইচ্ছামৃত্যুর বর আছে। আমি ইচ্ছে না করলে আমাকে সরাবার সাধ্য কারও নেই। আমি বেশ একটা ভাল দিনক্ষণ দেখে দু’ চক্ষু বুজব। অর্থাৎ আমি এই অবস্থাতেও থাকব কিছুদিন।”
তারপর তিনি বললেন, “আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে। কেউ আমাকে একটু জল খাওয়াতে পারো?”
সঙ্গে-সঙ্গে অনেকে ছুটে গিয়ে নানারকম পাত্রে নানারকম সুগন্ধী পানীয় নিয়ে এল। ভীষ্ম তার কোনওটাই ছুঁয়ে দেখলেন না। তিনি তাকালেন অর্জুনের দিকে। অর্জুন তাঁর মনের ভাব বুঝতে পেরে একটা বিশেষ তিরে বিদ্ধ করলেন সেখানকার মাটি। অমনি সেখান থেকে উঠে এল একটা নির্মল জলের ফোয়ারা। তা গিয়ে পড়ল ভীষ্মর মুখে। তিনি তৃপ্তির সঙ্গে পান করলেন। তারপর সকলকে বললেন, “তোমরা যাও। যার-যার কর্তব্য পালন করো।”
অর্থাৎ ভীষ্ম এই যুদ্ধে নিহত হলেন না বটে, তবে যোদ্ধা হিসেবেও তাঁর আর যোগ্যতা রইল না।