॥ ৫ ॥
এখন পাণ্ডবদের একটা নিজস্ব রাজ্য হয়েছে। শত্রু কেউ নেই। তাঁরা নতুন রাজধানী নানা ভাবে সাজাচ্ছেন।
একদিন ময় এসে দেখা করলেন অর্জুনদের সঙ্গে। অর্জুনের পাশে বসে আছেন কৃষ্ণ। ময় তাঁদের প্রণাম জানিয়ে বললেন, “হে অর্জুন, খাণ্ডববন ধ্বংস করার সময় আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। সেই উপকারের বিনিময়ে আমিও আপনাদের কিছু উপকার করতে চাই।”
অর্জুন হেসে বললেন, “উপকারের বদলে কারও কাছ থেকে উপকার নিতে নেই। আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আপনি যা বললেন তাই-ই যথেষ্ট।”
ময় তবু বারবার একই অনুরোধ করতে লাগলেন। তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন, সুতরাং তার বিনিময়ে কিছু না দিতে পারলে তাঁর শান্তি হচ্ছে না।
অর্জুন বললেন, “আপনার প্রাণ বাঁচিয়েছি বলেই যে আপনার কাছ থেকে কিছু নিতে হবে, তা আমি মোটেই চাই না। তবু যদি আপনি কিছু দিতে চান, তা হলে কৃষ্ণকে খুশি করার জন্য কিছু করুন। তাতেই আমার তৃপ্তি হবে।”
কৃষ্ণ ময়ের কথা শুনে বললেন, “ঠিক আছে, তুমি যদি কিছু দিতেই চাও, তা হলে যুধিষ্ঠিরের রাজসভাটা এমন ভাবে সাজিয়ে দাও, যেমন আগে কোথাও হয়নি।”
দেবতাদের প্রধান স্থপতি যেমন বিশ্বকর্মা, দৈত্যদেরও প্রধান স্থপতি এই ময়। লোকে তাঁকে বলে ময় দানব। তাঁর স্বভাব বেশ শান্ত আর খুবই গুণী।
কৃষ্ণের কথা শুনে ময় চলে গেলেন নিজের দেশে। কিছুদিন পর ফিরে এলেন প্রচুর জিনিসপত্র নিয়ে। তারপর সাজাতে লাগলেন রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসভা। কত রকম মণিমাণিক্য ও স্ফটিক দিয়ে গড়া হল সেই রাজসভা আর তার সঙ্গে পুকুর ও বাগান। উদ্বোধনের দিন সেই রাজসভা দেখে সকলেরই চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা। এ রকম আগে কেউ কখনও দেখেনি। অতি উজ্জ্বল, অতি মনোহর। মাঝখানের সরোবরটি দেখে অনেকের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তার সামনের চাতাল ও সিঁড়ি স্ফটিকের তৈরি, মনে হয়, সেখানেই বুঝি জল আছে। আর সরোবরের জল এতই স্বচ্ছ যে, জল বলে মনেই হয় না। কোনও-কোনও রাজা তার উপর দিয়েই হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। একদিন দেবর্ষি নারদ এলেন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করতে। ইনি স্বর্গেও থাকেন, আবার পৃথিবীতেও ঘুরে বেড়ান। এই রাজসভা দেখে তিনিও খুবই মুগ্ধ। তিনি আরও অনেক বিখ্যাত রাজসভা দেখেছেন। যেমন, ইন্দ্রের রাজসভা। দেবতাদের রাজার সভা, সে তো দারুণ হবে নিশ্চয়ই। তারপর যমের সভা, কুবেরের সভা, এমনকী স্বয়ং ব্রহ্মার নিজস্ব সভা, এগুলো খুবই বিখ্যাত বটে, যুধিষ্ঠিরের সভারও তুলনা নেই৷
নারদ আরও একটি খবর জানালেন। তিনি বললেন, “মহারাজ ইন্দ্রের সভায় তোমার পিতা পাণ্ডুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি তাঁর একটা অনুরোধ তোমাদের জানাতে বলেছেন। তিনি বললেন, ‘যুধিষ্ঠিরের ভাইরা দাদার খুব অনুগত, সেই ভাইদের নিয়ে যুধিষ্ঠির ইচ্ছে করলে এখন সারা পৃথিবী জয় করতে পারে। যুধিষ্ঠির এখন রাজসূয় যজ্ঞ করছে না কেন? সেই যজ্ঞ করলে আমি খুব তৃপ্তি পাব।’”
নারদ তো এই কথাটা যুধিষ্ঠিরের কানে তুলে দিয়ে চলে গেলেন, কিন্তু রাজসূয় যজ্ঞ করা কী চাট্টিখানি কথা! অতি বিশাল ব্যাপার। রাজসভায় ঋষিদের ও অন্য ভাইদের এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সবাই মহাউৎসাহে বলতে লাগলেন, “হ্যাঁ, হোক-হোক, রাজসূয় যজ্ঞ হোক।”
একটি রাজ্যের অধিপতিকে বলে রাজা। যিনি অনেক রাজ্য জয় করেন তিনি সম্রাট। আর রাজসূয় যজ্ঞ করতে গেলে পৃথিবীর সব রাজাকে জয় করতে হয়। তা কি সম্ভব!
পরামর্শ করার জন্য যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের কাছে খবর পাঠালেন। কৃষ্ণ এসে সব শুনে প্রথমেই অন্যদের মতো সায় দিলেন না। সুবিধে-অসুবিধে বিবেচনা করতে লাগলেন। পৃথিবীর কোন রাজার কতটা শক্তি তা তিনি সবই জানেন। সেই সব রাজার পরিচয় দিতে-দিতে কৃষ্ণ বললেন, “ভীম আর অর্জুন এঁদের সবাইকে জয় করতে পারেন, শুধু একজনকে ছাড়া। তাঁর নাম জরাসন্ধ। এই জরাসন্ধকে জয় করার ক্ষমতা পাণ্ডবদেরও নেই। এমনকী, স্বয়ং কৃষ্ণ এবং যাদবরাও এই জরাসন্ধকে আটকাতে না পেরে এখন রৈবতক পাহাড়ের উপর একটা দুর্গ বানিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন।”
তা হলে কী উপায়? একজন রাজাও বাকি থাকলে তো রাজসূয় যজ্ঞ হয় না! কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “আপনার অবশ্যই রাজসূয় যজ্ঞ করা উচিত। আমি ভীম আর অর্জুনকে নিয়ে ছদ্মবেশে বেরোচ্ছি। তারপর দেখা যাক কী হয়।”
এই জরাসন্ধ সম্পর্কে একটা গল্প প্রচলিত আছে। মোটেই সত্যি নয়, তবে গল্পটা বেশ মজার।
মগধের রাজা ছিলেন বৃহদ্রথ। তাঁর দুই রানির কোনও ছেলে ছিল না। তাই মনে খুব দুঃখ। একদিন শুনলেন, চণ্ডকৌশিক নামে এক নামী ঋষি তাঁর রাজ্যে এসে বসে তপস্যা করছেন। অমনি রাজা তাঁর বউদের সঙ্গে নিয়ে ঋষির পায়ে পড়ে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। রাজার দুঃখের কথা শুনে ঋষি একটুক্ষণ চোখ বুজে রইলেন, একটু পরেই একটা পাকা আম তাঁর কোলে এসে পড়ল। ঋষি একটুক্ষণ সেই আমটি ধরে রাখলেন, তারপর রাজাকে দিয়ে বললেন, “এটা নিয়ে যান, আপনার মনোবাসনা পূর্ণ হবে।”
ফিরে এসে রাজা তাঁর দুই রানিকে আমটি দিলেন, তাঁরাও সেটি সমান দু’ভাগে ভাগ করে খেয়ে নিলেন। যথা সময়ে দুই রানিই সন্তানের জন্ম দিলেন। আধখানা ছেলে, এক-একজনের একটা কান, একটা হাত, একটা পা। তারপর কী আর করা যাবে, সেই দুই খণ্ড রাজকুমারের দেহ ফেলে দিয়ে আসা হল আঁস্তাকুড়ে।
রাত্তিরবেলা জরা নামের এক রাক্ষসী মাংসের লোভে রাজধানীতে ঘুরে বেড়ায়। সে ওই দু’ টুকরো বাচ্চাকে দেখে হাতে তুলে নিল, তারপর খেলাচ্ছলে জুড়ে দিল টুকরো দু’টো। অমনি বাচ্চাটা জীবন্ত হয়ে হাত-পা ছুড়তে লাগল। রাক্ষসীর একবার ইচ্ছে হল শিশুটিকে খেয়ে ফেলতে। তারপরেই তার মায়া হল, “আহা কী সুন্দর ছেলে, রাজাকেই ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।”
সে তখন এক সুন্দরী তরুণীর রূপ ধরে বাচ্চাটিকে নিয়ে রাজসভায় গিয়ে বলল, “রাজা, এই নিন আপনার সন্তান।”
তখন রাজপুরীতে আবার আনন্দের ধুম পড়ে গেল।
গল্পটা বড়ই আজগুবি আমরা জানি। আধখানা আম থেকে কখনও আধখানা ছেলে জন্মাতে পারে না। আর জরা রাক্ষসী দু’টো টুকরো জোড়া দিতেই বাচ্চাটা বেঁচে উঠল। এই জোড়া দেওয়ার কথাটা আগে রাজবাড়িতে কারও মনে পড়েনি। যাই হোক গল্প তো গল্পই।
জরা রাক্ষসী প্রাণ বাঁচিয়েছিল বলে ছেলেটির নাম রাখা হয়েছিল জরাসন্ধ। ক্রমে-ক্রমে সে হয়ে উঠল এক প্রবল শক্তিমান বীর যোদ্ধা। তাঁর দাপটে সবাই ভয় পায়। একের পর এক রাজ্য জয় করে জরাসন্ধ সেই রাজাদের ধরে এনে নিজের কারাগারে বন্দি করে রাখেন। দেবতার পুজোয় তাঁদের এক-এক করে বলি দেওয়ার ভয় দেখান।
জরাসন্ধকে জয় না করতে পারলে রাজসূয় যজ্ঞ হবে না। আর সম্মুখ যুদ্ধেও জরাসন্ধকে জয় করা সম্ভব নয়, কৌশল করে তাঁকে হারাতে হবে। কৃষ্ণের কথা শুনে ভীম আর অর্জুন ব্রাহ্মণ সেজে যাত্রা করলেন মগধের দিকে। অনেক নদী-পর্বত পেরিয়ে যেতে হল তাঁদের।
সেখানে পৌঁছে কৃষ্ণের নির্দেশে তাঁরা যা কাণ্ড শুরু করলেন, তা মোটেই ব্রাহ্মণদের মানায় না। এটা ভাঙছেন, সেটা ভাঙছেন, হুংকার দিয়ে সবাইকে ভয় দেখাচ্ছেন। মগধের মানুষ সরে গিয়ে তাঁদের পথ করে দিল।
এইভাবেই দৌড়তে-দৌড়তে রাজবাড়ির পিছনের দরজা ভেঙে তিন জন উপস্থিত হলেন জরাসন্ধের পুজোর ঘরে।
ব্রাহ্মণবেশে সেই তিন জনকে দেখে জরাসন্ধ পরম ভক্তিভরে তাঁদের পাদ্যঅর্ঘ্য দিয়ে পুজো করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কে?”
কৃষ্ণ শিখিয়ে দিয়েছিলেন বলে ভীম আর অর্জুন কোনও কথা বললেন না। কৃষ্ণ বললেন, “এঁরা ব্রত করেছেন, এখন কথা বলবেন না।”
জরাসন্ধ বললেন, “আপনাদের গলায় মালা, গায়ে চন্দন চিহ্ন। আপনাদের কাপড়ের রং লাল, বাহুতে যে দাগ রয়েছে, তাতে মনে হয়, আপনাদের ধনুর্বাণ চালনার অভ্যেস আছে। আপনারা কি সত্যিই ব্রাহ্মণ? আপনারা পিছনের দরজা দিয়েই বা ঢুকলেন কেন?”
কৃষ্ণ বললেন, “স্নান উৎসবের সময় ক্ষত্রিয় আর বৈশ্যরাও এ রকম সাজ নিতে পারে। আর শত্রুগৃহে যে-কোনও ভাবে ঢোকা যায়।”
জরাসন্ধ অবাক হয়ে বললেন, “শত্রু! আমি আপনাদের শত্রু হলাম কী করে?”
কৃষ্ণ বললেন, “তুমি অনেক রাজাকে বন্দি করে এনে কারাগারে রেখেছ, তাদের বলি দিতে চাও। এই অন্যায়ের জন্য তোমাকে শাস্তি দিতে এসেছি।”
জরাসন্ধ বললেন, “অন্যায়? আমি তো প্রত্যেকটি রাজাকে যুদ্ধে হারিয়ে বন্দি করে এনেছি। পরাজিত রাজাদের নিয়ে তো যা খুশি করা যায়।”
কৃষ্ণ বললেন, “অত কথার দরকার কী? তুমি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো। তিন জনের মধ্যে কার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাও?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জরাসন্ধ ভীমকেই পছন্দ করলেন।
তারপর শুরু হল বাহুযুদ্ধ।
ভীমের পরাক্রম কে না জানে। আর জরাসন্ধও অতুলনীয় যোদ্ধা। লড়াই হতে লাগল সমানে-সমানে। একসময় দু’জনের গা থেকে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরোতে লাগল। দু’জনের গর্জনে কেঁপে উঠল সব দিক।
কার্তিক মাসের পয়লা তারিখে আরম্ভ হল সেই যুদ্ধ, চলল টানা তেরো দিন। এর মধ্যে কেউ কিছু খাওয়ারও সময় পায়নি। অবিশ্বাস্য লাগে শুনতে, তাই না? চোদ্দো দিনের দিন জরাসন্ধ ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিতে চাইলেন। সামনা সামনি যুদ্ধে এক জন বিশ্রাম নিতে চাইলে অন্যজনেরও থেমে যাওয়াই নিয়ম। কিন্তু কৃষ্ণ ভীমকে বললেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে।
ক্লান্ত জরাসন্ধকে অকস্মাৎ তুলে নিয়ে ভীম বোঁ বোঁ করে ঘোরাতে লাগলেন প্রায় একশো বার। জরাসন্ধর তখন আর বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ভীম তাঁকে মাটিতে ফেলে পিঠে হাঁটু দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে, তাঁর দু’টো পা ধরে টানতেই তাঁর শরীর দু’ ভাগ হয়ে গেল। তাতেই জরাসন্ধ শেষ। তখন ভীমের ভয়ংকর চিৎকারে মনে হল বুঝি হিমালয় কিংবা পৃথিবী বিদীর্ণ হচ্ছে।
কারাগার থেকে বন্দি রাজাদের মুক্তি দিতে তাঁরা দু’ হাত তুলে বন্দনা করতে লাগলেন কৃষ্ণ আর পাণ্ডবদের। বিজয়গর্বে সেই তিন জন ফিরে এলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে।
ব্যস, এর পর আর রাজসূয় যজ্ঞে কোনও বাধা রইল না। তবু পৃথিবীর অন্য সব রাজাদেরও তো বশ্যতা স্বীকার করাতে হবে। যুধিষ্ঠিরের শ্রেষ্ঠত্ব কেউ না মানতে চাইলে যুদ্ধ করতে হবে তাঁর সঙ্গে। তাই অর্জুন, ভীম, সহদেব আর নকুল এই চার ভাই চারদিকে যাত্রা করলেন দিগ্বিজয়ে।
কয়েক জায়গায় ছোটখাটো যুদ্ধ হল বটে, কিন্তু পাণ্ডবদের পরাক্রম কেউ সহ্য করতে পারলেন না। ভীম যুদ্ধ করতে-করতে একসময় পৌঁছে গেলেন আমাদের এই বঙ্গদেশে। কিন্তু তখন বঙ্গদেশ ছোট-ছোট রাজ্যে বিভক্ত। কোনও রাজারই সাধ্য হল না ভীমকে প্রতিহত করার।
চার ভাই-ই ফিরে এলেন প্রচুর ধনরত্ন আর ঘোড়া আর হাতি নিয়ে। এ সবই পরাজিত রাজাদের উপহার। যজ্ঞ করলেও তো প্রচুর খরচ হবে।
যজ্ঞের আয়োজন মানে কী? সে এক এলাহি ব্যাপার। নানান দেশ থেকে বিখ্যাত সব ঋষি, পণ্ডিত আর রাজাদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। হস্তিনাপুর থেকেও আসবেন ধৃতরাষ্ট্র, ভীম, বিদুর, দুর্যোধন ও আরও অনেকে। এঁদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা-আলাদা থাকার ব্যবস্থা, পছন্দমতো খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। পান থেকে একটু চুন খসলেই নিন্দে হয়ে যাবে। তৈরি হতে লাগল শত-শত নতুন বাড়ি। নতুন রান্নাঘর, আর জোগাড় হল নানা রাজ্যের রান্নার লোক। কোনও ব্যবস্থার ত্রুটি নেই।
তা হলে কি রাজসূয় যজ্ঞ সহজে মিটে গেল? মোটেই না। মোটেই না। একটু-আধটু রক্তপাত হবে না?
সেই পুণ্যদিনে শত-শত রাজা ও বিশিষ্ট মানুষেরা সমবেত হয়েছেন যজ্ঞস্থলে। এ যেন আকাশের নক্ষত্রমণ্ডলীর মতো উজ্জ্বল। যজ্ঞ শুরুর আগে, একজন কাউকে প্রধান হিসেবে অর্ঘ্য দিতে হয়। কাকে অর্ঘ্য দেওয়া হবে? ভীষ্মের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে যুধিষ্ঠির ঘোষণা করলেন, “এই যজ্ঞের প্রধান হিসেবে অর্ঘ্য দেওয়া হবে কৃষ্ণকে।”
এতে অনেকে অবাক হলেও মুখে কিছু বললেন না। কিন্তু চেদি রাজ্যের রাজা শিশুপাল দারুণ রেগে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, “হে যুধিষ্ঠির, তুমি এটা কী করলে? এ কি ছেলেমানুষি নাকি? এই সভায় এত সব জ্ঞানী, গুণী, প্রাজ্ঞ পুরুষ থাকতে তুমি কৃষ্ণকে পুজো দিলে? কৃষ্ণ কে? সে তো রাজাই নয়। ভীষ্ম যদি তোমাকে এই পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তা হলে বুঝতে হবে, অনেক বয়স হয়েছে তো, তাই ভীষ্মের মতিভ্রম হয়েছে। আরে ভীষ্ম নিজেই তো পুজো পাওয়ার যোগ্য। কিংবা স্বয়ং ঋষি বেদব্যাস এখানে রয়েছেন, কিংবা অস্ত্রগুরু দ্রোণ বা কৃপ। আরও অনেক রাজা এবং মহাবীর কর্ণ, যিনি সমস্ত রাজাদের জয় করেছেন। এঁদের বদলে কৃষ্ণ? তুমি কি আমাদের এখানে ডেকে এনে অপমান করতে চাও?”
কৃষ্ণ মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইলেন।
শিশুপাল কিন্তু থামলেন না। আরও কড়া-কড়া ভাষায় ভীম আর কৃষ্ণের নিন্দে করে যেতে লাগলেন। তা সহ্য করা কঠিন। একবার সহদেব আর একবার ভীম উঠে শিশুপালের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ভীষ্ম তাঁদের থামালেন।
খুব ঘাবড়ে গেলেন যুধিষ্ঠির। তা হলে কি সব কিছু ভন্ডুল হয়ে যাবে? অন্য রাজারাও তো কেউ শিশুপালকে থামাবার চেষ্টা করছেন না। কৃষ্ণই বা নীরব কেন?
ভীষ্ম তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “কুকুর কখনও সিংহের সামনে গিয়ে স্পর্ধা দেখাতে পারে? দ্যাখোই না এর পর কী হয়? কৃষ্ণের উপর ভরসা রাখো।”
একটু পরে যা অবস্থা দাঁড়াল, তাতে মনে হচ্ছে সত্যিই হয়তো এত বড় যজ্ঞের আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ ধরে গালমন্দ করেও কৃষ্ণকে উত্তেজিত করা যাচ্ছে না দেখে শিশুপাল এখানে যুদ্ধ করতে চাইলেন কৃষ্ণের সঙ্গে। আরও বেশ কয়েকজন রাজাও দাঁড়ালেন তাঁর পাশে, সবাই অস্ত্রশস্ত্রে সেজেগুজে প্রস্তুত হল। এই বুঝি যজ্ঞস্থল হয়ে যায় রণক্ষেত্র।
এবার শিশুপাল হেঁকে বললেন, “ওহে জনার্দন (কৃষ্ণের আর-এক নাম), আমি তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছি। আজ তোমাকে আমি যমালয়ে পাঠাব।”
এবার কৃষ্ণ উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর ভাবে সব রাজাদের উদ্দেশ করে বললেন, “আপনারা শুনলেন এই দুর্মতি এতক্ষণ ধরে আমার নামে কত মন্দ কথা বলল? এই শিশুপাল আমার এক পিসির ছেলে। অল্পবয়স থেকেই সে অনেক কুকর্ম করেছে। আমার সঙ্গে শত্রুতা করারও চেষ্টা করেছে। আমাদের রাজ্যে গিয়েও উৎপাত করেছে কয়েক বার। পিসি আমাকে অনুরোধ করেছেন, আমি যেন ওর একশো অপরাধ ক্ষমা করি। আজ সেই একশোতম অপরাধটি ঘটে গেল। ও আমার সঙ্গে যদি যুদ্ধ করতে চায়, তা হলে ওর সেই যুদ্ধসাধ মিটিয়ে দেওয়া যাক।”
এই কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গেই কৃষ্ণ তাঁর চক্র দিয়ে শিশুপালের মাথাটি কেটে দিলেন। যে লোক লড়াই করার জন্য এত তর্জন-গর্জন করছিলেন, তিনি কৃষ্ণের একটি চক্রও সামলাতে পারলেন না।
সমস্ত রাজা একেবারে হতবাক। অনেকেই কৃষ্ণের এই তেজস্বী রূপ আগে দেখেননি। কেউ-কেউ অবশ্য কৃষ্ণকে পছন্দ করেন না। কিন্তু মুখে আর কিছু বলার সাহস পেলেন না।
এর পর যজ্ঞ পরিচালনায় কোনও বিঘ্ন ঘটল না।
এই পুরো উৎসবে সবচেয়ে অসুখী মানুষটি কে? অবশ্যই রাজা দুর্যোধন! এখানে এত জাঁকজমক, কত দেশ থেকে রাজারা এসে বারবার জয়ধ্বনি দিয়েছেন যুধিষ্ঠিরের নামে। দুর্যোধনকে কেউ একবারও পাত্তাও দেননি। আর কী দারুণ রাজসভা বানিয়েছেন পাণ্ডবরা! হস্তিনাপুরের পুরনো রাজসভা এর তুলনায় একেবারে ম্লান।
ঘুরে-ঘুরে সবকিছু দেখতে গিয়ে নাকালও হলেন দুর্যোধন। সম্পূর্ণ স্ফটিকের তৈরি প্রাঙ্গণ দেখে তাঁর মনে হল জলাশয়। তিনি পোশাক সামলাতে গেলেন। আবার সত্যিকারের সরোবরের কাছে গিয়ে ভাবলেন, এটাও নিশ্চয়ই স্ফটিকের তৈরি! তার উপর হাঁটতে গিয়ে তিনি সব পোশাক ভিজিয়ে ফেললেন। পিছন থেকে হাসাহাসি করতে লাগলেন পাণ্ডবরা।
পাণ্ডবদের উপর হিংসায় তাঁর শরীর জ্বলছে, তার উপর এই অপমান! তিনি ফিরে এলেন হস্তিনাপুরে।
দুর্যোধনদের এক মামা আছেন, তাঁর নাম শকুনি। যেমন বুদ্ধি, তেমনই বাকপটু। তিনি দুর্যোধনকে বিমর্ষ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে তোমার?”
দুর্যোধন মাথা নামিয়ে বললেন, “মামা, পাণ্ডবদের এত গৌরব আমার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। তাদের এখন অতুল ঐশ্বর্য আর দারুণ প্রতাপ। তারা যা খুশি করতে পারে, আর আমরা যেন কিছুই না। এই অবস্থা দেখে আমি আর বাঁচতে চাই না। আমি আগুনে পুড়ে কিংবা বিষ খেয়ে কিংবা জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করব।”
শকুনি বললেন, “দুর্যোধন, তুমি শুধু-শুধু মাথা গরম করছ কেন? তুমি আগেও কয়েক বার নানাভাবে যুধিষ্ঠিরদের বিনাশ করতে চেয়েছিল, পারোনি। এখন তুমি তাদের এই রাজ্যের খানিকটা অংশ দিতে বাধ্য হয়েছ। তারা সাজিয়ে-গুজিয়ে নিয়ে নিজেদের অনেক উন্নতি করেছে, এতে তোমার ঈর্ষার কী কারণ থাকতে পারে? তোমারও তো রাজত্ব আছে, তোমার অনেক সুহৃদ আছেন। তুমি এবার আরও রাজ্য জয় করে তোমার ধনদৌলত বাড়াতে পারো।”
দুর্যোধন বললেন, “পাণ্ডবদের আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। ওদের শেষ করতে না পারলে আমার শান্তি হবে না। কালই আমি যুদ্ধযাত্রা করে ওদের রাজ-রাজধানী ধবংস করে দিতে চাই।”
শকুনি বললেন, “এরকম ছেলেমানুষি কোরো না। তোমার পক্ষেও অনেক বড়-বড় বীর আছেন বটে, কিন্তু ভীম, অর্জুন, কৃষ্ণ, দ্রুপদ রাজার ছেলেরা, ওদের পরাজিত করা কিছুতেই সম্ভব নয়। ভীম-অর্জুন দৈব অস্ত্র পেয়েছে শুনেছি। ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে তুমিই বরং বিপদে পড়বে। এই ইচ্ছা ছাড়ো।”
দুর্যোধন বললেন, “তা হলে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। আমি পাণ্ডবদের কাছে কিছুতেই মাথা নিচু করতে পারব না।”
এবার শকুনি বললেন, “যুধিষ্ঠিরের সর্বনাশ করার একটাই উপায় আছে।”
অমনি উৎসাহিত হয়ে দুর্যোধন বললেন, “উপায় আছে? বলুন কী উপায়?”
শকুনি বললেন, “যুধিষ্ঠিরের অনেক গুণ থাকলেও একটি অতি সাংঘাতিক দোষ আছে। ওর খুব পাশার জুয়া খেলার নেশা। কেউ ওকে ডাকলে না বলে না। তা হলে ডাকো যুধিষ্ঠিরকে। তোমার হয়ে আমি খেলব। আর পাশাখেলায় আমিই তো দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ। একবার যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে খেলতে বসলে আমি ওর ধনসম্পদ সব কিছু গ্রাস করে নেব।”
কিন্তু তক্ষুনি তো পাশা খেলার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। আগে ধৃতরাষ্ট্রের মত নিতে হবে। দুর্যোধন বাবাকে এই প্রস্তাব জানাতেই, ধৃতরাষ্ট্র বুঝে গেলেন এর উদ্দেশ্য কী! তিনি বললেন, “পুত্র, যুধিষ্ঠিররাও তো তোমার ভাই। তাদের উপর এত হিংসা করছ কেন? তারা তাদের মতো থাক না। তুমিও তো রাজা, তোমারও ক্ষমতা কিংবা ধনসম্পদ কম নয়। ইচ্ছে করলে তুমি অন্য একটা যজ্ঞ করতে পারো। তাতেও অনেক ধুমধাম হবে। ওসব পাশা খেলাটেলার চিন্তা বাদ দাও।”
কিন্তু দুর্যোধন তা শুনে নিবৃত্ত হলেন না। পাণ্ডবদের এত খ্যাতি, প্রতিপত্তি তাঁর কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। যে-কোনও উপায়ে ওঁদের শেষ করতেই হবে, নইলে তিনি আত্মহত্যা করবেন।
ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয় অনেকটা গ্রীষ্মকালের নদীর মতো। উপরের জল গরম, তলার দিকে ঠান্ডা, একেবারে দু’রকম। এক-এক সময় তিনি বেশ বুঝতে পারেন যে, তাঁর ছেলে কী-কী অন্যায় করছে, পাণ্ডবদের প্রতি কত অবিচার হচ্ছে, কৌরব বংশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তখন তিনি ছেলেকে বকুনি দেন, তার অন্যায় আবদারে প্রশ্রয় দেন না। আবার এক-এক সময় তিনি পুত্রস্নেহে অন্ধ হয়ে দুর্যোধনের অন্যায় আবদারেও রাজি হয়ে যান।
দুর্যোধন অনেকক্ষণ কাকুতি-মিনতি করতেই ধৃতরাষ্ট্র একসময় বললেন, “আচ্ছা, তা হলে সব ব্যবস্থা করো।”
যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলার নেশা, কিন্তু খেলাটা তিনি ভাল জানেন না। তাঁর আবার একটা নীতি আছে, কেউ এই খেলায় তাঁকে আহ্বান জানালে তিনি কিছুতেই তা প্রত্যাখ্যান করবেন না।
কৌরব পক্ষের আমন্ত্রণ পেয়ে রাজা যুধিষ্ঠির তাঁর চার ভাই ও অন্যান্য দলবল নিয়ে চলে এলেন হস্তিনাপুরে।
এই খেলা উপলক্ষে নতুন একটা মণ্ডপ বানিয়ে খুব সুন্দর ভাবে সেটা সাজানো হয়েছে। দুই পক্ষ বসবেন মুখোমুখি, তার চারপাশ ঘিরে বসবেন দর্শকরা।
যুধিষ্ঠির আসন গ্রহণ করার পর দুর্যোধন বললেন, তাঁর বদলে খেলবেন তাঁর মামা শকুনি, তিনি সব বাজি ধরবেন।
যুধিষ্ঠির এতেও রাজি হয়ে গেলেন।