॥ ৯ ॥
দ্রৌপদীকে অঝোরে কাঁদতে দেখে কৃষ্ণ বললেন, “দ্রৌপদী, আমি কৌরবদের কাছে যাচ্ছি। দুর্যোধনরা যদি আমার কথা না শোনে, তা হলে তারা যুদ্ধে নিহত হয়ে শেয়াল-কুকুরের খাদ্য হবে। হিমালয় যদি কেঁপে ওঠে, পৃথিবী যদি শত টুকরো হয়ে যায়, নক্ষত্রসমেত আকাশ ভেঙে পড়ে, তবু আমার কথা ব্যর্থ হবে না। যাজ্ঞসেনী, তুমি আর অশ্রুবর্ষণ কোরো না।”
সদলবলে কৃষ্ণ এলেন হস্তিনাপুরে। প্রথমে গিয়ে প্রণাম করলেন পাণ্ডবদের মা কুন্তীকে, তারপর গেলেন বিদুরের বাড়িতে।
কৃষ্ণ আসবেন বলে সমস্ত রাস্তাঘাট ও রাজসভা সাজানো হয়েছে বিশেষ ভাবে, কৃষ্ণের জন্য রাখা হয়েছে একটি সোনায় মোড়া আসন। কৃষ্ণ যখন সেখানে প্রবেশ করলেন, তখন কৌরবপক্ষের সবাই সেখানে উপস্থিত, আরও রয়েছে বহু দেশের রাজা-রাজপুত্রেরা। সবাই উন্মুখ হয়ে রয়েছেন কৃষ্ণের কথা শোনার জন্য। কৃষ্ণকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেন।
কৃষ্ণও সকলকে সম্মান জানিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন, “মহারাজ, কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে যাতে শান্তি হয়, আমি সেই প্রার্থনা জানাতে এসেছি। আপনাদের কত বড় বংশ, কোনও অন্যায় কাজে প্রশ্রয় দেওয়া আমার উচিত নয়। আপনার ছেলেদের শাসন করুন। দু’ পক্ষে যদি সন্ধি হয়, তা হলে এ রাজ্য এত শক্তিশালী হবে যে, পৃথিবীর আর কোনও দেশ আপনাদের আক্রমণ করতে সাহস পাবে না। এই পক্ষে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণের মতো বীর যোদ্ধারা আছেন, ওঁদের সঙ্গে যদি অর্জুন, ভীম আর পাণ্ডবপক্ষের সবাই যোগ দেন, তা হলে দেবতারাও এঁদের হারাতে পারবেন না। আর যদি এই দু’পক্ষের যুদ্ধ লাগে, তা হলে হয় পাণ্ডবরা কিংবা আপনার লোকেরা নিহত হবেন, তাতে কী লাভ হবে আপনার? আরও কত রাজা ও সৈন্যরা দু’ পক্ষে থাকবে, তাদের প্রায় সবাই মরবে। এত মানুষের জীবন নষ্ট করা কি আপনার কাম্য হতে পারে? আপনি শান্তি চাইলে এই রাজারাও নিজেদের রাজ্যে ফিরে যেতে পারেন। আপনার ছেলেরা পাণ্ডবদের সঙ্গে কত খারাপ ব্যবহার করেছে, পাণ্ডবরা কিন্তু তার কোনও প্রতিশোধ নেয়নি। আপনার আদেশে তারা বারো বছরের বনবাসে গিয়েছে, তারপর এক বছর অজ্ঞাতবাসও ঠিক-ঠিক পালন করেছে। এখন আপনি তাদের রাজ্য ফিরিয়ে দিন।”
একটু থেমে কৃষ্ণ আবার বললেন, “পাণ্ডবরাও আপনার সন্তানের মতো। আপনার কাছেই তারা পালিত হয়েছে। আপনি চাইলে এখনও তারা আপনার সেবা করতে পারে। অথবা তারা যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত। এখন কীসে মঙ্গল হবে, তা আপনি বেছে নিন।”
রাজসভায় সবাই মনে করলেন, কৃষ্ণ ঠিক কথাই বলছেন।
ধৃতরাষ্ট্র অসহায় গলায় বললেন, “কৃষ্ণ, তুমি যা বললে, তাই ধর্মসংগত ও ন্যায্য। কিন্তু আমার ছেলেরা আর আমাকে মানে না। গান্ধারী, ভীষ্ম, বিদুরের উপদেশও দুর্যোধন গ্রাহ্য করে না। তুমি ওকে বোঝাও।”
কৃষ্ণ তখন দুর্যোধনকে বললেন, “পুরুষশ্রেষ্ঠ, তোমার অনেক গুণ আছে। তুমি শাস্ত্রও জানো। এখন যেটা ন্যায়সম্মত, সেটাই করো। তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে বাল্যকাল থেকে অন্যায় ব্যবহার করেছ, তারা সব সহ্য করেছে। যুধিষ্ঠির সবাইকে ক্ষমা করে দেয়। এখন দু’ পক্ষে মিলেমিশে থাকতে পারো না? তুমি যদি যুদ্ধ চাও, তা হলে অর্জুনকে জয় করতে পারবে? দেবতা, গন্ধর্ব, যক্ষরাও অর্জুনের সামনে দাঁড়াতে পারে না, কোন মানুষ তার সমকক্ষ হবে? তোমার জন্য কৌরবরা ধ্বংস হোক, তুমি তাই চাও? এখনও বলছি, তুমি দুর্বুদ্ধি ত্যাগ করো। পাণ্ডবরা তো ধৃতরাষ্ট্রকে মহারাজ আর তোমাকে যুবরাজ বলে মেনে নেবে। তুমি শুধু তাদের রাজ্যের ভাগ দিয়ে দাও। তাতে সকলের শান্তি হোক।”
ভীষ্মও দুর্যোধনকে অনেক উপদেশ দিলেন। তাতে কর্ণপাত না করে উঠে দাঁড়িয়ে অভিমানের সঙ্গে বললেন, “তোমরা সবাই শুধু আমারই নিন্দে করো, পাণ্ডবদের কোনও দোষ দ্যাখো না। পাণ্ডবরা জুয়া খেলায় হেরে গিয়ে বনবাসে গিয়েছে, তাতে আমার কী দোষ? আমাকে যুদ্ধের ভয় দেখিও না। আমাদের দলে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণের মতো মহারথীরা রয়েছেন, এঁদের হারাবার সাধ্য কোনও মানুষেরই নেই। আর যুদ্ধক্ষেত্রে যদি মৃত্যুবরণও করি, সেটাও হবে গৌরবের। শোনো কৃষ্ণ, বাবা বলেছিলেন, পাণ্ডবরা তেরো বছর পর ফিরে এলে পাণ্ডবদেব রাজ্যও ফিরিয়ে দেবেন। তখন আমার বয়স কম ছিল, আমি এ শর্ত মেনে নিয়েছিলাম। এখন আর আমি ওসব মানি না। আমি ওদের কিছু দেব না। এমনকী, সূচ্যগ্র মেদিনীও দিতে রাজি নই।” (সূচ্যগ্র মেদিনী মানে, একটা ছুঁচের ডগায় যেটুকু মাটি ওঠে, সেইটুকু।)
রাগে কৃষ্ণের চোখ দু’টো জ্বলে উঠল, তবু তিনি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য দেখে তুমি হিংসেয় জ্বলে জুয়া খেলার আসর বসিয়ে ওদের হারিয়েছ? তুমি ছাড়া আর কে নিজের ভাইয়ের স্ত্রীকে রাজসভায় এনে অপমান করতে পারে? তুমি, দুঃশাসন আর কর্ণ মিলে কত কুকথা বলেছ তাকে। তুমি জতুগৃহ তৈরি করে কুন্তী আর পঞ্চপাণ্ডবকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিলে, তবু তুমি বলছ, তোমার কোনও দোষ নেই? পাণ্ডবরা নিজেদের বাবার অংশই চাইছেন, তাও তুমি ফিরিয়ে দিতে রাজি নও, তুমি অত্যন্ত পাপী। ঠিক আছে, তুমি যা চাও তাই হবে, শেষ পর্যন্ত সব কিছু হারিয়ে তোমাকে যুদ্ধক্ষেত্রেই শুয়ে থাকতে হবে।”
আরও কিছুক্ষণ বাদানুবাদ হল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত শান্তি বা সন্ধির কোনও আশা দেখা গেল না। বোঝা গেল, যুদ্ধ হবেই হবে। কৃষ্ণ বেরিয়ে এলেন রাজসভা থেকে।
ফেরার পর কৃষ্ণ দেখলেন, পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন কর্ণ। কৃষ্ণ তাঁকে তুলে নিলেন রথে। তারপর দু’জনে গিয়ে বসলেন নির্জন জায়গায়।
কৃষ্ণ কর্ণকে বললেন, “তোমাকে একটা কথা জানাই। তুমি কুন্তীর গর্ভের সন্তান অর্থাৎ তুমি একজন পাণ্ডব। তুমি আজ আমার সঙ্গে চলো, পাণ্ডবরা জানুক যে তুমি তাদের বড় ভাই। তা জানলেই তোমরা পাঁচ ভাই, দ্রোপদীর পাঁচ ছেলে ও অভিমন্যুরা সবাই তোমার চরণবন্দনা করবে। দ্রৌপদীও হবে তোমার স্ত্রী। তুমি হবে পৃথিবীর রাজা। যুধিষ্ঠির হবে যুবরাজ, সে তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে মাথায় চামর দোলাবে, ভীমসেন ছাতা মেলে ধরবে তোমার জন্য, অর্জুন তোমার রথ চালাবে, আর সবাই থাকবে তোমার সঙ্গে। কুন্তীপুত্র, তুমি পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে মিলে রাজ্য শাসন করো, কুন্তীও তোমাকে পেয়ে খুব আনন্দিত হবেন।”
কর্ণ অন্য অনেক সময় চঞ্চল হয়ে থাকেন, কটু কথা বলেন। এখন তিনি শান্ত ও গম্ভীর। ধীর গলায় বললেন, “কৃষ্ণ, তুমি যা বললে, তা আমি জেনেছি। সূর্যদেব আমার পিতা, কুন্তী আমার মা। আমার জন্মের পরেই মা আমাকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। অধিরথ নামে এক সূত আমাকে বাড়িতে নিয়ে যান। তাঁর স্ত্রী আমাকে তাঁর বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছেন। এঁদেরই আমি বাবা-মা বলে শৈশব থেকে জেনেছি। সবাই আমাকে সূতপুত্র বলে জানে, সূতবংশের মেয়েদেরই আমি বিয়ে করেছি। গোবিন্দ, সমস্ত পৃথিবী আর রাশি-রাশি ঐশ্বর্য পেলেও আমি এঁদের ত্যাগ করতে পারব না। লোভেও না, ভয়েও না! দুর্যোধন বরাবর আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করেছে, আমার ভরসাতেই সে অনেকটা যুদ্ধের জন্য উৎসাহী। সে ভাবে, আমিই অর্জুনকে হারাব। এখন আমি তাকে ছেড়ে যেতে পারি? কোনও প্রলোভনেই আমি এত অকৃতজ্ঞ হতে পারব না। তবে তুমি আমাদের আলোচনা গোপন রেখো। যুধিষ্ঠির যদি জেনে ফেলেন যে, আমিও তাঁর অগ্রজ, তা হলে তিনি আর রাজ্য নিতে চাইবেন না। আমাকে দিতে চাইলেও তো আমি তা নেব না, দুর্যোধনকে দিয়ে দেব।”
কৃষ্ণ বললেন “কর্ণ, আমি তোমাকে পৃথিবীর দায়িত্ব দিতে চাইলাম, তুমি তা নেবে না। পাণ্ডবদের জয় হবেই। দুর্যোধন আর তার দলের সবাই নিহত হবে!”
কর্ণ বললেন, “তুমি সব জেনেও কেন আমাকে ভোলাতে চাইছ? আমি তো জানিই যে পৃথিবীর ধ্বংস আসন্ন। দুর্যোধনরা আর আমি তার নিমিত্তমাত্র। আমরা কেউ বাঁচব না। আমি স্বপ্ন দেখেছি, তুমি যেন এই রক্তমাখা পিচ্ছিল পৃথিবীটা ছুড়ে দিচ্ছ, আর একটা মানুষের হাড়ে পাহাড়ের উপর বসে যুধিষ্ঠির সোনার বাটিতে পায়েস খাচ্ছেন। আর কেউ নেই।”
কৃষ্ণ বললেন, “আমার কথা তুমি শুনলে না, তবে অবশ্যই পৃথিবী ধ্বংস হবে।”
কর্ণ কৃষ্ণকে গাঢ় ভাবে আলিঙ্গন করে বললেন, “আশা করি, স্বর্গে আবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে।”
তারপর তিনি চলে গেলেন অন্য দিকে, এর পর চতুর্দিকে রটে গেল যে, একটা মহাযুদ্ধ শিগগিরই শুরু হবে, এই যুদ্ধে জয়-পরাজয় ঠিক হবার আগেই মৃত্যু হবে অসংখ্য মানুষের।
বিদুরকে কুন্তী বললেন, “দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হচ্ছে না, যুদ্ধ হলেও দোষ, না হলেও তো উপায় নেই। আমার ছেলেরা পারবে তো? কৌরবপক্ষে এত বড়-বড় সব যোদ্ধা, দ্রোণ হয়তো তাঁর প্রিয় শিষ্যদের সঙ্গে তেমন ভীষণ ভাবে যুদ্ধ করবেন না, আর পিতামহ ভীষ্মেরও তো পাণ্ডবদের প্রতি স্নেহের ভাব আছে, কিন্তু কর্ণ? তাকে নিয়েই তো আমার বেশি ভয়। সে অর্জুনের চেয়েও বড় যোদ্ধা কি না কে জানে! দুর্যোধন তো তার উপরেই বেশি ভরসা করে। আর সেও পাণ্ডবদের সঙ্গে শত্রুতা করে সব সময়!”
এইসব চিন্তা করতে-করতে আর থাকতে না পেরে পরদিন দুপুরবেলা কুন্তী একা-একা চলে এলেন গঙ্গা নদীর ধারে। সেখানে কর্ণ রোজ তপস্যা করেন কিছুক্ষণ। কুন্তী কর্ণের পিছনে, প্রচণ্ড রোদুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
এই অংশটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ নামে একটি অসাধারণ কবিতা লিখেছেন। যে বাঙালির সন্তান সেই কবিতা পড়েনি, তার জীবনই বৃথা, আমরাও পরে সেই কবিতাটি পড়ে নেব, মুখস্থ করেও ফেলতে পারি।
রবীন্দ্রনাথ সময়টি লিখেছেন সন্ধেবেলা, আসলে কর্ণ তপস্যা করতেন মধ্যাহ্ন গগনের সূর্যের দিকে তাকিয়ে। তাঁর মন্ত্র পড়া শেষ হবার পর তিনি পিছন ফিরে কুন্তীকে দেখতে পেলেন, রোদ্দুরে পুড়ে তাঁর চেহারাটা তখন শুকনো পদ্মফুলের মতো। কর্ণ খুব অবাক হলেও, হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বললেন, “আমি অধিরথ আর রাধার সন্তান, আমার নাম কর্ণ, আমাকে কী করতে হবে, আদেশ দিন।”
কুন্ত্রী বললেন, “না বৎস, তুমি রাধার গর্ভে জন্মাওনি, অধিরথও তোমার বাবা নন। তুমি আমার ছেলে। আমার বিয়ের আগে সূর্যদেবের আশীর্বাদে তোমার জন্ম। তুমি নিজের ভাইদের চেনো না, দুর্যোধনের সেবা করছ, তা মোটেই উচিত নয়। অর্জুন যেসব রাজ্য জয় করেছিল, তা এখন দুর্যোধনরা অন্যায় ভাবে হরণ করে রেখেছে। তুমি পাণ্ডবদের পক্ষে গিয়ে তা হরণ করে নাও। সবাই দেখুক অর্জুন আর কর্ণ পরস্পরের ভাই, তারা একসঙ্গে দাঁড়ালে তাদের সমকক্ষ আর কেউ হতে পারে?”
কর্ণ বললেন, “আপনার কথা শুনে আমার শ্রদ্ধা হচ্ছে না, আপনার অনুরোধও ধর্মসংগত মনে করি না। আপনি আমাকে জন্মের পরই ত্যাগ করে ঘোর অন্যায় করেননি? সারাজীবন আমাকে ক্ষত্রিয় বলে কেউ মানেনি, কত জায়গায় অপমান সহ্য করতে হয়েছে, কোনও শত্রুও কি মানুষের এত ক্ষতি করতে পারে? যথাসময়ে আপনি আমায় দয়া করেননি, এখন নিজের স্বার্থে আপনি আমায় উপদেশ দিতে এসেছেন। কৃষ্ণ আর অর্জুনের মিলিত শক্তির কথা কে না জানে? আমি এখন ওদের দলে যোগ দিলে সবাই বলবে, আমি ভয় পয়ে ওদিকে গিয়েছি। আমি যে পাণ্ডবদের ভাই, তা কেউ জানে না, যুদ্ধের সময় আমি ওদের পাশে দাঁড়ালে সবাই কী ভাববে? ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা সব সময় আমাকে সম্মান করেছে, আমার উপর ভরসা করে তারা যুদ্ধে যেতে চাইছে, এখন আমি তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব? ছিঃ!”
কুন্তীর নিরাশ ও ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে কর্ণ বললেন, “আপনি যা চাইতে এসেছেন, তা একেবারে ব্যর্থ হবে না। অর্জুন ছাড়া আপনার চার ছেলে হাতের কাছে এলেও আমি তাদের হত্য করব না, কথা দিচ্ছি। যুদ্ধ হবে আমার আর অর্জুনের সঙ্গে। হয় অর্জুন আমার হাতে নিহত হবে, অথবা আমি তার হাতে নিহত হয়ে স্বর্গে যাব। অর্জুন অথবা আমি। একজনই বাঁচবে। শেষ পর্যন্ত আপনার পাঁচটি ছেলেই থাকবে।”
কুন্তী তখন কাঁপতে-কাঁপতে এসে কর্ণকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “দৈবের বশে যা হবার তা তো হবেই। অর্জুন ছাড়া অন্য চারজন ভাইকে তুমি অভয় দিয়েছ, এই শপথ যেন মনে থাকে।”
কর্ণ প্রণাম করলেন কুন্তীকে, তারপর দ্রুত চলে গেলেন সেখান থেকে।
এরপর দু’ পক্ষেই শুরু হয়ে গেল যুদ্ধের প্রস্তুতি। হুট করে যুদ্ধ শুরু করা যায় না। রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখে নিতে হয়, বুঝে নিতে হয় এই সময় বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে কিনা। প্রচুর খাদ্য-শস্য সংগ্রহ করে রাখতে হয়। এত সৈন্যসামন্তর প্রতিদিন খাবারদাবারের ব্যবস্থা, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করে রাখা দরকার। রাতে থাকার জন্য খাটাতে হবে অসংখ্য তাঁবু।
দু’ পক্ষকেই সেনাপতি বেছে নিতে হবে। পাণ্ডবপক্ষে অনেক বড়-বড় বীর রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কে হবেন সেনাপতি? অনেক আলোচনার পর ঠিক হল, দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্নকেই সেনাপতি করা যাক, তাতে প্রবীণরা কেউ অসন্তুষ্ট হবেন না। কৌরবদের এত আলোচনার দরকার হল না। ভীষ্ম বয়সে সকলের চেয়ে বড়, সকলের শ্রদ্ধেয়, যোদ্ধা হিসেবেও অসাধারণ, তাই দুর্যোধন তাঁকেই অনুরোধ করলেন। ভীষ্ম রাজি হয়েও বললেন, “বৎস, আমি তোমাদের সঙ্গেই এতকাল আছি, তোমাদের হয়ে যুদ্ধ করব ঠিকই। তবে তোমরা আর পাণ্ডবরা আমার কাছে সমান। পাণ্ডুর ছেলেদের কাউকেই আমার হত্যা করা উচিত নয়, কিন্তু আমি প্রতিদিন অন্তত দশ হাজার পাণ্ডব সৈন্য বধ করব।”
যুদ্ধ শুরুর আগে, কিছু-কিছু নিয়মকানুন ঠিক করা হয়, যা দু’পক্ষই মেনে নেয়। সারাদিন যুদ্ধের পর, সন্ধে হলে, তখন কোনও শত্রুতা থাকবে না। যুদ্ধ হবে সমানে-সমানে, অর্থাৎ রথীর সঙ্গে রথীর, অশ্বারোহীর সঙ্গে অশ্বারোহীর, পদাতিকের সঙ্গে পদাতিকের। নিরস্ত্র লোককে কেউ মারবে না, কেউ যদি যুদ্ধ থামিয়ে ক্ষমা চায়, তাকে ক্ষমা করা হবে, ইত্যাদি। অর্থাৎ বেশ ভদ্রতা, সভ্যতা মেনে যুদ্ধ।
একদিন কৌরব শিবিরে কে কত পরাক্রান্ত বীর, তাই নিয়ে আলোচনা চলছে। রথী, মহারথ, অতিরথ এইরকম ভাবে যোদ্ধাদের বিচার করা হয়। ভীষ্ম সকলের কথাই জানেন, তিনি বললেন, “দুর্যোধন, তুমি ও তোমার ভাইরা সকলে শ্রেষ্ঠ রথী। মদ্ররাজ শল্য পাণ্ডবদের মামা হন, তবু তিনি তোমাদের দলে যোগ দিয়েছেন, তিনি অতিরথ। দ্রোণাচার্য একজন শ্রেষ্ঠ অতিরথ। ইনি দেবতাদের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে পারেন।”
তারপর ভীষ্ম একে-একে অন্য রাজাদের কাউকে মহারথ, কাউকে অতিরথ বলতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনি দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার এই বন্ধুটি, কর্ণ, যে সব সময় গর্ব করে কথা বলে, সে অতিরথ নয়, পূর্ণ রথীও নয়। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে ওকে আর বেঁচে ফিরে আসতে হবে না। আমার মতে, ও অর্ধরথ।”
যে-কোনও কারণেই হোক, ভীষ্ম কোনও দিনই কর্ণকে সুনজরে দেখেন না। তাঁর মতো মহাবীরকে অর্ধরথ বলা তো দারুণ অপমান করা। কর্ণ দ্রোণাচার্যের শিষ্য নন, তাই দ্রোণাচার্য কর্ণকে পছন্দ করেন না, যখন-তখন খোঁচা মারেন। তিনিও বললেন, “হ্যাঁ, ভীষ্ম তো ঠিকই বলেছেন, কর্ণের তেজ আছে, আবার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়েও যায়। ও দয়ালু আর অসাবধান, ওকে তো অর্ধরথই বলা উচিত।”
অসম্ভব রাগে জ্বলে ওঠেন কর্ণ। তিনি বললেন, “পিতামহ, আপনি বিনা দোষে আমাকে কুকথা বলেন, দুর্যোধনের জন্যেই আমি তা সহ্য করি। আপনি কৌরবদলের মধ্যে কাউকে বড়, কাউকে ছোট বলে ভেদ সৃষ্টি করছেন। আপনি আসলে কৌরবদের শত্রুতাই করতে চান। দুর্যোধন, তুমি এঁকে হঠাও! বৃদ্ধ লোকদের কথা শোনা উচিত। কিন্তু খুব বেশি বৃদ্ধ লোকদের নয়, তখন তারা ছেলেমানুষের মতো হয়ে যায়।”
ভীষ্ম তারপরেও কর্ণের বিরুদ্ধে তড়পে উঠলেন।
তখন কর্ণ চেঁচিয়ে উঠলেন, “এই আমি প্রতিজ্ঞা করছি, ভীষ্ম যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন আমি যুদ্ধ করব না। এঁর মৃত্যু হলে তবেই আমি বিপক্ষের সমস্ত বীরদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরব।”
এ কী সাংঘাতিক কথা! অনেকটা কর্ণের ভরসাতেই দুর্যোধন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চেয়েছেন। সেই কর্ণ থাকবেন যুদ্ধের বাইরে? তাতে তো পাণ্ডবদেরই লাভ হল। যুদ্ধ শুরু হবার আগেই ভীষ্ম আর দ্ৰোণ পাণ্ডবদের সাহায্য করলেন এতখানি! তবে কি ওঁরা দু’জন ইচ্ছে করেই কর্ণকে অমন রাগিয়ে দিলেন?
ভীষ্মও আর কর্ণকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন না, কর্ণও অটল রইলেন তাঁর প্রতিজ্ঞায়।
পরদিন সকালে দু’ পক্ষের সৈন্যসামন্তরাই স্নান করে, শুদ্ধ বস্ত্র পরে, পুজো ও ধ্যান সেরে নিয়ে চলে এল কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে। মাঝখানে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে দু’ পক্ষ দাঁড়াল মুখোমুখি। দু’ দিকেই পরিচিত বীরপুরুষরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়েছেন সামনের সারিতে। শুধু কর্ণ কোথাও নেই।
একটু পরেই শুরু হবে মহারণ।