॥ ১০ ॥
দু’পক্ষেই ভেরি আর শাঁখ বাজালে যুদ্ধ শুরু হয়। সেসব বেজেও উঠল, তবু একটাও অস্ত্র বিনিময় হল না। সকলে চুপ। কারণ, মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায় অর্জুনের রথ এসে দাঁড়িয়েছে। সেই রথের সারথি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। সকলে অবাক হয়ে ভাবছে, এ কী করছেন অর্জুন? যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তো ওখানে আসার নিয়ম নেই।
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, “প্রিয় বন্ধু, দেখে নাও কাদের সঙ্গে তোমায় যুদ্ধ করতে হবে। অনেকেই মহাবীর, তবু তোমার সমকক্ষ কেউ নয়। তুমিই শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে।”
অর্জুনের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। সারা শরীর কাঁপছে। তিনি খসখসে গলায় বললেন, “এ কী কথা বলছ তুমি? ও পক্ষে রয়েছেন আমার অনেক শ্রদ্ধেয় আর আত্মীয়রা। ভীষ্ম আমার পিতামহ, তিনি বাল্যকাল থেকে আমায় আদর করেছেন, তাঁর সঙ্গে আমি যুদ্ধ করব আর মারব? অস্ত্রগুরু দ্রোণ, ইনি প্রথম থেকেই আমার প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। এমন-এমন সব গোপন অস্ত্র ব্যবহার শিখিয়েছেন, যে অস্ত্র কেউ জানে না। এখন আমি তাঁকে মারতে যাব? এত অকৃতজ্ঞ মানুষ হয়। আরও কতজন রয়েছেন আমার আত্মীয় কিংবা ভাইয়ের মতন, তাঁরা আমরা তো একই বংশের মানুষ, এই যুদ্ধে সেই বংশটাও ধ্বংস হয়ে যাবে। না, না, আমি এই যুদ্ধে যোগ দিতে পারব না, তাতে যদি আমরা হেরেও যাই, তাতে কোনও দুঃখ নেই। এমনকী, আমায় কেউ মেরে ফেলতে চাইলেও মারুক। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুই তো সবচেয়ে গৌরবময়।”
অর্জুনের হাত থেকে খসে পড়ল তাঁর তির-ধনুক, তিনি মুখ নিচু করে রইলেন।
কৃষ্ণ বললেন, “এসব কী বলছ, পার্থ? এখানে তোমার এমন দুর্বলতা দেখানো মোটেই শোভা পায় না। তুমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে যেতে চাইলে লোকে তোমাকে ক্লীব বলবে। (অর্থাৎ যে পুরুষও নয়, নারীও নয়।) শোনো, মানুষ হচ্ছে মরণশীল প্রাণী। বাচ্চা বয়স, তারপর কৈশোর-যৌবন, তারপর বার্ধক্য, এর পরেও কী থাকে, মৃত্যু! এ তো কেউ আটকাতে পারে না। সে কবে মরবে, তা আমিই ঠিক করে রাখি, আমিই কাল। আমি ওদের আগেই মেরে রেখেছি। এতে তোমার কোনও দায়িত্ব নেই, তুমি নিমিত্ত মাত্র। আরও শোনো অর্জুন, কর্মেই মানুষের অধিকার, তার ফলাফল নিয়ে চিন্তা করা ঠিক নয়।”
এর পরেও অর্জুন অনেক প্রশ্ন করতে লাগলেন কৃষ্ণকে। আর কৃষ্ণও উত্তর দিতে লাগলেন বুঝিয়ে-বুঝিয়ে। তাতে অনেকটা সময় লাগে, সারাদিনই কেটে যেতে পারে। কিন্তু দু’ পক্ষের সৈন্যদের দাঁড় করিয়ে রেখে কৃষ্ণ ও অর্জুন সারাদিন ধরে এই আলোচনা করবেন, সেটা ঠিক সত্যি বলে মনে হয় না।
আমার ধারণা, এখানে অর্জুনকে যা-যা বলা হল, তা বেশ সংক্ষেপেই সারতে হয়েছে। বাকি সবটা আলোচনা করা হয়েছে যুদ্ধের ঠিক আগে কিংবা পরে। মহাভারতের এই অংশটাকে বলা হয় গীতা। সেটা আলাদা বই হিসেবেও পাওয়া যায়। অনেক হিন্দুর মতে, এই গীতা তাদের প্রধান ধর্মের বই। তবে অনেক হিন্দুই এ বই পড়েনি কিংবা পড়লেও মানে বোঝেনি। বইখানি নিজেদের কপালে ঠেকিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।
আমরাও আপাতত এই অংশটা এড়িয়ে যেতে চাই।
রথের উপর বসে অর্জুন আর কৃষ্ণ কী কথা বলছেন, তা তো অন্য কারও শোনার কথা নয়। মাত্র দু’জন শুনতে পেয়েছেন।
অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র নিজের ঘরে দুরুদুরু বক্ষে বসে আছেন। এই ভয়ংকর যুদ্ধে দু’ পক্ষের অনেকেই মরবে আর তাঁদের এত বড় বংশটা যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তাও তিনি বুঝেছেন।
কিছুক্ষণ আগে ঋষি ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি এই মহারণ নিজের চোখে দেখতে চাও? তা হলে আমি কিছুদিনের জন্য তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পারি। তুমি সব কিছু দেখতে পাবে।”
ধৃতরাষ্ট্র তক্ষুনি বললেন, “না, না, না, আমি দেখতে চাই না। আমার কত প্রিয়জন, পাণ্ডবদেরও আমি ভালবাসি আর আমার ছেলেরা আমার অবাধ্য হলেও তো ওরা আমারই সন্তান। যুদ্ধক্ষেত্রে মরবে, তা আমি সহ্য করতে পারব না। চাই না দৃষ্টিশক্তি।”
বেদব্যাস বললেন, “দেখতে না চাও, শুনতে চাও কি? আমি একটি ছেলেকে এনেছি, তার নাম সঞ্জয়। খুব মেধাবী। ওকে আমি বর দিয়েছি, ও বহু দূরের সব কিছু দেখতে পাবে, শুনতে পাবে। ও সব সময় থাকবে তোমার পাশে।”
ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধের দৃশ্য দেখতে না চাইলেও এখন দারুণ আগ্রহ নিয়ে সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। তারপর কী হল? তারপর কৃষ্ণ অর্জুনকে অত কথা শোনাবার জন্যে কী করলেন, কোথায় গেলেন?
সঞ্জয় বললেন, “অর্জুন এখন উত্তপ্ত হয়ে উঠে যুদ্ধে যোগ দিতে প্রস্তুত। শ্রীকৃষ্ণ রথটা নিয়ে গেলেন পাণ্ডবদের শ্রেণির দিকে। সকলে তো যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়েই আছে। যুধিষ্ঠিরও বর্ম পরে, যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত হয়ে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বসে আছেন একটা রথে। এবার তিনি ভেঁপু বাজালেই শুরু হয়ে যাবে লড়াই।”
এই কথা বলতে-বলতেই সঞ্জয় খুব অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললেন, “এ কী, এ কী, যুধিষ্ঠির এ আবার কী করছেন?”
ধৃতরাষ্ট্রও ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল? কী হল? কী করল যুধিষ্ঠির?”
এই সব কাহিনি যিনি শোনাচ্ছেন, সেই সৌতি থেমে গিয়ে একটু পরে শ্রোতা মুনি-ঋষিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হে মান্যবরগণ, আমি তো অনেকটাই মহাভারত কথা শুনিয়েছি আজ। এখন আপনারা বিশ্রাম নিন। আবার কাল সকালে শুরু করা যাবে।”
তারপর ধৃতরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে সঞ্জয় বললেন, “মহারাজ, বুঝতেই পারছি, আপনি ক্লান্ত। আপনার বিশ্রামের দরকার। আজ এই পর্যন্তই থাক। কাল আবার সবই শোনাব।”
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “না, আমি মোটেই ক্লান্ত হইনি। আমার বিশ্রামেরও দরকার নেই। যুদ্ধ শুরু হবে আজ, আর তুমি কাল শোনাবে সেই বাসি খবর? না, না, না, তুমি অন্তত আজ সন্ধে পর্যন্ত সব কিছু আমাদের জানাও।”
সমস্ত মুনি-ঋষিও চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “আমরা শুনতে চাই। আজই কী-কী ঘটছে সব জানাও।”
তখন সৌতি বললেন, “তা হলে এর পরের কিছুটা আমার চেয়ে সঞ্জয়ই ভাল বলতে পারবেন। মহামুনি বেদব্যাসের বরে সঞ্জয় সব কিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখতে পারবেন, আমার তো সে ক্ষমতা নেই।”
সঞ্জয় বললেন, “হ্যাঁ, আমি বলতে রাজি আছি। ঋষির বরে আমার একটুও ক্লান্তি বোধ হয় না। আমি এখন যা দেখছি, তা-ই বলে যাচ্ছি। আপনারা শুনেছেন যে, যুধিষ্ঠির যুদ্ধসাজে বসে আছেন। এবার তিনি ভেঁপু বাজালে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। অনেকেই আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারছে না।
“তারপর হঠাৎই দেখছি, যুধিষ্ঠির তাঁর যুদ্ধের সাজ খুলে ফেলছেন। সরিয়ে দিচ্ছেন সব অস্ত্রশস্ত্র। রথ থেকে নেমে খালি পায়েই ছুটতে লাগলো দু’ পক্ষের মাঝখানে খোলা জায়গায়।”
তাঁর ভাইয়েরা, পাণ্ডবপক্ষের বড়-বড় যোদ্ধারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। যুধিষ্ঠির কী করতে চাইছেন? অর্জুন আর ভীম তাঁর কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করলেন, “মহারাজ, এ কী করছেন? আমাদের সঙ্গে না থেকে কেন আপনি ছুটে যাচ্ছেন শত্রুপক্ষের দিকে?”
যুধিষ্ঠির তার কোনও উত্তর না দিয়ে ছুটতে লাগলেন আরও জোরে। তখন তাঁর ভাইয়েরা, বড়-বড় রাজারাও দৌড়তে লাগলেন তাঁর পিছু-পিছু।
দু’ পক্ষের কেউ-ই ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না। পাণ্ডবপক্ষে সকলে নীরব। আর কৌরবপক্ষের কিছু-কিছু যোদ্ধা এই দৃশ্য দেখে ঠাট্টাইয়ার্কি আর রসিকতা শুরু করে দিল। কেউ-কেউ বলতে লাগল, “এ তো দেখছি পাণ্ডবপক্ষের রাজা না কুলাঙ্গার? এত ভয় পাচ্ছেন কেন? ওঁদের পক্ষে তো অনেক ভাল-ভাল যোদ্ধা রয়েছেন। আছেন ভীম আর অর্জুন, তবু কি ভয়ে আত্মসমর্পণ করতে আসছেন? তবে বোধ হয় যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয় বংশে জন্মাননি।”
যুধিষ্ঠির এসে থামলেন কৌরবপক্ষের সেনাপতি, মহাবীর ভীষ্মের রথের কাছে। হাত জোড় করে তিনি বললেন, “পিতামহ, আমরা বাধ্য হয়ে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমেছি। আপনি দয়া করে আমাদের অনুমতি দিন আর আশীর্বাদ করুন।”
ভীষ্ম একটুক্ষণ যুধিষ্ঠিরের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “প্রিয় বৎস, তুমি যদি যুদ্ধ শুরুর আগে এভাবে আমার সম্মতি নিতে না আসতে, তা হলে আমি অভিশাপ দিতাম, তোমরা হেরে যাবে, এখন তোমার এই সৌজন্যবোধ দেখে খুশি হয়ে বলছি, তোমরা সব নিয়ম মেনে যুদ্ধ করো, তোমাদেরই জয় হবে। দ্যাখো, মানুষ অর্থের দাস, কিন্তু অর্থ কারও দাস নয়। কৌরবরা আমাকে অর্থ দিয়ে এমন ভাবে বেঁধেছে যে, ওদের পক্ষ নিয়েই আমাকে কাপুরুষের মতন যুদ্ধ করতে হবে। এখন কি তুমি কোনও বর চাও?”
যুধিষ্ঠির পিতামহের পা ছুঁয়ে বললেন, “আপনি কৌরবদের হয়েই যুদ্ধ করুন আর আমাদের মন্ত্রণা দেবেন। সেটাই যথেষ্ট।”
ভীষ্ম বললেন, “আমাকে তো তোমাদের বিরুদ্ধে লড়তেই হবে। তুমি কী মন্ত্রণা চাও, এখন বলো। আমি সাধ্যমতন তা জানাতে চেষ্টা করব।”
যুধিষ্ঠির বললেন, “ঠাকুরদা, কোনও যুদ্ধেই আপনি হারেন না, অথচ আপনাকে হারাতে না পারলে আমাদের পক্ষে এ যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভবই নয়। আপনাকে আমরা কীভাবে হারাতে পারি?”
ভীষ্ম বললেন, “যুদ্ধে আমাকে হারিয়ে দিতে পারে, এমন তো কাউকে দেখি না। এমনকী, স্বয়ং ইন্দ্রও আমাকে হারাতে পারেননি।”
যুধিষ্ঠির তখন এমন একটা প্রশ্ন করলেন, যা পৃথিবীর যে-কোনও যুদ্ধে দু’ পক্ষের কেউ কখনও করে না।
যুধিষ্ঠির ভীষ্মের দিকে চেয়ে বললেন, “আপনাকে যুদ্ধে হারানো অসম্ভব। তা হলে বলে দিন, আপনাকে কীভাবে হত্যা করতে পারব?”
ভীষ্ম বললেন, “আমাকে কেউ হারাতেও পারবে না, মারতেও পারবে না। এখন আমার মৃত্যুকালও আসেনি। যাও, গিয়ে যুদ্ধ করো, কয়েক দিন পর এসো আমার কাছে।”
ভীষ্মের কাছ থেকে বিদায় নিয়েও কিন্তু যুধিষ্ঠির ফিরে গেলেন না। এবার তিনি সদলবলে গেলেন অস্ত্রগুরু দ্রোণের কাছে। তাঁকেও যথারীতি প্রণাম ও সম্মান জানিয়ে যুধিষ্ঠির সেই একই প্রশ্ন করলেন তাঁকে।
অস্ত্রগুরুও সেই একই ভাবে বললেন, “তুমি যদি আমার অনুমতি নিতে না আসতে, তা হলে আমি তোমাকে অভিশাপ দিতাম। এখন আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি, তুমি নির্ভয়ে যুদ্ধ করে যাও এবং জয়ী হও। মানুষ অর্থের দাস, কিন্তু অর্থ কারও দাস নয়। কৌরবরা অর্থ দিয়ে আমাকে বেঁধে রেখেছে। তাই তোমাদের পক্ষে গিয়ে আমার যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। তোমার কি অন্য প্রার্থনা আছে? বলো। আমি সাধ্যমতন তা পূরণ করার চেষ্টা করব।”
যুধিষ্ঠির বললেন, “আপনাকে যুদ্ধক্ষেত্রে হারিয়ে দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। আপনি আমাদের জয়ী হওয়ার আশীর্বাদ দিলেন। আপনাকে না হারাতে পারলে আমরা জয়ী হব কী করে? কী উপায়ে আপনাকে বধ করতে পারি?”
দ্রোণ বললেন, “আমি যুদ্ধক্ষেত্রে যদি হঠাৎ রেগে যাই, অস্ত্রবর্ষণ শুরু করি, তখন আমাকে বধ করতে পারে, এমন তো কাউকে দেখি না। তবে আমি যদি কোনও কারণে অস্ত্র পরিত্যাগ করে অজ্ঞানের মতন হয়ে যাই, তখনই আমাকে কেউ বধ করতে পারে।”
যুধিষ্ঠির এবার গেলেন আর-এক অস্ত্রগুরু কৃপের কাছে। সেখানে একই কথা বলে উত্তরও পেলেন আগের দু’জনেরই মতন। তবে কৃপ অমরত্বের বর পেয়েছেন আগেই, সুতরাং তাঁকে হত্যা করা যাবে না। তাঁকে অন্য ভাবে আটকে রাখতে হবে।
এর পর যুধিষ্ঠির গেলেন মদ্রদেশের রাজা শল্যর কাছে। তাঁকেও প্রণাম ও সম্মান জানিয়ে যুধিষ্ঠির সেই একই কথা বললেন।
এই শল্য আবার পাণ্ডবদের সম্পর্কে মামা। আগেই তিনি দুর্যোধনের পক্ষে লড়বেন বলে কথা দিয়ে ফেলেছেন। তিনি বললেন, “বৎস যুধিষ্ঠির, আমি চাই তোমরা এই যুদ্ধে জয়ী হবে। কৌরবপক্ষের দুর্যোধন অর্থ দিয়ে আমাকে বেঁধে ফেলেছেন। তাই কৌরবপক্ষেই আমাকে লড়তে হবে। তুমি আর কী সাহায্য চাও বলো।”
যুধিষ্ঠির বললেন, “আপনি কৌরবপক্ষেই যুদ্ধ করুন। তবে আপনি কি একটা ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবেন?”
মহাবীর শল্য বললেন, “কী সাহায্য চাও, শুনি।”
যুধিষ্ঠির বললেন, “মামা, আপনি যদি যুদ্ধের মধ্যে নানারকম কথা বলে কর্ণের শক্তি আর তেজ খানিকটা কমিয়ে দিতে পারেন, তাতেই আমাদের যথেষ্ট উপকার হবে।”
শল্য উদার ভাবে বললেন, “সে তো আমি করতেই পারি। বারবার ওর মনোযোগ ভেঙে দেব। এখন যাও, নিশ্চিন্ত হয়ে যুদ্ধ শুরু করো।”
এখানে একটা ব্যাপারে আমার বেশ খটকা লেগেছে। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ আর শল্য, প্রত্যেকেই টাকার কথা বলছেন কেন? এঁরা কেউই গরিব নন। শল্য তো একটা রাজ্যের রাজা। দুর্যোধন কি এঁদের অনেক টাকা দিয়ে বেঁধে ফেলেছেন? প্রথম তিন জনের কথার অন্য একটা মানে হতে পারে, এঁরা বহু বছর ধরে কৌরব রাজত্বে থেকেছেন। ‘তাই নুন খাই যার, গুণ গাই তার’ এই প্রবাদের মতন এঁরা অকৃতজ্ঞ হতে চাননি, তাই এই যুদ্ধেও তাঁরা এই পক্ষেই থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু শল্যর ব্যাপারে তাও নয়, তিনি স্বাধীন রাজা, তিনিও কেন বলবেন টাকার কথা? তা হলে কি সেই কালেও টাকা দিয়ে বড়-বড় যোদ্ধাদের কিনে রাখা যেত? এর কোনও উত্তর নেই। এর আগেও আমরা দেখেছি যে, কয়েকটা ঘটনার ঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, ধাঁধার মতন মনে হয়।
যাই হোক, এর পর আর কারও কাছে গেলেন না যুধিষ্ঠির। নিজের রথে ফিরে আবার যুদ্ধের সাজপোশাক পরতে লাগলেন।
এখন যুদ্ধ শুরু করতে আর কোনও বাধা নেই।
তবু যুধিষ্ঠির উঠে দাঁড়িয়ে খুব উঁচু গলায় কৌরবদের দিকে চেয়ে বললেন, “তোমাদের মধ্যে যদি এমন কেউ থাকে, যে এই অন্যায় যুদ্ধে আমাদের পক্ষে থাকতে চায়, তা হলে চলে এসো এদিকে, আমরা তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বরণ করে নেব। কেউ আসবে?”
একটুক্ষণ সকলে নীরব।
তারপর একজন সৈনিক কৌরবপক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে যুধিষ্ঠিরকে বলল, “হে মহারাজ, আমি এই যুদ্ধে তোমার পক্ষেই থাকতে চাই। আমি যথাসাধ্য যুদ্ধ করব কৌরবদের বিরুদ্ধে।”
সকলে অবাক হয়ে বলল, “এ তো ধৃতরাষ্ট্রেরই এক ছেলে। দুর্যোধনের আপন ভাই। এর নাম যুযুৎসু।”
যুধিষ্ঠির দু’ হাত বাড়িয়ে বললেন, “এসো, এসো ভাই, তোমাকে এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে যুদ্ধের জন্য বরণ করে নিচ্ছি।”
সঞ্জয় বোধ হয় এই দৃশ্যটার কথা ধৃতরাষ্ট্রকে বলেননি। তা হলে তিনি আরও ভেঙে পড়তেন।
তিনি বললেন, “এ কী, সকলে এত চুপচাপ কেন? এখনও যুদ্ধ শুরু হয়নি? প্রথম তিরটা কে ছুড়ল?”
সঞ্জয় বললেন, “ঠিক বোঝা গেল না। খুব সম্ভবত আপনার দ্বিতীয় ছেলে দুঃশাসন। সে ছুটতে ছুটতে ভীষ্মের কাছে এসে আরও অনেকে মিলে ভীষ্মকে ঘিরে ধরে এগোতে লাগল পাণ্ডবদের দিকে।”
আগেই ঠিক হয়ে আছে যে, রথে চড়ে যিনি যুদ্ধ করবেন, তার বিরুদ্ধে লড়তে আসবেন অন্য পক্ষের এক রথী। পায়ে হাঁটা সৈন্যদের সঙ্গে লড়বে অন্য পদাতিকরা। অর্থাৎ যুদ্ধ হবে সমানে-সমানে। অবশ্য সব সময় এই নিয়মা সম্ভব নাও হতে পারে।
এ রকম সামনাসামনি যুদ্ধে এক-একদিন এক-একজনের তেজ বেশি জ্বলে ওঠে। যুদ্ধ শুরু হতে না-হতেই ভীম এমনই হিংস্র হয়ে উঠলেন যে, দূর থেকে তাঁকে দেখেই অনেকে পালাতে শুরু করল। অর্জুনের ছেলে অভিমন্যু আর ভীমের ছেলে ঘটোৎকচকে এর আগে কেউ যুদ্ধ করতে দ্যাখেনি। আজ বোঝা গেল, এরা দু’জনেই খুব বড় যোদ্ধা। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ল অনেকখানি প্রান্তর জুড়ে। পাণ্ডবরা এক বছর অজ্ঞাতবাসের সময় যে রাজ্যে লুকিয়ে ছিলেন, সেই রাজ্যের রাজকুমার উত্তর একবার কী করেছিলেন, তা আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই। কৌরবরা সেই রাজ্য আক্রমণ করলে উত্তর অনেক হম্বিতম্বি করেছিলেন, তারপর যুদ্ধক্ষেত্রে এসে অন্য পক্ষের বড়-বড় যোদ্ধাকে দেখেই ভয়ের চোটে পালাতে চেয়েছিলেন। এখন দেখা গেল, এর মধ্যে তিনি অনেক কিছু শিখে নিয়েছেন, যুদ্ধ করছেন প্রবল বিক্রমে। তাঁর এক ভাই শ্বেতও খুব তেজস্বী যোদ্ধা। এই দুই ভাই মিলে রণক্ষেত্রে শত্রুপক্ষকে ভয়ে কাঁপিয়ে দিতে লাগলেন। শ্বেত একসময় মহারথী ভীষ্মের সঙ্গেও মুখোমুখি যুদ্ধ করতে এলেন।
কৌরবদের সৈন্যবাহিনী পাণ্ডবপক্ষের চেয়ে অনেকটাই বেশি। ভীষ্ম বলে রেখেছেন, তিনি প্রত্যেকদিন পাণ্ডবপক্ষের অন্তত দশ হাজার সৈন্যকে যমের বাড়ি পাঠাবেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি এমন লড়াই শুরু করলেন, যা অন্য পক্ষের কারও প্রতিরোধ করার সাধ্য নেই। ভীষ্ম একসঙ্গে অনেক বাণ চালাতে-চালাতে সারা আকাশই ঢেকে দিলেন। তখন বোঝা গেল না যে, ভীষ্ম অত বৃদ্ধ বা তাঁর শরীরে একটুও দুর্বলতা আছে।
ভীষ্মকে আটকাবার জন্য একসময় অর্জুন চলে এলেন তাঁর সামনে। দু’জনেই তুমুল ভাবে চালাতে লাগলেন সংগ্রাম। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, ভীষ্মও চান না অর্জুনকে মেরে ফেলতে আর অর্জুনও চান না পিতামহকে নিজের হাতে নিহত করতে। অথচ দু’জনের মধ্যে একজন নিহত না হলে এ লড়াই শেষ হবে কী করে? দু’জনেই মাঝে-মাঝে আকাশ দেখতে লাগলেন। কখন সন্ধে নামবে? একটু পরেই মুছে গেল দিনের আলো। বেজে উঠল শঙ্খ, ভেরি, দুন্দুভি, তাতেই বোঝা গেল যে, আজকের মতন যুদ্ধ শেষ।
সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “মহারাজ, প্রথম দিনে আপনাদের পক্ষই কিছুটা জয়ী হয়েছে বলা যায়। কৌরবদের মধ্যে কোনও বীরই প্রাণ দেননি, পাণ্ডবপক্ষে কিন্তু হারাতে হয়েছে উত্তর আর শ্বেত নামে দুই রাজকুমারকে। তাঁরা রণক্ষেত্রে বীরের মতন প্রাণপণে যুদ্ধ শুরু করে প্রাণ দিয়েছেন।”
সন্ধেবেলায় যুদ্ধ শেষ হলে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে যেখানে-সেখানে শুয়ে পড়ে, কেউ-কেউ স্নান করতে যায়, খিদের জ্বালায় পেট পুড়ছে, শুরু হয়ে যায় খাদ্য পরিবেশন।
কয়েকজন বড়-বড় পাণ্ডবদলের যোদ্ধা মিলে আড়ালে বসে আলোচনা করেন সেদিনের যুদ্ধ নিয়ে। কী-কী ভুল হয়েছিল, কোথায় তাঁদের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
যুধিষ্ঠিরের প্রধান ভয় কর্ণকে নিয়ে। তাঁর দৃঢ় ধারণা, একমাত্র কর্ণই পারেন অর্জুনকে হারিয়ে দিতে। কর্ণ এখনও আসেননি, কর্ণকে চটিয়ে দিয়ে ভীষ্ম তাঁকে সেনাবাহিনীর বাইরে রেখেছেন, তাতে পাণ্ডবদেরই উপকার হয়েছে। কিন্তু এখন সেই ভীষ্মই পাণ্ডবদলের প্রধান শত্রু। সেই বৃদ্ধ যে এতটা দাপটের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, তা কেউ ভাবেইনি। এখন ভীষ্মকে সরিয়ে দিতে না পারলে জয়ের কোনও আশা নেই। তবে একটা ব্যাপার সকলে লক্ষ করেছে, বড়-বড় বীরেরা যখন একসঙ্গে যুদ্ধ চালায় ভীষ্মের সঙ্গে, তখন সেই দলে অংশ নেন শিখণ্ডী নামে দ্রুপদ রাজার এক ছেলে। একমাত্র তাঁকে দেখলেই ভীষ্ম যেন কিছুটা দুর্বল হয়ে যান। তার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ না করে ভীষ্ম চলে যান অন্যদিকে।
কেন? এবার সেই গল্পটা শুনে নিতে হবে।