॥ ৩ ॥
যযাতি মহাশক্তিশালী রাজা। অনেক যুদ্ধ তিনি জয় করেছেন। আবার ভাল-ভাল খাদ্য, আনন্দ-ফুর্তিও পছন্দ করেন খুব। যখন যুদ্ধটুদ্ধ থাকে না, সেই সময় তিনি দলবল নিয়ে শিকার করতে বেরোন।
সেদিনও শিকার তাড়া করতে-করতে এক জায়গায় এসে তিনি শুনতে পেলেন, কোথায় যেন একটি মেয়ে কাঁদছে। কিন্তু এদিক-ওদিক তাকিয়ে তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না। কী আশ্চর্য, কান্নার শব্দটা আসছে কোথা থেকে?
অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেছেন বলে রাজার তেষ্টাও পেয়েছে খুব। একটু দূরে একটা কুয়ো দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলেন, কান্নার শব্দটা আসছে ওই কুয়োর মধ্যে থেকে। একটি মেয়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে বলছে, “উঃ, আর পারছি না, বাঁচাও, বাঁচাও আমাকে!”
যযাতি উঁকি দিয়ে দেখলেন, সে কুয়োতে জল নেই, তলায় বসে আছে একটি ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে।
যযাতি অবাক হয়ে বললেন, “কে তুমি? উঠে দাঁড়াও, একটা হাত উঁচু করো, আমি ধরছি।”
দেবযানী ডান হাতটা তুলতেই রাজা তাকে ধরে টেনে তুললেন উপরে।
রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কে? তোমার এই অবস্থা হল কী করে?”
কান্না থামিয়ে দেবযানী বলল, “আমি দৈত্যদের গুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে। ওই দৈত্যদের রাজকন্যা আমাকে এই কুয়োর মধ্যে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।”
রাজা যযাতি আর কিছু শুনতে চাইলেন না। তৃষ্ণায় তাঁর গলা শুকিয়ে গিয়েছে। মেয়েটিকে বললেন, “তোমার হাত-পা কিছু ভাঙেনি তো? এবার বাড়ি যাও?”
তিনি জলের খোঁজে চলে গেলেন সেখান থেকে।
দেবযানীর হাত-পা কিছু ভাঙেনি বটে, কিন্তু অপমানে, রাগে, দুঃখে, অভিমানে তার মন ভেঙে গিয়েছে। সে আর বাড়ি ফিরতে চাইল না, বসে রইল সেইখানেই।
কিন্তু একসময় তো বাড়িতে তার খোঁজ পড়বেই। কোথায় গেল দেবযানী? কয়েকজন তাকে খুঁজতে বেরোল। তাদের মধ্যে এক দাসী সেই কুয়োর ধারে দেখতে পেল তাকে। সে গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে আর কান্না গড়াচ্ছে তার দু’ চোখ দিয়ে।
দাসী ব্যাকুল ভাবে দেব্যানীকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে চাইলে সে বলল, “না, আমি যাব না। তুই বাবাকে গিয়ে বল, রাজার মেয়ে শর্মিষ্ঠা আমার এই দশা করেছে। আমি ওই রাজার রাজ্যে আর পা দেব না। এখানেই না হয় মরব।”
দাসীর মুখে এ-কথা শুনেই ছুটে এলেন শুক্রাচার্য সেখানে৷
দেবযানী প্রথমে বাবার বুকে মাথা দিয়ে আবার কাঁদল। তারপর আস্তে-আস্তে জানাল সব ঘটনা।
শেষকালে সে বলল, “বাবা, আমার সবচেয়ে অপমান হয়েছে কোন কথা শুনে জানো? ওই মেয়েটা বলেছে, তুমি নাকি ওর বাবার পায়ের কাছে বসে থাকো। তুমি নাকি রাজার অন্নদাস, রাজা দয়া না করলে আমরা নাকি খেতেই পাব না। এসব যদি সত্যি হয়, তা হলে আমি আর বাঁচতে চাই না।”
সব শুনে শুক্রাচার্য একটুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “না রে মা, ওসব সত্যি নয়। দেবতা কিংবা দানব সকলে আমার ব্ৰহ্মাতেজের কথা জানেন। আমি মৃত মানুষদের বাঁচাতে পারি, আবার সব কিছু ধ্বংসও করে দিতে পারি। মানুষের উপকারের জন্য আমি বৃষ্টি নামাই, গাছপালাগুলো সতেজ হয়। দৈত্যদের রাজা আমাকে খুবই সম্মান করেন, তাই আমি এখানে আছি। ওই মেয়েটি ঝগড়া করে রাগের মাথায় যেসব বলেছে, তা একেবারেই সত্যি নয়। ও নিয়ে তুই আর মাথা ঘামাস না। ওকে ক্ষমা করে দে। মনের মধ্যে রাগ পুষে রাখতে নেই। বরং ক্ষমা করলেই শান্তি পাওয়া যায়।”
দেবযানী বলল, “আমি ওসব বুঝি না। আগে ওরা ক্ষমা চাইবে, তারপর তো আমরা ক্ষমা করব কিনা ভেবে দেখব। ওরা যদি ক্ষমা না চায়, তা হলে আমি কিছুতেই আর ও রাজ্যে যাব না। বরং এখানে মরব, তাও ভাল।”
মেয়েকে কিছুতেই শান্ত করতে না পেরে শুক্রাচার্য চলে এলেন রাজসভায়। রাজা বৃষপর্বাকে বললেন, “রাজন, তোমার লোকরা আমার শিষ্য কচকে বারবার মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে, সেটা খুবই অন্যায়, তবু আমি তোমাকে কিছু বলিনি। এখন তোমার মেয়ে শর্মিষ্ঠা আমার মেয়ে দেবযানীকে চরম অপমান করেছে, আমার সম্পর্কেও বলেছে যে, আমি নাকি তোমার অন্নদাস। এর পর আর আমার এ রাজ্যে থাকা চলে না। আমি চললাম।”
ভয়ে কেঁপে উঠলেন দানবরাজ। দেবতারা মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র পেয়ে গিয়েছেন, এখন তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে ওঠা যাচ্ছে না। এর পর যদি শুক্রাচার্য চলে যান, তা হলে মহাবিপদ হবে।
হাতজোড় করে কারস্বরে অসুররাজ বললেন, “গুরুদেব, এ আপনি কী বলছেন? এই রাজ্যের যত ধনসম্পত্তি সব কিছুই আপনার অধীন। আমিও আপনার সেবক। আমার অবুঝ মেয়ে কী বলছে না বলেছে, তা আপনি গ্রাহ্য করবে না।”
শুক্রাচার্য বললেন, “ওসব বললে তো হবে না। তুমি আমার মেয়েকে শান্ত করতে পারবে কিনা দ্যাখো। নইলে তার সঙ্গে আমি এ রাজ্য ছেড়ে অবশ্যই চলে যাব।”
রাজা বৃষপর্বা তক্ষুনি সদলবলে বনের মধ্যে গিয়ে দেবযানীর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “এই তোমার সামনে বলছি, এই রাজ্যের সব কিছু তোমার বাবার অধীন। তুমি আমার মেয়েকে আর আমাকে ক্ষমা করো।”
দেবযানী তবু চুপ করে রইল।
বৃষপর্বা আবার বললেন, “সেজন্য তুমি যা চাও, পৃথিবীর যে- কোনও জায়গা থেকে আমি তোমার জন্য এনে দিতে পারি।”
দেবযানী এবার বলল, “আমি চাই, শর্মিষ্ঠা আজ থেকে আমার দাসী হয়ে থাকবে, তার সঙ্গে আরও অনেক অসুরকন্যা দাসী হয়ে এসে আমার সেবা করবে। আমি যেখানে যাব, তারাও আমার সঙ্গে যাবে।”
বৃষপূর্বা বললেন, “তাই হবে। আমি এক্ষুনি শর্মিষ্ঠাকে পাঠাচ্ছি।”
বাবার আদেশ শুনে শর্মিষ্ঠা তা অমান্য করতে সাহস পেল না। সে বুঝতে পারল, রাগের মাথায় দেবযানীকে কুয়োয় ফেলে দেওয়া অন্যায় হয়েছে। এখন শুক্রাচার্য যদি এ রাজ্য ছেড়ে চলে যান, তা হলে তার বাবা ও দেশবাসীর মহাক্ষতি হবে।
শর্মিষ্ঠা হয়ে গেল দেবযানীর দাসী।
এর পর দেবযানী যখন জঙ্গলে নাচ-গান করতে যায়, তার সঙ্গে- সঙ্গে আসে শর্মিষ্ঠা ও অন্য দাসীরা। দেবযানীই এখন রানির মতন।
একদিন আবার সেই বনের মধ্যে এসে পড়লেন এক রাজা, সঙ্গে দলবল। দেবযানী দেখামাত্র চিনতে পারল, এই সুপুরুষ রাজাই তাকে উদ্ধার করেছিলেন কুয়ো থেকে। রাজা যযাতি কিন্তু দেবযানীকে ঠিক চিনতে পারলেন না। অল্প কিছুক্ষণের জন্য দেখেছিলেন তো।
দেবযানীই এগিয়ে গিয়ে আলাপ করল রাজার সঙ্গে। জানাল সেদিনের কথা। দাসীদের সে আদেশ করল, রাজাকে ফলমূল-জল দেওয়ার জন্যা।
এর পর রাজা কয়েকদিন তাঁবু গেড়ে রইলেন সেখানে। দেবযানীর সঙ্গে তাঁর খুব ভাব হয়ে গেল। দেবযানীর সঙ্গে রাজার বিয়েও হল, তিনি তাকে নিয়ে গেলেন নিজের রাজধানীতে। সঙ্গে শর্মিষ্ঠা আর অন্য দাসীরাও গেল।
সেকালে একজন পুরুষ মানুষের দু’-তিনটি বউ থাকতে পারত। এখন আর ওসব হয় না। সেকালের রাজারা আবার ইচ্ছে করলে দু’শো-তিনশো জন মেয়েকেও বিয়ে করতে পারতেন। কখনও একজন মেয়েকে বিয়ে করলে তার দাসীরাও আপনাআপনিই বউয়ের মতো হয়ে যেত।
সেই হিসেবে শর্মিষ্ঠাও হল যযাতির এক স্ত্রী। কিন্তু তার রাজপুরীতে স্থান হল না। দেবযানীর আদেশে অশোকবনে একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে দেওয়া হল শর্মিষ্ঠার জন্য।
কয়েক বছর পরে দেবযানীর দু’টি ছেলে জন্মাল আর শর্মিষ্ঠার ছেলে হল তিনটি। এর মধ্যে দেবযানীর সঙ্গে শর্মিষ্ঠার মাঝেমধ্যেই ঝগড়া হত, এবার সে খুব রেগে গেল। সে পাটরানি, তার ছেলে হল দু’টি আর দাসী শর্মিষ্ঠার একটি বেশি। রাজা কি শর্মিষ্ঠাকে বেশি ভালবাসছেন? রাজার ব্যবহারও যেন কেমন-কেমন!
রাগে, দুঃখে কাঁদতে-কাঁদতে দেবযানী নালিশ জানাল বাবার কাছে গিয়ে। শুক্রাচার্য খুব বিরক্ত হয়ে রাজাকে অভিশাপ দিলেন, “তুমি আমার মেয়ের উপর অবিচার করেছ। আজ থেকে তুমি বুড়ো হয়ে যাও। তুমি আর কিছুই করতে পারবে না।”
অমন সুন্দর, সুঠাম চেহারা যযাতির, সেই মুহূর্তে তিনি একেবারে থুত্থুড়ে বুড়ো হয়ে গেলেন। শুক্রাচার্যের কাছে ক্ষমা চাইবারও সময় পেলেন না।
কয়েকটা দিন রাজা খুব মনমরা হয়ে রইলেন। তাঁর মনটা তো বুড়ো হয়নি, শরীরটাই শুধু অথর্ব হয়ে গিয়েছে। অথচ এখনও তাঁর অনেক কিছু করার ইচ্ছে।
অভিশাপ দেওয়ার পর শুক্রাচার্য বলেছিলেন, রাজার আগেকার চেহারা ফিরে পাওয়ার একটাই উপায় আছে। যদি অন্য কেউ নিজের আয়ু ও যৌবন ধার দিতে চায়, তা হলে রাজা আবার যুবক হতে পারবেন, আর যে আয়ু দেবে, সে বুড়ো হয়ে যাবে।
রাজা তাঁর সব ছেলেদের ডাকলেন। প্রথমে বড় ছেলে যদুকে ডেকে বললেন, “শোন, তুই কয়েকটা বছরের জন্য তোর যৌবন আমাকে দিবি? আমার অনেক কাজ বাকি আছে। আরও অনেক কিছু ভোগ করতে ইচ্ছে করে। এর বদলে তুই যা চাইবি, তাই-ই দেব।”
যদু তা শুনেই বলল, “না, না, আমি এক্ষুনি বুড়ো হতে যাব কেন? আমার বুঝি ভাল-ভাল খাবার খেতে আর ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে না? বুড়ো হলে সেসব কিছুই পারব না। আমাকে এই অনুরোধ করবেন না।”
যযাতি তখন তাঁর অন্য ছেলেদেরও এই একই অনুরোধ করতে লাগলেন। চার ছেলেই বলল, তারা অল্পবয়সে বুড়ো হতে রাজি নয়। একেবারে ছোটছেলে, শর্মিষ্ঠার পুত্র পুরু কিন্তু এই কথা শোনামাত্র রাজি হয়ে গেল। তারপরেই পুরু হয়ে গেল বৃদ্ধ আর বাবা যযাতি তক্ষুনি হয়ে গেলেন অল্পবয়সি যুবক।
সেই অবস্থায় যযাতি মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। আর পুরু অসুস্থ বুড়োদের মতো শুয়ে থাকে খাটে।
এইভাবে কেটে গেল বেশ কয়েক বছর।
মহাভারতে কথায়-কথায় এক হাজার বছর, দশ হাজার বছর বলা হয়ে থাকে। তা বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি। আমরা তো এখন জানি, মানুষ অতদিন বাঁচে না। তাই শূন্যগুলো কয়েকটা কমিয়ে দিতে হবে।
ধরা যাক, বছর দশেক বাদে রাজা যযাতি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। যত ইচ্ছে খাওয়াদাওয়া, ভোগবিলাসিতা, শিকার আর ভ্রমণের পর যযাতি বুঝলেন, মানুষের কোনও কিছুতেই তৃপ্তি হয় না। সবসময় মনে হয়, আরও চাই, আরও চাই। এই চাওয়ার যেন শেষ নেই। আবার এর মধ্যে একঘেয়েমিও এসে পড়ে।
তাই যযাতি একদিন পুরুর কাছে এসে বললেন, “পুত্র, আমি তোমাকে তোমার যৌবন ফিরিয়ে দিতে এসেছি। আমি যথেষ্ট ভোগ করেছি, আমার আর কিছু চাই না। আমি সিংহাসন ছেড়ে চলে যাব। আজ থেকে তুমিই হবে রাজা!”
রাজার এই ঘোষণা শুনে মন্ত্রীটন্ত্রি প্রত্যেকেই আপত্তি জানালেন। নিয়ম অনুযায়ী বড়ছেলেরই রাজা হওয়ার কথা।
কিন্তু যযাতি কারও কথা শুনলেন না। বড় ছেলে কিংবা আর কোনও ছেলেই তাঁর কথা শোনেনি। একমাত্র পুরুই বিনা বাক্যে বাবার ইচ্ছে পূরণ করেছিল। পুরুই তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। পুরুর মাথায় তিনি পরিয়ে দিলেন রাজমুকুট। আর পুরুও তখন থেকে হয়ে গেল আগেকার মতো যুবক। বৃদ্ধ হয়ে গেলেন যযাতি।
এর পরেও যযাতি অনেক কাণ্ড করেছেন। সে সবে আর আমাদের দরকার নেই।
পুরু বেশ শান্তশিষ্ট রাজা ছিলেন। তাঁর আমলে তেমন কোনও গল্প নেই। তবু তাঁর কথা বলতে হয় বিশেষ কারণে। মহাভারতের মূল গল্প কৌরব আর পাণ্ডবদের নিয়ে। তাদের কথা বলতে দেরি হয়ে যাবে। যযাতি আর পুরুর বংশেই সেই কৌরব আর পাণ্ডবদের জন্ম।
পুরুর বংশে পরপর কয়েকজন রাজা তেমন কিছু বিখ্যাত হননি। তারপর এক রাজা হলেন, তাঁর নাম দুষ্মন্ত। তিনি খুব বিখ্যাত। তাঁকে নিয়ে একটা চমৎকার গল্প আছে।
তখনকার দিনে বনের মধ্যে অনেক মুনি-ঋষির আশ্রম থাকত। সেইরকমই ছিল কণ্ব নামের এক মুনির আশ্রম। ভারী সুন্দর সেই আশ্রমের পরিবেশ। সেখানে হরিণ, ময়ূররা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ তাদের কিছু বলে না। সেখানে রাজাদেরও শিকার নিষেধ। এমনকী, সেখানে কেউ একটা গাছের ডালও ভাঙে না।
রাজা দুষ্মন্ত একবার শিকারে বেরিয়ে একটা হরিণকে তাড়া করতে-করতে পৌঁছে গেলেন সেই আশ্রমের কাছে। সেখানকার সুন্দর গাছপালা আর ফুল-ফল দেখে রাজা বুঝতে পারলেন, এটা একটা আশ্রম, এখানে শিকার করা উচিত নয়। তিনি তাঁর সৈন্যসামন্তদের সেখানেই অপেক্ষা করতে বললেন। আর নিজে পায়ে হেঁটে ঢুকলেন আশ্রমের মধ্যে।
এইসব আশ্রমকে বলে তপোবন। কয়েকটা কুটিরের মধ্যে থাকেন আশ্রমের মানুষজন। রাজা সেই তপোবনের শোভা দেখতে-দেখতে একটা কুটিরের সামনে দাঁড়ালেন। এ পর্যন্ত কোনও মানুষজন তাঁর চোখে পড়েনি। কণ্বমুনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে অন্য কোথাও গিয়েছেন। ওই কুটিরে রয়েছে কণ্বমুনির পালিতা কন্যা শকুন্তলা। তার মতো রূপসি মেয়ে এ পৃথিবীতে আর নেই বললেই চলে। রাজার ডাক শুনে বেরিয়ে এল শকুন্তলা।
আমরা এই গল্পটা একটু সংক্ষেপে শুনব। নইলে আসল গল্পে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। মহাকবি কালিদাস মহাভারতের এই কাহিনিটা নিয়ে আলাদা একটা নাটক লিখেছেন। তার নাম ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’। তাতে মহাভারতের ঘটনার চেয়ে আরও অনেক কিছু আছে, আর তা অতি চমৎকার। সারা পৃথিবীতেই এই নাটকটি বিখ্যাত। আমরা পরে সেই বই পড়ে নেব।
মোট কথা, এরপরে শকুন্তলার সঙ্গে বিয়ে হল রাজা দুষ্মন্তের। তাঁদের এক সন্তান জন্মাল, তার নাম ভরত। এই ভরত বিশাল রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। তাঁর বংশধরদের নিয়েই শুরু হবে আমাদের আসল গল্প।
এই বংশের এক রাজার নাম কুরু। তিনিও খুব বড় রাজা। কুরু বংশধরদের বলে কৌরব। আমাদের আসল গল্পের চরিত্ররাও সকলেই ছিল কৌরব। পরে তারা দু’ ভাগে ভাগ হয়ে যায়।
কৌরব বংশে কয়েক পুরুষ বাদে এলেন আর-এক রাজা। তাঁর নাম শান্তনু। এই বার আসল গল্পের শুরু।
অন্য অনেক রাজার মতো শান্তুনুও শিকার করতে ভালবাসেন খুব। তিনি এখনও বিয়ে করেননি, তাই রাজপুরীতে তাঁর মন টেকে না। কোনও মেয়েকেই তাঁর পছন্দ হয় না বিয়ের জন্য। শিকার নিয়েই মও হয়ে থাকেন।
রাজা শান্তনু একদিন শিকার করতে-করতে পৌঁছে গেলেন এক নদীর ধারে। জলে নেমে জল খেতে গিয়ে একদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কাছেই বসে আছে একটি ফুটফুটে মেয়ে। যেমন তার সুন্দর পোশাক, তেমনি তার অপরূপ রূপ। শান্তনুর মনে হল, তিনি এমন সুন্দর মেয়ে আগে কখনও দেখেননি।
তিনি কাছে এসে মেয়েটিকে নরম ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ? এখানে বসে আছ কেন?”
মেয়েটি মৃদু-মৃদু হেসে বলল, “এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমি কি এমনিই বসে থাকতে পারি না?”
রাজা বললেন, “তোমাকে দেখে আমি খুবই মুগ্ধ হয়েছি। তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তা হলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমি এদেশের রাজা, আমার নাম শান্তনু।”
মেয়েটি বলল, “আপনার কথা জানি। আপনার অনেক গুণ, আপনি ভালমানুষ, আপনি কারও উপর জোর করেন না। আপনাকে আমি বিয়ে করতে রাজি আছি। কিন্তু আপনাকে আমার একটা শর্ত মানতে হবে।”
রাজা ব্যগ্র ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “কী শর্ত বলো?”
মেয়েটি বলল, “আপনি আমার পরিচয় জানতে চাইবেন না! আপনার রানি হয়ে আমি সব সময় আপনার সেবাযত্ন করব। তবে আমার কোনও কাজে আপনি বাধা দিতে পারবেন না। যদি বাধা দেন, তা হলেই কিন্তু সেদিন আমি চলে যাব। কোনওমতেই আমাকে আটকাবার চেষ্টা করতে পারবেন না।”
রাজা এতই মুগ্ধ যে, সেই শর্তেই রাজি হয়ে গেলেন।
সেই রহস্যময়ী মেয়েটি রাজা শান্তনুর রানি হয়ে চলে এলেন রাজপুরীতে।
তাঁর যেমন সুন্দর রূপ, তেমনই সুন্দর ব্যবহার। সকলে তাঁকে ধন্য-ধন্য করে। রাজার সেবাযত্নেরও কোনও ত্রুটি করেন না রানি।
এক বছর কেটে যাওয়ার পর সেই রানির একটি পুত্রসন্তান হল। তখন তিনি একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। সদ্য জন্মানো শিশুটিকে কোলে নিয়ে তিনি নদীর জলে ফেলে দিলেন!
শিউরে উঠলেন রাজা। কোনও মা কি তার সন্তানকে ইচ্ছে করে জলে ডুবিয়ে দিতে পারে? ওইটুকু বাচ্চা, ও তো এক্ষুনি মরে যাবে।
রাজা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তাঁর মনে পড়ল শর্তের কথা। তিনি তো বাধা দিতে পারবেন না।
পরের বছরও সেই একই ব্যাপার। আবার একটা ছেলে, আবার রানি তাকে ফেলে দিলেন নদীতে। রাজার বুক দুঃখে-কষ্টে ভরে গেলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না। রানির আর কোনও দোষ নেই, শুধু এই নিষ্ঠুর কাণ্ডটির কোনও কারণই বোঝা যায় না।
এইরকম ভাবে পরপর সাতটি ছেলে জন্মাবার পরেই ডুবে গেল নদীতে।
আট বারের বার যখন আবার একটি ছেলে হল, রানি তাকেও নিয়ে চললেন নদীর দিকে, তখন রাজা শান্তনু আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি রানির সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকে বললেন, “রানি, তোমার এত গুণ, তবু তুমি এই নিষ্ঠুর কাজটি কেন করো? মা হয়ে কেউ কি সন্তানকে মেরে ফ্যালে? আমার একটি ছেলেও বেঁচে থাকছে না, তাতে যে কষ্টে আমার বুক ভেঙে যায়, তা কি তুমি বুঝতে পারো না? এই ছেলেকে আমি মরতে দেব না!”
রানি হেসে বললেন, “রাজা, আপনি শর্ত ভঙ্গ করেছেন। আমি তো আর থাকতে পারব না। আমি চলে যাচ্ছি। আপনি এই ছেলেটিকে রাখতে চান, রাখুন। এ ছেলের জন্য আপনার বংশ ধন্য হবে।”
রাজার কোলে শিশুটিকে দিয়েই রানি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
এবার তো সকলের মনে হবেই, কে ওই রহস্যময়ী রমণী।
আমাদের দেশে সবচেয়ে যে পবিত্র নদী, তার নাম গঙ্গা। এই গঙ্গা নদী আসলে এক দেবীর অংশ, সেই দেবীর নামও গঙ্গা নদী, তিনি থাকেন স্বর্গে।
তিনি পৃথিবীতে এই অদ্ভুত কাণ্ডটি করলেন কেন?
স্বর্গে দেবতাদের মধ্যেও কয়েকটি শাখা আছে। একটি শাখার নাম বসু।
আমরা ছেলেবেলায় এক-দুই-তিন সংখ্যা মুখস্থ করার জন্য একটি ছড়া বলতাম। এখন বোধ হয় সেই ছড়াটি শেখানো হয় না। ছড়াটা এইরকম: এক-এ চন্দ্র, দুই-এ পক্ষ, তিন-এ নেত্র, চার-এ চতুর্বেদ, পাঁচ-এ পঞ্চবাণ, ছয়ে ঋতু, সাত-এ সমুদ্র, আট-এ অষ্ট বসু, নয়ে নবগ্রহ, দশ-এ দিক। এর মানে হল চাঁদ একটা, মাসে দু’টি পক্ষ, অর্থাৎ অমাবস্যা আর পূর্ণিমা, তিন-এ নেত্র, এটা বোঝা একটু শক্ত। আমাদের তো দু’টো চোখ। নেত্র মানে চোখ। কিন্তু কোনও-কোনও দেবতার তিনটে চোখ থাকে। শিবঠাকুরের মূর্তি কিংবা ছবির কপালে একটা চোখ আঁকা থাকে। আর আমাদের প্রধান গ্রন্থ বেদ-এর চারটে ভাগ। আর মদন নামে একজন দেবতার আছে পঞ্চবাণ। আর আমাদের ঋতু তো ছ’টা, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্ত। পৃথিবীতে বড়-বড় সমুদ্র সাতটা। আর অষ্ট বসু মানে বসু আট জন। নবগ্রহ মানে আকাশে সূর্যের ন’টি গ্রহ। আর দিক হচ্ছে দশটি, পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ ইত্যাদি।
আকাশের দেবতারা মাঝে-মাঝে পৃথিবীতে বেড়াতে আসতেন। এই আটজন বসুও বউদের সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে এসে একটা কুকীর্তি করেছিলেন।
সেকালের ঋষিদের মধ্যে খুব বড় একজন ঋষি ছিলেন বশিষ্ঠ। তিনি মহাজ্ঞানী ও গুণী তো বটেই, এমনিতেও ভালমানুষ। সহজে রাগতেন না। কিন্তু রাগলে তিনি সাংঘাতিক অভিশাপ দিতে পারতেন।
তাঁর আশ্রমে একটি গোরু ছিল, তার নাম সুরভি। আর-এক নাম নন্দিনী। এ রকম গোরু সারা পৃথিবীতে আর একটাও ছিল না। সেই সুরভি ইচ্ছে করলে দশ হাজার লোকেরও খাদ্য-পানীয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। গোরুটিকে দেখতেও অপূর্ব।
আট জন বসু তাঁদের বউদের নিয়ে বেড়াতে এসে বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে সুরভিকে দেখতে পেলেন। দ্যু নামে একজন বসুর স্ত্রী ওই নন্দিনীকে দেখে আবদার করলেন, “ওই অসাধারণ গোরুটা আমাদের চাই। নিয়ে চলো না!”
দ্যু দেখলেন, সামান্য একজন ঋষির আশ্রম, বাধা দেওয়ার কেউ নেই। গোরুটিকে নিয়ে তো যাওয়াই যায়। বউয়ের আবদার মেটাবার জন্য অন্য বসুদের বললেন সেই কথা। তাঁরাও রাজি। তাঁরা তো জানেন না, এর আগে একবার বিশ্বামিত্র, তখনও তিনি ঋষি হননি, রাজা ছিলেন, ওই সুরভিকে জোর করে নিয়ে যেতে গিয়ে কী বিপদেই না পড়েছিলেন! সেবারই তিনি বুঝেছিলেন যে, রাজাদের চেয়েও ঋষিদের শক্তি কত বেশি। তারপর থেকেই বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠার জন্য জেদ ধরেছিলেন।
বশিষ্ঠ ঋষি তখন আশ্রমে ছিলেন না। বসুরা সহজেই সুরভিকে ধরে নিয়ে গেলেন। বশিষ্ঠ ফিরে এসে যোগবলে সব জানতে পারলেন। তিনি তো সুরভিকে ফিরিয়ে আনলেনই, তা ছাড়া বসুদের তিনি অভিশাপ দিলেন, ওই বসুদের এবার পৃথিবীতে জন্মাতে হবে, এখানকার সব দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হবে।
বসুদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
স্বর্গে কতরকম আনন্দ, সেখানে কতরকম আরাম, ইচ্ছেমতো সবরকম খাবার পাওয়া যায়। বয়স বাড়ে না। তার বদলে পৃথিবীতে কখনও খুব শীত, কখনও গরম, কত অসুবিধে। এখানে কাটাতে হবে সারাজীবন?
তাঁরা এসে বশিষ্ঠমুনির কাছে কেঁদে পড়লেন। নিজেদের দোষ স্বীকার করে তাঁরা ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলেন।
নরম মন ঋষি বশিষ্ঠের। ততক্ষণে তাঁর রাগ পড়ে গিয়েছে। তিনি বললেন, অভিশাপ তো আর ফেরানো যায় না। তবে স্বর্গের কোনও দেবী যদি পৃথিবীতে এসে তাঁদের জন্ম দেন আর তারপরেই জলে বিসর্জন দেন, তা হলে আর তাঁদের পৃথিবীতে থাকতে হবে না।
বসুরা তখন স্বর্গে গিয়ে গঙ্গাদেবীকে কাকুতি-মিনতি করে পৃথিবীতে এসে তাঁদের মা হতে রাজি করালেন।
সেইজন্যই গঙ্গাদেবী পৃথিবীতে এসে রাজা শান্তনুর রানি হয়েছিলেন। আর সন্তানদের নদীতে বিসর্জন দিয়েছিলেন।
কিন্তু একটি সন্তান যে রয়ে গেল?
হাঁ, এঁর নাম দ্যু, এই বসুই স্ত্রীর আবদারে প্রথম সুরভিকে হরণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এঁর দোষই সবচেয়ে বেশি। সুতরাং এঁকে পৃথিবীতে থেকে যেতে হবে। অবশ্য আগেকার কথা তাঁর মনে থাকবে না।
রানি চলে গেলেন, শান্তনু এই ছেলেটিকে রেখে দিলেন। এর নাম দিতে দেবব্রত।
এই সন্তানটির যেমন তেজ, তেমনই বীরত্বপূর্ণ দেহ। যেমন যুদ্ধবিদ্যায়, তেমনই সর্বশাস্ত্রে শিক্ষিত হল সে।
এই দেবব্রত মহাভারত কাহিনির অন্যতম প্রধান চরিত্র। তিনি না থাকলে মহাভারতের অনেক ঘটনাই ঘটত না।
আর রাজার পর রাজার বংশের পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই৷ রাজা শান্তনু ও রাজকুমার দেবব্রত! এঁদের নিয়েই আসল গল্প শুরু হয়ে গিয়েছে।
রাজকুমার দেবব্রত যেমন রূপবান, তেমনি তাঁর গুণেরও শেষ নেই। সব রাজকুমারকেই তো যুদ্ধবিদ্যা শিখতে হয়, দেবব্রত সবরকম অস্ত্রচালনায় আর সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠলেন। দেবব্রতর আবার পড়াশোনায় খুব মাথা। তখনকার দিনে যত শাস্ত্র ছিল, তাও তিনি জেনে নিলেন গুরুদের কাছে। অর্থাৎ এই রাজকুমার যেমন জ্ঞানী, তেমনি বীর।
এঁকে নিয়ে রাজা শান্তনুর গর্বের শেষ নেই। শান্তনুর পরে দেবব্রতই হবেন রাজা, তাই তাঁর নাম যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া হল।
তারপরেই হল একটা কাণ্ড!
রাজা শান্তনুর মনে যতই সুখ থাকুক, একটা দুঃখও ছিল। তাঁর যে কোনও রানি নেই। গঙ্গা তো চলে গিয়েছেনই অনেক আগে। রাজা সেইজন্যই মাঝে-মাঝে একা-একা ঘুরে বেড়ান।
একদিন তিনি যমুনা নদীর ধারে এক জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে-ঘুরতে কীসের যেন গন্ধ পেলেন। ভারী সুন্দর গন্ধ, কোথা থেকে গন্ধটা আসছে? খুঁজতে-খুঁজতে রাজা দেখলেন, নদীর ঘাটে একটা নৌকোর উপর বসে আছে একটি মেয়ে। তার গা থেকেই কোনও অচেনা ফুলের তীব্র গন্ধ ভেসে আসছে সব দিকে।
খুব অবাক হয়ে শান্তনু তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কে? এখানে বসে আছ কেন?”
মেয়েটি বলল, “আমার নাম সত্যবতী। আমি ধীবরকন্যা। আমার এই খেয়ানৌকোয় আমি মানুষদের এপার-ওপার করি।”
ধীবর মানে যারা মাছ ধরে। এখন যাদের বলে জেলে। তাদের গায়ে মাছ-মাছ গন্ধ হয়। তাই রাজা আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার গায়ে এত সুন্দর গন্ধ হল কী করে?”
সত্যবতী বলল, “এক ঋষি একদিন আমার এই নৌকোয় যাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে বর দিয়েছেন।”
পৃথিবীর আর কোনও মেয়ের গা থেকে তো এত সুন্দর গন্ধ বেরোয় না। আর সত্যবতীকে দেখতেও বেশ সুশ্রী। তাই রাজা ঠিক করলেন, তিনি এই মেয়েটিকেই বিয়ে করবেন।
তক্ষুনি রাজা গিয়ে দেখা করলেন সত্যবতীর বাবার সঙ্গে।
দেশের রাজা স্বয়ং এসে একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছেন, তা শুনে তো যে-কোনও মেয়ের বাবাই দারুণ আনন্দিত হন। এই ধীবরও খুশি হলেন ঠিকই, কিন্তু এঁর স্বার্থবুদ্ধিও খুব প্রখর।
তিনি হাত কচলাতে-কচলাতে বললেন, “মহারাজ, আপনি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছেন, সে তো আমাদের পক্ষে মহাসৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আমার একটা প্রার্থনা আছে। আপনি আগে কথা দিন, তাতে রাজি হবেন?”
রাজা তো ইচ্ছে করলে যে যা চায়, সবই দিতে পারেন। তবু তিনি বললেন, “আগে তোমার প্রার্থনা শুনি, তার আগে কথা দেব কী করে?”
ধীবর বললেন, “মহারাজ, আমার প্রার্থনা এই যে, বিয়ের পরে আপনাদের যে সন্তান হবে, আমার মেয়ের সেই সন্তানই হবে আপনার পরে এই দেশের রাজা!”
শান্তনুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এ কী অদ্ভুত প্রার্থনা!
কুমার দেবব্রত তাঁর এত প্রিয়, সে-ও সব দিক থেকে যোগ্য। তাকে যুবরাজ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, তাঁর পরে সে-ই হবে রাজা। তার বদলে অন্য কারও কথা ভাবা যায়? অসম্ভব!
শান্তনুর মুখখানা ম্লান হয়ে গেল, তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “না। আমি এ প্রার্থনা মানতে রাজি নই। দরকার নেই এ বিয়ের।”
শান্তনু ইচ্ছে করলে ধীবরের কথা অগ্রাহ্য করে জোর করে সত্যবতীকে বিয়ে করার জন্য নিয়ে যেতে পারতেন। রাজারা তো এ রকম করেই থাকেন। কিন্তু এই রাজা অত্যন্ত ভদ্র এবং সভ্য, তিনি সেরকম কিছু করলেন না। ফিরে গেলেন রাজধানীতে।
মেয়েটিকে তাঁর খুবই পছন্দ হয়েছিল। তাই কয়েক দিন মনখারাপ করে শুয়ে রইলেন, কারও সঙ্গে কথা বললেন না।
মন্ত্রীরা সব খবর পেয়ে যান। কী হয়েছে, তা তাঁরা জেনে গেলেও এই সময় রাজাকে বিরক্ত করতে সাহস করলেন না।
কয়েক দিন বাদে কুমার দেবব্রতও লক্ষ করলেন, বাবা কয়েকদিন রাজকার্যে মন দিচ্ছেন না, বাইরে আসছেন না।
“কী ব্যাপার?” তিনি মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন।
মন্ত্রী বললেন, “কুমার, আপনার পিতার যে কারণে মন খারাপ, তা দূর করার কোনও উপায়ই নেই। বরং কয়েকটা দিন যাক, হয়তো আস্তে-আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।”
দেবব্রত তবু আসল কারণটা জানার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন।
সব শুনে তিনি বললেন, “ও, এই ব্যাপার। আপনারা চলুন তো আমার সঙ্গে এক্ষুণি।”
মন্ত্রী ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে সদলবলে রাজকুমার দেবব্রত চলে এলেন সেই ধীবরের বাড়িতে।
ধীবরকে নমস্কার জানিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে কুমার দেবব্রত বললেন, “আপনি আমার পিতার কাছে কী প্রার্থনা করেছিলেন, তা আমি শুনেছি। আপনি যা চেয়েছেন, তাই-ই হবে। এখানে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে আমি শপথ করছি, আমি কোনও দিন রাজ্যের রাজা হতে চাই না। কোনও দিন সিংহাসনে বসব না। আমার এ-কথা মিথ্যে হবে না।”
এ কিন্তু তাঁর বাবার আদেশ নয়, দেবব্রত নিজে থেকেই সিংহাসনের দাবি ছেড়ে দিলেন, এ রকম আগে শোনা যায়নি। সকলে ধন্য-ধন্য করতে লাগল।
ধুরন্ধর ধীবরটি এতেও পুরোপুরি খুশি নন। তিনি বিগলিত ভাব দেখিয়ে বললেন, “কুমার, আপনি যা বললেন, তার তুলনা নেই সত্যি। কিন্তু, মানে, আপনি তো সিংহাসনের দাবি ছেড়ে দিলেন, কিন্তু আপনার ছেলেরা? তারা যদি সিংহাসন চায়?”
কুমার দেবব্রত বললেন, “আমার ছেলে মানে? আমি তো এখনও বিয়েই করিনি। তা হলে শুনুন, আমি আবার শপথ করছি, আমি জীবনে কখনও বিয়েই করব না। তাতে ছেলেটেলের প্রশ্নই উঠবে না।”
তখন উপর থেকে দেবব্রতর মাথায় অনেক ফুল ঝরে পড়ল। তখনকার দিনে কেউ যদি দারুণ কোনও ভাল কাজ করতেন কিংবা সাংঘাতিক মনের জোর দেখাতেন, তা হলে আকাশ থেকে দেবতারা তাঁর মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করতেন।
এ রকম দু’টো ভীষণ প্রতিজ্ঞা করার জন্য সেদিন থেকে কুমার দেবব্রতর আর-এক নাম হল ভীষ্ম।
এর পর সত্যবতীর বিয়ের ব্যবস্থা হল। রাজা শান্তনু ছেলের এই মহান আত্মত্যাগের কথা শুনে আনন্দে চোখের জল ফেলতে-ফেলতে ছেলেকে বর দিলেন, তাঁর ইচ্ছামৃত্যু হবে। অর্থাৎ ভীষ্ম যতদিন বাঁচতে চাইবেন, ততদিনই বেঁচে থাকতে পারবেন।
এর পরে মহাভারতের কাহিনিতে দেখা যাবে, অনেকেই বাচ্চা থেকে বড় হচ্ছেন, বুড়ো হচ্ছেন, তারপর মরে যাচ্ছেন। কিংবা কেউ-কেউ যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করছেন, কিন্তু ভীষ্ম ঠিক বেঁচে থাকছেন।
বেশ কিছুদিন শান্তনু ও সত্যবতী সুখে দিন কাটালেন। তারপর স্বর্গে গেলেন শান্তনু। ততদিনে তাঁদের দু’টি ছেলে হয়েছে। তাদের নাম চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য।
স্বামীর মৃত্যুর পর সত্যবতী সব কিছু ব্যাপারে ভীষ্মের সঙ্গে পরামর্শ করেন। বড়ছেলেটি রাজা হল, তাকে সবরকম সাহায্য করেন ভীষ্ম। এ ছেলেটির অন্য অনেক গুণ আছে, যুদ্ধবিদ্যাও ভাল শিখেছে, কিন্তু একটা দোষও আছে। বড্ড গোঁয়ার আর অহংকারী।
গন্ধর্বদের এক রাজার সঙ্গে একদিন এই রাজার দেখা হল, তাঁরও নাম চিত্রাঙ্গদ। গন্ধর্বরাও অনেকটা দেবতাদেরই মতন, তাঁরাও আকাশে থাকেন, মাঝে-মাঝে আসেন পৃথিবীতে। তাঁকে দেখে এই রাজা বললেন, “তোমার নাম আর আমার নাম এক হবে কেন? আমি কৌরবদের রাজা, আমার রাজ্য কত বড়, তুমি তোমার নাম পালটাও!” গন্ধর্বরাজ তাতে রাজি হবেন কেন? তিনি হেসে বললেন, “তুমি সামান্য মানুষ, তুমিই তোমার নাম পালটাও বরং!” লেগে গেল তর্ক, তারপর দু’জনে তুমুল যুদ্ধ।
ভীষ্ম এ-কথা কিছুই জানতেন না। খবর পেয়ে তিনি এসে পৌঁছবার আগেই কৌরবরাজ যুদ্ধে হেরে গিয়ে প্রাণ দিলেন।
ছোটভাই বিচিত্রবীর্য বেশ ছোট, তাকেই রাজা করলেন ভীষ্ম। ভীষ্ম তো রাজা হবেন না। তাই কিশোর ছেলেটিকে সিংহাসনে বসিয়ে তিনিই সব রাজকার্য সামলান।
কয়েক বছর পর বিচিত্রবীর্য খানিকটা বড় হতে ভীষ্ম ঠিক করলেন, এবার তার বিয়ে দিতে হবে, কিন্তু বয়স বাড়লেও তার শরীর বেশ দুর্বল। যুদ্ধ করতেও শেখেনি ভাল ভাবে৷ নিজে-নিজে বিয়েও করতে পারবে না, ব্যবস্থা করতে হবে ভীষ্মকেই।
এই সময় ভীষ্ম শুনলেন, কাশীর রাজার তিন কন্যার স্বয়ংবর হবে। তখনকার দিনে রাজারাজড়ার মেয়ের বিয়ের এই বেশ একটা ভাল ব্যবস্থা ছিল। মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের স্বামী পছন্দ করতেন। কোনও রাজা তাঁর মেয়ের স্বয়ংবরের কথা ঘোষণা করে দিতেন, অন্য অনেক রাজ্য থেকে রাজা ও রাজকুমাররা উপস্থিত হতেন সে রাজ্যে। নির্দিষ্ট দিনে রাজসভায় তাঁরা সকলে সার বেঁধে বসতেন, মালা হাতে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হতেন রাজকন্যা। এক-একজন রাজা বা রাজকুমারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একজন বলে দিত, তাঁর কী-কী গুণ আছে, কত বড় রাজ্য, কত ধনসম্পদ ইত্যাদি। রাজকন্যার যাঁকে ভাল লাগত, তাঁর গলায় মালা দিয়ে দিতেন।
কাশীর রাজার ঘোষণা শুনে ভীষ্ম উপস্থিত হলেন সেখানে। বিচিত্রবীর্যকে তিনি সঙ্গে নিলেন না। ওর দুর্বল চেহারা দেখে যদি রাজকন্যাদের পছন্দ না হয়?
স্বয়ংবর সভা শুরু হতে ভীষ্মর মনে একটা খটকা লাগল। এই রে, কোনও রাজকন্যা যদি তাঁর গলায় মালা দিয়ে দেয়! তিনি যেমন রূপবান, তেমনি তেজস্বী, তাঁকে দেখলে রাজকন্যাদের তো পছন্দ হবেই। কিন্তু তিনি তো বিয়ে করবেন না প্রতিজ্ঞা করেছেন, তিনি নিজের জন্যও আসেননি!
ভীষ্মকে দেখেও অনেক রাজা অবাক। কারণ, তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা সকলে জানে।
স্বয়ংবর সভা শুরু হতে-না-হতেই ভীষ্ম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ক্ষত্রিয়দের মধ্যে বিয়ে করার অনেক রীতি আছে। তার মধ্যে রাজকন্যাদের হরণ করে নিয়ে গিয়েও বিয়ে করা যায়। আমি এই তিন কন্যাকেই হরণ করে নিয়ে যাচ্ছি, আপনাদের কারও তাতে আপত্তি থাকলেও আমি গ্রাহ্য করি না।”
সেই তিনটি মেয়েকেই ভীষ্ম নিজের রথে তুলে নিলেন। অমনি রাজাদের মধ্যে নানা কোলাহল শুরু হয়ে গেল। কেউ-কেউ গালাগালি দিতে লাগল ভীষ্মকে, কেউ-কেউ ‘মার, মার’ বলে চেঁচাতে লাগল। সকলে মিলে আক্রমণ করতে এল ভীষ্মকে।
কিন্তু এরা তো কেউ ভীষ্মের বীরত্বের কথা জানে না। তিনি তো একাই একশো। সব রাজা একদিক থেকে অস্ত্র ছুড়তে লাগল, ভীষ্ম বাধা দিতে লাগলেন প্রত্যেককে। বেশ কিছুক্ষণ দারুণ যুদ্ধ চলল, অস্ত্রের ঝনঝনা ও মানুষের আর্তনাদে ভরে গেল চতুর্দিক।
শেষ পর্যন্ত সকলে পরাজিত হয়ে পালাল।
নিশ্চিন্ত ভাবে আবার রথ চালাতে লাগলেন ভীষ্ম। কিছু দূর যাওয়ার পর তিনি শুনতে পেলেন, কে যেন চেঁচিয়ে বলছে, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, পালাচ্ছ কোথায়?”
রথ থামিয়ে তিনি দেখলেন, শাল্ব নামে আর-একজন রাজা ধেয়ে আসছেন। এই রাজারও বীরত্বের খুব খ্যাতি আছে। ভীষ্ম হাসলেন। তিনি পালাবেন?
শুরু হল শাল্বর সঙ্গে যুদ্ধ।
তিন রাজকন্যার মধ্যে একজন ছটফট করে উঠে দাঁড়াতেই ভীষ্ম বললেন, “তোমরা চুপ করে বসে থাকো। তোমাদের কোনও ভয় নেই।”
বিশাল এক হাতির পিঠে চেপে বসে রাজা শাল্ব খুব পরাক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন বটে, কিন্তু ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করতে দেবতারাও ভয় পান। ভীষ্মের হাতের প্রত্যেকটা তিরই যেন অগ্নিবাণ।
বেশ কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর শাল্বও পিছু হটতে বাধ্য হলেন।
তিন রাজকন্যাকে নিয়ে ভীষ্ম এসে পৌঁছলেন রাজধানী হস্তিনাপুরে।
কয়েক দিন পর যখন বিবাহের অনুষ্ঠান শুরু হবে, তখন ওই তিন কন্যার মধ্যে বড় মেয়েটি, যার নাম অম্বা, সে ভীষ্মকে বলল, “আপনাকে আমি একটা কথা জানাতে চাই। আমি আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, স্বয়ংবর সভায় মহারাজ শাল্বর গলাতেই মালা দেব, আমার বাবাও তা জানতেন, তিনিও তাই চেয়েছিলেন। এখন আপনার ভাইকে বিয়ে করা কি আমার উচিত হবে?”
ভীষ্ম বললেন, “তুমি একথা আগে বলোনি কেন? তা হলে তো শাল্বর সঙ্গে যুদ্ধ না করে তোমাকে সেখানেই নামিয়ে দিতাম!”
যাই হোক, অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে ভীষ্ম অম্বাকে শাল্বর কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। এর পরেও অবশ্য অম্বাকে নিয়ে অনেক গন্ডগোল হবে, সে আবার কাহিনিতে ফিরে আসবে। তখন তার কথা আবার জানব।
বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বাকি দু’টি রাজকন্যার বিয়ে হল খুব ধুমধাম করে। এর পর কয়েকটি বছর বেশ সুখে-শান্তিতেই কাটল। তারপর একদিন জানা গেল, এই অল্পবয়সি রাজাটির যক্ষ্মারোগ হয়েছে। সেসময় তো এ রোগের কোনও চিকিৎসাই ছিল না। তার আর বেশিদিন আয়ু নেই।
মহাভারতের কাহিনি তো বিশাল, তাই এর কিছু-কিছু বাদ দিতে হবে। বটগাছের যেমন অনেক ডালপালা হয়, তেমনি এ কাহিনিও ছড়িয়ে গিয়েছে নানা দিকে। কত মুনি-ঋষির জীবনের কথা যে ঢুকে গিয়েছে এর মধ্যে, তার আর ইয়ত্তা নেই। সেসব জানতে গেলে আসল গল্পের খেই হারিয়ে যায়।
আর কিছু কিছু ঘটনা আছে, যা বড়দের মতো, ছোটরা ঠিক বুঝবে না। বড় হয়ে মূল মহাভারত পড়ে নিলেই সব জানা যাবে।
এখানে একজন ঋষির কথা অবশ্য বলতেই হবে।
সত্যবতীর বিয়ের আগে একটি সন্তান জন্মেছিল। তার গায়ের রং খুব কালো বলে নাম রাখা হয়েছিল কৃষ্ণ। আর একটা দ্বীপে জন্ম বলে পুরো নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। এঁর আরও একটা নাম আছে, ব্যাস। পরাশর ঋষির কাছে ইনি পালিত হয়েছেন। আর বড় হয়ে ওঠার পর তিনি হয়েছেন মহাপণ্ডিত। আমাদের দেশে সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থের নাম বেদ। এক সময় এই বেদের শ্লোকগুলো নানা ভাবে ছড়ানো ছিল। এই ব্যাস সেইসব শ্লোক কোনটার পাশে কোনটার থাকা উচিত, তা ঠিকঠাক করে চারটে ভাগে ভাগ করলেন। সেই চার খণ্ডের নাম ঋক, সাম, যজু আর অথর্ব। তাঁর সেই ভাগ এখনও লোকে মেনে নেয়। এ কাজের জন্য তাঁর নাম হয়ে যায় বেদব্যাস!
আমরা তো জানি, এই বেদব্যাসই মহাভারত রচনা করেছেন। পৃথিবীতে এমন লেখক আর-একজনও নেই, যিনি তাঁর কাহিনির মধ্যে নিজেই এসে দেখা দেন মাঝে-মাঝে। অনেক কিছু ঘটছেও তাঁরই জন্য। এসব আমরা জানতে পারব আস্তে-আস্তে।
সত্যবতী তাঁর এই ছেলের কথা আগে কাউকে জানাননি। একসময় তিনি ভীষ্মকে সব কথা খুলে বললেন। ভীষ্ম তো দারুণ। অবাক। মহাপণ্ডিত বেদব্যাসের কথা কে না জানে! সেই বেদব্যাস সত্যবতীর ছেলে? তার মানে তিনি তো ভীষ্মেরও একরকম সৎভাই। তক্ষুনি তাঁকে খবর পাঠিয়ে নিয়ে আসা হল রাজধানীতে। তাঁকে অনুরোধ করা হল, সব ব্যাপারে ভীষ্মকে পরামর্শ দিতে ও সাহায্য করতে।
বেদব্যাস রাজি হলেন। তবে তিনি রাজপুরীতে থাকবেন না, তাঁর নিজস্ব আশ্রম আছে। এখানে আসবেন মাঝে-মাঝে।
যক্ষ্মারোগে বিচিত্রবীর্যের মৃত্যু হল কিছুদিনের মধ্যেই। তাঁর দুই ছেলে, ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডু।
ধৃতরাষ্ট্র বড়ছেলে, তাঁরই রাজা হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি জন্মান্ধ! হায়, হায়, জন্মান্ধ কী করে রাজ্য চালাবে? দ্বিতীয় ছেলেটি এমনিতে ঠিকঠাকই আছে, কিন্তু গায়ের রং কীরকম হলদেটে মতো, সেইজন্য তার নাম রাখা হয়েছে পাণ্ডু।
সত্যবতী আর ভীষ্ম ঠিক করলেন যে, পাণ্ডুকেই রাজা করা হবে। বড়ভাই ধৃতরাষ্ট্রও রাজসভায় বসবেন, রাজার মতন সম্মান পাবেন। দেশের বাইরে যুদ্ধবিগ্রহ চালাতে গেলে রাজা হিসেবে যাবেন পাণ্ডুই।
এবার এই দুই ছেলের বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু অন্ধ ছেলের বিয়ে হবে কী করে? রাজার ছেলের সঙ্গে রাজকন্যারই বিয়ে হয়, কিন্তু কোনও রাজকন্যাই তো অন্ধ রাজকুমারকে বিয়ে করতে রাজি হবে না!
ভীষ্ম খবর পেলেন যে, গান্ধার রাজ্যের রাজা সুবলের একটি সুন্দরী কন্যা আছে, তার নাম গান্ধারী। ভীষ্ম রাজা সুবলের কাছে ধৃতরাষ্ট্রের জন্য বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। এ ছেলেটি অন্ধ বটে, কিন্তু আর কোনও খুঁত নেই। শরীরে দারুণ শক্তি, বুদ্ধিও তীক্ষ্ণ। তা ছাড়া এত বড় একটা রাজ্যের ঠিক রাজা না হলেও রাজারই মতো সম্মান পান। তাঁর স্ত্রী যিনি হবেন, তিনিও রানির মতনই থাকবেন।
মহাশক্তিশালী কৌরব রাজ্য আর বীরশ্রেষ্ঠ ভীষ্মের কাছ থেকে আসা প্রস্তাব তো সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনি বললেন, “আমার মেয়ে যদি রাজি থাকে, তা হলে আমার কোনও আপত্তি নেই।”
বাবার মত আছে জেনে গান্ধারীও সঙ্গে-সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। শুধু তাই-ই নয়, গান্ধারী এমন একটা কাজ করলেন, যার কোনও তুলনাই নেই। বিয়ের কথা ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পরই তিনি খানিকটা মোটা কাপড়ে তাঁর দু’ চোখ বেঁধে ফেললেন। তাঁর স্বামী অন্ধ, তাই তিনিও সারাজীবন কিছু দেখবেন না।
বধূ হিসেবে হস্তিনাপুরে আসার পর তাঁর সুমিষ্ট ব্যবহার ও ধর্মজ্ঞান দেখে সকলে ধন্য-ধন্য করতে লাগল।
এবার পাণ্ডুর বিবাহ। এতে কোনও সমস্যা নেই, রাজা কুন্তীভোজের পালিত কন্যা পৃথার স্বয়ংবর সভায় হাজির হলেন পাণ্ডু। অত বড় রাজ্যের রাজা, তা ছাড়া পাণ্ডুর বীরত্বেরও খ্যাতি হয়েছে, সুতরাং তাঁরই গলায় মালা দিলেন রাজকন্যা। এই পৃথারই আর-এক নাম কুন্তী।
পাণ্ডু এর পরেও মদ্র দেশের রাজকন্যা মাদ্রীকে বিবাহ করে নিয়ে এলেন রাজধানীতে। কিছুদিন পর তিনি বেরোলেন বিজয় অভিযানে। কয়েকটি রাজ্য জয় করলেন। প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে এসে সবই নিবেদন করলেন মা সত্যবতী ও ভীষ্মকে।
এবার তাঁর কিছুদিন ছুটি চাই। সে ক’দিন দাদা বসবেন সিংহাসনে, আসল কাজ তো সবই করবেন ভীষ্ম। দুই স্ত্রীকে নিয়ে পাণ্ডু চলে গেলেন গভীর অরণ্যে।
সেখানে বাতাস নির্মল, ঝরনার জলের কুলুকুলু শব্দ, আর কতরকম পাখির ডাক শুনতে-শুনতে মনটা জুড়িয়ে যায়। রাজ্য চালাবার দায়িত্ব মাথায় নেই। চমৎকার দিন কাটে। খাদ্যের অভাব নেই, গাছে-গাছে রয়েছে অনেক ফলমূল আর অজস্র হরিণ দেখা যায়, তার একটাকে মারলেই তো বেশ কয়েক দিন চলে যায়।
একদিন পাণ্ডু দেখলেন, দু’টি হরিণ একটা নদীর ধারে খেলা করছে। দু’টিতে মিলে একবার ছুটে একদিকে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে এদিকে। পাণ্ডু ধনুক তুলে একটা তির মারলেন, তাতেই একটি হরিণ বিদ্ধ হয়ে মানুষের গলায় আর্তনাদ করে উঠল।
এই রে, এ আবার কী ব্যাপার!
সেই আহত হরিণ বলে উঠল, “ছিঃ মহারাজ, এ কী করলে? খেলার সময় কেউ কাউকে মারে? আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে হরিণের রূপ ধরে খেলা করছিলাম। আমি একজন ঋষি, তুমি আমাকে মেরে মহাপাপ করেছ! ব্রাহ্মণকে হত্যা করলে অনন্ত নরকবাস হয়। তুমি জানতে না যে আমি কে, তাই তোমার শাস্তি একটু কমিয়ে দিচ্ছি, তোমার কোনও দিন ছেলেমেয়ে হবে না।”
এই অভিশাপ শুনে পাণ্ডু কেঁপে উঠলেন। তারপর ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। আর বলতে লাগলেন, “হায়, হায়, আমি এ কী করলাম। আমার কোনও দিন সন্তান হবে না? আমার জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে গেল! যে রাজার সন্তান হয় না, তাকে সকলে ছি ছি করে। আমি আর রাজধানীতে যাব না, সংসারেই থাকব না।”
দুই স্ত্রীকে বললেন, “তোমরা ফিরে যাও, আমি এই বনেই থেকে পূজা-প্রার্থনা করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।”
কুন্তী আর মাদ্রী ফিরে যেতে রাজি নন। তাঁরা থেকে গেলেন রাজার সঙ্গে, রাজধানী হস্তিনাপুরে কেউই আর তাঁদের খবর পান না।
পাণ্ডু পুত্রসন্তানের জন্য রোজই কান্নাকাটি করেন বলে একদিন তাঁর বড়রানি কুন্তী বললেন, “মহারাজ, আপনি যদি অনুমতি দেন, তা হলে আমি একটা ব্যবস্থা করতে পারি।”
এই কুন্তী মহাভারতের একটি প্রধান চরিত্র। এবারে আস্তে-আস্তে বলতে হবে তাঁর কথা।
কুন্তী যখন কুমারী ছিলেন, তখন তাঁদের রাজ্যে এসেছিলেন দুর্বাসা মুনি। ইনি একটু রেগে গেলেই অভিশাপ দেন, আবার খুশি হলে বর দেন। কুন্তী তাঁর এমনই সেবাযত্ন করেছিলেন যে, তুষ্ট হয়ে দুর্বাসা তাঁকে একটা বর দিলেন। ঠিক বর নয়, তিনি কুন্তীকে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি যদি এই মন্ত্র পড়ে আকাশের কোনও দেবতাকে ডাকো, তা হলেই সেই দেবতা তোমার কাছে এসে উপস্থিত হবেন, আর তোমাকে একটা উপহার দেবেন।”
দুর্বাসা চলে যাওয়ার পর কুন্তী ভাবলেন, সত্যি-সত্যি একটা মন্ত্র পড়লেই আকাশের দেবতারা নেমে আসবেন? তা কি হয়? আচ্ছা, দেখা যাক তো!
আকাশের সূর্যের দিকে তাকিয়ে কুন্তী সেই মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। সঙ্গে-সঙ্গে সূর্যদেব এক দীপ্তিমান পুরুষের রূপ ধরে এসে উপস্থিত হলেন তাঁর কাছে।
সূর্যদেব কুন্তীকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি আমার কাছ থেকে একটি সন্তান উপহার চাও?”
কুন্তী ভয় পেয়ে গেলেন। এ আবার কীরকম উপহার! তিনি কুমারী, তিনি সন্তান চাইবেন কেন? বিয়ের পরই তো মেয়েরা মা হয়।
তিনি বললেন, “প্রভু, আমি ভুল করেছি। আপনাকে এমনি-এমনি ডেকে ফেলেছি। আমার ওসব কিছু চাই না। আপনি ফিরে যান।”
সুর্যদেব বললেন, “তা তো হয় না। ওই মন্ত্রে একবার ডাকলে ফিরে যাওয়া যায় না। এ উপহার তোমাকে নিতেই হবে। তবে তোমার কোনও ভয় নেই।”
তিনি কুন্তীকে একবার ছুঁয়ে দিয়ে আবার মিলিয়ে গেলেন আকাশে।
কুন্তী গর্ভবতী হলেন এবং কিছুদিন পর তাঁর একটি সন্তান হল। ভারী ফুটফুটে সুন্দর চেহারার ছেলে।
এখন এ ছেলেকে নিয়ে তিনি কী করবেন? বিয়ের আগে কোনও রাজকন্যার সন্তান হলে সকলে খুব নিন্দে করবে। তার আর বিয়েই হবে না। তাই কেউ কিছু জানার আগেই কুন্তী চুপি চুপি একটা ভেলা বানিয়ে তার উপর বাচ্চাটাকে শুইয়ে চাদরটাদর চাপা দিয়ে ভাসিয়ে দিলেন নদীতে। যতদূর দেখা গেল, সেদিকে তাকিয়ে তিনি কাঁদতে লাগলেন অঝোরে।
বাচ্চাটা কিন্তু জলে ডুবল না, মরলও না, ঠিক বেঁচে গেল। তার কথা আবার বলা হবে যথাসময়ে। এর মধ্যে সেই বাচ্চার কথা জানল না কেউ।
এখন কুন্তী মহারাজ পাণ্ডুকে বললেন, “আমি একটা মন্ত্র জানি। সেই মন্ত্রে যে-কোনও দেবতাকে ডেকে একটি সন্তান উপহার পেতে পারি।”
তাই শুনে পাণ্ডু বললেন, “অ্যাঁ? এ আবার হয় নাকি? ডাকো তো, ডাকো তো, একজন দেবতাকে এখনই ডাকো।”
একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে, স্নানটান করে, শুদ্ধ বসন পরে কুন্তী ডাকলেন ধর্মদেবতাকে। ঋষির সেই মন্ত্রের জোর একটুও কমেনি। সঙ্গে-সঙ্গে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন ধর্মদেবতা। কুন্তীকে একবার ছুঁয়ে আশীর্বাদ করে তিনি চলে গেলেন।
যথাসময়ে কুন্তীর একটি সুন্দর ছেলে হল। তার নাম রাখা হল যুধিষ্ঠির।
সন্তান পাওয়া এত সহজ দেখে মহাআনন্দিত ও মহাউৎসাহিত হয়ে পাণ্ডু কুন্তীকে বললেন, “তুমি আর-একজন দেবতাকে ডাকো।”
কুন্তী এবার ডাকলেন বাতাসের দেবতা পবনকে। অমনি পবনদেব উপস্থিত। তিনিও কুন্তীকে একটি উপহার দিলেন। এবারেও একটি বেশ হৃষ্টপুষ্ট ছেলে হল, তার নাম দেওয়া হল ভীম।
আবার ডাকা হল দেবরাজ ইন্দ্রকে। ইন্দ্রের আশীর্বাদে যে অপরূপ সন্তানটি জন্মাল, তার নাম হল অর্জুন।
রাজার দ্বিতীয় রানি মাদ্রী এইসব দেখে করুণ ভাবে বললেন, “আমার কি কোনও সন্তান হবে না?”
পাণ্ডু তখন কুন্তীকে বললেন, “তুমি তোমার ওই মন্ত্রের জোরে মাদ্রীকে সন্তান দিতে পারো না?”
কুন্তী বললেন, “পারি। মাদ্রী যে-কোনও দেবতার নাম মনে-মনে চিন্তা করুক, আমি মন্ত্রের জোরে তাঁকে ডেকে আনছি।”
মাদ্রী একটু চালাকি করলেন। দেবতাদের দু’জন চিকিৎসক আছেন, তাঁদের নাম অশ্বিনীকুমার। এঁরা যমজ, আর সব সময় একসঙ্গে থাকেন। মাদ্রী ডাকলেন তাঁদের।
অশ্বিনীকুমাররা এসে মাদ্রীকে আশীর্বাদ করলেন। মাদ্রীর দু’টি সন্তান হল। তাদের নাম রাখা হল নকুল আর সহদেব।
মাদ্রী আবার এক দেবতাকে ডাকতে চাইলেন।
কুন্তী তাঁর স্বামীকে বললেন, “না, আর হবে না, ও কেন একসঙ্গে দু’জন দেবতাকে ডেকেছে?”
পাণ্ডু বললেন, “বেশ। যথেষ্ট হয়েছে। আমার এই পাঁচটি সন্তানই যথেষ্ট।”
দিন-দিন সেই পাঁচটি সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ছেলে বড় হয়ে উঠতে লাগল।
ওদিকে ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীরও কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি অনেকদিন। সেইজন্য তাঁদের মনে দুঃখ ছিল।
একদিন ব্যাসদেব এলেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।
সেখানে কয়েকদিন থাকার সময় তাঁর খুবই সেবাযত্ন করলেন গান্ধারী।
তাতে খুবই তৃপ্ত হয়ে ব্যাস গান্ধারীকে বললেন, “তুমি আমার কাছে কী বর চাও, বলো।”
গান্ধারী বিনীত ভাবে বললেন, “যদি বর দিতে চান, তা হলে দিন, আমি যাতে ছেলেমেয়ের মা হতে পারি।”
সঙ্গে-সঙ্গে বেদব্যাস বললেন, “তথাস্তু। আমার বরে তোমার একশোটি ছেলে আর একটি মেয়ে হবে।”
এ কী বর দিলেন ঋষি? কোনও মায়ের কি একশো একটি ছেলেমেয়ে হতে পারে? অসম্ভব! বড় জোর পনেরো-কুড়ি।
আগেকার দিনে সব কিছুই খুব বাড়িয়ে বলা হত। কেউ হয়তো খুব কঠোর তপস্যা করলেন পনেরো বছর, বলা হল পাঁচ হাজার বছর। কারও-কারও বয়সই বলা হয়েছে, এক হাজার কি দু’ হাজার বছর, তা তো আর হতে পারে না! যাই হোক, গান্ধারীরও বোধ হয় দশ-এগারোটি ছেলেমেয়ে হয়েছিল, সেটাই হয়ে গিয়েছে একশো একটি। যাই হোক, গল্পের খাতিরে আমরা তাই মেনে নিলাম।
ব্যাসদেবের বরে গান্ধারী গর্ভবতী হলেন কিন্তু সন্তান প্রসব আর হয় না। দু’ বছর তারা রয়ে গেল পেটের মধ্যে। তারপর বেরোল একটা প্রকাণ্ড মাংসপিণ্ড। তা দেখে ভয় পেয়ে গান্ধারী কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না, তখন আবার ব্যাসদেব এসে হাজির। তিনি সেই মাংসপিণ্ডটাকে একশো একটা ভাগ করে প্রত্যেকটি টুকরো এক-একটা ঘি-ভরতি হাঁড়িতে রাখতে বললেন। সেই থেকে একশোটি ছেলে আর একটি মেয়ে জন্মাল।
প্রথম ছেলেটি খুবই রূপবান, তার নাম রাখা হল দুর্যোধন। আর মেয়েটির নাম দুঃশলা। অন্যদের মধ্যে তৃতীয় সন্তানটির কথা পরে কয়েকবার এসেছে, বাকিরা সব এলেবেলে।
আবার ওদিকে, অরণ্যের মধ্যে রাজা পাণ্ডু মারা গেলেন হঠাৎ। তখনকার দিনে কোথাও কোথাও সহমরণ প্রথা ছিল। অর্থাৎ স্বামীর সঙ্গে এক স্ত্রীও পুড়ে মরতেন। পাণ্ডুর সঙ্গে স্বেচ্ছায় সহমরণে গেলেন তাঁর ছোটরানি মাদ্রী।
কুন্তী পাঁচটি ছেলেকেই মানুষ করতে লাগলেন সমান যত্নে। তারা একটু বড় হওয়ার পর তাদের শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে ভেবে অরণ্য ছেড়ে ফিরে এলেন রাজধানী হস্তিনাপুরে।
এতদিন ওঁদের কোনও খবরই পাওয়া যায়নি। এখন ওঁদের দেখে রাজ্যের লোকের যেমন দুঃখ হল, আনন্দও হল তেমন। দুঃখের কারণ, রাজা পাণ্ডুর মৃত্যু হয়েছে। আর আনন্দের কারণ, তাঁর এমন সুন্দর স্বাস্থ্যবান পাঁচটি ছেলে এসেছে রাজ্যে।
সেই শোক ও আনন্দ কেটে গেল ক’দিন পর। তারপর দেখা দিল একটা অতি কঠিন প্রশ্ন। এতদিন তো ভীষ্মই রাজত্ব চালাচ্ছিলেন, সিংহাসনে বসিয়ে রেখেছিলেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে। এখন পাণ্ডুর মৃত্যু হয়েছে। নতুন রাজা হবে কে?
অন্ধ বলে ধৃতরাষ্ট্র রাজা হতে পারেননি, কিন্তু তাঁর বড়ছেলে তো সিংহাসন দাবি করতেই পারে। আবার পাণ্ডুও রাজা ছিলেন, তাঁর ছেলেই বা রাজা হবে না কেন? এ বিষয়ে এক-একজনের এক-একরকম মত।
আর একটা প্রশ্ন, দুর্যোধন আর যুধিষ্ঠিরের মধ্যে কে বয়সে বড়? এই বংশের জ্যেষ্ঠসন্তানই রাজা হতে পারে। কিন্তু এ প্রশ্নেরও সঠিক কোনও উত্তর নেই। দুর্যোধন তার মায়ের পেটে দু’ বছর আটকে ছিল, তার মধ্যেই জন্ম নিয়েছে যুধিষ্ঠির। মায়ের পেটে যে আগে আসে, সে বড়, না যে পৃথিবীর আলো-বাতাস আগে দ্যাখে, সে বড়?
এ অতি সূক্ষ্ম আর জটিল প্রশ্ন। এই প্রশ্ন নিয়েই একের পর-এক এসেছে মহাভারতের বাকি সব ঘটনা।