আমাদের মহাভারত – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশকের নিবেদন
মহাভারতের কাহিনি চিরন্তন। সেই কাহিনিই ছোটদের জন্য সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাষায় বলেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল আনন্দমেলা পত্রিকায়। কিন্তু তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে সেই কাহিনি অসমাপ্ত থেকে গেল। তবু মহাভারতের সম্পূর্ণ কাহিনিটি যাতে পাঠকের সামনে থাকে সেই উদ্দেশ্যে আনন্দমেলা পত্রিকায় মহাভারতের বাকি সামান্য অংশের কাহিনি সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করা হয়। এই বইতেও সেইভাবে প্রকাশিত হল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আমাদের মহাভারত’।
॥ ১ ॥
আমি যখন বেশ ছোট, তখন আমার দিদিমার মুখে প্রায়ই একটা কথা শুনতাম, “যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে।” আমি এর মানে বুঝতে পারতাম না। কেমন যেন ধাঁধার মতো মনে হত।
দিদিমার কাছে মানে জিজ্ঞেস করলে তিনি মধুর ভাবে হেসে বলতেন, “তুমি আর একটু বড় হও সোনা, তখন তোমাকে আমি একটা বই পড়তে দেব, তখন তুমি নিজেই সব বুঝবে।”
আমার বয়স তখন সাত বছর, তখনই আমি জানি আমাদের এই দেশটার নাম ভারত, ইংরেজিতে বলে ইন্ডিয়া। কিন্তু দু’ বার ভারত কেন?
আমার দিদিমা খুব পড়ুয়া ছিলেন, রোজই কোনও না-কোনও গল্পের বই পড়তেন। একখানা বেশ মোটা বই রাখা থাকত তাঁর বিছানার পাশের র্যাকে। প্রত্যেকদিন তার থেকে পড়বেনই দু’-এক পাতা।
বইটির নাম মহাভারত, কাশীরাম দাস বিরচিত। আমি তো বাংলা লেখা পড়তে পারি, সুকুমার রায়ের কয়েকটি কবিতা মুখস্থ। একদিন দিদিমার সেই বইটা পড়ার চেষ্টা করলাম, কিছু মানে বুঝতে পারলাম না। বড্ড খটমট। অনেক কথার মানেই জানি না। প্রথম লাইনটাই এ রকম: ‘বিঘ্ন বিনাসন গৌরীর নন্দন…’ নাঃ, এই শব্দ আমার অজানা। তাই এই বইটা আর আমি খুলে দেখিনি।
এর তিন-চার বছর পর গল্পের বই পড়ার নেশা আমায় চেপে ধরেছে। পাড়ার লাইব্রেরি থেকে রোজ বই নিয়ে আসি। আত্মীয়- স্বজনদের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গেলেও খুঁজি গল্পের বই, এখন অনেক শক্ত-শক্ত বাংলা শব্দের মানে বুঝতে পারি।
একদিন বড়মামার বাড়িতে একটা বই পেলাম, সেটার নাম ‘মহাভারত’। কিন্তু সেটা মোটেই বড় বই নয়, মোট ছিয়ানব্বই পাতা। পদ্যে নয়, গদ্যে লেখা। আমার একটা খটকা লাগল, দিদিমার ঘরে মোটা বইটার নাম মহাভারত আর এই পাতলা বইটার নামও মহাভারত? এই বইটায় তো ‘কাশীরাম দাস বিরচিত’ লেখা নেই!
দিদিমাকে সে কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, “আসল মহাভারত তো সংস্কৃত ভাষায় লেখা, তা আর এখন ক’ জন পড়বে, ক’ জন বুঝবে? তাই বাংলায় প্রথম মহাভারত লিখলেন কাশীরাম দাস। তারপর আরও অনেকে লিখেছেন।”
আমি মনে-মনে ভাবলাম, ‘কাশীরাম দাসবাবু আর একটু সহজ করে লিখলেন না কেন?’
তারপর কেটে গিয়েছে অনেক বছর।
এর মধ্যে আমি জেনে গিয়েছি দিদিমার সেই ধাঁধাটার উত্তর, “যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে।” একটা ভারত আমাদের দেশের নাম, আর অন্য ভারত হচ্ছে ‘মহাভারত’। তার মানে, আমাদের দেশে যা-যা আছে, তা সবই পাওয়া যাবে মহাভারতের কাহিনিতে। অনেক রকম মহাভারত পড়ার পর আমি বুঝতে পারি, এ কথাটা সত্যিই। আমাদের এত বড় দেশে যা কিছু আছে, তা সবই যেন রয়েছে মহাভারতে। মূল মহাভারতের বাংলা অনুবাদ আমি যে কতবার পড়েছি, তার ঠিক নেই। এখনও মাঝে-মাঝে সেই বইয়ের যে-কোনও পৃষ্ঠা খুলে পড়তে শুরু করি, প্রত্যেকবারই নতুন মনে হয়।
গত শনিবার আমার বড়মাসির বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম। চন্দননগরে এদের বাড়িটি খুব সুন্দর, সামনেও একটা বাগান আর পিছনেও বাগান। ছাদ থেকে গঙ্গা দেখা যায়। কতরকম পাখি আসে। আমি মাঝে-মাঝে কলকাতা ছেড়ে এখানে আট-দশ দিন থেকে যাই।
বড়মাসির দু’টি ছেলেমেয়ে, টুবলু আর রিয়া। ওরা যমজ, একই দিনে জন্মেছে। কিন্তু একরকম দেখতে নয়। তবে একজনের জ্বর হলে, আর একজনেরও হবেই। দু’জনেই মিষ্টি খাবার পছন্দ করে না, টক খেতে খুব ভালবাসে। এদের এগারো বছর বয়স, দু’জনেই ইংরেজি স্কুলে পড়ে।
এবারে এসে আমি বসার ঘরে নতুন বই খুঁজছি। টুবলু এসে বলল, “ছোড়দা, তুমি বকরাক্ষস দেখেছ? কত বড় হয়?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুই হঠাৎ বকরাক্ষসের কথা বললি কেন?”
টুবলু বলল, “আমাদের মালি, এই যে ভজন, সে একদিন বাগানের গাছে দু’টো বক দেখে বলল, “বাড়ির মধ্যে বক আসা মোটেই ভাল নয়। এ দু’টো বকরাক্ষসের বাচ্চা।’”
আমি বললাম, “ধ্যাৎ, বকরাক্ষস মোটেই বকের মতো দেখতে নয়। তুই বকরাক্ষসের গল্পটা জানিস না?”
টুবলু বলল, “হ্যাঁ জানি। ভজনদাদা বলেছে, বকরাক্ষসটা খুব পাজি ছিল, রাম সেটাকে মেরে ফেলেছে।”
আমি হাসতে-হাসতে বললাম, “সে কী রে! বকরাক্ষসের গল্প আছে তো মহাভারতে। সেখানে রাম আসবে কী করে? তুই মহাভারত পড়িসনি?”
মাথা দুলিয়ে টুবলু বলল, “না।”
টুবলুর বয়স এগারো বছর, অথচ সে মহাভারতের কথা জানে না! ওর বয়সে আমি দু’-তিন বার পড়ে ফেলেছি। ইংরেজি স্কুলে পড়লে বুঝি জানতে হয় না মহাভারতের কথা?
টুবলু বলল, “রাম মারেনি, তবে কে মেরেছে রাক্ষসটাকে? খুব লড়াই হয়েছিল? গল্পটা বলো না তুমি!”
আমি বললাম, “শুধু বকরাক্ষসের কথা বললেই সব বোঝা যাবে না। আগের কথাও জানতে হবে। তুই পঞ্চপাণ্ডবের নাম জানিস?”
আবার মাথা দুলিয়ে টুবলু বলল, “নাঃ! পঞ্চপাণ্ডব মানে কী?”
আমি মনে-মনে বললাম, ‘এই রে, এ তো কিছুই জানে না।’
মুখে বললাম, “পঞ্চ মানে পাঁচ, তা জানিস তো? ওরা পাঁচ ভাই, ওদের বলা হত পাণ্ডব। ওদের কথা আগে জানতে হবে। তা হলে একটা কাজ করা যাক, পুরো মহাভারতের গল্পটাই তোকে ছোট করে শোনাতে পারি। তুই শুনবি?”
টুবলু একটু চিন্তা করে বলল, “যদি ভাল লাগে, তা হলে সবটা শুনব, আর যদি শুনতে ইচ্ছে না করে…”
দরজার কাছে কখন রিয়া এসে দাঁড়িয়েছে, লক্ষ করিনি। সে বলল, “গল্প বলা হবে, আমি শুনব না?”
টুবলু বলল, “ছোড়দা, একটু দাঁড়াও, আমি আমার এক বন্ধুকে ডেকে আনি।”
টুবলু দৌড়ে গিয়ে একজনের বদলে দু’জন ছেলেকে ডেকে আনল।
তারপর শুরু হল গল্প।
এসো, তোমাদের সঙ্গে আমিও আবার নতুন করে মহাভারত পড়ি।
মহাভারত একখানা অসাধারণ বই। যারা এই বই একবার মন দিয়ে পড়েছে, তারা সারা জীবনেও ভুলতে পারে না।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বিখ্যাত বই চারখানা। রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড আর ওডিসি। এ ছাড়াও আছে বাইবেল, কোরান, গীতা এইসব, কিন্তু সেগুলো ধর্মের বই। প্রথম চারখানা শুধু গল্পের বই। তার মধ্যেও মহাভারতই সবচেয়ে বড়। দারুণ-দারুণ সব গল্প আছে এই বইতে।
এই চারখানা বইকেই বলে মহাকাব্য। আমি তবে গল্পের বই বলছি কেন? এই সব গল্পই কবিতার ছন্দে লেখা। তার কারণ, তখনকার দিনে গদ্য লেখার চল ছিল না। আর কবিতায় গল্প লেখার প্রধান কারণ, তখন তো আর বইয়ের দোকান ছিল না। বই ছাপাই হত না। একজন কেউ লিখতেন, অন্যরা তা শুনে-শুনে মুখস্থ করতেন। আর গদ্যের চেয়ে কবিতা মুখস্থ রাখাই অনেক সহজ। সে সময়কার মানুষ খাঁটি ঘি-দুধ আর টাটকা ফলমূল খেতেন। তাই তাঁদের স্মৃতিশক্তিও খুব বেশি ছিল। সেজন্যই তাঁরা অত লম্বা-লম্বা কবিতা গড়গড় করে মুখস্থ বলতে পারতেন।
আচ্ছা, মহাভারতের কাহিনিটা আমরা কার কাছ থেকে পেয়েছি?
তোমাদের মধ্যে যারা বেশ পড়ুয়া, তারা টক করে বলে দেবে, “কেন, এটা তো বেদব্যাস ঋষির লেখা, তা সবাই জানে!”
বেদব্যাস ঋষি মহাভারত রচনা করেছেন, তা ঠিকই। কিন্তু বেদব্যাস যে কত হাজার বছর আগে লিখেছিলেন, তারই তো ঠিক নেই। তিনি নিজেই কি এত বড় গল্পটা বানিয়েছেন? নাকি তিনি লিখেছিলেন ছোট করে, তারপর অন্য কোনও-কোনও ঋষি নিজেরাও কিছু-কিছু গল্প ঢুকিয়ে দিয়েছেন, রং চড়িয়েছেন? সেটাই বোধ হয় সম্ভব। আর বেদব্যাস নিজের হাতেও এটা লেখেননি। খুব সম্ভবত তিনি লিখতে জানতেনই না! আগেকার দিনের অনেক মুনি-ঋষিই লিখতে-পড়তে জানতেন না। তাঁরা মনে-মনে অনেক অসাধারণ শ্লোক রচনা করতে পারতেন। কী দারুণ প্রতিভা ছিল তাঁদের! বেদব্যাসও মনে-মনে এই বিশাল কাহিনিটি তৈরি করলেন, তারপর কোথাও তো লিখে রাখাও দরকার। তখন তিনি দেবতাদের মধ্যে থেকে গণেশকে অনুরোধ করলেন তাঁর এই উপন্যাসটা লিখে দেওয়ার জন্য। গণেশ ছিলেন পড়াশোনায় ফার্স্ট বয়। মানুষের মতো শরীর আর শুঁড়ওয়ালা হাতির মতো মাথা হলে কী হয়, সাংঘাতিক তাঁর মেধা। গণেশ রাজি হলেন লিখতে।
লেখার পর ব্যাসদেব প্রথমে তাঁর ছেলে শুকদেবকে সবটা শিখিয়ে দিলেন। তারপর শেখালেন আর কয়েকজন শিষ্যকে। এঁরা আবার শোনাতে লাগলেন অন্যদের। এইভাবে লোকের মুখে-মুখে ছড়াতে লাগল মহাভারতের গল্প। এই গল্পের এমনই টান, যে একটু শুনেছে, সে-ই তৃষ্ণার্তের মতো বসে থাকে বাকি সবটা শোনার জন্য।
আমরা পেলাম কার কাছ থেকে?
মহাভারত লেখার অনেক বছর পরের কথা। শৌনক নামে একজন খুব বড় ঋষি জঙ্গলের মধ্যে আশ্রমে এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। বারো বছর ধরে চলবে সেই যজ্ঞ। আরও অনেক মুনি- ঋষি এসে থাকছেন সেখানে। দিনের বেলা আগুন জ্বেলে যজ্ঞ আর মন্ত্র উচ্চারণ হয়, আর সন্ধেবেলা সকলে মিলে এক জায়গায় বসে গল্প করেন।
একদিন সেখানে সৌতি নামে একজন এসে উপস্থিত হলেন। এঁর কাঁধে নানারকম পোঁটলাপুঁটলি দেখলেই বোঝা যায়, ইনি নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ান। ইনি কিন্তু ব্রাহ্মণ নন, সূত। সূতরা রথ চালান কিংবা অন্য ব্যাবসা-ট্যাবসা করেন, কেউ-কেউ গল্প বলতেও খুব ওস্তাদ। এখন যেমন অনেকে ঘুরে-ঘুরে বই বিক্রি করে, তখন তো বই ছিল না। তাই এই ধরনের লোকেরা ঘুরে-ঘুরে নানান জায়গায়। গল্প শোনাতেন। তার মানে, গল্প শোনানোটাও কারও-কারও। জীবিকা হতে পারে। ব্রাহ্মণ নন বলেই সৌতি এই যজ্ঞে নিমন্ত্রিত হয়ে আসেননি, এসেছেন গল্প শোনাবার জন্য। গল্প শুনিয়ে বেশ কিছুটা আতপ চাল, নানান রকম ফল আর দু’-এক টুকরো সোনাও পাওয়া যায়। সৌতি এঁর আসল নাম নয়। অন্য একটা নামও আছে। তার দরকার নেই।
সৌতিকে দেখে ঋষিরা তাঁকে গল্পকথক বলে চিনলেন। অমনি কয়েকজন তাঁকে খাতির করে বললেন, “আরে ভাই, এসো-এসো, বোসো। অনেক দূর থেকে আসছ মনে হচ্ছে। বিশ্রাম করো, জল খাও।”
একজন জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এখন কোথা থেকে এলে?”
সৌতি বললেন, “আমি মহারাজ জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে গিয়েছিলাম, সেখানে মহাঋষি বেদব্যাসের পুরো মহাভারত শুনলাম।”
কয়েকজন চমকে উঠে বললেন, “সর্পযজ্ঞ! সে আবার কী?”
সৌতি বললেন, “বলছি, বলছি। সেই যজ্ঞ থেকে ফিরে আমি অনেক তীর্থস্থানে গেলাম, অনেক আশ্রমে ঘুরলাম। তারপর সমন্তু পঞ্চক নামে এক তীর্থস্থানে গেলাম। সেখানে কৌরব আর পাণ্ডবদের ঘোর যুদ্ধ হয়েছিল। তারপর আবার ঘুরতে-ঘুরতে এসে পড়লাম এখানে। এখন বলুন, আপনারা কোন গল্প শুনতে চান? আমার ঝুলিতে অনেক রাজারাজড়ার গল্পই আছে।”
তখন ওখানকার সব ঋষি বললেন, “তুমি আজকের ওই মহাভারতের গল্পই শোনাও। মহাত্মা বেদব্যাসের মহাভারতের নাম শুনেছি, কখনও শোনার সৌভাগ্য হয়নি। সেটাই শুনতে চাই।”
একজন জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি স্বয়ং বেদব্যাস ঋষির মুখ থেকে সেই কাহিনি শুনলে?”
সৌতি বললেন, “আজ্ঞে না। মহাত্মা বেদব্যাসের এক শিষ্য, তাঁর নাম বৈশম্পায়ন, তিনিই শুনিয়েছেন। মহারাজ জনমেজয় জানতে চাইছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষের কাহিনি। তবে স্বয়ং বেদব্যাসও সেখানে বসে ছিলেন তাঁর শিষ্যের পাশে।”
ওইখানে বসে শুনে-শুনেই সৌতি সব মুখস্থ করে ফেলেছিলেন? কী আশ্চর্য ক্ষমতা!
এই সৌতির মুখ থেকেই আমরাও শুনলাম মহাভারতকাহিনি। বহু বছর পর এই সৌতির মুখের কাহিনি নিয়েই বই ছাপা হয়েছে।
সেই কাহিনি শুরু করার আগে, একটা প্রশ্ন জাগে, রাজা জনমেজয়ের সভায় বেদব্যাস ঋষি বসে থাকলেন কী করে? তাঁর বয়স কত?
সত্যি কথা বলতে কী, বেদব্যাসের বয়সের গাছপাথর নেই। মহাভারতের আসল নায়ক-নায়িকাদের বহু আগে তাঁর জন্ম, তার পরেও বহু বছর, এমনকী, এ-কথাও বলা যেতে পারে যে, তিনি আজও বেঁচে আছেন! পুরাণকাহিনি অনুসারে তিনি অমর, বেশ লম্বা, গায়ের রং মিশমিশে কালো, পেট পর্যন্ত লম্বা দাড়ি, মাথার চুলে জটা, তিনি আজও ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অবশ্য এ যুগে তিনি চেহারা পালটে ফেলে ফুলবাবু সাজতেও পারেন। এ রকমও কল্পনা করা যায়, এখন মহাভারত নিয়ে যত সিনেমা, থিয়েটার, যাত্রা, নাচ- গান হয়, বেদব্যাস ঋষি আড়ালে বসে সব দেখছেন আর মৃদু-মৃদু হাসছেন। রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকি মুনি কিন্তু অমর নন, তিনি মরে গিয়েছেন কবেই। তিনি এখন চতুর্দিকে রামায়ণ নিয়ে যে কত টিভি সিরিয়াল আর নাটক হয়, তার কিছুই দেখে যেতে পারলেন না।
পুরাণে মোট সাত জনকে বলা হয়েছে অমর। অশ্বত্থামা, দৈত্যরাজ বলি, ঋষি বেদব্যাস, রামায়ণের হনুমান আর বিভীষণ, কৃপ আর পরশুরাম। এঁদের মধ্যে পরশুরামের কথা রামায়ণ আর মহাভারত দু’টোতেই আছে। এঁরা কেন বা কী করে অমর হলেন, তা আস্তে- আস্তে জানা যাবে।
সৌতির গল্প বলার কায়দাটা খুব অদ্ভুত। সোজাসুজি কিছু বলেন না। প্রথমে তিনি পুরো কাহিনিটাই খুব সংক্ষেপে জানিয়ে দিলেন। তাতে না আছে কোনও রস, না আছে মজা। তা শুনেই ঋষিরা হইহই করে উঠলেন, তাঁরা বললেন, “এ কী, মোটে এইটুকু! না, না, আমাদের হাতে অনেক সময় আছে, তুমি ধীরেসুস্থে, খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সব বলো।”
সৌতি তখনও কিন্তু গোড়া থেকে শুরু করলেন না। এই ঋষির গল্প, কোথায় কার সঙ্গে কার ঝগড়া, এইসব শোনাতে লাগলেন ছাড়া-ছাড়া ভাবে। এতেও কারও মন ভরে না। সকলে তোয়াজ করতে লাগলেন সৌতিকে। সর্পযজ্ঞের ব্যাপারটাই বা কী? সেটাও সৌতি ঠিক খুলে বলেন না, একটু ছুঁয়েই চলে যান অন্য দিকে, যাতে সকলের কৌতূহল আরও বেড়ে যায়।
আসলে জনমেজয় রাজার সর্পষজ্ঞ হয়েছিল মহাভারত কাহিনির একেবারে শেষে। অনেক গল্প বা সিনেমা যেমন ফ্ল্যাশব্যাকে হয়, শেষ থেকে শুরু, সর্পযজ্ঞ ব্যাপারটাও তাই। আমরা অত ঘোরালো- পাঁচালো ভাবে মহাভারত পড়তে চাই না। আমরা শুরু করব প্রথম থেকে।