০২. এক যে ছিলেন রাজা

॥ ২ ॥

এক যে ছিলেন রাজা…

কোন রাজা?

মহাভারতে এত রাজা আর তাঁদের বংশধরদের কথা আছে যে, মাথা গুলিয়ে যায়। অত মনে রাখাও যায় না। সব মনে রাখার দরকারও নেই।

আমরা একজন রাজাকে বেছে নিচ্ছি, তাঁর নাম যযাতি। এই যযাতিকে বেছে নেওয়ার একটা কারণও আছে।

এই যযাতির কথা বলার আগে একটু আগের কথা বলতে হবে। সেই সময় আকাশে থাকতেন দেবতারা আর অসুররা ছড়িয়ে ছিলেন পৃথিবীর নানান জায়গায়, তাঁরা সমুদ্রের তলাতেও থাকতে পারতেন। দেবতা আর অসুরদের প্রায়ই লড়াই হত। দু’ পক্ষের ক্ষমতাই প্রায় সমান-সমান। যুদ্ধে অনেক অসুর যেমন মরত, তেমনি প্রাণ হারাতেন। অনেক দেবতা।

দেবতারাও প্রাণ হারাতেন? সে কী! আমরা যে জানি, দেবতারা সকলেই অমর?

হ্যাঁ, এখন সব দেবতাই অমর ঠিকই, কিন্তু সে আমলে অমর ছিলেন না। তখনও তো তাঁরা অমৃত খাননি। পরে একসময় কোথা থেকে কলসিভরতি অমৃত পাওয়া গেল আর অসুরদের ঠকিয়ে দেবতারা সব অমৃত কীভাবে খেয়ে নিলেন, সে গল্প আমরা যথাসময়ে শুনব।

এখন যে আমলের কথা বলছি, তখন দেবতাদের তুলনায় বরং অসুরদের খানিকটা সুবিধেই ছিল। যুদ্ধে প্রাণ হারালেও কিছু-কিছু অসুর আবার বেঁচে উঠত। অমৃত না খেয়েই! কী করে?

দেবতাদের গুরুর নাম বৃহস্পতি আর অসুরদের গুরুর নাম শুক্রাচার্য, দু’জনেই খুব তেজস্বী। তবে বৃহস্পতির তুলনায় দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের একটা গুণ বেশি ছিল, তিনি মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র জানতেন, অর্থাৎ মৃতদের মন্ত্র পড়ে বাঁচিয়ে তুলতে পারতেন। তাই নিয়ে দেবতাদের বেশ দুঃখ ছিল।

তখন দেবতারা এক বুদ্ধি বের করলেন।

গুরু বৃহস্পতির একটি ছেলে আছে, যেমন সে চেহারায় রূপবান, তেমনই তার ব্যবহার সুন্দর। তার সঙ্গে কথা বললে সকলে খুশি হয়। এই ছেলেটির নাম কচ।

কয়েকজন দেবতা বৃহস্পতিকে অনুরোধ করলেন, “আপনার ছেলেকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিন না। শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে তাঁর শিষ্য হতে চাইবে। সেখানে শাস্ত্রপাঠ-টাঠ করতে-করতে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রটাও শিখে নিয়ে এখানে ফিরে আসবে। তারপর যত যুদ্ধ হবে, আমরাও মৃতদের বাঁচিয়ে দিতে পারব।”

বৃহস্পতি হেসে বললেন, “অত কি সোজা?”

দেবতারা বললেন, “কেন? বড়-বড় পণ্ডিতদের কাছে গিয়ে কেউ যদি শিষ্য হতে চায়, তাঁরা তো ফিরিয়ে দেন না। শুক্রাচার্য ওকে ফিরিয়ে দেবেন?”

বৃহস্পতি বললেন, “তা ফিরিয়ে দেবেন না। শুক্রাচার্য অতি ধুরন্ধর লোক। কচকে দেখলে উনি বুঝবেন, কেন সে এসেছে। আমার ছেলে হয়ে সে যাবে আমার শত্রুপক্ষের কাছে শাস্ত্র শিখতে? শুক্রাচার্য ওকে আর সবই শেখাবেন, আসল জিনিসটা ছাড়া।”

একজন দেবতা বললেন, “শুক্রাচার্যের একটি মেয়ে আছে, তার নাম দেবযানী। এই কচেরই বয়সি হবে। কচ যদি তার সঙ্গে ভাব করে নিতে পারে, তা হলে সে হয়তো বাবাকে বলে কচকে সাহায্য করতে পারে।”

বৃহস্পতি বললেন, “ঠিক আছে, গিয়ে দেখুক! যদি কার্যসিদ্ধি করতে পারে। তবে খুব সাবধানে থাকতে হবে। অসুররাও ওর আসল উদ্দেশ্যটা টের পেয়ে গেলে অনেক রকম বিপদ হতে পারে।”

তারপর শুভদিন দেখে কচ এসে পৌঁছে গেল পৃথিবীতে। অসুররাজার সভায় এসে গুরু শুক্রাচার্যকে প্রণাম করে নিজের পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানাল।

মিথ্যে কথা বলার তো উপায় নেই। শুক্রাচার্যের মতো বড়-বড় ঋষিরা যোগবলে এক নিমেষে সব জেনে যেতে পারেন। তিনি বললেন, “ঠিক আছে বৎস, আমি তোমাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলাম। তুমি আমার বাড়িতে থাকবে, আমি তোমাকে শাস্ত্র শেখাব।”

শুক্রাচার্য কচকে খুব কঠিন-কঠিন শাস্ত্রপাঠ দিতে লাগলেন। তিনি দেখতে চান, এত শক্ত-শক্ত পড়া দেখে ছেলেটি পালিয়ে যায় কিনা। কচ কিন্তু দারুণ ধৈর্যের সঙ্গে সব শিখতে লাগল।

দেবযানীর সঙ্গেও তার ভাব হয়ে গেল সহজেই। দেবযানীর বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আশপাশের কোনও মুনি-ঋষির ছেলেকেই তার পছন্দ হয়নি। তার বাবাও জোর করেন না। কোনও দিন ইচ্ছে হলে সে নিজেই বিয়ে করবে। কচ নাচ জানে, গান জানে, দেবযানী তো এসব আগে কখনও শেখেনি। দু’জনে ওরা বনের মধ্যে ঘুরতে-ঘুরাতে গান গায়।

একদিন দেবযানী কচকে দেখতে পেল না, সে কোথায় গেল? তার কুটিরে নেই, জলাশয়ের ধারে নেই, শুক্রাচার্যের আশ্রমে নেই। তা হলে? পড়াশোনার চাপ সহ্য করতে না পেরে সে পালিয়ে গেল দেবলোকে?

দেবযানী গিয়ে তার বাবার কাছে কেঁদে পড়ল।

শুক্রাচার্য তখন যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সঞ্জীবনী মন্ত্র পাঠ করলেন। তারপর উঁচু গলায় ডাকলেন, “কচ, কচ, তুমি যেখানেই থাকো, এই মুহুর্তে আমার সামনে এসে উপস্থিত হও!”

তখনই কাদের একটা কুকুর বিকট চিৎকার করে উঠল। তার পেট ফেটে সেখান থেকে বেরিয়ে এল কচ। ঠিক আগের মতো চেহারা।

এ কী ব্যাপার হল? সে কুকুরের পেটে গিয়েছিল কী করে?

কচ বলল, “আমি ঠিক জানি না, আমি কী দোষ করেছি। জঙ্গলের মধ্যে কয়েকজন অসুর আমাকে ঘিরে ধরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে লাগল। তারপর একেবারে কুচি-কুচি করে কেটে খাইয়ে দিল একটা কুকুরকে। কেন তারা এমন করল, আমি জানি না।”

শুক্রাচার্য বললেন, “কিছু-কিছু অসুর সন্দেহ করেছে, কেন শত্রুপক্ষ বৃহস্পতির পুত্রকে পাঠিয়েছে এখানে।”

তিনি শুধু বললেন, “হুঁ, সাবধানে থেকো।”

কচ এই প্রথম মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে গেল। অসুররা তার সারা শরীরটা একেবারে খণ্ড-খণ্ড করে কেটেছিল, কিন্তু এখন সারা শরীরে একটুও দাগ নেই। সব ঠিকঠাক আগের মতো। কবে সে এই মন্ত্র শিখবে?

শুক্রাচার্য কিন্তু তাকে এই মন্ত্র শেখাবার কোনও নামই করছেন না। আরও কঠিন-কঠিন শাস্ত্র পড়াচ্ছেন।

কয়েকজন অসুর আবার একদিন কচকে ধরে নিয়ে গেল নদীর ধারে। তাকে খুন করে ভাসিয়ে দিল জলে।

এবারেও দেবযানীর কান্নাকাটিতে শুক্রাচার্য বাঁচিয়ে দিলেন কচকে।

কথায় বলে, বারবার তিন বার। অসুররা এবার এমন সাংঘাতিক একটা কাণ্ড করল, যাতে কচকে বাঁচাবার আর কোনও উপায়ই রইল না।

রাত্তিরবেলা যখন সকলে ঘুমন্ত, তখন কয়েকজন অসুর নিঃশব্দে কচকে তুলে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে খুন করল। তারপর পুড়িয়ে ছাই করে ফেলল একেবারে। সেই ছাই সবটুকু তুলে মিশিয়ে দিল এক হাঁড়ি সোমরসের মধ্যে। খানিকটা লেবুর রস দিয়ে সেই রসকে আরও সুস্বাদু করা হল। সেই হাঁড়িটা রেখে দেওয়া হল শুক্রাচার্যের আশ্রমে।

পরদিন সন্ধেবেলা শুক্রাচার্য একটু-একটু সোমরস পান করতে-করত সবটাই শেষ করে ফেললেন। আজ একটু অন্যরকম স্বাদ হলেও ভালই লাগল তাঁর।

এদিকে আবার পাওয়া যাচ্ছে না কচকে। তাকে একা-একা বেশি দূর যেতে নিষেধ করা হয়েছিল। সে যেও না, তবু সে হারিয়ে গেল কী করে? দেবযানী জঙ্গলে, নদীর ধারে সব জায়গায় তন্নতন্ন খুঁজেও কচকে পেল না। পাবে কী করে? কচ তো আর নেই।

দেবযানী এমন কাঁদতে লাগল, যেন অজ্ঞান হয়ে যাবে। গড়াগড়ি দিতে লাগল মাটিতে।

শুক্রাচার্য আবার যজ্ঞের আগুন জ্বালালেন। তারপর মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র সবেমাত্র একটুখানি উচ্চারণ করতে না করতেই তাঁর পেটের মধ্যে থেকে কচ বলে উঠল, “গুরুদেব, এই যে আমি এখানে।”

কাছাকাছি যারা রয়েছে, সবাই একেবারে স্তম্ভিত। মানুষের পেটের মধ্যে মানুষ? তাও বেঁচে আছে!

এখন কী হবে?

কচকে বাঁচাতে হলে শুক্রাচার্যকে মরতে হবে। কারণ, তার পেট ভেদ করে বের করতে হবে কচকে। আর শুক্রাচার্যকে বাঁচাতে হলে কচকে একেবারে হজম করে ফেলতে হবে। একেই বলে, উভয় সংকট।

সন্ধেবেলা আর সবাই চলে গিয়েছে। শুক্রাচার্যের কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে দেবযানী। তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে শুক্রাচার্য ভাঙা-ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কী চাস বল তো, মা? আমি মরে গিয়ে কচকে বাঁচিয়ে তুলব? তোর জন্য আমি তাতেও রাজি আছি।”

দেবযানী মুখ তুলে “না-না!” বলে চিৎকার করে উঠল।

সে তার বাবাকে খুবই ভালবাসে। বাবার মৃত্যু চাইতে পারে না। আবার কচের মৃত্যুও সে সহ্য করতে পারছে না।

একটু পরে সে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, এমন কি কোনও উপায় নেই, যাতে তোমরা দু’জনেই বেঁচে থাকতে পার?”

তখনই উত্তর না দিয়ে শুক্রাচার্য চুপ করে রইলেন।

একটি মাত্র উপায় আছে, যদি অন্য কাউকে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রটি প্রয়োগ করতে শিখিয়ে দেওয়া যায়। সে তা হলে প্রথমে শুক্রাচার্যের পেট ফাটিয়ে কচকে বের করে আনবে। তারপর সেই মন্ত্রেই সে আবার শুক্রাচার্যকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে।

কিন্তু এ মন্ত্র তো যে-কেউ শিখতে পারে না। তার জন্য অনেক শাস্ত্রপাঠ, অনেক জ্ঞান সঞ্চয় করতে হয়। অসুরদের মধ্যে কারও তা নেই। একমাত্র কচেরই সে যোগ্যতা আছে। গুরুর পেটের মধ্যে কচ এখনও বেঁচে আছে, তাকে এই মন্ত্র শিখিয়ে দেওয়া এখনও সম্ভব।

শুক্রাচার্য একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি এতদিন ধরে কিছুতেই কচকে সেই মন্ত্র দান করেননি, এখন নির্বোধ অসুরদের এই কাণ্ডের জন্য তিনি কচকে শেখাতে বাধ্য হলেন।

কচি বেঁচে ওঠার পর যদি শুক্রাচার্যকে বাঁচাতে রাজি না হয়? সে তো আসলে শত্রুপক্ষের লোক। মন্ত্রটা পাওয়ার পর ছিন্নভিন্ন অবস্থায় শুক্রাচার্যকে ফেলে রেখে সে পালিয়ে যেতে পারে দেবলোকে। সেখানে আনন্দের উৎসব শুরু হয়ে যাবে। কচ মৃত সব দেবতাদের বাঁচিয়ে তুলবে আর অসুরদের কেউ থাকবে না।

তবু শুক্রাচার্য নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বৎস কচ, তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে?”

কচ বলল, “কষ্ট যাই হোক, আপনার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।”

শুক্রাচার্য বললেন, “তা হলে মন দিয়ে শোনো, আমি তোমাকে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাকে জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনব। আমি এখানে যে যজ্ঞের আগুন জ্বেলেছি, সেই আগুনেই তুমি এই মন্ত্র পড়ে আমার প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারা। যদি তোমার ইচ্ছে হয়।”

মন্ত্র পড়লেন শুক্রাচার্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ নিখুঁত শরীর নিয়ে শুক্রাচার্যের পেট ফাটিয়ে বেরিয়ে এল কচ। শুক্রাচার্য কোনও রকম যন্ত্রণার শব্দও করলেন না। রক্তাক্ত শরীরে চিত হয়ে পড়ে রইলেন।

বাবার ওই অবস্থা দেখে আকুল ভাবে কাঁদতে লাগল দেবযানী। কচ তার দিকে একবারও তাকাল না, সে যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিয়ে মন্ত্র পড়তে লাগল।

প্রথমবার একটু ভুল হলেও যজ্ঞে পরপর তিন বার সেই মন্ত্র সম্পূর্ণ করার পর প্রাণ ফিরে পেয়ে উঠে বসলেন শুক্রাচার্য, তাঁর শরীর ঠিক আগের মতো।

কচ এবার শুক্রাচার্যের পায়ের কাছে শুয়ে পড়ে আনন্দ আর কান্না মেশানো গলায় বলতে লাগল, “গুরুদেব, আপনি বারবার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আপনি আমাকে সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র দান করেছেন। আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আপনি যা আদেশ দেবেন, তাই পালণ করব।”

শুক্রাচার্য তার মাথায় হাত ছুঁইয়ে নিঃশব্দে আশীর্বাদ করলেন।

কচ বলল, “গুরুদেব, আপনি অনুমতি দিলে আমি এবার বাড়ি ফিরে যেতে পারি। অনেক দিন আপনজনদের দেখিনি। মন কেমন করছে।”

শুক্রাচার্য বললেন, “এবার তো তুমি ফিরে যেতেই পার। তোমাকে আমি আটকাব কী করে? অনেক দিন এখানে আছ ঠিকই। তা ছাড়া যে উদ্দেশ্য নিয়ে তুমি এসেছিল, তাও সিদ্ধ হয়েছে। যাও, ফিরে যাও! এখানে অসুররা তোমাকে আবার মেরে ফেলার চেষ্টা করতে পারে।”

কিন্তু তখনই ফিরে যাওয়া কচের পক্ষে সহজ হল না।

বাবা বেঁচে আছেন। প্রিয় বন্ধু কচও ফিরে এসেছে, তাই দেবযানীর আনন্দের সীমা নেই। সে বাইরের বাগানে বসে কচের কাছে গান শুনতে চাইল।

দু’-তিন খানা গান শোনাবার পর কচ বলল, “হে দেবী, এবার আমায় যেতে হবে।”

দেবযানী হেসে বলল, “আমি হঠাৎ দেবী হয়ে গেলাম কেন? আমি তো তোমার বন্ধু।”

কচ গম্ভীর ভাবে বলল, “তুমি আমার গুরুর মেয়ে। তোমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলাই তো আমার উচিত।”

এর পর কচ নিজের দেশে ফিরে যাবে শুনে দেবযানী আঁতকে উঠল।

সে বলল, “না, না। তোমার ফেরা হবে না। আমি তো ঠিক করে ফেলেছি, আমাদের দু’জনের বিয়ে হবে। তুমি এখানেই থাকবে।”

কচের পক্ষে তো আর এখানে থেকে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল, দেবতারাও অপেক্ষা করছেন তার জন্য।

দেবযানী আবার বলল, “আমি তোমার কত সেবা করেছি। আমার জন্যই বাবা বারবার তোমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। আমার জন্যই তুমি মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র শিখেছ। এখন আমায় ছেড়ে চলে যেতে চাইছ?”

কচ বলল, “তুমি আমার অশেষ উপকার করেছ, তা ঠিক। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারব না। আমি গুরু শুক্রাচার্যের শরীরের মধ্যে ছিলাম, সেখান থেকে বেরিয়েছি, সুতরাং আমি তাঁর ছেলের মতো হয়ে গিয়েছি। আর তুমি তাঁর মেয়ে। তার মানে, আমরা তো ভাই-বোন। ভাই-বোনে আবার বিয়ে হয় নাকি?”

দেবযানী বলল, “ধ্যাৎ, যতসব বাজে কথা।”

এই রকম তর্ক হতে-হতে দেবযানী একসময় খুব রেগে গিয়ে বলল, “আমি তোমার এত উপকার করলাম, আর তার বদলে তুমি আমায় অপমান করছ? বেশ, যাও ফিরে যাও! আমি তোমায় অভিশাপ দিচ্ছি, তুমি যে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র শিখলে, সেটা তুমি প্রয়োগ করতে পারবে না। তুমি কাউকেই বাঁচাতে পারবে না।”

এই অভিশাপ শুনে কচ বেশ কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। যাঃ, তার এত কষ্ট, এত সাধনা বৃথা গেল? এত বড় ঋষির মেয়ের কথা তো মিথ্যে হবে না।

একটু পরে সে গভীর দুঃখের সঙ্গে বলল, “দেবযানী, তুমি অন্যায় ভাবে আমাকে এই অভিশাপ দিলে। তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমিও তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি, কোনও ঋষিপুত্রের সঙ্গেই তোমার বিয়ে হবে না। আর সঞ্জীবনী মন্ত্র আমি প্রয়োগ করতে পারব না বটে, কিন্তু অন্যদের তো শেখাতে পারব? সেরকম শিষ্য তৈরি করে নেব আমি।”

এই বলে কচ চলে গেল দেবলোকে।

দেবযানীর মনে আর সুখ নেই। তার আর নাচতে ভাল লাগে না, গান গাইতে ভাল লাগে না। একা-একা ঘুরে বেড়ায়। মেজাজটা খিটখিটে হয়ে গিয়েছে, যার-তার সঙ্গে ঝগড়া করে।

একদিন সাংঘাতিক ঝগড়া হয়ে গেল সেখানকার রাজকন্যা শর্মিষ্ঠার সঙ্গে।

অসুররাজ বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা আর দেবযানী প্রায় সমান বয়সি। দু’জনেই রূপে-গুণে সমান। তবে রাজার মেয়ে বলে শর্মিষ্ঠার ব্যবহারে সব সময় অহংকার-অহংকার ভাব।

একদিন দু’জনেই অনেক সঙ্গী ও সহচরী নিয়ে খেলা করছিল বাগানে। তারপর একটা সরোবরে নেমে গেল সাঁতার কাটতে। এই সময় প্রবল বেগে বাতাস বইতে লাগল। তার ফলে, উপরে রেখে যাওয়া মেয়েদের পোশাকটোশাকগুলো জড়িয়েমড়িয়ে গেল। মেয়েরা তাড়াতাড়ি উঠে এসে দৌড়ে খুঁজতে লাগল নিজেদের পোশাক।

শর্মিষ্ঠা ভুল করে দেবযানীর একটা ওড়না জড়িয়ে নিল নিজের গায়ে।

দেবযানীর এমনিতেই মেজাজ খারাপ। সে রেগেমেগে বলল, “এই, তুই আমার ওড়না নিয়েছিস কেন রে?”

শর্মিষ্ঠা বলল, “ও, ভুল হয়ে গিয়েছে, দেখছি।”

দেবযানী বলল, “তোরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কাকে বলে জানিস না। আমার ওড়নাতে বিচ্ছিরি গন্ধ হয়ে যাবে।”

এবার শর্মিষ্ঠাও রেগে উঠে বলল, “আমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কাকে বলে জানি না? তুই কি জানিস? থাকিস তো একটা কুঁড়েঘরে। আমাদের রাজবাড়িতে তোর মতো গন্ডা-গন্ডা দাসী। তারাও তোর চেয়ে বেশি পরিষ্কার।”

দেবযানী বলল, “এঃ, ভারী তো রাজবাড়ির গর্ব করছিস। আমার বাবা ইচ্ছে করলে ওরকম কত রাজবাড়িতে থাকতে পারতেন, তোর বাবা আমার বাবার সামনে সব সময় হাতজোড় করে কথা বলেন। না? তুইও তাই করবি।”

শর্মিষ্ঠা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “আমার বাবা হাতজোড় করে থাকেন? বাবা বসেন সিংহাসনে, তোর বাবা বসেন তাঁর পায়ের কাছে। আমার বাবার দয়াতেই তো তোরা বেঁচে আছিস। না হলে তোরা তো ভিখিরি, খেতে পেতিস না। এ রকম পোশাকই বা পেতিস কোথায়।

ঝগড়া, গালাগালি চলতে-চলতেই শুরু হয়ে গেল ঠেলাঠেলি, হাতাহাতি। দেবযানী একা আর শর্মিষ্ঠার সঙ্গে অনেক দাসী। অনেকে মিলে দেবানীকে ঠেলতে-ঠেলতে একটা শুকনো কুয়োর মধ্যে ফেলে দিল।

তখন কয়েকটি মেয়ে ভয় পেয়ে বলে উঠল, “এই রে, এখন কী হবে?”

কিন্তু শর্মিষ্ঠার মাথায় তখন এমন আগুন জ্বলছে যে, সে বলল, “বেশ হয়েছে। দ্যাখ তো, মরে গেল নাকি?”

কুয়োর মধ্যে পড়েই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে দেবযানী। কোনও সাড়াশব্দ নেই।

ঠোঁট উলটে শর্মিষ্ঠা বলল, “মরেই গিয়েছে। ঠিক হয়েছে। চল, চল, বাড়ি চল।”

দেবযানীকে সেই কুয়োর মধ্যে ফেলে রেখে সদলবলে চলে গেল শর্মিষ্ঠা।

বেশ কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে এল দেবযানীর। প্রথমে সে বুঝতেই পারল না যে, সে কোথায়? অন্ধকার প্যাচপেচে জায়গা। উঠে দাঁড়িয়েও উপরের দিকে তার হাত পৌঁছল না। এখান থেকে সে উদ্ধার পাবে কী করে?

কান্না এসে গেল তার। সে কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

প্রায় এক প্রহর পরে সেই কুয়োর কাছাকাছি শোনা গেল ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ। অনেক মানুষের কণ্ঠস্বর। এক রাজা তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে শিকার করতে-করতে চলে এসেছেন সেখানে।

এই রাজার নাম যযাতি। প্রথমেই যাঁর কথা বলেছি।

শৌনক ঋষির যজ্ঞের কাছে অনেক মুনি-ঋষি যেখানে সৌতির মুখ থেকে গল্প শুনছিলেন, সেখানে দু’-একজন ঋষি এই সময় বললেন, “সৌতি, তুমি যে বলছিলে, জনমেজয় রাজার সর্পযজ্ঞে আকাশ থেকে অনেক সাপ টপাটপ খসে পড়ছিল আগুনে, সেখানে তারপর কী হল?”

আর-একজন ঋষি হইহই করে বললেন, “না, না, আমরা যযাতির গল্পটাই আগে শুনতে চাই।”

আমরাও যযাতির কাহিনিই অনুসরণ করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *