॥ ৪ ॥
রাজকুমাররা যে শুধু রাজভোগ খায় আর খেলাধুলো করে সময় কাটায়, তা কিন্তু নয়। ভোরবেলা উঠে তাদের নানারকম ব্যায়াম করতে হয়, তির-ধনুকের যুদ্ধ আর গদাযুদ্ধও শিখতে হয়। অনেক ছবিতে আমরা দেখি রাজকুমাররা তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করছে, মহাভারতের যুগে কিন্তু তলোয়ার ছিল না। ছিল খড়্গ বা খাঁড়া। ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ তখনও চালু হয়নি, অবশ্য ঘোড়ায় টানা রথ ছিল। সেই রথ যারা চালাত, তাদের বলা হত সারথি। রাজকুমারদেরও শিখতে হত রথ চালানো।
এ ছাড়া রাজকুমারদের পড়াশোনাও করতে হত। গুরুর কাছে তারা শাস্ত্রের পাঠ নিত। রাজ্য চালাবার যত রকম নিয়মকানুন, তাও জেনে নিতে হত। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের তুলনায় রাজকুমারদের যুদ্ধবিদ্যা আর শাস্ত্রজ্ঞানে অনেক উন্নত হতে হত, আর যেসব রাজকুমার এসব পারত না, তারা এলেবেলে হয়ে পিছিয়ে পড়ত।
দুর্যোধন আর তার ভাইরা, যুধিষ্ঠির আর তার ভাইরা সবাই রাজকুমার। সবাই অস্ত্রচালনা শেখা, শাস্ত্রপাঠ আর খেলাধুলো করত একসঙ্গে। তবে সবাই তো সব ব্যাপারে সমান হয় না, ক্রমশ বোঝা গেল তির-ধনুকের যুদ্ধে অর্জুনই সবার চেয়ে ভাল, যুধিষ্ঠিরের ঝোঁক পড়াশোনার দিকে আর গদাযুদ্ধে দুর্যোধন আর ভীম কেউ কাউকে সহজে হারাতে পারে না। এ ছাড়া ভীমের যেমন মস্ত বড় চেহারা, তেমনি তার দারুণ গায়ের জোর। খেলাধুলোর সময় ভীম, কৌরবভাইদের খুব জ্বালাতন করে। মাঝে-মাঝেই ভীম দু’ জন জ্যাঠতুতো ভাইকে ধরে মাথা ঠুকে দেয়, কখনও তাদের একজনকে চুলের মুঠি ধরে বোঁ বোঁ করে ঘোরায়, কখনও স্নান করার সময় ভীম একাই জনাদশেক কৌরব রাজকুমারকে চেপে ধরে জলের মধ্যে ঠুসে দেয়। তারা যখন মৃত্যুভয়ে আঁকুপাকু করে, তখন ভীম হাসতে-হাসতে তাদের ছেড়ে দেয়। কৌরবরা যদি খেলার সময় কোনও গাছে ওঠে, অমনি ভীম সেই গাছে এমন জোরে-জোরে লাথি মারে যে, গাছটা থরথর করে কাঁপতে থাকে। আর কৌরব ছেলেরা টুপটাপ করে খসে পড়ে নীচে, তাতে তাদের হাত-পা মচকায় কিংবা মাথায় চোট লাগে। ভীম এসবই করে মজার জন্য। কিন্তু ভীমের পক্ষে যেটা মজা, অন্যদের কাছে তা খুবই ভয়ের ব্যাপার।
দু’পক্ষের রাজকুমার একসঙ্গেই সব কিছু শিখছে বটে, কিন্তু মনে-মনে তো তাদের চিন্তা আছে যে, সময় হলে কে হবে রাজা? দুর্যোধন ধরেই নিয়েছে, ধৃতরাষ্ট্রের বড়ছেলে হিসেবে সে-ই রাজা হবে। ওদিকে যুধিষ্ঠিরেরও দাবি কম নয়। এদের যে দু’জন গুরু, সেই কৃপ আর দ্রোণ, পাণ্ডবদেরই বেশি পছন্দ করেন। অর্জুন তো তাঁদের চোখের মণি। আরও অনেকে যুধিষ্ঠিরের পক্ষে। কিন্তু দুর্যোধন ঠিক করেছে, যে যাই বলুক, ছলে-বলে-কৌশলে তাকে রাজা হতেই হবে। এ নিয়ে যদি ঝগড়াঝাঁটি বা লড়াই হয়, তা হলেও দুর্যোধনের ধারণা, অন্য পাণ্ডবভাইদের আটকে রাখা যাবে, শুধু দুশ্চিন্তা ভীমকে নিয়ে। তাকে যে সব কৌরবভাই-ই খুব ভয় পায়।
একদিন গঙ্গার ধারে এক বাগানে সবাই মিলে পিকনিক করতে গেল। ভারী চমৎকার জায়গা, আর প্রচুর খাবারদাবারের ব্যবস্থা। কিছুক্ষণ খেলাধুলো আর জলে দাপাদাপির পর খাওয়াদাওয়া। সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলেও ভীমের আর শেষই হয় না। সে যে একাই পনেরো-কুড়ি জনের সমান খাবার খায়। এই সময় দুর্যোধন চুপিচুপি বিষ মিশিয়ে দিল ভীমের খাবারে। সেই বিষাক্ত খাবারও ভীম খেয়ে নিল কিছু সন্দেহ না করে। তারপর একসময় সেখানেই সে ঢলে পড়ে গেল। দুর্যোধন তখন লতাপাতা দিয়ে ভীমের হাত-পা বেঁধে ফেলে দিল গঙ্গায়। ব্যস, নিশ্চিন্ত।
এতেও কিন্তু ভীমের মৃত্যু হল না। লতার বাঁধন ছিঁড়ে একসময় সে উঠে এল জল থেকে। এর পর পাণ্ডবরা অনেক সাবধান হয়ে গেল।
রাজকুমারদের প্রথম অস্ত্রগুরুর নাম কৃপা তাঁর বোন কৃপীর স্বামীর নাম দ্রোণ। ইনি ব্রাহ্মণ হয়েও অসাধারণ যুদ্ধবিদ্যা অর্জন করেছিলেন। এঁর কাছেই শিক্ষা পেয়ে কৌরব আর পাণ্ডবরা অসাধারণ বীর হয়ে ওঠে। দ্রোণের ছেলের নাম অশ্বত্থামা। সেও রাজকুমারদের সঙ্গে বড় হয়ে উঠল। সকালবেলা রাজকুমাররা আসবার আগেই দ্রোণ তাঁর ছেলেকে বিশেষ ভাবে অস্ত্রশিক্ষা দিতেন। অর্জুন সে-কথা জানতে পেরে সূর্য ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে চলে আসত গুরুর বাড়িতে। অর্জুনের এত বেশি আগ্রহ দেখে দ্রোণ তাকে শেখাতেন খুব যত্ন করে। তাঁর ইচ্ছে হল, অর্জুনই হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বীর। তার সমকক্ষ কেউ থাকবে না।
এই সময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল।
রাজকুমাররা মাঝে-মাঝেই শিকার করতে যায়, সেটাও তাদের শিক্ষার অঙ্গ। দল বেঁধে সবাই যায়, সঙ্গে অনেক কুকুরও থাকে। কুকুরগুলোই বুনো জন্তুদের খুঁজে বের করে। কিছুক্ষণ সবাই মিলে দাপাদাপি করার পর একসময় ওদেরই একটা কুকুর অর্জুন আর কয়েক জনের সামনে এসে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল। তার মুখের মধ্যে সাতখানা ছোট-ছোট তির বেঁধা। তাতে সে মরছে না বটে, কিন্তু কোনও আওয়াজও বের করতে পারছে না। সবাই হতবাক। এ রকম আশ্চর্য ব্যাপার কেউ কখনও দেখেনি। এ যেন তির চালিয়ে কুকুরটার মুখ সেলাই করে দেওয়া হয়েছে।
এ রকম ক্ষমতা অর্জুনেরও নেই। কে এই কাণ্ড করেছে, তাকে খুঁজতে বেরোল সকলে। একসময় দেখা গেল, বনের মধ্যে একটা কুঁড়েঘর, সেখানে ধনুক আর বাণ হাতে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। সে প্রায় অর্জুদেরই সমবয়সি, গায়ের রং কুচকুচে কালো। সে কোনও দিকে না তাকিয়ে শুধু শব্দ শুনেই তির ছুড়ছে।
অর্জুন তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “হে বীর, তুমি কে? কার পুত্র?”
সে ছেলেটি বলল, “আমি নিষাদদের নেতা হিরণ্যধেনুর ছেলে।”
অর্জুন আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী? তুমি কার কাছ থেকে এমন অপূর্ব যুদ্ধবিদ্যা শিখেছ?”
ছেলেটি বলল, “আমার নাম একলব্য। আমার গুরু দ্রোণ। আমি তাঁর কাছেই সব কিছু শিখেছি।”
এই কথা শুনে রাজকুমারদের বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। এই ছেলেটি অস্ত্রগুরু দ্রোণের শিষ্য? দ্রোণ কবে একে সব শেখালেন? এ ছেলেটিকে তো আগে ওরা কেউ দেখেনি!
অর্জুনের মনে বেশ দুঃখ হল। দ্রোণ তাকে বলেছিলেন, অর্জুনই হবে সবচেয়ে বড় যোদ্ধা, কিন্তু এ ছেলেটি তো তার চেয়েও বেশি কিছু জানে।
রাজকুমাররা ফিরে এসে দ্রোণকে সব কথা জানাতে, তিনিও খুব বিস্মিত হলেন। একলব্য সে আবার কে? এই নামে তো তাঁর কোনও শিষ্য নেই। এই নামটাই তিনি আগে শোনেননি। তিনি রাজকুমারদের বললেন, “চলো তো, চলো তো, আমি নিজে গিয়ে দেখি?”
কয়েক দিনের মধ্যেই আবার সকলে এল সেই জঙ্গলে। সেই কুঁড়েঘরটার সামনে একলব্য একই রকম ভাবে তির ছোড়া অভ্যেস করছে।
দ্রোণকে দেখেই সে অতিব্যস্ত হয়ে দৌড়ে এসে মাটিতে শুয়ে পড়ে প্রণাম করল। জল এনে ধুয়ে দিল তাঁর পা। একটা পাথরের উপর হরিণের চামড়া পেতে আসন তৈরি করল দ্রোণের জন্য। তারপর তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রইল হাতজোড় করে।
দ্রোণ বললেন, “ওহে, তুমি তো দেখছি যথার্থ একজন বীর। কিন্তু আমি তো তোমায় কখনও দেখিনি। আমি তোমার গুরু হলাম কী করে?”
একলব্য বলল, “কয়েক বছর আগে আমি আপনার কাছে গিয়েছিলাম আপনার শিষ্য হতে। আপনি রাজি হননি। হয়তো আপনার মনে নেই।”
সত্যিই দ্রোণের কিছুই মনে নেই। তিনি বললেন, “আমি তোমায় কিছুই শেখাইনি। তবু তুমি আমায় গুরু বলছ কেন?”
একলব্য বলল, “আপনার চেয়ে বড় গুরু তো আর হয় না। তাই আমি ফিরে এসে মাটি দিয়ে আপনার একটা মূর্তি গড়েছি।”
ঘরের দরজাটা খুলে দিয়ে সে বলল, “এই দেখুন সেই মূর্তি। আমি রোজ এই মুর্তি পুজো করি। তারপর একা-একা অস্ত্রচালনা অভ্যেস করেছি। তাতেই যেটুকু পারি, শিখেছি। আপনি অবশ্যই আমার গুরু।”
দ্রোণের প্রায় স্তম্ভিত হওয়ার মতো অবস্থা। জঙ্গলের মধ্যে একা-একা এই ছেলেটি এত কিছু শিখেছে! কতখানি নিষ্ঠা আর মনের জোর থাকলে এটা সম্ভব। এ রকম আর কখনও শোনা যায়নি।
দ্রোণ রাজকুমারদের মুখের দিকে তাকালেন। অর্জুনের মনের জ্বালা তিনি বুঝতে পারলেন ঠিকই। তিনি নিজেই তো চেয়েছিলেন, অর্জুনের সমান যোদ্ধা আর কেউ হবে না। এ ছেলেটি তো এর মধ্যেই অর্জুনকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।
তিনি বললেন, “ওহে নিষাদ, তুমি যখন আমাকে গুরু বলেই মেনেছ, তখন তো তোমাকে গুরুদক্ষিণাও দিতে হবে।”
একলব্য বলল, “নিশ্চয়ই। সে তো আমার সৌভাগ্য। আমার যা কিছু আছে, যতটুকু আমার সাধ্য, সবই আপনাকে দিতে রাজি আছি। আপনি অনুগ্রহ করে কী চান বলুন।”
দ্রোণ বললেন, “যা চাইব তাই-ই যদি দিতে চাও, তা হলে তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি কেটে আমাকে উপহার দাও।”
দ্রোণের এ রকম নিষ্ঠুর কথা শুনেও এক মুহূর্ত দ্বিধা করল না একলব্য। সে তক্ষুনি একটা খড়গ এনে ঘ্যাচাং করে কেটে ফেলল তার বুড়ো আঙুল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছড়াতে লাগল চতুর্দিকে।
দ্রোণ এই অত্যন্ত অন্যায় কাজটি করলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য অর্জুনের জন্য। অর্জুনের আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না।
যারা জঙ্গলে থাকে, শিকার করাই যাদের পেশা, তাদের বলে নিষাদ। আদিবাসীও বলা হয়। এই একজন নিষাদের ছেলে রাজকুমারদের সঙ্গে যুদ্ধবিদ্যা শিখবে, তা দ্রোণ চাননি বলেই একলব্যকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের চেষ্টায় সে যদি অনেক কিছু শিখতে পারে, সেজন্য তো তাকে দোষ দেওয়া যায় না। তবু তার উপর এমন অবিচার করলেন দ্রোণ। বুড়ো আঙুল কেটে ফেললে মানুষ আর যুদ্ধ করতে তো পারেই না, কোনও কিছুই শক্ত করে ধরতে পারে না। দ্রোণ অসাধারণ অস্ত্রগুরু ছিলেন বটে, কিন্তু মানুষটা তেমন মহৎ ছিলেন না। সেজন্য তাঁকে প্রতিফলও পেতে হয়েছিল।
যাই হোক, রাজকুমারদের তো শিক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে, এবার লোকজনের সমাজে তাদের কৃতিত্বের প্রমাণ দিতে হবে। এজন্য দ্রোণ পরপর দু’টি ব্যবস্থা করলেন।
প্রথমে তিনি একজন শিল্পীকে দিয়ে একটা নীল রঙের পাখি তৈরি, করালেন। তারপর সেই পাখিটিকে একটা উঁচু গাছের উপর বসিয়ে সমস্ত রাজকুমারদের ডাকলেন। তাদের বললেন, “তোমরা সবাই তির-ধনুক নিয়ে তৈরি হও। ওই যে পাখিটা দেখছ, ওর মুন্ডু কেটে মাটিতে ফেলতে হবে। একে-একে এসো, আমি বলার পর তির ছুড়বে।”
প্রথমে তিনি ডাকলেন যুধিষ্ঠিরকে।
যুধিষ্ঠির তির-ধনুক উঁচিয়ে তৈরি হতেই দ্রোণ বললেন, “বৎস, তুমি ওই গাছের ডালে পাখিটিকে দেখতে পাচ্ছ?”
যুধিষ্ঠির বলল, “হ্যাঁ, গুরুদেব।”
দ্রোণ আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি পাখিটা ছাড়া পুরো গাছটা দেখতে পাচ্ছ?”
যুধিষ্ঠির বলল, “হ্যাঁ গুরুদেব, আমি সবাইকেই দেখতে পাচ্ছি।”
দ্রোণ হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন, “ধুত, তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। তুমি এখান থেকে সরে পড়ো।”
যুধিষ্ঠির বেচারি ভাল মানুষ। যুদ্ধবিদ্যা তেমন ভাল ভাবে শিখতে পারেনি। কিন্তু তির ছোড়ার আগেই সে কেন এমন ধমক খেল, তা বুঝতেই পারল না।
দ্রোণ এবার ডাকলেন দুর্যোধনকে। তাকেও তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি নীল পাখিটা দেখতে পাচ্ছ?”
দুর্যোধন বলল, “হ্যাঁ গুরুদেব, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।”
দ্রোণ আবার প্রশ্ন করলেন, “তুমি পুরো গাছটা, আমাকে, তোমার ভাইদেরও দেখতে পাচ্ছ?”
দুর্যোধন সগর্বে উত্তর দিল, “কেন দেখতে পাব না, সবই দেখতে পাচ্ছি। আমার তো চোখ খারাপ নয়।”
দ্রোণ গম্ভীর ভাবে বললেন, “এই উত্তর আমি শুনতে চাইনি, তুমি সরে যাও।”
এর পর আরও অন্য রাজকুমারদের ডাকা হল। কারও উত্তরই দ্রোণের পছন্দ হল না।
একেবারে শেষে তিনি ডাকলেন অর্জুনকে। অর্জুন ধনুর্বাণ নিয়ে প্রস্তুত হওয়ার পর দ্রোণ জিজ্ঞেস করলেন, “বৎস, তুমি কি গাছটি দেখতে পাচ্ছ? গাছের উপর পাখিটাকে? আমাকে আর তোমার ভাইদের?”
অর্জুন বলল, “গুরুদেব, আমি গাছটি দেখতে পাচ্ছি না, আপনাকে আর ভাইদেরও দেখছি না। শুধু পাখিটাকে দেখছি।”
দ্রোণ বললেন, “তুমি গোটা পাখিটাকে দেখতে পাচ্ছ?”
অর্জুন বলল, “না, আপনি তো বলেছেন ওর মাথাটা কেটে ফেলতে, তাই আমি শুধু ওর মাথাটাই দেখছি।”
দ্রোণ সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “বেশ, এবার লক্ষ্যভেদ করো।”
তাঁর কথা শেষ হতে না-হতেই অর্জুনের তির ছুটে গেল। সেই নকল পাখিটার মুন্ডু খসে পড়ল মাটিতে।
দারুণ খুশি হয়ে দ্রোণ জড়িয়ে ধরলেন প্রিয়তম শিষ্যকে। কোনও কিছুকে তিরবিদ্ধ করতে গেলে শুধু একাগ্র ভাবে সেটাকেই দেখতে হয়, এ-কথা শুধু অর্জুন বুঝেছে।
এর পর আরও বড় প্রদর্শনী।
যুদ্ধক্ষেত্রের মতো একটা বিশাল জায়গা ঘিরে রাখা হবে। সেখানে সব রাজকুমার একসঙ্গে তাদের অস্ত্রচালনার কৌশল দেখাবে। পরস্পরের সঙ্গে তারা যুদ্ধও করবে। তবে নকল যুদ্ধ, কেউ কাউকে মারবে না।
কয়েক দিন ধরে সাজানো হল সেই যুদ্ধক্ষেত্র। দর্শকদের জন্য একদিকে বসার ব্যবস্থা হল, মেয়েদের জন্যও আলাদা ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট দিনে হাজার-হাজার মানুষ এসে উপস্থিত হল। রাজধানী হস্তিনাপুরে এই উৎসব দেখতে দূর-দূর থেকেও এল অনেকে।
প্রথমে বাদ্যকরেরা নানারকম বাজনা বাজাতে লাগল। আকাশ-বাতাস ভরে গেল সুরের মূর্ছনায়। তারপর প্রবেশ করলেন অস্ত্রগুরু দ্রোণ, তাঁর পরনে ধপধপে সাদা পোশাক। মাথার চুল সাদা, দাড়ি সাদা, গলায় সাদা পইতে, গায়ে শ্বেতচন্দন মাখা, গলায় সাদা ফুলের মালা। তারপর এলেন তাঁর শ্যালক কৃপ ও ছেলে অশ্বত্থামা। আরও কিছু ব্রাহ্মণ এসে মঙ্গলমন্ত্র উচ্চারণ করলেন কিছুক্ষণ।
এবার দ্রোণের নির্দেশে সার বেঁধে প্রবেশ করল সুসজ্জিত রাজকুমাররা। গুরুদেবের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে তারা শুরু করল যুদ্ধখেলা। কতরকম অস্ত্র, সেইসব অস্ত্রের সে কী ঝনঝন রব। যদিও আসল যুদ্ধ নয়, তবু যোদ্ধাদের চিৎকারে কান পাতা দায়।
দর্শকরা মুগ্ধ। সকলকে স্বীকার করতেই হল যে, অসাধারণ দ্রোণের শিক্ষার গুণ। এর পর এই রাজ্য আক্রমণ করতে আর কোনও রাজার সাহস হবে না।
এই খেলার সময় শুধু এক জায়গাতেই এক-আধবার গন্ডগোল হচ্ছে। দুর্যোধন আর ভীম দু’জনেই গদাযুদ্ধে প্রায় সমান-সমান। এই দুই ভাই তো কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। খেলার ছলে লড়তে-লড়তে একসময় দু’জনেই এত রেগে যাচ্ছে যে, মনে হচ্ছে যেন একজন আর একজনকে মেরেই ফেলবে। তখন দ্রোণের নির্দেশে অশ্বত্থামা ছুটে গিয়ে থামিয়ে দিচ্ছে তাদের। দর্শকরাও দু’দলে ভাগ হয়ে গিয়েছে। একদল মনে করছে দুর্যোধন বড় যোদ্ধা, অন্যদল মনে করছে ভীম।
অর্জুনের খেলা সব শেষে, আর একলা। অর্জুনের সঙ্গে তো লড়বার মতো আর কেউ নেই।
অর্জুন অস্ত্রের যেসব কেরামতি দেখাতে লাগল, তা যেন ভোজবাজির মতো। কখনও তার তিরের ডগায় আগুন জ্বলে উঠছে, কখনও তার তির মাটি ভেদ করে তুলে আনছে জলের ফোয়ারা। কখনও সে একসঙ্গে এত তির ছুড়ছে যে, মাথার উপর আকাশ দেখা যাচ্ছে না। কখনও সে রথে চড়ে বাণবিদ্ধ করছে একটা লোহার তৈরি শূকরকে, কখনও সে মেঘ ফুটো করে বৃষ্টি নামাচ্ছে।
অর্জুনের অস্ত্রবিদ্যা দেখানো শেষ হয়নি। এর মধ্যেই আর একজন যুবক ধীর পায়ে ঢুকল সে যুদ্ধক্ষেত্রে। খুবই সুন্দর তার চেহারা, টানা-টানা চোখ, টিকলো নাক, ফরসা রং, কোঁকড়ানো চুল। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। দুই কানে কবচকুণ্ডল। তাকে দেখলেই মনে হয়, সে সাধারণ কেউ নয়।
তাকে দেখে দর্শকদের চিৎকার থেমে গেল। সকলেরই চোখে কৌতূহল, এ কে? এ কে?
যুবকটি অর্জুনের কাছে এসে গম্ভীর গলায় বলল, “পার্থ, তুমি অস্ত্র নিয়ে যেসব কীর্তি দেখালে, তা বেশ ভালই হয়েছে। তবে এর প্রত্যেকটি আমিও করে দেখাচ্ছি, তুমি অবাক হোয়ো না।”
তারপর দ্রোণের অনুমতি নিয়ে সেই যুবকটি তির-ধনুক তুলল। অর্জুন এতক্ষণ যেসব কৃতিত্ব দেখাচ্ছিল, তার প্রত্যেকটিই সে ঠিক-ঠিক দেখিয়ে দিল।
সকলে একেবারে তাজ্জব। একটুক্ষণ সকলে চুপ করে রইল। তারপর কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল, “ওকে চিনেছি। ওর নাম তো কর্ণ, কর্ণও মহাবীর।”
শুধু মহাবীর নয়, অর্জুনের সমকক্ষ। এ পর্যন্ত তো সকলে ধরে নিয়েছিল অর্জুনের মতো বীর এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। এখন দেখা গেল, এই তো আর একজন আছে!
কর্ণকে দেখে সবচেয়ে খুশি হল দুর্যোধন আর তার ভাইরা। সকলে সবসময় অর্জুনের প্রশংসা করে, তাতে তাদের বুকে জ্বালা ধরায়। ভীম সবসময় তাদের অপমান করে। এখন একে যদি দলে পাওয়া যায়…
দুর্যোধন দৌড়ে গিয়ে কর্ণকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এসো, এসো, তুমি আমাদের কাছে থাকবে। তুমি যা চাইবে তাই-ই পাবে। এর পর ও-ই ওদের উচিত শিক্ষা দেবে। ওদের খুব বাড় বেড়েছিল।”
কর্ণের অস্ত্রের তেজ দেখে অর্জুনের এমনিতে হিংসে হয়েছিল, এখন এই ধরনের কথা শুনে হঠাৎ খুব রেগে গিয়ে সে বলল, “ওহে কর্ণ, যাদের কেউ ডাকেনি তবু কথা বলতে আসে, তাদের নরকে যাওয়া উচিত। তোমাকে আমি সেখানে পাঠাব।”
কর্ণ বলল, “ডাকেনি মানে কী? এ জায়গাটা তো সকলের জন্যই খোলা। রাজ্যের যে কেউ এখানে খেলায় যোগ দিতে পারে, তাই আমি এসেছি। তুমি যদি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাও, তাতেও আমি রাজি আছি। তারপর দেখা যাক, কে কাকে নরকে পাঠায়!”
দু’জনে দাঁড়াল মুখোমুখি। এবার আর খেলা নয়, সত্যিকারের যুদ্ধ হবে। আকাশের মেঘ সরে গেল, সূর্য দেখা গেল কর্ণের ঠিক মাথার উপরে। সবাই উদগ্রীব হয়ে রইল। কে জিতবে, কে হারবে? দর্শকরাও দু’ ভাগ হয়ে গিয়েছে।
দ্রোণ চুপ করে গিয়েছেন। এই কর্ণ তো তাঁকে গুরু বলে স্বীকার করেনি, তাই নিষাদ একলব্যের মতো একে কোনও শাস্তিও দিতে পারবেন না। লোকে এ-কথাও জানল যে, দ্রোণের কাছে শিক্ষা না নিয়েও কেউ অর্জুনের সমান বীর হতে পারে!
এই সময় বৃদ্ধ কৃপ দু’ জনের মাঝখানে এসে কর্ণকে বললেন, “দ্যাখো, এই অর্জুন হচ্ছে মহারাজ পাণ্ডুর পুত্র আর রানি কুন্তীর সন্তান। তুমি কে? তোমার পরিচয় দাও। কোন বংশে তোমার জন্ম, তোমার বাবার নাম কী? রাজকুমাররা তো যার-তার সঙ্গে যুদ্ধ করে না।”
এ-কথা শুনে কর্ণ কোনও উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে রইল। তার মুখখানা বর্ষার জলে ভেজা পদ্মফুলের মতো রাঙা মনে হল।
সকলেই বুঝে গেল, এই কর্ণ তো রাজকুমার নয়ই, সেরকম কোনও বংশপরিচয়ও নেই তার।
তখন দুর্যোধন এগিয়ে এসে কৃপকে বলল, “আচার্য, এই কর্ণ যে যুদ্ধ করতে জানে, তার তো প্রমাণ দিয়েছেই। বীরের সঙ্গে বীর যুদ্ধ করবে না কেন? তবু অর্জুন যদি রাজা বা রাজপুত্র ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজি না থাকে, তা হলে আমি এই মুহূর্তে তাকে অঙ্গরাজ্যের রাজপদ দিতে চাই।”
মূল রাজ্য ছাড়াও রাজকুমারদের অধীনে ছোট-ছোট নিজস্ব রাজ্য থাকে। দুর্যোধনেরও ছিল সেরকম অঙ্গরাজ্য। তক্ষুনি হাঁকডাক করে, পুরোহিত আনিয়ে সব মন্ত্রটন্ত্র পড়ানো হল। তারপর দুর্যোধন কর্ণের মাথায় পরিয়ে দিল রাজমুকুট।
তখন কর্ণ খুবই অভিভূত হয়ে বলল, “রাজকুমার, তুমি যে আমাকে এই সম্মান দিলে, তার বদলে আমি তোমাকে কী দিতে পারি?”
দুর্যোধন বলল, “কর্ণ, আমি আর কিছু চাই না। তোমার বন্ধুত্ব চাই।”
কর্ণ বলল, “আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু হলে। আমি কথা দিচ্ছি, সব সময় তোমায় সাহায্য করব, তোমার পাশে-পাশে থাকব।”
এর পর তো যুদ্ধ হতেই পারে। আর কোনও বাধা নেই।
তবু বাধা পড়ল। সেই রঙ্গভূমিতে আর একজন বৃদ্ধ প্রবেশ করলেন, তিনি ভয়ে কাঁপছেন। ঘামে ভিজে গিয়েছে তাঁর সারা গা।
তাঁকে দেখে কর্ণ ছুটে গিয়ে সেই রাজমুকুট পরা অবস্থাতেই মাথা নুইয়ে, তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। সবাই বুঝতে পারল, ইনিই কর্ণের বাবা।
এঁর নাম অধিরথ। ইনি পেশায় রথ চালান অর্থাৎ জাতিতে শূদ্র। তিনি কর্ণকে আশীর্বাদ করলেন। তাঁর চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু ঝরতে লাগল।
এই কর্ণ যে সামান্য এক শূদ্রের সন্তান, তা বুঝতে পেরে ভীম মুখ বিকৃত করে হি হি করে হেসে উঠল, “ওরে নরাধম, তুই অর্জুনের হাতে মরতে চাস? তোর শখ তো কম নয়! যা, যা, তুই রথচালকের ছেলে, তুইও গিয়ে রথ চালা। পুজোর প্রসাদ যেমন কুকুরকে খাওয়ানো যায় না, এই অঙ্গরাজ্যের রাজা হওয়াও তোকে মানাবে না।”
এ-কথা শুনে অপমানে ও রাগে কর্ণের শরীর কাঁপতে লাগল, তবু সে কোনও উত্তর দিল না। বারবার তাকাতে লাগল আকাশের দিকে, দেখল সূর্যকে।
দুর্যোধন বলল, “ভীম, তোমার এ ধরনের কথা বলা একেবারেই উচিত নয়। মানুষের ভাগ্য কতরকম হয়। কতরকম জায়গা থেকে আসে। বীরত্বটাই আসল কথা। এই কর্ণ মহাবীর, অঙ্গরাজ্যও এঁর পক্ষে অতি সামান্য। ইচ্ছে করলে ইনি সারা পৃথিবী জয় করতে পারেন। অত কথার দরকার কী? এঁর সঙ্গে লড়াই করেই দ্যাখো না।”
এর মধ্যে আর একটা কাণ্ড হয়েছে।
রাজকুমারদের এই যুদ্ধখেলা দেখতে রাজবাড়ি থেকে ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, কুন্তী, গান্ধারী ও আরও সবাই এসেছেন। কর্ণকে নিয়ে যখন অন্যরকম ব্যাপার হচ্ছে, হঠাৎ কুন্তী অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তখন তাঁর মাথায় জল দেওয়া ও সেবা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল সবাই।
কুন্তী অজ্ঞান হয়ে গেলেন কেন? তিনি কানের কবচকুণ্ডল দেখে কর্ণকে চিনতে পেরেছেন!
সেই যে বিয়ের আগে এক ঋষির কাছ থেকে বর পেয়ে কুন্তী এক মন্ত্র উচ্চারণ করে সূর্যদেবতাকে ডেকেছিলেন। সুর্যের আশীর্বাদে তাঁর একটি ছেলে জন্মায়। লজ্জায় সে-কথা গোপন করবার জন্য তিনি শিশুটিকে একটা ভেলায় চাপিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন নদীতে। সে-কথা মনে আছে আমাদের।
সেই শিশু কিন্তু মরেনি। ভেলাটা ভাসতে-ভাসতে একটা ঘাটে এসে ঠেকে। সেখানে রাধা নামে এক মহিলা স্নান করতে এসেছিলেন। ফুটফুটে বাচ্চাটাকে দেখে কোলে তুলে নিয়ে যান। তিনিই আদরযত্নে বাচ্চাটিকে বড় করে তোলেন। এই রাধারই স্বামীর নাম অধিরথ। ছেলেবেলা থেকে কর্ণ এই দু’ জনকেই মা-বাবা বলে জানে। নানা জায়গা থেকে অস্ত্রশিক্ষা করে সে এখন মহাবীর হয়ে উঠেছে।
কর্ণকে চিনতে পেরে কুন্তীর বুক কেঁপে উঠেছিল, তবু এবারেও তিনি অন্যদের কর্ণর পরিচয় জানাতে পারলেন না।
অত সব কাণ্ডের মধ্যে সন্ধে হয়ে গেল। সন্ধের পর আর যুদ্ধ করার নিয়ম নেই। আজ আর কিছু হবে না, এখন সকলের বাড়ি ফেরার পালা।
কর্ণের মতো এক মহাবীরকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে দুর্যোধন আনন্দে লাফাতে-লাফাতে তাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে গেল। আর ভয়ে কাঁপতে লাগল যুধিষ্ঠিরের বুক। তার ধারণা হল, এই কর্ণ অর্জুনের চেয়েও বড় বীর। দুর্যোধন এর সাহায্য পেলে অনেক বিপদ ঘটাবে।
যুধিষ্ঠির জানল না যে, ভীম যাকে অত খারাপ কথা বলেছে, সে যাকে অত ভয় পাচ্ছে, সে আসলে তার আপন দাদা। আর কর্ণও জানল না যে, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন এই তিনজনই তার নিজের মায়ের পেটের ভাই।
অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে সিংহাসনে বসিয়ে আসল রাজ্য চালান ভীষ্ম। এখন রাজকুমাররা বড় হয়েছে, তাদের মধ্যে থেকেই একজনকে রাজপদে বরণ করা উচিত। কাকে?
যুধিষ্ঠির আর দুর্যোধন এই দু’জনেই আসল দাবিদার। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর এইসব গুরুজন এসে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, যুধিষ্ঠিরকেই রাজমুকুট দেওয়া উচিত। যুধিষ্ঠির বুদ্ধিমান, ধীর, স্থির, সহজেই মানুষের মন জয় করে নিতে পারে। অন্য দিকে দুর্যোধনেরও অনেক যোগ্যতা আছে ঠিকই, তবে সে বড় চঞ্চল আর উদ্ধত। সাধারণ মানুষ তাকে যে ভয় পায়, কিন্তু ভালবাসে না।
যুধিষ্ঠিরের নাম যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া হল। যুবরাজই কিছুদিন পরে রাজা হন। দুর্যোধন এই খবর শুনে রাগে, হিংসেয় জ্বলে উঠলেন। কিছুতেই তিনি তাঁর দাবি ছাড়তে চান না। তাঁর বাবা যদি অন্ধ না হতেন, তা হলে তিনি-ই তো রাজা থাকতেন। আর এই বংশের নিয়ম অনুসারে রাজার বড়ছেলে হিসেবে সিংহাসন তাঁরই প্রাপ্য। পাণ্ডু তো কিছুদিনের জন্য রাজা হয়েছিলেন, তাঁর বড় ছেলে রাজত্ব পেতেই পারেন না।
যতই রাগ হোক, দুর্যোধনরা তো তখনই পাণ্ডবভাইদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করতে পারেন না। গুরুজনরা বাধা দেবেন। দেশের প্রজারাও খেপে যেতে পারে। তখন দুর্যোধন তাঁর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করতে লাগলেন, কীভাবে কৌশল করে পাণ্ডবদের বিনাশ করা যায়। বিনাশ মানে, একেবারে মেরে ফেলা। অনেক ভেবেচিন্তে তাঁরা একটা ষড়যন্ত্র করে ফেললেন। দুর্যোধনদের এক মামার নাম শকুনি। তাঁর খুব কূট বুদ্ধি। এ ছাড়া কনিক নামে এক মন্ত্রী, ভাই দুঃশাসন এঁরাও দুর্যোধনকে উসকে দেন, কর্ণও এই দলে যোগ দিয়েছেন।
এঁরা সবাই মিলে গেলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। যুধিষ্ঠির রাজা হলে পাণ্ডবরাই যে প্রধান হয়ে উঠবেন দিন-দিন, কৌরবরা পিছু হটে যেতে বাধ্য হবেন, আর কোনও দিনই কৌরব বংশের কেউ রাজা হতে পারবেন না, এইসব বোঝালেন। এবং বললেন, যে-কোনও উপায়ে হোক, যুধিষ্ঠিরদের সরাতেই হবে।
ধৃতরাষ্ট্র মানুষটা ভাল, কিন্তু দুর্বল। নিজের ছেলেদের প্রতি তাঁর বেশি স্নেহ থাকা স্বাভাবিক। আবার পাণ্ডবদেরও তিনি ভালবাসেন। যুধিষ্ঠির সব সময় তাঁর সঙ্গে ভক্তিপূর্ণ ব্যবহার করেন, তাঁকে রাজমুকুট দেওয়ার ব্যাপারে তিনি নিজেও রাজি হয়েছেন। অথচ দুর্যোধনের রাগ আর অভিমান দেখে তাঁর কষ্টও হয়। এখন কী করেন তিনি?
দুর্যোধনরা বললেন, “আপনাকে বিশেষ কিছু করতে হবে না। পাণ্ডবদের কাছাকাছি দেখলেই আমার সর্বাঙ্গে জ্বালা হচ্ছে। আপনি কিছুদিনের জন্য ওদের বহু দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিন। বারণাবত বলে একটা খুব সুন্দর জায়গা আছে, ওরা কয়েক মাস সেখানে গিয়ে থাকুক না। ওদের জন্য একটা চমৎকার বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে সেখানে।”
ধৃতরাষ্ট্র প্রস্তাবে রাজি হলেন। তাঁর কথা শুনে কুন্তী ও পঞ্চপাণ্ডব বেড়াতে গেলেন বারণাবতে। সে স্থানটি অপরূপ সুন্দর। আর তাঁদের জন্য যে বাড়িটি বানানো, সেটি যেমনই বিশাল, তেমনি সুসজ্জিত। রাজমাতা আর রাজকুমাররা তো এখানে বেড়াতে আসতেই পারেন।
কিন্তু দুর্যোধনরা কি বেশি-বেশি খাতির করবার জন্য যুধিষ্ঠিরদের এখানে পাঠিয়েছেন?
আসল ব্যাপারটা হল, দুর্যোধনের সাঙ্গোপাঙ্গরা ওই যে বাড়িটা বানিয়েছেন, তাতে রয়েছে প্রচুর দাহ্য পদার্থ। অর্থাৎ যা সহজেই আগুনে জ্বলে যায়। ওঁদের মতলবটা এই যে, সময়-সুযোগ বুঝে পাণ্ডবরা যে রাত্রে প্রচুর খাওয়াদাওয়া করে অঘোরে ঘুমোবেন, সেই রাতে চুপি-চুপি আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে। লকলক করে জ্বলে উঠবে আগুন, পাণ্ডবরা পালাবার সুযোগ পাবেন না। সবাই পুড়ে মরবেন সেখানে। এই বাড়িটার নাম জতুগৃহ।
ওঁদের কাকা বিদুর এই ষড়যন্ত্রটা টের পেয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দুর্যোধনের চেয়েও যুধিষ্ঠিরদের বেশি ভালবাসেন। যুধিষ্ঠিররা যখন রাজধানী ছেড়ে চলে আসেন, তখন তিনি তাঁদের আশীর্বাদ করবার সময় সাংকেতিক ভাষায় ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছিলেন। সে-কথা আর কেউ বোঝেননি, শুধু যুধিষ্ঠির বুঝেছিলেন। যুধিষ্ঠির সেই জন্য বারণাবতে এসেই খুব গোপনে লোক ডাকিয়ে বাড়ির মধ্যে এক জায়গায় গর্ত খুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করালেন। তারপর একদিন নিজেরাই সেই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ঢুকে পড়লেন সুড়ঙ্গে। একটু পরেই সেই আগুন এমন ভয়ংকর হয়ে উঠল যে, নগরের বহু লোক ছুটে এসেও তা নিভিয়ে ফেলতে পারল না। পুরো বাড়িটা ধ্বংস হয়ে গেল।
সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকেও পাণ্ডবরা বুঝলেন পালাতে হবে তাড়াতাড়ি। দুর্যোধনরা টের পেলে যদি পিছু-পিছু তাড়া করেন? কিন্তু সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে তো দৌড়নো সহজ নয়, কুন্তীর পক্ষে তো খুবই কষ্টকর। ভীম মাকে তুলে নিলেন কাঁধের উপর। নকুল আর সহদেবকে বগলদাবা করলেন, আর যুধিষ্ঠির, অর্জুনকে দু’ হাতে ধরে ছুটে চললেন ঝড়ের বেগে। গাছপালা ভেঙে, মাটি কাঁপিয়ে যেতে লাগলেন ভীম।
কিছুক্ষণ পরে তাঁরা উপস্থিত হলেন গঙ্গা নদীর কূলে। সেখানে নদী যেমন চওড়া, তেমনই বড়-বড় ঢেউ। কী করে পার হওয়া যাবে? দূর থেকে একটা নৌকো এগিয়ে এল, সেটা পাঠিয়েছেন বিদুর। সেই নৌকোয় গঙ্গা পার হয়ে পাণ্ডবরা ঢুকে পড়লেন একটা গভীর অরণ্যের মধ্যে। কৌরবদের কেউ যাতে সন্ধান না পান, তাই ভীম সবাইকে নিয়ে আবার ছুটতে-ছুটতে চলে গেলেন বনের অনেক ভিতরে। সেখানে গাছপালা এত নিবিড় যে, সূর্যের আলো দেখা যায় না। খাওয়ার মতো কোনও ফলমূলও নেই। জলও নেই।
এক জায়গায় সবাই ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। তৃষ্ণায় আকুল হয়ে পড়লেন কুন্তী। মায়ের এই কষ্ট দেখে ভীম বললেন, “আপনারা এখানে বিশ্রাম নিন, আমি যেমন ভাবে হোক জল নিয়ে আসছি।”
কোথায় আছে জলাশয়? খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে ভীম দেখলেন, আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক হাঁস, যাদের বলে সারস। এরা তো জলেই থাকে। তাই ভীম ওদের দেখে-দেখে ছুটতে লাগলেন, পৌঁছে গেলেন এক সরোবরে। এত পরিশ্রমে ভীমের সারা গা ঘেমে গিয়েছে। তিনি আগে জলে নেমে ভাল করে স্নান করে নিলেন। তারপর কোনও মতে একটা পাত্র তৈরি করে নিয়ে এলেন জল। ফিরে দেখলেন, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তাঁর চার ভাই আর মা মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
ভীমের চোখে জল এসে গেল। তাঁর মা কত বড় বংশের মেয়ে, মহারাজ পাণ্ডুর পত্নী, কত আরামে, কত নরম শয্যায় তাঁর শোয়া অভ্যেস, আজ তাঁর এই অবস্থা! তাঁর ভাইরাও তো রাজকুমার, শুয়ে আছেন মাটিতে।
শুধু যে দুঃখ হল তাই-ই নয়, একটু পরে তাঁর শরীর জ্বলতে লাগল অসম্ভব রাগে। দাদা যুধিষ্ঠির যদি অনুমতি দিতেন, তা হলে পালিয়ে না এসে তিনি দুর্যোধনদের সকলকে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন।
ভীম ওঁদের ঘুম ভাঙালেন না। তিনি একা জেগে বসে পাহারা দিতে লাগলেন। জঙ্গলে তো কতরকম বিপদ হতে পারে!
একটি মেয়ে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে।
এ আবার কে? জঙ্গলের মধ্যে একা কে সুন্দরী? কাছে এসে মেয়েটি মিষ্টি গলায় বলল, “আপনি কে? এখানে ঘুমিয়ে আছে কারা? আপনি জানেন না, এই বনে এক সাংঘাতিক হিংস্র রাক্ষস থাকে? সে নরখাদক, সে আপনাদের সবাইকে খেয়ে ফেলবে। এদের জাগিয়ে তুলুন, শিগগিরই পালান এখান থেকে।”
ভীম বললেন, “ওসব রাক্ষস-টাক্ষস আমি গ্রাহ্য করি না। তুমি আস্তে কথা বলো, এঁদের যেন ঘুম না ভাঙে।”
মেয়েটি বলল, “আপনি বুঝতে পারছেন না, সে অতি বিশাল এক রাক্ষস। কেউ তার সঙ্গে পারে না। আপনারা আমার সঙ্গে চলুন, আমি আপনাদের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেব।”
ভীম বুঝতে পারলেন, এ মেয়েটিও রাক্ষসী। ওরা যেমন ইচ্ছে রূপ ধরতে পারে। ভীম বললেন, “আমাদের নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি এখান থেকে সরে পড়ো।”
মেয়েটি তবু আন্তরিক ভাবে কাকুতি-মিনতি করছে, তারই মধ্যে হুমহাম করে এসে পড়ল এক অতিকায় রাক্ষস। তার নাম হিড়িম্ব। আর ওই সুন্দরী সাজা মেয়েটি তারই বোন হিড়িম্বা।
হিড়িম্ব রাক্ষস একটা তালগাছের মতো লম্বা। মুলোর মতো বড় দাঁত, চোখ দু’টো জ্বলছে আগুনের গোলার মতো। সে এসে একবার গর্জন করতেই ভীম তার একটা হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে-টানতে নিয়ে গেলেন অনেকটা দূরে। যাতে তাঁর মা-ভাইদের ঘুম না ভাঙে।
তারপর দু’জনে শুরু হল লড়াই।
রাক্ষসটি লম্বায়-চওড়ায় ভীমের চেয়ে অনেক বড় হলেও ভীমের গায়েও অসাধারণ শক্তি। দারুণ যুদ্ধ চলতে লাগল দু’জনের মধ্যে।
এর মধ্যে অন্যদের ঘুম ভেঙে গিয়েছে আওয়াজ শুনে। চার ভাই গেলেন ভীমের কাছে।
হিড়িম্ব আর ভীম প্রায় সমান-সমান লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এক-একটা গাছ তুলে মারছেন পরস্পরকে। অর্জুন ভীমকে বললেন, “তুমি কি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ? তা হলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”
ভীম বললেন, “না, সাহায্য লাগবে না। এইবার দ্যাখ!”
ভীম সেই হিড়িম্ব রাক্ষসের একটা হাত ধরে বোঁ বোঁ করে ঘোরাতে লাগলেন মাথার উপরে। তারপর প্রচণ্ড জোরে তাকে আছড়ে ফেললেন মাটিতে। ব্যস, সে রাক্ষস আর উঠল না।
এদিকে হিড়িম্বা কুন্তীর কাছে বসে কাঁদতে-কাঁদতে বলতে লাগল, “আমি আপাদের কোনও ক্ষতি করতে চাইনি। আমার দাদা অতি হিংস্র, কিন্তু আমি আপনাদের সেবা করতে চাই। আপনার ছেলে ভীম অত বড় বীর, তাকে আমি বিয়ে করতে পারলে ধন্য হব।”
হিড়ীম্বকে বধ করে মায়ের কাছে ফিরে এসে ভীম দেখলেন, তখনও হিড়ীম্বা বসে আছে।
ভীম বললেন, “রাক্ষসের বোন যতই সুন্দরী সাজুক, এও তো রাক্ষসী। একেই বা আর বাঁচিয়ে রাখা হবে কেন?”
ভীম তাকে মারতে যেতেই যুধিষ্ঠির বললেন, “না-না ভীম, স্ত্রী-হত্যা করতে নেই।”
কুন্তী বললেন, “সত্যিই তো, ও তো কিছু দোষ করেনি। ওকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।”
ভীম আর হিড়িম্বাকে মারলেন না। মায়ের কথা শুনে তাকে বিয়েই করে ফেললেন। পরে তাঁদের একটি ছেলে হয়েছিল, তার নাম ঘটোৎকচ। এই নামটি মনে রাখতে হবে। আমাদের এই মহাভারতের কাহিনিতে ঘটোৎকচ এক সময় ফিরে আসবে।
জতুগৃহ থেকে পালিয়ে এসে কয়েকটা দিন কেটে গেল বনে-জঙ্গলে। পাণ্ডবরা বুঝতে পারলেন, দুর্যোধন একবার যখন তাঁদের মেরে ফেলার চেষ্টা করেছেন, এর পরে আবারও নিশ্চয়ই সেই চেষ্টা করবেন। পাণ্ডবরা সংখ্যায় মোটে পাঁচজন। আর দুর্যোধনের একশো ভাই, তা ছাড়াও অনেক সঙ্গীসাথি আর সৈন্যসামন্তও এখন তাঁর অধীনে। সুতরাং এখন সরাসরি যুদ্ধ করা যাবে না। কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে হবে।
তাঁরা তাঁদের পোশাক বদলে ফেললেন। বড়-বড় গাছের ছাল দিয়ে একরকম পোশাক তৈরি হয়, তাকে বলে বল্কল। মুনি-ঋষিরা এই পোশাক পরেন। কুন্তী আর তাঁর পাঁচটি ছেলে ওই পোশাক পরে নিলেন ছদ্মবেশ। এখন আর কেউ তাঁদের চিনতে পারবে না।
ঘুরতে-ঘুরতে এক সময় তাঁরা উপস্থিত হলেন একটা নগরে। তার নাম একচক্রা। সেখানে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে তাঁরা আশ্রয় পেলেন। জঙ্গলে তবু হরিণ শিকার আর ফলমূল জোগাড় করে খাবার জুটত। শহরে কী হবে? পাঁচ রাজপুত্র রোজ ভিক্ষে করতে বেরোতে লাগলেন। পাঁচজনই মহাবীর, কিন্তু ব্রাহ্মণ সেজে থাকতে হচ্ছে বলে ভিক্ষে করতেও কোনও লজ্জা নেই।
দিনের শেষে যুধিষ্ঠির ভিক্ষেয় পাওয়া চাল-ডাল-গম সব দিয়ে দেন কুন্তীর কাছে। কুন্তী নিজে রান্না করে খাবারটা দু’ ভাগ করে নিয়ে এক ভাগ প্রথমেই রাখেন ভীমের জন্য। আর বাকি এক ভাগকে আবার পাঁচ ভাগ করে নিজেরা খেয়ে নেন। ভীমের বড় চেহারা, তাই তাঁর বেশি খাবার লাগে। সব সময় তাঁর পেটে খিদের আগুন জ্বলে, সেইজন্য তাঁর আর এক নাম বৃকোদর। বৃক মানে আগুন।
আর যেদিন ভিক্ষে করে শুধু ফলটল পাওয়া যায়, রান্নার কিছু নেই, সেদিন মা তাঁর ছেলেদের বলেন, “নিজেরাই ভাগ করে নিয়ে নাও।”
এইভাবে তো কেটে গেল কয়েকদিন।
একদিন কুন্তী শুনতে পেলেন, একটা ঘরে কারা যেন কান্নাকাটি করছে।
তিনি তখন কান পেতে শুনলেন, যে ব্রাহ্মণের এই বাড়ি, তিনি আর তাঁর স্ত্রী আকুল ভাবে কাঁদছেন আর কী যেন বলছেন। ওঁদের এক ছেলে আর এক মেয়ে। সেই মেয়েটাও কাঁদছে আর ছেলেটি খুব বাচ্চা, সে বারবার বলছে, “তোমরা কাঁদছ কেন? ও মা, কী হয়েছে, বলো না?”
তখন কুন্তী তাঁদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কাঁদছেন কেন? কিছু বিপদ হয়েছে? আমি কি আমাদের সাধ্যমতো আপনাদের সাহায্য করতে পারি?”
ব্রাহ্মণ তখন বললেন, “আপনি আমাদের সাহায্য করতে চাইলেন, এতেই আমরা ধন্য হয়েছি। কিন্তু আমাদের যা বিপদ, তাতে সাহায্য করা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের এই নগরটা একটা রাক্ষস দখল করে রেখেছে। সে এতই শক্তিশালী যে, তাকে দূর করার ক্ষমতা আমাদের নেই। সে একটা নিয়ম করেছে যে, প্রতিদিন এক-একটা বাড়ি থেকে একজন মানুষকে পাঠাতে হবে তার কাছে, তাকে সে খাবে। যে পরিবার এই নিয়ম ভাঙবে, সে এসে সেই পরিবার একেবারে ধ্বংস করে দেবে! আজ আমাদের পালা পড়েছে। যেতে একজনকে হবেই। বাবা-মায়ের বদলে আমাদের প্রিয় কন্যাটিই যাবে বলে জেদ ধরেছে।”
সব শুনে কুন্তী বললেন, “আপনারা এজন্য চিন্তা করবেন না। আপনাদের ছেলেটি খুবই ছোট আর মেয়েটিও বেশি বড় নয়। আপনারা স্বামী-স্ত্রী চলে গেলে সংসার নষ্ট হয়ে যাবে। আমার তো পাঁচটি ছেলে, আমি তাদের একজনকে পাঠাচ্ছি।”
ব্রাহ্মণ অমনই না-না করে উঠে বললেন, “তা হয় না। আপনারা আমাদের অতিথি, আমাদের জন্য আপনাদের এত বড় ক্ষতি…।”
কুন্তী কিছুই শুনলেন না। তিনি ভীমকে পাঠাবেন ঠিক করলেন।
তা শুনে যুধিষ্ঠির খুবই আপত্তি জানালেন। কারণ বিপদে-আপদে ভীমই তাঁদের প্রধান ভরসা।
ভীম কিন্তু মায়ের কথা মেনে নিতে রাজি।
শুধু মানুষ নয়, সঙ্গে বেশ কিছু খাবারদাবারও পাঠাতে হয় রাক্ষসের জন্য। সে থাকে এক পাহাড়ের উপরে। তার নাম বকরাক্ষস।
ভীম সকালবেলা সেখানে উপস্থিত হয়ে রাক্ষসকে দেখতে পেলেন না। দু’-চার বার তার নাম ধরে ডেকেই ভীম সেই সব খাবার নিজেই খেতে শুরু করে দিলেন। একটু পরেই প্রকাণ্ড চেহারার সেই রাক্ষস ভীমকে খাবার খেতে দেখে রেগে গিয়ে হুংকার দিল। ভীম গ্রাহ্যই করলেন না।
রাক্ষস কাছে এসে ভীমের পিঠে চপেটাঘাত করতে লাগল।
তবুও ভীম তাঁর দিকে ফিরেও তাকালেন না। খাবার শেষ হয়নি যে!
রাক্ষস তখন একটা গাছ উপড়ে এনে ধেয়ে এল ভীমের দিকে।
ভীম তখন খাবারের ঝুড়িটা একেবারে খালি করে ফেলেছেন। বেশ একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে এবার তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আয়, যুদ্ধ করবি?”
এই রাক্ষসটা হিড়িম্ব রাক্ষসের চেয়েও বড়।
এই রাক্ষসরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে জানে না। এরা একটা গাছ তুলে গদার মতো করে নেয় কিংবা খালি হাতেই লড়াই করতে আসে।
ভীমও এক টানে গাছ উপড়ে তুলে ফেলতে পারেন আর তাঁর গায়ের জোরও সাংঘাতিক। কিছুক্ষণ গাছে-গাছে পেটাপিটির পর শুরু হল হাতাহাতি। প্রায় সমানে-সমানে যুদ্ধের পর একবার ভীম বকরাক্ষসকে মাথার উপর তুলে বনবন করে ঘুরিয়ে দারুণ জোরে আছাড় মারলেন। তাতেই সে শেষ!
বকরাক্ষসের বাড়িতে তার বউ-ছেলেমেয়ে, আরও অনেক লোক থাকে। তারা এই কাণ্ড দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে আছে।
ভীম তাদের বললেন, “আজ থেকে তোমরা আর মানুষ খাবে না, এই প্রতিজ্ঞা করো। তা হলে আমি তোমাদের কোনও ক্ষতি করব না। নইলে কিন্তু আবার এসে সবাইকে শেষ করে দেব।”
একচক্রা নগরীর সব মানুষ রাক্ষসের ভয় থেকে মুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু ভীমের কথা কেউ জানল না। কেটে গেল আরও কিছুদিন। একদিন কুন্তী তাঁর ছেলেদের ডেকে বললেন, “দ্যাখ, এই জায়গাটা আর ভাল লাগছে না। একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে। লোকে ভিক্ষেও তে কম দিচ্ছে দেখছি। অন্য কোথাও যাবি?
মাতৃভক্ত ছেলেরা সঙ্গে-সঙ্গে রাজি। বেরিয়ে পড়লেন পরদিনই।
এর মধ্যে কুন্তী এক অতিথি ব্রাহ্মণের কাছে পাঞ্চাল দেশ সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছিলেন। সেইজন্য ঠিক হল, সেখানেই যাওয়া যাক। খুব বেশি দূরেও নয়। হাঁটতে-হাঁটতে তাঁরা পৌঁছে গেলেন এবং এক কুমোরের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন।
কয়েক দিন পর ওঁরা দেখলেন, দলে-দলে মানুষ পথ দিয়ে চলেছে একই দিকে। কোথায় যাচ্ছে এরা? একজন পথিকের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের কথা হল। জানা গেল যে, সেই দেশের রাজকন্যার স্বয়ংবর সভার আয়োজন হয়েছে। বহু দেশ থেকে বহু মানুষ আসছে, বিরাট উৎসব হবে। ব্রাহ্মণদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন রাজা।
পাণ্ডবভাইরা তো ব্রাহ্মণ সেজেই আছেন। তাই তাঁরা ঠিক করলেন, তাঁরাও যাবেন সেই উৎসব দেখতে।
এর মধ্যেই জানা গিয়েছে যে, সেই রাজকন্যার নাম দ্রৌপদী। তাঁর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন। এঁদের জন্ম সাধারণ ভাবে হয়নি। এঁরা দু’জনেই অলৌকিক ভাবে উঠে এসেছেন যজ্ঞের আগুন থেকে। ধৃষ্টদ্যুম্ন মহাবীর এবং দ্রৌপদীর মতো রূপসি আর ভূ-ভারতে নেই।
উৎসব আসরটি দারুণ জমকালো ভাবে সাজানো। সব দিকে ফুলের সুগন্ধ। এক পাশে বসেছেন বহু রাজা ও রাজকুমার, অন্য পাশে ব্রাহ্মণ, পুরোহিত ও ঋষি, আর এক পাশে এ দেশের মহারাজ ও বিশিষ্টজনেরা। এত সব রাজা-রাজড়ার মধ্যে কার গলায় বরমাল্য দেবেন দ্রৌপদী? সেই জন্য একটা অস্ত্র পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে। একটা ধনুক ও কয়েকটা বাণ রাখা আছে, আর অনেক উপরে রয়েছে এক গোল যন্ত্র, তারও উপরে একটা জিনিস। যিনি ওই ধনুকে ছিলা পরিয়ে পাঁচটি বাণ চালিয়ে ওই যন্ত্রের গোল ফুটোর মধ্যে দিয়ে জিনিসকে বিদ্ধ করে মাটিতে নামিয়ে আনতে পারবেন, তাঁকেই বরণ করবেন দ্রৌপদী।
যে জিনিসটা বিদ্ধ করতে হবে, সেটা কী? মহাভারতে তা লেখা নেই। গল্প বলার সময় সৌতি ভুলে গিয়েছেন। পরে অনেকে বানিয়েছেন যে, ওটা ছিল হিরে-মুক্তোয় তৈরি একটা নকল মাছ। হতেও পারে।
বেশ কিছুক্ষণ নাচ-গান হওয়ার পর এল সেই শুভক্ষণ। ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর বোনকে সঙ্গে করে এনে সমবেত রাজন্যবর্গকে শুনিয়ে দিলেন দ্রোপদীকে জয় করার শর্ত। তারপর এক-এক করে বলতে লাগলেন রাজাদের নাম আর পরিচয়। সে তালিকা শেষই হতে চায় না।
এই রাজাদের মধ্যে রয়েছেন দুর্যোধন ও তার অনেক ভাই, কর্ণ ও অন্য বীরেরা এবং বলরাম, তাঁর ভাই কৃষ্ণ ও যদু বংশের আরও অনেকে। আমাদের গল্পে কৃষ্ণ-বলরামকে আগে দেখিনি। কুন্তী কৃষ্ণ-বলরামদের পিসি হন, সেই সম্পর্কে পাণ্ডবরা এঁদের পিসতুতো ভাই। কিন্তু এতদিন ওঁদের দেখা হয়নি।
যতটা শোনা গিয়েছিল, দ্রৌপদী যেন তার চেয়েও বেশি সুন্দর। ঠিক যেন আগুনের শিখা।
এর পর শুরু হল পরীক্ষা। এ পরীক্ষা যে কত কঠিন, তা আগে বোঝা যায়নি৷ বড়-বড় রাজারা এই বিশাল ধনুকে গুণ পরাতেই পারলেন না। চেষ্টা করতে গিয়ে অনেকে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন। অনেকের জামাকাপড় ছিঁড়ে গেল। মনে হল, কেউই এটা পারবেন না।
তখন উঠে দাঁড়ালেন কর্ণ।
ব্রাহ্মণদের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকা পাণ্ডবরা তাঁকে চিনতে পেরেই ভাবলেন, ইনি ঠিকই পারবেন। অন্য অনেক রাজাও ভাবলেন, ইনি লাভ করবেন কন্যারত্নটি।
কর্ণ এসে অনায়াসে সে ধনুকে জ্যা পরিয়ে তির হাতে নিলেন।
দ্রৌপদী তখন বলে উঠলেন, “আমি সূতপুত্রকে বরণ করব না!”
অপমানে, রাগে কর্ণ আকাশের দিকে তাকিয়ে একবার সূর্যকে দেখলেন। তারপর ফিরে গেলেন মুখ নিচু করে।
আর কেউ পারছেন না দেখে উঠে এলেন অর্জুন। ঠিক কর্ণেরই মতো তিনি ধনুকে জ্যা পরালেন অনায়াসে। তারপর পাঁচটি বাণে যন্ত্র ভেদ করে সেই জিনিসটি নামিয়ে আনলেন নীচে। দ্রৌপদী মালা পরিয়ে দিলেন তাঁর গলায়।
তারপর মহাকোলাহল শুরু হয়ে গেল। একদল বললেন, “স্বয়ংবর সভায় শুধু ক্ষত্রিয়রাই অংশ নিতে পারে। এই বামুনের তো কোনও অধিকার নেই। এত সব রাজাকে ডেকে এনে অপমান করা হয়েছে।”
আর একদল বললেন, “ব্রাহ্মণেরা সব পারে। সব কিছুতেই তাদের অধিকার আছে।”
ক্ষত্রিয়ের দল তেড়ে এলেন অর্জুনদের দিকে। এ রাজ্যও তাঁরা ধ্বংস করে দিতে চান। এত রাজা একসঙ্গে, তাঁদের বিরুদ্ধে কে লড়াই করবে?
ভীম তুলে আনলেন একটা বড় গাছ, অর্জুন হাতে নিলেন তির-ধনুক, দুই ভাই অন্যদের আড়াল করে দাঁড়ালেন। অর্জুন বললেন, “আপনারা ভয় পাবেন না। দূরে দাঁড়িয়ে দেখুন, কী হয়।”
এই দুই ভাইয়ের বীরত্বের সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা কারও নেই। একে-একে সবাই কুপোকাত হতে লাগলেন। আর কর্ণ? তাঁর মতো এত বড় বীরও হেরে গেলেন? কর্ণও প্রথমে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। একসময় অর্জুনের একেবারে কাছে এসে পড়ে বললেন, “হে দ্বিজ, তুমি সত্যিকারের কে? তোমার তিরচালনা দেখে মনে হচ্ছে, তুমি স্বয়ং রাম কিংবা সূর্য কিংবা সাক্ষাৎ ভগবান বিষ্ণু।”
অর্জুন বললেন, “না-না, আমি রাম-টামের মতো অত বড় কেউ নই। আমি এক ব্রাহ্মণ, গুরুর কাছ থেকে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছি। আসুন যুদ্ধ করি।”
কর্ণ বললেন, “না, আমি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে যুদ্ধ করি না।”
তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে গেলেন। এঁরা পরস্পর দুই ভাই, কিন্তু কেউ কাউকে চিনলেন না।
কৃষ্ণ তাঁর দাদাকে বললেন, “ওই যে দু’জন যুদ্ধ করছে, ওরা নিশ্চয়ই ভীম আর অর্জুন। এ রকম বীর আর কে হবে? শুনেছিলাম বটে, জতুগৃহে ওরা পুড়ে মরেনি!”
কৃষ্ণ তখন সকলের মাঝখানে এসে বললেন, “আপনারা থামুন, থামুন। এই ব্যক্তিই সব নিয়ম মেনে, ধর্ম অনুসারে শর্ত পূরণ করে রাজকুমারীকে লাভ করেছেন। তাতে আপনারা আপত্তি করছেন কেন?”
কৃষ্ণের কথায় থামল যুদ্ধ। রাজারা ফিরে যেতে লাগলেন। নববধূকে সঙ্গে নিয়ে পাঁচ ভাই চললেন মাকে সুসংবাদ জানাতে।
বাড়িতে পৌঁছে ভীম আর অর্জুন মজা করে বললেন, “মা দ্যাখো, আজ ভিক্ষে করে কী এনেছি।”
কিছু একটা জিনিস ভেবে কুন্তী ঘরের ভিতর থেকে বললেন, “যা এনেছ, তোমরা পাঁচজনে ভাগ করে নাও।”
তারপরই মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে তিনি যেমন লজ্জা পেলেন, তেমন ধর্মভয়ও হল। এ কী বললেন তিনি? তারপরই তিনি ছেলেদের বললেন, “যা বলে ফেলেছি, বলেছি। এখন তোমরা যে-কোনও একজন ভাই এই মেয়েটিকে বিয়ে করো। যুধিষ্ঠির সবচেয়ে বড়…।”
যুধিষ্ঠির, এমনকী অর্জুন, পাঁচ ভাইয়ের কেউই দ্রৌপদীকে বিয়ে করতে রাজি হলেন না। তাঁরা কোনওদিন মায়ের কোনও কথা অমান্য করেননি, মাতৃবাক্য কখনও মিথ্যে হতে পারে না।
তা হলে কী হবে? দ্রৌপদীকে ফেরত দিয়ে আসাও রীতিবিরুদ্ধ।
সে রাতে আর কিছু মীমাংসা হল না। যা সামান্য খাবার ছিল, তাই খেয়ে শুয়ে পড়লেন সবাই। খাট-বিছানা তো নেই। ভূমিশয্যায় শয়ন। দ্রৌপদীও শুয়ে পড়লেন কুন্তীর পায়ের কাছে।
ধৃষ্টদ্যুম্ন চুপিচুপি এসে দেখে গিয়েছিলেন, এই ব্রাহ্মণেরা কোথায় থাকেন। রাজাকে সেই খবর দিতে রাজা তাঁর দূত এবং রথ পাঠিয়ে সকলকে নিয়ে এলেন রাজবাড়িতে। স্বয়ংবর সভার পর তো ধুমধাম করে বিয়ের উৎসব করতে হবে। তিনি যুধিষ্ঠিরকে ডেকে কবে অর্জুনের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা হবে, তা জানতে চাইলেন।
তখন যুধিষ্ঠিরকে বলতেই হল নিদারুণ সংবাদটি, “মা বলেছেন, পাঁচজনকে ভাগ করে নিতে। তা হলে পাঁচ ভাইকেই একসঙ্গে বিয়ে করতে হবে এই রাজকন্যাকে। অর্জুন একা বিয়ে করতে রাজি নয়।”
এ কথা শুনে রাজা দ্রুপদের বুকে যেন বজ্রাঘাত হল। এ কী অসম্ভব কথা! এক পুরুষের অনেক বউ থাকতে পারে, কিন্তু এক নারীর তো একাধিক স্বামী থাকতে পারে না। এ নিয়ে হুলস্থূল পড়ে গেল।
এর মধ্যে এসে পড়লেন মহাঋষি বেদব্যাস। এই কাহিনিতে মাঝে-মাঝেই তাঁকে দেখা যাবে। এটা বেশ মজার ব্যাপার, তিনি মহাভারত লিখেছেন, আবার তিনিই অন্যতম প্রধান চরিত্র।
বেদব্যাস সব শুনে বললেন, “এক নারীর একাধিক স্বামী সাধারণত হয় না বটে, তবে আগে দু’-একবার এ রকম হয়েছে। এখনও হতে পারে, তাতে দোষ নেই।”
এত বড় ঋষির কথা কে অমান্য করবে! তা ছাড়া তিনি যখন বিধান দিয়েছেন, তা হলে নিশ্চয়ই অধর্ম হবে না।
মন্ত্র পড়ে, পাঁচবার পাঁচ রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল দ্রৌপদীর।
এদিকে হয়েছে কী, এতদিন পাণ্ডবরা জীবিত না মৃত, তা-ই জানত না অনেকে। এখন সব জানাজানি হয়ে গিয়েছে। তাতে আবার বুকে জ্বালা ধরে গেল দুর্যোধনের। পাণ্ডবরা বেঁচে আছেন তো বটেই, দ্রৌপদীকেও তাঁরা জয় করে নিয়েছেন। চতুর্দিকে তাঁদের সুনাম। এখন কি তাঁরা ফিরে এসে রাজ্য চাইবেন? কিছুতেই তাঁদের রাজ্য দেওয়া হবে না। যেমন ভাবে হোক, ওঁদের মেরে ফেলতেই হবে। আগে মারতে হবে ভীমকে। তিনি না থাকলেই দুর্বল হয়ে যাবেন পাণ্ডবরা।
কিন্তু ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুররা এসে রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বোঝালেন, “দুর্যোধনের দুর্বুদ্ধির কথা মোটেই শোনা উচিত নয়। বরং পাণ্ডবদের এখন ফিরিয়ে আনা উচিত। রাজ্য দু’ ভাগ করে তাঁদের এক ভাগ দিয়ে দিলেই তো হয়। তাতে ঝগড়া মিটে যায়।”
ধৃতরাষ্ট্র এই উপদেশ মেনে নিয়ে বিদুরকে বললেন, “তুমি যাও, ওদের সমাদর করে নিয়ে এসো।”
পাণ্ডবরা ফিরে আসার পর সারা রাজ্যে আনন্দের স্রোত বয়ে গেল। পথের দু’ পাশে দাঁড়িয়ে হাজার-হাজার মানুষ অভ্যর্থনা জানাল তাঁদের। পাণ্ডবরাও রাজসভায় এসে প্রণাম করলেন গুরুজনদের।
বিশ্রাম-টিশ্রাম নেওয়ার পর তাঁদের আবার ডাকলেন ধৃতরাষ্ট্র, যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “বৎস কৌন্তেয়, (কুন্তীর ছেলে বলেই এই নাম) তোমরা এই রাজ্যের অর্ধেক নাও, আর খাণ্ডবপ্রস্থে গিয়ে রাজত্ব করো। তা হলে আর দুর্যোধনের সঙ্গে তোমাদের ঝগড়া হবে না। তোমরা শান্তিতে থাকো।”
জ্যাঠামশাইয়ের এই কথা শুনে খুশিই হলেন পাণ্ডবরা। ধৃতরাষ্ট্রের পা ছুঁয়ে তাঁরা যাত্রা করলেন এবং অরণ্য পেরিয়ে পৌঁছে গেলেন খাণ্ডবপ্রস্থে। সেখানকার প্রধান নগরীর নাম ইন্দ্রপ্রস্থ। সেটাই হল পাণ্ডবদের রাজধানী।
ইন্দ্রপ্রস্থ নগর এমনিতেই বেশ সুন্দর, পাণ্ডবরা সাজিয়ে-গুছিয়ে তাকে আরও সুন্দর করে তুললেন। যুধিষ্ঠির এখন আর রাজকুমার নন, তিনি এখন রাজা। চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেল তাঁর সুনাম। সমস্ত রকম মানুষের সঙ্গেই তাঁর সুমিষ্ট ব্যবহার, আর ভুলেও একটাও মিথ্যে বলেন না। চার ভাই তাঁর খুব অনুগত। আর দ্রৌপদী সকলের সঙ্গে সমান ব্যবহার করেন।
এর মধ্যে অর্জুন একবার বেরোলেন ভ্রমণে। অনেক অরণ্য, অনেক রাজ্য ঘুরতে-ঘুরতে তিনি এসে পৌঁছলেন প্রভাসে। সেখানে দেখা হল কৃষ্ণর সঙ্গে। কৃষ্ণ অর্জুনকে নানারকম খাতির-যত্ন ও আপ্যায়ন করলেন। সেখানেই দু’জনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কৃষ্ণ তাঁর বন্ধুকে নিয়ে গেলেন রৈবতক পাহাড়ে। সেখানে দিনের পর-দিন নানারকম গল্প ও গানবাজনা শুনে চমৎকার সময় কাটতে লাগল। তারপর তাঁরা এলেন দ্বারকায়। এখানে বলরাম ও আরও অনেকে উৎসবে মেতেছিলেন, অর্জুনরাও যোগ দিলেন তাতে। এখানেও নাচ-গান হল খুব।
কিছুদিন পর কৃষ্ণের বোন সুভদ্রার সঙ্গে বিয়ে হল অর্জুনের। এবার তো নিজের রাজ্যে ফিরতে হবে। অর্জুনের সঙ্গে সুভদ্রা ছাড়াও কৃষ্ণ-বলরাম ও আরও অনেকে চলে এলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। যুধিষ্ঠির সকলকে অভ্যর্থনা করলেন আন্তরিক ভাবে। সুভদ্রাকে দেখে দ্রৌপদী প্রথমে একটু রাগ করলেন বটে অর্জুনের উপর, তারপর নিজের বোনের মতন মেনে নিলেন।
যুদ্ধবিগ্রহ কিছু নেই, এখন প্রতিদিনই উৎসব। আনন্দ আর ফুর্তি। বলরামের এসব খুবই পছন্দ। তবে বলরামকে একসময় সদলবলে ফিরে যেতে হল, কিন্তু কৃষ্ণ তাঁর বন্ধুকে ছেড়ে যেতে চাইলেন না। দ্রৌপদীর সঙ্গেও তাঁর খুব ভাব।
একদিন অর্জুন তাঁর বন্ধুকে বললেন, “ক’দিন ধরে কী সাংঘাতিক গরম পড়েছে দেখেছ? যমুনার ধারে একটা সুন্দর জায়গা আছে, এখন সেখানে বেড়াতে গেলে কী হয়?”
কৃষ্ণ বললেন, “আমিও তো সে-কথাই ভাবছিলাম।”
পরদিনই প্রচুর খাদ্য-পানীয় নিয়ে যাত্রা করা হল যমুনা তীরে। সুভদ্রা আর দ্রৌপদী ছাড়াও আরও অনেক নারী-পুরুষ গেলেন সঙ্গে। সেখানে যাঁর যা খুশি তেমন আনন্দে মেতে উঠলেন। গুরুজনরা কেউ নেই, তাই মেয়েদেরও যে-কোনও খাদ্য-পানীয় নিতে বাধা নেই। কেউ জঙ্গলের মধ্যে, কেউ নদীতে নেমে মাতামাতি করতে লাগলেন, কৃষ্ণ আর অর্জুনও উপভোগ করতে লাগলেন সব কিছু।
একসময় এক দীর্ঘকায় ব্রাহ্মণ সেখানে এসে উপস্থিত। তাঁর মাথায় জটা, মুখ দাড়ি-গোঁফে ঢাকা, জ্বলজ্বল করছে দুই চোখ।
তাঁকে দেখেই কৃষ্ণ আর অর্জুন উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করলেন।
সেই ব্রাহ্মণ বললেন, “আমার সব সময় খিদে পায়, আমি অনেক কিছু খাই, তোমরা আমার খাবারের ব্যবস্থা করো।”
ওঁরা দু’জন বললেন, “আপনি কী খেতে চান, বলুন। আমরা নিশ্চয়ই তা জোগাড় করব। যে-কোনও খাদ্য।”
সেই ব্রাহ্মণ আসলে কোনও মুনি বা ঋষি নন। আগুনের একজন দেবতা আছেন, তাঁর নাম অগ্নিদেব, ইনি সেই দেবতা। সব পুজো কিংবা যজ্ঞেই প্রচুর ঘি দেওয়া হয়, অত ঘি খেতে-খেতে অগ্নির অরুচি রোগ হয়েছে, যাকে বলে অগ্নিমান্দ্য। সেই অসুখ সারাবার জন্য তিনি খাণ্ডব নামে গোটা বনটা খেয়ে ফেলতে চান। সেই জঙ্গলের সব গাছপালা, পশুপাখি খেলে তাঁর পেট আবার ঠিক হবে।
কৃষ্ণ আর অর্জুন প্রথমে অবাক হলেন। অগ্নি একটা জঙ্গল খেতে চান, তার জন্য অন্যের সাহায্যের কী দরকার। আগুন তো ইচ্ছে করলেই যে-কোনও জঙ্গল কিংবা নগর পুড়িয়ে দিতে পারে!
অগ্নি বললেন, “এই জঙ্গলে নাগদের এক রাজা তক্ষক তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকেন। তিনি আবার দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের বন্ধু। সেইজন্যেই অগ্নি এই জঙ্গলে গেলেই ইন্দ্র এমন বৃষ্টি ঢালতে শুরু করেন, তখন অগ্নির আর কোনও তেজ থাকে না। সুতরাং ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ না করে খাণ্ডববনের কিছু ক্ষতি করা যাবে না।”
অর্জুন খুব বড় বীর ঠিকই, কিন্তু ইন্দ্র তো দেবতা। তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করা কি সোজা কথা? অর্জুন এবং কৃষ্ণ তবু রাজি হলেন। তাঁরা অগ্নিদেবকে বললেন, “আমরা সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করতে রাজি আছি, কিন্তু আমাদের সেরকম অস্ত্র তো নেই।”
অগ্নি তখন অর্জুনকে দিলেন গাণ্ডিব নামে ধনুক আর একটা তূণীর, যেটার নাম অক্ষয় তূণীর অর্থাৎ যার তির কখনও ফুরোয় না এবং পেলেন দারুণ একটা রথ। আর কৃষ্ণ পেলেন সুদর্শন চক্র। এই চক্রটার এমনই ক্ষমতা যে, নিমেষের মধ্যে শত্রুকে বধ করে আবার ফিরে আসবে কৃষ্ণেরই কাছে।
এইসব অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কৃষ্ণ আর অর্জুন অগ্নিদেবকে বললেন, “এবার আপনি শুরু করুন। আমরা আপনার পার্শ্বরক্ষা করছি।”
শুরু হল খাণ্ডবদাহন। অত বড় একটা বন, বহুরকম গাছ ও পশুপাখি থাকে সেখানে। হঠাৎ আগুন লাগায় দারুণ ভয় পেয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল পশুপাখিরা। অর্জুন আর কৃষ্ণ তির চালিয়ে তাদের ফেরত দিতে লাগলেন আগুনের দিকে, সেখানে তারা মরতে লাগল দলে-দলে।
স্বর্গের দেবতা ইন্দ্র খাণ্ডববনে অগ্নিকাণ্ডের খবর জেনে তাঁর বন্ধু তক্ষককে বাঁচাবার জন্য বর্ষণ শুরু করে দিলেন। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন, আর উপর থেকে পড়ছে বৃষ্টি, তার ফলে সমস্ত অঞ্চল ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু শোনা যাচ্ছে শত-শত জীবজন্তুর আর্ত চিৎকার।
এরই মধ্যে কৃষ্ণ আর অর্জুন তির ছুড়ে-ছুড়ে মেঘ সরিয়ে দিতে লাগলেন। মাঝে-মাঝে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, আবার আসছে মেঘ। কিন্তু এই সব মেঘ থেকে বর্ষণেও আগুনের তেজ একটুও কমছে না।
তখন ইন্দ্রও কৃষ্ণ আর অর্জুনের উপর নানারকম সাংঘাতিক অস্ত্রবর্ষণ করতে লাগলেন। অন্য আরও অনেক দেবতাও অস্ত্র নিয়ে দাঁড়ালেন তাঁর পাশে।
চলতে লাগল আকাশের দেবতা আর পৃথিবীর দু’টি মাত্র মানুষের সাংঘাতিক যুদ্ধ। অবশ্য কৃষ্ণকে পরে অনেকে স্বয়ং ভগবান বলে মেনে নিয়ে পুজো করে। কিন্তু সেই সময় তো তিনি এসব কিছু নন। মানুষ।
কয়েক দিন ধরে ঘোর যুদ্ধ চলল। ইন্দ্র ও দেবতারা সমান ভাবে অস্ত্রবর্ষণ ও জলবর্ষণ করে যেতে লাগলেন। আর কৃষ্ণ আর অর্জুনের সহায়তায় আগুনও নিভল না, অরণ্যও দগ্ধ হতে লাগল।
তারপর একসময় দৈববাণী হল। তখনকার দিনে মাঝে-মাঝে দৈববাণী হত। কে বলতেন, তাঁকে দেখা যেত না। সেই দৈববাণীতে বলা হল, “হে দেবরাজ, এই যুদ্ধ বন্ধ করো! কৃষ্ণ আর অর্জুনের এমনই পরাক্রম যে, ওদের কেউ কখনও হারাতে পারবে না, আর তোমরাও পরাজিত হবে না। তা হলে এই যুদ্ধ কতদিন চলবে? হে ইন্দ্র, তোমার বন্ধু তক্ষক এই বনে এখন নেই, অন্য কোথাও গিয়েছেন, সুতরাং তাঁর কোনও ক্ষতি হয়নি।”
এ-কথা শুনে ইন্দ্র অস্ত্র সংবরণ করলেন, দেবতারাও ফিরে গেলেন।
টানা পনেরো দিন ধরে চলল এই অগ্নিকাণ্ড। শুধু তক্ষকের ছেলে অশ্বসেন কোনওক্রমে পালিয়ে যেতে পেরেছিল, আর ময় নামে এক নিরীহ দৈত্য আর চারটি পাখির ছানা বেঁচে গেল।
অত বিশাল খাণ্ডববন ধ্বংস হয়ে গেল একেবারে।
গাছ আমাদের নীরব বন্ধু। কৃষ্ণ আর অর্জুন কেন ওইসব গাছ পুড়িয়ে দিতে সাহায্য করলেন? সেই জঙ্গলের কত প্রাণী কী বীভৎস ভাবে পুড়ে মরল! অগ্নির বদহজম হয়েছে বলে বড় একটা জঙ্গলকে খেয়ে ফেলতে হবে? কৃষ্ণ আর অর্জুন রাজি হলেন কি অগ্নিদেবতার অভিশাপের ভয়ে? নাকি ওঁর কাছ থেকে ভাল-ভাল অস্ত্র পাওয়া যাবে এই আশায়? গল্পের এই জায়গাটা আমার মতো অনেকেরই পছন্দ হয় না।