হেগেল ও তাঁর দর্শন

হেগেল ও তাঁর দর্শন

বাংলাদেশের প্রথম দর্শন উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার মতো অভাজনকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য জাক লাকাঁ সভার পরিচালকদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা সীমাহীন। আমার নিজের যে ধরনের দর্শন-সাধনা তা এখনো লোকচক্ষুর আড়ালে অতি সংগোপনে সাধিত হয়— তা অনেকটা যোগ-ব্যায়ামের মতো ব্যক্তিগত ব্যাপার। দর্শন বিষয়ে আমার কাজ আজও অসমাপ্ত ও অপ্রকাশ্য, অন্য মানুষের কাছে তা পরিবেশন করার সুযোগ এখনো আসেনি। এই অবস্থায় আমাকে ধরে এনে কোনো দর্শনবিষয়ক সমাবেশের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া সমীচীন হয়নি। তবু ডাক যখন পড়েইছে তখন দুটো কথা বলে যদি কোনোরকমে দায়িত্ব পালন করে বিদায় নেওয়া যায় সে-চেষ্টা করা উচিত।

তা ছাড়া চর্চার জন্য আপনারা নির্বাচন করেছেন এমন একজন দার্শনিককে যাঁর দর্শন, বারট্র্যান্ড রাসেলের মতে, অতিশয় জটিল (Hegel’s philosophy is very difficult) এবং সকল মহান দার্শনিকদের মধ্যে তাঁকে বোঝা সবচেয়ে কঠিন (he is, I should say, the hardest to understand of all the great philosophers.)। এই একই কথা আমাকে দুই যুগ আগে বার্লিনের ফ্রি ইউনিভারসিটির দর্শন ইনসটিটিউটের এক তরুণ অধ্যাপক বলেছিলেন : হেগেলের অধিবিদ্যা ও যুক্তিবিদ্যা অত্যন্ত দুর্বোধ্য ও জটিল। তাঁর চিন্তাধারা শুরু থেকে শেষ অব্দি এক রৈখিক নয় বহুমাত্রিক এবং শেষপর্যন্ত তাতে পরস্পরবিরোধী- প্রগতিশীল, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল উপাদান পর্যাপ্ত। তা সত্ত্বেও তাঁর স্বদেশ জার্মানীতে শুধু নয় গোটা ইউরোপ ও আমেরিকায় উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক দার্শনিকদের উপর তাঁর প্রভাবই ছিল সবচেয়ে বেশি। এই সময়কালের পশ্চিমের সকল প্রধান দার্শনিকই ছিলেন হেগেলিয়ান বা হেগেলপন্থী। বিশেষ করে বিশুদ্ধ দর্শন (অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব প্রভৃতি), প্রোটেস্টান্ট ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস দর্শন ও রাজনৈতিক দর্শন প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা অতুলনীয় প্রভাব বিস্তার করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু নয় রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের উপরও তাঁর দর্শনের প্রভাব ছিল খুবই প্রবল। রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রেরণা হিসেবে শুধু নয়, নাৎসি জার্মানী ও ফ্যাসিবাদী ইতালীর একনায়কত্ববাদী স্বৈরশাসনের উত্থানের পেছনেও বহু আগে প্রয়াত হেগেলের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়। বাংলা ভাষায় হেগেল সম্পর্কে প্রথম যে বইটি আমি বহুদিন আগে পাঠ করি তা হলো নগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের হেগেলের দার্শনিক মতবাদ ও মার্কসীয় দর্শন।

সকল মানুষেরই জীবনদর্শন গড়ে ওঠে তাঁর সময়ের সংস্কার, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডল ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিকগণই হোন, চীনের কনফুশিয়াস, লাও জু অথবা মো জু-ই হোন, ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদীরাই হোন বা জার্মান ভাববাদীরাই হোক তাঁদের কারো পক্ষেই সম্পূর্ণ স্থানকালের ঊর্ধে ওঠা সম্ভব ছিল না। এক দার্শনিক তাঁর সময়ের আর-একজনের চেয়ে অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল অথবা প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারেন, কিন্তু তাঁদের চিন্তা-চেতনা আবর্তিত হয় একটি অভিন্ন অবস্থার পটভূমিতে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে হেগেলের সময় জার্মানী আজকের মতো অখণ্ড একটি রাষ্ট্র ছিল না। সেকালের জার্মানী ছিল অনেকগুলি জার্মানভাষী স্বাধীন রাজ্য নিয়ে গঠিত একটি পশ্চাৎপদ ভূখণ্ড। সে-সাম্রাজ্যের চরিত্র ছিল সামন্ততান্ত্রিক। তবে সেটি ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের অন্তিমকাল। বড় পুঁজিবাদী শিল্প-কারখানা ইংলন্ডে গড়ে ওঠায় সাধারণ কৃষক ও গ্রামীণ পেশাজীবীদের অবস্থা খুবই খারাপ হতে থাকে। শোচনীয়ভাবে তারা শোষিত হচ্ছিল নানাভাবে।

তবে পুঁজিবাদের সেই জন্মলগ্নেই সূচিত হয় শ্রেণী-সংগ্রাম, বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগ্রহ এবং দেশে দেশে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম। তখন থেকেই অনুভূত হতে থাকে সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর ঐতিহাসিক জাগরণ। অসংগঠিতভাবে হলেও তারা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে শুরু করে। যখন মহামারী কলেরায় হেগেল মারা যান সেই ১৮৩১-৩ এ ফরাসিদেশের সবচেয়ে বড় শিল্প এলাকা লিয়োঁতে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিলো। ১৮৩০-এর দশকে ইংলন্ডেও শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক আন্দোলন দেখা দেয়। জার্মানীর রাজ্যগুলোয় সামন্তবাদ, স্বৈরশাসন ও ভূমিদাস ব্যবস্থা যথেষ্ট মাত্রায় ছিল। কোনো শক্তিশালী বুর্জোয়া ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীও ছিল না জার্মান-ভাষী এলাকাটিতে। সামন্তবাদী শোষণ-নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধ মধ্য-আঠার শতক নাগাদ লেখক- দার্শনিকগণ সংযত প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। ইমানুয়েল কান্ট, জোহান গটলিয়েব ফিটে, হেগেলের দার্শনিক রচনায় এবং জোহান ভোলফগ্যাঙ ফন গোয়েটে, ফ্রিডরিশ ফন শিলার, হাইনরিশ ফন ক্লাইন্ট প্রমুখের সাহিত্যে প্রতিবাদী বক্তব্য ধ্বনিত হয়। সমকালীন অনেক গৌণ লেখক তাঁদের অনুসরণ করেন।

গেয়র্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিশ হেগেলের জন্ম স্টুটগার্টে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে। শিক্ষা-জীবনে ছিলেন গ্রিক সাহিত্য ও দর্শনের ছাত্র। এক সময় তিনি খ্রিস্টধর্মের চেয়ে গ্রিকদের ধর্মকে বেশি ভালো মনে করতেন। ১৭৯৩-এ তিনি টুইবিগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। সেখানে তাঁর পাঠ্যবিষয় দর্শন ছিল না, ছিল ধর্মতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্ব। ছাত্রজীবন শেষে কিছুকাল জীবিকার জন্য বার্ণ ও ফ্রাংকফুর্টে গৃহশিক্ষকের কাজ করেন। ১৭৯৯-তে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি সামান্য অর্থের অধিকারী হন এবং গৃহশিক্ষকতা ছেড়ে দেন। তাঁর ইচ্ছে হয় তিনি নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞানচর্চায় সময় ব্যয় করবেন। তাঁর বন্ধু দার্শনিক ফ্রিডরিশ শিলিং তাঁকে পরামর্শ দেন আপেক্ষাকৃত নিরিবিলি শহর ইয়েনায় গিয়ে জ্ঞানচর্চা করতে। ১৮০১ সালে হেগেল ইয়েনা যান এবং ১৮০৩-এ ইয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এর মধ্যে ১৮০৬ সালে নেপোলিয়নের সৈন্যসামন্ত ইয়েনা দখল করে। হেগেলের বাসবভনেও ঢুকে পড়ে ফরাসি সৈন্যরা। সেই গোলযোগের মধ্যেই তিনি তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি The Phenomenology of Spirit-এর পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে কোনোরকমে ইয়েনা ত্যাগ করেন। কপর্দকহীন হেগেল অতঃপর যান বামবার্গ-এ। সেখানে একটি দৈনিকের সম্পাদক নিযুক্ত হন। কিন্তু সেন্সরশীপ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর বনিবনা হলো না। সম্পাদনা ছেড়ে দিয়ে ১৮০৮ সালে তিনি চলে যান নূরেমবার্গে, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পেলেন রেক্টরের চাকরি। কয়েক বছর সেখানে ছিলেন। ১৮১২-তে প্রকাশিত হয় তাঁর Objective Logic -এর চার বছর পর Subjective Logic। এরমধ্যে তাঁর খ্যাতি জার্মানীর বাইরে বিস্তৃত হয়েছে। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন প্রফেসর হিসেবে এবং গভীর দর্শনচর্চায় মনোযোগ দেন, কিন্তু হাইডেলবার্গের রাজনৈতিক পরিবেশ তাঁর ভালো লাগে না। বছর দুই সেখানে কাটান। ১৮১৭-তে প্রকাশিত হয় তাঁর Encyclopedia of Philosophy। আহ্বান আসে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের। তখন সেটি ইউরোপের শ্রেষ্ঠ দর্শনচর্চার কেন্দ্র। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার পর বেরোয় তাঁর The Philosophy of Right। বার্লিনে তিনি লেকচার দিতেন বহু বিষয়ে : গ্রিক দর্শন, নন্দনতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, ধর্মদর্শন, ইতিহাস- দর্শন, দর্শনের ইতিহাস প্রভৃতি।

হেগেল যখন টুইবিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তখনই তার ওপর খ্রিষ্টধর্ম ও ফরাসি বিপ্লব বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। তিনি হয়ে ওঠেন সামন্ততন্ত্রবিরোধী, স্বৈরতন্ত্রের সমালোচক এবং অচল ও পুরনো ব্যবস্থাকে ভেঙে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত বিপ্লবের সমর্থক। নেপলিয়নের ব্যক্তিত্ব ও তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকায় তরুণ হেগেল মুগ্ধ হন এবং তাঁকে আখ্যায়িত করেন বিশ্বরাষ্ট্রের কর্ণধার ও ‘বিশ্ব আত্মা’ বলে। জার্মানীর রাজ্যগুলোর প্রচলিত ঘুনে ধরা অবস্থার তুলনায় নেপলিয়নের সংস্কারমূলক ও প্রগতিশীল ব্যবস্থাগুলো তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়। একটি সাংবিধানিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্পৃহা তাঁর মধ্যে দেখা দেয়। কিন্তু অল্পকাল পরে নেপলিয়নের পতনকে তিনি দেখেছেন একটি ‘ঐতিহাসিক বিপর্যয়’ বলে। তাঁর বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক লেখায় দেখা যায় যে তিনি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বমূলক একটি সীমিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রত্যাশা করেছেন। আঠার শতকের শেষ দশকে তিনি রচনা করেন ‘জার্মানীর সংবিধান’ শীর্ষক এক লেখা, যা তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। একটি কেন্দ্রীয় জার্মান রাইখ বা সংসদ পুনরুদ্ধারের প্রস্তাব তাতে আছে, যার থাকবে একক রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা। জীবনের শেষ দিকে লেখা তাঁর ‘ব্রিটিশ সংস্কার বিল’ শীর্ষক লেখাটিতে হেগেলের রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি জনগণকে একটু ‘বেশি ভোটাধিকার’ না দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।

রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় হেগেল অনেক বিষয়েই দিয়েছেন। সমাজে নারী ও পুরুষের অবস্থান সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা শুনলে আজকের অনেক নারীবাদী তাঁর প্রতিকৃতির প্রতি তাকাবেনও না। যে-সব নারী-নেত্রী বাংলাদেশসহ নানা দেশে ক্ষমতাসীন হয়েছেন তাঁরা তাঁকে রীতিমতো ঘৃণা করবেন। বাংলা অনুবাদে হেগেলের কথা :

নারী ও পুরুষের মধ্যে ব্যবধান হলো প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে যা পার্থক্য তাই। পুরুষ প্রাণীর সঙ্গে তুলনীয়, নারী উদ্ভিদের সঙ্গে। যখন কোনো নারী কোনো রাষ্ট্রে কর্ণধার হন, তৎক্ষণাৎ সে-দেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে।

হেগেলীয় দর্শনের প্রধান উপজীব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে চেতনা বা মন, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি, ইতিহাসের দর্শন, দর্শনের ইতিহাস, খ্রিস্ট ধর্ম, প্রকৃতি দর্শন, রাজনৈতিক দর্শন, নন্দনতত্ত্ব প্রভৃতি। তিনি ছিলেন আস্তিক ও প্রচলিত খ্রিস্টধর্মের অনুসারী। ঈশ্বর তাঁর ভাষায় এক Pure Spirit বা পরম আত্মা বা বিশুদ্ধ নিরাকার চেতনা। কিন্তু সেই পরম আত্মাকে বোঝার জন্য, তাঁর মতে, ধর্মগ্রন্থের চেয়ে দর্শনই বেশি উপযোগী। তিনি উপলব্ধি করতেন যে ধর্ম হলো অন্ধবিশ্বাসে পরিপূর্ণ। সুতরাং ধর্মের মাধ্যমে প্রকৃত সত্যকে বিশুদ্ধ নিরাকার পরম সত্তাকে জানা সম্ভব নয়। দর্শন চর্চার মাধ্যমেই সেই পরম আত্মা বা সত্তাকে জানা সহজ। হেগেল আত্মস্থ করেছিলেন তাঁর পূর্ববর্তী বিভিন্ন ইউরোপীয় চিন্তাধারাগুলো, যেমন— ফরাসি দার্শনিকদের ভাববাদী দর্শন, জার্মান রোম্যান্টিকদের চিন্তা ও ব্রিটিশ প্রয়োগবাদীদের দার্শনিক মতবাদ প্রভৃতি। তাতে তিনি হয়ে ওঠেন জার্মান ক্লাসিক্যাল ভাববাদীদের একজন মহত্তম ও প্রতিভূ প্রতিনিধি, কান্টের পরেই যাঁর স্থান।

কান্টের বিশুদ্ধ দর্শন বা মেটাফিজিকস্ হেগেলকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে। কান্টের দার্শনিক মতবাদ হলো ভাববাদের সঙ্গে বস্তুবাদের সমন্বয় এবং এই দুই মতবাদের মধ্যে একটা আপসরফা। তাঁর দার্শনিক তত্ত্ব বলে, মানুষ নিজেই এই প্রপঞ্চময় জগৎকে ও সেই জগতের ক্রিয়াশীল নিয়মগুলো সৃষ্টি করেছে। কান্ট সংবেদন (Sensation) বা ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে জ্ঞানের একমাত্র উৎস বলে গণ্য করতেন, কিন্তু এটাও মনে করতেন যে বস্তুসমূহ বা বিষয়গুলোর সারমর্ম বা ‘স্বরূপী সত্তা’ (things-in-themselves) মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কান্টের মতে, দর্শন হলো একটি ধারণামূলক জ্ঞান (a conceptual knowledge)। কিন্তু হেগেলের মতে, সকল জ্ঞানই মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ মানবিক জ্ঞান (All knowledge is human knowledge)।

কান্টের অধিবিদ্যার মতো হেগেলের অধিবিদ্যাও অত্যন্ত দুরূহ। তাঁর ভাষা বিমূর্ত, দুর্ভেদ্য, অতি সংহত ও রহস্যময়। এমন সব শব্দ বা শব্দবন্ধ তিনি ব্যবহার করেছেন যা আর কেউ কোথাও প্রয়োগ করেননি। তাঁর দর্শন সর্বব্যাপ্ত, বহুবিধ ও বিচিত্রগামী। তাঁর অধিবিদ্যা জীবনের অন্তরস্থ প্রকৃতি (inner nature of life) সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ করে না বটে, কিন্তু আমাদের ফলপ্রসূভাবে (productively) চিন্তা করতে শেখায়। হেগেলীয় দৰ্শন মূলত ইতিহাসের অগ্রগতি উপলব্ধির পদ্ধতিমাত্র (is mainly a method for understanding the progress of history)। তাঁর দর্শনকে আরো বলা হয় মানবজাতির সচেতন প্রচেষ্টার অভিব্যক্তি (expression of Man’s efforts)।

হেগেলের অধিবিদ্যা মানবজাতির অমূল্য সম্পদ হলেও তাঁর ডায়ালেকটিক্‌স বা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি, ইতিহাস-দর্শন এবং রাজনীতিসংক্রান্ত ‘অধিকার দর্শন’-ই দেশে দেশে আজও আগের মতোই আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। ক্লাসিক জার্মান দার্শনিকগণই ডায়ালেকটিসের সমস্যাগুলির প্রতি অতীতের যে-কোনো দার্শনিকের চেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। বস্তুজগতের বিকাশ ও সেই জগৎকে প্রতিফলনকারী মানুষের চেতনা বা মনের বিকাশের বিশ্বজনীন সংযোগ ও বিশ্বজনীন নিয়মগুলো নিয়ে ডায়ালেটিক্সের কাজ। আমরা লক্ষ্য করি প্রকৃতি, সমাজজীবন ও মানবচেতনার মধ্যে এক পরস্পরনির্ভরশীলতা। সংযোগ ও মিথষ্ক্রিয়ার মতো যার মধ্যে বস্তু ও প্রক্রিয়াসমূহ পরস্পরকে প্রভাবিত করে ও পরস্পরের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, ডায়ালেকটিসের আরেক মূল নীতি হলো বিকাশের নীতি। সমাজের নিয়ম প্রগতির পথে বিকশিত হওয়া, কিন্তু তা সরল পথে নয় দ্বান্দ্বিক উপায়ে হয়ে থাকে। তাই বিপরীতগামী হওয়া এবং পুনরায় পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তনের বহু দৃষ্টান্ত ইতিহাসে রয়েছে।

বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রবক্তাদের সঙ্গে ভাববাদী হেগেলের পার্থক্য হলো, তাঁর মতে, পৃথিবীর অন্তঃসার (essense) ও ভিত্তি হলো এক নিরাকার চেতনা (pure spirit), যার অস্তিত্ব মানুষের বাইরে— মানুষনিরপেক্ষ। হেগেলের দ্বান্দ্বিক মতবাদ সাবজেকটিভ ভাববাদী, তা ধর্মের ঈশ্বর ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, সেখানে বস্তু গৌণ, মানুষের মনই প্রকৃত সত্য। তাই মার্কস প্রমুখ বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিক দার্শনিকগণ মনে করেন হেগেলের মতবাদ অবৈজ্ঞানিক।

হেগেল ডায়ালেকটিসের মৌলিক নিয়মগুলি বিশদভাবে সূত্রাবদ্ধ করেছিলেন। যে কোনো জাগতিক বিকাশের উৎস হলো বিপরীতের সঙ্গে সংগ্রাম, বস্তুসমূহ ও ঘটনাবলির সহজাত আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলিই সকল গতি ও জীবনের মূল। তিনি বলেছেন, সত্য একটি প্রক্রিয়া। তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে মূল প্রতিপাদ্যের (thesis) সঙ্গে তার বিরোধী ভাবধারার সন্নিবেশ ঘটিয়ে (anti-thesis) সংশ্লেষণের (synthesis) মাধ্যমেই করা সম্ভব। তিনি বলেছেন, যে কোনো বিষয় ও ঘটনাকে বিচার করা উচিত দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে- তাঁর উদ্ভব, তার পরিবর্তন বা বিকাশ ও বিনাশের দৃষ্টিকোণ থেকে।

হেগেলের রাজনৈতিক দর্শনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী উপাদান পর্যাপ্ত, যা তাঁর পূর্ববর্তী আর কোনো দার্শনিকের মতবাদে ছিল না। একটি রাজতন্ত্রী শাসনব্যবস্থায় বাস করেও এবং নিজে ভাববাদী হয়েও তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ-নির্মাতার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। অবশ্য হেগেলীয় চিন্তাধারাকে মার্কস এঙ্গেলস আরো বিজ্ঞানসম্মত দাৰ্শনিক ভিত্তি দিয়েছেন। হেগেলের মতে, ইতিহাসের কোনো অবস্থা বা পর্যায়ই মূল্যহীন নয় তা যত অসহনীয় বা বীভৎসই হোক না কেন। হেলমূট কোয়েনিগ তাঁর Spirit of Revolution—Studies in Kant, Hegel and Marx (স্টুটগার্ট ১৯৮১) এ এ- সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে তাঁর ফেনোমেনোলজি-তেও বিপ্লবের উপাদান বিদ্যমান। হেগেল বলেছেন, সর্বহারা শ্রমজীবী শ্রেণীর পরাজয়, ব্যর্থতা ও প্রতিবন্ধকগুলো হলো একটি বিশেষ ধাপ–একএকটি অপ্রতিরোধ্য প্রক্রিয়া। এই কাৰ্য পরম্পরার ভেতর দিয়েই সর্বহারা শ্রেণী একটি বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত হবে, নতুন যুগের সৃষ্টি করবে এবং পালটে দেবে পৃথিবীর ইতিহাস।

শুধু সমাজতন্ত্র নয় গণতন্ত্র সম্পর্কেও হেগেলের চিন্তাধারা প্রণিধানযোগ্য। ১৯৭৯- এর ফেব্রুয়ারিতে আমি যখন বন এবং কোলন-এ যাই তখন আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় মনিকা ডিমান নামে এক তরুণীর, বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্রী। তাঁর সঙ্গে ঘোরাফেরার সময় একদিন তাঁকে নিয়ে দু’চারটি বইয়ের দোকানে যাই। তার কিছুদিন আগে হেগেলের গণতান্ত্রিক ধারণা সম্পর্কে একটি শ’ চারেক পৃষ্ঠার গ্রন্থ বন্ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। রাইনহার্ড আলব্রেট রচিত সেই গ্রন্থের নাম Hegel und die Demokratie অর্থাৎ ‘হেগেল ও গণতন্ত্র’। মনিকা আমাকে বইটি উপহার দেন। ওটি পড়ার মতো বিদ্যা আমার ছিল না। তবে অন্য বিশেষজ্ঞ দিয়ে পড়িয়ে জানতে পারি যে হেগেলের Philosophy of Law-এর আলোকে তাঁর মৌলিক রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও পশ্চিমী গণতন্ত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে হের আলব্রেট আলোচনা করেছেন। হেগেল চেয়েছেন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক তত্ত্বের সঙ্গে গণতন্ত্রের একটি নিঃশর্ত ও সুস্পষ্ট নীতি সংযুক্ত থাকবে। সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে তার অ-প্রগতিশীল বক্তব্যও রয়েছে। আগেই বলেছি পরস্পরবিরোধী বক্তব্য হেগেলের রচনায় দুর্লভ নয়।

হেগেলের মৃত্যুর বহু বছর পরে কুড়ি শতকের ব্রিটিশ দার্শনিক কার্ল পোপার যে বিতর্কের সূচনা করেন তাঁর ‘মুক্ত সমাজ এবং/অথবা অবরুদ্ধ সমাজ’ (open society and/or closed society) তত্ত্বের উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে সে প্রশ্নের মুখোমুখি হেগেলও হয়েছিলেন এক শ বছরেরও আগে। ফরাশি দার্শনিকগণ, জার্মান রোম্যান্টিকগণ অথবা ব্রিটিশ উপযোগবাদী দার্শনিকগণ কেউই শিল্পোন্নত বিশ্বের অনাগত সমস্যা ও সংকট এবং সমাজে তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভাবিত হননি। সে-ক্ষেত্রে হেগেল বরং অনেক অগ্রসর ও পরিণামদর্শী। তিনি তাঁর ‘আইনের দর্শন’-এ আধুনিক সমাজের বাস্তবতা দেখতে পেয়েছিলেন এবং সেজন্য ‘রাষ্ট্রের একটি দার্শনিক তত্ত্ব’ প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন।

হেগেলের রাজনৈতিক মতবাদ বিশেষ করে তাঁর ‘অধিকার দর্শন’ যুগপৎ প্রগতিশীল, প্রতিক্রিয়াশীল, রক্ষণশীল ও সমালোচনামূলক; তাই তাঁর মৃত্যুর পর হেগেলপন্থীরা তৎক্ষণাৎ দু’ভাগের ভাগ হয়ে যান : এক দল তাঁর বাম প্রগতিশীল চিন্তার ওপর জোর দেন, অপরটি তাঁর রক্ষণশীল মতবাদকেই বেশি গুরুত্ব দেন। বাম ধারার নব্য হেগেলপন্থীরা ধর্ম ও জার্মান রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচনা করেন, দক্ষিণপন্থীরা রক্ষণশীল অংশকে তাদের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে ব্যস্ত হন। ১৮৩০ এবং ‘৪০-এর দশকে তাঁদের যৌবনে মার্কস ও এঙ্গেলস ছিলেন নব্য বাম হেগেলপন্থী। তাঁরা হেগেলের যুক্তিবাদী দ্বান্দ্বিক প্রগতিশীল চিন্তাধারা বৈপ্লবিক-গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা তাঁর বুর্জোয়া চরিত্র, রক্ষণশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার সমালোচনা করেন।

কুড়ি শতকে এক দল নব্য হেগেলপন্থীর আবির্ভাব ঘটে পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানীতে ও ইতালীতে। এমনিতেই ওই দুই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল হিংসাত্মক, প্রতিক্রিয়াশীল, গণতন্ত্রবিরোধী ও আগ্রাসনপ্রবন। এই উগ্র হেগেলপন্থীরা তাতে আরো ইন্ধন জোগান। ১৯৩০-এ হেগ-এ গঠিত হয় ‘আন্তর্জাতিক হেগেলীয় সংঘ’। নাৎসী জার্মানীর উত্থানের পেছনে এই সংঘের তাত্ত্বিক সমর্থন ছিল ব্যাপক। তিরিশের দশকের শুরুতে বার্লিনে ও রোমে এই সংঘের আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন হয়। তাঁরা হেগেলের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিক্রিয়াশীল অংশকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। এই নব্য হেগেলপন্থীদের মধ্যে ছিলেন প্লেঙ্গে, লাসন, বিন্ডার, স্মিড্‌ট, গায়েরিং প্রমুখ। রা কাইজার জার্মানীর পতনের পর ভাইমার প্রজাতন্ত্রের সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির বিরোধিতা করেন এবং রাষ্ট্রের সামরিকায়নের পক্ষে মত দেন। তাঁরা হিটলারের রাইখকে অভিনন্দন জানান একটি ‘নৈতিক রাষ্ট্র’ রূপে, বন্দনা করেন হিটলারের সম্প্রসারণবাদী সমরনীতির। ‘অধিকার দর্শন’-এর প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাকে নাৎসী জার্মানীর অভ্যন্তরীণ ও আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদী নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বর্ণনা করেন।

অন্যদিকে ১৯২০ ও ‘৩০-এর দশকেই ইতালীতে অভ্যুদয় ঘটে আর এক দল নতুন হেগেলপন্থীর। তাঁদের মধ্যে জেতিলে প্রধান। তাঁরা মুসলিনীর সর্বগ্রাসী কর্তৃত্বপরায়ন ফ্যাসিবাদী তৎপরতাকে সমর্থন দেন। মুসোলিনীর আমলাতন্ত্রী, জনগণের সকল অধিকার- হরণকারী নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রের সমর্থনে হেগেলের দর্শনকে উপস্থিত করেন। তবে নাৎসী জার্মানী বা ফ্যাসিবাদী ইতালীতে হেগেলপন্থীদের মতবাদ কখনো ‘সরকারি দর্শন’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি, বাইরে থেকে তারা সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন মাত্র।

তবে এতো পক্ষে-বিপক্ষে লেখার মধ্যেও তাঁর অধিবিদ্যা, লজিক ও ইতিহাস- দর্শনের নিরপেক্ষ আলোচনাও একালে কম হয়নি। যেমন হেগেলের ইতিহাস দর্শনের সম্ভবত অমার্কসবাদী দৃষ্টিতে সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন আর. জি. কলিংউড তাঁর Idea of History (Oxford, 1946 ) গ্রন্থে। কার্ল ব্রোজে তাঁর হেগেল ও নীৎসের ইতিহাস ও রাজনৈতিক দর্শনের ওপর প্রণীত Kritische Geschichte (Critical History, Berne, 1978) গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কলিংউড, ব্রোজে প্রমুখ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, আজও হেগেলের চিন্তাধারা প্রাসঙ্গিক।

হেগেলের দ্বান্দ্বিক দার্শনিক তত্ত্ব প্রাসঙ্গিক শুধু তাঁর দেশ ও পশ্চিমের অন্যান্য দেশে নয়, আমাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও তা প্রাসঙ্গিক ও প্রযোজ্য। সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে তাঁর দর্শনের একটি প্রয়োগিক মূল্য রয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ বিষয়টি ভেবে দেখবেন। *

* জাক লাকাঁ সভা আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী ‘ঢাকা দর্শন উৎসব’-এ ‘হেগেল বক্তৃতা ১৪১০’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত প্রধান অতিথির অভিভাষণ, ১০ মে ২০০৩।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *