মোসাম্মৎ রেজিয়া খাতুন : এক বিস্মৃত মুসলমান নারীবাদী
১.
আহমদ ছফার চিন্তা ও চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাঙালি মুসলমান। বাঙালি মুসলমানের উত্থান-পতন, অর্জন ও ব্যর্থতা, জয় পরাজয়, তার সাফল্য ও সম্ভাবনা, তার শক্তি ও দুর্বলতা প্রভৃতি ছিল তাঁর আগ্রহের প্রধান বিষয়। এ সব নিয়ে তিনি নিজে যেমন বিরামহীন ভেবেছেন, তেমনি সমধর্মী ও প্রতিপক্ষের সঙ্গে তর্ক করতে পছন্দ করতেন। তাঁর সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন—কিশোর কিশোরী থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত—শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে-তাদের সঙ্গে তিনি বাঙালি মুসলমানের বিচিত্র বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। আজ তাই দ্বিতীয় আহমদ ছফা স্মৃতিবক্তৃতার বিষয় হিসেবে আমরা নির্বাচন করেছি কুড়ি শতকের একজন বাঙালি মুসলমান নারী কবি, প্রাবন্ধিক, লেখিকা ও সমাজকর্মীকে যিনি বস্তুত কৈশোর পেরুতে না পেরুতেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। গত ৭৫ বছরে তাঁর নাম সাহিত্য সংস্কৃতির কোনো আসরে কেউ উচ্চারণ করেননি। কোনো নারীবাদী গ্রন্থে তো নয়ই কোনো প্রবন্ধ-নিবন্ধেও তিনি উল্লেখিত হননি। নারীবাদ সম্পর্কে অজস্র লেখালেখি ও যথেষ্ট গবেষণা হয়েছে গত কয়েক দশকে। কোথাও এই সম্ভাবনাময়ী নারীবাদীর কোনো উল্লেখ নেই। এই হতভাগিনী কবি, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মীর নাম মোসাম্মৎ রেজিয়া খাতুন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে এই মেধাবী কবি ও নারীবাদী লেখিকার আক্ষরিক অর্থেই অকালমৃত্যু হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই তিনি হারিয়ে যান বিস্মৃতির অতলে। বাঙালি মুসলমান নারীবাদের ইতিহাস রচনা করতে গেলে তাঁকে স্মরণ করা কর্তব্য।
উনিশ শতকে অল্প কয়েকজন বাঙালি হিন্দু নারী তাঁদের গৃহের প্রাঙ্গণ থেকে সমাজের প্রান্তরে প্রবেশ করেন। কুড়ি শতকই বাঙালি মুসলমান নারীর জীবনে প্রথম শতক, তার আগে বাঙালির ইতিহাসে মুসলিম নারী বস্তুত অনুপস্থিত। এই শতকের শুরুতে বাঙালি মুসলমান নারী প্রথমবার ঘর থেকে বেরিয়ে সমাজের প্রাঙ্গণে তার সফল পদার্পন ঘটায়। শতাব্দীর শুরুতেই আমরা পাই দু’জন প্রতিভাময়ী নারীকে : বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ও খায়রন্নেসা খাতুন। তাঁরা একাধারে সাহিত্যসেবী ও সমাজসেবক, বিশেষ করে শিক্ষাবিস্তারে তাঁরা উভয়েই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
শতাব্দীর পর শতাব্দী নীরবে নিভৃতে অবহেলিত অবরুদ্ধ ও নির্বাক থাকার পর কুড়ি শতকে সাধারণের মধ্যে বাঙালি নারীর প্রথম কণ্ঠস্বর শোনা যায়। পুরুষের মতো তারও কিছু বলবার আছে, ঘরের ভেতরে শুধু সন্তান প্রতিপালন ও রান্নাবান্নায় নয়, সমাজ ও দেশের কাজেও তার মেধা ও ক্ষমতা আবশ্যক, সেটা জানা গেলো কুড়ি শতকে। পত্রপত্রিকায় বাঙালি নারীর পদ্য, প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রভৃতি প্রকাশিত হতে শুরু হয় এবং সমাজসংস্কার, শিক্ষাবিস্তার এমন কি রাজনৈতিক ব্যাপারেও তাদের আগ্রহ প্রকাশ পায়, যদিও তারা এ জন্যে মুখোমুখি হন প্রবল বাধার। বেশির ভাগই বাড়ির ভেতরে থেকে কঠোর অধ্যবসায় দ্বারা স্বশিক্ষিত হয়ে উঠেন, কেউ কেউ পারিবারিক আনুকূল্যে বিদ্যালয়ে শিক্ষার সুযোগ পান বটে কিন্তু পর্দাপ্রথার ঝামেলা হিন্দু নারীদের চেয়ে তাদের বেশি পোহাতে হয়। ১৯২০-এর দশক নাগাদ পর্দাপ্রথা কিছুটা শিথিল হয়ে আসে অথবা সহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। তবে কোনো নারীর একাকী বাইরে চলাফেরা তখনো শুরু হয়নি, সেটা হয় অনেক দেরিতে, ষাটের দশকের আগে নয়।
রূপজালাল (১৮৭৩) আখ্যানকাব্যের স্রষ্টা শিক্ষানুরাগিনী কুমিল্লার জমিদার ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর (১৮৪৭-১৯০৩) পরের প্রজন্মের বেগম রোকেয়া ও খায়রুননেসার সমসাময়িকদের মধ্যে খ্যাতি অর্জন করেননি বটে কিন্তু প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন করিমুন্নেসা খানম (১৮৫৫-সেপ্টেম্বর ১৯২৬), যাঁর সম্পর্কে তাঁর মৃত্যুর পর বেগম রোকেয়ার মন্তব্য হলো, ‘সমাজ তাঁকে গলাটেপা করিয়া না রাখিলে করিমুন্নেসা সাহেবা দেশের একটা উজ্জ্বল রত্ন হইতে পারিতেন।’ ১৯২০-এর দশক নাগাদ বাঙালি মুসলমান সমাজের অনেক তরুণী সাহিত্য ও সমাজসংস্কার বিশেষ করে নারীর অধিকার অর্জনের জন্য সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথা উপেক্ষা করে অন্দর থেকে বাইরে বেরুনোর উদ্যোগ নেন। পত্রপত্রিকায় তাঁদের গল্প কবিতা উপন্যাস প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রভৃতি প্রকাশিত হতে দেখা যায়। তাঁদের কেউ কেউ উৎসাহ আনুকূল্য না পেয়ে অকালে ঝরে পড়েন, কেউ কেউ খ্যাতি অর্জন করেন এবং লেখালেখি চালিয়ে যান অনেক দিন পর্যন্ত। ১৯২০ এবং ১৯৩০-এর প্রথম দিকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যে সব মুসলমান নারীর লেখা চোখে পড়ে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—মিসেস এস. রহমান (১৮৮৫-১৯২৬), নূরুন্নেসা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী (১৮৯৪-১৯৭৫), আখতার মহল সৈয়দা খাতুন (১৯০১-১৯২৮), মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা (১৯০৬-১৯৭৭), ফজিলাতুননেসা (১৯০৫-১৯৭৫), শামসুন্নাহার মাহমুদ (১৯০৮- ১৯৬৪), বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯), রাবেয়া খাতুন, সফিয়া খাতুন, খাতুন সফিয়া, সফিয়া খানম, রাজিয়া খাতুন, মোসাম্মৎ রেজিয়া খাতুন, ফাতেমা খাতুন, নসিমুন নেসা খাতুন, শামসুন নাহার, সাজেদা খাতুন, মোসাম্মৎ আনোয়ারা বেগম, হাসিনা খাতুন, সালেমা খাতুন সিদ্দিকা, রাহেলা খাতুন, সৈয়দা উম্মে আতিয়া আজিজ, ফাতেমা খানম, আনোয়ারা চৌধুরী, এম. আনোয়ারা বেগম প্রমুখ। অনেক নারী কবি-সাহিত্যিকের পরিচয় আমরা অনেক অনুসন্ধানের পরে জানতে পেরেছি বটে, অনেকের পরিচয়ই রয়ে গেছে অজানা। আর একটি ব্যাপার আমাদের কৌতুহলের সৃষ্টি করে। তা হলো বাঙালি মুসলমান প্রতিভাসম্পন্ন নারীদের উপর শুধু সমাজই বৈরীভাবাপন্ন নয়, বিধাতাও যেন বিরূপ। বহু প্রতিভাময়ী নারীরই অকালমৃত্যু হতে দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে একজন রেজিয়া খাতুন।
২.
রেজিয়া খাতুন সম্পর্কে তাঁর মৃত্যুর পর সওগাত (ভাদ্র ১৩৩৩) মন্তব্য করেছিলো—তিনি ‘অতুলনীয় বুদ্ধিমতী ও রাজনীতিকা’ ছিলেন, কথাটি যথার্থ। স্বামী ও পিতামাতার প্রভাবে তিনি কৈশোরেই হয়ে ওঠেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন কর্মী। গান্ধীর প্রথম অসহযোগ আন্দোলনের সময় (১৯২০-২১) তিনি নিতান্ত বালিকা, তবু ওটুকু বয়সেই তিনি এবং তাঁর বড় বোন রহিমা খাতুন অসহযোগে যোগ দেন। বাংলা ইংরেজি দুটো ভাষাই ভালোমতো রপ্ত করতে থাকেন। তখনই শুরু তাঁর সাহিত্যচর্চা এবং অন্যান্য সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজের।
[তাঁর পিতার ও পিতামহের নাম আমি বহু কষ্টে সংগ্রহ করেছিলাম, আমার সংগ্রহে আছে, তবে এই মুহূর্তে খুঁজে না পাওয়ায় উল্লেখ করা সম্ভব হলো না।]
১৩১৬ বঙ্গাব্দের ৩ চৈত্র (মার্চ ১৭, ১৯১০) খুলনা শহরের টুটপাড়া এলাকায় এক সংস্কৃতিবান পরিবারে রেজিয়া খাতুনের জন্ম।২ অতি অল্প বয়সে অর্থাৎ আট দশ বছরের মধ্যেই তাঁর প্রতিভার পরিচয় সকলের কাছে প্রতিভাত হয়। তাঁর সম্পর্কে আমি প্রথম অবগত হই বহুদিন আগে আমার ঘনিষ্ঠ একজন পুলিশ অফিসারের স্ত্রীর কাছ থেকে। ১৯২০-এর শেষ অথবা ১৯৩০-এর শুরুতে তাঁর স্বামী খুলনার কোনো থানার একজন দারোগা ছিলেন। তাঁরা যখন খুলনায়- বছর তিনেকের বেশি ছিলেন- তখন রেজিয়া খাতুন ও রহিমা খাতুনের নাম শোনেন। বিশেষ করে অকালপ্রয়াত রেজিয়া খাতুন সম্পর্কে নানা কথা জানতে পারেন। আমি যে মহিলার কথা বলছি তাঁরও গল্প উপন্যাস কবিতার বই পড়ার খুবই সখ ছিল। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল ইসলাম, কামিনী রায় প্রমুখের গল্প উপন্যাস কবিতার বইয়ের প্রথম সংস্করণ আমি দেখেছি। তিনি বলেছেন, রেজিয়া খাতুনদের পরিবারে এবং তাঁর স্বামীর পরিবারে পড়াশোনার চর্চা ছিলো উল্লেখ করার মতো। রেজিয়া খাতুন, রহিমা খাতুন তাঁদের পাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পাঠাগার, বিশেষভাবে মেয়েদের জন্যে। তাছাড়া চালু করেছিলেন মেয়েদের নৈশ বিদ্যালয়। ১৯৩০-এর দশকের শেষ নাগাদও তা ছিলো। চল্লিশের দশকের ভাঙাগড়ার মধ্যে সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কারণ বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের নেতা আবুল হুসেনের (১৮৯৬- ১৯৩৮) ছোটো ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে আমি ১৯৮০-র প্রথম দিকে খুলনায় গিয়ে যেসব এলাকায় রেজিয়া খাতুন বাস করতেন সেখানে খোঁজ নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইস্কুল বা পাঠাগারের কোনো চিহ্ন দেখিনি।
সেকালের রীতি অনুযায়ী ১২-১৩ বছর বয়সেই রেজিয়া খাতুনের বিয়ে হয়ে থাকবে। ঠিক কত সনে তাঁর বিয়ে হয়েছিল তা জানা সম্ভব হয়নি, আনুমানিক ১৯২২-২৩ সালে হবে। তাঁর স্বামী ছিলেন দৌলতপুরের ‘খাঁ বাড়ি’র সন্তান মোহাম্মদ আবুল কাশেম অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন মহাত্মা গান্ধী এবং শওকত আলী, মোহাম্মদ আলীর একজন অবিচল সমর্থক। ১৯২১-২২ সালে অসহযোগে অংশগ্রহণ করার কারণে তিনি এক মাস কারাগারে ছিলেন। তারপর সম্ভবত তিনি বিয়ে করে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। মোহাম্মদ আবুল কাশেম ছিলেন বাংলার এক প্রাচীন পরিবারের সন্তান।
রেজিয়া খাতুনের পিতার পরিবারে সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিবেশ ছিলই, কিন্তু বিয়ের পরেই তাঁর প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত সুযোগ আসে। স্বামী মোহাম্মদ আবুল কাশেম ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান মানুষ, প্রগতিশীল এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষা-সাহিত্য প্রভৃতি ব্যাপারে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। তিনি নিজেও সাহিত্যচর্চা করতেন। দৌলতপুরেরই পাশের পল্লী মহেশ্বরপাশা। আবুল কাশেম সম্পর্কে মহেশ্বর পাশা পরিচয় গ্রন্থে বলা হয়েছে :
মোহাম্মদ আবুল কাসেম তরুণ সাহিত্যসেবী, তিনি ইং ১৯২২ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়া কলিকাতা কংগ্রেস অফিসে উপস্থিত হন এবং পরে রাজনৈতিক বক্তৃতার ফলে এক মাস সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কারামুক্ত হইয়া তিনি নিঃসম্বলে ভারতের বিভিন্ন দেশ ও নগর পর্যটন করেন। তাঁহার ভ্রমণবৃত্তান্ত পরে নানাবিধ সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। “মোহাম্মদী’ “আল্ মুসলিম”, “দৈনিক সুলতান” প্রভৃতি কয়েকটি মুসলিম কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগে কার্য্য করেন। [ডাক্তার খগেন্দ্রনাথ বসু, মহেশ্বর পাশা পরিচয়, ১৯৩০, পৃ. ৩০৪।]
মুঘল যুগের সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তান আবুল কাশেম। তাঁরই এক পূর্বপুরুষের নামে দৌলতপুরের নামকরণ হয়। এ সম্পর্কে গবেষক ডাক্তার খগেন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন :
উচ্চ
অর্ধ শতাব্দী পূর্ব্বে ভৈরবনদের কূলে দৌলতপুর কয়েক ঘর মুসলমান এবং চর্মকারের বসতিযুক্ত একটি ক্ষুদ্র পল্লী ছিল, কিন্তু আজ ইহার প্রসিদ্ধি বহুগুণে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছে। এই পল্লী আজ ক্ষুদ্র শহরে পরিণত হইতে চলিয়াছে। প্রথম শ্রেণীর কলেজ, ইংরাজী স্কুল, মাদ্রাসা, মক্তব, বালিকা বিদ্যালয়, পোস্টাফিস, রেল স্টেশন, স্টীমার স্টেশন, বাজার, ডাক্তারখানা প্রভৃতি শিক্ষিত মানবের নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান সমন্বিত এরূপ বন্দর বঙ্গদেশে আর কোথায়ও আছে কিনা সন্দেহ। ভৈরবের কূলে দৌলতপুর অতি রমণীয় স্থান। এই সকল সুবিধার জন্য অনেক বিদেশী ভদ্রলোক এখানে বাড়ি করিতেছেন। নিকটবর্তী গ্রাম অপেক্ষা এখানকার স্বাস্থ্য ভাল। [ডাক্তার খগেন্দ্রনাথ বসু, পৃ. ২০৩।]
মুঘল আমল ও ইংরেজ কোম্পানীর সময়ের দলিলপত্র ঘেঁটে খগেন্দ্রনাথ যাঁর নামে দৌলতপুর নামকরণ সেই দৌলত খানের পূর্বপুরুষদের বংশ তালিকার ভিত্তিতে রেজিয়া খাতুনের শ্বশুর পরিবারের পুরো বিবরণ দিয়েছেন। তিনি জানান :
দৌলত খান নামক এক ব্যক্তি “খান” অর্থাৎ ‘বিজয়ী” উপাধি লইয়া পশ্চিম দেশ হইতে এই স্থানে আসেন, তাঁহার বংশধরগণ “শেখ” অর্থাৎ “ধৰ্ম্ম নেতা” উপাধি লইয়া এখানে বাস করিতেছেন। দৌলত খান যখন এই দেশে আগমন করেন, তখন খুলনা পৃথক জেলারূপে পরিগণিত হয় নাই, নওয়াবাদের থানা বলিলেই খুলনা বুঝিতে হইত। দৌলতপুর তখন জঙ্গলাবৃত ছিল। দৌলত খান অল্প দিনের মধ্যেই এতদ্দেশে প্রতিপত্তি বিস্তার করেন এবং এই স্থানের দৌলতপুর নামকরণ করেন। দৌলত খানের বংশের একটি শাখা মাত্র এখানে বাস করিতেছেন।
দৌলত খানের অধস্তন ৮ম পুরুষ নুটই সেখ। (এটি সম্ভবত তাঁর ডাক নাম।) তাঁহার পাঁচ পুত্রের অন্যতম আমানুল্লা সেখের পৌত্র রায়ান উদ্দীনের নাম এ স্থলে উল্লেখযোগ্য। তিনি দৌলতপুর স্কুল হইতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া দৌলতপুর কলেজে অধ্যয়ন করেন, পরে পুলিশ বিভাগে প্রবেশ করিয়া সাব-ইনস্পেক্টার হন, অশ্বারোহণ এবং প্যারেড প্রভৃতি ব্যায়াম চর্চায় যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দেন, কিন্তু পুলিশের কর্ম তাঁহার ভাল লাগে নাই সেজন্য তিনি দৌলতপুর স্কুলে শিক্ষকতা গ্রহণ করেন। সংসারের ঘাত-প্রতিঘাতে নিষ্পেষিত হইয়াও, নানা বাধাবিঘ্নের মধ্য দিয়াও তিনি মক্কা পরিদর্শন করিয়া হাজী উপাধিতে ভূষিত হন, কিন্তু ইহার এক বৎসর পরেই ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩রা জানুয়ারি তারিখে কলেরা রোগে অকালে প্রাণত্যাগ করেন। শারীরিক ব্যায়ামে এক সময়ে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখাইয়া বহু পারিতোষিক লাভ করিয়াছিলেন।” [ডাক্তার খগেন্দ্রনাথ বসু, মহেশ্বর পাশা পরিচয়, ১৯৩০, পৃ. ২০৩-৪।]
নুটই শেখের নাতি গোলাম রহমান ছিলেন রেজিয়া খাতুনের শ্বশুর। গ্রন্থটি যখন প্রকাশিত হয় তখন গোলাম রহমান জীবিত। তাঁর সম্পর্কে মহেশ্বর পাশা পরিচয় প্ৰণেতা লিখেছেন :
গোলাম রহমান সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ, পরোপকারী; এ জন্য তিনি হিন্দু মুসলমান সকলেরই শ্রদ্ধাভাজন। তিনি বহু জনহিতকর কার্যে লিপ্ত আছেন এবং স্থানীয় মসজিদের বর্তমান ইমাম বা ধর্মগুরু। [মহেশ্বর পাশা পরিচয়, পৃ. ২০৪।]
রেজিয়া খাতুনের এলাকায় যেমন ছিল জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একটি শক্ত ঘাঁটি তেমনি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার অনুকূল পরিবেশও। তাঁর শিল্পীসত্তা পরিস্ফূটিত হওয়ার সুযোগ আসে সেখান থেকেই। কবিতা প্রবন্ধ লেখা শুধু নয় ছবি আঁকা; মাটি, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে নানা কারুশিল্পের কাজ প্রভৃতি চর্চার জন্য তাঁদের এলাকায় একটি চমৎকার পরিবেশ ছিল সেকালে। ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রয়াত ড. ভবতোষ দত্ত তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন :
কাঁটাতারের ঘেরা (দৌলতপুর) কলেজের “ক্যাম্পাস”-এর বাইরে ছোট ছোট গ্রাম— খালিশপুর, পাবলা। একটু দূরে মহেশ্বর পাশা, সেখানে শশী পাল নামে একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন। বছরে একবার প্রদর্শিত হতো–আমরা নৌকা করে দেখতে যেতাম মহানন্দে। এখন মনে হয় শশী পাল অনেকটা রবি বর্মা ধরনের ছবি আঁকতেন। বৈষ্ণব ধর্মাশ্রিত কলেজে দুর্গাপূজো হতো না, তাই পূজো দেখতে যেতাম পাবলার জমিদার বাড়ি, আর বিসর্জন দেখতাম ভৈরব নদের ওপারে সেনহাটির কাছে গিয়ে। সেনহাটি এ অঞ্চলের বিখ্যাত গ্রাম। সদ্ভাবশতক-এর কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার থেকে আরম্ভ করে বহু জ্ঞানী-গুণী এই গ্রাম থেকে বেরিয়েছে। [ভবতোষ দত্ত, আট দশক, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ১৪।]
রেজিয়া খাতুনের কোনো কোনো কবিতায় কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের (১৮৩৪-১৯০৭) প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মেধাবী নিষ্ঠাবান ও আদর্শ মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল রেজিয়া খাতুনের। তাঁদের এলাকায় তখন ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্রের (১৮৭২-১৯৩১) খুবই নামডাক। তিনি ছিলেন দৌলতপুর বি.এল. কলেজের সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ। শিশু কিশোর যুবক যুবতীদের মধ্যে তাঁর প্রভাব ছিল অসামান্য। ড. ভবতোষ দত্ত তাঁর স্মৃতিচারণমূলক আত্মজীবনীতে লিখেছেন :
আসল ভয় ছিল কয়েকজন মানুষকে। সবচেয়ে বেশি ভয় করতাম আমার বন্ধু শিবুর (শিবশঙ্কর মিত্রের) বাবা অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মিত্রকে। আমরা পাশাপাশি বাড়িতেই থাকতাম। কখনো তাঁর পড়ার ঘরে আমাদের কলবর পৌঁছে গেলে হুঙ্কার দিতেন “ওহানে কেডা-রে?” আমরা প্রাণপণে পালাতাম। তবে মাঝে মধ্যে তিনি অদৃশ্য হয়ে যেতেন। শিবু বলত কলকাতায় নাকি প্রকাণ্ড একটা লাইব্রেরি আছে- দৌলতপুরের লাইব্রেরির একশটার সমান- সেখানে তিনি পড়াশোনা করতে যান। আমরা মনে মনে ভাবতাম আরো একটু বেশি পড়াশোনা করলেই ত পারেন। [ভবতোষ দত্ত, আট দশক, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ১৭।]
ভবতোষ দত্ত অনেকের প্রসঙ্গেই সরস স্মৃতিচারণ করেছেন, কিন্তু তিনিও দু লাইন লিখতে ভুলে যান রেজিয়া খাতুনের কথা। রেজিয়া খাতুনকে তিনিও জানতেন। ১৯২০- এর দশকে লেখিকা হিসেবে, সমাজসেবী হিসেবে ছিলেন তিনি তখন সুপরিচিত। আমি ১৯৯০-এর প্রথম দিকে কলকাতায় ভবতোষ দত্তকে রেজিয়া খাতুন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেন, ‘খুব মনে আছে। আমাদেরই বয়েসী ছিলেন। অল্প বয়সে মারা যান।
মহেশ্বর পাশা পরিচয়-এ মহেশ্বর পাশার পার্শ্ববর্তী খুলনা দৌলতপুর অঞ্চলের আঠার- উনিশ শতক ও বিশ শতকের প্রথম দিকের খ্যাতনামা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষেপে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। এলাকার ‘বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য’ ব্যক্তিত্ব রেজিয়া খাতুন সম্পর্কে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলা হয়েছে :
এই স্বর্গীয় কুসুম প্রস্ফূটিত হইবার পূর্ব্বেই চিরদিনের জন্য ঝরিয়া পড়িয়াছে। এই বিদুষী মুসলমান রমণীর অকাল মৃত্যু দৌলতপুরের দুর্ভাগ্য। ১৩৩৩ সালের ৩রা আশ্বিন মাত্র ১৭ বৎসর বয়সে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। পূর্ব্ব বৎসর তিনি স্বামীর আন্তরিক চেষ্টায় মুসলমান সমাজের শত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া কলিকাতা গবর্নমেন্ট মোসলেম ফিমেল পৰ্দ্দাহ ট্রেনিং ইন্স্টটিউশনে টিচারশিপ পড়িতে যান, কিন্তু দুরন্ত বেরিবেরি রোগের কবলে পড়িয়া ইহসংসার ত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। রোগাক্রান্ত হইলেই চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁহাকে পিত্রালয় খুলনা টুটপাড়ায় আনা হয় এবং সেইখানেই তাঁহার মৃত্যু হয়। গদ্য ও পদ্য উভয়বিধ রচনাতেই তিনি পারদর্শিনী ছিলেন। তাঁহার প্রবন্ধ ও কবিতা “বঙ্গলক্ষ্মী”, “মাতৃমন্দির”, “সওগাত”, “ইসলাম দর্শন”, “মোসলেম দর্পণ” প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। বস্তুতঃ সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি অল্পদিনের মধ্যে খ্যাতি অর্জন করেন। উন্নত সূচীকার্য্য, এমব্রয়ডারি, ক্রচেট ওয়ার্ক, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদিতে তিনি বহু পদক ও প্রশংসাপত্রের অধিকারিণী হইয়াছিলেন। [ডাক্তার খগেন্দ্রনাথ বসু, মহেশ্বর পাশা পরিচয়, পৃ. ৩০৫।]
রেজিয়া খাতুনের আকস্মিক মৃত্যুর পর খুলনার মানুষ শোকাভিভূত হয়। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তারা দৌলতপুরে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর নামে একটি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় : দৌলতপুর রেজিয়া খাতুন বালিকা বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন মির্জা ইব্রাহিম হোসেন। তাঁর সম্পর্কেও কিছু বলা দরকার। মির্জা ইব্রাহিমের জন্ম ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে দৌলতপুরে তাঁর মাতুলালয়ে। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ছিলো খুলনার অন্তর্গত দেয়ানা গ্রামে। খগেন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন :
তাঁর পূর্বপুরুষগণ দিল্লীর সম্ভ্রান্ত বংশোদ্ভূত ছিলেন। ভারতের মোগল সাম্রাজ্যের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে তাহার বৃদ্ধ প্রপিতামহ যশোহরে আসিয়া বসতি স্থাপন করেন এবং অচিরেই যথেষ্ট ভূ-সম্পত্তির মালিক হইয়া পড়েন। পিতামহ মির্জ্জা ছানা উল্লা সংসারে অনাসক্ত সাধু প্রকৃতির লোক ছিলেন। সম্পত্তি বিভাগ বিষয়ে ভ্রাতৃগণের সহিত মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি স্বীয় অংশ এমন কি গৃহ পর্যন্ত পরিত্যাগ করিয়া স্ত্রী এবং ৫ বৎসর বয়স্ক পুত্র মির্জা মোহাম্মদ তোরফানকে লইয়া চিরদিনের মত আসিয়া খুলনার অন্তর্গত দেয়ানা গ্রামে নূতন বসতি স্থাপন করেন। [ডাক্তার খগেন্দ্রনাথ বসু, মহেশ্বর পাশা পরিচয়, পৃ. ৩০৫।]
ছানা উল্লার পুত্র কেনায়েত উল্লাহর কনিষ্ঠ পুত্র হলেন মির্জা ইব্রাহিম। ১৯২৪ সালে তিনি বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। প্রথমে সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন। মির্জা ইব্রাহিম শিক্ষা বিস্তারের জন্য ১৯২০ ও ৩০-এর দশকে প্রচুর কাজ করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান তাঁর চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়। দৌলতপুর বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়ের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর উদ্যোগে ১৯২০- এর দশকে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে দৌলতপুর মাদ্রাসা, দৌলতপুর হাই স্কুল, চুয়াডাঙ্গার মেমনগর হাইস্কুল, চুয়াডাঙ্গার অন্তর্গত কলাবাড়ি রায়নগর জুনিয়ার মাদ্রাসা, উথলি বালিকা মক্তব প্রভৃতি। ১৯২৮-২৯ সালে তিনি চুয়াডাঙ্গার সার্কেল অফিসার ছিলেন।
মির্জা ইব্রাহিম ছিলেন রেজিয়া খাতুনের একজন বড় উৎসাহদাতা ও পৃষ্ঠপোষক। তাই তাঁর মৃত্যুর পর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘রেজিয়া খাতুন বালিকা বিদ্যালয়’। এই বিদ্যালয়ের জন্য তিনি ‘যথেষ্ট অর্থব্যয়’ শুধু করতেন না, বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের তিনি নিজের টাকায় বইপত্র কিনে দিতেন। এই মহান শিক্ষাব্রতীর কথা আজ তাঁর এলাকার মানুষও ভুলে গেছে। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন খগেন্দ্রনাথ :
বালিকাগণের পুস্তকাদির ব্যয়ভার তিনিই বহন করিতেছেন। তিনি অত্যন্ত সরল এবং অমায়িক প্রকৃতির লোক, উচ্চপদস্থ হইয়াও অতি দীনাতিদীনকেও বন্ধুভাবে আলিঙ্গন করিতে দ্বিধাবোধ করেন না। দরিদ্রকে যথাসাধ্য অর্থসাহায্য করা তাঁহার জীবনের আর একটি ব্রত, দরিদ্রব্যক্তি নিজের অভাব জানাইয়া কখনও তাঁহার নিকট হইতে বিফল মনোরথ হয় নাই। অনেক স্কুল কলেজের ছাত্রকেও তিনি রীতিমতভাবে অর্থ সাহায্য করিয়া থাকেন। [মহেশ্বর পাশা পরিচয়]
বাঙালি মুসলমান-সমাজে বড় সমাজসেবক, সমাজ-সংস্কারক, উচ্চ অন্তঃকরণবিশিষ্ট ব্যক্তি বিশেষ জন্মগ্রহণ করেননি। মির্জা ইব্রাহিমের মতো একজন সমাজসেবীকেও মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি তাঁর সম্প্রদায়, অথচ সেকালে নারীশিক্ষা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রেজিয়া খাতুন বালিকা বিদ্যালয়টি এক সময় অযত্নে অবহেলায় বন্ধ হয়ে যায়।
৩.
আত্মপ্রকাশের পর পরই রেজিয়া খাতুন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বহুমুখী প্রতিভার কারণেই তিনি বিশেষ খ্যাত ছিলেন। আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী তাঁর এক প্রবন্ধে রেজিয়া খাতুন সম্পর্কে, তখনো তিনি জীবিত, লিখেছিলেন :
এখন এমন একজন মহিলার নাম করিব যিনি লেখার চেয়ে শিল্প প্রতিভার জন্য বিশেষ প্রসিদ্ধ। ইনি খুলনা জিলার অন্তর্গত দৌলতপুরের মোসাম্মৎ রিজিয়া খাতুন সাহেবা। এই বিদূষী মহিলা ও তাঁহার ভগিনী রহিমা খাতুন সাহেবার বহুমুখী প্রতিভায় সকলেই চমৎকৃত হইয়াছেন। ইংরেজি-বাংলা বহু সংবাদপত্রই মুক্তকণ্ঠে ইঁহাদের প্রশংসা করিয়াছেন। অঙ্কন, শ্রমশিল্প, প্রাথমিক চিকিৎসা (First aid) ও গৃহধাত্রী বিদ্যায় ( Home Nursing) ইঁহারা প্রথমশ্রেণীর পদক ও প্রশংসাপত্র প্রাপ্ত হইয়াছেন। তাঁহাদের এই অসাধারণ পারদর্শিতা দর্শনে আমাদের প্রাণে বঙ্গীয় মুসলিম নারীদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটা আশার সঞ্চার হইয়াছে। [“বঙ্গ সাহিত্যে মুসলমান মহিলা’, সওগাত, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৩৩।]
অতি অল্প বয়সে সাহিত্যজগতে রেজিয়া খাতুনের আবির্ভাব যে সকলের কৌতুহলী দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং তাঁর ‘গুণকীর্তনে’ সকলেই পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিলেন তা তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত বিক্রমপুরীর এই লেখা থেকে অনুমান করা যায় :
রিজিয়া খাতুন সাহেবার বঙ্গভাষার প্রতিও যে যথেষ্ট অনুরাগ আছে, তাহার পরিচয় আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি। ইনি ইসলাম দর্শন, শরিয়ৎ, মোসলেম দর্পণ, বঙ্গলক্ষী প্রভৃতি পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখিয়াছেন এবং এখনো লিখিতেছেন। আশা করি এভাবে বঙ্গভাষার সাধনা করিয়া অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় সাহিত্যেও ইনি শক্তিমত্তার পরিচয় দিবেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের কঠিন নিগড় ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করিয়া যে দূরদর্শী ও মহাপ্রাণ পুরুষ মুরুব্বীগণের ঐকান্তিক চেষ্টা ও উৎসাহে এই মহিলাদ্বয় বিবিধ শিক্ষায় পারদর্শিতা লাভ করিয়া সমাজের মুখোজ্জ্বল করিয়াছেন, আমরা আজ এই সুযোগে প্রাণ খুলিয়া তাহাদের উৎসাহ ও সমাজহিতৈষণার গুণকীর্তন করিতেছি। [সওগাত, ভাদ্র ১৩৩৩।]
এই প্রবন্ধ প্রকাশের মাত্র এক মাসের মধ্যে আকস্মিকভাবে রেজিয়া খাতুনের মৃত্যু হয় এবং তিনি যে কবিতাটি সওগাত-এ প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন সেটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই রেজিয়া খাতুন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। সওগাত-এর কার্তিক ১৩৩৩ সংখ্যায় সেই মনের বিয়ে’ শীর্ষক কবিতাটি যখন প্রকাশিত হয় তখন কবিতার শেষে তারকাচিহ্ন দিয়ে সম্পাদক লেখেন : ‘অল্পদিন পূর্বেই লেখিকা সওগাতে প্রকাশার্থে কবিতাটি আমাদের নিকট পাঠাইয়াছিলেন কিন্তু মর্মান্তিক দুঃখের বিষয় কবিতাটি ছাপা হওয়ার পূর্বেই তিনি এন্তেকাল করিয়াছেন।’ রেজিয়া খাতুনের ‘মনের বিয়ে’ শীর্ষক শেষ প্রকাশিত কবিতাটি এই :
সজনে শাখে দোয়েল নাচে
কোথায় ধায় পরাণখানি,
আনন্দেরি উৎসবেতে
অবুজ মন অ-থির বাণী।
আজকে বুঝি অজানা দেশে
সখীগণের আঁচল ছায়ে,
ফুটল যেন বিয়ের কুঁড়ি
আগুন-ভরা উতল বায়ে।
আদিম হতে নারীই যে গো
পুরুষেরই পথের সাথী,
জীবন ভরা অন্ধকারে
দেখিয়ে নেয় সমুখ বাতি
সকল যুগে আমরা দুটি
আসূচি চলে বাঁধন গড়ে,
আজকে কেন থাকব মোরা
দূরের দেশে একলা সরে।
আমাদের এ মিলন-ক্ষণে
হাসির ভায়ে উজল ধরা,
হর্ষ বোলে আঙনখানি
আগমনীর পুলক-ঝরা।
আশীষ করে স্বর্গ হতে
নহবতের সুরের বেনু,
বধির আজি শ্রবণ পেল
উঠল বেজে কাহার বেনু।
সত্য যেন হউক উহা
জীবন পথে সকল যুগে,
পরস্পরে ঘর করি গো
আনন্দেতে নিবিড় সুখে।
সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনও রেজিয়া খাতুনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন এবং তিনি ছিলেন তাঁর একজন পৃষ্ঠপোষক ও গুণগ্রাহী।
পশ্চাৎপদ মুসলমানসমাজের মেয়েদের উন্নতির জন্য রেজিয়া খাতুনের অসামান্য আগ্রহ ছিলো এবং উদ্যোগ ছিল। মেয়েরা যাতে বিদ্যালয়ে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাজ করে কিছু উপার্জন করতে পারে সে ব্যাপারে তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কুটির শিল্পের কাজে শুধু নয় চিত্রশিল্পেও রেজিয়া খাতুনের ঝোঁক ছিল অসামান্য, বেঁচে থাকলে শুধু বড় লেখিকা নন হয়ে উঠতেন তিনি একজন চিত্রশিল্পীও : বাঙালি মুসলমানসমাজে প্রথম মহিলা চিত্রশিল্পী।
রেজিয়া খাতুনের মৃত্যুর পর বাংলা ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্য পত্রিকা প্রবাসী যেখানে মুসলমানদের কোনো স্থানই ছিল না বলা চলে, তাঁর সম্পর্কে লিখেছিল :
আমরা দুঃখের সহিত জানাইতেছি যে, মুসলমান লেখিকা রেজিয়া খাতুনের মৃত্যু হইয়াছে। মৃত্যুর সময় তাঁহার বয়স মাত্র ১৭ বৎসর হইয়াছিল। মোসাম্মদ রেজিয়া খাতুনের নাম হিন্দু মুসলমান অনেকেই জানেন। তিনি মোসলেম সমাজের শত বাধা- বিঘ্ন ও ভয় ভীতি উপেক্ষা করিয়া ১৯২৫ [খ্রিস্টাব্দে] কলিকাতা গভর্ণমেন্ট মোসলেম ফিমেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউশনে “টিচারশিপ” পড়িতে আসেন। ইনি সাহিত্য, উন্নত সূচীকার্য, এমব্রয়ডারী, ক্রচেট-ওয়ার্ক, চিত্রাঙ্কন ড্রইং ইত্যাদিতে পারদর্শিতার জন্য বহু পদক ও প্রশংসাপত্র প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। রেজিয়া খাতুনের সাহিত্যচর্চার প্রতি অত্যন্ত অনুরাগ ছিল। তিনি দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে [নবম শ্রেণী] উন্নীত হওয়ার পূর্বেই অবসরমত স্কুল লাইব্রেরির সমস্ত ভালো বই ও পত্রিকা পড়িয়াছিলেন। পরে তাহার প্রবন্ধ ও কবিতা বঙ্গলক্ষী, মাতৃমন্দির, সওগাত, ইসলাম দর্শন, মোসলেম দর্শন ও শরিয়ত প্রভৃতি মাসিক পত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল ইঁহার লেখার ভিতর দিয়া প্রগাঢ় ধর্ম ও সমাজপ্রীতি সর্বত্র ফুটিয়া উঠিত। ইনি স্বীয় ধর্মে দৃঢ় বিশ্বাসী হইলেও ধর্মান্ধতা বা কোনরূপ কুসংস্কারের অধীনা ছিলেন না। [প্রবাসী, মাঘ ১৩৩৩।]
রেজিয়া খাতুনের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর মুসলমানসমাজের প্রগতিশীল সাহিত্য পত্রিকা সওগাত লিখেছিল :
বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের অন্যতম সুলেখিকা মোসাম্মৎ রেজিয়া খাতুন সাহেবা বিগত ফাতেহা দোয়াজ দহমের পুণ্যময় সোবেহ সাদেকে বেরীবেরী রোগে ইহজগৎ পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন (ইন্নলিল্লাহে….)। মৃত্যু-সময় তাঁহার বয়স মাত্র ১৭ বৎসর হইয়াছিল। এই অল্প বয়সেই তিনি শরিয়ত, মোসলেম দর্পণ, ইসলাম দর্শন, মাতৃমন্দির ও বঙ্গলক্ষী প্রভৃতির পত্রিকায় লেখনী চালাইয়া যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার লেখার ভিতর দিয়া প্রগাঢ় সমাজ ও ধর্মপ্রীতি ফুটিয়া উঠিয়াছিল। ইসলামধর্মে দৃঢ়বিশ্বাসী হইলেও তিনি কোনরূপ কুসংস্কারের অধীন ছিলেন না। সমাজের শত বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করিয়া তিনি কলিকাতায় মোসলেম ফিমেল ট্রেনিং স্কুলে অধ্যায়নার্থ আসেন। মোসাম্মৎ রেজিয়া খাতুন গদ্য পদ্য উভয়বিধ রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। শুধু সাহিত্য আলোচনায় নয়, অন্যদিকেও মোসাম্মৎ রেজিয়া খাতুন বিশেষ যশ অর্জন করিয়াছিলেন। তিনি সূচিকর্ম, অঙ্কন, শ্রমশিল্প, প্রাথমিক চিকিৎসা, ধাত্রীবিদ্যা প্রভৃতিতে বিশেষ কৃতিত্ব লাভ করেন। ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শীতার জন্য এই বৎসর তিনি সেন্ট জন এমবুলেন্স হইতে প্রথম শ্রেণীর মেডেল ও সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হন। সূচিকর্ম ও অঙ্কনে বিগত খুলনা প্রদর্শনীতে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং পুরস্কারস্বরূপ মেডেল সার্টিফিকেট ও অর্থ প্রাপ্ত হন। তৎপর জব্বলপুর প্রদর্শনীতে এই দুই বিষয়ে তিনি প্রথম শ্রেণীর মেডেল ও সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হন। বস্তুতঃ এত অল্প বয়সে এরূপ সর্ব্বোতমুখী প্রতিভা বড়ই দুর্লভ। ইঁহার অকাল প্রয়াণে বঙ্গীয় মুসলমান সমাজ একটি উজ্জ্বল রত্ন হারাইলেন বলিতে হইবে। আমরা ইঁহার [আত্মার] মাগফেরাৎ কামনা করিতেছি। [সওগাত, কার্তিক ১৩৩৩।]
৪.
রেজিয়া খাতুনের আরেক বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র ছিল না, এ জন্যে সেই সাম্প্রদায়িকভাবে উত্তপ্ত ১৯২০-এর দশকেও হিন্দু মুসলমান দু’সম্প্রদায়ের মধ্যেই তাঁর সমান জনপ্রিয়তা ছিল। হিন্দুদের মধ্যেও তিনি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার একটি স্থান করে নিয়েছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায় ডাক্তার খগেন্দ্রনাথ বসু কাব্যবিনোদ সাহিত্যভূষণের মহেশ্বর পাশা পরিচয় শীর্ষক গ্রন্থে, যে গ্রন্থ থেকে আগেই উদ্ধৃত করা হয়েছে। মহেশ্বর পাশা সেকালের খুলনা জেলার একটি বিখ্যাত প্রাচীন গ্রাম। মহেশ্বর পাশার পাশের গ্রামেরই বাসিন্দা ছিলেন রেজিয়া খাতুন। খগেন্দ্রনাথ লিখেছেন :
সে আজ বেশি দিনের কথা নহে, বিদূষী রাজিয়া (রেজিয়া) খাতুন লোকান্তরিত হইয়াছেন। এই তরুণ লেখিকা মুসলমান সাহিত্যিক মাত্রেরই আশাপূর্ণ দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হইয়াছিলেন। কিন্তু ফুটিতে না ফুটিতেই তিনি ঝরিয়া পড়িয়াছেন।
মহেশ্বর পাশা পরিচয় গ্রন্থটি আলোচনাকালে সওগাত খগেন্দ্রনাথ এবং রেজিয়া খাতুনের এই অসাম্প্রদায়িক দিকটির কথা উল্লেখ করেছিল :
সঙ্কলয়িতা [খগেন্দ্রনাথ] এই মুসলমান বিদূষীর কথা গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করিয়া আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন। বর্তমান সময়ে এ দৃশ্য একটু অস্বাভাবিক, কারণ এখন হিন্দু ও মুসলমান প্রত্যেকেই প্রতিবেশির কর্তব্য ভুলিয়া গিয়া দ্বন্দ্ব-কলহে একান্ত অনবসর। এই অনবসরের মধ্যে যে একজন হৃদয়বান হিন্দু প্রতিবেশি মুসলমানের কথা ভাবিতে পারিয়াছেন, ইহা তাঁহার উদার হৃদয়েরই পরিচায়ক। [সওগাত, ৭ বর্ষ ৬ সংখ্যা, মাঘ ১৩৩৬।]
১৯২০-এর দশকে বাঙালি মুসলমান সম্পাদিত বেশ কয়েকটি উদারপন্থী পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয় তার মধ্যে হাকিম মশিহর রহমান কোরায়শী সম্পাদিত মাসিক মোসলেম দর্পণ উল্লেখযোগ্য। কলকাতার ৫০ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট থেকে সম্পাদক কর্তৃক এটি প্রকাশিত হয়। ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন :
প্রথম সংখ্যার প্রকাশকাল ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৪৮, মুদ্রণসংখ্যা ৩,২০০ দাম দু’আনা। তৃতীয় সংখ্যা ছাপা হয় ৪,০০০। অনতিবিলম্বে এর ইংরেজি সংস্করণ The Moslem Mirror প্রকাশ পায় ডা. এস. জামানের সম্পাদনায়। [আনিসুজ্জামান, মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, ১৯৬৪, পৃ. ৩৯৬।]
রেজিয়া খাতুন মোসলেম দর্পণ-এর একজন নিয়মিত লেখিকা ছিলেন। পত্রিকাটির সবগুলি কপি এখন পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে তো নয়ই কলকাতায়ও নয়। অতি অল্প বয়সেই একটি জীবনদর্শন তৈরি হয় রেজিয়া খাতুনের। ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না একটুও কিন্তু নিজের ধর্ম ইসলামের প্রতি অনুরাগ ছিলো অসামান্য। মোসলেম দর্পণ-এ “বিশ্ব- রহস্য’ শীর্ষক এক কবিতায় তিনি লেখেন :
১
আমি জ্ঞান হতে জানি প্রভু
অনন্ত দয়ার আধার তুমি,
সসীমের গণ্ডী স্পর্শেনি তোমায়
অসীম তুমি যে বিশ্বস্বামী।
২
তোমার বাণী কোরাণে লিখিত
হজরত মোহাম্মদ (দঃ) তোমার প্রেরিত।
তুমিই সৃজিয়াছ অনন্ত আকাশ
তোমার হুকুমে প্রকৃতি বিকাশ।
৩
‘কুন’ শব্দে হয়েছিল জগতের সৃষ্টি,
‘ফায়াকন’ শব্দে নাশিবে সমষ্টি।
যেদিক নেহারি তোমার লীলা,
তাজ্জব হই ভাবি বিশ্বজনীন খেলা।
৪
তোমার প্রদত্ত জ্ঞানের প্রভাবে,
হয়েছিল ‘তাজে’র ভিত্তি:
তোমার শ্রেষ্ঠ দানের মহিমায়
মর্তে ‘পিরামিড’ আশ্চর্য সত্যি।
৫
বিশ্ববরেণ্য যাঁহারা আজি,
তোমার কৃপায় তাহা, সত্য জানি।
আজি যে বিজ্ঞানের উন্নতি এত
নিয়ে সে যে তব আশীষ বাণী।
৬
অনন্ত ক্ষমতা তোমার প্রভু,
ল্যাপলণ্ডে ষান্মাস নিশা রাজে।
হিমালয় শৃঙ্গে অনন্ত তুষার,
হিরক থাকেও কয়লার মাঝে।
৭
প্রশান্ত মহাসাগরে ভীষণ তুফান
তাহার মাঝারে দ্বীপের উত্থান।
তথায় আবার মানব-বসতি
সেও যে তব আজব কীরিতি।
৮
তোমার মহিমা বোঝা যে ভার,
প্রলয় করে তাহা সাধ্য কার,
হাসির লহরী ছুটিছে সংসারে,
নিমিষে প্রবর্তিত হয় হাহাকার। [মোসলেম দর্পণ, অক্টোবর ১৯২৬।]
রেজিয়া খাতুনের কোনো কোনো কবিতার ছন্দে ত্রুটি লক্ষ্য করা যাবে, বেঁচে থাকলে তা কাটিয়ে ওঠা তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন হতো না। তবে সুন্দর রোমান্টিক কবিতাও তিনি বেশ কিছু লিখেছেন। যেমন :
আধারে সাথী
আনন্দ মোর ঝড়ের সাথে
বাদল ধারাতে-
কোলাহলের বিপুল ধ্বনি
সুরের সাড়াতে।
নিবিড় নীরব একটি ক্ষণে
জাগ্ছে বেদন সকল মনে
রুদ্ধ কারাতে।
নেমে এসো প্রিয় আমার
কোরবো কি আশা!
সাথে লয়ে হর্ষ-ধ্বনি
মিলন পিয়াসা।
বাঁশীর সুরের আনন্দেতে
দুহুঁ মোরা উঠব মেতে
ফুটবে না ভাষা।
রেজিয়া খাতুনের বেশ কিছু প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাঁর প্রবন্ধের ভাষা ও বিষয়বস্তু মননশীল। বেঁচে থাকলে পরিণত বয়সে মূল্যবান চিন্তাশীল প্রবন্ধ তাঁর হাত থেকে পাওয়া যেতো। ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর যে আগ্রহ ও পড়াশোনা ছিল যথেষ্ট তার প্রমাণ তাঁর প্রবন্ধে উপস্থিত। ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। স্বদেশের মুসলমানদের অধঃপতনে দুঃখ পেলেও রেজিয়া খাতুন হতাশ হননি। জাতির দুঃসময়ে কোনো মহৎ চিন্তাশীল মানুষের বড় গুণ যা তা হলো জনগণকে আশাবাদী করে তোলা। ‘মোসলেম জাহানের বিশেষ মসজিদ মিশন সমূহ’ (মোসলেম দর্পণ, অক্টোবর ১৯২৬) তাঁর একটি ইতিহাস বিষয়ক রচনা। ‘মোসলেম জাহানের মুখপত্রসমূহ’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে তিনি লেখেন :
…..বৰ্ত্তমান মুসলমানগণ এই বঙ্গদেশের স্থানবিশেষে হীনবীর্য নিষ্প্রভ হইলেও সমগ্র দুনিয়ায় চল্লিশ কোটি মোসলেমের অসাধারণ ক্ষমতা, অতুল প্রভাব প্রতিপত্তি ও তেজঃবীৰ্য্য যথেষ্ট আছে। তাঁহাদের অতুলনীয় বীরত্ব, অসাধারণ পাণ্ডিত্য দর্শনে বহু শতাব্দী পূর্বেও পাশ্চাত্য জগত স্তম্ভিত ও চমৎকৃত হইয়াছিল এবং এখনও হইতেছে। স্মিথ সাহেবও শেষটায় স্বীকার করিয়াছেন যে, “সমগ্র জগতে ইসলামের স্থান অনেক উপরে। তাঁহাদের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যভাব জগতে আদর্শ স্থানীয় শিখিবার জিনিস।” বর্তমানে প্রাচ্যের শত শত নিঃস্বার্থ প্রতিভাবান মনীষী প্রচারক জীবন মরণ পণ করতঃ প্রতীচ্যে নীরবে নিঃসন্দেহে আপন আপন ধর্মের মহিমা, মাহাত্ম্য-গূঢ়-মৰ্ম্ম মোসলেম গৌরবকীর্তি গাঁথা প্রচার করিয়া সাত সমুদ্র তের নদী পারেও আশাতিরিক্ত ফল পাইতেছেন, তাহা এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধ পাঠে কতকটা বুঝিতে সক্ষম হইবেন। এতৎদ্দেশে সাম্প্রদায়িকবিবাদ-বিসম্বাদ নাই, কলহ জিঘাংসা নাই; প্রচারকগণ স্ব স্ব কার্যোদ্ধারের জন্য প্রাণপণ পরিশ্রম করিতেছে। তাই তাহাদের যুগ যুগব্যাপী কঠোর সাধনা ক্রমে ফলবতী হইয়াছে। প্রসিদ্ধ ইংরেজ কবি “কীপলিং” বলিয়াছেন- “প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মিলন অসম্ভব।” আজ ইসলাম তাঁহার ভবিষ্যতবাণী বাতিল করিয়া দিয়াছেন। অর্থাৎ ইসলামই আজ বিশ্বের সমূদয় মানবজাতিকে এক অচ্ছেদ্য প্রীতির ডোরে বাঁধিয়া দুনিয়া হইতে দ্বন্দ্ব, কলহ, অশান্তি ও অধর্ম্ম তুলিয়া দিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছে। [মোসলেম দর্পণ, এপ্রিল ১৯২৬।]
সমাজে নারী যে নিপীড়িত শ্রেণীর অন্তর্গত এবং চিরকাল সর্বত্র ‘স্বার্থান্ধ পুরুষ’ দ্বারা অত্যাচারিত তা তিনি শৈশবেই উপলব্ধি করতে সমর্থ হন। মৃদু প্রতিবাদের সুর শোনা যায় তাঁর ‘রমণী-সৌন্দর্য্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে :
এত অত্যাচার, এত উৎপীড়ন, এত বাধা ও এত বিঘ্ন—সমস্তই স্ত্রী জাতির একচেটিয়া সম্পত্তি; আবার শুনি তাহার কোনই প্রতিকার নাই- এমন কি, তাহা অসম্ভব; কারণ ইহা বিধিদত্ত। তবে কি নারী জীবন বিধাতার অভিসম্পাৎ? আমাদের অবস্থা বিবেচনা করিয়া কল্পনাই হউক আর যাহাই হউক আমার একটা ধারণা হয়। বোধ হয় সেই অনন্ত কালের প্রথম দিন, যেদিন ভাগ্যনিয়ন্তা মানব ভাগ্য-বিধান প্রস্তুত করিতেছিলেন, সেই দিন আমরা আশায় উদ্দ্গ্রীব হইয়া অতিরিক্ত লাভের আশায় ও লোভে পড়িয়া বিধাতার কি চুরি করিয়াছিলাম— তাই তিনি আমাদিগকে অভিসম্পাত করিলেন; একদিনের ব্যবহারে আমাদের সমস্ত জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া গেল। যদি তা’ না হয়, তবে বোধ হয় পুরুষ ও নারী খোদাতালার দুই ধারে দাঁড়াইয়া যখন আপন আপন স্বার্থের দাবী তুলিতেছিল কিন্তু তখন পুরুষ তাহাদের স্বার্থের সহিত বিধাতার প্রস্তুত প্রত্যেক বিধানটি মিলাইয়া দেখিতেছিল, সেই দিন বোধ হয় অবলা আমরা কোন কথাই বলিতে পারি নাই—কেবল হাঁ-হু করিয়াই বিধাতা যাহা বলিলেন তাহাই মাথা পাতিয়া লইলাম; ফলে আমরা নিজেদের সমস্ত স্বার্থ হইতে বঞ্চিতা হইলাম— এমন কি নিজস্ব কিছুই থাকিল না। শুধু আমরা ভাগ্যহীনাই হইলাম না— আর একজনের ভাগ্যের সহিত আমাদের ভাগ্য গ্রথিত হইয়া তাহারই ভাগ্যের গতি অনুসারে আমাদের চলিতে হইবে, ইহাই বিধাতার বিধানে বিধিবদ্ধ হইয়া গেল। বোকা আমরা—তখন আমাদের অবস্থা-জ্ঞান হয় নাই; দূরদর্শী খোদাতালা কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতের কালিমাময় চিত্র দেখিয়া আমাদিগের ভাগ্যনিয়ন্তাদিগকে বলিয়া দিলেন— “দেখ, আপনা ভুলিয়া, আপনা ছাড়িয়া সে আজ তোমাতে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিয়া তোমার অধীনা হইল, তুমি স্নেহ, প্রীতি ও অনুগ্রহ দানে কখনও তাহাকে বঞ্চিতা করিও না।” কিন্তু এতো বিধাতার অনুরোধ মাত্র- আইন ত’ নয়? আইনই যদি হইত তাহা হইলে তাহারা এরূপ নিঃসঙ্কোচ ও নির্ভয়ে আমাদিগকে যত অত্যাচার ও উৎপীড়নের কেন্দ্র করিয়া নিজ নিজ স্বার্থ-সিদ্ধির চেষ্টা করিত না।
সত্যই কি আমাদের কোনো অধিকার নাই? না থাকে চাই না, দয়াময়ই বঞ্চিতা করিয়া থাকেন তো অন্যের দানের অধিকার লাভ কি? যে স্বার্থত্যাগের মহামন্ত্র বলে আমরা সেদিন কোন অধিকার চাহিয়া লই নাই- আজিও তাহা চাই না; যত বিপদ; যত আপদ, যত অভাব, যত অসুবিধা, যত অত্যাচার ও যত উৎপীড়ন আমাদের ঘাড়ে চাপাইয়া দাও- আমরা বহিতে পারিব
“স্বার্থত্যাগ মহামন্ত্রে দীক্ষা আছে যার,
কঠোর বীরের ধর্ম পালে সেই জন।”
কিন্তু স্বার্থান্ধ পুরুষ তোমার নিজের স্বার্থেই তোমার জ্ঞান নাই- আমাদের উপর অত্যাচার করিতে যাইয়া তোমাদের নিজেদের স্বার্থের মূলে যে কুঠারাঘাত করিতেছ, তাহা একবার চাহিয়া দেখ। [ইসলাম দর্শন, ৫ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা, ফাল্গুন ১৩৩২ পৃ-১৯৭]
শারীরিক সৌন্দর্য নারীর প্রধান সৌন্দর্য নয় তার আত্মার সৌন্দর্যই তার প্রধান গুণ– সে কথাটি তিনি বলবার চেষ্টা করেছেন। ‘রমণী সৌন্দর্য্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন :
আমার যাহা কর্তব্য কার্য্য তাহাই আমি করিব জানিতে কিছু হয় ত সেই সম্বন্ধেই জানিব; কাজ সারিয়া যদি সময় থাকে ত অন্য দিক দেখিব, ইহাই আমাদের ব্রত হওয়া উচিত। আমরা রমণী আমাদের এই রমণীত্বের মধ্যে এতগুলি কৰ্ত্তব্য নিহিত আছে যে, তাহা সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে হইলে সেই সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করাই দুষ্কর; অন্য বিষয় ত দূরের কথা! আমাদের কৰ্ত্তব্যগুলি অত্যন্ত কঠিন; অথচ তাহা সুন্দররূপে করা চাই বলিয়া আমাদিগকে এত ধৈর্য্যশীল ও সৌন্দর্য্যশালিনী করা হইয়াছে। নচেৎ সংসারে সুখ-শান্তির অস্তিত্বই থাকিত না। অতএব সংসারে সুখ-শান্তি পূর্ণরূপে বিকশিত করিতে হইলে রমনীর ভিতর ও বাহিরের সমস্ত সৌন্দৰ্য ফুটাইয়া তোলা যে একান্ত আবশ্যক, তাহা বোধ হয় কেহই অস্বীকার করিতে পারিবেন না। আর সেই জন্যই আমরা রমনী-সৌন্দর্য্যের প্রতি আমাদের সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। [ইসলাম দর্শন, ৫ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা, ফাল্গুন ১৩৩২ পৃ-২২৮]
৫.
রেজিয়া খাতুন তাঁর স্বল্প স্থায়ী জীবনে যথেষ্ট কাজ করেছেন। তার চেয়ে বড় কথা তিনি একটি সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি যখন মারা যান তখন বেগম রোকেয়া জীবিত। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে বাংলার মুসলমান নারীসমাজ তাঁর স্মৃতি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। তাঁর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি সংগ্রহ করে কোনো বই প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বহুকাল পরে আজ আমাদের হাতে তাঁর সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য অপ্রতুল। যে কারণে তাঁর সঠিক ভূমিকাটির মূল্যায়ন করা কঠিন।
বাঙালি মুসলমান নারীর জেগে ওঠার ক্ষেত্রে ১৯২০-এর দশকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন হিন্দু-ব্রাহ্ম নারীদের ক্ষেত্রে ১৮৭০-৮০। পত্রপত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে নারী জাগরণের ব্যাপারটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উনিশ শতকে মুসলমানদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকায় ইসলাম প্রচারক, সুধাকর, মিহির, মিহির ও সুধাকর, লহরী প্রভৃতিতে—নারীর কোনো স্থান ছিল না। কিন্তু কুড়ি শতকের মুসলমান সম্পাদিত-প্রকাশিত পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে নারীদের স্থান দেওয়া হলো। নবনূর (১৯০৩), সওগাত (১৯১৮), বঙ্গনূর (১৯১৯), নূর (১৯২০), মোসলেম ভারত (১৯২০), মোসলেম দর্পণ (১৯২৫), ইসলাম দর্শন প্রভৃতি সাময়িকীতে মুসলমান নারীর উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। শিক্ষা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও সমাজসংস্কারে মুসলমান নারীর অংশগ্রহণ শুরু হয় বিশের দশকেই। শিক্ষার প্রতি তাঁদের আগ্রহ প্রকাশ পায়। সমাজসংস্কারে তাঁরা মন দেন। ঘরকন্যার বাইরে বহির্জগতে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে বাঙালি মুসলমান নারী সচেতন হয়ে ওঠেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, তাদের প্রাথমিক পর্যায়ের ভূমিকাটির আজও সঠিক মুল্যায়ন হয়নি। আমি ১৯২০- এর দশকের পনের জন নারীর লেখালেখি ঘেঁটে দেখেছি তাঁরা যথেষ্ট প্ৰগতিশীল ভূমিকা পালন করেছেন কঠিন সীমাবদ্ধতার ভেতরেও।
আমরা অকারণে অথবা ভাবাবেগবশত কাউকে, অতীতেরই হোন বা বর্তমানেরই হোন, মহিমান্বিত করতে চাই না। তবে আমাদের মনোযোগের অভাবে কোনো কৃতী বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাবেন সেটাও কাম্য নয়। আধুনিককালে নারীবাদ বা নারীমুক্তি বলতে যা বোঝায় তেমন মুক্তি ও স্বাধীনতা ৮০/৮৫ বছর আগের বাঙালি নারীবাদীদের কাছে আশা করা সমীচীন নয়। তাঁদের ছিলো পুরুষের মতো শিক্ষিত হয়ে ওঠার আকাঙক্ষা, অন্দর থেকে বেরিয়ে সমাজে কিছু কাজ করার আকুলতা, পুরুষের প্রায় সমান অধিকার অর্জনের স্বপ্ন। তাঁদের সেই আকাঙ্ক্ষা, আকুলতা ও স্বপ্ন শতাব্দীর শেষ দিকে এসে বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁদের সেই শতাব্দীটিরই শেষ দশকটিতে বাংলাদেশের মানুষ শাসিত হলেন দু’জন মহিলা প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা। জীবনের সকল পর্যায়ে আজ নারীর উপস্থিতি অপরিহার্য। পোশাকশিল্পের লাখ লাখ নারী সকাল থেকে মধ্যরাত অব্দি কাজ করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা উপহার দিচ্ছেন হত দরিদ্র জাতিকে। এই যে নারী জাগরণ এর পেছনে শতাব্দীর প্রথম দিকের বাঙালি মুসলমান নারীর অবদান সামান্য নয়। আজকের প্রগতিশীল নারীসমাজ তাঁদের কাছে অপরিশোধ্য ঋণের দায়ে আবদ্ধ—তাঁদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা সীমাহীন। *
—
* ১ আগস্ট ২০০৩ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদ সম্মেলন কক্ষে প্রদত্ত আহমদ ছফা স্মৃতি বক্তৃতা ২০০৩
সংযোজন ০১ – রমণী-সৌন্দর্য্য* মোসাম্মাত রেজিয়া খাতুন
১.
এত অত্যাচার, এত উৎপীড়ন, এত বাধা ও এত বিঘ্ন-সমস্তই স্ত্রী জাতির একচেটিয়া সম্পত্তি : আবার শুনি তাহার কোনই প্রতিকার নাই-এমন কি, তাহা অসম্ভব; কারণ ইহা বিধিদত্ত। তবে কি নারী জীবন বিধাতার অভিসম্পাত্ত আমাদের অবস্থা বিবেচনা করিয়া কল্পনাই হউক আর যাহাই হউক আমার একটা ধারণা হয়। বোধ হয় সেই অনন্ত কালের প্রথম দিন, যেদিন ভাগ্যনিয়ন্তা মানব ভাগ্য-বিধান প্রস্তুত করিতেছিলেন, সেই দিন আমরা আশায় উদ্গ্রীব হইয়া অতিরিক্ত লাভের আশায় ও লোভে পড়িয়া বিধাতার কি চুরি করিয়াছিলাম— তাই তিনি আমাদিগকে অভিসম্পাত করিলেন; একদিনের ব্যবহারে আমাদের সমস্ত জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া গেল। যদি তা’ না হয়, তবে বোধ হয় পুরুষ ও নারী খোদাতালার দুই ধারে দাঁড়াইয়া যখন আপন আপন স্বার্থের দাবী তুলিতেছিল কিন্তু তখন পুরুষ তাহাদের স্বার্থের সহিত বিধাতার প্রস্তুত প্রত্যেক বিধানটি মিলাইয়া দেখিতেছিল, সেই দিন বোধ হয় অবলা আমরা কোন কথাই বলিতে পারি নাই—কেবল হাঁ-হু করিয়াই বিধাতা যাহা বলিলেন তাহাই মাথা পাতিয়া লইলাম; ফলে আমরা নিজেদের সমস্ত স্বার্থ হইতে বঞ্চিত হইলাম- এমন কি নিজস্ব কিছুই থাকিল না। শুধু আমরা ভাগ্যহীনাই হইলাম না—আর একজনের ভাগ্যের সহিত আমাদের ভাগ্য গ্রথিত হইয়া তাহারই ভাগ্যের গতি অনুসারে আমাদের চলিতে হইবে, ইহাই বিধাতার বিধানে বিধিবদ্ধ হইয়া গেল। বোকা আমরা—-তখন আমাদের অবস্থা-জ্ঞান হয় নাই; দূরদর্শী খোদাতালা কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতের কালিমাময় চিত্র দেখিয়া আমাদিগের ভাগ্যনিয়ন্তাদিগকে বলিয়া দিলেন- “দেখ, আপনা ভুলিয়া, আপনা ছাড়িয়া সে আজ তোমাতে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিয়া তোমার অধীনা হইল, তুমি স্নেহ, প্রীতি ও অনুগ্রহদানে কখনও তাহাকে বঞ্চিতা করিও না।” কিন্তু এ তো বিধাতার অনুরোধ মাত্র- আইন ত’ নয়? আইনই যদি হইত তাহা হইলে তাহারা এরূপ নিঃসঙ্কোচ ও নির্ভয়ে আমাদিগকে যত অত্যাচার ও উৎপীড়নের কেন্দ্র করিয়া নিজ নিজ স্বার্থ-সিদ্ধির চেষ্টা করিত না।
সত্যই কি আমাদের কোন অধিকার নাই? না থাকে চাই না, দয়াময়ই বঞ্চিতা করিয়া থাকেন তো অন্যের দানের অধিকারে লাভ কি? যে স্বার্থত্যাগের মহামন্ত্র বলে আমরা সেদিন কোন অধিকার চাহিয়া লই নাই- আজিও তাহা চাই না; যত বিপদ; যত আপদ, যত অভাব, যত অসুবিধা, যত অত্যাচার ও যত উৎপীড়ন আমাদের ঘাড়ে চাপাইয়া দাও—আমরা বহিতে পারিব।
“স্বার্থত্যাগ মহামন্ত্রে দীক্ষা আছে যার,
কঠোর বীরের ধর্ম পালে সেই জন।”
কিন্তু স্বার্থান্ধ পুরুষ তোমার নিজের স্বার্থেই তোমার জ্ঞান নাই- আমাদের উপর অত্যাচার করিতে যাইয়া তোমাদের নিজেদের স্বার্থের মূলে যে কুঠারাঘাত করিতেছ, তাহা একবার চাহিয়া দেখ।
মানুষ এমনই বোকা যে, আপন লাভ আপনিই বোঝে না। আমাদিগের দ্বারা স্বার্থসিদ্ধি করুক ক্ষতি নাই; কিন্তু আমাদিগকে পদদলিত করিয়া তাহার যে কোনও স্বার্থই সিদ্ধ হইতে পারে না, তাহা তাহারা বোঝে না। খোদাতালা কিন্তু ভারি কৌশলী; যে দিন টু’ শব্দটাও না করিয়া আমরা অবাধে তাহার কথাগুলি মানিয়া লইলাম-সেই দিন তিনি কিন্তু আমাদের পরিণাম দেখিয়া শিহরিয়া উঠিলেন; ফলে কৌশলে আমাদের ভাগ্য-পুরুষের ভাগ্যের সহিত এরূপভাবে নিয়ন্ত্রিত করিয়া দিলেন যে, আমাদিগগের উপর অত্যাচার করিয়া তাহারাও কোনও উপকার লাভ করিতে পারিবে না। দয়াময়ের এই একটিমাত্র ইঙ্গিতে তাহাদের সমস্ত চাতুরী বিফল হইয়া গেল; মোহান্ধ তাহারা তখনও কিছু বোঝে নাই-এখনও বোঝে কিনা জানি না। ধরিলাম তাহাদেরই কথা সত্য— স্ত্রীলোক পুরুষের সেবাই মাত্র করিবে; জগতের যত উন্নতি সব তাহারা একচেটিয়া করিয়া লইবে; আর আমরা তাহাদের আজ্ঞা পালন করিব মাত্র। কিন্তু সেবা ধৰ্ম্মটা যদি আমাদিগকে না শিখান হয়, তাহা হইলে আমরা তাহাদিগের সন্তোষজনক সেবা করিব কেমন করিয়া? অতন্ত : এই জন্য—এই সেবা ধর্মটা তাহাদিগের নিজের স্বার্থের দিকে চাহিয়া না হয় আমাদিগকে শিখাইলেন। তাঁহারা যতই উচ্চাঙ্গের উন্নতি লাভ করিতে থাকেন এবং এই উন্নতির ফলে তাঁহাদিগের রুচি যতই মার্জ্জিত হইতে থাকে, ততই সেই সেবাটাও একটু মার্জিত রুচিসম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় কি? সেবাটার মার্জিত রুচিসম্পন্ন হইতে হইলে তাহারও যে একটা শিক্ষার প্রয়োজন—ইহা তাহাদের বোঝা উচিত; তাহা ছাড়া নিজের উন্নতির পরিমাণ অনুযায়ী যদি এই সেবিকারা উন্নত না হয়, তাহা হইলে তাহাদিগকেই ত প্রকারান্তরে সেবক সাজিতে হইবে; কারণ সে যাহা বলে সেবিকা যদি তাহা না বুঝে, সে যাহা করে তাহা যদি অনুসরণ করিতে না পারে, এবং সে যাহা চায় তাহা যদি না দিতে পারে, অধিকন্তু উল্টা তাহার রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করিতে হয়, তাহা হইলে তাহার সব উন্নতির মাথাই যে ভাঙ্গিয়া পড়িবে।
মনে হয় আমারই বুঝিবার ভুল না হয় সাধারণের অবিচার; কারণ একে যে জ্ঞান অবাধে লাভ করিবে অন্যের তাহাতে অধিকার নেই- এ এক অপূৰ্ব্ব উক্তি! আমি বুঝি নারী-পুরুষ সকলেই মানুষ, একের যাহা প্রাপ্য অন্যেরও তাহাতে পূর্ণ অধিকার আছে। আমিও জ্ঞানলাভ করিব সে ও জ্ঞানলাভ করিবে এবং উভয়েই জ্ঞানালোকে আলোকিত হইয়া একের অভাব অন্যে পুরণ করিয়া—উভয়ে মিলিয়া জ্ঞানের পূর্ণতা সাধন করিবে। আমার যাহা অভাব সে দেখিবে, তাহার যাহা অভাব আমি দেখিব; এইরূপ আদান প্রদানের ফলে আপনা হইতে যে পবিত্র মিলন, অকৃত্রিম বন্ধুত্ব ও অনাবিল প্রেমের সৃষ্টি হইবে, তাহা জ্ঞানের মহত্ত্বর অঙ্গরূপে উভয়েরই জীবনে যে শান্তির আলোকবিকীর্ণ করিবে, সেই আলোকের ফলে উভয়ের হৃদয় আলোকিত হইয়া যে নূতন জ্ঞান- রাজ্যের সৃষ্টি করিবে, তাহার অন্যথা অসম্ভব। উভয়ের ভাগ্য এক সূত্রে গ্রথিত, একই পথে চালিত হইয়া বিভিন্ন কৰ্ত্তব্যে নিয়োজিত থাকিবে; ইহার মধ্যে বাধ্যতামূলক কোনও কিছুর সমাবেশ আছে বলিয়া আমার মনে হয় না। একই পথে দুইজন কর্মী দুইজনের কর্ত্তব্য পরস্পর হইতে বিভিন্ন তথাপিও এরূপভাবে জড়িত যে, এক হইতে অন্যকে ছিন্ন করা যায় না; দুই জনে দুই জনের কৰ্ত্তব্য করিয়া চলিয়া যাইতেছে অথচ একের কার্য্য প্রভাব অন্যে অনুভব করিতেছে এবং এই প্রভাব বলে পরস্পর পরস্পরের কর্তব্যকে মার্জিত করিয়া লইতেছে; ফলে উভয়ের কাজই নির্দোষভাবে সম্পন্ন হইতে হইতে পরস্পর পরস্পরের আকর্ষণ দ্বারা আকর্ষিত হইয়া ক্রমেই নিকটবর্ত্তী হইতেছে ততই উভয়ের প্রভেদ বিলুপ্ত হইতেছে এবং এইরূপ চলিতে চলিতে যতই পূর্ণতা হইতেছে, এবং এইরূপ চলিতে যতই পূর্ণতা প্রাপ্ত হইতে থাকিবে, প্রভেদ ততই লুপ্ত হইয়া যাইবে। কালে পূর্ণতার ফলে উভয়ে মিশিয়া এক হইয়া এক উজ্জ্বল-মধুর মিলনের সৃষ্টি করিবে, এই মিলনের ফলে আর একটা নূতন জ্ঞানালোকের সৃষ্টি হইবে।
যদি নারী নারী হয় ও পুরুষ পুরুষ হয় এবং স্ত্রী-পুরুষে যদি কোনও প্রভেদ থাকে, তাহা হইলে তাহাদিগকের কর্তব্যের মধ্যেও যে একটা প্রভেদ আছে, তাহা কেমন করিয়া অস্বীকার করা যায়। নারীর স্থান যেমন পুরুষে পূর্ণ করিতে পারে না, সেইরূপ একের কর্ত্তব্য অন্যের দ্বারা সম্পাদিত হইয়াও অসম্ভব। প্রত্যেকের কর্তব্যই প্রত্যেকের বিশেষত্ব এবং সেই কর্তব্যের মধ্য দিয়া প্রত্যেকের স্বভাব প্রকাশ পাইবে। এইরূপে দুই দিক হইতে দুই জনের স্বভাব বিকশিত হইয়া পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হইয়া জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়। এই দুই দিকের মধ্যে যে দিক যত অবনত হইবে, জ্ঞানও তদনুরূপ অপূর্ণ থাকিবে; শুধু তাহাই নহে, এক অঙ্গের বিকলত্বের জন্য সমস্ত অঙ্গ কর্মহীন হইয়া যায়-তথাকথিত পুরুষের জ্ঞানও পূর্ণ হয় না; যতদূর হয় তাহাও কার্য্যকরী হয় না। হজরত মোহাম্মদ (দঃ) জননী ‘আয়েশা’কে যখন বালিকা বয়সে বিবাহ করেন, তখন কারণ জিজ্ঞাসিত হইলে বলিয়াছেন, “বালিকা-বিবাহ করিলাম তাহাকে আপন হাতে গড়িয়া তুলিয়া কাৰ্য্যোপযোগী করিব; আমার জীবনের অর্দ্ধেকটা তাহার মধ্যে নিবদ্ধ থাকিবে; নারীজগতের গুপ্ত রহস্য আয়েশার মধ্য দিয়া প্রকাশিত হইবে।” এই জন্য বাস্তবিক হজরতের দেহত্যাগের পর ধর্ম্ম সম্পর্কীয় আইনের অর্দ্ধেকের বেশি জননী আয়েশার দ্বারা প্রকাশ পাইয়াছিল। এই ‘আয়েশা’ না থাকিলে হজরতের কত মূল্যবান কথা ও উপদেশ যে অপ্রকাশ থাকিত তাহা কে জানে? দ্বিতীয়তঃ পরম ধার্ম্মিকা ও বিদূষী জননী ‘খোদেজা’ সহায়তা না করিলে হজরত ইসলাম ধর্ম্ম অত সহজে প্রচার করিতে উৎসাহিত হইতেন কি না সন্দেহের ব্যাপার। এইরূপ স্বামী-স্ত্রী উভয়ে পূর্ণ জ্ঞানে জ্ঞানী হইলেই তাহারা পরস্পর পরস্পরের সাহায্যে জগতের মহত্তম কার্য্য করিতে সমর্থ হন।
এখন কথা হইতেছে —-উভয়ে উভয়ের কাজ করিবে, গন্তব্য পথে যাইবে তাহাতে অন্যে বাধা না দেয়। এইরূপ বাধা ও প্রতিবন্ধকতার ফলে যে আত্ম-অবনতি হয় তাহা শত চেষ্টায়ও পূরণ করা সহজ নহে। সমাজের দোহাই দিয়া একজনকে পদদলিত করিয়া অন্যজন যতই উন্নতি লাভ করুক না কেন এবং সমাজকে যতই উন্নত করুক না কেন, আর একজনের জ্ঞানলাভের অন্তরায় হইয়া এবং সেই জ্ঞানলাভ দ্বারা সমাজের যে উন্নতি হইত তাহার প্রতিবন্ধক হইয়া প্রকারান্তরে সমাজের যে অপকার করিল তাহা পূরণ হইবার কি?
একের জ্ঞানলাভে অন্যের প্রতিবন্ধক যেমন অন্যায় ও অবিচার, সেইরূপ একের সীমা ছাড়াইয়া জ্ঞানলাভার্থে অন্যের সীমার মধ্যে প্রবেশ করা অনধিকার চর্চা। পুরুষ ও নারীর প্রকৃতিগত প্রভেদ অনুসারে তাহাদের জ্ঞানেরও একটা প্রভেদ আছে; এই প্রভেদ মানে তাহাদের যার যার একটা সীমা। যে যার সীমাবদ্ধ থাকিয়া তাহারই মধ্যে জ্ঞানের উপকরণ গড়িয়া লইবে; কিন্তু সে যদি তাহা না করিয়া লোভবশে অন্যের সীমার মধ্যে পদার্পণ করে, তাহা হইলে সব নষ্ট হইয়া যাইবে। একজন হয়তো বহু পরিশ্রম—বহু অধ্যবসায়ের ফলে নিজের জ্ঞানের পথ পরিষ্কার করিয়াছে, আর একজনের পক্ষে তাহা অবাধে ভোগ করিতে যাওয়া সমীচীন নহে; তা ছাড়া ভোগেও সে শান্তি পায়না—নিজের প্রকৃতির সহিত খাপ খায় না, অথচ জবরদস্তি করিয়া তাহা আপনা করিয়া লইবার চেষ্টা করিবার ফলে নিজের বিশেষত্ব নষ্ট হইয়া যায়। উচিত যে যার সীমার মধ্যে বদ্ধ থাকে এবং তাহারই মধ্যে বসিয়া স্বভাবসিদ্ধ পরিচিত জিনিসসমূহের আলোচনা ও গবেষণার দ্বারা তাহাকে আরও উন্নত করা উচিত। এইরূপ উন্নতি যেমন উচ্চ হইতে উচ্চতরে উঠিতে থাকে, তাহার ঘাত প্রতিঘাতে নিজের স্বভাব ও মন উন্নত হয়; এইরূপ আত্মোন্নতি সমাজের সহিত অতি ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। মনে কর স্ত্রী-জগত যদি তাহাদেরই জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিয়া আপনাদের অভাব অভিযোগ শারীরিক, মানসিক ও দৈহিক বিষয়সমূহ আপনারাই আলোচনা করিতে থাকে এবং তাহার উন্নতি ও প্রতিকার করিবার পথ আপনারা আবিষ্কার করে তাহাতে সমস্ত সমাজের উপর যে গভীর উন্নতির আলো বিকীর্ণ হয়, তাহা অন্যের দ্বারা সম্ভব নহে। তাহাদের প্রথম কর্তব্য তাহারা আপন কৰ্ত্তব্য আপনি দেখিয়া লয়, সেই কৰ্ত্তব্য প্ৰত্যেককে পৃথকভাবে রাখিয়া একটি একটি করিয়া তাহার আকার প্রকার ও প্রকৃতি বিবেচনা করিতে থাকে সঙ্গে সঙ্গে তাহার অতীত ও বর্তমানের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করিয়া তাহার অভাব অসুবিধা ভবিষ্যতে যাহাতে দূরীভূত হয় তাহার উপায় অবলম্বন করিতে তৎপর হয়। এইরূপ অভাব অসুবিধা দূর হইয়া যখন স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ায় তখন চিন্তা ও কর্ম্মের পথে আর কোনও বাধা থাকে না; এই চিন্তা ও কর্ম যখন অপ্রতিহতভাবে কাজ করিতে পারে তখন ক্রমেই উচ্চাঙ্গের উন্নতির পথে অগ্রসর হয়। এই উন্নতিই আত্মোন্নতি। এইরূপ আত্মোন্নতির ফলে দেহ-মন পবিত্র হইয়া যখন স্থিরভাবে দাঁড়ায় তখন চতুদিকস্থ জিনিসের উপর নজর পড়ে এবং সূক্ষ্ম বুদ্ধি বলে তাহার প্রকৃত অবস্থা অবগত হইয়া তাহাদের উন্নতির দিকে ধাবিত হয়। এখান হইতেই প্রকৃত সমাজের উপকার ব্রত আরম্ভ হয়।
২.
জ্ঞানলাভের প্রথম অঙ্গ শক্তি ও সীমা-বিচার। প্রথম দেখিতে হইবে আমি কি এবং সমাজে আমার স্থান কোথায়! ‘কি এবং কোথায়’ এই দুইটি কথা দুই দিকে রাখিয়া মধ্য থেকে আমার কর্তব্যের উদ্ধার করিতে হইবে। সেই কর্ত্তব্যটি আবার এমন হওয়া চাই যাহা আমার অস্থি ও মজ্জাগত। এইরূপ গবেষণার ফলে অনেকগুলি কর্তব্যের সম্মুখীন হয়তো হইতে হয়। ইহাদিগকে আবার শ্রেণী-বিভাগ করিয়া অভাব অভিযোগের অনুপাতে একটির পর একটি করিয়া যাইতে হয়। যখন যে কত্তব্যটি হাতে থাকে, তাহাকে লইয়া একটু বিবেচনা করিতে হয়; একদিকে কর্তব্যের গুরুত্ব আর একদিকে আমার শক্তির পরিমাণ বিবেচনা করিতে হয়। আমার শক্তি অনুযায়ী যেখান হইতে যতদূর আমার পক্ষে করা সম্ভব তাহাও দেখা উচিত। এইরূপে যখন কর্ত্তব্যটার একাংশ করা হইল, তখনই কৰ্ত্তব্যপথে আমার কিছু উন্নতি হইল। এই উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমার শক্তিও একটু অগ্রসর হয় এবং উহা যেখানে যাইয়া থামে, সেই জায়গায় আমার শক্তিও প্রতিগত হয়। তখন কর্তব্যের আর কতকটা অংশ তাহার দৃষ্টিগোচর হয়। দর্শনমাত্র সেটুকুও করিবার জন্য শক্তি অগ্রসর হয়। এইরূপ একাংশের পর আর একাংশ সম্পন্ন করিতে করিতে একদিকে আমার দেহ- মন নিজেও যেমন উন্নতির উচ্চতম শিখরে আরোহণ করে সেইরূপ আমার জীবনের অনুষ্ঠিত কৰ্ম্মগুলিকেও সঙ্গে সঙ্গে সম্পন্ন করিয়া আমার ইহ-পরকাল ধন্য করিয়া দেয়।
কিন্তু এই শক্তি-সাধনা ও কর্তব্য পালন পরস্পরের মধ্যে এরূপভাবে জড়িত যে, একটির উন্নতি অন্যটির সাধন ব্যতীত হয় না। ইহাদের মধ্যে মিলন এতই গভীর যে ঠিক আমারই যাহা কৰ্ত্তব্য তাহা না পাইলে আমার শক্তিও কার্য্য করিতে সমর্থ হয় না। এই যে মহা-শক্তি যাহা আমার জীবনের প্রকৃত সার্থকতা সম্পাদন করিবে, তাহা নিজে নিজে প্রকাশ হইতে পারে না; তাকে প্রকাশিত হইতে হইলে আমার কর্তব্য সাধনের মধ্য দিয়াই হইতে হইবে। তাই কৰ্ত্তব্য নিৰ্ব্বাচনে যদি ভুল হয় আসলেই যদি গলদ থাকে, তবে কোনও শক্তিই কাজ করিতে পারে না; সুতরাং কৰ্ত্তব্য নিৰ্ব্বাচনই প্রথম ও প্রধান কাজ। প্রথমে কৰ্ত্তব্য নির্বাচন করিয়া তাহাতে আত্ম-শক্তি প্রয়োগ করিলে উভয়ের সংঘর্ষে জ্ঞানামৃত লাভ হইয়া থাকে। এখন কথা হইতেছে যে, আমাদের এই কর্ত্তব্যটি কি? আমার মতে আমাদের প্রথম কৰ্ত্তব্য গৃহধর্ম্ম। মানব-জীবনের প্রধান অধ্যায় এই সংসার–ধর্ম্ম আবার কয়েক ভাগে বিভক্ত; যথা স্বামী-সেবা, সন্তান-পালন, স্বাস্থ্যরক্ষা ও সর্ববিষয়ের শৃঙ্খলা; সংসারের উন্নতির প্রতি দৃষ্টি করাও এই কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। আবার এই সংসার কতকগুলি বিভিন্ন সম্বন্ধীয়, বিভিন্ন ভাবাপন্ন এবং বিভিন্ন রুচি ও বিভিন্ন প্রকৃতির লোক দ্বারা সংগঠিত। তাদের একদল পুত্রকন্যা স্থানীয়, একদল ভ্রাতা-ভগিনী সম্বন্ধীয় এবং অন্যদল মাতৃপিতৃ স্থানীয়। এতদ্ব্যতীত অবস্থা-বিশেষ চাকর-চাকরাণীও থাকে। এদের প্রত্যেকের অবার অভিযোগ দেখিয়া তদনুযায়ী তাহা পূরণ করিতে নিতান্ত কম জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। এদের সকলের আব্দার সহ্য করিয়া সব দিক রক্ষা করা বড় সহজ ব্যাপার নয়। তাই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, স্থির সঙ্কল্প, উদার ভাব, অপক্ষপাতিত্ব, সহৃদয়তা, কৰ্ত্তব্যনিষ্টা ও নিঃস্বার্থপরতা প্রভৃতি বহু গুণের সমন্বয় না হইলে সংসারে সুখ-শান্তি আনয়ন করা একান্তই অসম্ভব হইয়া পড়ে। কিন্তু সুশিক্ষিতা ও সদগুণশালিনী রমনী এত সহজে ও সুন্দরভাবে ঐ সকল কর্তব্য পালন করে যে, তাহা দেখিলে বিস্ময়ে অবাক হইতে হয়। অতএব যে রমণী শিক্ষিত অশিক্ষিত, বালকবৃদ্ধ প্রভৃতি প্রত্যেকের মন যোগাইয়া চলিতে না পারে, তাহার শিক্ষা-দীক্ষা ব্যর্থ এবং সে সংসার ধর্মের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।
আমাদের সর্ব্বদাই মনে রাখিতে হইবে যে, জীবন-বিকাশের প্রথম হইতেই ভবিষ্যৎ জীবনের আদর্শ গঠিত হয়। বাল্যকালে যখন বাহিরের বিষয়ে জ্ঞান থাকে না, তখন চঞ্চলমতি বালক-বালিকাগণ যাহা দেখে তাহারই অনুকরণ করে; এই অনুকরণ তাহার ভিতর অলক্ষ্যে এরূপভাবে প্রভাব বিস্তার করে যে, ইচ্ছায় হউক আর অনিচ্ছায় হউক সমস্ত জীবনে সে ইহার বিপরীত কার্য্য করিতে পারে না। সুতরাং চরিত্র গঠন কার্য্য এইখানেই আরম্ভ এবং এইখানেই শেষ হয়; ভবিষ্যতে সংসার কর্মক্ষেত্রে এই সময়ের গঠিত চরিত্রের গুণগুলি প্রকাশ পায় মাত্র।
আবার জ্ঞান ও গুণের একটা সমাবেশ না হইলে সংসার-ধর্ম পালন করা অসম্ভব। জ্ঞান দ্বারা কর্ত্তব্য নির্ব্বাচন ও উহার গুরুত্ব অনুভব করিতে হয়। কিন্তু নির্দ্ধারিত কর্তব্য প্রতিপালন করিতে হয় গুণ দ্বারা। জ্ঞান কর্ত্তব্য দেখাইয়া দেয়, গুণ তাহাকে সরল ও সরস করে; তাই জ্ঞান ও গুণের মিলন এত মধুর। সংসার জ্ঞানাভিনয় দেখাইবার জায়গা নয়। আমরা যদি শুধু লোক দেখাইবার জন্য জ্ঞান অর্জ্জন করি এবং সেই অর্জিত জ্ঞানের অভিমানে গৰ্ব্বভরে বসিয়া থাকি, তবে জ্ঞান লাভ হইয়াছিল সত্য, কিন্তু তাহা বৃথা গেল। যে সম্বন্ধে যে জ্ঞান লাভ করিব, তাহা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া ভাল করিয়া দেখিয়া তার সদ্ব্যবহার করিব; এই ত জ্ঞান লাভের প্রকৃত উদ্দেশ্য। কিন্তু যদি তাহা না করি, তবে সে জ্ঞান অর্জ্জন না করাই ভাল ছিল। আমি যে কত কি জানি, তা’ লোকে নাই বা জানিল; কিন্তু আমি যা জানি, তা’র দ্বারা আমি যাহা করিতে পারি তাহাই করিব। এখানেই জানার স্বার্থকতা। আমি জানি, ইহা লোকে বুঝুক—সে জানা না জানাই ভাল; বরং আমি যাহা জানি, লোকে তাহা শিখুক, ইহাই আমার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আমার যাহা কৰ্ত্তব্য কাৰ্য্য তাহাই আমি করিব—জানিতে কিছু হয় তা সেই সম্বন্ধেই জানিব; কাজ সারিয়া যদি সময় থাকে ত অন্য দিক দেখিব, ইহাই আমাদের ব্রত হওয়া উচিত। আমরা রমণী; আমাদের এই রমণীত্বের মধ্যে এতগুলি কৰ্ত্তব্য নিহিত আছে যে, তাহা সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে হইলে সেই সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করাই দুষ্কর; অন্য বিষয় ত দূরের কথা! আমাদের কর্তব্যগুলি অত্যন্ত কঠিন; অথচ তাহা সুন্দররূপে করা চাই বলিয়া আমাদিগকে এত ধৈর্য্যশীল ও সৌন্দর্য্যশালিনী করা হইয়াছে। নচেৎ সংসারে সুখ- শান্তির অস্তিত্বই থাকিত না। অতএব সংসারে সুখ-শান্তি পূর্ণরূপে বিকশিত করিতে হইলে রমনীর ভিতর ও বাহিরের সমস্ত সৌন্দর্য্য ফুটাইয়া তোলা যে একান্ত আবশ্যক, তাহা বোধ হয় কেহই অস্বীকার করিতে পারিবেন না। আর সেই জন্যই আমরা রমণী-সৌন্দর্য্যের প্রতি আমাদের সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি।
—
[* প্রথম প্রকাশ : ইসলাম দর্শন, ৫ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা, ফাল্গুন ১৩৩২; এবং ৫ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা, চৈত্র ১৩৩২। ]
সংযোজন ০২ – মোসাম্মৎ রেজিয়া খাতুন : এক বিস্তৃত নারীবাদী
[রাষ্ট্রসভা পত্রমালার ২য় সংখ্যায় চারজন জ্ঞানী মানুষ লিখেছিলেন আহমদ ছফার “শত গুণ থাকা সত্ত্বেও তিনি নারীবিদ্বেষী হিসেবে প্রতিভাত, তাঁর সাহিত্যে নারীর উপস্থাপন সমস্যাজনক জ্ঞানীচতুষ্টয়ের সাবধানবাণী আমরা ভুলি নাই। আমাদের ধারণা এই সাবধানবাণী কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির ফল। আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমান সমাজের ভবিষ্যত ভাবনার অংশ হিসেবে বাঙালি মুসলমান সমাজের নারী আন্দোলন নিয়েও কিছুটা ভাবতেন। তা দেখলেই বোঝা যাবে তিনি যার বিরোধিতা করতেন তা নারী নয়, বরং নারীর নামে বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণীর বিদেশ অনুকরণ, বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের দালালী। একেই ছফা বলতেন ‘ইংরিজী ইংরিজী’ আন্দোলন। মহাত্মা আহমদ ছফার দুটি অল্প পরিচিত লেখা এখানে পুনমুদ্রণের অনুমতি দেওয়ার জন্য আমরা তাঁর উত্তরাধিকারীদের ঋণ স্বীকার করছি।
বর্তমান সংখ্যায় আমরা বাঙালী মুসলমান সমাজের আদি নারী চিন্তাবিদদের একজন দৌলতপুরের রেজিয়া খাতুনের কথা হাজির করছি। এই অকালমৃত প্রতিভাময়ীর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে মরহুম আহমদ ছফার বন্ধু সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রদত্ত ‘আহমদ ছফা স্মৃতিবক্তৃতা; ২০০৩’ এই সংখ্যায় ছাপতে পেরে আমরা আনন্দিত। প্রচলিত নারীবাদী গবেষণার সাথে সৈয়দ আবুল মকসুদের গবেষণার কিছু প্রভেদ চোখে পড়ার মতো। প্রচলিত গবেষক- যেমন গোলাম মুর্শিদ বা সোনিয়া নিশাত আমিন – যে জিনিসকে আধুনিকতা বলেন তা আসলে ঔপনিবেশিক প্রভুদের অনুকরণ। সৈয়দ আবুল মকসুদ এই ধারার গবেষক নন। সৈয়দ আবুল মকসুদ আমাদের অগ্রণী সমাজ সংস্কারক ও চিন্তাবিদদের একজন। সম্প্রতি তিনি ইঙ্গ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ইরাক আগ্রাসনের প্রতিবাদে পাশ্চাত্য লেবাস বাদ দিয়ে সত্যাগ্রহ শুরু করেছেন। আমরা তাঁর এই প্রতিবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি। তিনিও বাঙালী মুসলমান সমাজ বিষয়ে তাঁর বড় গবেষণার একটি অংশ এখানে তিনি প্রকাশ করার অনুমতি দিয়ে আমাদের পত্রিকার মান বাড়িয়েছেন। আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ!
মনীষী সৈয়দ আবুল মকসুদের সৌজন্যেই এখানে আমরা রেজিয়া খাতুনের মাসিক ইসলাম দর্শন-এ ১৩৩২ বাংলায় প্রকাশিত একটি লেখা নতুন করে ছাপতে পারলাম।
আহমদ ছফার এন্তেকালের এক বছরের মাথায়- গত বছর শ্রাবণ মাসে- আমরা অনিয়মিত গবেষণাপত্র জ্ঞানে ‘রাষ্ট্রসভা পত্রমালা’ প্রকাশ শুরু করি। আমাদের গরীবী হালের প্রমাণস্বরূপ গত এক বছরে এই কাগজের মাত্র তিনটি চিকন সংখ্যা ছাপা হয়। অতএব বর্তমান সংখ্যাটি ২য় বছরের ১ম বা সারা জীবনের ৪র্থ সংখ্যা। বর্তমান সংখ্যা প্রকাশের ব্যয়ভার আংশিক বহন করেছেন আহমদ ছফা অনুরাগী এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কবি শামস আল মমিন। আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। হক’স বে লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী জনাব আবদুল হক বিজ্ঞাপন দিয়ে এই সংখ্যায়ও আমাদের বাধিত করলেন। প্রথম আলো পত্রিকার সাংবাদিক জনাব নাসির আলী মামুন এবং উপ-সম্পাদক জনাব সাজ্জাদ শরিফ আহমদ ছফার অনুরাগী। তাঁদের ঋণও আমরা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করি।
পাঠক ও পাঠিকা পত্রিকাটি কিনে পড়বেন বলেই আমরা আশা রাখি। বাংলাদেশের চিন্তাভাবনার জগতে এই পত্রিকাটি যদি সামান্যও একটি ভূমিকা পালন করতে পারে, তবে আমাদের ভালবাসা সফল হবে।
প্রধান সম্পাদক : সলিমুল্লাহ খান
সম্পাদক-প্রকাশক : জহিরুল ইসলাম
ঢাকা ১৭ শ্রাবণ ১৪১০
—
* খালেদা খাতুন গয়রহ, ‘আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা’ ও লিঙ্গীয় সম্পর্ক নিয়ে অধিপতির ভাবনাজাল ॥ চিঠি’, রাষ্ট্রসভা পত্রমালা : ২, ২০০২
সৈয়দ আবুল মকসুদ : পরিচয় সাজ্জাদ শরিফ
সারমেয় চেনা যায় বাবলা গাছের গোড়ায়, আর বুদ্ধিজীবীদের আপৎকালে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তাদের খাসলতের পরিচয় ধারাবাহিকভাবে দিয়ে আসছেন। আমেরিকা যখন ন্যাংটো হয়ে গায়ে তেল মেখে নির্লজ্জভাবে ইরাকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদের চেহারার আরেক প্রস্থ তখন আমাদের কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। কিন্তু এই দুঃসময়ে তাদের বাইরে থাকেন গুটিকয়েকজন। এঁদের মধ্যে সৈয়দ আবুল মকসুদের শিরদাঁড়ার চিহ্ন আমরা উত্তরোত্তর স্পষ্ট হতে দেখি। তিনি ঘৃণাভরে শরীর থেকে উপনিবেশের চিহ্ন পরিত্যাগ করেছেন। এবং সেখানেই থেমে থাকেননি, গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে আত্মমর্যাদার উদ্বোধন ঘটাতে চেয়েছেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ গবেষণা করেন, গরু খোঁজেন না। তাঁর গবেষণা নিরঞ্জন নয়। সেগুলোর উদ্দেশ্য ও বিধেয় আছে। তাঁর ভাবুকতা ও অন্বেষণের বিষয় পূর্ববঙ্গের জনসমাজ- ইতিহাসের তলায় চাপা পড়া যে সমাজ অবিরাম তার ইতিহাসের কর্তা হয়ে ওঠার লড়াই চালিয়ে গেছে, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে তাদের নাম যা-ই হোক না কেন : শুদ্র, বৌদ্ধ, নাথ বা মুসলমান। সৈয়দ আবুল মকসুদের গবেষণার বিষয় পূর্ববঙ্গের জনসমাজ বটে, কিন্তু এই হতমান ও লাঞ্ছনাপীড়িত জনগোষ্ঠীর যেসব সদস্য চারপাশের মানুষকে নিয়ে সম্মানের সঙ্গে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছেন তাঁদের সাধনা এবং এর মধ্য দিয়ে এই সমাজের অভিসারী ও ঊর্ধমুখী চেতনার রেখাঙ্কন তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু। ফলে তাঁর গবেষণার তালিকায় পাশাপাশি স্থান করে নিতে পারেন হরিশচন্দ্র মিত্র, গোবিন্দচন্দ্র দাস, খায়রন্নেসা খাতুন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। ভাসানী এবং ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে তাঁর গবেষণা রীতিমতো সমীহ জাগায়।
সৈয়দ আবুল মকসুদের জন্ম দেশভাগের এক বছর আগে, ১৯৪৬ সালে, মানিকগঞ্জে সাংবাদিকতা পেশার সূত্রে তিনি দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন, যা তাঁর মনকে দিয়েছে ব্যাপকতা এবং রচনা করেছে তাঁর গবেষণার পশ্চাৎভূমি।
তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র জীবন ও সাহিত্য (৩ খণ্ড), যুদ্ধ ও মানুষের মূর্খতা, হরিশচন্দ্র মিত্র, ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্র, মোতাহের হোসেন চৌধুরী ও তাঁর সাহিত্যকর্ম, গোবিন্দচন্দ্র দাসের ঘরগেরস্থালি, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ দার্শনিক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বিকেলবেলা, জার্মানীর জর্নাল, পারস্যের পত্রাবলি, রবীন্দ্ররাজনীতি, পথিকৃৎ নারীবাদী খায়রন্নেসা খাতুন, চিন্তা ও চেতনা, বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, রাজনীতি ও ধর্মীয় রাজনীতি প্রভৃতি। এছাড়া তিনি সম্পাদনা করেছেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচনাবলী।
এখন তিনি নিমগ্ন রয়েছেন পূর্ববঙ্গের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর সংসর্গ এবং কাজী নজরুল ইসলামের জীবনসংক্রান্ত গবেষণায়।
[রাষ্ট্রসভা পত্রমালা চতুর্থ সংখ্যা]