মধ্যযুগের ধর্মবিষয়ক রচনায় বাংলা ভাষার ব্যবহার

মধ্যযুগের ধর্মবিষয়ক রচনায় বাংলা ভাষার ব্যবহার

যে বিষয়ে বলবার জন্য আপনারা আমাকে মনোনীত করেছেন সে-বিষয়ে আমি একজন বিশেষজ্ঞ নই। তা ছাড়া আমার যা কিছু কাজ তা সবই আধুনিক কাল নিয়ে মধ্যযুগ আমার গবেষণার এলাকা নয়। আজকের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে সাহিত্যের পাঠক হিসেবে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও পন্ডিতের রচনা থেকে যেটুকু অবগত হতে পেরেছি তা থেকেই যৎসামান্য নিবেদন করব মাত্ৰ।

বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা গত হাজার বছরে নানা রকম রূপান্তরের ভেতর দিয়ে বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে। বঙ্গে মুসলমান শাসনের সূচনা অর্থাৎ তের শতকের প্রথম দিক থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ বা তার সামান্য আগে বা পরের সময়টি বাংলা ভাষা ও বাঙালির ইতিহাসের মধ্যযুগ। আঠার শতকের শুরু থেকেই আধুনিক যুগের সূচনা, বাংলা গদ্য- সাহিত্যেরও সূচনা। তবে তার আগে অর্থাৎ মধ্যযুগে বাংলা গদ্যভাষার আদৌ অস্তিত্ব ছিল না তা নয়। প্রাথমিক পর্যায়ের মধ্য ও প্রাক্-মধ্যযুগের সাহিত্য ছিল মূলত মৌখিক। পরে- বহু পরে- সেসব যখন লিখিত হয়েছে, সংগতভাবে ধারণা করা যায়, লেখার সময় তা কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে থাকবে, বিশেষ পরিমার্জিত যদি নাও হয়ে থাকে। তা ছাড়া যাঁরা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁরা তাঁদের নিজেদের পছন্দমতো বানানপদ্ধতিই অনুসরণ করেছেন। মৌখিক সাহিত্যের পরে এলো হাতে লেখা সাহিত্য। সবশেষে কলকাতার অদূরে শ্রীরামপুরে খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রাযন্ত্র স্থাপনের পর মুদ্রিত রচনার সূচনা।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ বাংলা সাহিত্যের শুধু ভাষারীতি নয় প্রকরণ, শৈলী, বিষয়বস্তু- সবই নতুনত্ব অর্জন করে। আঠার শতক আর উনিশ শতক পাশাপাশি হলেও তাদের মধ্যে দূরত্ব যেন যোজন যোজন। সময়ের দিকটি এখানে বড় ব্যাপার নয় তাদের মধ্যে স্বভাবের ব্যবধান বিশাল। উনিশ শতকের শক্তিমান লেখকগণ পুরনো রীতিনীতি পরিহার করে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মনোযোগ দেন। এবং তাঁরা তাঁদের মডেল হিসেবে সামনে রাখেন ঔপনিবেশিক শাসকদের ইংরেজি সাহিত্যকে। বস্তুত শুরু হয় ইংরেজি সাহিত্যের এক সাবলীল অনুকরণ। তাতে অবিলম্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং বাঙালির সৃষ্ট অন্যান্য শিল্পকলা ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে।

ইংরেজি সাহিত্যেও যেমন রয়েছে এ্যাঙ্গলো-স্যাক্সন খ্রিস্টান কাব্য, মিডল ইংলিশ খ্রিস্টধর্মীয় বিষয়ক রচনা, মধ্যযুগীয় ধর্মীয় নাটক, নৈতিকতা বিষয়ক ও আধ্যাত্মিক পদ্য প্রভৃতি তেমনি প্রাক্-আধুনিক যুগের অর্থাৎ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের উপজীব্যও প্রধানত ধর্মীয় বিষয় : দেবতাদের কথা ও অবতারদের জীবনবৃত্তান্ত এবং পৌরাণিক কাহিনীকাব্য।

২.

প্রতিপাদ্য বিষয়ে আলোচনার সময় আমাদের বিবেচনা করতে হবে তিনটি জিনিস : মধ্যযুগ, ধর্মবিষয়ক রচনা এবং বাংলা ভাষা। মধ্যযুগের সময়সীমা আগেই বলেছি আধুনিককালের সূচনা পর্যায় অর্থাৎ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্ববর্তী কয়েক শ বছর। এই সময় বাংলা সাহিত্যে যা রচিত হয়েছে তার প্রায় সবই পদ্যে। সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তেমন গদ্যের সূচনা উনিশ শতক থেকে। উনিশ শতকের আগের গদ্য লেখা যা পাওয়া গেছে তা সৃষ্টিশীল রচনা বা সাহিত্য নয় সে-সব ব্যবহারিক গদ্য চিঠিপত্র, পরিচয়পত্র, রাজন্যবর্গের প্রীতিপত্র, জীবিকাপত্র, ভূমিপরিচয় জ্ঞাপক দলিলপত্র প্রভৃতি।

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে আমরা আলোচনা করব বাংলা ভাষায় ধর্ম-বিষয়ক রচনা নিয়ে— ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মীয় সাহিত্যের বিষয়বস্তু নিয়ে নয়। ধর্মতত্ত্বও ধর্মবিষয়ক রচনাই, কিন্তু সকল ধর্মবিষয়ক রচনাই ধর্মতত্ত্ব নয়। তা ছাড়া উনিশ শতকের আগে ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক কোনো গ্রন্থ বা প্রবন্ধ-নিবন্ধ বাংলা ভাষায় রচিত হয়ওনি। দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত কাব্যচর্চা, পীর-পয়গম্বরের মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত কবিতা এবং নীতিকথামূলক ও আধ্যাত্মিক রচনাও ধর্মবিষয়ক রচনার অন্তর্গত। তাই মধ্যযুগে ধর্মবিষয়ক রচনা বলতে আমরা পাচ্ছি শুধুই কাব্য-সাহিত্য, যেমন- পৌরাণিক পাঞ্চালী, মনসা কাহিনী, চৈতন্য জীবনকথা, বৈষ্ণব পদাবলী, কৃষ্ণ-মঙ্গল, পদাবলী ও কৃষ্ণলীলা কাব্য, মনসা-মঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, শিবমাহাত্ম্য কাব্য, মুসলমান কবিদের নবী-পয়গম্বর বিষয়ক কাহিনী কাব্য, পদাবলী সংহিতা প্রভৃতি, রামায়ন-মহাভারতের পুরাণ কাহিনীনির্ভর কাব্য, পীরগাথা, বিদ্যাসুন্দর কাহিনী, মুসলমান কবিদের পুঁথি প্রভৃতি।

মধ্যযুগে হিন্দুশাস্ত্রবিশারদ বাঙালি ব্রাহ্মণগণ বিশুদ্ধ ধর্মতত্ত্ব যেমন ন্যায়-স্মৃতি প্রভৃতির চর্চা করেছেন সংস্কৃত ভাষায়। বাংলার অবাঙালি আরবি-ফারসিশিক্ষিত মুসলমান পন্ডিতগণ ইসলাম ধর্মবিষয়ক রচনা লিখেছেন আরবি ও ফারসিতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ বাঙালি তাদের ভাব প্রকাশের জন্য বেছে নেন প্রাকৃত বাংলা ভাষাকে, যে-ভাষা সংগঠিত নয়- সাধারণ অর্থে শুদ্ধ নয়। তবে বাঙালি তার ধর্ম-পুরাণ প্রভৃতির চর্চা করতে গিয়েও তার জীবনের কথাই বলবার চেষ্টা করেছেন। তার বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার চেয়ে ভাবের চর্চা করার দিকেই ঝোঁক বেশি। বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিশেষজ্ঞ নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন :

বস্তুত অরূপের ধ্যান এবং বিশুদ্ধ জ্ঞানময় অধ্যাত্ম সাধনার স্থান বাঙালির চিত্তে স্বল্প ও শিথিল। বাঙালী তাহার ধ্যানের দেবতাকে পাইতে চাহিয়াছে রূপে ও রসে মণ্ডিত করিয়া; তাহার সন্ধান বিশুদ্ধ বিশুষ্ক জ্ঞানের পথে ততোটা নয় যতটা রূপের ও রসের পথে অর্থাৎ বোধ ও অনুভবের পথে। … বাঙালির ভক্তি যে জ্ঞানানুগ নয়, হৃদয়ানুগ, আবেগপ্রধান, তাহা সুস্পষ্ট ধরা পড়িয়াছে বাঙালি কবির দেবস্তুতি রচনায়, …… [ বাঙালীর ইতিহাস (আদি পর্ব), পৃ. ৮৫৬]

অর্থাৎ বাঙালির ধর্মবিষয়ক রচনাতেও দৈনন্দিন জীবনের হাসিকান্না, সুখদুঃখ, প্রেমপ্রীতি এমন কি যৌন প্রসঙ্গও পর্যাপ্ত পাওয়া যায়। বরং তার দেহঘনিষ্ঠ যৌনচেতনার ছড়াছড়ি যেন একটু বেশিই।

৩.

মধ্যযুগের ধর্মবিষয়ক রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পৌরাণিক পাঞ্জালী, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন প্রভৃতি। পনের ষোল শতকের কবিগণ এসব রচনার স্রষ্টা। পৌরাণিক পাঞ্চালীর প্রাচীনতম কবিদের রচনা সম্পর্কে সুকুমার সেনের মন্তব্য :

পুরানো বাঙ্গলা সাহিত্য ত্রিধারায় প্রবাহিত। প্রথম গীতিকবিতা, দ্বিতীয় পৌরাণিক গেয় অথবা পাঠ্য আখ্যায়িকা, তৃতীয় অ-পৌরাণিক গেয় কবিতা-আখ্যায়িকা। শেষ দুই ধারার রচনার রূপ বা ফর্ম প্রায় একই রকম এবং সে ফর্মের নামও এক, “পাঞ্চালী”। দেবতার আখ্যানময় পাঞ্চালী কাব্যের নামে নায়ক-দেবতার নামের পরে “মঙ্গল “ কথাটি যুক্ত থাকে (কখনও কখনও “বিজয়” ক্বচিৎ “মঙ্গল” ও “বিজয়” দুটিই)। এই জন্য এগুলির এখন নাম দাঁড়াইয়াছে “মঙ্গল” কাব্য। মঙ্গল শব্দটির অর্থ গৃহকল্যাণ। অতএব বোঝা যাইতেছে যে গোড়ার দিকে এই আখ্যায়িকাগুলি গার্হস্থ্য-কর্মের (অথবা ব্রতের) সঙ্গে যুক্ত ছিল। প্রাচীন কবিরাও তাই অনেকে নিজেদের রচনাকে “ব্রতগীত” বলিয়াছেন।

[বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খন্ড, পৃ. ১০৩]

আমরা পনের শতকপূর্ব বাংলা সাহিত্যের চর্যাগীতি, রাজসভার গীতিকবিতা, ব্রজবুলি গীতিকবিতা প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা করব না। সে-ভাষা অস্পষ্ট, বাংলা বলে সনাক্ত করাই কঠিন। পনের শতক নাগাদ বাংলা ভাষার একটা আদল তৈরি হয়ে যায়। পনের শতকের শ্রেষ্ঠ কবি কৃত্তিবাস ওঝা (জন্ম ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে) বঙ্গের প্রাচীনতম প্রধান কবিদের অন্যতম। দীর্ঘকাল হাতে হাতে লিখে প্রচারিত তাঁর রামায়ন-কাব্য এক পর্যায়ে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশন প্রেস থেকে ১৮০২-৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। পরে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৩০-৩৪ অব্দে। কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’ কাব্য এক সময় শুধু হিন্দুগণ নয় সব ধর্মের পাঠক- শ্রোতাকেই আপ্লুত করত। শ্রীরামপুর সংস্করণে যে ভাষা আমরা দেখি তা যথেষ্ট প্রাঞ্জল। যেমন-

রাজভোগ সুগ্রীব রাজা দিনে ২ জ্ঞান
রাত্রি দিন রঘুনাথের সীতারে ধেয়ান।
সোনার খাটে শোয়া সুগ্রীব তাহে নেত্রের তুলি
সীতা লাগি কান্দেন রাম লোটাইয়া ধূলি।
বাছের বাছের সুন্দরী সুগ্রীবের অভিলাষ
সীতা লাগি কান্দেন রাম বরিষা চারি মাস।
কান্দিতে ২ রাম হইল কাতর
ক্ষণে ক্ষণে লক্ষণ দেন প্রবোধ উত্তর।

‘বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থ গুণরাজ খানের ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যের ভাগবত অনুসারেই কৃষ্ণলীলা বর্ণিত হয়েছে। লেখক গৌড়েশ্বর সুলতান রুকন উদ্দিন বরবাক শাহ-এর আমলে (১৪৫৯-৭৪ খ্রিস্টাব্দ) কাব্যচর্চা করেন। ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ কাব্যের ভাষাও অস্পষ্ট নয় অতি চমৎকার। যেমন-

জল জন্তু স্থল জন্তু সুন্দর রূপ ধরে
বৈষ্ণব শরীর যেন সেবিয়া হরিরে।
বরিষার ধারা পাইয়া গিরি স্নিগ্ধ হইল
হরি সেবি লোক সব চৈতন্য পাইল।

অর্থাৎ জল ও স্থলের প্রাণীকূল যেমন বর্ষার জলে স্নাত হয়ে সুন্দর রূপ ধারণ করে, পাহাড়-পর্বত যেমন শ্যামল-স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে, তেমনি হরিসেবায় ভক্তের শরীরে কান্তি আসে।

বিভিন্ন উপমা ও মেটাফোরের মাধ্যমে গুণরাজ খান তাঁর কবিতায় ভারতীয় অধ্যাত্মচিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ঈশ্বর-ভক্তিমূলক রচনা হিসেবে এই কাব্য অসাধারণ। যেমন-

সবাতে আছয়ে হরি এমন ভাবিহ।
আপনা হইতে ভিন্ন কারে না দেখিহ।
নিজ আত্মা পর আত্মা যেই তারে জানে।
তার চিত্তে কভু নাহি ছাড়া নারায়ণে।
কর্ণধার বিনে যেন নৌকা নাহি যায়।
তেমনি প্রভুর মায়া সংসারে ভ্রমায়।
ইহা বুঝি পণ্ডিত ভাই স্থির কর মন।
একভাবে চিন্ত প্ৰভু কমল লোচন।

তাঁর কবিতায় শুধু ভক্তি নয় মানবতাবাদী দার্শনিক চিন্তাও উচ্চারিত হয়েছে।

৪.

তের শতকের শুরুতে বঙ্গের অংশবিশেষে তুর্কী মুসলমানদের শাসনকালের সূচনা। বহিরাগত এই শাসকদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, আচার-আচারণ এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। নির্বাচিত-নিপীড়িত বৌদ্ধ জনগণ প্রকাশ্যে না হলেও মনে মনে স্বাগত জানায় মুসলমান শাসকদের এবং এই শাসনকে সামাজিক মুক্তির দরোজা বলে তাদের কাছে বোধ হয়ে থাকবে।

যুগ যুগ ধরে শাসকশ্রেণীর আশীর্বাদধন্য উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বিদেশী শাসনকে তাদের ভাগ্যবিপর্যয় বলে মেনে নিয়ে তাকে ‘দেবতার মার’ বলে সান্ত্বনা লাভ করেন। শাসকদের সংস্কৃতি ধর্ম প্রভৃতির প্রভাব থেকে ন্যায়-স্মৃতিশাস্ত্রবিশারদ আর্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ সনাতন সমাজকে রক্ষার জন্য প্রতিরোধ যেমন গড়ে তোলেন তেমনি নবযুগপন্থী ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধীগণের বিদ্রোহও সমান্তরাল গতিতে চলে।

যে কোনো দেশ যখন কোনো বহিরাগত শাসকের অধীনে যায় তখন সেখানে নতুন শাসকদের নব প্রবর্তিত শাসনপদ্ধতির সঙ্গে শাসকদের সংস্কৃতি ও ধর্মও যায় (যেমন ইরাক দখলের পর এখন সেখানে আমেরিকানদের ভাষা ধর্ম সংস্কৃতি প্রভৃতি যাবে)। তুর্কী শাসকদের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম ধর্ম ও ইসলামি সংস্কৃতিও এখানে আসে। ইসলামি দর্শন এ দেশের মানুষের চিন্তাধারায় প্রভাব বিস্তার করে। শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী অনাচার, অবিচার, বৈষম্যে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা, মুসলমানদের আগমনে স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেলে থাকবে। ইসলামের একেশ্বরবাদ, স্রষ্টার কাছে সকল মানুষ সমান— এই ধর্মীয় ও সামাজিক দর্শন এবং মুসলিম সুফি সাধকদের অবৈষম্যমূলক নির্মল জীবনাচরণ ও তাঁদের মানবতাবাদী শিক্ষা সাধারণ মানুষকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। তারা যে দলে দলে ধর্মান্তরিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুধু ইসলাম গ্রহণ করেন তাই নয় নতুন চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও সঞ্জীবিত হয়ে এক নতুন যুগের সূচনায় ব্রতী হন। ব্রাহ্মণ্যবাদের কঠোর-নিষ্ঠুর ও চরম বৈষম্যমূলক রীতিনীতি, সংস্কার, আচার-আচরণ ও দর্শনের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তবে সেই বিদ্রোহ যে তাৎক্ষণিক বিস্ফোরণের আকারে ছিল তা নয় যুগ যুগ ধরে ধীরে ধীরে সংগঠিত হয়। এ সম্পর্কে একজন মধ্যযুগের সাহিত্য-সংস্কৃতিবিশেষজ্ঞ বলেন :

যে কোনো চিন্তা-চেতনা-দ্রোহ-আন্দোলন সমাজক্ষেত্রে প্রকটিত ও ফলপ্রসূ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। বাঙলায়ও তাই হয়েছিল। তের শতকে উপ্ত ও অঙ্কুরিত এবং চৌদ্দ শতকে বর্ধিত ও পল্লবিত হয়ে পনের ষোল শতকে তা ফলপ্রসূ হল। লৌকিক দেবতার জনপ্রিয়তায়, লোকায়ত লোকধর্মের প্রসারে ও গীতা-স্মৃতি-সংহিতার প্রভাব-সংকোচনে এ বিপ্লবের প্রকাশ ও ক্রমস্ফীতি লক্ষণীয়।

[বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য, আহমদ শরীফ, পৃ. ৩১১]

ষোল শতকের বাংলার ধর্মীয় ও সমাজজীবনে যে নব জাগরণের সূচনা হয় তার নায়ক ছিলেন শ্রীচৈতন্য। তাঁর আবির্ভাব বাঙালির জীবনে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। চৈতন্যের জন্ম ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর শিষ্য ও শিষ্যের শিষ্যদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর জীবনচরিত লেখেন। চৈতন্যদেবের শিষ্য ধনঞ্জয় পণ্ডিতের শিষ্য চূড়ামণি দাস যে জীবনী খানি প্রণয়ন করেন তার নাম ‘গৌরাঙ্গবিজয়’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখের অনুমান এই জীবনী ‘আনুমানিক ১৫৪২-৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত। চৈতন্যের জন্মগ্রহণের পরে বৌদ্ধশাস্ত্রবিশেষজ্ঞ, মীমাংসাশাস্ত্রে পণ্ডিত, বৈদান্তিক সকল শ্রেণীর মানুষ যে আনন্দ প্রকাশ করে সে-কথা বর্ণনা করে চূড়ামণি দাস লিখেছেন :

বৌদ্ধ তার্কিক মৈমাংসিক বৈদান্তিক।
সভাকার নাটে কহে ইবে দেখি ধিক ॥
সব লোক নাচে কান্দে করে কিবা কাজ।
ভাল লোক নাচে কান্দে না বাসএ লাজ ॥
হোর দেখ অধ্যাপক অদ্বৈত আচাৰ্য্য।
নাচিয়া কান্দিয়া ওবা সাধে কোন কাৰ্য্য ॥
তর্কবাদীন্দ্ৰ সিদ্ধানন্দ ভট্টাচাৰ্য্য।
এ দিগবিজয়ী কবি পূজে সর্ব্বরাজ্য ॥

[গৌরাঙ্গবিজয়, চূড়ামণি দাস, সুকুমার সেন সম্পাদিত, ১৯৫৭, পৃ. ১৪-১৫

আশৈশব চৈতন্য ছিলেন ধর্মপ্রাণ। তাঁর ১৬/১৭ বছর বয়সে একদিন সেকালের বিশিষ্ট বৈষ্ণব শ্রীনিবাস পণ্ডিতের ধারণা হলো যে চৈতন্য একজন বৈষ্ণববিদ্বেষী। একদিন শ্রীনিবাস পণ্ডিত গঙ্গাস্নানে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ওই পথে চৈতন্যকে দেখে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন। এই ঘটনা চৈতন্যের মনে দাগ কাটে। কিন্তু তা তাঁর জীবনের মোড়ও ফিরিয়ে দেয়। তিনি সিদ্ধান্ত যেন সাধনা দ্বারা তিনি এমন বৈষ্ণব হবেন যার তুলনা আর কেউ থাকবে না। তখন তাঁর ‘বিদ্বেষী’-রাও তাঁর ‘গুণকীর্তি’ করতে বাধ্য হবেন। চৈতন্যচরিতামৃত-তে কবি চৈতন্যের জবানীতে বলিয়েছেন,

এমন বৈষ্ণব মুই হইনু সংসারে।
অজ ভব আসিবেক আমার দুয়ারে ॥
শুন ভাইসব এই আমার বচন।
বৈষ্ণব হইব মুই সৰ্ব বিলক্ষণ ॥
আমাকে দেখিয়া সে যে সকলে পলায়।
তাহারাও যেন মোর গুণকীর্তি গায়।

একজন মহামানবের জীবনেতিহাস অতি প্রাঞ্চল ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। চৈতন্যভাগবত-এর ভাষাও অতি সহজবোধ্য। চৈতন্যদেবের জীবনের ছোটখাট ঘটনাবলি তা পাঠকের কাছে ঋজু ভাষায় পরিবেশন করে। কৃষ্ণের বিরহেই যে তিনি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন তা তিনি কথাপ্রসঙ্গে বঙ্গে নব্যন্যায়-এর প্রবর্তক দার্শনিক বাসুদেব সার্বভৌম (১৪২০/৩০-১৫৪০)-কে জানান। সার্বভৌমের সঙ্গে চৈতন্যদেবের প্রথম সাক্ষাৎ হয় পুরীতে। তখন চৈতন্য সন্ন্যাসীবেশ পরিহিত ও মুণ্ডিতমস্তক। সার্বভৌমের উক্তি-

পরম সুবুদ্ধি তুমি হইয়া আপনে।
তবে তুমি সন্ন্যাস করিলা কি কারণে?

শ্রীচৈতন্যের জবাব-

প্রভু বোলে শুন সার্বভৌম মহাশয়।
‘সন্ন্যাসী’ আমারে নাহি জানিহ নিশ্চয় ॥
কৃষ্ণের বিরহে মুঞি বিক্ষিপ্ত হইয়া।
বাহিরে হইলু শিখাসূত্র মুড়াইয়া ॥
‘সন্ন্যাস’ করিয়া জ্ঞান ছাড় মোর প্রতি।
কৃপা কর যেন মোর কৃষ্ণের হয় মতি ॥

[চৈতন্য ভাগবত, অন্ত খণ্ড, তৃতীয় অধ্যায়]

চৈতন্যদেবের জীবন, শিক্ষা ও দর্শন সম্পর্কে ষোল শতকে রচিত কবিরাজ গোস্বামীর ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’, জয়ানন্দের ‘চৈতন্যভাগবত’ প্রভৃতি বাঙালির জীবনকে শুধু আলোকিত করেনি, তাকে শুধু নতুন দর্শনই উপহার দেয়নি, তাকে নতুন আধ্যাত্মিক শিক্ষাই দান করেনি, তাকে দিয়েছে নতুন এক সৃষ্টিশীল সাহিত্য সম্পদ। বাঙালিকে বৈষ্ণবীয় ঈশ্বরতত্ত্বে উদ্বুদ্ধ করেছে। যেমন –

অনুমান প্রমাণ নহে ঈশ্বর-তত্ত্ব-জ্ঞানে।
কৃপা বিনা ঈশ্বরের কেহ নাহি জানে।
ঈশ্বরের কৃপালেশ হয়ত যাহারে।
সেই ত ঈশ্বর তত্ত্ব জানিবারে পারে ॥

৫.

বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব সাহিত্য বা পদাবলী অমূল্য সম্পদ। বৈষ্ণব পদাবলী একই সঙ্গে যেমন নরনারীর প্রেমবিষয়ক সাহিত্যকর্ম তেমনি তা ঈশ্বরপ্রেমবিষয়ক রচনাও বটে অর্থাৎ তার মধ্যে ধর্মীয় উপাদান উপস্থিত। পনের শতক থেকে আঠার শতক পর্যন্ত চার শ বছর বাংলার বৈষ্ণব কবিগণ তাঁদের কাব্য সাধনা অব্যাহত রাখেন। বহু সংখ্যক বৈষ্ণব কবি ও তাঁদের রচিত পদাবলী আজ হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। শুধু বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস (বড়ু, দ্বিজ প্রভৃতি), জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাস প্রমুখ কয়েকজন কবির অমূল্য শিল্পগুণসম্পন্ন রচনা আজও টিকে আছে। টিকেই নয় প্রতিদিনই পঠিত হয় শুধু শিক্ষার্থীদের দ্বারা নয় সাধারণ পাঠকদের দ্বারাও। সেগুলোর বিষয়বস্তু ও রসের কারণে তা চিরকাল টিকে থাকবে। কারণ ওই গান শুধু দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত নয়, মানব-মানবীর জন্যেও। তাই রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেছেন :

শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান!
পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান-অভিমান,
অভিসার, প্রেমলীলা, বিরহ-মিলন,
বৃন্দাবনগাথা — এই প্ৰণয়স্বপন
শ্রাবণের শর্বরীতে কালিন্দীর কূলে,
চারি চক্ষে চেয়ে দেখা কদম্বের মূলে
শরমে সম্ভ্রমে, এ কি শুধু দেবতার!
এ সংগীতরসধারা নহে মিটাবার
দীন মর্ত্যবাসী এই নরনারীদের
প্রতি রজনীর আর প্রতি দিবসের
তপ্ত প্ৰেমতৃষা!

বৈষ্ণব কবিদের রচনায় রাধাকৃষ্ণের প্রেমের বিচিত্র অনুভূতি থেকেই দেবতার চরণে অর্ঘ্য হিসেবে নিবেদিত হোক না কেন তাতে নরনারীর দেহঘনিষ্ঠ প্রেমেরই প্রকাশ ঘটেছে। সহজিয়াপন্থী গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শনের প্রবক্তারা যে পিরীতি-সাধনা’ করেছেন তা নরনারীরই চিরন্তন প্রেম। যেমন চন্ডীদাস বলছেন :

সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ
না জানি কতেক মধু শ্যাম নামে আছে গো
বদন ছাড়িতে নাহি পারে।
জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে ॥
নাম পরতাপে যার ঐ ছন করিল গো
অঙ্গের পরশে কিবা হয়।
যেখানে বসতি তার নয়নে দেখিয়া গো
যুবতী ধরম কৈছে রয়।।
পাশরিতে করি মনে পাশরা না যায় গো
কি করিব কি হবে উপায়।
কহে দ্বিজ চন্দিদাস কুলবতী কুলনাশে
আপনার যৌবন যাচায়!

জ্ঞানদাস আরো স্পষ্ট করে আরো সুন্দর ভাষায় বলছেন :

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর ॥
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে ॥

জ্ঞানদাস ও প্রেম-প্রতপ্ত নর-নারীর অন্তরের বিরহের কথাই বলেছেন কাব্যগুণমণ্ডিত ভাষায় :

এঘোর রজনী মেঘ গরজনি
কেমনে আওব পিয়া।
শেজ বিছাইয়া রহিলূঁ বসিয়া
পথ পানে নিরখিয়া ॥
সই, কি করব কহ মোরে।
এতহু বিপদ তরিয়া আইল
নব অনুরাগ ভরে।
এহেন রজনী কেমনে গোঙাব
বন্ধুর দরশ বিনে।
বিফল হৈল সব মনোরথ
প্রাণ করে উচাটনে।
দহয়ে দামিনী ঘন ঘন ধ্বনি
পরাণ মাঝারে হানে।।

এর মধ্যে ধর্মকর্মের কথা কোথায়? ধর্মের বা শাস্ত্রের কঠোর বাণী কোথায়? নরনারীর চিরন্তন হৃদয়াবেগই প্রকাশিত হয়েছে। তবে আধ্যাত্মিক আকুতিও প্রকাশ পায় কোনো কোনো পদাবলীতে। যেমন বিদ্যাপতি বলছেন :

গগণে গরজে ঘন ফুকরে ময়ুর।
একলি মন্দিরে হাম পিয়া মধুপুর ॥
শুন সখি হামারি বেদন।
বড় দুঃখ দিল দারুন মদন ॥
… … …
হরি গেল মধুপুরি হাম একাকিনী।
ঝুলিয়া ঝুরিয়া মরি দিবসরজনী
নিঁদ নাহি আওয়ে শয়ন নাহি ভায়।

বৈষ্ণব ধর্মের মূল্য বাণী ‘প্রেম’ ও ‘সমর্পন’ এই সব পদাবলীতে প্রচারিত হয়েছে বটে, এর আধ্যাত্মিক দিক বাদ দিলেও বাংলা সাহিত্যের বিবর্তন ও বিকাশে এই সব পদাবলীর ভূমিকা অপরিমেয়। সহজিয়া সম্প্রদায়ের সতের শতকের কবি অকিঞ্চন দাস তাঁর ‘বিবর্ত বিলাস’-এ যে ভাষায় লিখেছেন তার দৃষ্টান্ত :

শ্রীরূপ করিলা সাধনা মীরার সহিতে
ভট্ট রঘুনাথ কৈলা কর্ণবাই সা’থে ॥
লক্ষ্মহীরা সনে করিলা গোঁসাই সনাতন।
মহামন্ত্র প্রেমে সেবা সদা আচরণ।
গোসাঞি লোকনাথ চন্ডালিনী কন্যা সঙ্গে।
দোহা জন অনুরাগ প্রেমের তরঙ্গে ॥
গোয়ালিনী পিঙ্গলা সে ব্ৰজদেবী সম।
গোসাঞি কৃষ্ণদাস সদাই আচরণ ॥
শ্যামা নাপিতানীর সঙ্গে শ্রীজীব গোঁসাই।
পরম সে ভাব কৈলা যার সীমা নাই ॥
রঘুনাথ গোস্বামী পীরিতি উল্লাসে।
মীরাবাঈ সঙ্গে তেহ রাধাকুন্ডে বসে ॥
গৌরপ্রিয়া সঙ্গে গোপাল ভট্ট গোঁসাই।
করয়ে সাধন অন্য কিছু নাই ॥

৬.

প্রধান ধর্মব্যবস্থাগুলির বাইরে উপমহাদেশে তথা বাঙালিসমাজে নানা ধরনের দেবতার প্রচলন ছিল যাঁরা সমাজের এক-একটি অংশের পূজার পাত্র ছিলেন। তাঁদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এক-একটি সম্প্রদায়। যেমন বৃক্ষ পূজা, সাপ পূজা অতি প্ৰাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চলে প্রচলিত ছিলো। যেমন—

বৈদিক চিন্তার পরিণতিতে বাস্তুদেবতার দুইটি প্রতীক দাঁড়াইয়া গিয়াছিল। এক. বৃক্ষ অথবা স্থানু। দুই. নাগ (অর্থাৎ সাপ)। স্থানুর দুই পরিণতি চৈত্য এবং শিবলিঙ্গ। বৃক্ষ পূজার পরিণতি বিচিত্র- বট, অশ্বত্থ, বিল্ব, সিজ অথবা তুলসী। [ বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, সুকুমার সেন, পৃ. ২২২]

পশ্চিমবঙ্গে ততটা নয় কিন্তু পূর্ব বাংলায় ব্রত-অনুষ্ঠানরূপে মনসাপূজা প্রচলিত ছিল প্রাচীনকাল থেকে। এ অঞ্চলের কবিগায়কগণ মধ্যযুগে পালাগানের আসর জমিয়ে মনসামঙ্গল বা বেহুলা-লক্ষিন্দরের কাহিনী শ্রোতাদের শুনিয়ে মুগ্ধ করতেন। সেইসব কবিতার ভাষাও যথেষ্ট প্রাঞ্জল। স্বামী লক্ষিন্দরকে নিয়ে বেহুলা শ্বশুরবাড়িতে যাবার আগে যোগী-যোগিনীর ছদ্মবেশে একবার বাপের বাড়ি যাচ্ছে। কবির ভাষায় –

চৌদ্দ ডিঙ্গা ঘাটে থুইয়া যোগী-যোগিনী হৈয়া
চলিল বেহুলা লক্ষিন্দর,
রূপ জিনি তিলোত্তমা রক্ত বস্ত্র পরি রামা
আচ্ছাদিত অঙ্গ মনোহর।
গলায় রুদ্রাক্ষমালা স্কন্ধে ঝুলি হাতে তালা
লখিন্দর চলে তার আগে
বেহুলা যায় পিছু পিছু লজ্জায় না বলে কিছু
মায়ারূপে দোহে ভিক্ষা মাগে।

সতের-আঠার শতকের আর একটি ‘মনসামঙ্গল’ বাক্যের ভাষা এ রকম :

পুত্রবর পাঞা আইসে মনসাকুমারী।
মনভাবে গর্ভে ধরে দেবী বিষহরি!
তার কত দিনে জন্ম লভিল কুমার।
আস্তিক তাহার নাম বিষ্ণু অবতার।
এইরূপে আস্তিকের হইল জনম।
বাপের চরণে পদ্ম লইল শরণ ॥
আমারে ছাড়িয়া মুণি গেলেন চলিঞা।
পৃথিবীতে রহিলাম আমি অপূজ্য হইঞা ॥
আশ্বাস দিলেন তারে দেব ত্রিলোচন।
তোমার পূজা মর্ত্যেতে করিবে জগজন ॥

সতের শতকের আরো বহু দেবদেবীর উদ্দেশ্যে মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। কৃষ্ণরায় দাস ১৭৫২ সালে রচিত তাঁর ‘কালিকামঙ্গল’ কাব্যে লিখেছেন :

দক্ষযজ্ঞভঙ্গ-কথা প্রথম রচহ গাঁথা
পুরাণ প্রমাণি এ সকল।
জন্ম হিমালয় গিরি কামদেব ভষ্ম করি
বিবাহ করিল পুণ হর।
তারকের গুণ নাশে সুলোচন বুঝে রোষে
তাহারে বধিলা পুরন্দর।
তারাবতী তার প্রিয়া সেবিয়া পাইল বর
কৈলা মোর চরিত্র সকল
নারদ তথায় গিয়া পশ্চাৎ হইল নর
বিদ্যা আর সুন্দর ভূতল।

সতের শতকের আর এক ‘মানসা-মঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা দ্বিজবংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতী রচনা করেন ‘দস্যু কেনারামের পালা’। দস্যু কেনারাম দ্বিজ বংশীদাসের মুখে ‘মানসা ভাসান’ শুনে দস্যুবৃত্তি ত্যাগ করে নৈতিক জীবনে ফিরে আসে। সে ডাকাতি করা ছেড়ে দেয়। কেনারাম ও দ্বিজ বংশীর মধ্যে যে কথোপকথন হয় তাতে সে-কালের সমাজচিত্রটিও পাওয়া যায় :

“না দেখে মানুষজন বনের পশুপাখী।
যার ধন তার কাছে লুকাইয়া রাখি ॥”

“কার ধন কার কাছে রাখ লুকাইয়া।
অবাক্যি হইলা ঠাকুর একথা শুনিয়া ॥”

“কেনা কহে এই ধন সকলি মাটির।
মাটিতে লুকাইয়া রাখি যুক্তি করি স্থির।
মাটিতে মিশিয়া ধন যাউক মাটি হইয়া।
মানুষ যে নাহি পায় সে ধন খুঁজিয়া।।
ভাবিয়া দেখহ ঠাকুর যত টাকা কড়ি।
কেবলি লোভের চিহ্ন জগতের বৈরি ॥”

“ঠাকুর বলেন কহ কি লাভ তাহায়।
ধন লইয়া কোন্ জন মাটিতে লুকায় ॥
ভোগ নাহি কর ধন রাখ লুকাইয়া।
এ ধনে কি ফল আছে অর্জন করিয়া ॥”

“কেনারাম বলে ঠাকুর ভোগের লাগিয়া।
ধন নাহি লই আমি পথিকে ভারাইয়া ॥
দেশে যত ধনী আছে তাহাদের ধনে।
ভিক্ষুক লোকের আসে কোন প্রয়োজনে ॥
থাকিয়া ভান্ডারের ধন ভান্ডারেতে ক্ষয়।
এ ধনেতে সংসারের কোন্ কার্য হয় ॥”

এই নীতিকথামূলক কাব্যের বিষয়বস্তু আমাদের বিবেচ্য নয়, এর সহজ-সরল ভাষা মধ্যযুগের বাঙালির প্রতিদিনের ভাষার দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এ ভাষার সঙ্গে আধুনিক ভাষার বিশেষ দূরত্ব কোথায়? এ ভাষায় ভাল গদ্য লেখাও যেতো।

৭.

মধ্যযুগে বহু মুসলমান কবি শরিয়তি ইসলাম ও লোকায়তিক ইসলাম বিষয়ে নানা উপাখ্যান-কাব্য রচনা করেছেন। আহমদ শরীফের মতে,

ধর্ম-সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাঙলার মুসলমানও উদাসীন ছিলেন না। তাঁরা জনগণকে ধর্মবুদ্ধি দানের জন্য নানাভাবে চেষ্টা-যত্ন করেছেন। রসুলচরিত, নবীকাহিনী, ইসলামের উদ্ভবযুগের বীর-বৃত্তান্ত – শরিয়ৎশাস্ত্র, মারফত তত্ত্ব, পীর-পাঁচালী প্রভৃতি রচনা করে তারা ইসলাম প্রচারে গৌরব, স্বধর্মের প্রসারগর্ব এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ববোধ গণমনে জিইয়ে রাখবার প্রয়াস পেয়েছেন।

[ বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য, পৃ. ৬০১]

চট্টগ্রামের অধিবাসী সৈয়দ সুলতান সতের শতকে বেশ কিছু ধৰ্মমূলক কাব্য রচনা করেন। তাঁর ‘জ্ঞানপ্রদীপ’ তান্ত্রিক যোগবিষয়ক রচনা। ‘নবীবংশ’ তাঁর স্মরণীয় কীর্তি। এতে সৃষ্টি তত্ত্ব, পয়গম্বরদের আবির্ভাব প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে। ‘নবীবংশ’ রচনা সম্পর্কে কবির নিজের ভাষ্য :

যে রূপে সৃজন হইল এ তিন ভূবন
যে রূপে সৃজিল জান সুরাসুর গণ।
যে রূপে আদম হাওয়া সৃজন হৈল
যে রূপে যথেক পয়গাম্বর উপজিল।
বঙ্গেতে এসব কথা কেহ না জানিল
নবীবংশ পাঞ্জালীতে সকল কহিল।
মুঞি পাপী এ সকল প্রচার করিলুঁ
তোহ্মরা সবের লাগি দর্পণ সৃজিলুঁ।
এ দর্পণ দর্শিনে খন্ডিব যথ ধন্ধ
নিরক্ষিলে দর্পণ জানিবা ভাল মন্দ।

হযরত মোহাম্মদ (সা:) মৃত্যুর আগে তাঁর উম্মতদের উদ্দেশ্যে যেসব উপদেশ দেন এবং প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে যা বলেন-

তোহ্মরা সমাজ হোন্তে যাইতে আছি আহ্মি
কেহ কার অপচয় না করিবা তুহ্মি।
বিধবা সবেরে তুহ্মি করিবা আদর
পড়শীরে না বুলিবা কঠোর উত্তর।
পিতাহীন শিশুরে গৌরব অতি করি
পালন করিঅ সবে মনে মায়া ধরি।
বাপের মায়ের বোল না কর লঙ্ঘন
দোজাহানের পরিচর্যা করিবা সমন।
পরচর্চা পরিনিন্দা মিথ্যা না কহিঅ
পরধন পরনারী কভু না হেরিঅ।
রতি ভুঞ্জি গোসল করিঅ সেইক্ষণ
মালের জাকাত দিতে না হইঅ বিমন।
পঞ্চওক্ত তুহ্মি সবে নামাজ গুজারি
আল্লার সেবাত মন দিবা যত্ন করি।
কলেমা কহিঅ নিত্য রোজা একমাস
দাঢ়াইছে জিব্রিলে আসি মোর পাশ।

‘জ্ঞান-প্রদীপ’-এ স্মরণীয় আধ্যাত্মিক কথা ও সুফিবাদী সাধনতত্ত্ব সাবলীল ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে। যেমন-

১. নাহি তার আদি অন্ত নাহি মাতা পিতা
আপন সে নিরাকার আছে সৃষ্টিকর্তা।

২, সূক্ষ্ম, স্থুল নহে সৰ্ব্ব ব্যাপিত যে আছে।
অজয়, অমর সে যে সবানক বাঞ্ছে ॥

৩. হুতাশনে তপ্ত প্ৰভু জলেতে শীতল।
জ্যোতিকাতে স্থির প্রভু পবনে চঞ্চল ॥

ভারতচন্দ্র রায় (১৭১২-১৭৬০) আঠার শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘মঙ্গল-কাব্য’ রচয়িতা কবি। তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

রাজসভা কবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল গান রাজকণ্ঠে মনিমালার মত, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা, তেমনি তাহার কারুকার্য।

তিনি ছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি। বাংলা, সংস্কৃত, ফারসিসহ বহু ভাষায় ছিল তাঁর পাণ্ডিত্য, অথচ তাঁর কবিতার ভাষা অতি প্রাঞ্জল; তবে আমরা যে ধরনের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়ক রচনা নিয়ে আলোচনা করছি তেমন রচনা তাঁর সামান্য।

আঠার শতকের গীতিকবি রামপ্রসাদ সেন (১৭২০-১৭৮১) ভগবৎ সাধনায় বস্তুত সারাজীবনই ব্যয় করেন। তাঁর ভক্তিপূর্ণ সঙ্গীতসমূহ, যা ‘রামপ্রসাদী’ সঙ্গীত নামে জনপ্রিয়, বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ওগুলো ধর্মীয় রচনা না হলেও তার কাছাকাছি। তাঁর গানের ভাব ও ভাষা দুইই প্রাঞ্জল। যেমন সুরাপান বিষয়ক তাঁর একটি গানের ভাষা :

সুরাপান করিনে আমি, সুধা খাইরে কুতূহলে,
আমার মন-মাতালে মেতেছে আজ,
মদ-মাতালে মাতাল বলে।

খ্রিস্টান শাসকদের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টান মিশনারিরাও তাঁদের প্রচার কাজ চালিয়ে যান। শাসকদের থেকে তাঁরা পান পৃষ্ঠপোষকতা। ভারতের পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে তাঁরা পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এ দেশীয় ধর্মসমূহের চেয়ে যে খ্রিস্টান ধর্ম ভালো সেটা প্রমাণের জন্য মিশনারিরা এ জাতীয় রচনা প্রকাশ করেন, তবে তাতে বাংলা ভাষার গদ্যচর্চার দরোজা খুলতে থাকে। যেমন দোম আন্তোনিও রচিত ‘ব্রাহ্মণ-রোমান-ক্যাথলিক সংবাদ’-এর ভাষা—

রামের এক স্ত্রী, তাহার নাম সীতা, আর দুই পুত্রো লব আর কুশ তাহান ভাই লকোণ, রাজা অযোধ্যা বাপের সত্যো পালিতে বোনবাসী হইয়াছিলেন, তাহাতে তাহান স্ত্রীরে রাবোণে ধরিয়া লিয়াছিলেন, তাহার নাম সীতা, সেই স্ত্রীরে লঙ্কাত থাক্যা আনিতে বিস্তর যুর্দো করিলেন, বালিরে মারি তাহার স্ত্রী তারা সুসীবেরে দিলেন, সে বালির ভাই, তাহারে রাজখণ্ড দিলেন, বিস্তর রাখ্যোস বধ করিলেন, কুর্মোকর্ণো বধিলেন, ইন্দ্রোজিৎ বধিলেন, প্রছাতে রাবোণ বধিয়া সীতারে আনিলেন, রাবোণের স্ত্রীরে রাবোণের ছোটো ভাই বিবীষোণেরে দিলেন, তাহার নাম মোন্ধোদরী, তাহারে রাম বর দিয়াছিলেন, কহিয়াছিলেন, তুমি জর্মো আইয়োস্তী হও, এ কারোণ বিবীষোণেরে দিলাম, যেমনি (?) করিয়া রাবোণ বধ হইয়াছে, তাহারে আর জিয়াইতে না পারিলেন, তাহার অন্যো ও সীতা যে নিতে কহিলেন, তাহার পর সীতারে আনিয়ো বিস্তর পরীক্ষা দিলেন, যে রাবোণ নি এহারে পরোশ করিয়াছে। তাহাতে পরীক্ষাতে সীতা সাঁচা হইলেন, ততাচো রামে তাহানে প্রতএ নহিলো, আর রামের দুই পুত্রো লব আর কুশ সংগে রামের বিস্তার ষুর্ধ করিলেন পুত্রো না চিনিয়া, শেষ মুনিষ্যে পরাজএ করিয়া দিলো, প্রচাতে সকলে প্ৰত্তো হইলো, শেষ রাজখন্ডো অযোদ্যাতে করিলেন, প্রচাতে তাহান পরোলোক হইলো। তাহার আত্তাম্ পরমেশরেতে মিশিলো গিয়া।

(রামের কাহিনী, ব্রাহ্মণ-রোমান-ক্যাথলিক সংবাদ, দোম আন্তোনিও, সুরেন্দ্রেনাথ সেন সম্পাদিত, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৭, পৃ. ৩৭)

স্বাভাবিক কারণেই মধ্যযুগে বাঙালি ভাষা-সচেতন ছিল না। তাই উনিশ শতকের আগে বাংলা ভাষার বানানরীতিতে বা বাক্য-গঠনে কোনো শৃঙ্খলা ছিলো না। বাংলা বর্ণমালা ও বানান সংস্কার হচ্ছে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে। মুদ্রণশিল্পের সূচনাও তখন থেকে। প্রথমে ধাতুতে ঢালাই যন্ত্রে বাংলা অক্ষর তৈরি হতো, তারপর তা হতো মুদ্রাযন্ত্র মুদ্রিত। সুস্থিত ও সর্বসম্মত মান-ভাষা স্থির হয়েছে উনিশ শতকেই। শব্দ, বানান, বাক্য, যতিচিহ্ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে মোটের উপর একটি শৃঙ্খলা আসে আধুনিক কালেই। বাংলা ভাষায় সব ধরনের শব্দই রয়েছে- তদ্ভব, তৎসম, বিদেশী এবং গ্রাম্য আঞ্চলিক কথ্য।

মধ্যযুগের রচনায় যতিচিহ্ন বলতে দাড়ি ও দুই-দাড়ি ব্যবহৃত হতো, কমা- সেমিকোলন প্রভৃতি ইংরেজি ভাষা থেকে গৃহীত। উনিশ শতকের পূর্বপর্যন্ত যে বাংলা কবিতা তা মূলত পয়ারে রচিত। পয়ারের প্রথম পংক্তিতে এক-দাড়ি হিসেবে যে যতিচিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে তা অর্ধতি অর্থাৎ কমা-র কাজ করেছে এবং দ্বিতীয় পক্তিতে দুই-দাড়ি বা জোড়া-দাড়ি পূর্ণ যতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আমি, তুমি, আমরা, তোমরা প্রভৃতি সর্বনামগুলি অনেক লেখকই আহ্মি, তুহ্মি, আহ্মরা, তোহ্মরা এবং তোমাদের, তোহ্মাবার বানানে লিখেছেন। সপ্তমী বিভক্তির ‘এ’-কার যুক্ত না করে লেখা হতো— বনএ (বনে), মনএ (মনে), স্থানএ (স্থানে), ভিতরএ (ভিতরে), ঘরএ (ঘরে) প্রভৃতি। ক্রিয়াপদের রূপ ছিল নানা রকম- যেমন হৈল (হইল), করিমু (করিব) প্রভৃতি। অনুজ্ঞা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার শেষে ‘ও’ বা ‘য়া’ না লিখে ‘অ’ ‘আ’ লেখা হতো- যেমন, যাইঅ, যাইআ প্রভৃতি। উইলিয়াম কেরী, রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার (১৭৬২- ১৮১৯) প্রমুখ বাংলা ভাষাকে একেবারে সংস্কৃতায়িত করে ফেলেন আঠার শতক পর্যন্ত যা ছিল না। কেরী ছিলেন খোদ শাসকশ্রেণীর মানুষ; রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) প্রমুখ শাসকদের সহযোগী, তাঁরা যূথবদ্ধভাবে পরস্পরের সহযোগেই এই কাজটি করেন। প্রাক্-ঔপনিবেশিক যুগের মুসলিম শাসকদের রাজনীতি ও ভাষা- সংস্কৃতি সবকিছু তাঁদের কাছে অগ্রহণযোগ্য বা বর্জনীয় বোধ হয়ে থাকবে, এবং পাশ্চাত্য ও প্রাচীন ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির সংমিশ্রণে এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম দেওয়ার আগ্রহ তাঁদের মধ্যে হয়ে থাকবে প্রবলভাবে জাগ্রত। তাই ভারতের প্রাচীনতম ও পবিত্রতম ভাষা সংস্কৃত (যা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম বলে তাঁরা মনে করতেন) বেশি গুরুত্ব পায়— তৎসম ও সংস্কৃতসম শব্দ দখল করে প্রচলিত তদ্ভব ও দেশী শব্দের স্থান। নির্মিত হয় সংস্কৃতজাত বাংলা ভাষা যার প্রভাব-প্রতিপত্তি গোটা উনিশ শতকব্যাপী অক্ষুণ্ণ ছিল। আজ আমি যে ভাষায় এই বক্তৃতাটি উপস্থিত করছি তা তাঁদেরই তৈরি ভাষা। অথচ মধ্যযুগের সাহিত্যে দেখা যায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল লেখক আরবি-ফারসি ও প্রাকৃত-আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করতেন। তবে উনিশ শতকে তৈরি মান সাধু গদ্য ভাষার দুর্গে আঘাত আসে কুড়ি শতকে চলতি বাংলা ভাষা প্রচলনের মাধ্যমে। সাধু ও চলতি ভাষায় প্রধানত পার্থক্য শুধু ক্রিয়াপদে ও সর্বনামে।

তবে এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাধু ও চলতি দুটি মানভাষার ধীর গতিতে বিকাশ ও বিবর্তন ঘটতে থাকে আগে থেকেই কুড়ি শতকে এসে বিশিষ্ট লেখকদের হাতে সাধু ও চলতি রীতি অর্জন করে সুস্থিতি। বিশেষ করে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষক ও সেকালের গদ্যলেখকগণ একটি সুশৃঙ্খল ভাষারীতি প্রচলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভাষার সঙ্গে শাসকশ্রেণীর সম্পর্ক অতি গভীর। জীবনের প্রয়োজনেই ভাষা সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয় কারণ ভাষাকে নানা দায়িত্ব পালন করতে হয়। কুড়ি শতকের প্রথমার্ধ থেকেই সাধু ভাষার ব্যবহার কমে একেবারে শূন্যের কাছে নেমে আসে। আজকাল যে কোনো কোনো দৈনিক পত্রিকায় সম্পাদকীয়টি শুধু সাধু ভাষায় লেখা হয় তা নমুনা হিসেবে, অন্য প্রয়োজনে নয়। কোনো কোনো প্রাচীনপন্থী লেখক অবশ্য সারাজীবনই সাধু ভাষায় লিখেছেন এবং আজও হঠাৎ চোখে পড়ে কাউকে। তবে তাঁরা ব্যতিক্রম।

ইংরেজি সাহিত্যে গিওফ্রে চসার ( ১৩৩৭-১৪০০) যেমন তাঁর নিজের এলাকা ইংলন্ডের দক্ষিণ-পূর্ব মধ্যাঞ্চলের প্রচলিত ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন এবং শেষপর্যন্ত সেটাই আধুনিক মান ইংরেজির ভিত্তি তৈরি করে, তেমনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার কথ্য ভাষা সামান্য সংস্কার করে মান সাধু ও চলতি ভাষার মডেল তৈরি করে। প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬)-র মন্তব্য হলো ‘নদিয়া শান্তিপুর প্রভৃতি স্থানে, ভাগীরথীর উভয় কূলে এবং বর্তমান বর্ধমান ও বীরভূম জেলার পূর্ব ও দক্ষিণাংশে যে ডায়ালেট প্রচলিত ছিল, তাই কতক পরিমাণে সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে সাধু ভাষার রূপ ধারণ করেছে।’ [সাধু ভাষা বনাম চলতি ভাষা, ভারতী, চৈত্র ১৩১৯]।

ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণী ও তাঁদের বুদ্ধিজীবীদের বিচরণ ও কর্মক্ষেত্র ছিল প্রধানত ওই এলাকাটিতেই বেশি। তাই ওইসব এলাকার ভাষা তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অভিমতও তাই। তিনি বলেন, ‘কলিকাতা অঞ্চলের উচ্চারণকেই আদর্শ ধরিয়া লইতে হইবে। কারণ কলিকাতা রাজধানী। কলিকাতা সমস্ত বঙ্গভূমির সংক্ষিপ্তসার।’

[বাংলা উচ্চারণ, রবীন্দ্র-রচনাবলী, দ্বাদশ খন্ড]

রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যে শাসকশ্রেণীর অভিপ্রায় ও মনোভাবই সমর্থিত হয়েছে। যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আজ আমরা গর্ব করি, যে ভাষার কবি এশিয়ার মধ্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন, যে-ভাষায় জন্মগ্রহণ করেছেন মধূসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম সহ অগণিত শক্তিশালী কবি-সাহিত্যিক একুশ শতকে আজ আমরা যে ভাষায় লিখছি তার স্রষ্টা ফোর্ট ইউলিয়াম কলেজের মিশনারি ও তাঁদের মুন্সীগণ নন মধ্যযুগের সাহিত্যসেবক গণই। যত অশুদ্ধ, শৃঙ্খলাহীন তাঁরা হোন না কেন তাঁরাই আধুনিক বাংলা ভাষার নির্মাতা। তাদের তৈরি ভিত্তি প্রস্তরের ওপরই নির্মিত হয়েছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সুরম্য সৌধ। তাই মধ্যযুগের লেখকদের প্রতি জানাই আমাদের কৃতজ্ঞতা। *

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

বসুমতী প্রকাশিত, অন্নদামঙ্গল, ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলী

নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব), কলিকাতা, ১৩৫৯

ক্ষিতিমোহন সেন, ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯২৮

আহমদ শরীফ সম্পাদিত, বাংলার সুফী সাহিত্য, ঢাকা, ১৯৬৯

মুকুন্দরাম কবিকঙ্কণ, চন্ডীমঙ্গল কাব্য,

কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যচরিতামৃত, বসুমতী সংস্করণ

বৃন্দাবন দাস, চৈতন্যভাগবত, বসুমতী সংস্করণ জয়ানন্দ, চৈতন্যমঙ্গল, কলিকাতা

ভক্তিমাধব চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, শূন্যপুরাণ, কলিকাতা

দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় (দ্বিতীয় খণ্ড), কলিকাতা

মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, কবিকঙ্কন চন্ডী, বসুমতী সংস্করণ

মাধব আচার্য, অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী সম্পাদিত, কৃষ্ণমঙ্গল, কলিকাতা

সুকুমার সেন, বৈষ্ণবীয় নিবন্ধ, কলিকাতা

সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের গদ্য, কলিকাতা

সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড), কলিকাতা

অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (১ম, ২য় ও ৩য় খণ্ড), কলিকাতা

আহমদ শরীফ, বাঙ্গালী ও বাঙলা সাহিত্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা

আহমদ শরীফ সম্পাদিত, বাঙলা সুফী সাহিত্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা

শশিভূষণ দাশগুপ্ত, বাংলা সাহিত্যের নবযুগ, কলিকাতা

শশিভূষণ দাশগুপ্ত, ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, কলিকাতা

শশিভূষণ দাশগুপ্ত, শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ : দর্শনে ও সাহিত্যে, কলিকাতা

সুকুমার সেন, মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালী, বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ

আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, কলিকাতা

প্রমথনাথ তর্কভূষণ, বাঙালীর বৈষ্ণব ধর্ম, কলিকাতা

সত্যজিৎ চৌধুরী ও অন্যান্য সম্পাদিত, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ

ভক্তি মাধব চট্টোপাধ্যায়, বাংলা গদ্যের আদিপূর্ব, কলকাতা

Sashi Bhushan Das Gupta, Obscure Religious Cult as

Background of Bengali Literature, Calcutta

Muhammad Enamul Haq, A History of Sufism in Bengal Asiatic Society of Bangladesh

Toponath Chakravarty, Some Aspects of Religious Life as Depicted in Early InscriptionM, and Literature of Bengal, Calcutta

—-

এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে প্রদত্ত মুন্সী আফতাবউদ্দিন ও আবদুল হাফিজ ট্রাস্ট ফান্ড লেকচার ২০০২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *