আবুল মনসুর আহমদ

আবুল মনসুর আহমদ

আবুল মনসুর আহমদের (১৮৯৮-১৯৭৯) তিনটি পরিচয় : সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ। এবং এই তিনের সমন্বয়ে তিনি একজন সৎ বুদ্ধিজীবী ও ভাবুক। তাঁর এই তিন সত্তার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই – প্রত্যেকটি অন্য দুটির সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁর সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবনের সূচনা একই সঙ্গে প্রথম মহাযুদ্ধের পর যখন তিনি জগন্নাথ কলেজে ছাত্র। তখন তাঁর কয়েকটি ছোটগল্প মাসিক ‘সওগাত’-এ প্রকাশিত হয়। কলেজের শিক্ষা শেষ হতে না হতেই তিনি তাঁর বন্ধু আবুল কালাম শামসুদ্দীনের উৎসাহে মওলানা মনীরুজ্জামান ইসলামাবাদীর ‘ছোলতান’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতা জীবনের শুরু করেন ১৯২৩ সালে। ইসলামাবাদী ছিলেন একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক, উদার ধর্মীয় নেতা ও লেখক। তাঁর সংস্পর্শে এসে আবুল মনসুর আহমদ উপকৃত হন। তিনি কিছু দিন মওলানা আকরম খাঁর সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’তেও কাজ করেন। তারপর যোগ দেন মৌলবী মুজিবর রহমানের ‘দ্য মুসলমান’-এ সহ-সম্পাদক হিসেবে। এরপর মুজিবর রহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘খাদেম’-এ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ‘খাদেম’ ছিলো অসাম্প্রদায়িক ও হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যে বিশ্বাসী। কিন্তু তার সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় ১৯৩৮-এ যখন তিনি নিযুক্ত হন নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতির মুখপাত্র ‘দৈনিক কৃষক’-এর প্রধান সম্পাদক। বলাই বাহুল্য, ‘কৃষক’-এর ভূমিকা ছিলো প্রগতিশীল ও গণমুখী। কিন্তু নীতিগত কারণে ‘কৃষক’-এর মালিকদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ দেখা দেয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯৪১-এ তিনি যোগ দেন এ. কে. ফজলুল হকের দৈনিক ‘নবযুগ’-এ। তিনিই ছিলেন ‘নবযুগ’-এর সম্পাদক; কিন্তু প্রধান সম্পাদক হিসেবে নাম থাকত কাজী নজরুল ইসলামের। ‘নবযুগ’-এও তিনি বেশিদিন থাকতে পারেননি রাজনৈতিক ব্যাপারে মতপার্থক্যের কারণে। তারপর ১৯৪৭-এ প্রকাশিত হলো তার সম্পাদনায় কলকাতা থেকে দৈনিক ইত্তেহাদ’। এটি ছিলো সেকালের অন্যতম প্রধান বাংলা দৈনিক। এই দৈনিকে যাঁদের হাতেখড়ি অথবা যাঁরা কাজ করেছেন, পরবর্তীতে ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে তাঁরা বিশিষ্ট সাংবাদিক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হন। ‘ইত্তেহাদ’ ছিলো প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক, সম্ভবত সে কারণেই ‘৪৭-এর পরে নাজিমউদ্দিন সরকারের রোষানলে পড়ে সেটি কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হতে পারেনি। ১৯৫০-এ ‘ইত্তেহাদ’ বন্ধ হয়ে গেলে আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা জীবনের বস্তুত অবসান ঘটে এবং শুরু হয় তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন। কুড়ি শতকের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনি সাংবাদিকতার পথিকৃৎদের অন্যতম।

আবুল মনসুর আহমদের প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে : আয়না (১৯৩৫), ফুড কনফারেন্স (১৯৪৫), ছোটদের কাছাছুল আম্বিয়া (দুই খণ্ড ১৯৫০), ‘সত্যমিথ্যা’ (১৯৫৩), ‘জীবনক্ষুধা’ (১৯৫৫), গালিভারের সফরনামা (১৯৫০), আসমানী পর্দা (১৯৫৭), পরিবার পরিকল্পনা (১৯৬৭), পাক বাংলার কালচার (১৯৬৬), আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (১৯৬৯), আবেহায়াত (১৯৬৯), শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু (১৯৭২), আত্মকথা (১৯৭৮), বেশি দামে কেনা অল্প দামে বেচা স্বাধীনতা (১৯৮০) এবং ইংরেজিতে রচিত এন্ড অফ বিট্রেয়াল (১৯৭৬)। তাঁর ছোটোগল্প ও উপন্যাস এখনকার পাঠকদের সম্ভবত ভালো লাগে না, কিন্তু তার আত্মজৈবনিক ও স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থগুলো এখনও পঠিত হয় এবং শতাব্দীর রাজনৈতিক বিষয়ের লেখকদের অবশ্যপাঠ্য। ওই সকল গ্রন্থ থেকে তাঁরা যথেষ্ট উপকৃত হন। তবে তাঁর সৃষ্টিশীল লেখাগুলোর মধ্যে রম্যরচনা এখনও পাঠককে আনন্দ দিতে পারে। তাঁর ব্যঙ্গরসাত্মক গল্প-গ্রন্থ সম্পর্কে নজরুল ইসলাম ‘সওগাত’-এ লিখেছিলেন :

আবুল মনসুরের গল্পগুলি রাজনৈতিক জগতের চিত্র। এই দিক দিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবুল মনসুর সম্পূর্ণরূপে একক। বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক-রস-সাহিত্য এ পর্যন্ত যে কেউ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেননি, এ কথা সত্যের খাতিরে স্বীকার করতেই হবে।

নজরুল একেবারেই ভালো সমালোচক ছিলেন না, কিন্তু তাঁর বন্ধু আবুল মনসুর সম্পর্কে তিনি যা বলেছিলেন তাতে বিশেষ অতিশয়োক্তি ছিলো না। রস-সাহিত্যে অনেকেই অসামান্য কাজ করেছেন; কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ রাজনৈতিক রসসাহিত্যে তাঁর সময় পর্যন্ত বিশেষ কাজ হয়নি। তিনি একাধারে ধর্মব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের প্রতারণা ও ভণ্ডামির চিত্র আঁকতে চেয়েছেন। বাংলা ভাষার প্রধান কথাশিল্পীদের পাশে আবুল মনসুর ম্লান, কিন্তু প্রধান রসসাহিত্যিকদের পাশে আবুল মনসুরের অবশ্যই স্থান হবে। হাস্যরসাত্মক সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তর অবিস্মরণীয় কীর্তি। সূক্ষ্ম অথচ নির্মল হাস্যরসিক রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সমসাময়িক ও পরবর্তীদের মধ্যে প্রমথ চৌধুরী, শরৎচন্দ্র, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু প্রমুখ এই ধারায় অসামান্য কাজ করেছেন। আবুল মনসুরের আয়নাতে এমন কিছু লেখা রয়েছে যা ইন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেশচন্দ্র বসু, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজশেখর বসুর ব্যাঙ্গ-রস-কাহিনীর সঙ্গে তুলনা করা চলে। তাছাড়া হুজুর কেবলা, গো-দেওতা-কা-দেশ, নায়েবে নবী, লীডার কওম, মুজাহেদীন, বিদ্রোহী সঙ্ঘ, ধর্মরাজ্য প্রভৃতি এখনও বিষয়বস্তু হিসেবে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক। তাঁর চরিত্র পীর সাহেব, সুফী সাহেব, লীডারে কওমদের মতো এখনও কেউ কিছু লিখলেই মুরতাদ ঘোষিত হবার একেবারে একশ ভাগ সম্ভাবনা।

পূর্ববাংলার গ্রামীণ মুসলমানসমাজকে কাছে থেকে দেখেছেন বলে খুব ভালো জানতেন আবুল মনসুর। তাঁর গল্প-উপন্যাসের বিষয়বস্তু মুসলমানসমাজের ধর্মীয় গোড়ামি, অন্ধত্ব ও অন্যান্য অসংগতি। ‘আয়না’ ও ‘ফুড কনফারেন্স’ সমাজের বাস্তবচিত্র ও সমকালীন রাজনীতির দর্পণ। তিনি অশিক্ষিত ও মাদ্রাসা-শিক্ষিত মোল্লা-মৌলবীদের উপদ্রবে অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন তার প্রমাণ তাঁর লেখার সর্বত্রই উপস্থিত। উপন্যাস জীবনক্ষুধা ও সত্যমিথ্যাও গ্রামীণ সমাজের সমস্যাকেন্দ্রিক। গ্রামীণ মুসলমানসমাজের চিত্র আঁকতে গিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষের বাক্রীতি, নিত্যব্যবহৃত শব্দাবলি ও উপভাষাকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সকল ক্ষেত্রেই যে সে প্রয়োগ খুব উপযুক্ত হয়েছে তা নয়, কিন্তু তাতে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের ছবি পাওয়া যায়। মুসলমানসমাজে ব্যবহৃত আরবি-ফারসি শব্দ তিনি তাঁর গল্প-উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন। পরবর্তীকালে শওকত ওসমানসহ আরো কেউ কেউ এ কাজ করেছেন, আবুল মনসুর তাঁদের পথিকৃৎ।

তাঁর গল্প-উপন্যাস-রসরচনার বাইরে অসৃষ্টিশীল গদ্য মূলত স্মৃতিচারণমূলক ও আত্মজৈবনিক। তবে কুড়ি শতকের প্রথমার্ধের একজন প্রতিনিধি-বাঙালি-বুদ্ধিজীবীর প্রতিকৃতি তাতে পাওয়া যায়। বক্তব্য বা বিষয়ের উপরই তিনি জোর দিয়েছেন ভাষার ওপর নয়; সে জন্য তাঁর ভাষা পরিশীলিত নয়। তবে বাংলাদেশের কুড়ি শতকের ইতিহাস যাঁরা রচনা করবেন তাঁদের কাছে একদিন তাঁর রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, আত্মকথা প্রভৃতি অমূল্য সম্পদরূপে বিবেচিত হবে। তাঁর জীবন কর্মময়। কংগ্রেসের অসহযোগ, খিলাফত আন্দোলন এবং স্বরাজ্য দল, মুসলিম লীগ এবং কৃষক প্রজা পার্টির কর্মী ও নেতা হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল আবুল মনসুরের। তাছাড়া ১৯২০ এবং ‘৩০-এর দশকে কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতাও ছিল তাঁর। ১৯৪৬-এর সাধারণ নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন, কিন্তু ‘পরে জিন্নাহ সাহেব গণপরিষদ বয়কট করার নির্দেশ দিলে তিনি তা মেনে নেন।’ যাইহোক, ১৯৪৭-এর আগে এবং ‘৪৭-এর পরে তিনি কোনো জনপ্রিয় নেতার অন্ধ ভক্ত ছিলেন না। তাই ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর শুধু নয় জিন্নাহর পর্যন্ত সংগত কারণে সমালোচনা করেছেন তিনি দ্বিধাহীনভাবে।

আবুল মনসুরের চিন্তাধারার সঙ্গে আমরা ভিন্নমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে বাঙালি মুসলমান সমাজের অনেক চিহ্নিত প্রগতিশীলদের চিন্তায় যে অসংগতি লক্ষ্য করা যায় তাঁর মধ্যে তা অনুপস্থিত। তিনি গা বাঁচিয়ে অথবা চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে কথা বলতেন না। যা ভাবতেন একান্তে তাই ব্যক্ত করতেন প্রকাশ্যে সকলের মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সম্মেলন ১৩৫১-র (১৯৪৪) মূল সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন :

ধর্ম ভূগোলের সীমা ছাপিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু তমুদ্দন ভূগোলের সীমা এড়াতে পারে না, বরঞ্চ সে-সীমাকে আশ্রয় করেই সংস্কৃতির পয়দায়েশ; এখানেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সরহদ্দ। এখানেই পূর্ব পাকিস্তান একটি ভৌগোলিক সত্তা। এই জন্যেই পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা ভারতের অন্যান্য জাত থেকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ধর্মীয় ভ্রাতাদের থেকে একটা স্বতন্ত্র আলহিদা জাত।

অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গ যে পাকিস্তানের একটি অবিচ্ছেদ্য নয় বিচ্ছিন্ন অংশ তা স্বীকার করে নিয়েই এই অঞ্চলের বাঙালি জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি আলোচনায় ব্রতী হন।

পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য মাহফিল আয়োজিত চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন’-এ তিনি ‘পাক-বাংলার কালচার ও ভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে অধিকাংশ আলোচকের সঙ্গে অভিন্ন মত পোষণ করেননি বলেই ইসলামকেই পূর্ব বাংলার সংস্কৃতির একমাত্র নিয়ন্ত্রণী শক্তি হিসেবে গণ্য করেননি। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলার কৃষ্টি ও ভাষার পার্থক্য স্বীকার করে নিয়ে, ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক-সামাজিক ঐতিহ্যের ভিত্তিতে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা পুনর্গঠনের ওপর তিনি জোর দেন।’

মাসিক মোহাম্মদীতে (কার্তিক ১৩৫০/১৯৪৩) ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শীর্ষক এক নিবন্ধে আবুল মনসুর পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি এবং পরিচালকদ্বয় আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং মুজীবুর রহমান খাঁর প্রশংসা করে লিখেছিলেন :

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত রূপায়ণের ভাবী রূপ নিয়ে মুসলিম বাংলার চিন্তানায়কদের মধ্যে এখন থেকেই আন্দোলন-আলোচনা খুব স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছে। এই বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি যে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকায় অভিনয় করেছে, সে সম্বন্ধে বাঙলার মুসলমান এমনকি, এদের সীমিতাংশও, আজো পুরোপুরি সচেতন হননি।… বস্তুত পাকিস্তান দাবিকে একটা নিছক রাজনৈতিক, এমনকি নির্বাচনী শ্লোগান থেকে একটা ইনটেলেকচুয়াল আইডিয়্যালিজমে রূপান্তরিত করেছে প্রধানতঃ এই দুই ব্যক্তির মনীষা। আমি একাধিকবার স্বীকার করেছি, প্রধানতঃ এদের প্রেরণায় আমি পাকিস্তানের আদর্শবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। কায়েদ-ই-আজমের মনে যাই থাক, বাংলায় পাকিস্তানবাদ নিশ্চয় পার্লামেন্টারি কচকচিতে খেই হারিয়ে ফেলতো যদি না এই দুই ব্যক্তি নানা বিপদ ও অপ্রীতি অগ্রাহ্য করে নিশিদিন কলম চালিয়ে পাকিস্তানবাদকে এই ইনটেলেকচুয়াল রূপ দিতেন….।

এই পাকিস্তানবাদের ইনটেলেকটুয়াল রূপটি সেকালের প্রধান বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কেমন ছিল তা সংক্ষেপে আলোচনা করা সম্ভব নয় তবে আবুল মনসুরের ধারনায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলার যে চারিত্র গ্রহণের কথা ছিল ১৯৪৭-এর পর তাঁরা দেখলেন এ এক অন্য পূর্ববঙ্গ। মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক নেতারা ততোদিনে পূর্ব বাংলা দখল করে নিয়েছেন। এবং তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন একদল ভাড়াটে কবি- সাহিত্যিক-সাংবাদিক। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা পূর্ব বাংলার দুর্দশা দেখে প্রথম দিকেই মর্মাহত ও হতাশ হন। আবুল মনসুরও হতাশ হন। তিনি সেই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী যিনি দিল্লীর কংগ্রেসী শাসকদের মনোভাবের সঙ্গেও একমত নন, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবী শাসক-শোষকদের সঙ্গে গাটছড়া বাধারও বিরুদ্ধে। তবে তিনি মোটেই উগ্র নন, যা বলার নিচু কণ্ঠে শান্তভাবেই বলেন। তাঁর ভাষায়, ‘গোটা পাকিস্তান অর্থ ছিল কার্যতঃ পশ্চিম পাকিস্তান।’ তিনি আরো পরিষ্কার করে বলেন : ‘আমাদের রাষ্ট্রীয় রূপ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বা স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ যাই হোক ভাষা-সাহিত্য-কালচার-সংস্কৃতিতে যে আমরা একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান ও অপরদিকে ভারত হইতে সম্পূর্ণ পৃথক, এসব ব্যাপারেই যে আমাদের নিজস্বতা ও স্বকীয়তা আছে, এটা আমার অনড় দৃঢ় মত।’ [আত্মকথা]

আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন প্রথমত পূর্ব বাংলার একজন বাঙালি, তারপর একজন মুসলমান এবং এই দুইয়ের সমন্বয়ে হয়ে উঠেছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি মুসলমান। ওই বাঙালি মুসলমান হওয়াটাই তাঁর জন্যে হয়েছিলো সমস্যা। তাঁর লেখা পড়ে এবং জীবন পর্যালোচনা করে মনে হয় না তিনি কিছুমাত্র সাম্প্রদায়িক ছিলেন। অনেক বাঙালি মুসলমান নেতার মতো তিনি একেবারেই ভারতবিদ্বেষী ছিলেন না, হিন্দু বিদ্বেষী তো ননই। তাঁর ব্যবহৃত কিছু কিছু শব্দ ও শব্দ-বন্ধ তাঁকে ভুল বোঝার পথ করে দেয়। তার মধ্যে পূর্ববঙ্গীয়তা ছিলো পুরোপুরি; কিন্তু হিন্দু-বিরূপতা ছিল না একেবারেই। যেমন তিনি পূর্ব বাংলাকে বলেছেন ‘মুসলিম বাংলা’, কথাটিতে আমরা শংকিত হতে পারি কারণ পদ দুটিতে ধ্বনিত হয় যেন সাম্প্রদায়িক চেতনা। কারণ পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি ভুট্টোর মুখেও শোনা গেছে কথাটি ‘৭০-এর দশকে। আবুল মনসুরকে সমর্থন করার জন্যে বলছি না, বস্তুত তাঁর লেখা পাঠ করে সহজেই বোঝা যায় যে কথাটিতে তিনি বোঝাতে চাইতেন ‘মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গ’। অবহেলিত পূর্ব বাংলাই ছিল তাঁর চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। সেটা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ভেদবুদ্ধি থেকে নয় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতার চেতনাপ্রসূত। যে ভৌগোলিক অবস্থানে আজকের বাংলাদেশ, যার রাজনৈতিক রূপ গ্রহণ করতে শুরু করে ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে, তারপর ১৯৪৭-এ এক চারিত্র গ্রহণ করে এবং ১৯৭১-এ যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্রের রূপ গ্রহণ করে তার প্রতিষ্ঠাতাদের আবুল মনসুর আহমদ একজন : ছোটো এবং বড়, প্রত্যক্ষ এবং পরেক্ষ, দু’রকম ভূমিকাই তিনি পালন করেছেন। আমি প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলতে চাই, যদি ১৯৪৭-এর পর খাজা নাজিমুদ্দিনদের হাতে ক্ষমতা না থেকে আবুল মনসুর ও তাঁর সমধর্মীদের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হতো, অন্তত তাদের পরামর্শ গৃহীত হতো, তা হলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতো- সমাজ হতো সাম্প্রদায়িকতামুক্ত। অনুরূপভাবে ১৯৭১-এর পর যদি তাঁদের পরামর্শে বাংলাদেশ শাসিত হতো তা হলে ‘সোনার বাংলা’ না হোক অন্তত শান্তিতে বসবাসযোগ্য এক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হতো। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রায় একটি দশক জীবিত ছিলেন তিনি, কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ তাঁকে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করার প্রয়োজন মনে করেননি তাঁর অনুজ অথবা পুত্রপ্রতিম শেখ মুজিব। আবুল মনসুরের মতো মধ্যপন্থী মানুষ প্রগতির জন্য কখনোই বাধা নয়, কারণ তাঁরা রক্ষণশীল হতে পারেন কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল নন— তাঁরা মুখর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ও সকল রকম অন্যায়-অবিচার ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে।

সুতরাং তাঁদের চিন্তা, মেধা, প্রজ্ঞা ও মানবপ্রেম একটি জাতি গঠনে অত্যন্ত প্রয়োজন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা চেয়েছিলাম গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা। আবুল মনসুর আহমদ এই নীতিগুলোর কোনোটারই বিরুদ্ধে ছিলেন না। সমাজতন্ত্রী তিনি ছিলেন না, কিন্তু সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কোনো কর্মসূচির তিনি বিরোধিতা করতেন না। আর গণতন্ত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষ তিনি ছিলেন পুরোপুরি। তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। *

* বাংলা একাডেমী আয়োজিত ‘আবুল মনসুর আহমদ জন্মশতবর্ষ উদযাপন’ অনুষ্ঠানে পঠিত প্ৰবন্ধ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *