আমাদের জীবনে একুশের তাৎপর্য

আমাদের জীবনে একুশের তাৎপর্য

১.

আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের বাঙালিদের জীবনে একুশের ভাষা-আন্দোলনের তাৎপর্য কি এ সম্পর্কে বলতে গেলে শুধু একবাক্যেই বলা যায় যে সে-তাৎপর্য খুব ব্যাপক ও গভীর। অন্যদিকে সে তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেক কথাই বলা আবশ্যক, সেজন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময়, ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ, আত্ম-তদন্ত— নিজেদের দিকে নিরাবেগ দৃষ্টিতে তাকানো। সেজন্য বেশি প্রয়োজন আত্ম-বিশ্লেষণ ও আত্ম-সমালোচনার। আত্মপ্রসাদের কোনো সুযোগ এ ক্ষেত্রে নেই।

ভাষা-আন্দোলনকে উপর থেকে দেখলে মনে হয় একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটি ছিলো ঔপনিবেশিকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং স্বাধীনতার স্পৃহার বহিঃপ্রকাশ। এই আন্দোলনের প্রধান চারটি দিক রয়েছে : সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক।

ভাষা-আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বার্থ, বাঙালি কবি-শিল্পী- সাহিত্যিকের স্বার্থ, বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের স্বার্থ, শিক্ষকের স্বার্থ, অফিস-আদালতের কর্মচারি-কর্মকর্তার স্বার্থ, কলকারখানার শ্রমিকের স্বার্থ, ব্যবসায়ীর স্বার্থ, এমন-কি বাংলার কৃষকেরও স্বার্থ। যে-আন্দোলনের ভেতরে ছিল এদেশের সকল সম্প্রদায়ের, সকল মানুষের স্বার্থ অর্থাৎ সমগ্র জাতির স্বার্থ রক্ষিত হয় যে-আন্দোলনে সে-আন্দোলনের তাৎপর্য সুদূরবিস্তৃত না হয়ে পারে না। বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষিত না হলে বাংলা সাহিত্য বিপন্ন হতো এবং একদিন এ ভাষা বিকৃত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। উর্দু না জানার কারণে শিক্ষার্থীরা বিপর্যয়ে পড়তো, চাকরি-বাকরিতে পিছিয়ে পড়তো বাঙালি, শ্রমিকের স্বার্থ বিঘ্নিত হলে, জাতির অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যেতো, বিপন্ন হতো গোটা বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি। সে-জন্যই বাংলা ভাষার অধিকার নিশ্চিত করা এতো জরুরী ছিল।

একটি জনগোষ্ঠীর ভাষার অধিকার হরণ করা হলে তাতে তাদের শারীরিকভাবে হত্যা করা হয় না বটে, কিন্তু দৈহিকভাবে ছাড়া আর-সকলভাবেই তাদের হত্যা করা হয়। বাহান্নার একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদগণ এবং সে-আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতা ও কর্মীগণ সে-সময়ের চার কোটি বাঙালিকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রই শুধু বানচাল করে দেননি অনাগত দিনের বাঙালিদের ধ্বংস করার চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেন।

যে-কোনো জনগোষ্ঠীর নানারকম ধর্ম থাকে : তাঁর আধ্যাত্মিক ধর্ম, সামাজিক ধর্ম, সাংস্কৃতিক ধর্ম, রাজনৈতিক ধর্ম, অর্থনৈতিক ধর্ম প্রভৃতি। সকল জাতির অধ্যাত্মধর্ম একরকম নয়, সকল জাতির সামাজিক ধর্মও একরকম নয়- বাঙালির সমাজজীবনের সঙ্গে বিহারী ও বালুচদের সমাজধর্মের সাজুয্য কোথায়? রাজনৈতিক বিশ্বাস ও চেতনাও সকল জাতির এক রকম নয়। স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তো প্রত্যেক জাতির অনন্য সম্পদ। তা থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। সকল সমাজের অর্থনৈতিক বিন্যাস অভিন্ন নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে বাঙালির সঙ্গে পাঞ্জাবী, সিন্ধী, পাঠান, বালুচদের মিল ছিল শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসে। অন্য সকল ব্যাপার – সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বিষয় তাদের একেবারেই আলাদা। এক জাতি অন্য জাতির মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এ প্রশ্নে কোনো আপস হয় না।

শুধু বাঙালিই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রক্ত দিয়েছে কথাটি ঠিক নয়। নিজের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে অন্য দেশের অন্য ভাষার মানুষও, কিন্তু আমাদের ভাষা-আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা অর্জন করে। কারণ আমরা ভাষার অধিকার আদায় করেছিলাম, অন্যেরা সংগ্রাম করেও তা পারেনি। ভাষার জন্য ভারতে জীবন দিয়েছে আসামের উপত্যকায় বাঙালিরা। ১৯৬১-তে শিলচরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে গণ-আন্দোলনে নিহত হন এগার জন। ১৯৬৫ সালে তামিলনাড়ুতে ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে, পরিণামে ক্ষমতায় আসে তামিলপন্থী একটি দল যেমন বাংলাদেশে ‘৫৪-তে যুক্তফ্রন্ট। ১৯৬৫-তে মাদ্রাজে ভাষার জন্য আত্মাহুতি (self-emmolution) দেন ১২ জন। বছর দুই আগেও তামিলনাডুতে ভাষার জন্য ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে, কারাবরণ করেন হাজার হাজার। শ্রীলংকায়ও ভাষার জন্যে আন্দোলন হয়েছে। ভাষার দাবিতে লড়াই চলছে এই ফেব্রুয়ারিতেই মেসিডোনিয়ায়। সেখানে দু’জন মারাও গেছেন।

বাহান্নর ভাষা-আন্দোলন ছিল একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন। দুই অংশবিশিষ্ট পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে লোকসংখ্যা ছিল শতকরা ছাপ্পান্ন জন। কিন্তু এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় একটি সংখ্যালঘু সরকার। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা করা চলে নেলসন ম্যান্ডেলা-পূর্ব দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ সরকারের। পাঞ্জাবীরা ছিল সংখ্যায় কম, কিন্তু তারাই পাকিস্তানের বিপুল অধিকাংশ বাঙালি, সিন্ধী, বেলুচ, পাঠান প্রভৃতি যারা রাষ্ট্রের প্রায় চার-পঞ্চমাংশ তাদের শাসন ও শোষণ করার জন্য একেবারে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই তৎপর হয়ে ওঠে। এ জন্য ভাষা – আন্দোলন একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিকতাবিরোধী এক সফল বিস্ফোরণ।

২.

১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারির সপ্তাহখানেক আগে পাকিস্তানী আদর্শে বিশ্বাসী মাসিক সাহিত্যপত্র দ্যুতি ‘আমাদের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে লিখেছিলো :

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমত অনুযায়ীই সরকার পরিচালিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের জনসাধারণের প্রাদেশিক ভাষা [ভিন্ন ] হলেও তারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দুই যে সরকারি ভাষা হবে এবং উর্দুই যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে তাতে দ্বিধা প্রকাশ করার কিছুই নেই। ঠিক একই নীতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শতকরা ৬৫ জন বাংলা ভাষাভাষীর মতামতকেও অস্বীকার করার কোন ক্ষমতা কোন গণতান্ত্রিক সরকারের থাকতে পারে না।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে বিগত ১৯৪৮ সনে সারা পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল আন্দোলন হয়ে গেছে। জনমতের চাপে পড়ে তদানীন্তন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী জনাব খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলা ভাষার দাবীকে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারিভাবে সে- প্রতিশ্রুতি ও প্রস্তাব কার্যকারী করা হয়নি। শুধু তাই নয়, জনাব খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব পাক-প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পূর্ব-বঙ্গ সফরে এসে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অভিমত প্রকাশ করে গেছেন। তার প্রতিবাদস্বরূপ গোটা প্রদেশেই তুমুল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রদেশের ছাত্ররা শোভাযাত্রা, ধর্মঘট ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বাংলা ভাষার ন্যায্য অধিকার দাবী করছেন।

আমরা আশা করি সরকার গণদাবীকে উপেক্ষা করে সমস্যা-পীড়িত পাকিস্তানকে আরো সমস্যাসঙ্কুল করে তুলবেন না।

[দ্যুতি, প্রথম বর্ষ : প্রথম সংখ্যা নবপর্যায় ফাল্গুন ১৩৫৮]

এতে প্রমাণিত হয় এদেশের মুসলিম লীগের সমর্থক এবং ইসলামপন্থীরাও বাংলা রাষ্ট্রভাষা হোক তা চাইতেন তবে সে জন্য সংগ্রামের পথে না গিয়ে তারা আলাপ- আলোচনা ও আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে মাতৃভাষার অধিকার অর্জন করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ দলমতনির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল মানুষ বাংলার পক্ষে ছিল, যেমন অল্পসংখ্যক দালাল ছাড়া ‘৭১-এ সকল বাঙালি স্বাধীনতার পক্ষে ছিল, তেমনি বাহান্নতেও পাঞ্জাবীদের অল্পসংখ্যক দালাল ও তাঁবেদার ছাড়া সকল বাঙালিই বাংলার প্রশ্নে একমত ছিল। সে জন্যেই দু’ বছর পরে সাধারণ নির্বাচন হলে জনগণ মুসলিম লীগকে প্রত্যাখ্যান করে।

ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণীত হবার পরেও সে দেশে সরকারি ভাষা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত ছিল অনেক দিন, এখানো আছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিতাড়িত করার পর স্বাধীন ভারতেও বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উঠেছিলো, হিন্দিভাষী শাসকদের দাপটে সে-দাবি অগ্রাহ্য হয়। কাজী আবদুল আদুদ সম্পাদিত মাসিক সংকল্প-তে অন্নদাশঙ্কর রায় ‘ভাষার লড়াই’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে ‘হিন্দীর সঙ্গে বাংলা, মারাঠী ও কর্ণাটকী এই তিনটি ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা’ করার ‘আর্জি’ করেছিলেন। তখন আবার ওই দাবির সঙ্গে কেউ কেউ উর্দুকেও ভারতের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্ন তোলেন। সেই প্রশ্নের উত্তরে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন :

আমি যখন বাংলার নাম করি তখন আমার মাথায় ঘুরছিল হিন্দীর চেয়ে বাংলা যাদের পক্ষে সহজ সেই আসামী, মনিপুরী, মৈথিলীদের কথা। কেবল বাঙালির কথা নয়। কেবল বাঙালির কথা ভাবলে অত বড় দুঃসাহস আমার হতো না। কারণ রাষ্ট্রভাষা নির্ধারিত হয় একাধিকের স্বার্থে, বিপুল সংখ্যকের স্বার্থে।

তেমনি মারাঠীর নাম করবার সময় কেবল মারাঠীর স্বার্থচিন্তা করিনি, কর্ণাটকীর উল্লেখ করার সময় কেবল কর্ণাটকীদের স্বার্থ ধ্যান করিনি। হিন্দীর চেয়ে মারাঠী বা কৰ্ণাটকী যাদের পক্ষে সহজ তাদের কথাও ভেবেছি।

…গণতন্ত্রে কোনো জিনিস কারো উপর জোর করে চাপানো যায় না। যায় না বলেই ঢাকার ছেলেরা জান দিল। সেখানকার উজীরের পতন হলো।

[সংকল্প, ৪-৫ সংখ্যা, শ্রাবণ-ভাদ্র ১৩৬১]

একুশে ফেব্রুয়ারির অব্যবহিত পরে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র পরিচিতি এক সম্পাদকীয়তে লেখে :

সম্প্রতি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে ঢাকায় যে মর্মন্তুদ ঘটনা সংঘটিত হলো তাতে প্রত্যেক অনুভূতিশীল মানুষের প্রাণেই চরম আঘাত লেগেছে। রাষ্ট্রের মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করাই যদি রাষ্ট্রধর্ম হয় তবে বাংলা ভাষার এ আন্দোলনকে যে- কোন জাতীয় সরকার সমর্থন না করে পারে না।

… … … … … … … …

বাংলা ভাষায় দাবী নিয়ে সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ঘটনাও আমাদের কাছে ঠিক এমনি একটি ঘটনা বলেই মনে হয় যার কথা হয়তো বাংলার মানুষ কখনো ভুলবে না। এই অঘটনের ভেতর দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রের পক্ষে একটা মহাকল্যাণকর মহাযুগের আবির্ভাবের সংকেত-ধ্বনিই যেন আমরা শুনতে পাচ্ছি।

[পরিচিতি, ১ : ৪ সংখ্যা, মাঘ-চৈত্র ১৩৫৮]

যথার্থ মন্তব্য করেছিল এই প্রগতিশীল পত্রিকাটি, তবে তাঁদের ভবিষ্যৎবাণী এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সফল হয়নি। একদিন হবে, আশা করি।

একুশের ভাষা-আন্দোলন এদেশে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার সূচনা করে, যদিও সে-আন্দোলন কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল না, কিন্তু এই আন্দোলনের পরে এ দেশের রাজনীতি আর যথাপূর্ব থাকল না, ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি মানুষ অনাস্থা ঘোষণা করল। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির কয়েক মাস পরে ঢাকা থেকে আমার দেশ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তার প্রথম-সংখ্যার (১৬ ভাদ্র ১৩৫৯) সম্পাদকীয়তে ঘোষণা করা হয়।

‘আমার দেশ’ সাম্প্রদায়িকতা বিশ্বাস করে না এবং বর্তমান পরিবেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রয়োজন স্বীকার করে না।

‘বর্তমান পরিবেশ’ বলতে ভাষা-আন্দোলন পরবর্তী বাঙালি জাতীয়তাবাদী পরিবেশের কথাই বলা হয়ে থাকবে। এ বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয়, ভাষা-আন্দোলন ছিল সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল তা একুশের চেতনারই বহিঃপ্রকাশ।

ভাষা-আন্দোলন সংঘটিত হবার পর তেতাল্লিশ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এটি খুব অল্প সময় নয়। বাংলাদেশের বর্তমান জনসমষ্টির অর্ধেকের জন্ম ভাষা-আন্দোলনের পরবর্তীকালে। এখন সেই আন্দোলনের তাৎপর্য নিরাবেগ দৃষ্টিতে বিচার করা বাঞ্ছনীয়। ভাষা-আন্দোলনের পরবর্তী দু’ বছরের মধ্যে মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটে যে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনার জায়গাটি অধিকার করে নেয় ভাষাগত জাতীয়তাবাদী চেতনা। এই উত্তরণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যে দেশে একই ভাষাভাষী অভিন্ন নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একই রক্তের উত্তরাধিকারী কোনো জনগোষ্ঠীর বসবাস সেখানে ধর্মীয় চেতনাকে প্রশ্রয় দেয়া মহানির্বুদ্ধিতা। এ বিষয়টি মুহম্মদ আলী জিন্নাহ উপলদ্ধি করেই তাঁর প্রথম গণপরিষদ ভাষণে বলেছিলেন :

আমাদের এমন মনোভাব নিয়ে কাজ আরম্ভ করা উচিত যাতে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুদের মধ্যে সকল জটিলতা দূর হয়।… আপনি যে-কোনো ধর্ম বা বিশ্বাসের অন্তর্গত হউন না কেন তার কোনো সম্পর্ক নেই রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের সঙ্গে। …
আপনারা লক্ষ্য করবেন, আমাদের সামনে এমন এক সময় আসবে যখন হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না, মুসলমান আর মুসলমান থাকবে না, অবশ্যই ধর্মীয় অর্থে নয়, কারণ তা হলো প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক অর্থে

তা সত্ত্বেও মুসলিম লীগের একশ্রেণীর নেতা পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতা টিকিয়ে রাখাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন; একুশ তাঁদের সেই সাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করে। তা ছাড়া আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এ. কে. ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিই করে গেছেন। আজ সচেতন জনগোষ্ঠীকে মূল্যায়ন করতে হবে এদেশে একুশের অসাম্প্রদায়িক চেতনা দিন দিন বিকশিত হয়েছে না সংকুচিত হয়েছে।

বাংলাদেশের নারী-আন্দোলনেও একুশের ভূমিকা অসামান্য। সেই ৫০-এর দশকের শুরুতে এ দেশের নারীসমাজ বাইরের জগতের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে খুব বেশি জড়িত থাকতেন না। কিন্তু ভাষা-আন্দোলনের ঘটনাবলির দিকে তাকালে দেখা যায় সে- আন্দোলনে স্কুল-কলেজের ছাত্রী-কিশোরী-যুবতী-গৃহবধূ থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত অনেকেই পথে নেমেছিলেন। বাংলাদেশের নারীসমাজকে পথে নামতে শিখিয়েছে একুশ। তাই এ কথা বলা যায় যে, একুশের পথ ধরেই আমাদের নারী-আন্দোলনের নব-পর্যায়ের সূচনা।

৩.

ভাষা-আন্দোলনের সরাসরি প্রভাব ছিল ১৯৫৪-র ২১-দফা নির্বাচনী ইশতাহারে। একুশের ঘটনা না ঘটলে মুসলিম লীগের পতন ঘটতো না ১৯৫৪-তে। ২১-দফার প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল আইয়ুবের সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১৯৬২-র ছাত্র-আন্দোলনে, ১৯৬৬-র ছয়-দফার আন্দোলনে, ১৯৬৯-এর ছাত্রসমাজের এগার দফা আন্দোলনে। এইজন্যে যখন বলা হয়, ভাষা-আন্দোলনের পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে তাতে কোনো অতিরঞ্জন নেই; বিন্দুমাত্র অসত্য নেই।

১৯৪৭-পরবর্তীকালের এ দেশের রাজনীতির ইতিহাস হলো সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতিশ্রুতি প্রদান ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ইতিহাস। ১৯৫৪-র নির্বাচনের আগে যুক্তফ্রন্ট যে-ঐতিহাসিক একুশ-দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিলো, সেটি নতুন করে পড়তে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি, তার অনেকগুলোর প্রাসঙ্গিকতা স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে আর নেই। সেই কর্মসূচি প্রণীত হয়েছিলো ভাষা-আন্দোলনের চেতনার প্রেক্ষাপটে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, গত ৪০ বছরে কত সরকার এলো এবং গেলো, সেই একুশ-দফার বহু কর্মসূচি আজো বাস্তবায়িত হলো না। যেমন, দফাগুলোর মধ্যে ৩, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১৩, ১৫, ১৬ ক্রমিক নম্বরের দফাগুলো আংশিক অথবা সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত থেকে গেছে। ১৭ নম্বর দফাটি যুক্তফ্রন্ট সরকার বাস্তবায়িত করেছিল বলে আজ আমরা এই প্রাঙ্গণে বক্তৃতা দিতে ও গ্রন্থমেলা করতে পারছি। তা না হলে এখানে আজ বাস করতেন একজন মন্ত্রী বা আমলা। যে-দফাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি তার সবগুলোই ছিলো প্রগতিশীল— সেগুলো ছিলো কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণের জন্য।

বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল বিষয়ই ভাষা-আন্দোলনের মধ্যে প্রকাশ্যে অথবা প্রচ্ছন্নভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। আগেই বলেছি, সেটি ছিল একটি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন – রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। কিন্তু গত ৪৩ বছরেও এ দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী হলো না। বারবার এদেশের মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করছে, বারবারই রাজনীতিকদের অদূরদর্শিতা, সংকীর্ণ স্বার্থচেতনা অথবা ধৈর্যের অভাবে গণতন্ত্রের পথটি স্বৈরতন্ত্রের গভীর গর্তে গিয়ে বিলীন হয়েছে।

একাত্তরে বাঙালির জীবনে স্মরণকালের বৃহত্তম ও মহত্তম ঘটনাটি ঘটল, অর্জিত হলো স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতায় একুশের দান অপরিমেয়। ১৯৭২-এ প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে একুশের চেতনা ও ২১-দফার প্রভাব ছিল প্রচুর। শুধু তাই নয় পাকিস্তানের ৫৬ – র সংবিধানেও ২১-দফার প্রভাব ছিল। বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা ঘোষিত হলো। ৭৩-এর নির্বাচন হলো সেই সংবিধানের ভিত্তিতে। প্রতিষ্ঠিত হলো সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার, যা ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি, কিন্তু দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হলো না। সেজন্য কমবেশি সরকার ও বিরোধী দলসমূহ সম্মিলিতভাবে দায়ী। একদিকে অসহিষ্ণু সরকার, অন্যদিকে অধৈর্য বিরোধী দল। নতুন স্বাধীন দেশে নতুন ও অনভিজ্ঞ সরকারকে তার কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহানুভূতির সঙ্গে সময় দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত ও পেশাজীবীরা অবিলম্বে অনেক বেশি পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সরকারও জনগণ ও বিরোধী দলের মনস্তত্ত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। বিরোধী দলকে সহযোগিতার জন্য আহ্বানও করা হয় না। বাংলাদেশে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সহযোগিতার কোনো দৃষ্টান্ত কখনোই স্থাপিত হয়নি। (অবশ্য সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো এবং শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানীর মতো দু’ একটি ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সহমর্মিতা ও গভীর আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায়)।

৭০-এর দশকটি হতে পারতো আমাদের রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী করার সময়। কিন্তু ওই গুরুত্বপূর্ণ দশকটির অপচয় ঘটেছে। ওই দশকটি শুধু দেশের স্বাধীনতা ছাড়া জাতিকে আর বিশেষ কিছু দেয়নি, দিলেও দিয়েছে সামরিক শাসন উপহার। অতঃপর ৮০-র দশক আবির্ভূত হলো জাতির জীবনে এক অভিশাপরূপে, যা আসতে পারতো আমাদের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে, যেমনটি এসেছিলো মালয়েশিয়ার মানুষের জীবনে। ইন্দোনেশিয়াতে স্বৈরাচার ছিল রাজনীতিতে কিন্তু তাতে সেখানকার অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়নি। ৭০ ও ৮০-র দশকে রোপণ করা ফসল আজ অনেক দেশ তাদের গোলায় তুলেছে। আমরা আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশের মতো আত্মঘাতী সর্বনাশের পথে চলতে শুরু করি। এ জন্য দেশবাসীর কেউ না কেউ নিশ্চয়ই দায়ী। কিন্তু তারা কারা? তাদের আমরা চিনি। তাদের ছবি আমরা প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় দেখি। তাদের বাণী আমরা পাঠ করি অথবা শ্রবণ করি।

একুশের আন্দোলনে বাঙালির অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত ছিল খুবই স্পষ্টভাবে। মানবাধিকার, আইনের শাসন, শ্রমিকের অধিকার, বৈজ্ঞানিক উপায়ে কৃষিকাজ, সেচব্যবস্থার আধুনিকরণ, কৃষিতে সমবায়, কুটিরশিল্পের বিকাশ, পাটব্যবসা জাতীয়করণ, লবনশিল্পের উন্নতি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিলো ২১-দফার সেই কর্মসূচিগুলোয়।

একটি বিষয়ে আমি এখানে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। ভাষা-আন্দোলনের ওপর একটি স্বতন্ত্র জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কেন্দ্ৰীয় শহীদ মিনারের সংলগ্ন সেই জাদুঘরে ভাষা-আন্দোলন সংক্রান্ত দলিল-দস্তাবেজ, পুস্তক- পুস্তিকা, প্রচারপত্র, আন্দোলনের শহীদদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ইত্যাদি সেখানে রক্ষিত থাকতে পারে, যাতে অনাগত দিনের উৎসাহী মানুষ ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস সেখানে গিয়ে জেনে আসতে পারেন। এবং শহীদ মিনারের সঙ্গেই প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন একটি ‘ভাষা-আন্দোলন পাঠাগার’। বাংলাদেশে টাকার অভাব নাই—এ দুটি কাজ করার মতো অর্থেরও আশা করি অভাব হবে না।

৪.

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাপ্রসারের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। মার্কিন দার্শনিক জন ডিউই এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমেরিকার সবচেয়ে যোগ্য রাষ্ট্রপতি টোমাস জেফারসন রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য জোর দিয়েছেন ধর্ম, নৈতিকতা ও শিক্ষা ওপর। তিনি বলেছেন, সাধারণভাবে মানুষ যদি শিক্ষিত ও সচেতন হয়ে ওঠে তা হলে আপনা আপনি স্বৈরাচার উধাও হয়ে যায়। আমেরিকা যদিও এখন একটি খুবই বিপদজনক রাষ্ট্র তবু এক- সময় গণতান্ত্রিক চেতনায় সে-দেশ পৃথিবীর বহু দেশকে প্রভাবিত করেছে। রাজনীতিক ও চিন্তাবিদ এডমণ্ড বার্ক বলেছেন : ইচ্ছার বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রকাশ ঘটে ভোট প্রদানের মাধ্যমে। একজন শিক্ষিত ভোটারের সচেতনভাবে বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে ভোট প্রদান আর সহায়সম্বলহীন নিরক্ষর নির্বোধ মানুষের প্রার্থীদের ক্যানভাসারদের প্ররোচনায়, উৎকোচের বিনিময়ে অথবা ভয়ভীতির কারণে ভোট দেয়ার মধ্যে ব্যবধান বিস্তর। ১৯৯১- এর নির্বাচনে কারচুপি হয়নি বলে আমরা মনে করি, এবং দাঙ্গাহাঙ্গামা ছাড়াই মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে ও উৎসাহউদ্দীপনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই নির্বাচনের দিন আমরা কয়েকজন ঢাকার নিকটবর্তী অনেকগুলো এলাকায় গিয়ে বেশকিছু ভোটারকে জিজ্ঞেস করলাম যাকে ভোট দিয়েছেন অন্য প্রার্থীর তুলনায় তার শ্রেষ্ঠতা কোথায়? সদুত্তর দিতে পারেনি প্রায় কেউই। প্রার্থী ও তার দল সম্পর্কে ভোটারদের বিশেষ কিছু জানা নেই। এটি হয়েছে সচেতনতার অভাবে, অশিক্ষার কারণে। সে জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই দেশবাসীকে শিক্ষিত করে তোলা প্রয়োজন।

গত তিরিশ বছরে দেশে শিক্ষা সম্প্রসারিত হয়েছে সামান্য পরিমাণে, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার উপকরণ সম্প্রসারিত হয়েছে অনেকখানি, এ ক্ষেত্রে ব্যয় হয়েছে বিপুল অর্থ। বহুসংখ্যক নতুন বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গ্রামগ্রামান্তরে, অগণিত মাদ্রাসা-মক্তবে গিজ গিজ করছে পল্লীগুলো, ভোর না হতেই সেগুলোতে আমসিপারা বগলে নিয়ে যাচ্ছে শিশু ও কিশোর-কিশোরী। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পাকা করা হচ্ছে, পল্লীর শিশুরা দালানে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। কলেজগুলোর অট্টালিকা দূর থেকে চোখে পড়ে। কিন্তু সেগুলোতে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা বিশেষ নেই, কোনো কোনো বিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানভবনগুলো শিক্ষার্থীর অভাবে খা খা করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় পাঠাগার গড়ে ওঠেনি, যা আছে নামেমাত্র। যে-সকল পুরনো ইস্কুল- কলেজে একদিন পাঠাগার ছিলো সেগুলোর বইপত্র খোয়া যেতে যেতে আর বিশেষ অবশিষ্ট নেই, নতুন পাঠাগার প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগও নেই।

পাঠাগার প্রতিষ্ঠা নয় ভিডিও লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা চলছে সারা দেশে। পল্লীগুলোয় বিদ্যুৎ গেছে। ভিসিআর, ভিসিপি এযুগেরই জিনিস, এবং বিজ্ঞানের দান, সুতরাং তার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করি না। বিদ্যুৎ যখন গেছে তখন কম্পিউটার শেখার সুযোগ হয়েছে ইস্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরও, সে-সুযোগ যদি আজ হাতছাড়া হয় একটি প্রজন্ম পিছিয়ে পড়বে। দ্রুতপরিবর্তনশীল পৃথিবীতে একটি প্রজন্মের পেছনে পড়ে থাকা জাতিরই পেছনে পড়ে থাকা। পনের বিশ বছর আগে বিদ্যুৎ ছিল না বলে ইস্কুলগুলোয় সন্ধ্যের আগেই কাজকর্ম শেষ করতে হতো। আজ উজ্জ্বল আলোর অভাব নেই দেশের অধিকাংশ এলাকাতেই, কিন্তু অভাব শিক্ষার আলোর। যে-শিক্ষা পাচ্ছে আমাদের শিশু- কিশোররা তা এই যুগের জন্য এতই অল্প যে তাকে শিক্ষা বলা সমীচীন নয়। পশ্চিমের আধুনিক শিক্ষা পাচ্ছে না আমাদের সন্তানরা, কিন্তু সেখানকার মন্দ জিনিসগুলো ভিসিপি ও ডিস এন্টেনার মাধ্যমে গ্রহণ করছে অনায়াসে।

তা ছাড়া পাঠ্যপুস্তকের মান অতি নিচে নেমে গেছে। পাকিস্তান আমলের প্রথম পনের বছরে যখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক প্রমুখ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তখন পাঠ্যপুস্তকের মান ছিল উন্নত এবং চারিত্র ছিল মোটামুটি অসাম্প্রদায়িক। আইয়ুবের সময় থেকে পতন শুরু হয়। বর্তমান অবস্থা ভয়াবহ। শিক্ষাক্ষেত্রে জাতি যেন আজ চরম অভিভাবকহীন। গৃহশিক্ষকের তৈরি নোটের ফটোকপি পড়ে পাশ করছে ছাত্রছাত্রীরা, কষ্ট করে হাতে লিখে কপি করারও প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞান অন্য দেশের মানুষের উপকার করছে, আমাদের করছে ভয়াবহ ক্ষতি।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় চরম অব্যবস্থা ও বৈষম্য বিরাজ করছে। একদিকে কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট কলেজ, মধ্যখানে সাধারণ বিদ্যালয়, আরেক দিকে নানা নামের নানা রকমের মাদ্রাসা। এই অব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী শতকে আমরা পিছিয়ে পড়বো পৃথিবীর শিক্ষিত জাতিগুলোর থেকে, যেমন বাঙালি মুসলমান পিছিয়ে পড়েছিল উনিশ শতকে বাঙালি হিন্দুদের থেকে এক শতাব্দী। যার খেসারত এখন বাঙালি জাতি দিচ্ছে। ইসলামী চরিত্র গঠনের নামে, মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার নামে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পাশাপাশি ‘বাংলাদেশে প্রাইমারি স্কুল এবং ইবতেদায়ী মাদ্রাসা এই দুই ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রথম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করে থাকে।’ [সংগ্রাম, ৯.২.১৯৯৫] দেশে রয়েছে ১৭,০০০ ইবতেদায়ী মাদ্রাসা, অর্থাৎ প্রত্যেক থানায় ৪০ থেকে ৪৫টি প্রাথমিক মাদ্রাসা। বিপুল অর্থ অপব্যয় হচ্ছে এগুলোর পেছনে। বিনিময়ে জাতি পাচ্ছে কি? দেশবাসীকে ধার্মিক নয় ধর্মান্ধ হওয়ার পথ রাষ্ট্র ও সরকারই করে দিচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকেই মাদ্রাসা শিক্ষা দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে—এই মধ্যযুগীয় শিক্ষাকে উৎসাহিত করছে রাষ্ট্র। মাদ্রাসা শিক্ষা যদি ভালোই হতো তা হলে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, মন্ত্রী ও সচিবদের সন্তানরা ওতে পড়তো। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা এবং বিখ্যাত রাজনীতিকদের ছেলেমেয়েরা তো ওগুলোয় পড়ে না, গরিব মানুষের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার নামে মাদ্রাসায় ঠেলে দেয়া হচ্ছে- রাষ্ট্রই তাদের প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মান্ধ হওয়ার পথ করে দিচ্ছে। মাদ্রাসা থেকে যারা বেরুচ্ছে তারা খুব অল্প ব্যতিক্রম বাদে শুধু যে সাম্প্রদায়িক তাই নয় বাঙালিসংস্কৃতির প্রতিও বিরূপ। মাদ্রাসাশিক্ষা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। মাদ্রাসাশিক্ষা প্রগতির পথে এক বিরাট প্রাচীর। এই প্রাচীর অক্ষত রেখে আমরা এগুতে পারবো না, ধর্মীয় শিক্ষার নামে, মাদ্রাসার নামে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলো খুবই মুখর, কিন্তু ওইসব দলের নেতারা অসুখবিসুখে চিকিৎসার জন্য অনবরত যান ভারত, থাইল্যাণ্ড, সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন এবং আমেরিকা। আমরা আরবির বিরুদ্ধে নই, ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন এবং ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞান অর্জনের বিরুদ্ধেও নই, কিন্তু শিক্ষার নামে মানবসন্তানের সর্বনাশ করার বিরুদ্ধে। একুশই আমাদের এ শিক্ষা দিয়েছে।

প্রশ্ন হলো শিক্ষার জন্য শিক্ষিতসমাজ কি ভূমিকা পালন করছেন? যে বিশাল জনগোষ্ঠী সঠিক পথ খুঁজে না পেয়ে অজ্ঞানতার অরণ্যে হারিয়ে যাচ্ছে, মাদ্রাসা-মক্তবের চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে, তাদেরকে আধুনিক শিক্ষার আলোতে নিয়ে আসার দায়িত্ব সকল বিবেকসম্পন্ন মানুষের। ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন মোটামুটি ভালো ছিল তাই তা বাস্তাবয়িত হয়নি। তা ছাড়া অন্যান্য শিক্ষা কমিশন শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে দিয়েছে ধর্মীয় শিক্ষার নামে। উনিশ শতকে বাংলার হিন্দুরা ভালো করে বাংলা ও ইংরেজি লেখার জন্য সংস্কৃত বর্জন করেন। তারা এগিয়ে যান। মুসলমানরা স্বাতন্ত্র্য রক্ষার নামে, আভিজাত্য প্রকাশের বাসনায় আরবি, ফার্সি, উর্দু শিখতে গিয়ে প্রাণের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে যখন ইংরেজি ও বাংলা শিখতে গেল তখন তাদের মাথা গেল গুলিয়ে, উনিশ শতক এবং কুড়ি শতকের প্রথম দুই দশক মুসলমানরা পাঁচটি ভাষা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কোনোটিই শিখতে পারেনি বরং পড়ল মারাত্মকভাবে পিছিয়ে। আজ যে অবুঝ শিশুটি আমসিপারা নিয়ে মক্তবে মাদ্রাসায় ছুটছে সে জানে না যে তার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তার অজ্ঞতার কারণে একদিন তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে সর্বনাশা ধর্মান্ধ শক্তির কাছে। তাদের হাতিয়ার হয়ে সে নিজের ও সমাজের ক্ষতি করবে। অবিলম্বে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে সঠিক পথে। কিন্তু কে আনবে? সরকার এ কাজ করবে না। বেশি প্রগতিশীলতা সরকারের পছন্দ নয়- কোনোকালের কোনো সরকারেরই নয়।

৫.

যে বিশাল জনগোষ্ঠীর চেতনার মান উঁচু নয়, যারা পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণ করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অক্ষম, তাকে নানা প্রলোভনে প্রতারিত করে নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো এমন প্রতিশ্রুতি দিতে থাকে যা ক্ষমতা গ্রহণ করে পূরণ করা দুরূহ। তবে যে-প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন খুবই সহজ সেগুলোও অবাস্তবায়িত থাকে। এই অবস্থাটি আমরা দেখে আসছি ১৯৩৭-এর নির্বাচনের সময় থেকে। আজও একই ঐতিহ্য অনুসৃত হচ্ছে। এ কারণে জনতা অবিলম্বে সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে—হতাশ হয়—ক্ষুব্ধ হয়। আজও কোনো বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক পন্থা সকল প্রধান দল একত্রিত হয়ে গ্রহণ করেনি। ইংরেজ-ঔপনিবেশিক দুর্বৃত্তরা বিতাড়িত হওয়ার পর থেকে দেশের শাসক ও শাসিত উভয়েই স্বাধীনভাবে চলার যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করেনি। জনগণের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য থাকবে, কিন্তু মৌলিক প্রশ্নে—ভাত, কাপড়, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি প্রশ্নে : নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের প্রশ্নে—কারো কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। নির্বাচনের আগে অথবা বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় বিচিত্র প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা শুধু বাংলাদেশের নয় উপমহাদেশের তথা তৃতীয় বিশ্বেরই রোগ, তবে আমাদের দেশেই তার পরিমাণ ও প্রকোপ বেশি। নির্বাচিত সরকার থেকে যখন মানুষ বিশেষ কিছু পায় না তখন স্বৈরশাসকরা চুপি চুপি এগিয়ে আসে। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই, তারা ক্ষমতায় এসেই রাস্তাঘাট সেতু দালানকোঠা নির্মাণ শুরু করে, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে স্বেচ্ছাচারিতা করে টাকাকড়ি বিতরণ করে প্রভাবশালীদের মধ্যে, মৌলিক গণতন্ত্রী সৃষ্টি করে, পরোক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করে, অর্থাৎ যা খুশি তাই করে। সকল সামরিক শাসনের মধ্যেই বিভিন্ন পেশাজীবী তাদের বেতনবোর্ড পেয়েছে এবং বাস্তবায়িত করেছে। এ এক মর্মান্তিক সত্য ও ভয়াবহ বাস্তবতা। একুশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও এই বাস্তবতা একেবারেই সামঞ্জস্যহীন।

৬.

সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের যে-কথাটি বলা হয় সেটি একটি কথার কথা। বাংলাদেশে সকল স্তরে বাংলাই প্রচলিত রয়েছে এবং এই কাজটি হচ্ছে নিরক্ষর জনগণের দ্বারা। তারা অন্য ভাষা জানেও না, তাই অন্যভাষার ওপর নির্ভর করার কোনো সুযোগ তাদের জীবনে নেই। শিক্ষিতরাই সৃষ্টি করছে এ ব্যাপারে নানা বিঘ্ন। শিক্ষিতরাই উকিল-ব্যারিস্টার, অধ্যাপক- সাংবাদিক, জজ-জেনারেল আমলা-ইঞ্জিনিয়ার-এদের দ্বারাই মাতৃভাষার লাভ এবং ক্ষতি হয়ে থাকে। নিরক্ষর মানুষ ভাষার ভালো-মন্দ কোনোটাই করতে পারে না, তারা শুধু ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে।

পৃথিবীর সকল দেশের সাধারণ মানুষই—অল্পশিক্ষিত মানুষই বানান ভুল করে, অশুদ্ধ বাক্যে ভাব প্রকাশ করে, কিন্তু সংস্কৃতিসেবীরা করেন না। কোনো মুদিদোকানের মালিক হিসেব কষতে গিয়ে কোনো দ্রব্যের নাম ভুল বানানে লিখলে আমাদের বিচলিত হবার কিছু নেই, কিন্তু শহীদ মিনারে অথবা শহীদদের সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে যান যে-সকল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দলের নেতারা তাঁরা যখন ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শব্দটিই বছরের পর বছর ধরে অশুদ্ধ বানানে লিখছেন তাতে বিস্মিত হতে হয়। আরো বিস্মিত হতে হয় যখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে বানানটি শুদ্ধ করে লেখার জন্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে। জাতীয় সংসদে সদস্যগণের অনেকেই অশুদ্ধ ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলতেই পছন্দ করেন। কখনো কখনো তা বেশ উপভোগ্য। এক একটি বাংলা-শব্দও যা উচ্চারণ করেন শুনলে পিলে চমকে যায় : পুচ্চল্লিশ, পোচপান্ন, অষ্টানব্বুই ইত্যাদি। আজ বাংলা সংবাদপত্রগুলোতেও অশুদ্ধ বানানের ছড়াছড়ি।

১৮৭২ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত সত্তর বছরে বাংলা ভাষার যে উন্নতি হয়েছে, বাহান্নপরবর্তী চল্লিশ বছরে সমপরিমাণ সফলতা অর্জনে আমরা সক্ষম হইনি, যদিও এই সময় অনেক কাজ হয়েছে। আমাদের ভাষা-আন্দোলনে যে-সকল কিশোর এবং কুড়ি- পঁচিশ বছর বয়স্ক কবি-সাহিত্যিক অংশ নিয়েছিলেন ৫০ এবং ৬০-এর দশকে তাঁদের অধিকাংশই গভীর-ব্যাপক কোনো কর্মে নিজেদের নিয়োজিত করেননি। প্রতি বছর অগণিত একুশের সংকলনে সেই আন্দোলন সম্পর্কে গল্প-কবিতা-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে অজস্র, কিন্তু অবিস্মরণীয় গ্রন্থ রচিত হয়েছে অতি অল্প। পরিভাষার ক্ষেত্রে কিছু কিছু কাজ হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গ্রন্থাবলি বাংলায় অনুবাদিত না হলে বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার মান উঁচু হবে না।

বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার পর যখন বাধ্য হয়ে শাসকগোষ্ঠী বাংলাভাষার মর্যাদা দিতে স্বীকৃত হয় তখন একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্যটিই শুধু অর্জিত হয়; কিন্তু সেই আন্দোলনের উদ্দেশ্য পুরোপুরি অর্জন সম্ভব হয়নি। আমাদের দেশের শিক্ষিতসমাজ এবং জাগ্রত ছাত্রযুবসমাজ ভাষার সাংবিধানিক মর্যাদা আদায় করেই তাঁদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। ভাষার জন্যে আরো কিছু এবং অনেক কিছু করা প্রয়োজন। কোনো ভাষাভাষী মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ—তার বাস্তব ও স্বপ্ন, তার চিন্তা ও কর্ম যাবতীয় জিনিস—– সাহিত্য ধারণ করে। কিন্তু কোনো জনগোষ্ঠী যদি অক্ষরজ্ঞানহীন হয় তা হলে সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ থেকে তারা থাকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। বাংলা একটি উন্নত ভাষা—পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। এই ভাষার মননশীল ও সৃষ্টিশীল অমূল্য সাহিত্যসম্পদ থেকে যদি শতকরা নব্বই জন বঞ্চিত থাকে তা হলে তা খুবই পরিতাপের বিষয়। কিন্তু শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক দীনতা প্রভৃতি কারণে অন্তত ৯৫ শতাংশ মানুষের মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল ইসলাম প্রমুখ লেখকদের রচনাবলিতে কোনো প্রবেশাধিকার নেই। বস্তুত তারা তাদের মৌলিক অধিকার থেকেই বঞ্চিত!  

সেজন্যেই ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের শিক্ষিতসমাজের উচিত ছিল শুরু করা আরো একটি আন্দোলন : নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে অভিযান। ভাষা-আন্দোলনে রক্ত দিতে হয়েছে, কিন্তু শিক্ষাবিস্তারের আন্দোলনে রক্ত দেয়ার কোনো প্রয়োজন হতো না। এই আন্দোলন সফল করার জন্য দৃঢ়চিত্তে কঠিন সংকল্প নিয়ে এগিয়ে গেলেই হতো। অশিক্ষা থেকেই জন্ম নেয় অন্ধবিশ্বাস, ক্ষতিকর কুসংস্কার। জাতি আজ সেগুলোরই শিকার।

৭.

ভাষা-আন্দোলনের মূল নায়ক ছিল দেশের যুবসমাজ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন দেশের প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী জনগণ। আমাদের দেশের জনসমষ্টির অর্ধেক কিশোর-কিশোরী ও যুবসম্প্রদায়। তারাই সমাজের প্রাণশক্তি। তাদের কাছে সমাজের দাবি অনেক। গত চার দশকেরও বেশি সময় যাবৎ তারা দেশের সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। জাতির কল্যাণে তারা রক্ত দেন অকাতরে। এই যুবসমাজেরই একটি ছোট্ট অংশ দিকভ্রান্ত— তারা পথভ্রষ্ট। তাদের সঠিক পথে চালানোর কোনো পরিচালক নেই—পথপ্রদর্শক নেই। শৃঙ্খলাই সুন্দর জীবনের পূর্বশর্ত——সেই শৃঙ্খলার অভাব তাদের মধ্যে খুব বেশি। সংখ্যায় অতি অল্প হলেও তারা অনাচারে লিপ্ত। সেই অল্পসংখ্যকের জন্যেই গোটা সমাজ লজ্জিত, বিব্রত। তারা জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে। তারা শহীদ মিনারের পবিত্র চত্বরে বিপদজনক ঘটনা ঘটায়, একুশের গ্রন্থমেলার গাম্ভীর্য নষ্ট করে। বাঙালির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উৎসব একুশের অনুষ্ঠানও তাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের জন্যেই বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সম্মিলিত ছাত্র সংগঠনগুলো এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যৌথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে বাধ্য হয়।

একুশের চেতনা যদি আমাদের সকলের মধ্যে পুরোপুরিভাবে সঞ্চারিত থাকতো তবে এই ধরনের একুশের চেতনার পরিপন্থী অশ্লীল কাজের বিরুদ্ধে কোনো নির্দেশ জারির প্রয়োজন হতো না। প্রতি বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন জাতীয় দিবসের গাম্ভীর্য ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য আবেদন জানান, তা সত্ত্বেও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে জাতীয় স্মৃতি সৌধে, শহীদ মিনারে, একুশের বইমেলায়, শিলাইদহে প্ৰভৃতি স্থানে।

আমাদের জাতীয় জীবনে ১৬ ডিসেম্বরের গুরুত্ব দুগ্ধপোষ্য শিশু, নিতান্ত নির্বোধ, উন্মাদ এবং রাজাকার-আলবদর ছাড়া সকলেই অবগত, তা সত্ত্বেও একটি ১৬ ডিসেম্বর উদযাপনের সংবাদ দৈনিক ইত্তেফাক এ-রকম লেখে :

স্মৃতিসৌধের পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের বেদীতে অনেকে জুতাসহ উঠিয়া পড়ে এবং উহার পুষ্পস্তবকগুলি পায়ে মাড়াইয়া বিধ্বস্ত করে। কিছু সংখ্যক তরুণ, এমন কি বয়স্ক লোকদের খামখেয়ালির দরুন গোলাপবাগান এবং আশেপাশের ফুলের বাগান পুষ্পবিহীন হইয়া পড়ে এবং গাছগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইহা ছাড়া উপস্থিত নাগরিকদের বিশেষভাবে মহিলা ও শিশুদের, খুবই অসুবিধায় পড়িতে হয়। ইহাতে অনুষ্ঠানের ভাবগম্ভীর পরিবেশ ব্যাহত হয়। [দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৮৫]

১৯৮৭-র ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৭টি ছাত্রসংগঠনের এক যুক্তবিবৃতিতে ‘শহীদ মিনারের মূলস্তম্ভে কোনো নেতার ছবি বা সংগঠনের ব্যানার না টাঙানোর জন্যে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান’ জানানো হয়। ‘বিবৃতিতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষা ও যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ দিবস পালনের লক্ষ্যে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে গড়িয়া ওঠা ঐক্যমত্যের ভিত্তিতেই এই আহ্বান’ জানানো হয়েছে। [আজাদ, ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭] তা সত্ত্বেও কয়েক বছর যাবত শহীদ মিনারে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।

শুধু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নয় দেশের নানা জায়গায় শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার খবর পাওয়া গেছে। শিলাইদহে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে দলীয় নেতার শ্লোগানে আকাশবাতাস কলুষিত হয়েছে- ‘লাঠিসোটা নিয়ে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়।’ ‘নজরুল ইনস্টিটিউটটে স্থাপিত নজরুলের ভাস্কর্য কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে নষ্ট করা হয়েছে।’ ভাস্কর্যকে যারা প্রতিমার সঙ্গে তুলনা করে তাদের মন থেকেই পৌত্তলিকতার আমেজ অপসারিত হয়নি। ইসলামি বিপ্লবের পরও ইরানে কবি-শিল্পীদের মূর্তি যথাস্থানেই তাদের মহিমা ঘোষণা করছে— তেহরানে ফেরদৌসীর মূর্তিটি ইসলামবিরোধী বলে কেউ ভেঙে দেয়নি।

গোটা পৃথিবীতেই এখন ধর্মীয় ক্ষতিকর উদ্দীপনা উন্মাদনা সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহরূপে। উপমহাদেশে ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতা এবং প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন সমান্তরালভাবে চলছে। প্রধান প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একশ্রেণীর হীনস্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। যারা ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে এনেছেন। সাধারণ ধর্মভীরু মানুষকে হিংস্র হওয়ার পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন অন্যকে আঘাত হানার জন্য। বাংলাদেশেও ধর্মীয় রাজনীতি আজ অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশি সক্রিয়। সাম্প্রদায়িক দলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা দিয়ে পাতিবুর্জোয়া গণতন্ত্রী দলগুলোও ভোটের আশায় ধর্মকে তোয়াজ করে কর্মসূচি প্রণয়ন করছে। এ সবই ভাষা-আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থী এবং একুশের শহীদদের অবমাননা, তাঁদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। গণমাধ্যমগুলো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি যতোটা নয় তার চেয়ে বেশি বিতরণ করছে প্রতিক্রিয়াশীলতার দুর্গন্ধ।

বাংলাদেশের যে বদনামটি আগে ছিল না সেই মৌলবাদের আলখাল্লা তার গায়ে ১৯৯৪-তে পরিয়ে দেয়া হয়েছে। কাজটির জন্য মূলত দায়ী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও মৌলবাদীরা, কিন্তু পরোক্ষে তাদের সহায়তা করেছে একশ্রেণীর অতি প্রগতিশীল মানুষ। ধর্মান্ধরা জাতির কি ভয়াবহ সর্বনাশ করলো তা তারা জানে না, অথবা জেনেই করেছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। সামান্য কারণে তারা একজনকে ঘোষণা করছে ‘মুরতাদ’, কারো চাইছে ফাঁসি। অন্যদিকে ইসলামকে গালাগালির জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে আসছে বিপুল অর্থ। আজ অনেকে জেনে গেছেন, ইসলামকে নিন্দা করলে রাতারাতি ধনী ও বিশ্ববিখ্যাত হওয়া যায়। শুধু সে কারণেও অনেকে প্রগতিশীলতার মুখোশ পরে উসকানিমূলক লেখায় উৎসাহ পাচ্ছেন। বিপুল অর্থ ব্যয় করে যারা বাংলাদেশকে মৌলবাদীর ভাবমূর্তি নির্মাণ করেছে তারা গত কয়েক মাসে অসামান্য সফলতা অর্জন করেছে। তাদের সাহায্য করেছেন আমাদেরই একশ্রেণীর তথাকথিত প্রগতিশীল কবিসাহিত্যিক, যারা নিজেরা খুবই অসৎ, সংকীর্ণ, যুক্তিহীন এবং বিদেশী প্রভুদের বিশ্বস্ত হুকুমবরদার। মৌলবাদী ও উগ্রপন্থীদের অনবরত গালাগালি করলে তাদের লাভই হয়। কয়েকদিন আগে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, নিষ্প্রয়োজনে অব্যাহত সমালোচনা করে, ওদের কথার গুরুত্ব দিয়ে মুসলিম উগ্রবাদীদের ভাবমূর্তি তৈরি করা হচ্ছে যা গণতন্ত্রের জন্যে ক্ষতিকর। ওদের উপেক্ষা করাই উচিত।

গণতান্ত্রিকসমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের সচেতনশ্রেণীকে অবশ্যই সরকার ও সমাজব্যবস্থার এমন-কি প্রচলিত রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে অবাধ সমালোচনার অধিকার দিতে হবে। সেই অধিকার অর্জনের পর কেউ যদি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেন তাতে বিচলিত হবার কোনো কারণই নেই। অব্যাহত সমালোচনার ভেতর দিয়েই সমাজ এগিয়ে যায়, সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়ে ওঠে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত শুধু যে সরকারের থেকেই আসে তা নয়, সমাজের যে-কোনো প্রভাবশালী অংশ থেকেই বাক্-স্বাধীনতার ওপর আঘাত আসতে পারে। বরং বাংলাদেশে সরকারেরই সমালোচনা করা যায়, প্রধান বিরোধী দলের সমালোচনা করা যায়, কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদী চক্রের বিরুদ্ধে কিছু বললেই বিপদ। যেমন ধর্মীয় কোনো ব্যাপারে কিছু বললেই তার কদর্থ করে চীৎকার শুরু হয়ে যায়। বুদ্ধিজীবীদের বাড়িতে বোমা পড়ে, পত্রিকার অফিস আক্রান্ত হয়, মিছিল হয়, জনসভা হয়, ফতোয়া জারি হয়, মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়, আরো অনেক কিছু হয়। এগুলো সরকার করে না। সরকারের আইন-আদালত আছে, সরকারের বাইরে যারা তারা আইন ও দণ্ড তাদের নিজেদের হাতে তুলে নিতে চায়। প্রধানমন্ত্রীকে গালাগাল করলে আজ জেলে যাওয়ার সম্ভবনা নেই, বিরোধী দলীয় নেত্রীকে সমালোচনা করলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু এমন অনেক উগ্রবাদী ধর্মান্ধগোষ্ঠী রয়েছে যাদের কিছু বলা যাবে না। তবে তাদের হাত থেকে সকলকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারেরই এবং সমাজের বিবেকসম্পন্ন মানুষের।

আমাদের দেশের সরকার অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস চাইলেও দেন না, কিন্তু ১৯৮৮- তে সামরিক একনায়ক এরশাদ দেশবাসীকে না চাইতেই একটি জিনিস উপহার দেন : রাষ্ট্রধর্ম। অযাচিতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের খুশি করার জন্য এটি দেয়া হয় তা মনে করার কোনোই কারণ নেই—ওই কর্মটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই করা হয়েছিল : বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা জোরদার করার জন্য। ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণা করায় দেশের মুসলমানদের কোনো উপকার হয়নি, ইসলাম ধর্মও কিছুমাত্র উপকৃত হয় নি, কিন্তু অমুসলমানরা অন্তরে অত্যন্ত আঘাত পান। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো জনগোষ্ঠীকে বা সম্প্রদায়কে আহত করার অধিকার কারো নেই। কিন্তু অবাক ব্যাপার, ভোটের কথা বিবেচনা করে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বাতিলের ব্যাপারে বিশেষ কিছু বলে না। এই নীরবতা একুশের চেতনার বিরোধী 1

৮.

একটি সমাজের জন্য সবচেয়ে দুঃসময় সেটি যখন সত্য কথাটি সরাসরি উচ্চারণ করা বিপদজনক। সামরিক শাসনের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা সামাজিক অসহিষ্ণুতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, দলীয় অসহিষ্ণুতা। অসহিষ্ণুতা ও গণতন্ত্র একসঙ্গে থাকতে পারে না। নৃশংস সামরিক জান্তার চেয়ে একদল ধর্মান্ধ মানুষ অধিকতর ভয়ঙ্কর। মার্শাল ল’র মতোই মারাত্মক সামাজিক সংকীর্ণতা এবং সেই সংকীর্ণতাপ্রসূত উগ্রতা। পাড়াগাঁয়ে ধর্মীয় ফতোয়াবাজদের দৌরাত্ম—নগরে বন্দরে উচ্চশিক্ষিত ফতোয়াবাজদের উল্লম্ফন। যুক্তিহীন ভাবাবেগ মার্শাল ল’র চেয়েও ক্ষতিকর ও ভয়াবহ। আমাদের সমাজ থেকে যুক্তি আজ অপসারিত—বিচার-বিবেচনা অর্থাৎ বিবেক নির্বাসিত। এ অবস্থা অতীতের কোনো কোনো অন্ধকার যুগকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। যে জাতি একুশের আন্দোলন করেছে, মুক্তিযুদ্ধ করেছে তার কাছে এটা কেউ আশা করে না।

কোনো জাতির শিল্প-সাহিত্যসংক্রান্ত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির মধ্যে তার চারিত্র ও মনস্তত্ত্বের প্রকাশ ঘটে। চিরকালই সকল সমাজ দু’ভাগে বিভক্ত : একদিকে প্রতিক্রিয়াশীল ও রক্ষণশীলদের যৌথ দল, অন্যদিকে প্রগতিশীল শক্তি। প্রতিক্রিয়াশীলদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ওয়াজ-ওরস-জিকির প্রভৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের পল্লীর নির্মল বায়ু আজ তাদের কর্মকাণ্ডে দুর্গন্ধে ভরে গেছে। খানিকটা শিক্ষিত প্রতিক্রিয়াশীল যারা তারা শহরে সভা-সেমিনার করে থাকেন। তাতে তারা তাদের মনের কথাই প্রচার করেন। নাচ-গান-বাজনা-নাটক হারাম বলে ওসবে ওরা হাত দেন না। ওরা সেমিনার করেন ওগুলোর বিরুদ্ধে কথা বরার জন্য। প্রগতিশীলরা সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য—সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমাদের সমাজে দু’টোই সমান্তরালভাবে হচ্ছে।

সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে একটি সমাজের প্রাণস্পন্দন অনুভব করা যায়। যে-সমাজে কোনো সাহিত্য শিল্প নৃত্য সংগীতের অনুষ্ঠান অনুপস্থিত সে-সমাজ নিঃসন্দেহে প্রাণহীন। তবে কোনো কিছুই সংখ্যা বা পরিমাণ দিয়ে নয় তার উৎকর্ষ ও গুণ দিয়েই বিচার্য। অসংখ্য অনুষ্ঠান হলেই যদি সমাজের মঙ্গল নিশ্চিত হতো তা হলে আমাদের সমাজ ও দেশ আজ একটুও পিছিয়ে থাকতো না। আমাদের দেশে সামাজিক- সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিছুটা বেশিই যেন হয়ে থাকে। উদাহরণের জন্য বলা যায়, শুধু গত ১০ ফেব্রুয়ারিতেই ঢাকা নগরী এবং তার উপকণ্ঠে ৬২টির বেশি নানারকম সামাজিক- সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অনুষ্ঠান-সূচিতে দেখা গেছে। কমবেশি সারা বছর প্রতিদিনই এমনটি হয়ে থাকে। অর্থাৎ বছরে শুধু রাজধানীতেই অনুষ্ঠান হয় আনুমানিক একুশ হাজার। ঢাকাতেই বছরে বড় সেমিনার সিম্পোজিয়াম হয়ে থাকে সাত আট শ-র মতো। এ সম্পর্কে বছরখানেক আগে একটি চমৎকার জরিপও হয়েছিল। এই সকল অনুষ্ঠান বাঙালির প্রাণশক্তির পরিচয় কিছুটা বহন করে বটে কিন্তু এতে যে জাতির বিশেষ কল্যাণ হচ্ছে তা বলা যাবে না। এ সকল অনুষ্ঠানের যারা আয়োজন করেন তাদের অধিকাংশেরই উদ্দেশ্য নিজেদের নাম পত্রিকায় মুদ্রণের ব্যবস্থা করা, তারবেশি কিছু হয়। গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ আলোচনাসভা মাসে দু’চারটিই যথেষ্ট। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেয়া দরকার। ২০-এর দশকে ঢাকার ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’- এর উদ্যোক্তারা বছরে একটি বা দুটি করে আলোচনাসভার আয়োজন করেছিলেন মাত্র বছর পাঁচ-ছয়। কিন্তু সেই সেমিনারগুলোর আলোচ্যবিষয় গোটা সমাজের চৈতন্যে ব্যাপক-গভীর আলোড়ন তোলে এবং দীর্ঘদিন তার প্রভাব সমাজে প্রবাহিত থাকে। আরো ভাববার বিষয়, তখন ঢাকায় কোনো দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল না তাঁদের সেই আলোচনার বিষয়বস্তু শিক্ষিতসমাজের মধ্যে প্রচারের জন্য। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা নিজেরাই ‘শিখা’ নামে একটি বার্ষিকী বের করতেন। সেই ‘শিখা’র চার-পাঁচটি সংখ্যা বাঙালি মুসলমানসমাজে এখানো অনির্বাণ রয়েছে। আমাদের এই স্থবির সমাজটাকে একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আজ এমন উদ্যোগ চাই। আজ তো আমাদের অর্থ, কাগজ, কালি, মুদ্রণ-উপকরণ প্রভৃতি কোনো কিছুরই অভাব নেই।

আমাদের সাহিত্য অনেককাল যাবত এক অতি সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। আমরা যেন আধুনিক হয়ে উঠতে পারছি না। খ্যাতনামা এবং কিছুটা শক্তিশালী লেখকদেরও ব্যস্ত থাকতে হয় অথবা ব্যস্ত থাকতে তাঁরা পছন্দ করেন তুচ্ছ কাজে। ভারত ছাড়া এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশে লিখিয়ের সংখ্যা বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লেখক হওয়ার নেশায় অনেকে তার নিজস্ব পেশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। আবালবৃদ্ধগৃহবধু, যুবক ও যুবতী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আড়তদার ও ঠিকাদার, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-অসামরিক আমলা, কেরাণী ও কূটনীতিক, উকিল-জজ-ব্যারিস্টার, ইণ্ডেন্টার, কারবারী, শিল্পপতি সকলেই গ্রন্থকার হওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। অপ্রয়োজনীয় বই বের করতে গিয়ে ছাপাখানা শ্রেষ্ঠ লেখকদের গ্রন্থাবলি ফেলে রাখছে। এ অবস্থাটি তো সাহিত্যের জন্যে ক্ষতিকর। এককালে গ্রন্থকার ও সাহিত্যসাধক হওয়া ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ এখন বাঙালির জীবনে সহজতর ব্যাপার লেখকরূপে পরিচিত লাভ করা। এই দরিদ্র সমাজটিতে করার মতো এতো কাজ আছে— সে-সব দিকে এগিয়ে যাবার উৎসাহ অতি অল্পমানুষের মধ্যেই দেখা যায়। সবাই হতে চাইছেন লেখক।

শুধু হতাশার ব্যাপার নয়, বাহান্নপরবর্তী তেতাল্লিশ বছরে সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমাদের অর্জনের পরিমাণও খুব কম নয়। তবে নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের প্রত্যাশা আরো বেশি। আগামী শতকের শুরুতে তাদের কাছ থেকে অমূল্য জিনিশ পাবো বলে আমরা আশা করি। বাংলা ভাষায় আজ উচ্চশিক্ষা দেয়া হচ্ছে, একুশের পর থেকেই ধীরে ধীরে বাংলা জীবনের নানা ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে, এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরো ব্যাপক হবে আশা করা যায়। সমাজের জন্য ক্ষতিকর প্রবণতাও নিশ্চয়ই একদিন বন্ধ হবে।

৯.

এই বাংলার মাটির সকল প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক বস্তুতে যেমন এদেশের ধর্ম-বর্ণ- নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার রয়েছে, তেমনি এই দেশের সকল কৃতী মানুষের কর্ম ও চিন্তাধারায় অর্থাৎ তাঁদের শিক্ষায় সমৃদ্ধ হওয়ার অধিকার সকলের। আমরা যারা যে ধর্মের অনুসারীই হই না কেন প্রত্যেক বাঙালি অতীতের প্রত্যেক বাঙালির উত্তরাধিকারী। আমি মুসলমান বলে কে বলে আমার অধিকার নেই আচার্য শান্তিদেব, শ্রীধর আচার্য অথবা অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের বিতরণ করে যাওয়া জ্ঞানে। এ দেশের সকল বাঙালির পরম শ্রদ্ধেয় নন কি শ্রীচৈতন্যদেব, তাঁর কাছে আমাদের ঋণ সকলের। রঘুনাথ শিরোমণি, বাসুদের সার্বভৌম, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের সকলের সম্পদ-তাঁদের ধর্মবিশ্বাস ভিন্ন ছিল বিবেচনা করে তাঁদের দূরে সরিয়ে রাখা অপরাধ। এ দেশের সকলের সম্পদ রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, লালন শাহ, বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মশাররফ, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার, যামিনী রায়, নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন প্রমুখ। কোনো বাঙালি শুধু বাংলা ভাষায় নয় সংস্কৃতে হোক, আরবিতে হোক, ফারসিতে হোক, ইংরেজিতে হোক যা সৃষ্টি করেছেন তা গোটা জাতির সম্পদ।

আমাদের দেশে একশ্রেণীর বাঙালিমুসলমান কবি-সাহিত্যিক স্বাধীনতার পরে হীনম্মন্যতা ও দুর্বলচিত্ততার কারণে, প্রগতিশীল শিবির থেকে খারিজ হয়ে যাওয়ার অমূলক আশঙ্কায়, মুসলমান মনীষীদের সম্পর্কে নীরবতা অবলম্বন অথবা তাঁদের অবদান অস্বীকার করে অমার্জনীয় অপরাধ করে আসছেন। হাজি শরিয়তউল্লাহ, স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব আবদুল লতিফ, মুন্সী মেহেরুল্লাহ প্রমুখ আজ প্রতিক্রিয়াশীলদের সম্পদে পরিণত হয়েছেন। কখন তাঁদের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী আসে যায় দেশবাসী জানে না। নবাব আবদুল লতিফ এবং নওয়াব আলী চৌধুরীর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের দুটি আবাসিক হলের নামকরণ করা উচিত ছিলো। মীর মশাররফ, শরিয়তউল্লাহ, আবদুল লতিফ, নওয়াব আলী চৌধুরী, মেহেরুল্লাহ, জগদীশচন্দ্র বসুর নামে ঢাকায় কোনো রাস্তা নেই। চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসুর নামে যে-রাস্তা আছে তা না থাকার নামান্তর। রবীন্দ্রনাথের নামে উত্তরা উপশহরে কেন ঢাকা শহরের কেন্দ্রেই রাস্তা হওয়া উচিত ছিলো। বাঙালিজাতির এই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আজ আমাদের এ সম্পর্কে ভাবতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পিতা পিতামহদের যে-সন্তান স্মরণ করে না সে-তো হতচ্ছাড়া।

প্রগতিশীলদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তে অথবা উদাসীনতায় অথবা মতলববাজিতে সাধারণ বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যারা একটু ধর্মভীরুগোছের, তাদের সাম্প্রদায়িক হওয়ার ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়েছে। তারা ধর্মান্ধদের কুক্ষিগত হওয়ার পথে। হজরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর আবির্ভাব-তিরোধান তিথি যখন শুধু মোল্লাগোছের মুসলমান, মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানপন্থী এবং সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন গোষ্ঠীটি তাদের স্থুল রুচিমতো উদযাপন করে তখন আমাদের সকলের দীনতার প্রকাশ ঘটে। তাঁর জীবন ও শিক্ষাসম্পর্কে যে গভীর ও ব্যাপক আলোচনাসভা হবে তাতে যতদিন পর্যন্ত দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রগতিশীল কবি-শিল্পী- সাহিত্যিক-চিন্তাবিদ এবং অন্য ধর্মের—হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আমন্ত্রিত না হবেন, ততোদিন পর্যন্ত এ দেশ থেকে ও সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করা সম্ভব হবে না। প্রগতিশীলরা যদি স্নায়বিক দুর্বলতায় ভোগেন তাতে সমাজের অশেষ ক্ষতি। জন্মাষ্টমীতে কেন হবে না মুসলমানদের অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্ত? বৌদ্ধপূর্ণিমায় কেন আমরা অংশগ্রহণ করবো না।

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডঃ রাধাকৃষ্ণণ রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন :

Though Hinduism is the background of all the activities in the school, the birthdays of the great prophets, the Budha, the Christ, Mohammad, Nanak, are celebrated.

শান্তিনিকেতনের সঙ্গে কবি ছাড়া আরো অনেকেই যুক্ত ছিলেন যাঁরা ঋষিপ্রতিম মানুষ, নিজের ধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও তাঁরা ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দিতেন না।

তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন অন্য ধর্মের প্রতি। এখন সেখানকার অবস্থা কি বলতে পারবো না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও কিছুকাল সেখানে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান, শিখ ধর্মপ্রবর্তকদের জন্মদিনে তাঁদের স্মরণ করা হতো। যে-কাজটি রবীন্দ্রনাথ পারতেন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর পারতেন, ক্ষিতিমোহন সেন পারতেন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রবোধচন্দ্র সেন প্রমুখ পারতেন, সেটি আমাদের এ কালের কবিসাহিত্যিকগণ করতে ভয় পান-ভয় পাছে যদি প্রগতিশীলদের তালিকা থেকে নাম- কাটা যায়। এটি খুবই ক্ষতিকর প্রবণতা। বাংলাদেশের আজ দুর্ভাগ্য, মোল্লামার্কা মুসলমানের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিদেশ থেকে বিপুল অর্থ আসছে, অন্যদিকে ইসলামের ভালো দিকের নিন্দা করার জন্যও আসছে টাকা-পয়সা ও সুযোগ-সুবিধা।

আমাদের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী তাঁদের দেশপ্রেম উচ্চৈঃস্বরে প্রচার করেই জীবন ব্যয় করে দিলেন, অন্য বিশেষ কাজ করার অবকাশই পেলেন না। দেশপ্রেমের দূরন্ত প্রতিযোগিতা দেখেছি পাকিস্তান-আমলে, এখন চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা, কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ধর্মীয় চেতনার মতো দেশপ্রেমও এমন একটি গভীর-গাঢ় চেতনা যে তা চেঁচিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না–তা আচরণে ও কর্মেই প্রকাশিত হয় যেমনটির প্রকাশ ঘটেছিল একুশের শহীদ ও নেতাদের আচরণে, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাসংগ্রামীদের কর্মকাণ্ডে। মহান দেশপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে রাধাকৃষ্ণনের আর একটি উক্তিও উল্লেখ করার মতো :

Rebindranath loved India because of her ideals. He says, ‘l love India but my India is an idea and not a geographical expression, Therefore, I am not a patriot. I shall seek my compatriots all over the world.

I am not a patriot— ‘আমি দেশপ্রেমিক নই’—আমরা বলতে পারবো না। আমাদের বন্ধুরা কথা বন্ধ করে দেবেন। প্রথাগত দেশপ্রেমিক হলে রবীন্দ্রনাথ এ উক্তি করতে পারতেন না, আর এ দেশের মানুষের তাঁর দেশপ্রেমে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলে এমন স্বীকারোক্তির পর তাঁকে লাঠিসোটা নিয়ে আঘাত করতো। যে দেশপ্রেম যে জাতীয়তাবোধ বিশ্বপ্রেমে বিশ্বমানবতাবোধে রূপান্তরিত হতে ব্যর্থ হয় মানুষের প্রতি ভালোবাসার সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয়, তা শেষ পর্যন্ত দেশের ও জাতির কোনো কল্যাণে আসে না। গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশে এমন সব ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তাতে আমাদের দেশপ্রেমের পরীক্ষা ছিল, আমরা সে-সব পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছি; কিন্তু পরীক্ষায় পাশের পরেও আরো কাজ অবশিষ্ট থাকে, সে-সকল কাজ দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করার মধ্যেই চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করে।

১০.

অতীতের সংগ্রামের চেতনাকে কিভাবে ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য কাজে লাগাতে হয় তা পৃথিবীর অনেক জাতি জানে। চীনের মানুষ ও নেতারা জানেন, ভারতের মানুষ জানেন, কোরিয়ার মানুষ জানেন, ভিয়েতনামের জনগণ জানেন! ভারত পাকিস্তানের কয়েক ঘন্টা পরে স্বাধীন হয়, কিন্তু দ্রুত এগিয়ে যায় কয়েক দশক, অর্থাৎ স্বাধীনতাকে ভারত কাজে লাগায় পাকিস্তানের চেয়ে আগে। ভারতে গণতন্ত্র আসে, পাকিস্তানে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়। চীন স্বাধীন হয় পাকিস্তান ও ভারতের দু’বছর পরে -অগ্রগতি অর্জন করে এই দু’দেশের অনেক আগে। ভিয়েতনামে শতাব্দীর নৃসংশতম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অবসান হয় বাংলাদেশেরও কয়েক বছর পরে। শত্রুর মুখে ছাই ছুড়ে দিয়ে ভিয়েতনাম এগিয়ে গেছে, আজ তাকে তোয়াজ করার জন্য তার প্রাক্তন সাম্রাজ্যবাদী শত্রু এগিয়ে এসেছে। আমরা শুধু অপরকে দোষ দিতে জানি। আমরা আমাদের দুর্গতির জন্য দোষ দেই ইংরেজদের, দোষ দিই হিন্দুদের, দোষ দিই পাঞ্জাবীদের। ভারতের মূর্ত ও বিমূর্ত জিনিশে বাংলাদেশ প্লাবিত হয়েছে, ব্যাপক চোরাচালান হচ্ছে, সে-জন্য দোষ দিচ্ছি ভারতকে। অন্যকে দোষারোপ করার আগে নিজেদের চরিত্র পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

আমরা বিভ্রান্ত বলেই, আমরা যুক্তিবাদী নই বলেই, এ কাজ করি। গত কুড়ি বছর যাবত বামপন্থী দলের নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোর ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অব্যাহতভাবে গালাগালি দিয়ে এসেছেন। মৌলবাদীরা অতি ধূর্ত। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু তারা যখন এনজিওদের গালাগাল দেয়া শুরু করল তখন অবিলম্বে বামপন্থীরা এনজিওদের পাশে যেয়ে দাঁড়ালেন। সমস্ত ব্যাপারটা বিচার-বিশ্লেষণ করে ধীরস্থিরভাবে কাজ করা উচিত ছিলো। ফতোয়াবাজ ও এনজিও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

মাও সেতুঙ তাঁর নিজের দেশের সর্বনাশের জন্য দায়ী করেছেন ‘তিন অমঙ্গলের’ : অপচয়, আমলাতন্ত্র ও দুর্নীতি; আমাদের দেশে এই তিনটির সঙ্গে যোগ হয়েছে আর একটি : অর্থহীন ভাবাবেগ। অপচয়ের ক্লাসিক উদাহরণ বাংলাদেশ। কাগজের জন্য ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবই ছাপা যাচ্ছে না, তাদের খাতাপত্রের অভাব, মূল্যবান গ্রন্থাবলি প্রকাশে বিঘ্ন ঘটছে, কিন্তু রাজধানীর দেয়ালগুলো পোষ্টারে প্লাবিত। আমাদের শ্রেষ্ঠ নেতারা ৫০ এবং ৬০-এর দশকে রাজনীতি করেছেন, স্বাধিকার আন্দোলন করেছেন, অল্প কয়েকটি হাতে-গোনা পোষ্টার দেয়ালে সেঁটে দিয়ে। মানুষ তাতেই সাড়া দিতো। সচিত্র বহুবর্ণ পোষ্টারের প্রয়োজন ছিল না। আজ শুধু চালডাল নয় যখন কাগজও আমদানী করতে হচ্ছে তখন ঢাকার দেয়ালগুলো পোষ্টারের ভার বহন করতে পারছে না। প্রয়োজনেও পোষ্টার অপ্রয়োজনেও পোষ্টার।

যারা সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর নয়, এ যুগে তারা তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারবে না। ভাষা ও সংস্কৃতির লড়াইতে আমরা প্রতিপক্ষকে পরাভূত করেছি বাহান্নাতে। একাত্তরে পরাজিত করেছি রাজনৈতিক শত্রুকে। কিন্তু অর্থনীতিতে অগ্রগতি ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে না পারার ফলে অতীতের সমস্ত অর্জন—রাজৈনৈতিক ও সাংস্কৃতিক—নস্যাৎ হওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা অন্যকে পরাজিত করেছি, হেরে যাচ্ছি নিজেদের কাছে। পশ্চিমের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিহত করার শক্তি হারিয়ে ফেলছি শুধু অভাবের কারণেই নয় স্বভাব-দোষেও। এমনটি হচ্ছে কারণ আমরা একুশের চেতনা থেকে সরে এসেছি।

১১.

তবু হতাশাকে আমরা প্রশ্রয় দেবো না। যতক্ষণ আমরা বেঁচে আছি মাথা উঁচু রাখতেই হবে। শাসক ও সমাজপতিদের ব্যর্থতার গ্লানি মুছে দিতে অনাগত সময়ে দেখা যাবে বারবার একদল তরুণ বাঙালির ভাষা-আন্দোলনের চেতনায় বিস্ফোরিত হবে জাতির স্বার্থ সংরক্ষণের প্রেরণা থেকে। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, একুশের তাৎপর্য অনির্বাণ থাকবে আগামী শত শত বছর, একুশের তাৎপর্য অম্লান থাকবে যতদিন পৃথিবীতে একজন বাঙালিও বেঁচে থাকবে। এ কোনো আবেগের কথা নয়। যখন যেকোনো অপশক্তি বাঙালির যেকোনো ধরনের অধিকার হরণ করার অপচেষ্টা করবে তখনই তারমধ্যে জেগে উঠবে একুশের চেতনা। যখনই কোনো অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হবে বাঙালির ওপর তখনই তার মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে একুশের চেতনার অনির্বাণ শিখা। যখনই বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসবে, বাঙালি সমাজের ওপর আঘাত আসবে, যখনই বাঙালিকে রাজনৈতিকভাবে বিপন্ন করার ষড়যন্ত্র হবে, যখনই বাঙালিকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার পরিকল্পনা হবে, যখন বাঙালির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা দেখা দেবে, তখনই ভাষা- আন্দোলনের চেতনা তাকে পথ দেখাবে। সেখানেই একুশের তাৎপর্য। *

*

১৯৯৫-এর একুশের ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীতে প্রদত্ত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি স্মারক বক্তৃতা’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *