কনফুসিয়াসের শিক্ষা ও দর্শন

কনফুসিয়াসের শিক্ষা ও দর্শন

চৈনিক সভ্যতা পাঁচ হাজার বা সাত হাজার বছরের অথবা আরো বেশি প্রাচীন। কিন্তু সকল সভ্যতারই উত্থান, বিকাশ ও পতন ঘটে। এক সময়ের সভ্য সমাজ অন্য সময়ে ধ্বংসের প্রান্তে উপনীত হয়। তখন আবার নতুন সভ্যতা নির্মাতাদের আবির্ভাবের প্রয়োজন হয়। কমিউনিস্ট বিপ্লব-পূর্ব, বিশেষ করে প্রজাতন্ত্র-পূর্ব, চীনের এক মহান সভ্যতা ও সমাজের নির্মাতা কনফুসিয়াস। তিনি প্লেটো বা ইমানুয়েল কান্টের মতো ‘বিশুদ্ধ’ দার্শনিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মহাজ্ঞানী- প্রধানত একজন লোক-শিক্ষক। তাঁর কর্ম, চিন্তাধারা ও উপদেশসমূহই তাঁর দর্শন। তাঁর জীবন থেকে তাঁর দর্শনকে পৃথক করার উপায় নেই। জীবন ও জগৎ যতোদূর সম্ভব আদর্শরূপে গড়ে তোলার জন্য যে-সকল উপায় তিনি গভীরভাবে চিন্তা করে খুঁজে বের করেছিলেন সেগুলোই তাঁর মহান শিক্ষা ও দর্শন।

কনফুসিয়াসের শিক্ষা তিনটি প্রধান ধারায় প্রবাহিত : নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মীয়। যদিও এগুলোর মধ্যে তাঁর নৈতিক শিক্ষাই চৈনিক সমাজের ওপর সবচেয়ে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। বুদ্ধিবৃত্তিক বা ইনটেলেকচুয়াল শিক্ষা তাঁর নৈতিক শিক্ষার একটুখানি নিচের ধাপ মাত্র। তাঁর ধর্মীয় শিক্ষা হলো তাঁর নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তি শিক্ষার এক সমন্বিত আধ্যাত্মিক রূপ।

পূর্ব চীনের সানদঙ প্রদেশের একটি অঞ্চলের নাম লূ। এই লু-এর রাজধানী কু-ফু নগরীর নিকটবর্তী কেউই এলাকায় খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১ অব্দে কনফুসিয়াসের জন্ম। তাঁর পিতামহের অবস্থা ভালো না থাকলেও, তাঁর পিতা শু নিয়াঙহে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন, তাঁর পদবী ছিলো ‘সিটি মেজর’। তাঁর মা য়েঙ চেং-সাই ছিলেন বিদূষী ও নির্মল চরিত্রের অধিকারী। যখন কনফুসিয়াসের বয়স মাত্র দু-তিন বছর তখন তাঁর পিতা মারা যান। কনফুসিয়াসের চৈনিক নাম কোঙ কিউ বা কোঙ ঝোঙনি। স্বদেশের তিনি কোঙ ফূ-জু বলে পরিচিত যার অর্থ ‘কোঙ এর মহাশিক্ষক’। কোঙ ফু-জু লাতিন ভাষায় হয়েছে কনফুসিয়াস।

অল্প বয়সেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ করেই তিনি জীবন কাটিয়ে দেবেন। যৌবনের শুরুতেই তিনি প্রাচীন জ্ঞান সংগ্রহ ও বিচার বিশ্লেষণে মন দেন। ১৯ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন এবং সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। নানা রকমের পদে তিনি কাজ করেন। কখনো সরকারি গুদাম-রক্ষক, কখনো হিসাব-রক্ষক, কখনো আয়কর কর্মকর্তা প্রভৃতি। তা ছাড়া ‘রু’ নামে একটি চাকরি করেছেন যার কাজ হলো মানুষের জন্ম-মৃত্যুর হিসাব রাখা। তার মধ্যে তিনি ‘ছয়-কলা’য় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এই ছয়- কলা হলো : সদাচারণ, সংগীত, ধনুর্বিদ্যা, শকট চালনা, সাহিত্যচর্চা ও অংক শাস্ত্র।

কয়েক বছর চাকরি করার পর তিনি ইস্তাফা দিয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। দেশের নানা এলাকা পরিভ্রমণ করেন। তরুণদের মধ্যে তাঁর জ্ঞান বিতরণ করতে থাকেন। সামন্তবাদী সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ছিল বিস্তর। তাঁর শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমাজের নিচের স্তরের মানুষও থাকতো। তিনি ঘোষণা করেন : ‘শিক্ষার-ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য ও উচু-নিচু ভেদাভেদ নেই। সকলেরই রয়েছে মেধা অনুসারে শিক্ষার সমান অধিকার।

কনফুসিয়াসের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। রাজার দৃষ্টিও তিনি আকর্ষণ করেন। প্রথমে তিনি ব্লু-এর রাজপ্রাসাদে এক বড় কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। তারপর পূর্তমন্ত্রী এবং অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু নানা ব্যাপারে শাসকের সঙ্গে তার মতানৈক্য ও দেখা দেয়ায় তিনি রাজকার্য ছেড়ে দিয়ে শিষ্যদের নিয়ে গোটা দেশ ভ্রমণে বেরোন। বিভিন্ন রাজ্যের শাসকগণ তাঁকে সম্মান দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করেননি। ৪৭৯ খ্রিস্টপূর্ব অব্দে লূ-তে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর শিষ্য সংখ্যা ছিলো তিন হাজার। কিন্তু হাজারখানেক বছরের মধ্যে চীনের কোটি কোটি মানুষ তার অনুসারী হয়।

কনফুসিয়াসের মৃত্যুর পর তাঁর ছাত্ররা তাঁর বাণী আর শিক্ষাপ্রণালীকে গ্রন্থভুক্ত করার উদ্যোগ নেন। আজ ‘কনফুসিয়াসের এনালে’ বলে যে গ্রন্থগুলো প্রচলিত সেগুলোর কোনোটিই যে তাঁর নিজের সঙ্কলিত, সে প্রমাণ নেই। বর্তমানে প্রচলিত তাঁর কুড়িটি গ্রন্থ মোট ৪৯৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এগুলোতে তাঁর সামাজিক, ধর্মীয়, নৈতিক, রাজনৈতিক, শিল্পকলা বিষয় আর অন্যান্য দর্শন সঙ্কলিত। ধীরে ধীরে এইসব মৌলিক তত্ত্বের প্রচুর পরিমাণে টীকা ভাষ্য ব্যাখ্যা রচিত হয়েছে বিভিন্ন পণ্ডিতের দ্বারা। আর সে কারণেই কনফুসীয় সাহিত্যের পরিমাণ বিপুল।

পন্ডিতমহলে অনুমোদিত কনফুসিয়াসবাদের তেরটি গ্রন্থ রয়েছে। এগুলো হলো :

১. ই চিয়াং বা পরিবর্তনের মহাগ্রন্থ।

২. পু চিয়াং বা ইতিহাসের মহাগ্রন্থ।

৩. শিহ্ চিয়াং বা কাব্যের মহাগ্রন্থ।

৪. চৌ লি বা চৌ-এর আচার।

৫. ই লি বা আচার ও আনুষ্ঠানিকতা।

৬. লি চি বা আচার-প্রথার দলিল।

৭. সো চুয়ান বা সো-এর ভাষ্য।

৮. কুং-ইয়াং চুয়ান বা কুং-ইয়াং-এর ভাষ্য।

৯. কুং-লিয়াং চুয়ান বা কুং-লিয়াং-এর ভাষ্য

১০. লুন উ বা এনালেক্‌সমূহ।

১১. শিয়াও চিং বা সন্তানোচিত কর্তব্যবোধ।

১২. এর ইয়া বা অভিধান।

১৩. মেঙ-জু বা মেনসিয়াস।

জীবনের শেষ দিকে কনফুসিয়াস তাঁর নিজের লু-রাজ্যের এক বছরওয়ারী ইতিহাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন। ওই ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮১ অব্দের ধারাবাহিক ঘটনার বর্ণনা আছে। এই গ্রন্থটির নাম ‘বসন্ত ও শরৎ বিষয়ক গ্রন্থ’। উল্লেখ করা যেতে পারে, খ্রিস্টপূর্ব ৭৭০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৬ অব্দ ছিলো লু-রাজ্যের ‘বসন্ত ও শরৎ যুগ’।

যদিও চীনের সভ্যতা ও সংস্কৃতি হাজার হাজার বছরের পুরনো এবং অত্যন্ত সমৃদ্ধ, তবু যেকালে কনফুসিয়াসের জন্ম, তখন চীনের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বিশৃঙ্খল। তখন চীন ছিল নামেমাত্র অখন্ড এক দেশ, যেখানে নামেমাত্র একজন সম্রাট ছিলেন। বিভিন্ন সামন্তরাজাদের অধীনে একেক অঞ্চলে, একে রাজ্যে এক ধরনের দ্বৈতশাসন ছিল প্রচলিত। প্রজাদের দুর্দশার ছিল না অন্ত। স্বৈরশাসকরা সাধারণ মানুষকে শোষণ-নিপীড়ন করে বিলাসী জীবনযাপন করতো। পুরনো মূল্যবোধ থেকে সাধারণ মানুষও সরে গিয়েছিল দূরে। সমাজে ছিল না লেশমাত্র ন্যায়নীতি। তাই নীতিভ্রষ্ট সাধারণ মানুষের সীমাহীন দুঃখে পীড়িত হন কনফুসিয়াস। তিনি সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা এবং ব্যক্তিজীবন আর পরিবারে সুখসমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে শুরু করেন নীতিজ্ঞান প্রচারের কাজ।

কনফুসিয়াসকে একজন ধর্মগুরু বলে গণ্য করা হলেও, বস্তুত তিনি তা নন। তিনি নিজেও সে-দাবি করেননি। অতিজাগতিক বা দৈব ব্যাপারে তিনি অতি অল্পই আলোচনা করেছেন। পরকাল প্রসঙ্গেও তাঁর বিশেষ উৎসাহ ছিল না। তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ নীতিবাদী দার্শনিক। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনই ছিলো তাঁর জীবনের মূল ব্রত। তিনি তাঁর পূর্ববর্তীদের নীতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করে সেগুলোর ভিত্তিতেই তাঁর নিজস্ব দর্শন প্রচার করেন। যদিও তিনি বিনয়ের সঙ্গে দাবি করেন যে, তিনি কোনো নতুন দর্শনের স্রষ্টা নন। পুরনো দার্শনিক মতবাদের প্রচারক মাত্র। মানুষের সদাচারণের ওপরই তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। চীনের মানুষকে তিনি উপহার দেন এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।

কনফুসিয়াস ছিলেন মূলতঃ মানবতাবাদী দার্শনিক। প্রাচীনকালে যখন নানা রকম দেবদেবীর মাহাত্ম্যে মানুষ থাকতো মুখর, অতিপ্রাকৃতিক শক্তির বন্দনায় মানুষ পেতো অপার আনন্দ, তখন কনফুসিয়াস মানুষের মহত্ত্ব প্রচারে আবির্ভূত হন। তাঁর মতে, ‘সর্বোত্তম মানুষ’ প্রধানত দুটো গুণের অধিকারী, একটি ‘ জেন’ (Jen) আর অপরটি ‘ই’) (Yi)। ‘জেন’ হলো অপরের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। ‘ই’ গুণের অর্থ হলো সদাচারণ ও ন্যায়পরতা। তিনি বলেছেন, ‘জেন’ যদিও সকল মানুষের প্রতি ভালোসাকে বোঝায় কিন্তু এটির উৎপত্তি পিতামাতার প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তি থেকে যার নাম দিয়েছেন তিনি ‘পূর্ব পুরুষ পূজা’। কনফুসিয়াসের আগে চীনের সমাজে এই পুর্বপুরুষ পূজার প্রথা প্রচলিত থাকলেও, পরিবারের প্রতি আনুগত্য, পিতামাতার প্রতি ভক্তি আর প্রেমের ওপর তিনি তাঁর পূর্ববর্তী শিক্ষকদের চাইতে অনেক বেশি জোর দিয়েছেন।

সব ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও কনফুসিয়াস পরিবারকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেন, পরিবারই নৈতিক শিক্ষার প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান। পরিবারই ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সেতুবিশেষ। অবশ্য তাঁর আগেও চীনদেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাপারে পরিবারের ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ।

কনফুসিয়াসের মতে, সমাজে প্রধানত পাঁচ ধরনের মানবিক সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমন, ১. পিতা-পুত্রের প্রেমের সম্পর্ক, ২. শাসকের সঙ্গে প্রজার ন্যায়বিচারের সম্পর্ক, ৩. স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য প্রেম ও পৃথক দায়িত্বের সম্পর্ক, ৪. জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠের মধ্যকার প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক, এবং ৫. বন্ধুদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক। এই পাঁচ ধরনের সম্পর্কের তিনটিই পরিবারে বিদ্যমান। প্রত্যেকেই যদি তাদের দায়িত্ব আর অন্যের প্রতি করণীয় সম্পর্কে সচেতন থাকে তা হলে শুধু পরিবারেই নয়, সমাজে ও রাষ্ট্রে সুখশান্তি নিশ্চিত হতে পারে বলে কনফুসিয়াস মনে করতেন।

কনফুসিয়াসের জীবনকালে চৌ বংশীয়রা ছিলেন চীনের শাসনকর্তা। চৌ শাসনকর্তারা তাঁর শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো মর্যাদা দেননি। কনফুসিয়াস নিজে রাষ্ট্রীয় জীবনে তাঁর দর্শনের প্রয়োগ দেখে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শিক্ষা অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, শাসকদের কাছেও তাঁর দর্শন ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ২২১ অব্দে চি’ইন রাজবংশের শাসকদের আবির্ভাব ঘটলে কনফুসিয়াসের মতবাদ রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়। প্রথম চি’ইন সম্রাট শি হুয়াং তি-র শাসনকালে কনফুসিয়াসবাদ নির্মূল করার জন্য যাবতীয় উদ্যোগে নেয়া হয়। তাঁর সমর্থকদের হত্যা পর্যন্ত করা হয়। তাঁর মতবাদসংক্রান্ত প্রায় যাবতীয় গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু শাসকদের এই উন্মত্ততায় কনফুসিয়াসের দর্শনের বিশেষ ক্ষতি হয়নি, সাধারণ মানুষের মন থেকে তা মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। চিইন রাজবংশের পতনের পর দীর্ঘদিন চীন শাসন করেছেন হান বংশীয় শাসকরা। তাঁদের রাজত্বকাল ছিলো সোয়া চারশো বছর অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ অব্দ থেকে ২২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী। হান শাসকরা কনফুসিয়াসবাদকে চীনের রাষ্ট্রীয় দর্শন বলে ঘোষণা দেন। তখন থেকেই রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যেই শুধু নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়েও কনফুসিয়াসের চিন্তাধারার ব্যাপকভাবে চর্চা হতে থাকে যা অব্যাহত থাকে এ শতকের দ্বিতীয় দশকে চীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত। কনফুসিয়াসের পরবর্তীকালে চীনে তাওবাদ আর বৌদ্ধধর্মের প্রসারের পরেও তাঁর জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ণ হয়নি।

গত দু’হাজার বছর ধরে চীনের প্রশাসনব্যবস্থা পৃথিবীব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এই সময়সীমার ভেতরে চীনই ছিলো পৃথিবীতে সব থেকে সুশাসিত ভূখণ্ড। দু’হাজার বছরের মধ্যে অল্প কিছু সময় বাদে প্রায় সমস্ত সময় জুড়েই সে-দেশের প্রশাসনিক কাঠামো ও দক্ষতা ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ় ও সুশৃঙ্খল।

চীনে অসাময়িক কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য এক কঠোর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করা হয় শত শত বছর আগে। আমলা নিয়োগের এই প্রক্রিয়ায় (পরীক্ষায়) পরীক্ষার্থীকে কনফুসিয়াসীয় চিন্তাধারায় অবশ্যই পারদর্শী হতে হতো। আর এইভাবে চীনের শক্তিশালী আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পেছনে কনফুসিয়াসের শিক্ষা অসামান্য কাজ করেছে। কনফুসিয়াস শুধু দার্শনিক ছিলেন না, ছিলেন সমাজ ও রাজনীতিরও একজন মহান সংস্কারক। আত্মশুদ্ধি আর আত্মউন্নতির ওপরই তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন।

১২৪ খ্রিস্টাব্দে চীনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবিষয় হিসেবে কনফুসিয়াসের মতবাদকে অবশ্যপাঠ্য করা হয়। দর্শন, শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও ধর্মীয় বিষয়ে কনফুসিয়াস হয়ে ওঠেন তখন থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্থীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কনফুসিয়াসের জনপ্রিয়তার অন্যতম লক্ষ্য তাঁর সারল্য, কেননা তিনি মানুষকে এমন কোনো শিক্ষা দেননি যা পালন করা তার পক্ষে কঠিন।

নির্মল চরিত্র গঠনের ওপর তিনি জোর দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। তাঁর মতবাদে আটটি ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে আর সেগুলো হলো :

১. কোনো বস্তু ও বিষয়ে অনুসন্ধিৎসা, ২. জ্ঞানের প্রসার ঘটানো, ৩. আন্তরিক ইচ্ছাশক্তি, ৪. মনের শুদ্ধিকরণ, ৫. ব্যক্তিগত জীবনে নীতির অনুশীলন, ৬. পরিবার নিয়ন্ত্রণ, ৭. রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, এবং ৮. পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন। এসবই জাগতিক বিষয়। তবে কনফুসিয়াসবাদে রয়েছে কিছু ধর্মীয় ও অধিবিদ্যার বিষয়ও। সবকিছুর উর্ধে কনফুসিয়াস জোর দিয়েছেন সাধুতা ও সরলতার ওপর। যে ব্যক্তি সৎ ও সরল সে নিজেকে ‘সর্বোত্তম মানুষ’ রূপে গড়ে তুলতে পারে এবং সে অপরের চরিত্র বিকাশেও রাখতে পারে ভূমিকা। কনফুসিয়াসের প্রধান অনুসারী, চীনের আর একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মেনসিয়াস (খ্রিস্টপূর্ব ৩৭১-২৮৯) কনফুসিয়াসের সাধুতা ও সারল্যের মতবাদকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি কনফুসিয়াসবাদকে আরো প্রসারিত করেছেন। মেনসিয়াস বলেছেন, মানুষ মূলতঃ ভালো, তবে তার স্বভাবের আরো উৎকর্ষ সাধন করতে হলে গভীর অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমেই সেটা করা সম্ভব। অন্যদিকে কনফুসিয়াসের আরেক শিষ্য সু-জু’র মতে, মানুষ মূলত মন্দ; কিন্তু সে অনুশীলনের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে। শিষ্টাচার অনুশীলন, আচার অনুশীলন, সঙ্গীতের চর্চা, আইনানুগত্য ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ ভালোত্ব অর্জন করে। যাহোক, কনফুসিয়াসের শিষ্যদের সবাই ব্যক্তির নৈতিক উৎকর্ষ সাধন, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা আর রাজনৈতিক সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন।

কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রীয় দর্শন অত্যন্ত উদার। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্র হবে বিশাল একটি পরিবারের মতোই। পরিবারের প্রধান যেমন স্নেহ-ভালোবাসায় সকল সদস্যের শ্রদ্ধা অর্জন করেন, তেমনি সরকার ও রাষ্ট্রের প্রধানদেরও হতে হবে উদার ও স্নেহশীল। কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রনীতিতে নিষ্ঠুরতার কোনো স্থান নেই। রাষ্ট্রশক্তি প্রজাপীড়ন করবে, সেটা তিনি মোটেই অনুমোদন করেননি। রাজার লক্ষ্য হবে রাজ্যের ও প্রজার অব্যাহত কল্যাণসাধন। যেমন একজন পিতা তাঁর সন্তানসন্ততির মঙ্গলের জন্য চেষ্টা করেন। কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রীয় দর্শন চীনে সামন্তবাদ পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং একধরনের ‘শ্রেণীহীন সমাজ’ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।

কনফুসিয়াস অত্যন্ত জোর দিয়েছেন সুশাসন ও ভালো সরকারের উপর। এ সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে একটি কাহিনী। একদিন তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে পার্বত্য এলাকার অরণ্যের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। বনের একেবারে ভেতরে তিনি দু’একটি বাড়িঘর দেখতে পেলেন। কৌতুহলবশত সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন এক মহিলা কাঁদছে। কারণ জিজ্ঞেস করায় মহিলা বলল যে তার চাচা, পিতা এবং অল্প আগে তার পুত্রকে বাঘে হত্যা করেছে। শুনে তিনি বললেন, এই বনের মধ্যে বাস করলে তো বাঘ-ভালুতে মারবেই। তিনি পরামর্শ দিলেন নিরাপদ লোকালয়ে চলে যাবার। শুনে মহিলা বলল, লোকালয়ের অবস্থা কি জঙ্গলের চেয়ে ভালো? সেখানে হানাহানি রক্তারক্তি তো জঙ্গলের চেয়ে বেশি। মহিলার এই কথা থেকে তিনি এক বড় সত্যের সন্ধান পেলেন। তিনি তাঁর শিষ্যদের বললেন, ‘শুনেছো, একটি স্বৈরশাসক বাঘের চেয়ে ভয়ঙ্কর। “A tyranical government is even more frightening than tigers.” সেই জন্যেই আমরা একটি ভালো সরকারের ওপর জোর দেই। “You see, my dear disciples, this is all the more reason why we should pursue a government of virtue for the country.” ভালো সরকার শুধু চীনের জন্য নয় পৃথিবীর সকল দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পাশবিক স্বৈরশাসন কাকে বলে বাংলাদেশের মানুষ তা একাত্তরে প্রত্যক্ষ করেছে। ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খানরা যে উম্মত্ত বাঘের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর ছিলো তা বাঙালিদের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। সুন্দরবনের বাঘ বছরে পাঁচ দশ জন মানুষ হত্যা করে, ইয়াহিয়া-টিক্কা-ফরমান আলিরা মিনিটে দশ বিশজন হত্যা করতো।

কনফুসিয়াসের নীতি অনুসারে শাসনকর্তা হতে হবে নীতিবাদী। তিনি রাজ্য চালাবেন নৈতিকতার ভিত্তিতে, বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়। তাঁর মতে, একজন ভালো ও নীতিবাদী শাসকই ভালো আইন প্রণয়ন করতে পারেন। শাসককে হতে হবে সুশিক্ষিত ও চিন্তাশীল। মানুষকে যতদূর সম্ভব বেশি ব্যক্তিস্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে সে উৎকর্ষ অর্জনের সুযোগ পায়। প্রজার অপরাধের শাস্তিও হতে যতদূর সম্ভব লঘু

কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক দর্শনে গণতান্ত্রিক চেতনার প্রকাশ ঘটেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাজা ঈশ্বরের নন, বরং পুরোমাত্রায় জনসাধারণেরই প্রতিনিধি। কনফুসিয়াসের যোগ্যতম ও প্রধান অনুসারী মেনসিয়াস ঘোষণা করেছেন, মানুষই সবকিছুর মানদণ্ড। প্রথমেই মানুষের স্থান, তারপরে রাষ্ট্র এবং সবশেষে শাসক। শাসকের গুরুত্বই সবচেয়ে কম। রাজতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র, তার সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি কোনো রাজা সুশাসন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার আর রাজা থাকার অধিকার নেই। কুশাসকের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটানোর সম্পূর্ণ অধিকার প্রজার রয়েছে। কনফুসিয়াসপন্থীদের মতে, প্রজাদের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটাতে হবে শাসন কাজে, এখানে রাজার ব্যক্তিগত ইচ্ছার গুরুত্ব অল্প। এই নীতিতে পুরোপুরি গণতন্ত্রেরই জয়গান উচ্চারিত হয়েছে, অস্বীকার করা হয়েছে রাজার দৈব-অধিকার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ধারণা, কনফুসিয়াসদের এই নীতিই ১৯১১ সালে চীনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিল।

চীনের যে দক্ষ সিভিল সার্ভিসের কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে সেটা প্রকৃতপক্ষে কনফুসিয়াস পন্থীদেরই দান। চীনে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব গঠনে এই মতবাদ বড় ভূমিকা পালন করেছে। ধর্ম, বর্ণ, সামাজিক অবস্থান ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যোগ্যতা অনুসারে যে কেউ যে-কোনো পদে নিয়োজিত হতে পারেন বলে কনফুসিয়াস মনে করতেন! কনফুসিয়াসের প্রভাবে চৈনিক আভিজাত্য শুধু বংশমর্যাদায় নয় কর্মগুণে বিবেচিত হতে থাকে। যোগ্যতার উপর জোর দেয়া হয়, বংশের ওপর নয়। এই নীতির ভিত্তিতে প্রায় দেড় হাজার বছর চীনের বহু সরকারি কর্মকর্তা নিচু অবস্থান থেকে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিলেন কেবল নিজেদের যোগ্যতা প্রদর্শন করে।

সকল মহামানবকেই বিচার করতে হবে তাঁর কালের প্রেক্ষাপটে। আড়াই হাজার বছর আগের চীনের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতেই কনফুসিয়াস বিচার্য। আজ অনেক ব্যাপারে মনে হতে পারে, তিনি আর এমন কি মূল্যবান কথা বলেছেন। এ সব তো সকল ভালো মানুষই জানে। আজ তাঁর অনেক বক্তব্য মনে হবে প্রগতিবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল, যেমন তাঁর নারীসম্পর্কিত মতামত। তিনি নারীকে ঘরের ভেতরে বন্দি রেখে সাংসারিক কাজকর্মে, সন্তান প্রতিপালনে, পিতা, স্বামী ও পুত্রের অধীনে রাখারই পক্ষপাতী ছিলেন। গৃহের আঙিনার বাইরে তার কোনো কর্মের জগৎ থাকবে না। পর-পুরুষের সংস্পর্শে আসাও তার জন্যে নিষেধ। তিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ The Book of Poetry-তে বলেছেন :

When a daughter to the family is born,
Bring her up to be gentle and mild,
Make sure she does no evil or harm.
She is expected only to cook food and brew wine.
And cause no worries to her father or mother.

অর্থাৎ কনফুসিয়াসের মতে, তাকেই বলা হবে গুণবতী নারী যে জানে কাপড় বুনতে, মদ চোলাই করতে, রান্নাবান্না করতে এবং পিতামাতাকে কষ্ট না দিতে। A woman was regarded as virtuous if she knew how to weave cloth, make wine and cook meals, without coursing trouble to her parents.

তিনি বলেছেন, একজন নারীকে ‘বিয়ের আগে তার পিতার পরামর্শ মতো চলতে হবে, বিয়ের পরে তার স্বামীর আদেশ এবং স্বামীর মৃত্যুর পর তার পুত্রের পরামর্শ মতো।’ তিনি আরো বলেছেন, প্রতিভাহীনতাই নারীর বৈশিষ্ট্য— Lack of talent is a virtue in women. শুধু নারীবাদী নন কোনো মানুষই এ কথায় সমর্থন দিতে পারে না। তাঁর এই শিক্ষা আমাদের কাছে আজ মনে হবে হাস্যকর। আজ তাঁর জন্মস্থান কু- ফুতেই নারী জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার স্থান করে নিয়েছে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে তাঁর মতবাদ মূল্যহীন ছিল। নতুন এক সমাজ নির্মাণের কালে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার ভিত্তি শক্ত করার প্রয়োজনে তাঁর এই শিক্ষা সেখানে নিশ্চয়ই বড় ভূমিকা পালন করেছিলো। যৌন অনাচারের পথ রোধ করেছিলো। তারপর যুগের প্রয়োজনে পরবর্তীকালে নতুন দর্শনের সূচনা হয়েছে।

কোনো মহামানবের শিক্ষা, চিন্তাধারা ও দর্শন শুধু যেমন তাঁর নিজের কালের গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ থাকে না- ভবিষ্যতের মানুষকে পথ দেখাতেই থাকে, তেমনি তা শুধু তাঁর নিজের দেশের ও সমাজের মধ্যেও আবদ্ধ থাকে না : সমগ্র মানবজাতিই তাঁর শিক্ষা থেকে কোনো-না-কোনোভাবে উপকৃত হয়। কনফুসিয়াসের চিন্তা ও দর্শন শুধু চীনের সমাজে নয়, জাপানে নয়, কোরিয়ায় নয় ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের নৈতিক জীবনকেও প্রভাবিত করে থাকবে। যদিও কনফুসিয়াসের কোনো অনুসারী এ অঞ্চলে নেই। নৈতিক শিক্ষার কোনো স্থান-কালপাত্র নেই। তা সর্বজনীন। যে-কোনো সমাজ, যে-কোনো জাতি ও যে-কোনো রাষ্ট্র তাঁর শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারে। *

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

Chen Jingpan, Confucius as a teacher ong Shu’an, Confucius

Wang Chih-hsin, The Philosophy of Confucius

P. D. Bergan, The Sages of Shantung

M. M. Dawson, The Ethics of Confucius

R. K. Douglas, Confucianism and Taoism

Leonard Shihlieu Hsu, The Political Philosophy of Confucianism.

Yu-Tang Lin, The Wisdom of Confucius

Tames Legge, The Life and Teachings of Confucius

W. G. Walshe, Confucius and Confucianism

—-

* ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গোবিন্দ দেব সেন্টার ফর ফিলজফিক্যাল স্টাডিজ’-এ প্রদত্ত প্ৰবন্ধ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *