বাঙালি জাতি, বাঙালি মুসলমান, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ
The element behind patriotism is nationality.
-Ibn Khaldun, The Muqaddimah
Nationalism is a doctrine invented in Europe at the begining of the nineteenth century. Briefly, the doctrine holds that humanity is naturally divided into nations, that nations are known by certain characteristics which can be ascertained, and that the only legitimate type of government is national self-government.
-Elie Kedourie, Nationalism, (1994) p. 1
১.
আবু জাফর শামসুদ্দীন (১৯১১-৮৮) ছিলেন একজন বাঙালি মুসলমান লেখক ও বুদ্ধিজীবী। তিনি ছিলেন প্রথমত একজন বাঙালি, দ্বিতীয়ত একজন মুসলমান। এবং এই দুইয়ের সমন্বয়ে বাঙালি মুসলমান : এটিও তাঁর একটি স্বতন্ত্র পরিচয় এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। এই পরিচয় দ্বারা তিনি যে সত্তা অর্জন করেন তা হলো তিনি একজন বাঙালি হয়েও একজন বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি বৌদ্ধ থেকে স্বতন্ত্র। অন্যদিকে এই পরিচয় দ্বারা তিনি যে মানুষটিতে পরিণত হন তা হলো তিনি মুসলমান বটে কিন্তু একজন বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি বৌদ্ধ বা বাঙালি খ্রিষ্টানের মতোই একজন বাঙালি: ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির সমন্বয়ে গঠিত বাঙালি জাতির তিনি একজন। সেই বাঙালিত্ব অর্জনে তাঁর মুসলমানিত্ব কোনো বাধা নয়—একজন হিন্দু বাঙালির সঙ্গে তাঁর কোনো-কোনো বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য থাকলেও কিছুমাত্র বিরোধ নেই। সে-কারণেই নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিতে তাঁর একটুও হীনম্মন্যতা ছিল না। তাই বাঙালিত্বের জন্যে ছিল তাঁর অসামান্য অহঙ্কার।
এই বাংলাদেশে যার জন্ম কুড়ি শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতে তার আত্মপরিচয় নিয়ে নানা রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিষয়টি আবু জাফর শামসুদ্দীনকে ভাবিত করেছে এবং তা নিয়ে তিনি লেখালেখিও করেছেন। তাঁর মন জানবার জন্য আমরা তাঁর আত্মজীবনী ‘আত্মস্মৃতি’ পাঠ করতে পারি। তাতে শতাব্দীর প্রথম আট দশকের পূর্ব বাংলার একজন বাঙালি মুসলমানকে পাওয়া যায়। একজন গড়পড়তা বাঙালি মুসলমানের পক্ষে ১৯২০-এর দশক থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত যতোটা মুক্তমনের অধিকারী হওয়া সম্ভব আবু জাফর শামসুদ্দীন ততোটা হওয়ার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। ‘সাধ্যমতো’ বললাম এ কারণে যে বিভ্রান্ত হওয়ার মতো পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও চাপ ছিল প্রবল। সেই চাপের মুখে কোনো বাঙালি মুসলমানের পক্ষে অবিচলিত থাকা প্রায় অসম্ভব ছিল। এই সময় মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও স্পেনের মুসলিম সভ্যতা বাঙালি মুসলমানের কাছে এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে যে তার পক্ষে বাংলাদেশের ও উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি কমই গুরুত্ব পেতে থাকে।
১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত একজন শিক্ষিত বাঙালির পোশাক-পরিচ্ছদের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে তিনি সকল বাঙালির মতো নন। বাঙালিত্বের অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বাইরেও তার একটি আলাদা আত্মিক ও বাহ্যিক পরিচয় রয়েছে, তাকে সামগ্রিকভাবে বিচারের জন্যে যা মোটেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং পরিত্যাজ্যও নয়— ওটা ছাড়া তার চলে না বলে সে মনে করে। তাই বাঙালি মুসলমানের শুধু একটিমাত্র ভাষা—তার মাতৃভাষা বাংলাতেও তার তৃষ্ণা মেটে না। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে সরকারি ভাষা ইংরেজিতেও তার মন ভরে না, তাকে সে আপন মনে করতে পারে না। সে মনে করে বিদেশি ইংরেজি নয় ‘মুসলমানদের ভাষা’ আরবি, ফারসি বা উর্দু জবানও তার কিছু আয়ত্তে থাকা অতি আবশ্যক। সেগুলোর চর্চা ছাড়া সে যেন অসম্পূর্ণ। ‘ঠাকুর মার ঝুলি’র চেয়ে ‘আলেফ লায়লা’র কাহিনী তাকে বেশি মুগ্ধ করে। অতীশ দীপঙ্করের চেয়ে ইবনে সিনা বা আল গাজ্জালি তার নিকটতম। বল্লাল সেনের চেয়ে বৈরাম খাঁ তার আপন মনে হয়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের চেয়ে খলিফা হারুন-উর-রশীদ তার নিকটতম। পাজামা-পাঞ্জাবিতে কিংবা পাজামা-প্যান্ট-সার্টে অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের পরিচয়টি যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়, একটি শিরওয়ানি বা আচকান তার চাই। গরিব যে মুসলমান কৃষকটি তার জামা-জুতা কিছু থাক বা না থাক কোনো রকমে একটি লুঙ্গি ও পিরহান থাকলে তখন একটি কিস্তি টুপি ছাড়া তার মাথাও ঠাণ্ডা হয় না, বুকও শীতল হয় না। স্নো পাউডার প্রভৃতি সুগন্ধীর সঙ্গে একটুখানি আতর না হলে বাঙালি মুসলমানের মন ভরে না। যার অবস্থা ভালো এবং ভদ্রলোক বলে পরিচিতি ওডিকোলনের চেয়ে মেশকে আম্বর তার প্রিয়। একটা তুর্কি টুপিতে যে তার খোলতাই হয় তাই নয়, ওটি ছাড়া যেন তার মাথা খালি খালি ঠেকে। বেশি বইপত্র পড়ার প্রয়োজন নেই, আমাদের দেশের ১৯২০, ৩০, ‘৪০ এবং ‘৫০-এর দশকের মুসলমান রাজনৈতিক নেতাদের আনুষ্ঠানিক পোশাকের দিকে তাকালে বিষয়টি অনুধাবন করা সহজ হবে। বিভিন্ন সমাবেশ-সম্মেলন উপলক্ষে তোলা তাঁদের গ্রুপ পোর্ট্রেটগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাঁরা এমন পোশাকে সজ্জিত যা একজন হিন্দু বা বৌদ্ধের চেয়ে আলাদা। পোশাক আলাদা হয় মন আলাদা হলে। মন অর্থাৎ একজন মানুষের চিন্তা-চেতনার বিষয়টিই আসল। কারণ সে যে-ভাবে চিন্তা করে, আচরণে ও কাজে তারই প্রতিফলন ঘটে।
২.
একটি বিস্তীর্ণ, সমতল ও উর্বর ভূখণ্ড, একটি বিশাল বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী, একটি অতি সমৃদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতি, একটি প্রাচীন সভ্যতা, সুদীর্ঘ ইতিহাস ও অভিন্ন জীবনধারা ইত্যাদি থাকার ফলে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র গঠনের সকল সম্ভাবনা অনেক আগে থেকেই ছিল। হোসেন শাহী শাসকদের সময় (১৪৯৪-১৫৩৮) বঙ্গে একটি জাতিরাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল।
একটি রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডে বাঙালির জাতি গঠনে সবরকম বলিষ্ঠ উপাদান থাকা সত্ত্বেও ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই দিল্লির অবাঙালিদের দ্বারা শাসিত হওয়ায় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তার অভ্যুদয় ঘটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কি ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক, কি কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, কি মুসলিম লীগ নেতা কেউই চাননি বাঙালি একটি সুসংহত জাতি হয়ে উঠুক। তাঁরা বাঙালির জাতীয় সংহতি নষ্ট করতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্রটি সুকৌশলে প্রয়োগ করে সফল হন। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে বাঙালির একটি জাতিরাষ্ট্র গঠিত হলে তা হবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনবহুল শক্তিশালী রাষ্ট্র। বাঙালির যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তেমনি তার মেধা রয়েছে এবং তার জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য দীর্ঘকালের। অবাঙালি পশ্চিমী শাসকশ্রেণী জানতেন বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে মাড়োয়ারি, বোম্বেঅলা, ইসমাইলী খোজাদের সর্বভারতীয় ব্যবসায়ী স্বার্থ বিপন্ন হবে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে বিভেদের বীজ আগেই রোপিত হয়েছিল তাই ব্যবহার করা হলো বাংলা বিভাগের জন্য। এক ভাগ গেল পাকিস্তানে, আর এক ভাগ ভারতে। ইংরেজের সৃষ্ট ও অনুগত হিন্দু ও মুসলমান মধ্যশ্রেণীর নেতৃবৃন্দ বাংলা বিভাগে ভূমিকা পালন করতে চূড়ান্ত সাফল্যের পরিচয় দেন। কংগ্রেসের হিন্দু নেতাদের মৌখিক বিরোধিতা ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে। একপর্যায়ে কংগ্রেসও বাংলাবিভাগ দাবি করে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই বাঙালি মুসলমানের মধ্যে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে তা পশ্চিম পাকিস্তানি বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের নিষ্ঠুর শাসন-শোষণের প্রতিক্রিয়াপ্রসূত কারণে, অন্য কোনো কারণে নয়। এবং তাৎক্ষণিক কারণ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর শাসকদের নির্লজ্জ আঘাত। পূর্ব পাকিস্তানের বা পূর্ববঙ্গের মানুষের—হিন্দু মুসলমান-বৌদ্ধ নির্বিশেষে সকলের জাতীয়তাবাদী চেতনায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা— না হিন্দু না মুসলমান কেউই— সমর্থন দিয়ে সংহতি প্রকাশ করে এগিয়ে আসেননি। তারা— বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা দূর থেকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন, কিন্তু এ কথা কদাচ বলেননি যে আমরাও বাঙালি জাতীয়তাবাদী, আমরাও আপনাদের সঙ্গে একত্র হয়ে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করব; দিল্লির নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসার আগ্রহ অভিপ্রায় আকাঙ্ক্ষা মনোবল তাদের মধ্যে কিছুমাত্র লক্ষ্য করা যায়নি। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি-অবাঙালি মুসলমানরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে পাকিস্তান ধ্বংস করার ও মুসলমানদের ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে শঙ্কিত হয়েছে। সুতরাং ‘৪৭-উত্তর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা পূর্ব-বাংলার মানুষের নিজস্ব ব্যাপার, সকল বাঙালির এর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।
যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত তা এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জাতীয়তাবাদ : জাতীয়তাবাদের এক খণ্ডিত রূপ— অখণ্ড রূপ নয়। তা অনেকটাই ব্রিটিশ যুগের মুসলিম জাতীয়তাবাদেরই এক উন্নত সংস্করণ। দ্বিখণ্ডিত অবস্থায় পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মানুষরা দুই পরাশক্তির প্রভাবে ছিল বটে কিন্তু তাদের জার্মান জাতীয়তা দ্বিখণ্ডিত হয়নি তাদের একত্র হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং শেষ পর্যন্ত একত্র হওয়াই তার প্রমাণ। ভিয়েতনাম অনেকদিন দ্বিখণ্ডিত ছিল কিন্তু তাদের জাতীয়তা অভিন্ন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রে দুই কোরিয়া দু’ ধরনের শাসনব্যবস্থায় রয়েছে কিন্তু কোরীয় জাতীয়তার প্রশ্নে কোনো দ্বিমত নেই দুই দেশের কোরীয়দের। দুই বাংলার বাঙালিদের অবস্থা তেমনটি নয়। এই না থাকার একটিমাত্র কারণ ধর্ম: হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব—পশ্চিম বাংলার অধিকাংশ বাঙালি হিন্দু হওয়ার ফলে তারা ধর্মীয় কারণে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের ছায়ার নিচে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে; বাংলাদেশের বিপুল অধিকাংশ বাঙালি ইসলাম ধর্মাবলম্বী; তারা কষ্টেসৃষ্টে যেভাবেই হোক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কাঠামোতে থাকতেই চায়। সেই স্বাধীন স্বতন্ত্র থাকার আকাঙ্ক্ষাই তাদের জাতীয়তাবাদ এবং এই জাতীয়তাবাদের নামই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, কিন্তু তা সত্যি-সত্যি যে আধুনিক সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ নয়, এক ধরনের ‘মুসলিম বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, তার প্রকাশ ১৯৭৫-এর পর থেকে তো প্রকটভাবে ঘটেছেই—১৯৭২-৭৫-এও সে উপাদান অনুপস্থিত ছিল না। তবে ১৯৭২-৭৫-এ যা ছিল প্রচ্ছন্ন আজ তা প্রকট। মুসলিম জাতীয়তাবাদ থেকে মুসলিম মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে। পাকিস্তানে যেমন ঘোষিত ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, ভারতে অঘোষিত হিন্দুত্ব, তেমনি বাংলাদেশে আজ মুসলমানত্বের জয়জয়কার। আধুনিক জাতীয়তাবাদের প্রধান স্তম্ভ যে সেক্যুলারিজম— তার নামনিশানা উপমহাদেশের দেশগুলো থেকে উধাও হয়েছে– বাংলাদেশ থেকেও।
৩.
অস্বীকার করা যাবে না যে, ইসলামের ভিত্তিতেই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সেই আন্দোলন হয়েছিল মুসলমান জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। সেই জাতীয়তাবাদের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না বটে কিন্তু অনেকগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতা সেই আন্দোলনে তীব্র গতিবেগ সঞ্চার করেছিল। ভারতের মতো অতো বড় না হলেও পাকিস্তান ছিল একটি সাম্রাজ্যরাষ্ট্র- empire state— জাতিরাষ্ট্র (nation state) নয়। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর দেখা গেল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণ ও শোষণ- নিপীড়ন ইংরেজ শাসকদের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। নতুন শাসকদের শোষণ-অত্যাচার বিশেষ করে তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে ওই সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় এবং ১৯৭১-এ এক সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে গঠন করে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র। এবার তার আদর্শ হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যদিও ১৯৪৭-এর চেয়ে তখন এই ভূখণ্ডে মুসলমানের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি এবং অমুসলমানের সংখ্যা ২৩ বছর আগের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশের যে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ ঘোষিত হলো তা ইসলামহীন সেক্যুলারিজম নয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ইসলামসংক্রান্ত অনুষ্ঠান একটু বেশিই যেন প্রচারিত হতো। হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে বিশেষ কিছুই হতো না। কিন্তু কেন তা হতো? তা হতো এই জন্যে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান শ্রোতাদের কাছে ইসলামি অনুষ্ঠানের বিশেষ আবেদন ছিল। যার বিশেষ আবেদন থাকে তার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। বস্তুত বাংলাদেশ কি সেদিন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হতে চেয়েছিল নাকি অসাম্প্রদায়িক হতে চেয়েছিল। সেদিন বাংলাদেশের ধর্মাবলম্বী নির্বিশেষে বাঙালি জনগণ চেয়েছিল অতীতের সাম্প্রদায়িকতার বিষ ধুয়ে-মুছে একটি সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে— সেক্যুলার হতে নয়। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সেক্যুলারিজমের কোনো এজেন্ডা ছিল না। সেক্যুলারিজম ও নন-কমিউন্যালিজম-এর মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, কিন্তু দুটো এক জিনিস নয়। অনেকেই এই দুটোকে এক করে গুলিয়ে ফেলেন এবং ভুল করেন সেখানেই। পৃথিবীতে নন-কমিউন্যাল রাষ্ট্র আছে অনেক কিন্তু সেক্যুলার রাষ্ট্রের সংখ্যা খুব কম। শুধুমাত্র কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোই সত্যিকারের সেক্যুলার রাষ্ট্র। অনেক সময় শব্দের অপপ্রয়োগ বড় বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। পরিণামে বিপত্তি ঘটে।
জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কি প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হলো তা বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সেই বিচার বাদ দিয়ে ভাসাভাসাভাবে আবেগের বশে দেশপ্রেমের পরিচয় দিলে দেশের কোনো লাভই হবে না, তা হবে আত্মপ্রবঞ্চনা। একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের বিপুল অধিকাংশের বয়স ছিল ৩০/৩২-এর নিচে। অধিকাংশ সেক্টর কমান্ডারদের বয়স ছিল ৩৫-এর কম। তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ভারত-বিদ্বেষ বা হিন্দু-বিরূপতা ছিল না বললেই চলে, কারণ তারা কখনো উঁচু শ্রেণীর হিন্দু জমিদার- মহাজনদের শোষণ-নিপীড়ন, দুর্ব্যবহার-তাচ্ছিল্য-অবহেলার শিকার হননি। পাকিস্তানি শাসকদের প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সত্ত্বেও নতুন প্রজন্মের পূর্ব বাংলার মুসলমান তরুণরা সাম্প্রদায়িক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে একাত্তরে পূর্ব বাংলার মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশিই ছিল ৪০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষ। তারা অবিভক্ত বাংলার বহু বেদনার স্মৃতি তখনো বহন করছিলেন। তারা একদা নির্মম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন। ব্যতিক্রম কিছু বাদে তাদের প্রায় সকলেই ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক-বাহক, মনে মনে তারা ছিলেন ভারতের প্রতি সন্দেহপ্রবণ, হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিহীন।
এই প্রেক্ষিতে পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তার কারণেই যখন মুক্তিযুদ্ধে ভারত সর্বাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয় তখন তা দেশের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বয়স্ক মানুষের মনে নতুন কোনো আশাবাদের জন্ম দেয়নি। আশঙ্কার জন্মই দিয়ে থাকবে। কারণ সেদিন জনগণ ‘স্বাধীনতা’ চেয়েছিল—ইসলামাবাদের পরিবর্তে দিল্লির ‘আধিপত্য’ প্রত্যাশা করেনি। এরমধ্যেই কট্টর পাকিস্তানবাদীরা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে, ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ও গোপনে তৎপর হয়। তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে জীবন উৎসর্গ করে। হত্যা করতে থাকে প্রগতিশীলদের। কিন্তু স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের সংখ্যা ৯৫ শতাংশের বেশি হওয়ায় তাদের নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব না হলেও তাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে হত্যা ও কলুষিত করতে ভালোই সফল হয়। আজকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের উত্থানের কারণই তাই।
অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বা মুজিবনগর সরকারের অন্যান্য নেতা সাংবিধানিক রাজনীতি ও সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন, তাঁদের কারোই গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ ছিল না। সুতরাং, তাঁরা কোনো বড় শক্তির সাহায্য ছাড়া কীভাবে একটি হিংস্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করবেন? সম্মুখ যুদ্ধের তো নয়ই গেরিলা যুদ্ধেরই মানসিক প্রস্তুতি ছিল না দেশবাসীর ও নেতাদের। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বিতাড়িত মানুষদের আশ্রয়, খাদ্য, প্রয়োজনীয় অর্থ, অস্ত্রশস্ত্ৰ, প্ৰশিক্ষণ, রণকৌশল সবই মুক্তিকামী বাংলাদেশকে ভারত সরকার এবং ভারতীয় জনগণ উপহার দেয়। এবং প্রয়োজনের তাগিদেই সেগুলো গ্রহণ করতে বাংলাদেশ বাধ্য হয়। সেদিন বাংলাদেশের শুধু ছিল তার মুক্তিকামী মানুষের অটুট মনোবল ও অবিচল দেশপ্রেম; কিন্তু সেই সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে অর্থ, অস্ত্র, আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়া শুধু মনোবল ও দেশপ্রেম দিয়ে অল্প সময়ে বড় অর্জন সম্ভবপর ছিল না। তাই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সমস্ত ব্যাপারটি অনিবার্যভাবে ভারতের হাতে চলে যায়। ইবনে খদ্দুনের যে উদ্ধৃতি উপরে দেয়া হয়েছে তাতে বলা হচ্ছে জাতীয়তাবোধের মধ্যেই দেশপ্রেম নিহিত। ২৩ বছরের বৈষম্যমূলক ও বৈমাত্রেয় আচরণে এ দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা ভেবেছিলেন সকলের মিলিত সংগ্রামের মাধ্যমে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সেখানে তারা পাবেন সমঅধিকার ও অবৈষম্যমূলক আচরণ। তারা এটা উপলব্ধি করার প্রয়োজন বোধ করেননি যে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছ থেকে অবৈষম্যমূলক আচরণ আশা করা দুরাশাই বটে। তাদের সেই ভুল ভাঙে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই। একটি উদাহরণ দেই। পাকিস্তানিরা রমনা কালীমন্দির গুঁড়িয়ে দেয়। হিন্দুমন্দির হলেও সেটি ছিল বাঙালিজাতির হেরিটেজ স্থাপত্য। দেশের সকল মানুষের সম্পত্তি। কালীবাড়ির পরিবর্তে পাকিস্তানিরা যদি একটি মসজিদ ভাঙতো সেটি পুনর্নির্মিত হতো স্বাধীনতার ছয় মাসের মধ্যে। স্বাধীনতার পরে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট পুনর্নির্মাণ হতে লাগলো, রমনা কালীবাড়ির কথা ভুলে গেল ‘সেক্যুলার’ সরকার ও জনগণ। বাংলাদেশের ধর্মীয়-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ নয় কি?
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পুরো জনগোষ্ঠী সর্বান্ত:করণে সমর্থন করে বটে; কিন্তু স্বার্থপর শিক্ষিত বুর্জোয়া শ্রেণীর তাতে নেতৃত্ব ও প্রাধান্য থাকায় ওই আন্দোলন থেকে যে বিজয় অর্জিত হয় তাতে গোটা জনগোষ্ঠী সর্বদা উপকৃত হয় না। বামপন্থী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বুর্জোয়া ও পাতি বুর্জোয়াদের সংগ্রাম, পক্ষান্তরে কমিউনিস্টদের সংগ্রাম হলো শ্রেণীসংগ্রাম, যেখানে সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবোধ ও সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিউনিস্ট বা বামপন্থীদের নেতৃত্বে হয়নি, তাদের পূর্ণ সমর্থন ও সর্বাত্মক সহযোগিতা ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার উপাদান অনুপস্থিত তা নয়, কারণ সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু হিন্দু-মুসলমানের কথা বাদ দিলেও এই বাংলাদেশ — কি অবিভক্ত কি বিভক্ত আরো বহু ক্ষুদ্র জাতির বাসভূমি। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলায় কথা বলতে জানে বটে, কিন্তু তাদের নিজেদের আলাদা ভাষা-সংস্কৃতি রয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধাক্কা তাদের জীবনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা স্বাভাবিক। যে আন্দোলনের প্রবক্তা ও পরিচালক মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী এবং সাম্রাজ্যবাদীদের মদদপুষ্ট নানা গোষ্ঠী তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার উপাদান থাকবেই, তাতে সংখ্যাগুরুরাই সবকিছু— সংখ্যালঘুরা কৃপার পাত্র মাত্র। একই সঙ্গে কেউ জাতীয়তাবাদী ও আন্তর্জাতিকতাবাদী ও বিশ্বমানবতাবাদী হতে পারে না। জাতীয়তাবাদপ্রসূত দেশপ্রেম অনেক সময় ট্রাইবালিজমেও পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সমষ্টিগত স্বার্থপরতা’য় পর্যবসিত হয়।
একালের একজন ইরানি চিন্তাবিদ ড. আলি মোহাম্মদ নাকাভি তাঁর ‘ইসলাম এ্যান্ড ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থে বলেছেন, Conflict between Islam and nationalism is inevitable— ইসলামের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সংঘর্ষ অনিবার্য। কারণ যেহেতু ইসলাম একটি স্বতন্ত্র, আধ্যাত্মিক, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনব্যবস্থা— কতগুলো বিশেষ বিশ্বাসের সমষ্টি, তার সাথে জাতীয়তাবাদী মতবাদের বিরোধ ঘটা স্বাভাবিক (Islam, too, being a school having its own independent, spiritual, practical, political and social system and comprising a particular set of beliefs, it naturally comes into conflict with the school of nationalism.) কোনো মুসলমান যখন ‘জাতীয়তাবাদী’ হয় তখন প্রধানত সে তার নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থের কথাই চিন্তা করে, ধর্মনির্বিশেষে সকল মানুষের নয়। এটা অবশ্য সকল ধর্মাবলম্বীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানও একাত্তরে নিজেদের স্বার্থের কথাই ভেবেছে, সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-আদিবাসীদের কথা ভাববার অবকাশ তার হয়নি। তারপরেও সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সম্প্রীতির কথা যেটুকু ধ্বনিত হয়েছে তা ভারতের অকুণ্ঠ সাহায্য-সহযোগিতার জন্য- নির্মল পরধর্মাবলম্বী প্রেম থেকে নয়। তার প্রমাণ স্বাধীন বাংলাদেশের গত একত্রিশ বছরের রাজনীতি।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার পরে যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো তার শাসকরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম মূলনীতি বলে ঘোষণা করলেও তা ছিল বাস্তবে ‘ইসলামিক-সেক্যুলার’ রাষ্ট্র। কথাটা ‘সোনার পাথরবাটি’র মতো শোনালেও খুবই কঠিন সত্য। সত্য এই জন্য যে উপমহাদেশের কোথাও এই মুহূর্তে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মতো অনুকূল সামাজিক অবস্থা নেই। কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর জোর করে কোনো আদর্শ চাপিয়ে দেয়া যায় না। সমাজ স্থায়ী ও চিরন্তন রাষ্ট্র অস্থায়ী। রাষ্ট্র ভাঙা যায় এক ধাক্কায়, সমাজ ভাঙে না শত শত বছরেও। রাতারাতি একটি সমাজ গঠিত হয় না, রাতারাতি একটি রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের আগে কোনো ‘পাকিস্তান’ বা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ছিল না, কিন্তু এই ভূখণ্ডে একটি শক্ত সমাজ ছিল। একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে দীর্ঘ পূর্বপ্রস্তুতি, শক্ত আদর্শ ও রাজনৈতিক দর্শন, সেক্যুলার শিক্ষা-ব্যবস্থা, সনাতন মন- মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন তা শুধু বাংলাদেশে নয় গোট দক্ষিণ এশিয়ায়ই অনুপস্থিত। যে এলাকার বাসিন্দারা হিন্দুত্ব ও মুসলামনত্বের বাইরে কিছু ভাবতেই পারে না সেখানে একটি ঘোষণা দিলেই রাতারাতি সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। একটি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার একজন নগণ্য কর্মী হিসেবে এবং গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতারা সেদিন চেয়েছিলেন একটি ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠিত করতে ধর্মের কারণে যেখানে থাকবে না কোনো বিরোধ ও ভেদাভেদ। সকল ধর্মাবলম্বীই সেখানে ভোগ করবে সমান অধিকার- তবে ইসলামি সংস্কৃতির সেখানে থাকবে প্রাধান্য, যেমন ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিত ভারতে হিন্দুধর্মের আধিপত্য। পাকিস্তান তো ঘোষণা দিয়েই ইসলামি রাষ্ট্র। তাকে প্রজাতন্ত্র বলা যাবে না কারণ যেখানে গণতন্ত্র অনুপস্থিত এবং যে দেশ অব্যাহতভাবে মিলিটারি শাসন করে সেটি প্রজাতন্ত্র হয় কি করে? পাকিস্তান হলো একটি স্বৈরতান্ত্রিক ইসলামপন্থী ব্যর্থ রাষ্ট্র যদিও দেশটি একটি প্রাচীন সভ্যতার অংশ। একটি প্রাচীন সভ্য দেশকে ইসলামপন্থী শাসকরা একটি মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। শুধু নিজেদের দেশটিকেই করেননি তাদের মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা তাদের দোসরদের মাধ্যমে ভিন্ন সংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশেও পাচার করেছেন। মুসলমান-প্রধান হওয়ায় বাংলাদেশের এখন তা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়েছে।
৪.
প্রত্যেক ধর্মেরই দুটি দিক : একটি শাশ্বত—ধর্মগ্রন্থে যেমনটি নির্দেশ করা হয়েছে, অপরটি প্রচলিত বিশ্বাস যা ধর্ম ও ধর্মবহির্ভূত নানা উপাদানে গঠিত। প্রগতিবিরোধী কট্টর যারা তারা ধর্মের শাশ্বত বিষয়গুলো ধরে রাখতে চায়। তারা পানের থেকে চুন খসতে দেয় না। বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমানের পূর্বপুরুষগণ নিম্নবর্ণের হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ইসলামধর্ম তুলনামূলকভাবে একটুখানি উদার বলে নতুন ধর্মান্তরিতরা তাদের আগের ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তারা তাদের পুরনো লৌকিক বিশ্বাস ও আচারপ্রথা পরিত্যাগ করেনি। সে-ভাবেই স্থানীয় লোকজ রীতিনীতি ও নতুন ধর্মের শিক্ষা প্রভৃতির সমন্বয়ে বাংলাদেশে একটি সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। সেই সংস্কৃতিতে বৌদ্ধ সহজিয়া উপাদানও আছে, ইসলামও আছে, হিন্দুত্বও আছে এবং এগুলোর বাইরে ধর্মনিরপেক্ষ লোকজ উপাদানও আছে। এ সবকিছুর সমন্বয়েই বৃহত্তর বাঙালি সংস্কৃতি।
আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের শুরুতে ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু রিভাইভ্যালিজম এবং ইংরেজ-শাসন-বিরোধী মুসলিম মৌলবাদী ওয়াহাবি, ফারায়েজি আন্দোলন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অনৈক্য ও ব্যবধান সৃষ্টি করে। সেই ব্যবধান কমিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে কমই। বরং ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়েছে। হিন্দু-মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের প্রায় কেউই এ ব্যাপারে সঠিক ভূমিকা পালন করেননি। প্রত্যেকেই তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের উন্নতি ও ভালো-মন্দ নিয়ে ভেবেছেন, সকলের দিকে একসঙ্গে তাকানোর ফুরসত হয়নি কারো। তাতে উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ক্রমাগত বেড়েছে। কিন্তু তার পরেও টিকে আছে বাঙালির মূলধারার সহনশীল মানবতাবাদী সমন্বয়ী-সংস্কৃতি। তার একটিই কারণ, তা হলো হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল বাঙালি ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। পূর্ব বাংলার বাঙালিও নয়, পশ্চিম বাংলার বাঙালিও নয়। নিজের ধর্মের প্রতি পক্ষপাত তার খুব বেশি কিন্তু হিংস্র-সাম্প্রদায়িক হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের উস্কানিতে বাঙালির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ভারসাম্য হারিয়ে কখনো হিংস্র হয়ে ওঠে। সে-দৃষ্টান্ত যেমন বহু আছে, তেমনি তাদের প্রতিরোধ করার মানুষও এ সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ইসলামি ঐতিহ্যের পরিপন্থী কোনো ধরনের কর্মকাণ্ড এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগণ মেনে নেবে না। হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্ম তো এ মাটিরই জিনিস, কিন্তু দূর থেকে দেরিতে আসা ইসলামের শিকড়ও এ দেশের মাটির অনেক গভীরে প্রোথিত। অবশ্য বাংলায় ইসলাম এসেছে বখতিয়ার খিলজির আগমনের অনেক আগে। আরব বণিকরা ব্যবসা করতে প্রথম আসেন উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে। তাঁদেরই অনেকে এখানে বংশানুক্রমে থেকে যান। বাঙালিদের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। এইভাবে আট থেকে এগার শতক নাগাদ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান ব্যবসায়ীরা দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। তাঁদের মাধ্যমেই ইসলামের উদার মতবাদ ও সাম্যের বাণী দ্বারা শুধু যে ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার এবং জাতিভেদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ আকৃষ্ট হয় তাই নয়, স্থানীয় অমুসলমান রাজারাও আরব মুসলমানদের নির্মল চারিত্রিক গুণাবলিতে মুগ্ধ হন এবং তাঁদেরকে উদার পৃষ্ঠপোষকতা দেন। কারণ চিরকাল বাংলাদেশের অমুসলমানরা—হিন্দু-বৌদ্ধ প্রভৃতি – ধর্মপ্রাণ বা ধর্মভীরু ছিলেন—ধর্মান্ধ ছিলেন না। নিজের ধর্মের প্রতি অবিচল অনুরাগ থাকলেও অন্য ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেননি। সম্প্রতি বাঙালি জাতি সম্পর্কে একটি ভালো বই প্রকাশিত হয়েছে লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ থেকে। গ্রন্থটি হলো ড. নীতিশ সেনগুপ্তের History of Bengali Speaking People। প্রাচীনকাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বাংলাভাষী জনগণের ইতিহাস এর উপজীব্য। তিনি গবেষণা করে প্রতীয়মান করতে চেষ্টা করেছেন যে, উভয় বাংলার সংস্কৃতি এক ও অভিন্ন এবং তা গড়ে উঠেছে বহু শতাব্দীব্যাপী হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমানের মিলিত চেষ্টায়। তিনি দেখিয়েছেন যে, ইংরেজ উপনিবেশবাদীরা এদেশ দখলের আগে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের দৃষ্টান্ত নেই।
অবশ্য মুসলমানদের নিজেদের মধ্যেই নানা রকম বিভেদ আছে : মৌলবাদী ইসলামের সঙ্গে উদার ইসলামের, এক মজহাব বা উপ-সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরেক উপ- সম্প্রদায়ের, রক্ষণশীলদের সঙ্গে প্রগতিশীল আধুনিকদের। উনিশ শতকের শেষ থেকে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বিজ্ঞানমনস্কদের সঙ্গে প্রাচীনপন্থী গোড়াদের সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, তাদের সেই সংঘর্ষ হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে কম বিপজ্জনক নয়। তবে লোকজ ইসলামপন্থীর সংখ্যাই গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে বেশি।
গত দুই দশকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন এনজিওগুলোর সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রত্যন্ত পল্লীতে প্রসারিত হওয়ার ফলে গ্রাম ও শহরের দরিদ্রপীড়িত ভূতলবাসী মানুষদের চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। তাদের বহুকালের অন্ধত্ব অনেকটাই ঘুচেছে। স্ত্রী-শিক্ষারও প্রসার ঘটেছে। কিছুটা হলেও ‘আধুনিকায়ন’ হয়েছে। তাতে অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মীয় গোঁড়ামি অনেকটা দূর হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে মাদ্রাসা-শিক্ষা সঙ্কুচিত না হয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আনুভূমিকভাবে সম্প্রসারিত হওয়ায় একশ্রেণীর দরিদ্র মানুষের অন্ধত্ব ও গোঁড়ামি দূর না হয়ে বরং পাকাপোক্ত হচ্ছে। দেশে মাদ্রাসা- শিক্ষার ভেতর দিয়েই মৌলবাদী ইসলাম বাংলাদেশে টিকে আছে এবং আরো বহুদিন টিকে থাকবে। এরা প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঘোরতর প্রতিপক্ষ। দেশে এক ও অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা থাকলে পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতো। মাদ্রাসা থেকে অনিবার্যভাবে তৈরি হয় ধর্মান্ধ মানুষ ও মৌলবাদী দলের কর্মী। সাধারণ স্কুল-কলেজ থেকেও তা হতে পারে। কারণ মৌলবাদী নেতারা অনেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। মসজিদের ইমাম, জেহাদী জঙ্গী সংগঠনগুলোর সদস্য, ইসলাম প্রচার সংঘগুলোর নেতাকর্মী অবধারিতভাবে মাদ্রাসা থেকেই আসে। অল্প শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষেরা এদের দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হয় এবং সমাজে সাম্প্রদায়িক চেতনা চাঙ্গা হয়।
আমাদের চিন্তায় ও জীবনে অগ্রগতি আনতে চাইলে আমাদের তর্ক করতে হবে। নিজের দলভুক্ত অথবা নিজের মতাদর্শের সমর্থক অর্থাৎ একই মতাদর্শে ও চিন্তায় বিশ্বাসী মানুষের মধ্যে তর্ক হয় না, হলেও তা প্রাণহীন ও অর্থহীন। তর্ক করতে হয় ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষের সঙ্গে যুক্তির নিক্তি হাতে নিয়ে। সমাজের পরস্পরবিরোধী শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিণামে যে সংশ্লেষণ হয় তাতে সমাজ উপকৃত হয়। আমাদের সমাজে দ্বান্দ্বিকভাবে বা dialectically চিন্তার প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। এটা ক্ষতিকর। সমাজে সবসময়ই কম হোক বেশি হোক পরস্পরবিরোধী শক্তি কাজ করে। কিন্তু সঠিক পথে চলা প্রগতিশীল ধারাটির বিজয়ের ওপরই সমাজের অগ্রগতি নির্ভর করে। আজ (আগেও এমনটি হয়েছে) বাংলাদেশে একদল ধর্মপন্থী গোড়া মুসলমান বর্বরোচিত পন্থায় আধুনিকতাকে অব্যাহতভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। একটু স্পষ্টভাষী যুক্তিবাদী চিন্তার মানুষকে ‘মুরতাদ’ ‘নাস্তিক’ বলে গালাগাল দিচ্ছে, তাঁদের ফাঁসি চাইছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ডাক দিচ্ছে ‘জেহাদ’-এর, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যন্ত বিপর্যস্ত করছে। অন্যদিকে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ আন্দোলনও হচ্ছে। বাধা সত্ত্বেও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বলিষ্ঠভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। প্রগতিশীলদের শক্তিই প্রবল, বাধাবিপত্তির মধ্যেও তাঁদের বিজয় নিশ্চিত।
হিন্দু হোক, বৌদ্ধ হোক, মুসলমান হোক, আস্তিক হোক, নিরীশ্বরবাদী হোক, সাম্প্রদায়িক হোক, ধর্মনিরপেক্ষ হোক এই ভূখণ্ডের বাংলাভাষী মানুষের এমনই নিয়তি যে অনিবার্যভাবে তাদের পূর্বপুরুষদের মতোই ভবিষ্যতেও বংশানুক্রমে রাজনৈতিক উত্থান- পতন বিজয় ও বিপর্যয়ের মধ্যেই বসবাস করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কোনো তত্ত্ব দিয়ে জাতীয়তার গুরুত্ব বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন নেই। এ মাটির হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সকলের রক্ত এক। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, সুগন্ধার পানি কোনো কারণে দূষিত হয়ে পড়তে পারে, তাদের কেটে ভাগ করা যাবে না। বাঙালি জাতি আজ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তবে বাঙালির মধ্যে যতোই বিভেদ সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র হোক তাদের শেষ পর্যন্ত ভাগ করা যাবে না।
১৯৭২-এ বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের এক সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন প্রখ্যাত প্রাচীনভারত বিশেষজ্ঞ ইতিহাসবিদ এ. এল. বাশাম। তিনি বলেছিলেন, “বাঙালিরা নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে নিজেদের এককভাবে গড়ে তুলবে, বাঙালি বাঙালি হবে। বাংলাদেশ বাংলাদেশ হবে।’ আমিও প্রফেসর বাশামের কথারই প্রতিধ্বনি করতে চাই। *
—
* আবু জাফর শামসুদ্দীন স্মারক বক্তৃতা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ৩০ আগস্ট ২০০৩ প্রদত্ত