একুশের সুবর্ণ জয়ন্তী : ১৯৫২ থেকে ২০০২
কলকাতা বইমেলা চত্বরে ‘একুশের সুবর্ণ জয়ন্তী’ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সেমিনারে আমার ক্ষুদ্র নিবন্ধটি উপস্থাপন করার শুরুতে ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলা ভাষার মর্যাদা ও বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তাঁদের অমর স্মৃতির প্রতি আমি আমার গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। পাকিস্তানি শাসকদের জালিম বাহিনী সেদিন হত্যা করেছিল আমাদের ভাই আবুল বরকত, শফিকুর রহমান, রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, অহিউল্লা ও নাম-না-জানা আরও কাউকে। সেই রক্তাক্ত ঘটনায় যাঁরা আহত হয়েছিলেন, নির্যাতিত হয়েছিলেন, কারাবরণ করেছিলেন অথবা ভাষা- আন্দোলনে কোনো-না-কোনোভাবে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের প্রতিও জ্ঞাপন করছি আমার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের একজন সামান্য নাগরিক ও লেখক হিসেবে আজ আমি আপনাদের এখানে উপস্থিত হয়েছি। একুশের ধারাবাহিকতায়ই সংগঠিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবনদান করেছেন পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের হাতে। সেই চিরঞ্জীব শহীদদের প্রতি জানাচ্ছি আমার গভীর শ্রদ্ধা। একই সঙ্গে আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ভারতের সেই সকল নাগরিকদের স্মৃতির প্রতি যাঁরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষদের সাহায্য সহযোগিতা করতে গিয়ে জীবন দান করেছেন।
ইতিমধ্যে অর্থাৎ গত পঞ্চাশ বছরে ভাষা-আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশে অজস্র প্রবন্ধ- নিবন্ধ, স্মৃতিচারণ ও গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলোর কিছু কিছু আপনাদের পাঠ করার হয়তো সুযোগ হয়েছে এবং ধারণা করি সেই আন্দোলন সম্পর্কে বহু তথ্য এখন মোটের উপর আপনাদের জানা। সুতরাং সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করা এ মুহূর্তে অর্থহীন এবং সময়ের অপচয় মাত্র। আজ সেদিনের ঘটনাপঞ্জি নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলবো না। জাতির জীবনে সেই আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কেই দু’চার কথা সবিনয়ে পেশ করব মাত্র। তবে ভাষা-আন্দোলন যে বিশাল ব্যাপক মাত্রা অর্জন করেছিল, গোটা জাতির চৈতন্যে যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল, তা অল্প কথায় এবং স্বল্প সময়ে বর্ণনা করা একেবারেই সম্ভব নয়। একুশের আন্দোলন বাংলাদেশের মানুষকে কি দিয়েছে, একুশ থেকে আমরা কি অনুপ্রেরণা পেয়েছি সে-সম্পর্কেই সামান্য কিছু কথা নিবেদন করব। তবে সেই আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে দু’চার কথা না বললেও নয়।
পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না, সেটি ছিল একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন— একটি অনন্যসাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন। সেই আন্দোলনের দুটি পক্ষ ছিল : একটি পাকিস্তানী আধা-উপনিবেশবাদী স্বৈরশাসক ও তাদের এ অঞ্চলের কিছু অনুগ্রহভাজন সহযোগী, এবং অন্যটি পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী নিপীড়িত জনগণ যারা ছিল সমগ্র পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। বলা বাহুল্য, আন্দোলনটি কোনো সুপরিকল্পিত বিপ্লব ছিল না বটে, তা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড এক বিদ্রোহ- এক গণবিস্ফোরণ, কিন্তু সেই তাৎক্ষণিক বিদ্রোহের মধ্যেই অনেকখানি বৈপ্লবিক উপাদানও উপস্থিত ছিল। তাই ভাষা-আন্দোলনের তাৎপর্য নানাবিধ : সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক। ওই আন্দোলন না হলে বাঙালি সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেত, রাজনীতিতে গণতন্ত্রের চিহ্ন থাকত না, পরিণামে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত এবং ঘটত সামাজিক বিপর্যয়। একুশ আমাদের উদ্ধার করেছে।
১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর পূর্ব বাংলার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিপুল অধিকাংশ ধারণা করেছিল যে এই অঞ্চলে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কারণ সেই প্রস্তাবেই উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে এবং পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র বা independent states প্রতিষ্ঠার কথাই বলা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালে লীগের দিল্লি অধিবেশনে states এর স্থানে state অর্থাৎ একটিমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। পূর্ব বাংলার জনগণ পরিস্থিতির চাপে সে-প্রস্তাবও মেনে নেয়। এবং ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় তখন পূর্ববাংলা হয় তার পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েও পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পূর্ব বাংলার জনগণ তাকেও স্বাধীনতা বলেই স্বীকার করে নেয়।
কিন্তু ওই স্বাধীনতা যে বাঙালিদের জন্য ‘স্বাধীনতা’ নয় তা তাদের উপলব্ধি করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হলো না। মাত্র এক পক্ষকালের মধ্যেই বাঙালি বুঝতে পারল যে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের যতই ত্যাগ থাক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও নতুন রাষ্ট্রে তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এটা তাদের হীনম্মন্যতাবশত অনুমান নয়—অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা। কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র বার তের দিন পর পোস্টকার্ড, খাম ও ডাকবিভাগের অন্যান্য ফর্ম-এ প্রচলিত ইংরেজির সঙ্গে উর্দুও জুড়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশের অল্প শিক্ষিত মানুষও এক-আধটু ইংরেজি পড়তে পারত কিন্তু উর্দু ছিল তাদের কাছে একেবারেই দুর্বোধ্য। ৪৭-এর ডিসেম্বরে সরকার ঘোষণা করে যে, যে নতুন মুদ্রা বাজারে ছাড়া হবে তাতে লেখা থাকবে শুধু ইংরেজি ও উর্দু, বাংলা নয়। সরকারের এ সকল অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিশেষ করে সচেতন ছাত্র- যুবসমাজ এই সব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। উল্লেখযোগ্য যে তখন মুসলিম লীগ বিরোধী প্রকাশ্য রাজনীতির অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। দল হিসেবে কংগ্রেস ছিল নিস্তেজ।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক আবদুল মতিন (তখন তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পরে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা) বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তান সচিবালয়ের চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারিগণ বাংলা ভাষার পক্ষে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েকদিন পর প্রথম প্রতিবাদ-মিছিল বের করেন। রাজনীতিবিদদের মধ্যে দু’জনের নাম স্মরণ করতে হয় যাঁরা বাংলা ভাষার মর্যাদা অর্জনের জন্য পাকিস্তান গণপরিষদ ও পূর্ব বাংলা বিধান সভায় প্রথম দাবি তোলেন। তাঁরা হলে কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে একাত্তরের মার্চে শহীদ হন) এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
১৯৪৮-এর ১১ মার্চ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় এক অভূতপূর্ব হরতাল পালিত হয়। ওই দিন অন্তত ৬৫ ব্যক্তি গ্রেফতার হন। তার চার দিন পর ১৫ মার্চ পূর্ব বাংলা বিধান সভার অধিবেশন বসে। সেই অধিবেশনে ১১ মার্চের হরতাল এবং বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে উত্তপ্ত আলোচনা করেন মওলানা ভাসানী ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। এর তিন সপ্তাহ আগে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ‘উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি তোলেন ধীরেন দত্ত। তাঁর দাবির বিরোধিতা করেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। সংসদে কথা বলার সুযোগ নেই এই অভিযোগে মওলানা ভাসানী বিধান সভা থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৪৮-এর মার্চে। তাঁর জীবনের পরবর্তী ২৮ বছরে তিনি আর সংসদীয় রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেননি।
এর দুদিন বাদে, ১৯ মার্চ ১৯৪৮, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা-গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ করাচি থেকে ঢাকা আসেন। পূর্ব পাকিস্তানে সেটাই ছিল তাঁর প্রথম সফর। ২১ মার্চ তিনি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় পাকিস্তানের প্রস্তাবিত রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে অনেক কথাই বলেন এবং এক পর্যায়ে ঘোষণা করেন :
আমি আপনাদের সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়। যে কেউ অন্যপথে চালিত হবে সে হবে পাকিস্তানের শত্রু।
জিন্নাহর এই কুখ্যাত উক্তির পর বস্তুত পূর্ব বাংলার, অল্প কিছু দাস্যমনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ বাদে, সকলেই পাকিস্তানের শত্রুতে পরিণত হলো। অবশ্য জিন্নাহর বক্তব্য সেদিন বাঙালি শ্রোতারা বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়নি। তৎক্ষণাৎ সমাবেশের এককোন্ থেকে সমস্বরে ধ্বনিত হয় : No No না, না। তবে সেই আওয়াজ তাঁর কানে পৌঁছেনি অথবা পৌঁছলেও তিনি তার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। কারণ চার দিন পর ২৪ মার্চ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তখনও তিনি জোর দিয়ে বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তাতে ছাত্রনেতারা শুধু হতাশ নন, ক্ষুব্ধ নন—ক্রুদ্ধ হন। তবে পূর্ব বাংলার মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা শুধু জিন্নাহ নন পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতারাও কিছুমাত্র কম করেননি। সেই নেতাদের প্রধান মুখপাত্র ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন। ১৯৪৮- এর সেপ্টেম্বরে জিন্নাহর মৃত্যুর পর তিনি হন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। তিনি নিজে ঢাকার নবাব পরিবারের মানুষ হলেও ছিলেন উর্দুভাষী এবং তাঁর সময়েই বাহান্নতে বাংলা ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথ রক্তরঞ্জিত হয়।
প্রসঙ্গত এখানে একটি কথা উল্লেখ করা দরকার। বাংলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কোনো নেতাই উর্দুর বিরুদ্ধে ছিলেন না। তাঁরা শুধু চাইছিলেন উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হোক। কিন্তু শীর্ষ লীগ নেতারা এই দাবিকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ‘প্রাদেশিকতা’ প্রভৃতি বলে অপবাদ দিচ্ছিলেন। যদিও লীগ নেতারা নিজেরাই ছিলেন ঘোরতর সাম্প্রদায়িক। আরও একটি কথা উল্লেখ করা আবশ্যক, তা হলো কিছু সংখ্যক জনবিচ্ছিন্ন মুসলিম লীগ নেতা উর্দুর পক্ষ নিয়ে বাংলাভাষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও মুসলিম লীগের বহু আঞ্চলিক নেতা-কর্মী এবং সমর্থক, যারা পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, ছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত থেকে শুধু নয়, তারও অনেক আগে থেকেই বাঙালি মুসলমান কবি-লেখক শিল্পী-বুদ্ধিজীবীগণ দুটি বড় দলে বিভক্ত ছিলেন। এক দল ছিলেন ধর্মপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক; অন্য দল মোটামুটি ধর্মনিরপেক্ষ, কিছুটা প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক। প্রথম দলটি ছিল মুসলিম লীগের সাংস্কৃতিক এজেন্ট। তাদের কাজ ছিল সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ নেতাদের সন্তুষ্টির জন্য মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে উর্দু বা আরবির পক্ষে ওকালতি করা। তা করতেন তারা ইসলাম ও মুসলমানের নামে। তারা কেউ কেউ একবার বলেছেন আরবি অক্ষরে বাংলা ভাষা লেখা হোক, কেউ বলেছেন বাংলাভাষাকে মুসলমানিকরণ করা হোক, কেউ বলেছেন রোমান হরফে বাংলা লেখা হোক। তাদের মতে, পাকিস্তানের সংহতির জন্য সেটা প্রয়োজন। কিন্তু তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-বাঙালিদের থেকে মুসলমান বাঙালিদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। তারা বাংলা ভাষাতেই যে সংস্কৃতের গন্ধ পেতেন তা নয়, বাংলা অক্ষরের মধ্যেও হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতার উপস্থিতি আবিষ্কার করতেন। তাই একজন খ্যাতিমান কবিও লেখেন ….Even the Bengali atphabet is full of idolatry.
প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্ররোচনায় হোক বা ধর্মীয়- সামাজিক কারণে হোক বাঙালি মুসলমানের একটি বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে নিজের বলে ভাবতে অন্ধের মতো ভালবাসত, শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর বলে এবং বিদ্যায় ও বিত্তে অগ্রসর হিন্দুদের কাছ থেকে অবহেলা ও তাচ্ছিল্য পেয়ে তারা আরও বেশি প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে দেখা দেয় নানা রকম বিভ্রান্তি। সেই বিভ্রান্তি শুধু ৪৭-এর আগে নয় ৪৭-এর পরও অব্যাহত ছিল। সেই বিভ্রান্তিকে প্রথম সজোরে ধাক্কা দেয় একুশ : বাঙালি মুসলমান দেখল অন্তত একটি ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান দেশের সকল নাগরিক এক— তা হলো তাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাহান্নর একুশের আগে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে মুসলমানিত্বই ছিল বেশি- বাঙালিত্ব ছিল কম। বাঙালি মুসলমান অকুণ্ঠভাবে নিজেকে কখনোই ‘বাঙালি’ বলে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেনি। তার ধর্মের ইতিহাস দ্বারা সে ছিল আচ্ছন্ন। একুশের ঘটনার পরে সে রাতারাতি বাঙালি মুসলমান থেকে বাঙালি হয়ে ওঠে তার মুসলমানিত্বকে বিসর্জন না দিয়েও। এটি ভাষা-আন্দোনের একটি বড় অর্জন।
তবে একুশ শতকের রাজনীতি-আক্রান্ত বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে প্রাক-আধুনিক বিশেষ করে মধ্যযুগের মুসলমান কবিদের পার্থক্য অনেকটা। তাঁরা সেক্যুলার ছিলেন কতটা বলা মুশকিল তবে ছিলেন মাতৃভাষা প্রেমিক। তাঁদের সম্পর্কে আধুনিক গবেষণা বিশেষ হয়নি। হিন্দু-গবেষকরা তো করেনইনি, মুসলমান-গবেষকরা যা করেছেন তাও পর্যাপ্ত নয়। অথচ তাঁরা অবহেলার যোগ্য নন। মুসলমানি আমলে মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বাংলা সাহিত্যের চর্চা করেছেন। মাতৃভাষা বাংলা তাদের সকলের কাছেই ছিল সমান প্রিয়। তাই ষোল শতকের কবি সৈয়দ সুলতান ঘোষণা করেছেন :
যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন
সেই ভাষা হয় তার অমূল্য রতন ॥
মাতৃভাষা বাংলার প্রতি যারা শ্রদ্ধাশীল নয় তাদের সম্পর্কে সতের শতকের কবি আবদুল হাকিম অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় বলেছেন :
যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মন না জুরায়,
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে না যায় ॥
কিন্তু সৈয়দ সুলতান বা আবদুল হাকিমের তিন চার শ বছর পরে বাঙালি মুসলমান রাজনীতিবিদ ও তাদের তাঁবেদার বুদ্ধিজীবীদের মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটে। তারা মূর্ছিত হতে থাকেন আরবি-উর্দুর নামে। অবিভক্ত ভারতের একজন প্রধান মুসলিম লীগ নেতা ও মন্ত্রী তমিজউদ্দিন খানকে তাই জিন্নাহরও আগে সেই ১৯৪৩ সালে উর্দুর জন্যে ওকালতি করতে দেখা যায়। মুসলমানদের সংহতির জন্য একটিমাত্র সাধারণ ভাষার ওপর তিনি জোর দিয়ে উর্দুকেই মনোনীত করেন। (… the necessity of a common language which can not be but Urdu)। এসব তৎপরতার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িকতাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া। কায়েমী স্বার্থবাদিরাই এসব পারে।
এই অবস্থাটিই জন্ম দেয় বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ শাসকদের মধ্যে বিন্দুমাত্র গণতান্ত্রিক চেতনা থাকলে বাঙালি তরুণদের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা অর্জন করতে হতো না। ১৯৪৭ থেকে ৫২ পর্যন্ত সাড়ে চার বছর পূর্ব বাংলার ছাত্র-যুবসমাজ ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীগণ শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাষ্ট্রভাষা সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছেন। পক্ষান্তরে পাকিস্তানী শাসকরা চেয়েছেন সংঘাত এবং শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালিকে পদানিত রাখতে। সবচেয়ে ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করেছেন খাজা নাজিমউদ্দিন। ঢাকার নাগরিক এই অভিজাত ব্যক্তি বাঙালিদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। ১৯৪৮-এর মার্চে তিনি ভাষা-আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে এই মর্মে এক চুক্তি করেন যে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা হবে। কিন্তু গভর্ণর জেনারেল হয়ে তিনি তাঁর চুক্তির বরখেলাপ করেন। যখন বাংলা ভাষার মর্যাদা অর্জনের জন্য পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের মানুষ সংহত ও ঐক্যবদ্ধ তখন ১৯৫২-র ২৭ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় এক জনসভায় নির্লজ্জভাবে ঘোষণা করেন : ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। একাধিক রাষ্টভাষা থাকলে কোনো রাষ্ট্র শক্তিশালী হতে পারে না।’ ভাষা- আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতাদের অনেকের ধারণা, নাজিমউদ্দিন এই উস্কানিমূলক উক্তি না করলে ‘বোধ হয় ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনা না-ও ঘটতে পারতো। নাজিমউদ্দিনের জন্য ভাষা-আন্দোলন দ্রুত এগিয়ে গেছে।’ [মোহাম্মদ তোয়াহা ]
১৯৫১-তে গঠিত হয়েছিল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এই সংগঠন নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করছিল এবং জনমত সৃষ্টি করছিল। নাজিমউদ্দিনের সর্বশেষ ঘোষণার পরে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনে দলমত নির্বিশেষে একটি বড় মঞ্চ গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। কারণ বাঙালির দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। ১৯৫২-র ৩১ জানুয়ারি বিভিন্ন সংগঠনের এক মৌন সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ৪০-সদস্যবিশিষ্ট ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ফেব্রুয়ারির তিন সপ্তাহব্যাপী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিবাদসভা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি সরকার পূর্ব বাংলা বিধান সভার অধিবেশন আহ্বান করে। সেই উপলক্ষে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। উদ্দেশ্য ভাষা-আন্দোলনের কর্মসূচি বানচাল করা। তখন পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন নূরুল আমিন। তিনি নিজে যে বাংলা রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে ছিলেন তা নয়, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা করার সৎসাহস তাঁর ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে সংসদ ভবনের দূরত্ব মাত্র কয়েক শ গজ। আন্দোলনের তরুণ নেতৃবৃন্দ সরকারের স্বৈরাচারী নীতির কাছে নতি স্বীকার না করার সিদ্ধান্ত নেন। তারা শান্তিপূর্ণ মিছিল করে সংসদভবনের দিকে এগোচ্ছিলেন। তখনই উচ্চতর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ অকল্পনীয় বর্বরতার পরিচয় দেয় : নির্বিচারে গুলি চালায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর : জন্ম নেয় অমর একুশে ফেব্রুয়ারি।
একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন সম্পর্কে প্রথম স্মারক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৩- তে। শিরোনাম ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত এবং মোহাম্মদ সুলতান প্রকাশিত সেই সংকলনের শুরুতে বলা হয়েছে :
একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তরের সম্ভাবনা নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারি তেমনি এক যুগান্তকারী দিন।
শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে নয়, একুশে ফেব্রুয়ারি সারা দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। দুনিয়ার মানুষ হতচকিত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়েছে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনতার দুর্জয় প্রতিরোধের শক্তিতে, শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছে ভাষার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণদের এই বিশ্ব ঐতিহাসিক আত্মত্যাগে। জাতিগত অত্যাচারের বিরুদ্ধে, জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য দুনিয়া জোড়া মানুষের যুগ যুগব্যাপী যে সংগ্রাম একুশে ফেব্রুয়ারি তাকে এক নতুন চেতনায় উন্নীত করেছে।
মুসলিম লীগ সরকার ভাষা-আন্দোলনকে কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র এবং ভারতের কারসাজি বলে চিত্রিত করেছে। তারা বাংলাদেশের মানুষের ন্যায়সংগত দাবির তাৎপর্য ও তাদের মনটি বুঝবার চেষ্টা করেননি। তবে এটাও সত্যি যে, ভাষা-আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি নেপথ্যে থেকে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারির এক দিন পর পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি এক প্রচারপত্রে লেখে :
নরহত্যার প্রতিবাদে ভাষার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য রেলশ্রমিক থেকে শুরু করে শহরের গরীব বস্তিবাসী, কর্মচারী ও ছাত্র জনতার যে ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠের বজ্র কঠোর ঘোষণা ঢাকার অলিতে গলিতে ধ্বনিত হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি তাকে মোবারকবাদ জানাচ্ছে। সর্বশ্রেণীর জনতার এহেন সংগ্রামী ঐক্য পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
একুশে ফেব্রুয়ারির পরে যে অগণিত নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে সরকার জেলে ঢোকায় তাঁদের প্রায় সকলেই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। কংগ্রেসের বহু হিন্দু নেতাও কারাবরণ করেন। বিনা বিচারে তাঁরা বহু বছর জেলে থাকেন। মওলানা ভাসানীর মতো বৃদ্ধ নেতাকেও এক বছরের বেশি জেলে আটকে রাখা হয়। এ সবই করা হয়েছিল পূর্ব বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নস্যাৎ করার হীন উদ্দেশ্যে।
বাঙালির প্রতিপক্ষ পাঞ্জাবী শাসক-শোষকদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি, বরং তাদের ষড়যন্ত্র ও দুঃশাসন পাকিস্তানেরই বিপর্যয় ডেকে আনে। তারা সংখ্যাগুরু বাঙালির উপর যে জাতিগত নিপীড়ন ও নির্যাতন চালায় ২৪টি বছর তার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের তুলনা করা চলে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতেই থেমে থাকে না- সেটি ছিল একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। যে রাজনৈতিক অধ্যায়টির পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে।
গণতন্ত্র সম্পর্কে পাঞ্জাবী শাসকদের কোনো ধারণা ছিল না। আর ধারণা যদি থেকেও থাকে তা হলেও গণতন্ত্রকে তারা ভয় করত— মৃত্যুর মতো ভয়। পূর্ব বাংলার মানুষ ব্রিটিশ আমলাতান্ত্রিক শাসন দেখেছে, ৪৭-এর পর দেখতে লাগল পাকিস্তানী আমলাতন্ত্রের শাসন। ১৯৩৭ থেকে ৪৭ পর্যন্ত তারা যেটুকু সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনের স্বাদ পেয়েছিল ৪৭-এর পর তাও হারাল। পরাজয়ের ভয়ে কেন্দ্রের ও প্রদেশের মুসলিম লীগ সরকার সাধারণ নির্বাচন এড়িয়ে যেতে লাগলেন। তারপর জনগণের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে সরকার ১৯৫৪-তে পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। সেই নির্বাচনের ফলাফলের কথা আপনাদের মধ্যে যাঁরা প্রবীণ তাঁরা হয়তো অনেকেই জানেন। ২৩৭ মুসলিম আসলের মধ্যে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মাত্র নয়টি আসনে বিজয়ী হয় এবং সকল আসন পায় ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তি যুক্তফ্রন্ট। সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনে ভাষা-আন্দোলনের প্রভাব ছিল একশ ভাগ।
কিন্তু পাকিস্তানী শাসকদের ষড়যন্ত্রও থেমে থাকল না এক মুহূর্তের জন্যে। রাতারাতি তারা প্রদেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে। শুধু তাই নয়। বিশিষ্ট বাঙালি নেতাদের তারা জেলে ঢোকায়। তা ছাড়া বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। তারা জানত শারীরিকভাবে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন বা ধ্বংস করা যাবে না। তাই সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিকে ধ্বংস করার পথ খুঁজে বের করতে থাকে। যখন পাকিস্তানবাদীরা দেখল যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবেই তখন তারা বাংলা ভাষাটা ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালায়। একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। একুশের আন্দোলনের মাত্র এক মাসের মধ্যে Pakistan Language Formula নামে এক পুস্তিকা প্রকাশ করেন একজন পাকিস্তানবাদী নেতা (নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় সরকারের মদদে)। তাঁর নাম মওলানা রাগীব আহসান, অবিভক্ত বাংলায় তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের একজন এম.পি। তিনি লেখেন :
Bengali should be made the medium of instruction and State Language in East Bengal provided, of course, it is fully Islamized and developed as a Pakistani Language in place of the Sanskritized Hindu Bengali of Calcutta.
কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি ও তাদের মনোভাবই ব্যক্ত হয়েছিল এই লেখায়। শুধু তাই নয়, ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন :
Bengali should adopt Arabic script to help the further development and Islamization of Musalmani Bangla.
হাজার বছরের পুরনো একটি সমৃদ্ধ ভাষার বিরুদ্ধে, যে ভাষায় রয়েছে অমূল্য সাহিত্য-সম্পদ, যে ভাষার কবি ভূষিত হয়েছেন নোবেল পুরস্কারে, যে ভাষায় কথা বলে কোটি কোটি মানুষ, সেই ভাষার বিরুদ্ধে এমন জঘন্য ষড়যন্ত্র হতে পারে তা কেউ সহজে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু পূর্ব বাংলায় হয়েছিল তাই।
তবে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাঙালি কোনো অপশক্তির কাছেই নতি স্বীকার করতে জানে না; সে-শক্তি যারাই হোক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালি সূর্য- সন্তানদের ত্যাগ ও সংগ্রাম ছিল ভারতবর্ষে শীর্ষে। পাকিস্তানী আধা-ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে সে পরাভব বরণ করতেই পারে না। অব্যাহত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে মাতৃভাষার রাজনৈতিক অধিকার সে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৫৬-র পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। শহীদের রক্তদান সাৰ্থক হয়।
একুশের জাতীয়তাবাদী চেতনা বাঙালির মধ্যে অনির্বাণ ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত- অনির্বাণ থাকবে যতদিন পৃথিবীতে একজন বাংলাভাষী মানুষও বেঁচে থাকে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা, মূল সংবিধান প্রণীত হয়েছে বাংলায়, যদিও তার একটি ইংরেজি ভাষ্যও রয়েছে। রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনের জন্য আমাদের সরকার ও জনগণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমার জানা মতে, গত তিরিশ বছরে অভ্যন্তরীণ কাজকর্মে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান সরকারি কাগজপত্রে বাংলা ছাড়া ইংরেজিতে সাক্ষর করেননি। [প্রচণ্ড হাতে তালি ]
শিক্ষার উন্নতির সঙ্গে ভাষার উন্নতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম বাংলা। তবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের বইপত্রের অভাব। এ ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি কাজ করছেন। তবে কাজের গতি খুব মন্থর। অর্থের অভাব যতটা না তার চেয়ে বেশি অভাব যোগ্য অনুবাদকের। এ প্রসঙ্গে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, শিক্ষার মান আজ খুব নিচে নেমে গেছে। তা ছাড়া একটি শ্রেণীর মধ্যে অতিরিক্ত ইংরেজিপ্রীতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটু অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর প্রবণতাও ক্রমবর্ধমান। বিষয়টি একুশের চেতনাকে ম্লান করে।
যে এয়ারলাইনস-এ আমি কলকাতায় এসেছি তার নাম বিমান। যে ব্যাংক থেকে আমি ডলার কিনেছি তার নাম পূবালী ব্যাংক। আমাদের অন্যান্য ব্যাংকের নাম সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, উত্তরা প্রভৃতি। আমাদের তেল কোম্পানীগুলোর নাম পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। স্বাধীনতার আগে আমাদের ইনসিওরেন্স কোম্পানীগুলোর নাম ছিল ইংরেজিতে পরে সেগুলোর নামকরণ হয় তিস্তা বীমা, সুরমা বীমা, রূপসা বীমা প্রভৃতি। আমাদের রেডিও-র নাম “বাংলাদেশ বেতার’। তবে টেলিভিশন এখনও রয়ে গেছে। আপনাদের দূরদর্শনের মতো একটা বাংলা নামকরণ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মতো আমাদের মুদ্রার নাম ‘রূপী’ নয়, স্বাধীনতার আগে তাই ছিল। এখন আমাদের মুদ্রার নাম ‘টাকা’। বাংলার মানুষ যুগ যুগ ধরে মুদ্রাকে টাকাই বলে। এসবই একুশের ফসল। চট করে এ সব বিষয়কে খুব ছোট ব্যাপার মনে হতে পারে, কিন্তু একটু চিন্তা করে দেখলে এ সবেরও তাৎপর্য বিরাট একটি জাতির জীবনে।
মাতৃভাষার জন্য আমাদের তরুণরা জীবন দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ আজও মাতৃভাষা পড়তে ও লিখতে জানে না। আমাদের রাষ্ট্রের মানুষ বাংলা সাহিত্যের বই পড়তে অক্ষম। আমাদের রাষ্ট্রের এটি বড় ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতা মোচনের উদ্যোগ চলছে। একদিন নিশ্চয়ই, তা যত দেরিতেই হোক, আমাদের এক শ ভাগ মানুষ শুধু অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নয় শিক্ষিত হয়ে উঠবে। পড়তে পারবে তারা তাদের মাতৃভাষায় লেখা বইপত্র।
জেলা আদালতগুলো পর্যন্ত মামলার রায় বাংলায় লেখায় বাধা নেই, তবে উচ্চ আদালতে জেরা ইত্যাদি বাংলায় হলেও রায় শুধু ইংরেজিতে দেয়াই বিধেয়। সরকারি অসরকারি অফিসের সকল কাজ বাংলাতেই হয়। আমরা উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ দীর্ঘদিন ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিলাম। এর মধ্যে এখন ধাক্কা লেগেছে বিশ্বায়নের। এই অবস্থায় ইংরেজির চাপ অগ্রাহ্য করে স্বাজাত্যবোধ বজায় রাখা ও মাতৃভাষায় দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করা কঠিন বৈকি!
একুশ আমাদের সাহিত্য ও শিল্পকলার উপর যে প্রভাব ফেলেছে তা সীমাহীন। সে- সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলা সম্ভব নয়। একুশ আমাদের লেখকদের অধিকতর আধুনিক ও সেক্যুলার হতে অনুপ্রাণিত করেছে। সাহিত্যিকদের মধ্যপ্রাচ্যপ্রীতি দূর করেছে। একুশের পর থেকে আমাদের মূলধারার সাহিত্যে দ্বি-জাতিতত্ত্বীয় ভাবধারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তাতে সাম্প্রদায়িকতার চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে আমরা সাম্প্রদায়িকতা সম্পূর্ণ দূর করতে পেরেছি। উপমহাদেশের কোথাও তা সম্ভব হয়নি। আপনারাও তা পারেন নি। আপনারা নিজেরা যতই নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলুন না কেন। তবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অব্যাহতভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। আপনাদের এখানেও করছেন, আমাদের ওখানেও করছেন। পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের সাহিত্যের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে, তা সত্ত্বেও আত্মতৃপ্তির কোনো অবকাশ নেই। এখনো আমাদের অনেক কাজ বাকি। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের সাহিত্যের সৃষ্টিশীল ও মননশীল দু’ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় অগ্রগতি হয়েছে অসামান্য। আমাকে দয়া করে এ ব্যাপারে একটুখানি আত্মপ্রশংসার সুযোগ দেবেন। বাংলাদেশের দৈনিকগুলো আপনারা পান না। যদি পেতেন তা হলে লক্ষ্য করতেন আমাদের মূলধারার কাগজগুলোর মান বেশ উঁচু। আমি অবশ্যই ইংরেজি পত্রিকাগুলোর কথা বলছি না। আমাদের বাংলা কাগজের প্রতিবেদন এবং সম্পাদকীয় উপসম্পাদকীয় নিবন্ধগুলো লেখা হয় প্রমিত বাংলায়। আমাদের ভাষা আপনাদের ভাষার চেয়ে একটু ভিন্ন এবং উন্নত। আমাদের দেশ ছোট এবং দরিদ্র তাই আমাদের কোনো ভাল জিনিসও অন্যের চোখে পড়ে না। পড়লেও তার প্রশংসা করা হয় না।
গতবার থেকে আমাদের অহংকারের দিন একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পৃথিবীর সকল দেশে পালিত হচ্ছে। এই দিনটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমাদের জন্য কম শ্লাঘার ও গৌরবের ব্যাপার নয়। আমাদের দেশপ্রেমিকদের আত্মদান বিশ্বের মানুষের শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
আপনারা আমার প্রীতি সালাম ও শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন। ধন্যবাদ।*
—
* কলকাতা বইমেলা ২০০২-এ অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ দিবস’-এ ‘একুশের সুবর্ণ জয়ন্তী’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধ। নিবন্ধটি সম্পূর্ণ অথবা ঈষৎ সংক্ষিপ্ত আকারে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের প্রধান বাংলা দৈনিকগুলোর সম্পাদকীয় অথবা সাময়িকীর পাতায় প্রকাশিত হয়