হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মতামত

হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মতামত

‘সিন্ধু থেকে হিন্দু’ গ্রন্থের মোট ২০টি প্রবন্ধের মূলকথা হচ্ছে : হিন্দুধর্মটি যতটুকু না ধর্ম তার চেয়ে অনেক বেশি সভ্যতা। এই ধর্মটি প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার (দ্রাবিড় ও অষ্ট্রিক) সাথে যুক্ত। মাতৃতান্ত্রিক এই সভ্যতার মূল দেবতা শিব। হিন্দুদের কেউ কেউ অহেতুক একে ‘সনাতন’ ধর্ম আখ্যা দিয়ে প্রাচীন সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়। হিন্দু ধর্মের সাথে যাযাবর, পিতৃতান্ত্রিক ও অনুন্নত আর্যদের সংযুক্তি একটি দুর্ঘটনা মাত্র। এই দুর্ঘটনায় হিন্দুদের উপকার-অপকার দুইই হয়েছে। দুইয়ের মিলন ঘটাতে গিয়ে প্রচুর সময় ব্যয় হয়। ঘাত-সংঘাত ও বোঝা-পড়ার মাধ্যমে শুরু হয় সংশ্লেষণ। ধর্মটি হয়ে ওঠে একটি বিবর্তনশীল ধর্ম। কিন্তু কালক্রমে এর ওপর পড়ে একটি ব্রাহ্মণ্য (জন্মগতভাবে ব্রাহ্মণ সর্বশ্রেষ্ঠ) আবরণ। ধর্মটি যেহেতু প্রতিনিয়ত গ্রহণ- বর্জনের মাধ্যমে পরিপুষ্ট হচ্ছে তাই ব্রাহ্মণ্য আবরণও একদিন বিলীন হয়ে ধর্মটি হবে প্রকৃত অর্থে হিন্দুধর্ম। আশার কথা এর প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। এই ধর্মের কোনো প্রতিষ্ঠাতা নেই, এটি কোনো সংগঠিত (অর্গানাইজড) ধর্মও নয়। অন্যান্য ধর্ম যেখানে একমুখী (‘ইউনিফরম’) সেখানে হিন্দুধর্ম বৈচিত্র্যময়। বহু মত আশ্রয় পেয়েছে এই ধর্মে। তাই বলা হয়: যত মত তত পথ। অন্যান্য ধর্মের সাথে এর রয়েছে প্রচুর মৌলিক পার্থক্য। সিন্ধু সভ্যতার শিব ও বুদ্ধ হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। এঁরা উভয়েই সাম্য ও সুন্দরের প্রতীক। রামায়ণ ও মহাভারতের মাধ্যমে এদের সাথে পরে যোগ হয়েছে রাম ও কৃষ্ণ। রামায়ণ ও মহাভারত প্রকৃতপক্ষে লোকগাথা, বীরের কাহিনী। ধর্মগ্রন্থ নয়। এদিকে হিন্দুর দেব-দেবীও হচ্ছে রূপান্তরিত। এই রূপান্তরের ফসলই হলেন মহাদেবী দুর্গা ও কালী। লোকায়ত সংস্কৃতি ও লোকায়ত দেব-দেবী ছাড়া হিন্দুর কল্পনা করা যায় না। যজ্ঞ করত আর্যরা। এটি জনপ্রিয় না হওয়ায় তীর্থের উদ্ভব হয়েছে। অধিকাংশ তীর্থই শিব ও তাঁর পরিবারের সাথে সম্পর্কিত। ‘মনু’ নামীয় এক তথাকথিত ধর্মবেত্তাই হিন্দুর মধ্যে বিভেদের সূত্রপাত করেন। তার প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় কাঠামোটি (ব্রাহ্মণ্যধর্ম) অনেক উদার ধর্মীয় মতের বিলুপ্তি ঘটিয়েছে। উদার গণতান্ত্রিক সাম্যকামী হিন্দুর এই ধর্মটিকে জটিল ও হৃদয়হীন করে তোলে হিন্দুর পুরোহিত শ্রেণি ও ব্রাহ্মণ্য শক্তি। এটি করতে গিয়ে তারা আশ্রয় নেয় নানা পুরাণ কাহিনীর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বপ্ন, কল্পনা, মিথ্যা, ছলনা ও বৈষম্য ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে রচিত পুরাণ কাহিনীকেই করা হয় তথাকথিত ধর্মের কাহিনী। প্রথাকে উপস্থাপিত করা হয় ধর্ম হিসবে। জাতিভেদ হিন্দুর আদি পাপ। এই জাতিভেদ প্রথা হিন্দুকে খণ্ডিত বিখণ্ডিত করেছে, করেছে শক্তিহীন। এটি হিন্দুর অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। স্থায়ী কলহের ভিত্তি এই জাতিভেদ এই অঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মের জন্ম দিয়েছে। যা ছিল জাতিতে (কাস্ট) জাতিতে কলহ তা আজ হয়েছে ইতিহাস পরম্পরায় আন্ত :ধর্মীয় কলহ। পদবি ব্যবস্থাটি বিভ্রান্তিকর। পদবির সাথে জাতির (কাস্ট) অহেতুক সম্পর্ক টানার ফলে সৃষ্টি হয়েছে একটি স্থায়ী বৈষম্যধর্মী ব্যবস্থা। হিন্দুর কাঠামোতে মোট হিন্দুর মাত্র পাঁচ-সাত শতাংশ মানুষ জন্মগতভাবে নিজেদেরকে তথাকথিত বর্ণহিন্দু দাবি করে সমাজের বাকি হিন্দুদেরকে করে রেখেছে নির্জীব, বন্দি ও উদ্যমহীন। সম্প্রসারণের শক্তি বণিকগণ হিন্দু সমাজে আজও নিগৃহীত।

বলা বাহুল্য হিন্দু ও হিন্দুধর্ম সম্পর্কে উপরোক্ত মূল বক্তব্য আমার নিজস্ব কোন বক্তব্য নয়। যে কোন পাঠক এই সমাজের বিদগ্ধজন ও পণ্ডিতদের লিখিত গ্রন্থ পাঠ করলেই তা বুঝতে পারবেন। তবে এ স্থলে অসুবিধা একটিই, অনেকের পক্ষে এতসব গ্রন্থ সংগ্রহ করে পড়া কঠিন। তাই নিচে হিন্দু ও হিন্দুধর্ম সংশ্লিষ্ট সর্বমোট ৬০টি গ্রন্থ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি তুলে ধরা হল যাতে পাঠকরা ‘হিন্দু’ সম্বন্ধে একটা ধারণা পেতে পারেন। বলা বাহুল্য ৬০টি গ্রন্থের লেখকই হিন্দুসমাজের সেরা লেখক।

১. স্বামী বিবেকানন্দ
বাণী ও রচনা সঙ্কলন : রামকৃষ্ণ মঠ :
ঢাকা : ২য় সংস্করণ : ১৩৯৯।

১. গীতা শঙ্করাচার্য কর্তৃক প্রণীত: “অনেকে এরূপ অনুমান করেন যে, গীতাখানি শঙ্করাচার্য-প্রণীত। তাঁহাদের মতে-তিনি উহা প্রণয়ন করিয়া মহাভারতের মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দেন।” পৃ : ১৩২।

২. দোলযাত্রা হচ্ছে প্রাচীন মদণোৎসব: “অতি প্রাচীনকালে আমাদের দেশে ‘মদণোৎসব’ নামে এক উৎসব প্রচলিত ছিল। সেইটিকেই লোকে দোলরূপে পরিণত করিয়া কৃষ্ণের ঘাড়ে চাপাইয়াছে। রাসলীলাদিও যে ঐরূপে চাপানো হয় নাই, কে বলিতে পারে?” পৃ: ১৩৩।

৩. কৃষ্ণ একজন রাজা ছিলেন : “কৃষ্ণ সম্বন্ধে এই বোধ হয় যে, তিনি একজন রাজা ছিলেন। ইহা খুব সম্ভব এই জন্য যে, প্রাচীন কালে আমাদের দেশে রাজারাই ব্রহ্মজ্ঞান-প্রচারে উদ্যোগী ছিলেন।” পৃ: ১৩৩।

৪. কুরু-পাঞ্চাল যুদ্ধের কোনো প্রমাণ নেই: “কুরুপাঞ্চাল যুদ্ধের বিশেষ প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না, তবে কুরুপাঞ্চাল নামে যুদ্ধ যে সংঘটিত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। … কেহ কেহ বলেন, এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ রূপক মাত্র। ইহার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য সদসৎ প্রবৃত্তির সংগ্রাম। এই অর্থও অসঙ্গত না হইতে পারে।” পৃ: ১৩৩।

৫. অর্জুন ঐতিহাসিক ব্যক্তি নন: “অর্জুন প্রভৃতির ঐতিহাসিকতা-সম্বন্ধে সন্দেহ এই যে- ‘শতপথব্রাহ্মণ’ অতি প্রাচীন গ্রন্থ, উহাতে সমস্ত্ৰ অশ্বমেধ যজ্ঞকারিগণের নামের উল্লেখ আছে। কিন্তু সে স্থলে অর্জুনাদির নামগন্ধও নাই, অথচ পরীক্ষিত জনমেজয়ের নাম উল্লিখিত আছে। এদিকে মহাভারতাদিতে বর্ণনা-যুধিষ্ঠির অর্জুনাদি অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়া-ছিলেন। এখানে একটি কথা বিশেষরূপে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, এইসকল ঐতিহাসিক তত্ত্বের অনুসন্ধানের সহিত আমাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্থাৎ ধর্ম সাধনা-শিক্ষার কোন সংস্রব নাই। ঐগুলি যদি আজই সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত হয়, তাহা হইলেও আমাদের বিশেষ কোন ক্ষতি হয় না। তবে এত ঐতিহাসিক গবেষণার প্রয়োজন কি? প্রয়োজন আছে; আমাদিগকে সত্য জানিতে হইবে, কুসংস্কারে আবদ্ধ থাকিলে চলিবে না।” পৃ: ১৩৩।

৬. গীতার দ্বারা বিবাদ নিরসন করা হয়: “পূর্ব পূর্ব ধর্মশাস্ত্র হইতে গীতার নতুনত্ব কি? নতুনত্ব এই যে, পূর্বে যোগ জ্ঞান ভক্তি-আদি-প্রচলিত ছিল বটে, কিন্তু সকলের মধ্যেই পরস্পর বিবাদ ছিল, ইহাদের মধ্যে সামঞ্জস্যের চেষ্টা কেহ করেন নাই, গীতাকার এই সামঞ্জস্যের বিশেষ চেষ্টা করিয়াছেন।” পৃ: ১৩৪।

৭. গীতার বিশেষত্ব দুটো: ক. সমন্বয়ভাব ও খ. নিষ্কাম কর্ম।” প্রকৃত নিষ্কামকর্মী পশুবৎ জড়প্রকৃতি বা হৃদয়শূন্য নহেন। তাঁহার অন্তর এতদূর ভালবাসায় ও সহানুভূতিতে পরিপূর্ণ যে, তিনি সমগ্র জগৎকে প্রেমের সহিত আলিঙ্গন করিতে পারেন। এরূপ প্রেম ও সহানুভূতি লোকে সচরাচর বুঝিতে পারে না।” পৃ: ১৩৫।

৮. কৃষ্ণের জীবনে অসামঞ্জস্য : “কৃষ্ণের জীবনচরিতে হয়তো অনেক ঐতিহাসিক অসামঞ্জস্য আছে, অনেক বিষয় হয়তো প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে—এসবই সত্য হইতে পারে, কিন্তু তাহা হইলেও ঐ সময়ে সমাজে যে এক অপূর্ব নতুন ভাবের অভ্যুদয় হইয়াছিল, তাহার অবশ্যই ভিত্তি ছিল।” পৃ: ১৪৫।

৯. পুরোহিত ও প্রতিমা পূজা বৌদ্ধদের থেকে প্রাপ্ত: “বৌদ্ধদের প্রচারে (এই) যজ্ঞগুলি লোপ পাইল, তৎপরিবর্তে বিরাট বিরাট মন্দির, জাঁকালো অনুষ্ঠান পদ্ধতি, আড়ম্বরপ্রিয় পুরোহিত দল এবং বর্তমান কালে ভারতে আর যাহা কিছু দেখিতেছ, সেইগুলির আবির্ভাব হইল। …বৌদ্ধধর্মই ভারতে পৌরোহিত্য ও প্রতিমা পূজা সৃষ্টি করিয়াছিল।” পৃ: ১৪৮।

১০. জগন্নাথ মন্দির বৌদ্ধদের : “জগন্নাথ মন্দির একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। আমরা এটিকে এবং অন্যান্য বৌদ্ধ মন্দিরকে হিন্দু মন্দির করিয়া লইয়াছি।” পৃ: ১৪৮।

১১. হৃদয়হীন শঙ্করাচার্য: “শঙ্কর মহামনীষী ছিলেন বটে, কিন্তু বোধ হয় তাঁহার হৃদয় মস্তিষ্কের অনুরূপ ছিল না। রামানুজের হৃদয় শঙ্করের হৃদয় অপেক্ষা উদার ছিল।” পৃ: ১৪৯। শঙ্করের ছিল বিরাট মস্তিষ্ক, রামানুজ ও চৈতন্যের ছিল বিশাল হৃদয়।” পৃ: ১৫০।

১২. জাতিভেদ কাম্য নয় : “জাতিভেদ অপরিণত মনের শিক্ষালয় মাত্র।” পৃ: ২৮০।

১৩. ব্রাহ্মণরা অনুদার : “অধিকাংশ উপনিষদই ক্ষত্রিয়গণের লেখা এবং বেদের কর্মকাণ্ড (যজ্ঞকাণ্ড) ব্রাহ্মণের কীর্তি। সমগ্র ভারতে আমাদের যেসব বড় বড় আচার্য হইয়া গিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে অনেকেই ক্ষত্রিয় ছিলেন, তাহাদের উপদেশও উদার ও সর্বজনীন, কিন্তু দুইজন ছাড়া ব্রাহ্মণ আচার্যগণের মধ্যে সকলেই অনুদার ভাবাপন্ন ছিলেন। ভগবানের অবতার বলিয়া পূজিত রাম কৃষ্ণ ও বুদ্ধ ইহারা সকলেই ক্ষত্রিয় ছিলেন।” পৃ: ২৮৩।

১৪. নিজ জাতির (কাস্ট) সকলকে নিয়ে ওপরে উঠতে হবে: “ভারতবর্ষে সমগ্র গোষ্ঠীটিই জাতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে একক-রূপে গৃহীত। এখানেও নিম্ন জাতি হইতে উচ্চতর, বা উচ্চতম জাতিতে উন্নীত হইতে পারা যায়, তবে এই পরার্থবাদের জন্মভূমিতে নিজ জাতির সকলকে লইয়া একত্র উন্নত হইতে হইবে।” পৃ: ২৮৬।

১৫. ব্রাহ্মণ কর্তৃক নীচজাতির উচ্চাশা দমন: “স্বাভাবিকভাবেই যে গোষ্ঠীটি নিজেদের উন্নীত করিয়াছে, তাহারা নিজেদের জন্য সব সুবিধা সুরক্ষিত করিয়া রাখিতে চায়। সুতরাং উচ্চবর্ণেরা বিশেষত ব্রাহ্মণেরা যখনই সম্ভব হইয়াছে, রাজার সাহায্য এবং প্রয়োজন হইলে অস্ত্রের দ্বারাও নিম্নবর্ণের লোকদের উচ্চাশা দমন করিবার চেষ্টা করিয়াছে।” পৃ: ২৮৬।

১৬. হিন্দু একটি মিশ্র জাতি: “আমাদের বিভিন্ন বর্ণবিভাগ এবং নানা উপ-বিভাগের মধ্যে বর্তমান বিবাহ প্রথাকে সীমাবদ্ধ রাখা (যদিচ এই রীতি সর্বত্র পালিত হয় না) সত্ত্বেও আমরা পুরাপুরি মিশ্রিত জাতি।” পৃ: ২৮৬।

১৭. বর্ণ প্রথা কাল্পনিক : “বর্ণ-বিশেষের উৎপত্তি সম্বন্ধে দাম্ভিকতাপূর্ণ মতবাদ অসার কল্পনা মাত্র।” পৃ: ২৮৭।

১৮. ব্রাহ্মণরা জন্মগত গর্ব পালনে ব্যস্ত: “যিনি নিজেকে ব্রাহ্মণ বলিয়া দাবি করেন, তিনি নিজের সেই পবিত্রতার দ্বারা এবং অপরকেও অনুরূপ পবিত্র করিয়া নিজের দাবি প্রমাণ করুন। ইহার বদলে বেশীর ভাগ ব্রাহ্মণই প্রাপ্ত জন্মগত গর্ব পালন করিতেই ব্যস্ত্র।” পৃ: ২৮৭।

১৯. উচ্চবর্ণরা ১০০০০ বছরের মমি: “আর্য বাবাগণের জাঁকই কর, প্রাচীন ভারতের গৌরব ঘোষণা দিন রাতই কর; আর যতই কেন তোমরা ‘ড ম্ ম্ ম্’ বলে ডল্ফই কর, তোমরা উচ্চবর্ণেরা কি বেঁচে আছ? তোমরা হচ্ছ দশ হাজার বচ্ছরের মমি!! আর ‘চলমান শশ্মান হচ্ছ তোমরা।… এ মায়ার সংসারের আসল প্রহেলিকা, আসল মরু মরীচিকা তোমরা – ভারতের উচ্চবর্ণেরা।

….বর্তমানকালে তোমাদের দেখছি বলে যে বোধ হচ্ছে, ওটা অজীর্ণতাজনিত দুঃস্বপ্ন। ….এখন ইংরেজ রাজ্যে-অবাধ বিদ্যাচর্চার দিনে উত্তরাধিকারীদের দাও, যতশীঘ্র পার দাও। তোমরা শূন্যে বিলীন হও, আর নতুন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুঠির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে। বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। বেরুক ঝোপ, জঙ্গল, পাহাড়, পর্বত থেকে। এরা সহস্র সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে, নীরব সয়েছে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা। সনাতন দুঃখ ভোগ করেছে– তাতে তাতে পেয়েছে অটল জীবনী শক্তি।” পৃঃ ৩১৮।

২০. ভট্টাচার্য্যের কীর্তি: গুড়গুড়ে কৃষ্ণব্যাল ভট্টাচার্য-মহাপণ্ডিত, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের খবর তাঁর নখদর্পণে। শরীরটি অস্থিচর্মসার; বন্ধুরা বলে তপস্যার দাপটে, শত্রুরা বলে, অন্নাভাবে। আবার দুষ্টেরা বলে, বছরে দেড়কুড়ি ছেলে হলে ঐ রকম চেহারাই হয়ে থাকে। যাই হোক, কৃষ্ণব্যাল মহাশয় না জানেন এমন জিনিসটিই নাই, বিশেষ টিকি হ’তে আরম্ভ কোরে নবদ্বার পর্যন্ত বিদ্যুৎপ্রবাহ ও চৌম্বুকশক্তির গতাগতিবিষয়ে তিনি সর্বজ্ঞ। আর এ রহস্য-জ্ঞান থাকার দরুন দুর্গাপূজার বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা হতে মায় কাদা, পুনর্বিবাহ, দশ বৎসরের কুমারীর গর্ভাধান পর্যন্ত সমস্ত বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কর্তে তিনি অদ্বিতীয়। আবার প্রমাণ প্রয়োগ সে তো বালকেও বুঝতে পারে, তিনি এমনি সোজা করে দিয়েছেন। বলি, ভারতবর্ষ ছাড়া অন্যত্র ধর্ম হয় না। ভারতের মধ্যে ব্রাহ্মণ ছাড়া ধর্ম বুঝবার আর কেউ অধিকারীই নয়, ব্রাহ্মণের মধ্যে আবার কৃষ্ণব্যালগুষ্ঠি ছাড়া বাকী সব কিছুই নয়, আবার কৃষ্ণব্যালদের মধ্যে গুড়গুড়ে!!! অতএব গুড়গুড়ে কৃষ্ণব্যাল যা বলেন, তাহাই স্বতঃপ্রমাণ। মেলা লেখাপড়ার চর্চা হচ্ছে, লোকগুলো একটু চম্‌চমে হোয়ে উঠছে, সকল জিনিস বুঝতে চায়, চাকতে চায়, তাই কৃষ্ণলাল মহাশয় সকলকে আশ্বাস দিচ্ছেন যে, মাভৈঃ, যেসকল মুষ্কিল মনের মধ্যে উপস্থিত হচ্ছে, আমি তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করছি, তোমরা যেমন ছিলে তেমনি থাক। নাকে সরিষার তেল দিয়ে খুব ঘুমোও। কেবল আমার বিদায়ের কথাটা ভুলো না। লোকেরা বললে –বাঁচলুম, কি বিপদই এসেছিলো বাপু। উঠে বসতে হবে, চলতে ফিরতে হবে, কি আপদ!! “বেচে থাক্ কৃষ্ণব্যাল” বোলে আবার পাশ ফিরে শুলো। হাজার বছরের অভ্যাস কি ছোটে? শরীর কর্তে দেবে কেন? হাজারো বৎসরের মনের গাঁট কি কাটে! তাই না কৃষ্ণব্যালদলের আদর। “বল বাবা ‘অভ্যাস’ অস্ মারো” ইত্যাদি।” পৃ : ৩২৭।

২১. বৈষম্যকামী পুরোহিত: “সমাজের প্রত্যেক খুঁটিনাটি বিষয়ে পুরুতগুলোর অত গায়ে পড়ে বিধান দেবার কি দরকার ছিল? তাতেই তো লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন কষ্ট পাচ্ছে! তোমরা মাংসাহারী ক্ষত্রিয়দের কথা বলছ। ক্ষত্রিয়েরা মাংস খাক আর না খাক, তারাই হিন্দুধর্মের ভিতর যা কিছু মহৎ ও সুন্দর জিনিস রয়েছে, তার জন্মদাতা। উপনিষদ লিখেছেন কারা? রাম কি ছিলেন? কৃষ্ণ কি ছিলেন? বুদ্ধ কি ছিলেন? জৈনদের তীর্থঙ্করেরা কি ছিলেন? যখনই ক্ষত্রিয়েরা ধর্ম উপদেশ দিয়েছেন, তাঁরা জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে ধর্মের অধিকার দিয়েছেন, আর যখনই ব্রাহ্মণেরা কিছু লিখেছেন, তাঁরা অপরকে সকল রকম অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন। পৃ: ৩৪৩।

২২. সকলের অধিকার নিশ্চিত করো: “কোন লোকের বিরুদ্ধে, কোন সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে কিছু বলো না। জাতিভেদের স্বপক্ষে বিপক্ষে কিছু বলো না, অথবা সামাজিক কোন কুরীতির বিরুদ্ধেও কিছু বলবার দরকার নেই। কেবল লোককে বলো, ‘গায়ে পড়ে কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে যেও না, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।” পৃ : ৩৪৪।

২৩. চুঁৎমার্গী হিন্দুধর্ম: “ওরে ভাই, দক্ষিণ দেশে যা দেখেছি, উচ্চ জাতির নীচের উপর যে অত্যাচার! মন্দিরে যে দেবদাসীদের নাচার ধুম! যে ধর্ম গরীবের দুঃখ করে না, মানুষকে দেবতা করে না, তা কি আবার ধর্ম? আমাদের কি আর ধর্ম? আমাদের ‘ছুঁৎমার্গ, খালি ‘আমায় ছুঁয়োনা, আমায় ছুঁয়োনা। হে হরি! যে দেশের বড় বড় মাথাগুলো আজ দু’হাজার বৎসর খালি বিচার করছে

ডান হাতে খাব, কি বাম হাতে, ডান দিক থেকে জল নেব, কি বা’দিক থেকে এবং ফটফট্ স্বাহা, ক্রাং ক্রুং হুঁ হুঁ করে তাদের অধোগতি হবে না তো কার হবে? পৃ: ৩৪৭।

২৪. রক্ত চোষা সাধু ও ব্রাহ্মণ : “যে দেশে কোটি কোটি মানুষ মহুয়ার ফুল খেয়ে থাকে, আর দশবিশ লাখ সাধু আর ক্রোর দশেক ব্রাহ্মণ ঐ গরীবদের রক্ত চুষে খায়, আর তাদের উন্নতির কোন চেষ্টা করে না, সে কি দেশ না নরক। সে ধর্ম, না পৈশাচ নৃত্য।” পৃ:৩৪৭।

২৫. হিন্দুর দরকার ইসলামী দেহ : “আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলামধর্ম স্বরূপ এই দুই মহানুমতের সমন্বয়ই – বৈদাস্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ – এক মাত্র আশা।” পৃ: ৩৬৫।

২৬. রামকৃষ্ণ মিশনের সীলমোহরের অর্থ : বিকশিত কমলদলযুক্ত হ্রদমধ্যে হংসবিরাজিত সর্পবেষ্টিত ছবি। তরঙ্গায়িত সলিল রাশি কর্ম, কমল = ভক্তি, উদীয়মান সূর্য = জ্ঞান, সৰ্প- পরিবেষ্টন = যোগ এবং জাগ্রত কুণ্ডলিনী শক্তি এবং হংস প্রতিকৃতি = পরমাত্মা। অর্থাৎ কর্ম ভক্তি ও জ্ঞান-যোগের সাথে সম্মিলিত হইলেই পরমাত্মা দর্শন লাভ হয়। পৃ: ৩৮৯।

২৭. সকলকে ব্রাহ্মণ কর: আমি সব জাতকে একাকার কত্তে বলি না। জাতি-বিভাগ খুব ভাল। এই জাতিবিভাগ-প্রণালীই আমরা অনুসরণ কত্তে চাই। জাতিবিভাগ যথার্থ কি, তা লাখে একজন বোঝে কিনা সন্দেহ। পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই, যেখানে জাত নেই। ভারতে আমরা জাতিবিভাগের মধ্য দিয়ে উহার অতীত অবস্থায় গিয়ে থাকি। জাতিবিভাগ ঐ মূলসূত্রের উপরই প্রতিষ্ঠিত। ভারতে এই জাতিবিভাগ প্রণালীর উদ্দেশ্য হচ্ছে সকলকে ব্রাহ্মণ করা ব্রাহ্মণই আদর্শ মানুষ। যদি ভারতের ইতিহাস পড়ে দেখ, তবে দেখবে এখানে বরাবরই নিম্নজাতিকে উন্নত করবার চেষ্টা হয়েছে। অনেক জাতিকে উন্নত করা হয়েছেও। আরও অনেক হবে। শেষে সকলেই ব্রাহ্মণ হবে। এই আমাদের কার্য-প্রণালী। কাকেও নামাতে হবে না সকলকে ওঠাতে হবে। আর এইটি প্রধানত ব্রাহ্মণদের কত্তে হবে, কারণ প্রত্যেক অভিজাত সম্প্রদায়েরই কর্তব্য নিজেদের মূলোচ্ছেদ করা। আর যত শীগগির তারা এটি করেন, ততই সকলের পক্ষেই ভাল। এ বিষয়ে দেরী করা উচিত নয়, বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ করা উচিত নয়। ইউরোপ-আমেরিকার জাতিবিভাগের চেয়ে ভারতের জাতিবিভাগ অনেক ভাল। অবশ্য আমি একথা বলি না যে, ইহা একেবারে সম্পূর্ণ ভাল। যদি জাতিবিভাগ না থাকতো, তবে তোমরা থাকতে কোথায়? জাতিবিভাগ না থাকলে তোমাদের বিদ্যা ও আর আর জিনিস কোথায় থাকতো? জাতিবিভাগ না থাকলে ইউরোপীয়দের পড়বার জন্যে এ সব শাস্ত্রাদি কোথায় থাকতো?” পৃ: ৩৯৪।

২. স্বামী বিবেকানন্দ
প্রবন্ধঃ শূদ্র জাগরণ: উচ্চ মাধ্যমিক সংকলন : গদ্য : পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ পক্ষে বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত।

১. শূদ্রজাতির গতি কিঃ “যাহাদের বিদ্যালাভেচ্ছারূপ গুরুতর অপরাধে ভারতে ‘জিহ্বাচ্ছেদ শরীর ভেদাদি’ ভয়াল দণ্ড সকল প্রচারিত ছিল, ভারতের সেই ‘চলমান শ্মশান’ ভারতের দেশের ‘ভারবাহী পশু’ সে-শূদ্রজাতির কি গতি?” পৃ: ৪৪

২. নিচুজাতি উঁচু জাতিতে উন্নীত: “বেশ্যাপুত্র বশিষ্ট ও নারদ, দাসীপুত্র সত্যকাম জাবালা, ধীবর ব্যাস, অজ্ঞাতপিতা কৃপ-দ্রোণ-বর্ণাদি সকলেই বিদ্যা বা বীরত্বের আধার বলিয়া ব্রাহ্মণত্বে বা ক্ষত্রিয়ত্বে উত্তোলিত হইল, তাহাতে বারাঙ্গনা দাসী ধীবর বা সারথিকুলের কি লাভ হইল বিবেচ্য, আবার ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য কুল হইতে পতিতরা সততই শূদ্র কুলে সমানীত হইত।” পৃ: ৪৫। ৩. ব্রাহ্মণেরা শূদ্রদের জিহ্বাচ্ছেদ আবার করতে পারে : “আমাদের আপনার মধ্যে তদপেক্ষা অনেক অধিক জাতিগত ঘৃণাবুদ্ধি আছে এবং মূর্খ ক্ষত্রিয় রাজা সহায় হইলে ব্রাহ্মণেরা যে শূদ্রদের জিহ্বাচ্ছেদ শরীরভেদাদি” পুনরায় করিবার চেষ্টা করিবেন না, কে বলিতে পারে?” পৃ: ৪৭।

৩. স্বামী বিবেকানন্দ
বেদাত্তের আলোকে: প্রবন্ধঃ বেদান্তই কি ভবিষ্যতের ধর্ম:
উদ্বোধন কার্যালয় : কলকাতা।

১. পাপ একটি: “বেদান্ত কেবল একটি পাপকে-জগতের মধ্যে কেবল একটিকেই-স্বীকার করে, তাহা এইঃ অপরকে বা নিজেকে পাপী ভাবাই পাপ।” পৃ: ৭৬।

২. বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব নয় চাই বিশ্বাত্মার ঐক্য: “এই জন্য বেদান্তের সিদ্ধান্ত-বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব নয়, বিশ্বাত্মার ঐক্য। আত্মা কখনও মরে না। মৃত্যু বলিয়া কোথাও কিছু নাই – দেহের ক্ষেত্রেও মরণ নাই, মনও মরে না।” পৃ: ৭৯।

৪. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বঙ্কিম রচনাবলী : প্রবন্ধ : কৃষ্ণ চরিত্র :
সাহিত্য সংসদ : কলকাতা : ১৪০৫।

১. কৃষ্ণের উপর রচিত হয়েছে অনেক পাপোপাখ্যান : “আমি নিজেও (বঙ্কিম) কৃষ্ণকে স্বয়ং ভগবান বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস করি। …. কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় যে সকল পাপোপাখ্যান জন সমাজে প্রচলিত আছে, তাহা সকলই অমূলক বলিয়া জানিতে পরিয়াছি এবং উপন্যাস-কারকৃত কৃষ্ণসম্বন্ধীয় উপন্যাস সকল বাদ দিলে যাহা বাকি থাকে, তাহা অতি বিশুদ্ধ, পরম পবিত্র, অতিশয় মহৎ ইহা জানিতে পারিয়াছি।” পৃ: ৩৫৩।

২. মহাভারতে অনেক অলীক কাহিনী যুক্ত হয়েছে : “সত্য বটে যে, মহাভারতে এমন বিস্ত র কথা আছে যে, তাহা স্পষ্টত অলীক, অসম্ভব ও অনৈতিহাসিক। সেই সকল কথাগুলি অলীক ও অনৈতিহাসিক বলিয়া পরিত্যাগ করিতে পারি। কিন্তু যে অংশে এমন কিছুই নাই যে, তাহা হইতে এ অংশ অলীক বা অনৈতিহাসিক বিবেচনা করা যায়, সেই অংশগুলি অনৈতিহাসিক বলিয়া কেন পরিত্যাগ করিব?” পৃ : ৩৫৭।

৩. কুরু-পাঞ্চালের মধ্যে মহাভারতের যুদ্ধ : কুরু ও পাঞ্চাল নামে দুই রাজ্য ছিল। তাদের মধ্যে বিবাদের পরিণামই মহাভারতের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে কুরুগণ পাঞ্চালগণ কর্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন। পৃ : ৩৬৩।

৪. আদি মহাভারতে কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার নন : মহাভারত তিন স্তরে রচিত। প্রথম স্তরে অর্থাৎ প্রথমে রচিত হয় ‘ভারত’ সংহিতা। এতে পাণ্ডবদের জীবন বৃত্তান্ত এবং আনুষঙ্গিক কৃষ্ণ কথা ছাড়া কিছু নেই। কৃষ্ণ নিজেও তার দেবত্ব স্বীকার করেন না। কিন্তু পরে অর্থাৎ দ্বিতীয় স্ত রে কৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার বানানো হয়েছে। তৃতীয় স্তরে অর্থাৎ আরো অনেক পরে ব্রাহ্মণরা এতে লোক-শিক্ষার মাল-মশলা ঢুকিয়ে দেন। “এই তিন স্তরের, নিম্ন অর্থাৎ প্রথম স্তরই প্রাচীন, এই জন্যই তাহাই মৌলিক বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। যাহা সেখানে নাই, তাহা দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরে দেখিলে, তাহা কবি কল্পিত অনৈতিহাসিক বৃত্তান্ত বলিয়া আমাদের পরিত্যাগ করা উচিত।” পৃ: ৩৭৩-৩৭৪।

৫. একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে রাধা সৃষ্টি: “মহাভারতে, হরিবংশে বিষ্ণু পুরাণে বা ভাগবতে ‘রাধা’ নাই, তবে এ ‘রাধা’ আসিলেন কোথা হইতে? রাধাকে প্রথমে ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেখিতে পাই।” পৃ: ৪১১। (এখানে উল্লেখ্য এই পুরাণটি বাঙালি কর্তৃক রচিত। অনুমান এটি রচিত হয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে। এই সময়ে কৃষ্ণকে রাধার সাথে মিশিয়ে কৃষ্ণের দেবত্ব পাকাপাকি করার আয়োজন হয়)।

৫. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বঙ্কিম রচনাবলী : প্রবন্ধ : দেবতত্ত্ব ও
হিন্দু ধর্ম: সাহিত্য সংসদ:কলকাতা:১৪০৫।

১. মনুর বিধানে সমাজ চলবে না: “যদি মন্থাদি (মনু) ঋষিরা অভ্রান্ত হন, তবে তাঁহাদের সকল উক্তিগুলিই ধর্ম – যদি তাহাই ধর্ম হয়, তবে ইহা মুক্ত কণ্ঠে বলা যাইতে পারে যে, হিন্দু ধর্মানুসারে সমাজ চলা অসাধ্য।” পৃ: ৭০৮।

২. মনুর বিধান মানলে শ্রাদ্ধাদি পিতৃকার্য করা সম্ভব নয় : মনুর বিধানে শ্রাদ্ধে কাদেরকে নিমন্ত্রণ করা যাবে না তার একটি নিষিদ্ধ তালিকা আছে। যাদেরকে শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণই করা যাবে না তারা হচ্ছে: ক. রাজার (সরকার) বেতনভুক, খ. ব্যবসায়ী, গ. সুদখোর, ঘ. বেদ না পড়া ব্যক্তি, ঙ. পরলোকে অবিশ্বাসী, চ. যার অনেক যজমান আছে, ছ. চিকিৎসক, জ. যে শ্রৌতস্মার্ত অগ্নি পরিত্যাগ করেছে, ঝ. যে ব্যক্তি শূদ্রের নিকট পড়াশুনা করে অথবা ঞ. যে ব্যক্তি শূদ্রকে পড়ায়, ট. যে ব্যক্তি ছল করে ধর্ম-কর্ম করে, ঠ. যে ব্যক্তি পিতা-মাতার সাথে বিবাদ করে এবং ড. যে পতিত লোকের সাথে অধ্যয়ন করে প্রমুখ। বঙ্কিম বলছেন: “ইহা মুক্তকণ্ঠে বলা যাইতে পারে যে, মনুর এই বিধান অনুসারে চলিলে শ্রাদ্ধকর্মে আজিকার দিনে একটিও ব্রাহ্মণ পাওয়া যায় না। সুতরাং শ্রাদ্ধাদি পিতৃকার্য্য পরিত্যাগ করিতে হয়। অথচ যে বাপের শ্রাদ্ধ করিল না, তাহাকেই হিন্দু বলি কি প্রকারে? এইরূপ ভুরি ভুরি উদাহরণের দ্বারা প্রমাণ করা যাইতে পারে যে, সৰ্ব্বাংশে শাস্ত্রসম্মত যে হিন্দুধর্ম, তাহা কোনরূপে এক্ষণে পুনঃস্থাপিত হইতে পারে না, কখনও হইয়াছিল কিনা তদ্বিষয়ে সন্দেহ। আর হইলেও সেইরূপ হিন্দুধর্মে এক্ষণে সমাজের উপকার হইবে না, ইহা এক প্রকার নিশ্চিত বলা যাইতে পারে।” পৃ: ৭০৮।

৩. হিন্দুর দরকার হিন্দুধর্মের সারাংশ গ্রহণ করা: “যদি সমস্ত্র শাস্ত্রের সঙ্গে সর্ব্বাংশে সংমিলিত যে হিন্দুধর্ম, তাহা পুনঃসংস্থাপনের সম্ভাবনা না থাকে, তবে এক্ষণে আমাদের কি করা কর্তব্য? দুইটি মাত্র পথ আছে। এক, হিন্দুধর্ম একেবারে পরিত্যাগ করা, আর এক হিন্দুধর্মের সারভাগ অর্থাৎ যেটুকু লইয়া সমাজ চলিতে পারে, এবং চলিলে সমাজ উন্নত হইতে পারে তাহাই অবলম্বন করা।” পৃ: ৭০৮।

৪. প্রকৃত হিন্দুধর্ম যাহা নহে, তাহা পরিত্যাগ করা উচিত: “যাহা প্রকৃত হিন্দুধর্ম নহে, যাহা কেবল অপবিত্র কলুষিত দেশাচার বা লোকাচার ছদ্মবেশে ধর্ম বলিয়া হিন্দুধর্মের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে, যাহা কেবল অলীক উপন্যাস, যাহা কেবল কাব্য, অথবা প্রত্নতত্ত্ব, যাহা কেবল ভণ্ড এবং স্বার্থপরদিগের স্বার্থসাধনার্থ সৃষ্ট হইয়াছে, এবং অজ্ঞ ও নির্বোধগণ কর্তৃক হিন্দুধর্ম বলিয়া গৃহীত হইয়াছে, যাহা কেবল বিজ্ঞান অথবা ভ্রান্ত এবং মিথ্যা বিজ্ঞান, যাহা কেবল ইতিহাস, অথবা কেবল কল্পিত ইতিহাস, কেবল ধর্মগ্রন্থ মধ্যে বিন্যস্ত বা প্রক্ষিপ্ত হওয়া ধর্ম বলিয়া গণিত হইয়াছে, সে সকল এখন পরিত্যাগ করিতে হইবে। যাহাতে মনুষ্যের যথার্থ উন্নতি, শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সৰ্ব্ববিধ উন্নতি হয়, তাহাই ধর্ম। ….যাহা ধৰ্ম তাহা সত্য, যাহা অসত্য তাহা অধর্ম্ম। যদি অসত্য মনুতে থাকে, মহাভারতে থাকে বা বেদে থাকে, তবু অসত্য, অধৰ্ম্ম বলিয়া পরিহার্য্য। পৃ: ৭০৯।

৫. পূর্বে চার বেদ ছিল না : “কিম্বদন্তী আছে যে, মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস বেদকে চারি- ভাগে বিভক্ত করেন। ইহাতে বোঝা যায় যে, আগে চারি বেদ ছিল না, এক বেদই ছিল।” পৃ: ৭১০।

৬. বেদ মানুষের লেখা: বেদ ভগবান প্রেরিত নয়। বেদ মানুষই লিখেছে। পৃ: ৭১০।

৭. আজকের পূজ্য দেবতারা কেউ বেদের দেবতা নন: ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, দুর্গা, কালী, কার্তিক, গণেশ ইহারা কেহই বেদের দেবতা নন। বেদের দেবতা অগ্নি, ইন্দ্র, বায়ু, মিত্র, বরুণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, বৃহস্পতি, পূষাভগ, আদিত্য ও মরুদগণ এঁরা হচ্ছেন বেদের দেবতা। পৃ: ৭১৩-৭১৪।

৮. বেদের সর্বমোট দেবতা ৩৩টি: “ঋকবেদে আছে যে, দেবতা তেত্রিশটি, কবি, ভক্ত বা ঠাকুরাণী দিদিদিগের গল্পে গল্পে তেত্রিশ কোটি হইয়াছে।” পৃ: ৭১৫।

৯. ইন্দ্ৰ দেবতা কে: “আমরা যদি এইকথা মনে রাখি যে, বৃষ্টিকারী আকাশই ইন্দ্র, তাহা হইলে ইন্দ্ৰ সম্বন্ধে যত গুণ, যত উপন্যাস, বেদ, পুরাণ ও ইতিহাসে কথিত হইয়াছে, তাহা বুঝিতে পারি। এখন বুঝিতে পারি, ইন্দ্রই কেন বজ্রধর, আর কেহ কেন নহে। যিনি বৃষ্টি করেন, তিনিই বজ্রপাত করেন।” পৃ: ৭১৯।

১০. বেদ না মানলেও হিন্দু হওয়া যায়: “…হিন্দুধর্ম বেদমূলক। বেদ হয় ঈশ্বরোক্ত, নয় ঈশ্বরের ন্যায় নিত্য। যে ইহা মানিল না, সে আবার হিন্দুধর্মের সত্যতা এবং শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করে কি প্রকারে? ইহার উত্তরে বলা যাইতে পারে যে, ধর্ম্মের যে নৈসর্গিক ভিত্তি আছে হিন্দুধর্ম তাহার উপর স্থাপিত। তাই ঈশ্বর প্রণীত ধর্ম্ম না মানিয়াও হিন্দুধর্ম্মের যাথার্থ্য ও শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করা যাইতে পারে। মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের সময় হইতে এই কথা ক্রমে পরিস্ফুট হইতেছে।” পৃ: ৭২১-৭২২।

১১. হিন্দুরা জড়োপাসক নহে: “হিন্দুরা জড়োপাসক নহে। চেতনাবিহীন পদার্থ হিন্দুদের কাছে অস্পৃশ্য পদার্থ। আজকাল যাহাকে জড় পদার্থ বলা হয়, যেমন, অগ্নি, বায়ু নদী পৰ্ব্বত ইত্যাদি, ইহারা হিন্দুদের কাছে চৈতন্যময়ের চেতনাযুক্ত পদার্থ।” পৃ: ৭৪২।

৬. ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর
বিদ্যাসাগর রচনাবলী : অখণ্ড সংস্করণ: সম্পাদনা:
সুবোধ চক্রবর্তী : কামিনী প্রকাশনালয়।

১. কৌলীন্য প্রথার মূল ভিত্তি: “রাজা বল্লাল সেন বিবেচনা করিলেন আচার, বিনয়, বিদ্যা প্রভৃতি সদগুণের সবিশেষ পুরষ্কার করিলে, অবশ্যই সেই সকল গুণের রক্ষা বিষয়ে সবিশেষ যত্ন করিবেন। তদনুসারে, তিনি পরীক্ষা দ্বারা যাঁহাদিগকে নবগুণ বিশিষ্ট দেখিলেন, তাহাদিগকে কৌলীন্য মর্যাদা প্রদান করিলেন। কৌলীন্য প্রবর্তক নয় গুণ এই আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থ দর্শন, নিষ্ঠা, আবৃত্তি, তপস্যা ও দান।” পৃ: ৮৫৪।

২. কুলাভিমানীদের আচরণ ঘৃণাস্পদ: “ইদানীন্তন কুলাভিমানী মহাপুরুষেরা কুলীন বলিয়া অভিমান করিতেছেন এবং দেশস্থ লোকের পূজনীয় হইতেছেন। … কিন্তু তাহাদের আচরণ, যারপর নাই, জঘন্য ও ঘৃণাসম্পদ হইয়া উঠিয়াছে।” পৃ: ৮৬৩।

৩. পাষণ্ড কুলীন সমাজঃ “এ দেশের ভঙ্গ-কুলীনদের মত পাষণ্ড ও পাতকী ভূমণ্ডলে নাই। তাঁহার দয়া, ধর্ম, চক্ষুলজ্জা, লোক লজ্জায় একেবারে বর্জিত। কোনও অতি প্রধান ভঙ্গ- কুলীনকে কেহ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ঠাকুর দাদা মহাশয়, আপনি অনেক বিবাহ করিয়াছিলেন, সকল স্থানে যাওয়া হয় কি? তিনি অম্লান মুখে উত্তর করিলেন, যেখানে ভিজিট পাই, সেইখানে যাই।… গ্রামে বারোয়ারি পূজার উদ্যোগ হইতেছে। পূজায় উদ্যোগীরা, বিষয়ে চাঁদা দিবার জন্য কোনও ভঙ্গকুলীনকে পীড়াপীড়ি করাতে, তিনি চাঁদার টাকা সংগ্রহের জন্য, একটি বিবাহ করিলেন।” পৃ: ৮৬৯।

৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: কালান্তর : বিশ্বভারতী : ১৪০০

১. অন্যায় ও শাস্ত্র: “যেটা অন্যায় সেটা প্রথাগত শাস্ত্রগত বা ব্যক্তিগত গায়ের জোরে শ্রেয় হতে পারে না, শঙ্করাচার্য-উপাধিধারীর স্বরচিত মার্কা সত্ত্বেও সে শ্রদ্ধেয় নয়।” পৃ : ১৫।

২. আর্য দেবতা বনাম সর্বভূতে আত্মা : আর্যরা তাদের সাথে তাদের নিজেদের দেবতা নিয়ে এসেছিল। স্থানীয়রা তা মানে নি। পরে সর্বভূতের মধ্যে সর্বভূতাত্মাকে উপলদ্ধি ও প্রচার করিয়া বিরোধের কাঁটা দূর করা হইল। পৃ : ১১৬।

৩. মঙ্গলকাব্যে অধর্মের জয়গান: “একদা আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় উচ্ছৃঙ্খলতার সময় ভীত পীড়িত প্রজা আপন কবিদের মুখ দিয়ে শক্তিরই স্তবগান করিয়েছে। কবিকঙ্কণচণ্ডী, অন্নদামঙ্গল, মনসার ভাসান, প্রকৃতপক্ষে অধর্মেরই জয়গান। সেই কাব্যে অন্যায়কারিণী ছলনাময়ী নিষ্ঠুর শক্তির হাতে শিব পরাভূত। অথচ অদ্ভূত ব্যাপার এই যে, এই পরা-ভগবানকেই মঙ্গল গান নাম দেওয়া হল”। পৃ: ১৩৩।

৪. শিবকে হেনস্তা : বৌদ্ধধর্ম (মধ্যযুগে) তখন জীর্ণ। “স্বপ্নে যেমন এক থেকে আর হয়, তেমনি করেই বুদ্ধ তখন শিব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। শিব ত্যাগী, শিব ভিক্ষু, শিব বেদ-বিরুদ্ধ, শিব সর্বসাধারণের। বৈদিক দক্ষের সঙ্গে এই শিবের বিরোধের কথা কবিকঙ্কণ এবং অন্নদামঙ্গলের গোড়াতেই প্রকাশিত আছে। শিবও দেখি বুদ্ধের মতো নির্বাণ মুক্তির পক্ষে, প্রলয়েই তার আনন্দ। কিন্তু এই শাস্তির দেবতা, ত্যাগের দেবতা টিকল না। পৃ: ১৪৯-১৫০।

৫. মালাবারের ব্রাহ্মণরা হিন্দুদেরকে মুসলমান করে : “ডাঃ মুঞ্জের রিপোর্টের আর-একটা অংশে তিনি বলছেন, ৮০০ বছর আগে মালাবারের হিন্দু রাজা ব্রাহ্মণমন্ত্রীদের পরামর্শে তাঁর রাজ্যে আরবদের বাস স্থাপনের জন্যে বিশেষভাবে সুবিধা করে দিয়েছিলেন। এমন কি, হিন্দুদের মুসলমান করবার কাজে তিনি আরবদের এতদূর প্রশ্রয় দিয়েছিলেন যে,তাঁর আইন- মতে প্রত্যেক জেলে পরিবার থেকে একজন হিন্দুকে মুসলমান হতেই হত। এর প্রধান কারণ, ধর্মপ্রাণ রাজা ও তাঁর মন্ত্রীরা সমুদ্র যাত্রা ধর্ম বিরুদ্ধ বলেই মেনে নিয়েছিলেন।” পৃ : ২৪১-২৪২।

৬. হিন্দু সংকীর্ণ : “অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের (হিন্দুর ) non-violent non- cooperation. হিন্দুর ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচরণমূলক হওয়াতে তার বেড়া আরো কঠিন। মুসলমান ধর্ম স্বীকার করে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ। আহারে ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখ্যান করে না, হিন্দু সেখানেও সতর্ক। পৃ: ১৩২।

৭. আচার প্রবল হিন্দুঃ “ধর্ম মতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল, আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্ম মতে প্রবল। একপক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা অন্য পক্ষের সে দিকে দ্বার রুদ্ধ।” পূঃ ৩১৩।

৮. হিন্দু যুগ প্রতিক্রিয়ার যুগ: “এক সময়ে ভারতবর্ষে গ্রীক পারসিক শক নানা জাতির অবাধ সমাগম ও সম্মিলন ছিল। কিন্তু মনে রেখো, সে ‘হিন্দু’ যুগের পূর্ববর্তীকালে। হিন্দুযুগ হচ্ছে একটা প্রতিক্রিয়ার যুগ-এই যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল।” পৃ: ৩১৩।

৯. হিন্দু লড়ে খণ্ডে খণ্ডে, একত্রে নয়: “বাহির থেকে যখন প্রথম আঘাত নিয়ে এল মোহম্মদঘোরী, তখন হিন্দুরা সে আসন্ন বিপদের দিনেও তো একত্রিত হয় নি। তারপর যখন মন্দিরের পর মন্দির ভাঙ্গতে লাগল, দেবমূর্তি চূর্ণ হতে লাগল, তখন তারা লড়েছে, মরেছে, খণ্ড খণ্ড ভাবে যুদ্ধ করে মরেছে। তখনো একত্র হতে পারল না। খণ্ডিত ছিলেম বলেই মেরেছে, যুগে যুগে এই প্রমাণ আমরা দিয়েছি।” পৃ : ৩২১।

১০. হিন্দুর নিজস্ব দুর্বলতা : “পাপের প্রধান আশ্রয় দুর্বলের মধ্যে। অতএব যদি মুসলমান মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা। আপনার জন্যেও, প্রতিবেশীর জন্যেও, আমাদের নিজেদের দুর্বলতা দূর করতে হবে। আমরা প্রতিবেশীদের (মুসলমান) কাছে আপিল করতে পারি, “তোমরা ক্রুর হয়োনা, তোমরা ভালো হও, নরহত্যার উপরে কোন ধর্মের ভিত্তি হতে পারে না।” –কিন্তু সে আপিল যে দুর্বলের কান্না। পৃ: ৩২২।

১১. তথাকথিত নমশূদ্র বনাম হিন্দুঃ “শোনা গিয়েছে, এবার পূর্ববঙ্গে কোথাও কোথাও হিন্দুর প্রতি উৎপাতে নমশূদ্ররা নির্দয়ভাবে মুসলমানদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। ভাবতে হবে না কি, ওদের দরদ হল না কেন, আত্মীয়তার দায়িত্বে বাধা পড়ল কোথায়? অস্তর্যামী আমাদের মর্মস্থানে বসে বলছেন, ধর্মে-কর্মে আচারে-বিচারে এক হবার মত ঔদার্য্য তোমাদের নেই। ‘এর ফল ফলছে’ আর রাগ করছি ফলের উপরে, বীজ বপনের উপরে নয়।” পৃ: – ৩২৭।

৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: সাহিত্য: বিশ্বভারতী : ১৪০১

১. রামায়ণের বানররা আসলে এদেশের আদিম অধিবাসী : রামচন্দ্র বানরগণকে অর্থাৎ ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদিগকে দলে লইয়া বহুদিনের চেষ্টায় ও কৌশলে (এই) দ্রাবিড়দের প্রতাপ নষ্ট করিয়া দেন, এই কারণেই তাহার গৌরব গান আর্যদের মধ্যে প্রচলিত হইয়াছিল। পৃ : ১০৩ (প্রবন্ধ : সাহিত্য সৃষ্টি)।

২. রামায়ণের রাক্ষসরা অসভ্য ছিল না: রাক্ষসরা অসভ্য ছিল না। বরঞ্চ শিল্পবিলাসে তাহারা আর্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল। পৃ: ১০৫ (প্রবন্ধ: সাহিত্য সৃষ্টি)।

৩. দক্ষ যজ্ঞের কারণ: শিবের যখন প্রথম অভ্যুত্থান হইয়াছিল তখন বৈদিক দেবতারা যে তাহাকে আপনাদের মধ্যে স্থান দিতে চান নাই তাহা দক্ষ যজ্ঞের বিবরণেই বুঝা যায়। পৃ: ১৩৯ (প্রবন্ধ : বাংলার জাতীয় সাহিত্য)।

৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ইতিহাস : বিশ্বভারতী : ১৩৮৬।

১. রামায়ণ ও মহাভারত : দুটোইসমাজ বিপ্লবের ইতিহাস। পৃ: ২৭।

২. রাম চন্দ্র সকলের বন্ধু : তিনি চন্ডালের মিতা, বানরের দেবতা, বিভীষণের বন্ধু। তিনি শত্রুকে ক্ষয় করিয়াছিলেন এ তাঁহার গৌরব নহে, তিনি শত্রুকে আপন করিয়াছিলেন, … তিনি আর্য-অনার্যের মধ্যে প্রীতির সেতুবন্ধন করিয়া দিয়াছিলেন। পৃ: ৩৪।

৩. দুই কৃষ্ণঃ বৈষ্ণবের কৃষ্ণ ও ভাগবতের কৃষ্ণ এক নন। পৃ: ৫০।

৪. রাজপুতরা কৃত্রিম ক্ষত্রিয়: ব্রাহ্মণরা এদের গ্রহণ করিয়া কৃত্রিম ক্ষত্রিয় জাতির সৃষ্টি করিল। ইহারা প্রাচীন ক্ষত্রিয়দের সমকক্ষ নহে। ইহারা ব্রাহ্মণ শক্তিকে দৃঢ় করিল। পৃ: ৫৫।

৫. হিন্দুদের উদ্দেশ্যহীন মৃত্যু: ইতিহাসে দেখা যায় নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুণ্ঠিত হন নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে। মুসলমানদের যুদ্ধের মধ্যে একদিকে ধর্মোৎসাহ অপরদিকে রাজ্য অথবা অর্থলোভ ছিল, কিন্তু হিন্দুরা চিতা জ্বালাইয়া স্ত্রী কন্যা ধ্বংস করিয়া আবালবৃদ্ধ মরিয়াছে, মরা উচিত বিবেচনা করিয়া, বাঁচা তাহাদের শিক্ষা বিরুদ্ধ সংস্কার বিরুদ্ধ বলিয়া। তাহাকে বীরত্ব বলিতে পারো, কিন্তু তাহাকে যুদ্ধ বলে না। তাহার মধ্যে উদ্দেশ্য বা রাষ্ট্রনীতি কিছুই ছিল না। পৃ: ১৫৩।

১০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : প্রাচীন সাহিত্য : বিশ্বভারতী : ১৩৯৯।

১. রামায়ণ গৃহধর্মের গ্রন্থ : বাহুবল নহে, জিগীষা নহে, রাষ্ট্রগৌরব নহে, শান্ত রসাস্পদ গৃহধর্মকেই রামায়ণ করুণার অশ্রুজলে অভিষিক্ত করিয়া তাহাকে সুমহৎ বীর্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। পৃ: ১০।

২. হিন্দুদের অস্বাভাবিক ধৈর্য্য : যখন কুরুক্ষেত্রের তুমুল যুদ্ধ আসন্ন তখন সমস্ত ভগবদ্‌গীতা অবহিত হইয়া শ্রবণ করিতে পারে, ভারতবর্ষ ছাড়া এমন দেশ জগতে আর নাই। পৃ: ৫৫ ৩. রাবণ সীতার শত্রু নয় : সীতার চরম শত্রু অধার্মিক রাবণ নহে, সে শত্রু ধর্মনিষ্ঠ রাম, নির্বাসনে তাঁহার এমন সংকট ঘটে নাই যেমন রাজাধিরাজ স্বামীর (রাম) গৃহে। পৃ: ৫৬।

১১ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ:
শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা : অনুবাদ : শুভেন্দ্রকুমার মিত্র :
মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স : ১৩৯০।

১. গীতার রচয়িতা অজ্ঞাতঃ গীতার রচয়িতা কে আমরা জানি না। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের প্রায় সকল গ্রন্থের রচয়িতাই অ-নামা। পৃ: ৬।

২. অর্জুন যুদ্ধ বিরোধী কেন: গীতা যখন রচিত হয় সেই যুগে এই সংসার পরিত্যাগ অনেক সম্প্রদায়ের আদর্শ ছিল। গীতার উদ্দেশ্য অর্জুনের এই বৈরাগ্য নিরসন করা। পৃ: ৬৩।

১২. শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শরৎ সাহিত্য সমগ্র: দ্বিতীয় খণ্ড :
সম্পাদনা : সুকুমার সেন : আনন্দ পাবলিশার্স লি: ১৩৯৩।

১. নারী সম্পর্কে শঙ্করাচার্য: “নরকের দ্বার নারী।” পৃ : ১৯৩৩ (প্রবন্ধ : নারীর মূল্য)।

২. ব্রাহ্মধর্ম কেন উঠে গেল: ব্রাহ্মধর্ম অল্প সময়ে বেশি সমাজ সংস্কার করে। তারা জাতিভেদ তুললেন, আহারের আচার-বিচার তুললেন, সপ্তাহান্তে মন্দিরে জুতা-মোজা পায়ে দিয়ে উপাসনার ব্যবস্থা করলেন। এতে সমাজ বৈরি হয়। ফলে ব্রাহ্মরা হিন্দু সমাজ থেকে আলাদা হয়ে গেল। অথচ সমাজ যদি এগুলো গ্রহণ করত তা হলে এত দুর্দশা আমাদের হত না। পৃ:২০৮৮ (পুস্তক আকারে অপ্রকাশিত রচনা : প্রবন্ধ: সমাজে ধর্মের মূল্য)।

৩. সমাজ সংস্কার ব্রাহ্মণকেই করতে হবে : “দেশের ব্রাহ্মণেরাই যদি সমাজ-যন্ত্ৰ এতাবৎকাল পরিচালন করিয়া আসিয়া থাকেন, ইহার মেরামতি কার্য তাহাদিগকেই দিয়াই করাইয়া লইতে হইবে। এখানে হাইকোর্টের জজেরা হাজার বিচক্ষণ হওয়া সত্ত্বেও কোন সাহায্যই করিতে পারিবেন না।” পৃ: ২০৮৮ (পুস্তক আকারে অপ্রকাশিত রচনা : প্রবন্ধ: সমাজে ধর্মের মূল্য)।

৪. সত্য ও স্বাধীন বিচার রহিত হিন্দু শাস্ত্র : “বস্তুত: (এই) সত্য ও স্বাধীন বিচার হইতে ভ্রষ্ট হইয়াই হিন্দুর শাস্ত্ররাশি এমন অধঃপতিত হইয়াছে। নিছক নিজের বা দলটির সুবিধার জন্য কত যে রাশিরাশি মিথ্যা উপন্যাস রচিত এবং অনুপ্রবিষ্ট হইয়া হিন্দুর শাস্ত্র ও সমাজকে ভারাক্রান্ত করিয়াছে, কত অসত্য যে বেনামীতে প্রাচীনতার ছাপ মাখিয়া ভগবানের অনুশাসন বলিয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, তাহার পরিসীমা নাই।” পৃ:২০৯১ (পুস্তক আকারে অপ্রকাশিত রচনা:প্রবন্ধ সমাজে ধর্মের মূল্যের)।

৫. বেদের সব কিছু অকাট্য নয় : “বেদের মধ্যে যখন রূপকের স্থান রহিয়াছে, তখন বুদ্ধি-বিচারের অবকাশ আছে। সুতরাং শুধু উক্তিকেই অকাট্য যুক্তি বলিয়া দাঁড় করানো যাইবে না।” (শরৎচন্দ্র চার বর্ণের ওপর বেদের সূক্তটি অর্থাৎ দশম মণ্ডলের ৯০ সূক্তটি আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে এটি খাঁটি সত্য জিনিষ নয় – রূপক)। পৃ: ২০৯৪ (পুস্তক আকারে অপ্রকাশিত রচনা : প্রবন্ধ : সমাজে ধর্মের মূল্য)।

৬. শ্লোক আওড়ানো বন্ধ হোক: “ভগবন, এই সমস্ত শ্লোক আওড়ানোর হাত হইতে এই হতভাগ্য দেশকে রেহাই দাও। ঢের প্রায়শ্চিত্ত করাইয়া লইয়াছ, এইবার একটু নিষ্কৃতি দাও।” পৃ:২০৯৫ (পুস্তক আকারে অপ্রকাশিত রচনা: প্রবন্ধ : সমাজে ধর্মের মূল্য)।

৭. হিন্দুর ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণ: “বুঝি, ছোঁয়াছুঁয়ি আচার-বিচারের অর্থ নেই, তবু মেনে চলি; বুঝি, জাতিভেদ মহা-অকল্যাণকর, তবু নিজের আচরণে তাকে প্রকাশ করিনে, বুঝি ও বলি, বিধবা বিবাহ উচিত তবু নিজের জীবনে তাকে প্রত্যাহার করি, জানি খদ্দর পরা উচিত, তবু বিলাতী কাপড় পরি, একেই বলি আমি অসত্যাচরণ। দেশের দুর্দশা ও দুর্গতির মূলে এই মহাপাপ যে আমাদের কতখানি নীচে টেনে এনেছে, এ হয়ত আমরা কল্পনাও করিনে। পৃ:২১৪০ (পুস্তক আকারে অপ্রকাশিত রচনা: প্রবন্ধ : সত্যাশ্রয়ী)

১৩. রাজশেখর বসু :
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকৃত মহাভারত: সারানুবাদ : ভূমিকা:
এম. সি. সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রথম মুদ্রণ-১৩৫৬ : দশম মুদ্রণ-১৩৯৪।

১. মহাভারত একটি সংকলন : “মহাভারতকে সংহিতা অর্থাৎ সংগ্রহ গ্রন্থ এবং পঞ্চম বেদ স্বরূপ ধর্মগ্রন্থ বলা হয়। যে সকল খণ্ড খণ্ড আখ্যান ও ঐতিহ্য পুরাকালে প্রচলিত ছিল তাই সংগ্রহ করে মহাভারত সংকলিত হয়েছে।” পৃ: বইয়ের ভূমিকা।

২. মহাভারত স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক ঘটনার মিশ্রণ: “সেখানে (মহাভারত) দেবতা আর মানুষের মধ্যে অবাধে মেলামেশা চলে, ঋষিরা হাজার হাজার বৎসর তপস্যা করেন এবং মাঝে মাঝে অপ্সরার পাল্লায় পড়ে নাকাল হন, … যজ্ঞ করাই ছিল রাজাদের সব চেয়ে বড় কাজ। লোকে কথায় কথায় শাপ দেয়, সে শাপ ইচ্ছা করলেও প্রত্যাহার করা যায় না। স্ত্রী পুরুষ অসংকোচে তাদের কামনা ব্যক্ত করে। পুত্রের এতই প্রয়োজন যে ক্ষেত্রজ পুত্র পেলেও লোক কৃতার্থ হয়। মনুষ্য জন্মের জন্য নারীগর্ভ অনাবশ্যক, মাছের পেট শরের ঝোপ বা কলসীতেও জরায়ুর কাজ হয়।” পৃ: বইয়ের ভূমিকা।

৩. মহাভারতের অসংগতি : “মহাভারতে যে ঘটনাগত অসংগতি দেখা যায় তার কারণ বিভিন্ন কিংবদন্তীর যোজনা। চরিত্রগত অসংগতির কারণ বহু রচয়িতার হস্তক্ষেপ, অন্য কারণ প্রাচীন ও আধুনিক আদর্শের পার্থক্য।” পৃ: বইয়ের ভূমিকা।

৪. ব্যাসদেবের তিন পুত্র : “ব্যাস, ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডু বিদুরের জন্মদাতা।”

৫. রহস্যময় কৃষ্ণ ও তাঁর চরিত্রের অসঙ্গতি: “মহাভারতের সবচেয়ে রহস্যময় পুরুষ কৃষ্ণ। বহু হস্তক্ষেপের ফলে তাঁর চরিত্রেই বেশী অসংগতি ঘটেছে। মূল মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণকে ঈশ্বর বললেও সম্ভবত তাঁর আচরণে অতিপ্রাকৃত ব্যাপার বেশী দেখান নি। সাধারণত তাঁর আচরণ গীতা ধর্ম ব্যাখ্যাতারই যোগ্য, তিনি বীরাগভয় ক্রোধ স্থিতপ্রজ্ঞ লোকহিতে রত কিন্তু মাঝে মাঝে তাঁর যে বিকার দেখা যায় তা ধর্মসংস্থাপক পুরুষোত্তমের পক্ষে নিতান্ত অশোভন, যেমন ঘটোৎকচ বধের পর তাঁর উদ্দাম নৃত্য এবং দ্রোণ বধের উদ্দেশ্যে যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যাভাষণের উপদেশ। …তিনি রাজা নন, যাদব অভিজাততন্ত্রের একজন প্রধান মাত্র।” পৃ:বইয়ের ভূমিকা।

১৪. প্রমথ চৌধুরী
প্রবন্ধ সংগ্রহ : বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ:
প্রবন্ধ ভারতবর্ষের ঐক্য : কলকাতা : ১৯৯৩।

১. বর্ণাশ্রম ধর্ম ও সনাতন ধর্ম একটি শতরঞ্জ: “এ সমাজ (হিন্দু সমাজ) শতরঞ্জের ঘরের মতো ছক-কাটা। এবং কার কোন ছক, তাও সুনির্দিষ্ট। এই সমাজের ঘরে কে সিধে চলবে, কে কোনাকুনি চলবে, কে এক পা চলবে, আর কে আড়াই পা চলবে তারও বাঁধাবাঁধি নিয়ম আছে। এর নাম বর্ণাশ্রম ধর্ম। নিজের নিজের গণ্ডীর ভিতর অবস্থিতি করে নিজের নিজের চাল রক্ষা করাই হচ্ছে ভারতবাসীর সনাতন ধর্ম।” পৃ: ২৮৬।

২. বেদাত্ম মত ব্যবহারিক জীবনকে সংকীর্ণ করেছে : “বেদান্ত মত আমাদের মনোজগৎকে যে পরিমানে উদার ও মুক্ত করে নিয়েছে, আমাদের ব্যবহারিক জীবনকে সেই পরিমাণে বন্ধ ও সংকীর্ণ করে ফেলেছে। বেদান্তের দর্পণে প্রাচীন যুগের সামাজিক মন প্রতিপফলিত হয়নি, প্রতিহত হয়েছে। বেদান্তদর্শন সামাজিক জীবনের প্রকাশ নয়, প্রতিবাদ।” পৃ: -২৮৭।

৩. আর্যদের স্বধর্ম: “প্রাচীন আর্যজাতির মনে দেশ প্রীতির চাইতে আত্মপ্রীতি ঢের বেশি প্রবল ছিল। দেশের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা নয়, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষাই ছিল তাঁদের স্বধর্ম।” পৃ: ২৮৯ ৪. হিন্দুর সমাজ একটি কারাগার : “ভারতবাসী আর্যদের কৃতিত্ব সাম্রাজ্য গঠনে নয়, সমাজ গঠনে; এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় শিল্পে-বাণিজ্যে নয়, চিন্তার রাজ্যে। শাস্ত্রের ভাষায় বলতে হলে ‘পৃথিবীর সর্বমানবকে’ আর্য আচার শিক্ষা দেওয়া এবং সেই আচারের সাহায্যে সমগ্র ভারতবাসীকে এক সমাজভুক্ত করাই ছিল তাদের জীবনের ব্রত। তার ফলে, হিন্দু সমাজের যা-কিছু গঠন আছে তা আর্যদের গুণে এবং যা-কিছু জড়তা আছে তাও তাঁদের দোষে। এই বিরাট সমাজের ভিতর নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও প্রভুত্ব রক্ষা করবার জন্য তাঁরা যে দুর্গ গঠন করেছিলেন, তাই আজ আমাদের কারাগার হয়েছে।” পৃ: ২৯৩।

১৫. ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার
বাংলাদেশের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড), জেনারেল প্রিন্টার্স য়্যাণ্ড
পাবলিশার্স প্রা: লি: অষ্টম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৮৮।

১. বাংলার আদি অধিবাসী নিষাদ জাতি : “বাংলা দেশে কোনো, শবর, পুলিন্দ, হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল প্রভৃতি যে সমুদয় আদিম জাতি দেখা যায় ইহারাই বাংলার আদিম অধিবাসীগণের বংশধর। …এই মানবগোষ্ঠীকে ‘অস্ট্রো-এশিয়াটিক’ অথবা ‘অস্ট্রীক’ এই সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে; কিন্তু কেহ কেহ ইহাদিগকে নিষাদ ‘জাতি’ এই আখ্যা দিয়াছেন। বাংলার নিষাদ জাতি প্রধানত কৃষিকর্ম দ্বারা জীবনধারণ করিত এবং গ্রামে বাস করিত। … সমতল ভূমিতে এবং পাহাড়ের গায়ে স্তরে স্তরে ধান্য উৎপাদন প্রণালী তাহারাই উদ্ভাবন করে। …কুড়ি হিসাবে গণনা করা এবং চন্দ্রের হ্রাসবৃদ্ধি অনুসারে তিথি দ্বারা দিনরাত্রির মাপ তাহারাই এদেশে প্রচলিত করে।” পৃ: ১৪।

২. ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ আর্য নন : আদি অধিবাসী নিষাদ এবং পরবর্তীতে আসা দ্রাবিড় ও ব্রহ্ম তিব্বতীয় ভাষাবাষী লোকদের পরে আসে বর্তমান ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থদের পূর্বপুরুষরা। ড. মজুমদারের মতে “তাহারা যে বৈদিক আর্যগণ হইতে ভিন্ন জাতীয় ছিলেন, এ- বিষয়ে পণ্ডিতগণের মধ্যে কোন মতভেদ নাই।” পৃ: ১৪-১৫।

৩. বাঙালি ব্রাহ্মণের রক্তের বিশুদ্ধতার দাবি ভিত্তিহীন: ড. মজুমদার প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের নৃতাত্ত্বিক গবেষণার ফল উল্লেখ করে লিখছেন: “বাংলাদেশের ব্রাহ্মণের সহিত ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ব্রাহ্মণ অপেক্ষা বাংলার কায়স্থ, বৈদ্য, সদগোপ, কৈবর্ত প্রভৃতির সহিত সম্বন্ধ অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ।” পৃ : ১৬।

৪. প্রাক-আর্য বাঙালি উন্নত সভ্যতার অধিকারী: প্রাক-আর্য বাঙালি খুবই উন্নত মানের সভ্যতার অধিকারী ছিল। তাঁর স্বপক্ষে পণ্ডিতপ্রবর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতামত উদ্ধৃত করে তিনি আরও বলেন: “কোন কোন পণ্ডিত সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে খ্রীস্ট জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে সিন্ধু নদের উপত্যকায়, মধ্যভারতে ও রাজস্থানের অনেক জায়গায় যেমন তাম্র- প্রস্তর যুগের সভ্যতা ছিল বাংলাদেশের এই (সম্ভবত অন্য) অঞ্চলেও সেরূপ সভ্যতাসম্পন্ন মনুষ্যগোষ্ঠী বাস করিত। ইহারা ধান্য চাষ করিত…ইহার অধিবাসীরা ইটের ও পাথরের ভিত্তির উপর প্রশস্ত গৃহ নির্মাণ করিত। … খুব সম্ভবত চাউলই লোকের প্রধান খাদ্য ছিল।” পৃ: ১৭-১৮।

৫. প্রথম বাঙালি সার্বভৌম নরপতি শশাঙ্ক শৈব ছিলেন: “বাঙালি রাজগণের মধ্যে শশাঙ্কই প্রথম সার্বভৌম নরপতি। …৬০৬ অব্দের পূর্বে শশাঙ্ক একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। … শশাঙ্ক শিবের উপাসক ছিলেন।” পৃষ্ঠা ৩৫-৪১।

৬. বল্লাল সেন শৈব ছিলেন: “বাংলায় পাশুপত সম্প্রদায় (শৈব) খুব প্রবল ছিল। সদাশিব সেনরাজগণের ইষ্ট দেবতা ছিলেন, রাজকীয় মুদ্রায় তাঁহার মূর্তি উৎকীর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়। বিজয় সেন ও বল্লাল সেন শৈব ছিলেন। লক্ষণ সেন ও তাহার বংশধাগণ বৈষ্ণব হইলেও কুলদেবতা সদাশিবকে পরিত্যাগ করেন নাই।” পৃ: ১৮৬।

দ্বিতীয় খণ্ড (মধ্যযুগ)

৭. ‘হিন্দু’ নামের প্রেক্ষাপট: “প্রাচীন যুগে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায় থাকিলেও মূলত: ইহারা একই ধর্ম হইতে উদ্ভূত এবং ইহাদের মধ্যে প্রভেদ ক্রমশঃ অনেকটা ঘুচিয়া আসিতেছিল। প্রাচীন যুগের শেষে বৌদ্ধধর্মের পৃথক সত্তা ছিল না বলিলেই হয়। জৈন ধর্মের প্রভাবও প্রায় বিলুপ্ত হইয়াছিল। সুতরাং মুসলমানেরা যখন এদেশে আসিয়া বসবাস করিল তখন ‘হিন্দু’ এই সাধারণ নামেই তাহারা এখানকার জাতিধর্ম ও সমাজকে অভিহিত করিল।” পৃ: ২৩১।

৮. হিন্দু সমাজের নিচে স্থান পেল প্রাক্তন বৌদ্ধরাঃ “বাংলাদেশে বৌদ্ধ পাল রাজত্বের সময় অনেক বৌদ্ধ ছিল। সেন রাজারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন, তাহার ফলে অনেক প্রাক্তন বৌদ্ধ সমাজের নিম্নস্তরে পতিত হয়।” পৃ: ২৩২।

৯. মধ্যযুগে হিন্দুর ধর্মচর্চায় যাগযজ্ঞাদি ছিল না: এ যুগে বারো মাসেই পূজা-পার্বণ ছিল। বৈদিক যাগযজ্ঞাদির বিশেষ প্রচলন ছিল না। ব্যাপক প্রচলিত ছিল ব্রতানুষ্ঠান, তন্ত্রের প্রগাঢ় প্রভাব ছিল। পূজাপার্বণে তান্ত্রিক মন্ত্রের প্রয়োগ তান্ত্রিক মণ্ডল, মুদ্রা, যন্ত্র ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। তান্ত্রিক দীক্ষা ছিল অপরিহার্য। প্রভাবশালী সম্প্রদায় ছিল শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব। পৃ: ২৪০।

১০. কালীপূজার প্রবর্তক: “বাংলাদেশে প্রচলিত কালীপূজার প্রবর্তক ছিলেন ‘তন্ত্রসার’- প্রণেতা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। এই দেশে প্রচলিত কালীমূর্তির পরিকল্পনা করিয়াছিলেন কৃষ্ণানন্দ।” পৃ: ২৪১।

১১. ‘শ্রাদ্ধ’ অর্থ কি? : “শূলপাণির মতে, সম্বোধন পদের দ্বারা আহুত উপস্থিত পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে হবিত্যাগের নাম শ্রাদ্ধ! রঘুনন্দন বলিয়াছেন যে, বৈদিক প্রয়োগাধীন আত্মার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাপূর্বক অন্নাদি দানের নাম শ্রাদ্ধ।” পৃ: ২৪৩।

১২. প্রায়শ্চিত্ত : “শব্দটি ‘প্রায়’ ও ‘চিত্ত’ এই দুইটি পদ দ্বারা গঠিত; ‘প্রায়’ অর্থাৎ তপ ও ‘চিত্ত’ বলিতে বুঝায় নিশ্চয়। অতএব প্রায়শ্চিত্ত শব্দে বুঝায় এমন তপশ্চর্যা যাহা দ্বারা পাপক্ষালন হইবে বলিয়া নিশ্চিতভাবে জানা যায়।” পৃ: ২৪৫।

১৩. স্মৃতি নিবন্ধগুলো ব্রাহ্মণের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত: বঙ্গীয় স্মৃতিশাস্ত্র দ্বারা হিন্দুর জীবন পরিচালিত। এ সম্বন্ধে বলা হচ্ছে: “জীবনের প্রতি পদক্ষেপেই ব্রাহ্মণবর্ণের প্রাধান্য স্থাপনের প্রয়াস স্মৃতিনিবন্ধগুলির পাতায় পাতায় রহিয়াছে। ব্রাহ্মণ উচ্চতম বর্ণ। কিন্তু অপর দুটি দ্বিজবর্ণের, অর্থাৎ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের তুলনায়ও শূদ্রের স্থান সমাজে অতিশয় হেয়।” পৃ: ২৪৭।

১৪. শূদ্রের জন্য বেদপাঠ নিষিদ্ধ: “শূদ্রের বেদপাঠের অধিকার নাই এবং বিভিন্ন সংস্কারের মধ্যে এক বিবাহ ভিন্ন অন্য কোন সংস্কারে শূদ্র অধিকারী নহে।” পৃ: ২৪৭।

১৫. ‘ব্রতের’ সংজ্ঞা: শূলপাণি বলিয়াছেন যে, যাহার মূলে আছে সঙ্কল্প এবং যাহা দীর্ঘকালানুপালনীয় তাহা ব্ৰত।” পৃ: ২৫৩।

১৬. বৈষ্ণবধর্ম চৈতন্যদেব প্রবর্তন করেন নি: “চৈতন্যের পূর্বেও যে এই বৈষ্ণবধর্ম বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ ও চণ্ডীদাসের ‘পদাবলী’ তাহার সাক্ষ্য দিতেছে।” পৃ:২৫৫

১৭. চৈতন্য দেবের বৈষ্ণব আন্দোলনের পরিণতি: “চৈতন্য কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলিয়া স্বীকার করিতেন। পুরীতে জগন্নাথ মূর্তি দেখিয়া তাঁহার ভাবাবেশ হইয়াছিল। তিনি বৃন্দাবন প্রভৃতি তীর্থের মহাত্ম্য স্বীকার করিতেন। জাতিভেদ না মানিলেও তিনি ইহা কিংবা প্রাচীন হিন্দু প্রথা ও অনুষ্ঠান একেবারে বর্জন করেন নাই। কিছুকাল পরেই তাহার সম্প্রদায় জাতিভেদ ও ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন।” পৃ: ২৭৩-২৭৪।

১৮. দুর্গাপূজা ও কালী পূজা কেন জনপ্রিয়? : “মধ্যযুগে প্রবর্তিত যে কয়েকটি নতুন ধর্মানুষ্ঠান এখনও বাংলাদেশে বিশেষ প্রভাবশালী, তাহাদের মধ্যে দুর্গাপূজা ও কালীপূজা এই দুইটিই প্রধান। ইহার মুখ্য কারণ তান্ত্রিক সাধনার সহিত এই দুই অনুষ্ঠানের নিগূঢ় সংযোগ। বর্তমান কালে যে পদ্ধতিতে দুর্গাপূজা হয় চতুর্দশ শতাব্দী বা তাহার কিছু পূর্বেই তাহার সূত্রপাত হইয়াছিল, কিন্তু সম্ভবত ষোড়শ শতকের পূর্বে তাহা ঠিক বর্তমান আকার ধারণ করে নাই।” পৃ: ২৭৯।

১৯. কালী পূজা জনপ্রিয় কবে থেকে? : “দীপালি উৎসবের দিনে কালীপূজার বিধান ১৭৬৮ খ্রীস্টাব্দে রচিত কাশীনাথের ‘কালীসপর্যাবিধি’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। ইহার খুব বেশি পূর্বে কালীপূজা সম্ভবত বাংলাদেশে সুপরিচিত ছিল না। প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রই কালীপূজার প্রবর্তন করেন এবং দণ্ডের ভয় দেখাইয়া তাহার প্রজাদিগকে এই পূজা করিতে বাধ্য করেন।” পৃ: ২৮০-৮১।

২০. স্মার্ত রঘুনন্দন সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ করেন: “সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক প্রভৃতি জাতির লোক বাণিজ্য করিয়া লক্ষপতি হইত এবং সমাজে খুব উচ্চ স্থান অধিকার করিত। মঙ্গলকাব্যগুলিতে এই শ্রেণীর প্রাধান্য বর্ণিত হইয়াছে। স্মার্ত রঘুনন্দন সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ করিয়াছিলেন? পৃ: ২৯০।

২১. ডোম ও বাগদিরাই সাহসী: মাধবাচার্য্যের চণ্ডীকাব্যের একটি কবিতা উদ্ধৃত করে লেখক বলছেন “অনুমিত হয় যে ব্রাহ্মণাদি সমস্ত জাতির লোকই সৈনিকের কাজ করিত (অথবা করিতে বাধ্য হইত)। কিন্তু সে যুগে (এবং এ যুগেও) যে ডোম বাগদিরা সমাজের সর্বনিম্নস্তরে অবস্থিত এবং অবহেলিত, তাহারা যে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিত উচ্চশ্রেণীর বাঙালীরা তাহা পারে নাই।” পৃ: ৩১২।

২২. বাঙালি হিন্দুর পেছনে পড়ার কারণ: মধ্যযুগে “বিদেশীর নিকট হইতে নতুন নতুন জ্ঞানলাভের স্পৃহা তাহাদের (হিন্দুদের) মোটেই ছিল না, এবং ভারতের বাহিরে যে বিশাল জগৎ আছে তাহার সম্বন্ধে তাহারা কিছুই জানিত না। …চীন দেশের তিনটি আবিষ্কার মুদ্রণ যন্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র ও চুম্বক দিগদর্শন যন্ত্র-সভ্য জগতে যথাক্রমে শিক্ষা ও চিন্তার রাজ্যে, যুদ্ধে ও সমুদ্র যাত্রায় যুগান্তর আনয়ন করিয়াছিল, কিন্তু বাঙালীরা ইহার কোন সংবাদ রাখিত না।” পৃ: ৩১৭।

২৩. অন্যরা যখন জ্ঞানের চর্চা করছে, আমাদের জ্ঞানীরা (ব্রাহ্মণ) তখন পরকীয়া-প্রেম নিয়ে ব্যস্ত: “যেসময়ে ইউরোপে নিউটন, লাইবনিজ, বেকন প্রভৃতি মানুষের প্রজ্ঞাশক্তি ও জ্ঞানের পরিধি বিস্তার করিতেছিলেন সেই সময় বাঙালীর মনীষা নব্যনায়ের (ন্যায়শাস্ত্র) সূক্ষ্মাতিসূক্ষ বিচারে, বাঙালীর প্রজ্ঞা কোন তিথিতে কোন দিকে যাত্রা শুভ বা অশুভ এবং ভোজ্য দ্রব্য বিধেয় বা নিষিদ্ধ তাহার নির্ণয়ে, এবং বাঙালীর ধর্মচিন্তা ও হৃদয়বৃত্তি স্বকীয় অপেক্ষা পরকীয়া প্রেমের আপেক্ষিক উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠার জন্য ছয় মাস ব্যাপী তর্কযুদ্ধে নিয়োজিত ছিল। পৃ: ৩১৭।

২৪. কৃত্তিবাসী রামায়ণে কৃত্তিবাসের কিছুই নেই: “ কৃত্তিবাস (পঞ্চদশ শতাব্দী) সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। …কৃত্তিবাসের রামায়ণ বিপুল প্রচারলাভ করিবার ফলে লোকমুখ এত পরিবর্তিত হইয়াছে এবং তাহাতে এত প্রক্ষিপ্ত অংশ প্রবেশ করিয়াছে যে কৃত্তিবাস-রচিত মূল রামায়ণের বিশেষ কিছুই আজ বর্তমান প্রচলিত ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ এর মধ্যে অবশিষ্ঠ নাই।” পৃষ্ঠা ৩৬৫-৬৬। তিনি (কৃত্তিবাস) বাল্মীকির রামায়ণকে অবিকলভাবে অনুসরণ করেন নাই। (পৃ:৩৭০)।

২৫. আসামের শঙ্করদেব শূদ্র ছিলেন : “শঙ্করদেব ( ষোড়শ শতক) আসামের বিখ্যাত বৈষ্ণব ধর্মপ্রচারক। শূদ্র হইয়াও তিনি ব্রাহ্মণদের দীক্ষা দিতেন, এই অপরাধে তাঁহাকে স্বদেশে নিগৃহীত হইতে হয়। তখন তিনি কামতা ( কোচবিহার) রাজ্যে পলাইয়া আসেন এবং কামতারাজের আশ্রয়ে অবশিষ্ট জীবন কাটাইয়া পরলোকগমণ করেন।” পৃ: ৩৮৭।

২৬. কাশীরাম দাসের মহাভারত : কাশীরামের আসল নাম কাশীরাম দেব, পিতা কমলাকান্ত দেব। জাতিতে কায়স্থ বলে তাঁরা পদবীতে দাস ব্যবহার করতেন। আদি নিবাস কাটোয়া। কাশীরাম দাসের নামে চালু মহাভারতের মাত্র সাড়ে তিন পর্ব তিনি লিখেছেন। এই সাড়ে তিনটি পর্ব হচ্ছে: আদিপর্ব, সভাপর্ব ও বিরাট পর্ব। বণপর্বের কিছু লিখে তিনি পরলোকগমণ করেন। তাঁর সম্পর্কিত ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরাম দাসের দাবি তিনি বাকি অংশ রচনা করেন। কিন্তু তিনিও তা শেষ করতে পারেন নি। আসলে গায়েনরা নন্দরাম ও অন্যান্য কবির রচনা থেকে খুশিমত নিয়ে কাশীরামের সাড়ে তিনপর্বের সাথে যোগ করে অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত রচনা করেন। ইহাই কাশীরামী ‘মহাভারত’। পৃ: ৩৮৮-৯০।

১৬. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
শহীদুল্লাহ রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) : সম্পাদক :
আনিসুজ্জামান : বাংলা একাডেমী : ঢাকা ১৯৯৫।

১. বাংলা ভাষার প্রাচীনতম লেখক: “মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথ যে নাথপন্থার আদি গুরু বা প্রবর্তক এবং বাংলা ভাষার প্রাচীনতম লেখক, তাহা অনেকেই স্বীকার করিয়াছেন। মীননাথের নামান্তর যে মৎস্যেন্দ্রনাথ তাহা নাথগীতিকায় পাওয়া যায়।” পৃ:-৯। “বর্তমানে আমরা যতদূর জানিতে পারিয়াছি তাহাতে বলা যা ইতে পারে যে, মৎস্যেন্দ্রনাথই বঙ্গের আদি কবি। তিনিই প্রাচীন ধর্মের শাপে বিনষ্ট বঙ্গ সন্তানগণকে পুনরুজ্জীবিত করিবার জন্য সর্বপ্রথম বাণীর সরস মন্দাকিনী বঙ্গভূমিতে প্রবাহিত করেন। পৃ: ১৩।

২. পালি সাহিত্যের উৎপত্তি : “ব্রাহ্মণ্যধর্মের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বৌদ্ধধর্মে পালি সাহিত্যের উৎপত্তি।” পৃ: ১২।

৩. একজন বাঙালি ভারতবর্ষকে একটি ধর্মমত দেন: “মীননাথই বাংলা ভাষার আদিম লেখক। মীননাথ বাঙালী। তাঁহার নামান্ত্রর মীনপাদ, মৎস্যেন্দ্ৰনাথ, মচ্ছিন্দ্রনাথ, মৎস্যেন্দ্ৰপদ, মচ্ছেন্দপদ, মোছন্দর। বাংলাদেশের যোগী সম্প্রদায় আদৌ নাথপন্থাবলম্বী ছিল। এক সময়ে সমস্ত ভারতবর্ষে এই নাথপন্থার বিশেষ প্রভাব ছিল। এখনও কিছু আছে। আদিনাথ শিব। তাঁহার পরেই মীননাথ, গোরক্ষনাথ, জালন্ধরী, হাড়িপা, কানুপা প্রভৃতি সিদ্ধগণ নাথপন্থার প্রধান দেবতা আদৌ ছিলেন নিরঞ্জন বা শূন্য। পরে নিরঞ্জনকে শিবের সঙ্গে মিলাইয়া দেওয়া হইয়াছে। নাথ পন্থার আদি প্রচারক মীননাথ। বাঙালীর ইহা একটি গৌরবের বিষয় যে, একজন বাঙালী গোটা ভারতবর্ষকে একটা ধর্মমত দিয়াছিলেন। এই নাথপন্থারই অন্যনাম সহজসিদ্ধি। ইহা পরে তিব্বতে প্রভাব বিস্তার করে।” পৃ: ২৪।

৪. সহজযান ও নাথধর্ম: “মীননাথ ও মৎস্যেন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার আদিম লেখক আর সহজযান মতের প্রবর্তক। নাথ সম্প্রদায় আদিনাথ শিবের পরেই মীননাথের নাম করে। সহজযান বা সহজসিদ্ধিকে তান্ত্রিক বৌদ্ধ মত বলা হয়। কিন্তু ঠিক বলিতে গেলে ইহাকে বৌদ্ধযোগ বলা যাইতে পারে। হিন্দুযোগের সাথে ইহার অনেক মিল আছে। আসলে আর্যদের ভারতে আসিবার পূর্বে প্রাচীন অনার্য ভারতীয়দের মধ্যে যোগ প্রচলিত ছিল। মহেন-জো-দারো ও হরাপ্পার প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা হইতে তাহা প্রমাণিত হইয়াছে। এই যোগ প্রথমে আর্যেরা গ্রহণ করিয়াছিলেন। পরে বৌদ্ধ ও জৈনেরা গ্রহণ করেন। এমন কি মুসলমান সুফীসম্প্রদায়ও গ্রহণ করেন। আমরা যে সমস্ত অতি প্রাচীন বাংলা লেখককে পাইয়াছি, তাঁহারা সকলেই এই সহজযান বা বৌদ্ধযোগ প্রচার করিয়া গিয়াছেন। এই সহজযানই নাথধর্ম।

নাথেরা চুরাশি সিদ্ধার উল্লেখ করেন। তিব্বতীতে ইহাদের বলা হয় “গ্রব-ছেন-গ্যা-বশি।” তাঁহাদের চুরাশিজন মহাসিদ্ধের মধ্যে মীননাথ, কানুপা, শবরীপা, লুইপা, বিরূপা আছেন। বলা ভাল “পা” সংস্কৃত “পাদ” হইতে ব্যুৎপন্ন, সম্মানের জন্য সিদ্ধাদের নামের সঙ্গে বসানো হয়। এখানে সংক্ষেপে এই কথাটা বুঝাইতে চাই যে, ইহাদের মতকে কেন যোগ বলা হইবে।

যোগের মূল কথা চিত্তবৃত্তির নিরোধ। পতঞ্জলি বলিয়াছেন, “যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধ:।’ মনে নানা চিন্তার ঢেউ উঠে; শয়নে স্বপনে, জাগরণে তাহার বিরাম নাই। মনকে করিতে হইবে চিন্তাশূন্য নির্বাত নিষ্কম্প প্রদীপের মত স্থির। তাহার একটি উপায় হইতেছে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করা। পতঞ্জলি ইহাকেই বলিয়াছেন, “প্রচ্ছদনবিধারণাভ্যাং প্রাণস্য।” যোগের চূড়ান্ত অবস্থা সমাধি। যোগের সাক্ষাৎ ফল হইতেছে নানা প্রকার অলৌকিক ক্ষমতালাভ, যাহাতে বিভূতি বা সিদ্ধি লাভ হয়।” পৃ: ৩৭।

৫. ধর্মপূজা: “নাথপন্থার সহিত যোগতান্ত্রিক বৌদ্ধমতের যেমন সাক্ষাৎ সম্পর্ক, ধর্মপূজার সহিত তেমন সম্পর্ক নাই। নাথপন্থা সহজসিদ্ধির খাঁটি উত্তরাধিকারী, ধর্মপূজা হিন্দু ধর্মের বৌদ্ধমতের (মূলত: শূন্যবাদের) মিশ্রণে উৎপন্ন। পরবর্তীকালের কবীরপন্থা, নানক-পন্থা প্রভৃতির ন্যায় ধর্মপূজাও একটি সঙ্কর ধর্ম। পরে অবশ্য ধর্মপূজায় নাথপন্থা হইতে কিছু আসিয়া মিশিয়াছিল।” পৃ: ৭৩।

৬. সেন-রাজারা বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করতেন: “তখনকার দিনে বাংলা ভাষার সঙ্গে বৌদ্ধ সহজিয়াদের নিগূঢ় সম্পর্ক ছিল। তাই সেন রাজারা বাংলা ভাষাকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতে পারেন নাই। রাজার অনাদরে, রাজপুরুষদের তাড়নায়, ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের ঘৃণায় সেনদের সময়ে বাংলা সাহিত্যের স্রোত একরূপ বদ্ধ হইয়া গিয়াছিল।” পৃ: ৮৯।

৭. “হিন্দু” নাম: “বস্তুত: মুসলমান রাজত্বের পূর্বে “হিন্দু” এই সাধারণ জাতীয় নামই ছিল না। ছিল ব্রাহ্মণ, শূদ্র ইত্যাদি প্রাচীন বর্ণমূলক জাতি কিংবা স্বর্ণকার, কর্মকার, তন্তুবায় ইত্যাদি ব্যবসায়মূলক জাতি। কিন্তু হিন্দু জাতি ছিল না। পৃ: ১৪৯।

৮. হিন্দু ধর্ম : “হিন্দু জাতি যেমন ছিল না, হিন্দু ধর্মও ছিল না। ছিল শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, সৌর বা গাণপত্য সম্প্রদায়। ইহাদের মধ্যে শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব এই তিন সম্প্রদায়ই প্রবল চিল।” পৃ: ১৪৯।

৯. সত্যপীর : “পাঠান আমলের শেষভাগে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের উদ্দেশে সত্যপীরের পূজার প্রচলন হয়। ইহা বেশ জনপ্রিয় হইয়াছিল।” পৃ: ১৪৯।

১৭. অন্নদাশঙ্কর রায়
নব্বই পেরিয়ে : দে’জ পাবলিশিংঃ কলকাতা।

১. বারোয়ারি পূজা: “আমার শৈশবে বারোয়ারি পূজা ছিল না। যেটা ছিল সেটা জমিদার-তালুকদারদের পারিবারিক পূজা।” পৃ: ২৯।

২. বেদ অনুবাদ করতে দেয়া হতো না : “ইংরেজরা না এলে (জাগরণ) কোনদিন সম্ভব হতো না। ইংরেজরা আসার ফলে আমরা দেখলাম, ‘পুরাণ’টা ইতিহাস নয়। …চন্দ্রগ্রহণ কেন হয় জানতাম না, জানলাম। পৃথিবীর ম্যাপ কখনো দেখিনি- চোখের সামনে একটা Globe পেলাম। তারপর এলো রেল, জলযান, টেলিগ্রাফ ইত্যাদি। … এইভাবে প্রাচীনের নতুন করে মূল্যায়ন শুরু হলো। ঋগ্বেদ অনুবাদ করলেন রমেশচন্দ্র দত্ত। বেদকে অনুবাদ করতে দেওয়া হতো না। সংস্কৃতই পড়তে দেয়া হতো না, কয়েক ঘর ব্রাহ্মণ মাত্র পড়তেন। সব ব্রাহ্মণেও পড়তো না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শুরু করলেন সংস্কৃত পড়ানো। কিন্তু উনিও সবটা পারলেননা—কায়স্থ ও নবশাখ অবধি নামতে রাজী ছিলেন, সোনার বেণে নয়।” পৃ:৪৩।

১৮. অন্নদাশঙ্কর রায়
নতুন করে ভাবা: দে’জ পাবলিশিং : প্রবন্ধ : ভারতীয়
সংস্কৃতি ও বিপন্নতা নিয়ে ভাবনা : কলকাতা : ১৯৯৯।

১. বাংলায় বেদ নয় তন্ত্রের প্রাধান্য : “আর্যদের দেবীর চেয়ে লৌকিক দেব- দেবীর সংখ্যা ও প্রভাব এদেশে তখনও বেশি ছিল, এখনও বেশি। বেদের চেয়ে তন্ত্রের প্রভাব এদেশে বেশি। ব্রাহ্মণ প্রাধান্য দেড় হাজার বছরের আগে ছিল না। তার পূর্বে বৌদ্ধ প্রাধান্য, জৈন প্রাধান্য ছিল।” পৃ : ৫৬।

২. কুপমণ্ডূকতার ফল ইসলাম : “কুপমুণ্ডক অবস্থায় ভারতের দুর্বলতা ইসলামকে সহজে পথ ছেড়ে দেয়।” পৃ: ৫৭।

৩. বস্তুজ্ঞান বনাম ব্রহ্মজ্ঞান: “বস্তুজ্ঞান না থাকলে কি ব্রহ্মজ্ঞান থাকে? ব্রহ্মজ্ঞান থাকলে আরো কয়েকটি গীতা, উপনিষদ লেখা হত, রাশি রাশি টীকা-ভাষ্য নয়। আরো কয়েকটি দর্শনের উৎপত্তি হত, রাশি রাশি ভক্তিগ্রন্থের বা পুরাণের নয়।” পৃ: ৫৭।

৪. হিন্দুদের পূর্বপুরুষ বৌদ্ধ: “আমাদের পদবী থেকে অনুমান করতে পারি যে আমাদের পূর্বপুরুষরা বৌদ্ধ ছিলেন। এই যেমন ঘোষ, বসু, মিত্র, দত্ত, কর, পালিত, সেন, গুপ্ত, নাথ, নন্দী, পাল,ভদ্র প্রভৃতি। এই সব বল্লাল সেনের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুরুত্থানের পূর্ববর্তী বৌদ্ধ নামগুলির শেষাংশ।” পৃ : ১১১। (প্রবন্ধ: আত্মদ্বীপ প্রবোধচন্দ্র)।

১৯. অন্নদাশঙ্কর রায়
প্রবন্ধ : পঞ্চাশ পূর্তির পূর্বে: সংকলন: স্বাধীনতার ৫০ বছর:
সম্পাদক : শৈলেন কুমার বন্দোপাধ্যায় : মিত্র ও ঘোষ।

১. হিন্দু সমাজে এখন ওলটপালট চলছে : “শ্রেণী হিসেবে না থেকে জাত হিসেবে তফসিলি হিন্দুরাও উন্নতির পর্যায়ে। তা থেকে বামুণের ছেলেরাও নাকি তফসিলি তালিকায় নাম লেখাতে যাচ্ছে, ধরাও পড়ছে। দলিত কন্যা মায়াবতী দেশের বৃহত্তম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। … হিন্দু সমাজে এখন ওলট পালট চলেছে। বর্ণ হিসাবে নিম্নবর্ণ, শ্রেণী হিসাবে উচ্চ শ্রেণী এরকম দৃষ্টান্ত ভুরিভুরি।” পৃ: ১৪।

২. ‘হিন্দু’ থেকে ‘হিন্দুস্থান’ : ‘হিন্দু’ থেকে ‘হিন্দুস্থান’। তার ব্যাপ্তিও বড় কম নয়। জাভার লোক ধর্মে মুসলমান, কিন্তু তাদের সংস্কৃতি হিন্দু। হিন্দুধর্ম বা হিন্দুইজম শব্দটি উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে কেউ ব্যবহার করেনি।” পৃ: ১৭।

৩. ভরতবংশীয়দের উদাহরণ মহৎ নয় : “ভরতবংশীয়রা খুব একটা মহৎ দৃষ্টান্ত রেখে যাননি। কুরু পাণ্ডব মিলে আঠোরো দিনে আঠারো অক্ষৌহিনী পুরুষ হত্যা করেছিলেন। মহাভারত এক মহা ট্র্যাজেডি। ব্যাসদেব এই শিক্ষা দিয়ে গেলেন যে যুদ্ধ জয় করেও সুখ নেই।” পৃ : ১৭।

২০. অন্নদাশঙ্কর রায়
সংস্কৃতির বিবর্তন : বাণীশিল্প : ১৯৮৯।

১. কায়স্থ এত বেশি কেন: কায়স্থদের মত এমন একটি অমনিবাস জাত আর নেই। যে যখন পেরেছে ভিতরে ঢুকেছে, জায়গা না পেয়ে বাদুড় ঝোলা হয়েছে। প্রত্যেকবারের রিপোর্টে (সেন্সাস) তাদের সংখ্যাবৃদ্ধির হার মুসলমানদেরকেও ছাড়িয়ে যায়। পৃ: ৪২-৪৩।

২. কায়স্থদের অবনতি ও উন্নতি : তুর্ক ও মোগল আমলে কায়স্থরা চটপট ফার্সি শিখে নিয়ে সরকার, মজুমদার চৌধুরী প্রভৃতি পদ পায়। জমিদার তালুকদার জায়গীরদার হয়। বৌদ্ধ সমাজে এদের যে মর্যাদা ছিল হিন্দু সমাজে শূদ্র বলে পরিগণিত হয়ে সে মর্যাদা না থাকলেও রাজ দরবারে তাঁদের মর্যাদা কারো চেয়ে কম নয়। তাঁদের কেউ কেউ ‘খান’ উপাধিও পান। পৃ : ৪৩।

৩. হিন্দু কারা : আর্যমিশ্র ভারতই পরে হিন্দুস্থান বলে চিহ্নিত হয়। অধিবাসীরা বৈদিক বৌদ্ধ জৈন নির্বিশেষে হিন্দু। বাইরে থেকে যেসব শক হুন গ্রীক আসে তারা কালক্রমে হিন্দু সমাজের ভেতরেই এক একটা জাত বা কাস্ট বনে যায়, পরে আদান প্রদান সূত্রে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় ইত্যাদি বর্ণভুক্ত হয়। গোড়ায় ছিল যবণ বা বিদেশী। পরে আর যবণ নয়, শকদ্বীপী ব্রাহ্মণ বা রাজপুত। পৃ : ৬৯।

২১. অন্নদাশঙ্কর রায়: বাংলার রেনেসাঁস : মুক্তধারা : ঢাকা : ১৯৯১।

১. হিন্দু ঐতিহ্য যুক্তির নয়: যাকে আমরা হিন্দু ঐতিহ্য বলি তার ঝোঁকটা যুক্তির দিকে নয় বিশ্বাসের দিকে। তাই পুরাণে ইতিহাসে কোন প্রভেদ নেই। পৃ : ১০৫।

২. হিন্দুর চর্বিত চর্বণ কর্ম : হাজার হাজার বছর আমরা চর্বিত চর্বণ ছাড়া আর কিছুই করি নি। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস একই বিষয়বস্তু নিয়ে শত শত গ্রন্থ রচনার ইতিহাস। ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব-বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসও তাই। বিচিত্র অভিজ্ঞতা অপূর্ব আবিষ্কার না হলে রেঁনেশাস হয় না। পৃ : ১১৬।

২২. অন্নদাশঙ্কর রায় : সাতকাহন : করুণা প্রকাশনী : ১৩৮৬।

১. যুধিষ্ঠির জুয়াড়ী : যুধিষ্ঠির যে জুয়াড়ী ছিলেন, জুয়া খেলায় স্ত্রীকে পর্যন্ত বিকিয়ে দিয়েছিলেন, এর জন্য মহাভারতকার তাকে শাস্তি দিলেন না। দিলেন যার জন্য সে অপরাধ অমার্জনীয়। মহাভারতে সত্যেরই জয়। সত্যই ধর্ম। তাই ধর্মের জয়। যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র। পৃ : ৫৩

২. বাল্মীকি অন্ত্যজ শ্রেণির : বাল্মীকি (রামায়ণ রচয়িতা) সম্ভবত অন্ত্যজ ছিলেন। এখন পর্যন্ত কোন ব্রাহ্মণকে তো বাল্মীকি বংশীয় বলে দাবী করতে শোনা যায়নি। পৃ : ৭৪।

৩. ব্যাসদেবও অন্ত্যজ : ব্যাসদেবের (মহাভারত রচয়িতা)মাতৃকুল ধীবর। তারাও অন্ত্যজ। পৃ : ৭৪।

২৩. ড. অতুল সুর সিন্ধু সভ্যতার স্বরূপ ও অবদান: জিজ্ঞাসা: কলকাতা।

১. আর্যরা লিখন প্রণালী জানত না : “আর্যদের মধ্যে লিখন প্রণালী প্রচলিত ছিল এবং ব্রাহ্মী লিপি তাদের দ্বারাই উদ্ভাবিত হয়েছিল এর সপক্ষে কোন প্রমাণ নেই। বরং বেদাদি শাস্ত্ৰ সমূহ অনার্যযোনি সম্ভূত ব্যাসদেব কর্তৃক সংকলন ও অনার্য দেবতা গণেশ কর্তৃক মহাভারতে শ্ৰুতি লিখন এই ট্র্যাডিশান প্রমাণ করে যে লিখন প্রণালী আর্যরা অনার্যদের কাছ থেকে নিয়েছিল।” পৃ : ৪৩।

২. আর্যরা বর্বর : “এখন আর্যদের সম্বন্ধে যখনই কিছু লেখা হয়, তখনই তাদের বর্বর জাতি বলে অভিহিত করা হয়। সর্বত্রই তারা উন্নত মানের প্রাগার্য সভ্যতাকে ধ্বংস করে, নিজেদের হীন ও বর্বর সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এক জায়গাতেই আর্যদের এই প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল। সেটা হচ্ছে ভারতবর্ষে।” পৃ : ৪৭।

৩. হিন্দুর দশাবতার ‘টোটেম’ থেকে প্রাপ্ত : “প্রাগার্য পশু পূজা থেকেই যদি হিন্দু দেবতা- গণের ‘বাহন’-এর উদ্ভব হয়ে থাকে, তা হলে টোটেম-প্রথা থেকেই হিন্দু দশাবতারের কল্পনা বিকশিত হয়েছিল। সম্ভবত: হিন্দুর অবতারসমূহ, এদেশের ধর্ম ও সংস্কৃতির নায়ক বা ‘হিরো’ ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্তত তিনজনকে যথা: রামকৃষ্ণ ও বুদ্ধকে আমরা সেভাবেই জানি। অন্যান্য অবতার সমূহ যথা: মীন, কুর্ম বরাহ, নৃসিংহ ঐরূপ সাংস্কৃতিক নায়কদের টোটেম-এর নাম থেকে উদ্ভূত, এটা অসম্ভব নয়।” পৃ : ৬৩-৬৪।

৪. মৃতের সৎকার : “মৃতের সৎকার সম্বন্ধে সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্র সমূহে দাহ ও সমাধি এই উভয় প্রথারই প্রচলন দেখা যায়।” পৃ : ৬৬।

২৪. ড. অতুল সুর বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় : জিজ্ঞাসা : কলকাতা।

১. মাহিষ্য জাতি: “বর্তমানে চাষী কৈবর্ত্যরা, তার মানে উচ্চশ্রেণীর কৈবর্তরা ‘মাহিষ্য’ নামে পরিচিত।” পৃ : ৪৯।

২৫. ড. অতুল সুর বাংলা ও বাঙালীর সমাজ ও সংস্কৃতি : জ্যোৎস্নালোক : ১৯৯০।

১. ব্রহ্মার চতুর্মুখ কেন : ব্রহ্মা মহাদেবকে অসম্মান করেন। মহাদেব তার একটি মস্তক কর্তন করেন। আগে ব্রহ্মার ছিল পাঁচ মুখ। সেই থেকে ব্রহ্মার চার মুখ। শিবই তার এক মুখ কেটে দেন। পৃ : ১০২।

২. হরি হর : শিব ও অন্য দেবতাদের নিয়ে যে সংঘর্ষ তার পরিসমাপ্তি ঘটে হরি-হর কল্পনায়। পৃ : ১২১।

২৬. নীরদ চন্দ্র চৌধুরী আজি হতে শতবর্ষ আগে : মিত্র ও ঘোষ : ১৯৯৯।

১. অচলায়তন সৃষ্টিতে দুই স্মার্ত পণ্ডিতের অবদান : নৈয়ায়িক ও স্মার্ত দুই পন্ডিত রঘুনাথ ও স্মার্ত রঘুনন্দন হিন্দু সভ্যতার এক দুর্ভেদ্য অচলায়তন সৃষ্টি করিয়াছিলেন। পৃ : ৮৯।

২. ব্রাহ্ম সমাজের কৃতিত্ব: বাঙালি ভদ্র সমাজের উচ্চস্তরে (এই) অনাচার দূরীভূত করিয়া পাপমুক্ত বাঙালি সৃষ্টি করিবার গৌরব প্রথম : প্রাপ্য ব্রাহ্ম সমাজের। এই সমাজ একটা বাঙালি ‘পিউরিটান’ সমাজের সৃষ্টি করিল। পৃ : ১১১।

২৭. অমলেশ ত্রিপাঠী : শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ : আনন্দ পাবলিশার্স।

১. স্বামীজীর ধর্মচক্র : এর পেছনে রয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুর মৈত্রী ভাবনা। পৃ : ৬৮।

২. গীতার ভিত্তি : সাংখ্য যোগ ও বৌদ্ধ মতবাদকে কুক্ষিগত করার প্রথম স্বার্থক চেষ্টা গীতা। পৃ : ৮৭।

৩. জগন্নাথ দেবের মন্দিরে কি আছে : জগন্নাথের মধ্যে সমন্বয় হয়েছিল শবর জাতির টোটেম, উপাসনা,বৌদ্ধ ত্রিরত্ন, পূর্ব উপকূলে পূজিত নৃসিংহ, পশ্চিম উপকূলে পূজিত কৃষ্ণ বলরাম ও সুভদ্রা। পৃ : ৮৯।

২৮. ড. নীহাররঞ্জন রায় বাঙালীর ইতিহাস (আদিপাঠ) : দে’জ পাবিলিশিং: কলকাতা-১৪০০

১. বর্ণবিভাগ কৃত্রিম: ড. রায়ের মতে আনুমানিক খ্রীস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে রচিত ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ একটি উপপুরাণ। তাঁর মতে এটি তুর্কবিজয়ের পর রাঢ়দেশে রচিত। এতে ব্রাহ্মণ বাদে বাংলাদেশের জনসাধারণকে তিনটি ভাগে যথা: উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর ও অন্ত্যজ বা অধম সংকরে ভাগ করা হয়েছে। তিন সংকরে মোট ৩৬টি ভাগ সম্বন্ধে তিনি বলেছেন:

ক. “তালিকা হইতে দেখা যাইবে, বৃহদ্ধর্মপুরাণ যদিও বলিতেছেন ছত্রিশটি জাত না বর্ণ- উপবনের কথা, নাম করিবার সময় করিতেছেন একচল্লিশটির।”

খ. “বর্ণ ও জনের দিক হইতে এই বিভাগ যে কৃত্রিম এ কথা অনস্বীকার্য, তাহা ছাড়া বর্ণ তো কিছুতেই জন-নির্দেশক হইতে পারে না।“

গ. তিনি প্রশ্ন করছেন : “স্বর্ণকার ও স্বর্ণবণিক কেনই বা মধ্যম সংকর, আর গন্ধবণিক ও কংসবণিক কেনই বা উত্তম সংকর, অথবা তৈলকার কেনই বা মধ্যম সংকর।” পৃ: ২৬-২৭।

২. ব্রাহ্মণদের বর্ণসংকর দেখানো হয় নি কেন? “ব্রাহ্মণবর্ণের মধ্যে সাংকর্ষের কথা যে বলা হয় নাই (পুরাণে) তাহার কারণ হয়তো এই যে, এইসব পুরাণ ও স্মৃতি প্রায়শ তাঁহা-দেরই রচনা অথচ নরতত্ত্বের দিক হইতে দেখা যাইবে এই জাতিসাৎকর্ষ অম্বষ্ট (বৈদ্য) ও করণদের (কায়স্থ) সম্বন্ধে যতখানি সত্য ঠিক ততখানি সত্য ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধেও।” পৃ: ২৭।

৩. তথাকথিত নমঃশূদ্র ও উত্তরভারতীয় বর্ণব্রাহ্মণ সমগোত্রীয়: “নমঃশূদ্রদের সম্বন্ধে নরতাত্ত্বিক পরিমিতি-গণনার ফলাফল একটু চাঞ্চল্যকর। এ তথ্য অন্যত্রও উল্লেখ করিয়াছি যে, দেহবৈশিষ্ট্যের দিক হইতে ইহারা উত্তর-ভারতের বর্ণব্রাহ্মণদের সমগোত্রীয়; বস্তুত উত্তর- ভারতের বর্ণব্রাহ্মণদের সঙ্গে বাঙালী ব্রাহ্মণবৈদ্য-কায়স্থদের চেয়েও বাঙালী নমঃ শূদ্রদের আত্মীয়তা (মিল) বেশি। অথচ এই নমঃশূদ্রেরা আজ সমাজের একেবারে নিম্নতম স্তরে! এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণ রচনার কালেই ইহারা অন্ত্যজশ্রেণীভুক্ত। এই সামাজিক তথ্যের সঙ্গে নরতত্ত্বপ্রমাণগত তথ্যের যুক্তির ও ইতিহাসসম্মত ব্যাখ্যায় কোনও সম্বন্ধ এখনও কিছু খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। পৃ: ৩৭-৩৮।

৪. হিন্দু সভ্যতায় আর্যদের একান্ত নিজস্ব কিছু নেই: “বৈদিক আর্যভাষীদের বাস্তব সভ্যতা ছিল একান্তই প্রাথমিক স্তরের। খড়, বাঁশ, লতাপাতার স্বল্প কালস্থায়ী কুঁড়েঘরে অথবা পশুচর্মনির্মিত তাঁবুতে ইহারা বাস করিত, গোপালনজনিত পশুমাংস পোড়াইয়া তাহাই আহার করিত এবং দলবদ্ধ হইয়া এক জায়গা হইতে অন্য জায়গায় ঘুরিয়া বেড়াইত। যাযাবরত্ব ত্যাগ করিয়া এ দেশে আসিয়া যথাক্রমে কৃষি অর্থাৎ গ্রাম-সভ্যতা এবং নগর-সভ্যতার সঙ্গে ধীরে ধীরে তাহাদের পরিচয় ঘটিল এবং ক্রমে তাহারা দুই সভ্যতাকেই একান্তভাবে আত্মসাৎ করিয়া নিজস্ব এক নতুন সভ্যতা গড়িয়া তুলিল। এই সভ্যতার বাহন হইল আর্যভাষা। এই দুই সভ্যতার সমন্বিত আর্যভাষীদের হইল কীর্তি; অথচ বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে তাহাদের একান্ত নিজস্ব কিছু তাহাতে বিশেষ নাই।” পৃ: ৫৩।

৫. বাঙালি হিন্দুদের প্রতি পূজা, আচার-অনুষ্ঠান কোত্থেকে আসল?

ক. “অস্ট্রিকভাষীরা বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ, পাথর, পাহাড়, ফলমূল, ফুল কোনও বিশেষ স্থান, বিশেষ বিশেষ পশু, পক্ষী ইত্যাদির উপর দেবত্ব আরোপ করিয়া তাহার পূজা করিত। এখনও খাসিয়া, মুণ্ডা, সাঁওতাল, শবর ইত্যাদি কোমের লোকেরা তাহা করিয়া থাকে। বাংলাদেশে পাড়াগাঁয়ে গাছপূজা তো এখনও বহুলপ্রচলিত, বিশেষভাবে শেওড়াগাছ ও বটগাছ; আর পাথর ও পাহাড়-পূজাও একেবারে অজ্ঞাত নয়।

খ. “বিশেষ বিশেষ ফল-ফুল-মূল সম্বন্ধে যে সব বিধি-নিষেধ আমাদের মধ্যে প্রচলিত, যে সব ফল-মূল আমাদের পূজার্চনায় উৎসর্গ করা হয়, আমাদের মধ্যে যে নবান্ন উৎসব প্রচলিত, আমাদের ঘরের মেয়েরা যে সব ব্রতানুষ্ঠান প্রভৃতি করিয়া থাকেন, ইত্যাদি, বস্তুত, আমাদের দৈনন্দিন অনেক আচার-অনুষ্ঠানই এই আদিম অস্ট্রিক-ভাষাভাষী জনদের ধর্মবিশ্বাস ও আচার- অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। একটু লক্ষ্য করিলেই দেখা যাইবে, ইহাদের অনেকগুলিই কৃষি ও গ্রামীণ সভ্যতার স্মৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। আমাদের নানা আচারানুষ্ঠানে, ধর্ম, সমাজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আজও ধান, ধানের গুচ্ছ, দূর্বা, কলা হলুদ, সুপারি, নারিকেল, পান, সিন্দুর, কলাগাছ প্রভৃতি অনেকখানি স্থান জুড়িয়া আছে। লক্ষণীয় এই যে, ইহার প্রত্যেকটিই অস্ট্রিক ভাষাভাষী জনদের দৈননিন্দন জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ।

গ. “বাংলাদেশে, বিশেষভাবে পূর্ববাংলায়, এক বিবাহ ব্যাপারেই ‘পানখিলি’, ‘গাত্রহরিদ্রা’, ‘গুটিখেলা,’ ‘ধান ও কড়ির স্ত্রী-আচার’ প্রভৃতি যে সব অবৈদিক, অস্মার্ত ও অব্রাহ্মণ্য, অপৌরাণিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি দেখা যায় তাহাও তো এই কৃষি-সভ্যতা ও কৃষি-সংস্কৃতির স্মৃতিই বহন করে। ধান্যশীর্ষপূর্ণ যে লক্ষ্মীর ঘটের পূজা বাংলাদেশে প্রচলিত তাহার অনুরূপ পূজা তো এখনও ওঁরাও-মুণ্ডাদের মধ্যে দেখা যায়; ইহাদের ‘সরণা’ দেবীর মাথায় ধান্যশীষ্যের জটার কল্পনা সুপ্রাচীন।”

ঘ. “শ্রাদ্ধাদি ব্যাপারে অথবা অন্য কোনও শুভ কাজের প্রারন্দ্রে ‘আভ্যুদয়িক’ নামে পিতৃপুরুষের যে পূজা আমরা করিয়া থাকি, তাহাও তো আমরা এই অস্ট্রিকভাষী লোকদের নিকট হইতেই শিখিয়াছি বলিয়া মনে হয়। এই ধরনের পিতৃপুরুষের পূজা এখনও সাঁওতাল, ওঁরাও, মূণ্ডা, শবর, ভূমিজ, হো ইত্যাদির মধ্যে সুপ্রচলিত। শরৎকুমার রায় মহাশয় তো বলেন, ভারতে শক্তিপূজার প্রবর্তন সম্ভবত ইহারাই প্রথম করে। ওঁরাও প্রভৃতি জাতির চাণ্ডী নামক দেবতার সহিত হিন্দু চণ্ডীদেবীর সাদৃশ্য দেখা যায়। অর্ধরাত্রে উলঙ্গ হইয়া ওঁরাও অবিবাহিত যুবক-পূজারী ‘চাণ্ডী স্থানে’ গিয়া চাণ্ডীর পূজা করে।

ঙ. “বাংলাদেশে হোলি বা হোলাক উৎসব এবং নিম্নশ্রেণীর মধ্যে চড়ক-ধর্মপূজার মিশ্রিত সমন্বিত রূপ বিশ্লেষণ করিলে এমন কতকগুলি উপাদান ধরা পড়ে যাহা মূলত আর্যপূর্ব আদিম নরগোষ্ঠীদের মধ্যে এখনও প্রচলিত। নিম্নশ্রেণী ও নিম্নবর্ণের অনেক ধর্মানুষ্ঠান সম্বন্ধেই এ কথা বলা যাইতে পারে। পৃ: ৫৪-৫৫।

৬. বাঙালি হিন্দুদের মূর্তিপূজা ও মন্দির ধারণা কোত্থেকে?

ক. “আর্য এবং পরবর্তী পৌরাণিক হিন্দুধর্মে মূর্তিপূজা, মন্দির, পশুবলি, অনেক দেবদেবী, যথা: শিব, উমা, শিবলিঙ্গ, বিষ্ণু ও শ্রী প্রভৃতি যে স্থান অধিকার করিয়া আছে তাহার মূলে দ্রাবিড়ভাষী লোকদের প্রভাব অনস্বীকার্য।”

খ. “যাগযজ্ঞও, যতদূর জানা যায়, ভূমধ্য-নরগোষ্ঠীর মধ্যেই যেন বেশি প্রচলিত ছিল। প্রাচীন মিশরে, আসিরিয়া ও ব্যাবিলনের সুপ্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যজ্ঞবেদীর নিদর্শন কিছু কিছু মিলিয়াছে এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অরণি ও ব্রীহি, যজ্ঞের যে দুইটি প্রধান উপাদান, এই দুইটি শব্দই সম্ভবত মূলত দ্রাবিড় ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। অবশ্য ইহাও হইতে পারে, যাগযজ্ঞ ভারতীয় আর্যভাষী আদি-নর্ডিকদের উদ্ভূত ধর্মানুষ্ঠান; কিন্তু যেহেতু ভারতের অন্যান্য নর্ডিক নরগোষ্ঠীর মধ্যে তাহার প্রচলন দেখা যায় না, সেইহেতু অনুমান একান্ত অসংগত না-ও হইতে পারে যে, ভূমধ্য-নরগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসিয়াই আবেন্তীয় আর্যভাষী ও ঋগ্বেদীয় আর্যভাষীরা এই যাগযজ্ঞের পরিচয় লাভ করিয়াছিল এবং ঋদ্বেদীয় আর্যভাষীরা ভারতবর্ষে আসিবার আগেই তাহা হইয়াছিল, এমনও অসম্ভব নয়।”

গ. “পশুবলি যে ভূমধ্য-নরগোষ্ঠী-সম্পৃক্ত প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধুতীরবাসী লোকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল, মহেন-জো-দড়োর ধ্বংসাবশেষ তাহা কতকটা প্রমাণ করিয়াছে। এই মহেন্- জো-দড়োর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে লোকের বাসের অনুপযোগী ক্ষুদ্রবৃহৎ এমন কয়েকটি গৃহ আবিষ্কৃত হইয়াছে যেগুলিকে কতকটা নিঃসংশয়েই মন্দির বা পূজাস্থান ইত্যাদি বলা যায়। কেহ কেহ তাহা স্বীকারও করিয়াছেন।”

ঘ. “এক্ষেত্রেও আশ্চর্য এই যে, ‘পূজন’ বা ‘পূজা’, এবং ‘পুস্প’ (এই শব্দ দুইটি ঋগ্বেদেই আছে)- এই দুটি শব্দই দ্রাবিড়ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। লিঙ্গপূজা এবং মাতৃকাপূজা যে সিন্ধুতীরের প্রাগৈতিহাসিক লোকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল, তাহাও প্রমাণ করিয়াছে হরপ্পা-মহেন্‌ – জো-দড়োর ধ্বংসাবশেষ। অবশ্য এই দুটি পূজা সর্পপূজার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অনেক আদিম অধিবাসীদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল, তবু ভারতবর্ষে ইহার যে রূপ আমরা দেখি তাহা যে আর্যভাষীরা ভারতীয় আর্যপূর্ব ও অনার্য লোকদের সংস্পর্শে আসিয়া ক্রমশ গড়িয়া তুলিয়াছিল, এই অনুমানই যুক্তিসংগত বলিয়া মনে হয়। লিঙ্গপূজাই ক্রমশ শিবের সঙ্গে জড়িত হইয়া শিবলিঙ্গ ও শক্তি-যোনি পূজায় রূপান্ত্ররিত হয় এবং মাতৃকাপূজা ও সর্পপূজা ক্রমশ যথাক্রমে শক্তিপূজায় ও মনসাপূজায়।“

ঙ. “দ্রাবিড়ভাষীদের আণ-মন্দি-পুং বানর-দেবতার ক্রমশ বৃষকপি এবং পরবর্তী কালে হনুমান-দেবতার রূপান্তর অসম্ভব নয়। তেমনই অসম্ভব নয় দ্রাবিড়ভাষীদের বিণ, বা আকাশ- দেবতার রূপান্তর বিষ্ণুতে, এবং তাহা সুপ্রাচীন কালেই হয়তো হইয়াছিল। বৈদিক বিষ্ণুর যে রূপ আমরা দেখি তাহাতে যেন দ্রাবিড়ভাষীদের আকাশ-দেবতার স্পর্শ লাগিয়া আছে।”

চ. “শিব সম্বন্ধে এ কথা আরও বেশি প্রযোজ্য। শ্মশান-প্রান্তর-পর্বতের রক্ত-দেবতা একান্তই দ্রাবিড়ভাষীদের শিব যাহার অর্থ লাল বা রক্ত এবং শেম্বু যাহার অর্থ তাম্র; ইনিই ক্রমে রূপান্তরিত হইয়া আর্যদেবতা রুদ্রের সঙ্গে এক হইয়া যান। পরে শিবন্=শিব, শেম্বু শম্ভূ, রুদ্র-শিব এবং মহাদেবে রূপান্তর লাভ করেন। এই ধরনের সমন্বিত রূপ পৌরাণিক অনেক দেবদেবীর মধ্যেই দেখা যায়, এ কথা ক্রমশ পণ্ডিতদের মধ্যে স্বীকৃতি লাভ করিতেছে। দৃষ্টান্ত বাহুল্যের আর প্রয়োজন নাই। এই সমন্বিত রূপই আর্যভাষীদের মহৎ কীর্তি এবং ভারতীয় ঐতিহ্যে তাহাদের সুমহান দান।”

ছ. “মহেন-জো-দড়োর ধ্বংসাবশেষ হইতে মনে হয় সেখানকার লোকেরা মৃতদেহ কবরস্থ করিত, কেহ কেহ আবার খানিকটা পোড়াইয়া শুধু অস্থিগুলি কবরস্থ করিত।”

৭. পৌরাণিক ‘ব্রাহ্মণ্য’ ধর্ম বৈদিক আর্যভাষীর সভ্যতা নয় : “শতাব্দী পর শতাব্দীর বিরোধ-মিলনের মধ্য দিয়া এমন করিয়া ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের বুকে আর্যভাষী আদি-নর্ডিকেরা এক সমন্বিত জন, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়িয়া তুলিল। সে জনের রক্তবিশুদ্ধতা আর রহিল না; তাহার রক্তে বিচিত্র রক্তধারার স্রোতধ্বনি রণিত হইতে লাগিল, কোথাও ক্ষীণ, কোথাও উচ্চগ্রামে। এই সমন্বিত জনের নাম ভারতীয় জন। সে ধর্মও আর বেদ-ব্রাহ্মণের ধর্ম রহিল না। তাহার মধ্যে বিভিন্ন বিচিত্র পূর্বতন ধর্মের আদর্শ, আচার, অনুষ্ঠান সব মিলিয়া মিশিয়া এক নতুন ধর্ম গড়িয়া উঠিল; তাহার নাম পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। সে সভ্যতাও বৈদিক আর্যভাষীর সভ্যতা থাকিল না। বিচিত্র পূর্বতন সভ্যতার উপাদান উপকরণ আহরণ করিয়া তাহার এক নতুন রূপ ধীরে ধীরে পৃথিবীর দৃষ্টির সম্মুখে ফুটিয়া উঠিল; এই নতুন সমন্বিত সভ্যতার নাম ভারতীয় সভ্যতা। আর সেই সংস্কৃতিই কি বেদ-ব্রাহ্মণের সংস্কৃতি থাকিতে পারিল? তাহার মানসলোকে কত যে পূর্বতন জন ও সংস্কৃতির সৃষ্টি-পুরাণ, দেবতাবাদ, ভয়-বিশ্বাস, ভাব- কল্পনা, স্বভাব-প্রকৃতি, ইতিকাহিনী, ধ্যান-ধারণা আশ্রয়লাভ করিল তাহার ইয়ত্তা নাই। সকলকে আশ্রয় দিয়া, সকলের মধ্যে আশ্রয় পাইয়া, সকলকে আত্মসাৎ করিয়া, সকলের মধ্যে বিস্তৃত হইয়া এই সংস্কৃতিও এক নতুন সমন্বিত রূপ লাভ করিল; তাহার নাম ভারতীয় সংস্কৃতি।”

৮. এ অঞ্চলের লোকদের ‘দস্যু’ হিসেবে দেখা হতো : “পুন্ড্রজনদের (বগুড়া অঞ্চল) সর্বপ্রাচীন উল্লেখ ঐতরেয় ব্রাহ্মণে, এবং তারপরে বোধায়ন-’ধর্মসূত্রে’। প্রথমোক্ত গ্রন্থের মতে ইহারা আর্যভূমির (উত্তর-পশ্চিম ভারত, পাঞ্জাব, আফগানিস্তান ইত্যাদি অঞ্চল) প্রাচ্য-প্রত্যন্ত দেশের দস্যু কোমদের অন্যতম; দ্বিতীয় গ্রন্থের মতে ইহারা সংকীর্ণযোনী, অপবিত্র; বঙ্গ ও কলিঙ্গজনদের ইহারা প্রতিবেশী।” পৃ: ১১৫।

৯. চাতুর্বর্ণ প্রথা এক অলীক উপন্যাসঃ “বর্ণাশ্রম প্রথা ও অভ্যাস যুক্তিপদ্ধতিবদ্ধ করিয়াছিলেন প্রাচীন ধর্মসূত্র ও স্মৃতিগ্রন্থের লেখকরা। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র এই চতুর্বর্ণের কাঠামোর মধ্যে তাঁহারা সমস্ত ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থাকে বাঁধিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। এই চতুর্বর্ণপ্রথা অলীক উপন্যাস, এই সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। কারণ, ভারতবর্ষে এই চতুর্বর্ণের বহিরে অসংখ্য বর্ণ, জন ও কোম বিদ্যমান ছিল; প্রত্যেক বর্ণ, জন ও কোমের ভিতর আবার ছিল অসংখ্য স্তর-উপস্তর। ধর্মসূত্র ও স্মৃতিকারেরা নানা অভিনব অবাস্তব উপায়ে (বর্ণসংকর তত্ত্বের মাধ্যমে) এইসব বিচিত্র বর্ণ, জন ও কোমের স্তর-উপস্তর ইত্যাদি ব্যাখ্যা করিতে এবং সব কিছুকেই আদি চতুর্বর্ণের কাঠামোর যুক্তিপদ্ধতিতে বাঁধিতে চেষ্টা করিয়াছেন। সেই মনু- যাজ্ঞবন্ধ্যের সময় হইতে আরম্ভ করিয়া পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে রঘুনন্দন পর্যন্ত এই চেষ্টার কখনও বিরাম হয় নাই।”

১০. ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ ও ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’ ইত্যাদির ঐতিহাসিক মূল্য নেই: এই দুটো গ্রন্থে বাঙালি হিন্দুকে ৩৬টি মতাম্বরে ৪১টি জাতিতে (কাস্টে) বিভক্ত করে স্থায়ী বর্ণবৈষম্যের বীজ বপণ করা হয়েছে। জন্ম দেওয়া হয়েছে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অবজ্ঞা প্লাবিত এক হিন্দু-সমাজের। অথচ এ দুটো গ্রন্থের সত্যতাই প্রশ্নসাপেক্ষ। ড. রায় লিখছেন : “স্মৃতি ও ব্যবহার গ্রন্থ ছাড়া অন্তত দুইটি অর্বাচীন পুরাণগ্রন্থ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, গোপালভট্ট-আনন্দভট্টকৃত বল্লাল-চরিত এবং বাঙলার কুলজী গ্রন্থমালায় হিন্দুযুগের শেষ অধ্যায়ের বর্ণবিন্যাসের ছবি কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু ইহাদের একটিকেও প্রামাণিক সমসাময়িক সাক্ষ্য বলিয়া স্বীকার করা যায় না।” পৃ: ২১১।

১১. কুলজীগ্রন্থগুলো গালগল্প ভরা ও অসঙ্গতিপূর্ণ : ড. রায় বলছেন: “এখনও অনেক কৌলীন্যমর্যাদাগর্বিত ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ বংশ এইসব কুলজীগ্রন্থের সাক্ষ্যের উপরই নিজেদের বংশ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকেন (পৃষ্ঠা ২১৪)। অথচ “কুলজী গ্রন্থের ঐতিহাসিকত্ব স্বীকার করা কঠিন (পৃ: ২১৩)। ড. রায় আরও বলছেন : “কুলজী গ্রন্থগুলিতে নানা প্রকার গালগল্প ও বিচিত্র অসংগতি আছে।” (পৃ:২১৫)।

১২. ‘কায়স্থ’ নামের উৎপত্তি : “করণ কথার মূল অর্থ, খোদাই যন্ত্র, কাটিবার যন্ত্র, এই অর্থে ‘করণি’ কথাটি আজও ব্যবহৃত হয়। ইতিহাসের গোড়ার দিকে লেখার কাজটা নরুণ জাতীয় কোনও খোদাই যন্ত্রদ্বারাই বোধ হয় নিষ্পন্ন হইত। সেই অর্থে পরবর্তীকালে লেখক মাত্রেই সম্ভবত ‘করণ’ নামে পরিচিত হইতেন। কোন সময় হইতে করণ ও কায়স্থ সমার্থক বলিয়া ধরা হইতে আরম্ভ করে তাহা বলা কঠিন।” পৃ: ২২৪।

১৩. হিন্দুর রক্তে বহমান আদিবাসীর দান: “হিন্দুর জন্মান্তরবাদ, পরলোক সম্বন্ধে ধারণা, প্রেততত্ত্ব, পিতৃতর্পণ, পিণ্ডদান, শ্রাদ্ধাদি সংক্রান্ত অনেক অনুষ্ঠান, আভ্যুদয়িক ইত্যাদি সমস্তই আমাদেরই প্রতিবাসীর এবং আমাদের অনেকেরই রক্তস্রোতে বহমান সেই আদিবাসী রক্তের দান।” পৃ: ৪৭৮।

১৪. আম্রপল্লব ঘট ও কলা বৌ ইত্যাদি আদিবাসীদের সম্পদ : “আমাদের সমস্ত শুভানুষ্ঠানে যে আম্রপল্লবে ঘটের প্রয়োজন হয়, যে কলা-বৌ পূজা হয়, অনেক ব্রতে যে ধানের ছড়ার প্রয়োজন হয়, এ-সমস্তই সেই আদিবাসীদের ধর্মকর্মানুষ্ঠানের এবং বিশ্বাস ও ধারণার স্মৃতি বহন করে। একটু লক্ষ্য করিলেই দেখা যায়, এই সব ধারণা, বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান আদিম কৃষি ও গ্রামীণ সমাজের গাছ-পাথর পূজা, প্রজণন শক্তির পূজা, পশুপক্ষির পূজা প্রভৃতির স্মৃতি বহন করে। … আমাদের নানা আচারানুষ্ঠানে, ধর্ম, সমাজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আজও ধান ও ধানের গুচ্ছ ধানদুর্বার আশীর্বাদ, কলা, হলুদ, সুপারি, পান, নারিকেল, সিন্দুর, কলাগাছ, ঘট, ঘটের উপর আঁকার প্রতীক চিহ্ন, নানা প্রকার আল্পনা, গোবর, কড়ি প্রভৃতি অনেকখানি স্থান জুড়িয়া আছে। বস্তুত, আমাদের আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে যাহা কিছু শিল্প-সুষমাময় তাহার অনেকখানিই এই আদিবাসীদের সংস্কার ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত।” পৃ: ৪৭৯।

১৫. দেবদেবীর বাহন আদিম পশুপক্ষী পূজার আবশেষ : “প্রাচীন ভারতবর্ষের ধর্মকর্মানুষ্ঠানের সঙ্গে যাঁহারা পরিচিত তাঁহারা জানেন, গরুড়ধ্বজা, মীনধ্বজা, ইন্দ্রধ্বজা, ময়ুরধ্বজা, কপিধ্বজা প্রভৃতি নানাপ্রকারের ধ্বজাপূজা ও উৎসব এক সময় আমদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এক এক কোম বা গোষ্ঠীর এক এক পশু বা পক্ষীলাঞ্জিত ধ্বজা; সেই ধ্বজার পূজাই বিশেষ গোষ্ঠীর বিশিষ্ট কোমগত পূজা এবং তাহাই তাঁহাদের পরিচয়; সেই কোমের যিনি নায়ক বিশেষ বিশেষ লাঞ্জন অনুযায়ী তাঁহার নাম তাম্রধ্বজ, ময়ুরধ্বজ, বা হংসধ্বজ। এই ধরনের পশু বা পক্ষীলাঞ্জিত পতাকার পূজা আদিম পশুপক্ষী হইতেই উদ্ভূত; বহু পরবর্তী ব্রাহ্মণ্য পৌরাণিক দেবদেবীর রূপকল্পনায় তাহা পরিত্যাগ করা সম্ভব হয় নাই। প্রমাণ, আমাদের বিভিন্ন দেবদেবীর বাহন, দেবীর বাহন সিংহ, কার্তিকের বাহন ময়ূর, বিষ্ণুর বাহন গরুড়, শিবের বাহন নন্দী, লক্ষীর বাহন পেঁচক, সরস্বতীর বাহন হংস, ব্রহ্মার বাহন হংস, গঙ্গার বাহন মকর, যমুনার বাহন কুর্ম, সমস্তই সেই আদিম পশুপক্ষী পূজার অবশেষ।”

১৬. আদিবাসীদের রথযাত্রা ইত্যাদি বৌদ্ধধর্ম হয়ে হিন্দুধর্মে: “ধ্বজা বা কেতনপূজার মত নানাপ্রকারের যাত্রাও বাঙলার আদিবাসী কোমগুলির অন্যতম প্রধান উৎসব বলিয়া গণ্য হইত। রথযাত্রা, স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা প্রভৃতি ধর্মোৎসব মূলত তাঁহাদেরই; পরে ক্রমশ ইহাদের আর্যীকরণ নিষ্পন্ন হইয়াছে। লৌকিক ধর্মোৎসবে এই ধরনের যাত্রা বা সচল নৃত্যগীতসহ সামাজিক ধর্মানুষ্ঠানের বিবরণ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও প্রাচীন বৌদ্ধ সংযুত্তনিকায়-গ্রন্থে জানা যায়। আর্য ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ উচ্চকোটির লোকেরা বোধ হয় এই ধরনের সমাজোৎসব ও যাত্রা খুব পছন্দ করিতেন না; সেই জন্য সম্রাট অশোক সমাজোৎসবের বিরুদ্ধে অনুশাসন প্রচার করিয়াছিলেন। কিন্তু কোনও রাজকীয় অনুশাসনই লোকায়ত ধর্মের এই লৌকিক প্রকাশকে চাপিয়া রাখিতে পারে নাই; জনসাধারণেরর ধর্মোৎসব ক্রমশ বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সমাজে স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিল, এবং তাহারই ফলে রথযাত্রা, স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা প্রভৃতি ধর্মোৎসব প্রচলন আজও অব্যাহত। প্রাচীন বাংলাদেশে প্রচলিত স্নানযাত্রাগুলির মধ্যে অগস্ত্যর্ঘযাত্রা (দশহরার স্নান), অষ্টমী, স্নানযাত্রা মাঘীসপ্তমী স্নানযাত্রা প্রভৃতির কথা কালবিবেক-গ্রন্থে জানা যায়।” গৃ: ৪৮৩।

১৭. ব্রত যারা করে তারাই ব্রাত্য : “যাত্রা, ধ্বজাপূজা প্রভৃতি ব্রতোৎসবও বাঙালীর ধর্মজীবনে একটি বড় স্থান অধিকার করিয়া আছে। এই ব্রতোৎসবের ইতিহাস অতি জটিল ও সুপ্রাচীন তবে এই ধরনের ধর্মোৎসব যে প্রাক্-বৈদিক আদিবাসী কোমদের সময় হইতেই সুপ্রচলিত ছিল এ-সম্বন্ধে সংশয় বোধ হয় নাই। আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি যাঁহাদের বলিয়াছে ‘ব্রাত্য’ বা ‘পতিত্’ তাঁহারা কি ব্রতধর্ম পালন করিতেন বলিয়াই ব্রাত্য বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন এবং সেইজন্যই কি আর্যরা তাঁহাদের পতিত বলিয়া গণ্য করিতেন? বোধ হয় তাহাই।” পৃ: ৪৮৩।

১৮. হোলী বা হোলাক উৎসব : “এ তথ্য এখন অনেকটা পরিষ্কার যে, আদিতে হোলী ছিল কৃষিসমাজের পূজা, সুশস্য উৎপাদন-কামনায় নরবলি ও যৌনলীলাময় নৃত্যগীত উৎসব ছিল তাহার অঙ্গ। তারপরের স্তরে কোনও সময়ে নরবলির স্থান হইল পশুবলি এবং হোমযজ্ঞ ইহার অঙ্গীভূত হইল।” ড. রায় বলছেন: এর সাথে পরে যোগ হয় বসন্ত বা মদন বা কামোৎসব। তাঁর মতে ষোড়শ শতকের পর বসন্ত বা মদন বা কামোৎসব ফাল্গুণী হোলী বা হোলক উৎসবের সঙ্গে মিশে যায়। কামোৎসব বন্ধ হয়ে যায়। পুনর্জাগরিত হয় হোলী উৎসব। এক সময়ে আবার এর সাথে যোগ হয় ঝুলন উৎসব। এই ঝুলন দেবদেবীর ঝুলন নয়। ড. রায়ের মতে এই ঝুলন নেহাতই মানুষের ঝুলন। ঝুলনায় মানুষেরা, নরনারী উভয়ই দোলা খেত, বেশি করে দোলা দিত মানবশিশুকে, তাকে আনন্দ দেবার জন্য। হয়ত তারই প্রকাশ পরবর্তী সাহিত্যে। বালকৃষ্ণ বা বালগোপালকে দোলাতেন মাতো যশোদা। ড. রায়ের মতে তার পরবর্তী এক সময়ে শুধু বালগোপাল নন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যৌবনলীলার সহচরী রাধাও এসে ঝুলনায় উঠলেন এবং এগারো শতকের আগেই কৃষ্ণরাধার ঝুলন ধর্মোৎসবে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে ঝুলন যাত্রা হোলীর সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়।

ড. রায় মনে করেন এভাবেই প্রাক-বৈদিক আদিম কৃষি সমাজের বলি ও নৃত্য- গীতোৎসব হোলীতে রূপান্তরিত হয়। ড. রায় লিখছেন: “ভারতের নানা জায়গায় এখনও হোলী বা হোলক উৎসবকে বলা হয় শূদ্রোৎসব; হোলীর আগুন এখনও ভারতের অনেক স্থানে অস্পৃশ্যদের ঘর হইতে আনিতে হয়।” পৃ: ৪৮৭-৪৮৮।

১৯. প্রাক-আর্য অম্বুবাচী পারণ: এটি “আদিম কৌম সমাজের প্রজনন শক্তির পূজো এবং তৎসম্পৃক্ত ধ্যান ধারণার সঙ্গে জড়িত।” অম্বুবাচীর পারণ উপলক্ষে মেয়েরা, বিশেষ করে বিধবারা তিন বা সাতদিন কোনও রান্না করা খাবার খান না, মাটি খুঁড়েন না, আগুন জ্বালেন না, রন্ধনাদি করেন না। তারা এমন কিছু করেন না যাতে পৃথিবীর (মাতা বসুন্ধরা) অঙ্গে কোনও আঘাত লাগে। বিশ্বাস করা হয় এ ক’দিন মাতা বসুন্ধরার ঋতুপর্ব। যতদিন ঋতুপর্ব থাকে ততদিন তার অঙ্গে আঘাত লাগে এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকতে হয়। পৃ: ৪৮৮।

২০. মনসা পূজাঃ “সাপ প্রজনন শক্তির প্রতীক এবং মূলত কৌম সমাজের প্রজনন শক্তির পূজা হইতেই মনসা পূজার উদ্ভব, এ তথ্য নিঃসন্দেহ। পৃথিবী জুড়িয়া আদিবাসী সমাজে কোনও না কোনও রূপে সর্পপূজার প্রচলন ছিলই।” পৃঃ-৪৮৯।

২১. ভগবতী বা দুর্গা বৌদ্ধ দেবী : “প্রাক-আর্যব্রাহ্মণ্য শবরদের সঙ্গে আর একটি বজ্রযানী বৌদ্ধ দেবীর সম্বন্ধ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ; ইহার নাম পর্ণশবরী। ইনি ব্যাগ্রচর্ম ও বৃক্ষপত্র পরিহিতা, যৌবনরূপিণী, বজ্রকুণ্ডলধারিণী এবং পদতলে তিনি অগণিত রোগ ও মারী মাড়াইয়া চলেন। ধ্যানেই বর্ণনা করা হইয়াছে যে, তিনি ডাকিনী, পিশাচী এবং মারীসংহারিকা। সন্দেহ নাই যে, আদিতে তিনি শবরদেরই আরাধ্যা দেবী ছিলেন; পরে কালক্রমে যখন আর্যধর্মে স্বীকৃতি লাভ করেন তখন তাঁহার পরিচয় হইল “সর্বশবরনাম ভগবতী”, সকল শবরের ভগবতী বা দুর্গা। বজ্রযানী বৌদ্ধসাধনায় শবরদের যে একটা বিশেষ স্থান ছিল চর্যাগীতির একাধিক গানই তাহার প্রমাণ।” পৃ: ৪৯০।

২২. জগন্নাথ দেবের মন্দির ও পূজার সাথে সম্পর্ক শবরদের ধর্ম ও পূজানুষ্ঠানের: “পূর্ব- ভারতে শবরদের এক সুপ্রাচীন ও সুবিস্তৃত সংস্কৃতির অবশেষ আমাদের জীবনযাত্রার নানাক্ষেত্রে সুপরিস্ফুট। পাহাড়পুর মন্দিরের অসংখ্য মাটির ফলকে শবর নরনারীদের দৈনন্দিন জীবনের নানা ছবি যে-ভাবে উৎকীর্ণ আছে, মনে হয়, জনসাধারণের জীবনের সঙ্গে তাঁহাদের যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। বাঙলার নানা স্থানে, যেমন উত্তরবঙ্গে ও পশ্চিম-দক্ষিণ বঙ্গে, এই শবররা কালক্রমে আমাদের হিন্দু সমাজের নিম্নতম স্তরে স্বাঙ্গীকৃত হইয়া গিয়াছে। নীলাচলক্ষেত্র পুরীর সুপ্রসিদ্ধ জগন্নাথদেবের মন্দির ও তাঁহার পূজার সঙ্গে শবরদের ধর্ম ও পূজানাষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের কথা আজ আর অবিদিত নাই। বাংলাদেশেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই ঘনিষ্ঠতা ধরা পড়িবে, বিচিত্র কী? কালবিবেক-গ্রন্থ ও পরবর্তী কালিকাপুরাণে শারদীয়া দুর্গাপূজার দশমী তিথিতে শাবরোৎসব নামে এক উৎসবের বিস্তৃত বিবরণ জানা যায়।” পৃ: ৪৯০।

২৩. লক্ষ্মী পূজা প্রাক-আর্য কৌম সমাজ থেকে প্রাপ্ত: “আমাদের দেশে লক্ষ্মীর পৃথক মূর্তিপূজা খুব সুপ্রচলিত নয়। বিষ্ণু-নারায়ণের শক্তি হিসাবেই তাঁহার যাহা কিছুই প্রতিপত্তি; অন্ত ত প্রাচীন বাঙলায় তাহাই ছিল। সাহিত্যে ও শিল্পে নারায়ণের শক্তিরূপিণী এই পৌরাণিক লক্ষ্মীই বন্দিতা হইয়াছেন। কিন্তু আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আর একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পূজা বাঙালী সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচস্তি। এই লক্ষ্মী কৃষিসমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি; শস্য-প্রাচুর্য্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পূজা ঘটলক্ষ্মী বা ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কিত ঘটের পূজা এবং এই পূজাব্রতের যে-সব ব্রতকথা এবং যে-সব পৌরাণিক কাহিনী জড়িত তাহা একত্রে বিশ্লেষণ করিলে বুঝিতে দেরী হয় না যে, লক্ষ্মীর এই লৌকিক মানস-কল্পনাই ক্রমশ পৌরাণিক লক্ষ্মীতে রূপান্তরিত হইয়াছে, স্তরে স্তরে নানা স্ববিরোধী ধ্যান ও অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়া। কিন্তু তৎসত্ত্বেও কৌম সমাজের ঘটলক্ষ্মীর বা শস্যলক্ষ্মীর বা আদিমতম পূজা বা কল্পনা তা বিলুপ্ত হয় নাই। বাঙালী হিন্দুর ঘরে ঘরে নারীসমাজে সে পূজা আজও অব্যাহত। আর শারদীয়া পূর্ণিমাতে কোজাগর-লক্ষ্মীর যে পূজা অনুষ্ঠিত হয় তাহা আদিতে এই কৌম সমাজের পূজা বলিলে অন্যায় হয় না। বস্তুত, দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শারদীয় কোজাগর উৎসবের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর পূজার কোনও সম্পর্কই ছিল না।” পৃ: ৪৯১।

২৪. ষষ্ঠীপূজা প্রজননশক্তি ও যাদুশক্তির পূজা: ষষ্ঠীদেবীর কোনও প্রতিমা পূজার প্রচলন ব্রাহ্মণ্য ধর্মে নাই; বৌদ্ধ প্রতিমা-শাস্ত্রে এবং ধর্মানুষ্ঠানে ষষ্ঠীদেবীর মানস-কল্পনাই বোধ হয় হারীতীদেবীর রূপ-কল্পনায় বিবর্তিত হইয়াছে। ষষ্ঠী এবং হারীতীর জন্ম একই মানস- কল্পনায় এবং দু’য়েরই মূলে প্রজনন শক্তিতে এবং মারীনিবারক যাদু-শক্তিতে বিশ্বাস প্রচ্ছন্ন। বৌদ্ধ ধর্মাচারে হারীতী দেবীর মূর্তিপূজা সুপ্রচলিত ছিল, কিন্তু ষষ্ঠীপূজায় আজও কোনও মূর্তিপূজা নাই এবং শেষোক্ত পূজা এখনও নারী-সমাজেই সীমাদ্ধ; সন্তান-কামনায়ও সন্তানের মঙ্গল কামনায় আজ এই পূজা বিবর্তিত। ষষ্ঠী-হারীতীর মারীনিবারক যাদুশক্তির পূজা এখন আশ্রয় করিয়াছে গর্দভবাহিনী শীতলাদেবীকে।” পৃ: ৪৯১।

২৫. ‘লোকনাথ’ ছিলেন বৌদ্ধবাঙালির সবচেয়ে প্রিয় দেবতা: “বাংলাদেশে যত মহাযানী- বজ্রযানী মূর্তি পাওয়া গিয়াছে তাহাদের মধ্যে নানা রূপের অবলোকিতেশ্বর-লোকনাথের প্রতিমাই সবচেয়ে বেশি। প্রতিমা-প্রমাণ হইতে মনে হয়, বৌদ্ধ বাঙালির তিনিই ছিলেন সবচেয়ে প্রিয় দেবতা।” পৃ: ৫৩৪।

২৬. বৌদ্ধ তারাদেবী হিন্দুর দুর্গা ও কালী : “বৌদ্ধ তারাদেবী তো ব্রাহ্মণ্য আয়তনে (ধর্মে) কালী ও দুর্গারই অন্য নাম।” পৃ:৫৫৪।

২৭. বৌদ্ধধর্মের স্মৃতি: বাংলা থেকে বৌদ্ধধর্ম প্রায় উঠে গেল। এর জায়গায় আসল ‘হিন্দুধর্ম’ ও ‘ইসলাম ধর্ম’। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের বেশ কিছু স্মৃতি এখনো রয়েছে। এদের অনেকগুলো থেকে বুঝা যায় বৌদ্ধদের কিভাবে সমাজে হেনস্তা করা হয়েছে। আজকের দিনে ‘বুদ্ধ’ বলে যে গাল আমরা দেই তা ড. রায়ের মতে ‘বুদ্ধ’ থেকে। বৌদ্ধদের ‘সংঘ’ বৰ্তমান বাংলায় ‘সাঙ্গাত’, হিন্দি ‘সংঘত’ (ঘনিষ্ঠ বন্ধু)। এছাড়া অনেক স্থান-নামের সাথে বৌদ্ধ স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যেমন ‘ধর্মরথ’ থেকে ধামরাই (সাভার, ঢাকা) ও ‘উপকারিকা’ (সুসজ্জিত মণ্ডল) থেকে উয়ারী (ঢাকা শহর)। প্রাচীনতর উপকারিকা’ বা উয়ারী শব্দের সাথে ফার্সী শব্দ ‘বার’ যোগ হয়ে ‘বারোয়ারী’। নেড়ানেড়ী শব্দটিও প্রথমত বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের বোঝাত। পৃ: ৫৫৯।

২৮. পালিত ও ধর ইত্যাদি পদবিধারীদের পূর্বপুরুষ বৌদ্ধঃ “বাঙালীর পালিত, ধর, রক্ষিত, কর, ভূতি, গুঁই, দাম বা দাঁ, পাল বা পাইন প্রভৃতি অন্যনামও বোধ হয় বৌদ্ধ স্মৃতিবহ।” পৃষ্ঠা ৫৫৯।

২৯. প্রাচ্যভারতের লোকেরা আর্যদের কাছে অসুর ও অস্পৃশ্য: “অথর্ববেদের ঋষিদের কাছে প্রাচ্যদেশ বহু দূরদেশ; শতপথ ব্রাহ্মণে এ-দেশের লোকেরা ‘আসুর্য’ অর্থাৎ অসুর প্রকৃতি বিশিষ্ট; ঐতরেয় ব্রাহ্মণে এ-দেশ দস্যুদের দেশ; বৌধায়ন-ধর্মসূত্র রচনাকালেও এ-দেশ অস্পৃশ্যদের দেশ। পৃ: ৫৬৭।

৩০. হিন্দুরাষ্ট্র ও রাজত্বের পতনের কারণ: ড. রায়ের মতে “হিন্দুরাষ্ট্রের ও রাজত্বের পতন ও অবসানের প্রধান কারণ ব্যক্তিগত সাহস বা শৌর্যের অভাব নয়, সে-কারণ রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব এবং শঙ্ঘশক্তির অভাব, এবং তাহার হেতু একাধিক। কৌমি চেতনা, আঞ্চলিক চেতনা, সামন্ত তন্ত্র, বর্ণবিন্যাসের অসংখ্য স্তরভেদ, সংকীর্ণ স্থানীয় রাষ্ট্রবুদ্ধি প্রভৃতি সমস্তই তাহার মূলে; এসব কথা বিস্তৃত ব্যাখ্যার কোনও অপেক্ষা রাখে না।” ড. রায় দ্বিতীয় একটি কারণের কথা বলেছেন এবং তা হচ্ছে চিরাচরিত রণপদ্ধতি। হিন্দুরা প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে সৈন্যচালনা এবং চতুরঙ্গবলসজ্জা ও ব্যবহার পদ্ধতি অপরিবর্তিত রাখে যা উন্নত বিদেশী আক্রমণকারী শক্তির তুলনায় নগণ্য। ড. রায়ের মতে তৃতীয় কারণটি হচ্ছে ‘এক ধরণের সনাতনী নিশ্চিন্ততা ও ভাগ্য নির্ভরতা। তাঁর মতে ভারতবর্ষ নতুন জীবনভূমি আবিষ্কারে বদ্ধপরিকর বিদেশি আক্রমণ- কারীদের ঠেকাতে পারত যদি তার নেতৃত্ব, সংঘশক্তি, উন্নত রণপদ্ধতি, রাষ্ট্রীয় দূরদৃষ্টি ও আত্মশক্তি (ভাগ্যবিশ্বাস নয়) থাকত এবং সামাজিক ভেদবুদ্ধি না থাকত ও নিবীর্য না হত। পৃ: ৭০৯।

৩১. ‘স্মৃতির’ শাসন হিন্দুকে ঘরকুণো করে ফেলে: “সেন-বর্মণ পর্যায়ে মধ্যভারতীয় স্মৃতিশাসন এবং দক্ষিণী-রক্ষণশীল মনোবৃত্তি ক্রমশ বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করিয়া বাঙালির সমাজকে স্তরে উপস্তরে ভাগ করিয়া (জাত-পাতে বিভক্ত) এবং সমাজে পুরোহিত-প্রাধান্যের প্রতিষ্ঠা করিয়া সমাজের ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিল।…. নানাদিক হইতে ব্যাহত হইয়া জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত হইয়া ভাগ্য নির্ভরতা অর্থাৎ জ্যোতিষ এবং নানা প্রকারের বিধিনিষেধই তাহার প্রধান আশ্রয় হইয়া দাঁড়াইল।” পৃ: ৭১০।

৩২. নাথধর্মের সাম্য ভাবনার ওপর চৈতন্যদেবের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত: “… সহজযানী প্রভৃতি বৌদ্ধ ও নাথ সম্প্রদায় প্রভৃতির মধ্যে মানুষের বর্ণ ও শ্রেণীগত বিভেদ-ভাবনা প্রায় ছিল না বলিলেই চলে। তাহা ছাড়া, মানবতার একটি উদার আদর্শও ছিল ইহাদের মধ্যে সক্রিয়। এই উদার সাম্যভাবনা ও মানবতার আদর্শের স্থান সমসাময়িক, অর্থাৎ একাদশ-দ্বাদশ শতকের ব্রাহ্মণ্য সমাজদর্শন ও সংস্থার মধ্যে কোথাও ছিল না। অথচ, ইহার অর্থাৎ এই সাম্যভাবনার ও মানবতার আদর্শের উপরই মধ্যযুগীয় বাঙলার বৃহত্তম ও গভীরতম ধর্ম ও সমাজ বিপ্লবের অর্থাৎ চৈতন্যদেব প্রবর্তিত সমাজ ও ধর্মান্দোলনের প্রতিষ্ঠা।” পৃ: ৭২২।

২৯. সুকুমারী ভট্টাচার্য হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা: দীপ প্রকাশন: কলকাতা: ১৯৯৭।

১. আর্যরা অন-আর্যদের কাছে কৃষিকাজ শেখে : বৈদিক ধর্ম যজ্ঞ-নির্ভর। আর্যরা যাযাবর। তারা প্রাগার্যদের কাছ থেকে কৃষি কাজ শিখে। পৃ: ৯।

২. রামের চরিত্র : নিরপরাধ নারীকে সন্দেহ, মিথ্যা ছলনায় সীতাকে বিসর্জন ও নির্বাসন, নিম্নবর্ণের ‘গুহকের’ আতিথ্য না নেওয়া ও শূদ্র শম্ভুককে হত্যা ইত্যাদি রামের চরিত্র। পৃ: ৪৮-৫৪।

৩. নিয়তিবাদ কবে থেকে : জন্মান্তরবাদ খ্রিস্টপূর্ব :৭ শতক থেকেই চালু ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে যোগ হয় কর্মবাদ ও নিয়তিবাদ। পৃ: ৬০।

৪. ঋগ্বেদের মহিলা ঋষি : কাক্ষীবতী, ঘোষা, মৈত্রেয়ী, অপালা, অম্ভৃণ ঋষির কন্যা বাক প্রমুখ ঋগ্বেদের মহিলা ঋষি যারা কিছু কিছু মন্ত্র লেখেন। বেদান্তের মহৎ তত্ত্ব ‘সোঅহম’ (আমিই সেই) অথবা তত্ত্বমসি (তুমিই সেই) সংহিতা সাহিত্যে এর প্রথম প্রবক্তা অভূম ঋষির কন্যা বাক্। পৃ : ৬৫।

৫. শব সৎকারে বেদের বিধান : বেদে আছে পুরুষের মৃত্যু হলে, গরু কেটে তার মৃত দেহ পুরুষের শবের উপর চাপিয়ে দিতে হবে। নাড়ী ভুড়ি শবের দুহাতে দিতে হবে যাতে যমলোকে যাওয়ার সময় যমের কুকুর-শ্যাম ও শবল নাড়ীভুড়ির বিনিময়ে শব ছেড়ে দেয়। পৃ : ৬৭।

৩০. সুকুমারী ভট্টাচার্য
প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য : আনন্দ পাবলিশার্স : ১৩৯৬।

১. ইন্দ্র যাযাবরদের নেতা : যাযাবর আক্রমণকারী আর্যদলের সেনাপতি ও যোদ্ধা হচ্ছেন ইন্দ্ৰ। পৃ : ১৫।

২. মহাভারতে ব্রাহ্মণ্য হস্তক্ষেপ : মহাভারতে যুদ্ধ ও নৈতিক কাহিনী এক তৃতীয়াংশ। বাকী দুই তৃতীয়াংশ ব্রাহ্মণ্য সংযোজন (হস্ৰক্ষেপ)। ব্রাহ্মণ্য সংযোজনে স্থান পেয়েছে ব্রাহ্মণদের গুণগান, জন্মান্তরবাদ, বর্ণাশ্রমবাদ ইত্যাদি। এগুলো পরে পুরাণে স্থান পায়। পৃ: ৭৫-৭৭।

৩. কৃষ্ণ চরিত্র ব্রাহ্মণদের সৃষ্টি : শেষতম ব্রাহ্মণ্য সংযোজনেই কৃষ্ণ প্রবেশ করেন মহাভারতে দেবতারূপে। মহাভারতে কৃষ্ণ প্রধান দেবতারূপে অবতীর্ণ হওয়ার পর জয়- পরাজয় আর বীরনিষ্ঠ রইল না, কৃষ্ণনিষ্ঠ হয়ে উঠল। …ক্ষত্রিয়ের নীতি পদদলিত হল। কৃষ্ণের পরামর্শে প্রত্যেকটি কৌরব মহারথীকে অন্যায় সমরে প্রাণ দিতে হল। মানবিক ও ক্ষাত্রনীতির ওপর আরোপিত হল কৃষ্ণ, কৃষ্ণই পরিমাপক হলেন ন্যায়-অন্যায়ের। … মানবায়িত মূল্যবোধ কৃষ্ণেও প্রতিহত হল। পৃ : ৮৫।

৩১. ক্ষিতি মোহন সেন :
হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ : বিশ্বভারতী : ১৩৮৭।

১. শিব বিরোধী ব্রাহ্মণগণ শিবকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় : শিব পূজা এক সময়ে ব্রাহ্মণের ও বৈদিকাচারে যে বর্জনীয় ছিল তাহা আমি জাতিভেদ নামক পুস্তকে আলোচনা করিয়াছি। বৈদিকাচারযুক্ত আর্যেরা চারিদিকে অনার্যের প্রভাবের মধ্যে পড়িয়া শিবপূজা গণপতি পূজা দেবীপূজা প্রভৃতি গ্রহণ করিতে বাধ্য হয়। পৃ : ৮-১২।

২. একেক পূজা এক এক জায়গায় : গণপতি পূজা ভারতের সর্বত্র, মহারাষ্ট্রে বেশি। বাংলায় দেবীপূজা দ্রাবিড় দেশে কার্তিক। উত্তর পশ্চিম গুজরাটে হনুমান পূজা, বিষ্ণুর কৃষ্ণ রূপ বাংলায় ও গুজরাটে, রাম রূপ উত্তর পশ্চিমে ও বিহারে। পৃ : ১৩।

৩২. দীনেশ চন্দ্র সেন :
বৃহৎ বঙ্গ : প্রথম খন্ড : দে’জ পাবলিশিং: ১৯৯৩।

১. গাঙ্গুলি চট্টোপাধ্যায় বন্দোপাধ্যায় পদবি : ‘গাঙ্গুড়’ নদীর তীরে উপনিবিষ্ট কনোজিয়া ঠাকুরেরা ‘গাঙ্গুলী’ নামে পরিচিত। এখন বাংলার স্থান বিশেষের নামে (যথা: চাটুতি, বাড়ূরী মুখটি) সংস্কৃত উপাধ্যায় শব্দের যোগে চট্টোপাধ্যায় বন্দোপাধ্যায় মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি রূপ ধারণ করেছে। পৃ : বইয়ের ভূমিকা।

২. ভক্তিবাদ বৌদ্ধধর্ম থেকে: বুদ্ধদেবের দুঃখবাদে ক্লান্ত হইয়া ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম ক্রমে ক্রমে উপনিষদের দিকে অগ্রসর হয়। কালচক্রযান ও বজ্রযানে যে ভক্তিবাদ সূচিত, শৈবধর্মে ও বৈষ্ণবধর্মে তার পরিণতি। পৃ : বইয়ের ভূমিকা।

৩. কৃষ্ণের ব্রাহ্মণ্যধর্মের সহায়তায় জৈন-বৌদ্ধধর্ম বিতাড়ন: কৃষ্ণের প্রবল সহায়তায় যে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থান হয়েছিল, সেই পুনরুত্থিত হিন্দুধর্ম জৈন-বৌদ্ধদিগের উজ্জ্বল অধ্যায় এদেশের ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে একেবারে মুছে ফেলেছিল। পৃ :

৪. হিন্দুরা বৌদ্ধধর্ম লুট করে : হিন্দুরা বৌদ্ধধর্ম শুধু নষ্ট করে ছাড়েন নি, তারা দু’হাতে বৌদ্ধের ভাণ্ডার লুণ্ঠন করে সমস্ত লুণ্ঠিত দ্রব্যের উপর নিজনিজ নামাঙ্কের ছাপ দিয়ে সর্বতোভাবে নিজস্ব করেছেন। হিন্দুর পরবর্তী ন্যায়-দর্শন, ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি সমস্ত বিষয়েই এই লুন্ঠনের পরিচয় আছে – কোথাও ঋণ স্বীকার নেই। পৃ : ৮। বৌদ্ধ ইতিহাস ব্রাহ্মণেরা স্বেচ্ছায় ও ঘোর শত্রুতা করে লুপ্ত করেছেন। পৃ : ১০।

৫. মেথর শব্দ মহত্তর থেকে : যে সকল বৌদ্ধ পুরোহিত তান্ত্রিক অনুষ্ঠান করে অতি হেয় জিনিষ ভক্ষণ করতেন তারাই সম্ভবত ‘মেথর’ শ্রেণিতে পরিণত হয়েছিলেন। শব্দটি ‘মহত্তর’ শব্দের অপভ্রংশ বলে মনে হয়। পৃ : ১০-১১।

৬. কৃষ্ণ ব্রাহ্মণ্য নেতা : এই বৃহৎ বঙ্গ পূর্ব হইতে নব ব্রাহ্মণ্য নেতা কৃষ্ণের বিদ্বেষী ছিল। পৃ : ৪৪।

৭. কৃষ্ণাশ্রিত ব্রাহ্মণ্যধর্ম : বেদের কালে ব্রাহ্মণ এত শক্তিশালী ছিল না। যে কোন জাতির লোক ব্রাহ্মণ হতে পারতেন। পৌরাণিক কালে ব্রাহ্মণকে দেবতারও উপরে স্থান দেওয়া হয়। এটাই কৃষ্ণাশ্রিত ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম। পৃ : ৪৭।

৮. বৌদ্ধধর্মের প্রতিবাদ রামায়ণ : বৌদ্ধধর্ম সন্ন্যাসের ধর্ম। এরই প্রতিশোধ হিসেবে গার্হস্থ্য ধর্মের রামায়ণ। পৃ : ১২৫।

৯. অষ্টম শতাব্দীতে শিব ও বুদ্ধই শ্রেষ্ঠ : বুদ্ধ ও শিব এই দুই মূর্তিই অষ্টম ও নবম শতাব্দীর জনসাধারণের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাস্য দেবতা ছিলেন। পৃ : ৪৩৮।

১০. ব্রাহ্মণ্যধর্ম সম্পদ বিরোধী : নব ব্রাহ্মণ্যধর্ম ধনকে উপেক্ষা করতে শেখাল। প্রতিষ্ঠা ও প্রতাপকে তুচ্ছ বলল। সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ করে ধনাগমের পথ রুদ্ধ করল। বণিক ‘বেণে’ নামে সমাজে অনাদৃত হল। নব্যব্রাহ্মণ বৈশ্যদিগের মূলে আঘাত করল। পৃ : ৪৮৩।

১১. বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চলই মুসলমান প্রধান : উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে বৌদ্ধরা সংখ্যায় খুব বেশী ছিল। সেখানেই ইসলাম কৃতকার্য হল। পৃ : ৫২২।

৩৩. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় :
ভারত সংস্কৃতি : মিত্র ও ঘোষ : ১৪০০।

১. হিন্দুর প্রধান মনোভাব: সমন্বয় সত্যানুসন্ধিৎসা ও অহিংসা এই তিন হিন্দু সংস্কৃতির মূল মনোভাব। পৃ : ৪।

২. দ্রাবিড় ও শিব : শিব ও উমা দ্রাবিড়দের মধ্যে প্রচলিত ছিল। মহেঞ্জোদারো তাদের অবদান। পৃ : ১০।

৩. অষ্ট্রিক-দ্রাবিড় বনাম আর্য: আর্যদের পূর্বে সুসভ্য দুটো জাতি ছিল। নাগরিক সভ্যতার দ্রাবিড়রা, গ্রামীণ সভ্যতার অষ্ট্রিকরা। আর আর্যরা ছিল মুখ্যত যাযাবর এবং অংশত গ্রামীণ সভ্যতার। পৃ : ১০।

৪. রামায়ণ ও মহাভারত : অন-আর্যদের দেবতাদের লীলাকথা, তাদের রাজাদের প্রাচীন কাহিনী ক্রমে সংস্কৃত ভাষায় গৃহীত হয়ে আর্যদের দেবকাহিনীর সাথে অচ্ছেদ্য হয়। তাতেই রামায়ণ ও মহাভারত সৃষ্ট হয়। পৃ : ১০-১১।

৫. হিন্দু সভ্যতার বয়স : ভারতীয় হিন্দু সভ্যতার বয়স, পূর্বে নির্দিষ্ট ইতিহাস অনুসারে, খুব বেশী হবে না, একথায় আমাদের অনেকের আত্মসম্মানে ঘা লাগবে। হিন্দু জাতির আর সভ্যতার ইতিহাসে মোটামুটি দুটি যুগ ধরা যেতে পারে – যজ্ঞের প্রাধান্যের যুগ, আর পৌরাণিক দেবতাদের প্রাধান্যের যুগ। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ কি তার ২/৪ শ বছর আগে থেকে এই সভ্যতার আরম্ভ, খ্রিস্টের জন্মের কিছু পূর্ব থেকে ৮০০/১০০০ বৎসর ধরে এই সভ্যতার সর্বাপেক্ষা গৌরবময় কাল। পৃ : ১২-১৩।

৬. ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধান-দুর্বা ব্যবহার আর্যরীতি নয় : ভারতের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধান, পান, হলুদ, সিঁদুর কলা সুপারি ব্যবহার অষ্ট্রিক (আর্য নয়) প্রভাবের ফল। পৃ : ৬৭।

৭. নদ-নদীর অন-আর্য নাম: অন-আর্য ভোটব্রহ্ম ভাষার তিস্তাং থেকে তিস্তা (ত্রিস্রোতা), কোল ভাষার ‘কর-দাক’ থেকে কপোতাক্ষ, ‘দামো-দাক’ থেকে দামোদর নদীর নাম। পৃ : ৬৯।

৮. হিন্দুর কাশী শহর : প্রাচীন কাশী ছিল সারনাথের দিকে। পরে কাশী দক্ষিণে গঙ্গা ধরে বিস্তৃত হয়। কাশি জাতির কথা উপনিষদে আছে। কাশী শিবস্থান রূপে পরে পরিচিত হয়। কাশীর অলিগলিতে শিবলিঙ্গের ছড়াছড়ি। এর সাথে ভেনিস শহরের মিল। কাশী নগরী শিবেরই মহিমা দ্বারা উজ্জ্বল। সর্ব্বত্রই হর হর বম্ বম্ শিব শিব শম্ভো, মহাদেব মহাদেব। হিন্দু দর্শন ও চিন্তার এবং হিন্দুর আধ্যাত্মিক অনুভূতির চরম প্রতীক – শিব ও উমা এবং বিষ্ণু ও শ্রী। জ্ঞানময় ঈশ্বর-শিব, প্রেমময় ঈশ্বর বিষ্ণু। পৃ : ৯৩-৯৫।

৩৪. হজারী প্রসাদ দ্বিবেদী :
আলোক পর্ব : সাহিত্য একাদেমি : দিল্লী : ১৯৯৪।

১. অদ্বৈতবাদ : একই দেবতা বিভিন্নরূপে অভিব্যক্ত। পৃ : ৪।

২. ওম (ওঁ) : অ – উ – ম এই তিনটি শব্দের মিলিত রূপ। ‘অ’ তে গতি, ‘ম’তে স্থিতি। ওঁতে বিশ্বের আরম্ভ। নাদ গতি, বিন্দু স্থিতি মিলিয়েই জগত। তাই সৃষ্টির জন্য নাদ দরকার। পৃ: ৪৪।

৩. বেদ বিরোধীরাই ইসলামপন্থী হয়: প্রচণ্ড বেদ বিরোধীরাই ইসলাম গ্রহণ করে বেশী। বাকীরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের দিকে আস্তে আস্তে ভিড়ে। পৃ: ৯৩।

৩৫. দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লোকায়ত দৰ্শন (প্রথম খণ্ড) :
নিউ এজ পাবলিশার্স প্রা: লি: ১৯৬৯।

১. তন্ত্র বেদান্ত বিরোধী : তন্ত্রঅতি প্রাচীন পদ্ধতি। তন্ত্রমতে ‘যাহা আছে দেহভাণ্ডে তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে’। দেহ রহস্যের মধ্যেই বিশ্ব রহস্যের পরিচয়। এতে দেহাতিরিক্ত আত্মার স্থান নেই। পৃ: বইয়ের ভূমিকা।

২. বেদবিরোধীরাই ‘পাষণ্ড’ : মহাভারত পুরাণাদিতে পাষণ্ড শব্দটি নাস্তিক বা বেদ বিরোধী যথা: বৌদ্ধ, জৈন ও চার্বাকদের বুঝানো হয়েছে। পৃ: ১৩।

৩. বেদান্ত : অধ্যাত্মবাদ বেদান্ত দর্শনের কথা। তাদের দাবী বেদ বাক্যের প্রকৃত তাৎপর্যই চরম সত্যের পরিচায়ক, স্বাধীন তর্ক বা বিচার-বিশ্লেষণের সাহায্যে দার্শনিক তত্ত্বে উপনীত হওয়া অসম্ভব। বৈদাস্তিকের চোখে শরীর বা দেহ কুৎসিত। তাদের মতে আত্মাই চরম সত্য বা পরম ব্রহ্ম। তাই দেহাত্মবাদীরা নাস্তিক, পাষণ্ড ও নরকগামী। পৃ: ২৬০।

৪. ঋগ্বেদে দেহ কুৎসিত নয়: ঋগ্বেদে ঋষি অবধারিতভাবে ‘শরীর’ বা ‘ দেহ’ অর্থেই ‘আত্মা’ শব্দের প্রয়োগ করেছেন। দেহ বা শরীর নামের পদার্থটি অন্তত: ঋগ্বেদের ঋষিদের কাছে ঘৃণিত ছিল না। পৃ: ২৬১।

৩৬. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
লোকায়ত দৰ্শন : দ্বিতীয় খণ্ড :নিউ এজ পাবলিশার্স প্রা: লি: ১৯৯৫।

১. গণেশ ‘সিদ্ধিদাতা’ কবে থেকে : খ্রিস্টিয় পঞ্চম/ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে গণেশ সিদ্ধিদাতা পৃ : ২. দেবী পূজা কৃষির সাথে যুক্ত : দেবী পূজা অনেক প্রাচীন প্রথা। এটি কৃষি আবিষ্কারের সাথে জড়িত। পৃ : ৫৪।

৩. পাথরে সিঁদুর পূজা কেন: পাথরে লাল রঙ দিয়ে জমিকে রজঃস্বলা করার কল্পনা। পৃ : ৫৮। ৪. দুর্গা শস্য জননী : আদিতে দুর্গা শস্য জননী ছিলেন। দুর্গাপূজার প্রধানতম অঙ্গ হল যন্ত্র ও ঘট। সর্বতোমঙ্গল নামক যন্ত্রের উপর ঘটের প্রতিষ্ঠা করতে হয়। পৃ : ৭২।

৩৭. প্রতিভা বসু
মহাভারতের মহারণ্যে : বিকল্প প্রকাশনী : কলকাতা : ১৯৯৮।

১. মহাভারতে ধর্মও নেই, অধর্মও নেই : “মহাভারতের “মরাল” কী সেটা ভেবেও বিচলিত হলাম। কেবল এটাই মনে হ’তে লাগলো, এই গ্রন্থ যেন আমাকে এই শিক্ষাই দিলো যে যেমন ভালো ব’লে কিছু নেই, তেমনই মন্দ ব’লেও কিছু নেই। সত্য ব’লেও কিছু নেই, মিথ্যে বলেও কিছু নেই। ধর্ম বলেও কিছু নেই, অধর্ম বলেও কিছু নেই। যা আছে তা কেবল সুবিধাবাদীর সুবিধাভোগ। এবং ন্যায় অন্যায় বলে যা কিছু আমরা শিখেছিলাম, মহাভারতের মহারণ্যে সে দুটি ধারণার জন্মই হয়নি।” পৃ : ১২-১৩।

২. মহাভারত ভরত বংশের ইতিহাস নয় : “বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মহাভারত নামত ভরতবংশের ইতিহাস হলেও, প্রকৃতপক্ষে সত্যবতী-দ্বৈপায়নের বংশের ইতিহাস। হয়তো সেইজন্যেই দ্বৈপায়ন লোকগাথায় বেঁধে সেই মূল আখ্যানটিকে অমরত্ব দিতে চেয়েছিলেন।” পৃ : ১৪।

৩. মহাভারত আসলে সত্যবতী-পুত্র দ্বৈপায়নের কাহিনী: “সত্যবতী তাঁর অবৈধ অনার্য পুত্রটিকে বংশরক্ষার দায়িত্ব দেবার পর দেখা গেলো পুত্র উৎপাদনে দ্বৈপায়ন অতি দক্ষ। ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু দ্বৈপায়নের ঔরসজাত পুত্র হলেও তাঁদের মাতারা শুদ্ধ ক্ষত্রিয়। কিন্তু অন্য পুত্র বিদুর, যাঁর মাতা এক নিম্নবর্ণা দাসী, যাঁর সঙ্গে ভরত বংশের কোনোভাবেই কোনো যোগ নেই, দাসরাজার পুত্রী সত্যবতীর কৃপায় কী জানি কেন তিনি এক মহৎ স্থান জুড়ে বসলেন। আমরা জানলাম তিনি নাকি সাক্ষাৎ ধর্ম; কিন্তু দেখলাম, কার্যক্ষেত্রে তিনি অতি প্রকটভাবে এবং অযৌক্তিকভাবে, কৌরবপক্ষ বিরোধী (বিশেষত দুর্যোধনের), এবং ততোধিক অযৌক্তিক এবং নির্লজ্জভাবে আপাত অচেনা, অকস্মাৎ আবির্ভূত, পাঁচমেশালী পঞ্চপাণ্ডবভ্রাতার (বিশেষত যুধিষ্ঠিরের) পক্ষপাতী। এতৎসত্ত্বেও তিনি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মহামন্ত্রীর পদে বসে আজীবন আধিপত্য করেছেন। দুর্যোধনের যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হবার সময় আগত হওয়া মাত্রই জ্যেষ্ঠভ্রাতা হিসেবে যুধিষ্ঠিরকে পাণ্ডুর ‘ক্ষেত্রজ’ রূপে উপস্থিত করা, এবং তার সপক্ষে ক্রমাগত লড়াই করার কোনো যুক্তিই বিদুরের নেই, যদি না এর মধ্যে অন্য কোনো রহস্য নিহিত থাকে। ‘ধর্মাচারণ-ই এ দু’জনের মধ্যে সংযোগসূত্র’ বুদ্ধদেব বসুর এই উক্তি মানা আমার পক্ষে ভীষণ কষ্টকর হয় যখন দেখি শুধুমাত্র সাম্রাজ্য দখলের উদ্দেশ্যে কতো চক্রান্তের সাহায্যেই বিদুর যুধিষ্ঠিরকে পরিচালনা করেছেন, এবং সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে জন্মমুহূর্ত থেকেই নিরপরাধ শিশু দুর্যোধনের বিরুদ্ধে ক্লান্তিহীন অপপ্রচার চালিয়ে তাঁকে একটি নির্ভেজাল শয়তান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিদুর-যুধিষ্ঠিরের সম্পর্কের ভিত্তি ধর্মে নয়, শান্তনুর সাম্রাজ্য দখলের উদ্দেশ্যমূলক চক্রান্তে। যে কোনো সাধারণ সাংসারিক ক্ষেত্রে এইভাবে সহসা কেউ ভ্রাতা সেজে সম্পত্তির অধিকার চেয়ে দরজায় দাঁড়ালে (বিশেষত যদি তার পিতা মৃত হয়) স্বীকার করে নেবার প্রশ্ন উঠবে না; রাজত্ব দখলের ক্ষেত্রে তো এ এক অকল্পনীয় পরিস্থিতি। সেদিক দিয়ে বিচার করলে ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের ভদ্রতা এবং উদারতা উদাহরণযোগ্য, যদিও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে মূল নির্দেশ অভ্যন্তরের অন্তরাল থেকে সত্যবতীই দিয়েছিলেন। ব্যাসদেবের সূত্রে তিনি সম্ভবত পূর্ণসত্যই জানতেন।” পৃ : ১৪-১৫।

৪. মহাভারতে স্থান পেয়েছে সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব : “বিশ্লেষণ অনুসরণ করলে যে ব্যাপারটা প্রকট হয়ে ওঠে তা হলো, মহাভারতের বিশাল প্রেক্ষাপটে বিধৃত এক অনস্বীকার্য কালো-সাদার (আর্য-অনার্য) দ্বন্দ্ব। সংঘাত বৈধ-অবৈধের, আর্য-অনার্যের। লক্ষণীয়, যে ভারতবর্ষে আজও জাতিভেদ প্রবল, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের বিভেদ গাত্রবর্ণে প্রতিফলিত, সেখানে ক্ষত্রিয়-কুলের এই কাহিনীতে কৃষ্ণবর্ণের আধিপত্য সর্বত্র, অবৈধ অনার্য এবং মিশ্ররক্তের জয়জয়কার, শুদ্ধ শোণিতের চূড়ান্ত পতন ও বিলুপ্তি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ-যার নাম ‘ধর্মযুদ্ধ’- তা যে কতো দূর অধর্মের যুপকাষ্ঠে বলি হতে পারে, কতো মিথ্যা প্রবঞ্চনা নিষ্ঠুরতা ছলনা বর্বরতা হীনতা এবং কাপুরুষতার নিদর্শনে ভরা, তা ভাবলেও স্তম্ভিত হতে হয়। আর যখন দেখি প্রতিটি অধার্মিক আচরণ, অন্যায় আঘাত, মিথ্যাচার এবং শঠতা এসেছে পাণ্ডবপক্ষ থেকে, প্রধানত স্বয়ং কৃষ্ণের কপটতায় আসক্তিহেতু, তখন বোঝা যায় না কী ধর্মে আমাদের উদ্দীপ্ত করা মহাভারতের উদ্দেশ্য। কেন দুর্যোধন মন্দ যুধিষ্ঠির ভালো বলে কথিত, কেন দ্বৈপায়ন স্বীকৃত অথচ কর্ণ প্রত্যাখ্যাত, কেন বিদুর ধর্ম, কেন কুন্তী সতী, আর কেনই বা চতুর কৃষ্ণের উপর ঈশ্বরত্ব আরোপিত হলো? সে কি কৃষ্ণ কৃষ্ণাঙ্গ বলেই? বিদুর এবং যুধিষ্ঠির অবৈধ বলেই? কুন্তী বহুগামিনী বলেই? রটনা দিয়ে ঘটনাকে বদলানো যায় সেটা আমরা সাম্প্রতিক রাজনীতিতেও দেখতে পাই। কিন্তু মহাভারতে ধর্মের বর্ম পরিয়ে যে-ভাবে কৃষ্ণাঙ্গ এবং অবৈধদের প্রতি প্রকট পক্ষপাত প্রদর্শন করা হচ্ছে, শুধুমাত্র অক্লান্ত রটনার সাহায্যে সাদাকে কালো এবং কালোকে সাদা করা হচ্ছে, এবং দ্বৈপায়নের পক্ষপাত অনুযায়ী কিছু মানুষকে অতিমানবের চেহারা-চরিত্র দিয়ে জিতিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল।” পৃ : ১৫-১৬।

৫. মহাভারত বর্ণসংকরদের কাহিনী : “সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করলে মনে হয়, মহাভারতের গল্প বহিরাগত আর্যশাসকদের বিরুদ্ধে অনার্য, কৃষ্ণবর্ণ, বর্ণসংকর, জাতিবৈষম্য বিড়ম্বিত দেশবাসীর অন্তিম প্রতিশোধ। শুদ্ধ শোণিতের গরিমালুপ্তির ইতিহাস। হিন্দুধর্মে যতোই জাতবিচারের প্রচলন থাক, ভারতবর্ষের মাটি থেকে যে রক্তের শুদ্ধতা বহু যুগ পূর্বেই ধুয়ে মুছে গেছে, ভরতবংশের এই মহিমাম্বিত কাহিনী তার দলিল। মুনিঋষিই হোন, আর ক্ষত্রিয় রাজা-মহারাজাই হোন, এমনকি তথাকথিত দেবতারা পর্যন্ত, সত্যবতী-দ্রৌপদীর মতো কৃষ্ণাঙ্গী, রূপযৌবনবতী, অনার্যা রমণীদের চরণে নিজেদের উৎর্গিত করেছেন। এবং মাতৃশাসিত সমাজের সেই সব প্রবল ব্যক্তিত্বশালিনী নারীদের সম্মোহনের কাছে আর্যপুত্ররা, তপস্বী ব্রাহ্মণেরা, জাতের শুদ্ধতা বিসর্জন দিতে মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করেননি। জাতের দোহাই দিয়ে একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে নেওয়া অথবা কর্ণকে দ্রৌপদীর প্রত্যাখ্যান, নেহাৎ-ই অর্জুনের স্বার্থে উদ্দেশ্য-প্রণোদিত ঘটনা। বহিরাগতদের সঙ্গে আদিনিবাসীদের মিশ্রণ অতি নিবিড় এবং গভীর ছিলো বলেই পেশাভিত্তিক জাতবিচারের প্রয়োজন হয়েছিলো, শোণিতের শুদ্ধতার প্রশ্ন সেখানে অবান্তর।” পৃ : ১৬।

৩৮. শঙ্কু মহারাজ
কুম্ভ মেলায় : দে’জ পাবলিশিং : কলকাতা : ১৯৮৯

কুম্ভ মেলা প্রকৃত পক্ষে আর্য ও ভূমিপুত্রদের দ্বন্ধ : দেবতা ও অসুররা একত্রে অমৃত মন্থন করলেন। কথা ছিল যা অমৃত উঠবে তা তারা উভয়েই ভাগাভাগি করে খেয়ে অমরত্ব লাভ করবেন। কিন্তু দেবতারা (আর্য) অসুরদের (ভূমিপুত্র) সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এই সম্বন্ধে শঙ্কু মহারাজ লিখছেন: “এইভাবে তিন দিন পরে পরে জয়ন্ত চার জায়গায় অমৃত কুম্ভ নামিয়ে রেখে বারোদিন বাদে ফিরে এলেন সমুদ্র মন্থনস্থানে। পথিমধ্যে সেখানে সিন্ধু থেকে লক্ষ্মীদেবীও উঠে এসেছেন। অসুরগণ তাঁদের ন্যায্য অংশ দাবী করলেন; দেবতারা সম্মত হলেন না। দেবাসুরের সংগ্রাম শুরু হলো। ন্যায়ের জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সংগ্রাম। বঞ্চকের (আর্য) বিরুদ্ধে বঞ্চিতের (ভূমিপুত্রে) সংগ্রাম। এ সংগ্রাম আজো চলছে, চিরকাল চলবে। সেই ন্যায়যুদ্ধে দেবতাদের জয় লাভের কোন সম্ভাবনা ছিল না বলেই বোধ করি ন্যায়ের পরম আশ্রয় নারায়ণকে অন্যায়ের আশ্রয় নিতে হলো। তিনি দেবাসুরের সামনে মোহিনী রূপে আবির্ভূত হলেন। তারপরে মোহিনী মায়ায় আচ্ছন্ন করে সরল অসুরদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করলেন। অমৃত পাণ করে দেবতারা অ-মৃত হলেন।” পৃ: ১১।

৩৯. জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায় মহাকাব্য ও মৌলবাদ : প্রবন্ধ : মহাভারতের কৃষ্ণ :
এলাইড পাবলিশার্স : কলকাতা : ১৯৯৬।

১. মহাভারতের যুদ্ধ সত্যি হয়েছিল কিনা সন্দেহ : “সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে কুরুক্ষেত্রে একটা বড় যুদ্ধ হয়ে থাকলে খ্রিস্টপূর্ব নবম কিংবা দশম শতাব্দীতে হয়েছিল। তার আগে হওয়া সম্ভব নয়। তবে মহাভারত-এ বর্ণিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সত্যি হয়েছিল কিনা হয়ে থাকলে কাদের মধ্যে হয়েছিল, আর আট হাজার অথবা চব্বিশ হাজার শ্লোকের আদি মহাভারত-এ এই যুদ্ধের কাহিনী ছিল কিনা, এসব নিয়ে গভীর সন্দেহের অবকাশ আছে।” পৃ : ৭৫।

২. পাণ্ডবরা অনৈতিহাসিক: “মহাভারতের সমকালীন অন্য কোন গ্রন্থে পাণ্ডবদের নাম পাওয়া যায় না। শতপথ ব্রাহ্মণ-এ ধৃতরাষ্ট্র পরীক্ষিৎ এবং জনমজেয়ের নাম আছে, কিন্তু পাণ্ডবদের উল্লেখ নেই।” পৃ: ৭৬।

৩. বেদব্যাস ও পাণ্ডবদের জন্ম বিকল্প পিতার ঔরসে: “মহাভারত রচয়িতা বেদব্যাস এবং মহাভারতের অন্যান্য প্রধান চরিত্রদের অনেকেরই জন্ম বিকল্প পিতার ঔরসে। কিন্তু পাণ্ডব ছাড়া অন্যদের স্বাভাবিক জন্ম, অর্থাৎ মানুষের সংগে মিলনের ফলে জন্ম। শুধু পাণ্ডবদের জন্ম অতি প্ৰাকৃত। পাণ্ডু কুন্তী ও মাদ্রীর হিমালয়ে আশ্রমবাস কালে যুধিষ্ঠির ভীম ও অর্জুন যথাক্রমে ধর্ম বায়ু এবং ইন্দ্রের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে, আর নকুল ও সহদেব অশ্বিনী কুমারের ঔরসে মাদ্রীর গর্ভে জন্ম লাভ করেন। এই অবিশ্বাস্য কাহিনী থেকে মনে হয় পাণ্ডবেরা কবিকল্পনার আবিষ্কার মাত্র।” পৃ: ৭৭।

৪. কৃষ্ণ কয়েকজন, মহাভারতের কৃষ্ণ ও গোপাল কৃষ্ণ এক নন: “মহাভারতের বাইরে আমরা কৃষ্ণ নামে অন্তত চারটি চরিত্রের সন্ধান পাই। এদের মধ্যে একজন ঋকবেদের ঋষি কৃষ্ণ, আবার ঋকবেদেই আরেকজন অসুর এর উল্লেখ আছে যার নামও কৃষ্ণ। এই অসুর কৃষ্ণ অংশুমতী নদীর তীরে দশ সহস্র সৈন্য নিয়ে আর্যদের অগ্রগতিতে বাধা দিলে ইন্দ্র তার “কৃষ্ণত্ব উন্মোচন করে” (গায়ের চামড়া তুলে নিয়ে?) তাকে বধ করে তার দেহ পুড়িয়ে ফেলেন এবং তার গর্ভবতী পত্নীদের হত্যা করেন। প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থ ললিত বিস্তর-এও একজন অসুর কৃষ্ণের সামান্য উল্লেখ আছে, কিন্তু সেই কৃষ্ণই ঋকবেদের অসুর কৃষ্ণ কিনা তা বলা সম্ভব নয়। এক তৃতীয় দেবকীপুত্র কৃষ্ণের উল্লেখ আছে ছান্দোগ্য উপনিষদে। এই কৃষ্ণ ছিলেন ঘোর অঙ্গিরস নামক এক সূর্য উপাসক (সম্ভবত প্রাচীন ভাগবত অবলম্বী) পুরোহিতের শিষ্য। … বিশ্বাসীরা সাধারণত অপর এক চতুর্থ কৃষ্ণের সঙ্গেই মহাভারত-এর কৃষ্ণকে অভিন্ন বলে প্রচার করে থাকে। ইনি বালক কৃষ্ণ, আর পৌরাণিক যুগে এই বালক কৃষ্ণকেই মহাভারত-এর কৃষ্ণের বাল্যরূপ হিশেবে প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করা হয়েছে। এই কৃষ্ণ রাখাল বালক বা গোপালক বা গোপাল। … কিন্তু এই কৃষ্ণকে মহাভারত-এ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাকে পাওয়া যায় বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ, ব্রহ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, জয়দেব গোস্বামীর গীতগোবিন্দ এবং ভাগবত পুরাণে। এগুলি সবই প্রথম পর্যায়ের মহাভারতের অনেক পরের লেখা।…মহাভারতের কোথাও রাধা নামের উল্লেখ নেই। …অতএব এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে মথুরা বৃন্দাবনের দেবকীপুত্র গোপালকৃষ্ণ মোটেই মহাভারত-এর কৃষ্ণ নন দুই কৃষ্ণের একীকরণ সাধিত হয় শুধু মাত্র অবতার কৃষ্ণের অবতারসুলভ বাল্য জীবন সৃষ্টির প্রয়োজনে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রবক্তা সুচতুর ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্য সাধক কলমের গুণে।” পৃ : ৭৯-৮১।

৫. প্রথমে লিখিত মহাভারতে কৃষ্ণের কোনো অস্তিত্ব ছিল না: “প্রথম পর্যায়ের মহাভারতে কৃষ্ণের কোন অস্তিত্ব ছিল না। পরবর্তীকালে মহাভারতের উপাখ্যান ভাগ সংযোজন এবং তার কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে কৃষ্ণকে একজন বলবান এবং প্রাজ্ঞক্ষত্রিয় ও পরে একজন অবতার রূপে গড়ে তোলা হয়েছে। এ তত্ত্ব যদি সম্পূর্ণ সত্য নাও হয়, তথাপি এ বিষয়ে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই যে বর্তমানে প্রচলিত বেদব্যাসী মহাভারত-এর কৃষ্ণ চরিত্র বহুলাংশেই কাল্পনিক। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা ভালো যে মহাভারত-এর রচয়িতা বলে কথিত বেদব্যাসের আসল নামও কৃষ্ণ। দ্বীপে জন্ম বলে তার বিশেষণ দ্বৈপায়ন, আর বেদকে চার ভাগ করেছিলেন বলে তার উপাধি বেদব্যাস। নিজের নামে স্বরচিত মহাকাব্যের প্রধান চরিত্র সৃষ্টি লেখকের পক্ষে অসম্ভব নয়।” পৃ : ৮২-৮৩।

৬. শ্রীভগবান ও শ্রীকৃষ্ণ এক নন : “ভগবদ্‌গীতার নায়কের নাম শ্রীভগবান, শ্ৰীকৃষ্ণ নয়। ব্রাহ্মণ্যধর্মের গভীর অসাম্য ভিত্তিক এবং অমানবিক অনুশাসনগুলোকে ঐশ্বরীয় মহিমায় মহিমান্বিত করে অশিক্ষিত এবং নিপীড়িত জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের উদ্দেশ্যেই চতুর ব্রাহ্মণেরা এই কাল্পনিক শ্রীভগবান চরিত্র সৃষ্টি করেছিল।” পৃ: ৮৯।

৭. মহাভারত ধর্মগ্রন্থ নয় : “মহাভারত কোন ধর্ম গ্রন্থ নয়, কল্পলোকের মহাকাব্য মাত্র পৃ : ৯০।

৪০. জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায়
সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভগবদ্‌গীতা: এলাইড পাবলিশার্স : কলকাতা : ১৯৯৭।

১. ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য গীতা: শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবাদ প্রচার করেন। তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য গীতাকে ব্যবহার করেন। পৃ : ১৩-১৪।

২. বিদ্যাসাগর গীতার নাম নেন নিঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কখনও দক্ষিণেশ্বরে যান নি, আমন্ত্রিত হয়েও। তিনি কৃষ্ণ অবতার, ভগবদ্‌গীতার নাম নেননি। পৃ: ২২।

৩. গীতা মহাভারতে ছিল না: বঙ্কিমের মতে গীতা আদি মহাভারতে ছিল না।

৪. গীতায় অহিংসা আক্রান্ত : গীতায় অহিংসা ধর্মকে (বৌদ্ধদের) সরাসরি আক্রমণ করা হয়েছে। পৃ : ৬০-৬৩।

৫. গীতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ : লেখক রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলেছেন: “অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করার জন্য আত্মার অবিনশ্বরত্ব সম্বন্ধে যে উপদেশ আছে তার মধ্যে বিশুদ্ধ সত্যের সরলতা নেই। আমার মনে হয় বৌদ্ধ উপদেশে ভারতবর্ষকে যখন নিষ্ক্রিয় করে তুলেছিল তখন কোন মনস্বী পূর্বতন গুরুর উপদেশকে কর্মোৎসাহকরভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।” পৃ: ৬৬।

৬. “সর্বধর্ম পরিত্যজ্যং মামকেং শরণং ব্রজ” এর অর্থ কি: বৌদ্ধধর্ম জৈনধর্ম ও অন্যান্য ধর্ম ছেড়ে আর্যদের ঈশ্বরে ও তার প্রচারিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে গ্রহণ কর – এই হচ্ছে আসল কথা। পৃ : ৭২। ৭. কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ নয়ঃ কৃষ্ণ যদু বংশের জাগতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে অধর্ম যুদ্ধে পরিচালক ছিলেন, একথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। অতএব কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকে কোন অর্থেই ধর্মযুদ্ধ বলা যায় না। পৃ : ৭৮-৮০।

৮. গীতার শ্রীভগবান ঐতিহাসিক নন: গীতার শ্রীভগবান ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবক্তাদের দ্বারা সৃষ্ট কল্পিত চরিত্র মাত্র, ঈশ্বরের অবতার অথবা অন্য কোন ঐতিহাসিক মানুষ নন। পৃ : ১৭৯!

৪১. কুণাল চক্রবর্তী
সমাজ সংস্কৃতি ইতিহাস : অধ্যাপক অশীন দাশগুপ্ত স্মারকগ্রন্থ :
সম্পাদনা : রণবীর চক্রবর্তী প্রমুখ : প্রবন্ধ : অসহিষ্ণুতার ইতিহাস?
বাংলার পুরাণে বৌদ্ধ : আনন্দ পাবলিশার্স : কলকাতা : ২০০০।

১. পৌরাণিক ধর্ম কি : “পৌরাণিকধর্ম ব্রাহ্মণ্য নেতৃত্বে বৈদিক ও স্থানীয় ধর্মবিশ্বাস ও আচরণের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। “ পৃ: ১৫৩।

২. বৌদ্ধধর্মের কুৎসা কেন: “ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতা দিয়ে বৌদ্ধধর্মের সূচনা হয়েছিল এবং বৌদ্ধদের ধর্মীয় – সামাজিক গুরুত্ব বজায় থাকলে বাংলায় ব্রাহ্মণ্য প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, এ কথা ব্রাহ্মণরা কখনও ভোলেননি। ফলে বাংলার পুরাণে বৌদ্ধধর্ম অনিবার্যভাবে ভ্রষ্ট ও পরিত্যজ্য প্রতিপক্ষরূপে বর্ণিত হয়েছে। সমাজতাত্ত্বিকরা বলেন, সামাজিক বর্ণবিন্যাসে অন্যপক্ষের প্রতি এর চেয়ে তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব আর হতে পারে না।” পৃ : ১৫৮।

৩. বুদ্ধই বিষ্ণু : “পুরাণ মতে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের উন্মলনে প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেছিলেন শিব। কিন্তু এ ব্যাপারে বিষ্ণুর ভূমিকা আরো সুদূর প্রসারী। বিষ্ণু স্বয়ং বুদ্ধকেই আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। পৃ : ১৬৩।

৪. ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মেজাজ আক্রমণাত্মক : “ব্রাহ্মণ্যধর্মে হিংসাত্মক আচরণের উদাহরণ অল্পই, আক্রমণাত্মক মেজাজের পরিচয় কিন্তু একটু খুঁজলেই পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণরা বুদ্ধ ও বৌদ্ধদের শোধন করে নিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক বৌদ্ধধর্মকে কিন্তু তাঁরা কখনও সহ্য করেননি, বরং সর্বশক্তিতে প্রতিহত করতে চেষ্টা করেছেন।” পৃ: ১৬৫।

৪২. সুনীল চট্টোপাধ্যায়
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস :
দ্বিতীয় খণ্ড : পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ : ১৯৯৫।

১. প্রথম ‘হিন্দুধর্ম’ শব্দ ব্যবহার : “খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আরবগণ শৈব এবং বৈষ্ণবদের প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম ‘হিন্দুধর্ম’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।” পৃ: ১৭৩।

২. শিব ও লিঙ্গ পূজা: “শিব পূজার সঙ্গে উর্বরতার প্রতীকরূপে নন্দি এবং লিঙ্গপূজাও যুক্ত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় শতাব্দীর শুরুতে লিঙ্গপূজার প্রচলন হয়েছিল বলে মনে করা হয়।” পৃ : ১৭৪।

৩. ‘জাতি’ (কাস্ট) জন্মগত নয়: “বিশ্বামিত্র প্রথমে ক্ষত্রিয় ছিলেন এবং পরে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছিলেন।” পৃ : ১৭৫।

৪. ব্রাহ্মণ কর্তৃক পুরাণ আত্মসাৎ: “একদা চারণ কবিগণ পুরাণ রচনা করেছিলেন। কিন্তু এখন (পৌরাণিক কাল) তাদের উপর ব্রাহ্মণদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁরা প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় সেগুলিকে নতুন করে লেখেন এবং সেগুলিতে বিভিন্ন হিন্দু সম্প্রদায় এবং তাদের আচার অনুষ্ঠান সংক্রান্ত তথ্যাদি যুক্ত করেন।” পৃ : ১৭৭।

৫. বৈদিক দেবদেবী পেছনে পড়ে যায় : “পৌরাণিক হিন্দুধর্ম ধর্মের ক্ষেত্রে পালাবদল ঘটিয়েছিল। বৈদিক দেব-দেবী ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিলেন, বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠান ধীরে ধীরে কমে এসেছিল।” পৃ : ১৭৭।

৬. গণপতি পূজা আধুনিক কালের: “কার্তিকেয় পূজার পূর্ব ইতিহাস থাকলেও, গণপতি (গণেশ) পূজার তা ছিল না। ৩০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে গণপতি পূজার কোন পরিচয় পাওয়া যায় না।” পৃ: ১৮১।

৪৩. রমেশ বসু
প্রবন্ধ : বঙ্গভাষায় বৌদ্ধ স্মৃতি: গ্রন্থ: বুদ্ধ ও বৌদ্ধ :
সংকলন : ড. বারীদবরণ ঘোষ: করুণা প্রকাশনী : কলকাতা।

১. পাষণ্ড শব্দ: “পাষণ্ড মানে ধর্ম্মাচার্য্য। নিন্দা বা প্রশংসা হিসাবে এ শব্দ ব্যবহৃত হয় নাই। পরে এই শব্দটির অর্থ পরিবর্তন ও অবনতি হইয়া শুধুই বিরুদ্ধবাদীর প্রতি প্রযুক্ত হইতে থাকে।” পৃ: ৭৯।

২. রথযাত্রা বৌদ্ধ উৎসব : “এখন আমরা রথযাত্রা উৎসবটিকে বিষ্ণুর সঙ্গে অচ্ছেদ্য সম্বন্ধযুক্ত মনে করিয়া থাকি। কিন্তু প্রাচীনকালে এ উৎসব বৌদ্ধদেরই ছিল।” পৃ: ৮৭

৩. কায়স্থ পদবির উৎপত্তি: “বৌদ্ধ আমলে লোকের নিজের নামটি মাত্র ব্যবহৃত হইত। তাহাদের পদ্ধতি বা বংশনাম কিছু ছিল কিনা জানা যায় না।… বৌদ্ধদিগের নামগুলির মধ্যে কোনোটি শক্তি, কোনোটি মৈত্রী, কোনোটি চারিত্র্য, কোনোটি মাঙ্গল্যবাচক ছিল। এইসব ভাব প্রকাশ করিবার জন্য অন্যান্য শব্দের মধ্যে ধর, কর, ঘোষ, দাস, গুপ্ত, মিত্র, ভদ্র, সেন, শীল, পাল, রক্ষিত প্রভৃতি নামের অংশরূপে ব্যবহৃত হইত। তখন কিন্তু এসব শব্দ দেখিয়া কাহারো জাতি নির্ণয় করা যাইত না। কারণ নামগুলি গুণবাচক ছিল এবং উহাতে বংশ পরিচয় ছিল না। পরে দেশে পুনরায় হিন্দু প্রভাবের সময়ে একটি মাত্র নাম দ্বারা জাতি বুঝান যায় না বলিয়া আলাদা উপনাম বা বংশনাম দরকার হইয়া পড়ে। অথচ বহুদিন পরে কাহারো আর পূর্বের জাতির কথা মনে ছিল না। তখন বৌদ্ধ অবস্থার নামের পূর্ব লিখিত অংশগুলি আলাদা করিয়া লইয়া নতুন করিয়া বংশনাম সৃষ্টি হইয়াছিল কিনা তাহা খোঁজ করিয়া দেখা দরকার।” পৃ: ৯০।

৪৪. তরুণ গাঙ্গুলী
‘মাইনর ভয়েস’: দৈনিক টেলিগ্রাফ: কলকাতা : ২৪.৭.৯৬।

‘কাস্ট’ ও ‘ক্লাস’ এক : দেশের প্রায় সকল অঞ্চলে, ‘জাতি’ (কাস্ট) ও ‘শ্রেণী’ (ক্লাস) প্রায় সমার্থক (বাংলা অনুবাদ)।

৪৫. রঞ্জিত কুমার মজুমদার
মা কালী কে ছিলেন? সংবাদ প্রতিদিন : কলকাতা : ১৮.১০.৯৮।

১. বর্তমানের কালীর রূপটি কৃষ্ণানন্দ স্বপ্নে দেখেছিলেন: “কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের আর একটি পরিচয়, চৈতন্য মহাপ্রভুর তন্ত্র শিক্ষক ছিলেন। এই মহাত্মা ভারতবর্ষের অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে প্রচুর লুপ্ত প্রায় তন্ত্র উদ্ধার করেন, ধৈর্যের সঙ্গে অধ্যয়ন করে রচনা করেছিলেন ‘তন্ত্রসার’ নামে একটি গ্রন্থ। যে গ্রন্থ আজও পণ্ডিত সমাজে অত্যন্ত অমূল্য শাস্ত্রগ্রন্থ হিসাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই কৃষ্ণানন্দ এক রাত্রে স্বপ্নে কালীর এক নতুন রূপ প্রত্যক্ষ করলেন। দক্ষিণ পদটি আগে রেখে ঘোর করাল বদনা কালী তাঁর জিহ্বাটি বার করে দাঁড়িয়ে আছেন। পরদিন অতি প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করে ঘরের বাইরে বনে একাগ্রচিত্তে চিন্তা করতে লাগলেন গত রাতে স্বপ্নে দেখা মূর্তির কথা। সত্যি কি স্বয়ং কালী স্বপ্নে তাঁকে এই নতুন রূপ ধারণ করে প্রত্যক্ষ করালেন, না একি তাঁর মানসিক কোন চিন্তার প্রতিফলন? মাতৃচিন্তায় বিভোর কৃষ্ণানন্দ এক সময়ে উদাস নেত্রে সম্মুখ পানে তাকাতেই হঠাৎ তাঁর নজরে পড়লো আটপৌরে শাড়ি পরিহিতা কৃষ্ণবর্ণা এক কিশোরীকে। কিশোরীটি তার ডান পা-টি আগে রেখে আর বাম পা-টি পশ্চাতে রেখে আপন মনে মাটির দেওয়াল লেপন করছে। কৃষ্ণানন্দের সঙ্গে কিশোরীটির দৃষ্টি বিনিময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিশোরী লজ্জায় জিভ কেটে ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়ল। এরকম একটি দৃশ্য দেখামাত্র কৃষ্ণানন্দের গত রাত্রে দৃষ্ট স্বপ্নের কথা চকিতে মনে পড়ে গেল। এরকম রূপই তো তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন। আর একবার ভাল করে দেখবার জন্য তিনি পুনরায় সম্মুখ পানে তাকালেন। কোথায় সেই কিশোরী। কেউ কোথাও নেই। শান্ত নিঃস্তব্ধ জনশূন্য ধু ধু প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই তাঁর দৃষ্টিগোচর হল না। নতুন করে কৃষ্ণানন্দ উপলব্ধি করলেন মহামায়ার বিচিত্র লীলা। স্বয়ং কালীরূপে প্রকটিতা হতে চান বলেই স্বপ্নে আর বাস্তবে এক অভিন্ন নতুন রূপ ভক্ত সাধককে দেখালেন। তিনিই প্রথম লিখলেন তাঁর ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে কালীর রূপ বর্ণনায়, “কারালবদনং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভূজাম কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুন্ডমালা বিভূষিতাম।”

২. বর্তমান কালী রূপ ষোড়শ শতাব্দী থেকে: “কৃষ্ণানন্দের সময় থেকেই অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ হতে কালীর ওই নবরূপের প্রচলন। বামা কালীর বাম পা আগে রাখা যেমন শাস্ত্র সম্মত তেমনি দক্ষিণ পা আগে রাখা মূর্তিও অশাস্ত্রীয় নয়। চরণযুগলের একটি আগে বা পিছনে রাখার জন্য কালীর আর এক নাম দক্ষিণাকালী নয়। দয়া দাক্ষিণ্য দাত্রী হিসাবেই ওই নামের সার্থকতা। কালী ইতিবৃত্ত জানতে গেলে তন্ত্র শাস্ত্রের উল্লেখ একান্ত অপরিহার্য। কারণ একমাত্র ওই শাস্ত্রেই কালীর উপাসনা এবং ক্রিয়া পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। এই তন্ত্র শাস্ত্রের উল্লেখ একান্ত অপরিহার্য। কারণ একমাত্র ওই শাস্ত্রেই কালীর উপাসনা ক্রিয়া পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। এই তন্ত্রশাস্ত্রের আর এক নাম, আগম শাস্ত্র।“

৪৬. অক্টাভিও পাজ
ইন দি লাইট অব ইণ্ডিয়া : দি হার্ভিল প্রেস : ১৯৯৭।

১. কৃষ্ণ অন-আর্য দেবতাঃ কৃষ্ণের উৎস অস্পষ্ট। তিনি বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। কিন্তু পূর্বে তিনি ছিলেন অন-আর্য দেবতা। সম্ভবত তিনি প্রাচীন ভারতের একজন সাংস্কৃতিক নেতা ছিলেন (বাংলা অনুবাদ) পৃ : ১৮১”।

৪৭. অতুলকৃষ্ণ বিশ্বাস
পাপ আজিকার নহে, তাহার চিহ্ন ইতিহাস জোড়া: দেশ: চিঠিপত্র কলাম : কলকাতা : ১৯৯৮। ‘দেশ’ এর ১৫.১১.১৯৯৭ তারিখের সম্পাদকীয় রচনা “মন্দিরে মন্দিরে অমানবিকতার পাপ রচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি।

১. ব্রাহ্মণ পাণ্ডারা জগন্নাথ দেবের মন্দির ইংরেজের হাতে তুলে দেয় : ১৮০৩ সাল। জগন্নাথ দেবের এক শ্রেষ্ঠ পাণ্ডা ওড়িষ্যা বিজয়ী ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কাছে দূত পাঠিয়ে ইংরেজদেরকে মন্দির অধিগ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন। ইংরেজরা অতঃপর মন্দিরটি অধিগ্রহণ করে।

২. জগন্নাথ মন্দিরে লক্ষ লক্ষ হিন্দুর প্রবেশ নিষিদ্ধ : ১৮০৯ সালে আইন করে মোট ১৭টি জাতির হিন্দুর জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের ‘পীরালি’ বংশ, রাজবংশী, শুঁড়ি, নমঃশূদ্র, মাছুয়া, বাগদি, চামার, ডোম, ভুইমালি ও হাড়ি অন্যতম।

৩. ব্রাহ্মণ পুরোহিতের ইংরেজ প্রীতি: অথচ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা হননকারী ইংরেজকে ব্রাহ্মণ-পুরোহিতরা সানন্দে জগন্নাথ মন্দিরের অভ্যন্তরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়।

৪. কোহিনুর ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা ইংরেজের হাতে তুলে দেয় : আমরা অনেকেই জানি না, ব্রিটিশ সম্রাটের মুকুট মহামূল্য উজ্জ্বলতম হিরা-কোহিনূর-পুরী জগন্নাথ মন্দিরের ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা গত শতাব্দীতে (ঊনবিংশ) ইংরেজ কর্মচারীদের হাতে তুলে দেয়।

৫. কিছুদিন আগ পর্যন্ত কালীঘাটে অস্পৃশ্যদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল: বর্তমান শতাব্দীর (বিংশ) ত্রিশ দশক পর্যন্ত অস্পৃশ্যদের কলকাতার কালীঘাটমন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হত না।

৬. অধিকাংশ হিন্দুর জন্য মন্দির ছিল নিষিদ্ধ: ১৯১১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলার ৪৫.৮ শতাংশ হিন্দুকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না।

৭. আম্বেদকরকে পুরী মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি: ১৯৪৭ সালে গভর্ণর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ড. বি আর আম্বেদকরকে (ভারতীয় সংবিধান রচয়িতা) সঙ্গে নিয়ে পুরীতে যান। বড়লাটকে মন্দির কর্তৃপক্ষ সম্বর্ধনা দেন। কিন্তু নীচু জাতির (তথাকথিত) আম্বেদকরকে মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

৪৮. নবনীতা দেবসেন
দেশ: বইয়ের ভুবনঃ ২৪.১.৯৮।

১. রাম ব্রাহ্মণ্যবাদী : তিন খণ্ডে এবার অন্ধ্রে রচিত হয়েছে ‘রামায়ণবিষবৃক্ষম’। লিখেছেন রঙ্গনায়কাম্মা। এটি একটি উপন্যাস। ১৯৭৪ সালে প্রথম খণ্ড প্রকাশ। ৭৬ সালের মধ্যে পূর্ণ। রঙ্গনায়কাম্মার মতে: রাম সামন্ততান্ত্রিক, ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের অসম নিষ্ঠুর সমাজ ব্যবস্থার প্রতিভূ। পৃ : ১১৯।

২. তামিল নাড়ুর পেরিয়ার ইভি রামস্বামী নাঈকারের রামায়ণ তত্ত্বে : রামকে অত্যাচারী আর্য ও রাবণকে দ্রাবিড় সংস্কৃতির ধারক বলা হয়েছে। পৃ : ১২৬

৪৯. ড. দেব কুমার দাস:
সংস্কৃত সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত :
সংস্কৃত পুস্তক ভান্ডার:কলকাতা : ১৪০৪।

১. রাম আসলে বীর : প্রথমে রাম বীর ছিলেন। পরের দিকে রামকে অবতার বানানো হয়। এবং আরো পরে তাকে বিষ্ণুর অবতার করা হয় রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশে। পৃ : ৪১-৪৩।

৫০. নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী
মহাভারতের ভারত যুদ্ধ এবং কৃষ্ণ: আনন্দ পাবলিশার্স : কলকাতা : ১৩৯৮।

১. কৃষ্ণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য: ক. তিনি তাঁর মামা কংসকে (ভোজপতি) হত্যা করেন, খ. গোপ মহিলাদের প্রেম জাগিয়ে তিনি পালিয়েছেন, গ. তিনি পরস্ত্রী গমণ করেছেন ঘ. যে সব যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন সেখানে তিনি অনেক সময় যুদ্ধরীতি মানেন নি, ঙ. কৌলিক সম্বন্ধ থাকা সত্ত্বেও হরণ করে তিনি রুক্মিনীকে বিয়ে করেন ও চ. তিনি মদ্যপান করতেন।

২. কৃষ্ণ ব্রাহ্মণদের পা ধুয়ে দেন : কৃষ্ণ ছিলেন ব্রাহ্মণদের পক্ষে। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে কৃষ্ণ ব্রাহ্মণদের পা ধুয়ে দিয়েছিলেন সকলের সামনে।

৩. কৃষ্ণের ধর্মরাজ্যের চেহারা: কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর রাজ্য জুড়ে হাহাকার। পুরুষ সৈন্য নিঃশেষ। কৌরবরা সব মৃত। পাণ্ডবরা বেঁচে থাকলেও তাদের বংশে পরীক্ষিৎ ছাড়া কেউ জীবিত নেই। বিধবাদের ক্রন্দন। যদু বংশ নির্বংশ। কৃষ্ণের দু’তিন স্ত্রী ছাড়া বাকীরা বিপথগামিনী, পুত্ররা ব্যভিচারী, সুরাপায়ী। কৃষ্ণের দেহত্যাগও গৌরবজনক নয়।

৪. ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণ হয়েছে: পৌরব রাজবংশ, ইক্ষাকু রাজবংশ ইত্যাদি রাজবংশে জন্মেও বংশধরেরা দলে দলে ব্রাহ্মণ হয়ে গেছেন। পৃ: ১৪৭।

৫. বলরাম দুর্যোধনের পক্ষপাতী : কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধ বলরামের কাছে মাতৃবংশের ঝগড়া। তিনি মহাভারতের যুদ্ধে কোন পক্ষ নেননি। কিন্তু দুর্যোধনের প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব ছিল। পৃ : ১৬০।

৫১. উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য :
ভারত দর্শন সার: বিশ্বভারতী : ১৩৯১।

১. নাস্তিক কে: বেদে অবিশ্বাসীরাই নাস্তিক বলে আখ্যায়িত। চার্বাক এই অর্থে নাস্তিক।

২. বেদ ভণ্ডদের সৃষ্টি: চার্বাক বলেছেন, ভণ্ড ধূর্ত ও নিশাচর এই তিন শ্রেণির লোকে মিলিয়া বেদ সৃষ্টি করিয়াছে। পৃ : ৪৭।

৩. ভারতীয় দর্শন : সর্বমোট ৯টি। এর মধ্যে ছয়টি যথা: সাংখ্য, যোগ, বৈশেষিক, ন্যায়, মীমাংসা ও বেদান্ত আস্তিক দর্শন এবং তিনটি যথা: লোকায়ত বা চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ নাস্তিক দর্শন। পৃ:৬২।

৪. চার্বাকের মতঃ সুখই কাম্য। পরলোক নেই। ভণ্ড, ধূর্ত, ও নিশাচররা বেদ রচনা করেছে। পশুবলীর প্রয়োজন নেই। ব্রাহ্মণরা লোক ঠকিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। দেহের পরে আর কিছু নেই, মৃত্যুর পর শেষ। অশ্বমেধ যজ্ঞে (শুক্ল যজুবেদের ২৩ অধ্যায়) অশ্লীল কথাবার্তা মন্ত্ররূপে উচ্চারিত হয়। পৃ: ৭৭-৮০।

৫. অবতারবাদ বৌদ্ধ ও জৈনদের থেকে পাওয়াঃ উপনিষদে অবতারবাদ নেই। কিন্তু বুদ্ধ ও মহাবীর বার বার আসছেন। কাজেই এই অবতারবাদ ওদের থেকেই পাওয়া। পৃ: ১১১-১১২

৬. বৌদ্ধ ও বৈদিক ধর্মের তফাৎ : বৌদ্ধদের সার কথা হচ্ছে প্রজ্ঞা, সমাধি ও শীল। জ্ঞান, ধ্যান ও চরিত্র। বৈদিকরা যজ্ঞকে প্রাধান্য দিয়েছে। বৌদ্ধ ও জৈনরা চারিত্রকে প্রাধান্য দিয়েছে। ভোগ অপেক্ষা ত্যাগকেই বৌদ্ধ ও জৈনরা বড় করে দেখেছে। পৃ: ১১২-১১৪।

৭. বেদান্ত: ছয়টি আন্তিক দর্শনের মধ্যে একটি। ইহার আরম্ভ উপনিষদে অর্থাৎ বেদের অন্তভাগে। তাই এর নাম বেদান্ত। অপর নাম ব্রহ্মবিদ্যা। ব্রহ্মই বেদান্তের আলোচ্য বিষয়। বেদান্ত সন্ন্যাসীর আশ্রয়ে পুষ্ট। ব্ৰহ্মই সত্য বস্তু, তা হইতেই জগতের ও বেদাদি শাস্ত্রের উদ্ভব হইয়াছে ইহাই বেদান্তের সিদ্ধান্ত। জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয়ের মূলে ব্রহ্ম। আত্মার দেহে অধিকার, মৃত্যুর পর দেহান্তর প্রাপ্তি ও মুক্তি বেদান্তের বড় কথা। পৃ: ২২১-২২৫

৮. খ্রিস্টের অনুকরণে কৃষ্ণ : খ্রিস্টের জীবনী ও কাহিনীর মধ্যে সাদৃশ্য এত বেশি যে উহা অনেকদিন পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে এবং অনেকে এরূপও মনে করিয়াছেন যে কৃষ্ণের জীবনের অনেক কাহিনী খ্রিস্টের জীবনী থেকে অনুকৃত হইয়াছে, যাহাকে আমরা ভাগবত বা বৈষ্ণব ধর্ম বলি তাহা বহুল পরিমাণে খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাবে পুষ্টি লাভ করিয়াছে। পৃ : ২৪৮

৯. বেদান্ত ও ন্যায় দর্শনও অভ্রান্ত নয়ঃ কোনো এক দর্শনে সমগ্র সত্য প্রকাশ পায় নাই। বেদান্ত ও ন্যায় উভয়ের মধ্যেই গ্রহণীয় ও বর্জনীয় দুইই আছে। পৃ: ২৬৭।

৫২. আশুতোষ ভট্টাচার্য
বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস : এ মুখার্জি এণ্ড কোং : ১৯৯৮।

১. হিন্দুর লোকসমাজ ব্রাহ্মণরা ধ্বংস করে: পাল-সেন আমলে যা সম্ভব হয়নি, মুসলমান আমলেও যা সম্ভব হয়নি তা পরবর্তীকালে সম্ভব হল। জমিদারের কর্মচারী তাহার অর্থনৈতিক সুবিধার সুযোগ লইয়া এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিত তাহার বর্ণের শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারে পল্লী জীবনের লোক সমাজের রূপটিকে অল্পদিনের মধ্যেই বিপর্যস্ত করিয়া তুলিল। পৃ : ৮।

২. জমিদারি প্রথা ব্রাহ্মণের প্রাধান্য তৈরি করে: এতদিন জাতি এবং ধর্মের অধিকারে এক একটি গ্রামের মধ্যে সকলেই সমান ছিল, কিন্তু ক্রমে (জমিদারি প্রথার পরে) ব্রাহ্মণের একটি কৃত্রিম সামাজিক প্রাধান্য সৃষ্টি হইল। পৃ: ৯।

৩. কালী দেবীর উৎপত্তি : কালী কৃষকের দেবী। পৌরাণিক ‘দেবাদিদেব’ এর সঙ্গে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মিশ্রিত হইয়া Supreme Deity (মহাদেবী) হয়। পৃ: ৭৩।

৪. একেশ্বরবাদ সৃষ্টি করতে গিয়েই কৃষ্ণের সৃষ্টি: চৈতন্যধর্মের পর সমাজে শ্রীকৃষ্ণ বা নারায়ণের উপাসনা বিশিষ্টতা অর্জন করে। চৈতন্য শ্রীকৃষ্ণ নারায়ণকে অবলম্বন করিয়া এ দেশে (মুসলমান একেশ্বরবাদের বিপরীতে) একেশ্বরবাদ গড়িয়া তুলিলেন। পৃ: ১১৭।

৫. চন্দ্রনাথ তীর্থ: বৌদ্ধদের দেবতা তারানাথ হিন্দুর শিব বা চন্দ্রনাথে পরিণত হইয়াছেন। আদিনাথ বা আদিদেবও তাই। পৃ: ২৩৯।

৬. মনসা দেবী নন, রাষ্ট্র শক্তির প্রতীক: মনসাকে দেবতা বলিয়া কল্পনা না করিয়া তাঁহাকে মধ্যযুগের অত্যাচারী রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক রূপেই কল্পনা করা হইয়াছে। সেই জন্য আত্মরক্ষায় নিরূপায় সমাজের সমগ্র ঘৃণা তাঁহার উপর পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিয়াছিল। অত্যাচারিতের নিকট বারবার সেই দেবতার অপমান ও পরাজয় বর্ণনা করিবার ভেতর দিয়া লাঞ্ছিত সমাজ সেদিন নিজের দুর্গতির মধ্যে এইভাবেই মানসিক সান্তনা লাভ করিয়াছে। মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীগণ মানুষ হইয়াও অমানুষ-দেবতা তো ননই। পৃ : ৪২০।

৭. চণ্ডীর উৎপত্তি : চণ্ডী শব্দটি সম্ভবত ‘অষ্ট্ৰিক’ কিংবা দ্রাবিড়। বৈদিক কোন চণ্ডী দেবী নেই। রামায়ণ ও মহাভারতে নেই। চণ্ডী সম্বন্ধে তিনটি মত যথা: ক. অনুমিত আদিবাসী সমাজ হইতে উদ্ভূত হইয়া এই দেবী কালক্রমে হিন্দু সমাজে প্রবেশ করিয়াছেন। পরে বৈদিক দেবী দুর্গা উমা দ্বারা প্রভাবিত হইয়া অভিন্ন হইয়া যায়, খ. বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবী বজ্রতারা পরবর্তী কালে বাংলার লৌকিক দেবী মঙ্গল চণ্ডীতে পরিণত হইয়াছেন ও গ. অনেকের মতে বৌদ্ধের আদ্যাশক্তি ক্রমশ হিন্দুর চণ্ডী হইয়া শিবের ভার্যা হন। পৃ: ৪৩৩-৪৪৯।

৫৩. আর সি দত্ত : প্রাচীন ভারতবর্ষের সভ্যতার ইতিহাস।

১. রাজপুতদের সহায়তায় পৌরাণিক হিন্দুধর্ম প্রতিষ্ঠিত: নবোথিত রাজপুতগণ যে বৌদ্ধধর্ম মতকে ভারত থেকে তিরোহিত করিয়াছেন তা বিশ্বাস করার কারণ আছে। রাজপুতগণ নতুন হিন্দু, পুরোহিত ব্রাহ্মণেরা তাদের ক্ষত্রিয় মর্যাদা দিয়ে বৌদ্ধদের বিনাশ ও হিন্দুধর্মের পুনরুদ্ধার করাইয়া লইলেন। তারা রাজ্য জয় করিয়া বৌদ্ধ চৈত্য ধ্বংস ও হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠা করিলেন। … এই রাজপুতরাই পৌরাণিক হিন্দুধর্ম প্রতিষ্ঠায় শক্তি যোগাইলেন পৃ : ১৪-১৫।

২. বেদেরকালে জাত-পাত ছিল না : গায়ত্রী মন্ত্রের ঋষি বিশ্বামিত্র। বলা হয় তিনি ক্ষত্রিয়। কিন্তু তিনি ক্ষত্রিয় ছিলেন না। কারণ বেদের কালে জাত বিচার ছিল না। তখন হিন্দু গৃহস্থ মাত্রই পুরোহিত, যোদ্ধা ও কৃষক ছিলেন। পৃ : ৮৫।

৩. রামায়ণের ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণের আজ্ঞাবহ : পরশুরাম সপ্তবিংশতি (২৭) বার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করে অবশেষে রামের কাছে পরাস্ত হন। বোধ হয় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে অনেক কাল বিরোধ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। উপনিষদেও এই বিরোধের প্রমাণ আছে। মহাভারতের ক্ষত্রিয় ভীষণ তেজী। রামায়ণে ক্ষত্রিয় নিষ্প্রভ ও ব্রাহ্মণের আজ্ঞাবহ। পৃ : ৯৮-৯৯।

৪. দ্রৌপদী বলতে কেউ নেই : কুরু-পাঞ্চাল যুদ্ধ। ‘পাঞ্চাল’ মানে পাঁচটি মিত্রতাবদ্ধ জাতি। পাঁচ জাতির প্রতীক পাণ্ডবদের পাঁচ ভাই। যেহেতু পাঁচ জাতি একতাবদ্ধ তাই একই ঘরকন্না করতে এক নারী-পাঞ্চালী (দ্রৌপদী) সৃষ্টি করে কবিরা। পৃ : ৯২।

৫. জাতিভেদের বীজ পৌরাণিক যুগের: জাতিভেদের বীজ বৈদিক যুগের শেষে রোপিত পরের যুগে অঙ্কুরিত হয়। বৌদ্ধ যুগে নষ্ট করার চেষ্টা হয়। পৌরাণিক যুগে তা সতেজ হয়। পৃ : ১০৪।

৫৪. শিবনারায়ণ রায় :
স্বদেশ স্বকাল স্বজন : প্যাপিরাস : ১৯৯৬।

১. বেদ রচয়িতারা বর্বর : ধ্বংস কর্মে বর্বরতায় বেদ রচয়িতারা ভ্যান্ডাল, ভিসিগথ বা হুনদের চাইতে কম পারদর্শী বা নির্মম ছিলেন না। পৃ : ৫০।

৫৫. ড. দীপক চন্দ্ৰ :
পিতামহ ভীষ্ম : দে’জ পাবলিশিং : ১৩৯৬।

১. ভীষ্মের মা গঙ্গা অন-আর্য : গঙ্গাকে অনার্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গঙ্গার আর্যীকরণ সহজে হয়নি। শান্তনুর সাথে তার বিবাহ হয়েছে। কিন্তু গঙ্গাকে আর্য কৌলিন্য থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। বইয়ের ভূমিকা।

২. ভীষ্ম ব্রাহ্মণ বিরোধী : ব্রাহ্মণ শাসিত কৌরব রাজ্যে ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের প্রতাপ খৰ্ব করলেন। ব্রাহ্মণরা পাণ্ডবকে পছন্দ করল। ভীষ্ম তাই ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষ ধরল। পৃ : ৮৬-৮৭।

৩. কৃষ্ণকে বিধাতা বানায় ব্রাহ্মণ পুরোহিতরাঃ কৃষ্ণ মর্ত্যের বিধাতা হতে গিয়ে এক অনর্থ বাধাল। সে যে বিধাতার অংশ, মানুষরূপী ঈশ্বর, দেশ ও দশের পরিত্রাণ করতে আর্বিভূত হয়েছে এই কথাটা একদল ব্রাহ্মণ পুরোহিত এবং মুনিঋষি বহুকাল ধরে প্রচার করে কৃষ্ণকে বিধাতা বানিয়ে তুলেছে। কৃষ্ণকে যারা বিধাতা বলে স্বীকার করল না তাদের সার্বিক ধ্বংসের জন্য কৃষ্ণ এই বৃহৎ যুদ্ধে লিপ্ত হলো। বহুকাল ধরে খুব ধীরেসুস্থে সে তার জমি প্রস্তুত করেছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আরম্ভ হলে ভীষ্ম তা জানতে পারেন। পৃ : ১৯৩।

৫৬. সতীন্দ্র মোহন চট্টোপাধ্যায় :
তন্ত্রের কথা : সাহিত্য সংসদ : ১৯৮৩।

১. তন্ত্র বনাম বেদ : বেদের সাথে তন্ত্রের সমান মর্যাদা অনেক আগে থেকেই। পৃ : ১। ২. তন্ত্রের উপজীব্য : পুরুষ ও নারীর সম্মিলিত পূজা। পুরুষ ও নারী হচ্ছে যথাক্রমে শিব ও শক্তি। পৃ: ২।

৩. দুর্গা ও কালী অন্ত্যজদের দেবী : অন্ত্যজদের মণ্ডপেই যে হিন্দুদের দুর্গা ও কালী প্রভৃতি পৌরাণিকী দেবীপূজার বোধন হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। পৃ: ৬।

৪. বুদ্ধদেব হিন্দু অবতার কিভাবে : জয়দেবই দ্বাদশ শতাব্দীতে ভগবান বুদ্ধকে হিন্দুর দশম অবতার করেন। পৃ : ২৭।

৫. তারা ও লোকনাথ বৌদ্ধ দেবদেবী : তারা বৌদ্ধতন্ত্রের নামজাদা দেবী। হিন্দুরা তারা দেবীকে দশ মহাবিদ্যায় স্থান দিয়ে আত্মসাৎ করেছে। তারাই এখন ব্রহ্মময়ী। বজ্রযানের জনপ্রিয় দেবতা লোকেশ্বর বা অবলোকিতেশ্বর (লোকনাথ)। পৃ : ৮২-৮৩।

৫৭. কে রাঘবেন্দ্র রাও :
বাবা সাহেব আম্বেদকর : সাহিত্য একাদেমী : ১৯৯৮।

ভারতীয় সংবিধানের রচয়িতা আম্বেদকর ধর্ম সমাজ ইত্যাদি বিষয়ে মূল্যবান অবদান রাখেন। শেষ পর্যন্ত হিন্দুর ছেলে আম্বেদকর হিন্দুধর্মের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। সমাজ তাকে যারপর নাই নির্যাতন করে। জীবনে তিনি বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হন। অথচ তিনি পাণ্ডিত্যে ছিলেন অসাধারণ। তবু তিনি সমাজে কোনো মূল্য পাননি। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতামত নিচে দেওয়া হল:

১. জাতির সৃষ্টি : প্রথমদিকে ভারতীয় সমাজে অসবর্ণ বিবাহ চালু ছিল। সবর্ণ বিবাহই ‘জাতি’র (কাস্ট) সৃষ্টি করে। পৃ : ১৮।

২. জাতির ক্ষতিকর দিকঃ জাতি অর্থনৈতিক দক্ষতা সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি করে। জাতির ব্যবস্থা হিন্দুকে বহু ভাগে বিভক্ত করে ও হীনবল করে। এতে পারস্পরিক যোগাযোগ রহিত হয়। বর্ণের ভিত্তি ছিল গুণ, কিন্তু ‘জাতির’ ভিত্তি হয় জন্ম। পৃ: ২১-২৫।

৩. হিন্দুর সংস্কার : প্রথমে তিনি মনে করতেন হিন্দুকে সংস্কার করা যায়, হিন্দুতে বিপ্লব সম্ভব নয়। কিন্তু পরে তিনি এই বিশ্বাস হারান। পৃ : ৬৭।

৪. মনুসংহিতা : মনু ধর্মীয় সাম্য অস্বীকার করেছেন। পৃ: ৭২।

৫. হিন্দু ধর্ম কি : অতিমানবের স্বর্গ, সাধারণ মানুষের নরক। পৃ : ৭৩

৬. ধর্মান্তরকরণ কেন : হিন্দু কর্তৃক বৌদ্ধ নির্যাতনের ফলেই ধর্মান্তরকরণ। পৃ : ৭৪।

৫৮. সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়
প্রাক্-পলাশী বাংলা সামাজিক ও আর্থিক জীবন:১৭০০-১৭৫৭
কেপি বাগচী এ্যাণ্ড কোম্পানী : কলকাতা-১৯৮২।

১. বৈদ্য ও কায়স্থ কারা? : “ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বৈদ্য ও কায়স্থরা বাংলার হিন্দু সমাজে একটি স্বতন্ত্র স্তর তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এরা তখনো শূদ্র বলে পরিগণিত হত ঠিকই, তবে এরা সুবর্ণবণিক ও কারিগর-থেকে কিছুটা দূরে সরে এসেছিল। এরা কিছুটা স্বতন্ত্র হয়ে পড়েছিল।” পৃ:১৬।

২. কায়স্থ কি করত? : কায়স্থরা একচেটিয়া করণিক। রাজস্ব বিভাগের চাকরি তাদের জন্য নির্দিষ্ট থাকত। মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজদ্দৌলা পর্যন্ত বাংলার নবাবরা হিন্দুদের ব্যাপকহারে রাজস্ব বিভাগে ও প্রশাসনে নিযুক্ত করেছিলেন। কায়স্থরা এই সরকারি চাকরির বেশির ভাগটাই পেত।” পৃ:১৮।

৩. নিম্ন জাতির উত্থান : বৃত্তি পরিবর্তন করে অনেকে ওপরে ওঠেছেন। যেমন: “রানাঘাটের বিখ্যাত পালচৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণ পান্তি জাতিতে ছিলেন ‘তাম্বুলি’ (পেশায় পান-সুপারির ব্যবসায়ী)। … রাজশাহীর অন্তর্গত দীঘাপাতিয়া জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা দয়ারাম রায় জাতিতে ‘তিলি’। পৃ:-২০।

৫৯. অরবিন্দ পোদ্দার
প্রচ্ছদ প্রবন্ধ : অনাবাসী ভারতপথিক নীরদ চন্দ্র :
দেশ কলকাতা : ৪.৯.১৯৯৯।

১. ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ সংঘাত: “কৃষ্ণের বুকে ভৃগু পদচিহ্ন—এই কাহিনীর মধ্যে রয়েছে ক্ষত্রিয়- ব্রাহ্মণ সংঘাতের সংকেত; সামাজিক-রাষ্ট্রিক প্রাধান্যের জন্য তাদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হয়েওছিল। এবং সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ব্রাহ্মণদের উপনিবেশ দক্ষিণ ভারতে পাড়ি দেয়, ও বসতি স্থাপন করে। কালক্রমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে ক্ষত্রিয়রাও বিচ্যুত হয়, ক্ষমতায় সমাসীন হয় বৈশ্য ও শূদ্ররা। মহাপদ্ম নন্দ, যিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ দশকের মাঝামাঝি, ছিলেন শূদ্রাণীর পুত্র। নন্দ বংশের পর আসে মৌর্য বংশ। তাদের আদিপুরুষ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যও শূদ্রাণীর সন্তান বলে পরিচিত। এদের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণদের সামাজিক মর্যাদা ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন হয়; ‘জাতক’-এর অনেক কাহিনী এর স্মারক। এইসব কাহিনীর তথ্যের ভিত্তিতে রচিত ‘দ্যা সোশ্যাল অর্গানাইজেশন ইন নর্থ-ইস্ট ইণ্ডিয়া ইন বুদ্ধস টাইম’ (আর ফিক) থেকে জানা যায়, রাজা অরিন্দম জনৈক পুরোহিত পুত্রকে নীচু জাতের মানুষ বলে চিহ্নিত করেন, কোশল দেশের রাজা তাঁর ব্রাহ্মণ কর্মচারীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতেন যাতে ব্রাহ্মণের মুখদর্শনের মতো নিন্দনীয় কাজ তাকে না করতে হয়। ব্রাহ্মণরা নাকি অস্পৃশ্য নিষাদ প্রভৃতি জাতের উপজীব্য যথা, পশুদের নির্বীজকরণ কসাইগিরি, শিকার ইত্যাদি করত (দাস-ব্রাহ্মণ জাতক); অবশ্য এতে তাদের ব্রাহ্মণত্ব অস্বীকৃত হত না।”

২. গুপ্ত যুগে ব্রাহ্মণদের প্রতিশোধমূলক গ্রন্থ ‘মনুসংহিতা”: “এবংবিধ (উপরোক্ত সামাজিক লাঞ্ছনা ও অপমানের প্রতিকারের জন্য ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীপতিরা যে সুযোগের অপেক্ষায় থাকবেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। সে সুযোগ আসে খ্রিস্টপূর্ব ১৮৭ সনে; সেনাধ্যক্ষ ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র সুঙ্গ মৌর্য বংশের সর্বশেষ সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করেন, এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। সেই দিন থেকে ব্রাহ্মণ্য প্রতিবিপ্লবের আরম্ভ; আর গুপ্তযুগের পরিসমাপ্তির মধ্যে (খ্রিস্ট পরবর্তী ৪৬৭ সন)- এর ভয়ংকর সফল রূপায়ণ।

৩. গুপ্ত যুগেই রামায়ণ, মহাভারত পরিবর্তন করা হয়: “এই সময়সীমার মধ্যেই (খ্রিস্টপূর্ব ১৮৭-খৃস্টাব্দ ৪৬৭১) রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি মহাকাব্য পরিমার্জিত হয়, ব্রাহ্মণের একচ্ছত্র আধিপত্য ও দিব্য শক্তির দ্যোত্তক কাহিনীগুলো তাতে প্রক্ষিপ্ত হয়, যেমন রামায়ণে শম্বুক হত্যার কাহিনী, মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত হয় গীতা। এই সময়েই রচিত হয় সুবিখ্যাত স্মৃতিশাস্ত্রগুলো। ঐতিহাসিক কালে ব্রাহ্মণদের পুঞ্জীভূত ক্রোধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা মনুসংহিতায় বিস্ফোরিত হয়। বর্ণ-সম্পর্ককে রূঢ় কঠিন বেষ্টনী দিয়ে আবদ্ধ করা হয়, এবং স্বধর্মে নিধন শ্রেয় (স্বধর্ম বলতে বর্ণ-নির্দিষ্ট কর্ম, সামাজিক দায়বদ্ধতায় নিযুক্ত থাকা বোঝায়), এই তত্ত্ব প্রচার করে বর্ণ-বৃত্তের বাইরে আসার পথ অবরুদ্ধ করা হয়। বর্ণপ্রথাকে federation আখ্যা দিয়ে এই ব্যবস্থার আপেক্ষিক উপযোগিতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করলেও স্মার্ত পণ্ডিতদের তথাকথিত ধর্মশাস্ত্রের অধার্মিকতা সম্পর্কে কিন্তু নীরদবাবু আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। অন্য দিকে, শম্বুক হত্যার ব্যাপারটিকে তিনি রামচন্দ্রের বর্ণভিত্তিক কর্তব্য সম্পাদন বলে অনুমোদন করেছেন।

৪. রাম কর্তৃক শূদ্র শম্ভুক হত্যা: “এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্রাহ্মণের পুত্রের মৃত্যু হয়েছে, রাজ্যে নিশ্চয়ই কেউ না-কেউ পাপকার্যে নিমগ্ন এই অভিযোগ করে ব্রাহ্মণ প্রতিকারের দাবিতে আত্মহত্যার হুমকি দিল, আর অমনি রামচন্দ্র কাজকার্য ফেলে তপস্যারত শূদ্রের সন্ধানে নির্গত হলেন এবং শম্বুককে হত্যা করলেন, এই কাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু এই প্রশ্ন?”

৬০. গিরিলাল জৈন দ্যা
হিন্দু ফেনোমেনন : ইউবিএসপিডি: ১৯৯৪।

১. হিন্দুত্ব একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণা! হিন্দুত্বকে বিভিন্ন ধর্মের ‘কনফেডারেশন’ বা যুক্তরাষ্ট্রীয় একটি ধারণা হিসেবে ভাবা হয়। এর দ্বারা হিন্দুদের প্রতি সুবিচার করা হয় না। পৃ: ১৫।

২. সহজযান ও গোরক্ষনাথ: পূর্ব থেকে পশ্চিমে কাবুলেরও বাইরে পর্যন্ত সহজযানী মার্গের অধিকার বিস্তৃত ছিল। ৮ম শতাব্দীর শঙ্কারাচার্য্যের পর সবচেয়ে শক্তিশালী ধর্ম গুরু গোরক্ষনাথ ছিলেন এই সহজযানের কেন্দ্রবিন্দুতে। তিনি দশম শতাব্দীর লোক। তার অনুসারীদের নাথপন্থী যোগী বলা হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে রাম ও কৃষ্ণের জনপ্রিয়তার পূর্ব পর্যন্ত নাথপন্থীরা ৬০০ বছর অত্যন্ত প্রভাবশালী সম্প্রদায় ছিল অথচ এ ঘটনাটি আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, যদিও উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত তাদের প্রভাব ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু তাদের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা নেই। পৃ: ৩১।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *