বেদ আছে, কিন্তু বেদের দেবতারা টিকেনি

বেদ আছে, কিন্তু বেদের দেবতারা টিকেনি

আনুমানিক তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে রচিত বেদ অনেক হিন্দুর কাছে ধর্মগ্রন্থ। বলা হয় ভগবদ্বিষয়ক জ্ঞানই হচ্ছে বেদ। বিশ্বাস করা হয় বেদের যাগ-যজ্ঞাদি দ্বারা চিত্তশুদ্ধি করে পরম পুরুষকে ডাকলে তাঁকে পাওয়া যায়। এমনও দাবি করা হয় যে বেদই হিন্দুর জীবনকে শতশত বছর যাবত নিয়ন্ত্রণ করে আসছে এবং হিন্দুর ধর্মটি বেদমূলক। অনেকে বেদকে দেখেন সকল জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে। বেদ জানা থাকলে আর কোনো জ্ঞানের প্রয়োজন নেই বলেও দাবি করা হয়।

এদিকে দেখা যায় ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদের গ্রহণযোগ্যতা বরাবরই প্রবল ছিল প্রতিবাদের বিষয়। বেদের বিরুদ্ধে প্রথম বড় প্রতিবাদ বৌদ্ধধর্ম। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে প্রধানত বেদকে এবং বেদের ধর্মকে অর্থাৎ বৈদিক ধর্ম বা আর্যধর্ম বা ব্রাহ্মণ্যধর্মকে অস্বীকার করেই বৌদ্ধধর্মের যাত্রা শুরু। বেদের দেবতা, সমাজ কাঠামো, জাতিবিন্যাস, যজ্ঞ ও পুরোহিত ইত্যাদি বিশেষ করে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করে বৌদ্ধধর্ম ভারতের জনপ্রিয় এক ধর্মের মর্যাদা লাভ করে। এর কিছুকাল আগে মহাবীরের জৈনধর্মও প্রায় একই অবস্থান নেয়। মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িককালে বেদ, বেদভিত্তিক সমাজ ও চিন্তাবোধ, যজ্ঞ ও পুরোহিত, বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য সমাজের বিরুদ্ধে কঠোরতম অবস্থান নেন বিখ্যাত ভারতীয় দার্শনিক চার্বাক। তাঁর দর্শন চার্বাক দর্শন হিসেবে পরিচিত। বৌদ্ধ ও চার্বাক দর্শন যেহেতু বেদবিরোধী তাই এই দর্শন দুটোকে বেদপন্থীরা নাস্তিক দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করে। আর বৌদ্ধরা পরিচিত হয় ‘নাস্তিক’ হিসেবে। বিপরীতে বেদে বিশ্বাসীরাই পরিচিতি লাভ করে ‘আস্তিক’ হিসেবে।

একদিকে আর্যধর্ম/বৈদিকধর্ম/ব্রাহ্মণ্যধর্ম এবং অন্যদিকে লোকায়ত ধর্ম ও বিশ্বাস, জৈন-বৌদ্ধধর্ম ও চার্বাক দর্শনের সংঘাত-সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে সংঘটিত সমাজ-বিপ্লবের এক পর্যায়ে বৌদ্ধধর্ম নির্জীব হয় এবং রচিত হয় পৌরাণিক ধর্মের প্রেক্ষাপট। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতে সূচনা ঘটে পৌরাণিক ধর্মের। এ ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে বিভিন্ন পুরাণ কাহিনী। একে বলা যায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের বা বেদভিত্তিক ধর্মের পুনরুত্থান। এই পুন- রুত্থানকালেই বিভিন্ন পুরাণ রচিত হয়। উদ্দেশ্য আর্যধর্ম ও দেশজ ধর্মের সমন্বয় সাধন করা। এটি করতে গিয়ে ব্রাহ্মণ্য সমাজ তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য একদিকে যেমন নানা কল্পকাহিনীর আশ্রয় নেয়, পুরোনো কাহিনীগুলোকে নিজের মত করে লিখে, তেমনি তাদেরকে অনেক বড় বড় ছাড়ও দিতে হয়। ভূমিপুত্রদের দেবতা (শিব) ও শিব পক্ষের দেবীদেরকে সম্মানের সাথে স্থান করে দিতে হয় ব্রাহ্মণ্যধর্মে। যজ্ঞের বদলে তীর্থের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। পাশাপাশি অবশ্য স্থানীয়দের কাছে অগ্রহণযোগ্য আর্য- দেবতাদের স্থলে তৈরি করা হয় নতুন নতুন আর্যদেবতা। এর জন্য বৌদ্ধদের ‘অবতারবাদ’ তত্ত্ব গ্রহণ করা হয়। এর মাধ্যমে তৈরি নতুন দেবতাদের মধ্যে রাম ও কৃষ্ণ অন্যতম। বলা হয় এরা বিষ্ণুর অবতার। এদিকে ভগবান বৌদ্ধকেও হিন্দুর অবতার হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এভাবেই কথিত পৌরাণিক হিন্দুধর্মের সূত্রপাত করা হয়।

এরপর অনেকদিন গত হয়েছে। বিদেশি শাসকরা এসেছে এদেশে। এসেছে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম। সবার সাথে হিন্দুকে করতে হয়েছে বোঝাপড়া। বিশেষ করে এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের বিশ্বাসের সাথেই শেষ পর্যন্ত করতে হয়েছে বোঝাপড়া। এ বোঝাপড়ায় বা বিবর্তন প্রক্রিয়ায় লোকায়ত সংস্কৃতি, দেব-দেবী, আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বন, বিশ্বাস, সংস্কার ইত্যাদিই কাজ করছে প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে।

লক্ষণীয় বিবর্তন প্রক্রিয়ায় বেদ নির্বাসিত হয় নি। বস্তুত কোনও কিছুই বর্জিত হয়নি। বেদ, রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা সবই অটুট রয়েছে। শুধু এদের সম্বন্ধে লোকের ধারণা ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। যেমন বেদ। বেদ এককালে প্রচলিত ছিল আর্যদের ধর্মগ্রন্থ হিসেবে। আজ বলা হচ্ছে এটি ভারতের প্রাচীনতম কাব্যগ্রন্থ যার মধ্যে বৈদিক সাহিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। রামায়ণ ও মহাভারত গৃহীত হয়েছে মহাকাব্য হিসেবে, ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়। তবে একথাও ঠিক অনেক হিন্দুর কাছে এসব গ্রন্থ আজও ধর্মগ্রন্থ, যদিও সিংহভাগ হিন্দু এ সম্বন্ধে আদৌ ভাবিত নয়। দৈনন্দিন পূজা-অর্চনা, আচার-অনুষ্ঠান, লোকসংস্কৃতি নিয়েই সিংহভাগ হিন্দু নিশ্চিন্ত।

দেখা যাচ্ছে একদিকে কিছু হিন্দু যখন বেদকে দেখছে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে তখন বেশির ভাগ হিন্দু এর প্রতি উদাসীন। অন্যদিকে যারা বেদের প্রতি আকর্ষিত তাদেরকে দেখা যাচ্ছে প্রায় সব উপলক্ষেই বেদের আশ্রয় নিতে। এমন কি ইদানিং দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে ভারতীয় টিমের জয়লাভের আশায়ও বেদপাঠ হচ্ছে। সংঘটিত হচ্ছে যজ্ঞ। ভারতীয় মিডিয়া এসব অনুষ্ঠান ফলাও করে প্রচার করছে। এমতাবস্থায় দেখা যাক বেদ কী, কী তাতে আছে, কিসে আকর্ষিত হচ্ছে শিক্ষিত হিন্দুর একটি অংশ, কেনই বা বেশির ভাগ হিন্দু বেদ সম্পর্কে উদাসীন। উল্লেখ্য নিচের বেদ পরিচিতির জন্য প্রধানত নির্ভর করা হয়েছে কলকাতার হরফ প্রকাশনীর প্রকাশিত চারটি বেদের বাংলা অনুবাদের ওপর।

১। বেদের রচনাকাল: চারটি বেদের মধ্যে ঋগ্বেদই প্রাচীনতম। ড. সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতে এই প্রাচীনতম বেদটির রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৯০০। অর্থাৎ ২৯০০ থেকে ৩২০০ বছর আগের ঘটনা। এদিকে দ্যা নিউ এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার (ভলিউম-২০, পৃষ্ঠা ২৮৯) তথ্যে দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন বেদ রচিত হয় ৩৫০০ বছর আগে। অনেকের মতে সিন্ধু সভ্যতার পতনের প্রেক্ষাপটে আর্য উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পর বেদের রচনা শুরু এবং তা চলে কয়েক শতাব্দী ধরে।

২. বেদের রচয়িতাঃ বেদের শ্লোকগুলো কে রচনা করেছেন এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এগুলো নানা মুনি-ঋষির রচনা হিসেবে প্রচলিত। বেদের সংকলন করেছেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। অর্থাৎ ব্যাস বা ব্যাসদেব। তিনি কালো রঙের বলে কৃষ্ণ এবং দ্বীপে জন্ম গ্রহণ করেন বলে দ্বৈপায়ন এবং বেদ সংকলন করেন বলে বেদব্যাস বলে পরিচিত। পরবর্তী অধ্যায়ে মহাভারত আলোচনাকালে ব্যাসদেব কে, কীভাবে তার জন্ম ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।

৩. বেদ ৪টি: বেদ সর্বমোট চারটি, যথা: ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন বেদ হচ্ছে ঋগ্বেদ। ঋগ্বেদ ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্যের নিদর্শন।

৪. বেদের ভাষাঃ বেদের ভাষা প্রাচীন সেকেলে সংস্কৃত। শুধু সংস্কৃত বলেই নয়, ভাষা এতই সেকেলে বা দুর্বোধ্য যে পণ্ডিতদের ‘টীকা’ ছাড়া বেদের মর্মোদ্ধার করা কঠিন। টীকাগুলোর মধ্যে সায়নাচার্য্যের টীকাই বহুল প্রচলিত। ‘টীকা’ দরকার আরও একটি কারণে। বৈদিক যুগে একই শব্দের বিভিন্ন অর্থ হতো। উদাহরণস্বরূপ ‘গো’ শব্দের অর্থ হতো জল, রশ্মি, বাক্য, পৃথিবী ও গরু ইত্যাদি। একইভাবে অশ্ব = রশ্মি, ঘোড়া ইত্যাদি। জলের নাম ছিল একশো একটি। একইভাবে পৃথিবী, রশ্মি, দিক, রাত্রি, ঊষা, দিন, মেঘ, বাক, নদী, কর্ম, মনুষ্য, অন্ন, বল ও যজ্ঞের বহু নাম ছিল। এসব শব্দের বর্তমান অর্থ সে যুগের অর্থের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই বেমানান। এমতাবস্থায় টীকাই ভরসা। কিন্তু মুষ্কিল হচ্ছে টীকায় অবধারিতভাবে টীকাকারের নিজস্ব মত থাকে। ফলে প্রকৃত অর্থ অনেক সময় চাপা পড়ে যায়।

৫. বৈদিক সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থঃ ঋগ্বেদ হচ্ছে বৈদিক সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থ। অর্থাৎ ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্য। এতে তখনকার মানুষ, বিশেষত আর্যদের সমাজ ও ধর্মভাবনার একটি পরিচয় পাওয়া যায়।

৬. বেদের স্তোত্রগুলোর কেন্দ্রবিন্দু: বেদের স্তোত্রগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দেবতা ও যজ্ঞ। অর্থাৎ দেবতাদের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যে স্তোত্র রচিত হতো তা নিয়েই বেদের জন্ম।

৭. বৈদিক যুগের উপাসনা রীতি: বৈদিক যুগে ঋষিরা যেখানেই শক্তি বা সৌন্দর্য্যের আভাস পেয়েছেন তার ওপরই দেবত্ব আরোপ করেছেন এবং তার জন্য স্তোত্র রচনা করেছেন। স্তোত্রের নামই ‘সূক্ত’। দেবতাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ‘অগ্নি’। তিনি পুরোহিতও বটে, কারণ অগ্নিতেই অন্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়া হতো। অন্য দেবতারা হচ্ছেন বায়ু, জল, সূর্য, ঊষা, পৃথিবী, আকাশ প্রভৃতি।

৮. বেদের সাহিত্য: মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ নিয়ে বৈদিক সাহিত্য। একে দুটো ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা: জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড। কর্মকাণ্ড মানেই যজ্ঞসম্পর্কিত বিষয়াবলী। এতে পড়ে মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ। উপনিষদ হচ্ছে জ্ঞানকাণ্ড। আরণ্যকে কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড উভয়েই আছে।

৯. বেদের কাঠামো: প্রত্যেকটি বেদ কয়েকটি ‘মণ্ডলে’ (অধ্যায়) বিভক্ত। মণ্ডলের অধীনে আছে বেশ কিছু ‘সূক্ত’। প্রত্যেকটি সূক্তে আছে বেশ কিছু ঋক।

১০. বেদে মোট মন্ত্ৰ (ঋকের) সংখ্যা: চারটি বেদে সর্বমোট ২০,৩৭৯টি ঋক আছে। নিচে বেদের নাম ও ঋক সংখ্যা দেওয়া হল:

বেদ – ঋকসংখ্যা

ঋগ্বেদ – ১০,৫৫২

যজুর্বেদ – ১,৯৭৫

সামবেদ – ১,৮৭৫

অথর্ববেদ – ৫,৯৭৭

মোট – ২০,৩৭৯

এখানে উল্লেখ্য, ঋগ্বেদের কিছু মন্ত্র (ঋক) যজুর্বেদ ও অথর্ববেদে আছে। আবার সামবেদের প্রায় মন্ত্রই (ঋক) ঋগ্বেদ থেকে নেওয়া। বলা বাহুল্য সকল বেদেরই একাধিক শাখা ছিল যা আজ বিলুপ্ত।

১১. বেদের সার সংকলন: সামবেদই বেদের সারসংকলন। এটি গীত প্ৰধান।

১২. যজ্ঞের অর্থ ও যজ্ঞানুষ্ঠান : দেবতার উদ্দেশ্যে দ্রব্য ত্যাগই যজ্ঞ। যজ্ঞে যে সমস্ত দ্রব্যসামগ্রী লাগে সেগুলো হচ্ছে: কাঠ, আহুতির জন্য ঘি ও সোমরস। যিনি এ সমস্ত দ্রব্য ত্যাগ করেন অথবা যার কল্যাণে যজ্ঞ করা হয় তিনি হচ্ছেন যজমান। যারা যজ্ঞ করতেন তাঁরা হচ্ছে ঋত্বিক।

১৩. বেদবিদ্যার প্রকার ভেদঃ বেদবিদ্যা দুই প্রকার যথাঃ পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা। পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা কি?

পরাবিদ্যা : যে বিদ্যার চেয়ে শ্রেষ্ঠবিদ্যা আর কিছুই নেই, যে বিদ্যার সন্ধান পেলে আর কিছুই জানার বাকি থাকে না বলে দাবি করা হয় তাই পরাবিদ্যা। পরাবিদ্যা হচ্ছে বিশ্বজ্ঞান। বিশ্বজ্ঞান স্বেচ্ছায় জাত হয়েছেন। ইনি স্বেচ্ছায় কর্ম করেন। তিনি আত্মজন্মা ও আত্মকর্মা। যিনি অদৃশ্য, অগ্রাহ্য (যাকে কর্ম-ইন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ করা যায় না), যার মূল জানা নেই, যিনি নিরাকার (অরূপ), যিনি অচক্ষু (সবদেখেও চক্ষুহীন), যিনি অশোত্র (শুনেও কর্ণহীন), যিনি নিত্য, সর্বগত ও অব্যয় তিনিই ব্রহ্ম। পরাবিদ্যা দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায়। বেদের অঙ্গীভূত কিছু রচনা অর্থাৎ উপনিষদ হচ্ছে পরাবিদ্যা। বেদের প্রান্তে অবস্থিত বলে একে উপনিষদ বলা হয়। এটিই পরবর্তীকালে বেদান্ত হিসেবে পরিচিত হয়। বেদান্ত শংকরাচার্য কর্তৃক প্রবর্তিত। এটি এখন তান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশনের প্রচারের বিষয়।

অপরাবিদ্যা : যে বিদ্যার ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে, যা ইহলৌকিক সুখের সন্ধান দেয় এবং পারলৌকিক মুক্তির উপায় বাতলে দেয় সেই বিদ্যা অপরাবিদ্যা। ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ এগুলো অপরাবিদ্যা। মোট এই ১০টি অপরাবিদ্যার মধ্যে চারটি বেদ বাদে বাকি ছ’টি বেদাঙ্গ বলেও পরিচিত অর্থাৎ অপরাবিদ্যা দুইভাগে বিভক্ত যথা: বেদ ও বেদাঙ্গ।

১৪. বেদের বিভাগ: প্রতিটি বেদ মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ নিয়ে গঠিত। ব্রাহ্মণের দুইভাগ, যথা: আরণ্যক ও উপনিষদ।

ঋগ্বেদ

আগেই বলা হয়েছে বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ প্রাচীনতম। এতে ধর্মের কথার চেয়ে অন্যান্য প্রসঙ্গই বেশি। বস্তুত ৯০ শতাংশ সূক্ত বা শ্লোকেই বিভিন্ন দেবতার বর্ণনা ও প্রশস্তি লিপিবদ্ধ আছে। এতে অবশ্য কিছু দর্শনমূলক শ্লোক আছে। বাকি শ্লোক বিবিধ বিষয়ের ওপর রচিত। নিচে ঋগ্বেদের একটি সাধারণ পরিচয় তুলে ধরা হল :

১. ঋগ্বেদের কাঠামোঃ এই বেদে ১,০২৮ টি সূক্তের অধীনে সর্বমোট ১০,৫৫২টি ঋক আছে।

মণ্ডলসূক্তঋক
প্রথম১৯১২,০০৬
দ্বিতীয়৪৩৪২৯
তৃতীয়৬২৬১৭
চতুর্থ৫৮৫৮৯
পঞ্চম৮৭৭২৭
ষষ্ঠ৭৫৭৬৫
সপ্তম১০৪৮৪১
অষ্টম১০৩১,৭১৬
নবম১১৪১,১০৮
দশম১৯১১,৭৫৪
মোট১,০২৮১০,৫৫২

২. রচনাকাল : ঋকগুলোর রচনাকাজ শুরু হয় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীতে এবং তা চলে কয়েক শতাব্দী যাবত। অনুমান করা হয় সিন্ধু সভ্যতা পতনের পর বেদের ঋকগুলোর রচনাকাজ শুরু হয়।

৩. ঋগ্বেদের ধর্ম : ঋগ্বেদের ধর্ম ছিল এক কথায় সূর্যোপাসনা। বৈদিক আর্যরা যে ধর্ম নিয়ে ভারতবর্ষে আসে তাতে সূর্যের স্তুতি আছে।

৪. বেদের গঠনবিন্যাস : গঠনবিন্যাস অনুযায়ী ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য ঋগ্বেদকে তিনটি অংশে ভাগ করেছেন। এই তিনটি অংশ হচ্ছে নিম্নরূপ :

ক. দেবতার রূপবর্ণনা : এর দুটো ভাগ। প্রথম ভাগে পড়ে দেবতার আকৃতি, বেশবাস, অলংকার, অস্ত্রশস্ত্র, রথ ও বাহনের বর্ণনা। দ্বিতীয় ভাগে পড়ে দেবতার শৌর্য, কীর্তি, পূর্বপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহের উল্লেখ।

খ. আপ্যায়ন : এগুলো দেবতাকে কী নৈবেদ্য দিয়ে তুষ্ট করা হচ্ছে তার বিবরণ অর্থাৎ ভোজ্য, পানীয় ও স্তোত্রের বিবরণ। নতুন স্তব রচনার প্রতিশ্রুতি ও প্রাচীন স্তবগানের উল্লেখ।

গ. প্রার্থনা : ঋগ্বেদে প্রার্থিত বস্তু এক। দেবতাদের কাছে চাওয়া হচ্ছে বিজয়। আরও চাওয়া হচ্ছে শত্রুবিনাশ, পশুধন, স্বর্ণ, স্বাস্থ্য, শস্য, সন্তান, রোগমুক্তি ও পরমায়ু।

বিষয়কে ভিত্তি করে ঋগ্বেদের সূক্তগুলোকে মোটামুটি নিম্নলিখিত তিনটি শ্রেণিতেও ভাগ করা যায়। যথা:

প্রথম শ্রেণি : বিশেষ দেবতা বা একাধিক দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও প্রার্থনা জ্ঞাপন।

দ্বিতীয় শ্রেণি : দার্শনিক বিষয়।

তৃতীয় শ্রেণি : মিশ্র জাতীয় (সূক্তগুলোর বিষয়বস্তু দেবতাও নয়, দর্শনও নয়)।

৫. ঋগ্বেদের সূক্তগুলোর বিষয়বস্তু: বিষয়বস্তু অনুযায়ী ঋগ্বেদের শ্রেণি বিভাগটি ওপরে দেখানো হয়েছে। হাজার হাজার শ্লোকের উদ্ধৃতি এখানে দেওয়া সম্ভব নয় বলে নিচে কিছু কিছু ঋকের উদাহরণ দিয়ে ঋগ্বেদের মূল বিষয়বস্তু সম্বন্ধে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হল :

ক. দেবতার উদ্দেশ্যেরচিত সূক্ত: ঋগ্বেদে এ ধরনের সূক্তের সংখ্যা যে ৯০ শতাংশেরও বেশি তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এসব সূক্ত পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় ইন্দ্র ও অগ্নিই বৈদিক দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। ইন্দ্রের ওপর আছে ২৫০ এর বেশি স্তব। তারপর অগ্নির স্থান। তাঁর উদ্দেশ্যে রচিত স্তবের সংখ্যা ২০০টি। তারপর সোম ও অন্যান্য দেবতার স্থান। দেবতাদের উদ্দেশে রচিত সূক্ত বা স্তবগুলোতে দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে নৈবেদ্য। তারপর তাদের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে নানা বস্তু। ঋষিরা দেবতাদের কাছে ধন কামনা করছেন, গরু কামনা করছেন। শত্রুকে হত্যা করা, ধ্বংস করা ও তাদের ধনসম্পত্তি ঋষিদেরকে দেওয়ার জন্য দেবতাদের প্রতি আকুল আবেদন জানানো হয়েছে। স্বর্ণ, স্বাস্থ্য, শস্য, সন্তান, পরমায়ু ও রোগমুক্তি ইত্যাদি চাওয়া হয়েছে দেবতাদের কাছে।

ঋকগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় ঋগ্বেদের ঋষিরা অত্যন্ত বৈষয়িক ছিলেন। আজকের দিনের হিন্দুর মতো সংসার ত্যাগী ভাব, বৈরাগ্যভাব, ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’ ইত্যাদি ভাব ঋগ্বেদের ঋষিদের ছিল না। প্রতিপক্ষ বা শত্রুকে অর্থাৎ প্রাগার্য-জনগোষ্ঠীকে ঘায়েল ও ধ্বংস করার কামনা তো পাতায় পাতায়।

খ. দার্শনিক তত্ত্বমূলক সূক্ত: আগেই উল্লেখ করা হয়েছে দার্শনিক তত্ত্বমূলক সূক্তগুলো স্থান পেয়েছে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে। অবশিষ্ট অন্যান্য ৯টি মণ্ডলেও কিছু কিছু দার্শনিক তত্ত্ব আছে। যেমন প্রথম মণ্ডলের ১৬৪ সংখ্যক সূক্ত। এই সূক্তেই বিখ্যাত বাণীটি পাওয়া যায়: ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি।’ এদিকে অষ্টম মণ্ডলের ৫৮ নং সূক্তে পাই: ‘একং বা ইদং বিবভূর সর্বম্’। এবারে আসা যাক দশম মণ্ডলের ১২৯ নং সূক্তে যা নাসদীয় সূক্ত নামে খ্যাত। এখানে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে সৃষ্টি কোথা হতে এল। বলা হয়েছে সৃষ্টির পূর্বে, যা আছে তাও ছিল না, যা নেই, তাও ছিল না। তারপর তপস্যার প্রভাবে একটি সত্তার আবির্ভাব হল। তিনি বুদ্ধিযুক্ত। তার মধ্যে কামনা উদ্ভব হল। সেই কামনা হতেই সৃষ্টি উদ্ভূত হল। অর্থাৎ একটি বুদ্ধি শক্তি মণ্ডিত ইচ্ছাশক্তি বিশ্বসৃষ্টির মূলে।

১০ম মণ্ডলের ১২১ নং সূক্তের দেবতা প্রজাপতি। এতে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে কোন দেবতাকে হবিদ্বারা পূজা করতে হবে। উত্তর দেওয়া হয়েছে যাকে হবিদ্বারা প্রীত করতে হবে তিনি হলেন প্রজাপতি। কারণ তিনি জাতমাত্রই সর্বভূতের অদ্বিতীয় অধীশ্বর হন, তার আজ্ঞা অন্য দেবতারা পালন করে, সসাগরা ধরা তারই সৃষ্টি, তিনি ব্যতীত আর কেউই সকল বস্তুকে আয়ত্ত রাখতে পারে নি। এখানে একেশ্বরবাদের বীজ পাওয়া যায় বলে কেউ কেউ মনে করেন।

১০ম মণ্ডলের ১২৫ নং সূক্তের দেবতা বাক্। আত্মাকেও এর দেবতা বলা হয়েছে। এই দেবতা নিজের বিষয় নিজেই বলেছেন। তিনি বলেছেন তিনি বিস্তর প্রাণীর মধ্যে আবিষ্ট আছেন; তিনি দ্যূলোকে ও ভূলোকে আবিষ্ট আছেন; তিনি সকল ভুবনে বিস্তারিত হন। এখানে সর্বেশ্বরবাদের বীজ পাওয়া যায় বলে কেউ কেউ মনে করেন যা পরবর্তীকালে উপনিষদে ব্রহ্মবাদে পরিণতি লাভ করে।

১০ম মণ্ডলের ৯০ নং সূক্তে এক বিরাট পুরুষের কল্পনা করা হয়েছে। তাঁর সহস্র মাথা এবং সহস্র চরণ। পৃথিবীকে ব্যাপ্ত করেও তিনি তাকে অতিক্রম করেন; এত বিরাট তিনি। তাঁরই দেহ খণ্ডিত হয়ে বিভিন্ন বস্তু ও প্রাণির রূপ নিল। তাঁর মুখ হতে ব্রাহ্মণ হল, বাহু হতে রাজন্য হল, ঊরু হতে বৈশ্য হল, চরণ হতে শূদ্র হল। তাঁর মন হতে চন্দ্র হল, চক্ষু হতে সূর্য হল, মুখ হতে ইন্দ্র ও অগ্নি, প্রাণ হতে বায়ু হল। তাঁর নাভি হতে আকাশ হল, মস্তক হতে স্বৰ্গ, চরণ হতে ভূমি, কর্ণ হতে দিক ও ভবন সকল সৃষ্টি হল। অর্থাৎ সংক্ষেপে বলা যায় তাঁর দেহই খণ্ডিত হয়ে বিশ্বের নানা বস্তু ও জীবে পরিণত হল। এখানে যা বীজ আকারে আছে তাই উপনিষদের ব্রহ্মবাদে পরিণত রূপ পায় বলে কেউ কেউ মনে করেন।

গ. মিশ্র জাতীয় সূক্ত : এই শ্রেণির সূক্তের বিষয়বস্তু দেবতাও নয়, দার্শনিক চিন্তাও নয়। প্ৰতি সূক্তেই দেবতার উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে একাধিক দেবতার বিষয় উল্লেখ আছে সেখানে তাদের সকলেরই নাম উল্লিখিত হয়েছে। যেখানে বহু দেবতার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে বিশ্বদেবতাগণকে দেবতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই দেবতার অর্থ দেবতা নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেবতাকে বিষয়বস্তুর সমার্থবোধক শব্দ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১ম মণ্ডলের ১৬২ নং সূক্তে অশ্বমেধ যজ্ঞের বর্ণনা দেওয়া আছে। এর দেবতা হিসাবে অশ্বের উল্লেখ করা হয়েছে। একই মণ্ডলের ১৭৯ নং সূক্তে লোপামুদ্রা এবং অগস্ত্যর মধ্যে রতির বিষয়ে কথোপকথন আছে। এখানে রতি দেবতা বলে উল্লিখিত হয়েছে। ১০ নং মণ্ডলের ৯৫ নং সূক্তে উর্বশী ও পুরুরবার কথোপকথন আছে। এখানে উর্বশী ও পুরুরবা দেবতা বলে উলিখিত হয়েছে। ১০ম মণ্ডলের ১৪৫ নং সূক্তে একটি ভেষজের উল্লেখ আছে যা সপত্নীকে পরাজিত করতে সাহায্য করে। এখানে সপত্নীবাধনই দেবতা। ১০ম মণ্ডলের ১৭৩ নং সূক্তে রাজার বিষয়ে আলোচনা আছে। এখানে রাজাই দেবতা বলে উল্লিখিত হয়েছে। ৭ নং মণ্ডলের ১০৩ নং সূক্তে ব্যাঙেদের উল বর্ণনা আছে। এর সঙ্গে ধর্মের কোনোও সম্পর্ক নেই, নিতান্তই প্রাকৃতিক ঘটনার বর্ণনা। ১০ম মণ্ডলের ১৮নং সূক্তে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বর্ণনা আছে। ১০ম মণ্ডলের ৮৫ নং সূক্তে বিবাহের বিষয়ের বর্ণনা আছে। এদিকে ১০১৭ নং সূক্তে দানের সুখ্যাতি করা হয়েছে এবং ১৪৬ নং সূক্তে বনানীর বর্ণনা আছে। এগুলির সঙ্গে ধর্মের কোনো সংযোগ নেই।

ঋগ্বেদে জাদুবিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত অল্পসংখ্যক মন্ত্র পাওয়া যায়। কোথাও পাখীর ডাক মঙ্গল বিধান করে, কোথাও কোন রোগ কোন রাক্ষস কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে এই ধরনের বিশ্বাসকে ভিত্তি করে মন্ত্র রচিত হয়েছে। এগুলোকে জাদুবিদ্যা সম্পর্কিত সূক্ত বলা যায়। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১ম মণ্ডলের ১৯১ নং সূক্তে নানা জীবজন্তুর বিষক্রিয়া নষ্ট করবার উপায় চিন্তা করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মধুবিদ্যা আয়ত্ত করলে এই বিষ নাশ করা যায়। এই মধুবিদ্যাই জাদুবিদ্যা বলে বিশ্বাস করা হয়।

২য় মণ্ডলের ৪২ ও ৪৩ সূক্তে শকুনির ডাক যে মঙ্গল বিধান করে এই ধরনের একটি বিশ্বাস লক্ষিত হয়। তাই শকুনির সান্নিধ্য কামনা করা হয়েছে এবং তাকে ডাকতে বলা হয়েছে। এখানে শকুনির ডাকের জাদুশক্তির ইঙ্গিত আছে।

১০ম মণ্ডলের ১৬২ নং সূক্তে বিশ্বাস করা হয়েছে যে গর্ভনাশের কারণ হল একটি বিশেষ রাক্ষস। এই সূক্তটিতে সে রাক্ষসকে বিদূরিত করার জন্য মন্ত্র পাওয়া যায়। এও জাদুবিদ্যা প্রয়োগের একটি উদাহরণ।

১০ম মণ্ডলের ১৬৩ নং সূক্তটি দুইভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত দেখা যায় তখনকার দিনে মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হতো। কারণ এই সূক্তটিতে যক্ষ্মারোগ নাশের মন্ত্র আছে। দ্বিতীয়ত তাতে মন্ত্র উচ্চারণ করে রোগ দূর করবার একটি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এও জাদুবিদ্যার নিদর্শন।

৬. ঋগ্বেদের দেবতা: ঋগ্বেদের দেবতার সংখ্যা নিয়ে মতানৈক্য দেখা যায়। ব্যাপক অর্থে দেবতা শব্দের ব্যবহার অর্থাৎ প্রস্তর খণ্ড, ধনুক, মুণ্ডক ইত্যাদিকে দেবতা হিসেবে আখ্যায়িত করার কারণেই এই মতানৈক্য। ঋগ্বেদ সংহিতার একাধিক স্থানে দেবতাদের সংখ্যা সম্বন্ধে উক্তি আছে। দুটি ঋকে তাঁদের সংখ্যা ৩৩৯ জন বলে উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু ঋগ্বেদের সূক্তগুলিতে যাদের দেবতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের সকলকে ধরলেও এত দেবতা পাওয়া যায় না। এদিকে ঋগ্বেদের আর এক জায়গায় ৩৩ জন দেবতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতেই বোধ হয় ‘শতপথ ব্রাহ্মণে’ ৩৩টি দেবতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত এই ৩৩ কেই হিন্দুরা ৩৩ কোটিতে উন্নীত করেছে।

সবকিছু বিচার করে মনে হয় ঋগ্বেদের প্রকৃত দেবতা হচ্ছে পৃথিবী বা অন্তরীক্ষ বা দ্যুলোকের এমন সব প্রাকৃতিক বিষয় যাদের মধ্যে শক্তির প্রকাশ দেখে ঋষিরা তাঁদের ওপর দেবত্ব আরোপ করেছেন। ঋগ্বেদের সূক্তগুলো প্রধানত আর্ত মনোভাব নিয়ে রচিত। শত্রু বা রোগ বা বিপদ হতে পরিত্রাণ বা বৈষয়িক সমৃদ্ধি কামনা করেই এই শ্রেণির সূক্তগুলি রচিত। কাজেই যেখানে শক্তির প্রকাশ তার কাছেই প্ৰাৰ্থনা নিবেদিত হয়েছে। অবশ্য অতিরিক্তভাবে তাদের মহিমাও কীর্তিত হয়েছে। এদের উপর ব্যক্তিত্ব আরোপ করে দেবতা বলে কল্পিত হয়েছে। এভাবেই ঋগ্বেদের দেবতা সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই এই লক্ষণগুলো দিয়েই ঋগ্বেদের প্রকৃত দেবতাদের নির্বাচন করা দরকার বলে সবাই মনে করেন।

ওপরের নীতির ভিত্তিতে ঋগ্বেদের সূক্তে বর্ণিত নিম্নোক্ত দেবতাদেরকে প্রকৃত দেবতা বলে স্বীকৃতি দেওয়া যায়:

বেদের দেবতা :

অগ্নি

মরুৎগণ

আদিত্যগণ

মিত্র

বৃহস্পতি

ব্ৰহ্মণস্পতি

রাত্রি

সবিতা

রুদ্র

অদিতি

অশ্বিদ্বয়

ভগ

সোম

বিষ্ণু

অর্জমা

সূর্য

অপগণ

পজর্ন্য

বরুণ

পূষণ

দ্যৌ

যম

ত্বষ্টা

ঊষা

পৃথিবী

সরস্বতী (নদী)

উল্লেখ্য বেদের উপরোক্ত দেবতাদের মধ্যে আজ আর কেউ জনপ্রিয় নয়। কেবলমাত্র বিষ্ণু অবতার তত্ত্বের মাধ্যমে রাম ও কৃষ্ণ রূপে টিকে আছেন। আর যদি রুদ্র দেবতাকে শিব হিসেবে ধরা হয় তাহলে তিনি টিকে আছেন মহাদাপটে।

৭. ঋগ্বেদের কালে সমাজ/ধর্ম/অর্থনীতি ইত্যাদি: ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূক্তে ওই সময়ের সমাজ, ধর্ম ও অর্থনীতি সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যায়। নিচে এর একটা সার সংক্ষেপ দেয়া হল :

ক. আয়ু : ওই সময়ে ঋষিদের পরমায়ু কম-বেশি একশো বছরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

খ. ধনবণ্টন : অন্তত একটি ঋকে ধনবণ্টনে সমতার প্রতি আকুতি লক্ষ করা যায়।

গ. জাতিভেদ : ওই সময়ে জাতিভেদ প্রথা ছিল না। তখন জাতি বলতে দুটো শ্রেণিকে বুঝাত-আর্য ও অন-আর্য (দস্যু)। ‘ক্ষত্রিয়’ অর্থে বলবানকে বুঝাত। আর্যরা অন-আর্যদের সমীহ করে চলত।

ঘ. গো-ধন : বৈদিক যুগের মানুষের কাছে গোধন ছিল গুরুত্বপূর্ণ ধনসম্পদ। সকলেই দুগ্ধবতী গাভীর জন্য প্রার্থনা করত। সবাই গোধন রক্ষায় ব্যস্ত থাকত।

ঙ. ব্যবসা : আর্যদের কেউ কেউ গো ও মেষপালন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল।

চ. সমুদ্রযাত্রা : সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ ছিল না, বরং তার প্রশংসা ছিল।

ছ. কৃষিকাজ: আর্যরা কৃষি কাজে নিযুক্ত ছিল।

জ. পাশা খেলা: এই খেলাটি সমাজে বহুল প্রচলিত ছিল। এর নেশায় আর্যরা সর্বস্ব হারাত। এমনকি স্ত্রী পর্যন্ত হারাত।

ঝ. দত্তক পুত্র: দত্তক পুত্র গ্রহণের প্রথা প্রচলিত ছিল।

ঞ. যক্ষ্মারোগ : ঋগ্বেদে যক্ষ্মারোগের উল্লেখ আছে।

ট. মাংস : খাদ্য হিসেবে আর্যদের মধ্যে তখন গো, মহিষ এবং অশ্বের মাংস জনপ্রিয় ছিল।

ঠ. স্ত্রীজাতি : স্ত্রী জাতির সম্মান ছিল। স্ত্রীলোক পুরুষের সঙ্গে একত্রে বসে যজ্ঞে অংশগ্রহণ করত।

ড. বহুবিবাহ : সমাজে বহু বিবাহ প্রচলিত ছিল।

ঢ. একেশ্বর চিন্তা : আর্যরা প্রত্যেকটি বিস্ময়কর ঘটনা ও কার্যে একটি করে দেবতা কল্পনা করে নিয়েছিল। পরে তারা উপলব্ধি করেন সবকিছুর মূলে একই শক্তি বিদ্যমান। তখন তারা বললেন এক ছাড়া দ্বিতীয় নেই।

যজুর্বেদ

১. যজুর্বেদ পরিচিতি :এই বেদটি দু’ভাগে বিভক্ত, যথা: শুক্ল ও কৃষ্ণ যজুর্বেদ। কৃষ্ণ অংশের আরেক নাম তৈত্তরীয় সংহিতা’। এ নামের পেছনে মজার একটি ঘটনা আছে। ঘটনাটি এইরূপ : গুরু বৈশম্পায়ণ ও শিষ্য যাজ্ঞবল্ক্য। বৈশম্পায়ণ ব্রহ্ম হত্যার অপরাধে পাপী। তিনি প্রায়শ্চিত্তের জন্য শিষ্যদেরকে কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য নির্দেশ দেন। তখন যাজ্ঞবল্ক্য একাই কৃচ্ছ্র সাধন করতে চাইলেন। বৈশম্পায়ন একে অসহ্য অহমিকা মনে করে ক্রুদ্ধ হন এবং যাজ্ঞবল্ক্যকে অধীত বেদ প্রত্যর্পণ করতে বলেন। আদেশ মোতাবেক যাজ্ঞবল্ক্য অধীত বেদ বমন করেন। তখন বৈশম্পায়ণের অন্যান্য শিষ্যরা তিত্তির পক্ষীর রূপ ধারণ করে তা গ্রহণ করেন। এজন্য এই বেদ ‘তৈত্তরীয়’ বা কৃষ্ণ- যজুর্বেদ বলে খ্যাত হয়।

এদিকে যাজ্ঞবল্ক্য নির্মল বেদবিদ্যা লাভের জন্য সূর্যদেবের আরাধনা করেন। তখন সূর্যদেব বাজী রূপ (বাজসনি যাজ্ঞবন্ধ্যের পিতার নাম) ধারণ করে যাজ্ঞবল্ক্যকে বেদবিদ্যা প্রদান করেন। এই বেদ শুক্ল যজুর্বেদ বা বাজসনেয়িসংহিতা নামে পরিচিত হয়।

২. যজুর্বেদের ভাষা: যজুর্বেদের মন্ত্রগুলোর অধিকাংশই গদ্যে রচিত।

৩. যাজ্ঞবল্ক্য : তিনি বিশ্বামিত্রের বংশধর। যাজ্ঞবন্ধ্যের পিতা নানা নামে পরিচিত, যথা: চারায়ণ, দেবরাত, ব্রহ্মরাত, যজ্ঞবল্ক, বাজসনি ইত্যাদি। তাঁকে বৈদিক যুগের শেষার্ধের যুগমানব হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ইহ জগতকে মায়া বলে উড়িয়ে দেননি।

৪. শুক্ল ও কৃষ্ণ যজুর্বেদের আসল মর্মার্থ: কাহিনীতে বর্ণিত ঘটনা যাই হোক না কেন গবেষকরা বলছেন প্রকৃতপক্ষে শুক্ল যজুর্বেদ শুদ্ধ মন্ত্রমাত্রের সংকলন। আর কৃষ্ণ যজুর্বেদে মন্ত্রের সঙ্গে অঙ্কুর-রূপে ‘ব্রাহ্মণ’ সাহিত্যধর্মী প্রচুর গদ্যনির্দেশের মিশ্রণ আছে। তাই একে কৃষ্ণ যজুর্বেদ বলা হয়।

৫. শুক্ল যজুর্বেদের ভেতরে আছে দুটো বিশিষ্ট রচনা: শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার শেষাংশে রয়েছে ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’ এবং তারও শেষাংশে আছে ‘বৃহদারণ্যকোপনিষদ’। এর সবটার রচয়িতা যাজ্ঞবল্ক্য। উল্লেখ্য ‘ব্রাহ্মণ’ সাহিত্যের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান হচ্ছে ‘শতপথ’ ব্রাহ্মণের। আবার আরণ্যক ও উপনিষদের মধ্যে ‘বৃহদারণ্যকোপনিষদ’ একটি তাৎপর্য্যপূর্ণ রচনা।

৬. শতপথ ব্রাহ্মণে (শুক্ল যজুর্বেদে) আছে: ধেনু বা অনডুহ (ষাড়) মাংস ভক্ষণ করলে পতিত হতে হয়। আবার আরেক জায়গায় যাজ্ঞবল্ক্যই বলছেন: আমি কিন্তু (গোমাংস) ভক্ষণ করব যদি সেটা সুসিদ্ধ (সুস্বাদু) হয়। ‘বৃহদারণ্যকোপনিষদে’ও (শুক্ল যজুর্বেদ) বলদের বা বৃষভের মাংসযুক্ত অন্ন ভোজন করাবার উপদেশ আছে। ‘বৃহদারণ্য- কোপনিষদে’ আত্মা সম্বন্ধে বলা হয়েছে ‘প্রাণ দ্বারা যে প্রাণিত হচ্ছে সেই তোমার আত্মা। সবকিছুরই সে অভ্যন্তরবর্তী।’ ‘পুত্রের চেয়ে প্রিয় বিত্তের চেয়ে প্রিয়, অন্যসব কিছুরই অন্তরতর যা তাই আত্মা’।

৭. যাজ্ঞবন্ধের অবদান: যাজ্ঞবল্ক্য গুরুর বিদ্যা প্রত্যর্পণ করে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি গোমাংস ভক্ষণে বাধানিষেধ মানতে চান নি, ক্ষত্রিয়কে ব্রহ্মবিদ্যার শ্রেষ্ঠ আচার্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, নারীকে ব্রহ্মবিদ্যা দান করেছেন, ক্ষুধা ও মৃত্যুকে পরম শত্রু বলে অভিহিত করেছেন।

৮. আর্য ও প্রাগার্য জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ: যজুর্বেদের যুগেই আর্যজনগোষ্ঠী ও প্রাগার্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংমিশ্রণের স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। এর অর্থ এই নয় যে ঋগ্বেদের আমলে সংমিশ্রণ ছিল না। বস্তুত দুই জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ঋগ্বেদের আমলেই শুরু হয় এবং তা স্পষ্টরূপ ধারণ করে যজুর্বেদের আমলে।

সামবেদ

১. সামবেদের পরিচয়: সামবেদ বিভিন্ন ঋষি কর্তৃক রচিত মন্ত্রের সংকলন। তাই একে ‘সামবেদ-সংহিতা’ বলা হয়। এটি একটি সঙ্গীত গ্রন্থ। বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে এই গানগুলো গাওয়া হতো। ‘সামবেদের’ ৭৫টি মন্ত্র বাদ দিলে বাকি সব মন্ত্র ঋগ্বেদ থেকে নেওয়া।

২. সার সংকলন : সামবেদই বেদের সার সংকলন হিসেবে বিবেচিত। সামবেদের গান সূর্যকে ঘিরে হয়। ওম উচ্চারণ করে সামবেদের গান গাওয়া হয়।

‘সাম’ এর মধ্যস্থিত ‘সা’ এর অর্থ প্রকৃতি, অক্ষয়া ঐশীশক্তি এবং ‘অম’ এর অর্থ আত্মা। আত্মা সূর্যমণ্ডলে আসীন। অর্থাৎ সূর্যরূপ জগতের আত্মার সঙ্গে যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাই ‘সাম’। আবার যেহেতু ঋকমন্ত্রের দ্বারা সামগান করা হয় সেহেতু ঋকই ‘সাম’ এবং ‘সাম’ই সূর্য।

‘ওম’ হচ্ছে: ‘অ + উ + ম’ এই তিন অক্ষরের সমষ্টি। অ = পৃথিবী, উ = অন্তরিক্ষ এবং ম = দ্যুলোক। ওম্ শব্দ দ্বারা পূর্ণ ব্রহ্মকে বোঝানো হয়। ‘ওম্’ দ্বারা তিনলোকের অতিরিক্ত যে জগৎ যা মানুষের বাক্য ও মনের অগোচর তাকেও বোঝায়। যেহেতু সূর্যের মধ্যে পরমাত্মার প্রকাশ তাই ওম্ দ্বারা জগতের আত্মা সূর্যের মধ্যে অধিষ্ঠানকেও বোঝায়।

৩. দুইভাগে বিভক্ত : সামবেদ দুইভাগে বিভক্ত, যথা : আর্চিক ও গান। যে গ্রন্থ কেবল সঙ্গীতের সংকলন তার নাম ‘আর্চিক’। যে গ্রন্থে সঙ্গীতের স্বরলিপি আছে তার নাম ‘গান’। আর্চিক সঙ্গীতের দুইভাগ যথা: পূর্বার্চিক ও উত্তরার্চিক।

৪. মন্ত্র সাজানো পদ্ধতি: পূর্বার্চিকের মন্ত্রগুলি দেবতা ও ছন্দ অনুসারে সাজানো হয়েছে। ফলে প্রথমেই পাওয়া যায় অগ্নিস্মৃতি, তারপর ইন্দ্র ও পরমাণ সোম স্ত্ততি। আরণ্যক খণ্ডের পর আছে মহানাম্নী আর্চিক। এতে আছে ত্রিলোকের আত্মা ইন্দ্রের স্তুতি।

৫. সামের আশ্রয় : সামের আশ্রয় ‘স্বর’, স্বরের আশ্রয় ‘প্রাণ’, প্রাণের আশ্রয় ‘অন্ন’, ‘অন্নের’ আশ্রয় ‘জল’, ‘জলের’ আশ্রয় পুনরায় ‘স্বর’ বা আদিত্য সূর্য।

অথর্ববেদ

১. অথর্ববেদের নাম ইতিহাস: অথর্ববেদের নাম অথর্ব (অচল) কেন হল তার কোনো সঠিক ইতিহাস নেই। অথর্ববেদ ‘অথর্ব’ (অচল) তো নয়ই বরং এই বেদই একমাত্র বেদ যা সচল আছে। অথর্ববেদেই ‘অথর্বের’ অর্থ করা হয়েছে পরব্রহ্ম ভগবান।

২. অথর্ববেদ পরবর্তী সংযোজন : অনেকের মতে গোড়ায় ঋক, যজু ও সামবেদই ছিল যাকে বলা হতো ত্রয়ীবেদ। অথর্ববেদ পরবর্তী সময়ে সংযোজিত হয়েছে। তবে এই মত সকলে গ্রহণ করেন না।

৩. অথর্ববেদের সাথে অন্যান্য বেদের পার্থক্য : অথর্ববেদই একমাত্র বেদ যা সকলের সব প্রয়োজন মেটানোর দিকে নজর দিয়েছে। ঋক, যজু ও সামবেদ প্রধানত মোক্ষপ্রাপ্তির দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। বিপরীতে অথর্ববেদ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ ইত্যাদি বিষয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করে নি।

৪. বিষয়বস্তু : অথর্ববেদে আছে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অর্থাৎ মানুষের রোগ নিবারণের ব্যবস্থা। শত্রুজয়, পাপক্ষয় ইত্যাদির জন্য এতে রয়েছে মন্ত্রাদি। আরও আছে সৌভাগ্যকরণ, পুত্রাদিলাভ, সুপ্রসব, কন্যাদির বিবাহ, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি নিবারণ, বাণিজ্যে শ্রীলাভ ইত্যাদি বিষয়ক মন্ত্র। বাস্তু সংস্কার, গৃহপ্রবেশ, চূড়াকরণ, উপনয়ন, জাতকর্ম ও বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ও অথর্ববেদের বিষয়বস্তু। বেদগুলোর মধ্যে অথর্ববেদেই প্রথম ‘সহমরণ’ এর কথা পাওয়া যায়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে অথর্ববেদে ইহলৌকিক বিষয়াদি আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, এই বেদে পারলৌকিক বিষয়াদি উপেক্ষিত হয়েছে। দেবতা কি, দেবতার স্বরূপ কি, ভগবান কিভাবে সর্বব্যাপী, তাকে কিভাবে পাওয়া যেতে পারে ইত্যাদি বিষয়ও অথর্ববেদের বিষয়বস্তু।

৫. অথর্ববেদে রয়েছে আর্যঐক্যের দ্বারা অন-আর্য বিনাশের আহ্বান: অথর্ববেদের ষষ্ঠ অধ্যায়ের সাত নম্বর পরিচ্ছেদের দুই নম্বর সূক্তে রয়েছে আর্য ঐক্যের এক বাণী। বলা হচ্ছে: “হে জনগণ, তোমাদের সংকল্প একরূপ হোক, তোমাদের হৃদয় এক হোক, তোমাদের মন সমান হোক। যাতে তোমাদের সকল কাজ একসাথে হয়, সেজন্য তোমাদের সংযুক্ত করছি। শত্রুর ক্রোধ বিনষ্ট হোক, আমাদের বিস্তৃত আয়ুধগুলি স্ব-স্ব কার্য-সমর্থ হোক, সেরূপ শত্রুর বাহুদ্বয় তাদের মনের সাথে থাকুক অর্থাৎ অস্ত্রচালনে অসমর্থ হোক। হে শত্রুর পরাভবকারী ইন্দ্র, শত্রুদের শোষক বল আমাদের কাছে পরাঙ্মুখ করে বিনাশ কর এবং তাদের ধন আমাদের অভিমুখ কর…।” উল্লেখ্য এখানে শত্রু হচ্ছে অন-আর্য জনগোষ্ঠী I

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *