মনুর বিষবৃক্ষ
অনেক হিন্দুর ধারণা ‘মনু’ থেকেই মানব। এই অর্থে ‘মনুবাদ’ হচ্ছে ‘মানবতাবাদ’ তথা মনুর বিধান। মনুর বিধান অর্থে ‘মনুবাদ’ যথাযথ, কিন্তু একে ‘মানবতাবাদ’ বলা হবে চূড়ান্ত অজ্ঞতার শামিল। যারা মনুবাদকে মানবতাবাদ বলতে চায় তারা হয় অজ্ঞতার কারণে এটি করে অথবা নিজের সাথে করে শঠতা। কেন অজ্ঞতা অথবা শঠতা তা বোঝার জন্য প্রথমেই দেখা যাক মনুবাদ বিরোধীরা এই সম্বন্ধে কী বলে? মনুবাদ বিরোধীরা বলে ‘মনুবাদ’ হচ্ছে বিষবৃক্ষ। এই বিরোধীদের মধ্যে আছে ভারতের অন্যতম আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ‘বহুজন সমাজ’ পার্টি (বিএসপি)। এই দলের দুই নেতা কাশীরাম ও উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর উদ্দেশ্য ‘হরিজন’দের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার আদায় করা। এতে তাঁদের মূল প্রতিপক্ষ দেখা যাচ্ছে ‘মনুবাদী’ জনগোষ্ঠী। তাঁদের অভিযোগ: ‘মনুবাদী’ বর্ণহিন্দুরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল সুবিধা যুগ যুগ ধরে কুক্ষিগত করে রেখেছে। তাঁদের আরও অভিযোগ: ‘মনুবাদী’রা সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মানুষ বলে গণ্য করে না।
এদিকে এসব অভিযোগের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে জাত-পাতের রাজনীতি বলে ডান-বাম রাজনৈতিক দলগুলো নিন্দা করে। তারা বলে জাত-পাতের রাজনীতি সমাজকে বহুধা বিভক্ত করছে, অস্থিতিশীল করছে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে। অপর দিকে ‘মনুবাদ’ বিরোধীরা বলছে মনুবাদীরাই ভারতীয় সমাজকে জাতের ভিত্তিতে ভাগ করে রেখেছে। এই জাতবিভাগ তারা করেন নি। সৃষ্ট বিভাজনে তারা যেহেতু সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তাই তারা এর প্রতিকার চান। বড় বড় দলের ভোটার হয়েও তারা বিগত ৫৪ বছরে (১৯৪৭-২০০১) এর প্রতিকার পান নি! তাই তারা এখন আলাদা হয়ে আন্দোলন করছেন। এটি জাত-পাতের লড়াই নয়, অস্তিত্বের সংগ্রাম। মানুষ হিসেবে বাঁচার সংগ্রাম।
মনুবাদী ও মনুবিরোধীদের উপরোক্ত বিতর্কে দেখা যাচ্ছে মনুবাদীদের কাছে যা জাত-পাতের রাজনীতি, মনুবিরোধীদের কাছে তা অস্তিত্বের সংগ্রাম, মানুষ হিসেবে বাঁচার সংগ্রাম। এই বিপরীত অবস্থানের হেতু কী তা বুঝতে হলে মনুর বিধানগুলো পরীক্ষা করে দেখা দরকার। কারণ মনুর বিধান অনুসরণ করে যারা চলতে চান তারাই মনুবাদী। মনুর বিধানগুলো কী? মনুর বিধানগুলোর পরিচয় পাওয়া যায় ‘মনুসংহিতায়’। হিন্দু সমাজ কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে তার বিধানই মনুর বিধান। বস্তুত হিন্দু সমাজ যুগ যুগ ধরে ‘মনুসংহিতা’ দ্বারা শাসিত হচ্ছে। ‘মনুসংহিতা’কে বলা হয় প্রাচীনতম ও প্রামাণ্য ধর্মশাস্ত্র।
মনুর অনুশাসন বস্তুত হিন্দুর সংবিধান। বহুকাল ধরে বিনা প্রতিবাদে চালু থাকায় রাষ্ট্রের আইনের চেয়ে ‘মনুর’ বিধান অনেক বেশি শক্ত ও দৃঢ়মূল হয়েছে। আইনী বিচারের ক্ষেত্রে দেখা যায় একজন বিচার প্রার্থী আদালতে যেতে পারে। সন্তুষ্ট না হলে যেতে পারে উচ্চ-আদালতে। কিন্তু ‘মনুর’ আইনের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। এর বাস্ত বায়নে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিভাবে শক্তিশালী ব্রাহ্মণ ও ‘মনুবাদী সমাজ’ সদা নিয়োজিত। তা ছাড়া সমাজ বদলের সাথে সাথে রাষ্ট্রের আইনও পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু ‘মনুর’ বিধানে কোনো পরিবর্তন নেই। কারণ মনুর বিধানকে বলা হয় ব্রহ্মার মুখনিঃসৃত বিধান। ব্রহ্মার বিধান মানুষ পরিবর্তন করে কী করে? ব্রহ্মার মুখ থেকে শোনা এবং মনু কর্তৃক সংকলিত এই বিধানগুলো আলোচনার আগে মনুসংহিতাটির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া দরকার।
‘মনুসংহিতা’ বা ‘মনুস্মৃতি’ (মনুসংহিতা : অনুবাদ : সুরেশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় : আনন্দ পাবলিশার্স : ১৯৯৯) খ্রিস্টপূর্ব দুই শতাব্দী থেকে খ্রিস্টাব্দ দুই শতাব্দী পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রচিত বলে অনুমান করা হয়। ‘মনু’ ব্রহ্মার পুত্র। আবার ‘মনুর’ ছয়জন বংশধরও ‘মনু’ বলে পরিচিত। কাজেই ‘মনুর’ মোট সংখ্যা দাঁড়ায় সাতে। যেহেতু গ্রন্থের নাম ‘মনুসংহিতা’ তাই একে এই সাত ‘মনুর’ কীর্তি হিসেবে দেখা যায়। বংশ পরম্পরায় সাত মনুর কীর্তি হওয়াতেই বোধ করি অনেকে মনে করেন বর্তমানে ‘মনুস্মৃতিকে’ যে আকারে পাওয়া যাচ্ছে আগে তা এই আকারে ছিল না। অন্তত তিনটি স্তরে ‘মনুস্মৃতি’ পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তনে কোনটি যোগ হয়েছে, কোনটি বাদ গেছে যা নির্ধারণ করা অসম্ভব।
এ প্রেক্ষাপটেই দেখা যায় বর্তমান মনুস্মৃতিতে সর্বমোট ২,৬৮৪টি শোক আছে। এই শ্লোকগুলোতে সন্নিবেশিত গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলোর হচ্ছে : ক. পৃথিবীর উৎপত্তি, খ. বিভিন্ন সংস্কারের নিয়ম, গ. ব্রতাচারণ, ঘ. বিবাহের নিয়মাবলী, ঙ. অপরাধের শাস্ত্রীয় বিধি, চ. শ্রাদ্ধবিধি, ছ. খাদ্যাখাদ্য বিধি, জ. বিভিন্ন বর্ণের কর্তব্য, ঝ. বর্ণাশ্রম বিধি, ঞ. স্ত্রী-পুরুষের পারস্পরিক ধর্ম, ট. সম্পত্তি বন্টনের বিধি, ঠ. সংকর বর্ণের বিবরণ, ড. জাতিধর্ম, ঢ. কুলধর্ম, ণ. ব্রাহ্মণের অধিকার ও করণীয় এবং ত. রাজা-প্রজার পারস্পরিক কর্তব্য ইত্যাদি। মোটামুটিভাবে বলা যায় হিন্দুর দৈনন্দিন সামাজিক ও ধর্মীয় কর্তব্যের অলঙ্ঘনীয় বিধি-বিধান নিয়েই ‘মনুস্মৃতি’। বলা বাহুল্য এগুলো চালু মনুর নামে।
মনুর ধর্মটি চারবর্ণ ভিত্তিক ধর্ম। মনুর মোট ২,৬৮৪ শ্লোক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আর্যদের দেবতা ব্রহ্মার পুত্র মনু তার ধর্মের নাম দিয়েছেন ‘সনাতন ধর্ম’। এই ধর্মে তিনি মানুষকে চার ভাগে ভাগ করেছেন, যথা: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এর মধ্যে প্রথম তিনটি দ্বিজ। এই কাঠামো দ্বারা তিনি ব্রাহ্মণকে প্রকৃতপক্ষে দেবতার আসনে বসিয়ে একটি স্থায়ী বৈষম্যপূর্ণ ধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রতিটি বিধানের কেন্দ্রবিন্দুতে ব্রাহ্মণ। তার স্বার্থকে রক্ষণ, সংহতকরণ ও নিরঙ্কুশ করাই হচ্ছে মনুর একমাত্র উদ্দেশ্য। এর জন্য যত ধরনের নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করা দরকার মনু তা অবলীলাক্রমে করেছেন। শুরুই করেছেন চার বর্ণের অলৌকিক ও অবিশ্বাস্য জন্ম কাহিনী দিয়ে। তাঁর মতে মুখ, বাহু, ঊরু ও পদ থেকে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের সৃষ্টি। কোনো মানুষের জন্ম মুখ, বাহু, ঊরু ও পদ থেকে যে হয় না এ কথা মনু জানতেন না তা বিশ্বাস করা কঠিন। তবু তিনি এ কাজ কেন করলেন? করেছেন ঠাণ্ডা মাথায়। এতে কাজ করেছে তার ভেদ বুদ্ধি। শুধু ব্রাহ্মণ, শূদ্র ও নারীদের সম্পর্কে মনুর বিধানগুলো পাঠ করলেই এই ভেদবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় :
১. ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে মনু: ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের কয়েকটি শ্লোকের বিষয়বস্তু নিম্নরূপ:
ক. . স্রষ্টা ব্রাহ্মণদেরকে মুখ থেকে সৃষ্টি করেছেন (৩১ নং শোক)।
খ. স্থাবর জঙ্গমাদির মধ্যে প্রাণী শ্রেষ্ঠ, প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীরা শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমানদের মধ্যে মানুষ এবং মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ (৯৬)।
গ. জাতমাত্রই ব্রাহ্মণ পৃথিবীতে সকল লোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন এবং সকল সৃষ্ট পদার্থের ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য তিনিই প্রভু (৯৯)।
ঘ. পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তার সবই ব্রাহ্মণের সম্পত্তি। শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য হেতু ব্রাহ্মণ সবই পাওয়ার যোগ্য (১০০) এবং ব্রাহ্মণ নিজের অন্নই ভক্ষণ করেন, নিজের বস্ত্র পরিধান করেন এবং নিজের দ্রব্য দান করেন। অন্য লোকেরা যা ভোগ করে তা ব্রাহ্মণের দয়া হেতু করে (১০০)।
২. শূদ্র সম্বন্ধে মনুঃ ব্রাহ্মণের পরে দেখা যাক মনু শূদ্রদের সম্পর্কে কী বলছেন। বলা বাহুল্য মনুর বিধান মোতাবেক হিন্দু জনসাধারণের সিংহভাগই শূদ্র বর্ণের। শূদ্রকে মনু কোনো অধিকার দেন নি। শূদ্রের একমাত্র কাজ তিন বর্ণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সেবা করা। মনু আরও বলছেন :
ক. শূদ্র বা দাসদের নিজস্ব কোনো সম্পত্তি রাখার অধিকার নেই।
খ. দাস ও শূদ্রের ধন ব্রাহ্মণ অবাধে নিজের কাজে প্রয়োগ করবেন।
গ. শূদ্র অর্থ সঞ্চয় করতে পারবে না। কারণ তার সম্পদ থাকলে সে গর্বভরে ব্রাহ্মণের উপর অত্যাচার করতে পারে।
ঘ. প্রভু কর্তৃক পরিত্যক্ত বস্ত্র, ছত্র, পাদুকা ও তোষক প্রভৃতি শূদ্র ব্যবহার করবে।
ঙ. প্রভুর উচ্ছিষ্ট তার ভক্ষ্য।
চ. দাস বৃত্তি থেকে শূদ্রের কোনো মুক্তি নেই।
ছ. যজ্ঞের কোনো দ্রব্য শূদ্র পাবে না।
জ. ব্রাহ্মণের পরিবাদ বা নিন্দা করলে শূদ্রের জিহ্বাছেদন বিধেয়।
ঝ. ব্রাহ্মণ শূদ্রের নিন্দা করলে যৎসামান্য জরিমানা দেয়।
ঞ. ব্রাহ্মণ কর্তৃক শূদ্র হত্যা সামান্য পাপ। এইরূপ হত্যা পেঁচা, নকুল ও বিড়াল ইত্যাদি হত্যার সমান।
ট. শূদ্র কর্তৃক ব্রাহ্মণ হত্যার বিচার মৃত্যুদণ্ড।
ঠ. শূদ্র সত্য কথা বলছে কিনা তার প্রমাণ হিসেবে তাকে দিব্যের আশ্রয় নিতে হবে। এতে তাকে জলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হাটতে হয় অথবা জলে ডুবিয়ে রাখা হয়। অদগ্ধ বস্থায় অথবা জলমগ্ন না হয়ে ফিরলে তার কথা সত্য বলে বিবেচিত হবে।
ড. দ্বিজকে (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য) প্রহার করলে শূদ্রের হাত কেটে ফেলা বিধেয়। ঢ. ব্রাহ্মণের সঙ্গে একাসনে বসলে তার কটিদেশে তপ্তলৌহদ্বারা চিহ্ন এঁকে তাকে নির্বাসিত করা হবে অথবা তার নিতম্ব এমনভাবে ছেদন করা হবে যাতে তার মৃত্যু হয়।
ণ. দ্বিজের ন্যায় উপবীত বা অন্যান্য চিহ্ন ধারণ করলে শূদ্রের মৃত্যুদণ্ড বিধেয়।
ত যে পথ দিয়ে উচ্চ বর্ণের লোকরা যাতায়ত করেন, সেই পথে শূদ্রের মৃতদেহও বহন করা যাবে না।
৩. নারী সম্পর্কে মনু : নারী সম্পর্কেও মনুর বিধান কঠোর ও বৈষম্যমূলক। নারী সম্পর্কে অবশ্য কয়েক জায়গায় গৌরবমূলক কিছু উক্তি আছে। কিন্তু সাধারণভাবে নারীর অবস্থান মনুর দৃষ্টিতে শূদ্রের অবস্থান থেকে কোনো মতেই উচ্চ নয়। নিচে এর কয়েকটি উল্লেখ করা হল :
ক. স্ত্রীলোক পতিসেবা করবে। তার স্বাধীন কোনো সত্তা নেই।
খ. নারীকে কুমারী অবস্থায় পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করবে।
গ. স্ত্রীলোকের পৃথক কোনো যজ্ঞ, ব্রত বা উপবাসের বিধান নেই।
ঘ. স্ত্রীলোকের সাক্ষী হওয়ার বা স্বাধীনভাবে ঋণ করার অধিকার নেই।
ঙ. বিধবা সাধ্বী নারী ব্রহ্মচর্য পালন করবে।
৪. ব্রাহ্মণ সম্পর্কে মনু: মনুসংহিতা পাঠ করলে স্পষ্টতই বোঝা যায় ‘মনু’র কাছে মানুষ গৌণ! ব্রাহ্মণই হচ্ছে মনুর মানসপুত্র। কিন্তু ব্রাহ্মণকে মানসপুত্র করতে গিয়ে মনু যে প্রকারান্তরে ব্রাহ্মণকে সমগ্র হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন (বহিষ্কার) করে ফেলেছেন এটি বোধ হয় তার খেয়াল ছিল না। কারণ স্পষ্টতই বোঝা যায় ব্রাহ্মণ হিন্দু নয়, ব্রাহ্মণই। তার অবস্থান হিন্দু সমাজের বাইরে। এমন যে একজন ব্রাহ্মণ তার কাজ কি তাও মনু নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। মনু ব্রাহ্মণদের অনেক গুণাবলির কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ :
ক. ব্রাহ্মণদের কাজ অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ।
খ. ব্রাহ্মণের নাম হবে শুভসূচক (শুভ শৰ্মা) ক্ষত্রিয়ের বলসূচক (বলবর্মা), বৈশ্যেও ধনসূচক (বসুভুতি) ও শূদ্রের নিন্দাবাচক (দীনদাস)।
গ. কাঠের হাতী, চামড়ার হরিণ ও বেদ না জানা ব্রাহ্মণ সমান।
ঘ. ব্রাহ্মণের গৃহে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রকে অতিথি বলা হয় না।
ঙ. ব্রাহ্মণ দয়াপরবশ হয়ে গৃহে অতিথিরূপে উপস্থিত বৈশ্য ও শূদ্রকে ভৃত্যদের ভোজন কালে ভোজন করাবেন।
চ. ব্রাহ্মণ অনিন্দিত কর্মদ্বারা শরীরকে কষ্ট না দিয়ে শুধু প্রাণ ধারণের জন্য অর্থ সঞ্চয় করবেন।
ছ. ব্রাহ্মণ লৌকিক বিষয়ে শূদ্রকে উপদেশ, উচ্ছিষ্ট, হবির শেষ ও ধর্মোপদেশ দেবেন না। তাকে ব্ৰত সম্বন্ধে উপদেশ দেবেন না।
জ. রসুন, গাঁজর, পেঁয়াজ, ছত্রাক ও অপবিত্র স্থানে উৎপন্ন দ্রব্য খাওয়া ব্রাহ্মণের জন্য নিষিদ্ধ
ঝ. ব্রাহ্মণেরা শূদ্র রাজার রাজ্যে বাস করবেন না।
মনু নির্ধারিত ওপরের গুণাবলির ভিত্তিতে বিচার করলে আজকের দিনে ব্রাহ্মণ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। এমনকি ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্যও খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবু দেখা যায় তারা নিজেদেরকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বলে দাবি করে। স্পষ্টতই তাদের এই দাবি জন্মভিত্তিক। কর্ম বা গুণাবলিভিত্তিক নয়। প্রতিনিয়ত কর্ম বা গুণাবলির পরিবর্তন হচ্ছে, তবু জাতির দাবি করা হচ্ছে জন্মগতভাবে। মজার বিষয় হচ্ছে জন্মভিত্তিক এই জাতিত্বের আবার স্বীকৃতি দিচ্ছে ভারত রাষ্ট্র। ভারতের সংবিধান মোতাবেক হিন্দু চারভাগে বিভক্ত। এই চারটি ভাগ হচ্ছে : ক. উপজাতি, খ. তপশীলী জাতি, গ. ‘আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস’ (ওবিসি) ও ঘ. অন্যান্য হিন্দু। এই চার ভাগে হিন্দুদেরকে ভাগ করে প্রথমোক্ত তিন শ্রেণির জন্য করা হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘সংরক্ষণের’ (রিজার্ভেশন) ব্যবস্থা। এই সংরক্ষণের বদৌলতে তথাকথিত নিচু শ্রেণির হিন্দুরা ওপরে উঠতে চাইছে। কিন্তু বাধা দিচ্ছে ‘বর্ণহিন্দুরা’। এটি করতে গিয়ে তারা তাদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি ব্যবহার করছে। এতেই মনুবাদী ও মনুবিরোধী দুটো শিবিরের জন্ম। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় মনুর অনুশাসন কত গভীর।
ওপরের আলোচনার প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন : ‘মনু’ ‘সনাতন ধর্মের’ নামে কি প্রেক্ষাপটে এবং কেন এমন একটি তথাকথিত ধর্মশাস্ত্র রচনা করলেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে তৎকালীন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে। দেখা যায় মনুসংহিতা যখন রচিত হচ্ছে তখন বৌদ্ধধর্মের প্রভাব সারা ভারতব্যাপী। বৌদ্ধধর্মের উত্থান ছিল তখনকার দিনে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদের’ বিরুদ্ধে একটি গণ-অভ্যুত্থান। গণ-অভ্যুত্থানের পর সবসময়ই প্রতিবিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীলরা আঘাত হানে। এদের শক্তি প্রচণ্ড, কারণ বৈষম্যের শক্তি সবসময়ই প্রবল হয়। এটি মরে না। যখনই সুযোগ পায় তখনই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তাই দেখা যায় অশ্বঘোষ যখন ‘ধম্মপদের’ মত মানবতাবাদী একটি গ্রন্থ লিখছেন ঠিক ঐ সময়েই মনু তার চরম প্রতিক্রিয়াশীল ‘মনুসংহিতা’ লিখে পাল্টা অভ্যুত্থানের মহড়া দিচ্ছেন। এই মহড়ায় ‘মনুবাদীরা’ সফল হন বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়কালে। জন্মগতভাবে ‘দ্বিজ’ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য) সম্প্রদায়ের লোকেরা মনুর বিধি দিয়ে পরবর্তীকালে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বৈষম্যের বেড়াজালে আবদ্ধ করে ফেলে। আজও তার কুফল বহন করছে বর্তমান হিন্দু সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী।
মনুসংহিতার বিধানাবলী ও তার দীর্ঘস্থায়ী কুফলের পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা যায় ভারতের মায়াবতী ও কাশীরামরা কেন মনুবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বাংলাদেশের হিন্দুদের কাছে মায়াবতীদের আন্দোলনের কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে কি না তা দেখা যাক। বাংলাদেশের হিন্দুদের সমস্যা দুই দিক থেকে। একদিকে তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, অন্যদিকে সিংহভাগ হিন্দু নিজধর্মে দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় হিন্দুরা বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানকে নিজেদের বলে মেনে নিতে পারছে না। কারণ সংবিধানে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছে। এতে হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর রাজনৈতিক অবস্থান নিশ্চিতভাবেই অবনমিত হয়েছে। তাই তাদের রাজনৈতিক সমানাধিকারের আন্দোলন সমর্থনযোগ্য। যদি এই আন্দোলন যুক্তিপূর্ণ ও সমর্থনযোগ্য হয় তাহলে হিন্দুদের নিজেদের মধ্যকার সামাজিক ও ধর্মীয় সমানাধিকারের দাবিও হয় যুক্তিপূর্ণ। কিন্তু এ ব্যাপারে ওপরের শ্রেণির হিন্দুদেরকে দেখা যায় সম্পূর্ণ নীরব। মনুর বিধান যে একটি প্রতিক্রিয়াশীল দলিল ও বৈষম্যপন্থী তা তারা বলেন না। যেমন বলে না ভারতের ডান- বাম রাজনৈতিক দলগুলো।
মনে হয় বর্ণহিন্দুরা স্ববিরোধিতায় ভুগছে। দেখা যায় তারা মুখে মুখে সব মানুষের অধিকারের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে তারা হিন্দুর সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারের প্রশ্নে নির্বিকার। বিপরীতে তাদেরকে আবার পৃথিবীর অন্যত্র সংঘটিত বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে দেখা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার একসময়ের বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে তারা ছিল একাত্ম। কিন্তু স্বদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও দীর্ঘস্থায়ী বর্ণবাদ তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না।
বর্ণহিন্দুদের উপরোক্ত স্ববিরোধিতা এই উপমহাদেশের প্রচুর ক্ষতি করেছে। এ প্রেক্ষাপটে সাধারণ হিন্দুদেরকেই তাদের নিজস্ব শক্তি নিয়ে এগুতে হবে। ইতিহাস তাদের পক্ষে। কারণ ‘মনুবাদ’ আর ‘বর্ণবাদ’ সমার্থক। একে কোনো সভ্য মানুষই আজকের দিনে মেনে নিতে পারে না। আশার কথা সাধারণ হিন্দু ধীরে ধীরে মনুবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত ও সোচ্চার হচ্ছে। তারই সাক্ষ্য মনুবাদের শিকার ‘দস্যুরাণী’ ফুলন দেবী (২০০১ সালের আগষ্ট মাসে নিহত)। তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘একলব্য সেনা’।
একলব্য কে?
একলব্য ছিলেন তথাকথিত নিচু জাতির (ভূমিপুত্র)। অর্জুনের গুরু দ্রোনাচার্য্যের কাছে তিনি অস্ত্র বিদ্যা শিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘নিচু’ জাতি বলে দ্রোনাচার্য একলব্যকে অস্ত্র চালনা শেখাতে অস্বীকৃত হন। উপায়ান্তর না দেখে একলব্য মনে মনে দ্রোনাচার্য্যকে গুরু মেনে নিজের উদ্যোগে অস্ত্রবিদ্যা শিখে অর্জুনের চেয়ে অনেক বড় ধনুর্বিদ হয়েছিলেন। দ্রোনাচার্য্য এটি পছন্দ করেন নি। তাই তাকে বীরত্ব থেকে বঞ্চিত করার জন্য দ্রোনাচার্য্য গুরু দক্ষিণা হিসেবে একলব্যের আংগুল চান। একলব্য নিজের আঙ্গুল কেটে গুরুকে দক্ষিণা দেন। বলা বাহুল্য একলব্য আঙ্গুল হারিয়ে ধনুক চালনায় অপারগ হন। দ্রোনাচার্য্যের অভিলাষ এতে পূর্ণ হয়। অর্জুন হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনুর্বিদ।
মজার ঘটনা মহাভারতে এই কাহিনীকে দেখানো হয়েছে গুরুর প্রতি শিষ্যের আনুগত্য ও শ্রদ্ধা হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে এটি যে বৈষম্য এবং তথাকথিত নিচুজাতির প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ তা ধর্মের নামে চেপে যাওয়া হয়েছে। মনে হয় ফুলন দেবী এই ঐতিহাসিক অবিচারের প্রেক্ষাপটেই ‘একলব্য সেনা’ গড়ে তুলেন। ফুলন দেবী, কাশীরাম ও মায়াবতীদের এ জাগরণ মনে হচ্ছে মনুবাদী সমাজে অনুকূল প্রভাব ফেলছে। তা নাহলে ‘ভারতীয় জনতা পার্টির’ (ভাজপা) এককালীন সভাপতি মুরলী মনোহর যোশী ধর্মীয় পুস্তক থেকে হিন্দুর সেকেলে সবকিছু বাদ দেওয়ার আহ্বান জানাতেন না। বলতেন না ধর্মীয় পুস্তকগুলোর পুনর্মূল্যায়নের কথা (ইণ্ডিয়া টুডে: ১৬.৭.২০০১)। এমতাবস্থায় আশা করা যায় মনুসংহিতা নামীয় বিষবৃক্ষটিও পুনর্মূল্যায়িত হবে এবং উৎপাটিত হবে। শত হোক মনুসংহিতা স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় যে তা থেকে বৈষম্যমূলক বিষয়গুলো বাদ দেওয়া যাবে না। বরং ব্রাহ্মণ্য সমাজ উদ্যোগ নিয়ে এসব গ্রন্থ থেকে ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের বিরোধী বিষয়গুলো বাদ দিলে একটি সুস্থ ও সবল সমাজের অনুকূল হবে এবং তা মানব সভ্যতার কল্যাণে আসবে। আশা করা যায় তারা একথা স্বীকার করবেন যে এ কাজটি অত্যন্ত জরুরি।