গীতার ধর্মে মানুষই স্ৰষ্টা

গীতার ধর্মে মানুষই স্রষ্টা

অনৈক শিক্ষিত হিন্দুর কাছে গীতা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। যারা গীতাকে ধর্মগ্রন্থ বলে মনে করেন তাদের মতে গীতা স্বয়ম্ভু, সর্বতপ্রসারী ও স্বতঃপূর্ণ। গীতা শুধু দানই করেছেন, কারও কাছ থেকে গীতা কিছু গ্রহণ করেন নি। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, গীতা স্বয়ং ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী। ভগবান কারও দান গ্রহণ করেন না, অর্থাৎ তিনি কারও থেকে ধার করে কথা বলেন না। এদিকে যারা এই মত পোষণ করেন না তাঁদের মতে গীতা বিভিন্ন মতের একটি সংকলন মাত্র। তারা বলেন, গীতা রচনার সময়ে তৎকালীন সমাজে নানা পরস্পর বিরোধী মতবাদ প্রচলিত ছিল। ছিল যজ্ঞভিত্তিক বৈদিক ধর্ম। এর পাশাপাশি প্রচলিত ছিল বেদবাদ, বৈদিক যজ্ঞভিত্তিক কর্মযোগ, বৈদান্তিক ব্রহ্মবাদ ও জ্ঞানমার্গ, সাংখ্যের নিরীশ্বরবাদী মত অর্থাৎ প্রকৃতিবাদ ও কৈবল্য জ্ঞান, অবতারবাদ, ভক্তিমার্গ, প্রতীকোপাসনা ইত্যাদি। অনেকক্ষেত্রেই এই সাধন মার্গগুলো ছিল পরস্পর বিরোধী এবং প্রত্যেকেরই দাবি ছিল তাদের অনুসৃত পথই মোক্ষ লাভের একমাত্র উপায়। পণ্ডিতগণ বলেন, গীতা এই সমস্ত পরস্পর বিরোধী মতবাদকে সমন্বিত করেন। দুই পক্ষের বক্তব্যকে সামনে রেখে নিচে প্রধানত জগদীশ চন্দ্র ঘোষের বাংলা গীতা অনুসরণে এ সম্বন্ধে একটা সাধারণ ধারণা লাভের চেষ্টা করা যাক:

১. গীতার বিভিন্ন নাম: গীতাকে ভগবদ্‌গীতাও বলা হয়। গীতায় দেখা যায় অর্জুন ও সঞ্জয় শ্রীকৃষ্ণকে হৃষিকেশ, মধুসূধন, জনার্দন, বায়ে, গোবিন্দ, অরিসূদন, কেশব ইত্যাদি নামে ডাকছেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং যখন কিছু বলছেন, তখন বলা হচ্ছে ‘শ্রীভগবান উবাচ’। একারণেই গীতাকে ভগবদ্‌গীতা বলা হয়। গীতাকে ত্রয়োদশ উপনিষদও বলা হয়, যদিও তা বেদের অঙ্গীভূত নয়। বলা হয়, গীতার মূল ভাবগুলো উপনিষদ থেকেই নেওয়া হয়েছে। গীতা তিনটি প্রস্থানত্রয়ীর (উপনিষদ, গীতা ও বেদান্ত দর্শন) একটি। এর অর্থ সংসার-সমুদ্রে এ তিনটিকে ধ্রুবতারা মনে করে হিন্দুরা মোক্ষলাভ করতে পারে।

২. গীতা সম্বন্ধে ড. রাধাকৃষ্ণণ: ড. রাধাকৃষ্ণণের মতে, “গীতার উপদেশ কোন বিশেষ চিন্তাশীল ব্যক্তি বা চিন্তাশীল গোষ্ঠীর ধারণাপ্রসূত অধিবিদ্যার পদ্ধতির আকারে প্রচারিত নয়। মানবসমাজের ধর্মজীবন থেকে যে পরম্পার উৎপত্তি হয়েছে তাকেই এতে রূপ দেওয়া হয়েছে।” এর অর্থ হচ্ছে গীতার উপদেশ কোনো ব্যক্তির নয়। এসব উপদেশ বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত হিন্দু ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকেই শ্রীকৃষ্ণ নামীয় একটি চরিত্র সৃষ্টি করে তাঁর মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে। প্রচার করা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং স্রষ্টা। অথচ দেখা যাচ্ছে তিনি একজন রক্তমাংসের মানুষ।

৩. রচনাকাল : কেউ কেউ বলেন গীতা খ্রিস্টপূর্বকালে রচিত। মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর কথা বলা হয়। তবে পণ্ডিতগণ ধারণা করেন গীতা খ্রিস্টাব্দের প্রথম চারশো বছরে রচিত ও পল্লবিত। অনেক পরে একে ঢুকানো হয় জনপ্রিয় মহাভারতে।

৪. গীতার রচয়িতা অজানা: গীতার রচয়িতা কে তা কেউ জানে না। যেমন জানা যায় না প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের অনেক পুস্তক/ধর্মীয় পুস্তকের রচয়িতার নাম। তবে প্রচলিত বিশ্বাস এটি ব্যাসদেবের রচনা। তাঁর রচিত মহাভারতের ‘ভীষ্মপর্ব’ই ( ২৩ থেকে ৪০ পরিচ্ছেদ) গীতা।

৫. গীতায় সর্বমোট ১৮টি অধ্যায় : গীতায় সর্বমোট ১৮টি অধ্যায় সন্নিবেশিত হয়েছে। ১৮টি অধ্যায়ে স্থানে পেয়েছে সর্বমোট ৭০০টি শোক। অধ্যায় ও বিষয়বস্তুর পরিচয় নিচে দেওয়া হল:

অধ্যায়বিষয়শ্লোক সংখ্যা
প্রথমঅর্জুন-বিষাদযোগ১-৪৬
দ্বিতীয়সাংখ্যযোগ১-৭২
তৃতীয়কর্মযোগ১-৪৩
চতুর্থজ্ঞানযোগ১-৪২
পঞ্চমসন্ন্যাসযোগ১-২৯
ষষ্ঠধ্যানযোগ বা অভ্যাস-যোগ১-৪৭
সপ্তমজ্ঞান-বিজ্ঞান যোগ১-৩০
অষ্টমঅক্ষ ও ব্রহ্মযোগ১-২৮
নবমরাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযোগ১-৩৪
দশমবিভূতি-যোগ১-৪২
একাদশবিশ্বরূপ-দর্শনযোগ১-৫৫
দ্বাদশভক্তিযোগ১-২০
ত্রয়োদশক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগ যোগ১-৩৫
চতুর্দশগুণত্রয়-বিভাগ-যোগ১-২৭
পঞ্চদশপুরুষোত্তম-যোগ১-২০
ষোড়শদৈবাসুর-সম্পদ্-বিভাগযোগ 
সপ্তদশশ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগযোগ১-২৮
অষ্টাদশমোক্ষযোগ১-৭৮

৬. গীতার অনেক ভাষ্যকার: গীতার অনেক ভাষ্যকার আছেন। রয়েছে তাদের সম্পাদিত অনেক ধরনের টীকা। বস্তুত টীকা ছাড়া গীতা বোঝা খুবই কঠিন। সব ভাষ্যকারের মধ্যে শঙ্করের গীতাভাষ্যই বহুল ব্যবহৃত। বাকিদের ভাষ্য বলতে গেলে বিলুপ্ত। লক্ষণীয় একেকজন ভাষ্যকার যার যার বিশ্বাসমত গীতার ভাষ্য লিখেছেন। অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ এবং শুদ্ধাদ্বৈতবাদ ইত্যাদি নানা বিশ্বাসে বিশ্বাসী ভাষ্যকারগণের মধ্যে যারা নিজ নিজ মত প্রতিষ্ঠার জন্য গীতাকে ব্যবহার করেছেন তাদের মধ্যে আছেন শঙ্করাচার্য, রামানুজাচার্য, শ্রীধরস্বামী মধ্বাচার্য ও বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রমুখ। মুষ্কিল হচ্ছে এঁদের টীকা পাঠ করলে বিভিন্ন মতের চাপে একজন পাঠকের বিভ্রান্ত হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

৭. গীতায় শ্রীকৃষ্ণের বাণী: যুদ্ধ বিমুখ অর্জুনকে যুদ্ধে নিয়োজিত করতে শ্রীকৃষ্ণ অনেক যুক্তি-তর্কের আশ্রয় নেন। এ ধরনের যুক্তি-তর্কে শ্রীকৃষ্ণ যা বলেন তাই গীতার বিষয়বস্তু। নিচে উদ্ধৃত শ্রীকৃষ্ণের কিছু বাণী থেকে তাঁর ধর্মটি সম্বন্ধে একটি ধারণা পাওয়া যাবে:

সাংখ্যযোগ

ক. যারা প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞানী তারা কি মৃত কি জীবিত কারও জন্য শোক করেন না। খ. আত্মা নিত্য, অবিনাশী, অপ্রমেয় (স্বপ্রকাশ)। অতএব হে অর্জুন যুদ্ধ কর (স্বধর্ম অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন কর)।

গ. যে আত্মাকে হন্তা বলে জানে এবং যে একে হত বলে মনে করে, তারা উভয়েই আত্মতত্ত্ব জানে না। ইনি হত্যা করেন না, হতও হন না।

ঘ. যেমন মানুষ জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, তেমনি আত্মা জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীর ধারণ করে।

ঙ. যুদ্ধে অবশ্যম্ভাবী হতাহতের জন্য শোক থেকে বিরত থাকার জন্য অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন: “যে জন্মে তার মরণ নিশ্চিত, যে মরে তার জন্ম নিশ্চিত, সুতরাং অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে তোমার শোক করা উচিৎ নয়।”

চ. ধর্মযুদ্ধ অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয়ঃ আর কিছু নেই।

ছ. ধর্মযুদ্ধ যদি তুমি না কর তবে স্বধর্ম ও কীর্তি নাশজনিত কারণে তুমি পাপী হবে, লোকে তোমার অকীর্তি ঘোষণা করবে, অকীর্তির চেয়ে মরণও শ্রেয়ঃ, যুদ্ধ না করলে লোকে বলবে তুমি ভয় পেয়েছ, শত্রুরা তোমার সামর্থ্যের অভাব রয়েছে বলবে, যুদ্ধে হত হলে তুমি স্বর্গে যাবে, জয়ী হলে পৃথিবী ভোগ করবে।

জ. অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা বলে বেদের কর্মকাণ্ডের (যজ্ঞ) দ্বারা স্বর্গলাভ হয়, তারা বলে বেদোক্ত যজ্ঞাদি ভিন্ন আর কোন ধর্ম নেই। তাদের চিত্ত কামনা কলুষিত।

ঝ. শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, বেদসমূহ ত্রৈগুণ্য-বিষয়ক। হে অর্জুন তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য হও। এর অর্থ অর্জুনকে বলা হচ্ছে সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিনগুণ যা জীবকে সংসারে আবদ্ধ করে তা ত্যাগ করতে।

ঞ. কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে কখনও তোমার অধিকার নেই। কর্মফল যেন তোমার কর্মপ্রকৃতির হেতু না হয়, কর্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়। এ ক্ষেত্রে নিষ্কাম কর্মের উপদেশ দেওয়া হয়েছে। নিষ্কাম কর্ম কী? স্বর্গফল লাভের জন্য বেদোক্ত কাম্য কর্ম অর্থাৎ যজ্ঞকর্মের বিপরীতটিই নিষ্কাম কর্ম।

কর্মযোগ

ক. জ্ঞানমার্গ ও কর্মমার্গের মধ্যে কোনটি শ্রেয়, এ প্রশ্নের উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সাংখ্যদিগের জন্য জ্ঞানযোগ (সন্ন্যাসমার্গ) এবং কর্মীদের জন্য কর্মযোগ শ্রেয়।

খ. যজ্ঞার্থ যে কর্ম তদ্ভিন্ন অন্য কর্ম মানুষের বন্ধনের কারণ। এস্থলে দেখা যাচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ পূর্বে যা বলেছেন তার ঠিক বিপরীতটি বলছেন।

গ. শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যদি আমি কর্ম না করি তাহলে লোকসকল উৎসন্নে যাবে। আমি বর্ণ- সঙ্করাদি সামাজিক বিশৃঙ্খলার হেতু হব এবং ধর্মলোপহেতু প্রজাগণের বিনাশের কারণ হব। এর অর্থ দাঁড়ায় শ্রীকৃষ্ণ বর্ণসঙ্করের অর্থাৎ বিভিন্ন বর্ণের বিবাহ-মিলনের বিরোধী। কারণ তাতে ধর্ম বিলোপ পায়।

ঘ. স্বধর্ম দোষবিশিষ্ট হলেও পরধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। স্বধর্মে নিধনও কল্যাণকর, কিন্তু পরধর্ম গ্রহণ করা বিপজ্জনক। এখানে স্বধর্ম কী? এ নিয়ে মত পার্থক্য লক্ষণীয়। গীতায় দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম (স্বধর্ম) পালন করতে বলেছেন। টীকাকাররা এর ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করলেও এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না যে শ্রীকৃষ্ণ স্বধর্ম বলতে ‘জাত-ধর্মের’ কথাই বলেছেন।

ঙ. কামই ক্রোধ যা শত্রু বলে জানবে। কামের দ্বারা জ্ঞান আবৃত থাকে। কাম অর্থ সাধারণভাবে বিষয়বাসনা। তার অর্থ দাঁড়ায় বৈষয়িক উন্নতির চিন্তা গীতার মতে বর্জনীয় হওয়া উচিত। অথচ বেদ বৈষয়িক কামনায় ভরপুর।

জ্ঞানযোগ

ক. যখনই যখনই ধর্মের গানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি সেই সময়ে নিজেকে সৃষ্টি করি (দেহ ধারণ করে আবির্ভূত হই)। সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্টদিগের বিনাশ ও ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। এখানে অবতারবাদের তত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে।

খ. বর্ণচতুষ্টয় গুণ ও কর্ম বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করেছি। গুণ ও কর্মের নানা ব্যাখ্যা প্রচলিত। এর মধ্যে জন্ম অনুসারেই আজও বর্ণ নির্ধারিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে জাতিভেদ অথবা জাতিভেদসহই সৃষ্টি।

সন্ন্যাসযোগ

ক. বিষয়ভোগজনিত যে সকল সুখ, সে সকল নিশ্চয়ই দুঃখের হেতু এবং আদি ও অন্ত বিশিষ্ট, বিবেকি ব্যক্তি ইহাতে নিমগ্ন হন না।

খ. যিনি দেহত্যাগের পূর্বেই এ সংসারে থেকে কামক্রোধজাত বেগ প্রতিরোধ করতে পারেন তিনিই যোগী ও সুখী পুরুষ।

ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ

ক. কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা না করে যিনি কর্তব্য কর্ম করেন, তিনিই সন্ন্যাসী, তিনিই যোগী। যিনি যজ্ঞাদি শ্রৌতকর্ম ত্যাগ করেছেন অথবা সর্ববিধ শারীরকর্ম ত্যাগ করেছেন তিনি নন।

খ. যিনি অত্যধিক আহার করেন অথবা যিনি একান্ত অনাহারী তার যোগ হয় না। অতিশয় নিদ্রালু বা অতি জাগরণশীল লোকেরও যোগসমাধি হয় না।

গ. অর্জুনকে যোগী হতে পরামর্শ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যোগী তপস্বিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, কর্মীগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য-যোগ

হে পার্থ, স্ত্রীলোক, বৈশ্য ও শূদ্র অথবা যাঁহারা পাপযোনিসম্ভূত অন্ত্যজজাতি, তাঁহারাও আমার আশ্রয় নিলে নিশ্চয়ই পরমগতি প্রাপ্ত হন।

মোক্ষযোগ

ক. হে পরন্তপ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদিগের কর্মসকল স্বভাবজাত গুণানুসারে পৃথক পৃথক বিভক্ত হয়েছে। (গুণানুসারে যে ভেদাভেদ তা বর্ণভেদ এবং বংশগত যে ভেদাভেদ তা জাতিভেদ)।

খ. সকল ধর্ম পরিত্যাগ করে তুমি একমাত্র আমারই শরণ লও। আমি তোমাকে সকল পাপ থেকে মুক্ত করব।

৮. গীতার ধর্মের মূলকথা: গীতায় প্রচারিত ধর্মের মূলকথা তিনটি, যথা: জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি। যার যার মত প্রতিষ্ঠার জন্য টীকা ভাষ্যকারদের কেউ কেউ অবশ্য শুধু জ্ঞানের কথাই বলেন, কেউ কেউ বলেন কেবলমাত্র কর্মের কথা, আবার কেউ কেউ বলেন শুধু ভক্তির কথা। অপর দিকে যারা সমন্বয়বাদী তাদের একপক্ষ বলেন গীতায় জ্ঞান-ভক্তি মিশ্রিত কর্মযোগের প্রাধান্য। আবার অন্যপক্ষ বলেন গীতায় জ্ঞান-কর্ম মিশ্রিত ভক্তি যোগেরই প্রাধান্য। লক্ষণীয় সমন্বয়বাদীদের মতামতই আজকাল গৃহীত হচ্ছে। সমন্বয়বাদীদের ব্যাখ্যা জীব-ব্রহ্ম তত্ত্ব ও মোক্ষ তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তারা গীতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন সাধন বলে জীব ঈশ্বরের ভাবপ্রাপ্ত হতে পারে। ঈশ্বরের ভাব কী?

ঈশ্বরের ভাব তিনটি, যথা: সৎ, চিৎ ও আনন্দ। এই তিনটি ভাব প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের তিনটি শক্তি। সৎভাবে যে শক্তি (সন্ধিনী) ক্রিয়া করে তার ফল জগৎসৃষ্টি, জগতের কর্মপ্রবাহ ও কর্মপ্রবৃত্তি। চিৎ শক্তির (সৎচিৎ) বলে ঈশ্বর জীবজগতকে সচেতন রাখেন এবং আনন্দ ভাবের শক্তির (হ্লাদিনী) দ্বারা তিনি জগতকে আনন্দিত রাখেন।

ঈশ্বরের তিন ভাব মানুষ কিভাবে লাভ করবে? বলা হচ্ছে মানুষ (জীব) ব্রহ্মের অংশ। যেহেতু জীব ব্রহ্মের অংশ সেহেতু জীবের মধ্যেও এই তিন ভাব বিদ্যমান, তবে অস্ফুট। জীব তাই কর্ম, জ্ঞান ও প্রেম (ভক্তি) শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে ঈশ্বরকে পেতে পারে। সেই জন্যই গীতায় এই তিন সাধন পদ্ধতির সমাবেশ ঘটেছে। বলা হচ্ছে কর্ম ঈশ্বরমুখী হলেই ইহা বিশুদ্ধ হয়ে নিষ্কাম কর্মযোগ হয়। জ্ঞান ও ভাবনা ঈশ্বরমুখী হলেই তা জ্ঞানযোগ হয়। আনন্দভাব ঈশ্বরমুখী হলেই তা ভক্তিযোগ হয়।

৯. গীতার দর্শন: গীতার দর্শন অদ্বৈতবাদী। গীতা দ্বৈতবাদ সমর্থন করে না। গীতা শুধু অধিবিদ্যা (ব্রহ্মবিদ্যা) নয় পাঠ বিনয়ও (যোগশাস্ত্র)। যোগ শব্দটি ‘যুজ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন; তার মানে যোজনা করা। যোগ মানুষের মানসিক শক্তিগুলোকে সংহত করে, সামঞ্জস্য বিধান করে, তাকে উন্নত করে। গীতায় বৃহৎ, সহজগম্য, বহুমুখী ও ব্যাপক যোগশাস্ত্র পাওয়া যায়।

১০. অবতারবাদ ও কৃষ্ণ কৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়। বিষ্ণু কে? বিষ্ণু বেদের সামান্য একজন দেবতা। তিনি বেদের প্রধানতম দেবতা নন। বিশ্বাস করা হয় এই বিষ্ণুই নরাকারে কৃষ্ণ। তিনিই ব্রহ্ম, পৃথিবীতে দেহী ও জাত রূপে আপাত প্রতীয়মান।

১১. গীতার সাথে মহাযান পন্থার সম্পর্ক: অনেকের মতে গীতার সাথে বৌদ্ধ মহাযান পন্থার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বলা হয় বস্তুত জ্ঞানমূলক বৌদ্ধধর্মের সন্ন্যাসবাদের সঙ্গে গীতোক্ত ভক্তিবাদ ও নিষ্কাম কর্মের সংযোগ করে উক্ত কর্মের যে সংস্কার সাধিত হয় তাই মহাযান পন্থা নামে অভিহিত। এমনও বিশ্বাস করা হয় যে, বৌদ্ধধর্মের সন্ন্যাসবাদ ও গীতার ভক্তিবাদ এ দুটোই খ্রিস্টধর্মের মূলতত্ত্ব।

১২. গীতা সম্পর্কে মতপার্থক্য প্রবল: গীতার রচনাকাল, বিষয়বস্তু ও রচনাকার ইত্যাদি সম্পর্কে প্রচুর মতভেদ বিদ্যমান। এর কারণ এতে বিভিন্ন ধরনের দার্শনিক তত্ত্ব ও ধর্মবাদ মিলিত হয়েছে। অনেক আপাত বিরোধী বক্তব্যও আছে। যেমন গীতায় নিরীশ্বরবাদী সাংখ্য-বেদান্তাদি দার্শনিক মত এবং কর্ম, যোগ, জ্ঞান ও প্রতীকোপাসনা ইত্যাদি পরস্পর বিরোধী সাধনমার্গের সমাবেশ ঘটেছে। আবার এসব মতবাদকে কালোপযোগী ও সরল করার চেষ্টাও লক্ষণীয়। কিন্তু মতভেদের বীজ থেকেই গেছে।

১৩. গীতার একটি কথাও নতুন নয়: পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে গীতা ভগবদ্‌গীতা হিসেবে পরিচিত। কারণ গীতার বাণী স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী। আমরা জানি ভগবান নিজেই স্রষ্টা, তাঁর অজানা কিছু নেই, তাঁর অজ্ঞাত কিছু নেই। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সকল জ্ঞানের আধার। এমতাবস্থায় কখনও অন্যের কথা ধার করে বলার প্রয়োজন ভগবানের হয় না। অথচ গীতায় উক্ত শ্রীভগবানের বাণীগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে শ্রীকৃষ্ণ সব ধার করা কথা বলছেন। একটি বাণী বা কথারও কোনো মৌলিকত্ত্ব নেই। জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘গীতার ভগবান’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন কিভাবে গীতার বাণীগুলো গীতা থেকে অনেক প্রাচীনতর। অর্থাৎ গীতায় শ্রীভগবানের সকল বাণীই প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে জানা ছিল। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হল:

ক. আত্মা-পরমাত্মা সংক্রান্ত গীতার বক্তব্যগুলো গীতার আগে রচিত কঠোপনিষদের অনেক শ্লোকের সাথে হুবহু মিলে যায়।

খ. একাদশ অধ্যায়ে বিশ্বরূপ দর্শনের বর্ণনার সংগে গীতার থেকে প্রাচীনতর শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের অনেক শোকের মিল গভীর। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে একেশ্বরবাদের কথা বলা হয়েছে। সেখানে অবশ্য ঈশ্বর হচ্ছেন রুদ্র শিব। গীতায় তা বদল করে শুধু বিষ্ণুকে (তার অবতার শ্রীকৃষ্ণ) বসিয়ে দিলেই বক্তব্যগুলোর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পণ্ডিতগণের মতে শ্রীগীতা প্রকৃতপক্ষে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের পরিমার্জিত রূপ মাত্র।

গ. গীতার পূর্বে রচিত ‘মনুস্মৃতির’ চাতুর্বর্ণ, স্বধর্ম-স্বকর্ম, শূদ্র ও নারীর অবস্থান সংক্রান্ত বিধি ইত্যাদির সাথে গীতার ভগবানের বাণীর হুবহু মিল রয়েছে।

ঘ. বৈদিক যুগ থেকে (গীতার চেয়ে প্রাচীনতর) চলে আসা কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ডের দ্বন্দ্ব, বিভিন্ন উপনিষদে আলোচিত আত্মা-পরমাত্মা সম্পর্ক, মোক্ষতত্ত্ব, ধর্মপদ ও সূতনিপাত প্রভৃতি বৌদ্ধ-গ্রন্থে স্থিতপ্রজ্ঞের বর্ণনা ও আদর্শ আচরণ বিধি, ধর্মশাস্ত্রে বিধৃত বর্ণধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থা, কপিলের সাংখ্যদর্শন, প্রাচীনতর ভগবত ধর্মের ভক্তি দর্শন ইত্যাদি প্রাচীনতর বিষয়ই শ্রীভগবান গীতায় ব্যবহার করেছেন।

ঙ. গীতার চেয়ে প্রাচীনতর নিরীশ্বরবাদী সাংখ্যদর্শনের গভীর প্রভাব রয়েছে গীতাতে। গীতায় কেবল নিরীশ্বরবাদকে ঈশ্বরবাদী করা হয়েছে।

চ. একইভাবে গীতার একাদশ থেকে অষ্টাদশ অধ্যায়ে বর্ণিত ধর্ম বৈষ্ণবপন্থী ভক্তিধর্মের অনুকরণ মাত্র।

ছ. গীতায় বর্ণিত পৌরাণিক কাহিনীগুলো এবং কল্পনার ঘটনাগুলো গীতা রচনার বহুকাল আগে থেকেই ভারতে প্রচলিত ছিল।

১৪. শ্রীকৃষ্ণের মুখে দুই রকমের পরস্পর বিরোধী কথা: পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, গীতায় অনেক পরস্পর বিরোধী মতবাদ সন্নিবেশিত হয়েছে অর্থাৎ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মত দিয়েছেন। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হল:

ক. কোথাও শ্রীকৃষ্ণ বৈদিক যাগ-যজ্ঞাদি ও বেদবাদের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন, আবার কোথাও তিনি বলছেন যজ্ঞাবশিষ্ট ‘অমৃত’ ভোজনে ব্ৰহ্মলাভ হয়।

খ. কোথাও বলা হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে বেদ নিষ্প্রয়োজন। আবার অন্যত্র বেদের গুণ কীর্তন করা হয়েছে।

গ. বলা হয়েছে ‘আমি সর্বভূতেই সমান, আমার প্রিয়ও নেই, দ্বেষ্যও নেই।’ আবার অন্য বলা হচ্ছে ‘আমার ভক্তই প্রিয়’।

ঘ. কোথাও শ্রীকৃষ্ণ বলছেন জ্ঞানেই মুক্তি, আবার কোথাও বলেছেন পরমপুরুষ কেবল ভক্তি দ্বারাই লভ্য।

ঙ. কোথাও শ্রীকৃষ্ণ যোগাভ্যাসের দ্বারা নির্বাণের কথা বলছেন, আবার কোথাও স্বকর্ম (স্বধর্ম) দ্বারা সিদ্ধিলাভ করার কথা বলেছেন।

চ. শ্রীকৃষ্ণ বারবার বলছেন নিষ্কাম কর্মের কথা। বলছেন ফলের আশা না করে, আসক্তি বা কামের বশবর্তী না হয়ে কাজ করার কথা। বিপরীতে দেখা যাচ্ছে আত্মার অমরতা, কালের অমোঘ গতি, জ্ঞান-ভক্তি-কর্মভিত্তিক নিষ্কাম কর্ম, অবতারতত্ত্ব ও ঈশ্বরের আত্মসমর্পণ ইত্যাদি ধর্মোপদেশ দিয়ে তিনি যখন অর্জুনকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ তখন শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের ফল দেখিয়ে (ব্যক্তিগত প্রলোভন দেখিয়ে) অর্জুনকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে উপদেশ দেন। উদাহরণস্বরূপ গীতায় দেখা যাচ্ছে তিনি অর্জুনকে বলছেন: (যুদ্ধে) হত হলে স্বর্গলাভ করবে, আর জিতলে পৃথিবী ভোগ করবে। অতএব, কৌন্তেয়, যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হয়ে উঠে পড়ো। সুখদুঃখ, লাভলোকসান এবং জয়পরাজয়কে সমান মনে করে যুদ্ধের জন্যই যুদ্ধ করো, তবেই তোমার পাপ হবে না। কেউ কেউ অবশ্য এসবকে পরস্পর বিরোধী মনে করেন না। তাদের মতে এগুলো হচ্ছে সমগ্রের আলাদা আলাদা প্রকাশ।

১৫. ভগবদ্‌গীতা বর্ণভেদ প্রথা ও জাতিভেদ প্রথা সমর্থন করে : জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যয়ের মতে (সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভগবদ্‌গীতা: এলাইড পাবলিশার্স লি: কলকাতা, ১৯৯৭) ব্রাহ্মণ্যধর্মের বর্ণভেদ প্রথা ও বর্তমান হিন্দুধর্মের মূল স্তম্ভ জাতিভেদ প্রথা গীতার দ্বারা প্রচারিত ধর্ম কর্তৃক সমর্থিত। ঋগ্বেদের পুরুষসূক্ত, বেদাংগের অঙ্গীভূত ধর্মসূত্র ও মনুস্মৃতি ইত্যাদির মতে বর্ণধর্ম ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট। একই মত গীতায় শুধু সমর্থিত নয়, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বয়ান দিয়ে এই নির্মম, নিষ্ঠুর, অমানবিক অসাম্যকে দৃঢ়মূল করা হয়েছে। অর্জুন কেন যুদ্ধ করবেন না তার কারণ হিসেবে বর্ণসংকরের ভয়ঙ্কর দিকের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যুদ্ধ হলে কুলক্ষয় হবে, কুলস্ত্রীরা ভ্রষ্টা হবে, ফলে বর্ণসংকরের উৎপত্তি হবে। ধর্ম উৎসন্নে যাবে। আর মূলধর্ম নষ্ট হলে নরকে যেতে হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের এই বক্তব্য জোরালোভাবে সমর্থন করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, যুদ্ধ করলে বর্ণাশ্রম ধর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বরং যুদ্ধ বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার জন্যই। আর বর্ণাশ্রম ধর্মে ক্ষত্রিয়ের কাজ যুদ্ধ করা।

গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বর্ণভেদের পক্ষে এবং বর্ণসংকরের বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলছেন যে, তিনি নিজে ভগবান হয়েও কর্ম করছেন। তিনি বলছেন তিনি যদি কর্ম না করতেন তাহলে বর্ণসংকরের কর্তা হতেন এবং প্রজারা বিনষ্ট হতো। এতে বোঝা যাচ্ছে যে চাতুর্বর্ণভিত্তিক আর্থসামাজিক কাঠামোকে অটুট এবং চিরায়ত রাখা, আর সে উদ্দেশ্যে বর্ণসংকর প্রতিরোধ করবার জন্যই ঈশ্বর নিয়ত কৰ্ম করে চলেছেন। গীতার চতুর্থ অধ্যায়েও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সরাসরি বলছেন যে, চাতুর্বর্ণ্য সমাজ তিনি নিজেই সৃষ্টি করছেন। কেউ কেউ বলতে চান যে গীতার চাতুর্বর্ণ প্রথা গুণ ও কর্মভিত্তিক, বংশগত নয়। কিন্তু ঋগ্বেদ, ধর্মসূত্র, মনুসংহিতা ও গীতার বক্তব্য এক সাথে মিলিয়ে পড়লে বোঝা যায় যে ব্রাহ্মণ্যধর্মের বর্ণভেদ প্রথার স্বাভাবিক পরিণতিই বংশগত জাতিভেদ যা আজও হিন্দুরা বিশ্বাস করে চলছে।

১৬. গীতার মতে শূদ্ররা পাপযোনি সম্ভূত: শ্রীমদ্ভাগবতগীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন যে তাঁকে আশ্রয় করে স্ত্রীলোক, বৈশ্য, শূদ্র এসব পাপাযোনিরা পর্যন্ত পরম গতি পায়, পূণ্যকর্ম ব্রাহ্মণ আর ভক্তিসম্পন্ন ক্ষত্রিয় তো পায়ই। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনসাধারণ অর্থাৎ শূদ্র এবং স্ত্রীলোক ও বৈশ্যদের সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণ এমন অবমাননাকর উক্তি করতে পারেন তা ভাবতে অবাক লাগে। বিশেষ করে তিনি যখন নিজেকে গীতায় বারবার ভগবান বলে দাবি করছেন। মজার ঘটনা এতদসত্ত্বেও শূদ্র ও বৈশ্যরা (ব্যবসায়ী) শ্রীকৃষ্ণকে আজকের দিনেও ভগবান হিসেবেই পূজা করেন। আরও লক্ষণীয় শ্রীকৃষ্ণকে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা অকাতরে টাকাও খরচ করেন।

অনেকেই বলতে চান গীতা রচনাকালে সমাজে প্রচলিত নানা ধরনের মত ও ধর্মকে শ্রীকৃষ্ণ একটি সমন্বিত রূপ দেন গীতায়। কিন্তু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে গীতার রচয়িতারা শ্রীকৃষ্ণকে আশ্রয় করে, তাকে ভগবানের (স্রষ্টার) আসনে বসিয়ে, তার মুখ দিয়ে বাণী বের করে প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পুনর্বাসিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এ প্রসঙ্গে জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায় লিখছেন:

গীতার শ্রীভগবান ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবক্তাদের দ্বারা সৃষ্ট কল্পিত চরিত্র মাত্র, ঈশ্বরের অবতার অথবা অন্য কোন ঐতিহাসিক মানুষ নন। জনসাধারণের বিপুল গরিষ্ঠ অংশের ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধিতার ফলে সমকালীন আর্যসভ্যতা যে গভীর সংকটের সম্মুখীন হয়েছিলো, সে ঐতিহাসিক সংকট থেকে পরিত্রাণ পাবার উদ্দেশ্যে একদিকে বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, ম্লেচ্ছ তথা ভূমিপুত্র অনার্যদের বিভিন্ন ধর্ম-উপধর্ম এবং নাস্তিকতাবাদের কঠোর সমালোচনা করে, আর অন্যদিকে মনুস্মৃতির সংগে বৌদ্ধধর্ম ও ভগবত ধর্মের কিছু ইতিবাচক বক্তব্যকে সমন্বিত করে ভগবদ্‌গীতা রচিত হয়েছিলো; আর তা আরোপিত হয়েছিলো শ্রীভগবান চরিত্রের মুখে। গীতাকারদের আশা ছিলো যে এভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্মের টোটাল আইডিওলজিকে, বিশেষত চাতুর্বর্ণ এবং শূদ্র ও নারীর হীনস্থান আর ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শ্রেণীর রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভুত্ব এবং আর্থিক শোষণকে বিস্তারিত এবং চিরায়িত করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ গীতার শ্রীভগবান শুধু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শ্রেণী দ্বারা আবিষ্কৃত এবং প্রতিষ্ঠিত শোষণ-শাসনের ধর্মীয় হাতিয়ার মাত্র।

১৭. সঞ্জয় শূদ্র সন্তান : গীতার সমস্ত বয়ান বা বাক্যই সঞ্জয়-বাক্য। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র প্রশ্ন করছেন, যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চাইছেন এবং প্রত্যুত্তরে সঞ্জয় বর্ণনা দিচ্ছেন। সঞ্জয় ব্যাসদেব কর্তৃক প্রদত্ত দিব্যদৃষ্টির বলে যুদ্ধ অবলোকন করেন ও যুদ্ধকালীন সময়ে দুইপক্ষের বাক্যালাপ শুনেন ও তাদের মনোভাব পরিজ্ঞাত হন। সেই মোতাবেক তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের বর্ণনা দেন। এ হেন সঞ্জয় কিন্তু শূদ্র সন্তান।

১৮. কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতাঃ কৃষ্ণের ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে প্রবল দ্বিমত আছে। কারও কারও মতে কৃষ্ণ একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি। আবার কেউ কেউ বলেন কৃষ্ণ বলতে কেউ ছিলেন না। কেউ কেউ বলেন কৃষ্ণ বস্তুত তিনজন। গীতায় অবশ্য কৃষ্ণকে পরমেশ্বরের সাথে অভিন্নরূপে ধরা হয়েছে। প্রশ্ন: ঈশ্বর আবার ঐতিহাসিক ব্যক্তি হন কিভাবে? জন্মগ্রহণ, দেহধারণ ঈশ্বরের বেলায় খাটে না। কিন্তু দেখা যায় হিন্দুরা ঈশ্বর ও ব্যক্তিকে এক করার জন্য একটি তত্ত্বের ব্যবহার করে। তারা বলে জীবাত্মা ও বিশ্বাত্মা অভিন্ন। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে হিন্দুরা দেহধারী অনেক দেবতা/ঈশ্বর তৈরি করে নেয়। এর জন্য তারা বৌদ্ধ কর্তৃক প্রবর্তিত অবতার-বাদতত্ত্ব ব্যবহার করে।

১৯. শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে কিছু তথ্য: নিচে সুধীর চন্দ্র সরকারের পুস্তক ‘পৌরাণিক অভি- ধান’কে ভিত্তি করে কৃষ্ণ সম্পর্কে কিছু তথ্য দেওয়া হল:

ক. কৃষ্ণ কংসকে নিহত করেন ও কারারুদ্ধ উগ্রসেনকে মুক্ত করে মথুরার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন।

খ. কৃষ্ণ-বলরাম বিদর্ভ রাজের স্বয়ংবর-সভায় উপস্থিত হয়ে রুক্মিণীকে হরণ করেন। রুক্ষ্মিণী রাজা শিশুপালের বাগদত্তা ছিলেন। রুক্মিণীর গর্ভে কৃষ্ণের প্রদ্যুম্ন প্রমুখ দশ জন পুত্র ও চারুমতি নামে এক কন্যা হয়। রুক্মিণী ভিন্ন কৃষ্ণের জাম্ববতী, সুশীলা, সত্যভামা ও লক্ষ্মণা নামে চারিটি প্রধানা স্ত্রী এবং ষোল হাজার অপ্রধানা স্ত্রী ছিলেন।

গ. কৃষ্ণ পাণ্ডবদের মাতুলপুত্র। কুন্তী কৃষ্ণের পিতৃসা।

ঘ. কৃষ্ণের পরামর্শ-ক্রমেই বনবাসকালে অর্জুন তাঁর ভগিনী সুভদ্রাকে হরণ করে বিবাহ করেন।

ঙ. মগধরাজ জরাসন্ধ কৃষ্ণের মহাপরাক্রান্ত শত্রু ছিলেন। তাঁর ভয়ে কৃষ্ণকে মথুরা ত্যাগ করে রৈবতক পর্বতের নিকট কুশস্থলীতে আশ্রয় নিতে হয়। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞের পূর্বে কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন ছদ্মবেশে মগধে যান ও সেখানে কৃষ্ণের পরামর্শানুযায়ী ভীম মলযুদ্ধে জরাসন্ধকে বধ করেন।

চ. যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসাবে ভীষ্ম কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দান করায় কৃষ্ণের পিতৃসার পুত্র চেদিরাজ শিশুপাল কৃষ্ণের নিন্দা করেন। পূর্বে কৃষ্ণ শিশুপালের শত অপরাধ মার্জনা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। এইবার তিনি চক্রদ্বারা শিশুপালের শিরশ্ছেদ করেন।

ছ. কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে কুরুপাণ্ডব উভয়পক্ষই সাহায্যপ্রার্থী হয়ে দ্বারকায় কৃষ্ণের নিকট আসেন। কৃষ্ণ তখন নিদ্রিত ছিলেন। প্রথমে দুর্যোধন কৃষ্ণের শিয়রে এসে বসেন ও পরে অর্জুন এসে কৃষ্ণের পাদদেশে করজোড়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। কৃষ্ণ জাগ্রত হয়ে প্রথমে অর্জুন ও পরে দুর্যোধনকে দেখেন এবং উভয় কর্তৃক নিজ নিজ পক্ষে যোগদান করতে অনুরুদ্ধ হন। কৃষ্ণ তখন বললেন যে, যদিও দুর্যোধন আগে এসেছেন, তবু অর্জুনকেই তিনি আগে দেখেছেন। অতএব উভয়পক্ষকেই তিনি সাহায্য করবেন। একদিকে কৃষ্ণের দশকোটি দুর্ধর্ষ নারায়ণী সেনা ও অপরদিকে তিনি স্বয়ং নিরস্ত্র ও যুদ্ধ-বিমুখ এই দুই পক্ষের মধ্যে নির্বাচনের জন্য বয়ঃকনিষ্ঠ বলে আগে অর্জুনকেই বেছে নিতে বললেন তিনি। অর্জুন কৃষ্ণকেই বরণ করলেন ও দুর্যোধন নারায়ণী সেনা নিলেন।

জ. দ্রোণ-বধের জন্য যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যাভাষণের পরামর্শ ও অন্যায় যুদ্ধে দুর্যোধনের উরুভঙ্গের পরামর্শ দিতে তিনি কুণ্ঠিত হন নি।

ঝ. কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করবার প্রতিজ্ঞা সত্ত্বেও তৃতীয় দিনের যুদ্ধে ভীষ্মের পরাক্রম দেখে তিনি স্বয়ং সুদর্শনচক্র হস্তে ভীষ্মকে বধ করতে অগ্রসর হন। ভীষ্ম সানন্দে তাঁকে অভ্যর্থনা করেন এবং অর্জুন সানুনয়ে তাঁকে নিবৃত্ত করেন। ভগদত্তের বৈষ্ণবাস্ত্র নিবারণ করে তিনি অর্জুনের প্রাণরক্ষা করেন। জয়দ্রথ, দ্রোণ ও কর্ণবধ কৃষ্ণের সাহায্য ভিন্ন সম্পন্ন হ’ত না। অশ্বত্থামা ব্রহ্মশির নিক্ষেপে উত্তরার গর্ভস্থ সন্তান পরীক্ষিৎকে নিহত করলে, কৃষ্ণ তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন।

ঞ. জ্ঞাতিযুদ্ধ নিবারণে সমর্থ হয়েও কৃষ্ণ তা না করায় গান্ধারী তাকে অপঘাত-মৃত্যুর অভিশাপ দেন। দেখা যায় এক ব্যাধের শরে বিদ্ধ হয়ে কৃষ্ণের মৃত্যু হয়।

ট. কৃষ্ণের দ্বারকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়।

ঠ. কৃষ্ণের বংশ যদুবংশ পরস্পরকে হত্যা করে ধ্বংস হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *