মহাভারত : রাজ্যের জন্য জ্ঞাতিযুদ্ধ
জনপ্রিয় দুটো ভারতীয় মহাকাব্যের মধ্যে মহাভারত একটি। অনেকের কাছে এটি প্রাচীন ভারতের একটি ছবি। কারো কারো কাছে এটি ভারতের সামাজিক ইতিহাস। আবার অনেকের কাছে তা ভারতের প্রাচীনতম মহাকাব্য। আবার অনেক লোকের কাছে মহাভারত একটি ধর্মগ্রন্থ। যে যেভাবেই গ্রহণ করুক না কেন এ কথা সত্যি যে মহাভারত প্রাচীন কাহিনী, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অমূল্য ভাণ্ডার। বলা হয় যা নেই মহাভারতে, তা নেই ভূ-ভারতে। কমপক্ষে দু-তিন হাজার বছর যাবত মহাভারতের নানা উপাখ্যান কোটি কোটি মানুষের মনোরঞ্জন করে আসছে। মহাভারত এ অঞ্চলের মানুষকে যেমন ধর্মতত্ত্ব শিখিয়েছে, তেমনি সাহিত্যিক-দেরকে যুগিয়েছে সাহিত্য সৃষ্টির অফুরন্ত উপাদান। মহাভারতের নানা কাহিনী আজও কাজ করছে লোকশিক্ষার অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে। এ গ্রন্থের বীরদের উদাহরণ অনেক লোকের কাছে একটি আদর্শ। মহাভারতের নায়কদের অনেক বক্তব্য আজও প্রবাদ হিসেবে কাজ করে।
যদিও সকলের কাছেই আকর্ষণীয় একটি গ্রন্থ তথাপি বিরাট কলেবরের মহাভারত সকল পাঠকের পক্ষে ধৈর্য্য ধরে পড়া সম্ভব নয়। অথচ সকলেই জানতে চান এতে কী আছে। এ কথা মনে রেখে নিচে মহাভারতের সংক্ষিপ্ত একটি পরিচয় তুলে ধরা হল। উল্লেখ্য এটি করতে গিয়ে রাজশেখর বসু কর্তৃক বাংলায় অনুদিত মহাভারতের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করা হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য গ্রন্থকারের মহাভারতের সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যবহৃত ভাষাই ব্যবহার করা হয়েছে।
১. মহাভারতের রচয়িতা ও রচনাকাল: কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এই গ্রন্থের রচয়িতা বলে মহাভারতে উল্লেখিত হয়েছে। ব্যাসদেব প্রকৃতপক্ষে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতা। অর্থাৎ মহাভারতের যুদ্ধ ব্যাসদেবের নাতিদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ। ব্যাসদেব তাঁর পৌত্রের প্রপৌত্র জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে নিজের শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত পাঠের আদেশ দেন। গোঁড়া পণ্ডিতগণের মতে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের কাল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের কাছাকাছি এবং তার কিছুকাল পরে মহাভারত রচিত হয়। ইওরোপীয় পণ্ডিতগণের মতে আদিগ্রন্থের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে। খ্রিস্টজন্মের পরেও তাতে অনেক অংশ যোজিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের কাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩০ বা ১৪৩০। তিলক ও অধিকাংশ আধুনিক পণ্ডিতগণের মতে প্রায় ১৪০০। ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘যুদ্ধের অনল্প পরেই আদিম মহাভারত প্রণীত হইয়াছিল বলিয়া যে প্রসিদ্ধি আছে তাহার উচ্ছেদ করিবার কোনও কারণ দেখা যায় না। ‘বর্তমান মহাভারতের সমস্তটা এককালে রচিত না হলেও এবং তাতে বহু লোকের হাত থাকলেও সমগ্র রচনাই এখন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের নামে চলে।
২. মহাভারতের বিষয়বস্তু: কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মহাভারতের কাহিনী আবর্তিত। কাহিনীর কেন্দ্রে যুদ্ধকে রেখে মহাভারতে ভরত বংশের ইতিহাস, যুদ্ধের বর্ণনা, নানা প্রাচীন উপাখ্যান, ধর্মকথা ও গীতা ইত্যাদির বিপুল সমাবেশ ঘটানো হয়েছে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটি সংঘটিত হয় কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে। পক্ষ দুটোর নাম কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষ হলেও প্রকৃতপক্ষে উভয়পক্ষই কুরু বংশের লোক অর্থাৎ কৌরব। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু দুই ভাই। দু’জনই প্রকৃতপক্ষে ব্যাসদেবের সন্তান যদিও তারা বিচিত্রবীর্যের সন্তান বলে পরিচিত। যুদ্ধ সংঘটিত হয় ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর সন্তানগণের মধ্যে। মজার ঘটনা দৃশ্যত যদিও জানা যাচ্ছে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর সন্তানদের মধ্যে যুদ্ধ, প্রকৃতপক্ষে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ কেউ তার ঔরসজাত নন, তেমনি নন পাণ্ডবগণও পাণ্ডুর ঔরসজাত। মহাভারতের বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে পিতা বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর সাধারণ ঐতিহ্যে রাজা হওয়ার কথা জ্যেষ্ঠ পুত্র ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু তিনি অন্ধ হওয়ায় তাঁকে রাজা না করে রাজা করা হয় কনিষ্ঠ পুত্র পাণ্ডুকে। পাণ্ডুর মৃত্যুতে ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যলাভ করেন। ইতিমধ্যে পাণ্ডুর পাঁচ সন্তান (পঞ্চ পাণ্ডব) শত্রুতা ও ঈর্ষার কারণে রাজ্য ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফিরে এসে তাঁরা রাজ্যের কিছু অংশ ফেরত পান এবং সুখেই দিন কাটান। কিন্তু যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের সাথে পাশা খেলায় হেরে যাওয়ায় পুনরায় তারা ১২ বছরের জন্য বনবাসে যেতে বাধ্য হন। তারা আবার রাজ্যে ফিরে আসলে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। সেই থেকেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সূত্রপাত।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ চলে মাত্র ১৮ দিন। যুদ্ধ শেষে জীবিত ছিলেন মাত্র দশজন। এর মধ্যে পাণ্ডবপক্ষে সাতজন যথা: যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, শ্রীকৃষ্ণ ও সাত্যকি। কৌরবপক্ষের জীবিতরা ছিলেন কৃপাচার্য, কৃতবর্মা ও অশ্বত্থামা।
৩. মহাভারতের কয়েকটি প্রসিদ্ধ চরিত্র: মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র হচ্ছে : মূল আখ্যানের ব্যাস, শান্তনু, ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী, বিদুর, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদী, দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি, কৃষ্ণ, সত্যভামা, বলরাম, শিশুপাল, শল্য, অম্বা-শিখণ্ডী এবং উপাখ্যান বর্ণিত দেবযানী, শর্মিষ্ঠা, বিপুলা, নল, দময়ন্তী, ঋষ্যশৃঙ্গ, সাবিত্রী প্রভৃতি। নিচে এদের কয়েকজনের পরিচয় রাজশেখর বসুর গ্রন্থ থেকে তুলে দেওয়া হল :
ক. কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস: ব্যাসদেব বিচিত্রবীর্যের বৈপিত্র ভ্রাতা এবং ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতা। তিনি কৃষ্ণবর্ণ ছিলেন। তাঁর রূপ, বেশ ও গন্ধ কুৎসিত ছিল। তিনি শান্তনু থেকে আরম্ভ করে জনমেজয় পর্যন্ত সাতপুরুষ ধরে জীবিত ছিলেন। ইনি মহাজ্ঞানী সিদ্ধপুরুষ, কিন্তু সুপুরুষ মোটেই নন। শাশুড়ী সত্যবতীর অনুরোধে অম্বিকা ও অম্বালিকা অত্যন্ত বিতৃষ্ণায় ব্যাসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। অম্বিকা চোখ বুজে ভীষ্মাদিকে ভেবেছিলেন বলে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেন। অম্বালিকা ভয়ে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন বলে পাণ্ডু পাণ্ডুর বর্ণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ব্যাস তৃতীয়বার মিলিত হতে চাইলে অম্বিকা ও অম্বালিকা চাকরানি পাঠিয়ে দেন। এই মিলনের ফল হচ্ছে বিদুর। এভাবেই ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু- বিদুরের জন্মদাতা ব্যাসদেব।
খ. ভীষ্ম : শান্তনু রাজার পুত্র। তিনি দ্যূতসভায় দ্রৌপদীকে রক্ষা করেন নি। ভীষ্ম যুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দেন এবং পরিশেষে পাণ্ডবদের হিতার্থে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তাঁর কামুক পিতার জন্য কুরুরাজ্যের উত্তরাধিকার ত্যাগ করেন। চিরকুমারব্রত নিয়ে দুই অপদার্থ বৈমাত্রেয় ভ্রাতা চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের অভিভাবক হন, এবং আজীবন নিষ্কামভাবে ভ্রাতার বংশধরদের সেবা করেন। তাঁর পিতৃ-ভক্তি অনুকরণীয়, কিন্তু অনুপযুক্ত কারণে তিনি অসাধারণ ত্যাগ স্বীকার করেন। ভীষ্ম তাঁর ভ্রাতার জন্য কাশীরাজের তিন কন্যাকে স্বয়ংবরসভা থেকে হরণ করেছিলেন, কিন্তু জ্যেষ্ঠা অম্বা শাল্বরাজের অনুরাগিণী জেনে তাঁকে সসম্মানে শাল্বের কাছে পাঠিয়ে দেন। অভাগিনী অম্বা সেখানে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সংকল্প করেন যে তিনি ভীষ্মের বধসাধন করবেন।
গ. ধৃতরাষ্ট্র : ধৃতরাষ্ট্র অব্যবস্থিতচিত্ত, তাঁর নীচতা আছে, উদারতাও আছে। দুর্যোধন তাঁকে সম্মোহিত করে রেখেছিলেন। অস্থিরমতি হতভাগ্য অন্ধ বৃদ্ধের ধর্মবুদ্ধি মাঝে মাঝে জেগে ওঠে, তখন তিনি দুর্যোধনকে ধমক দেন। সংকটে পড়লে তিনি বিদুরের কাছে মন্ত্রণা চান, কিন্তু স্বার্থত্যাগ করতে হবে শুনলেই চটে ওঠেন। ধৃতরাষ্ট্রের আন্তরিক ইচ্ছা যুদ্ধ না হয় এবং দুর্যোধন যা অন্যায় উপায়ে দখল করেছেন তা বজায় থাকে। কৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদূত হয়ে হস্তিনাপুরে আসেন তখন ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে ঘুষ দিয়ে বশে আনবার ইচ্ছা করেন। দারুণ শোক পেয়ে জীবনের শেষদিকে তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত হয়, যুধিষ্ঠিরকে তিনি পুত্রতুল্য জ্ঞান করতেন।
ঘ. গান্ধারী : গান্ধারী মনস্বিনী, তিনি পুত্রের দুর্বৃত্ততা ও স্বামীর দুর্বলতা দেখে শঙ্কিত হন, ভর্ৎসনাও করেন, কিন্তু প্রতিকার করতে পারেন না। শতপুত্রের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরের উপর তাঁর অতি স্বাভাবিক বিদ্বেষ হয়েছিল, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। পরিশেষে তিনিও পাণ্ডবগণকে পুত্রতুল্য জ্ঞান করতেন।
ঙ. কুন্তী : কুন্তী দৃঢ়চরিত্রা তেজস্বিনী বীরনারী, দ্রৌপদীর যোগ্য শাশুড়ী। যখনই মনে করেছেন যে পুত্রেরা নিরুদ্যম হয়ে আছে তখনই তিনি তীক্ষ্ণ বাক্যে তাঁদের উৎসাহিত করেছেন। উদ্যোগপর্বে কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, ‘পুত্র, তুমি মন্দমতি, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের ন্যায় কেবল শাস্ত্র আলোচনা করে তোমার বুদ্ধি বিকৃত হয়েছে, তুমি কেবল ধর্মেরই চিন্তা করছ।’
চ. যুধিষ্ঠির : যুধিষ্ঠির অর্জুনের তুল্য কীর্তিমান নন, কিন্তু তিনিই মহাভারতের নায়ক ও কেন্দ্রস্থ পুরুষ। তিনি নির্বোধ নন, কিন্তু দ্যূতপ্রিয়তা (জুয়া), উদারতা ও ধর্মভীরুতার জন্য সময়ে সময়ে তিনি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তিনি যুদ্ধপটু নন। দ্রোণবধের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণের প্ররোচনায় তিনি মিথ্যা বলেছেন। তবে সাধারণত পাপপুণ্যের সূক্ষ্ম বিচার করে তিনি কর্ম করেন। এজন্য দ্রৌপদী আর ভীমের কাছে তাঁকে বহু ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে। বার বার তাঁর মুখে বৈরাগ্যের কথা শুনে ব্যাসদেবও বিরক্ত হয়ে তাঁকে ভর্ৎসনা করেছেন। যুধিষ্ঠির দৃঢ়চিত্ত, যা সংকল্প করেন তা করেন। কপট উপায়ে দ্রোণবধের জন্য অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করেছিলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠির তাতে অনুতপ্ত হন নি। অশ্বত্থামা যখন নারায়ণাস্ত্রে পাণ্ডবসৈন্য বধ করছিলেন তখন অর্জুনকে নিশ্চেষ্ট দেখে যুধিষ্ঠির দ্রোণের অন্যায় কার্যাবলীর উল্লেখ করে ব্যাঙ্গ করে বললেন, ‘আমাদের সেই পরম সুহৃৎ নিহত হয়েছেন, অতএব আমরাও সবান্ধবে প্রাণত্যাগ করব।’ ভীম নাভির নিম্নে গদাপ্রহার করে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করলেন দেখে বলরাম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ভৎর্সনা করে চলে গেলেন। তখন যুধিষ্ঠির বিষণ্ন হয়ে কৃষ্ণকে বললেন, ‘ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আমাদের উপর বহু অত্যাচার করেছে, সেই দারুণ দুঃখ ভীমের হৃদয়ে হয়েছে, এই চিন্তা করে আমি ভীমের আচরণ উপেক্ষা করলাম।’ যুধিষ্ঠিরের মহত্ত্ব সবচেয়ে প্রকাশ পেয়েছে শেষ পর্বে। তিনি স্বর্গে এলে ইন্দ্র তাঁকে ছলক্রমে নরকদর্শন করতে পাঠালেন। যুধিষ্ঠির মনে করলেন তাঁর ভ্রাতারা ও দ্রৌপদী সেখানেই যন্ত্রণাভোগ করছেন। তখন তিনি স্বর্গের প্রলোভন ও দেবতাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে বললেন, ‘আমি ফিরে যাব না, এখানেই থাকব।’ ছ. ভীম: ভীমকে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘রক্তপ রাক্ষস।’ যুধিষ্ঠিরের মুখে অশ্বত্থামার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ শুনে দ্রোণ যখন অবসন্ন হয়েছেন তখন ভীম নির্মম ভাষায় দ্রোণকে তিরস্কার করেন। ভীম কর্তৃক দুঃশাসনের রক্তপানের বিবরণ ভীষণ ও বীভৎস। ভীম তাঁর বৈমাত্র ভ্রাতা হনুমানের মত আরাধ্য হতে না পারলেও জনপ্রিয় হয়েছেন। চমৎকার কুযুক্তি দিতে পারতেন। বনবাসে তের মাস যেতে না যেতে তিনি অধীর হয়ে পড়েন। ভীম মাংসলোভী পেটুক ছিলেন এবং তাঁর গোঁফদাঁড়ির অভাব ছিল। কর্ণ তাঁকে ঔদরিক আর তুবরক (মাকুন্দ) বলে খেপাতেন। ধৃতরাষ্ট্রাদির অপরাধ ভীম কখনই ভুলতে পারেন নি। যুধিষ্ঠিরের আশ্রিত পুত্রহীন জ্যেষ্ঠতাতকে কিঞ্চিৎ অর্থ দিতেও তিনি আপত্তি করেন। তাঁর গঞ্জনা সইতে না পেরেই ধৃতরাষ্ট্র বনে যেতে বাধ্য হন।
জ. অর্জুন : অর্জুন মহাভারতের বীরগণের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনি কৃষ্ণের সখা ও মন্ত্রশিষ্য, প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকির অস্ত্রশিক্ষক, নানা বিদ্যায় বিশারদ এবং অতিশয় রূপবান। মহাকাব্যের নায়কোচিত সমস্ত লক্ষণ তাঁর আছে, এই কারণে এবং অত্যধিক প্রশস্তির ফলে তিনি কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছেন। অর্জুন ধীর প্রকৃতি, কিন্তু মাঝে মাঝে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। কর্ণপর্বে যুধিষ্ঠির তাঁকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, তোমার গাণ্ডীব ধনু অন্যকে দাও। তাতে অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে কাটতে গেলেন, অবশেষে কৃষ্ণ তাঁকে শান্ত করলেন। কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের পূর্বক্ষণে কৃষ্ণ অর্জুনকে গীতার উপদেশ শুনিয়েছিলেন।
ঝ. দ্রৌপদী: দ্রৌপদী সীতা-সাবিত্রীর সম্মান পান নি। কিন্তু তিনি সর্ব বিষয়ে অসামান্যা। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে অন্য কোনও নারী তাঁর তুল্য জীবন্ত রূপে চিত্রিত হন নি। তিনি অতি রূপবতী, কিন্তু শ্যামাঙ্গী সেজন্য তাঁর নাম কৃষ্ণা। একবার সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ তাঁকে হরণ করতে আসেন। তখন বয়সের হিসাবে দ্রৌপদী যৌবনের শেষ প্রান্তে, তথাপি জয়দ্রথ তাঁকে দেখে বলছেন, ‘এ’কে পেলে আর বিবাহের প্রয়োজন নেই, এই নারীকে দেখে মনে হচ্ছে অন্য নারীরা বানরী।’ তিনি অসহিষ্ণু তেজস্বিনী, স্পষ্টবাদিনী, তীক্ষ্ণ বাক্যে নিষ্ক্রিয় পুরুষদের উত্তেজিত করতে পারেন। তাঁর বাগ্মিতার পরিচয় অনেক স্থানে পাওয়া যায়। বহু কষ্ট ভোগের কারণে মঙ্গলময় বিধাতায় তাঁর আস্থা ছিল না। তবু দ্রৌপদী মাঝে মাঝে তাঁর পঞ্চ স্বামীকে বাক্যবাণে পীড়িত করেন, স্বামীরা তা নির্বিবাদে সয়ে যান। তাঁরা দ্রৌপদীকে সম্মান ও সমাদর করেন। দ্রৌপদী পাঁচ স্বামীকেই ভালবাসেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে অনেক জ্বালিয়েছেন, তথাপি দ্রৌপদী তাঁর জ্যেষ্ঠ স্বামীকে ভক্তি করেন, অনুকম্পা ও কিঞ্চিৎ অবজ্ঞাও করেন। বিপদের সময় দ্রৌপদী ভীমের উপরেই বেশি ভরসা রাখেন। নকুল-সহদেবকে তিনি দেবরের ন্যায় স্নেহ করেন। অর্জুন তাঁর প্রথম অনুরাগের পাত্র, পরেও বোধ হয় অর্জুনের উপরেই তাঁর প্রকৃত প্রেম ছিল। দ্রৌপদীর একটি বৈশিষ্ট্য কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর স্নিগ্ধ সম্বন্ধ। তিনি কৃষ্ণের সখী এবং সুভদ্রার ন্যায় স্নেহভাগিনী, সকল সংকটে কৃষ্ণ তাঁর শরণ্য ও স্মরণীয়।
ঞ. দুর্যোধনঃ দুর্যোধন মহাভারতের প্রতিনায়ক। তিনি রাজ্যলোভী বা প্রভুত্বলোভী ও ধর্মজ্ঞানহীন। তিনি আমৃত্যু পাণ্ডবদের অনিষ্ট করেছেন, নিজেও ঈর্ষা ও বিদ্বেষে দগ্ধ হয়েছেন। তাঁর দুই মন্ত্রণাদাতা কর্ণ ও শকুনি। দুর্যোধন নিয়তিবাদী। রাজা দুর্যোধন প্রজাদের প্রতি কোনও দুর্ব্যবহার করেন নি। যুধিষ্ঠির স্বর্গে গিয়ে দুর্যোধনকে দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। নারদ তাঁকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, ইনি ক্ষত্রধর্মানুসারে যুদ্ধে নিজ দেহ উৎসর্গ করে বীরলোক লাভ করেছেন, মহাভয় উপস্থিত হলেও ইনি কখনও ভীত হন নি।’
ট. কর্ণ: বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘কর্ণচরিত্র অতি মহৎ ও মনোহর।’ কর্ণচরিত্রে নীচতা ও মহত্ত্ব দুইই দেখা যায়। বহু রচয়িতার হাতে পড়ে কর্ণচরিত্রের এই বিপর্যয় ঘটেছে।। কর্ণপর্ব ১৮-পরিচ্ছেদে অর্জুনকে কৃষ্ণ বলেছেন, ‘জতুগৃহদাহ, দ্যূতক্রীড়া এবং দুর্যোধন তোমাদের উপর যত উৎপীড়ন করেছেন সে সমস্তেরই মূল দূরাত্মা কর্ণ।
ঠ. কৃষ্ণ: মহাভারতে সবচেয়ে রহস্যময় পুরুষ কৃষ্ণ। বহু হস্তক্ষেপের ফলে তাঁর চরিত্রেই বেশি অসংগতি ঘটেছে। মূল মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণকে ঈশ্বর বললেও সম্ভবত তাঁর আচরণে অতিপ্রাকৃত ব্যাপার বেশি দেখান নি। সাধারণত তাঁর আচরণ গীতাধর্ম ব্যাখ্যাতারই যোগ্য। কিন্তু মাঝে মাঝে তাঁর যে বিকার দেখা যায় তা ধর্মসংস্থাপক পুরুষোত্তমের পক্ষে নিতান্ত অশোভন, যেমন ঘটোৎকচবধের পর তাঁর উদ্দাম নৃত্য এবং দ্রৌণবধের উদ্দেশ্যে যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যাভাষণের উপদেশ। মহাভারত পাঠে বোঝা যায় কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব বহুবিদিত ছিল না। কৃষ্ণপুত্র শাম্ব দুর্যোধনের জামাতা; দুর্যোধন তাঁর বৈবাহিককে ঈশ্বর মনে করতেন না। সর্বত্র ঈশ্বররূপে স্বীকৃত না হলেও কৃষ্ণ বহু সমাজে অশেষ শ্রদ্ধা ও প্রীতির আধার ছিলেন এবং রূপ শৌর্য বিদ্যা ও প্রজ্ঞার জন্য পুরুষ-শ্রেষ্ঠ গণ্য হতেন। তিনি রাজা নন, যাদব অভিজাততন্ত্রের একজন প্রধান মাত্র, কিন্তু প্রতিপত্তিতে সর্বত্র শীর্ষস্থানীয়। তথাপি কৃষ্ণদ্বেষীর অভাব ছিল না।
৪. মহাভারতের সময়কার সমাজ: মহাভারত পাঠে প্রাচীন সমাজ ও জীবনযাত্রার যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সবাই প্রচুর মাংসাহার করতেন। ভদ্রসমাজে মদ্যপান প্রচলিত ছিল। গোমাংসভোজন ও গোমেধ যজ্ঞের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। অস্পৃশ্যতা ছিল কম, দাসদাসীরা অন্ন পরিবেশন করত। মহাভারতের সর্বত্রই যুবতীবিবাহ দেখা যায়। রাজাদের অনেক পত্নী এবং দাসী বা উপপত্নী থাকত। বর্ণসংকরত্বের ভয় ছিল, কিন্তু সংকরবর্ণের লোক ছিল প্রচুর। অনেক বিধবা সহমৃতা হতেন, আবার অনেকে পুত্রপৌত্রাদির সঙ্গে থাকতেন। নারীর মর্যাদার অভাব ছিল না, কিন্তু সময়ে সময়ে তাঁদেরও দানবিক্রয় এবং জুয়াখেলায় পণ রাখা হতো। ভূমি, ধনরত্ন, বস্ত্র, যানবাহন প্রভৃতির সঙ্গে রূপবতী দাসীও দান করার প্রথা ছিল। উৎসবে শোভাবৃদ্ধির জন্য বেশ্যা নিযুক্ত হতো। ব্রাহ্মণরা প্রচুর সম্মান পেতেন। কিন্তু তারা তুমুল তর্ক করতেন বলে লোকে তাদের উপহাসও করত। দেবপ্রতিমার পূজা প্রচলিত ছিল। রাজাকে দেবতুল্য জ্ঞান করা হতো। প্রজারক্ষা করেন না এমন রাজাকে ক্ষিপ্ত কুকুরের ন্যায় বিনষ্ট করা উচিত বলেও বিশ্বাস করা হতো। অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান ছিল অতি বীভৎস। মহাভারতের কালে নরবলি চলত।
৫. মহাভারতকালীন যুদ্ধের নিয়মাবলি: যুদ্ধের নিয়মাবলিতে দেখা যায় নিরস্ত্র বা বাহনচ্যুত শত্রুকে মারা অন্যায় বলে গণ্য হতো। নিয়মলঙ্ঘন করলে যোদ্ধা নিন্দাভাজন হতেন। স্বপক্ষ বা বিপক্ষের আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। সূর্যাস্তের পর অবহার বা যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হতো। অবশ্য সময়ে সময়ে রাত্রিকালেও যুদ্ধ চলত। যুদ্ধ হতো নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে। যুদ্ধভূমির নিকট বেশ্যাশিবির থাকত। বিখ্যাত যোদ্ধাদের রথে চার ঘোড়া জোতা হতো। ধ্বজদণ্ড রথের ভিতর থেকে উঠত, রথী আহত হলে ধ্বজদণ্ড ধরে নিজেকে সামলাতেন। অর্জুন ও কর্ণের রথ শব্দহীন ছিল। দ্বৈরথ যুদ্ধের পূর্বে বাগযুদ্ধ হতো। বিপক্ষের তেজ কমাবার জন্য দুই বীর পরস্পরকে গালি দিতেন এবং নিজের গর্ব করতেন। বিখ্যাত রথীদের চতুর্দিকে রক্ষী যোদ্ধারা থাকতেন। পিছনে একাধিক শকটে রাশি রাশি শর ও অন্যান্য ক্ষেপণীয় অস্ত্র থাকত। মনে হয় পদাতিক সৈন্য ধনুর্বাণ নিয়ে যুদ্ধ করতো না। তাদের বর্মও থাকত না। এই কারণেই রথারোহী বর্মধারী যোদ্ধা একাই বহু সৈন্য শরাঘাতে বধ করতে পারতেন।
৬. মহাভারতে ঘটনাগত অসংগতি: প্রাচীনকালে প্রচলিত বিভিন্ন কিংবদন্তী যোজনার ফলে মহাভারতে প্রচুর ঘটনাগত ও চরিত্রগত অসংগতি দেখা যায়। বহু রচয়িতার হস্ত ক্ষেপ সম্ভবত এর একটি কারণ। দেখা যাচ্ছে মহামতি দ্রোণাচার্য একলব্যকে তার আংগুল কেটে দক্ষিণা দিতে বলছেন, অর্জুন তাতে খুশি। জতুগৃহ থেকে পালাবার সময় পাণ্ডবরা বিনা দ্বিধায় এক নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রকে পুড়ে মরতে দেন। দুঃশাসন যখন চুল ধরে দ্রৌপদীকে দ্যূতসভায় টেনে নিয়ে এল তখন দ্রৌপদী আকুল হয়ে বললেন,”ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর আর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কি প্রাণ নেই? কুরুবৃদ্ধগণ এই দারুণ অধর্মাচার কি দেখতে পাচ্ছেন না? প্রত্যুত্তরে ভীষ্ম বললেন, ধর্মের তত্ত্ব অতি সূক্ষ্ম, আমি তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পারছি না। বীরশ্রেষ্ঠ কর্ণ অম্লানবদনে যখন দুঃশাসনকে বললেন, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কর তখন মহাপ্রাজ্ঞ ভীষ্ম আর মহাতেজস্বী দ্রোণ চুপ করে বসে ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব ভাবতে লাগলেন। ভীষ্ম দ্রৌণ কৌরবদের হিতসাধনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কিন্তু দুর্যোধনের দুষ্কর্ম সইতেও স্কি তাঁরা বাধ্য ছিলেন? তাঁদের কি স্বতন্ত্র হয়ে কোনও পক্ষে যোগ না দিয়ে থাকবার উপায় ছিল না? মহাভারতে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। যুদ্ধারম্ভের পূর্বক্ষণে যখন যুধিষ্ঠির ভীষ্মের পদস্পর্শ করে আশীর্বাদ ভিক্ষা করলেন তখন ভীষ্ম জানালেন কৌরবগণ অর্থ দিয়ে আমাকে বেঁধে রেখেছে, তাই আমি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে পারি না। দ্রোণ ও কৃপও অনুরূপ কথা বলেছেন। এদের মর্যাদাবুদ্ধি বা code of conduct পাঠকের পক্ষে বোঝা কঠিন। এরা কেউ পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাত গোপন করেন না, অথচ যুদ্ধকালে পাণ্ডবদের বহু নিকট আত্মীয় ও বন্ধুকে তাঁরা অসংকোচে বধ করেছেন।
৭. মহাভারত স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক ঘটনার বিচিত্র সংমিশ্রণ: রাজশেখর বসুর মতে মহাভারতকথা স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক ঘটনার বিচিত্র সংমিশ্রণ। পড়তে পড়তে মনে হবে আমরা এক স্বপ্নলোকে উপস্থিত হয়েছি। সেখানে দেবতা আর মানুষের মধ্যে অবাধে মেলামেশা হচ্ছে। ঋষিরা হাজার হাজার বৎসর ধরে তপস্যা করছেন এবং মাঝে মাঝে অপ্সরার পালায় পড়ে নাকাল হচ্ছেন। সেখানে যজ্ঞ করাই রাজাদের সবচেয়ে বড় কাজ। বিখ্যাত বীরগণ যেসকল অস্ত্র নিয়ে লড়েন তার কাছে আধুনিক অস্ত্র তুচ্ছ। লোকে কথায় কথায় শাপ দেয়। এই শাপ ইচ্ছা করলেও প্রত্যাহার করা যায় না। স্ত্রীপুরুষ অসংকোচে তাদের কামনা ব্যক্ত করে। পুত্রের এতই প্রয়োজন যে ক্ষেত্রজ (অন্যের ঔরসে) পুত্র পেলেও লোকে কৃতার্থ হয়। কিছুই অসম্ভব গণ্য হয় না। গরুড় গজকচ্ছপ খান, এমন সরোবর আছে যাতে অবগাহন করলে পুরুষ স্ত্রী হয়ে যায়। বসু আরও লিখছেন, মনুষ্যজন্মের জন্য নারীগর্ভ অনাবশ্যক, মাছের পেট, শরের ঝোঁপ বা কলসীতেও জরায়ুর কাজ হয়। কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব পাকা করবার জন্য মহাভারতের স্থানে অস্থানে তাঁকে দিয়ে কেউ কেউ অনর্থক অলৌকিক লীলা দেখিয়েছেন, কিংবা কুটিল বা বালকোচিত অপকর্ম করিয়েছেন। কেউ সুবিধা পেলেই মহাদেবের মহিমা কীর্তন করে তাঁকে কৃষ্ণের উপরে স্থান দিয়েছেন; কেউ বা গো-ব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য, ব্রত-উপবাসাদির ফল বা স্ত্রীজাতির কুৎসা প্রচার করেছেন, কেউ বা আষাঢ়ে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র উত্ত্যক্ত হয়ে ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এ ছাই ভস্ম মাথামুণ্ডের সমালোচনা বিড়ম্বনা মাত্র। তবে এ হতভাগ্য দেশের লোকের বিশ্বাস যে যাহা কিছু পুঁথির ভিতর পাওয়া যায় তাই ঋষিবাক্য, অভ্রান্ত, শিরোধার্য। কাজেই এ বিড়ম্বনা আমাকে স্বীকার করিতে হইয়াছে।’
৮. মহাভারত সংগ্রহগ্রন্থ বা কাব্য নয়, জাতির ইতিহাস: মহাভারতকে সংহিতা অর্থাৎ সংগ্রহ গ্রন্থ বলা হয়। কেউ কেউ একে পঞ্চম বেদ অর্থাৎ ধর্মগ্রন্থ হিসেবে অভিহিত করে। প্রাচীন খণ্ড খণ্ড আখ্যান ও ঐতিহ্য সংগ্রহ করে মহাভারত সংকলিত হয়েছে। এতে ভগবদ্গীতা প্রভৃতি দার্শনিক সন্দৰ্ভ আছে। মহাভারত অতি প্রাচীন সমাজ ও নীতি বিষয়ক তথ্যের অনন্ত ভাণ্ডার। পরলোক প্রভৃতি সম্বন্ধে প্রাচীন ধারণা কী ছিল তাও এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়। প্রচুর কাব্যরস থাকলেও মহাভারতকে মহাকাব্য বলা হয় না, ইতিহাস নামেই এই গ্রন্থ প্রসিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘ইহা কোনও ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস।’
৯. মহাভারতে ভূমিপুত্রদেরই (অন-আর্য) জয়জয়কার: মহাভারত লোকের কাছে ভরতবংশের ইতিহাস বলে খ্যাত। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় মহাভারত প্রকৃতপক্ষে সত্যবতী-দ্বৈপায়ন বংশের ইতিহাস। কে এই সত্যবতী ও দ্বৈপায়ন? সত্যবতী হচ্ছেন মহাভারতের রচয়িতা (প্রকৃতপক্ষে সংকলক) ব্যাসদেবের মাতা। সত্যবতীর কাহিনী পাঠ করলেই জানা যাবে মহাভারতের রচয়িতার জন্ম কাহিনী ও মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর কাহিনী। সুধীর চন্দ্র সরকারের ‘পৌরাণিক অভিধানে’ সত্যবতীর কাহিনীটি এভাবে লিপিবদ্ধ আছে: চেদি-রাজ উপরিচর বসু একদা মৃগয়াকালে তাঁর রূপবতী স্ত্রী গিরিকাকে স্মরণ করে কামাবিষ্ট হন এবং তাঁর স্খলিত শুক্র এক শ্যেনকে দিয়ে রাজমহিষীর নিকট প্রেরণ করেন। পথে অন্য এক শ্যেনের আক্রমণে এই শুক্র যমুনার জলে পড়ে ও ব্রহ্মশাপে মৎসীরূপিণী অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা এই জল পান করে গর্ভবতী হয় এবং দশম মাসে এক ধীবর কর্তৃক ধৃত হয়। ধীবর এই মৎসীর উদরে একটি পুরুষ ও একটি কন্যাশিশু পায় ও মৎসী শাপমুক্ত হয়। পুত্রের নাম হয় মৎস্য ও কন্যার নাম সত্যবতী। কিন্তু কন্যার গাত্রে মৎস্যের গন্ধ প্রবল ছিল বলে এঁর নাম হয় মৎস্যগন্ধা। বসুরাজের এই কন্যা ধীবরপালিতা হয়ে যৌবনে যমুনায় খেয়া পারাপারের কাজ করতেন। একদা তীর্থ পর্যটনরত পরাশর মুনি এঁর নৌকায় উঠে এঁর অপরূপ সৌন্দর্যে আসক্ত হয়ে তাঁর কাছে এক পুত্র প্রার্থনা করেন, এবং কুজ্বটিকা সৃষ্টি করে নদীর মধ্যে তাঁর সহিত সঙ্গম করেন। পরাশরের ঔরসে সদ্য গর্ভধারণ করে সত্যবতী কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকে প্রসব করেন। পরাশরের বরে পুত্র প্রসবের পরেও সত্যবতী কুমারীই থাকেন ও তাঁর দেহ সুগন্ধময় হওয়াতে তাঁর নাম হয় গন্ধবতী। এক যোজন দূর হতে তাঁর দেহের সুগন্ধ পাওয়া যেত বলে তাঁকে যোজন-গন্ধাও বলা হত। একদা হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু যমুনা তীরবর্তী বনে ভ্রমণ করবার সময়ে এঁর গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে এঁকে দেখে ও পরিচয় পেয়ে এঁর পালক পিতা দাসরাজার নিকট কন্যাকে প্রার্থনা করেন। দাসরাজের শর্ত ছিল যে, সত্যবতীর গর্ভজাত সন্তানকে রাজ্য দান করতে হবে। শান্তনু এই কথা শুনে অসম্মত হলেন; কারণ তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ভীষ্মকেই তিনি রাজ্যদান করবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু এই কথা শোনার পর ভীষ্ম তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হয়েও সিংহাসনের অধিকার ত্যাগ করে পিতার ইচ্ছা পূরণ করেন। সত্যবতী ও শান্ত নুর বিবাহের ফলে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়। কনিষ্ঠ পুত্র যৌবন লাভ করার পূর্বেই শান্তুনুর মৃত্যু হয়। ভীষ্ম সত্যবতীর মতানুসারে চিত্রাঙ্গদকে রাজ পদে প্রতিষ্ঠিত করেন। চিত্রাঙ্গদ গন্ধর্বরাজের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হলে বিচিত্রবীর্য রাজা হন। তাঁর সহিত কাশীরাজের কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার বিবাহ হয়; কিন্তু সাত বৎসর পরে বিচিত্রবীর্যের যক্ষ্মারোগে মৃত্যু হয়। পুত্রশোকার্তা সত্যবতী তাঁর দুই বধূকে সান্তনা দানের পর রাজ্য ও বংশ-রক্ষার জন্য ভীষ্মকে ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে বলেন, নতুবা বিবাহ করে স্বয়ং রাজা হতে বলেন। ভীষ্ম পূর্ব প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে সত্যবতীর কথায় অসম্মত হলে তিনি তাঁর কুমারী কালে জাত পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকে আহ্বান করেন এবং মাতার নির্দেশে দ্বৈপায়ন অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুকে উৎপাদন করেন। কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধ আরম্ভ হবার পূর্বে পুত্র ব্যাসদেবের প্রেরণায় সত্যবতী বনবাসিনী হয়ে তপশ্চর্যায় নিযুক্ত থাকেন। এইভাবে তাঁর শেষ জীবন অতিবাহিত হয়। ওপরের বর্ণনা থেকে দেখা যাচ্ছে সত্যবতীর জন্ম মৎস্যরূপী অপ্সরার গর্ভে। ধীবর কর্তৃক পালিতা তিনি। তাঁর সাথে পরাশর মুনির মিলনের ফল হচ্ছে ব্যাসদেব। আবার সত্যবতীর সাথে শান্তনুর রাজার বিয়ের সন্তান হচ্ছে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। বিচিত্রবীর্যের স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকার সাথে ব্যাসদেবের মিলনের ফসল হচ্ছেন যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। মহাভারতের যুদ্ধের দুইপক্ষ যদি ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর সন্তানগণ হন তাহলে কি এই যুদ্ধটি ব্যাসদেবের নাতিদের মধ্যে হয় না? এবং হয় না কি তা সত্যবতী-ব্যাসের বংশের কাহিনী। এটি অবলোকন করেই প্রতিভা বসু লিখছেন:
সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করলে মনে হয়, মহাভারতের গল্প বহিরাগত আর্যশাসকদের বিরুদ্ধে অনার্য, কৃষ্ণবর্ণ, বর্ণসংকর, জাতিবৈষম্যে বিড়ম্বিত দেশবাসীর অন্তিম প্রতিশোধ। শুদ্ধ শোণিতের গরিমালুপ্তির ইতিহাস। হিন্দুধর্মে যতোই জাতবিচারের প্রচলন থাক, ভারতবর্ষের মাটি থেকে যে রক্তের শুদ্ধতা বহু যুগ পূর্বেই ধুয়ে মুছে গেছে, ভরতবংশের এই মহিমান্বিত কাহিনী তার দলিল। মুনিঋষিই হোন, আর ক্ষত্রিয় রাজা- মহারাজাই হোন, এমনকি তথাকথিত দেবতারা পর্যন্ত, সত্যবতী- দ্রৌপদীর মতো কৃষ্ণাঙ্গী, রূপযৌবনবতী, অনার্যা রমণীদের চরণে নিজেদের উৎসর্গিত করেছেন। এবং মাতৃশাসিত সমাজের সেই সব প্রবল ব্যক্তিত্বশালিনী নারীদের সম্মোহনের কাছে আর্যপুত্ররা, তপস্বী ব্রাহ্মণেরা, জাতের শুদ্ধতা বিসর্জন দিতে মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করেন নি জাতের দোহাই দিয়ে একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে নেওয়া অথবা কর্ণকে দ্রৌপদীর প্রত্যাখ্যান, নেহাৎ-ই অর্জুনের স্বার্থে উদ্দেশ্য-প্রণোদিত ঘটনা। বহিরাগতদের সঙ্গে আদিনিবাসীদের মিশ্রণ অতি নিবিড় এবং গভীর ছিলো বলেই পেশাভিত্তিক জাতবিচারের প্রয়োজন হয়েছিলো, শোণিতের শুদ্ধতার প্রশ্ন সেখানে অবান্তর।