বিভ্রান্তিকর পদবি
‘বঙ্কিমচন্দ্র গড়গড়ি’ অথবা ‘শরৎচন্দ্র গড়গড়ি’ নামের কোনো সাহিত্যিকের সাথে আমরা পরিচিত নই। আমাদের পরিচয় সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে। কিন্তু সাহিত্য জগতের এই দুই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের পূর্ব পুরুষদের কেউ না কেউ যদি কোনো না কোনো একসময়ে পদবি পরিবর্তন না করতেন তাহলে হয়ত তাঁদের আমরা আজ ‘বঙ্কিমচন্দ্র গড়গড়ি’ অথবা ‘শরৎচন্দ্র গড়গড়ি’ হিসেবে পেতে পারতাম।
সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের বয়ানে অন্নদাশঙ্কর রায় বলছেন: চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, বন্দোপাধ্যায় ইত্যাদি পদবি দুই শতাব্দীর বেশি পুরোনো নয় (গ্রন্থ: দেখাশুনা: মিত্র ও ঘোষ: কলকাতা ১৩৯৫)। তার অর্থ এই পদবিগুলো নতুন। পুরোনো পদবি বর্জন ও নতুন পদবি গ্রহণ সম্পর্কে লোকেশ্বর বসুও একই মত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে (আমাদের পদবির ইতিহাস : আনন্দ পাবলিশার্স : ১৯৮১) বাঙালি হিন্দুদের সকলেই কোন না কোন এক সময়ে পদবি বদলেছেন অথবা নতুন পদবি গ্রহণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন বাঙালি ব্রাহ্মণদের আদি পদবি ছিল : গুড়, হড়, গড়গড়ি, খড়খড়ি, চম্পটি ও ঝম্পটি। রাঢ়ী ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের পর্কটি, পোড়ারি, তোড়ক ও গোচন্ড ইত্যাদি জাতীয় পদবি ছিল ১৫৯টি। আজকের দিনে এই পদবিগুলো প্রায় অবলুপ্ত। যুগে যুগে এই অবলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে।
আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের কুল পদবি ছিল কুশারী। সত্যজিত রায়দের তিন/চার পুরুষ আগেও পদবি ছিল ‘দেও’। ‘বাঙালীর ইতিহাস’ রচয়িতা ড. নীহাররঞ্জন রায়দের কুল পদবি ছিল সোম বা হোম। নীরদ সি চৌধুরীদের পদবি ছিল ‘নন্দী’। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বাংলাদেশের দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবদের কুল পদবি ছিল ‘পুরকায়স্থ’। বিখ্যাত লোকদের অথবা তাঁদের পূর্ব-পুরুষদের পদবি পরিবর্তনের এমন দৃষ্টান্ত অসংখ্য।
ইদানীংকালেও প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন কলামে পদবি পরিবর্তনের বিজ্ঞপ্তি দেখা যায়। যেমন কলকাতার দৈনিক ‘সংবাদ প্রতিদিন’ (১৮/৯/৯৮) এ প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তি মারফত জনৈক শ্যামল কান্তি মণ্ডল হয়েছেন শ্যামল কুমার চ্যাটার্জি। বস্তুত প্রায় প্রতিদিন এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি মারফত হিন্দুরা পদবি বদলাচ্ছেন। কিন্তু লক্ষণীয় কেউ পদবি একেবারে বর্জন করে পদবিশূন্য হচ্ছেন না। এই প্রক্রিয়ায় কে কখন কোন পদবি বর্জন করেছেন ও কোন নতুন পদবি গ্রহণ করেছেন তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তবে এটা নিশ্চিত যে, এই প্রক্রিয়ায় পুরোনো পদবির মৃত্যু হচ্ছে ও নতুন পদবি জন্ম নিচ্ছে। ঘটনাটি অনেকটা বাণিজ্যিক অফিসের মত। এ ক্ষেত্রে আগে দেখা যেত ‘এসিস্টেন্ট জেনারেল ম্যানেজার’ ও ‘ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার’ ইত্যাদি ডেজিগনেশন। আজকের দিনে এগুলোর বদলে চালু হচ্ছে ‘এসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট’ ও ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট’ ইত্যাদি। ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক অবনমন এবং মার্কিনিদের উত্থানই বোধ করি এর কারণ।
পরিবর্তনের মাধ্যমে গৃহীত নতুন পদবিগুলোর সাথে পুরোনো পদবিগুলো তুলনা করলে পদবি পরিবর্তনের কারণ বোঝা যায়। ওপরে প্রদত্ত ‘মণ্ডল’ থেকে “চ্যাটার্জি’ পদবি গ্রহণের উদাহরণ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, এখানে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা বৃদ্ধির একটা প্রচেষ্টা লুক্কায়িত। কারণ আজকের দিনে ‘মণ্ডল’ পরিচয়ে হিন্দু সমাজে মর্যাদা পাওয়া যায় না। বরং এক ধরনের অবজ্ঞার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ‘চ্যাটার্জি’ পরিচয়ে এই মর্যাদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়। কারণ ‘চ্যাটার্জিদের’ বিনা বিচারে ব্রাহ্মণ বলে ধরে নেওয়া হয়। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সাধারণভাবে পদবির নিরিখে সামাজিক ও ধর্মীয় মর্যাদা নির্ণয়ের যে একটা প্রবণতা আছে তার কারণেই এমনটি ঘটে। বিশ্বাস করা হয় পদবি দিয়েই ‘জাতি’ (কাস্ট) চিহ্নিত করা যায়। কারণ সাধারণের বিশ্বাস পদবি বংশগত ও পারিবারিক। পিতার পদবি সন্তানদের ওপর বর্তায় এবং তা পুরুষানুক্রমে চলে। কিন্তু কেউ এটা আমলেই নিতে চায় না যে, জাতি-বৰ্ণ অথবা গোত্র এর কোনোটাই পদবির সাথে সম্পর্কিত নয়।
পদবি ব্যবহার প্রাচীন কোনো রীতিও নয়। বেদের সংকলক বেদব্যাসের (ব্যাসদেব) কোনো পদবি নেই। রামায়ণের কথিত রচয়িতা বাল্মীকির পদবি কী? রামায়ণ অথবা মহাভারতের চরিত্রগুলোর নামে পদবির কোনো চিহ্ন নেই। রাজা দশরথের যেমন কোনো পদবি নেই তেমনি নেই তার পুত্র রামের। এদিকে গীতার কৃষ্ণও ‘কৃষ্ণ চন্দ্ৰ ঘোষ’ অথবা ‘কৃষ্ণ চন্দ্র বসু’ নন। পরবর্তী সময়ের পৌরাণিককালেও পদবি ব্যবহারের রীতি ছিল না। পাল যুগের (অষ্টম-দ্বাদশ শতাব্দী) সাহিত্যেও পদবি ব্যবহারের দৃষ্টান্ত বিরল। উদাহরণস্বরূপ সে যুগের কয়েকজন কবি হচ্ছেন : হরিভদ্র, গ্রহকুণ্ড, জ্ঞানশ্রীমিত্র, শীলভদ্র, শান্তিদেব, দানশীল, কুমারবজ্র, প্রজ্ঞাবর্মা ও বিরূপা প্রমুখ। লক্ষণ সেনের (দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী) সভাকবি ছিলেন : জয়দেব, ধোয়ী, শরণ ও উমাপতিধর। এইসব ক্ষেত্রে ভদ্র, কুণ্ড, মিত্র ইত্যাদি নামের অংশ, পদবি নয়। মেয়েরা আগের দিনে দেবী অথবা দাসী ইত্যাদি পরিচিতি নিত। তাদের দ্বারা পদবি ব্যবহারের দৃষ্টান্ত রীতিমত আধুনিক। এতদসত্ত্বেও আমরা মনে করি পদবি ব্যবহার একটি প্রাচীন রীতি। পদবির সাথে সাথে ‘জাতি’ভেদ প্রথাও প্রাচীন। এখানেই শেষ নয়। আমরা আরও মনে করি যে, জাতি ও পদবি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই ‘জাতি’ তত্ত্ব তো মানিই, পদবির ভিত্তিতে জাতি নির্ধারণেও আমরা প্রবল উৎসাহী।
‘জাতি’র সাথে পদবি অথবা পদবির সাথে ‘জাতি’কে সম্পর্কিত করা যে কত হাস্যকর তা আলোচনা করার অপেক্ষা রাখে না। একথা সুবিদিত যে, বাঙালির রক্তধারা এক। পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মতই বাঙালিও সংকর জাতি। সর্বোপরি মধ্যযুগের বৌদ্ধকাল হিসেবে নিলে জাতি তত্ত্বের কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ আজ থেকে সাত-আট শ’বছর পূর্বে বৃহত্তর বাঙালির সমাজ ছিল শ্রেণি-জাত (কাস্ট) বিহীন সমতল একটি বৌদ্ধ অথবা প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সমাজ। জাত (কাস্ট) বিহীন এই সমাজ কমপক্ষে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চালু ছিল। সুদীর্ঘ কালের পর হঠাৎ করে ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে কতগুলো ‘মিথ’ (অলৌকিক কাহিনী/পুরাণ) সৃষ্টি করে বাঙালির ঘাড়ে এই ‘জাতি’ (কাস্ট) তত্ত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়।
‘জাতি’ তত্ত্ব যেখানে ‘মিথ’ সেখানে এর সাথে পদবিকে সম্পর্কিত করা নিশ্চয়ই অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক। অথচ দেখা যাচ্ছে বাঙালি হিন্দু এই তত্ত্বকে বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করে নিচ্ছে। এই বিশ্বাস এতই সুদৃঢ় যে সাধারণ লোকের পক্ষে তা ভাঙ্গা খুবই কঠিন! অথচ মানুষ সামাজিক ও ধর্মীয় মর্যাদা চায়। তাই পদবি পরিবর্তনের মাধ্যমে সে এই মর্যাদা লাভের জন্য সহজ একটি পথ খুঁজে। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি পদবির কথা উল্লেখ করা যায়। যেমন ‘মিত্র’ ও ‘ঘোষ’। এই দুটো পদবি সামান্য পরিবর্তন করে ‘মৈত্র’ ও ‘ঘোষাল’ হওয়া খুব সহজ। এতে এক ধাক্কায় বিনা পরিশ্রমে প্রচলিত বিশ্বাসে একজন ব্রাহ্মণ হওয়া যায়। এইভাবে ‘দাস’ পদবি পরিবর্তন করে ‘দাশ’ হওয়া যায়। এতে তথাকথিত নিম্ন জাতি থেকে উচ্চতর ‘বৈদ্য’ জাতিতে উন্নীত হওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে এই ‘দাস’ থেকে ‘দাশ’ হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে-’নব্যহিন্দুরা’ (অন্নদাশঙ্কর রায়: বইয়ের ভূবন: দেশ: ২৪/১/৯৮)।
এদিকে ঘোষ (দস্তিদার), দেব (পুরকায়স্থ), দত্ত (বণিক) ও দেব (নাথ) ইত্যাদি পদবির লেজ কেটে অনায়াসে ‘কায়স্থে’ উন্নীত হওয়া যায়। অপর দিকে (সূত্র) ধর এবং (সাহা) রায় এর প্রথমাংশ ছেটে দিয়ে ‘ধর’ অথবা ‘রায়’ হওয়া যায়। এই পথটিই সহজ নয় কি? বাস্তবে ব্রাহ্মণ্য সমাজ কর্তৃক প্রবর্তিত জাতি-পদবির কঠোর বিধি-বিধান অতিক্রম করতে না পেরে হিন্দুগণ এই পরোক্ষ পথই বেছে নেয়। এই প্রেক্ষাপটে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হলে ‘জাতি’ ও পদবি বিষয়ক অস্পষ্ট ধারণার অবসান হতে পারে। এই বিষয়গুলো হচ্ছে: ১. একটি জাতি কর্তৃক বহু পদবি ব্যবহারের দৃষ্টান্ত ২. বহু জাতি কর্তৃক একই পদবি ব্যবহারের দৃষ্টান্ত এবং ৩. পদবির উৎস। নিচে এই বিষয়ে আলোচনা করা হল:
১. একই জাতি কর্তৃক বহু পদবি ব্যবহার: ইদানীংকালে গবেষণায় যে সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে পদবি পরিচয়ে ‘জাতি’ (কাস্ট) নির্ণয় খুবই বিভ্রান্তিমূলক। খগেন্দ্রনাথ ভৌমিক তাঁর গ্রন্থে (পদবির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস: সঞ্চয়ন প্রকাশনী কলকাতা : ১৯৯৭) যে তথ্য উপস্থাপিত করেছেন তা এই বিভ্রান্তি দূর করতে সাহায্য করবে। তিনি তাঁর গ্রন্থে বাঙালি হিন্দু কর্তৃক ব্যবহৃত প্রায় ৪,৫০০ পদবি সংকলিত করেছেন। এই সংকলন তালিকা থেকে দেখা যায় একই ‘জাতি’ (কাস্ট) বহু সংখ্যক ও বিভিন্ন ধরনের পদবি ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ নিচে কয়েকটি (২১টি) ‘জাতি’ কর্তৃক ব্যবহৃত পদবিসমূহের কিছু সংখ্যক পদবি উল্লেখ করা হল:
‘জাতি’ | পদবির সংখ্যা | কয়েকটি উদাহরণ |
উগ্রক্ষত্রিয় | ৯৪ | কর গুণ গুপ্ত গুহ ঘোষ দত্ত দাশ দে নন্দী ও বসু |
কর্মকার | ১৬৭ | অধিকারী আচার্য ঘোষাল ঠাকুর ত্রিবেদী দত্ত দাশ দে দেব ধর নন্দী ভৌমিক মিত্র শর্মা সেন ও হাজরা। |
কায়স্থ | ৩২৮ | আঢ্য আশ ওধ কণ্ঠ কুণ্ডু খাঁ গণ গুণ গুপ্ত গুড় গুছাইত ঘর চাকী তারণ দাঁ দাম নাথ পইপণ্ডিত পুরকায়স্থ বর্মা বল বসাক ব্রহ্ম ভঞ্জ মণ্ডল মলিক শীল শিকদার শ্যাম ও সেন। |
কৈবর্ত | ১১৫ | কর গুপ্ত দাশ দে ধর বাগচী ভাদুড়ী ভৌমিক মৈত্র সেন ও হাজরা। |
গন্ধবণিক | ৪১ | কর চন্দ চন্দ্র দত্ত দাস দে ধর নাগ পাল পোদ্দার ভদ্র সাহা সেন সিংহ ও হালদার। |
গোপ | ৮৯ | অধিকারী দাস ধর সেন হাজরা ও হালদার। |
তন্তুবায় | ৯০ | কর চন্দ দাশ দাস দে নন্দী পাল ভদ্র সাহা সেন ও হালদার। |
তিলি | ৯৫ | দাস দে নন্দী নাথ পাল পোদ্দার বিশ্বাস ভৌমিক রক্ষিত ও সাহা। |
নমঃশূদ্র | ৪৪৯ | অধিকারী আইচ কর কুন্ডু গাঙ্গুলী গুণ গুপ্ত গুহ গোস্বামী ঘোষ ঘোষাল চন্দ চক্রবর্তী ঠাকুর দত্ত দে দেবধর নিয়োগী পাণ্ডে পাঠক বসু বাগচী ব্যানার্জি ভট্টাচার্য মিশ্র মুখৰ্জি মৈত্র লহিড়ী ও সাহা। |
বারুজীবী | ৫২ | কর কুন্ডু গুহ ঘোষ দত্ত দে দেব ধর নন্দী নাগ পাল বসু বিশ্বাস ভদ্র সেন ও সোম। |
বৈদ্য | ৫৭ | কর কবিরাজ গুপ্ত দত্ত দাশগুপ্ত পুরকায়স্থ বকশি ভূঁইয়া মলিক ও সেনবৰ্মন। |
বৈশ্য সাহা | ৬৩ | দত্ত দাশ নন্দী পাল ভৌমিক সরকার সেন সোম ও হালদার। |
ব্রাহ্মণ | ৪১১ | অসস্তি আকাশ আঠবলে ওক ওতা কতারি কালী কাহালি খড়খড়ি গল্পী গড় গড়গড়ি গুড় গোচন্ড ঘন্টা চম্পটি চোদার ঝম্পটি ডিংসাই ঢেঁকি ঢোল তোড়ক তৈলবাটী দিমসাই নেনে নেউকী প্রচণ্ড বাগী শিহরি বিচু বেহারা মাঝি মাসচটক শিহরি শিমলাই শূল শুড়ঙ্গী ও হড়। |
মালী | ৬০ | অধিকারী আচার্য কর গোস্বামী ঘোষ চন্দ দত্ত দাশগুপ্ত দে দেব ধর নন্দী পাল বসু সেন সোম ও হাজরা। |
মাহিষ্য | ৩৩৬ | অধিকারী উকিল কর গোস্বামী দে ধর ও নিয়োগী। |
মোদক | ৭২ | কর চন্দ দত্ত দাশ দে নন্দী নিয়োগী ভদ্র মিত্র সাহা ও সেন। |
যোগী (রুদ্রজ ব্রাহ্মণ) | ১৪৬ | অধিকারী গঙ্গোপাধ্যায় গোস্বামী চক্রবর্তী চট্টোপাধ্যায় ঠাকুর বন্দোপাধ্যায় বাকচি ব্যানার্জি ভট্টাচার্য ভাদুড়ী মুখার্জি শৰ্মা শীল ও সান্ন্যাল। |
শাঁখারী | ১২ | কর দত্ত ধর নন্দী নাগ ভদ্র সেন ও সিংহ। |
সদ্গোপ | ২০৯ | গোস্বামী ঘটক ঘোষাল দত্ত দাস নন্দী নিয়োগী পণ্ডিত পাণ্ডে পাল মহাপাত্র সাহা ও সেন। |
সূত্রধর | ৫২ | কর চন্দ দত্ত দে ধর বসু বর্ধন ও সেন। |
সুবর্ণবণিক | ৩৯ | কর চন্দ দত্ত দে ধর নন্দী পাল সেন সিনহা সিংহ ও হোম। |
ওপরের তালিকাটি ভাল করে লক্ষ করলে দুটো বিষয় নজরে পড়ে। প্রথমত দেখা যায় একুশটি (২১) ‘জাতির’ প্রত্যেকটি সর্বনিম্ম বারোটি (১২) থেকে সর্বোচ্চ ৪৪৯টি পদবি ব্যবহার করে। দ্বিতীয়ত সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে যে সব ‘জাতিকে’ ‘নিচু’ বলে গণ্য করা হয় সে সব ‘জাতি’ উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পদবিও ব্যবহার করে। আবার যে সব ‘জাতি’কে উঁচু বলে ধারণা করা হয় সে সব ‘জাতি’ও এমন পদবি ব্যবহার করে যা আপাতদৃষ্টিতে অবজ্ঞার সৃষ্টি করে।
২. বহু জাতি কর্তৃক একই পদবি ব্যবহারঃ ভৌমিক কর্তৃক সংকলিত তথ্যকে বিপরীত দিক থেকেও বিচার করা যায়। কারণ দেখা যাচ্ছে একই ‘জাতির’ লোক যেমন অনেক পদবি ব্যবহার করে, তেমনি বিভিন্ন ‘জাতি’ও একই পদবি ব্যবহার করে। তাঁর সংকলিত ৫৯৭টি পদবি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সাধারণভাবে উঁচু সামাজিক মর্যাদা’ নির্দেশকারী পদবিগুলো বিভিন্ন ‘জাতি’ বা সম্প্রদায়ের লোকেরা ব্যবহার করে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হল :
পদবি | জাতি | সংখ্যা(টি) |
অধিকারী | কর্মকার কায়স্থ গোপ নমঃশূদ্র পৌন্ড্রক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব মাহিষ্য মালাকার যোগী রাজবংশী-ক্ষত্রিয় মালী শোলাঙ্কি সদগোপ সবিতৃ ও সভাসুন্দর। | ১৬ |
গঙ্গোপাধ্যায় | ব্রাহ্মণ ও যোগী। | ২ |
গাঙ্গুলী | নমঃশূদ্র ব্রাহ্মণ সবিতৃ। | ৩ |
চক্রবর্তী | নমঃশূদ্র পোন্ড্রক্ষত্রিয় ব্ৰাহ্মণ যোগী ও সবিতৃ। | ৫ |
চট্টোপাধ্যায় | ব্রাহ্মণ যোগী ও সবিতৃ। | ৩ |
ঠাকুর | কর্মকার কায়স্থ কুর্মিক্ষত্রিয় নমঃশূদ্র পাটনী বৈদ্য ব্রাহ্মণ যাদব যোগী ও সবিতৃ। | ১০ |
ত্রিবেদী | কর্মকার কায়স্থ ব্রাহ্মণ। | ৩ |
বন্দ্যোপাধ্যায় | পৌন্ড্রক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ যোগী ও সবিতৃ। | ৪ |
ব্যানার্জি/ব্যানার্জ্জী | নমঃশূদ্র ব্রাহ্মণ যোগী ও সবিতৃ। | ৪ |
ভট্টাচার্য্য | নমঃশূদ্র ব্রাহ্মণ যোগী ও সবিতৃ। | ৪ |
মিশ্র | কর্মকার কায়স্থ নমঃশূদ্র বৈদ্য ব্রাহ্মণ যাদব যোগী সবিতৃ। | ৮ |
মুখার্জ্জি/মুখার্জ্জী | নমঃশূদ্র ব্রাহ্মণ মলক্ষত্রিয় ও যোগী | ৪ |
মুখোপাধ্যায় | পৌণ্ড্র-ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ। | ২ |
শর্মা | কর্মকার কায়স্থ পৌন্ড্রক্ষত্রিয় বৈশ্যকপালী ব্রাহ্মণ যোগী ও সবিতৃ। | ৭ |
শাস্ত্রী | বৈদ্য বৈশ্যতেলি ব্রাহ্মণ ও যোগী। | ৪ |
সান্যাল | কর্মকার ব্রাহ্মণ যাদব যোগী ও সবিতৃ। | ৫ |
ওপরের পদবিগুলোর মধ্যে কেবল মাত্র ‘অধিকারী’ বাদ দিলে বাকি পদবিগুলো ব্রাহ্মণদের পদবি বলে বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু তথ্যে দেখা যাচ্ছে এই পদবিগুলো বহু ‘জাতি’র লোক ব্যবহার করছে। বস্তুত মনে হয় তথাকথিত নিচু-জাতির লোক এই পদবিগুলোকে আশ্রয় করে সময়ের ব্যবধানে ব্রাহ্মণ সমাজে আত্মীভূত হয়েছে। সম্ভবত বাঙালি হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণের সংখ্যাস্ফীতির এটাই অন্যতম প্রধান কারণ। দ্বিতীয়ত এই অবস্থায় কে আসল ব্রাহ্মণ আর কে নকল তা ধরার কোনো উপায় নেই। ব্রাহ্মণের পদবি বলে স্বীকৃত একটি পদবি একজন তথাকথিত নিচু সম্প্রদায়ের লোক গ্রহণ করলে তা ধরার কি কোনো উপায় আছে? বস্তুত তা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর গ্রন্থে (সংহতির সংকট : প্রবন্ধ : আপেল বনাম আপেল শকট : বাণী শিল্প: দ্বিতীয় সংস্করণ : ১৯৯৯) বলছেন : নমঃশূদ্রের পুরোহিতরা বাড়ুয্যে চাটুয্যে লাহিড়ী বাগচী পদবি ধারণ করছেন। তারাও ব্রাহ্মণ। অথচ ‘তফশিলভুক্ত’।
৩. পদবির উৎস : বাঙালি হিন্দুর পদবিগুলোর ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এই পদবিগুলোর সূত্রপাত অনেকগুলো উৎস থেকে। এই সাধারণ উৎসগুলোর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে ক. বৃত্তি খ. উপাধি গ. নামের শেষাংশ ঘ. গ্রাম ঙ. পশু-পক্ষী চ. গুণ ও ছ. আভিজাত্য ইত্যাদি। নিচে এগুলোর কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হল :
বৃত্তিমূলক : পোদ্দার কয়াল লস্কর (নস্কর) পণ্ডিত ঘটক পাঠক জ্যোতিষী (যোশী) কবিরাজ উকীল গায়েন বণিক ঢাকী বৈদ্য ও নাইয়া ইত্যাদি।
উপাধি : রায় চৌধুরী সরকার মজুমদার হাজারী হাজারা মণ্ডল বিশ্বাস হালদার খাঁ সামন্ত চাকলাদার মহলানবীশ তরফদার সেহানবীশ খাসনবীশ পত্রনবীশ বকশি মুনশি ও মুফি ইত্যাদি।
নামের শেষাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে : বিশ্বা (বসু) পৃথ্বি (বসু) বিশ্বা (মিত্র) শীল (ভদ্র) প্রভা (কর) সন্ধ্যা (কর) অশ্ব (ঘোষ) সমুদ্র (গুপ্ত) ও দেব (দত্ত) ইত্যাদি।
গ্রাম : ঘোষাল চট্টোপাধ্যায় মুখোপাধ্যায় ও বড়াল ইত্যাদি।
পশু পক্ষী বস্তু : সিংহ নাগ (সাপ) পাখী বসাক বুট হাতি ঢাক জাল সানকি চা দা দই দাঁড় ঘড়া মেষ খুর আটা টেংরা বাঘ কাক ছড়ি লাঙ্গল ধান কড়াই ও ঘুঘু ইত্যাদি।
গুণ : গুণ বল ভদ্র যশ ও করুণা ইত্যাদি।
আভিজাত্যসূচক : অধিকারী আঢ্য কীর্তি কোঙার ভদ্র যশ শীল সর্দার সাঁতরা সেনাপতি ও দিকপতি ইত্যাদি।
ওপরে মোট সাতটি উৎসের একটি পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এর বাইরেও অনেক উৎস আছে। উৎস যাই হোক না কেন একটি জিনিস বোঝা যায় যে, এই পদবিগুলোর সাথে কৌলীন্য, আভিজাত্য, রক্তের বিশুদ্ধতা ও ‘জাতি’র (কাস্ট) কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো সৃষ্ট হয়েছে নানা ঐতিহাসিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে। এতে নানা উদ্দেশ্য কাজ করেছে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য এখানে উদাহরণস্বরূপ অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি তাঁর গ্রন্থের “আত্মদ্বীপ প্রবোধ চন্দ্র” (নতুন করে ভাবা: দে’জ পাবলিশিং ১৯৯৯) প্রবন্ধে বলেছেন: পদবি থেকে অনুমান করা যায় যে, বাঙালি হিন্দুদের পূর্বপুরুষরা বৌদ্ধ ছিলেন। এই যেমন ঘোষ, বসু, মিত্র, দত্ত, কর, পালিত, সেন, গুপ্ত, নাথ, নন্দী, পাল, ভদ্র প্রভৃতি পদবি। এগুলো বল্লাল সেনের ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী বৌদ্ধ নামগুলোর শেষাংশ। তিনি আরও বলছেন : ব্রাহ্মণ ছাড়া আর সব জাতিই বৌদ্ধ ছিল। এখনও তার রেশ রয়েছে পদবিগুলোতে। অন্নদাশঙ্কর রায়ের যুক্তিকে খণ্ডন করা খুবই কঠিন। কারণ আমরা জানি আজ থেকে সাত/আট শতাব্দী আগে ‘কায়স্থ’ বলে কোনো সম্প্রদায়ই ছিল না। সম্প্রদায় না থাকলে পদবির প্রশ্নও ওঠে না। ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থানের পূর্বে এ দেশের ধর্ম ছিল বৌদ্ধ। এই বৌদ্ধরা গেল কোথায়? তারাই হিন্দুধর্মের অংশ হয়ে পূর্বতন নামের শেষাংশকে বিচ্ছিন্ন করে ধীরে ধীরে এগুলোকে তাদের পদবিতে রূপান্তরিত করে।
পদবির আর একটি বৈশিষ্ট্য এখানে আলোচনা করা দরকার। দেখা যায় প্রকৃত নাম ও পদবির মাঝে কিছু শব্দ অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই আলঙ্কারিক শব্দগুলো হচ্ছে : চন্দ্র, কুমার, লাল, নাথ, বরণ, রঞ্জন, ভূষণ ও বালা। বলা বাহুল্য এই অলঙ্কার ব্যবহারে পদবির কোনো পরিবর্তন হয় না। আবার এই অলঙ্কারগুলো নিজেরাই স্বাধীন পদবি হিসেবেও কাজ করে।
পরিশেষে একথা বোধ হয় আর বলার প্রয়োজন নেই যে, পদবির সাথে জাতির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু বলা দরকার পদবির জন্ম, মৃত্যু ও পরিমার্জন আছে। এই জন্ম, মৃত্যু ও অবলুপ্তির সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালি হিন্দু সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় উত্থান-পতনের ইতিহাস। এই ইতিহাস বড়ই করুণ ও বেদনাদায়ক। ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় ব্রাহ্মণ্য সমাজ জাতিভেদের মাধ্যমে কোনো শ্রেণির মানুষকে ওপরে তুলেছে এবং কোনো শ্রেণির মানুষকে নামিয়েছে নিচে। এই প্রক্রিয়ায় পদবিগুলোও অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে তারা রাজন্যবর্গের সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছে। নিজেদের আধিপত্য ও ক্ষমতা অটুট রাখার স্বার্থে ব্রাহ্মণ্য সমাজ জাতি ও পদবি দ্বারা হিন্দু সমাজকে করেছে বহুধা বিভক্ত। এমনকি নিজেদের সমাজকেও করেছে শতধা বিভক্ত। এই বেদনাদায়ক ইতিহাসের আড়ালে কত জনগোষ্ঠীর চোখের জল, মর্ম যাতনা ও মনস্তাত্ত্বিক পীড়া যে চাপা পড়েছে তা পরিমাপ করা কঠিন। কিন্তু এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এর জের আজো বাঙালি হিন্দু সমাজকে টানতে হচ্ছে।