বৈরি সমাজে হিন্দু ব্যবসায়ী

বৈরি সমাজে হিন্দু ব্যবসায়ী

বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে বৈষয়িক জগত সম্বন্ধে একটা স্ববিরোধিতা লক্ষ করা যায়। দেখা যায় অর্থের (টাকা) ক্ষেত্রে তারা রামকৃষ্ণের (গদাধর চট্টোপাধ্যায়) অনুসারী। তারা বিশ্বাস করে : টাকা (মানি) মাটি, মাটি টাকা’। অর্থাৎ টাকা-পয়সা অর্থহীন। টাকার পাশাপাশি ঋণ (ক্রেডিট) অথবা বাকি সম্বন্ধেও তাদের বিশ্বাস অনুরূপ। বাকি সম্বন্ধে তাদের ধারণা: ‘আজ নগদ, কাল বাকি। বাকির নাম ফাঁকি’। তারা গ্রাহকদেরকে বলে: ‘বাকি চেয়ে লজ্জা দেবেন না’। অথচ কে না জানে যে, অর্থ বা টাকা (পুঁজি) ছাড়া যেমন ব্যবসা হয় না, তেমনি বাকি (ক্রেডিট) ছাড়াও ব্যবসা হয় না। এটি জেনেও বাঙালি হিন্দু মনে করে ‘অর্থ ও বাকি’ দুটোই ফাঁকি। শংকরাচার্য্যের মত অনুসরণ করে তারা বলে: এই সংসার হচ্ছে মায়ার সংসার। আসল সত্য হল ‘ব্রহ্ম’। ‘ব্রহ্মে’ বিলীন হতে পারলেই কেবল মুক্তি।

অর্থ ও জীবন সম্বন্ধে হিন্দুর ভাব-সাব দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় বাঙালি হিন্দুর প্রত্যেকেই যেন এক একজন অর্জুন। মহাভারতের অর্জুন যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ-বিরোধী ও বৈরাগী, তেমনি বাঙালি হিন্দুও সংসার যুদ্ধে বৈরাগী ও চরম অর্থবিরোধী (এন্টি মানি)। অথচ জীবনের চারটি বর্গ তারই ধর্মের অঙ্গ। এই চারটি বর্গ হচ্ছে : ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। অর্থাৎ অর্থোপার্জন জীবনের দ্বিতীয় বর্গ। প্রথম বর্গ ধর্মের পরেই তার স্থান। কাম এবং মোক্ষ যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে। এটি অনুসরণ করেই বোধ হয় বলা হয় : ‘বাণিজ্যে বসতেঃ লক্ষ্মী’। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যই হচ্ছে লক্ষ্মীর বসতিস্থল। এই নীতি বাক্য অনুসরণের সময় তাদেরকে আবার মনে হয় রীতিমত ‘চার্বাকপন্থী’। চার্বাক যেমন ঈশ্বর, বেদ, যজ্ঞ, জাতি-ভেদ ও পরকাল মানতেন না, তেমনি বাঙালি হিন্দুও ব্যবসার ক্ষেত্রে ধর্ম-অধর্ম কিছুই মানতে চায় না। এক্ষেত্রে সে চার্বাকের মতই “ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ’ (ঋণ করে ঘি খাও, যতদিন বাঁচ সুখে বাঁচ) এর অনুসারী। এই পরস্পর বিরোধী অবস্থান কি স্ববিরোধিতা, না সামাজিক নানা শ্রেণির ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও মিলন অথবা বর্ণ-সংগ্রামের ফল?

১. বর্ণসংগ্রামে ব্যবসায়ী : আপাতদৃষ্টিতে ওপরে বর্ণিত অবস্থানগুলোতে স্ববিরোধিতা লক্ষ করা গেলেও বাস্তবে মনে হয় এতে লুক্কায়িত আছে সমাজের দুই শ্রেণির লোকের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও মতামত। এর একদিকে আছে ব্রাহ্মণ্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী এবং অন্যদিকে রয়েছে ব্যবসায়ী অথবা বৈশ্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী। ব্রাহ্মণ্য সমাজ মনে করে যজ্ঞকর্মেই মুক্তি। তাই তাদের কাছে ক্ষত্রিয়ের সভ্যতা নির্মাণের শক্তি, বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি অথবা শূদ্রের সাম্য শক্তির কোনো মূল্য নেই। বস্তুত এই তিন শক্তির ভয়ে ব্রাহ্মণ্য সমাজ থাকে সদা কম্পিত। তাই বলা হয় : ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’। এর দ্বারা ব্রাহ্মণ্য সমাজ প্রধানত টাকার শক্তিকে বিনাশ করতে চায় যাতে তার ক্ষমতা নিষ্কণ্টক হয়।

অপরদিকে বৈশ্যের কাছে টাকা বা সম্প্রসারণ শক্তি অর্থাৎ ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীই’ মুখ্য। বাকি শক্তি তার কাছে গৌণ। তাই অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে তার লোভ সীমাহীন। এ ধরনের অবস্থানে সাধারণভাবে ব্রাহ্মণ তার সাথে ক্ষত্রিয়কে পেতে চায় না পেলে সে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয় (ব্রাহ্মণ পরশুরাম কর্তৃক ২১ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয়করণের কথা স্মরণীয়)। অপরদিকে ক্ষত্রিয় চায় ব্রাহ্মণ ও বৈশ্য উভয়কে। এই অংকে শূদ্রের মূল্য নগণ্য। এই যে ক্ষমতার লড়াই তার পশ্চাতে কাজ করে হিন্দুর চার বর্ণের জটিল ও পারস্পরিক সম্পর্ক। কী সেই সম্পর্ক?

আমরা জানি হিন্দু সমাজ চার বর্ণের ভিত্তিতে গঠিত। এই চারটি বর্ণ হচ্ছে: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এই চারের মধ্যে প্রথমোক্ত তিনের সম্পর্কই ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ণয় করে। তাই কখনও কখনও ক্ষমতা ভোগ করে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় জোট, বৈশ্য করে সমর্থন। আবার কখনো কখনো ক্ষত্রিয়-বৈশ্য জোট ক্ষমতা ভাগাভাগি করে, ব্রাহ্মণ করে সমর্থন। তিনের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে একজন নীরব অংশীদার। অবশ্য এই লড়াইয়ে তিনের সমঝোতা নাহলে শূদ্রের ভাগ্য ফেরে। এই সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ছকে বৈদিক সমাজে ক্ষত্রিয়রাই ছিল রাজ্য শাসনের অধিকারী।

খ্রিস্ট-পূর্ব কালে মগধ রাজ্যের উত্থানে এর প্রথম ব্যতিক্রম ঘটে। শূদ্র বংশের নন্দ (৩২৬ খ্রিস্টপূর্ব) বিম্বিসার বংশীয়দের হাত থেকে ক্ষমতা দখল করে মগধে নন্দ বংশের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। নন্দদের পরে ক্রমান্বয়ে আসে মৌর্য্যবংশের চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য, বিন্দুসার ও বিন্দুসার পুত্র সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব ৩২২-২৬৯)। এরা আর্যগ্রন্থ বেদেই বিশ্বাস করত না। কারণ তারা ছিল জৈন-বৌদ্ধধর্মালম্বী। এতে বৈদিক আর্য কাঠামো ভেঙে পড়ে। তাই পুরাণগুলোতে আক্ষেপ শুরু হয়।

অশোকের পর অল্পদিনের জন্য ছিল ব্রাহ্মণ সুঙ্গবংশের (খ্রিস্টপূর্ব ১৮৭-১৪৮) রাজত্ব। ব্রাহ্মণরা এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সুঙ্গবংশের পর শুরু হয় কাণ্যবংশের রাজত্ব। এটি শেষ হয় ঠিক খ্রিস্টাব্দ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে। এর পরবর্তী কালের সঠিক কোনো ইতিহাস নেই। এই প্রেক্ষাপটে আসে কুশান বংশের কনিষ্ক। তিনি ছিলেন শৈব (বেদ বিরোধী)। এর বহুদিন পরে চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় গুপ্ত বংশীয় শাসন। এরা ছিল বৈশ্য কিন্তু বেদে বিশ্বাসী। সম্ভবত বহুদিন বেদের বিরোধিতা করে এবং বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় সহযোগিতা করে ক্লান্ত বৈশ্যরা শেষ পর্যন্ত বেদপন্থী হতে বাধ্য হয়। তা না হলে এই গুপ্ত আমলেই পৌরাণিক ধর্মের নামে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুভ্যূত্থান ঘটত না। ব্রাহ্মণ্য সমাজ বৈশ্যদের অতীত ইতিহাসকে সামনে রেখে এই অভ্যূত্থানের সময় তাদেরকে শায়েস্তা করার সকল পদক্ষেপ নেয়। তাদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য গুপ্তযুগেই সমুদ্র যাত্রা করা হয় নিষিদ্ধ। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বৈশ্যরা পড়ে যায় পেছনে। ক্ষমতার লড়াইয়ে অষ্টম শতাব্দীর দিকে আবার সামনে চলে আসে ব্রাহ্মণ- ক্ষত্রিয় (রাজপুত) জোট। শূদ্র রাজত্ব চিরতরে হয় নির্বাসিত। এই যে পেছনে পড়া তার ধকল কাটিয়ে ওঠে আজ অবধি বৈশ্য ও শূদ্ররা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে পারে নি।

২. ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত বর্ণহীন বাঙালি সমাজ : সর্বভারতীয় এই বর্ণসংগ্রাম থেকে বাংলা দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুক্ত ছিল। প্রাক-বৌদ্ধ বাংলার (প্রাক-৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) সমাজ ছিল একটি সমতল সমাজ। বৌদ্ধ পাল রাজাদের আমলেও (250 খ্রিস্টাব্দ-১২০০)সমাজে কোনো জাত-পাত ছিল না। ছিল কৌমভিত্তিক সমাজ। তখনকার দিনে বণিকরা নগরশ্রেষ্ঠী, শ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, ব্যাপারী, গণপতি ও সওদাগর ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত হতো। সমাজে তাদের স্থান ছিল ঈর্ষনীয়। উদীয়মান দেবীদের বিরুদ্ধে চাঁদ সওদাগর ও ধনপতি সওদাগর প্রমুখের বিদ্রোহের ঘটনা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ব্যবসায়ীদের এই প্রভাব-প্রতিপত্তি থেকে বোঝা যায় তখনকার দিনে ব্যবসার একটা উন্মুক্ত ও অনুকূল পরিবেশ ছিল। সামাজিক বাধা- বিপত্তি ও হেনস্তার অনুপস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা কাজ করতে পারত বলে সেই যুগে বাঙালি ব্যবসায়ীরা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি সাধন করে। এক কথায় মধ্যযুগকে বাঙালি ব্যবসায়ীদের স্বর্ণযুগ বলা যায়।

এই স্বর্ণযুগ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উত্থানে শুরু হয় তাদের অবনতি! ফলে নেমে আসে সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক স্থবিরতা। ব্যবসা ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা সমাজেও সংক্রমিত হয়। স্থবির সমাজে জন্ম নেয় নানা সংস্কার কুসংস্কার ও কুপ্রথা। প্রথাই হয়ে ওঠে ধর্ম। এই স্থবিরতা স্থায়ী হয় মোটামুটি প্রাক-ব্রিটিশ কাল পর্যন্ত। এর জন্য বিদেশি আক্রমণ যেমন দায়ী তেমনি দায়ী ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন। কি এই সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন?

৩. সেন আমলে বর্ণবিন্যাস : পাল আমলের সমাপ্তি ও সেন আমলের আরম্ভকালে (দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী) বাংলার সমাজকে ব্রাহ্মণ্যধর্মের চারবর্ণের আদলে পুনর্গঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্যোগ পর্বেই ব্রাহ্মণ্য সমাজ সর্বভারতীয় অভিজ্ঞতাটি কাজে লাগায় বলে অনুমিত। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সাথে ঐতিহাসিক বিরোধের প্রেক্ষাপটে গোড়াতেই তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারে। ফতোয়া দেওয়া হয় যে, বাংলায় কোনো ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য নেই। তা হলে প্রশ্ন : বাংলার অধিবাসীরা কারা? বলা হয় এরা সবাই ব্রাহ্মণ্য সমাজের চতুর্থবর্ণ অর্থাৎ শূদ্র। কারণ এরা সবাই মিশ্র জাতি অথবা সংকর। যেহেতু সবাই সংকর ও শূদ্র তাই বাংলার সমাজকে চারবর্ণে বিভক্ত করার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এরই প্রথম দলিল হচ্ছে ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ (দ্বাদশ- ত্রয়োদশ শতাব্দী)। এতে বাংলার তৎকালীন সকল মানুষকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় যথা: উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর ও অন্ত্যজ। এই শ্রেণি বিন্যাসে চার ধরনের বণিকের উল্লেখ পাওয়া যায়, যথা : গন্ধবণিক, কাংস্যবণিক, শঙ্খবণিক ও সুবর্ণবণিক। এর মধ্যে প্রথমোক্ত তিনটিকে স্থান দেওয়া হয় উত্তম সংকর শ্রেণিতে এবং সুবর্ণবণিকদের স্থান দেওয়া হয় মধ্যম সংকরে।

শ্রেণি বিন্যাসে সুবর্ণবণিকরা কেন নিচে স্থান পেল সে সম্বন্ধে নানা কুলজীগ্রন্থে নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে বলা হয়েছে বল্লাল সেনের সাথে মত বিরোধের কারণেই তাদের অবনমন ঘটে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা মনে হয় ভিন্ন। সুবর্ণবণিকরা তৎকালীন সমাজে আজকের দিনের সোনার ব্যবসায়ীদের মতই প্রভাবশালী ছিল। অনেকের ধারণা গোড়াতেই তাই ব্রাহ্মণ্য সমাজ এই শ্রেণির ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।

শুধু সুবর্ণবণিকই নয় গন্ধবণিকদেরকেও শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য নানা পুরাণ কাহিনীর মাধ্যমে নতুন নতুন দেবী সৃষ্টি করা হয়, নেওয়া হয় কবিদের সাহায্য। তৈরি করা হয় নানা কল্পকাহিনী। ব্যবসায়ীদেরকে শিবের পূজা করতে বাধা দেওয়া হয়। কেন? বলা হয় শিবের কোনো শক্তি নেই। শক্তি আছে চণ্ডীতে। তাই শিবকে বাদ দিয়ে পূজা দিতে হবে মনসা-চণ্ডীকে। শিবের পূজারী চাঁদ সওদাগর (গন্ধবণিক) এতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফলে তার ওপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। এসব কাহিনী বাংলার মঙ্গল কাব্যের বিষয়বস্তু। রবীন্দ্রনাথ (কালান্তর: প্রবন্ধ : বাতায়নিকের পত্র : বিশ্বভারতী : ১৪০০) চাঁদ সওদাগরের এই বিদ্রোহের মধ্যে মানুষের জয়ের একটি ইঙ্গিত দেখেছিলেন। কিন্তু সওদাগর চণ্ডীর মারের কাছে এই জয়কে ধরে রাখতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: “চণ্ডী বললেন, ভয়ে অভিভূত করে, দুঃখে জর্জর ক’রে, গতিতে দুর্বল করে, মারের চোটে মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে তোমাদের কাছ থেকে জোর করে আমার পূজা আদায় করবই। নইলে? নইলে আমার প্রেস্টিজ যায়। ধর্মের প্রেস্টিজের জন্যে চণ্ডীর খেয়াল নেই, তাঁর প্রেস্টিজ হচ্ছে ক্ষমতার প্রেস্টিজ। অতএব মারের পর মার, মারের পর মার। অবশেষে দুঃখের যখন চূড়ান্ত হল তখন শিবকে সরিয়ে রেখে শক্তির কাছে আধমরা সওদাগর মাথা হেঁট করলে।”

বাংলার মঙ্গল কাব্যগুলো পর্যালোচনা করলে মনে হয় তখনকার সমাজ ছিল একটি প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধসমাজ। এই সমাজে ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী সদস্য। বৌদ্ধধর্ম জীর্ণ হয়ে পড়লে তারা শিবের পূজারী হয়। কারণ বুদ্ধের মতই শিব রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ত্যাগী, ভিক্ষু, বেদ-বিরোধী ও সর্বসাধারণের’। এমন একটি ব্যবসায়ী সমাজকে ব্রাহ্মণ্যধর্মভুক্ত করতে হলে তাদেরকে দুর্বল করা দরকার। তাই তাদের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া হয়। পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা খর্ব করার জন্য সমুদ্র যাত্রা করা হয় নিষিদ্ধ। এসবের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদেরকে দুর্বল করে জাতিবিন্যাসের পথটি সুগম করা হয়। জাতিবিন্যাসটিকে সুদৃঢ় করার জন্য আশ্রয় নেওয়া হয় নানা পুরাণ কাহিনীর। পাশাপাশি নেওয়া হয় ধন-সম্পদ বিরোধী একটি অবস্থান। ‘অর্থই অনর্থের মূল’, ‘এই সংসার মায়ার সংসার’ ও ‘ভক্তিতেই মুক্তি’ ইত্যাদি নীতি বাক্য প্রচার এবং ‘জন্মান্ত রবাদ’ ও ‘অবতারবাদ’ ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজকে করে ফেলা হয় স্থবির ও ভেতরমুখী। পাশাপাশি অপপ্রচার কুৎসা রটনা ও নানা শঠতামূলক প্রথা ও বিধির মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্য সমাজ বাংলার বণিকদেরকে গৃহবন্দি করে ফেলে।

উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে মধ্যযুগের জাতিবিন্যাসটির দিকে দৃষ্টিপাত করলে একটি বিষয় নজরে পড়ে। দেখা যায় জাতিগুলোর তালিকায় গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক, কাংস্যবণিক ও সুবর্ণবণিকদের উল্লেখ থাকলেও বর্তমান কালের সাধারণ ব্যবসায়ী (জেনারেল মার্চেন্ট) অর্থাৎ ‘সাহাদের” কোনো উল্লেখ নেই। তবে উল্লেখ আছে সাহাদের সাথে পরবর্তীকালে সম্পর্কিত ‘শৌণ্ডিক’ (শুঁড়ি) ‘জাতির’ কথা। বর্তমানকালে তিনি/তেলি জাতি থেকে যে ব্যবসায়ী পাওয়া যাচ্ছে সেই তিলি/তেলি জাতিরও উল্লেখ আছে। তবে ‘তৈলক’ নামে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় ‘তৈলকরা’ স্থান পেয়েছে উত্তম সংকরে এবং ‘শৌণ্ডিকদের’ (শুঁড়ি) স্থান মধ্যম সংকর হিসেবে। এরা তখনকার দিনে সংখ্যার দিক থেকে কতটুকু শক্তিশালী ছিল অথবা বাংলার কোন অঞ্চলে তাদের বসতি ছিল তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ব্রিটিশ-ভারতের তথ্য থেকে (রমণীমোহন দেবনাথ : ব্যবসা-শিল্পে বাঙালি: বাংলা একাডেমী : ঢাকা : ১৯৮৫) এই সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যায়। তথ্যে দেখা যায় ১৮৭২ সালে অবিভক্ত বাংলার লোকসংখ্যা ছিল ৩,৪৬,৯১,৭৯৯। এর মধ্যে বাংলার চিরায়ত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা ছিল ১১,৮৯,৮৪৭ (সাড়ে তিন শতাংশ)। নিচে ১৮৭২ সালের সম্প্রদায় ও অঞ্চলভিত্তিক একটি তথ্য দেওয়া হল:

সম্প্রদায়ভিত্তিক তথ্যঃ ১৮৭২

সম্প্রদায়পশ্চিমবঙ্গপূর্ববঙ্গমোট
সুবর্ণবণিক৯৪,৩৭৫৩০,৮৬৯১,২৫,২৪৪
গন্ধবণিক৯১,১৬৫৩২,৩৮৩১,২৩,৫৪৮
তেলি/তিলি৪,৪৫,০২৩৯৫,৭২৮৫,৪০,৭৫১
সাহা/শুঁড়ি১,১১,৯২৫২,৮৮,৩৭৯৪,০০,৩০৮
মোট৭,৪২,৪৮৮৪,৪৭,৩৫৯১১,৮৯,৮৪৭

ওপরের তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবসায়ীদেরকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। দেখা যায় সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক ও তেলি-তিলি ব্যবসায়ীদের প্রাধান্যস্থল পশ্চিমবঙ্গ। এই তিন সম্প্রদায়ভুক্ত ৭,৮৯,৫৪৩ জন বণিকের মধ্যে ৬,৩০,৫৬৩ জনের (৮০শতাংশ) বসবাস পশ্চিমবঙ্গে। অপরদিকে সাহা/শুঁড়িদের ঘনবসতি পূর্ববঙ্গে। মোট ৪,০০,৩০৪ জন সাহা ও শুঁড়ি সম্প্রদায়ভুক্তের মধ্যে পূর্ববঙ্গে ছিল ২,৮৮,৩৭৯ জন (৭২ শতাংশ) ও পশ্চিমবঙ্গে ছিল মাত্র ১,১১,৯২৫ জন। কিন্তু সার্বিকভাবে আবার দেখা যায় চারটি প্রধান ব্যবসায়ী শ্রেণির লোকসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গেই ছিল বেশি। অর্থাৎ মোট ১১,৮৯,৮৪৭ জন বণিকের মধ্যে ৭,৪২,৪৮৮ জনের (৬২ শতাংশ) বসবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গে।

এদিকে সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক ও তেলি/তিলি সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যবসায়ীদের জেলা- ওয়ারি তথ্যে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গে সুবর্ণবণিকদের ঘনবসতি ছিল যথাক্রমে : ২৪ পরগণা (২৭,৬১৫), বর্ধমান (১৩,৩১৩), মেদিনীপুর (১১,৪৯৯) ও হাওড়ায় (৮,৮৮৭)। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে গন্ধবণিকদের ঘন বসতির জায়গা ছিল যথাক্রমে: বর্ধমান (৩২,১০৫), মুর্শিদাবাদ (১১,০১৬), বীরভূম (১০,১৬৫) ও মেদিনীপুর (১০,১৪০)। ঘনবসতি অনুযায়ী তিলি/তেলিদের বাসস্থান ছিল যথাক্রমে : বর্ধমান (১,২৩,৭২৫), মেদিনীপুর (৭৫,২৪০), বাঁকুড়া (৫৪,৩৮৬), হাওড়া (৩৯,৯৫৬) ও মুর্শিদাবাদ (৩৯,১৮৯)।

অপরপক্ষে পূর্ববঙ্গে সুবর্ণবণিকদের ঘনত্ব অনুযায়ী বসতি ছিল যথাক্রমে : যশোহর (৬,৯২৯), নোয়াখালী (৫,১৬৫), ঢাকা (৪,৬৯৬),ময়মনসিংহ (৩,১০৬)। গন্ধবণিকদের অবস্থান ছিল যথাক্রমে : ঢাকা (৬,৬৩৪), যশোহর (৪,৫১১), টিপারা (৪,১৭৬) ও বাখেরগঞ্জ (৩,২৯০)। তিলি/তেলিদের অবস্থান ছিল যথাক্রমে : যশোহর (২১,৪৪৩), ঢাকা (১৩,৭১১), বাখরগঞ্জ (১২,১৮৪), পাবনা (১০,৬০৪) ও রাজশাহী (৮,০০০)।

ব্যবসায়ীদের উপরোক্ত ভৌগোলিক জনবিন্যাস থেকে বোঝা যায় পশ্চিমবঙ্গ ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে পূর্ববঙ্গের চেয়ে অগ্রগামী ছিল। তা নাহলে বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর বসতি পশ্চিমবঙ্গ হতো না। দ্বিতীয়ত এই জনবিন্যাস থেকে বাংলার কোন কোন জেলা ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসিদ্ধ ছিল তাও বোঝা যায়। এ কথা অনুমান করা কঠিন নয় যে, যেসব জেলা ব্যবসায় উন্নত ছিল সেসব জেলাতেই ব্যবসায়ীদের ঘনবসতি ছিল। কিন্তু দেখা যায় ভিন্ন ভিন্ন জেলায় ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায়ী জাতি ঘনবসতি গড়ে তুলে। আবার অঞ্চল হিসেবে পূর্ববঙ্গে গড়ে ওঠে সাহা ব্যবসায়ীদের ঘনবসতি। এই সাহা ব্যবসায়ীরা কারা? এদের উৎপত্তি কোত্থেকে? কিভাবে এরা সাধারণ ব্যবসায়ী (জেনারেল মার্চেন্ট) হিসেবে একটি ‘জাতিতে (কাস্টে)’ পরিণত হয়?

৪. সাহা সমাজের উৎপত্তিঃ আমরা জানি মধ্যযুগে রচিত জাতি তালিকায় পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ীর (সুবর্ণবণিক গন্ধবণিক কাংস্যবণিক শঙ্খবণিক ইত্যাদি) উল্লেখ থাকলেও সাধারণ ব্যবসায়ী সাহার কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু এ কথা অনুমান করা কঠিন যে, মধ্যযুগে বাঙালিদের মধ্যে সাধারণ ব্যবসায়ী (জেনারেল মার্চেন্ট) ছিল না। সম্ভবত তখনকার দিনে কোনো একটি বিশেষ পণ্যের ব্যবসায়ে নিয়োজিত বণিকদের একাংশই সময় ও সুযোগ মত সাধারণ ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করত। যেমন চাঁদ সওদাগর (গন্ধবণিক)। পরবর্তীকালে সাধারণ ব্যবসার গুরুত্ব বাড়তে থাকলে অর্থাৎ উদ্বৃত্ত পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ীরা এতে আকৃষ্ট হয়। মনে হয় কালক্রমে এই বিভিন্ন পণ্যভিত্তিক বণিকদের সংমিশ্রণেই সাহা সম্প্রদায়টির উৎপত্তি।

‘সাহা’ শব্দটির প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধার করা কঠিন। আমরা জানি মধ্যযুগের বণিকরা ‘সাধু’ নামে আখ্যায়িত হতো। এই ‘সাধু’ উপাধিধারী ব্যবসায়ীগণ একসময়ে ‘সাহু’ নামে আখ্যায়িত হন। শব্দের উচ্চারণের পরিবর্তনে ‘সাধু’ শব্দ ‘সাহু’তে রূপান্তরিত হওয়া বিচিত্র কিছু নয় (‘বধূ’ থেকে ‘বহু’)। ‘সাহু’র পাশাপাশি নবাবি আমলে ‘শাহ’ উপাধিও চালু হয়। মনে হয় এই দুইয়ের অনুকরণেই ‘সাহা’ পদবির উৎপত্তি। অনেকের মতে প্রথমাবস্থায় ‘সাহা’ উপাধি কোনো সম্প্রদায় সূচক ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে ‘সাহু’ শব্দটি ‘সাহা’য় রূপান্তরের পাশাপাশি ‘সাহা’ উপাধিও একটি সম্প্রদায়ের পদবিতে পরিণত হয়।

সাহা সমাজের লেখকগণ তাদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে দাবি করেন যে, পালরাজাদের আমলে সাহা ব্যবসায়ীরা ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে বাংলায় আসে। তারা মগধ (বিহার) রাজ্যের ‘সাহু’ ব্যবসায়ীদের বংশধর। তারা বলেন : বিহারের রাজগিরি অঞ্চলে ‘সাধু-শিলা’ নামে এক বড় নগরী ছিল। এই নগরে লক্ষাধিক সাহা ব্যবসায়ী বসবাস করত। এখান থেকে পাঁচজন সাহা ব্যবসায়ী, যথা : সাহু সাহা, সুবাহু ব্যাপারী, বলদেব রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দাস ও শিব চন্দ্র দাস বাংলায় আসেন। সাহু সাহা থেকে যায় সাগর বন্দরে। সুবাহু ও বলদেব গৌড়নগর ও ঢাকায় কুঠি স্থাপন করেন। কৃষ্ণচন্দ্র ও শিবদাস কুঠি স্থাপন করেন শ্রীহট্টে। ব্যবসা বৃদ্ধি ও পরিবার সম্প্রসারণের সাথে সাথে তারা পদ্মা, মেঘনা, বুড়িগঙ্গা, ইছামতী, মহানন্দা, চন্দনা ও হরসাগর ইত্যাদি নদীর পার্শ্বস্থিত নদী-বন্দরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।

বহিরাগত এই ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে মূল্যবান ধাতু, সুগন্ধি ও শস্যের ব্যবসায় মনোনিবেশ করে। এদিকে তারা বৌদ্ধরাজাদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হওয়ায় স্বদেশের সমাজে ‘পতিত’ ঘোষিত হয়। অধিকন্তু রাষ্ট্রীয় বিপ্লব, ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক ইত্যাদি কারণে এই ব্যবসায়ীরা শেষ পর্যন্ত বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা পরিচিত হয় ‘সালুক সাহা’ হিসেবে। কারণ বিহারের যে অঞ্চল থেকে তারা এসেছিল সেই অঞ্চল ‘সৌলুক’ বলে পরিচিত ছিল। এই ‘সৌলুক’ থেকেই ‘সালুক’ কথার উৎপত্তি বলে বিশ্বাস করা হয়।। ‘সালুক সাহা’ ছাড়াও তারা গৌড়বণিক, খণ্ড (শস্য)বণিক, বৈশ্যবণিক ও সাহাবণিক ইত্যাদি নামেও আখ্যায়িত। এই শ্রেণির ব্যবসায়ীদের সাথে বিভিন্ন পণ্যের স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও কালের ব্যবধানে মিশে যায়। অনুমিত দেশীয় গন্ধবণিকদের একটা অংশ এবং মদ্য ব্যবসায়ীদের (শুঁড়ি) একাংশ পণ্যভিত্তিক ব্যবসা ছেড়ে সাধারণ ব্যবসায়ী অর্থাৎ সাহা সমাজভুক্ত হয়। শুঁড়িরা মদের ব্যবসায়ী হিসেবে সমাজে নিচু স্থান পেত। সম্ভবত এ কারণেই তারা ধীরে ধীরে নিজস্ব বৃত্তি ছেড়ে সাধারণ ব্যবসায়ী হিসেবে ‘সাহা’ সমাজভুক্ত হয়। এ প্রক্রিয়া ব্রিটিশ আমলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিচে উল্লেখিত তথ্য থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হবে :

পশ্চিমবঙ্গ

সালসাহাশুঁড়ি
১৯১১ ১৩,৪০৩ ৪৫,৬১৬
১৯২১ ১,০২, ৭৯৯ ৭৩,৯৭৮
১৯৩১ ২৮, ৮৪৪ ৬৪,০৭৩
১৯৫১৮২,৭৬৬ ৪৫,১৫৩

 ওপরের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে চলিশ বছরে (১৯১১-১৯৫১) শুঁড়ি জনসংখ্যা আস্তে আস্তে হ্রাস পেয়েছে এবং পাশাপাশি ‘সাহা’ জনসংখ্যা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্ভবত লোকগণনার সময়ে শুঁড়িগণ নিজেদেরকে ‘সাহা’ হিসেবে নথিবদ্ধ করার ফলেই এটি ঘটেছে।

সাহা সম্প্রদায়ের উৎপত্তি বিষয়ক আলোচনার পর এদের বসতি সম্বন্ধে একটি ধারণা দেওয়া যাক। তথ্যে দেখা যায় ১৯৩১ সালে পূর্ববঙ্গে সাহার সংখ্যা ছিল ৩,৭৩,৩৮১ এবং পশ্চিমবঙ্গে ৪৬,৫১৪ জন। পূর্ববঙ্গে ঘনত্ব হিসেবে সাহার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকা জেলায় (৮৬,৮৮৭)। তারপরেই টিপারা (৬৩, ৭৬১), ময়মনসিংহ (৬২,৫০৪), ফরিদপুর ( ৩৬, ৭৬৯), পাবনা (২৬, ৭২১), যশোহর (২১,২৮৫), বাখেরগঞ্জ (২০,০৩০), নোয়াখালী (১৪,৩৬৯) ও খুলনা (১০,৬৩৮)। এছাড়াও পূর্ববঙ্গের রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামেও তাদের বসতি ছিল। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে সাহাদের সবচেয়ে বেশি ঘন বসতি ছিল কলকাতায় (১১,৬৭৩)। ঘনবসতি অনুযায়ী তার পরের স্থানগুলো হচ্ছে : নদীয়া (৭,৮২৮), বর্ধমান (৪,৭১৫), মুর্শিদাবাদ (৪,৫০০) চব্বিশ পরগনা (৪,১৭৮), বাঁকুড়া (৩,৪৪২) ও হাওড়া (২,৩৬৩)। এ ছাড়া মালদহ (১,৮৫৬) জলপাইগুড়ি (১,২৮০), হুগলি (১,২৫৮) ও মেদিনীপুর (১,২১৫) ইত্যাদি অঞ্চলেও সাহাদের বসতি ছিল। পশ্চিমবঙ্গের বাকি জেলায় সাঁহার সংখ্যা ছিল নামমাত্র।

ওপরের তথ্য থেকে দেখা যায় ১৯৩১ সালে সংখ্যার দিক থেকে সাহাদের প্রাধান্য ছিল পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ময়মনসিংহ, টিপারা, ফরিদপুর ও পাবনা জেলায়। এর মধ্যে ঢাকা শহরেই সাহা জনসংখ্যা ছিল ১০,৯৪৬। তখন ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা ছিল ১,৩৮,৫১৮। অর্থাৎ মোট ঢাকাবাসীর প্রায় ৮ শতাংশই ছিল সাহা। এই তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, ঢাকাতে সাহারা খুব প্রভাবশালী সম্প্রদায় ছিল। পুরোনো ঢাকার ‘দাস’ সম্বলিত রাস্তার নামগুলোই একথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই ‘দাস’ পদবিযুক্ত নামগুলো প্রকৃতপক্ষে সাহা ব্যবসায়ীদের পদবি। এদিকে সংখ্যার হিসেবে কলকাতা শহরে অবশ্য ঢাকার তুলনায় অধিক সংখ্যক সাহা বসবাস করত। কিন্তু শতাংশের হিসেবে তা ঢাকার চেয়ে কম। ১৯৩১ সালে মোট ১১,৯৬,৭৩৪ কলকাতাবাসীর মধ্যে ‘সাহা’ সম্প্রদায়ের লোকের সংখ্যা ছিল মাত্র ১১,৬৭৩ অর্থাৎ মাত্র এক-শতাংশ।

১৯৪৭ সালের দেশবিভাগে সাহাদের প্রভূত ক্ষতি হয়। কারণ সাহা সংখ্যাধিক্যের অঞ্চল পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের একটি অংশ হয়। এতে তাদের জমিদারি যেমন হাত ছাড়া হয়, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের সাথেও এদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক নষ্ট হয়। তারা ধীরে ধীরে অনেকেই ১৯৪৭ সালের পর পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে হাজির হয়। সাহারা যখন পশ্চিমবঙ্গ যাচ্ছে তখন ইতোমধ্যেই মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীদের আধিপত্য সেখানে প্রতিষ্ঠিত। এতে তারা সাধারণভাবে আবার দোকানিতে পরিণত হয়।

৫. বণিকদের প্রতি অবজ্ঞা : ব্যবসায়ীদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন, ভৌগোলিকভাবে ব্যবসায়ীদের বিস্তৃতি, পণ্যভিত্তিক ব্যবসার পাশাপাশি ‘সাধারণ ব্যবসার’ উদ্ভব এবং সাধারণ ব্যবসায়ী হিসেবে ‘সাহা’ জাতির উৎপত্তি ইত্যাদি ঘটনা যখন ঘটছে তখন বাংলা মুসলমান শাসনাধীন। সমাজ ধীরে ধীরে দুটো ভাগে ভাগ হচ্ছে। একদিকে শাসকের ধর্ম ইসলাম এবং অন্যদিকে জাত-পাতভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যধর্ম। ব্রাহ্মণ্য সমাজ হিন্দু সমাজকে নানা প্রথা-বিধি সংস্কার ও কুসংস্কার ইত্যাদির বেড়াজালে আবদ্ধ করে ফেলে। মুসলমান শাসকদের কর্মচারি হিসেবে নানা ধরনের পেশাভিত্তিক প্রভাবশালী শ্রেণি (জাতি) গড়ে ওঠতে থাকে। ‘কায়স্থ’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে তারা ব্রাহ্মণের সহযোগী-শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এদিকে সমুদ্রযাত্রা করা হয় নিষিদ্ধ। এর দ্বারা মনে হয় ব্রাহ্মণ্যসমাজ দুটো উদ্দেশ্য সাধন করে। প্রথমত ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষমতা খর্ব করা হয়। দ্বিতীয়ত এতে বহিরাগত শাসকরা প্রীত হয়। কারণ বৈদেশিক বাণিজ্যে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নিষ্কণ্টক হয়। প্রীত শাসকরা প্রতিদানে ব্রাহ্মণ্য সমাজ গঠনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় বহির্বাণিজ্য ও আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা ধীরে ধীরে আরব অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাঙালি ব্যবসায়ীরা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা মনে হয় তখন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে।

ইত্যবসরে এক সুযোগে ভারতের ‘মাড়োয়ার’ ইত্যাদি অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বাংলার ব্যবসার দিকে আকৃষ্ট হয়। ‘জগতশেঠ’ নামীয় পরিবারের ব্যবসায়ীরা প্রাক-পলাশি আমলে (প্রাক-১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ) মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে এসে প্রাধান্য বিস্তার করে। অর্থনৈতিকভাবে কাবু বাঙালি ব্যবসায়ীরা তখন ছোট ব্যবসার দিকে মনোনিবেশ করে। কিন্তু তারা প্রচণ্ড সামাজিক বিরোধিতা, বৈরিতা, অবজ্ঞা ও অপবাদের সম্মুখীন হয়। পুরো তিন-চার শত বছর যাবত নানা কল্পকাহিনীর মাধ্যমে তাদেরকে সমাজে হেয় করে রাখা হয়। উদাহরণস্বরূপ দেখা যায় ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’ সুবর্ণবণিকদেরকে ‘স্বর্ণচোরা’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। শ্রীমদ্‌ভাগবত ও চৈতন্য ভাগবতে তাদেরকে ‘মূর্খ’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয় (নরেন্দ্র নাথ লাহা : সুবর্ণবণিক কথা ও কীর্তি : ঋষিকেশ সিরিজ- ১৮ : দ্বিতীয় খণ্ড : কলকাতা : ১৯৪১)। এই প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ী সমাজ ষোড়শ শতাব্দীর দিকে জাতপাতহীন বৈষ্ণবধর্মের আশ্রয় নেয়। লক্ষণীয় ব্যবসায়ীরা যখন বৈষ্ণবধর্মে শক্তি যোগাচ্ছে বাংলার সামন্ত শ্রেণি এবং তথাকথিত উঁচু জাতির হিন্দুরা তখন ‘শাক্ত’ পন্থাকে মদত যোগাচ্ছে। বলা বাহুল্য শাক্ত পন্থাটি ছিল ভেদাভেদে বিশ্বাসী। এই বিপরীতমুখী প্রবণতার মধ্যেও ব্যবসায়ীদের সাথে ব্রাহ্মণ্য সমাজের বিরোধের একটি আভাস পাওয়া যায়।

৬. পলাশির পর অবস্থার উন্নতি : পলাশি যুদ্ধে (১৭৫৭) ক্ষমতার হাত-বদলের ফলে মনে হয় বাঙালি ব্যবসায়ীরা একটু নড়েচড়ে বসে। ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নামীয় জমিদারী প্রথার আর্বিভাব ঘটলে সমাজে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হয়। প্রথমাবস্থায় এই জমিদারিগুলোতে তথাকথিত উচ্চবর্ণের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু দুই-তিন দশক পর এসব জমিদারি নিলামে ওঠতে থাকে। সাহা ব্যবসায়ীসহ অন্য ব্যবসায়ীরা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। সাহা ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে মহাজন, গোলাদার, আড়তদার, দালাল ইত্যাদি হিসেবে কাজ ও সুদের ব্যবসা করে প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক হয়েছে। কিন্তু সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে তাদের স্থান নিচে। শিল্পের দিকে না গিয়ে তারা অধিকতর মর্যাদার আশায় জমিদারির দিকে ঝুঁকে পড়ে। জমিদারি রক্ষণে পুরোনো জমিদারদের আর্থিক অক্ষমতা এবং তাদের বংশধরদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ ইত্যাদি কারণে জমিদারি ক্রয়ে সাহাদের উদ্যোগ সফল হয়। শুধু সাহা ব্যবসায়ী নয়, অন্য ব্যবসায়ীরাও এই সুযোগ গ্রহণ করে। জমিদারি ক্রয় ও অর্থবিত্তে বলীয়ান হয়ে এসব ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সামাজিক মর্যাদার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কুলজী লেখক, শাস্ত্রকার ও ব্রাহ্মণ্যসমাজকে দিয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের স্ব স্ব জাতির গৌরবময় অতীত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করাতে শুরু করে। মোক্ষম সময়টি আসে ১৮৭২ সালে যখন ব্রিটিশরা প্রথম জাতিভিত্তিক লোকগণনা শুরু করে। লোক গণনায় নিচু জাতি হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ায় তারা বিক্ষুদ্ধ হয়। এ প্রেক্ষাপটেই সুবর্ণবণিকরা ১৮৭৮ সালে গড়ে তোলে ‘সপ্তগ্রামীয় সুবর্ণবণিক হিতসাধনী সভা’ এবং সাহারা ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করে ‘স্বজাতি হিত সাধন সমিতি’। গন্ধবণিকসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও স্ব স্ব সংগঠন গড়ে তুলে। সবারই দাবি তাদের বৈশ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। অধিকন্তু সাহাদের দাবি ছিল তাদেরকে শুঁড়ি হিসেবে নথিবদ্ধ করা যাবে না। নথিবদ্ধ করতে হবে বৈশ্যসাহা হিসেবে। এই আন্দোলনে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মেঘনাথ সাহা ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ফলে ১৯১১ সালের লোকগণনায় সাহাদেরকে আলাদাভাবে নথিবদ্ধ করা হয়।

৭. অন্য অঞ্চলের তুলনায় বাঙালি বণিক : ব্রিটিশ আমলের লোকগণনায় উঁচু জাতির দাবিতে ব্যবসায়ীসহ নানা জাতির সংগ্রাম থেকে বোঝা যায় যে, জাতিবিন্যাস সম্পর্কে সমাজে প্রচণ্ড চাপা বিক্ষোভ ছিল। এই বিক্ষোভটি কম পক্ষে পাঁচ-ছয় শত বছরের। জাতিগত নিপীড়ন, কুৎসা, অপবাদ, বৈষম্য, বৈরিতা, অবজ্ঞা এবং ব্যবসার অনুপযোগী ও প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে ব্যবসায়ীদেরকে এই পাঁচ-ছয় শত বছর কাটাতে হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে লক্ষণীয় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মত বাঙালি ব্যবসায়ীরাও বৈশ্যত্ব দাবি করে। এটি না করে তারা বর্ণপ্রথা নামীয় কুপ্রথাটির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারত। বরং উল্টো দেখা যাচ্ছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা এই কুপ্রথাটিকেই মেনে নিচ্ছে।

ব্যবসায়ী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি হিন্দুর অন্যায়কে সহ্য করা ও প্রশ্রয় দেওয়ার ক্ষমতা রীতিমত বিস্ময়কর। মনে হয় সুদীর্ঘকালের দাসত্ব ও পরাধীনতাই এর কারণ। তা না হলে বাংলার বাইরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে হিন্দু ব্যবসায়ীরা যেখানে ‘দ্বিজ’ ও বৈশ্য হিসেবে স্বীকৃত সেখানে তাকে “বৈশ্যত্বের’ জন্য আন্দোলন করতে হবে কেন? এই প্রসঙ্গে বাঙালি হিন্দু ব্যবসায়ীর বিপরীতে অন্যান্য সমাজে ব্যবসায়ীর অবস্থান কী তা দেখা যাক।

আমরা জানি সিন্ধি হিন্দু সমাজে কোনো শূদ্র নেই। প্রথাগতভাবে সমাজ দুভাগে বিভক্ত: আমিল (স্কলার) ও ভৈবন্দ (ব্যবসায়ী)। পেশাই এ সমাজে প্রধান, জন্ম নয়। তার ফলে সমাজে যে কেউ ওপরে উঠতে পারে। গুজরাটি সমাজেও ব্যবসায়িক সাফল্য সামাজিক স্বীকৃতি এনে দেয়। ভারতীয় সমাজে ‘মাড়োয়ারী’ ব্যবসায়ীদেরকেও বৈশ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দক্ষিণ ভারতের ‘চেটিয়ার’ ইত্যাদির শ্রেণির ব্যবসায়ীরাও সমাজে অধিকতর আদৃত ও স্বীকৃত। ভারতীয় পার্সি সমাজে উদ্যোক্তা ও ব্যাংকারদের স্থান সমাজের উচ্চস্তরে। পার্সি পঞ্চায়েতে উদ্যোক্তা, পাইকারি ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদেরকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বড় বড় ব্যবসায়ী স্যার জামশেদজী জিজিবয়, স্যার দীনশ পেটিট এবং স্যার কাওয়াসজী জেহাঙ্গীর ১৯৪৫ কাল পর্যন্ত পার্সি সম্প্রদায়ের প্রধান ছিলেন। এসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায় বাঙালি হিন্দু ব্যবসায়ীর সামাজিক অবস্থানটি ব্যতিক্রমধর্মী। অন্যান্য দেশের তুলনায় অবশ্য সকল হিন্দু ব্যবসায়ীর সামাজিক অবস্থানই মৌলিকভাবে পৃথক।

৮. চৈনিক সমাজ ও ভারতীয় সমাজ : ইউরোপীয় অথবা পূর্বএশীয় উন্নত দেশগুলোতে উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি ইত্যাদি শ্রেণির লোকের মর্যাদা ঈর্ষণীয় জন্ম দিয়ে সেখানে কারো কৌলীন্য স্থির হয় না। পেশার সাফল্যই মুখ্য বিষয়। এমনকি ভারতের প্রতিবেশী দেশ চিনের সমাজ কাঠামোও ব্যবসায়ীদের অনুকূলে। কারণ সেখানে জাতি-বর্ণ ভেদ নেই। ভারতীয় সামাজিক কাঠামো এবং এই কাঠামো থেকে উদ্ভূত ক্ষমতার লড়াইও চিনা সমাজে অনুপস্থিত। চিনা ও ভারতীয় সমাজের তুলনামূলক একটি চিত্র নিচে দেয়া হল:

ভারত ও চিনের তুলনামূলক চিত্র

ভারতচিন
ব্রাহ্মণ : এলিট শ্রেণিশী : স্কলার/জেনট্রি
ক্ষত্রিয়: যোদ্ধা শাসকনুঙ : কৃষক শ্রেণি
বৈশ্য : বণিককুঙ : শিল্পী শ্রেণি
শূদ্র : কৃষক/বৃত্তিজীবীশ্যাঙ : বণিক শ্রেণি

উপরোক্ত শ্রেণিবিন্যাস থেকে দেখা যায় দুই সমাজই চার শ্রেণিতে বিভক্ত। কিন্তু দুই কাঠামোর মধ্যে রয়েছে মৌলিক তফাৎ। ভারতীয় কাঠামো যেখানে জন্মগত, চিনের কাঠামো সেখানে কর্মগত বা বৃত্তিগত। চিনের কাঠামোটি কর্মগত হওয়ায় সেখানে বৃত্তিগত মর্যাদা আছে। এই কাঠামোটিকে ‘এস্টেট’ বলা যায়। চিনে কোনো ক্ষত্ৰিয় শ্রেণি নেই। সেখানে স্কলার/জেনট্রির পরেই কৃষকের স্থান। তারপরে শিল্পী শ্রেণি। সর্বনিম্নস্তরে রয়েছে বণিক শ্রেণি। বিপরীতে ভারতে ব্রাহ্মণের (এলিট) স্থান সর্বোচ্চ দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান যথাক্রমে ক্ষত্রিয় (যোদ্ধা) ও বৈশ্যের। সবার নিচে কৃষক ও বৃত্তিজীবীরা। চিনে ব্যবসায়ীর স্থান সবার নিচে হলেও সমস্যা হয় না। কারণ কাঠামোটি জন্মগত নয়। সামাজিক গতিশীলতা থাকার ফলে যে কেউ ওপরে উঠতে পারে। এতে শ্রেণি বা বর্ণগত স্থায়ী সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্বের কোনো সুযোগ নেই।

পরিশেষে বলা যায় ভারতীয় সমাজ, প্রতিবেশী চিনা সমাজ এবং উন্নত বিশ্বের সমাজের নিরিখে বাঙালি হিন্দু ব্যবসায়ীরা নিঃসন্দেহে সামাজিক মর্যাদাহীন একটি সম্প্রদায়। মর্যাদার প্রশ্নে বিগত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। ব্যবসায়ী ও বণিকদের সম্বন্ধে আজও সাধারণ বাঙালির দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব অনুদার। অনৈতিকতা ও অসাধুতা ইত্যাদির অভিযোগে তাদেরকে আজও দেখা হয় হেয় দৃষ্টিতে। বাঙালি হিন্দু সমাজে একজন কবি, লেখক, শিল্পী, এমনকি সরকারি চাকরিজীবী, ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারের যে মূল্য, একজন সৃজনশীল উদ্যোক্তা অথবা সফল ব্যবসায়ীর সে মূল্য নেই। তাই একজন সফল ব্যবসায়ী অথবা উদ্যোক্তা ধন-সম্পদের মালিক হয়েও উদ্যমহীন। অবজ্ঞা থেকে বাঁচার জন্য তারা তাদের বংশধরদেরকে চাকরি ও অন্যান্য অধিকতর মর্যাদা সম্পন্ন পেশায় পাঠাতে অনেক বেশি আগ্রহ দেখায়। কারণ সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নটি ব্যবসায়ীদেরকে সর্বদা পিছু টেনে রাখে যা থেকে তারা মুক্তি পেতে চায়।

এ প্রেক্ষাপটেই বিনয় ঘোষ বলেন : (বাংলার নবজাগৃতি: ওরিয়েন্ট লংম্যান লি: ১৩৮৮: প্রথম প্রকাশ:১৩৫৫) বর্ণবৈষম্যজনিত সামাজিক অবজ্ঞা ও উপেক্ষা আমাদের দেশে বণিক শ্রেণিকে শক্তিশালী আধুনিক পুঁজিপতি শ্রেণিতে পরিণত হতে দেয় নি, উদ্যম উদ্যোগ ও অর্থনৈতিক অভিযানের দুঃসাহসিক পথ থেকে তাদের উৎখাত করেছে। যে কর্ম ও কৃতিত্বের জন্য কোনো সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা লভ্য নয় তা করার জন্য কোনো প্রেরণা এ দেশের বণিকরা পাননি। বলা বাহুল্য বিনয় ঘোষ কর্তৃক চিহ্নিত এই অবজ্ঞা ও উপেক্ষার সূত্রপাত দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে চালু জাতিভেদ প্রথায়। এই জাতিভেদ প্রথার মধ্যেই আবার নিহিত রয়েছে প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লেখিত বর্ণ-সংগ্রামের বীজ। এই বীজ উৎপাটনে ব্যবসায়ীদেরকেই এগিয়ে আসা উচিত নয় কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *