মহাতীর্থ কুম্ভমেলা
হিন্দুদের কাছে মহাতীর্থ বা ‘তীর্থরাজ’ হচ্ছে ‘কুম্ভমেলা’। এই উপলক্ষে লক্ষ-কোটি হিন্দু তিন বছর পর পর পালাক্রমে মহাসানের জন্য সমবেত হয় ভারতের চারটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান যথা : প্রয়াগ, হরিদ্বার (হরদ্বার!), উজ্জয়িনী ও নাসিকে। উদ্দেশ্য কুম্ভমেলা উপলক্ষে গঙ্গাস্নান করে অমৃত লাভ করা, উদ্দেশ্য এমন একটি স্থানে কুম্ভস্নান করা যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে পূর্বপুরুষদের স্মৃতি, মুনি-ঋষিদের স্মৃতি, বৌদ্ধ রাজাদের দানদক্ষিণার অবিস্মরণীয় স্মৃতি ও হিন্দুর লোকসংস্কৃতি।
উদাহরণস্বরূপ প্রয়াগের কথা বলা যায়। হিন্দুদের বিশ্বাস প্রয়াগ ভগবান ব্রহ্মার যজ্ঞভূমি ও অগস্ত্য চ্যবণের তপস্যাভূমি। এই স্থানে কুম্ভস্নান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। শিবশংকর ভারতীর (পাক্ষিক ‘সানন্দা’ : কলকাতা : ১৫.১. ২০০১) মতে প্রয়াগের কুম্ভপর্বে শাহিসানের ক্রম নির্ধারিত করা আছে। স্নানের প্রথম অধিকার মহানির্বানী আখড়ার ‘নাথ সম্প্রদায়ের’ নিজের সহযোগী আখড়া অটলের। এরপর একসঙ্গে স্নান করেন নিরঞ্জনী আনন্দ আখড়ার সন্ন্যাসীরা। তারপর স্নান করেন অন্য সম্প্রদায়ের সাধু-সন্ন্যাসী এবং সাধারণ তীর্থযাত্রী ও পুণ্যার্থীরা। এই ক্রম অনুসারেই চলতে থাকে গোটা স্নানপর্ব।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে প্রয়াগের সাথে জড়িয়ে আছে মুনি-ঋষিদের স্মৃতি। ভারতীর মতে: “রামায়ণী যুগে প্রয়াগের বালুতটে ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে মুনি-ঋষিদের সমাগম হতো মাঘী মেলা উপলক্ষে। পুরোহিত ধৌম্যমুনির আদেশে মহাভারতীয় যুগে তীর্থভ্রমণকালীন ভ্রাতৃগণের সঙ্গে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির স্নান ও দান করেছিলেন তীর্থরাজ প্রয়াগে। আড়াই হাজার বছর আগে সিদ্ধার্থের বোধিলাভের পর রূপান্তরিত ভগবান বুদ্ধের প্রয়াগে পদার্পণ ও উপদেশ দান থেকেই হয়তো বৌদ্ধধর্মের সূচনা।
সপ্তম শতাব্দীতে প্রয়াগে মাঘী মেলায় রাজা হর্ষবর্ধনের ষষ্ঠ সর্বত্যাগ যজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন-সাঙ। ‘হিউয়েন-সাঙের দেখা ভারত’ গ্রন্থ থেকে তৎকালীন প্রয়াগ এবং হর্ষের কথা ভারতী উদ্ধৃত করেছেন এইভাবে: “হয়মুখ থেকে গঙ্গানদী পার হয়ে, নদীর কূল ধরে দক্ষিণ-পূর্বদিকে এগিয়ে গেলাম। প্রায় ৭০০ লি মতো পথ চলার পর ‘ পো- লো-য়ে-কিয়া ‘ অর্থাৎ প্রয়াগ রাজ্যের দেখা পেলাম। …
রাজধানীর পূর্বদিকে দুই নদীর সঙ্গমস্থলের কাছে দশ লি মতো অঞ্চল বেশ উঁচু ও মনোরম। পুরো জায়গাটি মিহি বালির আস্তরণে ঢাকা। রাজরাজড়া ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা কেউ কোনও কিছু দান করতে চাইলে এই জায়গাটিতে এসে করে থাকেন। প্রাচীনকাল থেকেই এই রীতি চলে আসছে। এ জন্য এ জায়গাটি ‘মহাদান ক্ষেত্র’ নামে খ্যাতিলাভ করেছে।
পূর্ব-পুরুষদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অধুনা রাজা শিলাদিত্য (হর্ষবর্ধন) এখানে এসে তাঁর পাঁচ বছরের সঞ্চয় একদিনে দান করে যান। এই ক্ষেত্রটিতে এসে সব ধনরত্ন স্তূপ সাজিয়ে প্রথমদিন তিনি খুব সমারোহের সঙ্গে বুদ্ধের পূজা করে অর্চনা করে তাঁকে অতি মূল্যবান রত্নাদি নিবেদন করলেন। তারপর দান করা শুরু হল। প্রথমে স্থানীয় ভিক্ষুরা পেলেন। তারপর দূর থেকে আসা ভিক্ষুরা। এরপর রাজ্যের বিশিষ্ট সব গুণিজনেদের দেওয়া হয়। এরপর এল স্থানীয় বিধর্মীদের পালা। সবার শেষে বিধবা, অসহায়, অনাথ, পরিত্যক্ত, গরিব আর ভিখারিরা পেল দান।”
ভারতীর মতে পূর্ব ও উত্তরকালের মহাযোগী গোরখনাথ, ত্রৈলঙ্গস্বামী, গম্ভীরনাথ, দয়ালদাস বাবাজি, ভোলানন্দ গিরি মহারাজ, রামদাস কাঠিয়া বাবাজি মহারাজ, প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, আনন্দময়ী মা এমনকি হিমালয়ের গিরিকন্দর কিংবা ‘বরফান মূলুক’ থেকে সমতলে অতি সাধারণ বেশে নেমে আসা আত্মজ্ঞানী শত সহস্র মহাপুরুষের চরণধূলিতে ধন্য হয়েছে তীর্থরাজ প্রয়াগ। এঁদের অবস্থান স্মৃতি, আধ্যাত্মিকতা ও অন্তর্নিহিত রহস্যময়তা ধরে রেখেছে প্রয়াগ, কুম্ভমেলা-অঙ্গন। সেই জন্যই প্রয়াগের প্রসিদ্ধি ভারত তথা পৃথিবী জুড়ে।”
প্রয়াগের প্রসিদ্ধির কথা বোঝা গেলো, কিন্তু যে কুম্ভমেলা উপলক্ষে লক্ষ-কোটি হিন্দু আজকের দিনে প্রয়াগ, হরিদ্বার (হরদ্বার!), উজ্জয়িনী ও নাসিকে সমবেত হয় সেই কুম্ভমেলার কাহিনীটি কী? কুম্ভমেলার পৌরাণিক এই কাহিনী বস্তুত মহাভারতের সমুদ্র মন্থনের কাহিনী। সমুদ্রমন্থনের ঘটনাটির তিনটি পক্ষ। দেবাসুরের মোড়কে প্রথম পক্ষ অবশ্যই ‘ভূমিপুত্ররা’ যাদেরকে পৌরাণিক গ্রন্থগুলোতে বার বার ‘অসুর’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। দ্বিতীয় পক্ষ হচ্ছে আর্যদেবতাগণ এবং আরেকটি পক্ষ ভূমিপুত্রদের দেবতা দেবাদিদেব মহাদেব। একটু গভীরভাবে দেখলেই বোঝা যাবে কাহিনীটি একটি বঞ্চনার কাহিনী। বঞ্চনা করছেন আর্য-দেবতারা, আর বঞ্চিত হচ্ছেন স্থানীয় জনসাধারণ। মহাদেব জড়িত হচ্ছেন ত্রাণকর্তা হিসেবে মানুষকে-প্রাণী জগতকে বাঁচানোর জন্য। তা করতে গিয়ে তিনি মন্থনকালীন সময়ে উত্থিত সমস্ত গরল (বিষ) পাণ করে হয়েছেন “নীলকণ্ঠ’। মহাদেব কুম্ভমেলার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত না হলে এবং তিনি ‘নীলকণ্ঠ’ না হলে আজকের কুম্ভমেলা সম্ভব হতো না।
আমরা জানি অমৃতের সন্ধানে সমুদ্র মন্থনকালে এক পর্যায়ে বিষ ওঠা শুরু করে। বিষক্রিয়ায় ‘দেবতা-অসুর’ ও প্রাণীকুল নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে ব্ৰহ্মা উত্থিত বিষপাণের জন্য মহাদেবকে অনুরোধ করেন। মানুষ ও প্রাণীকুলের অকৃত্রিম বন্ধু মহাদেব বিষপাণ করে নিজে ‘নীলকণ্ঠ’ হন এবং মানুষকে বাঁচান। মহাদেব কুম্ভমেলার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ার কারণেই সম্ভবত গোরক্ষপন্থী শৈবদের কুম্ভমেলায় স্নানের প্রথম অধিকার দেয়া হয়।
মজার ঘটনা হচ্ছে বিষপাণের জন্য ব্রহ্মা কিন্তু কোনো আর্যদেবতাকে (ইন্দ্ৰ ও বিষ্ণু প্রমুখ) অনুরোধ করেন নি। কোনো আর্যদেবতাও বিষপাণে এগিয়ে আসেন নি। বরং দেখা যাচ্ছে মহাদেব যখন সমুদ্রমন্থনকারী মানুষকে বাঁচানোর জন্য বিষপাণ করছেন আর্যদেবতারা তখন ব্যস্ত অন্য কাজে। তারা ফন্দি আটছেন কী করে পুরো অমৃত আত্মসাৎ করা যায়। এর জন্য তারা ‘অসুরদের’ (ভূমিপুত্র) সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছেন। সমুদ্র থেকে উত্থিত ‘অমৃতকুম্ভ’ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। পালানোতে সাহায্য করছেন ব্রহ্মা ও বিষ্ণু (নারায়ণ) সবাই। সামান্য একটু অমৃত ছদ্মবেশী এক ‘দানব’ (রাহু) পান করায় বিষ্ণু নিজে তার মুণ্ডচ্ছেদ করেন। শেষ অবধি তারা অন্যায় যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন ‘অসুরদের’ সাথে। অথচ মহাভারতের কাহিনীতে দেখা যায় ‘দেবতা’ ও ‘অসুর’দের মধ্যে সমুদ্র মন্থনের চুক্তি হচ্ছে অমৃত সমান সমান ভাগাভাগি হবে। এই চুক্তি রক্ষিত হলে এতসব কাণ্ডের কোনো প্রয়োজন ছিল না। অথচ তাই হল। যারা সমুদ্র মন্থন করলেন ও অমৃতকুম্ভ তুলে আনলেন সেই ভূমিপুত্ররা চুক্তি অনুসারে অমৃতের ন্যায্য ভাগ পেলেন না। এমতাবস্থায় একালে সাধারণ মানুষের অমৃত লাভের উপায় কি?
সাধারণ হিন্দুদের (ভূমিপুত্র) জন্য সুখবর হচ্ছে দেবতারা (আর্যরা) যখন অমৃ- তকুম্ভ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন চারটি স্থানে তারা ‘অসুরদের’ তাড়া খেয়ে বিশ্রাম করেন। এ চারটি জায়গার মধ্যে দুটোতে দৈবক্রমে ‘কুম্ভ’ থেকে দু’এক ফোঁটা অমৃত পড়ে যায়। যে চারটি জায়গায় দেবতারা বিশ্রাম করেছিলেন সেই চার জায়গাতেই এখন ‘কুম্ভমেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ হিন্দু অমৃতের সন্ধানে আজকের দিনে সেখানেই সম্মিলিত হয় দুই ফোঁটার অংশীদার হতে। কাহিনীটি সম্বন্ধে সম্যক ধারণার জন্য ‘কুম্ভমেলার’ ইতিহাস জানা দরকার। কী সেই ইতিহাস?
কলকাতার পাক্ষিক পত্রিকা ‘সানন্দার’ (১৫.১.২০০১) একটি নিবন্ধ থেকে কুম্ভমেলা সম্বন্ধে একটি ধারণা পাওয়া যায়। ‘প্রয়াগে প্রাণের মেলা’ শিরোনামীয় নিবন্ধে লেখক শিবশংকর ভারতী কুম্ভমেলা সম্বন্ধে লিখছেন :
“দেবতা ও অসুরদের মধ্যে কথা হল, সমুদ্রমন্থন করে যা উঠবে তা সমানভাবে ভাগ করে নেবেন উভয়পক্ষ। একসময় সমুদ্র মন্থনে অমৃতভরা কুম্ভ নিয়ে উঠে এলেন দেববৈদ্য ধন্বন্তরী অমৃতের মাহাত্ম্য জানতেন দেবরাজ ইন্দ্র। মুহূর্তমাত্র দেরি করলেন না তিনি। ইশারায় ইন্দ্রপুত্র জয়ত অমৃতভরা কুম্ভ অসুরদের হাতে যাওয়ার আগেই দেববৈদ্যের হাত থেকে নিয়ে ছুটতে লাগলেন। এ ঘটনায় ক্রোধে ফেটে পড়লেন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য। তাঁর আদেশে জয়ন্তর পিছনে ছুটতে লাগলেন অসুররা।
এইভাবে কুম্ভ নিয়ে পালানোর সময় তিনদিন পর পর অমৃতভরা কুম্ভ নামিয়ে ইন্দ্রপুত্র বিশ্রাম করলেন নাসিক, উজ্জয়িনী, প্রয়াগ আর হরিদ্বারে। অসুরদের তাড়া খেয়ে বারোদিন পরে ফিরে এলেন সমুদ্রমন্থন ক্ষেত্রে। কুম্ভ নামানোর সময় কয়েক ফোঁটা অমৃত পড়েছিল হরিদ্বারে ও প্রয়াগে। তাই এ দুটি ক্ষেত্রে হয় পূর্ণ অমৃতকুম্ভের স্নান। মানুষের এক বছর মানে দেবতাদের কাছে একদিন। সেই জন্য প্রতি তিন বছর অন্তর কুম্ভমেলা হয় চার জায়গায়। গড়ে বারো বছর পরে পূর্ণকুম্ভের মেলা হয় এক একটি ক্ষেত্রে।”
ভারতীর বর্ণনাটি এতই সংক্ষিপ্ত যে এর থেকে দেবতাদের চুক্তিভঙ্গ, শঠতা ও ছলনার বিষয়টি ধরা পড়ে না। এমতাবস্থায় শঙ্কু মহারাজের আশ্রয় নেয়া যাক। শঙ্কু মহারাজ তাঁর গ্রন্থে (কুম্ভমেলায় : দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা ১৯৮৯) যেভাবে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে কুম্ভমেলার ঘটনার মধ্যে লুক্কায়িত রয়েছে দেবতাদের একটি অন্যায়যুদ্ধের কাহিনী। রয়েছে দেবতারা (আর্য) কিভাবে অমৃত থেকে অসুরদের (ভূমিপুত্র) অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করেছেন তার কাহিনী। শঙ্কু মহারাজের গ্রন্থে কাহিনীটি এভাবে লিপিবদ্ধ আছে :
“দেবাসুরের সংগ্রাম আজও চলছে।
সেকালের মতো একালেও দুষ্ট-দেবতারা মেহনতি-অসুরদের অমৃত দিচ্ছেন না। মোহিনী- মায়ায় ভুলিয়ে তাঁদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছেন। তাই সংগ্রাম চলছে। এ সংগ্রাম বঞ্চক ও বঞ্চিতের, শোষক ও শোষিতের। এ সংগ্রাম চিরকাল চলবে। কিন্তু চির-কালের কথা থাক। আমি ভাবছি সেকালের কথা। ভাবছি সমুদ্রমন্থনের কথা, অমৃতকুম্ভের কথা।
দেবরাজ ইন্দ্রের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে নারায়ণ লক্ষ্মীদেবীকে সিন্ধুকন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করতে আদেশ দিলেন। তারপরে তিনি পিতামহ ব্রহ্মাকে বললেন দেবতাদের বলুন, তারা অসুরদের সঙ্গে সমুদ্রমন্থন করুক। মন্থন শেষে সমুদ্র থেকে লক্ষ্মী ও ধন্বন্তরি উঠবেন। দেববৈদ্য ধন্বন্তরি অমৃতকুম্ভ নিয়ে আসবেন।
ব্রহ্মার কাছে বিষ্ণুর নির্দেশ শুনে দেবতারা সবাই গোলকে এসে হাজির হলেন। নারায়ণ তাঁদের বললেন তোমরা অসুরদের সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রমন্থন শুরু করো। মন্থনকালে অনেক ঔষধি ও রত্ন পাবে। তাতে লুব্ধ হয়ে যেন আবার মন্থন বন্ধ করে দিও না। ধৈর্য্য সহকারে মন্থন চালিয়ে যেও। তাহলেই তোমরা অমৃত এবং লক্ষ্মী লাভ করতে পারবে।
দেবরাজ ইন্দ্র অসুরদের সমুদ্রমন্থনের আমন্ত্রণ জানালেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন, মন্থনের সম্পদ সমানভাগে ভাগ করে নেবেন। অসুরগণ দেবতাদের সাহায্য করতে সম্মত হলেন।
সমুদ্রমন্থনের আয়োজন সম্পূর্ণ হলো। মন্দার পর্বত হলো মন্থনদণ্ড। বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার কূর্মরাজ মন্দারকে ধারণ করতে সম্মত হলেন। নাগরাজ বাসুকি হলেন মন্থনরজ্জু। দেবতারা তাড়াতাড়ি গিয়ে বাসুকির পেছন দিক ধরলেন। অসুরদের থাকতে হলো সামনে। শুরু হলো সমুদ্রমন্থন। মন্দারের ঘর্ষণে বাসুকি বার বার নিঃশ্বাস ছাড়তে থাকলেন। ধোঁয়ায় আকাশ ছেয়ে গেল। জন্ম নিল দলে দলে মেঘ। দেবতারা মেঘ থেকে বৃষ্টি সৃষ্টি করে শ্রম লাঘব করলেন। বাসুকির গর্জনে ত্রিভুবন কম্পিত হলো। তাঁর মুখ থেকে বিষ বের হতে থাকল। বহু অসুর মারা গেলেন। তবু লক্ষ্মীলাভের আশায় তাঁরা মন্থন বন্ধ করলেন না। বাসুকির দেহের ঘর্ষণে মন্দারপর্বতের বনে আগুনে লেগে গেল। বনবাসীরা যাতে সেই আগুন পুড়ে না যায়, তাই দেবতারা আবার বৃষ্টি সৃষ্টি করলেন। আগুন নিভে গেল। মন্থন চলতে থাকল।
সহসা পঞ্চাশ কোটি ব্রহ্মাণ্ডের দীপ্তি নিয়ে সুধার ষোড়শকলা চন্দ্র উঠে এলেন সমুদ্র থেকে। ঠাঁই নিলেন আকাশে। তারপর সাগর থেকে একে একে উঠে এলো ঐরাবত অশ্ব উচ্চৈঃশ্রবা সুরভী-গাভী অপ্সরা আর নন্দনকাননের পারিজাত। উঠে এলেন মণিরাজ। দেবতারাই তাদের সবাইকে অধিকার করলেন। কিন্তু তাতে অসুররা কোন আপত্তি করলেন না কারণ তাঁরা লক্ষ্মী-লাভের জন্য সমুদ্রমন্থনে এসেছেন। লক্ষ্মী ছাড়া আর কিছু চাই না তাঁদের।
এবারে অমৃতকুম্ভ নিয়ে উঠে এলেন দেববৈদ্য ধন্বন্তরি। অসুরগণ অবিচলিত। তাঁরা ধন্বন্তরিকে চেনেন না, অমৃত জানেন না। তাঁরা লক্ষ্মীলাভের জন্যে সমুদ্রমন্থনে এসেছেন, তাঁরা অমৃতকুম্ভের প্রতি প্রলুব্ধ হলেন না।
কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র জানতেন ঐ অমৃতকুম্ভ অমূল্য। তাই তিনি কানে কানে পুত্র জয়ন্তকে বললেন দৈববৈদ্যের কাছ থেকে কুম্ভটি চেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যা এখান থেকে। সাবধান, ওটি যেন অসুরদেও হাতে না পড়ে। জয়ন্ত পিতৃআজ্ঞা পালন করলেন। তিনি অমৃতকুম্ভ নিয়ে ছুটতে শুরু করলেন।
অসুরগণ লক্ষ না করলেও ব্যাপারটা তাঁদের গুরুদেব শুক্রাচার্যের দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি চিৎকার করে অসুরদের বললেন – ওরে মূর্খের দল, এত কষ্ট করে সমুদ্রমন্থন করছিস আর ঐ দ্যাখ্ জয়ন্ত অমৃতকুম্ভ নিয়ে পালাচ্ছে। ঐ অমৃতমন্থনের সারবস্তু। শিল্পীর ছুটে যা, জয়ন্তর কাছ থেকে অমৃতকুম্ভ কেড়ে নিয়ে আয়! কয়েকজন অসুর মন্থন ছেড়ে তাড়াতাড়ি জয়ন্তকে ধরতে ছুটলেন। জয়ন্ত ছুটছেন আগে আগে আর অসুররা তাঁর পেছনে। তিনদিন অবিরাম ছোটার পরে জয়ন্ত শ্রান্ত হয়ে পড়লেন। তিনি অমৃতকুম্ভ মাটিতে নামিয়ে রেখে বিশ্রাম নিতে থাকলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ বিশ্রাম তাঁর কপালে লেখা ছিল না। কিছুক্ষণ বাদেই দেখতে পেলেন, অসুররা এসে গিয়েছেন। তাড়াতাড়ি অমৃতময় পূর্ণকুম্ভ মাথায় নিয়ে তাঁকে ছুটতে হলো। তিনিদিন পরে আবার তিনি এক জায়াগায় অমৃতকুম্ভ রেখে বিশ্রাম নিলেন কিছুক্ষণ। তারপরে অসুররা এসে পড়তেই তাঁকে পূর্ণকুম্ভ নিয়ে ছুটতে হলো।
এইভাবে তিনদিন পরে পরে জয়ন্ত চায় জায়গায় অমৃতকুম্ভ নামিয়ে রেখে বারোদিন বাদে ফিরে এলেন সমুদ্রমন্থনস্থানে। ইতিমধ্যে সেখানে সিন্ধু থেকে লক্ষ্মীদেবিও উঠে এসেছেন। অসুরগণ তাঁদের ন্যায্য অংশ দাবী করলেন, দেবতারা সম্মত হলেন না। দেবাসুরের সংগ্রাম শুরু হলো। ন্যায়ের জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সংগ্রাম, বঞ্চকের বিরুদ্ধে বঞ্চিতের সংগ্রাম। এ সংগ্রাম আজও চলছে, চিরকাল চলবে।
সেই ন্যায়যুদ্ধে দেবতাদের জয়লাভের কোন সম্ভাবনা ছিল না বলেই বোধ করি ন্যায়ের পরম আশ্রয় নারায়ণকে অন্যায়ের আশ্রয় নিতে হলো। তিনি দেবাসুরের সামনে মোহিনীরূপে আবির্ভূত হলেন। তারপরে মোহিনী-মায়ায় আচ্ছন্ন করে সরল অসুরদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করলেন। অমৃত পান করে দেবতারা অমৃত হলেন।
পালাবার সময় জয়ন্ত যে চার জায়গায় অমৃতকুম্ভ নামিয়ে বিশ্রাম করেছিলেন, সেই জায়গা চারটি হলো-হরিদ্বার, প্রয়াগ, নাসিক ও উজ্জয়িনী। কথিত আছে, অমৃতময় পূর্ণকুম্ভ নামিয়ে রাখবার সময় হরিদ্বার ও প্রয়াগে কয়েক ফোঁটা করে অমৃত পড়ে যায়। জয়ন্ত তিনদিন ছোটার পরে এক-একটি জায়গায় পৌঁছেছিলেন এবং বারোদিন বাদে ফিরে এসেছিলেন। দেবতাদের একদিনে মানুষের এক বছর। তাই বারো বছর বাদে এই চার জায়গার কোনখানে কুম্ভমেলা হয় পূর্ণকুম্ভ। হরিদ্বার ও প্রয়াগে কয়েক ফোঁটা অমৃত পড়ে গিয়েছিল বলে কেবল এই দু’জায়গাতেই প্রতি তিন বছর বাদে বাদে অর্ধকুম্ভ অনুষ্ঠিত হয়।”
ভারতী ও শঙ্কুমহারাজের বর্ণনাতে মহাদেবের ‘নীলকণ্ঠ’ হওয়ার প্রসঙ্গটি নেই। নেই বিষ্ণু (আর্য দেবতা) কর্তৃক সংঘটিত অন্যায়ের উল্লেখও। তাই দেখা যাক এ দুটো বিষয়ে ‘মহাভারত’ (রাজশেখর বসুর সারানুবাদ) কি বলছে। মহাভারত লিখছে :
“…অতিশয় মন্থনের ফলে কালকূট উঠল, সধুম অগ্নির ন্যায় সেই বিষে জগৎ ব্যাপ্ত হল। ব্রহ্মার অনুরোধে ভগবান মহেশ্বর সেই বিষ কণ্ঠে গ্রহণ করলেন, সেই থেকে তাঁর নাম নীলকণ্ঠ।
দানবগণ অমৃত ও লক্ষ্মী লাভের জন্য দেবতাদের সঙ্গে কলহ করতে লাগল। নারায়ণ মোহিনী মায়ায় স্ত্রীরূপ ধারণ করে দানবগণের কাছে গেলেন, তারা মোহিত হয়ে তাঁকে অমৃত সমর্পণ করলে। তিনি দানবগণকে শ্রেণীবদ্ধ করে বসিয়ে কমণ্ডলু থেকে কেবল দেবগণকে অমৃত পান করালেন। দানবগণ ক্রুদ্ধ হয়ে দেবগণের প্রতি ধাবিত হল, তখন বিষ্ণু অমৃত হরণ করলেন। দেবতারা বিষ্ণুর কাছ থেকে অমৃত নিয়ে পান করছিলেন সেই অবসরে রাহু নামে এক দানব দেবতার রূপ ধারণ করে অমৃত পান করলে। অমৃত রাহুর কণ্ঠদেশে যাবার আগেই চন্দ্র ও সূর্য বিষ্ণুকে বলে দিলেন, বিষ্ণু তখনই তাঁর চক্র দিয়ে সেই দানবের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। রাহুর মুণ্ড আকাশে উঠে গর্জন করতে লাগল, তার কবন্ধ (ধড়) ভূমিতে পড়ল, সমস্ত পৃথিবী কম্পিত হল। সেই অবধি চন্দ্রসূর্যের সঙ্গে রাহুর চিরস্থায়ী শত্রুতা হল।
বিষ্ণু স্ত্রীরূপ ত্যাগ করে দেবগণের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঘোর যুদ্ধ করলেন। দানবগণ পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেল।”
ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, যে অমৃতের সন্ধানে লক্ষকোটি হিন্দু আজকে কুম্ভমেলায় সমবেত হয় তা উত্তোলিত হয়েছে অসুরদের দ্বারা। কিন্তু উত্তোলিত অমৃত আত্মসাৎ করে নেয় ‘দেবতারা’। যে ফোঁটা দু’য়েক অমৃত কুম্ভ থেকে মাটিতে পড়ে তাও ‘অসুরদের’ কৃতিত্বে। এমতাবস্থায় ‘অসুররাই’ (অর্থাৎ ভূমিপুত্ররা) আমাদের পূজ্য হয় নাকি? কিন্তু আমরা জানি হিন্দুদেরকে বিশ্বাস করানো হয় আর্য ‘দেবতারাই’ পূজ্য। স্থানীয় লোকদের অন্যায় সহ্যের ক্ষমতা, উদারতা, সহনশীলতা, উন্নাসিকতা বা অজ্ঞতাই কি এর কারণ? না কি তা শিক্ষিত হিন্দুদের আর্যামিরই ফল? অবশ্য রক্ষা, আজকের দিনে ‘দেবতা অসুরের’ এই দ্বন্দ্বকে দেখানো হয় ‘শুভ-অশুভের’ মোড়কে। তারপরও কথা থেকে যায়। আর্য দেবতারা বার বার দেশিয়দের প্রতি এমন অন্যায় আচরণ, শঠতা, ছলনা, বৈষম্য ও ঘৃণা করেও কিভাবে যুগের পর যুগ কিছু হিন্দুর পূজা পেয়ে আসছে?