স্ট্রেঞ্জার – ৬১

একষট্টি

আরেকটা ঝিলিক হতেই রানা দেখল, লক্ষ্যভেদ করেছে ওর পঞ্চম বুলেট। হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে গেছে রিচি নোভাক। দু’হাতে চেপে ধরেছে পেট। টলমল করছে বোটের কিনারায় দাঁড়িয়ে।

তীরবেগে চলেছে বোট।

রিভলভারে গুলি ফুরিয়ে গেছে বলে ঝট্ করে পায়ের কাছ থেকে বন্দুকটা তুলে নিয়ে কাঁধে ঠেকাল রানা। চেম্বারে আছে দশ গেজের বাকশট। ওটার পেলেটগুলো অত দূরে পৌঁছুবে ঠিকই কিন্তু অনেক ছড়িয়ে যাবে, হয়তো লক্ষ্যে লাগবে না। তবু…

বড় করে শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে স্থির করল রানা, পরক্ষণে বন্দুকের নল কয়েক ইঞ্চি ওপরে তুলে টিপে দিল ট্রিগার।

আর কিছু করার নেই। বোটের দিকে চেয়ে রইল রানা। তবে দু’সেকেণ্ড পর হঠাৎই অন্ধকারে দেখল লকলকে আগুন। কমলা ও নীল শিখা ছড়িয়ে গেল বোটের পেছনে।

রিচির গায়ে না লাগলেও বুলেট বিঁধেছে স্পেয়ার গ্যাস ক্যান-এ, বুঝে গেল রানা। বাকশটের সীসা আগুন জ্বেলে দিয়েছে ওই দাহ্য তরলে।

আগুন থেকে পিছিয়ে টলমল করে বোটের সামনের দিকে চলল রিচি। আগুন ধরতেই বুম্ শব্দে বিকল হলো মোটর I দ্রুত কমছে বোটের গতি। লকলকে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে বোটে। জ্যান্ত রোস্ট হতে চলেছে রিচি নোভাক।

আগুনের আলোয় রানা দেখল, কয়েক পা পিছিয়ে দ্বীপের দিকে আবার তাকাল লোকটা। আগুনের হলকা পোড়াচ্ছে তাকে। বাধ্য হয়ে পানিতে নেমে পড়ল রিচি। বুঝতে চাইছে কোনদিকে রওনা হবে।

তাকে গ্রেফতার করতে পারবে, বুঝে গেল রানা। বন্দুক ফেলে তৈরি হলো বাইয়ুতে নামতে। কিন্তু তখনই বোটের আগুনে দেখল অদ্ভুত এক দৃশ্য।

বোটের কাছে দেখা দিয়েছে মস্ত এক অ্যালিগেটর। বিরাট হাঁ মেলে খপ্ করে শিকারের পেট কামড়ে ধরল ওটা। ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে চাইলেও এক টনি মাংসাশী প্রাণীটার শক্তি রিচির চেয়ে বহুগুণ বেশি। মুখের ভেতর __ শিকারকে ঘুরিয়ে নিয়ে বাইয়ুর থকথকে পানির নিচে তলিয়ে গেল অ্যালিগেটর!

ভাসছে জ্বলন্ত বোট, একটু পর আবর্জনা ছড়িয়ে টুপ করে তলিয়ে যাবে। আরও দুই মিনিট দাঁড়িয়ে থাকল রানা বাইয়ুর তীরে। পানির ওপর আর দেখা গেল না রিচি নোভাককে।

কয়েক মুহূর্ত পর গলা থেকে কবচ খুলে নিয়ে বাইয়ুর পানিতে ছুঁড়ে ফেলল রানা। কাজ শেষে ওটা ফেলে দিতে বলেছিলেন বড়মা এবি পামবো। ঘুরে বন্দুক তুলে নিয়ে উঠানের দিকে চলল রানা। আনমনে ভাবল, লিয় বাউয়ারের পেটে তলোয়ার গেঁথে খুন করেছিল রিচি নোভাক। আজ একইরকম জখম নিজের পেটে নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো তাকেও

দশ মিনিট পর উঠানে ফিরল রানা।

এরই ভেতর জঙ্গল এড়িয়ে উঠানে নেমেছে স্টেট পুলিশের বেল ৪৬০ হেলিকপ্টার। ওটা থেকে নেমেছে কয়েকজন প্যারামেডিক। এলিসার ছেলেমেয়ে ও শেরিফকে শুশ্রূষা দিচ্ছে তারা। তাদের নেতা জানিয়ে দিল, দ্বীপের দিকে আসছে বেশ কয়েকটা অ্যাম্বুলেন্স।

একবার বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল রানা, ওরা যেন অনেকগুলো বডি ব্যাগ সঙ্গে করে আনে।

এলিসা, বাচ্চারা, অফিসার লরেন্স, শেরিফ আর ে শেরিফ মাসুদ রানাকে নিয়ে সরাসরি ক্লোভিস প্যারিশের মেডিকেল সেন্টারে পৌছুল হেলিকপ্টারের পাইলট। অপেক্ষা করছিলেন ডাক্তার ও নার্সরা। ইনজুরি ও শকের চিকিৎসার জন্যে অন্য ওয়ার্ডে সরিয়ে নেয়া হলো এলিসা ও বাচ্চাদেরকে। প্রথম কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে ফিরতেই ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন কর্তৃপক্ষের সবাই। মারা গেছে বেশিরভাগ পুলিশ অফিসার। যারা এখনও জীবিত, তাদের অবস্থাও ভাল নয়।

রানা বারবার আপত্তি তুললেও জোর করে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো এক্স-রে রুমে। ফোলা পাঁজর ও পেটের ক্ষতটা দেখলেন বয়স্ক এক ডাক্তার। মাথা নেড়ে বললেন, পেটের সেলাই নিখুঁত। ভাল নার্সের সাহায্য পেয়েছেন। তবে পাঁজরের হাড়ে চিড় ধরেছে, পুরোপুরি সারতে কয়েকটা দিন সময় লাগবে।’

তাঁর কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে লাউঞ্জে চলে এল রানা। হাসপাতালে এলিসা ও বাচ্চাদের জন্যে অপেক্ষায় আছে জোসেফ গুডরিচ। শেরিফের অফিসে সংবাদ পৌঁছুতেই তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে এক ডেপুটি শেরিফ। লাউঞ্জে তার সঙ্গে দেখা হলো রানার।

গত একঘণ্টা ধরে ভীষণ দুশ্চিন্তা নিয়ে পায়চারি করেছে জোসেফ। রানাকে দেখে ছুটে এসে গ্রিজলি ভালুকের মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল।

‘সাবধান,’ ব্যথা পেয়ে মুখ কুঁচকে ফেলল রানা। ‘ফেটে গেছে পাঁজরের হাড়।’

লজ্জা পেয়ে পিছাল জোসেফ গুডরিচ

‘ওরা ঠিক আছে?’

রানা মাথা দোলাতেই স্বস্তি বোধ করলেও কেঁদে ফেলল জোসেফ। অধীর হয়েছে ওদেরকে নিজ চোখে দেখার জন্যে।

‘ওরা ভাল আছে,’ মুখে বলল রানা। ‘তবে অনেক ভোগান্তি গেছে ওদের ওপর দিয়ে।’

‘তুমি বলেছিলে ওদেরকে ফিরিয়ে আনবে, তাই করেছ। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমার নেই, বন্ধু। ‘

‘তুমি আর তোমার গোটা পরিবার আমার জন্যে যা করেছ, সেই তুলনায় কিছুই করিনি আমি,’ বলল রানা। ‘আমিই বরং তোমাদের সবার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।’

‘কী যে বলো! তুমি আমাদের পরিবারের সবার হিরো!’

‘তাই যদি হয়, তো পরে একটা বিয়ার কিনে খাইয়ো।’

‘একটা নয়, অন্তত দশটা! আমিও নেব গোটা সাতেক।’

মৃদু হাসল রানা। আর কিছু বলার আগেই ওদের সামনে থামল একজন মেইল নার্স। জোসেফকে বলল, ‘মিসেস গুডরিচ আর ছেলেমেয়ের পরীক্ষা শেষ। এখন চাইলে দেখা করতে পারেন, মিস্টার গুডরিচ। ‘

রানার দিকে মাথা দুলিয়ে মেইল নার্সের পিছু নিল জোসেফ। পারিবারিক মিলনে কাবাবের হাড্ডি হতে চাইল না রানা। মৃদু হাসল। হাসপাতালে এসে থামছে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স ও করোনারের গাড়ি। ব্যস্ত এক ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতেই রানাকে তিনি বললেন, ‘ইমারজেন্সি রুম-এ রয়েছেন শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। সুস্থ হয়ে যাবেন তিনি।’

ডাক্তার বিদায় নিতেই রানার সামনে থামল দু’জন স্টেট ট্রুপার। তারা নাকি ওকেই খুঁজছে। তাদেরকে বলা হয়েছে রানাকে শেরিফের অফিসে পৌঁছে দিতে।

তাদের সঙ্গে পেট্রল কার-এ উঠল রানা। বিশ মিনিট পর শেরিফের অফিসে টাকমাথা, গম্ভীর এক এফবিআই এজেন্টের মুখোমুখি বসল। লোকটার নাম জনি টি. ট্রাম্প। পরনে সাধারণ পোশাক। এফবিআই-এর ব্যাটন রৌগের অফিস থেকে এসেছে সে।

খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে জনি টি. ট্রাম্পকে। সামনে একগাদা অফিশিয়াল কাগজ। ওপরেরটা জাজের রাবার স্ট্যাম্প দেয়া অনুমতি পত্র। ওখানে লেখা, যেন গ্রেফতার করা হয় রিচি ও হ্যাঙ্ক নোভাককে। একইসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রমাণ নেই বলে বেকসুর মুক্তি দেয়া হচ্ছে মিস্টার মাসুদ রানাকে। পরের কাগজে রয়েছে শেরিফের প্রি-অপারেশন রিপোর্ট। তাতে জানানো হয়েছে কীভাবে রেইড করা হবে নোভাক দ্বীপে।

রানাকে হাজারখানেক প্রশ্ন করল এফবিআই এজেন্ট জনি টি. ট্রাম্প। একে একে জবাব দিল রানা। তবে ওর উত্তর হলো সংক্ষিপ্ত। বিরক্ত হয়ে ওঠার পর বলল, ‘জানি না আপনাকে কতটা সাহায্য করতে পারব, এজেন্ট ট্রাম্প। আসলে সবই ঘটেছে খুব দ্রুত। ভাল করে বুঝতেও পারিনি। শেরিফ আমাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন অবসার্ভার হিসেবে। ফলে লাইমলাইটে ছিলাম না। তেমন কিছু দেখিনি। আসলে কী হয়েছিল তা জানতে হলে জীবিত অফিসারদের সঙ্গে কথা বললেই ভাল করবেন।’

‘বলার মত মানুষই তো প্রায় নেই!’

‘সত্যিই দুঃখজনক।’

রানা এ কথা বলার পর চোখ বুজে নাকের ডগা খুঁটতে লাগল এজেন্ট ট্রাম্প। কয়েক মুহূর্ত পর চোখ মেলে বলল, ‘যা ঘটল, একেবারে দুঃস্বপ্নের মত। যাই হোক, কথা বলেছি অফিসার লরেন্সের সঙ্গে। সে বলল লিয বাউয়ারের খুনের কথা স্বীকার করেছিল রিচি ও হ্যাঙ্ক নোভাক। এরপর নিজের লোকের হাতে খুন হয়েছে হ্যাঙ্ক নোভাক। তার আগে সে খুন করেছে অফিসার উডো রবার্টসকে। ওদিকে পালিয়ে গেছে রিচি নোভাক। আপনি নাকি নিজ চোখে তাকে দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে দেখেছেন?’

‘মিথ্যা বলার মানুষই নন অফিসার জেনি লরেন্স,’ বলল রানা। ‘গোলাগুলির ভেতর যা দেখেছেন, তাই বলেছেন। আগেই বলেছি, গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে আমি তেমন জড়িত ছিলাম না, এখনও নেই।’

‘রিচি নোভাককে খুঁজতে শুরু করেছে এফবিআই এজেন্টরা। আপনি হয়তো জানেন না জানোয়ারটা কোথায় যেতে পারে?’

‘আমার কোনও ধারণা নেই,’ বলল রানা, ‘তাকে দেখেছি কয়েক পলকের জন্যে।’

‘তাহলে শেষ একটা প্রশ্ন, মিস্টার রানা। শুনেছি অপারেশনের এক পর্যায়ে আপনাকে ডেপুটি হিসেবে নিয়োগ দেন শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। এ কথা কি সত্যি? যে লোক গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত নয়, তাকে ডেপুটি করা আমার কাছে অদ্ভুত বলে মনে হয়েছে।’

মৃদু হাসল রানা। ‘বুনো পশ্চিমের লোক, শেরিফ হয়তো চেয়েছেন বাড়তি লোককে কাজে লাগাতে। তবে পরে আমাকে আর কিছুই করতে হয়নি।’

‘ওই ব্যাজটা এখনও আপনার কাছে আছে?’ জানতে চাইল এফবিআই এজেন্ট। ‘ওটা কিন্তু সরকারের সম্পত্তি।’

‘দ্বীপেই ওটা ফেরত দিয়েছি শেরিফের হাতে,’ বলল রানা।

‘শুনলাম আপনি বিখ্যাত রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির চিফ?’

‘কথাটা মিথ্যা নয়। এদিকে এসেছিলাম আমার প্রিয় একজন বংশীবাদকের অনুষ্ঠান শুনতে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল এজেন্ট জন সি. ট্রাম্প। ‘গোটা ব্যাপারটা কেমন ঘোলাটে লাগছে। তবে আপনাকে আটকে রাখার কোনও যুক্তি দেখছি না। আপনি যখন খুশি বিদায় নিতে পারেন, মিস্টার রানা। …আর ক’দিন আমেরিকায় থাকছেন?’

‘প্রথম সুযোগেই বাংলাদেশে ফিরব,’ বলল রানা।

এ কথা শুনে খুশি হলো এফবিআই এজেন্ট। মোটা হাতটা রানার দিকে বাড়িয়ে দিল। ‘শুভ হোক আপনার ট্রিপ।’

হ্যাণ্ডশেক করে শেরিফের অফিস থেকে বেরিয়ে এল রানা। বাইরের পরিবেশ শীতল। বাতাসে ফুলের সুবাস। আকাশে ঝিকমিক করছে হাজার হাজার নক্ষত্র।

রাস্তার দিকে পা বাড়াতেই পাশে এসে থামল ক্লোভিস প্যারিশের শেরিফ ডিপার্টমেন্টের একটা গাড়ি। নেমে গেল ড্রাইভারের জানালার কাঁচ। হাসিমুখে রানার দিকে চেয়ে আছে জেনি লরেন্স। এখন পরনে পরিষ্কার ইউনিফর্ম। মেয়েটাকে দেখে কেউ বুঝবে না, দু’ঘণ্টা আগে লড়াই করেছে নোভাক দ্বীপের জঙ্গলে।

‘কী হাল তোমার, অফিসার লরেন্স?’ মৃদু হাসল রানা। ‘অফিসারের কাঁথা পুড়ি! তবে ভাল আছি। বুকে একটা ফোর্টি-ফোর ম্যাগনাম রাউণ্ডের ধাক্কা দমাতে পারবে না আমাকে।’

‘গুড!’

‘যাবে নাকি আমার সঙ্গে… মানে, আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।’

‘আপত্তি নেই।’ প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসল রানা। ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’

‘আবারও হাসপাতালে, কথা আছে শেরিফের।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *