স্ট্রেঞ্জার – ৫৮

আটান্ন

রিচি ও হ্যাঙ্ক নোভাককে খুঁজছিল রানা, এবার পেয়ে গেছে তাদেরকে। কিন্তু এভাবে তাদেরকে পাবে ভাবতেও পারেনি ও। গুডরিচদেরকে সঙ্গে এনেছে দুই ভাই।

যে স্টিলের বড় রিভলভার দিয়ে জেনিকে গুলি করেছে রিচি, সেটা এখন ঠেসে ধরেছে এলিসার মাথার পাশে। ভীষণ ভয় পেয়েছে মহিলা। চোখ থেকে দরদর করে নেমে দুই গাল ভিজিয়ে দিচ্ছে অশ্রু। দু’হাতে শক্ত করে ধরেছে টিনাকে মা-র ঊরু জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রব। কিশোর রনের কবজি ধরে রেখেছে হ্যাঙ্ক নোভাক। ছেলেটার গলায় ধরেছে ধারালো ছোরা। ওটার ফলা থেকে ঝিলিক দিচ্ছে চাঁদের আলো।

মার খেয়ে রনের মুখ ও গাল ফুলে গেছে, দেখল রানা। বুঝে গেল, কিডন্যাপারদেরকে বাধা দিতে চেয়েছিল ছেলেটা। তবে ওর চেয়ে অনেক শক্তিশালী রিচি বা হ্যাঙ্ক।

‘নিশ্চয়ই ওদেরকে নিয়ে যেতে এসেছ, রানা,’ বলল রিচি। ‘তাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আমরা।’

‘বন্দুক সামলে, রানা,’ টিটকারি হাসি হ্যাঙ্কের ঠোঁটে ‘এসব মাল তোমার যেমন দরকার, আমাদেরও চাই। বুঝতে পেরেছ?’

রানার পায়ের কাছে মাটিতে পড়ে আছে জেনি লরেন্স। এক ফোঁটা নড়ছে না।

বন্দুকের ট্রিগার থেকে তর্জনী সামান্য সরালেও মাযল নামাল না রানা। মগজে খেলছে ব্যালিস্টিক, স্পিড, রিঅ্যাকশন টাইম ছাড়াও আরও কিছু বিষয়। নোভাক আর গুডরিচদের কাছ থেকে মাত্র পনেরো ফুট দূরে আছে ও। এত কম রেঞ্জে দশ গেজের ভারী পেলেট খুব ছড়িয়ে যাবে না। প্রায় একই জায়গায় লাগবে বারোটা ভারী পেলেট। ওগুলো আঘাত হানবে বারোটা নাইন এমএম বুলেটের মত। আত্মবিশ্বাসী রানার মনে হলো, রনকে আহত না করেই শেষ করতে পারবে হ্যাঙ্ক নোভাককে। কাজটা সহজ। তবে এর পরের কাজ ঢের বেশি কঠিন। কমপক্ষে দুই সেকেণ্ড লাগবে উইনচেস্টারের চেম্বারে আবারও গুলি ভরতে। ইজেক্ট করতে হবে খালি খোসা। প্রায় একইসময়ে চেম্বারে ঢুকবে নতুন কার্তুজ। কিন্তু এসব করার আগেই রিভলভারের ট্রিগার টিপে দেবে রিচি নোভাক। উড়ে যাবে এলিসা অথবা রানার মগজ। কারও সাধ্য নেই যে, বন্দুক দিয়ে রিচিকে আগেই শেষ করবে।

আবার অন্যভাবেও ব্যাপারটা দেখা যায়। তাতেও কমবে না বিপদ। রিচি নোভাককে গুলি করে এলিসাকে বাঁচাতে পারে রানা। সেক্ষেত্রে ছোরা দিয়ে রনের গলা ফাঁক করে দেবে হ্যাঙ্ক।

অবিশ্বাস্য কিছু না ঘটলে এলিসা আর রনকে একইসঙ্গে বাঁচানো অসম্ভব। আজকাল কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে না পৃথিবীতে। পায়ের কাছেই পড়ে আছে নিথর জেনি আজকে হঠাৎ করেই নিজেকে খুব একাকী লাগল রানার। যদিও প্রকাশ হতে দিল না নিজের অনুভূতি।

‘তোমার খেলা খতম, রিচি নোভাককে বলল রানা। ‘তুমি হয় মরবে, নয় তো জেলে যাবে। ভাল চাইলে ছেড়ে দাও ওদেরকে। আমি দেখব যাতে ভাল কোনও সেলে বাকি জীবন কাটাতে পারো। কয়েক বছর পর হয়তো তোমাকে ছেড়েও দিতে পারে কারাগার কর্তৃপক্ষ।’

‘নিজে পুলিশ হত্যাঁকারীর মুখে ভালই বোল ফুটছে দেখছি!’ হাসল রিচি নোভাক।

থুতনি তাক করে উডো রবার্টসসের লাশ দেখাল হ্যাঙ্ক। *জানো না, আইনের লোককে খুন করলে নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড?’

‘ভাল ঝামেলাতেই জড়িয়ে গেছি, কী বলো?’ বলল রানা।

‘তাই তো মনে হচ্ছে,’ বলল রিচি। ‘তবে এই বিপদ থেকে বেরোতে পারবে মাত্র একটা পক্ষ। অন্য পক্ষ মরবে।’

‘তুমি ঠিক আছ?’ এলিসার উদ্দেশে বলল রানা। ‘এরা কোনও নির্যাতন করেনি তো?’

চাঁদের আলোয় ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে এলিসার মুখ। ফাঁপা গলায় জবাব দিল সে, ‘ওরা রনকে খুব মেরেছে।’ রিচি অস্ত্রের মাযল দিয়ে ওর মাথার পাশে খোঁচা দিতেই গাল কুঁচকে ফেলল এলিসা।

‘এই মাগীর বাচ্চাগুলো একটাও মানুষ হয়নি,’ বলল হ্যাঙ্ক। ‘দু-চারটে চড় আর লাথি দিয়ে মানুষ করতে চেয়েছি।’

‘আমরা ব্যবসায়ী,’ বলল রিচি, ‘প্রথম কথা, মালের ক্ষতি করি না। ভাল আছে ওরা। ঠিক যেমনটা চাই আমি।’

খিক খিক করে হাসল হ্যাঙ্ক। ‘ওদের হাল তোমার পুলিশ বন্ধুদের চেয়ে অনেক ভাল। তাই না?’

তার বড়ভাই ঠাট্টা বোঝার লোক নয়। সরাসরি নিষ্পলক চেয়ে আছে রানার চোখে। ‘ব্যবসার কথা যখন উঠল, আমরা না একটা চুক্তি করেছি? এখন এটাও মনে হচ্ছে, ওই চুক্তি তুমি ভেঙেছ। তবে যৌক্তিক মনের মানুষ আমি। এখনও ওই চুক্তি বলবৎ থাকতে পারে।’

‘নিজেকে তোমার হাতে তুলে দেব, বদলে ওদেরকে ছেড়ে দেবে তোমরা,’ বলল রানা। ‘সেটার কথাই কি বলছ?’

‘তা ঠিক নয়। চুক্তির প্রথম দিকটা বুঝতে পেরেছ। তুমি আত্মসমর্পণ করবে। তারপর মাথা পেতে শাস্তি নেবে প্যাট্রিককে হত্যা করার জন্যে। আর চুক্তির দ্বিতীয় অংশ হিসেবে গুডরিচদের ছেলেগুলোর চামড়া ছাড়িয়ে ওদের শরীর ফেলব বাইয়ুর ভেতর। খুশি হয়ে খাবে অ্যালিগেটরগুলো। তা ছাড়া, ছেলেদের দিয়ে আমার কী কাজ? তবে কুত্তী ওই মেয়েলোকটা আর ছোট কুত্তীটার ব্যাপার একেবারে আলাদা। এরই ভেতর বিক্রির জন্যে দরদাম হচ্ছে কয়েকজনের সঙ্গে।’

ভেজা চোখ বুজে শক্ত করে টিনাকে আঁকড়ে ধরল এলিসা। ভীষণ ভয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল রব। হ্যাঙ্কের কাছ থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিতে চাইল রন। তবে লোহার মত কঠিন হাতে ওকে ধরেছে হ্যাঙ্ক। রনের গলার ওপর চেপে বসল ছোরার ফলা। টপ্ করে কালো এক ফোঁটা রক্ত পড়ল ছেলেটার জামার বুকপকেটে। হঠাৎ করেই থমকে গেছে বেচারা।

‘তা হলে টেক্সাস আর টেনেসির ব্যবসায়িক পার্টনারদের হতাশ করতে চাও না তোমরা?’ বলল রানা।

তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কাঁধ ঝাঁকাল রিচি। বিরাট রিভলভার ঠেসে ধরেছে এলিসার মাথার পাশে। ‘ও, তা হলে জেনেছ। এরই ভেতর অর্ডার এসেছে। আমি সবকিছুর ওপরে রাখি ‘ব্যবসা।’

‘অচল অবস্থায় পড়েছি আমরা,’ বলল রানা। ‘তোমার প্রস্তাবটা আমার একদম ভাল লাগেনি।’

‘আগেই বলেছি, এর এদিক-ওদিক হওয়ার নয়,’ বলল রিচি।

‘তার মানেই, মরবি তুই,’ থুতু ছিটিয়ে রানাকে বলল হ্যাঙ্ক।

‘তোমরা তো ভাবছ আমাকে চিনেছ,’ বলল রানা। ‘অথচ, তা আসলে ঠিক নয়।’

চোখ সরু করে ওকে দেখল রিচি। ‘কী বলতে চাও?’

তোমরা ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি করার আগে আমি নিজেই ওদেরকে খুন করব। বন্দুকে আছে তিনটে কার্তুজ। একটা ব্যয় হওয়ার পর বলো তো অন্য দুই কার্তুজ কোন্ কাজে লাগবে?’

তিক্ত হাসল রিচি। কঠিন চিড়িয়া! বলতে খারাপই লাগছে, তোমাকে রীতিমত শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে হচ্ছে।’

‘পেছনের দেয়ালে নাড়িভুঁড়ি ছিটিয়ে পড়লে তখন শ্রদ্ধা- ভক্তি সব উড়ে যাবে তোমার,’ বলল রানা, ‘সবকিছু সবার জন্যে ভাল হয় না। বিশেষ করে তোমার ক্ষেত্রে

‘পরে দেখব,’ বলল রিচি, ‘হ্যাঙ্ক, দু’ফাঁক করে দাও ছোকরার গলা।’

হ্যাঙ্ক কিছু করার আগেই বিদ্যুদ্বেগে নড়ে উঠল রানা।

গলা ভালভাবে দেখার জন্যে রনের মাথার চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিল হ্যাঙ্ক, খলখল করে হাসছে। ছেলেটার গলার ওপর চেপে বসল ছোরার ফলা। টপটপ করে পড়ছে রক্ত। ভাইকে মেরে ফেলছে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল রব ও টিনা। ব্যথা পেয়ে কাতরে উঠল রন। এলিসার বুক চিরে বেরোল চাপা আর্তনাদ

একই সময়ে রানার বাকশট উড়িয়ে দিল হ্যাঙ্কের মাথার বামদিকটা। রাতের আকাশ ভরে গেল বিকট ‘বুম!’ আওয়াজে।

রিভলভারের গুলিতে মরবে এলিসা, বুঝে গেছে রানা। কিন্তু তখনই ঘটল অলৌকিক কিছু!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *