স্ট্রেঞ্জার – ৫৬

ছাপ্পান্ন

ওই লোক পুলিশ দলের সদস্য। অন্যদের মতই পরনে ফোলা জ্যাকেট। পিঠে বড় করে লেখা: পুলিশ। বন্দুক নামিয়ে তাকে দেখল রানা। দীর্ঘদেহী, ধূসর চুলের সেই লোক। রানার মনে পড়ল নামটা: উডো রবার্টস। তাকে শেষ দেখেছে ঝোপের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়তে।

মনে সামান্য দ্বিধা নিয়ে তার দিকে চলল রানা। জঙ্গলের ভেতর দু’মিনিট হাঁটার পর দেখল, আহত শেরিফ আর জেনি লরেন্সের পাশে পৌছে গেছে অফিসার রবার্টস।

প্রায় একইসময়ে ওখানে পৌঁছল রানা। অবাক চোখে ওর দিকে তাকাল জেনি। ‘কী? পারলে ওদেরকে শেষ করতে?’

‘সবাইকে নয়,’ বলল রানা। উডো রবার্টসসের দিকে চেয়ে জানতে চাইল, ‘তুমি কোথা থেকে উদয় হলে?’

গায়ে আঁচড় পড়েনি তার। ভেজা জমিতে ঝাঁপ দিয়েছিল বলে গালে সামান্য কাদা। রানার আকস্মিক আগমনে সে উত্তেজিত ও বিব্রত। কাটা পড়া গাছপালার দিকে আঙুল তাক করল উডো রবার্টস। ‘ওদিকে লুকিয়ে ছিলাম। আমাকে দেখতে পায়নি। আরেকটু হলে শেষ হয়ে যেতাম। চারপাশে তাকাল সে। ‘আমাদের দলের আর কেউ নেই?’

‘রিচি আর হ্যাঙ্ককে ধরতে তোমার সাহায্য লাগবে,’ বলল রানা। ‘তুমি যাওয়ার জন্যে তৈরি?’

আবারও দ্বিধায় পড়ল রবার্টস। ‘ইয়ে…আসলে…. হারিয়ে ফেলেছি আমার পিস্তল।’

‘এটা নাও,’ পকেট থেকে নিয়ে গুক পিস্তলটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল রানা।

‘রানা, তুমি না বলেছিলে একা যাবে?’ জানতে চাইল জেনি।

‘প্ল্যান পাল্টে নিয়েছি,’ বলল রানা, ‘সঙ্গে থাকছে অফিসার রবার্টস।’

কড়া চোখে রানাকে দেখল জেনি। পেছনে রয়ে যেতে হলে অপমানিত বোধ করবে। পুরুষরা সবসময় বেশি বেশি কর্তৃত্ব দেখায়!

নড়ে উঠে মাটি থেকে মাথা তুলল শেরিফ। দু’চোখে প্রচণ্ড ব্যথার ছাপ। দরদর করে ঘামছে মুখ। চাপা স্বরে বলল, ‘তুমিও যাও, জেনি। আমার কোনও ক্ষতি হবে না।’

‘আপনার কোনও সমস্যা হবে না তো, স্যর?’

‘না, যাও, একটু জোরে বলল শেরিড্যান। ‘এটা আমার নির্দেশ।’

‘তা হলে চলো,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা।

ঝোপের ভেতর শেরিফকে রেখে উঠানের দিকে চলল রানা, জেনি আর উডো রবার্টস। ইঁটের বাড়ির ভেতরে জ্বলছে উজ্জ্বল বাতি। অন্যান্য দালানের দিকে যাওয়ার আগে ওটা ঘুরে দেখবে ভেবেছে রানা। কয়েক পা আগে হাঁটছে অফিসার রবার্টস। ডেকে তাকে থামাল রানা। দীর্ঘদেহী লোকটাকে নার্ভাস মনে হচ্ছে ওর। বারবার তাকাচ্ছে ওর দিকে।

অবিবাহিত, বর্ণবাদী জানোয়ার রিচি ও হ্যাঙ্ক। যা খুশি করতে পারে। নোংরা হওয়ার কথা বাড়ির ভেতরটা। তবে পাথরের লিভিংরুমে ঢুকে তেমন কিছু মনে হলো না রানার।

ফায়ারপ্লেসের ওপর ঝুলছে পুরনো একটা অয়েল পেইন্টিং। ওটাতে বিশাল এক বাড়ির ছবি। একসময়ে হয়তো ওখানে ছিল হান্টিং ট্রফি, প্রচুর অস্ত্র ও মেয়েমানুষের হারেম। রিচি আর হ্যাঙ্কের লিভিংরুমে অ্যাডলফ হিটলারের তৈলচিত্র পেলেও বিস্মিত হবে না রানা। একপাশে ধূসর দাড়িওয়ালা মাঝবয়সী এক লোকের পোর্ট্রেট। রানা বুঝল, এই লোকই উইলিয়াম এফ. নোভাক। ইউনিয়ান আর্মির বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর বায়োলজিকাল ওয়ারফেয়ার শুরু করে গৃহযুদ্ধের মোড় ঘোরাতে চেয়েছিল এই মাস্টারমাইণ্ড। সে রিচি আর হ্যাঙ্ক নোভাকের পরদাদা।

দু’মিনিটের ভেতর জানা হয়ে গেল বাড়িতে নেই রিচি ও হ্যাঙ্ক। রানা ভাবেওনি এখানে থাকবে তারা।

‘তারা এ বাড়িতে নেই,’ মন্তব্য করল জেনি। ‘অন্যান্য জায়গা খুঁজতে হবে।’

‘চলো,’ বলল রানা।

বাইরে এসে বাড়ির পেছনে অন্ধকার দালানগুলোর দিকে চলল ওরা। যে-কোনও সময়ে শুরু হবে প্রবল ঝড়। বাতাসে গুড়-গুড়-গুড় শব্দ তুলছে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি। এ ছাড়া আর কোথাও কোনও আওয়াজ নেই।

মনে মনে রানা টের পাচ্ছে, কাছেই কোথাও আছে রিচি আর হ্যাঙ্ক। কোনও নড়াচড়া বা আওয়াজ দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে আরও সতর্ক হতে হবে। আগের চেয়ে ধীরে চলছে ওর হৃৎপিণ্ড। দুই হাতে ধরেছে উইনচেস্টার বন্দুক।

বাড়ি থেকে সামান্য দূরে ছোট একটা ছাউনির নিচে এক সারিতে কয়েকটা কোয়াড বাইক। দু’দিকের টিনের শেডের মাঝের সরু গলি ধরে এগোল রানা। ওর বামে উত্তেজিত জেনি। ডানে ভীত অফিসার রবার্টস। চাঁদের ম্লান আলোয় দু’দিকে দেখা গেল করোগেটেড শিটের তৈরি অন্ধকার সব দরজা।

যে-কোনও সময়ে ওদের ওপর হামলা করবে রিচি, হ্যাঙ্ক বা তাদের দলের লোক। ট্রিগারে তর্জনী রেখে এগিয়ে চলেছে রানা। মাত্র দশ গজ যেতেই পরিষ্কার শুনল পায়ের আওয়াজ। বাতাসে ভেসে এল কারও গায়ের পাঁশুটে বোটকা গন্ধ। আরও সতর্ক হলো রানা। পরক্ষণে চাঁদের আবছা আলোয় দেখল, বামের দালানের দরজায় এসে দাঁড়াল দুটো ছায়া।

তবে তারা রিচি বা হ্যাঙ্ক নয়।

একজনের মুখে বিশ্রী পুরনো শুকনো ক্ষত। চিবুক থেকে শুরু করে উঠেছে মাথার তালুতে। রানা, জেনি ও রবার্টসকে দেখেই বিস্ফারিত হলো তার দুই চোখ। হ্যাঁচকা টানে বেল্ট থেকে নিতে গেল .৩৫৭ পিস্তল। কিন্তু অস্ত্রটা বের করার আগেই দশ গেজের বন্দুক দিয়ে গুলি করল রানা। ওর হাতের ভেতর রেসের ঘোড়ার মত লাফিয়ে উঠল উইনচেস্টার। টার্গেটে লেগেছে বাকশট। কীভাবে শত্রুকে মারতে হয়, ভাল করেই জানত বুনো পশ্চিমের গানম্যানরা। ছিটকে পেছনের দরজায় গিয়ে পড়ল লোকটা, তারপর ওখান থেকে মাটিতে। বুকের গর্তে ভরে দেয়া যাবে একটা তিন নম্বরী ফুটবল।

একইসময়ে কোমরে গোঁজা পিস্তল বের করল লোকটার সঙ্গী। তবে মৃত অফিসার পল নিউম্যানের গ্রক তুলে চেঁচিয়ে উঠল উড়ো রবার্টস, ‘অস্ত্র ফেলো, জ্যাকব! আত্মসমর্পণ করো!’

তাকে পাত্তা দিল না লোকটা। রানা বা জেনির কাছ থেকে দেড় ফুট দূর দিয়ে গেল তার বুলেট। কিমবার পিস্তল গর্জে উঠল জেনির হাতে। পর পর দুটো বুলেটের আঘাতে পিছিয়ে মাটিতে পড়ল লোকটা। খোলা মুখ থেকে ছিটকে বেরোল এক ঝলক রক্ত।

‘গুড ওঅর্ক,’ বলল রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল জেনি। ‘গুলি না করে উপায় ছিল না।’

হাতের তালুর উল্টো দিক দিয়ে ভুরুর ঘাম মুছল উড়ো রবার্টস। একবার গাল ফুলিয়ে তারপর বলল, ‘আরেকটু হলে সর্বনাশ হতো।’ একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে রানার কাছে জানতে চাইল, ‘আপনার কি মনে হয় এখনও এদিকে আছে রিচি আর ‘হ্যাঙ্ক?’

‘জানি না,’ সত্যি কথাই বলল রানা।

‘তো এবার কী করব?’ জানতে চাইল অফিসার রবার্টস।

‘নিয়ে চলো যেখানে জিম্মিদের রাখা হয়,’ বলল রানা। ‘জানতে চাই তারা সত্যিই মারা গেছে কি না।’

বড় বড় চোখে রানাকে দেখল উডো রবার্টস। চাঁদের আলোয় চকচক করছে দুই চোখ। ‘আমি জানব কী করে?’ কথাটা বলেছে সে আত্মরক্ষার সুরে।

‘কেন, যেভাবে আরও বহু কিছুই জেনেছ,’ বলল রানা, ‘এইমাত্র জানালে লোকটার নাম জ্যাকব। লাশটা দেখাল রানা।

‘আগেও ওকে গ্রেফতার করেছি,’ প্রতিবাদের সুরে বলল উডো রবার্টস। তবে কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস নেই। ‘ওই লোকের পুরো নাম রেলি জ্যাকব। সঙ্গের লোকটা টিনাশে বব।’

আস্তে করে মাথা নাড়ল রানা। ‘মিথ্যা বলতে হলে আরও ভালভাবে বলবে, রবার্টস। আমি দেখেছি গোলাগুলি শুরু হওয়ার আগেই ঝোপে ঝাঁপিয়ে পড়েছ। তখনই বুঝে নিয়েছি, এরপর কী হবে সেটা তুমি আগে থেকেই জানতে।’

নীরব জেনির দিকে তাকাল উডো রবার্টস। অর্ধেক ঘুরে দেখল রানাকে। ‘তোমরা কি পাগল হলে?’

‘তুমিই আসলে পাগল,’ বলল রানা, ‘মস্ত ভুল করেছ নোভাকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। পুলিশ ডিপার্টমেন্টে একজনের বেশি চর ছিল ওদের। তাদের একজন বিলি এস. কনরাড। দ্বিতীয়জন তুমি। আর তুমিই বলেছ, কী ধরনের বিপদে পড়ছে নোভাকরা। সহকর্মী পুলিশ অফিসারদের মৃত্যুর দায় এড়াতে পারবে না। এ ছাড়া, আরও বহু কিছুই করেছ।’

‘এ আস্ত পাগল, লরেন্স, নালিশের সুরে জেনিকে বলল উডো রবার্টস। ‘আমি কিছুই করিনি। এর কথা শুনেও প্রতিবাদ করবে না?’

মাথা কাত করে সহকর্মীদের চোখে চেয়ে আছে জেনি লরেন্স। বুঝতে শুরু করেছে, কী কারণে উডো রবার্টসকে সঙ্গে করে এনেছে রানা।

‘তারপর ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলে,’ বলল রানা। ‘তোমার ইচ্ছে ছিল জেনি আর শেরিফকে খুন করবে। বোধহয় সঙ্গে ছোরা আছে? নাকি খুন করতে খালি হাতেই? দেখার তো কেউ নেই যে প্রমাণ থাকবে। বড় বোনাস দিত রিচি। অথবা অন্য কোনও কিছু দিয়ে পুষিয়ে দিত।’

এক পা পেছাল ডেপুটি রবার্টস। চাঁদের আলো পড়ল তার চেহারায়। বিলি এস. কনরাডের যে হাল হয়েছিল শেরিফের অফিসে, সেভাবেই লালচে হয়েছে তার চেহারা। ‘ঠিকই ধরেছ,’ ধীর গলায় বলল, ‘কেউ জানত না।’ ঝট্ করে গ্লক তুলেই রানার মাথায় তাক করে ট্রিগার টিপে দিল সে।

বিকট আওয়াজ হলো। পিস্তলের নলে উঠেছে আগুনের ঝলক। পরক্ষণেই তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ছাড়ল উডো রবার্টস। অস্ত্র ফেলে খপ করে চেপে ধরল আহত ডানহাত। তিনটে আঙুলের অর্ধেক উড়ে গেছে পিস্তল বিস্ফোরণে। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসল সে। ক্ষত থেকে দরদর করে পড়ছে রক্ত।

‘ভেজা মাটিতে অস্ত্রটা পড়লে ব্যারেলের ভেতর কাদা ঢোকে,’ বলল রানা। ‘ব্যবহার করার আগে দেখা উচিত ছিল, ওটা দিয়ে গুলি করা যাবে কি না। রবার্টস, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার এটাই হচ্ছে প্রথম শিক্ষা।’

দ্বিতীয় শিক্ষাটা নামল উডো রবার্টসসের মুখে। বন্দুকের কুঁদোর বাড়ি খেয়ে নড়ে গেল তার চোয়াল। কঠিন কাঠ আর স্টিলের ভারী কুঁদো। দ্বিতীয়বারের মত রবার্টসসের মুখে নামল ওটা। চ্যাপ্টা হয়ে ফাটল দুই ঠোঁট ও নাক। ছিটকে বেরোচ্ছে রক্তের ফোয়ারা। দু’পায়ের মাঝে কাটা পড়া আঙুলগুলো চেপে ধরে গুঙিয়ে উঠল রবার্টস, ‘আমাকে মাফ করো! ঈশ্বরের দোহাই! মেরে ফেলো না!’

শক্ত হাতে বন্দুক ধরে বলল রানা, ‘একটা কারণ দেখাও, যেজন্যে তোমাকে মেরে ফেলা হবে না!’

‘আমি জানি ওই মেয়েলোক আর বাচ্চাগুলো কোথায় আছে। আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারব।’

‘তা হলে তা-ই করো,’ বলল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *