স্ট্রেঞ্জার – ৫৩

তেপ্পান্ন

রেইডিং পার্টি জড় হলে সবার আগে সেতুর ওপর পা রাখল রানা। তক্তাগুলো প্রাকৃতিক অত্যাচারে এবড়োখেবড়ো হলেও রেলওয়ের স্লিপারের চেয়ে পুরু, লোহার চেয়েও শক্ত। মানুষের কোমরের চেয়েও মোটা গুঁড়ি উঠেছে পানির তলা থেকে। গায়ে পিচ্ছিল সব সবুজ অ্যালজি।

নীরবে হেঁটে সেতু ধরে এগোল ওরা। সামনেই কোথাও আছে ওদের টার্গেট। দু’দিকে বাইয়ুর প্রায় স্থির কালো রঙের পানি। মাঝে মাঝে এখানে ওখানে ভাসছে পচে যাওয়া সবুজ লতাপাতা ও মরা মাছ। পরিবেশে বোটকা, বাজে গন্ধ। সেতুর ওপর নিজেকে অসহায় লাগছে রানার। তবে দ্বীপে ওঠার পর কমল অনিশ্চয়তার ভাবটা।

সামনেই দশ ফুট উঁচু পুরু তক্তার চওড়া গেট। ওটা আরও শক্ত করা হয়েছে লোহার রিভেট দিয়ে। ওপরে কয়েল করা রেযর ওয়াএয়ার। গেটে স্প্রে করা পেইন্টে লেখা:

প্রাইভেট প্রপার্টি।
বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করলে গুলি চালানো হবে।

গোটা আমেরিকায় এমন সাইন দেখা যায় অহরহ। তবে নোভাকদের হুঁশিয়ারিকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিল রানা।

রাইনো গাড়ি নিয়ে বেরোবার সময় গেট বন্ধ করেনি ওরা, নইলে হেভি ডিউটি কাটিং টুল্স্ ব্যবহার করতে গিয়ে প্রচুর সময় ব্যয় হতো। প্রথম বড় বাধা বিনা কষ্টে পেরোল ওরা।

দ্বীপে পা রেখে বলল শেরিফ, ‘আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় থাকল না।’

অন্যরা শুনবে না, এমন নিচু গলায় বলল রানা, ‘আ ভিতরে নাই বা ঢুকলেন, শেরিফ। আপনি জঙ্গলে অপেক্ষা করুন, আমরা কাজ শেষ করে ফিরছি।’

জবাব দিল না শেরিফ স্যাম শেরিড্যান।

গেট পেরোতেই সামনে ঝিনুক বিছিয়ে রাখা ড্রাইভওয়ে। দু’দিকে ঘন ঝোপঝাড়, ছায়াময়। শিরশির করছে রানার বুক। থেমে গিয়ে দেখল টায়ারের ট্র্যাক। প্রচুর ব্যবহার হয় এ পথ। ভারী ট্রাকের চাকার চাপে গুঁড়ো হয়েছে ঝিনুকের খোল। আছে হালকা গাড়ি ও মোটর সাইকেলের চাকার সরু দাগ। তবে এ থেকে বোঝা যাচ্ছে না দ্বীপে ক’জন আছে নোভাকদের লোক।

রানার ইশারায় পাঁচজনের ইউনিটে ভাগ হয়ে পথের দু’পাশে সরল সবাই। ঝিনুকের খোলের ওপর পায়ের ছাপ পড়বে না ওদের। পথের ডানদিক ধরে এগোল রানা সহ দলের পাঁচজন। বাম পাশে শেরিফের ইউনিট। পুরনো বন্দুক নিচু করে ইনফ্যান্ট্রি ম্যানের মত হাঁটছে শেরিফ। হয়তো ভাবছে, সামনের ঝোপ থেকে বেয়নেটসহ রাইফেল হাতে তেড়ে আসবে একদল লোক।

আনমনে ভাবল রানা, হয়তো ঠিক তা-ই হবে!

এ টিমের পিছু নিয়েছে সি ইউনিট। বামে ডি ইউনিট। আগের মতই মাঝে দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে সবাই।

শুধু শেরিফ নয়, প্রত্যেকে উত্তেজিত। নার্ভাস চোখে দেখছে পরস্পরকে। অ্যাকশনে নামা রাইফেলধারী ইউএস মেরিন সৈনিকের মত রানার ঘাড়ের কাছে ফোঁস-ফোঁস শ্বাস ফেলছে জেনি লরেন্স। জীবনের প্রথম মিলিটারি রেইডের কথা মনে পড়তেই রানা বুঝল, কতটা ভয় নিয়ে চলেছে এরা।

এ ধরনের পরিবেশে কখনও দূর হয় না ছোঁয়াচে ভয়। বেঁচে আছে এ মুহূর্তে, কিন্তু পরক্ষণে বাঁচবে, তার নিশ্চয়তা নেই। হয়তো বাড়ি ফিরবে কফিনে চেপে।

হাঁটার গতি কমিয়ে জেনি লরেন্সের পাশে চলল রানা। চোখে বিস্ময় নিয়ে ওকে দেখল মেয়েটা।

ফিসফিস করে বলল রানা, ‘চিন্তা কোরো না। আমার পেছনে থাকো। কোনও বিপদ হবে না।’

জবাবে নিচু গলায় বলল জেনি লরেন্স, ‘পারলে নিজের পাছা বাঁচান। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’

এ মেয়ে পাথরের টুকরো, একে সাহস জোগানোর দরকার নেই, বুঝে গেল রানা। হাসল ও। বলল, ‘তুমিই আবার ওখানে আরেকটা ফুটো করে দিয়ো না যেন!’

নীরবে হাঁটছে ওরা। রানা চলে গেছে নিজ পজিশনে। এঁকেবেঁকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দ্বীপের মাঝে গেছে পথ। মাথার ওপর গাছের পাতার ঘন ছাউনি। এখন ওটা ভেদ করছে না চাঁদের আলো। চারপাশ কুচকুচে কালো নাইট ভিশন গগল্‌স্ অন করে চোখে পরল রানা। হঠাৎই চারদিকে দেখছে ভুতুড়ে সবুজ জগৎ। এখন শত্রুর তরফ থেকে ট্রেসার গুলি এলে মনে হবে, ওরা পৌঁছে গেছে সায়েন্স ফিকশন সিনেমার লেয়ার ঝলকানির দৃশ্যে।

আগের মতই নীরব জঙ্গল। গুলি করতে করতে, বা কুঠার ও ম্যাচেটি নিয়ে তেড়ে এল না বর্ণবাদীদের দল।

দ্বীপের মাঝখানে পৌঁছে গেছে, আন্দাজ করল রানা।

এখন পর্যন্ত বাধা দেয়নি কেউ, কাউকে দেখেওনি ওরা। তবে এবার হয়তো যে-কোনও সময়ে আসবে হামলা।

আরও কয়েক মিনিট হাঁটার পর নাইট ভিশন গগলসের কারণে গাছের মাঝ দিয়ে উজ্জ্বল সবুজ আলো দেখল রানা। মাথার ওপর হাত তুলে ইশারা দিল। ওর কয়েক ফুট পেছনে দ্বিধা নিয়ে থেমে গেছে সবাই। সতর্ক চোখে দেখছে রানার ছায়ার মত শরীরটা।

সামনেই ডানে তীক্ষ্ণ বাঁক। পথের ওখানে পৌঁছে জোরালো আলোর উৎসটা দেখল রানা। তিরিশ গজ দূরে ঘন ঝোপঝাড়ের মাঝে ছোট একটা বাড়ি। আরও ভালভাবে দেখতে পা টিপে ওদিকে এগুল রানা।

ছোট হলেও রুক্ষ, এবড়োখেবড়ো ইঁটের বাড়ি। ঠিক চারকোনাও নয়। রানার মনে হলো, গৃহযুদ্ধের পর শহর থেকে পালিয়ে এসে দ্বীপে যে বাড়ি করেছিল উইলিয়াম এফ. নোভাক, এটা বোধহয় সেটাই। সেক্ষেত্রে দেড় শত বছরেরও বেশি বয়স এই বাড়ির।

সামনে বৃত্তাকার বড় উঠান। দুরমুশ মেরে শক্ত করা হয়েছে মাটি। পাথরের সঙ্গে মিশেছে ঝিনুক খোলের চূর্ণ। কাছেই আধুনিক নিচু ছাতের একটা দালান। ওটা ব্যারাক বলে মনে হলো রানার। পেছনে ধাতব কিছু ছাউনি। চাঁদের আলোয় কালচে দেখাচ্ছে ছাতের জং। বাড়ি ছাড়া আর সব দালান ডুবে আছে অন্ধকারে। সরু জানালা দিয়ে যে আলো আসছে, সেটা গগলসের গুণে দেখাচ্ছে সবুজ ম্যাগনেযিয়াম ফ্লেয়ারের মত। বাড়ির জানালার কাছে কেউ নেই, বা থাকলেও দেখা যাচ্ছে না।

রানার মনে পড়ল, উনিশ শ’ তেত্রিশ সালে এই বাড়ি দেখতে নোভাক দ্বীপে এসেছিলেন বড়মা এবি পামবো ও তাঁর বান্ধবীরা। সেসময়ে অস্ত্র হাতে তাঁদের দিকে তেড়ে গিয়েছিল উন্মাদের মত এক লোক। গুলিও করে। আর সেই লোকের নাতিরা আজ বাস করে এ বাড়িতে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কোথাও কোনও নড়াচড়া নেই, চারপাশ থমথমে। দ্বীপে আজ রাতে কূজন করছে না পাখিরা। এমন কী থেমে গেছে কীট- পতঙ্গের আওয়াজও। কেন?

সবকিছু বড় বেশি নীরব। স্তব্ধতা কানে বাজছে রানার। ভুতুড়ে সবুজ আলোর দিকে চেয়ে এবি পামবোর বলা অশুভ আত্মার কথা মনে পড়ল ওর। গলার কাছে ঝুলছে মোজো ব্যাগ। মনে মনে হাসল রানা। নিজেকে বলল: তুমিও কি পাগল হলে যে উদ্ভট সব চিন্তা করছ?

রানার রেডিয়ো ইয়ারপিসে ফিসফিস করল শেরিফের কণ্ঠ: ‘কিছু দেখলে, রানা?’

‘নিজে এসে দেখুন,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘ওভার অ্যাণ্ড আউট।’

ক’মুহূর্ত পর সরু ডাল ভাঙার মুট আওয়াজ পেল রানা। ওর পেছনে হাজির হলো শেরিফ ও তাঁর দলের সবাই। ঘুরে তাদেরকে দেখল রানা। আঙুল তুলল ঠোঁটে। বুনো শুয়োরও জঙ্গলে এদের চেয়ে কম আওয়াজ করে!

বাধ্য হয়ে নাইট ভিশনের সাহায্য নিয়েছে শেরিফ। হেড গিয়ার আর গগলসের মাঝে বাঁকা হয়ে ঝুলছে ক্যাম্পেইন হ্যাট। মানুষটাকে অদ্ভুত কোনও স্পেস কাউবয় বলে মনে হলো রানার। ঝোপে ওর পাশে থামল শেরিফ। মুঠোর ভেতর শত্রু করে ধরেছে বন্দুক। সতর্ক চোখে বাড়ি এবং চারপাশে চোখ বোলাল। ক’মুহূর্ত পর বলল, ‘ওদেরকে বাগে পেয়েছি। আটকা পড়েছে ইঁদুরের খাঁচায়। এবার বাড়ি ঘিরে কয়েকজন ঢুকে পড়ব ভেতরে।’

উঠানে গেল রানার চোখ। আবারও দেখল আঁধার দালানগুলো। বাড়ির আলোকিত জানালার ওদিকে এখনও কেউ নেই। চারপাশ নীরব।

কোথাও নড়াচড়া না দেখে কু ডাকছে রানার মন। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক করছে: কী যেন ঠিক নেই!

হঠাৎই মনে পড়ল খোলা গেটের কথা। অতি সহজেই দ্বীপে পা রেখেছে ওরা। তারপর বলতে গেলে হাসতে হাসতেই নোভাকদের আস্তানার কাছে পৌঁচেছে। বাধা দেয়নি কেউ। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়!

মনের ভেতর খচ খচ করছে রানার।

মস্ত কোনও ভুল করেছে ওরা!

কথাটা মাত্র ভেবেছে, এমনসময় একে একে ঘটল তিনটে ঘটনা।

প্রথমত, কারণ ছাড়াই মুখ তুলে ওপরে তাকাল রানা। কেন তা করল, নিজেও জানে না। ভীষণ একটা ভয়ের অনুভূতি নামল ওর শিরদাঁড়া বেয়ে। কয়েক ফুট ওপরে গাছের ডালে চোখ পড়তেই আটকে ফেলেছে শ্বাস। ডালে ঝুলছে ওয়াএয়ারলেস ক্যামেরা আর মোশন সেন্সার!

একটা নয়, উঠানের চারপাশে অন্তত বারোটা!

বাড়ির আলোর দিকে এতই খেয়াল ছিল, রানা দেখেনি মাথার ক’ফুট ওপর থেকে ওদের ওপর চোখ রাখছে জিনিসগুলো। বিশেষ করে মোশন সেন্সার সূক্ষ্মভাবে কাজ করে। ধুলোর ভেতর ছোট মাকড়সা হেঁটে গেলেও জানিয়ে দেয় ওটার মালিককে।

তার মানে, রেইডিং পার্টিকে দেখছে নোভাকরা। সেই যে দ্বীপে পা রাখল ওরা, তখন থেকেই!

বাড়ির ওই আলো ছিল কাছে টেনে আনার জন্যে।

এর আরেকটা অর্থ হচ্ছে, না জেনে-বুঝে সরাসরি ফাঁদে পা রেখেছে ওরা!

সেই মুহূর্তে দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল।

রানা মাত্র ভেবেছে চেঁচিয়ে সতর্ক করবে: পিছিয়ে যাও, এমনসময় অন্ধকার জঙ্গল থেকে এল শক্তিশালী সবুজ আলো। ওই রশ্মিতে রানা পরিষ্কার দেখল গাছের বাকল। নানাদিকে নড়ছে দানবীয় ছায়া। সেতুর দিক থেকে এল ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজ। তুমুল বেগে ড্রাইভওয়ের দিকে আসছে রাইনো এসইউভি গাড়িটা।

হঠাৎ করেই নোভাকদের প্ল্যান বুঝল রানা।

এন সার্কেল মোটেলে লোক পাঠায়নি নোভাকরা। আগে থেকেই জানত হামলা করবে পুলিশের রেইডিং পার্টি। সুতরাং ফাঁদের দিকে তাদেরকে ডেকে এনেছে তারা!

কিন্তু আরও সতর্ক হওয়ার উপায় রানা বা শেরিফের ছিল না!

এখন সবই বুঝতে পারছে রানা। এ-ও টের পেল, আটকে দেয়া হয়েছে সেতুর গেট। নিজেদের এলাকায় শেরিফ, তার দলের লোক আর রানাকে পেয়ে গেছে নোভাকরা।

চাইলেও এখন কোথাও পালাতে পারবে না ওরা!

গুডরিচ পরিবারকে উদ্ধার করতে পারবে না।

এবার প্রাণপণ লড়তে হবে নিজেদের রক্ষা করার জন্যে।

ঝিনুকের খোসা চুরমার করে ড্রাইভওয়ে ধরে ছুটে আসছে ভারী রাইনো এসইউভি। ছাতে ফিট করা আলো এতই জোরালো, নাইট ভিশন গগলসের মাঝ দিয়ে দেখতে গিয়ে প্রায় অন্ধ হলো রানা। চারপাশ থেকে যেন এল কোটি কোটি প্রোটন। ঝট্ করে গগল্‌স্‌ খুলে চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি ফেরাতে চাইল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর কাঁধে তুলল রাইফেল। নল তাক করেছে ছুটন্ত ভেহিকেলের দিকে। কিন্তু উন্মাদের মত ওদের দিকেই এল ড্রাইভার। যদিও খুব কাছে পৌছে হঠাৎ করেই তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে কড়া ব্রেক কষে থামল গাড়িটা। ঝড়ের বেগে খুলল চার দরজা। লাফিয়ে গাড়ি থেকে বেরোল পাঁচজন লোক। সবার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। এক পলকে রানা ভাবল, এটা যুদ্ধ নয়, পুলিশী রেইড, আগে থেকে গুলি করা উচিত হবে না।

গুলি না ছুঁড়ে দৌড়ে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকল লোকগুলো। কী করবে ভাবতে না ভাবতেই কর্কশ আওয়াজে চমকে গেল রানা। কল্পনাও করেনি, অমন কিছু থাকতে পারে এই দ্বীপে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *