স্ট্রেঞ্জার – ৫২

বায়ান্ন

নোভাক দ্বীপ লক্ষ্য করে চলেছে পুলিশের গাড়ির কনভয়। ঘনিয়ে আসছে কালচে সন্ধ্যা। সারাদিন ভীষণ গরম ছিল। বাতাসে ভারী জলকণা। পুবাকাশে ঝলমল করছে পূর্ণিমার চাঁদ। তবে ধীরে হলেও পশ্চিমাকাশে জমছে কালো মেঘ। রানার ধারণা, কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে তুমুল ঝড়-তুফান।

একটু পর স্যাটেলাইট ইমেজ ওদেরকে দেখিয়ে দিল: পৌনে একমাইল দূরে বাইয়ুর মাঝে জঙ্গল ও প্যাচপেচে কাদাময় নোভাক দ্বীপ।

আর কিছুদূর এগিয়ে জঙ্গলে সোয়্যাট ট্রাক ও এসইউভি রেখে পায়ে হেঁটে এগোল ওরা। গাড়িতে থাকল ড্রাইভাররা। রেডিয়ো করা হলে দেরি না করে হাজির হবে নোভাক দ্বীপে। ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে চলেছে বিশজনের সশস্ত্র দলটি। পুলিশের আর্মারি থেকে অস্ত্র হিসেবে মিলিটারি এ১ ভার্শান ফুল অটোমেটিক এম৪ কারবাইন নিয়েছে রানা। কালো জ্যাকেটের নিচে ব্যালিস্টিক ভেস্ট। ওটার পেছনে সাদা অক্ষরে লেখা: স্টেট পুলিশ। মাথায় নেভি এলএসপি বেসবল ক্যাপ। পেছন দিকে রেখেছে ওটার বিক। কানে হেডফোন ও চোখে নাইট ভিশন গগল্‌স্‌। সেই সঙ্গে আছে থ্রোট মাইক। টিমের কারও কারও মাথায় ট্যাকটিকাল হেলমেট। তাদেরই একজন জেনি লরেন্স। রানার ধারণা, নিজেকে সৈনিক হিসেবে ভাবতে ভালবাসে মেয়েটা।

কোনও প্যারামিলিটারি অ্যাপারাল ব্যবহার করছে না শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। পরনে সাধারণ ইউনিফর্ম আর মাথায় ক্যাম্পেইন হ্যাট। কোমরের হোলস্টারে আগের মতই .৪৫ কোল্ট। হাতে উইনচেস্টার লিভার অ্যাকশন শটগান। সবমিলিয়ে তাকে দেখাচ্ছে ঠিক এক শ’ বছর আগের বুনো পশ্চিমের ঘোড়া হারানো কাউবয়ের মত। বন্দুকের ভেতরে রয়েছে ওয়াইনের কর্কের মত দেখতে দশ গেজের বাকশট শেল। প্রতিটা কার্তুজে রয়েছে বারোটা সীসার বল। বন্দুক ছুঁড়লে ধসে পড়বে ইঁটের দেয়াল, এমনই বারুদের জোর।

‘প্লাস্টিকের যন্ত্রপাতি যখন ভাল লাগে, তো তোমাদের কাছেই থাকুক,’ হেডকোয়ার্টার ছেড়ে বেরোবার সময় বলেছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। ‘আমার হাতের জিনিসের ছয় রাউণ্ড গুলি লাগলে কারও সাধ্য নেই বেঁচে ফিরবে।’

ওদের দলের প্রথম কাজ আড়াল থেকে দ্বীপের ওপর চোখ রাখা। শেরিফকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে রানা। একসারিতে ওর পেছনে আসছে অন্যরা। মাঝে মাঝে শেকড় বা পাথরে হোঁচট খাচ্ছে। ভারী গিয়ার নিয়ে এসেছে বলে বিড়বিড় করে নিজেদেরকে অভিশাপ দিচ্ছে। অবশ্য ওই দলে নেই জেনি লরেন্স। দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ চেহারা করে রানার পেছনে হাঁটছে সে। লড়াইয়ের জন্যে তৈরি। আর্মি জীবনের কথা মনে পড়ছে রানার। একে অপরের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করত ওরা। পুলিশদের এ দলের ব্যাপারে অতটা নিশ্চিত নয় রানা। তবে এ দেশে এরচেয়ে ভাল দল জুটত না ওর কপালে।

এখন এদেরই ওপর নির্ভর করছে, স্ত্রী-সন্তানদেরকে জীবিত ফিরে পাবে কি না জোসেফ গুডরিচ।

জঙ্গলের মাঝ দিয়ে সামনে পানিতে জ্যোৎস্নার ভোঁতা প্রতিফলন দেখল রানা। থেমে গেল। পেছনে দাঁড়িয়ে গেছে দলের সবাই। হাতের ইশারা করল রানা। আগেই ওকে অনুরোধ করেছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান, যেন দ্বীপে পা রাখার আগে তার দলের হয়ে স্কাউটিং করে রানা।

পনেরো গজ দূরে বাইয়ুর কালচে পানি। তার আগে ঘন হয়ে জন্মেছে কোমর সমান ঝোপঝাড়। বেশি আর্দ্রতার জন্যে পাতা থেকে টপটপ করে ঝরছে পানির ফোঁটা। খুব সাবধানে ঝোপের ভেতর দিয়ে বাইয়ুর তীরে পৌঁছুল রানা। ব্যাগ থেকে বিনকিউলার বের করে চোখে লাগাল।

বেছে নিয়েছে ভাল জায়গা। পরিষ্কার দেখল কুঁজো পিঠ লোকের মত দ্বীপটাকে। বাইয়ুর পানির ওদিকে যেন নদীর মাঝে ওটা কোনও দুর্গ। ঘন হয়ে জন্মানো জঙ্গলের ভেতর মানুষের বসতির কোনও চিহ্ন নেই।

সতর্ক চোখে দ্বীপ ও বাইয়ু দেখে রানা বুঝল, ঠিকই ভেবেছে। নৌকা করে নোভাক দ্বীপে পৌছুতে পারবে না ওরা। খাড়া হয়ে ওপরে উঠেছে এদিকের তীর। ঝপ করে দেয়ালের মত মাটির বাঁধ নেমেছে বাইয়ুর বুকে। দ্বীপের ওপর দিকের জমি থেকে গুলি করে অনায়াসেই ওদেরকে খুন করতে পারবে নোভাকদের লোক।

এদিকের তীর থেকে সবচেয়ে কাছে দ্বীপের যে অংশ, তা-ও সত্তর গজ দূরে। ওদিকে কাঠের সেতু। খুব সতর্কতার সঙ্গে ওটা দেখল রানা। অন্তত দেড় শ’ বছর আগে খুবই শক্তপোক্তভাবে তৈরি করা হয়েছে সেতু। কাজে ফাঁকি দেয়নি স্থানীয় কারিগর। সারি সারি কাঠের খুঁটি মজবুত করতে ব্যবহার করেছে সাইপ্রেস গাছের কাণ্ড। যথেষ্ট চওড়া সেতু পেরোত সে আমলের দু’ঘোড়া টানা ওয়্যাগন। বাড়ি তৈরির মালামাল বা ভারী জিনিসপত্র আনা-নেয়াতেও কোনও সমস্যা ছিল না। সেতু পেরিয়ে দ্বীপে উঠতে পারবে ভারী সোয়্যাট ভেহিকেল। পরে ওটা কাজে লাগবে জিম্মিদেরকে সরিয়ে নেয়ার কাজে।

দ্বীপে নড়ছে না কিছু।

অবশ্য নিরাপদে ওখানে পৌঁছুবার আগে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই আগেই হামলা হবে কি না।

এলিসা আর বাচ্চাদের নিরীহ মুখ বারবার মনে পড়ছে রানার। পেছনে মৃদু শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকাল।

ওর সামনে এসে থামল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। আগের মতই শক্ত হাতে ধরেছে উইনচেস্টার বন্দুক।

তার দিকে বিনকিউলার বাড়িয়ে দিল রানা।

নীরবে ওটা নিয়ে চোখে লাগাল শেরিফ। রানার মতই দেখছে টার্গেট। কিছুক্ষণ পর ফেরত দিল বিনকিউলার। দরদর করে ঘামছে শেরিড্যানের হাতের তালু।

নিচু গলায় বলল রানা, ‘নার্ভাস?’

নাক দিয়ে ঘোঁৎ আওয়াজ করল শেরিড্যান। ‘মিথ্যা বলব না। গত তিন দিন বিশ্রাম পাইনি।’

‘শান্ত থাকুন,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘বাঁচতে হলে সতর্কতা ছাড়া উপায় নেই। গোলাগুলি শুরু হলে অন্যের পিঠ বাঁচাতে পারবে না কেউ।’

‘বাহ্, কী দারুণ সান্ত্বনা,’ বিড়বিড় করল শেরিফ।

চুপচাপ বিনকিউলার দিয়ে সেতু দেখল রানা।

নামছে রাতের আঁধার। আকাশে ঝড়ের কালো মেঘ সাঁই-সাঁই করে গিয়ে ঢেকে দিচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদটাকে।

যে-কোনও সময়ে অস্বাভাবিক কিছু ঘটবে, ভাবছে রানা।

মিথ্যা হলো না ওর ভাবনা।

জঙ্গুলে পথে বাঁক নিয়ে সেতুতে উঠল উজ্জ্বল হেডলাইট। ওটাকে অনুসরণ করল রানার বিনকিউলার। এখনও সন্ধ্যার যেটুকু আলো আছে, তাতে দেখল টিন্টেড কাঁচওয়ালা পেটমোটা রাইনো জিএক্স এসইউভি। উঁচু করে নেয়া হয়েছে গাড়ির সাসপেনশন। ছাতে শক্তিশালী বড় সবুজ স্পটলাইট। লুইযিয়ানায় রাতে শুয়োর শিকারে কাজে লাগে ওই জিনিস।

গাড়ির সামনের সিটে দু’জনকে দেখল রানা। তাদের মাথায় বেসবল ক্যাপ। এন সার্কেল মোটেল থেকে রানাকে তুলে আনার জন্যে রওনা হয়েছে নোভাকদের ষণ্ডারা। এ থেকে আরও একটা ব্যাপার বুঝল রানা, ওকে তুলে আনার জন্যে মাত্র দু’জনকে পাঠাবে না রিচি। গাড়ির ভেতর হয়তো আছে আরও অন্তত চার-পাঁচজন। সেক্ষেত্রে দ্বীপে কমে যাচ্ছে নোভাকদের শক্তি। এটা ভাল সংবাদ।

ধুপ-ধুপ আওয়াজ তুলে সেতু পেরিয়ে কাঁচা রাস্তায় গিয়ে উঠল এসইউভি। হারিয়ে গেল জঙ্গলের বাঁকে।

‘এন সার্কেল মোটেলে যাচ্ছে,’ সন্তুষ্ট সুরে বলল শেরিফ। ‘যেতে নব্বুই মিনিট। তোমাকে খুঁজবে পনেরো মিনিট। না পেয়ে ফিরতে লাগবে আবারও নব্বুই মিনিট।’

মনে মনে সায় দিল রানা। সোয়া তিন ঘণ্টার আগেই দ্বীপে উঠে পড়বে ওরা। দেড় ঘণ্টা পর যে-কোনও সময়ে রিচি বা হ্যাঙ্কের কাছে ফোন দেবে দলের লোক- পাইনি মাসুদ রানাকে। আর ওই সময় থেকে চরম বিপদে থাকবে এলিসা আর বাচ্চারা। ফিরতি পথে রওনা হলে নোভাকদের লোকদেরকে গ্রেফতার করে জেলখানায় ভরবে পুলিশ। তার আগেই জিম্মিদেরকে উদ্ধার করবে রানা ও শেরিফের টিম। নোভাকদেরকে জেলখানায় নিয়ে শুরু হবে জেরার কাজ।

হোলস্টার থেকে রিভলভার নিয়ে চেম্বার চেক করল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। আবার হোলস্টারে রাখল অস্ত্রটা। উইনচেস্টার বন্দুকের লিভার টেনে হ্যামার হাফ কক করল। গুলির জন্যে প্রায় তৈরি অস্ত্রটা। চাপা স্বরে বলল শেরিড্যান, ‘চলো, যাওয়া যাক।’

‘একমিনিট,’ বাধা দিল রানা।

‘দেরি করে কী লাভ?’

‘বেশি তাড়াহুড়ো বিপদ ডেকে আনে।’ সেতুর দিকে চেয়ে আছে রানা। কালো চাদর নামছে দ্বীপ ও বাইয়ুর ওপর। নোভাকদের আস্তানা থেকে আর কোনও গাড়ি এল না। খুনিরা সাধারণত টুকটাক নানান ভুল করে। ফোন বা অস্ত্র ফেলে গেছে বলে ফিরতে পারে রাইনো এসইউভির লোকগুলো।

আরও পাঁচ মিনিট সেতুর ওপর চোখ রাখল রানা। কোথাও নড়াচড়া দেখল না। বিনকিউলার গলায় ঝোলাতেই বুকের কাছে এবি পামবোর কবচের স্পর্শ পেল। ওর মনে পড়ল মহিলার কথা: ‘অনেকটা সময় নিয়ে ওই মো ব্যাগের ওপর নিজের সব জাদু খাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু একবার গলায় পরার পর ওটা খুলবে না।’

‘আপনার কবচ কাজে লাগে কি না, এবার বুঝব,’ মনে মনে বলল রানা। শেরিফের দিকে চেয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, এবার চলুন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *