স্ট্রেঞ্জার – ৬০

ষাট

রিচি নোভাককে মোকাবিলা করতে দ্বিধা নেই রানার। গাঢ় রক্তের দাগ দেখে বুঝেছে, সে গুরুতরভাবে আহত।

দালানের মাঝের গলি ধরে রক্তের ঘন, কালো চিহ্ন অনুসরণ করল রানা। মাথার ওপর কড়কড় শব্দ তুলছে বজ্রবিদ্যুৎ। কালো মেঘে ঢেকে গেছে চাঁদ।

ধীর পায়ে গেছে রিচি নোভাক। হয়তো বেশি দূরে নেই ভীষণ বিপজ্জনক লোক সে, ঠিক মানুষখেকো বাঘের মত। হয়তো সামনের কোনও ঝোপে বসে আছে। হিংস্র চোখে দেখছে রানাকে। গাছের ছায়া বা টিনের শেডে লুকিয়ে থাকতে পারে। সশস্ত্র। প্রথম সুযোগে খুন করবে ওকে। টর্চ জ্বাললে বিপদে হবে বলে অন্ধকারেই চলেছে বিসিআই এজেন্ট।

হঠাৎ কড়-কড়াৎ আওয়াজে বাজ পড়ল। পরক্ষণে এল প্রথম পশলা বৃষ্টি। ফোঁটাগুলো মাঝারি আকারের বরইয়ের সমান। এক পলকে ভিজে গেল রানা। পুব থেকে এল বৃষ্টির ছাঁট। তারপর ঝরঝর করে নামল অঝোর ধারায়। টং-টং আওয়াজে পড়ছে দালানগুলোর টিনের ছাতে। একটু পর কাদায় প্যাচ-প্যাচ করবে নোভাকদের গোটা দ্বীপ। রাতের আঁধার চিরে দিল নীল বিদ্যুৎশিখা। আকাশ থেকে এল গুড়গুড় হুমকি।

আওয়াজটা মিলিয়ে যেতেই হঠাৎ ইঞ্জিনের শব্দ শুনল রানা। ওটা জিপ নয়। মোটর সাইকেল। ওর মনে পড়ল বাড়ির কাছেই ছাউনিতে ছিল কোয়াড বাইক।

ওদিকে ছুটল রানা। কয়েক মুহূর্তের জন্যে হারিয়ে ফেলল পথ। মস্ত উঠানের নানাদিকে গলি। তবে আবারও এল ইঞ্জিনের গর্জন। খুব কাছেই।

দ্রুত হেঁটে একটা দালানের কোনা ঘুরতেই রানা দেখল, ঝড়ের বেগে বাইক নিয়ে আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে কেউ। থ্রটল মুচড়ে নিংড়ে নেয়া হচ্ছে ইঞ্জিনের সমস্ত শক্তি। উঠানের ওদিকে জঙ্গল লক্ষ্য করে চলেছে রিচি নোভাক। বোধহয় যাবে বাইয়ুর তীরে। হয়তো কোনও স্পিডবোট নিয়ে দ্বীপ ত্যাগ করতে চায়।

কোয়াড বাইক যেখানে থাকে, দৌড়ে ওখানে পৌঁছুল রানা। ছাউনিতে রয়ে গেছে দুটো মোটর সাইকেল। রানা আশা করল, ইগনিশনে চাবি পাবে। ছাউনির ছাত থেকে জলপ্রপাতের মত ভারী ধারায় পড়ছে বৃষ্টির পানি। এক এক করে বাইকদুটো পরখ করল রানা। তবে ও-দুটোর ইগনিশনে চাবি নেই। অথচ জলদি পিছু নিতে হবে। কাছের বাইকের স্টিয়ারিং কলামের নিচে টর্চের আলো তাক করল রানা। পেয়েও গেল ইগনিশনের তার। এবার ওটা ছিঁড়ে চালু করবে ইঞ্জিন। কিন্তু তখনই দেখল, মাটিতে পড়ে আছে স্পার্ক প্লাগের কেবল। রিচি বুঝেছে পিছু নেবে রানা, তাই অকেজো করে দিয়েছে বাইক দুটোকে।

বিড়বিড় করে কপালকে দোষ দিল রানা। দেরি না করে মোটর সাইকেলের আওয়াজ লক্ষ্য করে দৌড়াতে শুরু করল। জ্বেলে নিয়েছে টর্চ। পায়ের নিচে ছলাৎ করে উঠছে জমে যাওয়া পানি। উঠান হয়েছে পিচ্ছিল কাদার সাগর। বৃষ্টির তোড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে মোটর সাইকেলের চাকার দাগ। জঙ্গুলে পথ ধরে দ্বিচক্র-যানের পেছনে দৌড়ে চলল রানা।

আগের চেয়ে বেড়েছে ঝড়ের প্রকোপ। নুয়ে পড়ছে গাছ।

আকাশে ঝিলিক দিচ্ছে নীল আলোর জাল।

‘কড়াৎ!’ শব্দে সামনের এক গাছের মগডালে পড়ল বাজ। আগুন ধরে গেল গাছে।

দূর পাল্লার কামানকে হার মানিয়ে একের পর এক বজ্রপাত হচ্ছে চারপাশে। এখন আর কোয়াড বাইকের ইঞ্জিনের শব্দ পাচ্ছে না রানা। দৌড়ের গতি কমিয়ে টর্চের আলো নিভিয়ে দিল। ওর মনে হলো, সামনেই কোথাও অ্যামবুশ করবে রিচি। থেমে দাঁড়িয়ে কান পাতল।

বুম! কড়-কড়াৎ! একের পর এক পড়ছে বাজ।

ঘন ছায়া, ঝোপঝাড় ও গাছের ওপর চোখ বোলাচ্ছে রানা। এ পরিবেশে যে-কোনও শিকারি হবে অসহায় শিকার

আকাশে ঝলসে উঠল উজ্জ্বল বজ্র-ঝিলিক। পলকের ওই আলোয় রানা দেখল, মোটর সাইকেলের চাকার আবছা দাগ মুছে দিচ্ছে তুমুল বৃষ্টি।

কোনদিকে গেছে রিচি, জেনে গেছে রানা। হামলা করার জন্যে অপেক্ষা করছে না লোকটা। আবারও দৌড় শুরু করল ও। বারবার পিছলে যাচ্ছে কাদার ভেতর। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা বুজে দিতে চাইছে দু’চোখ। ঠাস্ ঠাস্ করে কপাল, গাল ও গলায় বাড়ি মারছে গাছের ডালপালা। বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপ করছে ওর ব্যালিস্টিক ভেস্ট। কপাল ভাল, অন্ধ

থেকে বুলেট এল না। ব্যথায় টনটন করছে রানার চিড় বসা পাঁজরের হাড়। তবুও প্রাণপণে ছুটে চলল ও। পেরিয়ে গেল দ্বীপের উঁচু জায়গাটা। সামনে ঢালু হয়ে বাইয়ুর দিকে গেছে জমি। ওদিকটা দ্বীপের পুব তীর। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে রানা দেখল, এঁকেবেঁকে পথ গেছে নিচে।

আরেকবার ঝলসে উঠল বিদ্যুৎচমক। সেই আলোয় রানা দেখল, জেটির পাশে কাত হয়ে পড়ে আছে পরিত্যক্ত কোয়াড বাইক। এখনও বনবন করে ঘুরছে পেছনের চাকা। ওটার আরোহী বোধহয় কড়া ব্রেক কষে থামতে গিয়ে পিছলে পড়েছে। দৌড়ে কোয়াড বাইকের পাশে পৌঁছল রানা। ট্যাঙ্ক থেকে বেরোচ্ছে পেট্রল। নাকে এল ঝাঁঝাল গন্ধ। উত্তর ও দক্ষিণ দিগন্তে ঝলসে উঠল জালের মত বিদ্যুৎ ঝিলিক। ওই আলোয় রানা দেখল, আশপাশে কেউ নেই। পরক্ষণে গুমগুম আওয়াজ ছাড়ল আকাশের মেঘ। ওটা ছাপিয়ে রানা न মোটরবোট চালু হওয়ার আওয়াজ।

ওটা আউটবোর্ড ইঞ্জিন।

রানার ধারণাই ঠিক, বোটে চেপে চলে যাচ্ছে রিচি নোভাক। একবার বাইয়ু পেরোলে ঘন জঙ্গলে হারিয়ে যাবে। আউটবোর্ড মোটরের আওয়াজ লক্ষ্য করে তাকাল রানা। পর্দার মত বৃষ্টির মাঝে একটু দূরে বোটহাউস। পা পল্টুনে ফিশিং বুম রিগ। কাছেই জেটি।

একবার বোটে করে বাইয়ু পেরোলে রিচিকে ধরতে পারবে না কেউ। ছপ ছপ শব্দে কাদা ও পানি ছিটিয়ে বোটহাউসের দিকে ছুটল রানা। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।

বাইয়ুর তীরে যাওয়ার আগেই রানা দেখল, ঝড়ের বেগে ছিটকে বোটহাউস থেকে বেরোল কালো একটা বোট। সাদা ফেনার স্রোত তৈরি করছে প্রপেলার। স্টার্নে একজনকে দেখল রানা। বোটের নাক ঘুরে গেছে খোলা চ্যানেলের দিকে।

পালিয়ে যাচ্ছে রিচি নোভাক!

ছুটে গিয়ে থকথকে কালো বাইয়ুর তীরে পৌঁছুল রানা। দেরি না করে কাঁধে বন্দুক তুলেই তাক করল বোটের দিকে। কিন্তু খাটো ব্যারেলের অস্ত্রটা দূরের টার্গেটের জন্যে উপযুক্ত নয়। রিচি নোভাকের গায়ে ছররা গুলি লাগার সম্ভাবনা খুবই কম। বন্দুক ফেলে বেল্ট থেকে শেরিফ স্যাম শেরিড্যানের রিভলভার নিল রানা। ট্রিগারে চাপ দিতেই সিলিণ্ডার ঘুরে পঞ্চম গুলি চলে এল নল বরাবর। হ্যামার ওপরে তুলে অস্ত্রটা তাক করল বোটের দিকে। তুমুল বৃষ্টিতে ভাল দেখতে পাচ্ছে না। হয়তো লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না। .৪৫ ক্যালিবারের রিভলভারটা টার্গেট পিস্তল নয়।

চলে যাচ্ছে বোট। রিচি নোভাককে ঠেকাতে হলে বিকল করতে হবে আউটবোর্ড মোটর।

রিভলভারে আছে পাঁচটা বুলেট। বোট আবছাভাবে দেখা গেলেও রিভলভারের ফোরসাইট দেখা যাচ্ছে না। আন্দাজে গুলি ছুঁড়তে হবে। অস্ত্র তুলেই টিপে দিল রানা ট্রিগার। হাতের ভেতর লাফিয়ে উঠল ভারী আগ্নেয়াস্ত্র। বিকট আওয়াজ ছড়িয়ে গেল বাইয়ুর চারপাশে।

লক্ষ্যভেদ করেনি বুলেট।

নিশ্চিন্তে বোট নিয়ে চলে যাচ্ছে রিচি নোভাক!

হ্যামার রিকক করল রানা। বাম বাহুর ওপর কব্জি রেখে আবার গুলি করল। ওর দ্বিতীয় বুলেটের আওয়াজটা চাপা পড়ল বজ্রপাতের গর্জনে।

আকাশে বারবার ঝিলিক দিচ্ছে বিদ্যুৎশিখা। সেই আলোয় রানা দেখল, বোটের তিন ফুট পিছনে পানিতে নাক গুঁজেছে এবারের গুলিটা।

আরও দূরে চলে যাচ্ছে বোট।

রানার তৃতীয় বুলেট নাক গুঁজল বোটের সামনের পানিতে। ও বুঝে গেল, রিচিকে গ্রেফতার করার সুযোগ হারাচ্ছে।

বোটের গানেলের চল্টা তুলল চতুর্থ বুলেট।

আবার চমকাল বিদ্যুৎ।

দ্বীপের দিকে ঘুরে তাকাল লোকটা, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে টা-টা দিল রানাকে।

রানা বুঝল, ওকে আস্ত গাধা ভাবছে রিচি নোভাক।

‘তুই সত্যিই গাধা,’ বিড়বিড় করে নিজেকে বলল রানা।

পঞ্চমবার গুলির জন্যে টানল হ্যামার।

সিলিণ্ডারে রয়েছে শেষ বুলেট।

নীলচে বিদ্যুতের ঝিলিক নানাদিকে ছিটকে যেতেই বড় করে দম নিয়ে রিচি নোভাকের বুক লক্ষ্য করে গুলি করল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *