স্ট্রেঞ্জার – ৫৪

চুয়ান্ন

বাড়ির পেছন থেকে এল ভি-৮ টার্বো-ডিয়েল ইঞ্জিনের মেঘগর্জনের মত গুরুগম্ভীর আওয়াজ। ওটা রাইনো গাড়ির গর্জনের চেয়েও ভারী। ওই জিপ ব্যবহার করা হয় মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং পুব-ইউরোপের যুদ্ধের ময়দানে। বিশ্রী, কর্কশ আওয়াজটা এক পলকে চিনেছে রানা। ওই শব্দ প্রায় যুদ্ধের ট্যাঙ্কের ইঞ্জিনের মত। আমেরিকার যুদ্ধবাজ কর্মকর্তারা নাম দিয়েছে এইচএমএমডাব্লিউভি, অর্থাৎ, হাই মোবিলিটি মাল্টিপারপাস হুইড্ ভেহিকেল। সাধারণ মানুষ বলে হামভি। দুনিয়ার যে-কোনও দুর্গম জায়গায় চলে আতঙ্কজনক দানবীয় এই জিপ। অনায়াসেই বেয়ে উঠতে পারে প্রায়-খাড়া দেয়াল। নিচে ল্যাণ্ড মাইন ফাটলেও আর্মারের কারণে কিছুই হয় না ওটার।

বাড়ির পেছন থেকে উঠানের দিকে তেড়ে এল হামভি। ক্রমেই বাড়ছে গতি। দলবল নিয়ে যে ঝোপের ভেতর আছে রানা ও শেরিফ, সোজা ওদিকেই এল ওটা। সামনে জ্বলে উঠল রাইনোর স্পটলাইটের অন্তত তিনগুণ শক্তিশালী হ্যালোজেন বাতি। জঙ্গল ও ঝোপঝাড় ভেসে গেল দিনের মত সাদা আলোর বন্যায়। হঠাৎই রানা, শেরিফ ও অন্যরা বুঝল, কোথাও লুকিয়ে পড়বার উপায় নেই ওদের!

ঝলমলে আলো এতই তীব্র, ড্রাইভারের চেহারা দেখতে পেল না রানা। অবশ্য আবছাভাবে চিনল খোলা ককপিটে স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে বসে আছে রিচি নোভাক।

ভীষণ ভয় পেয়ে সরে যেতে চাইছে পুলিশ অফিসাররা। হৈ-চৈয়ের ভেতর চোখের কোণে রানা দেখল, একঝাড় পুরু গাছের দিকে ছুটল ধূসর চুলের অফিসার উডো রবার্টস। গন্তব্যে পৌছুতে পারবে না বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ল ধুলোবালির ভেতর। এদিকে দশ গেজের বন্দুক কাঁধে তুলেছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। টেনে কক করল হ্যামার।

রানার দেখাদেখি চোখ থেকে হ্যাঁচকা টানে নাইট ভিশন গগল্স্ খুলে ছুঁড়ে ফেলল অফিসার জেনি লরেন্স। তিক্ত চেহারায় কাঁধে কারবাইন তুলেই টার্গেট খুঁজল। মন থেকে উবে গেছে কঠোর ট্রেইনিং। বেচারি বুঝেছে, যে-কোনও সময়ে খুন হবে। হামভির দিকে গুলি ছোঁড়ার আগেই তার চারপাশে ভেঙে পড়ল আস্ত নরক। বিকট আওয়াজে থরথর করে কাঁপতে লাগল কালো রাত।

আগেও নানান যুদ্ধে জিপের মত হালকা কমব্যাট ভেহিকেল ধ্বংস করেছে রানা। কখনও ভয় পায়নি হেভি মেশিন গানগুলোকে। তবে এ মুহূর্তে যা দেখল, আত্মা খাঁচা- ছাড়া হলো ওর। ভাবতেও পারেনি মুখোমুখি হতে হবে স্টার ফাইটার জেট বিমানের ওই গ্যাটলিং গানের!

ছাতহীন হামভির ওপর ঘাপটি মেরে বসে আছে ওটা!

জেট ফাইটার প্লেনের আফটারবার্নারের মত বিকট কর্কশ শব্দে গর্জে উঠল কামান। জ্বলজ্বল করে উঠল ওটার নলের মুখ। তুমুল গোলাবর্ষণের নিচে চাপা পড়ল পুলিশদের গুলির আওয়াজ। পদাতিক বাহিনী ও ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের আতঙ্ক ওই গ্যাটলিং গান। তবে ওটা এখন ফাইটার বিমানে নেই, আছে হামভি জিপের ওপর। প্রায় সিকি পাউণ্ড ওজনের শেলগুলোর গতিবেগ শব্দের তিন গুণ। প্রতি সেকেণ্ডে ছিটকে বেরোচ্ছে এক শ’র বেশি রাউণ্ড। দূর থেকে বাড়িঘর, আর্মার্ড ফাইটিং ভেহিকেল বা নিরেট টার্গেট ধ্বংস করতেই তৈরি করা হয়েছে মাঝারি বা দূর পাল্লার দানবীয় এই কামান। ভয়ঙ্কর ফায়ার- পাওয়ার। মানুষের দিকে এরকম পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গোলাবর্ষণ মানেই মশা মারতে ব্যবহার করা হচ্ছে ভারী স্লেজ হ্যামার।

শত শত রাউণ্ডের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে রেইডিং পার্টির সদস্যরা। গ্যাটলিং গানের হ্যাঁচকা টান খেয়ে উবে গেল চারপাশের বাতাস। গোলার আঘাতে কাণ্ড কেটে যাওয়ায় ধুপ-ধাপ-মড়াৎ শব্দে মাটিতে পড়ছে বড় বড় সব গাছ। কামানটা কাজ করছে প্রকাণ্ড চেইন স’র মত। ঝড়ের বেগে চারপাশে ছিটকে পড়ছে কুচি হওয়া কাঠ ও ডালপালা। চোখের পলকে ঝাঁঝরা হচ্ছে ক্ষত-বিক্ষত গাছ। কী ঘটছে বুঝতে পেরেই শ্যাওলা ভরা ভেজা মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা। বুঝে গেছে, এখন কিছুই করার নেই ওর।

ডাইভ দিতে দেরি করেছে পুলিশবাহিনীর কেউ কেউ। সি টিমের অফিসার পল নিউম্যান কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাটা পড়ল কোমর থেকে। কয়েক ফুট দূরে পড়ল পা-দুটো। জেনি লরেন্সের কলিগ কৃষ্ণাঙ্গিনী অফিসার ভীষণ ভয়ে পালিয়ে যেতে চাইলেও পারল না- কাটা পড়ল তার ডান ঊরু। সামনের ঝোপের ভেতর আছাড় খেল বেচারি। তীব্র ব্যথায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে সে, অথচ কামানের বজ্রপাতের মত কড়কড়ে আওয়াজে শোনা গেল না কিছুই। বন্দুক দিয়ে একবার গুলি করল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান, পরক্ষণে কুঁকড়ে গিয়ে পড়ল মাটিতে। স্পটলাইটের আলোয় ছিটকে উঠেছে রক্তের মিহি ধারা। মাথা কাত করে রানা দেখল, জঙ্গলের গাছগুলোর মতই কোমর থেকে কাটা পড়ল ডেপুটি ফিল জনসন এবং তার সঙ্গের চার অফিসার। কারও কিছু করার নেই! সতর্ক হওয়ার উপায়ও ছিল না! ওরা যেন ঢুকেছে কোনও দানবের কসাইখানায়!

এগিয়ে এল হামভি, সেইসঙ্গে চলছে গোলাবর্ষণ। ভীষণ রিকয়েলের কথা ভেবে মাত্র কয়েক সেকেণ্ড ভালক্যান ক্যানন ব্যবহার করে এয়ারক্রাফট পাইলট, নইলে গতি হারিয়ে আকাশ থেকে খসে পড়বে তার বিমান। রিচি নোভাকের সে সমস্যা নেই। কামানের নল ডানে-বামে ঘুরিয়ে যেদিকে খুশি গোলাবর্ষণ করছে। খুবলে তুলছে মাটি। ম্যাচবাক্সের কাঠির মত মটমট করে ভাঙছে প্রকাণ্ড সব গাছ। ছিন্নভিন্ন হচ্ছে পুলিশদের মৃতদেহ।

একদঙ্গল শেকড়ের পেছনে শুয়ে আছে রানা, এখনও হাতে রয়েছে রাইফেল। পরিষ্কার বুঝেছে, ওর কোনও কাভার নেই। লোহার মত শক্ত গাছ মুহূর্তে ঝাঁঝরা করছে কামানের গোলা। যে-কোনও সময়ে একরাশ গোলার আঘাতে মাংসের কিমা হয়ে যাবে রানা। আপাতত লুকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করবার নেই।

বিস্ফোরিত হলো রানার দু’পাশের মাটি। কোনও কোনও গোলা বিধল ওর দেহ থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে। একটা গোলার আঘাতে উড়ে গেল হাতের রাইফেল। ঝটকা খেয়ে বাহুর ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলল রানা। হাত ফিরিয়ে নিল বুকের কাছে। পরক্ষণে বুঝল, এবার গোলার আঘাতে খুন হবে ও। এক গড়ান দিয়ে সরে যেতে চাইল রানা। তবে সরে গেছে কামানের নল। অন্যদিকে তৈরি করছে নরক।

হামভির কড়া আলো সরতেই দু’বার গড়িয়ে জঙ্গলের ছায়াভরা একটা জায়গায় থামল রানা। উঠে চারপাশে তাকাল। ওর চাই এমন কোনও অস্ত্র, যেটা দিয়ে বন্ধ করতে পারবে এই হত্যাযজ্ঞ।

কিন্তু চারপাশে তেমন কিছুই নেই!

তখনই ওর চোখ পড়ল জেনি লরেন্সের ওপর। দু’ফুট দূরে কাত হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা। মাথা থেকে খসে পড়েছে হেলমেট। এলোমেলো চুল ছেয়ে ফেলেছে মুখটাকে। রানা প্রথমে ভাবল খুন হয়ে গেছে জেনি। কিন্তু রক্তের কোনও চিহ্ন নেই! পরক্ষণে দেখল, ভীষণ ভয়ে দুই হাতে হাঁটু চেপে ধরে থরথর করে কাঁপছে সে। কুঁকড়ে গেছে আতঙ্কিত বাচ্চার মত।

ঝট্ করে সামনে বেড়ে জেনির এম ফোর তুলে নিয়ে হামভি লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল রানা। ফুল অটোতে আছে অস্ত্রটা। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে খালি হলো ম্যাগাযিন। আর্মার প্লেট দেয়া গাড়ির বডিতে লেগে নানাদিকে ছিটকে গেছে বুলেট।

রানার মনে হলো বাচ্চাদের এয়ার গান দিয়ে হাতি মারতে চেয়েছে ও। খালি রাইফেল ছুঁড়ে ফেলে ঝুঁকে জেনি লরেন্সকে টেনে তুলল রানা। গলা ফাটিয়ে বলল, ‘আমার সঙ্গে এসো!

আলো পড়ে ঝিক করে উঠল মেয়েটার চোখ। দু’সেকেণ্ড চেয়ে রইল রানার দিকে। যেন বুঝতে পারছে না রানা শত্রু না মিত্র। শক আর ভয়ে অবশ হয়েছে ওর মন। আরেক পলক দেখার পর শক্ত করে রানার হাত ধরল। একইসঙ্গে প্রাণপণে জঙ্গলের দিকে ছুট দিল ওরা। একেবারে শেষ সময়ে টনক নড়েছে ওদের। এম ফোর রাইফেলের মাযল ফ্ল্যাশ দেখেছে রিচি নোভাক। এখন ওদের দিকেই ঘোরাচ্ছে কামানের নল। এক সেকেণ্ড আগে রানা ও জেনি যেখানে ছিল, সে জায়গার মাটিতে তৈরি হলো গভীর নালা। মেয়েটা যে ঝোপে ছিল, ঝটকা খেয়ে উপড়ে গেল ওটা।

জঙ্গলে ছায়াময় জায়গা বেছে ছুটছে রানা ও জেনি। রানার পায়ে বাধল নরম কী যেন। থমকে দেখল মাটিতে পড়ে আছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান

গোলাবর্ষণের সময় কখন যেন ক্রল করে জঙ্গলে ঢুকেছে সে। বেঁচে আছে, তবে বাজেভাবে আহত। ডান কাঁধে লেগেছে শেল। ক্ষতটা ভয়ঙ্কর। রানা সার্জন নয়, তবে বুঝতে দেরি হলো না, প্রায় খুলে গেছে শেরিড্যানের বাহু। ঝুলছে কেবল ক’টা লিগামেন্ট রয়ে যাওয়ায়।

‘এখান থেকে সরতে হবে,’ গলা ফাটিয়ে বলল রানা। সুস্থ হাত ধরে টেনে তুলতে চাইল শেরিফকে।

দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র ব্যথা সহ্য করছে গর্বিত, বয়স্ক লোকটা। যন্ত্রণার কথা স্বীকার করবে না। রক্তাক্ত মুখে ফুটে উঠেছে অসংখ্য দপদপে শিরা। তাকে মাটি থেকে তুলে পরক্ষণে কাঁধে নিয়ে জঙ্গলের গভীর দিক লক্ষ্য করে দৌড় দিল রানা। অক্ষত হাতে নিজের বন্দুক ধরে রেখেছে শেরিড্যান।

মনে মনে তার প্রশংসা না করে পারল না রানা।

বুড়ো পাখি আজও হিমালয় পেরোতে চায়! প্রথমে ভয় পেলেও পিঠটান দেয়নি দায়িত্ব থেকে। অতীত ভুলের জন্যে লজ্জিত। তবে এ হামলার পর বেঁচে গেলে নিজেকে আর ছোট ভাববে না সে।

হঠাৎই থামল কামানের গর্জন। রানার মনে হলো চিরকাল ধরে শুনেছে ওটার আওয়াজ। বাস্তবে সময়টা মাত্র পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ সেকেও। তাতেই উঠানের ওদিকের জঙ্গল হয়ে গেছে ধ্বংসস্তূপ। প্রায় কিছুই নড়ছে না ওখানে। সাদা উজ্জ্বল আলোয় ভাসছে ধোঁয়া। করুণভাবে গুঙিয়ে উঠছে কয়েকজন আহত পুলিশ সদস্য! ভীষণ ব্যথায় করুণ আর্তনাদ ছাড়ছে কে যেন।

ব্রেক কষে থেমেছে হামভি।

চড়া গলার কথাবার্তা ও হাসির শব্দ এল নোভাকদের ওদিক থেকে। জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল তাদের দলের খুনিরা, এখন চলেছে উঠান লক্ষ্য করে।

আহত স্যাম শেরিড্যানকে নিয়ে জঙ্গলের আরও গভীরে চলল রানা ও জেনি। হামভি থেকে চল্লিশ গজ দূরে ছায়াময় বড় এক কাঁটাঝোপে থামল ওরা। সাবধানে শেরিফকে মাটিতে শুইয়ে দিল রানা। প্রচুর রক্ত হারিয়ে দুর্বল হয়ে গেছে বুড়ো মানুষটা। পাল্‌স্ পরীক্ষা করে রানা বুঝল দুর্বলভাবে চলছে হৃৎপিণ্ড। চেতনা আর ঘুমের মাঝে ঝুলে আছে কোনমতে।

‘খারাপভাবে আহত,’ ফিসফিস করল জেনি লরেন্স।

‘অন্যদের অবস্থাও ভাল নয়,’ বলল রানা। ছায়া ভরা কাঁটাঝোপের মাঝ দিয়ে দেখল, নানান আবর্জনার ভেতর দিয়ে রণক্ষেত্রে ফিরছে নোভাকদের লোক। দ্বীপে তারা ছিল পাঁচ-ছয়জন। পরে যোগ দিয়েছে রাইনো গাড়ির হবু কিডন্যাপাররা। এ ছাড়া নোভাকরা তো আছেই।

আড়াল থেকে চেয়ে দেখছে রানা।

ছাতহীন হামভির ককপিটে কামানের ওপর ঝুঁকে কী যেন করছে রিচি নোভাক। হয়তো ফুরিয়ে গেছে গোলা, অথবা বিকল হয়েছে গ্যাটলিং গান। তবে যে সর্বনাশ করে দিয়েছে ওটা, সে ক্ষতি অপূরণীয়।

ক’ মুহূর্ত পর কামানের ওপর থেকে চোখ সরাল নোভাক। লাফিয়ে নামল উঠানে।

রানা দেখল, আড়াল থেকে দৌড়ে এসে বড়ভাইয়ের সামনে থামল হ্যাঙ্ক নোভাক। খুশিতে হাসছে খলখল করে। দু’ভাই বোধহয় ভাবতেও পারেনি মানবজীবন ও চারপাশের পরিবেশ কতটা ধ্বংস করতে পারবে তাদের সাধের অস্ত্র। মুখোমুখি হয়ে হাত তুলে হাই ফাইভ করল তারা। ঘুরে তাকাল দলের লোকদের দিকে। বেল্ট থেকে টেনে বের করল যার যার পিস্তল। দলের সবাইকে নিয়ে এগোল কাটা পড়া গাছগুলোর ভেতর দিয়ে 1

এবার কী ঘটবে, বুঝে গেল রানা।

জীবিত পুলিশ সদস্যদেরকে খুঁজছে নোভাকরা। একে একে গুলি করে শেষ করবে সবক’জনকে!

কামানের গর্জনের পর পিস্তলের ‘টাশ্!’ শব্দ হালকা মনে হলো রানার। কিন্তু ছোট ওই গুলিই যথেষ্ট কারও জীবন নিভিয়ে দেয়ার জন্যে। পড়ে থাকা মানুষগুলোর পাশে থেমে এক এক করে বেচারাদের মাথায় গুলি করছে রিচি ও হ্যাঙ্ক।

অদ্ভুত এক কষ্টে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল রানার। চট্ করে মনে হলো, বোধহয় আর বেঁচে নেই এলিসা, রন, রব ও টিনা!

বিলি এস. কনরাড ওদেরকে দ্বীপে আনার পর পরই হয়তো গুলি করে মারা হয়েছে। প্রথম থেকেই এ পরিকল্পনা করেছে রিচি আর হ্যাঙ্ক নোভাক। সবসময় রানার চেয়ে এক পা এগিয়ে ছিল তারা। বন্দি বিনিময়ের ইচ্ছে ছিল না। জিম্মিদেরকে খুন করেছে ঠাণ্ডা মাথায়। তারপর হত্যা করতে চেয়েছে রেইডিং পার্টির সবাইকে। তাতে প্রায় সফলও হয়েছে তারা।

পলকের জন্যে চোখ বুজল রানা। মনের আয়নায় ভেসে উঠল গুডরিচদের ডাইনিং টেবিল। সময়টা ছিল যেন হাজার বছর আগে। ওর মনে পড়ল, কত মিষ্টি মেয়ে ছিল টিনা। খেতে বসার আগে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেছিল ওদের সবার হয়ে। তাতে কত খুশিই না হয়েছিল এলিসা। বলেছিল: ‘সুন্দর বলেছ, মা।’

ওই বাচ্চা মেয়েটা মারা গেছে মা ও দুই ভাই সহ! ওকে হয়তো জবাই করেছে ওর মা-র সামনে! তারপর একে একে খুন করেছে এলিসা, রন আর রবকে!

মড়া কাঠের মত শুকিয়ে গেছে রানার গলা। শুধু ওর কারণেই এতবড় সর্বনাশ হলো একটা পরিবারের! মনে হচ্ছে: সমস্ত দোষ ওর! গলার কাছে পাথরের মত কী যেন আটকে গেছে রানার। ভাবল, ও নিজে খুন হলে এর চেয়ে ঢের ভাল হতো!

ভিজে গেল রানার চোখের কোণ। টপ্ করে এক ফোঁটা অশ্রু পড়ল ওর বুকে, ভেতরে জ্বলছে দাউদাউ আগুন। ঝট্ করে উঠে দাঁড়িয়ে নিল শেরিফ শেরিড্যানের উইনচেস্টার বন্দুকটা। ওটার ভেতর আছে চারটে কার্তুজ। অস্ত্রটা আপাতত কোনও কাজে আসবে না আহত শেরিফের।

‘কোথায় চললে?’ ভাঙা গলায় জানতে চাইল স্যাম শেরিড্যান।

বেসুরো শোনাল রানার কণ্ঠ, ‘যে কাজে এসেছি, তা শেষ করতে যাচ্ছি।’

‘আমিও যাব,’ চাপা স্বরে বলল জেনি লরেন্স।

মাথা নাড়ল রানা। ‘তুমি এখানেই থাকো। আমি ফিরে না এলে, চেষ্টা করবে শেরিফকে নিয়ে দ্বীপ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে।’

রানা ঘুরে দাঁড়াতেই পেছন থেকে ডাকল জেনি। ‘রানা?’ ওর গলার স্বর খুব নরম। নিজেকে এখন পুলিশ অফিসার হিসেবে ভাবছে না। ক্লোভিস প্যারিশে বড় হয়ে ওঠা এক মেয়ে, যে কিনা স্থানীয় স্কুলে একসঙ্গে পড়েছে এমন ব একদিন বিয়ে করবে, সুখী করবে তাকে, নিজেও সুখী হবে।

ঘুরে তাকাল রানা। ‘বলো কী বলবে, জেনি। মনের ভেতর কে যেন বলল ওকে, এরপর হয়তো আর কখনও নাম ধরে তোমাকে ডাকবে না কেউ।

‘ওদেরকে বাঁচতে দিয়ো না। এটা আমার অনুরোধ!’

‘আপ্রাণ চেষ্টা করব।’

‘আরেকটা কথা, রানা?’

‘কী?’

‘ভুলেও মরে যেয়ো না। প্লিয, আমি তোমার মত কাঁদতে চাই না।’

মৃদু মাথা দুলিয়ে হামভির দিকে পা বাড়াল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *