সোনার নায়ে রঙ্গের বৈঠা
দরবেশের আখড়াবাড়ি
গ্রামের নাম জলকর ভোমরা। বেলে ভেঙে আরও বেশ কিছু ভেতরে গেলেই গ্রাম জলকর ভোমরা। স্থানীয় মানুষ বলে ভোমরা গ্রাম। এদেশে বেশিরভাগ গ্রামনামেরই না আছে কোনও মাথামুণ্ডু না ছিরিছাঁদ। গ্রামের নাম বনুই। বোনের বরকে গ্রামদেশের মানুষ বনুই বলে অভিহিত করে। এ নাম কী করে আস্ত এক গাঁয়ের নাম হয়ে উঠল কে জানে! বেলে থেকে কিছু ছাড়িয়ে গোপালনগরের দিকে গেলে কানসোনা নামটি আমাকে অভিভূত করে ঠিকই। কিন্তু গ্রামের নাম ভোদাই। এ তো আর ভাষার শ্রুতি মধুরতা রক্ষা করে না কোনওভাবে। দেশগাঁয়ের প্রচলিত গাল কীভাবে যে গ্রামনামের সঙ্গে জুড়ে গেল কে জানে! আরও কত সব উদ্ভট নামের যে গ্রামে গিয়েছি তার কোনও ইয়ত্তা নেই। গ্রাম ঘোরা আমার স্বভাব। দেশগাঁয়ের রূপের ভেতর আমার সব সময়ই মনে হয় যে কোনও এক বিম্ববতী তার আরশি মেলে বসে রয়েছেন।
সেইরূপ দেখতে দেখতেই ভ্রমরা গ্রামে চলে এলাম আমি। যাব নিতাইরানি দরবেশের আখড়াবাড়ি। নিতাইরানির হদিশ আমাকে দিয়েছিলেন দিগরের ষষ্ঠী খ্যাপা।
বলেছিলেন, য্যান খ্যাপা একবার। গিয়ে দেখে আসুন অচিন ঘর। কত রকমের নিয়মকানুন।
ষষ্ঠী খ্যাপার কথাকে বরাবরই আমি মান্যতা দিতাম। চাকদহের গোবিন্দপুর, দিগরে ওঁর বাড়ি। গৃহী বাউল। গানবাজনা আর মাধুকরী করেই যেটুকু যা রোজগার করতেন খ্যাপা। ঝাকরা চুল। নানা তালি দেওয়া পোশাক পরতেন খ্যাপা।
আমি বলতাম, এমনধারা পোশাকের মানে কী গো খ্যাপা?
বলতে পারলেন না তো খ্যাপা। কিন্তু আমি তো হাল ছাড়ার পাত্র নই। জানতে হবে আমাকে ফকিরি মতে, বাউল ধারায় হরেক তালি দেওয়া কাপড়ের পোশাক পরেন কেন মুর্শিদ—গুরু। রংচঙে জোব্বা পরার কারণটা খুঁজে বের করতে হবে আমাকে। ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম এবার পাথরচাপড়ি। চৈত্রমাসে এ জায়গাটাতো ছয়লাপ হয়ে থাকে ফকিরে ফকিরে। খেলকা পরা, সাদা দাড়ি, মাথায় টুপি মারফতি পির—ফকিরেরা সব এখানে এসে ওঠেন দাতাপিরের দরবারে।
পাথরচাপড়িতে দাতার নামে জমায়েত হয় ইংরেজ আমল থেকে। উনিশ শতকের শেষভাগে পাথরচাপড়িতে দেহ রাখেন দাতা। সেই উপলক্ষে ১১, ১১, ১২ চৈত্র তিনদিনের উরস।
উরসের দিনে পিরপুকুরের জল এনে দাতার সমাধি ধোওয়াচ্ছিলেন তখন এক বৃদ্ধ ফকির। পরনে ওঁরও ষষ্ঠী খ্যাপার ধরনের সেই রংচঙে জোব্বা। শুনলাম তিনি চট্টোগ্রাম, বাংলাদেশের বারো আউলিয়া তরিকারই সিদ্ধ। ওনাকে ঘিরে গত বিকেলে এক বড় মতন জটলাও দেখেছিলাম। আলমগীর শেখ জলিল। সকলে বলছিলেন, জলিল বাবা।
চট্টোগ্রাম—ঢাকা মহাসড়কের পশ্চিম ধারে অবস্থিত মাওলানা ওলি আহমদের মাজারে বাস করেন তিনি। হাটবাজারি মাদ্রাসায় পড়িয়েছেনও এক সময়। তারপর ফকিরি নেন।
জলিল বাবাকে দুপুর দুপুর ফাঁকা পেয়েও গেলাম দাতার মাজারের গদিঘরে। পাশে ধুনি জ্বলছে তখন। ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনও পোশাক নেই বাবার। মাথায় অল্প চুল সব সাদা, দাড়ি—গোঁফ সাদা, ভুরুও সাদা। ওঁর মুরিদরা তখন বাবার পিঠে তেল—মালিশ দিচ্ছে।
আমি গেলাম। বলতে দিলেন আমায়। তিনি হজরত মহম্মদের সমাধিবাগান নিয়ে কথা বলতে থাকলেন। তিনি বললেন, এ হল গিয়ে বিশ্বজোড়া ইসলামি রওজা। ফকিরেরা মহম্মদের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন। তিনি শ্রেষ্ঠ সাধক। তাই তাঁরই সমাধির অনুকরণে পির ফকিরের সমাধিবাগান হয়।
কথার এক ধরতাই পেলাম যেন আমি। বললাম, বাবা ফকিরেরা যে রঙিন কাপড়ের টুকরো জোড়া জোব্বা পরেন, গায়েও ওই ধরনের চাদর জড়ান, এর মানেটা কী?
বাবা বললেন, ভালো প্রশ্ন। ফকিরেরা বলেন ও হল গিয়ে সত্যের তালি।
এর মানেটা কী?
সত্তরটি রঙের টুকরা জুড়ে ফকিরি জামা বানানো চলে। এ হল বাবা, সত্যের অনুভূতির তালি। ওতে একবিন্দু মিথ্যা মিশানো যে নাই। নবির নূরের কথা বলেন ফকির।
নূর কী?
নূর হল দেহমনের সূক্ষ্ম আলো। এ আলো প্রেমাগ্নি দ্বারা প্রজ্জ্বলিত হয়। প্রজ্জ্বলিত হলে চিদাকাশ, হৃদয়ের আসমানটা আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে। এই নূর হল আল্লাহর। নূরের অনুভবে যে সত্য আসে তা নবির ধার থেকে আসে। নবি তাঁর মুরিদকে সেই সত্যই যে দেন খিলকায়। খিলকা—পোশাক তাই সত্যের। সত্তরখানা তালির ফকিরি জামা ওই নূরের সত্যে গিয়ে মেশে। আল্লাহর অপ্রকাশ্য নূর যখন হৃদয়ে আসে তখন হরেক সত্যের রং দেখা যায়। ফকিরেরা সেই সত্যের রং দেখবেন বলেই সত্তরটি তালি দেওয়া জোব্বা পরে থাকেন।
আমি ফের দিগরে গিয়ে সেসব বলে এলাম ষষ্ঠী খ্যাপার কাছে। সামান্যই পড়তে লিখতে পারেন খ্যাপা। বৈষ্ণবমতে ওঁরা দীক্ষা। ভেক নিয়েছেন ফকিরি মতে। এক ছেলে ও মেয়ে রয়েছে খ্যাপার। ভাবতন্ময় হয়ে থাকেন। খুব গাঁজাও খান। প্রসাদি গাঁজা টেনেই নানান ঘরের কথা শোনান খ্যাপা। একসময় মাধুকরী করতেন বলে নানা গাঁয়ের সাধনঘর চেনেন তিনি। আমাকে নানা ঘরের কথা বলতেন খ্যাপা। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। এরই ভেতর খবর পেলাম দেহ রেখেছেন খ্যাপা। তখনও তো আমি গিয়ে উঠিনি নিতাইরানির আখড়াবাড়ি। মন এলোমেলো হয়ে গেল খ্যাপার মৃত্যুর খবরটা পেয়ে। সেদিনই চলে গেলাম আমি আখড়াবাড়ি।
নিতাইরানির কাছে পৌঁছালাম বেলাবেলি। গ্রামের লোকই এখন তাঁর দেখভাল করেন। বাতে একেবারে পঙ্গু। হাঁটাচলা করতে পারেন না। ভোমরা গ্রামেই নাকি তাঁর বাস একশো বছরের কাছাকাছি। গ্রামের একজনকেই জিজ্ঞেসা করায় সটান তাঁর কাছে নিয়ে গিয়ে আমাকে হাজির করলেন।
ডাকলেন, অবধূত, অবধূত। ডেকে আমাকে বললেন, একটু অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে। সময় নেবেন গোঁসাই। বার—বারান্দার পেছনে তাঁর ঘর। নড়বড়ে শরীরে এতখানি আসবেন তো।
বললাম, ঠিক আছে। এসে যখন পড়েছি এত অল্পে অধৈর্য হলে চলবে!
আমি বরং ততক্ষণ আপনাকে আমাদের দাদু গোঁসাইয়ের সমাধিখানা দেখাই।
দাদু গোঁসাই মানে? জিজ্ঞেসা করলাম আমি।
উনি আমাদের গোঁসাইয়েরও গোঁসাই। বড় দীর্ঘ আয়ুর মানুষ তো। দরবেশ। সাধনপথ বড় কঠিন। দাদু গোঁসাই একশো কুড়ি বছরের ওপর বেঁচেছিলেন বুঝলেন। আর এই গোঁসাইও কিন্তু একশো ছুঁইছুঁই।
আমরা এখন দাদু গোঁসাইয়ের সমাধিবেদির সামনে। কিছু ফুল দেওয়া রয়েছে বেদির ওপর। আছে ধূপ—দীপ দেওয়ারও জায়গা। একটা মোমবাতি জ্বলছে।
জিজ্ঞেসা করলাম, এখানে কি পুজো দেওয়ার রীতি আছে নাকি?
ঘরের চিন—পরিচয় আছে দেখছি আপনের। পুজো তো এ ঘরের রীতি নয়। করণ মেনে সেবা দিতে হয় আমাদের। ওই যে জলচৌকিখানা দেখছেন তার ওপর গোঁসাই তেনার গুরুর সেবা দেন রোজ। সেবা না দিলে গোঁসাই সেবা নেবেন ক্যামনে শুনি? গোঁসাইয়ের আগে ভক্তি, সেবা। তারপর করণরীতি মেনে নিজের সেবা।
আপনি কি গোঁসাইয়ের দীক্ষিত?
এ গাঁয়ে এখন গোটা দশ পরিবার আছে সবই দাদু গোঁসাইয়ের দীক্ষিত।
মানে এখনকার গোঁসাইয়ের গুরুদেবের।
হ্যাঁ। তেনার নাম গৌররানি দরবেশ। এ গাঁয়ের সকলেরই তিনি ছিলেন দাদু গোঁসাই। বাপের মুখে শুনেছি দাদু গোঁসাই ছিলেন অলৌকিক ক্ষমতাধারী। চিমটে হাতে নিয়ে কেবল মাধুকরীতে বেরোনো গোঁসাই নন।
জিজ্ঞেস করলাম, আর তোমাদের গোঁসাই?
তিনি যে দাদু গোঁসাইয়ের হাতেই গড়া। ছোট বাচ্চা সাথে নিয়ে দাদু গোঁসাই এসেছিলেন ভোমরা গ্রামে। আমার ঠাকুরদাদার দেওয়া জমির ওপরই এই এখনকার আশ্রম। দাদু গোঁসাইয়ের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে আমার ঠাকুরদার মারণরোগ সেরে গেল। তিনি আর যেতে দিলেন না গোঁসাইকে। সেই থেকে এ গাঁয়ে গোঁসাইয়ের আশ্রম। আগে চালা ছিল। এখন গ্রামের সবাই দালান করে দিয়েছে। তারা সবাই দাদু গোঁসাইয়ের বেদিতে জল—ফুল দেয়। পুজো করে।
শিষ্যদের দানে তবে আশ্রম পাকা হয়েছে?
না না। এখানে গোঁসাইয়ের শিষ্য কোথায়? সব ভক্ত, গোঁসাই শাস্ত্রজ্ঞ। গাঁয়ের ইস্কুলে পড়েছেন। গীতা, ভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত সব পড়ে শোনান। নাম করেন—হরিনাম। মানুষজন তাঁরে ভক্তি—শ্রদ্ধা করে। তবে কেউই তাঁর থেকে দীক্ষা নেননি।
কেন? জিজ্ঞেসা করলাম আমি।
কেন আবার! ওই যে বললাম ধর্মরক্ষার পথ বড়ো কঠিন। কত নিয়মকানুন। একবেলা সেবা। মাধুকরী। কোনও ঘরেই সেবা নেওয়া যাবে না। যাওয়া পর্যন্ত যাবে না ঘর ছেড়ে। ঘরের ভক্তি ঘর আগলে দিতে হবে। গোঁসাই তাই আগলাচ্ছেন। গ্রামের অষ্টপ্রহর কীর্তনে পর্যন্ত তিনি যান না। পুজো—আচ্চার প্রসাদ নেন না। এত মানাগোনা একালের কেউ পালবে বলেন? গোঁসাইয়ের তাই কোনও শিষ্য নেই। সবাই ভক্ত।
বার—বারান্দার সমাধির পাশেই আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বাক্যালাপ চালাচ্ছিলাম তখনও। বেশ অনেকখানি সময় পর গুটি গুটি পায়ে এলেন এবার নিতাইরানি দরবেশ।
এসেই বললেন, অবধূত, অবধূত। তুমি বসতে দাওনি ওনাকে গোবিন্দ!
লোকটি গোঁসাইকে বললেন, বাবা, একেবারেই জিজ্ঞেসু মানুষ। এটা—ওটা বলতে—বলতেই তো সময় কাবার। বসতে বলবার সময় পালাম কই!
গোঁসাই নিজে হাতে আসন পেতে আবার বললেন, অবধূত, অবধূত। এরপর হাতের ইশারায় আমাকে বসতে বললেন। লোকটিকে বললেন এরপর, যাও একটু সেবার ব্যবস্থা কর। কিস্তি, পাখা নিয়ে বেরোও ঘর দুই। যা জোটে তা দিয়ে সেবা দেব।
বললাম, আপনি অত ব্যস্ত হবেন না। আমার কিছুই লাগবে না। আমি কেবল আপনার সাধনধর্ম শুনতে চাই।
অবধূত, অবধূত। সেসব হবে। তবে সেবা এ ঘরের প্রধান ধর্ম। গোঁসাইকে আমি সেবা না দিয়ে পালনধর্ম কিছুই যে বলতে পারি না। এ বলার কথাও নয় গো, তবে গোঁসাই বলে গেছেন,
আসে যদি ভাবের গোঁসাই
কথা বেচো তখন নিতাই
মনে রেখো নৈরাকারি দরবেশ
কথা নিতে তাঁর ঘরে প্রবেশ।
নিতাইরানির পয়ার—ধরা কথা শুনে বললাম, আহা, আহা,
দরবেশের কথা অমৃতসমান
নিতাইরানি কহে, শুনে পুণ্যবান।।
বলিরেখা তোলা কোচকানো চামড়ার মুখে খানিক হাসির রেখা এল দরবেশের। বললেন, তা বেশ তা বেশ। ভাবুক যখন এল গোঁসাইয়ের দয়ায় তখন তাকে গোঁসাইধর্মের কথা না বেচে কি আমি পারি। শুনে হয়তো মনে হবে এ যে আজব ঘরের আজব কথা।
এরকম মনে হল কেন আপনার?
আমার নাম শুনে আপনার থতমত দশা হয়নি? পুরুষ মানুষের নামে মেয়েছেলের নামের জোড়। তা যে আপনাকে এখানে আনল আমাদের গুরুগোঁসাইয়ের আশ্রমে, তার নাম জানেন তো?
হ্যাঁ। গোবিন্দ। আপনি তো ওকে ওই নামেই সম্বোধন করলেন।
তা করলাম। তবে ওর নাম তো গোবিন্দ নয়। এই ঘরের শিষ্য। নামের পরে রানি জোড়া। এখনকার মানুষ তো। ঘররক্ষা করবে কী বলেন? গোঁসাই প্রদত্ত নামই সকলকে বলতেই লজ্জা পায়। ভক্তি আছে। একই ঘর। গুরুঘর আগলানো আমার কাজ। গুরুর নির্দেশ। তাই চুপ মেরে থাকি। যতদিন বাঁচব ঘর রক্ষা করে যাব।
খানিকটা বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন নিতাইরানি। হয়তো বা কিছুটা বিমর্ষও। আমি তাঁকে তখনকার মতো স্ববেশে আনবার জন্যই বললাম, কৃষ্ণ সাধনায় নারী—পুরুষের ভেদ কী? অভেদ দশাপ্রাপ্তি তো ওদের। কৃষ্ণ একা পুরুষ। বাদবাকি সকলেই তো প্রকৃতি, গোঁসাই। চৈতন্যদেব নিজে প্রকৃতি সেজেছিলেন ভাবসাধনা করেই। ভাব দিয়ে ভাবসাধনার ঘর যে আপনাদের। সবার কী আর মনোগত হবে।
কথা তোলাই তো আমার কাজ। দেখলাম, গ্রামবাংলার বৈষ্ণব বাবাজির মুখ থেকে তোলা কথাগুলোতেই কাজ হয়ে গেল। নিতাইরানি দরবেশের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি আমার হাত ধরে বললেন, আপনি গোঁসাইয়ের থেকেও বড় গোঁসাই বোধহয়। অচিন ঘর জানেন। ধুলো দিন পায়ের।
নিতাইরানি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন আমার পায়ের দিকে। আমি এবার তাঁর হাত দুটো চেপে ধরে বললাম, অবধূত, অবধূত।
গোঁসাইয়ের সমাধির সামনা—সামনি বসে তাঁর চোখ দিয়ে দেখলাম এরপর জল গড়াতে থাকল।
সাদা থান পরেন নিতাইরানি দরবেশ। তবে সেটা লুঙ্গির মতো করে আর গায়ে তাঁর সাদা একখানা পিরান। এ পোশাকের সঙ্গে আবার সহজিয়া বৈষ্ণবদের পোশাকের বেশ মিল রয়েছে। বৈষ্ণব গোঁসাইরা বলেন, তপন। খাটো সাদা ধুতি পরা পাটুলি স্রোতের বৈষ্ণবকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন, পিরান, তপন, তহবন্দের কথা। আদতে এগুলো সব ধুতি, ফতুয়া, চাদর। পাটুলির বৈষ্ণবরা ক্ষৌরি করেন না। সর্বকেশ রক্ষা করেন। নিতাইরানির ঘরের সঙ্গে দেখলাম প্রভূত মিল ওনাদের। ভাবতে ভাবতেই ঝুলি খুললেন দরবেশ।
আমাদের ঘরে গোঁসাই, নারী—পুরুষ সকলেই রানি। যুগল ভজন আমাদের নেই। আমরা নারীবেশে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রমণ করি।
আপনারা তো কেউ দেখছি নারী সেজে থাকেন না মঞ্জরী সাধকদের মতো।
নারী সেজে কী হবে? ভাবসাধনে আমরা নারী। আমাদের হল অভেদময় সন্ন্যাসের ঘর। আমাদের গোঁসাই ভেক নেই। নারী—পুরুষ এক। যুগল নেই বলে নারী দরবেশদেরও আমরা গোঁসাই বলে ডাকি। মা—গোঁসাই নেই আমাদের ঘরে।
বললাম, আপনাদের ঘর কী গোঁসাই?
জিজ্ঞাসায় আবারও খুশি হলেন দরবেশ। বললেন, ঘর আমাদের সনাতনের। জানো তো গৌড়ের দরবার থেকে চৈতন্যদেবের পথে যেতে গিয়ে সনাতন গোস্বামী ঠাকুর প্রথমে দরবেশী ভেক নিয়েছিলেন। আমাদের ঘর হল সনাতনের। মানে আদি। এ ঘরে কোনও গানবাজনা নেই। কিস্তি নিয়ে পারস ভিক্ষে করতে হয়।
পারস কী?
পারস হল রান্না করা খাবার। আশ্রমে উনুন জ্বালানো নিষেধ। রান্না করা যাবে না এ ধর্মের ঘরে। তাই আমরা বাড়ি বাড়ি পারস ভিক্ষে করি। রান্না করা খাবারদাবার আর কী।
বললাম, আমিষ চলে?
বললেন, আমিষ—নিরামিষ এসব ভেদও নেই যে ঘরে। আমাদের ঘরে বৈষ্ণব গোঁসাইদের মতন মালা নেই। চন্দন, রসকলির ব্যবহার নেই। দরবেশরা কণ্ঠি পরে না। ভজনসাধন দরবেশদের যা কিছু সবই গুহ্য গোপন শরীরের মধ্যকার সেই যুগল ভগবানের। রাধামাধব গোঁসাইয়ের থেকেও বড় গোঁসাই জানবেন। তিনিই দরবেশী সাধকদের মধ্যকার পুরুষ—প্রকৃতির কণ্ঠিখানা বদল করে দেন। সে আপনি মানসনেত্রে তো দেখতে পাবেন না। নির্জন পথের গুপ্ত সাধন হল গিয়ে পালনক্রিয়া। গোঁসাই বলে গেছেন। রক্ষা করে যাচ্ছি। কেউ জানতে চাইলে বলি। নচেৎ চুপ মেরে থাকি। গোঁসাইকে ভক্তি দিই। বলি, উত্তরণের পথে নিয়ে চল তুমি। যাওয়ার আগে যেন ধর্মরক্ষা করতে পারি।
নিতাইরানি দরবেশের মুখে দেখছি গৌধূলিসন্ধির আলো। অল্প অল্প করে নিভে যাবে সেও। পথরক্ষার নতুন দিবাকর যে আর উঠবেন না এ দরবেশজি ভালোই জানেন। তবু নতুন মানুষ দেখা করতে এলেই ওঁর চোখ চকচক করে ওঠে। বলহীন জীর্ণ শরীরখানা তরঙ্গ তোলে। বলে ওঠেন, অবধূত, অবধূত।
না ফেরার দেশে
পাটবাড়ি আশ্রম প্রকাশনার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন রাই। বানান সংস্কার থেকে মূল পাঠের অসঙ্গতি, অসম্পূর্ণতা সব তিনি সারিয়ে নিতে পারতেন গভীর অভিনিবেশের দক্ষতায়। দুপুর দুপুর আমি যেতাম। লাইব্রেরি রুমের গোঁসাই তখন ঝিমোতেন। শ্রীবৃন্দাবনে শ্যামসুন্দরের সুমধুর বংশীধ্বনি শুনে রাধারানির দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য উতলা দশার মতোই বোধহয় আমার তখন অবস্থা।
গোঁসাইজি চোখের পাতা এক করেছেন। প্রসাদি ভাতঘুম তাঁর। পৃথুল শরীর এলানো অফিস ঘরেরই চেয়ারে, নাসিকা গর্জনের শব্দ। আমার তখন বংশীধ্বনি। আকুল—পারা শ্রীরাধিকার মতো পুথিঘরের ভেতরে বসে বসে ভাগবতাচার্য শ্রীমদ রঘুনাথের ‘শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিণী’ মহাকাব্যের হাতে লেখা ১৬৫০০ সুললিত পয়ারের মধ্যেই হারিয়ে যাওয়া। পড়ে চলেছি,
বৈকুণ্ঠ নায়ক কৃষ্ণ চৈতন্য মুরতি।
তাহার অভিন্ন তেঁহ সহজে শকতি।।
দেখছি তুলট কাগজ। কাপড় জড়ানো পাটা। পাটার গায়ে রং—তুলি দিয়ে আঁকা ফুলকারি নকশা। বিভোর দুপুর। বিকেল হচ্ছে ক্রমে। কৃষ্ণচূড়া বাতাস তুলছে। শুনশান পাটবাড়িতে বসন্তের পাতা ঝরার শব্দ।
কিছু পর পাঠ শুরু হবে। তার আগে অবশ্য ভগবানও ঘুম থেকে উঠবেন। মন্দির খুলবে। তবে তার প্রহরের এখনও কিছু দেরি। এখন গোঁসাইজির নাসিকাধ্বনির সময়। আর কৌতূহলী আমার প্রথম বাংলা অনূদিত ‘ভাগবতের’ পুথিতে চোখ রাখার ক্ষণ। পুথির গায়ে মঙ্গলঘট, মৎস্য, ধ্বজা, যুগ্মবজ্র আঁকা। ভাবছি, রঘুনাথের মধুস্রাবী গলায় ভাগবত পাঠের ধ্বনি শুনেই তো চৈতন্য মহাপ্রভু পানিহাটি উজিয়ে আসা নৌকো মন্দির সংলগ্ন বটতলার ধারে ভিড়িয়ে ছিলেন।
ভাবতে ভাবতেই রাইরানির সুরেলা কণ্ঠ, চলুন আমার থাকবার জায়গায়। বসবেন ওখানেই। কথা হবে।
বললাম, প্রেমতরঙ্গিণীর এ পুথি তো হালের নকল।
কী করে বুঝলেন?
হাতের লেখা অতি চমৎকার ছাঁদে গড়া। কিন্তু এতে যেন লেগে এখনকার নিপুণ ক্যালিগ্রাফির আদল। মধ্যযুগ পরবর্তী পুথি লেখার ছিরিছাঁদটা যেন নেই।
হাসির আভা মুখে এঁকে রাই এবার বললেন, আপনার অনুমান সঠিক। এর নকল বিশের মধ্যভাগে। গুরুদেব তখন শরীরে। তিনিই বললেন, রাই, অমূল্যধন রায়ভট্টের সংগৃহীত পুথির বয়স একশো পেরোনো। অবস্থা ভালো নয়। গবেষকরা এসে দেখতে চান। তুমি একটা নকল করে রাখো।
বললাম, তার মানে এ পুথির করণকার আপনিই!
উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে রাই এবার বললেন, আমাদের বাড়ি মেদিনীপুরের চকলালপুর গাঁ। গোটা গাঁয়ের সকলে করণ। আমার ঠাকুরদাদা তালপাতা ও তুলট কাগজে পুথি নকল করতেন। আমি দেখছি। গুরুদেবের বলাতে সেই জাতবিদ্যাই কাজে লাগিয়েছি আর কী?
আমি এখন রাইরানির ঘরে। টেবিলের ওপরে রামদাস বাবাজির ফটোতে টাটকা রজনিগন্ধা। ভুরভুর করে সুবাস উঠছে। বিছানায় ছড়ানো রাজবল্লভ ঠাকুরের ‘মূরলীবিলাস’।
বললেন, বইটির নতুন সংস্করণ হবে তো। তাই পাঠভেদগুলোর নির্ভরযোগ্যতা থাকার জন্য বাঘনাপাড়ার সংরক্ষণ দেখছিলাম। তাত্ত্বিক—পণ্ডিত ঘরানার সম্পাদনা তো। প্রামাণিক।
আমি প্রামাণ্যতা খুঁজছিলাম শ্রীকৃষ্ণের ভক্তিজমির। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত সাহিত্য পড়তে গিয়েই মুকুন্দ ভট্টাচার্যের বৈষ্ণবশাস্ত্র পাঠ। একদিন রূপ গোস্বামীর ‘উজ্জ্বল নীলমণি’ গ্রন্থের বৃন্দাবন সংস্করণ খুঁজতে বরানগর পাটবাড়িতে আসা। রামদাস বাবাজির সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠা। যাতায়াত। অক্ষয় লাইব্রেরিতে বৈষ্ণবগ্রন্থ সম্পাদনার কাজ। কাজ করতে করতেই জীবনে ঝড়। পুরুষ শরীরেই নারীত্বের প্রকাশ। তখন তো আর খোলামেলা বিকল্প যৌনতার বাতাবরণ নেই। তথাপি মুকুন্দ ভট্টাচার্য ভালোবাসলেন পুরুষকে। প্রতারিত হলেন। লাঞ্ছিতও। দাদারাও সুযোগ পেয়ে মাতৃবিয়োগের পর একেবারেই বাড়ি ছাড়া করলেন।
মুকুন্দ ভট্টাচার্য এলেন পাটবাড়ি। রামদাস বাবাজি তাঁর দীক্ষাগুরু। পেলেন তিনি রাধারমণ বাবাজি বাহিত মঞ্জরী সাধনার বর্ধিত শিখা। জ্বলে উঠলেন তিনি। সরাসরি নারীবেশ যদিও হল না ওঁর। কিন্তু সখীভাব জাগিয়ে তিনি গুরুর কথাতেই কৃষ্ণসাধনাতে মন দিলেন। পুথি সম্পাদনা করলেন। পাটবাড়ির নতুন প্রকাশনা ওঁরই হাতে বছর পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। গুরুদেব দেহ রাখলেন। রাইরানিই ছিলেন তাঁর সেবক।
একদিন আবারও বেলা পড়ে আসার পরই গেলাম পাটবাড়ি। জানি তো এ সময়ই তিনি রামদাস বাবাজির সাধন—আসনের ধারে গিয়ে বসবেন। আমি অপেক্ষা করছি। রঘুনাথের ভাগবতীয় কথার মধুমাখা পাঠধারা আজও তো বহমান। সন্ধ্যা নামছে। আসছেন না যে রাইরানি।
এক বাবাজি আসনবেদিতে প্রদীপ দেখাতে এলেন। জিজ্ঞেস করলাম আমি রাইরানির কথা।
বেদি—আসনে দণ্ডবৎ প্রণাম সেরে বাবাজি বললেন, জানি না গো। এখনকার অনেকের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। গুরুদেবের সেবক। পুরোনো মানুষ। তুচ্ছতাচ্ছিল্য মানবেন কেন? সেদিন বিকেলবেলা। শরীরে জ্বর, দুর্বল মানুষটা তখন। তারই ভেতর অভিমানে চোখ ছলছল নিয়ে বেরিয়ে গেলেন পাটবাড়ি থেকে। তিন মাস গত। আজও ফেরেননি।
বললাম, কোথায় যে গেলেন এই অতিবৃদ্ধ বয়সে!
বাবাজি বললেন, তিনি গেছেন নীলাচল। না ফেরার দেশে।
সামান্য হদিশ পেয়ে দুশ্চিন্তা কাটিয়ে বললাম, নীলাচল গেলে কেউ ফেরে না বুঝি?
গোঁসাই বললেন, কেউ আর তিনি এক হলেন! গোবিন্দ জাগাতেন প্রেমবৎ। মাঝবয়সি তাঁর অভিসারিকা রূপ তুমি তো আর দেখনি। দোলের দিন শাড়ির মতো করেই থান গায়ে দিতেন। খোপা খুলে নিতেন। কপালে চন্দনের ফোঁটা। সাদা থানে তিনি তো কৃষ্ণময়ী মীরা ছিলেন গো। একাত্মদশার সাধক—সাধিকারা ফেরেন না। বিলীন হন। চৈতন্যদেব ফেরেননি, মীরাবাঈ, মাতা জাহ্নবা। এত গবেষণা করো। জানো না গোঁসাই?
ফিরছি। পাটবাড়িতে তখন সন্ধ্যারতি চলছে। তা যেন রঘুনাথ পণ্ডিতেরই ‘শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিণী’—র বাজনা। শুনতে পাচ্ছি রাইরানির পাঠ,
মোর ইষ্টদেব গুরু সে দুইচরণ।
দেহ মোর কাব্য মোর সেই সে শরণ।।
পূর্ণ সাধুর আশ্রম
হালিশহর কোনা মোড় ছাড়িয়ে বিশালাক্ষ্মী ঘাট পেরোলেই শীতলাতলার সম্মুখে পূর্ণ সাধুর আশ্রম। লোকমুখে তিনি ফক্করবাবা। আশ্রম বলতে গঙ্গার কিনারায় বন—জঙ্গলে ঘেরা খানিকটা পরিত্যক্ত জমি, জমির আসল মালিক শুনেছি শ্যামদাস গুপ্তবাবুরা। পূর্ণ তার উপরে ঘর বেঁধে আছে বহুকাল ধরে জমিটার মাঝ বরাবর।
মাথায় চালা ঠ্যাকে। হাত ছয় সাত প্রস্থে দৈর্ঘ্যে ছোট, বারান্দাসহ মাটির দেয়াল দেওয়া ঝুপড়ি ঘরখানিতে পূর্ণ থাকে। উত্তর সীমানায় আর একটু বড় আকারের প্রায় অনুরূপ বেড়া দেওয়া টালির ছাউনির ঘর। ওখানেই থাকেন মহেশ বাবা। সঙ্গে ওঁর সাধনসঙ্গিনী লীলা মা।
পশ্চিমে গা ঘেঁষে গঙ্গা বইছে। বর্ষাকালে সীমানার ভাঙন পেরিয়ে উঠে আসত আগে গঙ্গা। এখন প্রতিরোধ পেয়েছে। সরকারি ওয়াল। এক ধারেই অন্য আর এক মালিকের এখখণ্ড জমি।
ইট বাঁধানো দুর্গামাতার আশ্রমবাড়ি। মূর্তি নেই। ঘটে পুজো হয়। লীলা মা পুজো সারেন। মহেশ বাবার দুর্গামূর্তিতে বিশ্বাস নেই।
বলেন, শরীরের ভেতরই দুর্গা রয়েছেন। আলাদা করে আর মূর্তি প্রতিষ্ঠার দরকারটা কী?
মহেশ বাবা তাহেরপুরের বয়সের গাছ—পাথর পেরোনো সাধক দয়াল বাবার শিষ্য। কেউ বলেন, বাবার বয়স একশো বিশ, কেউ বা একশো তিরিশ।
আমি গেছি ওঁর ওখানেও। ছিন্নমস্তার উপাসক। বহাল তবিয়তে বেঁচেবর্তে আছেন দিনে একবার গাঁজাসেবা করে। যোগমার্গের সাধক তিনি। মহেশ বাবা তাঁরই উত্তরাধিকার।
গাছগাছালির ঘোমটা দেওয়া নির্জন জমিতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম মহেশ বাবাকে, দুর্গা কি আপনার চোখে?
খানিকটা আত্মদশার ভেতর গিয়েই বোধহয় বললেন, দুর্গাই বলুন আর কালী—সবই তো আসলে কুণ্ডলিনীশক্তি। কুণ্ডলিনীই জাগ্রত করে দেবীকে। দেবীর বাস মূলাধার চক্রে। আমরা তাঁরই বন্দনা করি দেহাচার দিয়ে। মেরুদণ্ড কী জানেন?
কী?
মেরুদণ্ড হল মেরুপর্বত। মস্তিষ্ক দেবভূমি। মেরুপর্বতেই দেবী পার্বতীর বাস।
এর অন্তর্গূঢ় রহস্য যদি একটু বিস্তারিত বলেন?
রহস্যের কিচ্ছু এখানে নেই। সব পরিষ্কার। কুণ্ডলিনী জেগে উঠে শক্তিদেবী মেরুদণ্ডস্থ সুষুম্না বেয়ে সহস্রারে উঠে পড়ে কূটস্থানে বিলীন হন। মস্তিষ্ক হল দেবভূমি। মূলাধার পৃথিবী। এটাই আমাদের স্থূল দেহাঞ্চল। যখন শক্তিদেবী দুর্গা মেরুপর্বতের শিখরবাসিনী হয়ে পড়েন তখনই তো তিনি দেবী পার্বতী। দেবীই আবার চণ্ডী।
জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে দেবী চণ্ডী হচ্ছেন?
মহেশ বাবা বললেন, চণ্ডী দেবী হলেন পরব্রহ্ম মহিষী। ব্রহ্মশক্তি ধরতে পারেন। জ্ঞান, ইচ্ছা ও ক্রিয়া—এই ত্রিশক্তির সমষ্টিভূতা হলেন দেবী চণ্ডী।
আর দুর্গা দেবী?
দুর্গা হলেন সাধক শরীরের দুর্ভেদ্যতা। সেই অগম্য স্থান জয় করতে হবে যে। যেতে গেলেই দেখবেন দেবীর বাহনখানা খালি চোখ পাকাচ্ছে আপনাকে।
সিংহ তা হলে কী বাবা?
প্রশ্নে খুশি হলেন তিনি। বললেন, সিংহ তো আর বনের পশুরাজ নয়। সিংহ হলেন মানুষেরই পাশবদ্ধতা। পাশ না গেলে মানুষ কীভাবে বা শিব হবেন শুনি? পাশ নাশ করতে পারলেই সাধক হয়ে উঠবেন পশুশ্রেষ্ঠ। সিংহাবতার। ধর্মে যে আমাদের অবতারবাদের অস্তিত্ব সেগুলো কী মনে করেন?
শরীরক্রিয়া বলছেন? জিজ্ঞেস করলাম।
আশ্রমে রোদ নরম হয়ে আসছে। মেঘ লেগেছে আকাশে। কুলু কুলু করে নদী বয়ে যাওয়ারই মতন এখানে এখন হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ার পরত যেন মহেশ বাবারও গলায়।
ভিজে শব্দ তোলা আওয়াজ নিয়ে তিনি বললেন, মৎস্য আমাদের প্রথম অবতার। মানুষ্যের জ্ঞানসমুদ্রকে চিহ্নিত করছে মৎস্যাবতার। সাধনায় আত্মজ্ঞান লাভ হলে সাধক নিজেই তো মৎস্যাবতার হয়ে পড়েন।
আর কূর্ম?
কচ্ছপ হল উভচর প্রাণী। জলেও থাকে আবার ডাঙাতেও আসে। ডাঙা হল ব্যক্তিসত্তা। জল—সমুদ্র হল জ্ঞানসত্তা। ব্যক্তিসত্তা কাটিয়ে ওই কূর্মের মতন জলে গিয়ে জ্ঞানসমুদ্রে পড়বেন যখন সাধক তখন তাঁর শরীরেই অবতীর্ণ হবেন কূর্মাবতার। কূর্ম যেমন জলে থাকে না সবসময়, তেমন সব শরীর কি আর সাধন আধার পায়?
সাধন আধার পেতে তো গুরু লাগে। বললাম আমি।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। দূরে ওই পাকুড় ডালের মাথায় পাখিরা ডাকাডাকি করছে। তারই ভেতর শব্দ তুলে মহেশ বাবা বলছেন, ওই দেখুন, পাখিরা ঘরে ফিরেছে। এবার চুপ করে বসে যাওয়ার সময়। রাত হলেই তেমন শব্দ পাবেন না ওদের। শরীরে যখন ব্যক্তিসত্তা থাকে তখন শব্দ হয় আমাদের। ব্যক্তিস্বরূপকে যখন সাধক সাঁতরে পার হতে থাকেন জ্ঞানসমুদ্রের মধ্যে দিয়ে, তখনই শরীরে উঠে আসছেন নৃসিংহ অবতার। মাথাটা দেখুন ওঁর সিংহের। শরীরখানা তো মানুষেরই। এর ভেতর রয়েছে আমাদের পশুচেতনার ইঙ্গিত।
ধরিয়ে দিলাম আমি, বরাহ অবতারখানা যে বাদ গেল। ওঁর উৎপত্তিটি জানতে চাই।
সারা মুখমণ্ডলে মৃদু এক হাসির রেখা তুলেই বাবাজি এবার বললেন, বরাহ থাকে ডাঙাতেই। আবার জানেন কী সেও সাঁতার দিতে পারে? ব্যক্তিসত্তা টপকাতে টপকাতেই সাধনায় শরীরের ভেতর যে তিনি দেখা দিয়ে দেবেন। আর ওই টপকানোর খেলাতেই নিজের ক্ষুদ্রতা, নীচতা এসবেরও প্রমাণখানা পাওয়া যাবে। ওই তো বামনত্বের লক্ষণখানা বেরিয়ে পড়ল এবার। বামনাবতারের পরই পরশুরাম আসেন।
এর অর্থখানা কী?
বাবাজি ঠোঁটের গায়ে হাসি তুলে বললেন, দেখুন আপনি ভালো করে। পশুর গায়ে মানুষকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। দুর্গা দেবীর সাধনাতেও ওই পশুত্ব কাটবে তো। পশু পাশ কাটলেই হাল ধরবেন কুলকুণ্ডলিনীর দেবী।
বললাম আমি, হলধর বলরাম। অষ্টম অবতার।
এই তো বুঝে ফেলেছেন সব। সাধনা হল শরীর কর্ষণের চিহ্নবস্তু। যত কর্ষণ করবেন আপনি দম—শ্বাসে নিজেকে ততই দেখবেন নিষ্কলঙ্ক হচ্ছেন।
কল্কি অবতার জেগে গেছে এবার।
শব্দ করে হেসে মহেশ বাবা বললেন, এই তো এই তো—সাধনাটাই ধরে ফেলেছেন আপনি। এবার ইন্দ্রিয় মন্থন করুন। কাম, ক্রোধ, লোভের বৃত্তিগুলো সব শরীর থেকে বের করে ফেলুন। দেখুন সহস্রারের দিকেই এগোচ্ছে আপনার কুণ্ডলিনী। মহাজ্যোতির্ময় প্রভার মধ্যে শরীরে আপনার জেগে গেছেন লক্ষ্মীদেবী। লক্ষ্মীর জাগতিক রূপ তো পেয়েছেন। সবাই কিছু না কিছু পান অধ্যাবসায় দিয়ে। ধন মান খ্যাতি এইসব আর কী। কিন্তু দেখুন শরীর আপনার অন্ধকারেই। লক্ষ্মীর বাহন দেখুন প্যাঁচা।
বললাম, শরীরের অন্ধকার। ধ্যানে যোগে মনোনিবেশে জয় করতে হবে।
শরীরজোড়া প্রফুল্লতার অভিব্যক্তি এনে বাবা বললেন, একদম একদম। অন্ধকার কাটলেই জ্ঞান জাগল জ্ঞানদায়িনী সরস্বতী। তাঁর বাহনখানা ভাবুন।
হাঁস। বললাম আমি।
বাবাজি বললেন, হংসপাখিকে আপনি দুধ আর জল মিশিয়ে খেতে দেন, দেখবেন সে দিব্যি দুধটুকু সাবার করে দিয়েছে। পাত্রে পড়ে আছে জল। আমাদেরও তেমনই হতে হবে। সাধকের জ্ঞানবত্তাটি ওই হংসপাখির সঙ্গেই তুলনীয় বুঝলেন।
কার্তিক আর গণেশ?
কার্তিকের বাহন দেখুন মনোলোভা ময়ূর। কী তার সৌন্দর্য, যখন সে ডানা ছড়ায়। সাধককেও ওভাবে সাজাতে হবে ভেতরকার নানান নাড়িগুলোকে। গুরুর সহায়তায় এগুলো সেজে উঠলেই তখন আপনি দেবসেনাপতি কার্তিক ঠাকুরই হয়ে গেলেন। আর আপনার ওই মূলাধার চক্রে ঘুমিয়ে ছিল কুণ্ডলিনীর দেবতা গণেশ। ও তো গুরু আগেই খুলে দিয়েছেন। শক্তিদেবী জাগা মানেই মূলাধারখানা খুলেছে। গণেশের পুজো দেখুন তাই সবার আগে করে নিতে হয়। ওঁর বাহন হল গিয়ে আমাদের ইন্দ্রিয়বত্তাগুলো। ওগুলোকে কাটতে না পারলে কিচ্ছুই হবার নয়। ইন্দ্রিয় কাটল। শরীরের অশুভ নিয়ন্তা দশাগুলোর নিধন হয়ে গেল আপনার। আপনি অসুরবধটা করলেন। দুর্গা হলেন।
সন্ধ্যা মজে গেছে অনেকক্ষণ। লীলা মা এবার দুর্গাঘটে আরতি সারছেন। মন্ত্র বলছেন,
ওঁ যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী
যা মাহিষোন্মূলিনী
যা ধূম্রেক্ষণচণ্ডমণ্ডমথনী
যা রক্তাবীজাশনী।
জিন্দা দেহে মরার বসন
বাউল মতবাদের প্রধান শর্তটি হল বস্তুনিয়ন্ত্রণ। সন্তানের জন্ম দেওয়া যাবে না। প্রাচীন মহতদের জীবনাচারে এ শর্ত বলবৎ হলেও আজকের বাউলেরা ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করেন।
বাউল সম্রাট পূর্ণদাস বলেন, তাঁরা সাত পুরুষ ধরে বাউল।
গ্রাম বাংলায় বাউল বৈষ্ণব সব একাকার হয়ে গেছে। বাউল মানে দীনহীনের ভাঙা কুঁড়ে। মাধুকরী করে খান, মেলা—মোচ্ছবে আখড়া গাড়েন খালি; পলিথ্যিন টাঙিয়ে ছোটমতন আস্তানা।
শহুরে যোগসাজশে এ ছবিতেও এখন অনেকখানি পরিবর্তন ধরেছে। নাগরিক সমাজের অত্যাধিক ঘেঁষাঘেষিতে বাউলও এখন সাধনা ভুলে বস্তুনিয়ন্ত্রণ ছেড়ে অর্থকামী বিচিত্র বিনোদনে গায়ক বাউলে পরিণত হয়েছেন।
তার মানে এই নয় যে, সাধক বাউল আর নেই। দুই বাংলা জুড়েই পরিব্যপ্ত বাউলের সাধনা। কুষ্টিয়া, যশোর, রাজশাহী, নদিয়া, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, সিলেট অঞ্চলে মুর্শিদ ধরে গুরু করেই বাউল সাধনায় জড়িয়ে পড়াটাই রীতি। সাধন আধারে ভেক—খিলাফত, খিলকা নেওয়াটার একটা ব্যাপার আছে।
বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ সহ হাওর অঞ্চল বা ভাটির পরিধিতে সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভিবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবেড়িয়া—বাংলাদেশে সাত জেলার চল্লিশটি উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত ভাটি অঞ্চলের বাউল সাধনাতে মুর্শিদ দীক্ষা আছে। কোনও ভেক—খিলাফতের ব্যাপার নেই।
ভাটির কিংবদন্তি সাধক শাহ আবদুল করিম থেকে দুবিন শাহ হয়ে আগের হাসন রাজা, আরকুম শাহদের কোনও ভেক—খিলাফতের ব্যাপার ছিল না। এখনও এসব অঞ্চলে পির, মুর্শিদের কাছে দীক্ষা নিয়ে ভেক—খিলাফত না নিয়ে সকলেই বাউল সাধনা করছেন। বস্তুর নিয়ন্ত্রণ এখানে বড় ব্যাপার নয়।
সমস্ত জায়গায় বাউলদের আচরণ, তরিকা, আহার্যেও ভিন্নতা রয়েছে গুরু পরম্পরায় সবখানেই বাউল ঘরানার সাদৃশ্য একটাই, সকলেই গুরুর শেখানো পন্থায় গুপ্ত—গুহ্য দেহসাধনা করেন। চারচন্দ্রভেদ, দমসাধনা, রজোসাধনা করেন। বেদবিধি, শরিয়ত মানেন না। কৃষ্ণ, চৈতন্য, শিব, ব্রহ্মা, মহম্মদ, নামাজ, রোজা, কালেমা, হজ—এগুলো সবই তাঁদের যুগল ভজনার দেহগত বাতুন এলাকা।
ছেঁউড়িয়া, কুষ্টিয়ার সাঁইনগর আখড়ার ফকির শামসুল হক জানালেন লালনঘরের ভেক—খিলাফতের কথা। বললেন, ফকিরের ভেক হইল গিয়া জিন্দা দেহে মরার বসন। হ্যার লেগাই সাদা পোশাক সাঁইজির ঘরে। ফকির জ্যান্ত থাকতেই মইরা যায়। তার দেহ মরে, কাম মরে—ইহলোকের যাবতীয় কাম—কামাদি মারতে চায় ফকির। পরলোকে তো তার বিশ্বাস নাই। দেহান্ত হইলে কাফনে সাদা পোশাক পরতেই হয়। ফকির তো জিয়ন্তে মরা। সাঁইজির কালেমায় বাতুন দেহতত্ত্ব সেই মইরা থাকার জাহের করে। বাতুনে লোক টের পায়। বাতুনে ফকির তাই সাদা পোশাক পরে।
আখড়াবাড়িতে এই পোশাক পরা বা ভেক নেওয়ার একটা অনুষ্ঠান হয়। একেই বলা হয় সাধুগুরুর খিলকা নেওয়া। সাদা পোশাক পরে খিলকা নেওয়ার বাহ্যিক অর্থটাই হচ্ছে, আত্মিকভাবে শরীরকে মেরে ফেলা।
দরবেশী ফকিরও সাদা পোশাক পরেন। ওপার বাংলার চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়ার মওলা মতুন আখড়াবাড়ির দরবেশরা খুবই নদিয়ার দরবেশী স্রোতে আসা—যাওয়া করেন।
আখড়াবাড়ির সৈয়দুল হক দরবেশকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই ভেক—খিলাফত নিয়েই তিনি এসেছেন আখড়াবাড়ি আড়ংঘাটা। বললেন, আমাগো খোদার ফকির কয়। আমরা সংসার ত্যাগ দিয়া দরবেশ হইছ্যি। দ্বারে দ্বারে ঘুইরা মাধুকরী করি। তাই আমরা হইলাম গিয়া দরবেশী ফকির।
বললাম, আপনারা তাহলে লালন ঘরের দরবেশ। এদিককার ভেবোডাঙা, শব্দলপুরের দরবেশরা লম্বা ঝুলের তালিমারা পোশাক পরেন।
পাকা দাড়ির জঙ্গলে হাত বোলাতে বোলাতে দরবেশ ফকির বললেন, কুষ্টিয়ার ফকিরেরা পাবনা, যশোর, ফরিদপুরে ছড়াইয়া পড়ছ্যে, সাঁইজির সময়কালেই। হাফহাতা সাদা জামা পরেন তেনারা, সাদা তহবন্দ, সাদা পাগড়ি, দোতারাখানও সাদা ওয়ারে ঢাকা।
দরবেশজিকে বললাম, পাটুলি, দাঁইহাট, অগ্রদ্বীপ, কাটোয়াতে এই পোশাকে ভেকধারী সহজিয়ারা ঘুরে বেড়ান। তাঁদের দোতারা তো থাকে না। হাতে কর্তাল। কাঁধে মাধুকরীর সাদা ঝুলি। এঁরা সব গৌরভজার দল। গেয়ে ফেরেন,
লয়ে আঁচলা ঝোলা জপের মালা
গৌর বলে চলে যাব।
খাটো করে সাদা ধুতি পরেন সব এঁরা। গায়ে থাকে সাদা পিরান একখানা। মাথা—য় সাদা পাগড়ি। সর্বকেশ রক্ষা করেন এঁরা।
হাতিশালা গাঁয়ের ফকিরেরা বলেন, সাদা পোশাকটা তো পুব পাকিস্তানের ছিল। ও দেশে গেরুয়ার চল নেই। এ দেশের বাউলেরা গেরুয়া পরেন। তালিতাপ্পার আলখাল্লা।
বর্ধমান হাটগোবিন্দপুরের সাধন দাস বৈরাগ্য লালনপন্থী ধারার সাদা পোশাক পরেন। বীরভূম খয়রাশোলের মাধব দাস বাউল, চিনপাইয়ের সাধনার সাদা পোশাক। সকলেই আসলে সহজিয়া পন্থার। সাধনা মা আশ্রমে বসে গেয়ে ওঠেন,
যার মুখে ভাই হরি কথা নাই
তার কাছে তুমি যেও না
যার মুখপানে চেয়ে ভুলে যাবে হরি
তার মুখপানে চেয়ো না।
ভীষণ সুরেলা কণ্ঠ মায়ের। পাশে বসে খোলে বোল তোলেন ওঁর সাধনসঙ্গী বিবেক গোঁসাই। এঁরা সদর্থক অর্থেই তো বাংলার বৈষ্ণব—বৈষ্ণবী।
ভেক—খিলাফতে এক হয়ে পড়েন ভাবনগরের সাধনায়।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট ব্লকেই আছে বাউল গ্রাম। দিনাজপুরেই একসময় বৌদ্ধ কায়াবাদীদের বিস্তার ছিল। যাঁদের যুগল সাধনায় ইন্দ্রিয়—রিপু, কামজয়ের কৌশলী নাড়ির পন্থাগুলো একসময় বৈষ্ণব—সহজিয়া—বাউল সাধনার সাধুগুরুদের পর্যন্ত আলোড়িত করেছিল। আবার নাথপন্থার চুরাশি সিদ্ধদের অন্যতম নাঢ় পণ্ডিত ও তাঁর সাধনসঙ্গিনীর ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে এখানে। গ্রামের জোলা—তাঁতিরা পর্যন্ত নাথধর্মে আসেন। ইসলামপন্থার সঙ্গে নাথদের সাধনা জড়িয়ে যায়। দিনাজপুরের বাউল গ্রাম ও গা—ঘেঁষা জগন্নাথবাটিতে এখনও জোলা নাথদের সেই উত্তরপুরুষদের বসবাস রয়েছে। তবে নাথদের কায়াবাদী সাধনা আর এঁদের মধ্যে নেই।
দিনাজপুরের গায়ে গা—লাগানো মালদহের রামকেলি। জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তিতে এখানে মেলা বসে। তখন দিনাজপুরের বাউলগ্রাম ও তার আশেপাশের সাধুরা এখানে এসে আখড়া করেন। রামকেলি হয়েই সেবার বাউল গ্রাম গিয়েছিলাম।
কাছেই তপন থানার অদূরবর্তী গাঁ নাগরাকুড়ি। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল এখানে একবার আসব। দিনাজপুরের সহজিয়া কায়াবাদিদের মধ্যে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে প্রবেশ করে এই নাগরাকুড়ি দিয়েই। নবদ্বীপ টোলে শিক্ষা পাওয়া হরিদাস বাবাজি নাগরাকুড়িতে ভিটেমাটি করেন এক সময়। অদ্বৈত ঠাকুরের বড় ছেলে অচ্যুতানন্দের বংশধর হলেন এই বাবাজি। নাগরাকুড়ি আসেন এখানে বৈষ্ণবমত প্রচার করবেন বলে তিনি। পরবর্তীতে পাশের গ্রাম মল্লিকপুরের বৈষ্ণব মোহান্ত সাতকড়ি বাবাজির একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করেন তিনি। এই যোগসাজশে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের প্রভাব বাড়ে দিনাজপুরের এলাকায়।
সেসব ঘুরে পুরনো স্মৃতি নাড়াচাড়া দিয়ে আমি এবার এলাম বোল্লাগ্রামে। এ গ্রামে আছে যতীন সাধুর আখড়াবাড়ি। যতীনের অনেক বায়েত—শিষ্য। গোপেন দাস বাউল, হেমন্ত দাস, হরেন বর্মন, বিদেশি উরাও—এঁরা সব যতীন সাধুকে মুর্শেদ মেনে বাউল সাধনা করেন।
যতীন সাধুর মুখেই প্রথম শুনি বলহরি দাসের কথা। তিনি ছিলেন দেশত্যাগী বাউল। রাজশাহীর মানুষ। লালন ঘরানার সাধক। তাই তো সাদা পোশাক ওঁর। কুষ্টিয়া—পাবনা—রাজশাহীতে বাউল খেদাও শুরু হলে বলহরি উদ্বাস্তু হয়ে এদিকে চলে আসেন। দিনাজপুরেও তাঁর অনেক শিষ্য—বায়েত। গোটা উত্তরবঙ্গে বলহরি আসলে বাউল সম্রাট।
যতীন সাধু বলছিলেন, দ্যাখোনি তো তেনার নাচ। যাত্রাদলে মেয়ে সাজতেন। কথায়, চলনে—বলনেও সেই ছাপ এসে গেছিল। ডানহাতে একতারা নিয়ে, বাঁ হাতে কোমর ধরে যাত্রার রানিদের মতন নাচতেন।
বললাম, ওঁর সাধনসঙ্গিনী ছিল না?
কী করে থাকবে! মেয়ে সেজে থাকতেন তো। গান গাইতেন নারীবেশেই দেশভাগের আগে। তেনার নারীসত্তা দেখেই গুরু কুতুব আলি আর কায়াসাধন দেননি।
আপনার জীবনে ওঁর প্রভাব কী?
মাথার চুলে খোঁপা বেঁধে নিলেন যতীন সাধু। চামড়ায় বেশ ভাঁজ পড়েছে। বয়স বোঝা যাচ্ছে। তবে শরীরের বাঁধুনি এখনও দেখার মতো।
বললেন, তিনি যে আমার পাল্লাগানের গুরু। এদিকে পাল্লাগানে দখল না থাকলে বাউল হওয়া যায় না। গুরু—শিষ্য, ভক্ত—ভগবানের পাল্লাদারি আমি তেনার কাছ হতেই পেয়েছি। তেনাকে মুর্শেদ মেনেই সাদা পোশাকখানা পরি। করণগানে দখল ছিল বেশ। দাঁড়ান একখানা প্রাচীন করণ শোনাই।
একতারা তুলে নিলেন এবার যতীন সাধু। গাইতে লাগলেন,
ভাবের ভিতর পশবি যখন
দেশকে যাবি চলে
ফিরে আসছি আমি। বোল্লা, বাউল গ্রাম, পার্বতীপুর। বৈষ্ণব সাধকেরও ডেরা। আখড়াবাড়ি থেকে সান্ধ্যকীর্তনের কথা ভেসে আসছে। আজ একাদশী তিথি। গোঁসাই গাইছেন,
হরি হরয়ে নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ।
যাদবায় মাধবায় গোবিন্দায় নমঃ।।