সহজ পথের একতারা
জ্যোতিধাম, কুষ্টিয়া
পয়লা কার্তিকের স্মরণসঙ্গের ভোরে ছেঁউড়িয়া, কুষ্টিয়ার নবপ্রাণ আখড়াবাড়ির গোষ্ঠগানের আসরখানা বেশ জমাটি হয়ে ওঠে। আখড়াবাড়ির সাধুগুরু ভক্ত শিল্পীরা পরিবেশন করেন গোষ্ঠগান। রাঢ়ের সাধুগুরুরা আবার বলেন, গোষ্ঠযাত্রার গান।
নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে বেশ নিষ্ঠা সহযোগেই সাধুগুরুরা সব পালন করেন কার্তিকের এই অনুষ্ঠান। এইদিনই কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া আখড়ায় দেহ রাখেন ফকির লালন শাহ। এখন সে জায়গা লালন ধামে পরিণত হয়েছে।
লালন আকাদেমির বিপরীতে রয়েছে ফকির লবান শাহ প্রতিষ্ঠিত সেই নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি। লালন শাহের একেবারে প্রত্যক্ষ শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম হলেন ফকির ভোলাই শাহ। ভোলাইয়ের কাছেই খিলাফত হয়েছিল ফকির কোকিল শাহের। লালন—প্রশিষ্য এই ফকিরের কাছেই নাড়া বেঁধেছিলেন ফকির লবান শাহ।
লবান শাহকে যখন আমি প্রথম দেখি তখন ওঁর আশি ছুঁইছুঁই অশক্ত বয়স। কিন্তু গলা সুরে খেলে। গোষ্ঠগানে হাতে তুলে নেন নিজেরই বানানো একতারা। এ কাজ তিনি শিখেছিলেন গুরু কোকিল শাহ ফকিরের কাছে।
লালনের গোষ্ঠগান রয়েছে বলতে গেলে আট—নয়টি। সূর্য ওঠার আগেই গোষ্ঠগান গাওয়ার নিয়ম। নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে প্রতিদিনই গোষ্ঠগান হয়। এরপর বায়েত—ভক্তদের ভেতর কালাম নিয়ে আলোচনা চলে।
নবপ্রাণে গোষ্ঠগান পরিবেশন করেন দৌলতপুর, কুষ্টিয়ার রওশন ফকির। আর দৌলতপুরেই প্রাগপুরে ফকির লবান শাহেরই পুরানা শিষ্য হেম আশ্রমে বসে নিমগ্ন ভাবসাধনায় গেয়ে চলেন গোষ্ঠগান।
ফকির লবান শাহ দেহ রেখেছেন দশ বছর তো হয়ে গেল। ঘোষপাড়ার সতী মায়ের আখড়াবাড়িতে বসে তিনি আমাকে ফাল্গুনের দোলোৎসবের নিমন্ত্রণ দিলেন। আশ্বিনেই খবর এল ওঁর সাধনসঙ্গিনী রিজিয়া ফকিরানির, তিনি দেহ রেখেছেন।
খৈলশাকুন্ডি, কুষ্টিয়ার জ্যোতিধামে লবান শাহের তিরোভাব তিথি এখন শুরু হয় সেই গোষ্ঠগানেই। নবপ্রাণ আখড়ার মতোই আগের দিন অধিবাস শুরুর সময় বিকাল থেকেই হয় দৈন্যগান, ভোরে গোষ্ঠগান, সাঁইজির কালাম চর্চা, বিধান মেনে সাধুসেবা। সবটাই হয় লবান শাহ ফকিরের সাধনসঙ্গিনী রিজিয়া ফকিরানির পৌরহিত্যে। থাকেন প্রধান দুই শিষ্য নহির শাহ, সামছুল ফকির।
নহির শাহ যখন সকাল ছ’টায় গোষ্ঠগান পরিবেশন করেন তখন বেজে ওঠে লবানের সাধের একতারাও ওঁরই পুত্র ফকির ইয়াহিয়াউল হকেরই হাতে। রঞ্জনা ফকিরানি করতাল বাজান। গোষ্ঠগানে বিশেষ বাদ্যযন্ত্র তো থাকে না।
দিনের সূচনা হচ্ছে। লবান বলতেন, সক্কাল সক্কাল হরিগুরু গোরুর পাল লয়ে মাঠে য্যাতিছেন। সাধক—বায়েতদের দেহখানা গড়াও তো কামকাজ। সাধুগুরু কর্মকাজে যাওনের আগে তাই গোষ্ঠগান গায়।
বলি, গোষ্ঠ কী তবে?
বৃদ্ধ লবান শাহ ফকির বলেন, গোষ্ঠ হল গিয়া সাধনের প্রজ্ঞা। নিজেরে নিজের হাঁকডাক। সাঁইয়ের নিরাকার রূপখানাকেই সকালবেলা ডাকার অভ্যাসখানাই তো সাধকের গোষ্ঠে যাওয়া রে। নালি পরে সাধকের কী আর জোতজমা অ্যাছে, বাটিঘর থ্যাহে; সাধকে কী আর সংসারী যে, গোরুটরু লইয়া গোষ্ঠে যাইব? গোষ্ঠ হইল গিয়া সাঁইয়ের মনের মানুষ পাওনের রূপদানি, আমার মুর্শেদে কইত রে বাপ। অ্যামনি অ্যামনি কি সাঁইজি গোষ্ঠ যাওনের কালাম দ্যিছে নি?
ঘোষপাড়ার আখড়াবাড়িতে ভোরবেলা লালন ফকিরের উত্তরসাধক লবান শাহ ফকিরের হাতে একতারা, কণ্ঠে গোষ্ঠযাত্রার গান। তিনি এসেছেন লালন মান্যতার পাঁচঘরের একতম সতী মায়ের ঘরে ভক্তি দিতে। আছেন কয়েকদিন। গোষ্ঠগান গাইছেন, কালাম বলছেন। বলছেন, সাঁইজি তো আসছিলেন। আমার মুর্শেদের বাসনা ছ্যিলো। শেষ বয়সে ঘুইরা গেলাম।
ফেরার পর পরই রিজিয়া ফকিরানির চিঠি এল, তোমাগো মুর্শেদ দেহ র্যাখছেন।
২০০৯ সালের অক্টোবরে চলে গেলেন লবান শাহ ফকির। আখড়াবাড়িতে ওঁর দেওয়া আশীর্বাদি একতারাখানা হাতে নিলেই আমার তো মনে পড়ে গোষ্ঠের কথা। গোষ্ঠ হল সাধন সূচনা। এত বছর পরও তো আমি সেই কাঁচা মুরিদের দশায়। ঘুম ভাঙলে কাঁচা কানেই শুনতে পাই একতারা হাতে গোষ্ঠগান গাইছেন প্রবৃদ্ধ সাধক লবান শাহ। ওদিকে নবপ্রাণে, জ্যোতিধামে, হেম আশ্রমেও তো চলছে গোষ্ঠগান। নহির শাহ গাইছেন। রওশন ফকির, লবান শাহ।
কানে লেগে আছে :
গোষ্ঠেতে চল হরি মুরারি
লয়ে গোধন গোষ্ঠের কানন
চল গোকুলবিহারী
গোষ্ঠেতে চলো হরি মুরারি।।
ঘোষপাড়া, কল্যাণী
ঘোষপাড়া মেলার আগের রাত। মেলা শেষ পর্বের প্রস্তুতির আয়োজন সেরে ফেলেছে পুরোদমে। আখড়ায় বাউল ফকিরদের সমাবেশ। সাধুরা তাঁদের ডেরায় ভক্তশিষ্যদের সঙ্গে গল্পে মশগুল। হোমযজ্ঞ শুরু হয়ে গিয়েছে দু—এক জায়গায়। আজ চাঁচর। এ রাতের চাঁদে পূর্ণিমার ঘোর লেগে। চতুর্দশীর আলো নিয়ে চাঁদ দাঁড়িয়ে পড়েছে সতী মা—র পুকুরের পাড়ে। এ ধারটা নির্জন। দু—একজন বৃদ্ধা ভিখারি রাতে শোবারও প্রস্তুতি সেরে নিয়েছে বাঁধানো পাড়ে ময়লা ছেঁড়া চাটাই পেতে। পুকুরের সিঁড়ির দিকটায় এগিয়ে গেলাম গানের আওয়াজ পেয়ে। লোকজন তেমন নেই। অথচ এখানে এমনভাবে বসে কে গাইছেন এই গান! কাকে বা শোনাচ্ছেন! এগিয়ে গেলাম আমরা তিন বন্ধু। শীতের কামড় না থাকলেও ঠান্ডা একটা বাতাস বইছে। এ বছর দোল আগে। মাঝ ফেব্রুয়ারি বলে শীত তার লোটাকম্বল গুছিয়ে নেয়নি। ভাঁজ করা চলছে সবে। আমি গায়ের পাতলা চাদরটা কানে—মাথায় জড়িয়ে নিলাম। আমার আবার চট করে ঠান্ডা লেগে যায়। গানের রেশ আমাদের কানে পুরোপুরি লেগে গিয়েছে। আমরা নিবিষ্ট মনে শুনছি। বৃদ্ধ এক ফকির একমনে গেয়ে চলেছেন। আমি নিশ্চিত তিনি আমাদের উপস্থিতি টের পাননি এখনও। পুকুরের দিকে মুখ করে রয়েছেন বলে আমাদের তিনি দেখতেও পাচ্ছেন না। হাওয়ায় আমার দুই বন্ধুর চুল ফরফর করে উড়ছে। চাদরের ভেতরও ঢুকে পড়ছে হাওয়া। চাদর পুরোটা জড়ানো নয় বন্ধুদের শরীরে। উত্তরীয় করে গলাতে দোলানো। হাওয়া ঢুকে চাদর বেঁকেচুরে যাচ্ছে। উত্তরীয় যেন দোল খাচ্ছে রাধাকৃষ্ণের মতো। দু—জন দু—জনকে ভালোবাসতে শুরু করলে শরীরী সেই ভালোবাসার মধ্যে যেভাবে দু—জনের প্রত্যঙ্গ নড়ে; দোল খায়, ফকিরের পিঠে তারই ছায়া পড়েছে যেন। ভালোবাসায় মেতে উঠছেন তিনি। এমনি তাঁর গায়কির আবিষ্টতা। তন্ময় হয়ে যাচ্ছি আমরা সব। আবীর ঘনঘন সিগারেট ধরাচ্ছে না। সুজিত ফাঁকা নির্জনে এসেছে সিগারেটে গাঁজা ভরে টানবে বলে, টানা দূরের কথা গাঁজার প্যাকেটও পকেট থেকেই বের করে উঠতেই পারেনি। গান এভাবেই বিবশ করেছে ওদের, মশা কামড়াচ্ছে। মুখের চারধারে ঘুরঘুর করছে মশা। তবু আমারও বিরক্তিবোধ নেই। ফকির যেন গানের গাঁজা খাইয়ে দিয়েছেন আমাদেরকে।
গাইছেন :
পূর্ণিমার চাঁদ ধরবি কে রে
তোরা দেখ চেয়ে
ত্রিবেণীর উত্তর দক্ষিণ
রবি শশি তার দুই কিনারে।
ঘোর ভাঙল ফকিরের। পিছন ফিরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝলাম তারে আর গান শোনানো হবে না। সে বলল মানুষ এসেছে গো। তুমি থোও। কথা কও ওদের সঙ্গে। গান শোনাও। আমি পিছন ফিরি দ্যাখলাম সত্যি। আপনারা সব এসি গিয়েছেন। তা বলেন খ্যাপারা সব। দুটো—একটা কতা কই। পরানের কতা।
আমরা তিনজনই ফকির বসার একটা সিঁড়ি বাদ দিয়ে বসে পরলাম। আবীর সিগারেট ধরাল। সুজিত বের করে নিল গাঁজা। ফকির আর আমাদের দূরত্ব এখন এক সিঁড়ির। কিন্তু এই মানুষটাকেই এতক্ষণ আমরা ধরতে ছুঁতে পারছিলাম না। গানে তিনি আমাদের থেকে যোজন দূরত্বে তৈয়ারি করে নিয়েছিলেন। এখন যেন খানিক ছুঁতে, ধরতে পারছি বলে মনে হচ্ছে। আবীর কলকে ছাড়া গাঁজা টানে না। ওর নাকি সিগারেটে আমেজ হয় না। কলকে প্রস্তুত করে বার দুই টানার পর ও ফকিরের দিকে বাড়িয়ে ধরল সেটা।
বলল, নেন আসেন।
কলকে প্রসন্ন বদনে কপালে ঠেকালেন ফকির। টানলেন। বার দুই টানার পর বললেন, ওধারে খেপি মা রয়েছেন। ওনারে একটু দিই, ডাকি? কী বলেন আপনারা?
কিছু বলার আগেই তিনি ডাকলেন, মা, মাগো, আসো দিকি এদিক পানে। বাবারা সব প্রসাদ করিছে।
মস্ত এক হাওয়া বইল এ সময়। আমরা দেখলাম হাওয়া ফুঁড়ে উঠে এলেন যিনি তাঁর সর্বাঙ্গ জলে ভেজা। লাল শাড়ির আঁচলে তবু লেপটালেপটি খাচ্ছে হাওয়া। কপালের সিঁদুর জল লেগে মিয়ে গেছে যেন। হাত ভর্তি পলায় চাঁদ লেগে জলের চিকচিক।
মা এসে ছিলিম ধরলেন। কোনওদিক তাকালেন না পর্যন্ত। কপালে ঠেকালেন।
বললেন, ব্যোম শংকর, ব্যোম শংকর।
বার তিনেক টেনে তিনি নেমে গেলেন সোজা। যেখান থেকে উঠে এসেছিলেন সেখানেই চলে গেলেন তিনি। এ যেন সীতার পাতাল প্রবেশ।
ফকির বললেন, গরম ধরিছ্যে মা—র। সেই থেকে জলে।
আমি ভাবলাম, এই শেষ শীতেও মা—র শরীরে এত গরম!
বললেন, তারাপীঠ থেকে এসেছেন মা। সঙ্গে কালভৈরব। এসে থেকে জলে রয়েছেন তিনি। তন্ত্র করেন তো। তাই শরীরে এত তাপ মা—র। তারাপীঠ যাবেন। দেখবেন শ্মশানে মায়ের দাপট। প্রতি অমানিশায় ক্রিয়াকর্ম করেন তিনি আর কালভৈরব। ভৈরব এসে থেকেই যে কোথায় গায়েব হলেন!
হাওয়া দিচ্ছে খেপি মা জলেই সেঁধিয়ে রয়েছেন।
চুপ হলেন ফকির। চোখে বোধহয় রং লেগেছে। বেশ কিছু টান হয়ে গেছে তাঁর।
* * *
জিজ্ঞাসা করলাম, কাকে গান শোনাচ্ছিলেন?
কাকে আবার! ফিক হেসে বললেন ফকির।
আমার মনে পড়ে গেল কবির কথা—চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো। ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো।
আমি সত্যিই চাইছি ফকির তাঁর জ্যোৎস্না হাসির পরত ছুঁয়ে কিছু বলুন। অমন যার গান; ভেতর থেকে ঠিকরে বেরোনো সব কথার কুচি।
জবাব দিলেন না ফকির।
তবে কি তিনি কথা বলতে চাইছেন না!
ভাবলাম আমি।
বললাম, তালে আমাদের দেখার সাথে সাথে বললেন যে, তারে আর গান শোনানো হবে না। কাকে গান শোনাচ্ছিলেন আপনি? খেপি মা তো বললেন ডুব মেরেই থাকেন জলে। কুম্ভক করে। তবে শ্রোতাটা কে শুনি? কেউ তো নেই এখানে!
আবারও ফিক হাসলেন ফকির। চুপ মারলেন। বুঝলাম তিনি কিছুই বলবেন না।
বললাম, আমরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন পরানের কতা কইবেন। কই কিছুই যে কইছেন না!
নীরবতা ভঙ্গ দিলেন ফকির।
বললেন, খ্যাপার যে আর তর সইছে না।
আবীর, সুজিত থম মেরেছে। বুঝলাম ধরেছে ওদের।
ফকির বললেন, আমি খ্যাপা চাঁদরে শোনাচ্ছিলাম গান। চাঁচরের চাঁদ কথা কইছে। ভাবলাম চাঁদরে চাঁদরে কতাই শোনাই। তাই চিমটে বাজিয়ে গাইছিলাম আর কী।
চমকে গেলাম আমি।
বলেন কী ফকির! চাঁদকে শোনাচ্ছেন গান! আশ্চর্য!
বিস্ময়কে তিনিই ভাঙলেন।
বললেন, ভাবছেন নেশা ধরি গেছে আমার। তা খ্যাপা চাঁচরে তো চাঁদের নেশাখান ধরে।
আমি চুপ। কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।
ফকির বললেন, আপনে চাঁদের সঙ্গে কতা কন না? কন কন।
আমি অবাক।
বলে চলেছেন তিনি, সকল মানুষই কথা কয় চাঁদের সঙ্গে। বুঝে, না—বুঝে, জেনে, না—জেনে কথা চলে চাঁদের সঙ্গে। খ্যাপা জানেন তো আপনে। এ লাইনে ঘোরাফেরা তো অনেকদিনের বলেই মনে হচ্ছে।
প্রথমেই বুঝেছি বৃদ্ধ ফকির চাঁদ বলতে কী বোঝাতে চাইছিলেন। তবে এসব ক্ষেত্রে দেখেছি না জানার ভান করলেই বেশি জানা যায়। আমি যে তাঁর ইঙ্গিত ধরতে পেরেছি এটা অভিজ্ঞ ফকির ধরে ফেলেছেন।
বললাম, তা হোক। তবু আপনার কথাই শুনতে ইচ্ছে করছে আজ এই ভাবের হাটে।
ময়লা চেহারার শীর্ণকায় ফকির। বললেন, বড় কতাটা বলে দিলা গো তুমি। দিলের লোক। দিলদার মেহেমান সব। ভাব না থাকলি এ পথে কুন লাভ নাই গো বাবারা।
বললাম, ভাবনগরে এবারে এট্টুস চন্দ্র খেলা করুক খ্যাপা।
ফকির হাসলেন। গাঁজার আগুন নিতে নিতেই ওঁর ঠোঁট পোড়া। সেই পোড়া ঠোঁট দিয়েই যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে ভাবনগরের মৃদু হাসি। হাসির পরত মেখেই কথা কইছেন ফকির।
বলছেন, চাঁদ যে যুগলের কলা গো খ্যাপা। চাঁদ রয়েছে শরীরের বিশুদ্ধ আর সহস্রারে। চন্দ্রমণ্ডল গো। শ্বেতবর্ণ। কল্পনা করতে পারলেই আনন্দপ্রবাহ নির্গত হবে তোমার ওই শরীরখানা দিয়ে। ভাবো গো খ্যাপা। ভাবের হাটে চন্দ্রের লহরী নিতে ঘরে গিয়ে নির্জনে বসো গা ধ্যানে। বসলেই দেখবা শরীরের মধ্যে চন্দ্রের বসবাস। নাড়িদের ফিসফাস। চন্দ্র নাড়ি ইড়া, সূর্য নাড়ি পিঙ্গলা। এসব দিয়েই চক্রের ভেতর ঘরে থাকা চাঁদখানা তুমি দেখতে পারবা। তারপর চিন—পরিচয়। আলাপ। কতা। তা দেখি তো মনে হচ্ছে মুর্শেদ এস্যি গিয়েছ্যেন জেবনে তোমার। তারে ধরে থ্যাহো। চক্রমধ্যে চাঁদের গাঁথা তিনি পড়ায়ে দেবেন তোমায়। তাকাও দিকি এদিক পানে একবার।
ফকিরের কথায় ওঁর চোখের ওপর চোখ দিলাম আমার। কিছুক্ষণ রাখার পর বললাম, কী বুঝলেন গো, মুর্শেদ? আমার হবে?
চেঁচিয়ে উঠলেন ফকির, অলখ নিরঞ্জন।
খেপি মা আর কালভৈরবও তখন আমাদের ভাবের হাটে এসে বসে গিয়েছেন। ধুনি জ্বালিয়েছে ভৈরব।
আমার দৃষ্টিতে ফকিরের চোখ লেগে কেমন এক সম্মোহন। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমার। ফকির নাড়িয়ে তুললেন আমায়।
বললেন, যোগিকো ভোগিকো রোগিকো জান, আঁখসে নিসান ঔর আঁখসে পয়ছান।
* * *
খেপি মা বললেন, তা বাবা ফকির তো কোলো তার মতো। চাঁদ, ব্যোমভোলার মাথার চাঁদ কী বাবা? কী মনে কর তুমি?
আমি চুপ।
মা এবার ফকিরের দিকে চেয়ে বললেন, ওসব সাধনযোগ তুমি ছাড়ান দাও দিকি।
ফকির হাসছেন মিটমিট করে। কালভৈরব তখন মায়ের পাশে।
খেপি মা বললেন, শিবের চাঁদখানাই সাধনে সিদ্ধি গো।
কীভাবে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
খেপি মা বললেন, চাঁদ শূন্যতা। শূন্যতা পরম। পরম হল গিয়ে শিব—বলেই মা ব্যোমভোলে ব্যোমভোলে বলে দু—বার চিৎকার তুললেন।
ভৈরবের ধুনির আগুন তখন অনেকখানি উঠেছে। আগুন চিনে দু—একজন এসেও জুটেছেন এর মধ্যে। তান্ত্রিকের ধুনি ঘিরে তখন আমাদের ভাবের জটলা। সুজিত বের করেছে মাজদিয়ার খেজুর গুড়ের মাখা সন্দেশ। হাতে হাতে ঘুরছে এবার প্রসাদি ছিলিম আর সন্দেশ। ফকির চিমটে নিয়ে তৈয়ারি। কালভৈরবের কথামতো গান ধরবেন তিনি। চন্দ্রসাধনের গান।
তার আগে কালভৈরব বলতে লাগলেন, চন্দ্র হল ব্রহ্মাণ্ডস্বরূপ। বাউল ফকিরও তা মানে। তাদেরও ব্রহ্মাণ্ড শরীর। আমাদেরও। সবার ব্রহ্মাণ্ড হল গিয়ে সেই শরীর। আমি—আমি—আমি—আমি বলতে লাগলেন ভৈরব।
থামেন দিকি।
খেপির কথায় বাবা থামলেন।
মা বললেন, শরীরের আজ্ঞা চক্র ভেদ হলেই চন্দ্রজ্যোতি বের হয়। শিবের মাথার চাঁদ হল সেই জ্যোতি। শরীরই শিব বাবা।
ভৈরব বললেন, আজ্ঞা ভেদ হলে একে একে শক্তি উপরে উঠেই শিবত্ব লাভ। জীবত্ব থেকে মানুষ শিবত্ব লাভ করে। মানে হল গিয়ে মানুষই ভগবান।
জমায়েতে তখন বাবার ভক্তশিষ্যরা এসে জুটেছেন। বেষ্টিত ভক্তশিষ্য বলতে থাকলেন, কালভৈরব কী জয়। খেপি মা কী জয়। তারাপীঠ কী জয়। তারা মা কী জয়। জয় শঙ্কর।
খেপি মা বললেন, হারামজাদারা সব জয় দিলি, সিদ্ধ ফকিরের জয় দিলি না। বলেই বললেন, ফকির ফজর শাহ কী…
সমবেতভাবে জয়ধ্বনি উঠল, জয়…
গান ধরলেন ফকির। চন্দ্রসাধনের।
কৃত্তিবাস, ফুলিয়া
চৈত্রমাস, ঠাঠাপড়া রোদ নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি ভৈরবী মায়ের দরজায়। কবি কৃত্তিবাসের জন্মস্থান ফুলিয়া—বয়রায় সেদিনই আমার প্রথম যাওয়া। ভ্যানরিকশাতেই গিয়ে নামলাম কৃত্তিবাস হাইস্কুলের গায়ে। চোখ পড়ল গিয়ে ওই শান বাঁধানো স্মৃতিস্তম্ভে। তারপরই কৃত্তিবাসের কল্পিত মূর্তিসহ মন্দিরে। ওপরে অশ্বত্থের ছায়া। নীচে এসে দাঁড়াতেই রোদের হলকা খানিক নরম হয়েছে। হাওয়াও দিচ্ছে ফুরফুরে। তবে তাতে লেগে গরমের ভাব।
খটখট শব্দ হচ্ছে তাঁতের। বোনা হচ্ছে জালি গামছা, কাপড়। মাটি রাস্তা ধরে এগোতেই নামাঙ্কিত লাইব্রেরি তথা সংগ্রহশালা। ঢুকতে ইচ্ছে করল না। শুনেছি ফ্রান্স থেকে আনা কৃত্তিবাসী রামায়ণের পুথির মাইক্রোফ্লিম এখানেই সংরক্ষিত।
মনে আমার তখন ভৈরবী মায়ের কৌতূহল। যাঁর টানে মূলত খবর পেয়ে এতদূর আসা। যবন হরিদাসের আখড়া পেরোতেই ছিটেবেড়ার এলাকা। কৃত্তিবাস আর যবনের পাশাপাশি সহাবস্থান। আর তার পাশেই ভৈরবী মায়ের সাধন অস্তিত্বের ধারা।
ভাবছি, এই বঙ্গভূমে ধর্মের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমাও লজিক সম্মত। না হলে শাক্ত—বৈষ্ণবও এমন পাশাপাশি থেকে গিয়ে নাক—উঁচু প্রবণতাকে চোখ রাঙায়। সম্প্রীতির অনুমোদনকে সার্থক করে।
ভাবতে ভাবতেই দুপুর প্রখর হচ্ছে। নিমগ্ন কাকের ডাকের মাঝে কোথাকার এক কোকিল পাখির ডাক খুঁচিয়ে তুলছে আমার রোমাঞ্চ। কেননা এসেছি আমি ভৈরবী মায়ের ডেরায়।
দেখছি, বাঁশের কঞ্চির গেটটি নারকেল দড়ি দিয়ে ছিটেবেড়ার সঙ্গে বাঁধা। ধারেকাছে কেউ নেই। তাঁতিবাড়ির কোলাহল থেকে একটু দূরে ভাঙা—ছেঁড়া ছায়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ভৈরবী মায়ের ভিটে। আর কোনও বসতিও নেই এদিকে। রাস্তার ওধারের জমি ঘন সবুজে ঢেকে রয়েছে।
গেট খুলে শুকনো পাতা মাড়াবার শব্দ আর পাখির ডাককে সাঙ্গ করেই আমি কেবল একবারই বলে উঠলাম, মা। মা আছেন?
তাতেই বিস্ফোরণ।
ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ এল।
মনে হল এক ক্ষুধার্ত সিংহীর গর্জন।
কী চাই?
বললাম, একটু দেখা করতে এসেছি আপনার সঙ্গে।
আওয়াজ আরও চড়া হল। উঠোনে ঘুরঘুর করা শালিক, ঘুঘু ফরফরিয়ে উড়ে গেল তেজি কথার ভঙ্গিমায়।
বললেন, দেখা—টেখা হবে না। মানে—মানে কেটে পড়। তন্ত্র—মন্ত্র কিছুই করবি না তোরা। শুধু বিয়ে করে ঘরে বউ আনবি, তার আগে ভৈরবীর কাছে আসবি শরীর নাড়াচাড়া শুনতে। যা—যা শান্তিপুর যা। নেড়েচেড়ে দেখে আয়। পাশযুক্ত পশু সব। ভোগের লালায়—ঝোলায় থাক গে যা। তা না চলে এসেছে আত্মশক্তির জাগরণ চিনতে। সরে পড় সরে পড়। না গেলে গায়ে গরমজল ঢেলে কুকুর তাড়াব।
বললাম, একবার যদি…
কথাটা সম্পূর্ণ করতে দিলেন না। তার আগেই আরও যেন ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।
গেলি গেলি। না গেলে ত্রিশূল ছুঁড়ে মারব। নিশানা জানিস তুই, যোগমায়া ভৈরবীর?
অগত্যা আর কথা বাড়ালাম না। ঘর থেকে বেরোলেন না তো ভৈরবী। সিংহীর গর্জন গুহা থেকে উঠে গুহাতেই শান্ত হয়ে এল। ক্ষুরধার দাঁত—নখ আর দেখা হল না তার।
চলে এলাম হরিদাসের আখড়ায়।
সদানন্দ বাবাজি আমার পূর্ব পরিচিত। একসময় পালপাড়ার মহেশ পণ্ডিতের শ্রীপাটে আমার তো যাতায়াত ছিল। সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ। অনেকদিনই হল থিতু হয়েছেন এই আখড়ায়।
বললেন, ঝাঁঝি খেলেন বুঝি? সকলেই আসে। চলে যায়। শুনেছি তো আগে দুবরাজপুর থাকতেন। বছর খানেক হল এখানেই রয়েছেন। লোকে তো বলে সিদ্ধাই রয়েছে ওঁর। কথাবার্তায় তো মনে হয় না। জানেন, এখানে আছেন এতদিন; আখড়া মাড়াননি কোনওদিন। খোল—করতাল জোরে বাজালে শাসান, আস্তে না বাজালে ল্যাংটো হয়ে এসে নাকি নেত্য করবেন! ভয়ে থাকি বুঝলেন। গ্রামের পাঁচজন ভক্তিশ্রদ্ধা করে। রোগও নাকি ভালো হয়! ওষুধ দেন জড়িবুটি।
বললাম, তাই?
বললেন, তা আপনি কী মনে করে, গোঁসাই? আবারও জিজ্ঞাসা। কত আর খুঁজে মরবেন ভগবান। এবার নাম নেন, নাম নেন। আত্মস্থ হন তো দিকি। মনে শান্তি পাবেন। কৃষ্ণনামে, হরিনামে সকল তোলপাড় দূর হবে।
হাসলাম।
বাতাসার শরবত দিলেন বাবাজি। হাতপাখা দিয়ে বললেন, জিরোন। হাওয়া খান। আমি প্রসাদ পাবার ব্যবস্থা করি। বিকেল—বিকেল গঙ্গাস্নানে যাবেন। তখন ধরবেন। চেষ্টা করবেন। যদি মুড ভালো থাকে। সারাক্ষণই তো খিঁচিয়ে রয়েছেন। কৃষ্ণ—সান্নিধ্য তো নেই, মাতাজির; নমনীয়তা আসবে কোথা থেকে শুনি?
* * *
বাবাজির এই কথা কতখানি যে ভুল এখন বুঝি অনেকদিন ভৈরবী সান্নিধ্যে আসার পর।
একদিন বেলাবেলি এলাম।
মা তখন কামাখ্যা মন্দিরের চাতালে পা ছড়িয়ে বসে।
দেখে বললেন, আয়। বোস। আজ রাধাষ্টমী। মা—কে কৃষ্ণ—উপাচারে সাজিয়েছি রে দ্যাখ। দ্যাখ, দ্যাখ খড়্গ খুলে নিয়েছি মায়ের হাতের। বাঁশি ভরে দিয়েছি। দিনরাত মা বাজাচ্ছেন। দুপুর—দুপুর কেউ নেই। মা বললেন, রাধা কই রে, যোগমায়া?
বলে এক মস্ত হাসি দিলেন মা। সেই হাসিতে আনন্দমূর্তির মতো খুলে গেলেন মা। বলতে থাকলেন আমায়।
বুঝলি, মাকে কী উত্তর করলাম আমি?
আমার জিজ্ঞাসার প্রতিশব্দকে বলবার সুযোগই দিলেন না ভৈরবী। নিজেই বলে চললেন।
মা, যোগমায়াই তো মহামায়া হয়ে আছে। মায়া কী রে ছোঁড়া?
বললাম, পাশ। বন্ধন।
উত্তর করার সুযোগটুকু পেলাম এইবার।
ভৈরবী বললেন, সেই মায়াকেই তো মেরে রেখে এসেছি যোগে। সেইজন্যই তো আমার নাম রাখা হয়েছে যোগমায়া।
কে রেখেছেন মা, আপনার অমন সার্থক নাম?
উত্তেজিত হয়ে উঠলেন ভৈরবী।
সার্থক—অসার্থক জানা—বোঝার তুই কে শুনি? কোন নির্ধারক তুই? বিচার—বিশ্লেষণ করা তোদের স্বভাব। সেজন্যই তো শিক্ষিত লোকদের থেকে ভগবান দূরে থাকেন। সারাক্ষণ তোদের কেবল যুক্তি—তর্ক, কেন রে, ভাব নেই তোর? মনের যুক্তিকে মার। তর্ক থামা। প্রমাণ ছাড়ান দে। তবেই দেখবি সত্য পাবি। সুন্দর পাবি তুই। সুন্দর পেলে শিব এমনিই আসবে তোর ভেতরে। তখন আর ভৈরবীর কাছে ঘুরে মরতে হবে না রে। শরীরেই তোর শক্তির জাগরণ হবে। শরীরই হবে তোর কামাখ্যা। শরীরই হবে তোর দেবী মহামায়া। শরীরেই তোর বিরাজ করবে মায়ের পঞ্চকামিনী রূপ।
স্বভাববশেই মৃদুস্বরে বললাম, কী কী মা, মায়ের সেই পঞ্চরূপ?
বোধহয় ভাবে এলেন এবার ভৈরবী। সার্থক মাতৃরূপ নিয়ে স্নেহ ঢেলে দিলেন কথায়।
বললেন, কামাখ্যা, ত্রিপুরী, কামেশ্বরী, সারদা, মহোৎসাহা। মায়ের এই হল পঞ্চকামিনী রূপ। দেবীর চারদিকে রয়েছেন সদা জাগ্রত অষ্টযোগিনী—গুপ্তকামা, শ্রীকামা, বিন্ধ্যবাসিনী, কটীশ্বরী, ধনস্থা, পাদদুর্গা, দীর্ঘেশ্বরী, প্রকটা। আসলে মা তো যোনিমণ্ডল রে। যোনিই সৃষ্টি। সৃষ্টির হাতেই খড়্গ। আজ দ্যাখ, তাঁর হাতেই আমি বাঁশি ধরিয়েছি। কৃষ্ণ হয়ে উঠেছেন মা। আর আমি দ্যাখ, চুল ছেড়ে দিয়ে আলুলায়িত ভাব নিয়ে রাধা হয়েই বসে থেকেছি। তারপরেই তুই এলি। তোকে বলে ফেললাম ভাবের কথা। ভাবই সব রে। ভাবই সব। ভাবসঙ্গে থাকবি সব সময়। সঙ্গ করলেই দেখবি রঙ্গ জমবে। ওঠ ওঠ। কৃষ্ণপুজোর সময় হয়ে এল। আরতিতে আজ খোল বাজবে। হরে কৃষ্ণ নাম হবে রে। থেকে যা। সব ধরতে পারবি তুই।
ভৈরবী উঠতে উঠতে গুনগুন করছেন :
সহজ পথে উছট লাগে
ওরে মন কানা
ও তুই আপনি সহজ না হইলে
সহজের পথ পাবি না।
তার মাঝেই খোঁপা বাঁধা হয়ে গেল যোগমায়া ভৈরবীর। ঢুকে গেলেন মন্দিরে। মায়ের হাতের বাঁশিতে জড়িয়ে দিলেন জবার মালা। আমি তখনও নাটমন্দিরে বসে। যুঝে উঠতে থাকলাম সেই বাঁশি—রহস্যের সঙ্গেই। খড়্গ, বাঁশি সব একাকার হয়ে এল আমার সামনে। কালীকৃষ্ণর সদর্থক প্রতিনিধির সামনে আমি তখন দাঁড়িয়ে!
গুরুছায়া, আরামবাগ
আরামবাগ থেকে কামারপুকুরের পথ উজালে আনুড় ইস্কুলতলা। সেখান থেকে রাঢ় বাংলার লাল ধুলো ঢাকা পথ পেরিয়ে গ্রামের প্রান্তসীমায় পৌঁছলেই গুরুছায়া। ফকির বাবার আশ্রম।
সামনে স্বচ্ছতোয়া পুকুর। দুপুরবেলা পাড়ের ধারে পোনা মাছেদের জটলা। পরদিন জাল ফেলল শাহজাহান।
কেজি পাঁচেকের পাকা কাতলা দেখিয়ে বলল, এই দিয়েই আজ সাধুগুরুর সেবা দেব। ছোট পোনার কিছু সেবা নেবে তুমি, গোঁসাই?
বললাম, না গো। কত খাব আমি!
সে বলল, তাহলে গোঁসাই, নিজে হাতে তুমি ওদের জলে ছাড়ো দিকিনি।
আমি মাছের চারা ছাড়তে ছাড়তে শাহজাহানকে বললাম, আখড়ায় শিষ্য—বায়েতরা এলে আর মনের কোনায় গানের উদয় হলে লালন সাঁই বলতেন, পোনা মাছের ঝাঁক আসছে রে।
শাহজাহান বলল, ঠিকই তো বলতেন গো, সাঁই। গান হল সাধনের তরিকা আর বায়েতরা তো সেই তরিকারই অংশীদার, গোঁসাই। তরিকার গুণে বায়েত মুরিদ হয় গো। পোনা গিয়ে দাঁড়ায় কাতলে।
এই হল শাহজাহান। একা হাতে সামলায় গুরুছায়া। কাকভোরে উঠে উঠোনে ঝাঁট দিয়ে গাইগোরুর কাজ, পায়রাদের দানাপানি, মাছেদের খাওয়ানো থেকে শুরু করে মাঠে যাওয়া, হাটবাজার—সব একা হাতে। এই হল গিয়ে তার গুরুসেবা।
সে বলে, ইলম—ই আসল কাজ গো। বোঝ তো ইলম?
বললাম, অর্জনের জন্য অন্বেষণই ইলম।
শাহজাহান ওর লিকলিকে আধপাকা দাড়িতে হাত বোলায় আর ফিকফিক হাসে।
বলে, গুরুছায়াতে তো কত মানুষই আসে গো। খ্যাপা, ফকির, গায়ক, কৌতূহলী, নেশারু। প্রথম যেদিন এলে গোঁসাই, সেইদিনই বুঝেছি ইলম—ই তোমার উদ্দেশ্য গো।
বললাম, কী করে বুঝলে?
সে বলল, শিক্ষিত, মান্যি মানুষ তুমি, মারিফত বুঝতে চাও, বাতিনি জ্ঞানের জন্য ছুটে আসো দূরের পথ। তুমি কী আলেম না হয়ে পারো?
বললাম, জ্ঞানীরা, আলেমরা তো জ্ঞানকে চারভাগে ভাগ করেছেন।
শাহজাহান বলল, ইলমে শরিয়তে তো আর ফকিরি বোঝা যায় না গো।
বললাম, ইলমে বাতিন জানব বলেই তো গুরুছায়াতে আসা।
শাহজাহান কাজ করে আর আমি তাকে উসকে তুলি। আনুড় হাই ইস্কুলেই তো উচ্চ মাধ্যমিক অবধি পড়েছে সে। তারপর কামারপুকুর কলেজ।
শাহজাহান বলতে থাকে, রামকৃষ্ণের দেশ। ঠাকুর তো ইলমের দ্বারাই এবাদত করতেন। এবাদতের জন্যই শায়েখ। তখন লেখালেখির শখ। ফকির বাবা আরামবাগ থাকেন। রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদে চাকরি করেন আর পত্রিকা বের করেন জুলফিকার। তার সন্ধানেই ওঁর ওখানে যাওয়া।
বললাম, তারপর শেখ সাদেক আলি ফকিরি নিলেন, সংসার ছাড়লেন, তোমার দাদির দেওয়া জমিতে আশ্রম করে কাটিয়ে দিলেন পঁচিশ বছর।
শাহজাহান আবারও দাঁড়িতে হাত বোলায়। ফিকফিক করে হাসে।
বলে, গোঁসাই, তুমিও সাঁইজির পোনা মাছ গো। বাবার কাছে বসো। ইলমে তরিকত বোঝ। বুঝতে বুঝতে গুপ্ত বাতিনির ইলমে বাতিনির দরজা ধরে ইলমে মারিফতে যাও। আমি মাঠে যাই। সন্ধের এবাদতে দেখা হবে গো।
আমি ফকির শেখ সাদেক আলির সামনে বসি।
ফকির বাবা এরশাদ করেন—আশ শরিয়াতু শাজারাতুন ওয়াত তরিকাতু আগছানুহা ওয়াল মারিফাতু আরজাকুহা ওয়াল হাকিকাতু শামারুহা; শরিয়ত একটি বৃক্ষ সদৃশ, তরিকত তার শাখাপ্রশাখা, মারিফত তার পাতা এবং হাকিকত হল ফল।
সেই ফল নিয়ে যখন গুরুছায়া ছাড়ি তখন মনে আলোড়ন : শাহজাহান ইলমের জন্য শায়েখ করলেন সাদেক আলিকে। নাড়া বাঁধলেন। সংসার ছাড়লেন। তার দুই ছেলে সোনার কাজে কুয়েত। দাদারা ধানি জমি, পুকুর দেখভাল করেন। বিবি ঘরের কাজ। আর সে গুপ্ত ইলমে ব্যস্ত। কোনও কিছু কামনার জন্য তার এবাদত নয়। এ তার ফকির বাবার শিক্ষা।
বাবা বলেন, আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্যই তো এবাদত।
বলি, কীভাবে এবাদত করব আমি?
সাদা পোশাকের সত্তরোর্দ্ধ ফকির। দুপুরের সেবার পর বিশ্রাম নিয়ে বসেছি আমরা। সেবার স্বাদ এখনও তো আমার মুখে লেগে। গরম ভাত, পাটপাতা ভাজি, ডাল, কুমড়োর রসা, মাছের তরকারি ও আমড়ার টক।
ফকিরের চোখ বড় বড়। শরীর টানটান। চাঁদিতে মস্ত টাক। গালে পাকনা দাড়ির জঙ্গল। সামনে ওঁর সন্ধেবেলার গান—এবাদতের যন্ত্রপাতি সব সাজানো। একতারা, দোতারা, তবলা, হারমোনিয়াম, ডুবকি, খোল, নাল, জুড়ি, কি নয়। হারমোনিয়ামের ওপর রাখা গানের খাতা ও রিডিং গ্লাস।
ফকির বললেন, আগে ওস্তাদদের কাছে ঘন ঘন যাতায়াতটা থাক। তাঁদের কাছে জ্ঞান অর্জন করাটা দরকার। এটাই হল গিয়ে ইলমে শরিয়ত। সবার প্রথমে রপ্ত করে নিতে হবে। প্রথম ইলমের পর, সমস্ত ওস্তাদদের কাছে ঘোরাফেরার পর দ্বিতীয় ইলমটা অর্জন করতে হবে।
কীভাবে?
এই ইলম অর্জন করতে হবে, বেটা আল্লাহর নিকট থেকেই। একে বলে ইলমে লাদুন্নী। এটা অর্জন করার জন্যই তখন শায়েখ দরকার। এবার নির্দিষ্ট পির—ফকিরকে গুরু করা দরকার। তিনিই গুপ্ত ইলমের দরজায় নিয়ে যাবেন।
জিজ্ঞাসা করি, গুপ্ত ইলমখানা কী?
ফকির বাবা বলেন, গুপ্ত ইলমই তো ইলমে হাকিকত রে, বেটা। মারিফত সাধনধারার খোসা। সেটাই ছাড়াতে হবে যে মুরিদকে। মুর্শেদ দেবেন সিলসিলা বা তরিকা। এভাবেই ইলমে শরিয়ত থেকে হাকিকতের দরজায় আসতে হবে। জানতে হবে আদি, অন্তে, প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহ কীভাবে বিরাজিত। তাঁর তো অসীম জ্ঞান ভাণ্ডার। চার আকসামেই দেহতত্ত্ববিদরা সব ধরে রেখেছেন। সেসব জানতেই তো যেতে হয় আউলিয়া, কেরাম, ফকির, দরবেশদের কাছে।
বলি আমি, সেই জ্ঞানভাণ্ডারের চার অবস্থাটা কী?
ফকির বললেন এবার, ও তো আল্লাহরই চার অবস্থা। আউয়ল, আখের, জাহির, বাতিন। ওলিরা সমস্ত জ্ঞানকে চারভাগে ভাগ করেছেন। চারখানার একখানা হল ইলমে শরিয়ত। জাহিরি ইলম। ইলম কী আর শুধু কিতাবাদি নাড়াচাড়ায় আসে রে।
ইলম কীভাবে আসে তবে?
ইলম হল এমন একখানা জিনিস রে, যা শুধু কিতাব পড়েই লাভ হয় না।
বলি, ইলম মেলে তবে কোন সিলসিলায়?
ফকির বললেন, এই তো মারিফত ধরিছে তোমায়। জানতে চাইছ।
বিকেল শেষ হয়ে আসছে এবার। দাওয়ায় বসেই দেখা যাচ্ছে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানখেত। ওর মাথায় এই কামারপুকুরের ঠাকুর রামকৃষ্ণের লীলাসঙ্গিনী সারদা মায়ের লাল টিপটি হয়ে বসে গেছে আনুড় আশ্রমের অস্তগামী সূর্য।
ফকির এখন অন্তর্জগতের মর্মে প্রবেশ করেছেন যেন। এসে থেকেই অবশ্য দেখছি জীবনে ওঁর কোনও অতৃপ্তি নেই। সুখ আর দুঃখের মধ্যে ভেদ করেন না। রিপুর কবল থেকে সরে এসে স্বরূপ চিনেছেন তিনি ওই আল্লাহর সঙ্গে বাতনি সম্পর্ক স্থাপনে।
বললেন, ইলম মানবদেহে আপনা হতেই উদয় হয়। ডেকে আনতে হয় না কাউকে। ইলমের প্রকাশ ঘটে আক্কেল দিয়ে। আক্কেলখানা যখন আসে, বেটা এই তোর মতোই তখন পির—মুর্শেদ—আউলিয়াদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে ইচ্ছে জাগে।
বলি, আমার তবে ইলম জেগেছে বলছেন?
ফকির বললেন, দেহের মধ্যেই আত্মার বসবাস। আত্মা বা রুহ ছাড়া শরীরখানাই অচল, অসাড়, নির্জীব। আত্মা ছাড়া, নফস ছাড়া শরীরের কোনও মূল্য নেই।
নফস কী?
নফস হল প্রাণ। রুহ, নফস, দেহ একসঙ্গে জড়িত। যখন জ্ঞান জাগে, ইলম জন্মায় তখনই রুহ—র নাড়াচাড়া শুরু হয়। তিষ্ঠাতে দেয় না এই রুহ। জ্ঞানচক্ষুর বিকাশ। যা ছুটিয়ে মারে। তোর যেমন এখনকার এই রুহ—র বিকাশ ছুটিয়ে মারছে খালি ওস্তাদদের দ্বারে। ইলম যার বেশি সেই—ই তো রে সব ছেড়ে আল্লাহর দরবারে চলে যায়।
আমি ভাবি, ফকির সাদেক আলি এ জন্যই কি চাকরি ছাড়লেন, সংসার? শাহজাহানও শায়েখ—পির পেয়ে গুরুছায়াতে বসবাস করেন। আসে জন বসে জন, এত লোকের রান্নাবান্না, জমায়েত, উরস। সব একা হাতে সামলায় শাহজাহানের বি এ পাশ করা একমাত্র বোন।
ফতেমা আমায় বলে, আমি বিয়ে করব না দাদা। পির—ফকিরদের রান্না করে, সাধুসেবা করেই জীবন কাটাব।
আমি ভাবি গ্রামদেশ আর অন্যভাবে বাঁচার মানে খোঁজা জেহাদি ফতেমার কথা। ও আমাকে ভাত বেড়ে দেয়। পানি ঢালে গ্লাসে।
গুরুছায়া ছেড়ে আসি। আসতে —আসতে ভেতর গুনগুনায় ফতেমার সান্ধ্য এবাদতে।
মাথায় সাদা ওড়না জড়িয়ে চোখ বুজে হাতে একতারা নিয়ে গান—এবাদতে বসে শাহজাহানের বোন ফতেমা খাতুন।
গেয়ে ওঠে সে :
হে অপরূপ রূপস প্রেমময়
চোখেতে তোমার জমিয়েছি রূপ
মহামতি গুরু, অপারের কাণ্ডারী
কৃপা করে তোমার প্রেমে ডুবাও।