ভবে আসা খেলব পাশা

ভবে আসা খেলব পাশা

সতী মায়ের আখড়া, ঘোষপাড়া

সতী মায়ের আখড়াঘরে দোলযাত্রা শুরু হয় সরস্বতী পুজো, শ্রীপঞ্চমীর দিন। ওই দিন ফকির ঠাকুর, কর্তাবাবা, সতী মা, দুলালচাঁদের ঘরে আবির, অভ্র, আতর, প্রণামী, কাপড় দিয়ে কর্তাভজা ঘরের বীজমন্ত্র উচ্চারণ করে দোল উৎসবের সূচনা হয়।

ঘোষপাড়ার দোল কর্তাভজাঘরে উৎসব—অনুষ্ঠানের ভেতরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই মেলা মূলত মহাশয়—বয়াতিদের জমায়েত। দূর দূর থেকে গুরুমহাশয় আর শিষ্য—বয়াতিরা আসতে থাকে সতী মায়ের দোলযাত্রায় ঘরের মালিক কর্তাবাবা মহান্তদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য।

মেলায় সাম্প্রদায়িকগণ স্থাপন করেন আসন। জলচৌকি পেতে মায়ের ছবি। ঘট। ঘটে ফুল পাতা আবির ফাগ, জটাজূট আলখাল্লা পরা মহাশয়। তাঁকে ঘিরে বয়াতিদের ভিড়।

মহাশয় তো বলতে থাকেন নামরসের কথা। বলেন, রসের স্থিরতায় নাম কাজ করবে যে।

জিজ্ঞেস করি, কীভাবে?

কুমীরদহ থেকে মেলায় আসা বৃদ্ধ মহাশয় বলেন, ঘোষপাড়ার দেহসাধনা গোপন ব্যাপার—স্যাপার বুঝলেন। কর্তাবংশ, বয়াতিদের সঙ্গে সাধনার এখন আর খুব যোগাযোগ নেই। এখন শুধু হাজার মানুষ, ডালিমতলায় মানত, হিমসাগরে স্নান, দণ্ডী। এসব কী আর ঘোষপাড়ার সাধনা?

বললাম, সাধনধারাটা তবে কেমন এখানকার?

এলো ফকির বললেন, ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষের ওপর হল গিয়ে নাম। তবে নাম জপলেই হবেটা কী শুনি? জপতে হবে নাম, রসেরই স্থিরতায়। ডালিমতলায় বসে রসেরই স্থিরতায় নাম জপেই আমাদের মা জননী সিদ্ধি পেয়েছিলেন, বুঝলেন। সেই সাধন না করে আমরা এখন ডালিমতলায় সতী মায়ের নামে লালপেড়ে কাপড় শাঁখা লোহা সিঁদুর দিই, গাছে বাঁধি ঢিল। কাজ হবে?

এলো ফকিরকে জিজ্ঞেস করি, কাজ হবে কিসে?

ফকিরের তখন সেবাধর্ম চলছে। কপালে জল চাপড়ে আঁচলে মুছিয়ে নিয়ে জটাজূট বেঁধে দিচ্ছেন কয়েকজন শিষ্যা। এরই মাঝে ফকির বললেন, কামবৃত্তিটা, ভোগটা আমাদের শরীরে আসলে নয়, মনে। মনের কামেই শরীরের বীর্য চঞ্চল হয়ে পড়ে। গাঢ় হয়ে জমতেই তো আর পারে না।

জিজ্ঞেস করলাম, বীর্য জমে কিসে?

বললেন, মনে কামের চিন্তা না থাকলেও শরীরে আপনাআপনি রস সঞ্চয় হয়। রস সঞ্চয় মানেই তো শরীর থেকে বাহিত হয়ে পড়ার প্রশ্ন।

বললাম, তবে?

এলো ফকির বললেন, মশায়, এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার। দশমী একাদশী তিথিতে শরীরের এই অবস্থা ঘটে। স্ত্রীলোকের যেমন প্রতিমাসে রস সঞ্চয় হয়ে রজঃ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং বের হয়ে যায়; যাকে ঋতুমতী দশা বলা হয়, এইরূপ পুরুষের শরীরেরও রস অধিক সঞ্চয় হয়ে পড়লে শুক্রবৃদ্ধি অধিক হয়ে দশমী একাদশীতে ক্ষয় হয়ে যায়। যেজন্য সাধক দশমী থেকে অমাবস্যা পূর্ণিমা পর্যন্ত শরীরকে অনাহারে অল্পাহারে রেখে শরীরের রস শুকিয়ে ফেলে। এতেই বীর্যবস্তু স্থির হয়ে পড়ে। শরীরের বীর্য যাদের স্বভাবত চঞ্চল, মনও যাদের কাম বিষয়ে অধিক চঞ্চল, তাদের এই নিয়মে বীর্যের চাঞ্চল্য দূর হয়। এটাই হল গিয়ে নামরসের সাধনা, বুঝলেন।

আমার সম্মতির দৃষ্টি চোখাচোখি হল এরপর। এলো ফকিরের সাধনসঙ্গিনী মালতী মা এবার বললেন, ও ছেলে, একখান গল্প বলি তোমায়। সাধনের গল্প। গোঁসাই—মহাজনেরই কথা।

বললাম, বলুন মা, শুনি এবার আপনার মত।

মালতী মা বলতে থাকলেন, ষড় গোঁসাইয়ের এক গোঁসাই সনাতন প্রভু বৃন্দাবনে বসে খালি নাম করেন। এদিকে শরীর চঞ্চল। রসসিক্ত। শুক্রগতির খালি ওঠাপড়া, বুঝলি বাপ। প্রভু গেলেন যমুনায় আত্মাহুতি দিতে। মনে তাঁর তো অপরাধ। এত গোবিন্দের নাম গাইলাম। রসবস্তু তবু যে স্থির হয় না। যমুনায় গিয়ে তিনি গুরুমা—র দেখা পেলেন। প্রভু দেখলেন এক স্ত্রীলোক জলে পূর্ণ একটা কলসিতে সমানে জল ঢালছে আর আক্ষেপ করে বলছে, জল পড়া বন্ধ হয় না কেন? গোঁসাই সনাতন তখন বললেন, তুমি মা, উপর থেকে জল ঢালছ। কলসিতে জল না ধরলে তো পড়ে যাবেই। এতে আক্ষেপের কী আছে! নারীরূপী সেই রাধারানি এবার বললেন, তুমি প্রতিদিন বেশি করে আহার্যবস্তুর রসে শরীর সিক্ত করে ফেলছ; আর সেই রসে তোমার শুক্রবৃদ্ধি হচ্ছে। শুক্র বাড়লে কামে উন্মত্ততা তো আসবেই, বাবা। এটা না বুঝে, নামরসের সাধনা না করে, তুমি আত্মহত্যা করতে এসেছ? তোমার মতন নির্বোধ আর কে আছে!

আখড়া এবার জমেছে। গুরু গুরুমায়ের কথার সম্মুখে বয়াতিদের ভিড় লেগেছে। এলো ফকির এক শিষ্যকে বললেন এই সময়, নতুন গোঁসাই সমঝদার মানুষ। নামরসের সাধনা বুঝতে এয়েছেন। তুই ওনাকে কর্তাবাবার সাধন নির্দেশিকাটা একবার বলে দে, লোকেন।

লোকেন গোঁসাই। মাথায় ঝুঁটি, গালে দাড়িগোঁফ। চুলে দোলযাত্রার আবির। দোতারা বাজিয়ে ধরলেন লালশশীর গান :

শক্তি পুরুষ অতি রস উপজে

কাজে কাজে দেখতো বুঝে পতি সতীর সহজে,

সাধ্য সাধক সঙ্গের সঙ্গী, অভেদ হে অর্দ্ধ অঙ্গের আঙ্গী

শুন হে বিধান, মানুষ প্রধান, সন্ধান শশী স্বরসে।

যুগলকিশোর, আড়ংঘাটা

দুপুরে অন্নভোগের পর সবে বন্ধ হয়েছে মন্দির। যুগলকিশোরের এখন বিশ্রামের সময়। সারাদিনে দর্শনার্থীর ভিড়ে তাঁরা চোখের পাতা এক করতে পারেননি। এত এত মানুষের প্রার্থনা, আর্তি সব শুনেছেন। এখন দু—দণ্ড জিরোচ্ছেন। ভক্তদের এরকমই সব বিশ্বাস।

গোঁসাই বাবাজি বললেন, এত কথা ক্যানে? তোমাদেরও তো পেটে ভাত পড়েছে। এখন জিরোও দিকি। কথা থামান দাও। তেনারা সব শুয়েছেন।

বললাম, কাদের কথা বলছেন?

অবাক হলেন গোঁসাই বাবাজি। সামান্য ভুরু কুঁচকোলেন। পাকা ভুরুর জঙ্গলে কৃষ্ণের হাওয়া খেলল যেন।

বললেন, বলেন কী কথা! আপনি খেলেন, খিলানে হেলায় খেয়ে পা ছড়িয়ে বসলেন আর রাধামাধব জিরোলেই দোষ!

বুঝলাম, বাবাজি এতক্ষণ যুগলকিশোরের যাতে ঘুমে, বিশ্রামে কোনও অসুবিধা না হয় সেজন্যই ভক্ত—শিষ্যদের নীচু স্বরে কথা বলতে বলছেন। এতখানিই রক্ত—মাংসের মনে করছেন বাবাজি আরাধ্য রাধামাধবকে।

প্রেমানন্দ গোঁসাই বাবাজিও যুগলকিশোরকে রক্তমাংসের মনে করেই ঠাকুরের বিশ্রামের সময় শোরগোলটা একটু কম করতে বলছেন।

আজ জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তি। যুগলকিশোরের বিশেষ উৎসব। লোকমুখে তা হল গিয়ে যুগলের মেলা। সংক্রান্তি থেকে শুরু হয়ে এক মাস চলে এই মেলা। একসময় চূর্ণি নদীর পাড়ে জঙ্গলাকীর্ণ স্থান ছিল। যুগলকিশোরের মন্দিরকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে এখানে জনপদ গড়ে ওঠে। সে সময় যাতায়াতের রাস্তা বলতে অবশ্য জলপথে চূর্ণি নদী আর হাঁটা পথে পশ্চিম দিকে বীরনগর। আরও কিছু পশ্চিমে গেলে একেবারে গঙ্গার তীর ঘেঁষাই কৃত্তিবাসের গ্রাম। পরবর্তীকালে ইংরেজ আমলে রেলপথ চালু হলে পর স্টেশন স্থাপিত হয়।

যুগলকিশোর নিয়ে এক কাহিনি—কিংবদন্তি রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের এক মহন্ত মহারাজ বৃন্দাবন থেকে কৃষ্ণের মূর্তি এনে বর্ধমান জেলার গঙ্গাতীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন একাকী নিরিবিলিতে একটু কৃষ্ণসাধনা করবেন বলে। শুরু হল সেখানে তাঁর নির্জন বসবাস। কৃষ্ণসেবা, সাধনভজন। এরই মধ্যে সেখানে শুরু হল বর্গির হাঙ্গামা। নবাবের রাজত্বে কৃষ্ণসাধনা চলবে না। সেই হাঙ্গামা সামলিয়ে চুপিসারে মহন্ত এসে পড়লেন তখন চূর্ণির পূর্বপাড়ের এই জায়গাতে। এখানে তিনি কৃষ্ণসাধনা শুরু করলেন আবারও নির্ভাবনায়। এ কথা নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কানে গেল। তিনি তখন কৃষ্ণকে একা না রেখে তার সঙ্গে রাধারানির একটি ধাতুমূর্তি জুড়ে দিয়ে নামকরণ করলেন যুগলকিশোর। তাঁদের পুজোর জন্য দেড়শো বিঘা জমি দিলেন মহারাজ। গড়ে উঠল মন্দির।

সে মন্দির এখনও দেখবার দশাতেই রয়েছে। পাঁচকুঠুরির দালান মন্দিরটি উঁচু ভিতের ওপর স্থাপিত। যুগলকিশোর মাঝখানে বড় সিংহাসনের ওপর। দণ্ডায়মান মন্দিরের বাইরে দুপাশে থাম বরাবর দশাবতারের কাজ রয়েছে। যা বাংলার লোকচিত্রকলার অন্যান্য নজির হিসেবে ভাবা যেতে পারে। চার কোণে রয়েছে তুলসীমঞ্চ। মন্দির চত্বরে বাঁধানো বকুল গাছকে ঘিরে বেড়ে উঠেছে তুলসী গাছ। এখানেই মেলা উপলক্ষে সাধুসন্তদের আস্তানা গড়ে ওঠে। বাউলরা আসে, রাতভর গান হয়। আখড়া বসে সব চূর্ণির দোরগোড়ায়। দূর—দূরান্তের দর্শনার্থী মেলায় এসে রাতে থেকে আষাঢ়ের প্রথম দিবসে ঘরে ফেরে। যুগলদর্শনে কেউই অনাথ বা অনাথিনী হন না। এই বিশ্বাসে বিশেষত মহিলারা এখানে ছুটে আসেন। ভক্ত হরিদাসও নাকি এসেছিলেন পরমার্থ লাভের আশায় এই মেলাতে! এখনও জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তিতে পিলপিল করে মানুষ আসে সেই বিশ্বাসের আশাতেই। আমার পরমার্থে বিশ্বাস নেই, তবে মানুষের বিশ্বাসে শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু অন্ধ শ্রদ্ধা কোনওভাবেই নয়। বিচার—বিশ্লেষণের পথে আমি আমার সেই শ্রদ্ধাকে রেখে যেতে চাই। সেই টানেই এখানে আসা। আসলে মানুষ যেখানে তার উন্মুক্ত বেদনার ছিন্ন পরিসরকে আশ্রয়ের ভাবনালোকের তলায় খানিক আকাঙ্ক্ষার মতো উজ্জীবিত করে নিতে চায়, সেখানে বিহ্বল সাহজিক আবেগ আমাকে বোধহয় টানে। তাই আমি ছুটে আসি বারবার সংবেদনী মানুষের আবহাওয়ায়। যে আবহাওয়া লোকায়ত একটি সজীব পরম্পরার উদাহরণ টানে আমার সামনে। সেই রূপান্বিত দিশা আমার বোধচর্চার চিন্তনকে পরিমার্জনা করে। অনেক সময় যৌক্তিকতায় চ্যালেঞ্জ জানায়। তারই জন্য আমার পথ পরিক্রমা। তারই জন্য অনবরত নিজেকে একাগ্র নিবেশে নিয়ে যাওয়া ভাবনগরের পথে।

দুপুরের রোদ নিস্তেজ হয়ে আসছে যুগলকিশোরের আঙিনায়। প্রেমানন্দ গোঁসাই বাবাজি ডাক দিলেন আমাকে।

বললেন, আসুন একবার আমার ঘরে। প্রাণাচার্য বাবাজি এসেছেন মাঝদুপুরে শান্তিপুর—বাবলা থেকে। অদ্বৈত বংশের গোঁসাই। শাস্ত্রজ্ঞানী। কৃষ্ণভেদ হবে ক্ষণ আপনার কিছুটা। আসুন আসুন। তাঁকে বলেছি আপনার কথা। কৃষ্ণজিজ্ঞাসার নানা সব ঔৎসুক্যর কথা। বাবাজি বললেন, নিয়ে আসো। কৃষ্ণকথা হবে খানিক।

তা গিয়ে পৌঁছলাম প্রেমানন্দ গোঁসাই বাবাজির ঘরে। গিয়ে দেখি পৃথুল চেহারার এক বাবাজি বসে। চোখে ভারি ফ্রেমের চশমা। হাতে আজকের সংবাদপত্র। টেবিলে রাখা পেতলের গ্লাস। তামার রেকাবি দিয়ে জলভরা মুখটা ঢাকাচাপা। পাশে চশমার খাপ। জপমালা ভরা গেরুয়া ঝুলি। ঝুলির গায়ে সুসজ্জিত কয়েকখানি বই থেকে কেবল স্পাইন দেখা যাচ্ছে ‘চৈতন্যভাগবতের’।

সাদর অভ্যর্থনা করলেন বাবলার বাবাজি।

বললেন, বসুন। কৃষ্ণজিজ্ঞাসার লোকজন কমে আসছে সব। কথা বলারই বা মানুষ কোথায়! আপনার খবর পেলুম। গুরুনিষ্ঠা, সেবানিষ্ঠা, নামনিষ্ঠার ভূষণধারী মানুষ দেখলাম বুঝলেন অনেক। কিন্তু কৃষ্ণকে জানবার স্পৃহা কোথায়? কৃষ্ণ কি ছাই শুধু মূর্তি নাকি?

জিজ্ঞাসা করলাম, কৃষ্ণ তাহলে কী?

অবশ্যই কৃষ্ণ শান্তি, স্মরণাগতি ও ভক্তি। তবে তাঁর মূর্তিময়তা তো একেবারে নিজের ভেতর।

কীরকম?

যুগলের মন্দিরে এসেছেন যখন, যুগলের কথাই বলি। কী মনে হয় আপনার, রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি ত্রিভঙ্গ কেন?

কেন? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

বাবাজি বললেন, আমাদের শরীরের তিন তিনখানা গুণ নিয়ে যে তাঁরা ত্রিভঙ্গ হয়ে রয়েছেন। আমরা বলি ত্রিভঙ্গমুরারি। তা হল গিয়ে স্বীয় শরীরের তিনখানা গুণ। বললাম, সত্ত্ব, রজঃ, তমো তো!

বাবাজি বললেন, জ্ঞানী মানুষ আপনি। ধরতে তো পারবেনই।

বললাম, ধরতে পারলেও সাকারের ব্যাখ্যাটা আপনার কাছেই শুনতে চাইছি আমি।

সত্ত্ব হল শরীরের নিত্যতা। স্থূল দেহ আমাদের। সবাইকার স্থূল শরীরে নিত্যজাগ্রত তিনি।

কীভাবে জেগে আছেন তিনি?

উপলব্ধিতে তাঁর নিত্য জাগরণ।

অস্তিত্বে কি তিনি কখনও তবে জেগে নেই? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

হাসলেন মৃদু ঝলকে ঠোঁটের অভিব্যক্তিতে বাবাজি। বললেন, আছেন, আছেন, পুরোদমে আছেন।

কীভাবে আছেন?

কীভাবে আবার! রজঃ হয়ে আছেন তিনি।

ভাবলাম, বাবাজি প্রকৃতির গুণের কথা বলছেন। রজঃ গুণ।

বললেন এবার, রজঃ হল গিয়ে রাজসিক। আমাদের শরীরকে রাজসিক মায়ায় তিনি ধরে রাখেন। মায়া হল বন্ধন।

বললাম, অষ্টপাশের বন্ধন?

অবশ্যই। কৃষ্ণকে শরীরের নিত্যতা মানলে আটপাশ থাকবে না। তা যে থাকতেই হবে।

হাসলেন বাবাজি। এবার বললেন, লীলা কী?

বললাম, আমার মতে তো খেলা।

‘চৈতন্যচরিতামৃত’ আওড়ালেন বাবাজি : কৃষ্ণের যতেক লীলা, সর্বোত্তম নরলীলা, নরবপু কৃষ্ণের স্বরূপ।

তারপর বললেন, কৃষ্ণের আদিতত্ত্ব শরীরের নিত্যতা। সেই নিত্যতা বুঝতে, জানতে, ধরতে নানাবিধ ভক্তিরস ছাড়া গতি নেই আমাদের। এই নববিধা ভক্তি দিয়েই তো সাধক কৃষ্ণভজনা করেন। আর ভজন করলেই তো সাধন হবে। শাস্ত্র বলে : ভাবিতে ভাবিতে কৃষ্ণ স্ফুরয়ে অন্তরে। কৃষ্ণনাম স্ফুরে মুখে, মনে, নেত্রে কৃষ্ণ।

আরেক বাবাজি বললেন, কৃষ্ণকথা শুনে, গেয়ে, মনে রেখে, বন্দনা করে, সেবা করে, নিবেদন করে, পূজা করে, সখ্য তৈরি করে কৃষ্ণকে শরীরময় করে তোলা যায়। সর্বক্ষণ হরিনাম করলে মনে, নেত্রে কৃষ্ণস্ফূর্তি হয়। শাস্ত্রের এই বচন শরীরে কৃষ্ণ—মান্য বা প্রামাণ্যতার বচন।

প্রাণাচার্য বাবাজি এবার শরীরের তৃতীয় গুণে ফিরে এলেন।

বললেন, তমো হল ভাব। মনের অন্ধকারকে দূর করে তামসিক ভাবখানা। এই ভাব এলে কৃষ্ণ হৃদয়ে, মনে, শরীরের সকল স্থানে আলো ফেলবে। তবেই তো কৃষ্ণের মাধুর্য বোঝা যাবে।

প্রেমানন্দ গোঁসাই বাবাজিও এ সময় আলোচনায় যোগ দিলেন।

বললেন, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃততেই তো আছে : আপন মাধুর্য হয়ে আপনার মন। আপনে আপনা চাহে করিতে আলিঙ্গন।।

তবে কৃষ্ণের সদর্থক শরীরী উপমার ব্যাখ্যা বাবলার বাবাজি দিলেন আমায় সান্ধ্য কীর্তনের পর।

বললেন, কৃষ্ণ হল গিয়ে আমি নিজে। কৃষ্ণ হল গিয়ে আপনার, আমার সবাইকার শরীর। কৃষ্ণ হল নাড়ি।

বললাম, শরীরের নাড়ির কথা বলছেন আপনি?

ধরে ফেলেছেন আপনি। ধরবেনই তো আপনি। চর্চাকারী মানুষ। এইসব মানুষদের সঙ্গে কৃষ্ণকথা বলেও সুখ। আমাদের শরীরে সাড়ে তিন লক্ষ নাড়ি রয়েছে। এই সাড়ে তিন লক্ষ নাড়িই হল গিয়ে কৃষ্ণ আর তার ভেতর প্রধান আটটি নাড়ি হল রাধার অষ্টসখী। বাকি সব নাড়ি গোপিনী।

তাহলে রাধার উপস্থিতি কি আমাদের শরীরে নেই?

আছে, থাকতেই হবে। রাধা ছাড়া কৃষ্ণ হবে কী করে? শরীরের প্রধান তিন নাড়িকে তো গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীর রূপ দেওয়া হয় যোগসাধনাতে। গঙ্গা ইড়া, যমুনা পিঙ্গলা, সুষুম্না সরস্বতী। কৃষ্ণমহিমায় রাধা হল গিয়ে প্রধান। তিন নাড়ির মধ্যে সুষুম্নার কাজ বেশি। তা সুষুম্নাকে আপনি রাধা ধরতেই পারেন। পিঙ্গলা তো যমুনা। রাধা নিজেও তো এই নদীর সঙ্গে সংযুক্ত কৃষ্ণলীলায়। যমুনার লীলাকে তো পিঙ্গলার রূপ দিতে পারি অনুভূতিতে। কৃষ্ণ তো আসলে রূপকল্পনার দৈত্য।

দৈত্য কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

কৃষ্ণ নির্ধারক। সে রাখে, সে মারে। নাড়িগুলো সব না জাগলে কৃষ্ণ জাগবে কী করে? যার নাড়ি যত বেশি জাগবে ধ্যানে, যোগে, ভক্তিতে তার তত বেশি সিদ্ধ দশা আসতে শুরু করে দেবে। সাধককে তো নির্ধারণ করবে শরীরের সাড়ে তিন লক্ষ কৃষ্ণ। তিনিই রাখবেন। অর্থাৎ কি না সিদ্ধস্তরে পৌঁছে দেবেন। আবার তিনিই তো মারবেন। স্থূল দেহে বসিয়ে রাখবেন। বুঝলেন, এটাই হল গিয়ে কৃষ্ণসাধনা।

বাবাজির কথা সাঙ্গ হলে পর আমি নাটমন্দিরে এসে দাঁড়ালাম। সেখানে এখন ভক্তসমাগম। কীর্তন চলছে। ঘোর কৃষ্ণময়তার আলোড়ন।

আনন্দময়ী আশ্রম, তারাপীঠ

তারাপীঠ আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমে বসে গিরি মহারাজ আমার চক্রগুলোকে কেন পদ্ম বলা হয় তার অধ্যাত্ম ব্যাখ্যা সারছিলেন। পাশাপাশি এটিও বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন যে, চক্রগুলোর নানা বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য।

কৌশিকী অমাবস্যার বিকেল গড়িয়ে গেছে সেই কখন। আনন্দময়ী আশ্রমে সন্ধ্যারতিও সারা হয়ে গেছে। বাইরের জনসমুদ্রের আওয়াজ এসে পৌঁছচ্ছে মন্দিরের মধ্যেও। দু—একজন অতি চেনাজানা ভক্ত নিয়ে বসে আছেন গিরি মহারাজ। আমি আর সাধনা ভৈরবী বসে বাবার পাশে।

বাবা বললেন, পদ্ম পাঁকে জন্মায় কিন্তু পাঁক দ্বারা পঙ্কিল তো হয় না। পাঁকের উপর কেমন দাঁড়িয়ে সৌন্দর্যের শোভা বিতরণ করে পদ্ম। তার পাপড়িতে কোথাওই কোনও কাদার ছিটে নেই। কাদা কী জানেন আপনি?

বললাম, কী?

কাদা হল আমাদের মায়ার প্রতীক। মায়া, কাদা ভেদ করে পদ্ম যেমন ওপরে ওঠে তেমনি আমাদের মায়া কাটিয়ে ঊর্ধ্বে উঠে যেতে হবে।

কীভাবে? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

সূর্যের আলো পেলেই পদ্ম পাপড়ি খোলে। শরীরের চক্রগুলোতেও যখন কুণ্ডলিনীশক্তি উপস্থিত হয় তখন সেগুলোও পদ্মের দলের মতোই খুলে যায়। সূর্যের বিকিরণ করা তেজেও পদ্মের দল মুড়ে যায় না। কিন্তু তার উপর জল ছিটিয়ে দিলেই পর দলগুলো সব বুজে সারা। শরীরের চক্রগুলোকে পদ্মসম মনে করার কারণ হল এই বোঝানো যে, মানুষকেও জলের উপরে থাকা পদ্মের মতো হতে হবে। পদ্মের দল যেমন জল পড়লে গুটিয়ে যায়, তেমনই বাইরের প্রভাবের বিরুদ্ধে মানুষকেও সেই পদ্মদলের মতোই তার ইন্দ্রিয় বন্ধ রাখতে হবে। তবেই সে সাধনার পথে যেতে সক্ষম হবে।

বাইরের প্রভাব বলতে কী বোঝাতে চাইছেন আপনি?

ভৈরবী বললেন, বিষয় বাসনার প্রভাব। বিষয়কে বিষ ভেবে তা থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে হবে। নানা বিষ চারদিকে। সমাজে। কামের বিষ, লোভের বিষ, মিথ্যার বিষ, ছলনা—কপটতার বিষ। এইসব বিষের পাঁক থেকে সরে এসে পদ্ম হয়ে ফুটে উঠতে হবে আমাদের। এ বড় কঠিন কাজ। শরীর শরীর। শরীরের বন্ধন নাশ সোজা ব্যাপার নয়।

বাবা বললেন, শরীর ক—রকমের, জানেন আপনি?

বললাম, আপনিই বলুন। আপনার কথা শুনব বলেই তো মায়ের সঙ্গে এসেছি।

বললেন, শরীর তিন রকমের হয় আমাদের। জানবেন।

কী কী?

করণ শরীর, স্থূল শরীর আর সূক্ষ্ম শরীর।

বললাম, শেষ দুটো বুঝতে পেরেছি। প্রথমটার অর্থ যে ধরতে পারলাম না।

এই দেহে আত্মার স্থিতি তা এসেছে যে মা থেকে। প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতি—শরীরকে মন্দির করে দিতে পারলে তবেই সেখানে পরমাত্মা বিরাজ করেন। তার আগে তো নয়।

চুপ করে গেলেন বাবা। ভক্তরা সব তার মুখের দিকে চেয়ে। তবু কিছু বললেন না বাবা।

ভৈরবী মা বললেন, আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করেন পরমাত্মা। পরমাত্মা নিজেই নিয়ন্তা। তখনই শরীর সত্ত্বগুণের হয়ে যায়। আত্মাকে করণদেহ মানলেই সূক্ষ্মদেহে পরমাত্মার বিরাজ হয়। সত্ত্বগুণ ঈশ্বরের প্রতিনিধি।

বাবা বললেন, সৃষ্টির উৎস কী, জানেন?

বললাম, কী?

সৃষ্টির উৎস মায়া নিজে। স্থূল শরীরে মায়া থাকে। শরীর যখন এই পাশে আবদ্ধ তখন সে পশুশরীর। পাশ কাটলেই শরীর পশুপতি। মহাদেব। বাবা বিশ্বনাথ।

এই বলে প্রণাম সারলেন ভৈরবী। জোরে বলতে থাকলেন, জয় বাবা বিশ্বনাথের জয়। সমবেত ভক্তের জয়ধ্বনিতে তখন আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম মুখরিত হয়ে উঠল। আর ঠিক তখনই বাবা আবার শুরু করলেন।

আমাদের এই দেহের একেক অংশে একেক ভূতের প্রাধান্য। সবার নীচে পৃথিবী। তার উপরেই জল। আগুনের স্থান মধ্যে, নাভির কাছে। বায়ু বিরাজমান বুকে। কণ্ঠে ব্যোম। ব্যোম থেকেই শব্দ আসে। পৃথিবীর চক্র কী হল তা হলে?

বললাম, মূলাধার।

বললেন, জলচক্র স্বাধিষ্ঠান। আগুন মণিপুর। বায়ুচক্র অনাহত। ব্যোমচক্র বিশুদ্ধ। এই ভূতের উপর কী রয়েছে, জানেন?

কী?

ভূতাতীত জগৎ। যার রং নেই, গন্ধ নেই, স্পর্শ নেই কোনও। রং আসছে কোথায়, জানেন?

কোথায়? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

বললেন, রং রয়েছে আজ্ঞা চক্রে। সকল বর্ণের আধার হয়ে সাদা হয়ে রয়েছে রং। এটাই হল স্থূল থেকে সূক্ষ্মে যাওয়ার সিংহদরজা। এর দ্বাররক্ষী কে, বলুন তো দেখি?

বললাম, ব্রহ্মরন্ধ্র। আপনাদের তন্ত্রমতে তা হল গিয়ে সহস্রার।

আমার উত্তরে খুশি হয়ে উঠলেন গিরি মহারাজ। সাধনা ভৈরবীর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, মা আমার, এ কাকে এনেছেন আপনি?

মা বললেন, বাবা, ওঁর সূক্ষ্মবোধ রয়েছে। কিন্তু ক্রিয়া নেই যে!

নেই কী করেই বা বলি আমি! করণক্রিয়া নেই। জ্ঞানক্রিয়া আছে।

করণক্রিয়াও আছে, বাবা। সব জীবদেহেই আছে তা। বলেন, তার প্রয়োগ নেই।

দেখলাম, মায়ের কথাতে সম্মত হলেন গিরি মহারাজ।

জিজ্ঞাসা করলাম, করণক্রিয়া শরীরে কেমনভাবে রয়েছে?

বললেন, শরীরে তো শ্বাস বয় আমাদের। যা প্রাণের কারণ।

বললাম, হ্যাঁ তো।

মা বললেন, এই শ্বাস হল শিব। প্রশ্বাসখানা শক্তি। শ্বাস হল হং আর প্রশ্বাস স। একে আমরা বলি মন্ত্র।

জিজ্ঞাসা করলাম, কীসের মন্ত্র?

এ হল অজপা মন্ত্র।

মানে?

জীবদেহের ঐশ্বরিক প্রবাহ। এই হল হংস। এই ক্রিয়া সব শররে কিন্তু যোগখানা লাগে কেবল সাধন শরীরে।

বাবা এতক্ষণ চুপ। এই প্রেক্ষিতে কিছুই বলছিলেন না তিনি।

এবার বললেন, প্রাণশক্তি আগুন। জীবনীশক্তি বায়ু। পঞ্চবোধে যখন পরম চৈতন্য জাগে, তখন আবার তিনরূপও যে জাগে।

জিজ্ঞাসা করলাম, কী কী এই তিনরূপ?

বললেন, জাগ্রত।

বললাম, মানে?

জাগ্রত হল গিয়ে শরীরের বিষয়চেতন। স্থূলদেহ ভোগ। দ্বিতীয় রূপ স্বপ্নময়। যেখানে অন্তর্বিষয় থাকে না। এই উপভোগ আসে সূক্ষ্ম শরীরে। সূক্ষ্মে এসে চেতনাও হারিয়ে যায়। তখনই পরম চৈতন্য জাগে।

বললাম, সহস্রারে তা হয়, বলছেন?

সহস্রারে দুই সত্ত্বা লীন হয়।

একটু যদি বুঝিয়ে বলেন।

শরীর জাগ্রত থাকে কীভাবে?

বললাম, দেহ আর প্রাণ নিয়ে।

আমাদের দেহ হল ব্যক্তি। এই ব্যক্তি মরলে স্বপ্নময়তা আসে। তখন চলে মানস স্তর। তারপরে মহামানস। তারপর ব্যক্তি যায় একেবারে তুরীয় দশাতে।

কীভাবে?

প্রথমে ব্যক্তি হল বস্তু। তারপর ঈশ্বরবোধ। শেষে ব্রহ্মণ।

বললাম, স্পষ্ট হল না কিছুই।

শ্লোক বললেন বাবা, আনন্দস্বরূপ অমৃত যদবিভাতি। সীমিত বুদ্ধি দিয়ে আনন্দের অমৃতের স্বাদ পাওয়া যায় না। চক্র জাগরণ বোঝা কী সহজ! চক্র হল প্রতিফলন।

কীসের?

মনের। মনকে জাগতিক থেকে মহাজাগতিকে আনে চক্র। চক্র সাধককে ভুগিয়ে মারে। চক্রকে বশ করতে পারলে শরীরে জ্বলে বিশ্বজগতের বাতি। এসব হল শক্তি তরঙ্গের লীলা, বাবা। লীলায় না এলে সবই ভাসা—ভাসা। এই যে আপনার মধ্যে স্পন্দন আছে। কিন্তু মহাস্পন্দন না এলে অসীম মহাশূন্য শরীরের সবই তো আপনার মনে হবে ধারণা। ধারণ না করলে ধারণা যাবে না, আপনার। মূলাধার—স্বাধিষ্ঠান—মণিপুরটা একটু একাগ্র হয়ে খুলুন না, দেখি। তা হলে অনেকটা বোধ আসবে আপনার। এ তো আর কঠিন কাজ নয়। তা হলেই বুঝতে পারবেন,

দেহের ভিতরে অবাক কাণ্ড।

দেহে নাচে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড।।

সুরে সুরে বললেন গিরি মহারাজ। সন্ধ্যা তখন মজে রাতের কাছাকাছি চলে আসছে। ঘড়িতে দেখলাম আটটা।

বললেন, এবার তো মহাশ্মশানে যাত্রা করতে হয়।

ভৈরবী বললেন, চলুন, বাবা। ভিড় ডিঙতে সময় লাগবে অনেক।

আমাকে বললেন, চলুন। শ্মশানে যজ্ঞক্রিয়ায় অংশ নিয়ে বসবেন। আহূতি দেবেন। মনে অনেক আলো আসবে। অনভিজ্ঞতা কাটবে আপনার। দেহের ব্রহ্মাণ্ড দেখতে দেহে যেতে হবে আপনাকে, বাবা। সঙ্গ দেহ চেনাবে খালি। কিন্তু কাজটা যে একার। শক্তিসাধক তাই কী বলছেন জানেন?

বললাম, কী?

উঠতে উঠতে মা সুরে ধরে ফেললেন :

 আপনাতে আপনি থেকো

 যেওনাকো কারুর ঘরে।

বাবাও লাইনদুটো গেয়ে উঠলেন ভাবের বসে :

 আপনাতে আপনি থেকো

 যেওনাকো কারুর ঘরে।

ভক্ত—শিষ্য সব খুশি হয়ে উঠলেন বাবা—মায়ের এই সুরের যুগ্মতায়। দু—জনেরই দরাজ গলা। তবে মায়ের গলায় সুর খেলে। বাবার রুক্ষ্ম গায়ন। সেই রুক্ষ্মতায় সুর দিয়ে আবারও গেয়ে উঠলেন মা। তাঁর পৃথুল শরীরে এবার যেন গায়নের ঢেউ খেলল। হাতে ধরা ত্রিশূলকে বেঁকিয়ে—চুরিয়ে গায়নে বাউলের ভঙ্গিকে নিয়ে এলেন তিনি :

 আপনাতে আপনি থেকো

 যেওনাকো কারুর ঘরে।

 কত মণি পড়ে আছে ঐ

 চিন্তামণির নাচদুয়ারে।।

সকলে তখন জয় মা জয় মা বলে ধ্বনি দিতে থাকলেন। তার ভেতরই চলতে থাকল সকলেরই শ্মশানে আসবার প্রস্তুতি। খালি হয়ে গেল আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম। আমরা এখন মন্দিররোডে। কৌশিকী অমাবস্যার জনসমুদ্রে।

ভৈরবী আমার পাশে পাশে চলেছেন। গিরি মহারাজ বেশ কিছুটা আগে। কিছুটা যাওয়ার পর তাঁকে আর দেখতে পেলাম না। ভিড়ের ভেতর কোথাও তিনি মিলিয়ে গেছেন।

জানি না সেটা একার রাজত্ব কি না!

আখড়া পরানপুর, খয়েরবুনি

আখড়া—শ্মশানে নেশার একটা ব্যাপার আছে। কৌতূহলী, নেশারু, মাতালদের সাধুগুরু—তান্ত্রিক সঙ্গের এও এক কারণ বটে। দুবরাজপুরের সদাননন্দ অঘোরীকে দেখতাম ঘন ঘন মদের বোতল নিয়ে ছেলে—ছোকরা, মধ্যবয়সিরা প্রসাদ করার নামে বাবার ডেরায় আসলে রীতিমতো বিরক্ত হতেন। অনেক সময় গালিগালাজ করতেন।

অঘোরী বাবা আত্মমগ্ন সাধক। সব সময় বুঁদ হয়ে আছেন। বলেন, কুলকুণ্ডলিনীর ঘর্ষণে সূক্ষ্ম শিরাদের গায়ে গা লেগেই মস্তিষ্কের ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়েই মদ ঝরে। সাধক আসলে ওতেই বুঁদ হন। তন্ত্রে নেশা তো স্থূল। ভোগ থেকে যোগে যাওয়ার।

মার্গীয় এই সত্য ধরতে শরীর সাধনা দরকার। এ তো শ্মশানে আনাগোনা করা নেশারু মানুষের কাজ নয়। তাঁরা তান্ত্রিক অঘোরীর ডেরায় আসেন একটু নেশা করবেন বলে, নিত্যকার অভাব—অভিযোগ—হতাশাকে দু—দণ্ড ভুলে তান্ত্রিকের সঙ্গে নেশার ঘোরে কিছু মোক্ষ, কখনো কবচ তাবিজ, বাণমারা—বশীকরণে সমস্যার সুরাহা হবে বলে। দুটো উদ্দেশ্য এখানে আসলেই সমাধান হয়ে যায়। তাই তাঁরা লোকালয় ছেড়ে এসব এলাকায় ঘোরাফেরা করেন।

বাউল ফকিরের আখড়ায় আবার সংসার সুরক্ষার মোক্ষ কিছু নেই। হাটে—মাঠে সারাদিন খাটা মানুষ সন্ধ্যায় চালপানি নেওয়ার সময় আখড়াবাড়িতে এসে ভিড় করেন। কেউ মুর্শেদের কালেমাকে শিরোধার্য করেন, কেউ বাজনদার, শখের গায়ক, কেউ বা কৌতূহলী কেবল।

আখড়ায় এলে গাঁজা সেবা হয় কিছুটা। নেশা হলে সারাদিনের পরিশ্রমের ধকলটা চলে যায়। ফকিরের ডেরায় অনেক বায়েত—শিষ্য আসেন একটু দম—শ্বাসের কাজ শিখে বীর্যরক্ষাটা শিখবেন বলে।

এমন মানুষ আমি দেখেছি এনায়েতুল্লা ফকিরের আখড়ায়। মুসলমান সমাজ ফকিরদের ঘৃণা করেন। বলেন, তারা বেনামাজি। রোজা রাখে না। আর গান এবাদত তো ইসলামে নিষিদ্ধ।

হিন্দুরা বাউল আখড়ায় যান। ফকিরি আখড়া নিয়ে তাঁদের অনেক ছুৎমার্গ আছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা শরিয়ত মুসলমানদের মতো সহজিয়া, জাতবৈষ্ণবদের হেয় করেন।

বলেন, ওরা বারোজেতে। জারজ। বাবাজি সেজে সেবাদাসী নিয়ে লীলা করে।

হিন্দু বর্ণাশ্রমী এখানে হল গিয়ে সেই মুসলমানদের শরিয়ত শ্রেণি। গ্রামাঞ্চলে এই যুগি, সুবর্ণবণিক, বৈশ্য, চাষি, কৈবর্ত, জেলে, জোলা, নিকিড়ি, নলুয়া, মালো, মিস্তিরি, শুড়ি, মাঝি, কাহারদের যে বিস্তৃত এলাকা—নিম্নবর্গীয় হিন্দু ও মুসলমান শ্রেণির—তাদের ঘরের পুরুষ মানুষরা শিষ্য—বায়েত ফকির বাউলদের।

অভিজাত মানুষদের ধার মাড়ানোটা নিছক কৌতূহলের। যেখানে একটু আরাম করে নেশাবস্তু সেবনটাই বড় কথা। ফকিররা অনেকে বিষ ঝাড়তে পারেন, গাছগাছড়া চেনেন, ওষুধপত্র দিতে পারেন।

তান্ত্রিক অঘোরীরাও তাই। এঁদের কাছে নিম্নবর্গীয় সমাজের সেজন্য প্রত্যাশা পেট—বাঁধানো নারীর ভ্রূণের খালাস, বাঁজা মেয়েমানুষদের সন্তান, খোজা পুরুষের সক্ষমতার শক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। যেজন্য বাড়ির বউ—ঝি—রাও এসব এলাকায় মাঝে—সাঝে যাতায়াত করেন।

পরানপুর, করিমপুরের এনায়েতুল্লা ফকিরের কাছে তাই কিছু জোয়ান মরদ আসতে দেখেছি। যারা শ্বাস শেখে, কণ্ডোমহীন মিলনে বীর্যবস্তু ঊর্ধ্বরেতা করে নিতে চায়। কেননা অশিক্ষিত শরিয়তবাদী তারা। মোল্লা—মৌলভি বলেছেন, আল্লার দানে কণ্ডোমের বাঁধা দিতে নেই। শ্বাসের বাধায় বীর্যরক্ষার দোষ নাই।

তাই ফকিরের ডেরায় আনাগোনা। তবে শুধু লোকায়ত ধর্মের আখড়া ডেরা তো খালি নয়। অধ্যাত্মবাদে, ধর্মসাধনার দ্বারে নেশার ব্যবহার অতি প্রাচীন কাল থেকেই।

বৈদিক আর্য ঋষি সোমের নেশা করতেন। ‘ঋকসংহিতা’য় আছে—ভঙ্গঃ।

ভাঙ খেয়েই তো ইন্দ্র বৃত্রের উপর বিজয় লাভ করলেন, সিদ্ধ হলেন। ভাঙের তাই আরেক নাম বিজয়া বা সিদ্ধি।

সাধুদের মাঝে সেই থেকেই ভাঙের চলন। অনেক সাধক বলেন, চিত্তের একাগ্রতা আনতে নেশাদ্রব্যের জুড়ি নেই। চিত্ত আবিষ্ট হয়, আকাশবৎ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। যোগসাধনায় তখনই বৃহত্তর অনুভূতি আসে। যোগের সঙ্গেও নেশাবস্তু জড়িয়ে।

তাহেরপুরের দয়াল বাবা একশো পেরোনো তান্ত্রিক সাধক। সারাদিনে কিছুই খান না। একটু দুধ।

আমি গেলেই বলেন, গাঁজা সেজে দে, তুই।

বললাম, গাঁজা খেলে কী হয়?

বললেন, তুই খা দিখিনি। গাঁজায় বীর্যবস্তুর স্থিরতা আসে। যোগসাধনায় বীর্যের স্থিরতা এলেই সহজে ঊর্ধ্বরেতা হয়। সিদ্ধি। তুই অভ্যাস কর।

এই বলে বাবা আমাকে ইয়া বড় কলকে ধরে টানা শিখিয়ে দিলেন। পারি না। টানতে গিয়ে দেখলাম দম লাগে বেশ। যোগসাধনা আদতে তো সেই দমের কারবার।

খয়েরবুনির সনাতন দাস বাউল বলতেন, গাঁজায় খিদে আসে না। দমের ধোঁয়ায় দেহস্থ বায়ুও উজানে বয়ে যায়। পেটের রোগ হয় না।

তান্ত্রিক মদ খান পঞ্চমকারের সাধনায়। তবে অনেক সাধক বলেন, মদ জলীয়। জলে বস্তু নীচে ঠেলে দেয়। বীর্যরক্ষা তখন সহজ নয়। দেহ, দেহজ রিপু, কামকে ধরেই এই সাধনা। কাম মহাকামে আসে। রূপান্তরিত হয় প্রেমে।

এ যে বড় শক্ত সাধনা। ব্যভিচারী, নেশারু ছাই বোঝে। তারা রিলে রেসের মতো গাঁজা টানে, মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে শ্মশানজমিতে।

সাধনবেলা বয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *