রাঙ্গা কমল রাঙ্গা করে
হেম আশ্রম, কুষ্টিয়া
হেম আশ্রমে বাৎসরিক তিনদিনের সাধুসঙ্গ হয় মার্চ মাসে। নহির শাহের সাধনসঙ্গিনী রওশনারা ফকিরানির স্মৃতিবার্ষিকী হিসেবেই হয়ে আসছে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের প্রাগপুরে অবস্থিত হেম আশ্রমের সাধুসঙ্গ। হেম আশ্রমে থাকতেন রশিদা ফকিরানি। তাঁরও চলে যাওয়া এই মার্চ মাসেই।
নহির শাহ বলেন, প্রতিবছর এই সাধুসঙ্গের মাধ্যমে আমরা সাঁইজির বাণী ও সুরের মাঝে আমাদের দুজন প্রয়াত সঙ্গীকে স্মরণ করি। কেননা মৃত্যু কোনও শোকের ব্যাপার নয়, মৃত্যু জিনিসটাই তো আনন্দের।
আমি চমকে উঠি নহির শাহের কথায়। আশ্রমে সাধুসঙ্গ শুরুর প্রস্তুতি চলতে থাকে। উন্মুক্ত সাধুসঙ্গ। নানা ঘরের ফকির—সাধুরা সব জড়ো হন। বৈষ্ণবরাও আসেন।
শুরুতে পাঁচটি আসন পেতে পাঁচ ঘরের প্রবর্তকদের নামে পাঁচ পদের সেবাসামগ্রী সাজিয়ে ভক্তি দেন লবান শিষ্য নহির শাহ। একে একে ভক্তি নিবেদন করেন রওশন ফকির, মোহররম শাহ, আমিরুল ফকির, সামছুল ফকির, রঞ্জনা ফকিরানি, টুনটুন ফকিরসহ ঘরের বায়েত ফকিরেরা।
খৈলশাকুন্ডির জ্যোতিধামেও সাধুসঙ্গ শুরুর আগে পাঁচ ঘরকে ভক্তিপ্রদানটাই রীতি। লবান শাহ আমাকে বললেন, এই তরিকা তো সাঁইজি প্রবর্তিতই। লালন ঘরে আমরা তাই এইসব মাইন্যা—মুইন্যা চলি।
বললাম, লালনের ঘর বলতে কী বোঝাতে চাইছেন আপনি?
আখড়াবাড়িতে বসে লালনের যিনি সাক্ষাৎ শিষ্য ভোলাই, ভোলাইয়ের শিষ্য কোকিল, কোকিলের শিষ্য লবান শাহ ফকির আমাকে বললেন, লালনের ঘর বলতে পাঁচটা ঘরকে বুঝায়।
বললাম, কারণ?
লবান শাহ বললেন, নিজের ঘর ছাড়াও সাঁইজি আরও চার ঘরকে ভক্তি দিতেন। প্রথম ঘরই হইল গিয়া ঘোষপাড়ার, সতী মায়ের। তাই তো ছুটে আসা।
বললাম, সাঁইজির চৈতন্যদেবের লৌকিক উদারতা পছন্দ ছিল। সেজন্যই তিনি গৌরগান লিখেছিলেন। সতী মায়ের ঘরে আউলেচাঁদের ভেতর সেই লৌকিক উদারতা ছাড়াও চৈতন্যের অবতারত্ব মিশেছে বলেই বোধহয় লালন সাঁই এই ঘরকে পছন্দ করতেন।
বললেন, দ্যাখেন, অতশত তো বুঝি না। ভাব নিয়া চলি। সাধক হইল গিয়া ভাবের বান্দা। পাঞ্জুর ঘরে, উজল চৌধুরী ও তাঁর বায়েত জহরউদ্দিন শাহের ঘরে, দেলবার শাহের ঘরে সাঁইজির তরিকার ভাব আছে বইল্যাই আমাদের সাধুগুরুরা মান্যতা দেয়।
সাঁইজির ঘরে একবার যেতে চাই।
মাজারে এখন দলাদলি। ভাববাদী নাই কুন। জ্ঞানের পথে মাজার। সাঁইজির কবর পূজা হয় অ্যাহন। আমাগো ঘরে মৃত জিনিসের পূজা নাই।
সতীমায়ের ঘরেও দেখলেন তো বিগ্রহ পূজা চলছে?
গুরু জানবেন আপনে জিয়ন্ত। তাঁর তো নাইয়র নাই। গুরুর ভাবের মৃত্যু তো নাই। ওইসব মাজার, সমাধি—দুই দ্যাশের প্রশাসনিক তৎপরতা, জ্ঞানবাদীদের ফায়দা লোটার জায়গা হইছ্যে। কার্তিকে আসেন। দ্যাখবেন সব লালন ঘরের ফ্যাকড়া ফকিরেরা মাজারের বাইরে। প্রশাসন আসল গো খেদাইয়া নকল পুষতাছ্যে।
বললাম, যাব। কার্তিকের পয়লায় তো সাঁইজির তিরোধান। ওই সময় গেলে অনেক সাধুসঙ্গ হবে।
লবান শাহ সায় দিলেন। হাসলেন। তারপর বললেন সাধনার সেই গোপন কথা, বুঝলেননি, কার্তিক হইল গিয়া ভাবের মাস। ওই মাসে দেহের ডাক পড়ে। দেহরক্ষার জন্যিই তো ভজনসাধন। লালন ঘরের সাধক তাই চান সাঁইজির মতনই তাঁর কার্তিকেই নাইয়র হোক।
আমার ছেঁউড়িয়া যাওয়ার আগেই খবর হল, লবান শাহ দেহ রেখেছেন সাঁইজির প্রস্থানের পর পর। ভাবলাম, সাঁইজি সাধক—বায়েতের মনের বাসনা শুনেছেন। কার্তিকের মাঝামাঝিতেই তাঁর নাইয়র হল। আর মনের কোণে ভিড় করে এল কত কথা।
ফকির লবান শাহের কাছেই তো শুনেছি তালাচাবির গল্প :
তালা মারা কালেমাতে
চাবি রয় মুর্শিদের হাতে
মুর্শিদ ছাড়া খুলবি কেমন করে?
ফকিরি ধর্মে তাই জাহের নেই, সবটাই বাতুন। তালা চাবি হল গিয়ে গুরু শিষ্যের বোঝাপড়া। গুরুর কাছেই কালেমা—বাক্যের চাবি। সত্যের অভিজ্ঞতা নিয়ে মুর্শেদ বসে আছেন। যে বিষয় নিজেকে প্রকাশের, আত্মতত্ত্বের সেই কালেমা তিনিই জানেন। বায়েতকে সেই বাতুনি মুর্শেদ জানান জাহের করে নয়, আখড়াঘরের গোপনীয়তায়। তাই লালনের ঘরের মানুষ, মুরিদ ফকির লবান শাহকে যখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালন নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি রেগেই যান।
বলেন, আমরা কী লালন সম্পক্কে কিছু জানি! আমরা কী ওনার কবর খুঁইড়া দেখছ্যি যে লালন ওখানে আছেন কী নাই! আমরা তো একটা ভাবের, গুরুনামের উপরে দাঁড়ায়া আছ্যি।
প্রাগপুরে নহির শাহের হেম আশ্রমে ঘরের ভক্তিদানের তরিকা দেখে ভাবি, লালন ঘরে দাঁড়াবার জায়গা তো আসলে এটাই।
ফকির নহির শাহ এখন বাংলাদেশের একজন প্রবীণ সাধক ও লালন ঘর অনুসারী। লালন সাঁইজির সঙ্গে ওঁর উত্তরাধিকার সম্পর্ক লতিকার পর্যায়ক্রমটি হল গিয়ে এরকম—ফকির লালন শাহ, ভোলাই শাহ, কোকিল শাহ, লবান শাহ, তারপরেই ফকির নহির শাহ। লবান শাহের অন্যতম এই সাক্ষাৎ শিষ্য এখন আধ্যাত্মিক গুরু, ভাবসংগীত শিক্ষক ও সংগীত সংগ্রাহকও বটে। ১৯৭১ সালে তিনি দেশের প্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। ‘৭৪ সালে লবান শাহ ফকিরের কাছ থেকে কালেমা নিয়ে রওশনারা ফকিরানিকে সাধনসঙ্গিনী করে গুরুর আশ্রয়েই সাধনা শুরু করেন জ্যোতিধামে। ‘৯৪ সালে কুষ্টিয়ারই প্রাগপুরে গড়ে তোলেন নিভৃত সাধনভজনের জন্য হেম আশ্রম। বাংলাদেশে তাঁকে নিয়ে ইতোমধ্যেই নির্মিত হয়ে গিয়েছে দু—দুটো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র—’ভুবন মাঝি’ ও ‘সহজ মানুষ’।
লবান শাহের ঘরে, সাধুসেবায় নারীপুরুষ, শিশুযুবাবৃদ্ধ নির্বিশেষে একযোগে শতাধিক মানুষ তিনবেলা খাদ্যসেবা গ্রহণ করেন গৌরপূর্ণিমা ও লালন সাঁইজির তিরোভাব দিবসে আয়োজিত মিলনোৎসবে। লালন ঘরের সাধুরা সব মাছ খান। কিন্তু লবানের আখড়াবাড়িতে সেবা সম্পূর্ণ নিরামিষ। অন্ন, চার—পাঁচ রকমের সবজি দিয়ে বানানো তরকারি আর ডাল। অতিরিক্ত সেবাদ্রব্য হিসেবে যুক্ত হয় পায়েস ঘরের ফকির সাধুরা আখড়ায় এলে।
সেবা নিতে নিতেই লবান বলেন, খাদ্যখাবারের মধ্য দিয়াই মহাপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পক্ক গইড়া ওঠে। দেহের মধ্যে বাস করেন যে পরম, তাঁর সেবাই সাধুসেবা।
সাধুসঙ্গে সেবা নিতে নিতে নহির শাহকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা মাছ খান না কেন? লালন সাঁই তো শুনেছি মাছ খেতেন।
নহির শাহ বললেন, সাঁইজি কী খেতেন, না খেতেন তা তো কেউই আমরা দেখিনি। তবে একথা সত্য লালন ঘরানায় মাছ চলে। আমিও তো খেতাম।
ছাড়লেন কেন তবে?
আমার গুরু লবান শাহ একদিন মাছ খাওয়াটা নিষিদ্ধ করলেন। জ্যোতিধামে গুরু শিষ্যদের মধ্যে আলোচনা চলল সেদিন। তারপরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, সেবার পদ থেকে মাছ পদ উঠিয়ে নেওয়া হল।
বললাম, কেন?
বললেন, এতে তো আমি ক্ষতি কিছু দেখছিনা কো। মাছে ভাতে বাঙালি। সেটা তো সমস্যা নয়। কেউ খেতে চাইলে খাবে। লালন ঘরের সাধুরা তো উজানে ধাওয়া মাছ খায়। নদীর পানির মাছ সাধু ফকিরের খাদ্য জানবেন। পুকুর বা বদ্ধ জলার মাছ সাধনায় নিষিদ্ধ।
কারণ?
সেবা নিচ্ছিলেন নহির শাহ আমার পাশে বসেই। অন্নের ভেতর ব্যঞ্জন জড়িয়ে নিতে নিতেই বললেন, জানবেন সাধুরা কেবলমাত্র দেহকে সন্তুষ্ট রাখতেই খাবার খান। রুচির জন্য খান না। সাধুরা তাই সব সময় খেয়াল রাখেন খাবার যেন দেহকে বিরক্ত না করে। আমার গুরু বলতেন, খাদ্য হল দেহের ঔষধ। এর বেশি কিছু নয়।
আমি ভাতের গরাস তুলি তখন।
নহির শাহ বলেন, আপনি এবার সেবা—পঙক্তি খেয়াল করুন।
দেখি, পরম ভক্তি নিয়ে সাধুরা সব এখানে সেবা গ্রহণ করছেন।
নহির শাহ বললেন, সাধুগুরু যখন সেবা নেন, সেবার সময় তিনি এর উৎপাদকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে সেবা ভক্ষণ করেন।
বললাম, এটা করা হয় কেন?
সেবার মাঝে তামার ঘটি থেকে খানিক পানি গলায় ঢেলে নিলেন নহির শাহ ফকির। এক পঙক্তিতে বসেছি আমরা সকলে। টুনটুন ফকির, একতারা সাঁই, রঞ্জনা ফকিরানি।
বুঝলাম, কথা বলার সুবিধার্থে ফকির গলাটা একটু ভিজিয়ে নিলেন। সুঠাম চেহারার তিনি। চোখে সব সময়ই দেখছি কেমন এক নির্লিপ্ত ভাব লেগে। সবই করছেন তিনি। এত বড় সাধুসঙ্গের তদারকি। অথচ কর্ম থেকেই যেন ওঁর মন তোলা রয়েছে ওই ভাবের ঘরে। আমি অবাক হয়ে যাই।
বললেন, বুঝলেন না, পৃথিবীর খাদ্যচক্রে আমরা সক্কলে তো একে অন্যের খাবার। এ কথাটা যখন ধরতে পারবেন তখন আর খাদ্যের জন্য রসনাই তৈরি হবে না আপনার মনে। খাদ্য হয়ে উঠবে সেবা। আর আমার গুরু বলতেন, আমাদের সেবায় সমতা আসুক না। সাধুসঙ্গে কত বৈষ্ণবীয় ধারার সাধুরা আসেন, তাঁরা অনেকেই মাছ খান না বলে সেবা নেবার সময় একটা বিড়ম্বনা গড়ে ওঠে। সব দিক ভেবে তাই আমাদের সাধুসেবা থেকে লবান শাহ মাছ পদ উঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখনও সেইভাবে চলছে। সাধনা হল উজানে চলার। সেথায় শরীরে হরেক খাদ্যদ্রব্য পুরে যদি শরীর বোঝা হয়ে পড়ে তাহলে সাধুগুরুর জানবেন সব বৃথা গেল। ফকিরি করার অর্থটা কী, বোঝেন?
বললাম, কী?
নহির শাহ বললেন, ফকিরি হল গিয়ে দেহরসের কারবার। দেহরসকে কখনো নিম্নগামী করে না ফকিরে। সেজন্যেই উজানের সাধনায় লালন ঘরে স্রোতের মাছ খালি চলে। সেই মাছ খেলে মাছের প্রকৃতি শরীরে ঢোকে। খাদ্য থেকে রসনা নয় খালি, খাদ্যের প্রকৃতিটা নিতে হবে আমাদের শরীরে।
বলি, সাধনায় শরীর সম্বন্ধে আপনার অভিমত কী?
সেবা নিতে নিতেই নহির শাহ বলেন, আমি তো সকলকেই বলি, শরীরকে বোঝা কোরো না। মনের ভারে হাঁটো।
আমিও হাঁটতে হাঁটতেই দেখি বাউলের লালনশাহী, পাঞ্চশাহী, দেলবারশাহী, উজল শাহ চৌধুরী এবং পাঁচুশাহী ঘর। পাঁচু শাহ আমাদের সতী মায়ের ঘরানা। মানিকগঞ্জে আছে আবার দেওয়ান রশীদের ঘরানা।
সব ঘরানাতেই আমি হাঁটতে থাকি। হাঁটাই আমার কাজ :
আমার হয় না রে সে মনের মতো মন
আগে জানব কি সে রাগের কারণ।
মহাশ্মশান, তারাপীঠ
কৌশিকী অমাবস্যা। তারাপীঠে আজ তিল ধারণের জায়গা নেই। বিকেল গড়াতেই অজস্র মানুষ। সাধু—সন্ন্যাসী, তান্ত্রিক, ভৈরবী, সাধারণ মানুষ। মন্দির রোডের উপর একটা চায়ের দোকানে বসে আছি। গতকালই এসে পৌঁছেছি। দোকানদার চা দিতে দিতে বললেন, এখনই যা অবস্থা। মহাশ্মশানের যজ্ঞে আজ মানুষের সমাবেশ দেড়—দু’লাখে চলে যাবে।
চারধারে থিক থিক করছে লোক। এর মাঝেই বসে আছি আমি আর সাধনা ভৈরবী। বেশকিছু ভক্তশিষ্যের জমায়েত হয়েছে এখানে ভৈরবীর কারণে। সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভৈরবীর কথা শুনছিলেন। তাঁর বলবার ধরনটিও সুন্দর। অদ্ভুত এক আকর্ষণশক্তি মিশে আছে কথার ভেতরে। থেমে থেমে মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে যেন কিছু চিন্তা করে কথা বলছেন ভৈরবী। চেহারাতে যথেষ্ট ঔজ্জ্বল্যের ভাব আজ আর নেই। তবে বেশ বোঝা যাচ্ছে একসময় তিনি গৌরবর্ণা ছিলেন। অযত্নে সেই রং এখন অনেকটাই তামাটে হয়ে এসেছে। এক ভক্তের অনুরোধেই ভৈরবী কৌশিকী অমাবস্যার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছিলেন। হাতে তখনও তাঁর চায়ের গ্লাস।
বললেন, কৌশিকী দেবী ভাদ্রমাসের অমানিশাতেই জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন। তাই এই অমানিশা কৌশিকী অমাবস্যা নামে খ্যাত। এই দিনে মা তারার পুজো করাও পুণ্যের কাজ। মা—কে পুষ্পাঞ্জলি দিলে, ভক্তিভরে ডাকলে জীবনে প্রাচুর্যের উদবেলিত হাওয়া এসে লাগে। এরই সঙ্গে মহাশ্মশানে যজ্ঞ ও দ্বারকাতে স্নান করলে কুম্ভে স্নানের ফল লাভ হয়। মৃত্যুভয়, দুশ্চিন্তা, নৈরাশ্য, অশান্তি, সমস্যা—এসবের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
কথাগুলো বলেই চোখদুটি বন্ধ করে নিলেন ভৈরবী। মনে হল যেন কিছু চিন্তা করছেন। শ্রোতারা সব তখন অধীর অপেক্ষায় বসে। ধীরে ধীরে চোখ খুললেন এবার ভৈরবী। পথচলতি মানুষের আওয়াজ গাঢ় হচ্ছে। ভিড় বাড়ছে তারাপীঠে। দু—একজন দাঁড়িয়েও পড়ছে ভৈরবীর আকর্ষণে। সেদিকে তাঁর ভ্রূক্ষেপ নেই। নিমগ্না হয়ে রয়েছেন তিনি মায়ের মাহাত্ম্য বর্ণনায়, চিন্তাস্রোতকে খুলে নিয়ে আবারও বলতে থাকলেন ভৈরবী।
দেবী কৌশিকীর নাম চণ্ডীতে আছে। মহিষাসুরকে বধ করলেন দেবী দুর্গা। দেবতারা সব নিশ্চিন্ত হলেন। কিন্তু সেটাও বা ক’দিনের জন্য। শুরু হয়ে গেল শুম্ভ আর নিশুম্ভের অত্যাচার। দেবতারা তখন সব স্বর্গ ছাড়তে বাধ্য হলেন। স্বর্গরাজ্য উদ্ধারের জন্য দেবদেবীরা সবাই দেবভূমি হিমালয়ের দেবী মহামায়ার স্তব করতে থাকলেন। দেবী সন্তুষ্ট হয়ে শুম্ভ—নিশুম্ভ নিধনে নিজের দেহকোষ থেকে এক পরমাসুন্দরী দেবীমূর্তির জন্ম দিলেন। এক উজ্জ্বল জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। নিজের শরীরের কোষ থেকে জন্ম হল বলে দেবীর নাম কৌশিকী। গায়ের রং তপ্ত কাঞ্চনের মতো। কৌশিকী দেবীর শরীর থেকে বের হওয়ার পর দেবী মহামায়ার গায়ের রং হয়ে উঠল কালো। তাই তিনি কালিকা নামে হিমালয়ে রয়ে গেলেন।
কথার ফাঁকেই আস্তে আস্তে চুপিসাড়ে সন্ধ্যা নামছে। ভৈরবীর কাছে গল্পকথা শুনে মানুষজন সব একে একে আগলা হচ্ছে। রাস্তায় গিজগিজ করছে লোক। কারও কারও হাতে প্যাঁড়া, ফুল, মালা, আলতা—সিঁদুরের ডালা। সন্ধ্যাপূজায় মা—কে নিবেদনের জন্য। আমি বসে ভৈরবীর পাশে। দোকানদারকে আরও একপ্রস্ত চা দিতে বললাম। সঙ্গে বিস্কুট।
ভৈরবী বললেন, আমি কিন্তু শুধু চা। চিতাহোমে বসব আজ। তার আগে পানীয় ছাড়া কোনও খাদ্যবস্তু আমি কিন্তু গ্রহণ করি না।
বললাম, তন্ত্রসাধনার উৎকৃষ্ট স্থান হিসেবে কেনই কেবল শ্মশানকে বাছা হয়?
চুপ করে গেলেন সাধনা ভৈরবী। কিছুপর চায়ে একবার চুমুক দিয়ে বললেন, শ্মশান কীসের প্রতীক বলে মনে হয়?
ভৈরবীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিনিবদ্ধ চোখের তারা তখন আমার চোখেই যেন থমকে আছে। এমনই তাঁর চাহনির মাদকতা।
চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম আমি, মৃত্যুর।
পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন ভৈরবী।
কিসের মৃত্যু?
উত্তর দিলাম এবার, শরীরের।
বোধহয় খুশি হলেন ভৈরবী। তাঁর চোখে—মুখে আনন্দের আলোর এক সঞ্চার আমি যেন দেখলাম তারাপীঠের সন্ধ্যায়। সন্ধ্যারতি শুরু হয়ে গেছে। মায়ের কাঁসর—ঘণ্টার আওয়াজ মাইকে বেরিয়ে আসছে সজোরে। ভৈরবীও একবার ‘জয় মা জয় মা’ বলে লাফিয়ে উঠলেন, দোকানিও বুকের কাছে দু—হাত জোড় করে দোকানে ঝোলানো তোরা মায়ের ছবির দিকে তাকালেন। দু—একজন খরিদ্দারের একান্তে গল্পগুজবের মুহূর্তটিকেও নিজে হাতে নিয়ে নিলেন ভৈরবী। সবাই তখন মায়ের দিকে ফিরে কিছু শুনবার অপেক্ষায়। এমনই তাঁর সম্মোহনী শক্তি।
বললেন, শরীর যেখানে চিরতরে শুয়ে থাকে, শয়ন করে তাই হল গিয়ে শ্মশান। তন্ত্রে শ্মশান হল গিয়ে বিনষ্ট করে ফেলা শরীরকে। শরীর যোগে বিনষ্ট করতে পারলে, স্থূলতা নষ্ট করে নিতে পারলে তবেই শরীরের মৃত্যু। এই যে শ্মশানে শ্মশানকালী পূজিতা হন, কী কারণে তিনি পূজিতা হন?
বললাম, মায়ের ধ্বংসময়ী রূপ শরীরের স্থূলতাতে বিনাশের জন্যই।
একেবারে ঠিক। শ্মশানকালীর দুই হাত কেন?
কেন?
এক হাতে তিনি শরীরের স্থূলতাকে ধ্বংস করেন আর আরেক হাতে সূক্ষ্ম শরীরের প্রাপ্যযোগকে সাধকের হাতে তুলে দেওয়ার ইশারা করেন।
বললাম, সে তো প্রতীকময়তার ইশারা।
ভৈরবী বললেন, তন্ত্র তো প্রতীক অধ্যায়। তাকে পড়তে—জানতে—শিখতে হয়। তন্ত্র তো বইতে লেখাজোখা কোনও কিছু আসলে নয়। তন্ত্র শরীর লেখে। শরীরের শক্তিকে তুলে ধরে। গুরু সেই শক্তির আলোকে নিয়ে আসেন। চিত্তকে কামনা শূন্য করতে শেখান গুরু। চিত্তের এই নাশকতা তো শ্মশানস্বরূপ। শরীরকে শ্মশান করে নেওয়ার জন্যই তো তান্ত্রিক বসেন গিয়ে শ্মশান সাধনায়। চিতাহোমে।
জিজ্ঞাসা করলাম, চিতায় বসে হোম করার অর্থ কী একটু যদি বুঝিয়ে বলেন?
বললেন, চিতা তো ধ্বংসময়তার প্রতীক। শরীরকে নাশ হতে সাহায্য করে চিতা। তন্ত্রে নাশ শরীরের স্থূলতার বিনাশ। তাই সেই বিনাশশক্তির মাঝে বসেই আমাদের যাবতীয় স্থূলকায়াকল্পকে নষ্ট করতে হয়। ধ্বংস করতে হয়। ধ্বংস আগুনকে ইশারা করে। আগুন হোমকে। অগ্নি প্রজ্জ্বলন হল শরীরের ভূতাগ্নিকে সক্ষম করার জন্য বাহ্য আগুনের অবয়ব। হোমে যে শক্তি প্রয়োগের কথা বলা হয় তা আমাদের চেতনার শক্তিকেই জ্যান্ত করবার জন্য বিশ্বাস। যে বিশ্বাসে মানুষের ছুটে আসা তারাপীঠে। পুণ্যতিথিতে শক্তিস্থানে। আসলে আমরা তো কোনও না কোনওভাবে শক্তিমত্তার বিকাশ চাই। এই যে আজ তারাপীঠে গিজগিজ করছে জনতা—জনার্দনের শক্তি।
চোখ বুজলেন ভৈরবী। অদ্ভুত একটা শান্ত ও স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে প্রায় সকলের দিকে একবার চোখে চোখ মেলালেন। একটু স্মিত হাসি হাসলেন।
বললেন, এবার আমায় উঠতে হবে। আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমে একবার যাব। সেখানে গিরি মহারাজ এসেছেন।
তারপরই আমার দিকে ফিরে তাকালেন ভৈরবী। জনতা—জনার্দন আস্তে আস্তে ভৈরবীর সম্মোহনীশক্তির বাইরে বেরিয়ে গেলেন। আরও বিপুল জনস্রোতে মিশে গেলেন সবাই। আমিও তখন উঠবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভাবছি এইবার মহাশ্মশানের দিকেই যাব। অজস্র সাধু—তান্ত্রিক—ভৈরবী এসেছেন। তাঁদের মধ্যেই এক—আধজনকে খুঁজে নিয়ে একটু সঙ্গ করবার ইচ্ছে জাগছে মনে। যদিও গতকাল রাতে ভৈরবী আমাকে বলেছিলেন, বুঝলেন, তারাপীঠ এমনই জায়গা যেখানে ভালো—মন্দ দু—রকমই আছে, আবার এমন বয়স্ক তান্ত্রিকও রয়েছেন যাঁর সঙ্গ করলে শান্তি আসে মনে। তবে সঠিক মানুষটিকে চিনে বের করে নিতে হবে। না হলে আপনার জিজ্ঞাসার আধার সব বৃথা যাবে।
উঠতে উঠতে এই কথাগুলো যখন ভাবছি তখন দেখি ভৈরবী মন্দির রোডের উপর গিজগিজে ভিড়ের ধারে ঠায় দাঁড়িয়ে। হাতে তাঁর ত্রিশূলের চকমকি অনেক মানুষই দেখে প্রণাম সারতে সারতে এগিয়ে যাচ্ছেন। দু—একজন কুশল বিনিময়ও করছেন।
উঠবার সময়ই দোকানদার বললেন, মায়ের পেছনে সেটে থাকুন একেবারে। ঠিক লোকের সঙ্গ নিয়েছেন। তারাপীঠের মহাসাধক শঙ্কর খ্যাপার শিষ্যা। বহু সাধকসঙ্গের অধিকারিণী।
বললাম, সঙ্গে না নিতে চাইলে কি শুধু শুধু অনুসরণ করা যায়? যাই দেখি…
এই বলে এগোতেই একজন বললেন, মা আপনাকে ডাকছেন।
এগিয়ে গেলাম।
বললেন, কোথায় আর যাবেন! চলুন আমার সঙ্গে আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমে। গিরি মহারাজের সঙ্গে কথা বললে আপনার অনেক জিজ্ঞাসারই নিরসন হয়ে যাবে। তবে শুধু কথায় কী হয় বলেন? গুরু ধরেন, গুরু। এই দেহ হল শ্মশান—সমান, গুরু এসেই মন্তর দিয়ে করবেন ফুলের বাগান।
নবপ্রাণ আখড়া, কুষ্টিয়া
প্রেমানলে মন পোড়ানো সহজ কথা তো নয়। যে পারে, ভাষা সেখানে অন্তরায় হয়ে ওঠে না। দুনিয়াজোড়া প্রেমের ভাষাখানাই তো এক। দোবরা সেখানে কী ভাষায় কথা বলল সেটা বড় কথা নয়।
কথাগুলো ফকির নহির শাহের। নবপ্রাণে তখন সাদা থান পরা ছিপছিপে দোবরা গুরুর পাশটিতে চুপ করে বসে। ফ্রান্স থেকে এসেছেন দোবরা লালনের গান আর মারফতি ধারার প্রতি কৌতূহলী হয়ে। গুরু করেছেন লালন—পরম্পরার নহির শাহকেই।
বছর পাঁচেক আছেন দোবরা লালন শাহের কুষ্টিয়ার আখড়ায়। গোটা নদিয়া হেঁটেছেন গুরুর হাত ধরে। থাকতে থাকতে সামান্যই কুষ্টিয়ার ভাষা রপ্ত করেছেন। এখনও টানা বাংলা বলতে না পারলেও ধরতে পারেন বাংলা কথা।
গুরু বলেন, মানুষের কল্যাণে তো অনেক দেবতা, নবি, রসুল সব এসেছেন। সকলেই এসে বলে গিয়েছেন তাঁদের মতটারে অনুসরণ করতে। আমি বলি পুরো অন্য কথা।
জিজ্ঞাসা করি, কী?
নহির শাহ বলেন, তুমি শুধু তোমাকেই দ্যাখো। তোমাকেই ভালো করে বোঝ। তোমাকেই জানো, চেনো। আগে আপনারে চিনতে পারলে যাবে অচেনারে চেনা। এই হল গিয়ে লালন ঘরের সাধন তরিকা।
বললাম, আপনি তবে লালন হয়ে উঠতে বলছেন?
ময়লা চেহারার নহির। রবীন্দ্রনাথের মতোই সুসজ্জিত সাদা দাড়ি। মাথায় লালন ঘরের উষ্ণিক। বসে আছেন আখড়ায়।
দোবরা মন দিয়ে শুনছেন গুরুরই কথা।
গুরু বললেন, শুরুতেই আপনি কিন্তু মস্ত বড় একখানা ভুল করে বসলেন।
স্বভাবসুলভ জিজ্ঞাসায় বললাম, কী?
নহির শাহ বললেন এবার, লালনের কোনও ধর্ম নেই। লালন হলেন মুক্ত মানুষ। তাঁর আছে হয়ে ওঠা। ফকিরিটাই হয়ে ওঠা। জীবন দেখানো।
ভাবি আমি, মুক্তিযোদ্ধা নহির সত্যিই তো হয়ে উঠেছিলেন! বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই তিনি চলে এলেন গুরু আশ্রয়ে।
আশ্রয়ে আসার আগেই বিবাহ হয়েছিল নহিরের। দুই সন্তানকে নিজের হাতে কবরে মাটি দিয়ে তিনি এলেন খৈলশাকুন্ডিতে লবান শাহের আখড়ায়।
নহির শাহ বললেন, আমার গুরু বলতেন লবন জমিতে যেমন কখনো গাছ হয় না, তেমনই দেহের ত্রুটি নিয়ে তো সাধনাও চলে না।
কথা শুনে নড়ে উঠলাম আমি।
ধরতে পারলেন ফকির।
বললেন, ওতে অবাক করা কিছু নেই। গুরুর কালেমায় সত্য থাকে খালি। সত্য আছে চারণ পাঠে। বই পুস্তকের সত্য আপনাকে বিভ্রান্ত করতে পারে। গুরুর বলা সত্যতে আপনি কখনো বিভ্রান্ত হবেন না। কেননা গুরু তো এই সত্য পেয়েছেন সাধনা করে। নিজেকে চিনে। গুরুর কালেমায় শুধু থাকে নিজের অভিজ্ঞতার পথ। সেই পথে গেলেই আপনার মারফত আসতে পারে।
বললাম, মারফত কী?
বললেন, মারফত হল দেহকাজে অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য জ্ঞান। যা পুস্তকের ভেতর কখনো লেখা থাকে না। মারফত বলে, তুমি তোমার মতো হও। মারফত বলে, বুদ্ধ, যিশু, রসুল কিছুই হওয়ার দরকারটা নাই। এগুলো হল সব বিভক্ত জ্ঞান।
মানে?
কারও মতো হওয়া মানেটা হল গিয়ে ভাগ হয়ে পড়া। সবাই বলে, এর মতো হও, ওর মতো হও। মারফতই বলে, নিজের মতো হও। দেহ জানো। দেহ ধরে নিজেকে চেনো। নিজেকে চেনার জন্য লালন হবারও দরকার নাই। সাঁইজি উন্নত মানুষ। দেহসত্য জেনে উন্নত হওয়াটাই লালন ঘরের কাজ। লালন হওয়াটা কখনো নয়।
আমি দেখি দোবরা মন দিয়ে শুনছেন গুরুর কথা। আমার দিকে চোখাচোখি হল একবার। জুঁই ফুলের মতো ছোট্ট, শুভ্র হাসি লেগে আছে খালি ওঁর মুখে। কোনও কথা নেই। আমারই বয়স। অথচ কী অন্বেষণ! কত্তদূর এসেছেন তিনি। গুরুর সঙ্গে সাঁইজির নদিয়ায়।
লালন ঘরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমি ভাবি লবান শিষ্য সামছুল ফকিরের কথা। পরিব্রাজক ফকির তিনি। নহিরেরই বয়সি। বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের সুফি—পির—দরবেশ, ওলি—আউলিয়াদের পদচারণার ভেতরই একসময় ঘুরে বেড়াতেন তিনি। গায়ে পরতেন চট। এখন ওঁর সাদা দাড়ির সঙ্গে লালন ঘরের শুভ্র পোশাক।
সামছুল ফকির বললেন আমায়, নদিয়ার ভাবখানা বুঝলেন কেবলই হয়ে ওঠার। সাধনায় হয়ে ওঠাটাই কাজ। কেউ এলে আমি তারে বলি খালি, জীবন দেখাও দেখি, তুমি।
জিজ্ঞাসা করি, কেমন জীবন সে?
বৃদ্ধ ফকির বলেন ভাবের কথা।
বলেন, ভাবচর্চা করবেন বলে মহাপ্রভু শাস্ত্র ছাড়লেন। পণ্ডিতি সব বিসর্জন দিয়ে এলেন। ফকির বাউল দরবেশ বয়াতিদের সহজ মানুষ অন্বেষণের সঙ্গে চৈতন্য মহাপ্রভুর ভাবের ঐক্য আছে।
কী সেই ঐক্য? শুনি।
চৈতন্য দেখালেন তো ভাব ধরো, করণ করো। শরীরখানায় রাধারানির দ্যুতি ছড়িয়ে তিনি কৃষ্ণকে খুঁজতে লাগলেন, হাঁ কৃষ্ণ, হাঁ হাঁ কৃষ্ণ কাঁহা গেলে তোমা পাই।
জিজ্ঞাসা করলাম, শেষমেশ কোথায় গেলেন চৈতন্যদেব?
সামছুল ফকির মুচকি হাসলেন। তাঁর মুখে যে ভাবসাধনের ঢেউ। নীলাচলের সমুদ্র। আমি সরাব কেমন করে!
ফকির বললেন, জানি আপনি বিতর্কে যেতে চাইছেন। চৈতন্যদেবের জিয়ন্ত শরীরখানার শেষভাগে কী হল, তিনি খুন হলেন না অন্তর্ধান হল ওঁর, মূর্তিতে—সে বড় কথা নয়।
বড় কথা কী?
বড় কথা হল জিয়ন্তে ওঁর শরীরখানা কী দশায় উপনীত হল। শরীর অহরহ কৃষ্ণনাম করল আর নামে আমাদের গুরুর বলা সেই ত্রুটি সেরে গেল সেটাই তো বড় কথা। শরীর খুলল দম—শ্বাস আর নামের গুণেই।
ফকির যেন এবার ঘাঁই দিলেন ভাবমণ্ডলে। ওঁর সাধনসঙ্গিনী বুড়ি মা—ও জ্যোতিধামে মানুষ। নহির শাহের মেয়ে। ফকির লবান শাহ আদর করে ডাকতেন, রঞ্জনা বলে। নহির বলতেন, বুড়ি মা। এই নামেই তিনি এখন লবান ঘরে পরিচিত। পৃথুল চেহারার সদা হাস্যময়ী বুড়িমাই তো খৈলশাকুন্ডির আখড়া দেখভালের দায়িত্বে। লবানের সাধনসঙ্গিনী রিজিয়া ফকিরানির যথেষ্ট বয়স হয়েছে। সেসব আর পারেন না। বুড়িমাই শিষ্যশাবকদের দেখভাল করেন। কুষ্টিয়া থেকে এসে পথ হাঁটেন সোনার নদিয়ায়।
পঞ্চাশের কাছাকাছি ওঁর বয়স। প্রচলিত বিয়ের পিঁড়িতে বসা হল না। বেজে উঠল না সানাই। লালন ঘরের শুভ্র পোশাক গায়ে তুলে তিনি ফকিরি যুগল ভজনার দিকে পা বাড়ালেন সামছুল ফকিরকে সাধনসঙ্গী করে। আজ তিনি লালন ঘরের সর্বজনীন মা। বুড়ি মা।
বড় সুরেলা যে ওঁর কণ্ঠ। কুষ্টিয়ার পাককোলায় নিজের আশ্রম আনন্দধাম। তেতাল্লিশ বছর ধরে সেখানে গুরুবার্ষিকী করেন সামছুল ফকির। সাধুসঙ্গ হয়। বুড়ি মা গেয়ে ওঠেন লালন ঘরের সেই ভেক—খিলাফতেরই গান। আখড়া তখন গমগম করে ওঠে বুড়ি মা’র গলারই ভাবে :
কে তোমারে এ বেশভূষণ
পরাইলো বলো গো শুনি।
জিন্দা দেহে মুর্দার ভূষণ
খিলকা তাজ আর ডোর কোপনি।।
লবান শাহ তো বলতেন, ফকির গো ভেক হইল গিয়া জিন্দা দেহে মরার বসন। হ্যার লেগাই সাদা পোশাক সাঁইজির ঘরে। ফকিরেরা জ্যান্ত থাকতেই মইরা যায়। তার দেহ মরে, কাম মরে—ইহলোকের যাবতীয় কাম—কামাদি মারতে চায় ফকির আর পরলোকে তার তো বিশ্বাসই নাই। দেহান্ত হইলে পরে কাফনে সাদা পোশাক পরাইতেই হয়। ফকিরে তো জিয়ন্তে মরা। সাঁইজির কালেমায় বাতুন দেহতত্ত্ব সেই মইরা থাকার জাহের করে। বাতুল লোকে টের পায়। বাতুনে ফকিরে তাই সাদা পোশাক পরে।
পোশাক পরা, ভেক নেওয়ার একটা অনুষ্ঠান হয় আখড়াবাড়িতে। একেই বলা হয় সাধুগুরুর খিলকা নেওয়া। সাদা পোশাক পরে খিলকা নেওয়ার বাহ্যিক অর্থটাই হচ্ছে আত্মিকভাবে শরীরকে মেরে ফেলা। দরবেশী ফকিরও সাদা পোশাক পরেন। চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়ার মওলা মতুন আখড়াবাড়ির দরবেশরা খুবই নদিয়ার দরবেশী স্রোতে আসা—যাওয়া করেন। আখড়াবাড়ির সৈয়দুল হক দরবেশকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই ভেক খিলাফত নিয়েই। তিনি এসেছেন আড়ংঘাটার শ্যামরানি দরবেশের কাছে।
বললেন, আমাগো খোদার ফকির কয়। আমরা সংসার ত্যাগ দিয়ে দরবেশ হইছি। দ্বারে দ্বারে ঘুইরা মাধুকরী করি। তাই আমরা দরবেশ।
বললাম, আপনারা তাহলে কি লালন ঘরের দরবেশ? এদিককার ভেবোডাঙা, শব্দলপুরের দরবেশরা লম্বা ঝুলের তালিতাপ্পা মারা আলখাল্লাধারী। সাদা ধুতি লুঙ্গি, সাদা ফতুয়া পরেন ইমদাদুল হক ফকির। মান্য সৈয়দ বংশের তিন পুরুষের ফকিরি—মুর্শেদ তিনি।
দরবেশ বললেন, বাড়িতে নিশ্চয়ই সমাধি আছে।
বললাম, হ্যাঁ তো। ইমদাদুল ফকিরের বাকসিদ্ধ দাদাজান, দাদি, আব্বা আর আম্মির সমাধি আছে। ফকির সেখানে জোব্বা, তহবন্দ পরে এবাদত দেন, আমি দেখেছি।
সৈয়দুল হক দরবেশ বললেন, কুষ্টিয়ার ফকিররা পাবনা, যশোর, ফরিদপুরে ছড়াইয়া পড়ছ্যে। সাঁইজির সময় হতিই। বুঝলেন কর্তা। হাফহাতা সাদা জামা পরেন তেনারা, সাদা তহবন্ধ, সাদা পাগড়ি, দোতারাটাও সাদা ওয়ারে ঢাকা।
দরবেশকে বললাম, পাটুলি, দাঁইহাট, অগ্রদ্বীপ, কাটোয়াতে এই পোশাকে ভেকধারী সহজিয়ারা ঘুরে বেড়ান। তবে দোতারাটা হাতে থাকে না। কাঁধে মাধুকরীর সাদা ঝুলি।
গোঁসাইরা বলেন, লয়ে আঁচলা ঝোলা জপের মালা গৌর বলে চলে যাব।
বলেন, নারী মধ্যে রাধা, কাপড় মধ্যে সাদা, কর্ম মধ্যে সাধা।
এঁদের সাধনা রাধারানির নাম করা। এটাই কাজ। পোশাক সাদা খাটো করে পরা লুঙ্গি। যাকে তহবন্দ বা তপন বলেন ঘরের মানুষ। মাথায় সাদা পাগড়ি বাঁধা থাকে সব সময়। সর্বকেশ রক্ষা করাটাই ঘরের রীতি।
সৈয়দুল হক বললেন, আমাদের ঘরের দরবেশ—ফকিরেরা তো ক্ষৌরী করেন। দাড়িগোঁফ কাটেন।
আমি সৈয়দুল দরবেশকে বললাম, হাতিশালা গাঁয়ের ফকিরেরা বলেন যে, সাদা পোশাকটা পুব পাকিস্তানের। ওদের তো গেরুয়ার চল নেই।
বললাম, রাঢ় তথা পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ বাউলরাই গেরুয়া পরেন। অনেকের তালিতাপ্পা আছে। কেউ তালিতাপ্পার ন—টুকরো কাপড়কে পদ্মচক্র, নবদ্বারের বাতুনে কথা দিয়েই মিলিয়ে দিতে চান। কথার কেরামতি জানেন।
সৈয়দুল হক ফকির মন দিয়ে এদিককার ঘরের আচরণবাদ শুনতে থাকেন। আমিও বলে চলি :
বীরভূমের বেশিরভাগ সাধুগুরু বাউলনামধারী। ঠাকুরঘরে রাধাকৃষ্ণ রেখে যুগল দেহভজনা করেন, কেউ কেউ একেবারে নিছকই গায়ক, সাজা বাউল। এঁদের বেশিটাই জাতবৈষ্ণবতায় সামিল। গোত্র জিজ্ঞাসা করুন গে। বলবেন, অত্যুতানন্দ গোত্রের। কৃষ্ণ—সাযুজ্যের গোত্র এঁদের। সকলেই বাতুনে কথার ওস্তাদ। বলবেন, দেহমিলনে আমাদের বীর্যচ্যুতি নেই। তাই আমরা অচ্যুতানন্দ। এভাবেই ভেকধারী, সাজারা আপনাকে কথার তোড়ে পেড়ে ফেলবেন। আর আসলেরা ঘরের মানুষ না হলে অচিন ঘরের বিষয়আশয় চট করে আনকোরা কাউকে বলবেনই না। প্রথমে ল্যাজে খেলাবেন। তারপর ভাব বুঝে আপন করবেন।
উত্তর দিনাজপুরের প্রবৃদ্ধ সাধক বলহরি দাসই বলেছেন সারকথাটা, বাউল কি বৈরাগী? সে গেরুয়া পরবে কেন? উত্তর বাংলা আর ওপারের কুষ্টিয়া, রংপুর, পাবনা, রাজশাহীতে বাউলের ভেক—খিলাফতের সাধনায় সকলেরই সাদা পোশাক।
বললাম চুয়াডাঙ্গার সৈয়দুল হককে, বর্ধমান, হাটগোবিন্দপুরের সাধন দাস বৈরাগ্য লালনপন্থী। তাই তাঁর কেবল গেরুয়া পোশাক নয়। না হলে পশ্চিমবঙ্গের বাউলেরা অকাতরে সব রংদার গেরুয়ায় সেজে থাকেন। বেশিটাই কেবল ভেকধারী গায়ক।
সৈয়দুল বলেন, বাংলাদেশেও এখন সাজা ফকিরে ভরে গেছে গো। বৈষ্ণব মুরুব্বিরাও বাউলে মিশেছে। বাউল ফকির বৈষ্ণব সব এক হয়ে গিয়েছে।
বললাম, একবার বীরভূম, খয়রাশোলের মাধব দাস বাউল নিয়ে গেলেন আমায় চিনপাইয়ের সাধনা মায়ের আশ্রমে। গিয়ে দেখলাম বিবেক গোঁসাই, সাধনা মা সাদা পোশাক পরেছেন। কপাল চন্দনচর্চিত, গলায় তুলসি মালা। মাধব দাস বাউলও সাদা পোশাকই পরেছেন।
সাধনা মা গাইছেন :
যার মুখে ভাই হরি কথা নাই
তার কাছে তুমি যেও না
যার মুখপানে চেয়ে ভুলে যাবে হরি
তার কাছে তুমি যেও না।
বুঝলাম, সদর্থক অর্থেই তিনি বাংলার বৈষ্ণবী। ভেক—খিলাফতে এক হয়ে রয়েছেন ভাবনগরের সাধনায়।
খৈলিশাকুন্ডি, কুষ্টিয়া
খৈলিশাকুন্ডি জ্যোতিধামে ৪ এপ্রিল পালন করা হয় ফকির লবান শাহের আবির্ভাব তিথি। এইদিনটি হল আখড়াবাড়ির গুরুদিবস। ২৮ অক্টোবর আখড়ায় পালন করা হয় গুরুর তিরোভাব তিথি।
লালনের শিষ্য তথা পালক পুত্র ভোলাই শাহের সমাধি হয়েছিল ছেঁউড়িয়ায় লালন শাহের আখড়াবাড়িতেই। লবানের গুরু কোকিলকে সমাধিস্থ করা হয় সেখানেই।
লবানের সমাধি হয় খৈলিশাকুন্ডিতে নিজের হাতে তৈয়ারি আখড়াঘরে।
শিষ্য—বায়েতরা বলেন সব, হকের ঘর। ছেঁউড়ে আশ্রমকেও তো হকের ঘর আছে।
আমি তো তখন বুঝি না ছাই এত্তসব বাতুনে মানে। নবিশ। শিখছি, যাচ্ছি, ঘুরছি আর বুঝছি। সতী মায়ের বাড়িতে তো কোনও ‘হকের ঘর’ নেই! ব্যাপারটা আমার নতুন ঠেকল।
জিজ্ঞেস করে বসলাম লবান—পুত্র ইয়াহিয়াউল হককে।
বলি, এই হকের ঘরখানার রহস্য কী? আর ঘরে গেলে বায়েত—ফকিরে প্রতিবিনিময় হয় যে, আলেখ সাঁই বা অলখ নিরঞ্জন—এ, এরও বা মানে কী?
মনে পড়ে আমার এবার লবানের কথা। তিনি বাতনিবিদ্যা দিতে গিয়ে বলতেন, নেশাগিরি আর সাধুগিরি দুটো পৃথক কারবার।
তিনি আখড়াবাড়িতে নেশা ও মাদক জাতীয় দ্রব্যাদি ব্যবহারের ঘোর বিরোধী ছিলেন।
বলতেন, বস্তুর উপর আসক্তি দিয়ে নেশাগিরি হয়, কিন্তু সাধুগিরি হয় না। আমার মুর্শেদ বলতেন, সাঁইজি ছিলেন নেশার বিরোধী। বস্তুর নেশা তাঁর ছিল না। নেশা ছিল দম—শ্বাসে, দেহকাজে। এই হল গিয়ে সাধুর নেশা।
ইয়াহিয়াউল হক বললেন, হকের ঘর হল প্রকৃত সত্যের ঘর। সত্য এই, গুরু জিয়ন্ত। তিনি শুয়ে আছেন তাঁর ঘরেই। এ ঘরে তাই জপ—জিকিরে বসে শিষ্যরা। জিকিরের আগে শরীর ও মনখানা শান্ত করে নিতে হয়। এ হল গিয়ে বাতনি ওজু।
বললাম, এর মানে কী?
বললেন, নামাজের আগে শরিয়ত বিধানে ওজু করতে হয়। নফসকে বা মনকে পাক—পবিত্র করত হয়। মনের পাক—পবিত্র হওয়াটা তো দেখা যায় না। এই হল বাতনি ওজু। মারফতি ফকিরেরা সব এই ওজুতে বিশ্বাসী। জাহিরি ওজু হল পানির দ্বারা হাত—পা ধুয়ে নেওয়া। বাতনি ওজু করে বসতে হয় হকের ঘরে।
তারপর?
মন যখন শান্ত হল, নফস যখন স্থির হল তখন আজ্ঞায় যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।
বলি, কার সঙ্গে কার?
ফকির বলেন, দেহ ও মন এক করে রুহের সঙ্গে যোগাযোগ, আত্মার সঙ্গে সংযোগ। এই যোগসাজশের বাতনি শ্বাস ও করণ আছে। সেগুলোই তো শেখার। ফকিরি সালাত হয় আজ্ঞায়। দম—শ্বাসে। দেহটাই নামাজি হয় বাতনিকরণে। আলাদা করে ফকিরে তাই নামাজ পড়ে না। লালন ঘরে হকের ঘরে বসে শিষ্যরা এবাদত করে গুরুর। গুরু তখন উঠে আসেন মনের মানুষ হয়ে ওই আজ্ঞায়। সাঁইজি আমাদের বলেছেন আরশিনগর। দুই ভুরুর জোড়ায় মন উঠিয়ে স্থির করে দিতে পারলেই আলেখ সাঁইয়ের দেখা মেলে। তিনিই অলখ নিরঞ্জন। তিনিই ফকিরি কাঙ্ক্ষিত পরম। এগুলো তাই লালন ঘরের বীজমন্ত্র। ফকিরে ফকিরে মোলাকাতে অলক্ষ্যের স্বামী সেই সাঁইজির স্মরণ। যার জন্য এই সাধুগিরি।
সেই সাধুগিরি জানব বলেই আমি একবার চিঠি লিখলাম সত্যধামে। কুষ্টিয়ার লালন ধামের গায়ের ধারে সত্যধাম। তখনও আমার যাওয়া হয়নি। ফকির হৃদয় সাঁইয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে খালি আসাননগর—ভীমপুরের মধ্যবর্তী এলাকা কদমখালি শ্মশানে।
ঝোড় নদীর পাশে বসে সাঁই ডায়েরিতে লিখে দিলেন সেই ঠিকানা। মেলা চলছে। পশ্চিমবঙ্গে এই মহাত্মা লালন ফকিরের নামে প্রথম মেলার সূত্রপাত হয় ঝোড় নদী পার্শ্ববর্তী কদমখালি শ্মশানে সাঁইজির তিরোভাব শতবর্ষে।
মেলার তত্ত্বাবধায়কদের একজন হলেন বীরেন দাস বাউল। এই জানুয়ারি মাসেই দেহ রাখলেন তিনি। বীরেনদাই আমার সঙ্গে আলাপ করে দিয়েছিলেন কুষ্টিয়ার হৃদয় সাঁইয়ের। তিনি গাইতে এসেছিলেন আসাননগর—ভীমপুরের লালন মেলায়।
রাতে সেবার পাল্লাগান হয়েছিল বীরেন দাস বাউল আর হৃদয় সাঁইয়ের মধ্যে। গোরভাঙার মনসুর ফকিরও পাল্লায় অংশ নিয়েছিলেন হৃদয় সাঁইয়ের বিপক্ষে।
মেলা ভাঙলে আমি গেলাম তেহট্টের চিলাখালি। বীরেন দাস বাউলের আখড়াবাড়ি। হৃদয় সাঁই কদমখালির লালন তীর্থে যে ঘরখানিতে থাকতেন সাঁইজির প্রশিষ্য আজমত শাহ ফকির তার দাওয়ায় বসে ভক্তি দিয়ে ফকিরকে হাঁটা দিলেন কুষ্টিয়ার পথে।
বীরেন দাস বাউল বললেন আমায়, আজমত ফকির বহুদিন ছিলেন এখানে। ওঁর কাছ থেকেই লালন ঘরের ফকিরি পরম্পরার গানগুলি আমি সব পেয়েছি।
আজমত ফকির অসুস্থ হলেন। ওঁর বায়েতরা সব নিয়ে গেলেন ওপারের চুয়াডাঙ্গা। সেখানেই ঝাঝা গ্রামে নিজের বসতবাটিতে সমাধি হল ফকিরের।
এসব বলেই হৃদয় সাঁই চললেন কুষ্টিয়ায়। সেজন্য ওঁর ঘর ও ঘরানা নিয়ে কিছু কথা হল না আমার। ভাঙা মেলার পর চললাম তেহট্ট বীরেন বাউলের সঙ্গে। শ্যামনগর মোড়। বাঁশপাড়া। পেরোলেই চিলাখালিতে বাস দাঁড়াল।
রাত্রিবাসের পর ভোর ভোর এলাম জলঙ্গীর ধারে। নদীর ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে অশ্বত্থের ডাল। ডালে মাছরাঙা আর পানকৌড়ি। চষাখেতে বসে বীরেন বাউলের গান শুনছি। গান শুনতে শুনতে ভাবছি, হৃদয় সাঁইকে স্বভাব—জিজ্ঞাসায় চিঠিখানা লিখব।
চিঠির উত্তর এল দোলপূর্ণিমায় সতী মায়ের মেলার আগের রাতেই :
আমি তো অধম। আমি লালন সাঁইজির ঘরে দীক্ষিত। ফকির মনিরুদ্দিন সাঁইয়ের সিঁড়ি। আমার গুরুজি/সাঁইজি ফকির দৌলত সাঁই। গুরুকুল মেহেরপুর, বাংলাদেশ। আমরা বাউল মতে ফকিরি ধারায় চলি। ফকির লালন সাঁই ধামের পাশেই আমার আখড়াবাড়ি। সত্যধাম। আমি ডোর—কৌপিন নিয়ে আঁচলা ধারি হৃদয় সাঁই। দুই যুগের বেশি সময় ধরে আমি লালন দর্শন নিয়ে কাজ করছি। বিকৃত লালনকে সঠিক ধারায় নেওয়ার চেষ্টা। সাঁইজির বাণীর নিগূঢ় তত্ত্ব… এইসব আর কী। মেডিটেশন আর যোগ, এর সাথে জড়িত। আমরা যুগলে মেডিটেশন করি। ওষুধবিহীন বাঁচার চেষ্টা। ভক্তদের মেডিটেশন ও যোগ শেখাই। লালন সাঁইয়ের ধর্মমতে সৃষ্টি করিনি। সন্তান নেই। অধরা ফকিরানিকে নিয়ে আমার পথ চলা।