শ্মশানে জাগিছে শ্যামা
অট্টহাস ভেঙে কংকালীর দিকে আসতে গিয়েই পথে তাঁর সঙ্গে দেখা। তিনি তারাশিব ভৈরব। কংকালীর কিছুটা দূর হাতায় যেখানে গ্রাম লেগেছে তার একেবারে ধার ঘেঁষেই বটতলা। ফেঁকড়ির বহরই বলে দিচ্ছে এর প্রাচীনতা। পাখপাখালির সমাহারের মাঝেই বসেছিলেন তারাশিব। কৌতূহলবশত আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছি তাঁর কাছে। একটা শালিক তাঁর জটার লতায় ঠোঁট ডুবিয়েছে। আমাকে দেখে বেশ কয়েকটা ফুড়ুত। বুঝলাম তারাও বুঝেছে নিবিড়ের লোকের কাছে অপরিচিত এসে জুটেছে। তারাশিবের হাতের ইশারায় শান বাঁধানো বেদির ‘পরে বসলাম। তাঁর মাথায় শালিক সেই ফাঁকে বটঝুড়ির দোলনায় গিয়ে বসল। দেখলাম তার জোড় এসেছে।
তারাশিব বললেন, ‘ওঁরা হর—পার্বতী। রোজ বিকেলে একবার কংকালী ছেড়ে বটতলায় দোল খেয়ে যায়। জানেন তো মায়ের থান তখন শক্তিহীন হয়ে পড়ে। আপনার চোখ থাকলে কংকালীর সেই হাঁ—শূন্যতা টের পাবেন। মিনিট দুয়েক। তারপরই মা আর তাঁর ভৈরব কংকালী ফিরে যান। শ্রী ফেরে কংকালীর।’
এসব ঐশ্বর্যদায়িনী অনুভূতির কোনও প্রমাণ হয় না। গূঢ় ইঙ্গিত ধরতে সেই পুলকের সঞ্চারের ভেতর যেতে হয়। ক—জন তা পারেন! মনের জ্যোতির্ময় আকাশের বুকে খুব বড় ছায়াপদ্ম না ফুটলে সেই শক্তি দর্শনের উপলব্ধি হয় না। তারাশিবের তা হয়েছে কি না বলতে পারব না। এ পথে আমি নতুন নয়। অনেক ভৈরবকেই দেখেছি কথার জালে একেবারে পেড়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু মানসনেত্রে উজ্জ্বলতার কিছুই টের পান না। কথা কিছুদূর এগোলে এসব ভালোভাবেই বোঝা যায়। তারাশিবের সঙ্গে আমার তো আলাপ পরিচয়ই হয়নি। কথা এগোতে থাকল। বুঝলাম সত্ত্ব—গুণান্বিত অঞ্চলে তাঁর যাতায়াত শুরু না হলেও তিনি এমন এক ছায়াময়ীর ঐশ্বরিক মণ্ডলের হদিশ জানেন যেখানে গেলে হয়তো বা শক্তির উজ্জীবিত রূপকে কিছুটা হলেও দেখা যেতে পারে। আর দেখাই আমার একমাত্র কাজ। ব্যক্তি তাঁর চৈতন্য সত্তাকে কীভাবে এক বিন্দু পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে অন্তর্যামিত্ব লাভ করেন সেই ইচ্ছাময়ীর অবস্থানটির দেহাবয়ব দেখব বলেই আমার কেবল ছুটে চলা। যেন কোনও এক জ্যোতির বেষ্টনী আমাকেও টানছে। আমি সেই তরঙ্গোদ্ভূত জগতের মধ্যে ছুটে চলেছি। তারাশিব ভৈরব আমার সেই গতিপথের সূত্রধর মাত্র। তবু তাঁকেও আমার প্রণাম। কেননা তিনি হদিশ না দিলে সেই দীর্ঘদেহী কৃষ্ণবর্ণা মুণ্ডিত কেশের অঘোরী সাধিকার সঙ্গে কোনওদিনই আমার দেখা হত না। যেখানে তন্ত্র সাধনার অঘোরী সাধক মানে পিশাচসম, রাক্ষস, ব্যভিচারী, ম্লেচ্ছ, শ্মশানে থাকা পচা মরার হাড় চিবোনো বিসদৃশ উৎকট মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে একজন মহিলা অঘোরীর সন্ধান পাওয়া আমার কাছে যেন এক নতুন আলোকের ঝরনাধারার মতো। আমি তাই দিন দুয়েক কংকালীতে কাটিয়ে চলে গেলাম সরাসরি সেই অঘোরী সাধিকার সন্ধানে। আমার তখন অনেকটা সেই যোগানুভূতির স্তরে স্তরে আকাশ খুলে যাওয়ারই দশা। রহস্য, শিহরণ, ধূমপুঞ্জ, ভয় ইত্যাদি নিয়েই আমি এবার পথ হাঁটছি যথেষ্টই এক উন্মাদনার মধ্যে।
হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছেছি মরালী তীরবর্তী জনপদ হুদাতে। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা হুদা। মরালী এখন স্মৃতিচিহ্নের মতো। গ্রামের উত্তর—পূর্ব সীমায় একদা প্রবাহিত মরালীর পরিণতি এখন বোজা নালা। লোকমুখে যা গাঙ্গরা বিল নামে পরিচিত। প্রাচীন মানচিত্র বলছে, হুদাতেই মরালী থেকে একসময় গোমতীর বিস্তার ঘটেছিল। আর এই সংযোগস্থলে এখন দাঁড়িয়ে আছে পরিত্যক্ত এক নীলকুঠি। পাশেই শ্মশান। নীলকুঠি সাপ—বনবেড়ালের আস্তানা। উঁচু উঁচু বনবাদাড়ের ফাঁক গলে এখনও তার বেশকিছুটা ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। কেউ খুব একটা ধারেপাশে যায় না। এখানকার আদিবাসীদের পূর্বপুরুষেরা সব নীলকুঠির কর্মী। সেই সুবাদে পরবর্তী বলশালী পুরুষ কুঠির হকদার বলেই বোধহয় এখান থেকেই তারা প্রায়শ শিকার করে নিয়ে আসে বনবেড়াল—সাপ—ধেড়ে ইঁদুর। তিথি বিশেষে ভোজ সারে আদিবাসী সমাজ। সেই ভোজে এখন অন্তরায় হয়েছেন অঘোরী মাতাজি। তারাশিবের কথামতো তাঁর সন্ধানে এসে জানলাম মাতাজির নানা অলৌকিকতার কাহিনি। গ্রামের মানুষদের বহু দুরারোগ্য প্রাচীন রোগ কেবলমাত্র দৃষ্টিস্পর্শে ভালো হয়েছে বলে এখানকার মানুষের দাবি। গাঁওবুড়ার হুকুমে মাতাজি তাই এখানকার জ্যান্ত দেবী। তবে সেই দেবীর জন্য তাঁরা কেউ কিছুই করতে পারেন না বলে আপশোস। কেননা মাতাজি কখনো কুঠির বাইরে বেরোন না। খাবার—দাবার কিছুই খান না। পায়খানা—পেচ্ছাপ পর্যন্ত করেন না। এসে পর্যন্ত একাসনে বসে। কেবল অমাবস্যার রাতে আসন ছেড়ে শ্মশানে আসেন। যজ্ঞ করেন। সেদিন মায়ের ভক্তশিষ্য কিছু তান্ত্রিক—কাপালিক এসে জোটেন। গ্রামবাসীরা তাঁদের ভোজ দেন ধেড়ে ইঁদুর, বনবেড়ালের মাংসে। তবে মাতাজি আসার পর থেকে সাপ তাদের অধরা। মা এদের প্রতিপালন করেন। বিষধর মায়ের শরীরে পর্যন্ত আস্তানা গাড়ে। মা তাই হলেন এই সমাজের দেবী বিষহরি। তিনি আসার পর বছর ঘুরতে চলল সাপে কাউকে ছোবল মারেনি। উলটে রোগবালাই গেছে। পোয়াতির ধাইমা হয়ে ফুটফুটে প্রসব করিয়েছেন তিনি। পোলিওর বসে থাকা রুগী হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে। কাজ করছে। এই অঘোরী তাই হুদার বিষহরি মাতাজি। গ্রামবাসীরা অবশ্য তাঁর সাধনপন্থার কিছু বোঝেন না। তবে এটা বোঝেন মা শক্তিধারী। তাঁর কৃপাদৃষ্টি পেলে মঙ্গল হয়।
তা সেই মায়ের দরবারে যেতে গিয়ে তো নানা বিপত্তি। পথের ক্লেশ অবশ্য এখন আর তেমন ব্যাপার নয়। গা—সওয়া গোছের হয়ে উঠেছে। বিপদ এখানে বিষধরের। বিষহরি মাতাজির বিষধর, মাতাজির জড়ানো গলা থেকে নেমে পড়ে প্রায় আমিমুখো। মায়ের হাতের ঈশারায় সে তখন আবার স্থাণুবৎ। মা ওকে দেখিয়েই আমাকে কুণ্ডলিনীর শিক্ষা দিয়েছেন। স্থাণুবৎ কুণ্ডলিনী কীভাবে হিস হিস করতে পারে মা তার পাঠ দিয়েছেন। আমি কেঁপে কেঁপে উঠেছি মায়ের অলৌকিকতায়। পরে মনে হয়েছে মা যা করেছেন, করছেন সবই যোগের ক্রিয়াকরণ ভিন্ন কিছুই নয়। এখানে কোনও অলৌকিকতা নেই। বিস্ময় নেই কোনও। ইন্দ্রজালও নয় তা। এ হল এক ভরপুর বিজ্ঞান শরীরের শরীরহীন উচ্চাবস্থার।
অঘোরী মাতাজির দেখা পেয়েছিলাম কালবৈশাখীর এক বিকেলে। প্রকৃতির রং আর মাতাজির রঙে তখন কোনও ফারাক ছিল না। কৃষ্ণবর্ণা মাতাজি প্রকৃতির মতোই স্থির। ঝড়ের ঘনঘটা নিয়ে তৈরি যেন। অদ্ভুত অপরিরোধ্য এক মানসিক ইচ্ছের মধ্যে তখন মাতাজি আছেন। আমি টের পেলুম। আমার উপস্থিতির হিতাহিত তাঁর নেই। দেখলাম মাতাজির দেহের নিম্নাঞ্চল, বিশেষত তাঁর নাভি অঞ্চল থেকে কেবল একটি শব্দের অশ্রুত একটু ভাবের শিহরন নিয়ে উঠে এসে মুখ থেকে তা একেবারে শ্রুত শব্দের আকারে বেশ শ্রুতিমধুর ছন্দস্পন্দে একই সমতায় নাগারে বেরোচ্ছে। কুঠির বাইরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির আগত ম ম অন্ধকারেই প্রথম আমি সেই শব্দটি টের পেয়েছিলাম। একেবারে স্পষ্ট তার রেশ আমাকে মাতাজির স্থানাঙ্ক নির্ণয় করতে সহায়ক হয়েছিল। বিশাল নীলকুঠির ছমছমে সিংহ দরজা দিয়ে অতল প্রবেশপথ থেকে তখন ভেসে আসছিল শব্দ। চারধারের নির্জনতায় মোটা দেওয়ালে জমা ঝোপের আচ্ছাদনের ভাঙা জানলার সেই পুরুষ্টু কপাটে শব্দ তখন বেশ গাঢ়। তীব্র অন্ধকারে ছমছমানি আমার ভেতর। আমি নামছি শব্দ অনুসরণ করে ভাঙাচোরা র্সিড়ির ধাপের পাতালে। শব্দ যেন আরও গাঢ় হচ্ছে। আমার সারা শরীরে সেই মাদকতা ছেয়ে ফেলেছে। তন্ত্রসান্নিধ্যে এক যুগ কাটিয়ে ফেলার কারণেই আমি ভয়শূন্য। তবে এক শিহরন রয়েছে শব্দের। শব্দ বেরোচ্ছে নির্দিষ্ট সুরের সমতায়—অ—উ—ম, অ—উ—ম, অ—উ—ম….। সারা কুঠিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তখন নিরন্তর অ—উ—ম, অ—উ—ম, অ—উ—ম। যেন গমগম করছে। যত নামছি ততই যেন শব্দ অদ্ভুত গম্ভীর আওয়াজে পরিণত হচ্ছে। তবে সেই আওয়াজ অসম্ভব রকমের আকর্ষণী শক্তিতে ভরা। সেই প্রতিধ্বনির শব্দ শুনে বারবারই শিহরিত হতে হতে দেখলাম এক সময় আমি মাতাজির সম্মুখে। দেহে মনে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। তবে সেটা কোনওক্রমেই ভয় নয়। আশা। যা আমাকে কেবল বলে বোঝাচ্ছে, আমি এখন একজন সিদ্ধ অঘোরী সাধিকার সকাশে দাঁড়িয়ে আছি। পথশ্রম আমার বৃথা যায়নি। তারাশিব ভুল নিশানা দেননি। আমি বুঝতে পারছি অঘোরী সাধিকার কুণ্ডলিনী শক্তি ঊর্ধ্বগামিনী হয়েছে। দেহের নানা স্তরে চৈতন্যেরই নানা অবস্থার মধ্যে যখন কুণ্ডলিনী শক্তি মূলাধার ত্যাগ করে ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্ত হয়, তখন দেহের যে স্তরে তার অবস্থান হয় কেবল সেই স্তরের বিশেষ তরঙ্গই বিশেষ বিশেষ শব্দরূপে উচ্চারিত হবে। অঘোরী যোগিনীর এই দশাপ্রাপ্তির সারবত্তাটি হল, আমাদের শরীরের মধ্যে, শুধু আমাদের শরীর কেন, এই বস্তু জগতের সবকিছুর মধ্যে পরিপূর্ণতা সুপ্ত আকারেই বিদ্যমান। শক্তির জাগরণকলা যার মধ্যে যেমন, পরিপূর্ণতার প্রকাশও তার মধ্যে তেমনই ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। কুণ্ডলিনী শক্তি যদি শরীরের মধ্যে একবার জাগরিত হয়ে ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্ত হয়, তাহলে কাউকে আর কিছু দেখাতে হয় না। শরীরের সুপ্ত পূর্ণতা আপনাআপনিই ফুটে ওঠে। বেশ বুঝতে পারছি এখন যোগিনী শরীরের ঊর্ধ্বগতির ভেতরই বিরাজমান। প্রশান্তির স্বাদ তাঁর নিজের মধ্যে। চুপ করে বসে আমি দেখছি তার জ্যোতির্ময় রূপ। আধো অন্ধকারের ভেতর একটি প্রদীপ জ্বলছে। সেই অল্প আলোয় অন্ধকার অনেকটাই যেন নিবসিত হয়েছে এই বোঁটকা গন্ধের প্রায় পাতাল ঘরে। বাইরে এখন উতল হাওয়ার শব্দ। ঝড় উঠছে। পাতালেও তার রেশ। প্রদীপ দুলছে। শিখার কম্পনে দু—একটা বাদুড়ের ঝটপটানির ভেতর দেখলাম, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাক্ষাৎকার সেরে মাতাজি ফিরে এলেন আপন শরীরে। অঘোরীর বাহ্যিকতা শরীরে তাঁর নেই। মোটা লালপেড়ে শাড়ি তাঁর পরনে। মুণ্ডিত মস্তক। শরীরে কোনওরকম অলংকার নেই। হঠাৎই চোখ পড়ল তাঁর গলাবন্ধে। শিবরূপী শূন্যতার বাইরে দাঁড়িয়ে মাতাজির গলায় স্থূল শিবাত্মা দেখলাম আস্তে—ধীরে নেমে আমার সামনে দিয়ে এগোতেই, স্থাণুবৎ তাঁর হাতের ইশারায়। এই দৃশ্যে আমি অবাক হলাম না একটুও। কেবলমাত্র অনুভব করলাম আত্মার স্বরূপ জানা হয়ে যাওয়ার ফলে প্রকৃতির বন্ধন স্থূল থেকে সূক্ষ্মতম পর্যায়ে ছড়িয়ে আছে মাতাজির শরীরে। সে সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে কোনওরকম কথা হল না আমার। মাতাজি ইশারায় কেবল বুঝিয়ে দিলেন কালকে সকালবেলা আসতে।
হুদাগ্রামে সকাল সকালই ঘুম ভাঙল মোরগের ডাকাডাকিতে। সাধারণত এত সকালে আমি উঠি না। রাত কেটেছে সেই গাঁওবুড়ার ঘরেই। গতরাতের ঝড়বৃষ্টির রেশ সকালের গায়ে লেগে। বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। ঝড়ের দাপটে গাঁওবুড়ার ছাগলের চালাঘর পড়ে গেছে। নতুন নির্মাণে ব্যস্ত বুড়া। অগত্যা সকালে লাল চা, মুড়ি খেয়ে একাই হাঁটা ধরলাম নীলকুঠির দিকে। আজ অমাবস্যা। রাতে অঘোরী সাধিকা তন্ত্রক্রিয়া করবেন। তারাশিব ভৈরবের কথামতো তাই আগের রাতেই উঠে এসেছি অঘোরী সান্নিধ্যে। ক্রিয়াকরণে আমার আগ্রহ নেই তেমন। আগ্রহ অঘোরী মায়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দীপ্তির আনন্দস্বরূপ কেবল জানবার, বুঝবার, উপলব্ধি করবার। প্রকাশশালিনী কুণ্ডলিনী দেবীর বিদ্যানুশীলনজনিত আনন্দ অনুভব আমি তো আর কম দেখিনি। দেখেছি ভেলকি, ভোজবাজিও। সবই আমার চেনা। তবে গত সন্ধ্যায় চুপিসারে অঘোরী মায়ের অন্তরাত্মা যে পুরোপুরি মহানন্দ চিন্তায় ব্যাপৃত ছিল, এটা আমি বুঝেছি। সাধনসঙ্গে মিশে এটা তো এতদিনে আমার কাছে পরিষ্কার, কুণ্ডলিনী প্রতীক বটে তবে শরীরে সেটা কোনওভাবেই অনস্তিত্বের নয়। কুণ্ডলিনী শক্তি হল বস্তুজগতের ধাত্রী শক্তি। সেই ধাত্রী শক্তিকেই যোগী শরীরে ধারণ করেন। যে পথ দিয়ে শক্তিময় সাধকের কুণ্ডলিনী দেবী শরীর ও বস্তুজগতের অভেদে কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়েন, সেই পথেই আবার শরীর তাঁকে ফেরত পাঠায়। আর এভাবেই যোগী সৃষ্টির উৎসমুখে ঘুরে দাঁড়ান। যা আমাদের কাছে দেহাতীত অলৌকিক ঘটনা বলে মনে হয়। আদতে এর ভেতর কিন্তু অলৌকিকতা কিছু নেই। জগতে যা কিছু যত কিছু ঘটে, তা সবই আশ্চর্য ব্যাপার—এই অভিজ্ঞান ছাড়া কোনও কিছুকেই সত্যি সত্যিই অলৌকিক ঘটনার মধ্যে ফেলা যায় না। আমরা সকলেই যে এক একজন এক একটি জটিলভাবে সংঘটিত শরীরের ভেতর আবদ্ধ এবং এমন এক জগতের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, যা মহাশূন্যে গ্রহ নক্ষত্রদের মধ্যে দিয়ে দ্রুত বেগে ঘূর্ণায়মান—এর থেকে আর অধিকতর আশ্চর্য বা অলৌকিক ব্যাপার আর কিছু আছে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। সুতরাং চূড়ান্ত যোগপ্রক্রিয়ায় মহাব্যোমের আলোকস্তম্ভে যোগীর শরীরের রূপ পরিগ্রহ অনেকটা সেই সিনেমা হলের যন্ত্রঘর থেকে প্রক্ষেপিত আলোকরশ্মি প্রবাহে নির্মিত কোনও দৈবপ্রতিলিপি বলে আমাদের অনায়াসে মনে হতে পারে। কেন না সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমরা যখন পড়ি বা শুনি কিংবা সাধন সান্নিধ্যে থাকলে নীরব অবস্থানে যা কিছুটা আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয় সবই কিন্তু তখন অনেকটা সেই সিনেমার মতোই চোখের পর্দায় প্রতিফলিত চিত্রের মতোই প্রকাশ পায়। হুদার সকালে আমি যেন সেই প্রতিফলিত চিত্রেরই দেখা পেলাম।
চুপিচুপি কুঠিতে এসে দেখি পাতালঘরে আসনের উপর সমাহিত দশাতেই বসে আছেন মাতাজি। ভোরের আলো ফাঁকফোঁকর পেয়ে ভাঙাচোরা সিঁড়িটায় এসে ঠেকেছে। সবুজলতা যেন কোনওভাবেই তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। সেই আলো পাতালমুখীও। আসলে এ ঘরটি বোধহয় পাতালপুরী ছিল না। পরিত্যক্ত দশায় এখন দেখে যেটা মনে হয়, নীলকুঠির একই সমতার থেকে যেন এ ঘর খানিক নীচু। গর্তে ঢোকানো। হতেই পারে এক সময় জীবন্ত মরালীর স্রোতের কাদায় এ অংশ বন্যার ভয়াবহতায় ডেবে এমন হয়েছে। সে যাই হোক। ভোরের আলোয় এদিকেও তার প্রকাশসুলভ বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে স্বাভাবিকতাতে কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয়েও। দেখলাম মাতাজি একটি হরিণের চামড়ার আসনে সমাহিত। গতকাল বেশ অল্প আলোয় তা আমার নজরে আসেনি। আসন থেকে চোখ সরতেই দেখি আসনের উপর বিশেষ ভঙ্গি করে শিরদাঁড়া খাড়া করলেন আসনধারিণী। মনে হল গুনে গুনে শ্বাস নিলেন, প্রশ্বাস ত্যাগ করলেন। একবার মনে হল কণ্ঠদেশ বায়ুপূর্ণ করে দিয়ে তিনি গুহ্যদ্বার সংকুচিত করলেন। বোধহয় ভেতর থেকে কিছু বাইরে বেরিয়ে আসছিল যার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিলেন মাতাজি। দেখলাম এরপরই তাঁর সারা শরীর থেকে রীতিমতো স্বেদবিন্দু নির্গত হতে লাগল। আমার মনে হল, ঊর্ধ্বদেহ থেকে কোনও কিছু একটা মাতাজির দেহের নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে ক্রমশ এবং নীচের দিক থেকে কী যেন একটা উঠে গিয়ে তাঁকে ক্রমশ টেনে ধরছে। মনে হচ্ছে বোধহয় মাতাজির নিম্ন উদরে একটা প্রকাণ্ড বিস্ফোরণ ঘটল এই মুহূর্তে। একটা বিদ্যুৎ চমকানোর মতো আলো আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আর সেই আলোতে পাতালঘরও বেশ অনেকটা আলোকিত হয়ে পড়ল। ফের মাতাজির দিকে তাকাতেই দেখি, তাঁর মুণ্ডিত মস্তকের পেছন দিকে উজ্জ্বল একটা সূর্য বৃত্ত রচনা করে জ্বলছে। তারপরই আবার দেখলাম সূক্ষ্ম অথচ বেশ তীব্র আলোর রেখা বিদ্যুৎ চমকানোর মতোই নিম্ন দেহ থেকে ক্রমশ ঊর্ধ্বে উঠে যেতে থাকল। কণ্ঠ পর্যন্ত সেই আলোর রেখার ঊর্ধ্বগতি আমি একেবারে পরিষ্কার দেখলাম। বর্ণনাতীত এক উজ্জ্বল জ্যোতি এরপরই মাতাজিকে ঘিরে ঝলমল করতে থাকল। বুঝলাম দৃশ্যত এই ঘটনা একেবারেই অলৌকিক কিছু নয়। মাতাজির কুণ্ডলিনী এখন পুরোপুরি জাগ্রতদশাতে রয়েছে। মূলাধারে তাপ সৃষ্টি করে এ কাজটি কিন্তু অনায়াসে করা যায়। ন্যাস, প্রাণায়াম ও যোগাসনের সাহায্যে সেই তাপ সৃষ্টি হয়। এটা যথেষ্ট চর্চাসাপেক্ষ ব্যাপার। এই চর্চার ফলেই মাতাজিকে আমার জ্যোতির্ময় নারী বলে মনে হয়েছিল সে সময়। এই চর্চাই আসলে দেহকে দেহাতীত আলোর রশ্মির মতো সূক্ষ্ম করে তুলতে পারছিল আমারই চোখের সম্মুখে। বিস্ময়ের আমার সীমা থাকছিল না ঠিকই। তথাপি যোগ—যৌক্তিকতায় একে আমি কখনোই অলৌকিক ঘটনা বলে মনে করতে পারছিলাম না। আর যোগ যে ঈশ্বর বলে কোনও বিশেষ কিছুকে মানে তাও কিন্তু নয়। একাগ্রতার জন্যই আসলে যোগে ঈশ্বর নামধেয় কোনও কিছুকে সামনে রাখা হয়। ঈশ্বর মনোনিবেশ করে রেখে ক্রিয়াযোগের ফলে যোগসাধনার প্রাথমিক পর্যায় আয়ত্তে আসে। আসলে জ্ঞানযোগই হল শ্রেষ্ঠ যোগ। জ্ঞানই মুক্তিলাভের একমাত্র উপায়। ঈশ্বরানুরাগ যোগের একটি নিয়ম মাত্র। যেমন—শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, চর্চা ইত্যাদি। যোগসাধনায় ঈশ্বরকে সামনে রেখে একাগ্রতার চেষ্টা বেশ পরের দিকেরই ব্যাপার। যোগের মূল লক্ষ্য ঈশ্বর লাভ কখনোই নয়। দ্বন্দ্বাতীত যে আত্মা, তার লক্ষ্য কখনো ঈশ্বর বলে কোনও কিছু হতে পারে না। এই অপরিণামহীন আত্মা নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকে না। তাকে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হয় সম্পূর্ণ। ঈশ্বর হল গিয়ে এখানে মিডিয়াম। উপলক্ষ্য। যাকে লক্ষ্য করে লক্ষ্যাতীত সত্যে পৌঁছানো যায়। মাতাজি, বরং বলা ভালো মাতাজির ক্রিয়া বা আচরণ কিংবা নিমগ্নতা এখানে সেই লক্ষ্যাতীত সত্যের দিকেই ছুটে বেড়াচ্ছে। কখন যে ভোর হয়েছে, আলো বেড়েছে, বেলা হয়েছে, আমার নিশ্বাস—প্রশ্বাসে পাতালপুরীর শক্তি চলাচলের ধারায় টাল খেয়েছে সেদিকেও মাতাজির হুঁশ নেই। দেখলাম এক সময় তাঁর জিভ দুই ভ্রূ—র একেবারে মাঝখানে চলে এসেছে। দীর্ঘদেহী মাতাজির মানানসই এই জিভ। এ কি মনুষ্যের হতে পারে কখনো? যা আমি দেখছি, তা কি অলৌকিক কিছু তবে! যোগচর্চার জ্ঞান থাকলে এই দৃশ্যে হতবাক হওয়ার কিছু নেই। খেচরী মুদ্রাতে জিভ এইভাবে বের করে এনে দুই ভ্রূ—র মাঝখানে ঠেকিয়ে নিতে পারেন যোগী। মাতাজি সেই প্রক্রিয়াতেই রয়েছেন এখন। বুঝলাম মাতাজির কুণ্ডলিনী ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে ক্রমশ। তিনি ভ্রূ—জোড়া থেকে জিভ ফিরিয়ে নিয়ে কণ্ঠনালির মুখে এমন করে আটকে রাখছেন, যাতে নিশ্বাস কোনওক্রমে বাইরে বেরোতে না পারে। মনকে তিনি নিবিষ্ট করেছেন এবারে আজ্ঞা চক্রে। কুণ্ডলিনীর তড়িৎপ্রবাহ জয় করে তিনি বুঝলাম আত্মস্বরূপে মগ্ন। এক ঘণ্টা অতিবাহিত হল আমি এসেছি। বসে আছি। মাতাজির আত্মস্বরূপে লীনাবস্থা দেখছি। বুঝতে পারছি আবার মাতাজি স্বাভাবিকতায় ফিরছেন। আমার শ্বাসগন্ধ এবার তিনি আঁচ করতে পারছেন। চোখ খুললেন মাতাজি। তারপর বললেন, শরীরের স্থিতাবস্থা জানতে চাইছ। ও কি পড়ে—টড়ে জানা যায়। আসন, প্রাণায়াম, নাক—টেপাটেপি অনেকেই তো শিখিয়েছে তোমাকে। তাতে কি তোমার কুণ্ডলিনী গতি পেয়েছে?
তিনি বললেন, একটুও না। কুণ্ডলিনী হল সাপ। তাকে জাগাতে পারলেই সাপের চলাচল সহজ হবে। সহজভাবে তাকে দেখতে চেষ্টা কর।
বললাম, কী করে দেখব?
বললেন, চোখ বুজে দুই ভুরুর মাঝে তাকাও।
তাকালে?
দেখবে সেখানে ছোট স্ফুলিঙ্গের মতো একটি বিন্দু রয়েছে। চোখ বন্ধ কর তুমি। নিবিষ্ট হও ভুরুর যুগলে। বলেই যোগিনী তাঁর হাতখানি আমার দিকে সোজা করে বাড়িয়ে ধরলেন। তাঁর আর আমার দূরত্ব দশফুট তো হবেই। দেখলাম সেই দূরত্বকে অতিক্রম করে তাঁর হাতখানি আমার মাথার উপরে উঠে এল।
আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মাতাজির হাতের ছোঁয়ায় শরীরে আমার বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমি কেঁপে উঠলাম। তারপর স্থির। বিন্দু দেখতে পেলাম। এত ক্ষুদ্র বিন্দু আগে আমি হাজার চর্চার ফলেও কোনওদিন দেখতে পাইনি। আজ দেখলাম। ক্ষুদ্র অথচ বিশাল। অন্তহীন অনন্ত জ্যোতি।
কিছু পর সম্বিত ফিরল আমার।
মাতাজি হাসলেন। বললেন, যা আজ দেখলে সেই দেখার দিকে রোজ নিয়ম করে বসবে। বসলেই কুণ্ডলিনী খুলবে। সাপ এসে ধরা দেবে। কোথাও আর ঘুরে বেড়াতে হবে না। কারও কাছে যেতে হবে না। সবই যে ভেতরে রয়েছে তোমার। নিজের ভেতরের গুটিসুটি শক্তিকে নাড়াও। সব টের পাবে। কৌতূহল ভালো, জানা ভালো, জিজ্ঞাসা ভালো। কিন্তু নিজের ভেতরটা না জানলে জিজ্ঞাসার উত্তর মিলবে কীভাবে?
এর পর থেকে আমি দুই ভ্রূ—র মধ্যে সন্ধান করতে লাগলাম, কোথায় আছে বিন্দু। চোখ বুজলেই যে একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নক্ষত্রের মতো আলোর ফুলকি দেখা যায় কেবল এতদিনে আমার বিশ্বাস হল। এর আগে অনেক চেষ্টা করেছি আমি। পারিনি। কিন্তু সেই দিনের যোগিনীর তাপবাহী স্পর্শের পর থেকেই আমি দেখতে শুরু করলাম বহুদূর থেকে গাঢ় সাদা বর্ণের একটা জ্যোতি বিন্দুরূপে ফুটে উঠে বড় হতে হতে আমার দিকে ছুটে আসছে। সেই বিন্দু আরও বৃহত্তর আলোকবৃত্ত রচনা করেছে।
মাতাজি এরপর অধ্যাত্মজগতের নিয়মকানুন আমাকে শিখিয়ে দিলেন। ধ্যান পদ্ধতি, প্রক্রিয়া সবই এমন জলের মতো করে দিলেন যে আমার পড়া, শোনা বোধ, উপলব্ধি কিছুটা আমার ভেতর ফিরে আসতে থাকল। যাঁদের এ বিষয়ে আগ্রহ আছে তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে মাতাজির কাছে গেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউই তাঁর যোগ—বিভূতির কোনও নিদর্শন পাননি। আসলে যেটা হয়, যোগীরা নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া তাঁদের অধ্যাত্মশক্তির পরিচয় কখনো দেন না। নামের জন্য, অহংকারের জন্য তাঁরা তো কাজ করেন না। আশ্চর্য সংযমই অনেকের কাছে তাঁদের রহস্যময় করে রেখে দেয়। এক্ষেত্রেও তাই—ই ঘটেছে। তবে মাতাজি কোনও সাধারণা যোগিনী নন। তাঁর বিভূতি আমি টের পেয়েছি সেই অমানিশার রাতে। তার আগে শ্মশানে বসেই মাতাজি অঘোরী সাধনার সারবত্তাটি আমার জিজ্ঞাসা মতো তুলে ধরলেন। যা থেকে বেরিয়ে এল সাধনার সেই পথ। তবে সে পথ আমার চেনা হলেও এখনও পর্যন্ত একা, যুগলহীন কোনও মহিলা অঘোরীর ক্রিয়াকরণ দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। এজন্য তারাশিব ভৈরবের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি হদিশ না দিলে এমন সিদ্ধাই ভৈরবী, মাতাজি, যোগিনীর দেখা হয়তো আমি কোনওদিন পেতাম না।
হুদা শ্মশান, গাঙ্গরা বিল থেকে ফুরফুরে এক হাওয়া উঠছে সমানে। মাতাজি এখানে আজ শ্মশানকালীর নামে যজ্ঞ করবেন। সেই আয়োজনে তাঁর ভক্ত শিষ্যরাও কিছু এসে জুটেছেন। তারাশিব এসেছেন। মা আজ সকলের কথামতো একমাস পর পাতালপুরী থেকে বের হলেন। গত একবছর থেকে হুদাবাসী তাই—ই দেখে আসছেন। যজ্ঞে আহুতি দিয়ে মাতাজি প্রতি অমানিশাতে মাত্র একবারই আহার করেন। এটা তাঁর দীর্ঘ দিনেরই অভ্যেস।
জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার খাদ্যগ্রহণে দীর্ঘ বিরতি দেওয়ার কারণ কী?
দেখলাম স্নিগ্ধ, শান্ত, সৌম্য মূর্তি মাতাজির মুখে তখন ঈশ্বরোপলব্ধিজাত এক প্রশান্তি। সাধারণত অঘোরীদের মধ্যে প্রশান্তির কোনও বালাই থাকে না। এঁরা উগ্র, বদমেজাজিই হন। আমি অন্তত তেমনটাই দেখেছি। শ্মশানে কোনওমতে টোঙ করে এঁরা থাকেন। সংকারার্থে শব নিয়ে দলবল এলে কেউ কেউ সেই টোঙে উঁকি দেয় মদের বোতল প্রসাদি করে দেওয়ার জন্য। অঘোরী সাধুর মুড ভালো থাকলে দেন, না থাকলে গালাগাল ছাড়েন। এঁরা পৈশাচিক স্বভাবেরও হন। ঘেন্নাকে একেবারে জয় করে ফেলেন। বলেন, শ্মশানবৃত্তি নাশের জায়গাজমি। শ্মশান সাধনায় শরীর শব হয়ে যায়। শরীর শব করা মানে রিপু, ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে ওঠা। শবের উপর বসে ধ্যানযোগ সারার অর্থ হল মনের উপর থেকে নীচে অবধি একেবারে সর্বস্তরের কামনাকে আগাছার মতো টেনে তোলা। তা তুলতে পারলে ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ আসে। তা এলে ব্যক্তিত্বও শ্মশান হয়ে যায়। এসব কথা প্রথম আমাকে বলেছিলেন দুবরাজপুরের সদানন্দ অঘোরী। প্রবীণ সেই অঘোরীকে আমি দেখেছি মরা এলে মরার কাঁথা টেনে গায়ে চাপাতে। মরা পুড়ে এলে মাথার খুলি ফাটানোর সময় খুলির কাছে গিয়ে পাতিল ধরতে। সেই পাতিলে ঘিলুরস ধরে এনে টোঙে বসে পরম নিশ্চিন্তে ভাত মেখে খেতে। এই মাতাজি সদানন্দস্বরূপ কোনও আচরণ বোধহয় করেন না। ততখানি পৈশাচিক মেজাজেরও তিনি নন। হলে হয়তো হুদাবাসীর কাছে এত সম্মানীয়া হতেন না। তিনি বোধহয় মগ্না মাতাজি। অঘোরীর পরিচিত স্থূল বৃত্তিসমূহের ঊর্ধ্বে। তাঁর আচরণে তেমনটাই আমার মনে হয়েছে।
আমার প্রশ্নের উত্তরে মাতাজি বললেন, যে ব্যোমশক্তি সুষুম্না নাড়ির মধ্য দিয়ে আমার শরীরে শক্তি সঞ্চার করে, তা থেকেই আমি খাদ্য বা পুষ্টি নিয়ে থাকি। এর জন্য বাইরের আহারের দরকার হয় না। তবে যেদিন ধ্যানশক্তির বাইরে এসে দাঁড়াই, যেমন আজ, সেদিনই কেবলমাত্র কিছু খেয়ে থাকি। নচেৎ নয়।
বললাম, এই শিক্ষা আপনি কোথায় পেয়েছেন?
বললেন, গুরু আমাকে এই বিদ্যা প্রদান করে এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষ আদতে একটি আত্মা। শরীরটা কোনও পরিচয় নয়। মানুষ কেবল খাবারের গুণে বেঁচে থাকে এ সর্বতোভাবে কখনো সত্য নয়। মানুষ আত্মা বলেই আধ্যাত্মিক উন্নতির বলে সে ঈশ্বরের জ্যোতিতেও বেঁচে থাকতে পারে। গুরুবিদ্যায় আমি যার মস্ত প্রমাণ।
তবে মাতাজির এই প্রায় নিরাহারা দশাপ্রাপ্তি কোনও ঈশ্বরের আশীর্বাদ কিন্তু কখনো নয়। এটা একটা সর্বৈব যোগশক্তি। আমাদের পতঞ্জলি যোগসূত্রের বিভূতিপাদেও এর উল্লেখ আছে। মাতাজি আসলে এমন এক শ্বাসপ্রক্রিয়াতে সক্ষম যার দ্বারা তিনি মেরুদণ্ডস্থ সূক্ষ্মশক্তির উৎসস্থল বিশুদ্ধ চক্রকে প্রভাবিত করতে পারেন। কণ্ঠের বিপরীত দিকে অবস্থিত এই বিশুদ্ধচক্র পঞ্চভূত, আকাশ বা ইথারকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। এই ইথার জড়কোষসমূহের অনুপরমাণুদের মধ্যবর্তী শূন্যস্থান দখল করে রয়েছে। মাতাজি এই চক্রতে মনঃসংযোগ করেই ইথারের সাহায্য না খেয়েও সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটা তাঁর পুরোপুরি ঈশ্বর নামধেয় একাগ্রতার আশীর্বাদ। এখানেও অলৌকিকতার কোনও গন্ধ নেই। আসলে অধ্যাত্মবাদে কখনোই কোনওদিন অলৌকিকতা মিশে ছিল না। এখনও নেই। অধ্যাত্মবাদ হল গিয়ে আদতে পুরোপুরি বিজ্ঞানের সাম্রাজ্য। সেটা না বুঝেই আমরা কিছু আধ্যাত্মিক গুরুদের ভেলকিবাজিতে মোহিত হয়ে পড়ি। সঠিক অধ্যাত্মবাদী মানুষ রহস্য রাখেন না। রহস্যকে ধরতে সাহায্য করেন। এই অঘোরী মাতাজি যার জ্যান্ত প্রমাণ।
শ্মশানে গিয়ে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মাতাজির সঙ্গে অঘোরী সাধনপন্থা নিয়ে সে সময় বিস্তারিত আলোচনা চলছিল। মাতাজি বলছিলেন, মৃত্যু হল গিয়ে চিরবিরাজমান আর তার ক্ষেত্রভূমি শ্মশান বলেই সাধনার ক্ষেত্র হল গিয়ে শ্মশান।
বললাম, সে তো সেই স্থূল মৃত্যুযোগকেই আপনি চিহ্নিত করছেন।
মগ্না ভৈরবী এরপর বললেন, আমরা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেই যে শ্মশানজমি মনে করে থাকি। তবে কুণ্ডলিনীর সাহায্যে যে স্থল শরীরের মৃত্যু ঘটে মৃত্যুর মধ্যেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে উপভোগ তার ভেতর এটাই প্রমাণ হয় যে মৃত্যুর পরও ফিরে আসা আছে। জীবন আছে আমাদের। তবে সে জীবন সূক্ষ্ম।
কীভাবে?
সাধনযোগে সাময়িক মৃত্যুর পর যখন আবার স্থূল দেহে ফিরি তখনই তো সূক্ষ্ম অস্তিত্বের খবরকে উপলব্ধি করতে পারি। আর এই উপলব্ধি আমাকে শিখিয়েছে মৃত্যু ঘটলে স্থূল অস্তিত্ব না থাকলেও একটা সূক্ষ্ম অস্তিত্ব সব সময় থাকে। স্থূল জীবন স্থায়ী হয়। আমার গুরু তাই বলতেন, জীবন হল গিয়ে মায়া। সেজন্য জীবনের পার্থক্য ঘটে। সুখ আসে। দুঃখ আসে। জীবনের জন্ম আছে, মৃত্যু আছে। মৃত্যুটাই হল সাধকের রূপান্তর। গুরু এ কথা বলতেন।
কীরকম!
সাধকের জন্ম হয় না। আবির্ভাব ঘটে। তেমনি তাঁর মৃত্যুও নেই। তিরোভাব ঘটে। এই তিরোভাব হল রূপান্তর। মৃত্যুতে এই রূপান্তর হয় না। কেননা সাধারণের স্থূল অস্তিত্বের রূপরেখা আগে সূক্ষ্ম জগতে তৈরি হয়। তারই ঘনীভূত রূপ নিয়ে স্থূল দেহ এ জগতে আসে। সেই স্থূলতে আবার সূক্ষ্মের রূপান্তর ঘটাতে পারেন সাধারণে নয়। সাধক। তাই সাধক শরীরে নয়টি চক্র থাকে।
ছয়টি চক্রের কথাই তো বেশিরভাগ সাধক বলে থাকেন মাতাজি।
যারা বলেন তাঁরা তো অঘোরী সাধন করেন না।
নিগমানন্দের বইতে আমি নয়টি চক্রের বর্ণনা পড়েছি।
নিগমানন্দের নাম শুনে মাতাজি তাঁর উদ্দেশে প্রণাম রেখে বললেন, তিনি শব সাধনা করতেন। শব সাধনা করার অর্থ কী জানো তো?
বললাম, ব্যক্তিত্বের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া।
মাতাজি বললেন, এই তো ধরতে পেরে গেছ। ব্যক্তিত্ব হল মুখোশ। যা মানুষের সত্তাকে সবসময় আড়ালে রাখে। ব্যক্তিত্ব যখন খসে পড়ে তখনই মানুষ সাধক হয়ে ওঠেন। আর সাধক হতে হলে নয়টি চক্র ভেদ করতেই হবে।
যাঁরা ছয়টি চক্রভেদের কথা বলেন তবে তাঁরা সাধক নন?
নরই নারায়ণে রূপান্তর হন। গুরু বলতেন, নররা শরীরের তিনটি চক্রের প্রভাবে চলতে পারে আর খররাও শরীরের তিনটি নিম্নস্থ চক্রের প্রভাবেই চলে।
খর মানে আপনি কি গাধা বোঝাতে চাইছেন এখানে?
অবশ্যই। মনুষ্য শরীর প্রথমে খর থাকে। নর হয় তখন, যখন ষট চক্র ভেদ হয়। আর নর নারায়ণ হন নয়টি চক্র ভেদ হলে পরে। সাধক মানুষ নারায়ণসম। নিগমানন্দ বাবা তাই নয়টি চক্রের কথা বলেছেন। শ্মশান কী জানো তো?
বললাম, শূন্যতা।
মাতাজি উত্তর পেয়ে খুশি হয়ে বললেন, মানুষকে কামনা বাসনা মুক্ত হয়ে শ্মশানসম হতে হবে তখনই না তারা মহাশক্তির রহস্য বুঝতে পারবে। শ্মশান ছাড়া তাঁর স্বরূপ কখনো বোঝা যায় না। সেজন্যই অঘোরী সাধনা শ্মশানেই করতে হয়।
আপনি তো সর্বক্ষণ শ্মশানে থাকেন না?
সাধনা যখন সূক্ষ্মে আসে তখন তো শরীরই শ্মশান। এটা তো নিশ্চয়ই জানো তুমি তন্ত্র সাধনা প্রতীক সাধনা।
অঘোরী সাধনাও তো প্রতীকি সাধনা।
অঘোরী সাধনা আদতে হল গিয়ে বাবা, অন্ধকার জয়ের সাধনা। এটা তো তন্ত্রেরই অঙ্গীভূত।
বললাম, ইতিহাস তো বলে মা, কাশ্মীরী কাপালিক থেকে অঘোরীদের উৎপত্তির কথা। এঁদের প্রাচীন নাম কালমুখ।
মাতাজি বললেন, তুমি পড়াশুনা করা ছেলে। আমার গুরু আবার সন্ন্যাসীবাবা কিনারামের ঐতিহ্য মানতেন।
বললাম, সতেরো শতকে ওঁর আবির্ভাব। ইতিহাস তো বলে মা, উনি নাকি মৃতদেহ ভক্ষণ করতেন। মুত্র পান করতেন।
তুমি এতো জানো আর এটা জানো না, এই মৃতদেহ ভক্ষণ আসলে ওই শরীরটাকে মড়া করে ফেলে নিজেকেই আত্মস্বাদ করে নেওয়া।
জিজ্ঞাসা করলাম, কীরকম!
মাতাজি বললেন, অঘোরী অর্থ হল অন্ধকারের বিলয়। এই বিলয়ে তাই শিবের বৈনাশিক রূপ ভাবনা উঠে আসে। এই তীব্র শিবভাবনা থেকেই তাঁরা শিবানুসারী। অঘোরীদের শ্মশানবাস শিবভাবনারও ফলশ্রুতি।
বললাম, চিতাভস্ম গায়ে মাখা, নরকপাল সঙ্গে রাখা, পচা নোংরা খাবার খাওয়া—এসব ভাবনার প্রতীকী রূপটা কী?
চিতাভস্ম শিবারূপে শামিল। নর কপাল একটি প্রয়োজনীয় জিনিস বই কিছু নয়। শ্মশানে মরার খুলিটা সহজে মেলে। অঘোরীদের তো আর থালা—বাসন নেই। ওটা তাঁদের পানপাত্র। খাদ্য খাবারের জায়গা বটে। আর পচা নোংরা খাবার খাওয়া ইন্দ্রিয়জয়ের একটা দিক। যে কারণে আবার অনেক অঘোরী সাধক নগ্ন থাকেন। আসলে জীবনকে যত কম উপকরণে সাজানো যায় আর কী। আর মূত্র পানটা হল গিয়ে শরীরের বস্তু শরীরে ফিরিয়ে নেওয়া।
অঘোরী সাধনার উদ্দেশ্যটা কী?
মোক্ষলাভই সমস্ত সাধনার আসল উদ্দেশ্য। জীবন—মৃত্যুর চক্র পেরোনোটাই অঘোরী সাধনা। সেই চক্র পেরোনোর জায়গাটা তাই শ্মশান। শরীরকে শ্মশান করে স্থূল শ্মশানে অঘোরীরা তাই সাধনে বসেন। মৃতদেহ থেকে হাড় ছাড়িয়ে অনেক সাধক সঙ্গে রাখেন, কেউ গাঁজা—মদ খান—এগুলো তো স্থূলতার প্রতীক। আসলে সমস্ত বস্তুতেই ঈশ্বর দর্শন করাটাই আসল। আর নিজের ভেতর শক্তিময়ীর বিকাশ। সেজন্যই কালী—তারার উপাসনা আমাদের। সমস্ত উপাসনার ভূমি এই শরীর আর শ্মশান।
বললাম, তাহলে শরীরকে শ্মশান করে সূক্ষ্মে গিয়ে সাধনার মূল পর্বে ঢুকে আবার কেন প্রতীক শ্মশানে এসে বসছেন আপনি? শ্মশান যখন শরীরটাই হয়ে গেল কুঠিতে বসে তখন শ্মশানে আসার আর দরকার কী, কী দরকার একে—তাকে দিয়ে শ্মশানকালীর নামে যজ্ঞস্থল সাজানো?
এ সময় গাঁওবুড়া উপস্থিত। সে বলল, এ কী বলছেন বাবু? মাতাজির যজ্ঞস্থল কি আমরা সাজাতে পারি? উনি নিজে তা সাজিয়ে নেন।
বললাম, আজ তো আর তিনি সাজাননি যজ্ঞস্থল। আজকের সারাটাক্ষণই তো তিনি পাতালবাসী।
এ কী বলছেন বাবু!
মানে?
মাতাজি সকালবেলাতেই প্রতি অমাবস্যার কাজ সেরে রাখেন।
আজ সকালে তিনি তো আর করেননি। সারা সকাল তিনি তো মগ্না ছিলেন। সে দৃশ্য আমি তো দেখেছি।
আপনি ভুল দেখেছেন বাবুজি।
কী বলছ যা—তা।
হ্যাঁ বাবু। সারা সকাল মাইজি আর আমি যজ্ঞস্থল সাজালাম আর আপনি বলছেন, আপনি মাইজির সাথ ছিলেন। তা কি হয়?
বুঝলাম, মাতাজি দুই দেহ অনায়াসে ধরতে পারেন। না হলে এমনটা হওয়া কখনো সম্ভব নয়। আমি আরও নিশ্চিত হলাম এই কথার মাঝে মাতাজির নির্বিকার ভাবটি দেখে। তিনি যেন কিছুই শুনছিলেন না এই বাক্যালাপ। মগ্না ছিলেন। কিছুপর দু’জনকেই হাতের ইশারাতে থামিয়ে তিনি আবার প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন।
মাতাজিকে তবু আমি বললাম, বুড়া যা বলছে তা কি সত্যি মাতাজি?
যদিও জানি আমার প্রশ্নটা এক্ষেত্রে একেবারে বোকার মতোই হল। প্রকৃত যোগী কখনো তাঁর যোগ—বিভূতি প্রদর্শন করতে চান না।
উত্তরে মাতাজি বললেন, এরকম তো কতই হয়।
আমি বুঝে গেলাম সকালে তিনি যেমন আমার সম্মুখে নিমগ্না হয়ে যোগ—বিভূতি প্রদর্শন করছিলেন ঠিক একইভাবে তিনি গাঁওবুড়ার সঙ্গে যজ্ঞস্থল সাজিয়ে তুলে সেই বিভূতিরই সাক্ষ্য রাখছিলেন। আর এর মধ্যে কোনওরকম কোনও অলৌকিকতা কিছু নেই। গভীর ধ্যানে ব্রহ্মানুভূতির প্রথম আবির্ভাব ঘটে মেরুদণ্ডের কাঠামোতেই, তারপর তা মস্তিষ্কের মধ্যে আসতে থাকে। সেই অতুলানন্দের বেগ দুর্নিবার হতে থাকে। যোগী তাঁর বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেন নানাভাবে। মাতাজি যেমন ঘটিয়েছিলেন দুই শরীর ধারণ করে। একাধিক শরীরে আবির্ভূত হওয়া একপ্রকার যোগশক্তি। পতঞ্জলির যোগসূত্রে এর উল্লেখ আছে। উভয়ত আত্মপ্রকাশের ঘটনা তো নতুন কিছু নয়। যুগযুগান্তর ধরে বহু সাধুসন্তদের জীবনেই এই ঘটনা প্রদর্শিত হতে দেখা গেছে। এটি আদতে কোনও অলৌকিক ঘটনা নয়।
মাতাজি বললেন, অঘোরী সাধনার মূল লক্ষ্য হল সীমার বন্ধনকে অতিক্রম করে যাওয়া। পঞ্চ স্থূলতত্ত্ব বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছে। সাধক নিজের এই পঞ্চ স্থূলতত্ত্বের আবরণ খুলে ফেলে দিয়ে তাঁর ভেতরকার কুণ্ডলিনীকে অপ্রতিরোধ্য করে নেন। তবে সেই সূক্ষ্মতার থেকে আবার যখন তিনি স্থলে আসেন তখন সেই স্থূল থেকে সূক্ষ্মে যেতে হয়। গুরুদেব আমাকে তেমন ক্রিয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যার জন্য আমি অমানিশাতে যজ্ঞ করি। কিছু আহার গ্রহণ করি। আর এ সময় আমার স্থূলতার ভেতর সূক্ষ্মতার বিবেক হয়তো বা কিছু জারি থাকে, যে কারণে অসুস্থ মানুষকে দৃষ্টিস্পর্শ দিয়ে আমি তার কষ্ট কিছুটা লাঘব করতে পারি।
বললাম, অষ্টসিদ্ধি রপ্ত হলে তো শুনেছি অনেক কিছু করা যায়।
ওসব সাধকের কাজ নয়। সাধক কখনো অষ্টসিদ্ধির জন্য লালায়িত হন না। অষ্টসিদ্ধি আপনি আসে। প্রদর্শনে তাঁর শক্তি ক্ষয় হতে থাকে। একসময় সাধক শক্তিহীন হয়ে পড়ে হাঁ—হুতাশ করতে থাকেন।
বললাম, প্রতি অমাবস্যাতে আপনি শ্মশানকালীর নামে হোম করেন কেন?
আমার এই প্রশ্নের সময় মাতাজি যজ্ঞাসনে বসবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন বেশ রাত হয়েছে। ভক্তশিষ্য পরিবেশিষ্ট মাতাজি। তবু যেন তিনি একক। নিমগ্না। সবখানে আছেন কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে যে, কোনওখানেই তিনি নেই। এই প্রশ্ন শুনে একটুও বিব্রত হলেন না তিনি। যজ্ঞাসনে বসে পড়লেন। পাশে পাতা আসনে আমাকে বসবার ইশারা করলেন। বললেন, যজ্ঞের মহৎ কোনও উদ্দেশ্য নেই। এ তুমি জানোই। তবে আমি তোমায় কেবল এখানে আমার উপলব্ধিটি বলতে পারি।
বললাম, সেসব শুনব বলেই তো বসে আছি মাতাজি।
হোম করার মূল লক্ষ্যই হল ভূতাগ্নিকে প্রাণবন্ত করে দেওয়া।
সে তো যোগ সাধনাতেও সম্ভবপর।
সূক্ষ্মের কাজ সূক্ষ্মে। স্থূলে আসলে প্রতীকবিধি পালন করতেই হবে। এ আমার গুরুর নির্দেশ।
সূক্ষ্মের যে ভূতাগ্নির অতীন্দ্রিয়বোধ তা কি স্থূলের যজ্ঞরূপের ভূতাগ্নিতে সম্ভব মাতাজি?
বললেন, ভূতাগ্নির অর্থই তো হল সূক্ষ্মদেহের অগ্নি। এই অগ্নি দেহে উৎপন্ন হলে দূরদৃষ্টি, দূরঘ্রাণ, দূরশ্রবণের কৃপা মেলে।
বললাম, স্থূল ভূতাগ্নিতে তবে কী মেলে?
যজ্ঞের অর্থ চৈতন্যের পরিণতির লক্ষ্য ছাড়া কিছুই নয়।
কীরকম সেটা?
যেমন ধরো হোম শেষ করে অগ্নিতে নারকেল ছুঁড়ে দিয়ে যজ্ঞ সমাপন করা হয়। নারকেল হল যজ্ঞকারীর নিজের মস্তিষ্কেরই প্রতীক। নারকেল জলে ভরা। মানুষের মাথা রক্তে ভরা। মানুষের মাথার সাদা শাঁস থাকে। যজ্ঞে নারকেলের আহুতির অর্থই হল যজ্ঞকারীর চিৎ সত্তার চৈতন্যে পরিণতি দানের বার্তা দেওয়া। এছাড়া আর কিছুই নয়।
বললাম, তাহলে সেই যজ্ঞ শ্মশানকালীর উদ্দেশে কেন করছেন?
মাতাজি এবার যজ্ঞস্থলে অগ্নি নিক্ষেপ করলেন। চারদিকে তখন ধ্বনি। জোঁকার। ঢাক বাজছে। কাঁসি। তারই মধ্যে মাতাজি বলতে থাকলেন, ‘শ্মশান হল পরব্রহ্মণ। মহামুক্তির স্থান। অঘোরী সাধনার লক্ষ্যই যে তাই। শ্মশানে তাই শ্মশানকালী স্বাভাবিক।
বললাম, কেন?
কেন আবার! শ্মশানকালী দুই পা জোড় করে শিবের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। মায়ের দুই পায়ের সজোরে চাপ কিসের প্রতীক জানো?
কিসের?
অগ্রগতি পশ্চাদগতি কোনওটারই তো নয়।
বললাম, মহাশূন্যতার প্রতীক।
মাতাজি বললেন, সেই শূন্যতা শ্মশানসম। তাই সংসারত্যাগী মানুষেরাই কেবল শ্মশানকালীর পুজো করেন।
বললাম, কারণ তাঁরা একমাত্র মোক্ষকামী।
একথা শুনে মাতাজি আমার দিকে একবার ঘুরে তাকালেন। তাঁর দৃষ্টিস্পর্শ পেয়ে দেখলাম নিমেষে আমার চোখ থেকে অনিত্য জগৎ কিছুটা যেন সরে সরে যাচ্ছে। তারই ভেতর দেখছি মা আমার মাথায় হাত রেখে মন্ত্র পড়ছেন, ওঁ ক্রীং ক্রীং হূং হূং হ্রীং হ্রীং দক্ষিণে কালীকে ক্রীং ক্রীং ত্রীং হূং হূং হ্রীং হ্রীং স্বাহা।
তখন ঢাক বাজছে সজোরে। বুঝলাম, আমি গৃহবাসী বলেই মাতাজি শ্মশানে বসেই আমার অনিত্য জগৎ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একমনে কেবল দক্ষিণাকালীর মন্ত্র পড়ে যাচ্ছেন।
এমন মন্ত্রঘোরে সমাহিত আমি আগে আর কখনোই হইনি।