অন্ধকারে কাজলরেখা পারের চিহ্ন যায় না দেখা
যাওয়ার কথা ছিল কংকালী। পথ ঘুরে গেল অন্যদিকে। পথচলতি মানুষই আমার পথ ঘুরিয়ে দেয় মাঝে মাঝে। পথে না বেরোলে, নিম্নবর্গের মানুষজনদের ভক্তিভাবের আকুলতাতে সামিল না হলে এ—পথের মর্মভেদী গোপন টানের প্রবল তছনছ কিছুই বোঝা যাবে না। ধরা যাবে টাটকা ঘ্রাণ। অজস্র মানুষের মধ্যে আনমনা উদাসীন বরাবরই আমার নজর কাড়ে বেশি। বিপুল জিজ্ঞেসার পাহাড় জমা হয় আমার। মনে হয় নির্বিকার, অদ্ভুত এক পৃথিবীর মানুষ এঁরা সবাই। এক—একজন উদাসীন যেন এক—একটা কোলাহলের ফল্গু। কাছে গিয়ে দাঁড়ালে সহজানন্দেরই স্রোত পাওয়া যায়। আর সেই স্রোতেরই বিধ্বংসী বন্যায় ভেসে যায় আমার জীবন। ভাসতে ভাসতে দেখি এইসব জীবনপ্রবাহ থেকে আসলেই ভেসে গেছে জাগতিক সব চাওয়া—পাওয়ার খড়কুটো। এসব ভেসে যাওয়ার খবর এলেই গন্তব্য ভেসে যায়। উলটেপালটে যায় তার সীমানা। কংকালী তাই হঠাৎ করে পরিবর্তিত হয়ে ওঠে দুবরাজপুরে। পথ বদলে চলে আসি আমি এখানকার অঘোরী সাধু সদানন্দের সঙ্গে কথা বলতে।
বদমেজাজি বলে অঘোরীদের দুর্নাম বরাবরের। এঁদের ভাবসিদ্ধির ব্যাঘাত ঘটলেই তেড়ে গালাগাল ছাড়ে। হিতাহিত থাকে না তখন। বইতে থাকে দুর্বাক্যের স্রোত। প্রীতি—সম্ভাষণে অভ্যস্থ মানুষ সহজে এঁদের কাছে ঘেঁষতে পারে না। চায়ও না। আসেই তো কিছু সৎকারে এসে নেশাচ্ছন্ন হতে আসা গুটিকতক মানুষ। মাঝে মাঝে এদের বিরক্তিতেই আসলে অঘোরী সাধুর মুখের আগল খুলে যায়। আর কিছু মানুষ আসে মারণ, উচাটন, বশীকরণ, প্রবৃত্তির দাওয়াই নিতে। এদের উৎপাতও সহ্য করতে হয় অঘোরীকে। মুক্তির সাধনায় রত প্রকৃত অঘোরী এসব ঝামেলা পোহাতে চান না। অমাবস্যার রাতে একলা শ্মশানে মড়ার উপর বসে জপ করা অঘোরীরা সংসারীর এসব বিষ নেবেনই বা কেন? তখনই তাঁরা অশ্রাব্য গালাগালে এদের আলগা করে। দুবরাজপুর শ্মশানের অঘোরী আমার উদ্দেশ্যটিও ধরে ফেলেছিলেন। প্রথম যেদিন সদানন্দের কাছে গিয়েছিলাম, ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
বললাম, একটু কথা বলতে চাই।
বললেন, শালা, রিপুধারী। খুব অহংকার না তোর শিক্ষিত বলে। যা বলব সবই তো খাতাবন্দি করবি। পাঁচজনকে জানাবি। চিনি না তোদের। ওরে আকাট মুখ্যু, তুই যে নিজে কিছু না জেনে জানোয়ারের বাচ্চা হয়ে রইলি তা তো বুঝলি নি। অপরকে জানাতে চলে এল। যা যা ভাগ। মদ, মেয়েমানুষ জান গে। কাজে দেবে।
সেদিন আর ধারে ঘেঁষতে দেননি সদানন্দ।
পরদিন যাওয়ার আগে শ্মশান—লাগোয়া চা আর তেলেভাজার দোকানে গিয়ে বসলাম। উদ্দেশ্য সদানন্দের মর্জি—মেজাজকে একটু জেনে—বুঝে নেওয়া।
দোকানি বললেন, এক বান্ডিল বিড়ি নিয়ে যান। বাবা বিড়িতে খুশি হন খুব।
বললাম, কতদিন আছেন বাবা এখানে? কথার ভাঁজে তো মনে হচ্ছে না বীরভূমের লোক।
কেটলিতে চা ঢালতে ঢালতে দোকানি জবাব দিলেন—শ্মশানে তো বছর পাঁচ ধরে দেখছি। একদিন বইললাম, বাড়ি কোথা বাবা? বইললেন, তুর কী দরকার? তুয়ার বাড়ি গেলে তু কি খ—বি? মাঝে মাঝে চা খেতে আসেন। তবে লানা জায়গার সাধু, মাতাজিরা বাবার খোঁজে আসেন। শ্মশানে থাকেন। বাবু, অনেকেই রেতে বাবাকে শ্মশানে ন্যাংটো দাঁড়িন থাকতে দেখেছে। হ্যাঁ যেঁয়ে দেখেছে একটো পিতিম্যার মতো ম্যাঁয়ে না কি বাবার কুলে বসে খুব হাঁসছে। সত্যিমিথ্যা জানি লাই। তবে উঁ বাবা সিদ্ধাই বটে।
জিজ্ঞেস করলাম, কী করে বুঝলেন?
আমি একদিন বাবু, রেতে আলছিল্যাম মড়া পুঁড়ানতে। দেখি কী, বাবার বসার জায়গাটোনায় বেদিটো বাবা সমেত অনেক উঁচানে। ইটো সত্যি কথা। ভয়ে আমি ছুটল্যাম চিতাটোর কাছে। সবাই বুললে, কী হ্যোঁয়ানছে? গড় গড় করে ঘামছি। বুইলব কী কথাটো। দেখি বাবা পাশে দাঁড়িন আছে! সবাইকে এসে বুইলছে, খিদ্যে পেঁয়েছে তুরা আমাকে খঁতে দে। আমরা বইললাম, বাবা খাবার কোতি পাবো। আমরা তো খাবার সঙ্গে আনিনি, মড়া পুঁড়ানতে এসেছি। বাবা বুললে, আতপচাল গুলান চিতাটোকে খঁয়ে দে। ভাণ্ডটো দে। মড়াটার খুলি আমার ত্রিশূলটো দিয়ে খুঁচান দে। রসটো আমি খাব আর বিড়ি দে না কেনে, আমি ইঁটো ভালো খাই। পেট ভরে আমার।
দোকানির কথামতো এক বান্ডিল বিড়ি নিয়ে সকাল—সকাল হাজির হলাম তাঁর ডেরায়।
দেখামাত্রই বললেন, এত অপমান করলাম তারপরও আবার এসেছিস যখন মনে হচ্ছে তোর অহং মাত্রা কম আছে।
বিড়ির বান্ডিলটা দিলাম সদানন্দ অঘোরীর হাতে।
খুশিতে তাঁর চোখ চক চক করে উঠল।
বললেন, এত কীসের উৎসুক্য তোর?
বললাম, জানার, বোঝার।
কী আর জানবি বাবা। এ পথে ব্যক্তিত্বের সীমা লঙ্ঘন না করতে পারলে কিছুই জানা যায় না বাবা।
মানুষের তো ব্যক্তিত্বই সব বলা হয়ে থাকে বাবা।
সেটা তো ভুল বলা রে। ব্যক্তিত্বই তো তোর সত্তাকে ঢেকেঢুকে রাখে। আর সত্তা ঢাকা পড়লে তুই নিজে কী, জানবি কীভাবে শুনি?
আমি চুপ। অঘোরীর নমনীয়তায়, কথার গভীরতায়, শব্দ চয়নে একেবারে মুগ্ধ। মনে হচ্ছে উনি রীতিমতো শিক্ষিত অঘোরী। বাংলার বেশিরভাগ শ্মশানে বাস করা অঘোরীরা নিম্নবর্ণের এলাকা থেকেই মূলত উঠে আসে। তাদের উচ্চবর্ণের সাধুদের মতো লোকপ্রসিদ্ধ নেই। শুধু অঘোরীই বা কেন, এখানকার তান্ত্রিক ভৈরবদেরই বা শ্রদ্ধা কতটুকু। শিক্ষিত সমাজের কতজনই বা শ্মশানে, এদের ডেরায় আসে। গুটিকতক অনুরাগী, তাও তাদের বেশিরভাগটাই পাঁড় মাতাল, নেশাখোর কখনো বা দু—একজন এদের শক্তি প্রয়োগে বিশ্বাসী মানুষ অঘোরী, তান্ত্রিকের ডেরাতে এসে উপস্থিত হয়। বাদবাকি মানুষ এদের ভণ্ড, ভিখারি, ভৈরবী বা অঘোরিণীর সঙ্গে বাস করা ব্যভিচারী বলে জানে। ক—জনই বা খেয়াল রাখে এই এলাকার মধ্যে বেড়ে ওঠা আত্মতত্ত্বজ্ঞানীদের। সদানন্দ অঘোরী হলেন তেমনই একজন মানুষ। আত্মজ্ঞান বা মুক্তির সাধনাটাই যাঁর কাছে মুখ্য। বাবাজি বলে চলেছেন।
শ্মশানবাস কেন জানিস আমাদের? কেন মড়ার কাঁথা টেনে গায়ে দিয়ে ওই আমরা?
বললাম, কেন বাবা?
শ্মশান বৃত্তি নাশের জায়গা। শ্মশান সাধনায় শরীর শব হয়ে যায়। তোরা বলবি শব যখন হল শরীর তখন আর কাজ কী তার? তখনই তো শ্মশানে যাওয়া। পোড়ানো। আমরা বলি শরীর শব করা মানে রিপু, ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে ওঠা। শবের উপর বসে ধ্যানযোগ সারার অর্থ হল মনের উপর হতে নীচ অবধি একেবারে সর্বস্তরের কামনাকে আগাছার মতো করে টেনে তোলা। তা তুলতে পারলে ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ আসে। তা এলে কোথায় আর তোর ব্যক্তিত্ব। কিছু নেই রে। সবই শ্মশান।
বলতে বলতে উচ্চস্বরে হাসতে থাকলেন বাবা। প্যাকেট খুলে একটা বিড়ি মুখে দিয়ে বললেন, নান যোগে শরীর শব হয় রে। চির বিরাজমান মৃত্যু সেখানে।
বললাম, আপনি তো শরীরের মৃত্যুর কথা বললেন।
উত্তেজিত হয়ে উঠলেন সদানন্দ অঘোরী। বিড়ির শেষাংশটা টেনে পেটের কাছে এনে সেখানেই ঠুসে ধরলেন আগুনটা।
তাঁর এই শরীর নির্যাতনে অবাক হলাম আমি।
বললেন, অবাকের কিছু নেই রে ছোঁড়া। শরীর মারতে শব করতে শরীরকে যোগে ব্যথা দিতেই হবে। যাতনা না এলে যতন হবে কী করে?
জিজ্ঞেসা করলাম, কীসের যতন?
—কিসের আবার শরীরের!
বিস্ময় প্রকাশ করলেন বাবা।
বললাম, সূক্ষ্ম শরীরের।
আমার এই কথায় খুশি হলেন অঘোরী।
বললেন, যাক তোর বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। বয়স কম তো। তাই মাথাটা মোটা হয়ে যায়নি। না হলে জানতে বুঝতে যারা আসে সব ব্যাটা মাথামোটা। শিক্ষার অহংকারে অশিক্ষা জড়িয়ে মরে। নির্ভেজাল বোধটাই নষ্ট হয়। দেখছি তোর বোধটা আছে। তা বাবা একটু যোগ শিখে নে না। তাহলে পথটা লিপিবদ্ধ করতে সুবিধে হবে। জেনে বুঝে অনুভব করে বলা ভালো না? জ্ঞান না হলে জ্ঞান বিতরণ করবি কীভাবে? শুধু বই পড়ে কি যোগ বোঝা যায়? যোগ করতে করতে যোগাচারের স্বরূপ জানা যায়। না হলে তো তোর জানা—বোঝা সব বীজগণিতের X Y Z হয়ে যাবে। সবই মনে করার ব্যাপার।
বললাম, শেখাবেন আমায়?
হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি।
বললেন, মাটি কামড়ে পরে থাকতে পারবি? বিদ্যা নষ্ট করতে পারবি? এসব না করতে পারলে কুণ্ডলিনী জাগরিত হবে না। এ পথ আলাদা রে। তোর নয়। শক্তি তরঙ্গে অনুভব তোর হবে সাধকসঙ্গে এসে, কিন্তু বশীভূত হবে না কখনো শক্তি। এসব তোর দরকার নেই। শুধু বোধটাকে একটু নির্ভেজাল কর তাহলেই অনেকখানি হয়ে যাবে তোর। সাধু হওয়া সবার কম্ম নয়। আর এ পথ বড় ভয়ংকর। জ্ঞানীলোক থেকে যোগীলোকে আসতে না পারলে কিছুই হবে না।
অঘোরীদের মূল সাধনা হল গিয়ে শব সাধনা। শব আসলে সদানন্দ কথিত সেই ব্যক্তিত্বের সীমানাকেই ডিঙিয়ে যাওয়া। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহের মতোই তো ব্যক্তিত্বও একটি পাশ। অঘোরী সাধু সেই ব্যক্তিত্বকেই নষ্ট করেন প্রথমে। তার জন্যই সাধনা। ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ সবসময়ই অহং অতিক্রম করার কথাই কিন্তু বলে এসেছে। এখানে Personality হল অহং। তার নাশের জন্যই শরীরকে শব করে তোলা। শবের উপর বসে মনের বৃত্তিসমূহকে নষ্ট করে ফেলা। শাস্ত্রে শব সাধনার দিনও ধার্য করা আছে। ভাবচূড়ামণিতে রয়েছে : অষ্টম্যাঞ্চ চতুর্দশ্যাং পক্ষয়োরুভয়োরপি। ভৌমবারে তমিস্রায়াং সাধয়েৎ সিদ্ধিমুত্তমাম।। কৃষ্ণ বা শুক্ল পক্ষের অষ্টমী ও চতুর্দশী তিথিতে মঙ্গলবারের রাতে শব সাধনা করলে বলা হয়েছে সাধকের উত্তম সিদ্ধি আসবে। তবে যে কোনও শবের উপর বসেই সাধনক্রিয়া করা যাবে না।
পর পর দিন কয়েক গিয়েক জুটেছিলাম সদানন্দ অঘোরীর কাছে। একদিন বললেন, আজ চতুর্দশী। শব সাধনার প্রশস্ত সময়।
বললাম, আজ তবে শ্মশানে শব সাধনা হবে?
অঘোরী বললেন, হবে বললেই কি হয় রে বাবা। ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা লাগে। তিনি মড়া না পাঠালে শব সাধনা আর কেমন করে হবে!
শ্মশানে তো রোজ কত মরাই আসে।
আসলে কী হবে রে। সব মড়ার উপর বসে সাধনা হয় না রে। জিজ্ঞেসা করলাম, তবে!
সদানন্দ জবাব দিলেন, দুই কৃষ্ণ—শুক্ল পক্ষ ধরে অপেক্ষায় আছি। অষ্টমী যায়। চতুর্দশী আসে। শ্মশানে আর উপযুক্ত মড়া আসে না। মাকে বলি, মাগো আজ যেন একবার শবের উপর বসে তোর নাম জপতে পারি।
কী ধরনের শব লাগে সাধনাতে?
অপঘাতে মারা যাওয়া শবই হল গিয়ে উত্তম। তা আর পাচ্ছি কোথায় বল!
বললাম, আজ পেয়ে যাবেন।
ব্যঙ্গাত্মক এক হাসি দিলেন সদানন্দ।
বললেন, কেন রে ব্যাটা, তুই আত্মহত্যা করবি না কি আজ!
আমি চুপ। কী আর উত্তর দেব এর। আসলে আমি তো শব সাধনার উত্তম দিন শুনে সেই থেকে মন থেকে চাইছি, শ্মশানে আজ শব সাধনা হোক। আমি এর ক্রিয়াকরণ দেখি। দেখাই আমার একমাত্র কাজ। মূল স্রোতের বাইরে দাঁড়ানো এইসব লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস—করা প্রান্তিক মানুষদের ইন্দ্রিয়, সুখের লালস, স্বার্থপরতার সম্বন্ধ ছেড়ে বেরানো ঈশ্বরনির্দিষ্ট আত্মজ্ঞানের ঐকান্তিক যত্ন, গুরুনির্দিষ্ট কর্মপথটি আদতে কীরকম—সেটুকু দেখা—জানা—বোঝার ভেতর যে বলতে গেলে এক অর্থে লোকায়ত ধর্মের শ্রেণিকরণটি দাঁড়িয়ে আমাদের গতায়ত মানবগোষ্ঠীর একেবারে বাইরে—আমি সেই বাইরের মানুষ হয়ে শ্রেণিকরণেরও আহার—নিদ্রা—মৈথুন ও স্থূল স্বার্থময় ভোগের বাইরে আচরণবাদের জীবনযাপন প্রণালীটি ধরতে চাই। আর সেটুকু ধরব বলেই চাইছি শ্মশানে আজ শব সাধনার উপযুক্ত মড়াটি হাজির হোক। এ চাওয়ার ভেতরে সদানন্দ অঘোরীর সেই ইচ্ছাময়ীর চাওয়াটি লাগবে কি না আমার জানা নেই। সদানন্দ আমাকে যতই ব্যঙ্গ করুন না কেন, আমার চাওয়ার ভেতর বিশ্বাসের একটা স্রোত ছিল। আর সেই স্রোতকে সত্যি করেই কাকতালীয় হলেও শ্মশানে আজ জলে ডোবা এক কিশোরের শব এসে উপস্থিত হল। স্বভাবতই অঘোরী তৎপর হয়ে উঠলেন শব সাধনায়।
ভাবচূড়ামণিতে বলা রয়েছে, যে ব্যক্তির যষ্টি (লাঠি) শূল (সূক্ষ্মাগ্র অস্ত্র) ও খড়্গাঘাতে প্রাণ গিয়েছে, জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে, বাজ পড়ে বা সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে এমনই চণ্ডাল জাতীয় শবকে শব সাধনায় ব্যবহার করার কথা—যষ্টিবিদ্ধং শূলবিদ্ধং খড়্গবিদ্ধং জলে মৃতম। বজ্রবিদ্ধং সর্পদষ্টং চাণ্ডালঞ্চাভিভূতকম।। তবে ব্রাহ্মণের শব পরিত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি পালিয়ে না গিয়ে সামনাসামনি লড়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে তার দেহও শব সাধনার কাজে উত্তম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এইসব শব অল্প বয়স্ক ও সুন্দর হওয়া আবশ্যক—তরুণং সুন্দরং শূরং রণে নষ্টং সমুজ্জ্বলম্। পলায়নবিশূন্যন্তু সম্মুখরণবর্তিনম্।। ভৈরবতন্ত্র বলছে যে কোন কোন শব সাধনার কাজে ব্যবহার করা যাবে না। যে ব্যক্তি স্ত্রীর বশীভূত, পতিত, অস্পৃশ্য, দুর্নীতিগ্রস্ত, শ্মশ্রুবিহীন, ক্লীব, কুষ্ঠরোগাক্রান্ত, বৃদ্ধ, সেইসব শব বর্জন করার কথাও বলা হয়েছে। দুর্ভিক্ষে মৃত ব্যক্তির দেহও শব সাধনার কাজে বর্জনীয়। সদ্যমৃত শব ছাড়া বাসি বা গলিত শবও সাধনার আধার হিসেবে কখনোই নেওয়া যাবে না—স্ত্রীবশ্যং পতিতস্পৃশ্যং নয়বর্জং হি তূবরং। অব্যক্তলিঙ্গং কুষ্যৌং বা বৃদ্ধভিয়ং শবং হরেৎ।। ন দুর্ভিক্ষমৃতঞ্চাপি ন পর্যুষিতমেব বা।। স্ত্রীজনঞ্চেদৃশং রূপং সর্বথা পরিবর্জয়েৎ।।
পুকুরে সাঁতার কাটতে গিয়ে জলে ডুবে মরা এক কিশোরের শব এসেছে শ্মশানে। আত্মীয়—পরিজন অকালে চলে যাওয়া এই ছেলের শোকে স্বভাবতই মূহ্যমান। এরই ভেতর সদানন্দ সাধনার কাজে শবকে ব্যবহার করবেন বলে জানালেন।
ছেলেটির বাবার কাছে শব বৃত্তান্তের সমস্ত খোঁজ নেওয়ার পর অঘোরী বললেন, ওরে শোন, শরীরের একটুতেই আনন্দ হয় আবার একটুতেই রাগ হয়ে যায়। শরীরের মতো নীচ গুণহীন আর কিছুই নেই রে। তোর ছেলে তো আর দেহ নয় রে।
শোকে আকুল বাবা কী আর বলবেন তখন।
বললেন, বাবা, আমার ছেলেটা অকালে চলে গেল যে!
শোকাকুল বাবার পিঠে হাত রাখলেন অঘোরী।
বললেন, তোর ছেলের শরীর গেছে রে বোকা। ছেলে তো যায়নি রে। এই শরীর আর তোর ছেলের আত্মা এক নয় রে। ছেলের শরীরটা গেছে কেবল। আত্মাটা আছে রে। ঈশ্বরসেবায় সেই আত্মাটি যাতে নতুন শরীর পায় আমি তাই কামনা করি রে। তোর ছেলের শবের উপর বসে আমি আমার এই স্থূলশরীর স্থূলভোগের জাগরণকে নিবৃত্তি দেব রে।
সদ্য ছেলে হারানো বাবার মাথায় এইসব অতীন্দ্রিয় বোধ কী আর ঢোকে তখন! জাগতিক সব থেকে দামি সম্পদ তিনি নিমেষে হারিয়ে বসে। যাকে তিনি একটু একটু করে বড় করতে—করতে স্বপ্ন দেখছিলেন উজ্জ্বল আগামীর, সেই শরীর—কথিকার বিনাশে যে তারও মৃত্যু—এই বোধ প্রতিটি সংসারীরই। তাই কিশোরের মুহ্যমান বাবা এবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ছেলেকে অঘোরীর হাতে তুলে দিয়ে তিনি ও পরিজনরা শ্মশান ছাড়লেন সবাই এই আশায়, যাতে ছেলেটির অঘোরী সাধুর সমুদয় সিদ্ধাইয়ে স্বর্গবাস হয়। এছাড়া সংসারীর মন, বুদ্ধি, জাগতিক চৈতন্য আর কী বা চেতে পারে। আজকের শ্মশানে আমি সেই জাগতিক চাওয়া—পাওয়ার মর্মান্তিক সাক্ষী। আমার এক চোখে তখন জল অপর চোখে অঘোরীর শব সাধনার তত্ত্বদর্শী ক্রিয়াকরণ দেখবার আগ্রহ। এরই ভেতর সদানন্দ সাধু আমায় এসে বললেন, মানুষ হল গিয়ে মাছ। মনটা তার জল। কামনা—বাসনাগুলি সূতা ও বঁড়শি। চিন্তা তার টোপ। তা তুই বাবা, টোপ ফেলবি বলে বসে আছিস। তা থাক। কংকালী থেকে সর্বাণী মাতাজি আসবেন। রাতে আমাদের শব সাধনা দেখে যা। তোর নতুন লেখায় অঘোরীদের শব সাধনার বাড়বৃদ্ধি হোক।
আমার চোখে তখন ছেলে হারানো বাবার শোকের সকরুণ ছবি আর শব সাধনার করণ দেখবার ঝোঁক। দুই ছবির ভাষ্যে অঘোরীর শ্লেষ খুব একটা বিঁধল না আমায়। আস্তে আস্তে শ্মশান জুড়ে অন্ধকার নামতে থাকল। জ্বলে উঠল দোকানির আলো।
সন্ধ্যার মুখে—মুখেই শ্মশানে এসে হাজির হলেন অঘোরিণী সর্বাণী। অদ্ভুত সাজ তাঁর। কালো জোব্বা পরিহিতা তিনি। মাতায় মস্ত জটা; প্রায় গোড়ালি ছুঁই ছুঁই। ডান হাতের ত্রিশূলে জবজব করছে টাটকা সিঁদুর। বাঁ হাতের কমণ্ডুলুর গায়েও স্বস্তিক আঁকা। অথচ হাতে ভৈরবীদের মতো শাঁখা পলার ব্যাপার নেই কোনও। কপাল ভর্তি আহুতির ছাই। বিভূতির খানিকটা দুই বাহুতেই মাখানো। আর গলায় রুদ্রাক্ষ—স্ফটিক মালার ব্যাপারই নেই কোনও। যা আছে তাতেই আমার প্রথম চোখ পড়ল। আর তা ধরতে পেরেই অঘোরিণী বলে উঠলেন, তুয়ার তেজ আছে বটে। ছিষ্টির ক্রিয়াশীল দাপটটো তু বুঝিস। তা তু বাপ এ পথে আয় না কেনে?
সর্বাণী মাতাজির কথাতেই বুঝলাম যে, তিনি একেবারে বীরভূমেরই খাঁটি দেহাতি মহিলা। সদানন্দ অঘোরীর মতো শ্লিষ্ট ভাষা বলা এখানে অনুপ্রবেশকারী নন।
বললাম, এ পথ কী আর আমার জন্য মা!
কেনে লয়? তু তো শরক পাখি রে।
বললাম, ঠিক বুঝলাম না মা।
সদানন্দ অঘোরী বললেন, শালিক পাখির কথা মা বইলছেন তুকে।
অঘোরী সাধুর দেহাতি ভাষায় আমি এবার চমকে গেলাম।
অঘোরিণী বললেন, শরক পাখি দেখিসলি। মরদ যখন উঁ ধরে পাকুড় গাছের আঁঠাটো দিয়ে আঁঠাকাঠি তৈয়ারি করে। ই আঁঠাতে শরক পাখি পড়লে আর ছাড়াবার উপায় লাই বাপ! তা তু বাপ শরক পাখি বটে। ইঁ পথের আঁঠাকাঠি লেগে তুয়ার গায়ে। ছাড়বার উপায় লাই। তু চলে আয় না কেনে? সাধন কর। আজ রেতে তুকে আমি শবের উপর উঁঠেছেই মা তারার মন্তর দিব। আর ইঁ মালাটোর দাপট জানিস তু। ইঁটো দিয়ে তুকে জপে বঁসাব।
বললাম, এটা তো মা মহাশঙ্খের মালা। এ তো বড় দুর্লভ বস্তু। শাস্ত্রে এর বিধি তো আছে। শনি মঙ্গলবার অমাবস্যায় চণ্ডাল মরলে তার অস্থি দিয়ে এ মালা তৈরি হয়। সর্বত্র সমবুদ্ধি না হলে এ মালা ধারণের অধিকার হয় না।
মা তারা তুয়ার জ্ঞান জুটিং দিলে। ইঁ ‘ত আমি শ্মশানে এঁসেই বুঁঝেছি। যখন তু মালাটোর দিকে তাঁকায়লি বাবা। তু ছটপটালে কী হবে? তু উথানে যেছিস, ইথানে যেছিস ইঁ’ত মা তারা তুকে আঁঠান দিছে রে। ইঁ আঁঠানে তু ‘ত সেটিং থাকবি।
অঘোরী বললেন, ইঁ ‘ত শালা পা হড়কালছে আর কেঁদে বেড়াচ্ছে।
অঘোরিণী বললেন এবার, উঁ তো কর্মক্ষয় করতে আলছে ইঠাঁই। জ্ঞানের চামড়াটো লেগে আছে গায়ে। মা ওটো খসিঁয়ে লিলেই মাটির ঠাট টো বেরিং যাবে। উঁ ‘ত একটো সাধন বটে। জন্মান্তরের খারাপ কাজের ফলভোগ করছে ইঠেঁয়ে।
বললাম, না মা। আমি সাধক তো হতে চাই না। আমি আপনাদের সাধনপথের বিষয়টা কেবল জানতে চাই। জানতে চাই শব সাধনাই কেন, এত এত সাধন আধার থাকতে?
অঘোরীর দিকে তাকিয়ে ফিরে মাতাজি বললেন আমায়, ইসব জানা এত সোজা লয় রে। তু টেঁসে গেলে শরীরটো তুয়ার টেঁসে গেল। তুয়ার আত্মাটো। উঁ ‘ত তুয়ার শরীর লয়। শরীর’ত স্থূলতা রে। শরীরে তুয়ার সাধনের ট্যার টোকাও হল গিয়ে কুণ্ডলিটো। উঁ জাগাং দিলে ইঁ শরীরটোর মরণ হল বটে। তন্তর’ত স্থূল থেকে সূক্ষ্মে জাগাং রে। ই জগতে শরীর শব হলে পর মা তারার লীলাটো বুঝাং যায়। মা ‘ত কুণ্ডলি বটে। শবের উপর বসে ক্রিয়া করে মার কাছে তু সেটিং থাকবি। তু বস ন কেনে? বস… বস…
বলতে বলতেই মাতাজি আমাকে প্রায় জোর করে ছেলেটির শবের ওপর উঠিয়ে দিলেন।
মায়ের ক্রিয়াকলাপ দেখে অঘোরী বাবা তখন মুখে হাসি এলিয়ে বলতে থাকলেন, ইঁ ছাড়াবার জো—লাই। এড়াবার উপায় লাই বাপ। খাবি মার। তু তুয়ার কুণ্ডলিটো জাগাং। শ্বাস লে নো কেনে? তু মরেই দ্যাখ না শালা। মা মালাটো উঁয়ার হাতে ইঁবার দ্যাও না কেনে?
মৃত একটা ছেলের ওপর বসে আমার শরীরটা যেন শান্ত হয়ে আসতে থাকল। মনে হচ্ছে যেন শ্বাস উঠছে না আমার বুকে। তবে শরীরে কোনওরকম কোনও অশান্তি নেই। আমার হাতে এখন শূদ্রের হাড় দিয়ে তৈরি মাতাজির গলার মালাটি।
মা বলছেন, জপ না কেনে তু তারা… তারা…
আমি সম্মোহিত।
ঠোঁট নড়ছে না আমার।
আবার বলছেন অঘোরিণী—মার খ্যালা ই জগতে বড় বোঝা দায়।
সর্বাণী মাতাজির কথা আমি শুনতে পাচ্ছি। অথচ শরীরে আমার সাড় নেই কোনও। কিশোরের শব আর আমি যেন এক হয়ে গেছি।
মাতাজি বলছেন, এটে খেঁয়ে লে দিকি ব্যাটা।
শুনতে পারছি মায়ের কথা। অথচ ঠোঁট অসাড়।
সদানন্দ বলছেন, মাগো মালাটো লিয়ে লাও কেনে। উঁয়ার কুণ্ডলীটো জাগাং গেছে। মহাশঙ্খের মালাটো সেটিং গিয়ে।
আমি বুঝতে পারছি অঘোরিণী আমার ঠোঁট ফাঁক করে তরল একটা কিছু ঢেলে দিচ্ছেন। বুঝতে পারছি তরল গলায় যাচ্ছে। আস্তে আস্তে নামছে। জ্ঞান আসছে আমার। মা—ই আমাকে শব থেকে আলগা করে শরীরে ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
বেশ বুঝতে পারছি আমি।
শব সাধনার মূল অর্থ হল নিজের শরীরের স্থূলতাকে নাশ করে দিয়ে কুলকুণ্ডলিনীর সাহায্যে শক্তি জাগরণ। তার জন্যই যোগক্রিয়া। শরীরকে যেহেতু সদর্থক শক্তিমত্তায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাই প্রতীক শবদেহে বসে অঘোরী সাধক—সাধিকা নিজেদের শরীরের সর্বোপরি মনের বৃত্তিগুলিকেই নাশের প্রচেষ্টায় রত হচ্ছেন। শরীরের স্থূলতার মৃত্যুর কারণে সেই প্রতীকময়তা যাতে সুন্দর অতীন্দ্রিয় বোধস্পর্শে দিশা পায় তাই শব সাধনের ক্ষেত্রে শব গ্রহণের নির্দেশিকা। যে সব শবদেহ গ্রহণ করতে নিষেধ রয়েছে শাস্ত্রে, খেয়াল করলেই দেখা যাবে সেগুলি সবই আসলে ইন্দ্রিয়দোষে পুরোপুরি দুষ্ট। অঘোরী সাধক—সাধিকা যেহেতু ইন্দ্রিয়গুলিকে সাধনায় বশীভূত করে নিতে চাইছেন, সেহেতু প্রতীক ইন্দ্রিয়বৃত্তিনাশক শবদেহই তাঁদের ক্ষেত্রে হতে পারে সাধনার আধার। তরুণ ও সুন্দর শবদেহ গ্রহণের কথাও এই জন্যই বলা হয়েছে যে, সেই শরীরগুলিতে বৃত্তির প্রকোপ কিছুটা হলেও কম। অল্প বয়স্ক শরীর কতখানি বেশি বা ব্যভিচারী হতে পারে। তবে ব্যতিক্রম আছে ঠিকই। আর সুন্দরের সঙ্গে মনের প্রফুল্লতাও সংযুক্ত। অঘোরী—অঘোরিণীরা শবদেহের ওপর বসে সাধনা করবেন, তার আগে শবকে প্রণাম করে, সুগন্ধি জল দিয়ে তাকে স্নান করিয়ে বস্ত্র পরিয়ে শবদেহকে মার্জনা করে চন্দন দিয়ে অনুলিপ্ত করে নিয়ে তার ওপর উপবেশন করে নিজের গুরুপ্রদত্ত মন্ত্রকে উচ্চারণ করে পুষ্পাঞ্জলির মাধ্যমে চক্রস্থ শক্তিকে স্বীকৃতি জানিয়ে শক্তিকে জাগানোর বিহ্বলতায় নিজেদের সকল ইহজাগতিক পথ ও পন্থা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবেন, সেই শবদেহের বহিঃসৌন্দর্য তো কিছুটা হলেও সাধক—সাধিকাকে সম্মোহিত করতে বাধ্য থাকবে। দৃষ্টির এমন গুণাগুণকে ওঁরা অস্বীকার করবেন কীভাবে? কেননা তখনও পর্যন্ত তো ওঁদের দৃষ্টির স্থূলতাই জারি থাকবে। শব সাধনে সূক্ষ্মতার মনোরম্য শক্তির অট্টালিকাতে প্রবেশ করলে পরে বাদবিচারের আর কোনওই অস্তিত্ববোধ থাকবে না। শব সাধনার প্রতীকী নান্দনিক যুক্তিপর্যায় আসলে এখানেই চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
অঘোরীদের শব সাধনার সঙ্গে নর বলিদানেরও প্রচলিত কাহিনিটিও আছে। বেদাদি প্রাচীন পুস্তকে, বৃহৎকথাদি উপাখ্যানে এর অবশ্য যথেষ্ট উল্লেখও আছে। ভবভূতি—র মালতীমাধব নাটকে দেখানো হয়েছে যে, অঘোরঘণ্টা চামুণ্ডার পুজোর জন্য মালতীকে বলি দিতে প্রস্তুত হলে মাধব তাকে এসে রক্ষা করছে। এইসব ছবি তৎকালীন অঘোরপন্থার ভয়াবহতাকেই আসলে স্পষ্ট করলেও এটা তো ঠিক ভারতবর্ষে আগে নর বলিদান প্রচলিত ছিল। বৌদ্ধতন্ত্রে কালচক্রযানে ও অনার্যতন্ত্রের পিশাচযোগতন্ত্রে মহামাংস ভক্ষণেরও কথা তো আছে। বজ্রভৈরবী বা বজ্রতারার উপাসনায় মহামাংস ভক্ষণটি ছিল আদতে সাধনারই অঙ্গ। কিংবদন্তি রয়েছে যে চিনদেশীয় বজ্রতান্ত্রিক ফা—হা—উ—চা ঢাকার বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে বজ্রতারার সাধনা করতে বাংলার অনেক তরুণকে ছলে—বলে—কৌশলে ধরে এনে বজ্রতারার পূজামণ্ডপে বলি দিয়ে তাদের মৃতদেহের ওপর বসে সাধনা করে তাদের মহামাংস প্রসাদ রূপে বিতরণ করতেন। শেষমেশ অবস্থাটা এমন দাঁড়াল যে, বাংলায় নাকি চণ্ডাল পুরুষ আর একটিও রইল না। চণ্ডাল সমাজ সম্পূর্ণরূপে একটি নারী সমাজে পরিণত হয়েছিল। বলা হয় যে, চণ্ডাল সমাজ ধ্বংস করে দেওয়ার পর বৌদ্ধতান্ত্রিকেরা বাংলার নমঃশূদ্র সমাজের দিকে হাত বাড়িয়ে ছিলেন। নমঃশূদ্ররা তখন বৌদ্ধতান্ত্রিক দেবী মনসার পুজো করত। নমঃশূদ্র সমাজের নিরপরাধ যুবকদের মৃত্যুর পর বাংলার কায়স্থ—ঠাকুররা ফা—হা—উ—চার কাছে আবেদন রেখেছিলেন এভাবে যেন নমঃশূদ্রদের হত্যা করে বাংলাকে পুরুষশূন্য করে দেওয়া না হয়। বলাবাহুল্য ফা—হা—উ—চা তাতে কর্ণপাত করেননি। এর কিছুদিন পরই ফা—হা—উ—চার মৃত্যু হয়। কথিত যে, কায়স্থ—ঠাকুররাই নাকি গোপনে তান্ত্রিক ফা—হা—উ—চাকে হত্যা করেন। বৌদ্ধ বাংলায় কায়স্থদের পদবির সঙ্গে ঠাকুর জড়িয়ে ছিল। আজও এর কিন্তু নিদর্শন লেগে রয়েছে বসুঠাকুর, ঘোষঠাকুর, মিত্রঠাকুর, গুহঠাকুরতা ইত্যাদি পদবিগুলির মধ্যে। বৌদ্ধতন্ত্রগ্রন্থের মহামাংস নিয়ে অনেকের সন্দেহ যে, এটা বোধহয় বড়া গোস্ত। আদতে তা কখনোই নয়। মাংস শব্দের আগে মহাশব্দ যুক্ত মানে এটা বৃহৎ মাংস বা গোরুর মাংস এটা হতে পারে না। এটা অবধারিতভাবেই মানুষের মাংসেরই উল্লেখ। বজ্রযোগিনী গ্রামটিরও আদতে অস্তিত্ব আছে। অপভ্রংসে সেটা বদরজৈনী হয়েছে এই যা। এককালে সুবিশাল ও সুশিক্ষিত গ্রাম হিসেবে এর প্রসিদ্ধি ছিল। এই গ্রামেরই কাছেপিঠে বাস ছিল নালন্দা বিহারের কুলপতি ধর্মপাল দীপঙ্করেরও। তিনিই তিব্বতরাজ গাউৎসেনের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন এবং অচিরেই শ্রীজ্ঞান অতীশ উপাধিতে ভূষিত হন।
সদানন্দ অঘোরী সাধনযোগের কথা বলেছেন। শরীরকে নির্যাতনের প্রশ্নে ঠেলে দিয়েছেন জ্বলন্ত অগ্নিকে নিজের শরীরে নির্বাপণ করে নিয়ে। অঘোরী সাধনার এই যোগক্রিয়া ভয়ংকর কঠিন সাধনাই আসলে যার কথা তিনি উল্লেখও পর্যন্ত করেছেন। তবে জনশ্রুতি যেরকম আজ তা আসলে রূপক পরিসরেই মোড়া। শরীরী নির্যাতন আদতে যেটা, সেটা যোগের মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির চৌহদ্দিকে টপকানো। যেটা কঠিনক্রিয়াই। নির্যাতন যেজন্য, তা শরীরের জাগতিক অভিক্ষেপকে পরিচিত গতানুগতিক থেকে বের করে নেওয়া। যার জন্যই গুরু নির্দেশিত পথ। সাধনক্রিয়ার কষ্টসাধ্যতা। সেটাই আসল নির্যাতন।
তন্ত্রক্রিয়া গুরুর আদিগন্ত কারায়তনে বন্দি। গুরু ছাড়া একমুহূর্ত এগোনোর পথ নেই। শুধু তন্ত্র কেন? যে কোনও শরীর সাধনার ক্ষেত্রেই গুরু নির্দেশিকা অগ্রগণ্য। বাংলার বাউলও গুরু—শিষ্যের মেলবন্ধনে সহজাত সাধনা। গুরুই সেখানে শিষ্যের শরীরী যোগসাজশে প্রধান সহায়ককারী মানুষ। তন্ত্রও তাই। এগুলি সবই তো করণক্রিয়া। গুরুর শেখানো পদ্ধতির তাই অস্বীকারের কোনও জায়গা নেই সহজিয়া সাধনক্রিয়ায়। গুরুর সাধকের সিদ্ধিযোগে সহায়ক হন। গুরু কথার অর্থও তো তাই। গু—কে যদি অন্ধকার ধরি আর রু—কে আলো হিসেবে দেখি, তবে দেখব যিনি অজ্ঞানতার তিমির থেকে শিষ্যকে আলোকবৃত্তের মধ্যে নিয়ে আসেন তিনিই গুরু। আলোক এখানে জ্ঞানপ্রাপ্ততা। শরীর সাধনায় মন্ত্রজ্ঞানের থেকেও বড় শরীরজ্ঞান। চক্রজ্ঞান। নাড়িজ্ঞান। যোগজ্ঞান। গুরুই তা কেবল প্রদান করতে পারেন। রপ্তকৌশল শেখানে পারেন। যার জন্যই বলা হচ্ছে কিন্তু করণক্রিয়ার কথা।
অঘোরী সাধনার ভয়ংকরতার সম্পর্কে বলা হয় যে, সাধক ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর হাত পা কেটে জ্বলন্ত অগ্নিতে ফেলে দেন। বারো ঘণ্টা পর আবার সেগুলি আপনাআপনি বেরিয়ে এসে তাঁর শরীরে সংস্থাপিত হয়। এটা আর কিছুই নয়। শব সাধনার মতোই পুরোপুরি রূপকযোগ। যাকে প্রতীকক্রিয়া হিসেবেও অনায়াসে আমরা দেখাতে পারি। অঘোরী সাধনে এই যোগকে বলা হয় খণ্ডমণ্ড যোগ। এখানে হাত পা কেটে অগ্নিতে সমর্পণ করার অর্থ হল সাধকের কূর্মাসনে বসে কূর্মের মতোই অর্থাৎ কচ্ছপের মতো হাত পা গুটিয়ে নিয়ে বসা। এই হাত পা হল গিয়ে ইন্দ্রিয়ের প্রতীক। খণ্ডমণ্ড যোগে সাধক ইন্দ্রিয়বৃত্তিগুলিকেই টুকরো টুকরো কাটার মতো বিনষ্ট করে ফেলেন। যেটাকে বলা হচ্ছে আগুনে পোড়ানো। কাম, ক্রোধ, লজ্জা, ঘৃণা, ক্ষুধা, নিদ্রা, ভয়, তৃষ্ণা ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গুলিকে সাধক বশীভূত করে রাখার জন্যই কূর্মাসনে গিয়ে বসেন। অনেকে আবার অঘোরী সাধনাতে শরীরের একটি প্রত্যঙ্গকেও কেটে ফেলার কথা বলেন। এই ভয়ংকরতাও প্রতীকে সামিল। এক্ষেত্রে কেউ বলেন পায়ের একটি অংশ কেটে বাদ দেওয়ার কথা। কেউ বলেন পুরোপুরি এক পা বাদ দিয়ে একপায়ে দাঁড়ানোর কথা। এটি আসলে একখণ্ডযোগ অঘোরীর। শরীরের একটি বিশেষ উত্তেজক ইন্দ্রিয়কে আগেভাগে অসাড়, অবশ করা। যা বাদেরই সামিল। মাথা কেটে ফেলার কথাও কোনও কোনও ক্ষেত্রে বলা হয় ভয়াবহতা প্রদর্শনের কারণে। যা একেবারে অবাস্তব। এটি অঘোরী সাধকের আদতে হল গিয়ে হেঁটমুণ্ডযোগ। বলা হয়, হেঁটমুণ্ড হয়ে সাধনক্রিয়া করলে দ্রুত জ্যোতি দর্শন হয়। কিংবদন্তি—অসুররা নাকি হেঁটমুণ্ড হয়ে সাধনা করত তাই তাদের উদ্দেশ্য দ্রুত সিদ্ধি অর্জন করত। নবখণ্ডযোগের কথাও বলা হয় অঘোরী সাধনে। ভয়ংকরতায়, ভয়াবহতায় যা শরীরের মূল অংশকে কেটে বাদ দেওয়া। অগ্নিখণ্ডযোগের ভয়ংকরতায় গল্প ফাঁদা হয় যে, গুরু শিষ্যের ঘাড়ের পেছন দিক দিয়ে একটি জ্বলন্ত লোহার শিক মেরুদণ্ড বারবার ঢুকিয়ে দেন। অথচ তাতে শিষ্যের নাকি কোনও ব্যথাভাবের প্রকাশ দেখা যায় না। অগ্নিযোগ এখানে গুরুর শেখানো পথ ও পন্থাতে কুণ্ডলিনী জাগরণ। যা অনেকাংশেই প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার মতো মনে করে থাকেন সাধক। তবে চড়ক মেলায় জিভ ফুটো করা, পিঠে বর্শী বেঁধানো ইত্যাদি শারীরিক নিদর্শনের ছবি আমরা দেখে আসছি অদ্যবদি বিশেষত গ্রাম বাংলায়। যেগুলির ক্ষেত্রে যোগক্রিয়াতে শরীরকে নিষ্ক্রিয় করে নেওয়া হয়। যাতে ব্যথা তখনকার সময় বেশ কম লাগে। শ্বাসশক্তির একটা গুণাগুণ তো আছেই। গাজনের সন্ন্যাসীর এই শারীরিক নির্যাতন মহাদেব বা ভোলানাথ কিংবা চড়কনাথ বা নীলনাথের আশীর্বাদিস্বরূপ অলৌকিকতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হলেও তা যে শরীরক্রিয়া, অনেকাংশেই হটযোগেরই পদ্ধতিরূপ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলার পির—ফকিরেরাও হটযোগের কূর্মাসন বা কচ্ছপসাধন রপ্ত করে নিয়ে নিশ্বাস টেনে—টেনে নিজেদের লিঙ্গকে ভেতরে সংকুচিত করে নিতে পারেন। বাউলরা দেহ চালনায় মিলনের সময়ে সঙ্গিনীর যোনিদ্বারে লিঙ্গকে প্রবেশ করিয়ে ক্রমশ এই পদ্ধতিতেই ছোটো করে এনেও অনেকেই বস্তুরক্ষায় তৎপর হন। শরীরস্থ প্রাণ আর অপান বায়ুকে একত্র সংযোগ করে হটযোগে বর্শী বা লোহার শলাকা বেঁধানো হয় শরীরের নরম জায়গায়। যার জন্যই চড়ক বেঁধানোতেও জিভ বা পিঠের দিকের চামড়াকে বেছে নেওয়া হয়। যদিও পিঠের চামড়া তুলনায় পুরু। সেখানে বর্শী বেঁধানো হয় চক্রস্থ দণ্ড—আধারে শরীরকে ঘোরানোর জন্যই। তবে এসব ক্রিয়াযোগে ভগবান কতখানি লাভ হয় বলা দুষ্কর। যেটা হয় লক্ষ্মীলাভ। ভগবানের নামে সন্ন্যাসযোগে গাজনের সাধুর হাতে তো কিছু টাকাপয়সার আমদানি হয়। ভগবান কথার এক অর্থ তো শূন্যতা। ভগ অর্থ শক্তি। একে স্ত্রীযোনি হিসেবেও দেখতে পারি। ‘বান’ অর্থ অধীশ্বর। লিঙ্গ কল্পনা করে নেওয়া অস্বাভাবিক কোনও ব্যাপার নয়। তাহলে ভগবান কথার অর্থ দাঁড়ালো : শক্তির যিনি অধীশ্বর তিনি ভগবান। দেহসাধক, যোগী, অঘোরী—সবাই শরীরে শক্তির অধিকারকে ধরে রাখতে সক্ষম। যা সৃষ্টি হচ্ছে শূন্যতা থেকেই। শরীর শূন্য হচ্ছে বায়ুর ক্রিয়ায়। শক্তির ঘনীভূত রূপকে বলা হচ্ছে যে স্থূল জগৎ। সাধক সেই শরীরের স্থূলতার ঘটাচ্ছেন বায়ুর ক্রিয়াতেই। ফলে তাঁর শরীরে ভগবানের সৃষ্টি হচ্ছে। বিজ্ঞানও বলছে শূন্যতা থেকেই শক্তির উদ্ভাবনের কথা। সাধক শরীরে শক্তি জাগছে শূন্যতার মধ্য দিয়ে। আর শূন্যতা জাগছে যোগে। কাজটা মোটেই সহজসাধ্য নয়। অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। যা যোগে রপ্ত করে নিতে হয়। যথেষ্টই গুহ্য কাজ। তা গুরু শেখান। আর এইসব সহজিয়া সাধনকর্ম যেহেতু বাইরে প্রকাশের ব্যাপারই নয় কোনও তাই সাধক দেওয়াল তোলেন। বাউল বলেন : আপন সাধন কথা না কহিও যথাতথা। তান্ত্রিকেরও মত তাই। অঘোরী সাধকও সেই একই পথেই চলেন। দেহসাধনার মুখ্য উপজীব্য বস্তুই গুহ্যতা। রহস্যময়তা। তার কারণ সেখানে তো শুধু দেহযোগ নয় দেহমিলনযোগও বর্তমান। সাধক আর সাধন সঙ্গিনীর শরীর মিলছে। ধ্যানে, যোগে, নিয়মকানুনে। যোনি—লিঙ্গ এক হচ্ছে। এভাবেও নাকি ভগবান লাভ হচ্ছে! তাঁদের অনুভূত ভগবান। চক্রস্থ শক্তিতে মিলনে বীর্যগতি সাধকের মস্তিষ্কে উঠে যাচ্ছে। সাধিকার যোনিতে পতন হচ্ছে না। দুইজনেই শ্বাসযোগে বীর্যপাতকে ঠেকিয়ে দিচ্ছেন। তার কারণেই শরীরস্থ শূন্যতার জন্ম। তার ভেতর পরম লাভ। বাউল বীর্যরক্ষা বা বস্তুরক্ষাকে আবার পরম বলে মানলেও তান্ত্রিক তাকে কখনো মুখ্য বা পরম বলে মানেন না। তবে অঘোরী সাধনে যে ভয়ংকরতার আড়াল তা কিন্তু সেই গুহ্যতা রাখবার কারণেই সৃষ্ট পথ। যাতে টপ করে সেখানে সাধারণের প্রবেশ কখনো না ঘটে। এছাড়া এই অতিরঞ্জন ভয়ংকরের কোনও মানেই নেই। আর একে সমীহ আদায়ও বলা যায় না। কারণ, একে তো এটি প্রান্তিক সাধন তার ওপর এইসব গালগল্প বিশ্বাসযোগ্যতার পর্যায়েও যাবে না যা দিয়ে অঘোরীর রোজগার হবে কিছু। কেননা প্রান্তিক সাধনা এখন নীচু স্তরেই চলে গেছে সাধনকারীর নানা সব ভ্রষ্টাচারে আর ব্যভিচারে। তবে প্রকৃত সাধক বা সাধন—কাঙ্ক্ষিত মানুষের এখন অভাব আছে তা কিন্তু বলা যাবে না।
বলা হয় অঘোরী সাধনে কায়কল্প যোগের মাধ্যমে অঘোরী সাধক সাপের খোলসের মতো পুরোনো শরীরটা অগ্নিচুল্লিতে পুড়িয়ে একেবারে নতুন দেহ ধারণ করেন। এখানে যেটা হয়, কুলকুণ্ডলিনীশক্তির জাগরণে দেহের কোষগুলির গতিবেগ এত বেশি মাত্রাতে চলে যায়ে যে তার অবক্ষয় ভয়ানকভাবে কমে আসে। ফলে সাধন শরীরে জরা গ্রাস করতে পারে না সচরাচর। এটাই হল পুরোনো দেহ পুড়িয়ে নতুন দেহ ধারণের গল্প।
শরীরকে শ্মশান করে নেওয়া বা শব সাধনায় বসা এই দুই ক্রিয়াকল্পই আসলে করণক্রিয়া। তার জন্য প্রয়োজন চক্রক্রিয়া পদ্ধতির। গুরু সেই চক্রকেই আগে সম্যকজ্ঞানে শিষ্যকে উপলব্ধির স্তরে নিয়ে যান তারপরই শুরু হয়ে যায় শিষ্যের চক্রস্থ শক্তির জাগরণ। এই জাগরণই অঘোরী সাধনায় মূল ক্রিয়া। তন্ত্র সাধনার মূলেতেই আছে স্থূল থেকে সূক্ষ্মে যাওয়ার আচরণবিধি। সেজন্যই আদতে শ্মশানে অঘোরী—অঘোরিণীর শব সাধনা। সদানন্দ অঘোরী ও সর্বাণী মাতাজি এখন তারই প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এদিকে রাত গাঢ় হচ্ছে। শুনশান শ্মশান। শেয়াল ঘুরছে চারধারে। আধপোড়া মানুষের হাড়ের টুকরো টান দিচ্ছে সে। কয়েকজন ভক্তশিষ্যর সঙ্গে আমি তখন শবের আশেপাশে। দেখছি অঘোরী—অঘোরিণী একত্রে শব বন্দনা সারছেন। মন্ত্র পড়ছেন আর প্রণাম করে পুষ্পাঞ্জলি দিচ্ছেন। পুষ্পাঞ্জলির ফুল ছড়িয়ে পড়ছে মৃত কিশোরের মুখে।
অঘোরী—অঘোরিণী বলছেন, হূঁ হূঁ হ্রীং হ্রীং কালিকে ঘোরদংষ্ট্রে প্রচণ্ডে চণ্ডনায়িকাকে দানবান দারয় হন হন শবশরীরে মহাবিঘ্নং ছেদয় ছেদয় স্বাহা হূঁ ফট্…
আমি দেখছি শবের ওপর উঠে বসছেন অঘোরিণী।
অঘোরী তখন শবের পায়ে হাত দিয়ে পড়ে রয়েছেন শ্মশানজমিতে।
আমার শরীরটাও দেখছি চুপ হচ্ছে ক্রমশ। শ্মশান চুপ। অঘোরী—অঘোরিণী জপে বসেছেন মৃত কিশোরের ওপর। শেয়ালের শব্দ ছাড়া শ্মশানভূমিতে আর কোনও শব্দ জেগে নেই। আমিও শব হয়ে উঠছি আবার এখন।