শবেরে শিবত্ব দিলে নাশিতে যম—যন্ত্রণা

শবেরে শিবত্ব দিলে নাশিতে যম—যন্ত্রণা

গত শতকের নয়ের দশকের শুরুটাই ছিল আমার তীব্র বয়ঃসন্ধির কাল। আর সেই সময়ই শরীরে সেই অদ্ভুত রোগটা এসে বাসা বেঁধেছিল। ঘরে আমি একদমই থাকতে পারি না। বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা কষ্ট। বড় ছটফট করি। ঘর থেকে বেরোলেও শান্তি নেই। ইতস্তত ঘুরে মরি। গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি। অনেক রাত অবধি বসে থাকার সাহস নেই। সন্ধ্যা একটু মজলেই তাই ফিরে আসতে হয় বাবা—মায়ের ভয়ে। আবার আমার কষ্ট বাড়ে। ছটফটানি শুরু হয়। পড়াশুনোয় মনযোগ দিতে পারি না একেবারে। বকা খাই বাবা—মা ও মাস্টার মশাইয়ের কাছে। এভাবেই চলতে চলতে একসময় এসে হাজির হয় স্নাতক ছাত্রদশা। বাড়াবাড়ি শুরু হয় আমার। আমি তখন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই প্রায়—প্রায়ই। শ্মশানে রাত কাটাই।

শ্মশানে যাওয়ার বাতিকটা হয়েছিল গঙ্গার ধারে যেতে গিয়েই। আমাদের ছোট মফসসলের অনেক দূর পেরোলেই গ্রাম শুরু। আর গ্রামের শেষ হাতাতেই গঙ্গা—লাগোয়া শ্মশান। এখানটায় বসলেই বুকের কষ্টটা খানিক যেন ধরে আসত। ছটফটানি কিছুটা কমার ফলে হালকা লাগত খানিক। একদিকে মৃত্যুর হাহাকার; কাঠের চুল্লিতে মানুষ পোড়ানোর গন্ধ অপরদিকে বেশ দূরে বটতলায় সাধুবাবার আখড়া; হঠাৎ হঠাৎ ভৈরব—ভৈরবীর আগমন। তারই মাঝে একদিন এসে হাজির হলেন গলায় বিশাল হাড়ের মালা পরে, হাতে এক মানুষের মাথার কঙ্কাল নিয়ে কালো পোশাক পরা উঁচু—লম্বা, মস্ত জটাধারী, দশাসই সাধু। এতদিন আমি লাল পোশাকে রুদ্রাক্ষ ও স্ফটিকের মালাতেই দেখতে এঁদের অভ্যস্ত। বিসদৃশ এই সাধুকে দেখে আমার মনে তখন অতল জিজ্ঞাসা। এতদিনে শ্মশানবাসী তারাপদ সাধু আমার বন্ধু—সুজন—সুহৃদ। তিনি বুঝে নিয়েছেন সব অনুসন্ধিৎসা। দুজনের কথাবার্তার পর তিনি বললেন আমায়, ওকে একটা প্রণাম কর বাপ আমার। সিদ্ধ অঘোরী। আশীর্বাদ নে।

কানে আমার ঝাপট লাগল। বুঝলাম বার কয়েক শ্মশানে—শ্মশানে ঘুরে, রাত কাটিয়ে ইনি লালবেশের তান্ত্রিক সাধুগুরু নন, ভৈরব—ভৈরবীর দলেরও তো নন, একেবারে আলাদা গোত্রের। পোশাকে—আশাকে, বলনে—চলনে। প্রথম সেই অঘোরী নামটির সঙ্গে আমার পরিচয়।

অঘোরী বললেন তারাপদ সাধুকে, ওটো কে বটে?

বাবা, আমার কাছে আসে, থাকে। ও’ত…

বাক্য শেষ করতে দিলেন না অঘোরী বাবা। আমার দিকে সরাসরি চেয়ে বললেন, তুর মনটো আঁচুপাঁচু করে শালা। তারাপদ সাধুর দিকে ফিরে বললেন আবার, ইঁ পিরীতি বাবা অন্য জিনিস! এতে মার অবিশ্যি সায় আছে। রেতে ঘুমিন নাই, ঘুম থেকে ডেকে তোলানছে ওকে। তারাপদ তোর কাছে পৌঁছান দ্যিছে। ইঁ শালা ইদিকে উদিকে ছ্যুটে বেড়াবে। সব জাগাং যাবে। বলইবে, বলিং দাও এটো কী ওটো কী?

তখনও পর্যন্ত আমি যাকে বলে আনকোরা একেবারে এসব সাধনা ও ভাষার এলাকায়। শিষ্ট উচ্চারণে অভ্যস্ত আমি তাই বীরভূমের অঘোরী সাধকের দেহাতি ভাষা সবটা ধরতে পারিনি। ওই অঞ্চলের কথ্য ভাষায় আনুনাসিক চন্দ্রবিন্দুর প্রভাব আমাকে তখন হোঁচট খাওয়াচ্ছিল। আজ তো বুঝি, অঘোরী বাবা সেদিন আমায় এক পলক দেখে ভুল কিছু বলেননি। এই এলাকায় ছুটে বেড়ানোর অভ্যাস তো আমার আজও গেল না। ষোলো বছর পার হয়ে গেল—গত শতক পেরিয়ে এ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত ধসে গেল আমার সেই চেনা গঙ্গার পার ভাঙার মতো; তলিয়ে গেল অনেক লেখায়, বইয়ে—ঘোরাফেরা, জানাবোঝার অভিজ্ঞতা বটতলাসহ তারাপদ সাধুর আখড়ার মতো। তবু যা কিছু অকথিত রইল আজও তার একটি প্রধান বিষয় হল বাংলা ও বাঙালি সাধুর অঘোরীপন্থা। এখানকার অঘোরী—অঘোরিণীদের সাধনপন্থা, যোগ, বীভৎসতা, পৈশাচিকতাই এই নতুন বলার বিধৃত অধ্যায়।

অঘোরী কথার অর্থ হল, যার ঘোর কেটে গেছে। তন্ত্র মতে বলা হয়েছে—অঘোরান্ন পরো মন্ত্র অর্থাৎ অঘোর মন্ত্রের পর আর কোনও মন্ত্র নেই। তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই, অঘোরপন্থি সাধনাই শ্রেষ্ঠ সাধনা। অঘোরী সাধুদের সম্পর্কে নানা বদনাম আছে। বলা হয়, তারা মানুষের মাথার খুলি—যুক্ত যষ্টিদণ্ড নিয়ে ঘোরাফেরা করে সাধারণজনকে ভয়—টয় দেখায়। নিজের শরীরকে আঘাত—টাঘাত দিয়ে রক্ত বের করে বীভৎস আচরণে রোজগারে সহায়ক হয়। কথা একেবারে অমূলকও নয়। অঘোরীদের সম্পর্কে মানুষ মারা, মানুষের মাংস খাওয়া এমনকী মন্ত্র—বলে পুনরায় তাকে জীবিত করে দেওয়ার কিংবদন্তি পর্যন্ত আছে। এর থেকে আসলে যেটা সহজেই অনুমিত, অঘোরীপন্থীরা নানা যোগবিভূতি জানেন। অঘোরীরা যেমন শক্তির উপাসক হন আবার সাধন ভেদে তাঁরা শিবেরও উপাসনা করে থাকেন। শৈবপন্থী অঘোরীরা হাড়ের মালার সঙ্গে শিব—শক্তির প্রতীক হিসেবে তাই রুদ্রাক্ষের মালাও ধারণ করে থাকেন, তবে অঘোরী সাধুদের মানুষকে বীভৎস আচরণ দিয়ে ভয় প্রদর্শন বা ক্রূরতা সম্পর্কে যথোচিত শাস্ত্র বর্ণনাও তো আছে। সেখানে আবার তাঁদের যোগসিদ্ধি সম্পর্কেও সংশয় রাখা হয়েছে, বলা হয়েছে, মাথা ন্যাড়া, দণ্ডধারী, গৈরিক পোশাক পরা জটাজূট ছাই—মাখা নমঃ শিবায় উচ্চারণ করা সাধুরা যদি অনেক দেবদেবীর অর্চনার অধিকারী হয়েও ক্রূর হয়, যথোচিত ক্রিয়া অনুষ্ঠান না করে তবে তারা কীভাবে সিদ্ধ হবে—মুণ্ডী চ দণ্ডধারী বা কাষায়বসনোহপীবা। নারায়ণবদোবাপি জটিলোভস্মলেপনঃ।। নমঃ শিবায়বাচ্যোবা বহ্বচ্চর্চাপূজকোহপিবা। ক্রিয়াহীনোহথবা ক্রূরঃ কথং সিদ্ধিমবাপ্লুয়াত।। অঘোরীদের চক্রে বসা, যুগল সাধনা নিয়েও আবার দত্তাত্রেয় সংহিতা একইরকমভাবে সংশয় প্রকাশ করে বলেছে, যোগক্রিয়াই যোগসিদ্ধির কারণ আর এটাই সত্য। যারা কাম—প্রবৃত্তি ও খাওয়া—দাওয়ার আনন্দের জন্য যোগীর বেশ ধারণ করে, তাদের কেমন করে যোগসিদ্ধি আসবে—ক্রিয়ৈব কারণং সিদ্ধেঃ সত্যমেতত্তু সাংস্কৃতে। শিশ্নোদরার্থং যোগস্য কথং বা বেশধারিণঃ।। কাশীখণ্ড আবার বলছে যে, কলিতে যোগসিদ্ধি আসে না। তাই তপস্যাও সিদ্ধি হয় না। কলিতে ইন্দ্রিয়বৃত্তিই চঞ্চল হয়, মানুষের আয়ুও তাই কম, সেজন্য যোগোৎপত্তিরই প্রশ্ন নেই কোনও—চঞ্চলেন্দ্রিয়বৃত্তিঃ স্যাত কলিকলমষজদ্ভনাত। অল্পায়ুঃ সাত্তথা নৃনাং ক্কেহ যোগমহোদয়ঃ।। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, শাস্ত্র অঘোরীপন্থার যোগকে একপ্রকার নস্যাৎ করে—টরে অঘোরীদের সন্ন্যাসীর আসন থেকেই নামিয়ে আনতে চেয়েছে। অঘোরী—অঘোরিণীদের বিশৃঙ্খল জীবনকে স্পষ্ট করেছে খালি। যুগল সাধনার নামে প্রবৃত্তির স্খলন, মদ—মাংস খাওয়া, সাধারণজনকে ভয়—সৃষ্টি, অকথ্য—অশ্রাব্য গালাগাল দেওয়া, ঘৃণিত বস্তু গু—মুত গায়ে মাখা; খাওয়া, খারাপ ব্যবহার করে ভিক্ষা চাওয়া ইত্যাদি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে বেশি। একমাত্র তন্ত্রই অঘোরীপন্থাকে শ্রেষ্ঠ সাধনার সিংহাসনটি দিয়েছে। অঘোরীদের সম্পর্কে চলে আসা সেইসব বদ্ধমূল ধারণা এখন যে কেটেছে তা তো নয়। বাংলার অঘোরীপন্থাতেও সেই চর্বিতচর্বণ স্পষ্ট ও বিবর্তিত। তাই অঘোরীদের থেকে অনেকেই দূরে থাকতে পছন্দ করে। এদের সাধনাকে না—দেখে না—জেনে না—বুঝে বীভৎসতা ও পৈশাচিকতারই কেবল দোহাই পারে। ব্যাপারটা আদতে মোটেই সেরকম নয়। আমার অভিজ্ঞতা অন্য কথাই বলে।

তন্ত্র সাধনার প্রধান ক্ষেত্রভূমি হল শ্মশান। শ্মশান হল আদতে সেই তন্ত্রের পাশমুক্তি বা শূন্যতারই প্রতীকী। যে মানুষ তার হৃদয়কে কামনা বাসনামুক্ত করে শ্মশানের মতো করতে পারেন তিনিই তন্ত্র সাধনার সেই মহাশক্তির রহস্য বুঝতে পারেন। তান্ত্রিকগুরু তাই বলে থাকেন, শ্মশান ছাড়া তাঁর স্বরূপ কখনো বোঝা যাবে না গো। হৃদয়কে শূন্য করো। সেই শূন্যতায় এসে তিনি গো তিনি, পূর্ণ হয়ে যাবেন।

চিরবিরাজমান মৃত্যুর ক্ষেত্র হল শ্মশান। আর এই শ্মশানই তাই অঘোরীর সাধনারও প্রধান ক্ষেত্র। সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেই অঘোরী সাধক শ্মশানভূমি হিসেবে দেখেন। মৃত্যুকে তাঁরা স্বতন্ত্র রূপের ভেতর নিয়ে এসে পুজো করে থাকেন। কুণ্ডলিনীশক্তিকে তাঁরা জাগিয়ে স্থূল শরীরের একেবারে মৃত্যু ঘটিয়ে সূক্ষ্ম শরীরের ভেতর সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে উপভোগ করেন। কুলকুণ্ডলিনীকে জাগরিত করে ফেলে অঘোরী সাধক চক্রে চক্রে তার সাধনা করেন। অঘোরী যোগীর এই সাধনা ধরতে হলে আগে চক্রপন্থাগুলিকে বুঝে নিতে হবে। দেহসাধকের কাছে চক্রগুলি হল গিয়ে দেহের মেরুদণ্ডের মধ্যে বিভিন্ন জায়গাতে যেসব উপাদান ছড়িয়ে—ছিটিয়ে আছে তারই পরিচায়ক। এই চক্রশক্তির পর্যায়ক্রমে যাওয়ার আগে চক্র কী?—এ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ একটি ধারণা থাকলে বিষয়টি ধরতে সুবিধে হবে।

জৈব মনস্তত্ত্ব বা বায়োসাইকলজি অনুসারে আমাদের শরীরের মধ্যে রয়েছে সূক্ষ্ম থেকে অতি সূক্ষ্ম সব স্নায়ুগ্রন্থির সংরচনা। এই গ্রন্থিগুলি থেকে বিভিন্ন প্রকারের হরমোন নিঃসৃত হয়। যার মাধ্যমে আমাদের মানসিক চিন্তাভাবনা, মনের গতিপ্রকৃতি, শারীরিক কার্যাবলি তথা শারীরিক অবস্থা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয়। এই নিয়ন্ত্রণ পর্বে আমাদের শরীরেরই স্নায়ু সংরচনা ও গ্রন্থি সংরচনা একে অপরের উপর সংগতি রেখে এই কার্য সমাপন করে ফেলে। স্নায়ু আর গ্রন্থির সংরচনার ভেতরে মূল যে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সেটা সংঘটিত হচ্ছে আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যেকার ফাঁপা অংশে। দেহসাধক এর নাম রেখেছেন সুষুম্না নাড়ি। তিনি বলছেন যে, এই সুষুম্না নাড়ির ভেতরই রয়েছে আমাদের মানস—আধ্যাত্মিক ও বিশুদ্ধ—আধ্যাত্মিক সমস্ত কার্যাবলির মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা বিন্দু। একেই তাঁরা বলছেন চক্র বা প্লেক্সাস। সাধনার ক্ষেত্রে এই চক্রগুলিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমাদের শরীরের সোজা মেরুদণ্ডটির ওপর থেকে নীচে লম্বালম্বি যে সুষুম্না নাড়ি বা সুষুম্নাকাণ্ড, সাধক তাকে বলছেন ‘উজুবাট’। বলছেন তিনি, এই উজুবাট বা সুষুম্নাপথের ভেতরই লুকিয়ে রয়েছে কুলকুণ্ডলিনীর রহস্য। সেই রহস্যভূমিতে প্রবেশ করতে গেলে আগে চক্রগুলিরই সহায়তা দিতে হবে।

মেরুদণ্ডের অভ্যন্তরে ইড়া—পিঙ্গলা—সুষুম্না এই তিন নাড়ির সংযোগস্থলগুলিতেই রয়েছে উল্লেখিত সেই চক্রের স্থান। মনে আমাদের সর্বসময়ই চিন্তার উদয় হচ্ছে আবার বিলয় হচ্ছে। মনের এই কার্যাবলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৃত্তি। বৃত্তিগুলির অভিব্যক্তি ও নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ রূপে নির্ভর করে শরীরস্থ চক্রের উপর। চক্র সঞ্জাত স্পন্দনের ফলেই গ্রন্থ—উপগ্রন্থি থেকে গ্রন্থিরস বা হরমোনের ক্ষরণ হয়। আর মনের বৃত্তিগুলির স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক অভিপ্রকাশ নির্ভর করে মূলত এই হরমোনের মাত্রাগত তারতম্যের ওপর। যতক্ষণ পর্যন্ত এই বৃত্তি কাজ করে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মনের অস্তিত্বও বজায় থাকে। যখন বৃত্তিগুলির নাশ হয়, মনও তার অস্তিত্ব থেকে সরে আসে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, সবকিছুর মূলে রয়েছে সেই চক্রের ইতিবাচক ইঙ্গিত।

দেহসাধক চক্রের দলগুলিকে শক্তির বিভিন্ন স্তরের ইঙ্গিতবাচক অধ্যায় হিসেবে দেখে থাকেন। তাতে তিনি যে বর্ণগুলিকে বসিয়ে নিয়েছেন সেগুলি আসলে সেই সেই অঞ্চলভিত্তিক শক্তিতরঙ্গ (Frequency)। মোদ্দা কথা হচ্ছে, এক একটি বর্ণের মধ্যে এক এক ধরনের শক্তিতরঙ্গ বা Frequency কল্পনা করে নিচ্ছেন তিনি। যে একান্ন তরঙ্গে মহাশূন্যতা থেকে শূন্যতার অঙ্গীভূত শক্তি; Big Bang থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একান্নটি ধাপে সৃষ্টি হওয়ার বৃত্তান্ত—ইচ্ছার তাড়নাতে কামরূপে ঘনীভূত অবস্থায় বিস্ফোরিত হয়ে ধাপে ধাপে নীচে নেমে এসে বস্তুজগতের সৃষ্টি—কথিকা সেই একান্নটি তরঙ্গের নির্দেশক হল গিয়ে সাধক বর্ণিত এই একান্নটি বর্ণ। এদের মধ্যে আদি বর্ণ মহাশূন্যতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ছিল বলে বলা হচ্ছে, বিশেষ রূপরেখা নিয়ে বর্ণরূপে ধরা দেয়নি। বাকি সব ধর্তব্য তরঙ্গের খাপে গিয়ে পড়েছিল বলে সংস্কৃত বিশেষ রূপ নিয়ে বর্ণরূপে ধরা দিয়েছিল। তাই ব্যবহারিক হিসেবে সংস্কৃতে পঞ্চাশটি বর্ণ রয়েছে বলে যুক্তিক্রমকে এই স্রোতে ফেলা হচ্ছে। আদি বর্ণ, পরা বর্ণ—শেষমেশ এই হিসেব দাঁড়াচ্ছে।

দেহের মধ্যে মেরুদণ্ডের গাঁটে গাঁটে ছয়টি স্তরকে ছয়টি চক্র হিসেবে চিহ্নিত করছে অধ্যাত্মবাদ। এই ছয় চক্রেই বলা হচ্ছে যে রয়েছে, সাতটি তরঙ্গের ধারা। ছয় চক্র বা ষটচক্রের উপরে আরও তিন স্তরের অবস্থিতিকে চিহ্নিত করে একান্ন স্তরকে স্পষ্ট করে নিচ্ছেন দেহসাধক। ছয় চক্রের ওপরের তিন স্তরের শেষ স্তরটি সাধক বলছেন, সৎ। বাদবাকি দুই স্তরের সূক্ষ্ম তরঙ্গের নাম রাখছেন তিনি চিৎ ও আনন্দ। আনন্দকে দেখছেন জ্যোতিস্বরূপ। জগতের আদি প্লাজমা হিসেবে। আনন্দের ওপরের স্তর চিৎ, সৎ হল এখানে সেই নির্ভেজাল বোধের জগৎ। যেখানে কেবল ‘আমি’ বোধ আছে। তুমি বোধ নেই। জগৎ এখানে এসে আমি হয়ে উঠছে। সাধক এই অবস্থাকে চিহ্নিত করছেন ইদম ব্যতীত অহম হিসেবে।

কুলকুণ্ডলিনী প্রদত্ত এই একান্নটি তরঙ্গের একটি স্তরে উঠলে শরীরের মধ্যে সেই সেই স্তরের শক্তিতরঙ্গ বা Frequency সৃষ্টি হয়। আর এই শক্তিতরঙ্গের অনুভূতিটি ধরা পড়ে আমাদের মাথার স্নায়ুতে। ফলত সেখানেই বহির্বিশ্বের সম তরঙ্গের যাবতীয় ছবি ফুটে উঠে। দেহসাধক, যোগী, অঘোরীদের মানসনেত্রে এই ছবিগুলিই আদতে ধরা পড়ে। যত ঊর্ধ্ব তরঙ্গের স্তর ভেদ করতে পারেন এঁরা, ততই বেশি মাত্রার জগৎ বা মাল্টিডাইমেনশনাল ওয়ার্ল্ড মুঠোর ভেতর বলা চলে নিয়ে আসতে পারেন অনায়াসে। তখনই তাঁরা সর্বজ্ঞ ঋষির মতো হয়ে ওঠেন। এর জন্য যে কেবল কুণ্ডলিনীশক্তিকে মূলাধার থেকে ধাপে ধাপে তুলে চক্রে চক্রে সাধনা করতেই হবে তার কোনও মানে নেই। বরং সহজ পথ ধ্যানে বসেও এই চক্রগুলিই তাদের বিশেষ বিশেষ শক্তির পরিচয় নিয়ে সাধকের আয়ত্তে চলে আসতে পারে। অঘোরীদের সাধনার পথ বড় ভয়ংকর পথ। সে পথে যেতে গেলে প্রধান কাজটিই হল কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণ। তন্ত্র সাধনার মূল কথাও হল গিয়ে সর্বপ্রথম ওই কুলকুণ্ডলিনীরই জাগরণ।

কীভাবে কুণ্ডলিনী জাগে জিজ্ঞেসা করেছিলাম আমি হরনাথ অঘোরীকে। বীরভূমের ফুলেরডাঙাতে থাকেন তিনি। রোজ একবার হাঁটা পথে তারাপীঠের শ্মশানে এসে মায়ের পাদপদ্মে আর বামদেবের সমাধিতে ফুল দিয়ে যান। তাঁর গুরু আনন্দনাথজি থাকেন কামাখ্যাতে।

বললেন, জাগান দিয়ে তুমার কী হবেক শুনি? তুমার কালেজের পুথিতে এ জাগান লিখা নাই যে ‘গ।

বললাম, সেজন্যই তো জানতে চাইছি।

ফুলেরডাঙাতে হোমের আসন সাজাতে সাজাতে হরনাথ অঘোরী জবাব দিলেন এবার—ওর লজর পড়েছে দেখিস লাই?

কার নজর? বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম এবার আমি।

তু কেনে তুর দিকে তাকাস লাই? তুর লজর পড়ে লাই কুণ্ডলিনী বোঝাই পুঁটলি। তু কেনে একটু তল্লাস কর না বাবা।

কীভাবে খুঁজব আমি?

কলকাতার বাবু, অঘোরী মন্তর লিয়াছ, ভৈরব হয়েচ, সাধন কোরেচো, বইলব কেনে তুমার?

বললাম, জানব বলে বাবা এতদূর ছুটে এলাম।

হোমকুণ্ডের যন্ত্র আঁকতে আঁকতে অঘোরী বললেন, এই তো বুদ্ধি তুমার ‘গ, এই বুদ্ধি লিয়ে ভাবচো বটে পুথি লিখা হবে ‘গ তুমার?

জিজ্ঞেসা করলাম, কীভাবে বুঝলেন আমি বই লিখব?

একটু রেগে গিয়ে উত্তর করলেন বাবা। বললেন, শালা, কী ভাবচো বটে? কাঁচা তান্ত্রিক? সিদ্ধি লাই আমার?

আমি অপ্রস্তুত। কথা মেরামতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম এবার। বললাম, না বাবা, আমি তা বলতে চাইনি। যোগমায়া মা—ই তো আমাকে আপনার কাছে পাঠালেন। বললেন যে, মস্ত সিদ্ধাই বাবার। যা গিয়ে জান—বোঝ। বাবা সব জানায়া দিবে।

প্রশংসা শুনে একটু নরম হলেন হরনাথ অঘোরী। বললেন, গুরুটো লাই তুর। কুণ্ডলিনী তাই বেশ এগায়ে আর গেলন না দূর। প্রবৃত্তির বশে ও শক্তি জাগে রে। প্রকৃতির নিয়মে জাগান আসে। মেয়্যারা ছিষ্টি ধরে। তুর বীজের লয় হলি ও তো ছিষ্টি ধরে। এ ছিষ্টিতে শরীরটা হল দু—জনেরই কুণ্ডলিনীটা চলি গেল। এ তো নরের সঙ্গে নারীর আসল সম্বন্ধ লয়, বিয়া হল সন্তান হল, কী করে হল তুর? কে শিখান দিছে?

আমি চুপ।

বাবা বলে চলেছেন—কেউ লয়। জাগান এমনি আসে। গুরু লাগে না জাগান আসতে। মেয়্যা—মরদ দু—জনে দু—জনার কাজ গুছিয়ে ল্যায়। আর এ জাগানে গুরু ডলাই—মলাই দিলে শ্বাসের, দমের, তবে ছিষ্টি হয় শালা মায়ের চরণে বুদ্ধি। তখন হলহল করে খোলে কুণ্ডলিনী। কামের ছিষ্টি মায়ের ছিষ্টি—প্রবৃত্তি আর নিবৃত্তি সব জাগানে কুণ্ডলিনী। ও মানুষ করে আবার মানুষের শরীরকে দেবতা বানায়। ও সবই গুহ্য কথা, রহস্য প্রকাশ করতে লাই, তুই—ই চেষ্টা কর—না কেনে জাগান ধরতে, গুরু ধর, প্রাণকেন্দ্রের পানে তাকা। এসব পঁচাশি বছরের শরীর সাধনা। জীবন জাগান হলেই কুণ্ডলিনীর জাগান আসে। তাকে কেবল ঊর্ধ্বপানে তুলতে হয়। সাধনে আয়, বইলব। একদিনে সব তুকে বইলে দিব? দিব্য—ভাবের খোঁজ শরীর মাতায়। এ মাতন ক্রিয়ায় হয়। অত সোজা লয়।

মাতনে কী অনুভূতি হয় আপনার?

আবার রেগে উঠলেন হরনাথ অঘোরী। যজ্ঞাসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবার। সরাসরি আমার দিকে চোখ।

বললেন, রেতে ‘ত তু ও বিটিটার উপরে পড়িস। বোকা শালা ওটো কে বটে? ওটো হল মায়ের মাতন। কামের মাতনে রেতে তুমি বইলবা, কী কী করলা?

বললাম, সে অনুভূতি বলা যায় নাকি!

শালা, পথে আসো ইবার। কামের অনুভূতিন তুমার বইলবার ভাষাটো লাই। আর প্রেমের আছাড়, রক্তারক্তি আমি কী করি বইলব তোমায়! রাস্তাটা ঘুটঘুটে বটে। খুব হাতুরছি। গুরু আসিন বইল্ল, হরনাথ মূলাধারের গা ঘেঁসিং দম মার, লে শ্বাস লে তু। গুরুর কথা মতন শ্বাসটো তুল্যাছি অমনি অন্ধকারে হোঁচট। আবার শ্বাস… আবার গুরু… আমি তাই করল্যাম। শরীরটাকে শ্বাসে চোবাল্যাম। পেরিন কি করে যাব মা? মা বইল্ল, হাতটোনা ধর। আমি মার হাত ধরে একেবারে মার পাশে এসে বসল্যাম। দেখছি গুরু দাঁড়িন আছে। গুরু কথা বুলাতে ঘোরটো ভেঙ্গে গেল। গুরু বইল্ল, ওটো কী বটে? আমি বইল্লাম, কী? গুরু বইল্ল, ও তো পিতিম্যা লয় হর। মাথাটোনাতে উঠিন গেছে তুর কুণ্ডলিনী। ইটো সত্যি কথা বটে। তু বুঝবি লাই বাপ। একটোনাও স্বপ্নটো লয় ই’সব। ই’সব গুরুজ্ঞান। তুয়ার ওই শরীর ভগবান। মূলাধারের গভ্যে ঘুমিন গেছে কুণ্ডলিনী।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কীভাবে জাগাব ওকে?

ওই দেখ কেনে তুর কালেজের বুদ্ধি! শাস্তোর পড়িন কিছুই হবেক লাই। পারিস না কেনে গুরু ধরতে? তুয়ার ঘর আছে, ভগবান আছে, চাবিটো লাই তো। তালাটো দেওয়া। জ্ঞানবিদ্যার শিক্ষায় তালাটো খোলা যাবিক লাই।

কীভাবে খুলবে এই তালা?

আমি দেখছি যে তোর পাক খুলেছে। মূলাধারটা হেথা—সেথা ঘুরে, শাস্তর পড়ে, সাধু দর্শনে খুলিন যায়। তুয়ার তাই হয়েছে। ইবার দীক্ষা লিবি, অঘোরী মতে সাধন করবি সবটো খুলিন যাবে। না হলে পরে আবার ঘুমিন যাবে। গুরু—লাভ হলেই শক্তি জাগেন। সিদ্ধ গুরু হলে চ্যালার শক্তি জাগিয়ে দিবেন যে।

বললাম, আপনার গুরু কে?

গুরুর উদ্দেশে যজ্ঞাসনের দিকে ফিরে এবার প্রণাম সারলেন হরনাথ অঘোরী। তারপর দণ্ডবৎ থেকে উঠে বললেন, কী মনে লয় তুয়ার, আমার গুরুর বয়সটো কতক হবেক?

বললাম, কত?

গুরু আমার তারানাথ অঘোরী। মল্লারপুরে থাকতেন আগে। দাদুগুরুর নিবাস কামাখ্যায়। বনদুর্গা মন্দিরের সেবাইত। তিনি দেহ রাখলে গুরু আমার সেই যে গেলেন হেথায় আর ইদিকে এলেন না। একশো কুড়ি বছর গুরুর। হাঁটাচলায় জোরটো লাই। তবেক ইঁ বয়সেও রসঘটিত সাধন পারেন। অঘোরিণী মায়েদের চক্রমধ্যে অঘোর না জুটলে চক্রাধীশ গুরু আমার তাঁদের সাধনে সহায়তা করেন।

এই বয়সে!

কেন লয় রে ছেল্যে? ইন্দ্রিয়সুখের লক্ষ্যটা বলবান হলি পর রসশক্তির জাগান থাকে না। যৌবনের শক্তিক্ষয়ে তুয়াদের কুণ্ডলিনী ঘুমিন পড়ে। ইঁ’জন্য তুর কাছে ওটো অসম্ভব মনে হবে। মন বুলবে, জাগবেক লাই শরীর। হামার পঁচাশি বয়সের শরীরই তুয়ার হলে পর তুর ‘ত আশা লাই। আর অতটো বয়স তু ‘ত শালা… কত আগেই…

বললাম, মরে যাব?

তা হামিন জানি লাই। তু শালা ও—সব ব্যাজার কথা বলিস কেনে? রেতে থাক। কাষ্টগড়ার মা এলি পর ওই শক্তি জাগরণের প্রধান সম্বন্ধটা দেখিন দেবে। এখন চুপ মেরে বস তু।

আমাকে চুপ করিয়ে বাবা এবার শিষ্যকে ডাকতে থাকলেন—শুনো কেন্নে, পাক আর কতক সময় পর হবে গো? মায়ের ভোগটো ইদিকে না হলে রেতের ক্রিয়ার কাজকাম সারা হবেক লাই। তু তাড়াতাড়ি আন সব। মা হামার কতক সময় উপোস মেরে বসবে আর? কাণ্ডজ্ঞান তুয়ার কিছু লাই রে…

অঘোরী বাবার হাঁকাহাকির ভেতরই দেখলাম দুপুরের ভোগারতির আয়োজন আসছে একে একে। মায়ের অন্নভোগের ব্যবস্থা নিয়ে তৎপর হচ্ছে বাবার শিষ্য ভোলানাথ।

বাবা এবার বললেন, তুয়ার মন উন্নত না হলে চক্র ছাড়ান দিয়ে ওঠা কষ্টকর হবেক বটে। সাধারণ মনিষের লিঙ্গ তো। প্রাণশক্তির পথে অধঃ গতাগতির খেলান লিচ্ছে খালি। কুণ্ডলিনীর জাগানে বিষম ছটফটানি হবে রে তুয়ার। জেনে লিছিস ভালো। তবে করণ ছাড়া গাঁট উঠবেক লাই। গাঁট না উঠলে তুয়ার আমিতেই তু বসে বসে পুথি লিখবি। আর দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে বইলবি, কুণ্ডলিনীর জাগান কথাটো বলো ‘ত সাধু বাবা। বাবা বইলবে, তাঁর জ্যোতিটো উজ্জ্বল। তুয়ার আঁধারটো কসি খুলে আলগা হবেক লাই। ওই’ত মায়ের আরতিটো দ্যাখ কেনে, ধুঁয়ার কুণ্ডলীটো পাকায়ে পাকায়ে গাঁট খুলছে। শিরদাঁড়াটা ইরকম করে খুলে যায় বটে।

সন্ধ্যা একটু ঘন হতেই ফুলেরডাঙায় একেবারে ভক্তশিষ্য পরিবেশিষ্টা হয়ে হাজির হলেন দুবরাজপুরের সেই অঘোরিণী মা। তিনি এসে যজ্ঞবেদিতে প্রথমে প্রণাম সারলেন। তারপর হরনাথ অঘোরী দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করলেন দেখলাম অঘোরিণী মাকে। দীর্ঘ জটা লাল পোশাকের এই মহিলা হরনাথের থেকে কম করে তিরিশ বছরের ছোট হবেন। একসময় মায়ের চোখ গেল আমার দিকে।

বললেন, তু কে বটে?

আমি কিছু বলার আগেই উত্তর দিলেন বাবা, উঁ মা এ্যাঁয়াছে শহর থেকে।

আমার দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে অঘোরিণী বললেন, কইলকাতার মনিষ উঁ তু রংদার বটে। তা এ্যাঁয়াছিস কেনে বাপ হেথায়?

এবারও আমায় উত্তর করতে হল না।

অঘোরী বললেন, উঁ তো মা জাইনবার চায় রসের সাধনটোর কথা।

মস্ত এক হাসি দিলেন অঘোরিণী। তাঁর হাসির শব্দে শিষ্যভক্তরা পর্যন্ত ঘুরে তাকালেন মায়ের দিকে। তারপর বললেন আমাকে, তুয়ার শরীরটো রসের বটে। ভালো কইরকে দেখ কী কী রয়েছে ম্যাঁয়ামানুষের শরীরে। তুয়ার বউয়ের শরীলে দুঠো রাস্তা আছে জানবিক। ম্যাঁয়াদের শরীরটো রাস্তা বটেক।

জিজ্ঞেসা করলাম, কীসের? চোখ কপালে তোলার মতো ভঙ্গিমায় কথাতে শান দিলেন এবার অঘোরিণী। বললেন, আ—মোলো! তু কি মানছিস না? উঁ বাবা ‘গ সহজ রসের খেলাটি শিখান দাও না উঁকে কেনে?

অঘোরী বললেন, রাস্তাটো তুমি মা উঁকে বুঝান দাও না কেনে? উঁ তো লিখাপড়া জানা বুঝদার লোক বটে। খেলাটি শিখবেক লাই। শুনে—জেনে পুথি লিখবেক।

অঘোরিণী এবার অট্টহাসি দিয়ে বললেন, ছ্যালে আমার লেখক বটে। কী বইলছে গো বাবা আমার! আমার দিকে এরপর ফিরে তাকিয়ে বললেন, তু লেখক। রসের লেখক বটে। হেথাকে এ্যাঁয়াছিস ইয়ে লিখবি বইলে ত।

আমি চুপ।

বলে চলেছেন অঘোরিণী—তা বেশ তা বেশ। শোন কেনে ছাওয়াল।

বললাম, বলুন মা। আপনার কথা শুনব বলেই তো থেকে গেলাম।

কী জাইনবার চাস তু। বাবাকে লিয়ে কী করি তা—ই?

আমি চুপ।

অঘোরিণী বলে চলেছেন আবার—তু যা বউকে লিয়ে বিছানায় করিস ইঁ তা লয় বটে। নরনারীর সম্পর্ক ইঁ লয়।

বললাম, আপনারা সাধক—সাধিকা, আপনাদের সাধনধারাটাই জানতে চাইছি যে।

কথা শুনে মনে হল এবার অঘোরিণী প্রসন্ন হলেন। বললেন, তুয়ার বউ আমার বয়সে এ্যাঁয়ে রস ধরতে পারবেক লাই। আর তু বাবার বয়সে তো কাত। এ্যাঁয়াছিস, ঘুরতেছিস আচরণ দেখবি বইলে ‘ত। শোন তবে।

আমি ঘাড় সিধে করে বসলাম।

ম্যাঁয়ামনিষের শরীরে দুটো রাস্তা আছে বটে। নরক আর সরগ। তু ঠিক করে লিবি। কুন রাস্তাটা লিবি। সরগে যাবিক না নরকটি তুয়ার মনমতো হবেক। সংসারী লোক নরকটি বেছে নেয়। তু যেমন লিয়েছিস। সরগের রাস্তাটি রসের সাধনা।

কেমন তার পথ? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

ইঁ তো বাপ তুয়াদের মতন ঘোরের পথটি লয়। ই পথ হল গিয়ে বাপ অঘোরের। ইঁ দেখ না কেনে শরীরটো আমার শক্তির শ্বাস। তুকে ছুব, তুয়ারও মাতন আসবেক।

এই বলে অঘোরিণী আমাকে ছুঁয়ে দিলেন। ওঁর ছোঁয়াতে অস্বস্তি ছাড়া তেমন আর কিছুই হল না আমার।

বললেন, তুয়ার কুণ্ডলিনী তো হাঁ হয়ে আছে বাপ। তু ‘ত শিখে লিলে শক্তিটো লতুন হয়ে যাবে তুয়ার। কামের ঘোর কাটান গেলে তু ‘ত অঘোরী হয়ে যাবি।

অঘোরী হঠাৎ করে এসে কথার মাঝে প্রবেশ করলেন এবার। বললেন, উঁ ত শালা বইলেছে সব জানে। শাস্তর—জ্ঞান আছে ‘ত উঁয়ার।

অঘোরিণী মা বললেন, ই’সব অঘোরী সাধনা। গুরু বইলবে উঁয়ার শিষ্য শুনইবে। এঁর অন্যথা হবেক কেনে? গুহ্যাচারের কথাটো বাপ আমার, শাস্তরে লিখাটো লাই। তুঁ হেথাকে থাক। আলগা কামের ঘোর তুঁয়ার। সব দমে ঠেলান শিখে লিবি। শিখে লিলে তুঁয়ার পাত আর হবেক লাই। কামের ঘোর ইঁ ‘ত তখন তুর অঘোর দেহে থাকবে লাই। তু ভেবে লে তুর যা মনে লয়। যজ্ঞ হয়ে গেলে রেতে বইলবিক ‘ত তু কী চাস। যা চাইবি পুথিটো লিখার জন্য বিদ্যা, শিখে লিলে শিখার বিদ্যাটোও দিয়ে দেব তুঁয়ার। এখন জয় দেও দেকি ম্যাঁয়ের। কই ‘গ সব তুরা কই। মাতারার লামে জয় দে কেনে ইঁবার।

অঘোরিণীর হাঁকাহাঁকিতে বুঝলাম কথা আজ আর এগোনোর নয়। ফুলেরডাঙা থেকে বেরিয়ে আমি তারাপীঠের পথ ধরলাম এবার। হঠাৎই আমার মনের ভেতর কে যেন বলে উঠল এবার, তু তো শালা জানতে চেঁয়াছিলিস তা পলাইলি কেনে?

বুঝলাম আমার ভেতর কথা নাড়ছেন হরনাথ অঘোরী। নতুন জানার জন্য কালই তবে বেড়িয়ে পড়তে হবে কংকালী। পথ আমাকে কেবলই প্রশ্নমনস্ক করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *