তোমার মত বন্ধুয়ার রূপ রে
উজানধল, সুনামগঞ্জ
বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা কালনী নদী আর হাওরের আফল একটা মানুষকে বাউল বানাতে পারে, এ খবরটা প্রথম শুনি দীনদয়াল বাউলের মুখে। অসুস্থ করিমের খবরও পাই ওঁরই মুখে।
২০০৯ সাল, সেপ্টেম্বর মাসে আশ্বিনের ফোটা কাশের ভেতর দিয়ে ঢেউ খেলানো হাওয়া তুলে বাউল সাধক শাহ আবদুল করিমের খবর এল।
ঘোষপাড়ার বাউল সমাজ তাঁকে বিদায় দিলেন গানের ভেতর দিয়েই। আখড়াবাড়ির গায়ে বয়ে চলা রূপ হারানো ত্রিবেণীর মূল সোঁতাটা তখন এখানে গঙ্গা নামেই খ্যাত। তার ভেতরও যেন কালনী নদীর আফল তুলে আনলেন সাহেব কলোনির প্রবীণ বাউল সাধক স্মরণজিৎ খ্যাপা। খ্যাপার একতারায় বোল উঠেছে; গলায় হাওরের আফল,
ভবসাগরের নাইয়া মিছা গৌরব করো রে
পরার ধন লইয়া, একদিন তোমায় যাইতে হবে
এই সমস্ত থুইয়া রে, পরার ধন লইয়া।।
বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের উজানধল গ্রাম থেকে বাউল আবদুল করিমের দেহ রাখার খবর নদিয়ার ঘোষপাড়াতে পৌঁছলে এভাবেই এখানকার বাউল সমাজ তাঁকে বিদায় জানিয়েছিল।
আমার আজও কল্পনা করতে ভালো লাগে—উজানধলের আখড়াবাড়িতে যখন করিমকে স্ত্রী ও সাধনসঙ্গিনী সরলার কবরের পাশে সমাহিত করা হচ্ছিল, তখনই বোধহয় ডুবকিতে চাপড় দিয়ে দীনদয়াল বাউল গাইছিলেন ওঁর গান।
বাউল আবদুল করিমের গান প্রথম শুনি আমি ঘোষপাড়া নয়, সাহেব কলোনিতে স্মরণজিৎ খ্যাপার আখড়াবাড়িতে। খ্যাপা দুই মহতের পদ পছন্দ করেন তো খুব। এক, ভবা পাগলা। দুই, শাহ আবদুল করিম। ভবা পাগলা খ্যাপার মুখে নিজের লেখা গান শুনেই তাঁকে খ্যাপা উপাধিটি দিয়েছিলেন। মনসুরউদ্দিন তাঁর ‘হারামণি’—তে পূর্ববঙ্গের সাটুরিয়া থানা এলাকার আমতা বেলেটি গ্রাম ভবার জন্মভূমি বলে উল্লেখ করলেও আদতে তাঁর জন্ম ঢাকার ধামরাই থানা এলাকার আমতা গ্রামে।
১৯৫০ সালে ভবা পাগলা পশ্চিমবঙ্গে এসে বর্ধমানের কালনায় কালী মন্দির ও আশ্রম স্থাপন করে মাতৃসাধনা শুরু করেন। কালনার মন্দির প্রতিষ্ঠার দিবসেই স্মরণজিৎ খ্যাপা গেয়ে ওঠেন,
মানুষ তোমার কোথায় অবস্থান
আসো যাও নাই স্থিরতা অনুমান আর বর্তমান
বুঝো না এই বারতা, মানো না তুমি বিধাতা
প্রকৃতি যে সেই তো মাতা কথাটি কী মূল্যবান।
এই গান শুনেই ভবা নিজের গলার মালা খুলে স্মরণজিৎ বাউলের গলায় পরিয়ে তাঁকে ‘খ্যাপা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। স্মরণজিৎ খ্যাপাকে দেখি সন্ধ্যায় করিমের মতোই চালপানি নিয়ে দৈন্যগানের আসর বসান। সেখানে গেয়ে ওঠেন তিনি করিমেরই মুর্শেদ ভজনার পদগুলি। গানের সঙ্গে জমজমাট বাঁশির সঙ্গত রাখেন শ্রীদাম ফকির। তিনি স্মরণজিৎ খ্যাপারই শিষ্য। এখন নিজে দল করেছেন।
ঘোষপাড়ার বাউলনি কৃষ্ণা দাসী গেলে পরেই আমাকে করিমের একখানি গান শোনাতেন। কৃষ্ণার তখন জুড়ি ভাঙেনি নবকুমার দাস বাউলের সঙ্গে। দুজনেই একসঙ্গে গান গেয়ে বেড়ান। একসময় এই জুটি ছিল বাউল সমাজে চর্চা ও শ্রোতা মনোরঞ্জনের বিষয়। তারপরই জুড়িহীন কৃষ্ণার একাকি জীবন শুরু হয়। তবু কৃষ্ণা করিমকে ছাড়েননি। আসর মাত করেই গাইতেন। রংদোলের রাতে কৃষ্ণা দাসী বাউল আবদুল করিমের গান দিয়েই আসর জমাতেন সতী মায়ের মেলায়। এরপর তিনি প্রবল অসুস্থ হলেন। ধরা পড়ল ক্যান্সার। প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই বলা চলে চলেও গেলেন ঘোষপাড়ার উল্লেখ্যা বাউলনি কৃষ্ণা দাসী। ওঁর গলায় করিমের সেই গান আজও আমার কানে বাজে,
না জেনে করেছি কর্ম, দোষ দিব আর কারে
সর্পের গায়ে হাত দিয়েছি বিষে তনু ঝরে রে।
অনেকখানি খ্যাতি ও সম্মান নিয়ে শাহ আবদুল করিম তখন দেশের মানুষদের কাছে পরিচিত। বিদেশেও গেছেন প্রবাসী বাঙালিদের মরমিয়া সুর শোনাতে, বেরিয়ে গিয়েছে তাঁর গান গ্রন্থগুলিও এক এক করে। কালনী নদী তাঁকে বাউল করেছে বলেই একটির গ্রন্থনাম ‘কালনীর ঢেউ’। এ ছাড়া ‘ভাটির চিঠি’, ‘ধলমেলা’ ও ‘গণসঙ্গীত’—ও বেরিয়ে গেছে।
প্রথমবার যুক্তরাজ্য সফর করেছেন তিনি ১৯৬৮ সালে। সফরসঙ্গী ভাটির আরেক উল্লেখ্য বাউল দুর্বিন শাহ। ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ। শেখ মুজিবুরের সঙ্গে বাংলা গড়ার স্বপ্নেও সাড়া দিলেন তিনি। জনসভায় মুজিবুর রহমনের বক্তব্য শেষে তিনি গেয়ে উঠলেন এবার,
দরদি বাংলার নাও সাজাইয়া
আমরা যাব বাইয়া
গান, সাধনা, শিষ্য পরিবৃত্ত করিম আবার বাঁধাও পেয়েছেন শরিয়ত সমাজের কাছে। মারফতি সমাজের আল্লা—ঈশ্বর না মেনে, বেদ—কোরান অস্বীকার করে সহজ মানুষ—ভজা—ধর্মে সাড়া দেওয়ার বাসনাতে বহুবারই নেমে এসেছে আক্রমণ। স্বাধীন বাংলাদেশে করিম রেহাই পাননি। তঁরা সাধনসঙ্গিনী সরলা দেহ রাখলে গ্রামের ইমাম জানাজা পড়াতে বাধা দিয়েছিলেন। কারণ করিমের বাউল জীবন, সাধনা, গান—সবই বেশরা ও ইসলাম বিরোধী। লৌকিক ইসলামে বিশ্বাসী বাউল করিম দমে যাননি।
উজানধল আখড়াবাড়ির বাতাস ভারী করে জীবনের শেষবেলায় আত্মমগ্ন সাধক বলতে থাকেন, সরলা মারা যাওয়ার পর গ্রামের ইমাম সাহেব বললেন, বাউলের স্ত্রীর জানাজা পড়ানোর দরকার নাই। আকবর মারা যাওয়ার পর মসজিদের মাইকে তার মৃত্যুর সংবাদ প্রচার হল না। তার দোষ সে আমার সঙ্গে থেকেই গানটান গেয়ে নাকি বেশরা ও ইসলাম বিরোধী কাজ করেছে। তাই সে আমার মতোই কাফের হয়ে গেছে! বেতনভোগী ইমামের কথা শুনে আর রাগে—দুঃখে নিজেই আমার বাড়িতে কবর খুঁড়েছি। আকবরের জানাজা পড়িয়ে দাফন করেছি। গ্রামের কেউ কেউ আইছিল, কেউ কেউ আয়ে নাই।
আখড়াবাড়িতে বসে করিমের সেই অপমানিত মুখখানির কথা ভাবি আর মনে পড়ে শিষ্য পরিবৃত্ত হয়ে বসে আছেন তিনি। রোহী ঠাকুরকে গানেতে বলা নিগূঢ় তত্ত্বটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। সন্ধ্যার চালপানি নেওয়া হয়ে গেছে তখন। ডুবকিতে তাল ঠুকলেন রোহী ঠাকুর। লাল মিয়া দিলেন ডুগিতে চাপড়। শিষ্যরা সব গুরুর চরণে এইবার দীনতা প্রকাশ করছেন। গান শুরুর আগে দেহকাজের কথা কিছু বলছেন করিম। বাউলের সৃষ্টিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, মারিফততত্ত্ব, কামতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব। শেষমেষ বললেন, পৃথিবীটাই একদিন বাউলের হয়ে যাবে।
বিশ্বাসের আলো যেন ছলকে উঠল এবার ওঁর মুখে। সারাজীবন সেই বিশ্বাসটা সঙ্গে করেই বেঁচেছেন করিম স্বাধীন বাংলাদেশে। এই বাংলাদেশই তাঁকে আবার দিয়েছে সম্মান। একুশে পদক পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন আমজনতার ভালোবাসা আর অসংখ্য পুরস্কার।
পূর্ববর্তী মহত লালন শাহ, হাসন রাজা, রাধারমণের গানও তিনি কণ্ঠে ধারণ করেছেন। রেকর্ড করেছেন। বাদ পড়েননি সৈয়দ শাহনূর, দ্বিজদাস, আরকুম শাহ, শীতালং শাহদের মতো অল্প পরিচিত সাধক ও মহাজনও।
গান গেয়েছেন, সাধনা করেছেন, বই বের করতে শেষ সম্বল নয় বিঘে জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছেন। সাধক ও মহত মানুষজনদের পাশে থাকতে চেয়েছেন চিরকাল। সাধ্যমতো সাহায্যও করেছেন। কেবল আত্মভোলা বাউল সাধক হতে চাননি শাহ আবদুল করিম। বলতেন, মানুষই যদি না থাকে তাহলে দেহসাধনা করবে কে? দেহসাধনা করতে তো কেউ বাধাটাধা দিচ্ছে না, তবে বিপন্ন মানুষের কথা চিন্তা করতে হবে। গণমানুষের মুক্তি প্রয়োজন। তাই আমি বাউলগানের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই মানুষের দুঃখ—দুর্দশার কথা তুলে ধরি।
করিমের শেষ জীবনের সংবর্ধনা—অনুষ্ঠান। পেয়েছেন সোয়া তিন লাখ টাকা। করিম ভেবেছেন, সোয়া তিন হাজার।
বললেন, এত টাকা! এই সোয়া তিন হাজার টাকা দিয়ে আমি কী করব?
আয়োজকরা বললেন, সোয়া তিন হাজার নয়, সোয়া তিন লাখ।
এই শুনে করিম এক লাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ছেলেকে বললেন, চল চল বাড়ি যাই। সর্বনাশ, অত টাকা! এগুলা নিয়া আমরা কিতা করমু? আমার টাকার দরকার নাই। মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই বড় প্রাপ্তি। চল চল বাড়ি চল।
অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন শাহ আবদুল করিম। ওঁর জীবনীকার সুমনকুমার দাশের কাছে এ কাহিনি শুনে আমি কেঁপে উঠি। বসি গিয়ে বাউল করিমের কবরে। বাতাস গান তোলে করিম বাউলের।
মামজোয়ান, পাপিলেশ্বরী
স্মরণজিৎ খ্যাপার ওখানে শেষ যেদিন গিয়েছিলাম ওঁর জামাই মারা গিয়েছেন সেদিন। আখড়ায় ঢোকার মুখেই খবরটা আমি পাই। ভালো দোতারা বাজাতেন তিনি। খ্যাপার সঙ্গে সঙ্গতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। খ্যাপা যখন গাইতেন রাধারমণের গান, বাঁশির সুরে মোচড় তুলছেন জামাইরাজা ভুবন।
একবার আমরা গিয়েছিলাম পাপিলেশ্বরী। সেদিনটা ছিল রাধাষ্টমী। মা ব্রত রেখেছেন। মন্দিরে পাপিলেশ্বরীর মূর্তি। প্রথম যখন যাই মামজোয়ান চূর্ণীর ঘাট পেরিয়ে, গিয়ে চমকে গিয়েছিলাম এক হিজড়া রমণী সেই এলাকায় মা সেজে বসে আছেন। আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাবখানাতেই তো ওঁরা অভ্যস্ত। সেখানে তিনি এলাকার মা। ভালো কবিরাজি জানেন। সন্তান প্রসবের কাজ জানেন। গভীর রাতে গ্রামের বউদের প্রসব বেদনা উঠলে এই মা—ই ভরসা। এলাকার মানুষ বিশ্বাস করেন মন্দিরের মূর্তি নয়, এই হিজড়া রমণীই আসলে মা পাপিলেশ্বরী।
জিজ্ঞেস করেছিলাম মাকে, মায়ের অমন নাম কেন?
বলেছিলেন, আসলে ও মায়ের নাম তো নয় বাছা। আমার নাম।
বললাম, মানে?
বললেন, সমাজের অবজ্ঞা অপমান নিয়ে আমরা যে বড় হই। আমরা কখনো কারও কেউ নই। না মা না মাসি। মানুষের থুথু কফের মতো আমরা রাস্তাতে লেপটে থাকি। মানুষ মাড়িয়ে চলে যায়। ঘরে কী কখনো জায়গা হয় আমাদের?
বললাম, আপনি তো মা এখানকার মানুষদের।
বললেন, আমি পাপিলেশ্বরী। যদি কিছু উপকার হয় মানুষের সেই চেষ্টা করি। এলাকায় ডাক্তার নেই। প্রসব বেদনা নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই রুগি মারা যায়। যদি কিছু করতে পারি।
কোথায় শিখলেন এসব ধাত্রীবিদ্যা?
খানিক উদাস হলেন পাপিলেশ্বরী। বুঝলাম পুরোনো স্মৃতির তলদেশে জমে আছে অনেক ব্যথা, অনেক যন্ত্রণা। ঘা পড়তেই ক্ষরণ হতে শুরু করেছে। নিজেকে অপরাধীও মনে হল খানিক। কথা জানব বলে, তাঁর এই মায়ের অবস্থানটি ধরব বলে আমি ওনাকে স্মৃতিতে ফেরালাম। এ কী করলাম আমি! কিন্তু খোঁজাই যে আমার কাজ।
পাপিলেশ্বরী বললেন, এক সময় হিজড়াটোলা থেকে পালিয়ে কামাখ্যাপীঠ যাই। সেখানে সিদ্ধি বাবার সঙ্গে দেখা। বাবা বললেন, বেটি আমার, আজ একটু মায়ের ভোগ রেঁধে দে। জল চলে এল চোখে। অনেকদিন পর কেউ মেয়ে বলে ডাকল যে। আমিও তো একসময় কারও সন্তান ছিলাম। আমাদের হিজড়া সমাজের সকলেই তো কারও না কারও ঘরের সন্তান। না ছেলে না মেয়ে আমরা। ভোগ রাঁধছি আর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে আমার। সিদ্ধি বাবা বললেন, ক্যায়া বাত বেটি? আমি তো কাঁদছি। বাবা আশ্রয় দিলেন। এই শরীরটা ক্ষত—বিক্ষত আমার পায়ুকামে। পুলিশ, মাতাল, চোর, বদমাশ—সবাই খেয়েছে এই নপুংসক শরীর। আনন্দ করেছে। আমার টোলার গুরুমা তাও অত্যাচার করত আমার উপর। প্রাপ্ত টাকার হিস্যা না পেলেই। গাঁজা, মদ এসবের অবৈধ কারবার গুরুমায়ের। একবার বাচ্চা নাচাতে গিয়ে পালিয়ে চলে এলাম কামাখ্যা। সিদ্ধি বাবা মন্ত্র দিলেন। যোগ শেখালেন। আয়ুর্বেদ চিকিৎসা। বছর দশেক বাবার কাছে বেটির মতো থেকে আমার দীর্ঘ জটা চুলে। আমি মা। সিদ্ধাই মা নাম দিলেন আমার পাপিলেশ্বরী। মা বললেন, বেটি তু যা। আমি চলে এলাম মায়ের কথামতো এক ভক্তের সঙ্গে এখানে। তখন বনজঙ্গল ছিল তো এদিকটায়। যার সাথে এলাম তিনি জমি দিলেন। মায়ের মন্দির হল। এলাকায় চিকিৎসায় হাত দিলাম কামাখ্যার জড়িবুটি দিয়ে। সিদ্ধাই মা দাইয়ের কাজ জানতেন। শেখালেন। সে বিদ্যা এখন কাজে লেগে গেল। তখন থেকেই এলাকার মা আমি পাপিলেশ্বরী।
মায়ের দরবারে আজ গান। আমি এসেছি স্মরণজিৎ খ্যাপাকে নিতে।
বললাম, মাকে একখানা খবর দিই। আজ আর গাইতে যেতে হবে না।
বললেন, কেন বাবা?
বললাম, কিছু আগে জামাইকে শ্মশানে পুড়িয়ে এলেন। এমনদিনে গাইতে পারবেন? গতবছর মায়ের আশ্রমে জামাইরাজা সঙ্গত করেছিল। এবছর ওকে ছাড়া…
বললেন, বাউলের আবার শোক কী! চলো গাইতে যাব।
একটা গাড়ি করে এরপর স্মরণজিৎ খ্যাপাকে নিয়ে যাওয়া হল চূর্ণী নদীর ব্রিজ পেরিয়ে মামজোয়ান। অনেক মানুষ জড়ো হচ্ছেন খ্যাপার গান শুনবেন বলে।
পাপিলেশ্বরী মায়ের হাতে আজ খাঁড়া নেই। হিজড়া মাতা মায়ের হাতে বাঁশি দিয়েছেন। তিনি নিজেও তো আজ যোগিনীর বেশে। কপালে রসকলি।
সদানন্দ বৈষ্ণব জ্যান্ত মা পাপিলেশ্বরীকে আজ সাজিয়ে দিয়েছেন। গতকাল সদানন্দ গোঁসাইয়ের মেয়ের ব্যথা ওঠে মাঝরাতে। খবর যায় পাপিলেশ্বরীর কাছে। তিনি ভোররাত অবধি সেবা—শুশ্রূষা করে গোঁসাইয়ের মেয়ের প্রসব করান দু—দুটো ফুটফুটে যমজ। একটি মেয়ে অপরটি ছেলে।
পাপিলেশ্বরী মায়ের দরবারে আঁতুড় নেই। সদানন্দ গোঁসাই নাতি—নাতনি নিয়ে এসেছেন আজ। মা আজ সন্তান নাচাবেন এখানেই! নামকরণ হবে বাচ্চাদুটোর।
স্মরণজিৎ খ্যাপা গাইছেন, প্রাণ সজনীর বিরহে রাধারানির আকুলতার চরণদ্বয়।
যোগিনী পাপিলেশ্বরীর ভেতর সেই আকুলতা আর সন্তান স্নেহের আকুতি। নিজের সন্তান না থাকা ও সত্যিকারের মা না হয়ে ওঠার শোক আর খ্যাপার সন্তান হারানো, প্রিয়জন হারানোর শোক—সবটা মিলিয়ে মন্দিরের মূর্তি পাপিলেশ্বরী আজ নিজেই বিচ্ছেদী সেজেছেন।
এ সাজে বৈষ্ণব পদকর্তা রাধারমণই তো বাণী দিতে পারেন। মরমিয়া ছাড়া, সাধক ছাড়া, বাউল ছাড়া এমন আবহে আর কার কথাই বা চলতে পারে?
আমিও সেখানে বাক্যহারা জগন্নাথ।
ঝাঁজপিটা, নীলাচল
দোলের দিন নবদ্বীপে মহাপ্রভুর মন্দিরে আরতি হয় বসন্ত রাগে। কস্তুরী, চন্দন, অগুরু মাখিয়ে নিবেদন করা হয় মস্ত গলার মালা। এদিন তাঁর জন্মানোর দিন। তাই নবদ্বীপে আজ আর তিনি দেবতা কিংবা কৃষ্ণের অবতার নন। আজ তিনি শচীমাতার কোল আলো করা সেই ছোট্ট নিমাই। সবে জন্মেছেন তো। তাই মহাপ্রভু নন, শিশু নিমাইয়ের হাতে আজ চুষিকাঠি ধরিয়ে দেন গোবিন্দ বাবাজি। এ মন্দিরে তিনি অনেকদিন আছেন। আগে থাকতেন সমাজবাড়ি।
সমাজবাড়ির সঙ্গে বরানগর পাটবাড়ির মধুর যোগাযোগ। নবদ্বীপে সমাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন রাধারমণ দাস বাবাজি। রাধারমণ বাবাজির শিষ্য বৈষ্ণব পণ্ডিত রামদাস বাবাজি। তিনিই একসময় বরানগর পাটবাড়ির সংস্কার করিয়ে শ্রী ফিরিয়ে দেন।
আগে থেকেই সমাজবাড়িতে মঞ্জরী—ভাবের সাধনার চল ছিল। রামদাস বাবাজির সমসাময়িক ছিলেন সখী মা। তিনিই মঞ্জরী ভাবের সাধনা করতেন। এই সাধনা হত নবদ্বীপের সমাজবাড়িতে। এর মূল বিষয় যেটি, শ্রীকৃষ্ণের ভজনসাধনে শরীরের মধ্যে নারীর গুণাবলি এনে তোলা। সখী মা আদতে ছিলেন পুরুষ। রাধারমণ বাবাজি তাঁকে এই নারীবেশের সাধন দেন।
মহাপ্রভু মন্দিরের প্রবৃদ্ধ গোঁসাই হরিধন বাবাজি দেখেছিলেন সখী মাকে। রামদাস বাবাজি দেহ রাখেন পাটবাড়িতে। তার পরপরই সখী মাও চলে যান। হরিধন বাবাজির কাছেই শোনা, সমাজবাড়িতে তখন মঞ্জরী ভাবের সাধনা যোগ হয়েছে পুরোদমে। ললিতা সখী অবস্থান করছেন এখানেই রাধারমণবাগ, সমাজবাড়ি, নবদ্বীপ। ঝুলন, রাস, দোলে তিনি বিগ্রহের সামনে বসে নিজের লেখা পদাবলি গাইছেন। ভাবাবেশ হচ্ছে সখী মায়ের শ্রীকৃষ্ণের কথা বলতে বলতেই। বাবাজিকে তিনি বলছেন, আসনে দ্যাখো যুগলচরণের ছায়া পড়েছে। বাবাজি বললেন, শেষ জীবনে সমাজবাড়িতে পাঠে বসলেই সখী মা ওই ছায়া দেখতে পেতেন। গুরুপূর্ণিমার দিন ওই ছায়া আরও বড় হয়ে গেল যে! একমাত্র সেদিন আমরা দেখলাম মায়ের কৃপায় গোবিন্দচরণের ছায়া। এভাবেই সখী মায়ের অভিসার চলত। চলতে চলতেই গৌণী কৃষ্ণাচতুর্দশী তিথি। তিনি চলে গেলেন। শেষ বয়সে লিখলেন গুরুদেবকে নিয়ে গ্রন্থ ‘চরিতসুধা’।
ভাবি আমি তিনিই তো ‘শ্রীসুরকথামৃত’ ও ‘সঙ্গীতমাধব—টিপ্পনী’র বঙ্গানুবাদ করেছিলেন, বরিশালের গৌরনদী থানার হরিসেনা গাঁয়ের পাঠশালায় তাঁর বিদ্যাশিক্ষা শুরু হয়। উচ্চ প্রাইমারিতে পড়তে পড়তেই সংস্কৃত টোলে ভর্তি হন ব্যাকরণ পড়বেন বলে। সেখান থেকেই আবার কলকাতার কালীঘাট। কৃষ্ণদাস বেদান্তবাগীশের কাছে বেদান্ত শিক্ষা। তারপর এই নবদ্বীপের চতুষ্পাঠীতে পাঠগ্রহণ।
নবদ্বীপে সমাজবাড়িতে ললিতা সখীকে দেখেছিলেন অধ্যাপক ও অনুসন্ধানকারী বিশিষ্ট লেখক চিন্তাহরণ চক্রবর্তী। তিনি তখন কৃষ্ণনগর কলেজে পড়ান। সেখান থেকেই পুরুষ শরীরে থাকা ললিতা সখী, সখী মায়ের নাম শুনে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। অধ্যাপক চক্রবর্তীর পুত্রবধূ আমাকে জানান, আমি এটা সম্পর্কে নির্দিষ্ট বিবরণ কিছু জানি না কিন্তু আমার স্বামী তাঁর বাবা প্রয়াত অধ্যাপক চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর থেকে এ সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছেন। তাঁর লেখাগুলো অনেক গভীর এবং খাঁটি।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মঞ্জরী সাধনার সঙ্গে কমিউনিজমের ডিক্লাস হবার দর্শনগত মিল আছে কী? আপনি খুঁজে পান?
বললেন, দুর্ভাগ্যবশত আমরা এ ধরনের আদিবাসী ধারণা উপেক্ষা করেছি এবং অন্যান্য দেশ থেকে মতাদর্শ ধার নিতে আরও আরামদায়ক বোধ করেছি।
নীলাচলের ঝাঁজপিটা মঠে সমাজবাড়ির রাধারমণ বাবাজি ললিতা সখীকে নারীবেশী মঞ্জরীভাবের সাধনা দেন। বরানগর পাটবাড়িতে এক সময় সখী মায়ের যাতায়াত ছিল। কেননা ওখানকার তৎকালীন মহান্ত রামদাস বাবাজি হলেন ওঁর গুরুভাই। সমাজবাড়ি আশ্রমে ভাইফোঁটার দিন ললিতা সখী তিলকপাত্র নিয়ে সকাল সকাল মধুসূদন বাবাজি, গোবিন্দ বাবাজি, রামদাস বাবাজি, গোবর্ধন বাবাজি, শ্রীনন্দ বাবাজিকে ফোঁটা দিতেন।
সকালবেলা স্নান সেরে বিশুদ্ধ তসরের শাড়ি পরতেন ললিতা সখী। বিন্যস্ত লম্বা চুল। কপালে আঁকতেন চন্দনের টিপ। পায়ে দিতেন আলতা। ললিতা দাসী নূপুর পরতেন।
হরিধন বাবাজি বলেছেন আমায়, সখী মা, মহাপ্রভুর জন্মতিথিতে ভোর ভোর এসে শিশু নিমাইকে কোলে করে মাতৃবেশে হাতে চুষিকাঠি গুঁজে দিতেন। চুম্বন করতেন কপালে। শিশুর জামা বদলে দিতেন। দুধ খাওয়াতেন ঝিনুক বাটিতে করে। এটাই ছিল ওঁর সাধনা। সন্ধেবেলা যখন আরতি হত ললিতা দাসী বসন্ত রাগে গাইতেন, ভালি গোরা চাঁদের আরতি বাণী। তিনি যখন নেচে নেচে গাইতেন, জয় শচীনন্দন জয় গৌরহরি বিষ্ণুপ্রিয়া প্রাণনাথ নদিয়াবিহারী, তখন তাঁর নূপুর বোল তুলত ভীষণ।
চিন্তাহরণ চক্রবর্তী দেখেছেন, ললিতা দাসী যখন মাথায় কাপড় টেনে নারীর ভূষণজনিত লজ্জায় ম্লান তখন তাঁর গালজোড়া পরিপাটি কামানো।
পুরুষ থেকে নারী হতে লোকচক্ষুর আড়ালে সমাজবাড়ির সখী মা দাড়ি গোঁফ কামিয়ে প্রস্তুতি নিতেন। তারপর সারাদিন ভগবানের সেবা। চলনে বলনে পুরুষ থেকে নারী হয়ে ওঠা এই সাধিকারা যে এখন আর নেই তাও তো নয়।
মিলনগড় আখড়ায় সেবার দোল। সুসজ্জিত প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে আখড়া পার্শ্ববর্তী বিজয় সংঘ ক্লাবের বলখেলার মাঠে। ঘাসজমিতে ফরাস বিছানোর ছোট তদারকিও সামলাচ্ছিলেন মহিয়সী দাসী। মাথার ওপর বিরাট ঝাড়লণ্ঠন, সামনে রাধাকৃষ্ণের মাটির বিগ্রহ। অন্যধারে চৈতন্যদেবের পটচিত্র। এ চিত্র ঝাঁজপিটা মঠের। বড় বাবাজি রাধারমণ দেবের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন ওঁর সেবক ত্রিভঙ্গ দাস বাবাজি। মহিয়সী তখনও মিলনগড়েরই শচীনন্দন বিশ্বাস। তখনই ঘন ঘন নিত্যানন্দ প্রভুর বাড়ি একচক্রা যেতে যেতেই বাবাজির নজরে পড়েন। প্রথম নীলাচলে, ঝাঁজপিটা মঠেই তো আছে নরোত্তম ঠাকুরের সেবিত রাধাকান্ত বিগ্রহ। এই বিগ্রহের সম্মুখেই শচীনন্দন বিশ্বাসকে সখীসাধন দেন ত্রিভঙ্গ বাবাজি। পায়ে আলতা, নাকে বেসর। ভেকদীক্ষা হয় অবশ্য ললিতা সখীর আখড়ায়।
খুব গয়না পরতে ভালোবাসতেন ললিতা সখী। ওঁর ছিল তো আসলে ব্রজগোপীর সাধনা। ঝাঁজপিটাতেই ব্রজগোপী বেশে দীক্ষা হয়েছিল ললিতা সখীর। দীক্ষাগুরু বড় বাবাজি রাধারমণ দেব। পূর্বনাম গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। ঝাঁজপিটায় গুরুসেবার সময় নাম পেলেন ললিতা সখী। ওঁরই গুরুভাই চৈতন্যদাস তখন নিজেকে দাসী মনে করে গোপীভাবে সাধনা করে চলেছেন। এ সাধনা দেখেই অনুপ্রাণিত হন গোপালকৃষ্ণ। গুরু ডাকেন তো জয়গোপাল বলে।
ঝাঁজপিটায় রাতে একদিন সাধনা শুরু হল। জয়গোপাল, রাধাবিনোদ, করুণা, শরৎ ও রঘুনাথ দাস—বড় বাবাজি আশ্রিত এই পাঁচ গুরুভাই তখন ঘরের ভেতরে ভাবতন্ময় দশায় পৌঁছে গেছেন। শরৎ প্রভু রয়েছেন কৃষ্ণাবেশে, রাধাবিনোদ রাধাবেশে, জয়গোপাল ললিতাবেশে রসাস্বাদনে বিভোর হয়ে জ্ঞান হারালেন। সকালে সকলের ঘোর কাটলেও জয়গোপাল ভাবাচ্ছন্ন। গুরুদেবের চরণে পড়ে কাঁদছেন।
জগন্নাথ মন্দির থেকে খবর পেয়ে এলেন শিঙ্গারী পান্ডা। তাঁর উপস্থিতিতে গুরুদেব রাধারমণ বাবাজি জয়গোপালের হাতে তুলে দিলেন রাধারানির কৃপাবস্তু।
পান্ডা বাবাজি বললেন, আপনি জগন্নাথদেবের অন্তরঙ্গা সখী। মন্দিরে কীর্তনের সময়ই আপনার নৃত্যভঙ্গিমা দেখেই সেটা আমি বুঝতে পেরেছি।
গুরুদেব বললেন, এখন থেকে বেশোচিত কার্য চাই।
মহিয়সী মাকে ললিতা সখী বলেছিলেন, রাধারানির শাড়ি তিনি অলৌকিকভাবে পেয়েছিলেন। বড় বাবাজি তখন ঝাঁজপিটায় ভাবাবেশে। এক ভদ্রলোক কোথা থেকে এসে হাতে শাড়ি ধরিয়ে গেলেন। ভাব ভাঙলে গুরুদেব বললেন, রাধারানির কৃপাবস্তু যত্নে রেখো, আনন্দ পাবে। আমার ভাগ্যে হল না, প্রভু তোমাকে কৃপা করলেন।
মহিয়সী দাসী যখন ঝাঁজপিটায়। অনেককাল দেহ রেখেছেন বাবাজি। বড় বাবাজিই ললিতা সখীকে ভেক দিয়েছিলেন, নবদ্বীপে তাঁর আখড়ায় ছিল রাশি রাশি বই ও দুষ্প্রাপ্য সব পুথি। তিনি দেহ রাখার পর সেসব পাটবাড়ির সংগ্রহশালায়। মহিয়সী দাসীর মুখেই শুনেছিলাম, নারীভাবে সাধনায় ললিতা সখীর কেবল গয়না প্রীতির কথা। শাড়ি—ব্লাউজ, কপালে টিপ, পায়ে আলতা, সিঁথিতে সিঁদুর দিতেন ললিতা সখী। তাঁর সারা গায়ে গয়না।
ঝাঁজপিটায় মহিয়সী দাসীর ভেকের দিন ললিতা সখী তাঁর সাধের বেসর খুলে পরিয়ে দিয়ে আশীর্বাদি দিয়েছিলেন। মহিয়সী মা তখন বয়ঃসন্ধির গোড়ায়। ত্রিভঙ্গ বাবাজির মানসকন্যা তিনি। ছোটবেলায় মা—বাবাকে হারিয়ে বড়ই হয়েছেন আখড়ায়। ললিতা সখীর সেই বেসরই এখন সর্বক্ষণ জ্বলজ্বল করে মহিয়সী দাসীর নাকে। তাঁরও গোপীবেশ। মিলনগড়ে তিনি গুরুমা মহিয়সী। আশপাশের গ্রামগুলোও মহিয়সী দাসীর শিষ্যশিষ্যাদেরই বসতি। ঝাঁজপিটাতে দীক্ষার পর চৈতন্যপট তুলে দেন ওঁর হাতে গুরুদেব ত্রিভঙ্গ বাবাজি। তারপর বৃন্দাবন। গোপীশ্বর শিবের ওখানেই পড়ে থাকতেন।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, অত জায়গা থাকতে ব্রজজমির গোপীশ্বরই কেন সাধনপাট নির্বাচন করলেন আপনি?
বললেন, বৃন্দাবন তো সকলেই যায় রে বাবা। গোপীশ্বর যায় ক—জন? কিন্তু ওখানেই আছে কৃষ্ণসাধনার ধারা। গোপীদের মান্যতা। তুমি তো গেছ গোপীশ্বর শিব দর্শনে।
বললাম, হ্যাঁ তো মা। রাসলীলাতেই গোপীদের প্রাধান্যতা। গোপীর ‘গো’টাই সাধনায় বিশ্বপ্রকৃতি। বিশ্বপ্রকৃতিই শ্রীকৃষ্ণকে আপ্যায়িত করছে—আপ্যায়াতি ইতি পী, গোপী।
বললেন, বেশ বেশ। তা ওই আপ্যায়তির দশপ্রাপ্তিটিই যে বৃন্দাবনের গোপীশ্বর শিবে।
উৎসাহিত হয়েই এবার বললাম, সেটা কীরকম মা!
দোলের দিন। কিছুপরই আসরে কীর্তন গাইতে আসবেন নবদ্বীপের প্রবীণা কীর্তনিয়া সরস্বতী দাস। ললিতা সখী ওঁর কীর্তন পর্যন্ত করতেন খুব। তখন সরস্বতী দাসী বালিকা বয়সের ধার পেরিয়ে সদ্য যুবতী।
মহিয়সী দাসী বললেন, নরোত্তম ঠাকুরের গরানহাটি ঘরানা। ঝাঁজপিটায় আমাদেরই গুরু—পরম্পরা। এমনই দোলে ললিতা সখীর আখড়ায় সরস্বতীদি গাইতেন,
স্বেদমরকন্দ বিন্দু বিন্দু গায়,
নরোত্তমদাস করু চামরের বায়।।
ললিতা সখী তখন রাধাকান্তেরই আরতি সারছেন। সে যে দেখবার মতন নিসর্গ।
আজও কিছু পর আরতি শুরু হবে। চামরও উঠবে দুলে। সরস্বতী দাসও গাইবেন নরোত্তম ঠাকুরেরই পদাবলি। সেই প্রস্তুতির ভেতরই মহিয়সী বলতে থাকলেন আমায়, গোপীশ্বরলিঙ্গমূর্তি শিব। ওড়না জড়ানো। শিবের স্ত্রী—বেশ। রাসলীলায় শিব এসেছিলেন চুপিসাড়ে গোপীবেশে। ভগবান চিনতে পেরে বললেন, বৃন্দাবনটাই গোপীসাধনার জায়গা। তাই আজ থেকে দেবাদিদেব আপনিও ব্রজগোপী, গোপীশ্বর।
সরস্বতী দাস গাইছেন,
মুখের মুছাব ঘাম খাওয়াব পান গুয়া।
শ্রমেতে বাতাস দিব এ চন্দন চুয়া।।
মহিয়সী দাসী আরতি করছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই। তিনিও তো ব্রজগোপী। এই আখড়াতেই বসে একদিন বলেছিলেন আমায়, আমরা গোয়ালার মেয়ে। শরীরটা আকারে অবয়বে পুরুষ। ভজন সাধনায় নারীর সকল ভাব ও গুণাবলি এসে গেছে শরীরে। ললিতা সখী তো বলতেন, পথটা ভাবের আর ভক্তির গো। জ্ঞান দিয়ে যুক্তি দিয়ে ভালোবাসা হয় না।
আমি দেখছি ফাগবাহারে শ্রীকৃষ্ণকে ভালোবাসছেন ব্রজগোপী মহিয়সী। পরনে আজ তাঁর পুরুষ শরীরে ভক্তেরই দেওয়া লাল বেনারসি। সিঁথিতেও চওড়া সিঁদুর। এক গা গয়না তাঁর। নাকের বেসর থেকে আলো ঠিকরোচ্ছে। ডান হাতে চামর, বাঁ হাতে ঘোমটা সামলাচ্ছেন। একমাঠ লোকজন, পুরুষ মানুষ। তিনি যে নারী। ব্রজগোপী। নরোত্তম গাইছেন এখন সরস্বতী দাসীকে খানিক থামিয়ে,
শ্যামঘন বরিখয়ে কত রস ধার।
কোরো রঙ্গিনি ধারা বিজুরি সঞ্চার।।
পাটবাড়িতে এই সাধনধারা আর নেই। তবু আছেন মা মহিয়সী। আশি পেরোনো অশক্ত শরীরে তিনি দোলের দিন আসেন মহাপ্রভুর মন্দিরে। গলা সুরে খেলে না। তথাপি পায়ে নূপুর পরে তিনি বসন্ত রাগে শিশু নিমাইয়ের জয়গান করেন।
দোলের পরদিন মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশন। মন্দিরে সকালবেলা বেজে উঠবে বৃন্দাবনী সারং। এমনই তিথিদিনে আমি সেবার নবদ্বীপে। মহাপ্রভুর মন্দির থেকে বেরিয়ে যাব সমাজবাড়ি। সঙ্গে আমার পুরুষ থেকে নারী হয়ে ওঠা রাধারমণ বাবাজির সাধনধারার সাধিকা মা মহিয়সী।
বললাম যেতে যেতে, এই সাধনার মানেটা কী মা?
বললেন, মঞ্জরী ভাব প্রচ্ছন্ন ভাব, গোপন ভাব। বিদ্যার অহং খসিয়ে পুরুষের পৌরুষ সরিয়ে নারী হয়ে আত্মবৎ সেবা। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হবে। নিজের স্বরূপ, অহঙ্কার যেন না বেরোয়। জীবনেও এই সাধনা বড়। যেটুকু তুমি, যা তুমি, তোমার বিদ্যা শিক্ষা সব গোপন করো।
রং দোলের আবির গোটা নবদ্বীপে। তারই ভেতরে আমি কেবল দেখছি গোপনীয়তার রং। বিদ্যা শিক্ষার অহং সরিয়ে এক পুরুষ তাঁর শরীরে নারীর প্লাবন ধরে রেখেছেন এই একুশ শতকের চূড়ান্ত ভোগবাদের ভেতরে। আমরা তখন হাঁটছি সমাজবাড়ির পথে। হাওয়া দিচ্ছে বসন্তের। তারই ভেতর দূরে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে বসন্ত রাগের কীর্তন। দোলের নবদ্বীপের এটাও এক বৈশিষ্ট্য।
মায়ের চঞ্চলা সখী, নহাটা
প্রখর চৈত্রের দিনেও তো বুক শুকোয় না চৈতীর। নিদাঘ দহনবেলাতেও সে এক বুক কাজল কালো জল নিয়ে তিরতির করেই বইতে থাকে। জায়গাটা বনগাঁ ও গাইঘাটার মাঝামাঝি। বৈকারা ন’হাটার রাস্তা ধরে অনেকখানি তো হাঁটতে হয়। তবেই শ্মশানখানা পড়ে।
ন—হাটার এক সাধুর মেলায় গিয়েছিলাম সেবার। গিয়ে দেখি ভিক্ষাজীবী লাল ময়লা কৌপিনের দল। সেই দলে সাধু খুঁজব কীভাবে! গাঁয়ের গোঁসাইপানা এক লোক বোধহয় আমার এই সন্ধানের খোঁজটা ধরতে পেরেছিলেন। প্রাচীন চোখ।
এসে খানিক আলগা কথার পর বললেন, আপনি নিশ্চয় সাধু খুঁজছেন? এখানে তা আর পাবেন না।
বললাম, সাধুসন্ত এ মেলায় আর আগের মতো আসেন না?
ভগার ঘরে মস্ত চুরি কর্তা। ভগার দেওয়া পঞ্চইন্দ্রিয় নস্যাৎ করতে পারলে তো মানুষ সাধু হয়। সে আর ক—জন পারে। যারা পারে তারা আর কর্তা মেলাখেলায় বড় একটা আসে না। নির্জনের খিদে—তেষ্টা কি আর মেলার হাঁ—এ এলে মেটে? মেলা যে তাদের গিলি নিতি চায়। তাই তারা আর বড় একটা এধারে আসে না। তবে তেমন মনুষ্যর ডেরা এখানে একটা আছে। আপনি চাইলে আমি পথ দেখাতে পারি।
সেই দেখানো পথ ধরেই আমি এখন মাতাজির আস্তানায়। কাঁচা রাস্তা ভেঙে শ্মশান লাগোয়া মাতাজির ডেরা। টিনের চাল দেওয়া ইটের গাঁথনি। পলেস্তারাহীন দেওয়ালেই এক মস্ত ফলক। সেখানে গোটা গোটা হরফে আদ্যাস্তোত্র লেখা।
যখন পৌঁছালাম মায়ের আশ্রমে, সান্ধ্য আরতির জোগাড় চলছিল। দাহকাজ শেষ করে কিছু স্বজনহারা মানুষ চৈতীস্নানে রত। তাঁদের একজনকে মাতাজির হদিশ জিজ্ঞেসা করতেই বললেন, ঘরে যান। দেখুন ধ্যানমগ্না হয়েই আছেন। ঘর ছেড়ে বেরোন না তিনি।
গিয়ে পৌঁছালাম মাতাজির দরবারে। দেখলাম তিনি বসে। প্রথাগত ভৈরবীর ভেকও নয় তাঁর। চুলে জটার গন্ধ নেই। ফুরফুরে একঢাল চুল যেন দখিনা বাতাস লাগার অপেক্ষায়।
ঘরটি তাঁর পরিপাটি গোছানো। কোনও আসবাব তবে নেই। নেই কোনও তক্তপোশ। কম্বলের আসনে বসে তিনি। ঘরের ভেতরই মায়ের যন্ত্র। নানা আবিরে রংদার। ওপরে চাঁদোয়া খাটানো। অথচ এখানে মায়ের কোনও মূর্তিই নেই। মাতাজির পরনের লালটুকু জানান দিচ্ছে তন্ত্রমতের সাধিকা তিনি।
বললেন, আমাদের সখী সাধনের মত।
বললাম, আপনি তন্ত্রমতের নয়?
বললেন, মহাকাল নিষ্ক্রিয়, নিশ্চল, নিঃশব্দ।
বললাম, শক্তি তো চঞ্চলা।
সেই চঞ্চলারই সখী আমরা। সাধিকা নই। তাঁকে আমরা ইন্দ্রিয়শাসনে ধরি না। ধরি ভাবে।
আপনাদের পঞ্চমকার নেই?
শাক্তমতের তান্ত্রিক সাধনের পঞ্চমকার আমাদের নেই। স্থূল মদ, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন আমাদের নয়। আমাদের পঞ্চমকার সূক্ষ্মের।
জিজ্ঞেসা করলাম, আপনারা কি বৈষ্ণবীয় মতে মায়ের উপাসনা করেন?
বললেন, আমাদের উপাসনা নেই। বন্ধুত্ব আছে। মায়ের সখী আমরা। সই। মা আমাদের মূর্তিময়ী নন। তাঁর রূপ নেই, বর্ণ নেই।
কালকে হরণ করেছেন বলেই তিনি কালী।
বললাম, ঠিক বুঝলাম না আমি আপনাদের মত।
গুরু বলতেন আদ্যাশক্তি দর্শনের অযোগ্যা। বর্ণের আকারে তিনি দৃষ্টিযোগ্যা নন। সেজন্যই তিনি অন্ধকার। কালী। আদ্যাশক্তি।
এ তো আমাদের আদি মতেরই মা। অদৃশ্য ধারণা থেকেই তো মায়ের মূর্তিময় দেখাটি এসেছে।
বললেন, সে রূপে মা উগ্রা। মা কি কখনও উগ্রা হতে পারেন? অন্ধকার বলেই তাঁর কোনও সত্ত্ব, রজো, তমো নেই। গুণ এলেই তবে পাশের প্রশ্ন। সেখান থেকেই আসে ইন্দ্রিয়সাধনা। আমাদের পাশ নেই। পাশহীন সাধনা। সত্ত্ব, রজো, তমোর বাইরে যে অন্ধকার শক্তি তাকেই আমরা আপন করি। ভাব জমাই। সখী করি। গুরু আমাকে সখী সাধনা শিখিয়ে গেছেন। মা সেখানে আনন্দ।
বললাম, সেই তো আপনি প্রকৃতি—পুরুষ যোগে এলেন?
বললেন, আদ্যাশক্তি কালী কেন জানেন?
কেন?
আদ্যার উদ্ভবেই কালের উদ্ভব। কালের জননী বলেই তো মা আমার কালী। গায়ের রং কালো বলে তিনি কালী নন।
সে তো জানি, অন্ধকারের রং তো কালো বই আর কিছু হতে পারে না।
আসলে কী জানেন, আদ্যার রূপ দিয়েছি আমরা। কৃষ্ণবর্ণা, নীলবর্ণা, শ্বেতবর্ণা, শ্যামবর্ণা করেছি। বলতে পারেন কেন তাঁকে লাল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি করিনি?
মাতাজির এই প্রশ্ন, ভাবনা, কথা বলবার ধরনই বলে দিচ্ছে কোনও সামান্য সাধিকা তিনি নন। গুরুকুল আছে তাঁর। এবং সেটা রীতিমতো শাস্ত্রীয়। তিনি নিজেও কেবল নিরক্ষর লোকায়ত ভাবের সাধিকা নন।
বললাম, আপনিই বলুন মা কেন মূর্তিতে লাল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি নন? আপনার কথা শুনব বলেই তো এসেছি।
বললেন, আপনি যুক্তি শুনতে চান। ভাবকে তাই দূরে রেখে যুক্তিতে যাওয়াই সংগত।
কী করে বুঝলেন, আমি যুক্তিমতে আগ্রহী?
সামান্য হাসলেন মাতাজি। হাসলে তাঁর ফরসা গালে টোল পড়ে।
বললেন, বিশ বছর ধরে একা এভাবে পড়ে আছি। খোঁজ পেয়ে মানুষ আসেন যান। কেউ ভক্ত। কেউ বিপন্ন। কেউ বা জিজ্ঞেসু। এই ভেদ বুঝব না বলছেন!
না না তা আমি বলতে চাইনি।
এটা জানবেন তন্ত্র হল করণ। ভাব হল স্থাপন। দুয়ের পার্থক্য অনেক। তান্ত্রিক মাকে পেতে চান ইন্দ্রিয়শক্তিকে পরাস্ত করে। আমাদের ঘরে ইন্দ্রিয়কে আমরা ভাবে নিয়ে যাই। ইন্দ্রিয়কে বশ করি না আমরা। বন্ধুত্ব করি। মিতালি পাতাই।
বললাম, মা কেন লাল—সবুজ—হলুদ নন, আপনার মতটা যদি বলেন?
বললেন, বলব বলব। যুক্তি আপনাকে জাগিয়ে রাখে। যুক্তির খোঁজে আপনি সাধনপথে ঘোরাঘুরি করেন সে তো আমি জানি। যা বলব তা আপনি নিজেই সাজিয়ে নিতে পারেন আপনার জ্ঞানবুদ্ধির ভেদহীনতায়। সেখানে আপনি অভেদ।
বললাম, তবু বলুন না শুনি।
আদ্যা কাল। কালী। তাঁর বর্ণে যুক্তিমতে কালো রূপান্তরিত হতে পারে নীল তারায়, শ্যামায়। এর বেশি যুক্তিবোধ যাবে না যে। তাই মা লাল—সবুজ—হলুদ নন। ভাবে মা সবই হতে পারেন। সেই ভাব দিয়েই আমরা মাকে দেখি, বুঝলেন।
জিজ্ঞেসা করলাম, আপনাদের মতের ভক্তশিষ্যর সংখ্যা কেমন?
বললেন, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। এ পথ একক সাধনের। আমার গুরুর মানসকন্যা আমি। আমার কিছু ভক্তশিষ্য আছে। তাঁদের আমি নিরাকারের মত দিই। ব্রহ্মজ্ঞান সহজ ব্যাপার নয়। হৃদয়কে শাস্ত্র করতে পারলে তার ভাবের জ্ঞান সেখানে লেখা যায়। একা সাধক সেটা দেখতে পারেন। অন্য কারও দেখবার দরকার নেই। গুহ্য সাধনা গোপন করতেই বলে। মাকে আমি গোপন করে একা ভাবে মজি। বন্ধুত্বে। তা আমার জনে জনে প্রচারের দরকার কী?
আমি দেখলাম সখী সাধিকা এবার চোখ বন্ধ করে নিলেন। বুকের ওপর মেলে ধরলেন এরপর জোড়হাত। আমার যাওয়ার ইশারা।