উপন্যাস
গল্প

সেই একলা নীল মানুষ

সেই একলা নীল মানুষ

[রণজয় নামে একটি ছেলে তাদের গ্রামের নদীতে একদিন সকালবেলা একটা গোল ধাতুর বল ভাসতে দেখে। সেটা সে ছোঁয়ার পর থেকেই তার চেহারার বদল হতে থাকে। তার গায়ের রং হয়ে যায় কলমের কালির মতন নীল আর সে লম্বা হতে হতে প্রায় সাড়ে সাত ফুট হয়ে যায়। তখন গ্রামের সব লোক, এমনকী তার মা বাবাও তাকে দৈত্য ভেবে ভয় পায়। কিন্তু তার মনটা রয়ে গেছে ঠিক আগেরই মতন। এরপর তাকে একদিন ধরে নিয়ে যায় অন্য গ্রহের নীল মানুষরা। সেই অদ্ভুত গ্রহে কিছুদিন থাকবার পর সে একদিন কোনও ক্রমে সেখান থেকে পালায়। কিন্তু রণজয় রকেট চালাতে জানে না, ওই রকেট চালাচ্ছিল একটা পুতুল-মেয়ে। রণজয়। আর একটা গ্রহ দেখে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। কিন্তু সেটা আরও বিপজ্জনক। সেখান থেকেও সে অতি কষ্টে পালিয়ে আবার রকেটে চেপে বসেছে। কিন্তু পুতুল-মেয়েটিরও দম ফুরিয়ে গেছে। এখন চলন্ত রকেটে রণজয় একদম একা। তারপর–।]

রণজয় মেয়ে-পুতুলটিকে দু-একবার উলটেপালটে দেখল। তার ধারণা, স্প্রিং-এর মপুতুলের মতন এরও নিশ্চয়ই গায়ে কোথাও চাবিটাবি আছে। দম দিয়ে দিলেই আবার চলবে। কিন্তু এ তো সাধারণ পুতুল নয়, এ হচ্ছে রোবোয় দারুণ সূক্ষ্ম এর যন্ত্রপাতি। ওকে ঠিক করার সাধ্য রণজয়ের নেই।

শুয়ে থাকা পুতুলটিকে অবিকল একটা মেয়েরই মতন দেখতে। ওর জন্য খুব দুঃখ হল রণজয়ের। পুতুলটি কথা বলতে পারত না বটে কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে তাকাত, হাসত আর মাঝে-মাঝে ওর গা থেকে টুং-টাং শব্দ হত, তবু মনে হত, একজন কেউ সঙ্গে আছে।

কিন্তু এখন রণজয় একদম একা।

রকেটটা কত মাইল গতিতে যাচ্ছে রণজয় জানে না। মহাকাশে মহাশূন্যে কোথাও কিছু দেখা দেয় না। মাঝে-মাঝে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা একেবারে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। তখন রণজয়ের ভয় হয় যে হঠাৎ কোনও গ্রহতে ধাক্কা লাগলে একেবারে সবসুদ্ধ ছাতু হয়ে যাবে। কিন্তু রণজয়ের কিছু করবারও তো নেই। সে দু-একবার রকেটটার নানান বোম টিপে দেখেছে, কিন্তু তাতে ডাইনে বাঁয়ে বেঁকে না। এই রকেটটা যেন সোজাই চলতে জানে শুধু।

অন্ধকার কেটে গিয়ে মাঝে-মাঝে আলোর মধ্যেও এসে পড়ে রকেটটা। আমরা যে আলো চিনি, শুধু সেই আলো নয়, কত রকমের অদ্ভুত আলো। কমলা-বেগুনি-নীল সবুজ রঙের আলো।

মাঝে-মাঝে খুব দূরে একটা কোনও জ্বলজ্বলে নক্ষত্র বা উল্কাও সে দেখতে পায়, কিন্তু সেদিকে সে তো ইচ্ছে করলেও যেতে পারবে না।

রকেটটাই বা এরকমভাবে কতদিন চলবে? এক সময় নিশ্চয়ই জ্বালানি ফুরিয়ে যাবে। তখন কী হবে? রণজয় আর ভাবতে পারে না।

রণজয়ের খিদে পেয়েছে। বেঁচে থাকতে হলে তো কিছু খেতে হবেই।

রণজয় চালকের আসন ছেড়ে উঠে সারা রকেটটা ঘুরে দেখতে গেল।

রকেটটা বেশ ছোট। ইঞ্জিনের যন্ত্রপাতিই বেশি। তা ছাড়া আছে একটি মাত্র ঘর, আর একটা বাথরুম। খাবার জিনিস রাখবার কোনও ব্যবস্থাই নেই।

তখন রণজয়ের মনে পড়ল এটা আকাশে-ওড়া পরীক্ষার রকেট। মানুষ নেবার কথা নয়। সারি-সারি এরকম অনেক-অনেক ছোট রকেট সাজানো ছিল নীল মানুষদের গ্রহে, প্রত্যেকটিতেই একটা করে পুতুল-মেয়ে। রণজয় সেই রকমই একটা রকেট চুরি করে পালিয়েছে।

আকাশে-ওড়া পরীক্ষার রকেট বলেই এতে কোনও খাবার রাখা নেই। রোবো পুতুলগুলোর আরও কম। তাহলে জ্বালানিও তো বেশি থাকবার কথা নয়, তবু রকেটটা দিনের পর দিন চলছে কী করে?

কিন্তু মানুষ, সব সময়ই বাঁচতে চায়। রণজয় ভাবল, না খেয়েও তো মানুষ অনেকদিন বাঁচতে পারে। শহীদ যতীন দাস জেলখানার মধ্যে বাষট্টি দিন না তেষট্টি দিন যেন অনশনে ছিলেন। তার মধ্যে একটা কিছু নিশ্চয়ই ঘটে যাবে। তবে রণজয় কি অতদিন পারবে? এর মধ্যেই তার পেটে খিদের আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে।

কিছুই করবার নেই বলে রণজয় নিরাশভাবে চোখ বুজে বসে রইল। একটু বাদেই ঘুম এসে গেল তার।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে জানে না, হঠাৎ একটা কর্কশ শব্দে তার ঘুম ভাঙতেই সে চমকে লাফিয়ে উঠল।

কোথা থেকে এল আওয়াজ। এই মহাশূন্যে তো কোনওরকম শব্দ নেই। এমনকী রকেটের শব্দও ভেতরে বসে শোনা যায় না। চারদিকের স্বচ্ছ কাঁচের জানলায় রণজয় ঘুরে-ঘুরে দেখে এল। কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু অসীম শূন্য। তবে এ জায়গাটা অন্ধকার নয়, পাতলা নীল আলো ছড়িয়ে আছে।

তখন রণজয় ভাবল, তাহলে নিশ্চয়ই সে স্বপ্ন দেখেছে। এই কথা ভাবতে না ভাবতেই আবার সে শুনতে পেল সেইরকম শব্দ। দুর্বোধ্য ভাষায় কে যেন তাকে ধমকে কিছু বলছে।

এবারে সে লক্ষ করল, ইঞ্জিন ঘরের ওপর দিকে একটা জাল ঢাকা দেওয়া গোল গর্ত। আওয়াজটা আসছে সেখান থেকে। ওটা নিশ্চয়ই খবর পাঠাবার যন্ত্র। বহু দুর থেকে কেউ তাকে ডাকছে?

কিন্তু একটা অক্ষরও যে বোঝবার উপায় নেই। এমনকী মানুষের গলার আওয়াজ কিনা তাও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। টিয়াপাখি মানুষের মতন কথা বলতে শিখলে যেমন হয়, অনেকটা যেন সেইরকম শোনাচ্ছে।

বসবার জায়গাটার ওপর দাঁড়াতেই রণজয়ের মুখ সেই গোল গর্তটার কাছে পৌঁছে গেল।

সে বাংলাতেই চেঁচিয়ে বলল, তোমরা কে? কোথা থেকে কথা বলছ? আমি তোমাদের কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না।

নিশ্চয়ই রণজয়ের কথা ওরা শুনতে পেয়েছে, কেন না তক্ষুনি আরও এক গাদা কাঁকোম্যাকো-ট্যাকো ধরনের শব্দ ভেসে এল।

রণজয় বলল, আমি পৃথিবীর মানুষ। আমি শুধু বাংলা ভাষা জানি। আর একটু একটু ইংরিজি। তোমরা কী পৃথিবীর নাম শুনেছ?

আবার ভেসে এল সেই কাকো-ম্যাকো-ট্যাকো।

রণজয় বলল, দূর ছাই! এদের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই।

তখন সেও ওদের নকল করে কাঁকোম্যাকো-ট্যাকো ধরনের শব্দ করতে লাগল।

তাতেই ওদিককার শব্দ থেমে গেল হঠাৎ।

তারপর অনেকক্ষণ আবার চুপচাপ। রণজয় গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল, কারা এরকম ভাবে কথা বলছিল তার সঙ্গে। কত দূরে তারা আছে। জানলার দিকেও সে চোখ রেখেছে, যদি কিছু দেখা যায়।

যদি রণজয়ের মন ভালো থাকত, যদি খাবার-দাবারের কোনও অভাব না থাকত, যদি বাড়ি ফিরে যাবার সবরকম সুবিধে থাকত, তাহলে এইরকম সময়ে বাইরের দৃশ্য দেখতেও খুব ভালো লাগত তার।

খুব নরম নীল আলো ছড়িয়ে আছে বাইরে। তার মধ্যে এখন কোথা থেকে উড়ে আসছে কমলা রঙের থোকা থোকা মেঘ। দূরে দেখা যাচ্ছে দুটো তারা, ঠিক হীরের মতন ঝকঝকে।

সেই তারা দুটো ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। আরও একটু বাদে বোঝ গেল, সে দুটো তারা নয়, দুটো উজ্জ্বল রকেট।

রণজয়ের মনে হল, ওরা নিশ্চয়ই তাকে তাড়া করে আসছে। ওরাই তা হলে কাঁকে-ম্যাকো-ট্যাকো করেছিল।

রণজয় মরিয়া হয়ে এলোপাথাড়ি ভাবে বোতাম টিপতে লাগল। যদি রকেটের মুখ অন্য দিকে ঘোরানো যায়। কিন্তু কোনই লাভ হল না। কমপিউটারে বারবার লাল আলো জ্বলতে লাগল।

ওই রকেটে কীরকমের প্রাণী আছে কে জানে? হয়ত তারা খুবই হিংস্র। লড়াই করবার মতন কোনও অস্ত্রও নেই রণজয়ের কাছে। বাবা-মা তার নাম রেখেছিলেন রণজয়, কিন্তু এরকম যুদ্ধে সে কী করে জিতবে?

রকেট দুটো আর একটু সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেল রণজয়ের রকেটের কাছে। ওদের রকেট অনেক বড়। ওদের দুটো চলে গেল দু-পাশে। তারপর চলতে লাগল সমান গতিতে।

রণজয় ভাবল, ওরা কি তাকে বন্দি করবে, না দূর থেকে একটা অস্ত্র ছুঁড়ে পুরো রকেটটাই ধ্বংস করে দেবে। চলন্ত রকেট থেকে তাকে বন্দি করবে কী করে? কাছাকাছি এলেই তো ধাক্কা লাগবৈ।

তারপর রণজয় দেখল, ডান দিকের রকেটটা থেকে একটা সুতো ছুটে আসছে তার দিকে। ঠিক গুলিসুতোর মতন পাতলা, আসছে একেবারে সোজা। সেই সুতোটা তার রকেটে লাগতেই তার রকেটের গতি কমতে লাগল। একটু বাদে একদমই থেমে গেল।

রণজয় যাকে পাতলা গুলিসুতো ভেবেছে, তা আসলে চুম্বক-আলো। এই চুম্বক আলো দিয়ে যেকোনও গতিশীল জিনিসকে থামিয়ে দেওয়া যায়। এই চুম্বক-আলোর ব্যবহার পৃথিবীর মানুষ জানে না।

তারপর লাটাই গুটিয়ে যেরকম ঘুড়ি নামান হয়, সেইরকম ভাবেই সেই আলোর সুতো টেনে-টেনে রণজয়ের রকেটটা কাছে নিয়ে গেল ওরা।

এখন ওদের হাতে ধরা দেবার বদলে আর একটাই মাত্র পথ খোলা আছে। রকেটের দরজা খুলে রণজয় মহাশূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। কঁপানো মাত্রই অবশ্য সে মরে গিয়ে তার শরীরটা একটা শক্ত পাথরের টুকরোর মতন হয়ে যাবে। সেই অবস্থায় অনন্তকাল ধরে ঘুরবে।

দেখাই যাক না কী হয়, এই ভেবে রণজয় দাঁড়িয়ে রইল দরজার কাছে।

দরজা কিন্তু তক্ষুনি খুলল না। রণজয়ের রকেটটা পুরোই ঢুকে গেল অন্য রকেটটার পেটের মধ্যে। একটা বিরাট তিমি মাছ যেমন অন্য মাছ খেয়ে ফেলে, সেইরকম বড় রকেটটা খেয়ে ফেলল ছোট রকেটটাকে। তারপর আপনা-আপনিই দরজা খুলে গেল।

মাত্র সাত জন প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। তাদের মানুষ বলা যায়, না ও বলা যায়। উচ্চতায় তারা তিন-চার ফুট মাত্র, তাদের পা-গুলো খুব সরু সরু, পায়ের পাতা নেই বললেই চলে, পাখির মতন শুধু পাঁচটা আঙুল রয়েছে। শরীরও রোগা, হাতগুলো ছোট-ছোট কিন্তু হাতের মুঠো বেশ বড়। মুখগুলো মানুষের মতন হলেও চোখগুলো অস্বাভাবিক বড়। কারুরই মাথায় চুল নেই। সবাই পরে আছে অয়েল ক্লথের মতন জিনিসের চকচকে পোশাক। প্রত্যেকের হাতে একটা করে পিচকিরির মতন অস্ত্র।

কেউ কিছু কথা বলার আগেই ওদের একজন পিচকিরি থেকে খানিকটা আলো ছুঁড়ল, তাতেই ইলেকট্রিক শক্ খাবার মতন যন্ত্রণায় লাফিয়ে উঠল রণজয়। তার মাথা ঠুকে গেল নিজেরই রকেটের ছাদে।

রণজয় বুঝল, ওরা প্রথমেই তাকে জানিয়ে দিতে চায়, ওদের কাছে কীরকম অস্ত্র আছে। কিংবা এটা খুবই সাধারণ। এর চেয়েও অনেক ভয়ংকর কিছু আছে ওদের কাছে।

সে হাত দুটো সামনে এগিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে এক-পা-এক পা করে নেমে এল নিচে।

তখন আর দুজন কাকুম-সাকুম-মাকুম ট্যাকো-ম্যাকো বলে বকুনি দিয়ে আবার আলো ছুঁড়ল রণজয়ের দিকে।

রণজয় এবার যন্ত্রণায় ডিগবাজি খেতে লাগল। মনে হল যেন তার শরীরের সমস্ত হাড় ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাবে। এরপর সবাই মিলে একসঙ্গে আলো ছুঁড়লে রণজয় সঙ্গে সঙ্গে মরে যাবে।

রণজয় ছেলেটি আসলে খুব গোঁয়ার। খুব রেগে গেলে তার আর ভালো-মন্দ জ্ঞান থাকে না। আর এইটুকু-এইটুকু বাচ্চা-বাচ্চা বেঁটে-বেঁটে মানুষরা তাকে কষ্ট দেবে, এই অপমান সহ্য করে বেঁচে থেকে লাভ কী! তবু ওরা জানুক, পৃথিবীর মানুষ বীরের মতন লড়াই করে মরতে জানে।

উঠে দাঁড়িয়েই সে একসঙ্গে লাথি আর ঘুষি চালাল। তিন-চারজন তাতেই ধরাশায়ী হয়ে গেল একেবারে। যদিও রণজয়ের মতন অত বড় চেহারার মানুষের হাতে মার খেয়েও তারা মরে গেল না কিন্তু। কোনও ব্যথার শব্দও করল না। অন্য কজন রণজয়ের পিচকিরির আলো ছোঁড়ার চেষ্টা করতেই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগল রণজয়। সে নিজেও দুটো পিচকিরি কেড়ে নিয়ে ওদের দিকে আলো ছুঁড়ছে আর লাথিও চালাচ্ছে। এক-একবার রণজয়ের গায়েও লেগে যাচ্ছে সেই আলো। কিন্তু সে অনবরত লাফাচ্ছে বলে পুরোটা লাগছে না।

এইরকম লড়াই চলল বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু খুদে মানুষরা কেউ মরছে না। এমনকী রণজয় ওদের এক একজনকে চ্যাংদোলা করে তুলে প্রাণপণ শক্তিতে ছুঁড়ে মারছে দেয়ালে, তবু ওদের মাথা ভাঙছে না, শরীরের কোথাও কেটে রক্তও পড়ছে না।

রণজয় বুঝতে পারল, এই লড়াইতে তাকেই হেরে যেতে হবে। এর মধ্যেই সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

এই সময় সেই রকেটের অন্য দিকের একটা দরজা খুলে গেল। তারপর শোনা গেল একটা তীব্র বাঁশির সুর। একই রকমের কয়েকজন খুদে মানুষ এসে ঢুকল প্রথমে। কিন্তু কে যে বাঁশি বাজাচ্ছে তা বোঝা গেল না। এরা অন্য রকেটটা থেকে এসে পড়েছে বুঝতে পেরে রণজয় লড়াই থামিয়ে থমকে দাঁড়াল। আর কোনও আশা নেই!

সেই দ্বিতীয় দলের পেছনে-পেছনে এল একটি মেয়ে, সে এদের চেয়ে অনেক লম্বা। প্রায় মানুষের কাছাকাছি, তবে এরও চোখ অস্বাভাবিক বড়।

তার হাতে কোনও বাঁশি নেই, সে মুখ দিয়ে একটা শব্দ করছে, সেটাই বাঁশির মতন শোনাচ্ছে।

রণজয়কে দেখে সে অস্বাভাবিক চমকে উঠল। তার বড় চোখ দুটি আরও বিস্ফারিত হয়ে গেল। সেটা ভয়ে না রাগে তা বুঝতে পারল না রণজয়।

সে খুব দ্রুত চিন্তা করল, এই মেয়েটি নিশ্চয়ই এদের রানি। পিঁপড়েদের দলে যেমন একজন করে রানি থাকে, তার চেহারা অনেক বড় হয়, এদেরও নিশ্চয়ই সেইরকম।

বাঁশির শব্দ থামিয়ে মেয়েটি অন্যরকম একটা অদ্ভুত চিৎকার করতেই খুদে মানুষরা সবাই বসে পড়ল মাটিতে। অস্ত্র পাশে নামিয়ে রাখল।

মেয়েটিও মাটিতে বসে পড়ে খুব মিষ্টি গলায় কী যেন বলল রণজয়কে। কিন্তু সে এক বর্ণও বুঝল না।

রণজয় এক হাত নেড়ে জানাল সে ওদের ভাষা জানে না।

রণজয়ের হাত নাড়া দেখেই মেয়েটি মেঝেতে মাথা ঠেকাল, তার দেখাদেখি অন্য আর সবাই। তারপর সেই রানি মাথা তুলে তার একজন অনুচরকে কী যেন হুকুম করল।

সেই খুদে মানুষটি ছুটে গেল রকেটের ভেতরের দিকে। দুটো রুপোলি গোল বল নিয়ে ফিরে এল। একটা দিল তাদের রানির হাতে। আর একটা নিয়ে এল রণজয়ের দিকে।

রণজয় প্রথমে বলটা নিতে দ্বিধা করল। একবার অন্য গ্রহের একটা বল ছুঁয়েই তো তার এই অবস্থা। আবার এই বলটা ছুঁলে কী হয় কে জানে? যদি তার চেহারা এই মজার খুদে মানুষদের মতন হয়ে যায়? না, না, তা সে কিছুতেই চায় না।

সে হাত নেড়ে বলল, চাই না, চাই না!

তখন ওদের রানি সেই বলটা মুখের কাছে নিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলল, হে নীলদেবতা, আপনি এই জিনিসটা মুখের কাছে ধরলেই আপনার ভাষা আমরা বুঝতে পারব, আপনিও আমাদের ভাষা বুঝতে পারবেন।

বাংলা কথা শুনে এমনই চমকে গেল রণজয় যে সে আর কোনও দ্বিধা না করেই টপ করে তুলে নিল বলটা। কতকাল পরে সে বাংলা শুনল। কী অদ্ভুত যন্ত্র বানিয়েছে এরা। এর থেকে শব্দতরঙ্গ বেরিয়ে অন্য লোকের গায়ে ধাক্কা মারলেই তা সঙ্গে-সঙ্গে অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে।

রণজয় বলল, আপনারা কে? আমাকে বন্দি করতে চান কেন?

আশ্চর্য, রণজয় কিন্তু নিজের বাংলা কথাটা শুনতে পেল না। সেটা হয়ে গেল ওদের ভাষা।

রানি বলল, আপনাকে বন্দি করব? সে কী? আপনি তো আমাদের দেবতা। আপনার দেখা যে আজ পেয়েছি, সে আমাদের পরম সৌভাগ্য।

রণজয় বলল, আমি দেবতা? না, না, তোমাদের ভুল হয়েছে। আমি পৃথিবী গ্রহের সামান্য একজন মানুষ!

রানি বলল, কেন আমাদের ছলনা করছেন প্রভু? আমাদের প্রাচীন ইতিহাসে আছে, একদিন আমরা এই মহাশূন্যে আমাদের দেবতাকে খুঁজে পাব। তিনি উচ্চতায় আমাদের দ্বিগুণ। তার গায়ের রং মহাশূন্যের মধ্যে নীল, তার মাথায় চুল আছে। তার দেখা পেলে আমরা হব এখানকার গ্রহমণ্ডলীর শ্রেষ্ঠ জাতি। চলুন প্রভু, আমাদের গ্রহে চলুন, আপনাকে। আমরা সব কিছু দিয়ে সেবা করব।

রানির কথা শেষ হওয়া মাত্রই সব খুদে মানুষরা হইহই করে উঠে রণজয়কে ঘিরে নাচতে লাগল।

রণজয়ের একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা। কোথায় সে এক্ষুনি মরতে বসেছিল, তার বদলে হয়ে গেল দেবতা? যা বাবাঃ! সবাই তাকে অনেক রকম খাবার এনে দিল আর তাকে ঘিরে-ঘিরে কী সব গান গাইতে লাগল।

এইরকম ভাবে কতক্ষণ কাটল কে জানে? রণজয় এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর রানি তার কাছে এসে বলল, হে দেবতা, দেখুন, ওই আমাদের গ্রহ।

রণজয় জানলা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখল, এদের গ্রহটি বেশ সুন্দর। অসংখা পাহাড় দেখা যায় আর হাল্কা কমলা রঙের মেঘ। গাছপালা অবশ্য চোখে পড়ল না।

রণজয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীতে তো আর ফেরা হবে না। তা হলে এই অচেনা গ্রহেই দেবতা কিংবা রাজা সেজে থাকা যাক। খাতির-যত্ন তো পাওয়া যাবে।

কিন্তু এই সুখভোগ রণজয়ের ভাগ্যে সইল না।

খুদে মানুষদের গ্রহে নেমে সে সবে মাত্র কয়েক পা হেঁটেছে, অমনি তার দম আটকে আসতে লাগল। যেন সে এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। এখানকার বাতাস দারুণ ভারী।

বিদ্যুৎ চমকের মতন তার মনে পড়ল, এই গ্রহে গাছ নেই। এই গ্রহের হাওয়া মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। যতই দৈত্যের মতন চেহারা হোক, সে আসলে মানুষ, অক্সিজেন ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না।

হাঁপাতে-হাঁপাতে সে রানিকে বলল, আমাকে এক্ষুনি একবার যেতে হবে। আমার গ্রহ থেকে একটা যন্ত্র না আনলে আমি শ্বাস নিতে পারব না। তোমার কয়েকজন লোককে দাও আমার সঙ্গে। আমি রকেটে করে ঘুরে আসছি। আমার জন্য চিন্তা করো না, সময় হলে আমি ঠিক ফিরে আসব।

আর সময় নষ্ট করার উপায় নেই, রণজয় টলতে টলতে উঠে পড়ল রকেটে। রানি তক্ষুনি সব ব্যবস্থা করে দিল।

খুদে মানুষরা যদিও পৃথিবীর নামও শোনেনি, তবে সূর্য নামে একটা ছোট্ট তারার কথা তারা জানে। সেই হিসেবে খুঁজে-খুঁজে ওরা একদিন পৌঁছাল পৃথিবীতে। সন্ধের দিকে একটা পৃথিবীতে নামল রকেট।

রণজয় ভাবছে, এখন এই খুদে মানুষদের সে কী বলবে? তার পক্ষে তো আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়, ওখানে ও একদিনও বাঁচবে না। এরা তাকে দেবতা ভেবে, কিন্তু সে দেবতার মতন অমর তো নয়।

সমস্যার সমাধান সহজেই হয়ে গেল।

খুদে মানুষরা রণজয়ের সঙ্গে রকেট থেকে নামতেই ছটফট করতে শুরু করে। দিল। পৃথিবীর বাতাস আবার তাদের একেবারেই সহ্য হয় না। ঠিক কাটা পাঁঠার মতন ধড়ফড় করতে লাগল তারা মাটিতে পড়ে।

রণজয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ওদের কোলে করে করে তুলে দিল রকেটে। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, তোমরা চলে যাও। আমার সময় হলে আমি যাব। তোমাদের ভালো হোক। তারপর রকেটটা উড়ে যেতেই রণজয় পৃথিবীর প্রতি প্রণাম জানিয়ে কাঁদো কাঁদো ভাবে বলল, মা, তুমিই আমার সবচেয়ে ভালো। তোমায় ছেড়ে আমি আর কোথাও যাব না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *